
একসময় বলা হয়েছিল আবাসিক এলাকার মধ্যে কোনো রাসায়নিক গুদাম থাকবে না। অনেক দুর্ঘটনার পর, পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকা থেকে সেই আস্তানা সরিয়ে নেওয়া হয় কেরানীগঞ্জ। কিন্তু কেরানীগঞ্জে আবাসিক এলাকায় অনুমোদনবিহীন একাধিক রাসায়নিকের গুদাম থাকায় এলাকাবাসী বহুদিন ধরেই আতঙ্কের মধ্যে ছিলেন। তবু বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী, আট থেকে দশটি বিশাল রাসায়নিকের গুদাম তৈরি করেছেন। এখানে প্রতিদিন কাভার্ডভ্যানে বিভিন্ন রাসায়নিকের ড্রাম, বস্তা ও গ্যালন মজুদ ও বাজারজাত করা হচ্ছে। রাসায়নিকের গুদাম রয়েছে আতাশুর, কালিন্দী, খোলামোড়াসহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকায়।
স্থানীয় প্রশাসনের কাছে অনুমোদনবিহীন এসব গুদামের কোনো হিসাব নেই! এমন খবরের সত্যতা কতটুকু, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। চকবাজারের মতো ঘটনা, কেরানীগঞ্জেও না ঘটুক এলাকাবাসী অনেকদিন ধরেই তেমনটি চাচ্ছিলেন। কিন্তু হলো কই? সেই আবাসিক এলাকাতেই হলো রাসায়নিকের বিস্ফোরণ! ঢাকার কেরানীগঞ্জে আবাসিক এলাকায় একটি কারখানার রাসায়নিকের গুদামে আগুন লেগে একই পরিবারের ৫ জন নিহত এবং১৫ জন আহত হওয়ার ঘটনার দায়ভার কোন কর্তৃপক্ষ নেবেন? শুধু কেরানীগঞ্জ না, দেশের অনেক জেলায় আবাসিক এলাকাতেই গড়ে উঠেছে রাসায়নিক কারখানা। সেখানে যে কোনো সময় ঘটে যেতে পারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা।
দেশ রূপান্তরে বুধবার প্রকাশিত ‘আবাসিকে রাসায়নিক গুদাম, আগুনে শেষ পরিবারের ৫ প্রাণ’ শিরোনামের সংবাদের মাধ্যমে জানা যাচ্ছে উপজেলার গদারবাগ এলাকায় এ আগুনের ঘটনা ঘটে। স্বাদ গ্লাস অ্যান্ড পলিমার নামের কেমিক্যাল কারখানাটির মালিকের নাম হাজি আবুল হাসনাত টুটুল। এখানে পাশাপাশি দুটি কেমিক্যালের গোডাউন ছিল। গোডাউন দুটির মাঝখানে তিন রুমের একটি বাসায় থাকতেন গোডাউন দুটির কেয়ারটেকার মো. হানিফ। মূলত হানিফ দুটি গোডাউনের দেখভাল করতেন। তার বড় ছেলে মিলন (জেসমিন আক্তারের স্বামী) প্রবাসী এবং ছোট ছেলে সোহাগ একই মালিকের আরেকটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। তিন রুমের বাসায় কেয়ারটেকার হানিফ ও তার স্ত্রী এক রুমে থাকতেন। অন্য একটি রুমে থাকতেন হানিফের ছোট ছেলে সোহাগ, সোহাগের স্ত্রী মিনা ও তাদের দুই সন্তান। অন্য আরেকটি রুমে মেয়েকে নিয়ে থাকতেন জেসমিন। অগ্নিকা-ের পর হানিফ ও তার স্ত্রী এবং সোহাগ তার বড় মেয়েকে নিয়ে বের হতে পারলেও বাকিরা পুড়ে মারা যান। ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা লাশগুলো উদ্ধার করেন। সোহাগ, তার মেয়েসহ আরও কয়েকজনকে ভর্তি করা হয় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। মঙ্গলবার দুপুরে সেখানে মারা যান সোহাগ। সোহাগের বড় মেয়ে রোজার (৫) অবস্থাও আশঙ্কাজনক। পরবর্তী সময়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফয়সল বিন করিম ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আনিসুর রহমান। জেলা প্রশাসক ৫ সদস্যের একটি তদন্ত টিম গঠন করেন এবং নিহতদের পরিবারকে ২৫ হাজার ও আহতদের ১৫ হাজার টাকা অনুদান দেন।
বাহ, কী চমৎকার! মরলে পরিবারপ্রতি ২৫ হাজার এবং আহত হলে ১৫ হাজার এই যদি হয় তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ, তাহলে আর কী বলার থাকে? অথচ দরকার ছিল, কেমিক্যাল কারখানার মালিক হাজি আবুল হাসনাত টুটুলকে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করা। অথচ তা করা হলো না। তিনি থাকলেন, ধরাছোঁয়ার বাইরে। এভাবেই অপরাধীদের সাহস বাড়ে। বাড়তে বাড়তে একসময়, মানুষকে আর মানুষ মনে হয় না। তাদের মৃত্যু বা আর্তনাদ কোনো কিছুই কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় আসবে না। সবকিছু আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হলে পরে, আবার শুরু হবে কেমিক্যাল কারখানার কাজ। শুরু হবে মানুষ হত্যার লীলাখেলা। মানুষ পুড়ে মরবে। অথবা কেউ বিকৃত পোড়া শরীর নিয়ে বেঁচে থাকবেন জীবনভর। এভাবে ঘটনা ঘটতেই থাকবে। নিহত-আহতের পরিবার বিনিময়ে পাবে ২৫ বা ১৫ হাজার টাকা। ওদিকে যারা রাসায়নিকের ব্যবসা করে মানুষের রক্তের দামে টাকা আয় করছেন, তারা থাকবেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
নির্বাচনের আগে বিদেশিদের দৌড়ঝাঁপকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছে সরকারি দল। অন্যদিকে, দেশের গণতন্ত্রকে সুসংহত করার ক্ষেত্রে বিষয়টিকে ‘ভ্রাতৃপ্রতিম দেশগুলোর’ ভূমিকা হিসেবে দেখছে কিছু বিরোধী দল! তবে নিজ স্বার্থ সুরক্ষায়, বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদারদের এমন ভূমিকা প্রয়োজন বলে মনে করেন অনেক কূটনীতিক। এরই মধ্যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলে, পশ্চিমা তৎপরতার বিপরীতে বাংলাদেশের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছে চীন ও রাশিয়া। বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের তৎপরতাকে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ এবং নব্য উপনিবেশবাদ বলে দাবি করছে পশ্চিমা বিরোধীরা।
দেশের কিছু রাজনৈতিক দলের নেতাদের কথা ‘জনগণের ক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে হবে। মানুষের মৌলিক ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বাক, ব্যক্তি স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশনসহ সব স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এখন ধ্বংসের শেষ প্রান্তে। এই ফ্যাসিস্ট শক্তির হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে। আমরা মনে করি, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের বিকাশের লক্ষ্যে চলে আসা রক্ত ঝরা আন্দোলনে, অনেকের আত্মদান বৃথা যাবে না। আর এই আন্দোলকে দেশ-বিদেশে যারাই সমর্থন করবে তারা বাংলাদেশের জনগণের বন্ধু।’
আসলে নিজের ঘর ঠিক না থাকলে, অন্যেরা কথা বলার সুযোগ পাবেই। কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা বিদেশিদের এমন কাজকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। মনে রাখতে হবে, বর্তমানকে গুরুতর সমস্যা মনে করে যারা বিদেশি হস্তক্ষেপকে সমর্থন জানাচ্ছেন, ভবিষ্যতে তারাও একইভাবে দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে হুমকির মুখে পড়তে পারেন।
মজার বিষয় হচ্ছে, এই সমস্ত ম্যারাথন দৌড়বিদদের রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ নির্বাচন নিয়ে কোনো তৎপরতা দেখা যায় না! চীন-কোরিয়ার নির্বাচনেও না। ভারতের বিষয়েও না। এমনকি সম্প্রতি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে নিয়ে যা হলো, সেখানেও তাদের ‘টুঁ’ শব্দটি নেই! সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়নি? ইসরায়েল যেভাবে যুগের পর যুগ ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, সেখানে কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়নি? এমনকি বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বিরোধীদলীয় নেত্রী, তখন ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলায় আইভী রহমানসহ, কতজন নেতা-কর্মী নিহত হয়েছিলেন? সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং সাবেক মেয়র হানিফসহ কতজন নেতাকর্মী সেই বর্বরোচিত হামলায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন? তখন কোথায় ছিল মানবাধিকার? এসব ঘটনার ভূরি ভূরি উদাহরণ দেওয়া যাবে সেই সমস্ত ঘটনায় বিদেশি পর্যবেক্ষকদের (!) কোনো বিবৃতি বা নিন্দা নেই। এমনকি জাতিসংঘ বা কোনো মানবাধিকার সংগঠনেরও কোনো নিন্দাসূচক বিবৃতি ছিল না। কেন ছিল না? এখানেই আসল রহস্য।
এখানে কিছু বিষয় পরিষ্কার করা দরকার। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, মুক্ত বাক স্বাধীনতার সুযোগ নেই, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সমস্যা রয়েছে, বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে না এসব কিছুই আপাত সত্য বলে ধরে নিলাম। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব কথা বলার জন্য তো রাষ্ট্র-রাষ্ট্রের একটা কনভেনশন রয়েছে। কীভাবে, কোন বিষয়ে কথা বলা যাবে তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা রয়েছে আন্তর্জাতিক আইনে। এখানে জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো চিহ্নিত দেশকে সতর্ক করতে পারে। অথচ তা করা হয়নি।
ঘন ঘন যারা আসছেন তারা কনভেনশন অনুযায়ী, আলোচনার বিষয়টি আর সেই সীমার মধ্যে রাখতে পারেননি। তবুও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকার, তাদের পরামর্শ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। কিন্তু দেশের জাতীয় নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে সেটা কেউ শর্তের মধ্যে আনতে পারে না। তবে নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে কি না, সেটাই মুখ্য। ইন্দো-প্যাসেফিক কৌশলপত্রেও তাদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তারা মনে করছে হায় হায়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাজার মনে হয় ‘চীন’ দখল করে নিল! কোনোভাবেই চাচ্ছে না, আর্থিকভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হোক। একইসঙ্গে ভূ-রাজনীতিতেও একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করতে চায় এই জোট।
অন্যদিকে এই শক্তি শুধুমাত্র রাশিয়ার সঙ্গেই জোটবদ্ধভাবে পেরে উঠছে না। যে কারণে রাশিয়া-চীন-মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে যে শক্তিবলয় গড়ে উঠেছে, সেই বলয়ের বাইরে রাখতে চাইছে বাংলাদেশকে। ইতিমধ্যে এই বিষয়ে তাদের মধ্যে আতঙ্ক দানা বেঁধে উঠেছে। আসলে আমরা যা জানি বা জানানো হচ্ছে, অথবা যে যা বলছেন সেসব হচ্ছে আইওয়াশ। মূল বিষয় হচ্ছে, নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার যেন তাদের পক্ষে থাকে। বিষয়টা এমন আমি এটা চাই, তুমি রাজি থাকলে তোমার সঙ্গে আছি নইলে নাই! বাহ, কী চমৎকার গণতন্ত্র!
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইন্ধন দিচ্ছে কারা? কোন কোন পক্ষ প্রকাশ্যে ইউক্রেনকে অর্থ-অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করছে! এসব নিয়ে কে কথা বলবে? কোন দেশ? পৃথিবীর সমস্ত মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা যেন একমাত্র বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য! কিন্তু পাকিস্তানসহ পৃথিবীর অনেক দেশে মুক্ত গণমাধ্যম নেই। প্রকাশ্যে সরকারের কোনো সমালোচনাই করা যায় না যে সমস্ত দেশে সেইসব দেশ নিয়ে তাদের কোনো কথা নেই। সবকিছু যেন বাংলাদেশের মধ্যেই। কোনো দেশের আদৌ অধিকার রয়েছে কি না, পছন্দের রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় বসানো? আসল কথা হচ্ছে, তারা বাংলাদেশকে নিজেদের আয়ত্তের মধ্যে রাখতে চায়। মানবাধিকার, নির্বাচন পদ্ধতিসহ সবকিছুই ভাঁওতাবাজি!
এইভাবে একটি রাষ্ট্র আরেকটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ওপর প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ করলে পরিণতি ভালো কিছু হবে বলে মনে হয় না। তবে ভালো হওয়ার একটা বড় ধরনের সুযোগ রয়েছে। যদি সবকিছুই তাদের কথামতো করা হয়! আর যদি করা না হয়?
মনে রাখতে হবে, এটি ১৯৭৫ নয়। এখন ২০২৩! অনেক বদলে গেছে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির কৌশল। কোনো দেশ জোর করে একটি দেশের জায়গা দখল করবে, সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাবে এটা চাইলেই আর পারবে না। যে কারণে পররাষ্ট্রনীতির কৌশল পরিহার করা দরকার। যারা এমনটি করছেন, তাদের বিরুদ্ধেও পৃথিবীতে প্রবল ক্ষমতাধর দেশের জোট রয়েছে। বাংলাদেশ তাদের পরীক্ষিত মিত্র। তাদেরও এমন সুযোগ নেওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করে দেওয়া, ঠিক হবে না।
আসলে এইভাবে পররাষ্ট্রনীতির কৌশল বদলে দিলে, বাইরের কোনো দেশও সেই সুযোগ নিতে পারে। সফরকারী দেশগুলোর তখন কিছু বলার মুখ থাকবে না। আর ধোপে টিকবে না, কোনো যুক্তিই। এমন কোনো পদক্ষেপ না নেওয়াই ভালো, যাতে অন্য কোনো দেশ বাংলাদেশের বিষয়টি উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। আমরা সব দেশের সঙ্গেই বন্ধুত্ব চাই, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়। এরকম পররাষ্ট্রনীতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো, প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব।
লেখক: সাংবাদিক
‘পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলে একটা বিষয় রহিয়া গিয়াছে’। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট নিয়ে ভাবতে গিয়ে কথাটি মনে পড়ল। এই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সঙ্গে জাতীয়তাবাদ, সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয়গুলোর দ্বৈরথ এক পরাবাস্তব পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। স্কটল্যান্ড, ক্রিমিয়া থেকে শুরু করে, ইউক্রেন, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য কিংবা আফ্রিকার দেশগুলোর দিকে তাকালেও বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যায়। অন্যদিকে, আজকের দিনে উপনিবেশবাদ আর সাম্রাজ্যবাদের দোহাই দিয়ে কোনো নির্দিষ্ট দেশের শাসকশ্রেণি মানুষের অধিকার আর মতপ্রকাশকে আটকে রাখতে চাইলে বিনা চ্যালেঞ্জে পার পাবে না। এ ক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার মতো একঘরে হয়ে থাকতে হবে।
উল্লিখিত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি তুলনীয় নয়। তবে এ দেশে গণতন্ত্র, নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। অন্যদিকে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও ভিন্নমত দমনের কারণেও গত কয়েক বছর বাংলাদেশে আন্তর্জাতিকভাবে বহুবার নিন্দিত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সংকট দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। রাজনৈতিক সংকট বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। অতীতের ধারাবাহিকতায় এই সংকট এসেছে। দেশে রাজনীতিকদের মধ্যে যতক্ষণ পর্যন্ত পরমতসহিষ্ণুতা, গণতান্ত্রিক আচার-আচরণ ও সুশাসনের প্রতি অঙ্গীকার বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হবে ততক্ষণ শঙ্কা থেকেই যাবে। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে এই সংকট ও শঙ্কা আরও প্রকট ও প্রকাশ্য হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের গত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচন পর্যালোচনা করলে দেখা গেছে, নির্বাচনের এক থেকে দেড় বছর আগে বিভিন্ন বিদেশি দূতরা নানামুখী তৎপরতা শুরু করেন। এবারও শুরু হয়েছে। সরকারের মন্ত্রী, নির্বাচন কমিশনসহ (ইসি) রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নিয়মিত সাক্ষাৎ করছেন ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন মিশনের রাষ্ট্রদূতরা। বিদেশি প্রতিনিধিরা সফরে আসছেন। তাদের আলোচনায় উঠে আসছে নির্বাচন প্রসঙ্গ।
বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় বিদেশি রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তৎপরতাকে আমরা কী হিসেবে দেখব? একে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘হস্তক্ষেপ’ বা ‘নাক গলানো’ হিসেবে দেখার সুযোগ অবারিত। কিন্তু আজকের পৃথিবীতে কোনো দেশ তো একা নয়, যেমন কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ সংঘাত, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, মানবাধিকার পরিস্থিতি, দুর্নীতির মতো বিষয়গুলোও বিচ্ছিন্ন নয়। যে কোনো দেশের ভালো বা খারাপ পরিস্থিতি, স্থিতিশীলতা ও অস্থিতিশীলতা প্রতিবেশীসহ দূরবর্তী দেশগুলোকেও প্রভাবিত করে নানাভাবে। ফলে এসব বিষয়ে স্বভাবতই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রতিক্রিয়া দেখায়। অবশ্যই এই প্রতিক্রিয়া প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর পাল্টাপাল্টি স্বার্থ সাপেক্ষেই হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যেটা দেখছি। তাদের এই অবস্থান কিছু গুরুতর প্রশ্নেরও জন্ম দেয়। কিন্তু, এই সব প্রশ্নের বাইরে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সামনে অন্য একটি প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পার হলেও বাংলাদেশের ‘অভ্যন্তরীণ’ বিষয়ে বিদেশিদের ‘হস্তক্ষেপ’ বা ‘নাক গলানোর’ সুযোগ কে দিল? প্রশ্নটির সুরাহা করা দরকার। এছাড়া, বিদেশিরা যে বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসছে বা তারা যেসব করতে বলছে সেগুলো কি খারাপ? আমাদের গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার, নির্বাচনীব্যবস্থা, বাক স্বাধীনতার কি দরকার নেই? এসব বিষয়ে ঘাটতি রেখে কেবল বিদেশি ‘হস্তক্ষেপ’ মোকাবিলা করে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের বেহেশত কীভাবে কায়েম হবে?
মানবাধিকার, নির্বাচন নিয়ে বিদেশি রাষ্ট্র ও সংস্থার তৎপরতা আলোচনায় আসে বছর দেড়েক আগে। তখন গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাব এবং এর সাত কর্মকর্তার ওপর স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা) দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এর পরপরই দেশে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড লক্ষণীয়ভাবে কমে আসে, বিরোধী দলের পক্ষে প্রায় বিনা বাধায় সমাবেশ করা সম্ভব হয় এবং দেশের আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করার বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। অন্যদিকে সরকার এই স্যাংশন ও আমেরিকার বিভিন্ন সমালোচনা শুরু করে, বলা হয়ে থাকে বিরোধীরা লবি করে এই স্যাংশনের ব্যবস্থা করে। প্রশ্ন হলো যেসব অভিযোগের ভিত্তিতে ওই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সেই অভিযোগগুলো সঠিক কি না?
এর পর থেকে স্যাংশন বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচিত বিষয় হয়ে ওঠে। বিষয়টি আরও গতি পায় গত ২৪ মে গভীর রাতে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এদিন বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে দেশটির অব্যাহত নজরদারির কথা স্পষ্ট করে দেন। এই নতুন ভিসানীতিতে বলা হয়েছে, আগামী নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় কোনো রকম অনিয়ম, হস্তক্ষেপ ও বাধা দান করা হলে এর সঙ্গে জড়িত যেকোনো ব্যক্তি ও তার পরিবারকে ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাদানে জড়িত থাকলে সরকারের সব পর্যায়ের ব্যক্তিরা (যেমন: মন্ত্রী, আমলা, পুলিশ বা নিরাপত্তা বাহিনী) এবং বিরোধী দলেরও যে কেউ এই ভিসানীতির তোপে পড়তে পারেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের ‘হস্তক্ষেপ’ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে লেখক, গবেষক, রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর দৈনিক সমকালকে বলেছিলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে হস্তক্ষেপ করছে, তা আওয়ামী লীগের জন্য অসুবিধাজনক হয়ে গেছে। জনগণের জন্য শাপেবর হয়েছে। এই হস্তক্ষেপের ফলে জনগণ উপকৃত হতে পারে। যেমন র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অনেক কমেছে।’
ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনের ভোটের দিন এক স্বতন্ত্র প্রার্থীর ওপর হামলায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার এবং বিএনপির অবস্থান কর্মসূচি চলাকালে আহত হওয়া দুই নেতার একজনকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে খাবার ও ফলমূল পাঠানো এবং অপরজনকে ডিবি অফিসে ‘আপ্যায়ন’কে অনেকে বিদেশিদের নজরদারির পরিপ্রেক্ষিতে আচরণগত পরিবর্তন হিসেবেও দেখছেন। ফলে বাংলাদেশকে ঘিরে বিদেশিদের আনাগোনা, কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপে সাম্রাজ্যবাদ কিংবা হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখার সুযোগ থাকলেও দেখতে হবে এই ইলেকশন ডিপ্লোমেসি তারা কোন অবস্থায় করছে। জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদের বলেছেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে বিদেশিরা খারাপ উদ্দেশ্যে গণতন্ত্র ও ভোটের কথা বলছে। এসব কথার কোনো অর্থ নেই। বিদেশিরা জনগণের পক্ষেই কথা বলছে, তারা ভালো কিছু চাচ্ছে।’
অন্যদিকে, বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে ক্রসফায়ার, নিরাপত্তা হেফাজতে নিয়ে নির্যাতন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর দলীয় কর্মীর মতো আচরণসহ নানারকম অভিযোগ আছে। সুতরাং এইসব ঘটনার কারণে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যদি কেউ প্রশ্ন তোলে বা সমালোচনা করে, তাহলে সেটিকে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ’ বলার আগে নিজেকে প্রশ্ন করা দরকার, কেন অন্য কেউ এ ধরনের সমালোচনার সুযোগ পেল? বাংলাদেশের রাজনীতি, নির্বাচন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, প্রেস ফিডমসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিদেশি রাষ্ট্র, সংস্থাগুলো তো ভালো ভালো কথাই বলছে। এগুলো তো জনগণেরই চাওয়া। এগুলোকে বিদেশি হস্তক্ষেপ বলে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ কোথায়? যেখানে পশ্চিমা বিদেশি বন্ধুরাষ্ট্রগুলো আর জনগণের চাওয়া একই।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক
‘ইউরোপা নো লংগার এক্সিস্টস’ শিরোনামের নিবন্ধে পিয়েরো মেসিনা লিখেছেন ইউরোপ আর ‘জীবিত’ নেই ইউরোপ কার্যত আর বিরাজমান নয়। একটা চ্যুতিরেখা ইউরোপীয় মানসে ক্রিয়াশীল; যে রেখা ইউরোপ নামের পুরনো মহাদেশের বিলীয়মানতার নির্দেশক। রেখাটি ইউক্রেনের বাখমুত (আর্চেমভ্স্ক) এবং ফ্রান্সের নঁতেরেকে এক মরমি সুতায় গেঁথেছে। ইউরোপ তথা ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার স্বকীয়তা হারিয়েছে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির ২৪ (যেদিন ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযানের শুরু)। সেদিন বিশে^র ভূ-রাজনীতির নিশ্চায়ক পরিবর্তনেরও শুরু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছিল নাৎসি জার্মানির পতনের মধ্য দিয়ে। তারপরও পশ্চিম ইউরোপের প্রায় সর্বত্র নাৎসিবাদের ভূত ক্রিয়াশীল ছিল, ইতালিতে মুসোলিনির প্রেতাত্মা জীবিত ছিল এবং জার্মানিতে হিটলারের ছায়াশরীর ক্রিয়ারত ও ক্রীড়ারত ছিল। মার্শাল প্ল্যানের সঞ্জীবনী সুধায় তা ক্রমশ সঞ্জীবক প্রণোদক উজ্জীবক সত্তা হয়ে জাগ্রত ছিল। নঁতেরেতে জাতীয়তাবাদী হাইপাররিয়েলিস্টিক হাওয়ায় তা দোলায়মান ছিল আর বাখমুতে তা নব্য নাৎসিবাদে স্তেপান বান্দেরার গুণমুগ্ধ হয়ে প্রাণিত ছিল। ওল্ড ইউরোপ বা পুরনো ইউরোপ ছিল ‘পেরিফেরি অব দ্য অ্যামেরিকান এম্পায়ার’। সে ইউরোপের আসলেই বিদ্যমানতা নেই ইউরোপা নো লংগার এক্সিস্টস।
নঁতেরেতে নাহেল মারজুক নামের ১৭ বছরের এক মরোক্কীয়-আলজেরীয় বংশোদ্ভূত ফরাসি তরুণ (অভিবাসী বলাই ফরাসি সমাজের জন্য জুতসই) পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিল। আর তাতে জ্বলে উঠেছিল ফ্রান্সের সব পশ্চিম আফ্রিকীয় আরব অভিবাসী। বাস্তিল দুর্গ আবার কেঁপে উঠেছিল। জার্মান ডানপম্পি’ দল এএফডি বা অল্টারনেটিভ ফুর ডয়েচল্যান্ট এ বিষয়টিকেই একটু ভদ্রস্থভাবে বলেছে, ‘দ্য ইইউ ইজ আ ফেইল্ড প্রজেক্ট’। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিবাসন, জলবায়ু ও মুদ্রানীতি পুরো ব্যর্থ। তারা ইইউকে সীমান্ত নিরাপত্তা এবং কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতে মনোযোগ দিতে বলেছে। ইইউকে ফেডারেশন অব ইউরোপিয়ান ন্যাশনসে পরিবর্তিত করতেও বলেছে তারা। ইউরোপা আসলেই মৃত। ইউরোপের অকার্যকর হওয়ার সঙ্গে নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন তথা ন্যাটোও অকার্যকর হয়েছে; প্রথম দফায় ১৯৯০ সালে, সোভিয়েত ইউয়িনের বিলুপ্তির দিনে যে কারণে ন্যাটোর জন্ম হয়েছিল সেটি আর যৌক্তিক ছিল না; দ্বিতীয় দফায় ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযানের দিনে; তৃতীয় ও চূড়ান্ত দফায় অকার্যকর হয়েছে লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিউসে জুলাইয়ের ১১-১২ তারিখে, ন্যাটোর ‘আখেরি’ সম্মেলনে। প্রাজ্ঞজনদের বিবেচনা তা-ই। বিশ্বটা বদলাচ্ছে এবং ন্যাটো জাপানের সাগরজলে ঝাঁপ দিয়েছে পুনর্জনমের আশায় তাইওয়ানের ‘যোগিনী’-পরশে।
ইউক্রেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিআক্রমণে সুবিধা করতে পারছে না। একথা পুরনো হয়ে গেছে। জুন পর্যন্ত কাউন্টার অফেনসিভে ২৬ হাজারের বেশি ইউক্রেনি বা ইউক্রেনের পক্ষে লড়াই করে বিদেশি ভাড়াটে সৈন্য মারা গেছে। নিহত মার্সিনারির সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার। আর জুলাই মাসেই নিহত হয়েছে প্রায় ২১ হাজার ইউক্রেনি সৈন্য। জেলেনস্কি ও তার অন্তর্চক্রও ক্ষয়ক্ষতির হিসাবটা জানে। তারা হতাশ, যদিও তাদের চোখেমুখে সান্ত¡নার আভাস। বীরত্ব প্রদর্শনে কাউন্টার অফেনসিভ থেকে ইউক্রেন সন্ত্রাসী হামলায় নজর দিয়েছে। তারা রাশিয়ায় ড্রোন হামলা চালাচ্ছে। ইঙ্গ-মার্কিন পক্ষও ইউক্রেনের পারপরমেন্সে নাখোশ। তবে ব্রিটিশ মেরিন কমান্ডোরা ইউক্রেনের স্পেশাল ফোর্সকে নিবিড় প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ক্রিমিয়া দখলের জন্য। ন্যাটোর গেম অব থ্রোনসের খেলা থামেনি। এ খেলায় কে জেতাবে তাদের? ইউক্রেনের বধ্যভূমিতে ন্যাটোর সবই ডুবেছে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের ৫ আগস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘জেলেনস্কি ফিয়ার্স পিস প্রেশার ফ্রম ওয়েস্ট। পাশ্চাত্যের মধুলোভীরা সুযোগ পেলেই কিয়েভকে রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বসার জন্য চাপ দেবে। একথা জেলেনস্কি তার কূটনীতিকদের বলেছেন। কাউন্টার অভিযানটি জুতসই হচ্ছে না, যদিও মাঝেমাঝেই রাশিয়ায়, মস্কোতে ড্রোন এবং কদাচিৎ হাইমার্স ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা চালাচ্ছে ইউক্রেন এটা যে বড় একটা খবর তা পাশ্চাত্যের মূলধারার গণমাধ্যম তথা প্রেস্টিটিউট (শব্দটির উদ্গাতা লিবারটারিয়ান কনজারভেটিভ ও রিগ্যান আমলের মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি পল রবার্ট ক্রেইগস) ফলাও করে ছাপছে। যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্শাল প্ল্যানের আওতায় পশ্চিম ইউরোপের জন্য যে পরিমাণ খরচ করেছিল ইউক্রেনের জন্য তার চেয়ে বেশি খরচ করবে বলে মার্কিনি পক্ষই বলছে।
সে যা-ই হোক, রাশিয়ার সঙ্গে কী শর্তে বোঝাপড়া করা যায় সে চিন্তা করেছে ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্র। শিগগির আলোচনা শুরু হতে পারে বলে ইউক্রেনি প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির দপ্তরের প্রধান আন্দ্রিয়ি ইয়ারমাক বলেছেন। ইউক্রেন সিকিউরিটি গ্যারান্টি বিষয়ক চুক্তি নিয়ে কথা বলবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। এসব গ্যারান্টি কার্যকর থাকবে ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ না দেওয়া পর্যন্ত। ইয়ারমাকের মতে এতে প্রতিরক্ষার ও আর্থিক সহায়তার নিশ্চয়তাও থাকবে। রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যেই এ আলোচনা হবে। প্রসঙ্গটি উঠেছিল লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিউসে জুলাইয়ের ১১-১২ তারিখে, ন্যাটো সম্মেলনে। ইউক্রেনের সমর্থনে ন্যাটো কী করবে তা-ই ছিল আলোচনার বড় বিষয়। ন্যাটো মহাসচিব হ্যানস স্টলটেনবার্গ ভিলনিউসে ইউক্রেন-ন্যাটো কাউন্সিল গঠনের ঘোষণা দেন, যাকে চলমান বাস্তবতায় ফাঁকা আওয়াজই বলা চলে। ইউক্রেনের কাউন্টার অফেনসিভ ন্যাটোর বা যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের সার্বিক তত্ত্বাবধানেই হচ্ছে। ইউক্রেনের একক সিদ্ধান্তে হচ্ছে না। আর তাতে ন্যাটোকে সজীব সত্তা মনে হচ্ছে না। পৌরাণিক ইউরোপার অস্তিত্বহীনতার মতো ন্যাটোও কার্যত চলৎশক্তিহীন। তবু তার ক্ষতিকর প্রভাব-বলয় এখনো বিদ্যমান। ইউক্রেনের জন্য ন্যাটোর নিরাপত্তা-নিশ্চয়তা খুব দরকারি; তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো সমরাস্ত্রের সরবরাহের বিষয়টি।
ইউক্রেনের ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড ডিফেন্স কাউন্সিলের (এনএসডিসি) প্রধান ওলেক্সি দানিলভ বলেছেন, পারমাণবিক ক্ষমতার অধিকারী জি-৭-এর পক্ষ থেকে যদি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পাওয়া যায় তবে সেটাই হবে ইউক্রেনের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বের। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি নিরাপত্তা-নিশ্চয়তা বিষয়ক চুক্তি করতে প্রস্তুত। কিন্তু রাশিয়া কি এ প্রস্তাবে রাজি? রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন অবশ্য বলেছেন, শান্তির লক্ষ্যে আলোচনায় রাশিয়ার আপত্তি নেই। তবে কথা আছে ইউক্রেনই সিকিউরিটি গ্যারান্টির বিষয়টি স্বীকার করতে অনীহা প্রকাশ করেছিল। ইস্তাম্বুল বৈঠকে যে শান্তিচুক্তির খসড়া তৈরি হয়েছিল তা প্রথমে স্বীকার করেও পরে অস্বীকার করেছিল কিয়েভ। পুতিনের কথা হলো, রুশ ফেডারেশনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নিশ্চিত হতে হবে সবার আগে। অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আনাতোলি মাতভিয়িচুক লেন্তাডটআরইউ নিউজের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সিকিউরিটি গ্যারান্টি বিষয়ক আলোচনা শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি পদক্ষেপ হতে পারে। জেলেনস্কি শান্তি চুক্তির ইতি টানতে উদগ্রীব। এর জন্য যা মূল্য দিতে হয় তিনি দিতে ইচ্ছুক। কিন্তু জেলেনস্কি কাকে মূল্যটা দেবেন? মাতভিয়িচুকের মতে ইউক্রেন-মার্কিন আলোচনায় রাশিয়াকে আমন্ত্রণ জানানো হবে না। আবার মার্কিনিরা জেলেনস্কির কর্মকাণ্ডে আস্থা রাখতে পারছে না। ইউক্রেনি সশস্ত্র বাহিনীর সামর্থ্য দেখাতে চায় তারা। কিয়েভ কিছু এলাকা ফিরে পেতে রাশিয়ার সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যেতে চায়, তবে কূটনৈতিক পন্থায়। মাতভিয়িচুক জানান, ক্রিমিয়াকে ফিরে পেতে লড়বে কিয়েভ।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও সামরিক বিশ্লেষক ইগর গেরাসিমভ প্রাভদাডটআরইউকে বলেছেন, ইউক্রেনি সশস্ত্র বাহিনীর ব্যর্থ কাউন্টার অফেনসিভের কথা মাথায় রেখেই কিয়েভ (শান্তি) আলোচনা করতে চায়। ইয়ারমাকের বিবৃতি কাউন্টার অফেনসিভের ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতেই এসেছে। মার্কিনিদের সঙ্গে কথাবার্তায় ব্যর্থ হলে তারা অন্য একটি উপায় ভেবে রেখেছে। আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না, তারা ফয়সালার আলোচনার জন্য রুশ ফেডারেশনের সঙ্গে আলোচনায় বসার শেষ চেষ্টা করবে। কাউন্টার অফেনসিভের ব্যর্থতা তাদের জন্য আর কোনো পথ খোলা রাখেনি। রাশিয়া কি ইউক্রেনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি হবে? রাশিয়া আলোচনা এবং সিকিউরিটির গ্যারান্টির বিষয়টিকে আশাব্যঞ্জক মনে করে না। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইউক্রেনের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজনীয়তাও বোধ করে না তারা। ইউক্রেন-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনায় স্পেশাল মিলিটারি অপারেশনে প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন গেরাসিমভ। তিনি বলেন, এ অবস্থায় আলোচনা মেনে নেওয়া এবং ইউক্রেন যেমন আছে তেমন হিসেবে কার্যকর থাকার জন্য সময় দেওয়ার মানে হলো চলমান সংঘাতকে স্থগিত করা। ইউক্রেনের কথায় আস্থা রাখার কোনো কারণ নেই। জেলেনস্কি পাশ্চাত্যের কাছে লাগাতার সমরাস্ত্র চেয়েই যাচ্ছে। যত সমরাস্ত্রই পাঠানো হোক না কেন, এমন কোনো জাদুকাঠি জেলেনস্কির কাছে নেই যে কিয়েভ রাশিয়ার বিরুদ্ধে জিতে যাবে। এমনই মনে করেন সাবেক মার্কিন মেরিন কোরের ইন্টেলিজেন্স অফিসার স্কট রিটার। জেলেনস্কি স্বপ্ন দেখছেন। আসলে পাশ্চাত্য ইউক্রেনকে রক্তস্নানে নামিয়েছে। জেলেনস্কি যদি এ কথা বুঝেও থাকেন তাহলেও তার কিছু করার নেই। শেষ ইউক্রেনিকে বলি দেওয়াই মার্কিন তথা ন্যাটোর উদ্দেশ্য।
ন্যাটোর কেরামতি এখানেই। আর বাইডেন প্রশাসন এখন তাইওয়ানকে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামানোর পরিকল্পনায় ব্যস্ত। রাশিয়াকে যেভাবে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে মাঠে নামানো হয়েছে, চীনকেও সেভাবে তাইওয়ানের বিরুদ্ধে নামানোর পরিকল্পনা চলছে। দুই ক্ষেত্রেই কলকাঠি নাড়ানোতে ব্যাপক সাদৃশ্য রয়েছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রেও জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি তৈরি করা হয়েছিল। চীনের ক্ষেত্রেও তেমনটাই করা হবে। আর ইউক্রেনের মতো তাইওয়ানকেও অর্থ ও রসদ জোগাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ন্যাটোও থাকবে। কিছুদিন আগেই ন্যাটোকে টেনে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ পরিকল্পনার উদ্দেশ্য, তাইওয়ানি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্র ও লজিস্টিক সমর্থন জুগিয়ে প্রশিক্ষিত করা। তারাই চীনের বিরুদ্ধে লড়াবে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, তাইওয়ানি আর্মি ও মার্কিন আর্মির মধ্যে অপারেশনাল কোলাবরেশন বাড়ছে। যুদ্ধ বাধলে এর মাত্রা আরও বাড়বে। পরস্পরের শত্রু হবে তাইয়ান ও চীন। আর ফায়দা লুটবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
চীনকে সামরিকভাবে মোকাবিলার মার্কিন ছক প্রণীত হয়েছিল ২০২২ সালের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে। পিপলস রিপাবলিক অব চায়না চিহ্নিত হয়েছিল ‘আমেরিকাজ মোস্ট কনসিকুয়েনশিয়াল জিওপলিটিক্যাল চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে। কারণ চীন বিশ্ববাস্তবতা বদলে দেওয়ার আকাক্সক্ষা পোষণ করেছে। এ কৌশলে ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখার ইচ্ছাও আছে। বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বেশির ভাগটাই এ অঞ্চলে হয়। একবিংশ শতকের ভূ-রাজনীতির উপকেন্দ্রও এখানেই। মার্কিনিদের কাছে ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকার বাইরে অধিক গুরুত্বের আর কিছু নেই। বাইডেন প্রশাসনের এ কৌশলে চীনের সঙ্গে আসন্ন বিরোধে সামরিক বাহিনীর কী ভূমিকা হবে তার কথা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বলা হয়েছে-
We will...modernize and strengthen our military so it is equipped for the era of strategic competition with major powers...
চীনকে একটা তাইওয়ানি গ্যাঁড়াকলে আটকে ফেলা বিশ্বে মার্কিন একাধিপত্য বজায় রাখার প্রথম ধাপ। চীন যাতে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অধিপতি অর্থনীতি হয়ে উঠতে না পারে তা নিশ্চিত করাও এ কৌশলের লক্ষ্য। কৌশলের অর্থনৈতিক, সাইবার ও ইনফরমেশনাল এলিমেন্টস সামরিক কম্পোন্যান্টের সঙ্গে একযোগে কাজ করবে। যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো নামের সাদা মরা হাতিতে চড়ে জাপান সাগরের দিকে ছুটছে।
লেখক: সাংবাদিক
১৭৬১ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন ইংরেজ ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি ও ব্যাপ্টিস্ট মিনিস্টার উইলিয়াম কেরি। তিনি আধুনিক মিশনগুলোর জনক নামে পরিচিত। তিনি ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ভারতের শ্রীরামপুর দিনেমার উপনিবেশে (এখন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলি জেলায় অবস্থিত) খ্রিস্টধর্ম প্রচারের কার্যে নিযুক্ত হয়ে তিনি বাংলা, সংস্কৃত ও অন্যান্য ভাষা ও উপভাষায় বাইবেল অনুবাদ করেন। এডমন্ড ও এলিজাবেথ কেরির পাঁচ সন্তানের মধ্যে উইলিয়াম কেরি ছিলেন জ্যেষ্ঠ। তার মা-বাবা ছিলেন নরদাম্পটনের পলারসপ্যুরি গ্রামের তন্তুবায়। কেরি চার্চ অব ইংল্যান্ড সম্প্রদায়ে প্রতিপালিত হন। ছয় বছর বয়সে বাবা তার জন্য স্থানীয় চার্চ সম্প্রদায়ের করণিক ও গ্রাম্য স্কুলশিক্ষককে নিযুক্ত করেন। বাল্যকাল থেকেই কেরি ছিলেন জ্ঞানপিপাসু। তখন থেকেই প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, বিশেষত উদ্ভিদবিদ্যায় কেরির গভীর আগ্রহ লক্ষিত হয়। এ ছাড়া ভাষাশিক্ষার ব্যাপারেও তিনি ছিলেন বিশেষ মেধাসম্পন্ন। স্বচেষ্টায় তিনি লাতিন অধ্যয়ন করেছিলেন। কেরি নবগঠিত স্থানীয় সংঘ স্ট্রিক্ট ব্যাপ্টিস্টের কাজকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সেই সংঘে জন রিল্যান্ড, জন সাটক্লিফ ও অ্যান্ড্রু ফিলার প্রমুখের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান। পরের বছরগুলোতে তারা কেরির ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েছিলেন। প্রায়ই রবিবার করে তারা কেরিকে আমন্ত্রণ জানাতেন নিকটবর্তী বার্টন গ্রামের গির্জায় ধর্মোপদেশ দানের জন্য। ১৭৮৩ সালের ৫ অক্টোবর রিল্যান্ড কর্র্তৃক ব্যাপ্টাইজড হন কেরি এবং নিজেকে উৎসর্গ করেন ব্যাপ্টিস্ট ধর্মসম্প্রদায়ের উদ্দেশে। কেরি তার জ্যেষ্ঠ ছেলে ফিলিক্স, স্ত্রী, মেয়েসহ ১৭৯৩ সালের এপ্রিল মাসে একটি ইংরেজ জাহাজে চেপে লন্ডন ছাড়েন। নভেম্বর মাসে তারা কলকাতায় পৌঁছান। ১৮৩৪ সালের ৯ জুন ভারতের শ্রীরামপুরে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
অপেক্ষা আর মাত্র ৩ দিনের। তারপরই শুরু হয়ে যাবে ওয়ানডে বিশ্বকাপ, ইংল্যান্ডের চার বছরের রাজত্ব আরও চার বছর টিকিয়ে রাখার আর বাকিদের সেই মুকুট কেড়ে নেওয়ার লড়াই শুরু হবে গতবারের দুই ফাইনালিস্টের লড়াই দিয়েই।
শাহরুখ খানকে দিয়ে প্রোমো আর রণবীর সিংকে দিয়ে থিম সং, আইসিসি জানান দিয়েছে ক্রিকেটে বলিউডি আবেগের মিশেল ভালোই থাকবে। কিং খানের ‘জাওয়ান’ কাঁপাচ্ছে পর্দা, কাটতি বাড়ছে বক্স অফিসে; বিশ্বকাপে আইসিসির পকেট ভরবে তো?
প্রস্তুতি বলছে, ভরবে। উইকেটে হবে রান উৎসব, লড়াই হবে ধুন্ধুমার। তাতেই ২০২৩ ক্রিকেট বিশ্বকাপ হবে এক ব্লকবাস্টার মেগা হিট।
মাস তিনেক আগে, বিশ্বকাপের মূলপর্বের ম্যাচগুলো যে ১০ ভেন্যুতে আয়োজন করা হবে সেই ভেন্যুগুলোর কিউরেটরদের সঙ্গে বসেছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান কিউরেটর। সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছেন বিশ্বকাপের একটাই মন্ত্র, রান চাই।
বিশ্বকাপ শুরুর আগে, ভারত অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে যে ৩ ওয়ানডের সিরিজ খেলেছে সেই ম্যাচগুলো যদিও বিশ্বকাপের ভেন্যুতে হয়নি তবে সেই সব ম্যাচেও রানের বন্যা বয়েছে।
প্রথম দুটো ওয়ানডেতে বিরাট কোহলি-রোহিত শর্মাদের ছাড়াই অস্ট্রেলিয়ার করা ২৭৬ রান অনায়াসে তাড়া করে ৫ উইকেটে জিতেছে ভারত। পরের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের ঠেঙিয়ে তুলেছেন ৩৯৯ রান। তিন নম্বর ম্যাচে আবার অস্ট্রেলিয়া করেছে ৩৫২ রান, যা তাড়া করে ভারতও গিয়েছিল ২৮৬ অবধি।
উদ্বোধনী ম্যাচ হবে গুজরাতের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে। এখানে সবশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয় গত ১ ফেব্রুয়ারি, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৩ ম্যাচ সিরিজের তৃতীয় টি-টোয়েন্টি। ম্যাচে শুভমান গিল করেন সেঞ্চুরি, ভারত করে ৪ উইকেটে ২৩৪ রান আর জবাবে নিউজিল্যান্ড অলআউট হয় ৬৬ রানে।
বোঝাই যাচ্ছে, উইকেটের ধরন বুঝে ব্যাট করতে পারলে ৫০ ওভারে এখানে রানবন্যা হবে। বিশ্বকাপে ভারত-অস্ট্রেলিয়া মুখোমুখি হবে চেন্নাইয়ের চিদাম্বরম স্টেডিয়ামে। দুই দল এখানে মুখোমুখি হয়েছে বহুবার, পোশাকের রঙ কখনো রঙিন কিংবা কখনো সাদা হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝাঁজ কমেনি। এই মাঠে অস্ট্রেলিয়া ২৬৯ রান করে ভারতকে ২১ রানে হারিয়েছে সবশেষ ম্যাচে।
আইপিএল চ্যাম্পিয়ন চেন্নাই সুপার কিংসের ঘরের মাঠে সবশেষ মৌসুমে ধোনির ‘ইয়েলো আর্মি’ ৮ ম্যাচ খেলে ২০০ রানের ওপরে করেছে দুইবার, একবার জিতেছে অন্যবার হেরেছে। তবে দুই ইনিংসেই ২০০’র বেশি রান হয়েছে দুটো ম্যাচেই। অর্থাৎ চাইলে চেন্নাইকেও ব্যাটিং স্বর্গে পরিণত করা সম্ভব।
বিশ্বকাপের আগে দারুণ ছন্দে আছে দক্ষিণ আফ্রিকা। ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচ হারার পর টানা তিন ওয়ানডে জিতে সিরিজ তো নিশ্চিত করেছেই, টানা তিন ম্যাচে ৩০০’র ওপর রান করেছে। চতুর্থ ওয়ানডেতে তো ৪০০ পার করেছে প্রোটিয়ারা। ব্যাটিং উইকেটে তারাও যে কোনো প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। হেনরিক ক্লাসেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মাত্র ৮৩ বলে খেলেছেন ১৭৪ রানের ইনিংস। বিধ্বংসী রূপে ফিরছেন ডেভিড মিলারও।
প্রোটিয়ারা প্রথম ম্যাচ খেলবে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে, দিল্লির অরুন জেটলি স্টেডিয়ামে। সেখানে অবশ্য সবশেষ হয়ে যাওয়া আন্তর্জাতিক ম্যাচেও খেলেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারতের বিপক্ষে সেই ম্যাচে তারা অলআউট হয়েছিল মাত্র ৯৯ রানে। দিল্লির মাঠটা হয়তো খানিকটা স্পিনারদের দিকেই ঝুঁকবে, তবে অন্য মাঠগুলোতে প্রোটিয়া ব্যাটসম্যানদের রান উৎসবে মেতে উঠতে দেখার সম্ভাবনা জোরালো। তাই অনেক সাবেক ক্রিকেটারই প্রোটিয়াদের দেখছেন শেষ চারে।
বিশ্বকাপের আগে ক্লাসেন ছাড়াও ইংল্যান্ডের বেন স্টোকস খেলেছেন ১৮২ রানের ইনিংস, দারুণ ছন্দে ইংল্যান্ডের ডাভিড মালানও। তবে সেরা ছন্দে নিঃসন্দেহে শুভমান গিল। সবশেষ ৫ ইনিংসে দুটো শতরান আর একটা হাফসেঞ্চুরি। নিউজিল্যান্ডের ড্যারিল মিচেলও আছেন দারুণ ছন্দে। দুটো হাফসেঞ্চুরি আর একটা সেঞ্চুরি সবশেষ ৫ ইনিংসে। হায়দ্রাবাদে বিশ্বকাপের অফিশিয়াল প্রস্তুতি ম্যাচে পাকিস্তানের ৩৪৫ রান কিউইরা তাড়া করেছে ৩৮ বল হাতে রেখে।
বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল মনে করেন, এই বারের বিশ্বকাপে রানবন্যায় বোলারদের জন্য কাজটা হবে কঠিন। দেশ রূপান্তরকে আশরাফুল বলেন, ‘আমাদের পেসাররা গত এক দেড় বছর ধরে খুবই ভালো করছে। তবে যেহেতু ভারতের মাটিতে খেলা, আমরা দেখেছি যে সাড়ে ৩০০’র বেশি রান হচ্ছে প্রতিটা ম্যাচে। কেউ যদি ভালো না করে, তাকে মনে রাখতে হবে যে টুর্নামেন্টে পরের ম্যাচে ফিরে আসতে হবে। একজনের দিন খারাপ যেতেই পারে, কোনো ম্যাচে সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ রান উঠেই যেতে পারে। ৯টা ম্যাচের ভেতর ৪-৫টা ম্যাচে সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ রান হতে পারে। তাই বোলারদের ফিরে আসার মানসিকতা থাকতে হবে।’
বিকেএসপির ক্রিকেট উপদেষ্টা নাজমুল আবেদীন ফাহিমও বলেছেন যে দেড় মাসের আসরে প্রস্তুত থাকতে হবে যে কোনো কিছুর জন্যই, ‘দেড় মাসের আসর, ৯টা ম্যাচ এই সময়ে খেলতে হবে বা তারও বেশি। অনেক উত্থান-পতন হবে। যে কোনো কিছুর জন্যই তৈরি থাকতে হবে।’
রান উৎসবের বিশ্বকাপ যে হতে যাচ্ছে, তার সব রসদই মজুদ। মাঠগুলোকে করা হয়েছে ব্যাটিং স্বর্গ, বিশ্বকাপে আসার আগে সেরা সেরা ব্যাটসম্যানরাও আছেন ছন্দে। শুধু প্রশ্ন এটাই, রান উৎসবের এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে রান করবেন কে? সাম্প্রতিক সময়ের ব্যাটিংয়ের ছবিটা যে মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বিএনপি নেতারা।
তারা বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জার্মানিতে নেওয়ার কথা ছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সে সময় শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়। এবার চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছি। জার্মানিতে খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে আমরা তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাব। জার্মানিতে তার ভালো চিকিৎসা হবে।’
এর অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খালেদা জিয়া ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে তার লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে আসছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লিভার সিরোসিসের কারণে খালেদা জিয়ার হৃদ্যন্ত্র ও কিডনির জটিলতা বেড়েছে। তিনি হাসপাতালে কখনো কিছুটা ভালো থাকছেন, পরক্ষণেই তার স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। ফলে তাকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘লিভার সমস্যার কারণে ম্যাডামের শ্বাস কষ্ট হয়। ইতোমধ্যে তাকে দুইবার করোনারী কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রাখা হয়েছিল। লিভার প্রতিস্থাপন করতে পারলে শ্বাসকষ্টটা হতো না।’
এদিকে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষণ না থাকায় তার পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি এখন সামনে এসেছে।
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়া হতে পারে এমন খবরে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও খোঁজখবর নিচ্ছেন জার্মান বিএনপি নেতারা।
জার্মান বিএনপির সভাপতি আকুল মিয়া বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জার্মানিতে ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হতে পারে বলে জানতে পেরেছি। আমরা খুবই খুশি। কারণ জার্মানিতে আসলে আমরা তার চিকিৎসার বিষয়ে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারব। চেয়ারপারসনের যে চিকিৎসা দরকার তা সকল ব্যবস্থা জার্মানিতে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ম্যাডামের মুক্তি, তার উন্নত চিকিৎসা ও গণতন্ত্র ফেরাতে দেশে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে জার্মানিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। আগামী ৯ অক্টোবর আমাদের কর্মসূচি রয়েছে। জার্মান বিএনপির উদ্যোগে রোডমার্চ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করব জার্মান পার্লামেন্টের সামনে। ’
আকুল মিয়া বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যখন বিদেশে নেওয়ার আলোচনা চলছিল তখনও জার্মানিতে নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়েছিল। সে সময় তারেক রহমানের সেবা করতে না পারলেও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সেবা করতে পারব বলে আশা করছি। তার চিকিৎসা জার্মানিতে করতে পারলে আমরা ধন্য হবো।’
গত ২৫ সেপ্টেম্বর সোমবার খালেদা জিয়ার ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনি মতামত জানতে চেয়ে আবেদনের কপি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। খালেদা জিয়ার ভাইয়ের আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
বিশ্বকাপের দল ঘোষণা নিয়ে চলছে নানা নাটকীয়তা। রাতটা পোহালেই বাংলাদেশ দল উড়াল দেবে ভারতের গোয়াহাটিতে। তবে এখনও ঘোষণা করা হয়নি দল। বিসিবি জানিয়েছে, নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে চলমান তৃতীয় ওয়ানডের ম্যাচ শেষেই জানানো হবে বিশ্বকাপের দল।
প্রচুর আলোচনা ও জল্পনা–কল্পনার পর আজ বিশ্বকাপে নিজেদের স্কোয়াড ঘোষণা করবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। বিসিবির ফেসবুক পেজে আজ দুপুর ১টা ২৮ মিনিটে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়। সেখানে দেখা যায় বিসিবির লোগোসংবলিত বক্সে করে গুরুত্বপুর্ণ কিছু নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভিডিও–র শেষে প্রশ্ন করা হয়েছে, বলুন তো ভেতরে কি?
বিকেল ৫টা ৪৩ মিনিটে আরেকটি পোস্টে জানানো হয় সন্ধ্যা পৌণে ৬টায় ঘোষণা করা হবে দল। কিন্তু ৫টা ৪০ মিনিটে আরেকটি পোস্টে জানানো হয় তৃতীয় ওয়ানডের শেষেই দল ঘোষনা করা হবে।
তার নাম শেখ মোহাম্মদ আসলাম। একসময় সুইডেন ছিলেন বলে পরিচিত হয়ে ওঠেন স্ইুডেন আসলাম নামে। তেজগাঁও এলাকার এই শীর্ষ সন্ত্রাসী একসময় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড বা অপরাধ জগৎ কাঁপাতেন। ২৭ বছর ধরে আছেন কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে। হত্যাসহ ১৭ মামলার একটি ছাড়া বাকিগুলোতে জামিন পেয়েছেন তিনি। কিন্তু বহু দিনের পুরনো প্রতিপক্ষের হাতে প্রাণ হারানোর শঙ্কায় জামিনের জন্য আবেদন করছেন না তিনি।
মোহাম্মদপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালও জামিনের আবেদন করছেন না। প্রায় ২০ বছর ধরে কারাগারে থাকা হেলালের বিরুদ্ধে আছে অন্তত এক ডজন মামলা। বেশিরভাগ মামলায় জামিন হয়ে গেছে। এই দুজনের মতোই কারা হাজতে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছেন না। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে কেউ সাক্ষ্যও দিতে আসেন না আদালতে। তারা বছরের পর বছর ধরে কারাগারে থাকলেও সমস্যা হচ্ছে না। অনেকেই অসুস্থ না হয়েও বছরের পর বছর হাসপাতালে আরামে
থাকছেন। বাইরে থাকা তাদের সহযোগীদের সঙ্গেও যোগাযোগ থাকছে। এই সহযোগীরাই তাদের হয়ে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ করছেন।
পুলিশের তালিকায় ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম আছে যাদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। অবশ্য এই তালিকায় সুইডেন আসলাম নেই। তালিকা করা হয় ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর। এদের মধ্যে ১৩ জন বিদেশে আত্মগোপন করে আছেন। কারাগারে আছেন ৬ জন, মারা গেছেন ৩ জন। একজনের কোনো হদিস নেই।
এই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আটজনকে ১ লাখ টাকা এবং ১৫ জনকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়। এর মধ্যে পিচ্চি হান্নান র্যাবের ক্রসফায়ার, গণপিটুনিতে আলাউদ্দিন ও কামাল পাশা ওরফে পাশা কারাগারে মারা গেছেন। কালা জাহাঙ্গীর বেঁচে আছেন নাকি আত্মগোপনে, কেউ বলতে পারছেন না। পিচ্চি হেলাল, টিটন, ফ্রিডম সোহেল ও কিলার আব্বাস কারাগারে আছেন। খোরশেদ আলম ওরফে রাশু কিছুদিন আগে ছাড়া পেলেও কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ তাকে আবার আটক করেছে। মশিউর রহমান কচি, সুব্রত বাইন, আমিন রসুল সাগর. ইমাম হোসেন, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, মোল্লা মাসুদ, শামীম আহমেদ, হারিস আহমেদ, তানভিরুল ইসলাম জয়, জাব্বার মুন্না, জাফর আহমেদ, কামরুল হাসান হান্নান ওরফে ছোট হান্নান দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তাদের ধরতে ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করা আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, আত্মগোপনে থাকা সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তাদের ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি আন্ডারওয়ার্ল্ডে একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা চলছে। সম্প্রতি রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনকে গাড়ি থামিয়ে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ভাগ্যক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও গুলিবিদ্ধ এক পথচারী সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে আছেন। এ ঘটনায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন জড়িত বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আন্ডারওয়ার্ল্ড উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও। দেশের বাইরে থাকা সন্ত্রাসীরা নিজেদের সহযোগীদের মাধ্যমে নতুন করে আধিপত্য বিস্তারের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এমনকি কারাগারে থাকা সন্ত্রাসীরাও সহযোগীদের নানা বিষয়ে বার্তা দিচ্ছে। এর মধ্যে কেউ কেউ রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত হতে চাইছে। যে কারণে সন্ত্রাসীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে পুলিশ সদর দপ্তর সব কটি ইউনিট, রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার এসপিদের বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে আত্মগোপনে থাকা সন্ত্রাসীদের বিষয়ে নতুন করে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কারাগার কর্তৃপক্ষকেও হাজতি ও বন্দি সন্ত্রাসীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, যেসব সন্ত্রাসী দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আটক আছে, তাদের একটি তালিকা করেছে একটি সংস্থা। এ বিষয়ে বলা হয়েছে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও তারা জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছে না। তারা কারাগারকেই নিরাপদ মনে করছে।
কারা সূত্র জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম একটি মামলায় জামিন না নেওয়ায় কারাগারে আছেন। বাকি সব মামলার জামিন হয়ে গেছে। ২৭ বছরের কারাজীবনে তার দুইবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। বেশিরভাগ সময় কেটে যাচ্ছে হাসপাতালে থেকেই। হুইলচেয়ারে করে চলাফেরা করেন সব সময়। মোবাইল ফোনে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ করেন সহযোগীদের সঙ্গে। তার স্ত্রী আয়েশা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।
সুইডেন আসলামের বিষয়ে তার এক আত্মীয় দেশ রূপান্তরকে বলেন, এলাকায় তার যখন একক আধিপত্য ছিল, তখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। তারাই এখন তার বিরুদ্ধে। সুইডেন আসলাম বের হয়ে এলে প্রতিপক্ষরাই তাকে মেরে ফেলবে, এমন শঙ্কা আছে। এসব দিক বিবেচনা করেই তিনি বের হতে চাইছেন না। কারাগারেই তিনি ভালো আছেন।
জানা গেছে, সুইডেন আসলামের বিরুদ্ধে মামলাগুলোতে কোনো সাক্ষীও পাওয়া যায় না। ১৯৮৬ সালে তিনি অপরাধ জগতে যুক্ত হন। ওই বছর পূর্ব রাজাবাজারে স্কুলের সামনে কিশোর শাকিলকে গুলি করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। তারপর থেকে তার বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যাকা-সহ নানা অপরাধের তথ্য বের হয়ে আসে। এরই মধ্যে নিজেকে রক্ষা করতে সুইডেন চলে যান। বছর পাঁচেক ওই দেশে থেকে আবার ফিরে আসেন দেশে। তারপর সুইডেন শব্দটি নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। ১৯৯৭ সালের ২৩ মার্চ গালিব খুন হন। এ ঘটনায় আসলামসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ১৯৯৮ সালের ৮ এপ্রিল অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ২৪ সাক্ষীর মধ্যে পুলিশ চারজনকে আদালতে হাজির করতে পেরেছে। বাকিরা আর আসেননি এবং এই মামলায় তিনি জামিনও নেননি।
দীর্ঘদিন কারাগারে থাকলেও আসলাম মোবাইল ফোনে সহযোগীদের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন। স্ত্রী আয়েশা আকতার নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। বলা চলে রাজার হালেই আছেন তিনি।
মিরপুর ও কাফরুল এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার আব্বাস ২২ বছর ধরে কারাগারে আটক আছেন। তার বিরুদ্ধে থাকা ১১টি মামলার জামিন হয়েছে। একটি মামলার জামিন হতে বাকি আছে। তা ছাড়া কমিশনার নিউটন হত্যা মামলায় ফাঁসির আদেশ হলেও উচ্চ আদালতে খালাস পেয়েছেন তিনি। আরেকটি মামলার শুনানি চলছে উচ্চ আদালতে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কিলার আব্বাসের এক সহযোগী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভাইয়ের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কাশিমপুর কারাগারে গিয়ে দেখা করে আসি। দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি কারাগার থেকে বের হতে চাচ্ছেন না। জামিন চাইলে তিনি জামিন পেয়ে যাবেন। কিন্তু ভাই তা করবেন না। কারণ প্রতিপক্ষ সক্রিয় আছে। তার প্রাণ শঙ্কা আছে। আমরা ইচ্ছা করলে যেকোনো সময় জামিন নিয়ে ভাইকে বের করে আনতে পারি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আরেক সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালেরও প্রায় সব মামলার জামিন হয়ে গেছে। শুধু একটা মামলার জামিন বাকি আছে। তিনি যখন কারাগারে, তখন বিএনপি তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করেছিল। অথচ হেলাল বিএনপির রাজনীতি করেন। জেলে বসেই মোহাম্মদপুর, আদাবর ও ধানম-ি, মিরপুর এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন। মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড দখল ও চাঁদাবাজি চালাচ্ছেন। তার সঙ্গে মিরপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদতের ভালো যোগাযোগ। মোবাইল ফোনে নিয়মিত কথা বলেন তারা। তার আরেক সহযোগী হাবিবুর রহমান তাজ ১৩ বছর ধরে কারাগারে আটক আছেন। মামলার সাক্ষীদের হাজির করতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। ইচ্ছে করে জামিনও নিচ্ছেন না তাজ। গ্রেপ্তারের আগে দীর্ঘদিন ভারত পালিয়ে ছিলেন। ২০০৮ সালে ভারতে গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক মাস পর তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে রাজধানীর কাফরুলে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ইসমাইল হোসেনকে হত্যা করার অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তা ছাড়া কলেজছাত্র কামরুল ইসলাম ওরফে মোমিন হত্যার সঙ্গেও জড়িত তাজ। মতিঝিল থানার সাবেক ওসি এ কে এম রফিকুল ইসলামের আশ্রয়-প্রশয়ে থাকতেন তিনি। কয়েক বছর আগে ওসি রফিক মারা যান।’
মতিঝিলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার দুই কর্মকর্তাকে হত্যা করে আলোচনায় আসে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ঈদুল। প্রায় ১৫ বছর ধরে কাশিমপুর কারাগারে আটক আছেন তিনি। একবার পঙ্গু হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকে আটক করে ফেলে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে আটটি মামলা থাকলেও দুটি মামলা বাদে সব কটিতে জামিন পেয়েছেন। বাকি মামলাগুলোতে ইচ্ছা করে জামিন নিচ্ছেন না বলে তার এক স্বজন জানিয়েছেন।
সেভেন স্টার গ্রুপের একসময়ের সদস্য ফ্রিডম সোহেল ধানম-ি ৩২ নম্বরে গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজার আসামি। সাজা কমিয়ে কারাগারেই থাকার চেষ্টা করছেন সোহেল। তার বিরুদ্ধে ১১টি মামলা আছে। ৯টি মামলায় জামিন পেয়েছেন। একটি মামলায় সাজা হয়েছে। আরেকটি মামলায় জামিন নিচ্ছেন না।
তার সহযোগী পুরস্কারঘোষিত সন্ত্রাসী রাশু কিছুদিন আগে কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ তাকে আটক করে। তার এক স্বজন দেশ রূপান্তরকে জানান, মাস দুয়েক আগে সর্বশেষ মামলায় জামিন হয় রাশুর। তার কোনো ইচ্ছা ছিল না কারাগার থেকে বের হওয়ার। আর এ কারণে ইচ্ছা করেই একটি সংস্থাকে কারাগার থেকে বের হওয়ার তথ্য দিয়ে আবার গ্রেপ্তার হন। কারণ তিনি বের হলে প্রতিপক্ষের লোকজন তাকে মেরে ফেলবে এমন আশঙ্কা ছিল। আরেক সন্ত্রাসী লম্বু সেলিম একটি মামলা বাদে সব মামলায় জামিনে আছেন। ভারতের কলকাতা থেকে তাকে পুশব্যাক করা হয়েছিল। প্রায় আট বছর ধরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। বেশিরভাগ সময় হাসপাতালে থাকেন। নিরাপত্তাহীনতার কারণে জেল থেকে বের হচ্ছেন না তিনি।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, সন্ত্রাসীদের কর্মকা- রোধ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নানা কৌশলে কাজ করছে। তারা সরগরম হলেও কাজ হবে না। যারা দেশের বাইরে আছে, তাদের চিহ্নিত করে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ধরার চেষ্টা চলছে। যারা দেশে আছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে পুলিশ-র্যাব কাজ করছে। তবে আন্ডারওয়ার্ল্ডের কেউ বিশ্ঙ্খৃলা তৈরি করতে পারবে না। তিনি বলেন, ‘কোনো সন্ত্রাসী জামিন না নিলে এটা আমাদের করার কিছু নেই। তবে তাদের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, সেদিকে নজর দেওয়া হচ্ছে।’
পুলিশ সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি, চোরাকারবারিসহ ভিন্ন ধরনের অপরাধীরা দুবাই, মালয়েশিয়া, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মগোপন করে আছেন। তাদের সহযোগীরা বাংলাদেশে অবস্থান করে অপরাধমূলক কর্মকা- চালিয়ে আসছেন। তাদের নির্দেশে হত্যাকান্ডের মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছেন তারা। মতিঝিলে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যাকান্ডের পেছনে বিদেশ কানেকশন।
২০০৩ সালে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশের দুই সদস্যকে হত্যার পর পালিয়ে যাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দুবাইয়ে আত্মগোপন করে আছেন। টিপু হত্যাকান্ডের পর তিনি আলোচনায় এসেছিলেন। দুবাইয়ে থাকলেও ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে সবচেয়ে বেশি প্রভাব তার। জিসানের সহযোগী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক ভারতে পালিয়ে আছেন। কিন্তু দেশে তার দখলবাজি, টেন্ডারবাণিজ্য ও চাঁদাবাজিতে নিয়ন্ত্রণ এখনো আছে। মোল্লা মাসুদ ও সুব্রত বাইন ভারতে থেকে সক্রিয় আছেন। তানভীর ইসলাম জয়ও সক্রিয় আছেন। কলকাতা, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ঘুরে তার অবস্থান এখন থাইল্যান্ডে। সেখানে বসেই তিনি কলকাঠি নাড়ছেন।
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃতিক বিস্ময় হাওরের ওপর অত্যাচারের যেন শেষ নেই। ধান-মাছের এই বিপুল ভান্ডার রক্ষার নামে একদিকে চলে স্থায়ী-অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি; যার কারণে যখন-তখন হাওরডুবিতে ঘটে ফসলহানি। পাশাপাশি আরেক দিকে চলে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের নামে অবৈজ্ঞানিকভাবে যত্রতত্র বাঁধ-রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের ধুম; ফলে পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মরতে বসেছে হাওর। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে শেষমেশ সরকারপ্রধান হুকুম দিয়েছেনে ‘হাওরে আর কোনো সড়ক নয়।’
এই পরিস্থিতিতে দেশ রূপান্তরের চোখে ধরা পড়েছে আরেক অশনিসংকেত। এবার শিল্পপতিদের চোখ পড়েছে হাওরে। কোথাও কোথাও থাবাও পড়তে শুরু করেছে। তেমনি সব ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে ভাটি অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হবিগঞ্জ জেলার সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে। এখানে গড়ে উঠেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদনের কারখানা। তৈরি হচ্ছে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প। হাওরের ‘লিলুয়া’ বাতাসে এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে কারখানার দুর্গন্ধ। ‘চান্নি পসর রাইতে’ এখন আর শোনা যায় না বাউলকণ্ঠের দরদি সুর। প্রায় দিনই শিল্পপতিদের আনাগোনার অশুভ পদধ্বনি শুনতে পান হাওরবাসী।
অথচ যেকোনো ধরনের স্থাপনা তৈরি বা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য হওরের স্বাভাবিক পরিবেশ ও জীবনাচরণ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখার নির্দেশনা আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। গত ১৮ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে হাওর অঞ্চলের সড়কগুলো এলিভেটেড করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপর থেকে হাওরাঞ্চলে কোনো সড়ক করতে হলে এলিভেটেড পদ্ধতিতে করতে হবে, যাতে সেখানকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা পায়। সরকারপ্রধানের এমন নির্দেশের পরও থামেনি হাওর ধ্বংসের তৎপরতা।
হাওরে জমি কেনাবেচার হিড়িক
বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট বাজারের অদূরে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের নিচু জমি ভরাট করে বিশাল আকৃতির ছয়টি শেডসহ অনেক স্থাপনা নিয়ে ‘কাজী ফার্ম’ গড়ে তুলেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদন কেন্দ্র। উপজেলার বাগদাইরসহ আরও কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, উপজেলা ও জেলা সদরে যাতায়াতের একমাত্র পথের ধারেই কাজী ফার্মের এই প্রতিষ্ঠান। এখনই নাকে কাপড় দিয়ে দ্রুত পার হতে হয় রাস্তা; আর প্রতিদিন প্রায় ১২ লাখ ডিম উৎপাদনের এই বিশাল কারখানাটি পুরোপুরি চালু হলে দুর্গন্ধে বসবাস করা যাবে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন এলাকাবাসী। স্নানঘাট ভূমি কার্যালয় থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ১৯ একর ৮০ শতক জমি নামজারি হয়েছে। আরও কয়েক একর জমি কিনেছে তারা, যা নামজারির অপেক্ষায়।
গত ১৮ জুন হাওর লাগোয়া বাগদাইর গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হয় স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের সদস্য আলেকজান বিবির সঙ্গে। তিনিসহ আরও কয়েকজন নারী-পুরুষ দেশ রূপান্তরকে বললেন, হাওরের ফসলি জমি ভরাট করে এ ফার্মটি গড়া হয়েছে। এভাবে শিল্প গড়ে উঠলে হাওরের অস্তিত্ব বিলীন হতে আর সময় লাগবে না।
স্থানীয় লিটন মিয়া বললেন, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের ইলাম এলাকায় আকিজ গ্রুপেরও ১৮ বিঘা জমি রয়েছে। উঁচু পাড় বেঁধে আপাতত মাছ চাষ করছে তারা। আগে জমিটির মালিক ছিলেন সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির চৌধুরী। আব্দুল কাদির চৌধুরী জানান, পাঁচ-ছয় বছর আগে তার নিজের জমি ছাড়াও আশপাশের আরও ৫০ বিঘা জমি কিনেছে আকিজ গ্রুপ। আপাতত পুকুর করেছে। ভবিষ্যতে কী করবে, কোম্পানিই জানে।
দীর্ঘদিন ধরে জমি কেনাবেচায় মধ্যস্থতা (দালালি) করেন হারুন মিয়া। তিনি জানান, শুকনো মৌসুমে মাসের ১০ দিনই তাকে হাওরে জমি দেখাতে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন শিল্পপতির সঙ্গে তার মাধ্যমে জমির মালিকদের কথাবার্তা চলছে।
একই পেশার আলী আমজদ বলেন, ইদানীং গুঙ্গিয়াজুরী হাওর এলাকায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লোকজনের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। সালাউদ্দিন নামে ঢাকার এক বাসিন্দা গত মার্চে বন্ধুদের নিয়ে হাওর ঘুরে গেছেন। রাস্তার পাশে তিনি কমপক্ষে ১৫-২০ একর জমি কিনতে চান। তার সঙ্গে আলাপ করে আমজাদ যা বুঝতে পেরেছেন, জমিতে তারা সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে আগ্রহী।
লন্ডনপ্রবাসী নাঈম চৌধুরী জানান, তার ১২ বিঘা জমি কেনার জন্য দামদর ঠিক করেন ঢাকার ব্যবসায়ী জুয়েল খান। সবকিছু ঠিকঠাক করার পর অজ্ঞাত কারণে তিনি সরে যান। নাঈম চৌধুরী পরে জানতে পারেন, কমিশন নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় আইনি পরামর্শক জুয়েল খানকে নিরুৎসাহিত করেন।
হাওর গ্রাসের যত কৌশল
নিচু এলাকা হওয়ায় হাওরে জমির দাম তুলনামূলক কম। এখনো এক বিঘা (৩৩ শতক) জমি ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে বেচাকেনা হয়। পুটিজুরী গ্রামের বাসিন্দা টেনু মিয়া বলেন, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলা অংশে গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই-চার কিলোমিটার দূরেই ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, বিবিয়ানা গ্যাস কূপ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। আবার হাওর এলাকা স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারিও তেমন থাকে না। ফলে ড্রেজিং মেশিন দিয়ে জমি থেকে বালু তুলে অন্য অংশ ভরাট করে ফেলা সহজ হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ভরাট করা হয়। এভাবে সহজেই হাওরের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ফেলা হয়।
স্থানীয় নবীর হোসেন বলেন, জমির শ্রেণি পরিবর্তনের অনুমোদন নেওয়া সময়সাপেক্ষ ও বেশ ঝামেলার কাজ। নবীগঞ্জ ও বাহুবল ভূমি অফিসের কয়েকজন তহশিলদারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে তাদের না জানিয়েই শিল্পপতিরা সব কাজ সেরে ফেলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী কৃষিজমিতে শিল্প বা আবাসিক এলাকা তৈরির জন্য জমি কেনার আগেই জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হয়। আবেদনটি প্রথমে জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে পাঠাবেন। ইউএনও তখন উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে প্রতিবেদন চাইবেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (তহশিলদার) সরেজমিন পরিদর্শন এবং কৃষি, মৎস্য ও বন বিভাগের মতামত পাওয়ার পর জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবেন। এর পর জেলা প্রশাসক সেই অনুমোদন দিতে পারেন।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কোনো অনুমোদনেরই তোয়াক্কা করেন না শিল্পপতিরা। আবার কেউ জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন করলে তখন চাপের মুখে স্থানীয় প্রশাসনকে শিল্পপতিদের পক্ষেই প্রতিবেদন দিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরেজমিন পরিদর্শনে ভূমির যে শ্রেণি পাওয়া যায়, সেই মোতাবেক ভূমি কর আদায় করে নতুন শ্রেণির বৈধতা দিয়ে দেওয়া হয়।
শিল্পপতিরা রাস্তার পাশে প্রথমে এক-দুই একর জমি একটু বেশি দাম দিয়ে কিনে পরে পেছনের জমি প্রায় পানির দরে কেনেন বলে জানান স্নানঘাট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার আবুল কালাম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, সাধারণত শিল্প মালিকরা দালাল দিয়ে জমি কিনতে চান। কারণ, তারা সরাসরি কিনতে এলে দাম বেশি চাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আরেক মধ্যস্থতাকারী শামসু মিয়া বলেন, ‘বেশি জমি কেনার ইচ্ছা থাকলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। আমরা কম দামে কিনে দিয়ে বেশি কমিশন নেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ, আমাদের আয়ের একটা অংশ ভূমি শাখার কর্মকর্তাদেরও দিতে হয়। নইলে জমির কাগজপত্র যত স্বচ্ছই হোক, তারা “ঘিয়ের মধ্যে কাঁটা” বের করার চেষ্টা করেন।’
এ ছাড়া স্থানীয় বা বহিরাগতদের উদ্যোগে পুকুরের নাম করে হাওর এলাকার যেখানে-সেখানে মাটি খনন করা হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, আইন বা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ড্রেজার বসিয়ে কৃষিজমি থেকে দেদার বালু তোলা হচ্ছে।
জমি নিয়ে লুকোচুরি
হবিগঞ্জের ১৩টি হাওরের মোট আয়তন ৭৩ লাখ ৫৭৯ একর। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের অবস্থান জেলার বাহুবল, নবীগঞ্জ, বানিয়াচঙ্গ ও সদর উপজেলা ঘেঁষে। এই হাওরে কী পরিমাণ জমি ছিল বা এখন কতটুকু আছে, তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায়নি সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেও।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সর্বশেষ হিসাবে, এই হাওরের জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ৮৩৩ একর। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ৬৪ হাজার ২২০ একর। ৮ বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৭ সালে পরিসংখ্যান বিভাগের প্রকাশিত হিসাবে হাওরের আয়তন দেখানো হয়েছে ১৬ হাজার ৪২৯ একর। জেলা মৎস্য অফিস জানিয়েছে, এই হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৩৯৯ একর ৪ শতক। চারটি অফিসের কর্মকর্তারাই তাদের হিসাব সঠিক বলে দাবি করছেন। আরেকটি রহস্যময় বিষয় হলো, চারটি উপজেলা ঘেঁষে এই হাওরের অবস্থান হলেও ওই চার সরকারি প্রতিষ্ঠানই বানিয়াচঙ্গ ছাড়া বাকি তিন উপজেলার হিসাব দেখাচ্ছে।
১০ বছর আগে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে জমির পরিমাণ কত ছিল জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এক মাস সময় নিয়েও কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
ওদিকে ২০১৬ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন হাওর ও জলাভূমি অধিদপ্তরের প্রকাশিত ‘ক্লাসিফিকেশন অব ওয়েটল্যান্ড অব বাংলাদেশ ভলিউম-৩’-এ দেখা যায়, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের মোট আয়তন ৬৯ হাজার ৮২৯ একর ৩৭ শতক। এর মধ্যে বাহুবল উপজেলায় ৩০ হাজার ১৫৬ একর ২০ শতক, বানিয়াচঙ্গ উপজেলায় ১৭ একর ২০ শতক, হবিগঞ্জ সদর ১৫ হাজার ৯০১ একর ৮৬ শতক ও নবীগঞ্জে ২৩ হাজার ৭৫৩ একর ৯৯ শতক।
হাওর এলাকায় দিনে দিনে জনবসতি বৃদ্ধি, হাজার হাজার পুকুর তৈরি, জমি ভরাট করে শিল্প-কারখানা স্থাপনের কারণে আগের চেয়ে এখন কৃষিজমির পরিমাণ অনেকটাই কমে আসছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. নূরে আলম সিদ্দিকী।
গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের আওতাধীন বাহুবল উপজেলার সাতকাপন ও স্নানঘাট ইউনিয়নের ছয়টি মৌজার নাম উল্লেখ করে গত ১০ বছরে কী পরিমাণ জমি বিক্রি করা হয়েছে, উল্লিখিত সময়ে জমির মূল্য কত ছিল জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার সুশান্ত ঘোষ এবং জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মৌজা হিসাব করে জমি কেনাবেচার তথ্য সংরক্ষণ করা হয় না। এসব উত্তর দিতে হলে প্রতিটি দলিল তল্লাশি করে বের করতে হবে, যা ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ।’
আবেদন-অনুমোদন খেলা
স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জানান, কাজী ফার্মের বিক্রি হওয়া জমির মধ্যে ৭৮ বিঘায় আগে তারা বর্গাচাষ করেছেন দীর্ঘদিন। ২০১৮ সালের দিকে জমির মালিকরা কাজী ফার্ম লিমিটেডের কাছে বিক্রি করে দেন। পরে কাজী ফার্ম প্রায় দুই বছর ধরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তুলে পুরো জমি উঁচু করে নেয়। তবে নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, এই জমির আগের মালিকের দলিল এবং বর্তমানে কাজী ফার্মের দলিল- দুই জায়গাতেই এটি এখনো ‘কৃষি’ শ্রেণি হিসেবেই আছে।
সরেজমিনে জানা যায়, চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের তলদেশ থেকে বালু তুলে বাহুবলে নির্মাণাধীন কয়েকটি স্থাপনা ও ছয় লেনের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করতে স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা মৎস্যজীবী লীগের নেতা তাজুল ইসলাম একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। হাওরে থাকা তার জমিতে ‘দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য’ বানানোর কথা বলে মাটি কেটে পাড় তৈরির অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন তিনি। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান এ বিষয়ে ইউএনও ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) প্রতিবেদন দিতে বলেন। অভিযোগ উঠেছে, ওই সিন্ডিকেট বাহুবল উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তাদের পক্ষে প্রতিবেদন করায়। প্রতিবেদন পেয়ে কয়েকটি শর্ত দিয়ে জেলা প্রশাসক মাটি কাটার অনুমোদন দেন। বাণিজ্যিক কাজে তাজুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের দীর্ঘদিন ধরে বালু তোলার বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানান স্থানীয় কৃষকরা। এ নিয়ে দেশ রূপান্তরসহ স্থানীয় পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে জেলা প্রশাসন তদন্ত করে এর সত্যতা পায় এবং অনুমোদন বাতিল করে। সরেজমিনে দেখা গেছে, বালু তোলা বন্ধ হলেও এখনো ড্রেজার মেশিন ও পাইপলাইন সরানো হয়নি।
গত ১৪ আগস্ট পরিবেশ অধিদপ্তর, হবিগঞ্জ কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, কাজী ফার্ম বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ডিজাইন না দেওয়ায় তাদের পরিবেশ ছাড়পত্রের আবেদন বাতিল করা হয়েছে। একই দিন জেলা প্রশাসন অফিসের রাজস্ব শাখায় যোগাযোগ করে জানা গেছে, কাজী ফার্ম বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য কোনো আবেদনই করেনি। অফিস সহকারী আব্দুল ওয়াদুদ বিভিন্ন ফাইলপত্র ঘেঁটে ওই কোম্পানির মাধবপুর উপজেলায় কয়েকটি প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন পেয়েছেন।
আব্দুল ওয়াদুদ জানান, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় ৫ একর ৭৪ শতক জমি শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ নামে একটি কোম্পানির আবেদন গত ২৩ জানুয়ারি মঞ্জুর হয়েছে। এ ছাড়া ওই কোম্পানি হাওর থেকে দুই-তিন কিলোমিটর দূরে পশ্চিম ম-লকাপন, হায়দরচক মৌজার ৬টি প্রজেক্টের জন্য প্রায় ৬৩ একর জমি কিনেছে। এগুলোর মধ্যে দুই-একটি বাদে বাকিগুলোর শ্রেণি পরিবর্তন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গড়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য হাওরের দিকেই ধাবিত হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনবে।
শিল্পপতি পক্ষের ভাষ্য
জানতে চাইলে কাজী ফার্মের ম্যানেজার (অ্যাডমিন) জিয়াউল হক দেশ রূপান্তরের কাছে দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা আছে। গত ৭ আগস্ট মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে জিয়াউল হক জানান, বাহুবল স্নানঘাটে তাদের প্রতিষ্ঠানে ডিম উৎপাদন পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। এখানে লেয়ার মুরগির ডিম ছাড়াও কম্পোস্ট সার উৎপাদন হবে। এসব মুরগি খুবই স্পর্শকাতর। পরিবেশ একটি বড় বিষয়। যদি এখানকার পরিবেশ অনুকূলে থাকে, তাহলে আরও কী কী উৎপাদন করা যাবে তা পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বায়ুদূষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশে^র নামকরা প্রতিষ্ঠান জার্মানির ‘বিগ ডাচম্যান’-এর সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। ফলে প্রকট দুর্গন্ধ বেরোনোর শঙ্কা খুবই কম। তবে তিনি এও বলেন, সব প্রাণীর শরীরেই গন্ধ থাকে। লাখ লাখ মুরগি যেখানে থাকবে, সেখানে কিছু গন্ধ তো হবেই।
মুরগির বিষ্ঠা সংরক্ষণের ব্যাপারে জিয়াউল হক বলেন, এর গন্ধ বের হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে গন্ধ দূর করা হয়। হাওরের জমি ভরাট করে শিল্প গড়ার আইনি দিক সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছাড়া এ-সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়।’
গত ২৪ আগস্ট বাহুবল উপজেলার আব্দাকামাল এলাকায় আকিজ ভেঞ্চার গ্রুপের নির্মাণাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্থানীয় ম্যানেজার (অ্যাডমিন) হাবিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, উপজেলার পুটিজুরী, সাতকাপন, স্নানঘাট ইউনিয়নের বিভিন্ন মৌজায় আকিজ গ্রুপের জমি রয়েছে। বর্তমানে আব্দাকামাল এলাকায় প্রায় ৬৫ একর জমিতে বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনের কাজ চলছে। গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই কিলোমিটারের মতো দূরে এই ‘শিল্পপার্ক’ নির্মাণের পর হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় তাদের আরও যে ৫৭৪ শতক জমি রয়েছে, তাতে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প গড়ে তোলা হবে। তিনি দাবি করেন, ইতিমধ্যে প্রশাসনের কাছ থেকে তারা জমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছেন।
‘খুবই অন্যায় হবে’
পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, হাওরে নিচু জমি ভরাট করে যদি শিল্প গড়া হয়, তাহলে পরিবেশের ওপর খুবই অন্যায় করা হবে। প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে হাওরের পানি প্রবাহ ও পানি ধরে রাখার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে এমন অবকাঠামো করা যাবে না। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের সময় হাওরের পানি প্রবাহ যাতে সঠিক থাকে, এ জন্য তিনি সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডিকে।
তিনি আরও বলেন, ‘উজান থেকে নেমে আসা পানির সঙ্গে বালু আসার ফলে অধিকাংশ হাওরের বুক বালুমাটি এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। হাওর ও বিলগুলোকে পুনঃখনন করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। এখন সেখানে যদি মাটি ভরাট করে শিল্প গড়া হয়, সেটা কখনোই কাম্য নয়।’
লাক্সারিয়াস জীবন পাওয়ার জন্য এখন মানুষ দিনরাত শুধুই কাজ করে চলেছেন। যার মধ্যে অফিস ডেস্কে বসে কাজ করেন এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চেয়ারে বসে ল্যাপটপের সামনে তাকিয়ে থাকা রীতিমতো যন্ত্রণাদায়ক।
শুধু তাই নয়, এটা স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। যারা অফিসে ডেস্কে কাজ করেন তাদের মোটা হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
সারাদিন যারা ডেস্কে বসে কাজ করেন তাদের অন্যতম অভিযোগও এটি। তারা বলে থাকেন, চেয়ারে বসে কাজ করে মোটা হয়ে যাচ্ছি! তবে এই অজুহাতকে একেবারে সত্য বলার সুযোগ নেই। কারণ ডেস্কে বসে কাজ করেও স্লিম ও ফিট থাকা সম্ভব। এজন্য মেনে চলুন পাঁচটি টিপস।
হাঁটুনফিট ও কর্মক্ষম থাকতে নিয়মিত হাঁটুন। দিনের পর দিন দীর্ঘ সময় বসে থাকলে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। সুস্থ থাকতে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করুন। এমনকি কাজের ফাঁকেও ১০ মিনিটের ব্রেক নিয়ে হেঁটে আসতে পারেন।
সোজা হয়ে বসুনচেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসুন। মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলোতে অনেক চাপ পড়ে, সেই সঙ্গে চাপ পড়ে মেরুদণ্ডের পাশের মাংসপেশি ও লিগামেন্টের ওপর। কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় মনিটরটি চোখের সমান স্তরে রাখুন। মাউস ব্যবহার করার সময় শুধু আপনার কব্জি নয় পুরো হাত ব্যবহার করুন।
চাপ এড়িয়ে চলুনএটা খুব কঠিন কাজ, চাপমুক্ত থাকা। বিশেষ করে যখন চারপাশ থেকে নানা ধরনের চাপ আসতে থাকে। তবে মানসিক স্থিরতা ধরে রাখুন, নিজেকে মোটিভেট করুন। কোনও চাপই বেশি দিন থাকে না, এগুলো নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট না করে নিজের কাজে মনোযোগ বাড়ান। এক্ষেত্রে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে অনলাইনে কিছু যোগা শিখে অভ্যাস করুন।
চোখের যত্নকম্পিউটারে কাজ করার সময় স্ক্রিনে একটানা ১০-১৫ মিনিটের বেশি তাকিয়ে থাকবেন না। নিয়মিত চোখের পাতা ফেলুন। স্ক্রিনে পর্যাপ্ত আলো রাখুন, যেন চোখের ওপর বাড়তি চাপ না পড়ে।
হাড়ের যত্ন বসে থাকার ফলে হাড় দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ক্যালসিয়ামের ঘাটতিও হতে পারে। এজন্য নজর দিতে হবে প্রতিদিনের খাবারে স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে নিয়মিত ডিম, দুধ, দই ও বাদাম রাখুন।