
দৈনিক ইত্তেফাকে কলাম লিখতেন- ‘মোসাফির’ নামে। অসাধারণ শব্দনৈপুণ্যে বিদ্ধ করতেন পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আইয়ুব খানকে। সেইসময় অসংখ্যবার তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন, কারাবরণ করেছেন। অতীতের সঙ্গে অধুনার সংযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে আজ ছাপা হলো, সেই উপসম্পাদকীয়
পারতসাধ্যে পাকিস্তান রেডিও শুনি না। সরকারী প্রচারযন্ত্রে এই ধরনের একতরফা প্রচারের নজির বিশেষত: নির্বাচনকালে দুনিয়ার কোন গণতান্ত্রিক দেশে নাই। গত ১৫ই নভেম্বর ঢাকা মেল ধরিবার উদ্দেশ্যে সন্ধ্যা ৬টা হইতে রাত্রি সাড়ে ৮টা পর্যন্ত একটি প্ল্যাটফরমে অবস্থান করিতেছিলাম। সেখানে একটি ট্রানজিস্টারে ৬টা ৭টা ও রাত্রি ৮টার তিনটি নিউজ বুলেটিনেই অর্থমন্ত্রী শোয়েব সাহেবের প্রচারিত একটি বিবৃতি একইভাবে প্রচার করা হইল। বর্তমান শাসনামলে পুঁজিপতি শিল্পপতিদের সৌভাগ্য ও উন্নতিকে দেশবাসীর উন্নতি-অগ্রগতি বলিয়া চালাইবার প্রচেষ্টাই ছিল এই বিবৃতির লক্ষ্য। আর সেই বিবৃতি দুই ঘণ্টার মধ্যে তিনবার প্রচারিত হইলে শ্রোতাদের মনে বিরক্তিভাব না জাগিয়া পারে না, রেডিও কর্তৃপক্ষের সেদিকেও নজর নাই। কর্তার ইচ্ছায় কের্তন! তাই শ্রোতাদের ভাল লাগুক আর না লাগুক, শুভ প্রতিক্রিয়ার পরিবর্তে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হউক আর যাই হউক, তার প্রতি লক্ষ্য দিবার এখতিয়ার তাঁদের নাই। আফসোস হয় কর্তাব্যক্তিদের জন্য- যারা জানেন যে, রেডিও এবং অন্যান্য প্রচারযন্ত্র মারফত ছয় বৎসর ধরিয়া একতরফা প্রচার চালাইয়াও জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব হয় নাই এবং হয় নাই বলিয়াই সর্বত্র বর্তমান শাসক ও শাসন-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব গণবিক্ষোভ দেখা দিয়াছে। এই ত্যক্তকর নিউজ-বুলেটিন প্রচারের পরে হঠাৎ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের বেতার ভাষণ শ্রুত হইল।
প্রথম দিকে তিনি ভাল ভাল কথাই বলিয়াছেন নির্বাচনকালে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় জনগণের সহযোগিতার কথাই বলিয়াছেন। পর্যুদস্ত ছদ্মবেশী কনভেনশনপন্থী প্রার্থীরা এখানে-ওখানে গু-ামির আশ্রয় নিলেও প্রদেশের প্রধান প্রশাসক হিসাবে গভর্নরের এই আবেদনের একটা নৈতিক দিক রহিয়াছে। কিন্তু আফসোস, এই আবেদনটুকু শেষ হইতেই তিনি রাজনৈতিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হইয়া বেতার মারফত এমন কতকগুলি কথা বলিলেন যাহা শুধু বিতর্কমূলকই নয়, বিভ্রান্তিমূলকও বটে। তিনি অবশ্য মি. হাশিমুদ্দীনের মতো নির্লজ্জ দাবী করিতে ভরসা পান নাই যে, কনভেনশনপন্থীরা শতকরা ৮০টি আসন দখল করিতেছে। তবে তিনি নির্বাচকমন্ডলীর নির্বাচনে শতকরা ৮৫ জন ভোটারের অংশগ্রহণকে বর্তমান শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের সমর্থন বলিয়া দাবী করিয়াছেন। এবং রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে কটাক্ষের সুরে বলিয়াছেন যে, জনগণের যদি ভোটাধিকার না থাকিবে, তাহা হইলে দ্বারে দ্বারে ভোট ভিক্ষা করা হইতেছে কেন? গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির নিকট হইতে এই ধরনের বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা কেহ আশা করে নাই। সুস্পষ্ট নীতির ভিত্তিতে নির্বাচকম-লীর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইতেছে।
মোহতারেমা মিস ফাতেমা জিন্নার নেতৃত্বে জনগণের ছিনাইয়া নেওয়া ভোটাধিকার ফিরিয়া পাইবার দাবীতেই এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইতেছে। এই ৪০ বৎসরের মধ্যে ইউনিয়ন বোর্ড ইলেকশনে কখনও গোটা দেশবাসীর মধ্যে এইরূপ প্রাণচাঞ্চল্য ও জাগরণ লক্ষ্য করা যায় নাই; স্থানীয় লোকজনেরাই স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে ইহাতে উৎসুক্য প্রদর্শন ও অংশগ্রহণ করিয়াছে। আজিকার দাবী হইল আইন পরিষদের প্রতিনিধি এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনগণের সরাসরি ভোটাধিকার ফিরাইয়া পাওয়া এবং ইউনিয়ন কাউন্সিলকে স্বায়ত্তশাসিত স্থানীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে মর্যাদার সহিত অব্যাহত রাখা। তাই যাঁরা এই নির্বাচনে জনগণের উৎসাহ-উদ্দীপনাকে ভোটাধিকার বঞ্চিত করিয়া রাখার পক্ষে জনগণের সম্মতি বলিয়া প্রচার করিতে পারেন, তাদের সত্যের প্রতি যে কোন শ্রদ্ধা নাই তাহা না বলিয়া উপায় থাকে না। আমার নিজ অভিজ্ঞতা হইতে বলিতে পারি যে, একদম কাট্টা কনভেনশনপন্থী চেয়ারম্যান-মেম্বাররও আইয়ুব সাহেবকে ভোট দিবেন এই কথা বলিতে পারিতেছেন না। তারাও মিস জিন্নাকে ভোট দিবেন বলিয়া প্রতিশ্রুতি দিতেছেন; বড় জোর দুই-এক জায়গায় তাঁরা বলিতেছেন, জনগণ যাকে ভোট দিতে বলিবেন, সেদিকেই তাঁরা ভোট দিবেন।
আমরা জানি, আইয়ুব সাহেব ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকিবার জন্য যে কোনো পন্থা অবলম্বন করিতে পারেন। তার কারণও আছে। কিন্তু যাঁরা বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত থাকিয়া জনমতের এবং দেশবাসীর স্বার্থে বিরুদ্ধাচরণ করিয়া কর্তার ইচ্ছায় কের্তন করেন কিংবা নিজেকে অতিভক্ত ও উৎসাহী বলিয়া প্রমাণ দিতে চেষ্টা করিতেছেন, তাঁদের উদ্দেশে আমাদের কিছুটা বক্তব্য আছে। আইয়ুব সাহেবের নিজ প্রদত্ত বিবৃতি মতেই তিনি যখন ১৯৫৮ সালের ৮ই অক্টোবর ‘বিপ্লব’ অনুষ্ঠান করেন, তখন সামরিক হেড কোয়ার্টারে মাত্র চারিজন জেনারেলকে তিনি এই বিপ্লবের কথা জানান। জনাবরা একবার তাকাইয়া দেখুন, যাদের সহযোগিতায় সামরিক অভ্যুত্থান মারফত তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হইয়াছিলেন, আজ তাঁরা কোথায়। তাদের একজনও তাঁর সাথে আছেন? তাঁদের একজনও সাথে নাই; সবাইকে অপসারণ করা হইয়াছে; জেনারেল আজমের সহিত নীতির প্রশ্নে বিরোধ দেখা দেওয়ায় তিনি তো এখন মোহতারেমা মিস ফাতেমা জিন্নার একজন পহেলা কাতারের সমর্থক। এই তো গেল চারিজন জেনারেলের কথা। জেনারেল ছাড়া যে-সকল বেসামরিক লোকজনকে তিনি বড় বড় পদ দিয়া সমর্থক সাজাইয়াছিলেন, তাঁরাই-বা আজ কে কোথায়?
কোন ব্যক্তিবিশেষ বা দলবিশেষের বিরুদ্ধে আমাদের কোন ব্যক্তিগত বিদ্বেষ নাই। রাষ্ট্রে জনগণের অধিকার তথা আমাদের সকলের অধিকার যাঁরাই মানিয়া নিবেন, দলমত নির্বিশেষে তাঁরা সকলেই আমাদের বন্ধু। জনগণের সরাসরি ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচনের নীতি স্বীকৃত হইলে জনগণই ভোটের মাধ্যমে কোন্ ব্যক্তি বা কোন্ দলকে শাসনক্ষমতায় বসাইবে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবে। তাই যাঁরা জনগণকে সরাসরি প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার দিতে নারাজ, তাঁদের বিরুদ্ধাচরণ করা ছাড়া উপায় কি?
আইয়ুব সাহেবের অসুবিধা কোথায়, তাহা আমরা কিছু কিছু জানি। তিনি আজ জনমতের চাপে পড়িয়া সামরিক অভ্যুত্থানের দায়িত্ব এড়াইতে চাহিলেও তাঁর তৎকালীন বিবৃতি-বক্তৃতার উদ্ধৃতি দিয়া দেখানো হইয়াছে যে, তিনিই ছিলেন এই ‘বিপ্লবের’ প্রকৃত অধিনায়ক। তবু যদি তর্কের খাতিরে ধরিয়াও নেই যে, তিনি নিজে উদ্যোগী হইয়া ‘বিপ্লব’ অনুষ্ঠান করেন নাই, তাহা হইলে তাঁকে সোজাভাবে জিজ্ঞাসা করা যায়, তিনি ছয় বৎসর ক্ষমতা ভোগ করার পরেও আজও দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরাইয়া আনিতে তথা জনগণকে সরাসরি প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার ফিরাইয়া দিয়া গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা প্রবর্তনে অনিচ্ছুক কেন? প্রকৃত অবস্থা হইল, তিনি যে শাসনতন্ত্র রক্ষা করিবার শপথ গ্রহণ করিয়াছিলেন, সেই ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র বাতিল করার ব্যাপারে তাঁর হাত ছিল। তিনিই প্রধানমন্ত্রী হিসাবে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জার প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করিয়া তিন দিনের মধ্যে তাহা ভংগ করিয়া তিনি প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক শাসকের দুইটি পদই দখল করেন। তিনিই জনগণের সুখ-শান্তি বিধান, দেশ হইতে দুর্নীতি, স্বজন-প্রীতির উচ্ছেদ, মুনাফাশিকারী- চোরাকারবারীদের শায়েস্তা করার এবং দেশ হইতে কোটারী স্বার্থের মূলোচ্ছেদ করিয়া দেশে সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে-সকল প্রতিশ্রুতি দিয়া ছিলেন একে একে সেগুলিকেও ভঙ্গ করিয়াছেন।
সামরিক শাসন প্রবর্তনের পর দুই মাস যাইতে না যাইতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাইতে থাকে এবং আজ উহা গগনচুম্বী; অবাধ অর্থনীতির নামে তিনি মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ী- শিল্পপতিকে অবাধ মুনাফা অর্জনের সুযোগ দিয়াছেন; এক শ্রেণীর পুঁজিপতি-শিল্পপতি ও আমলাতন্ত্রের যোগসাজশে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গ্রামাঞ্চলে দুর্নীতি ও অনাচার ব্যাপক আকার ধারণ করিয়াছে; শাসন-ব্যবস্থার ব্যয় হ্রাসের প্রতিশ্রুতি দিলেও ব্যয়ভার কমাইবার পরিবর্তে পাঁচগুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে; বৈদেশিক দেনা তেত্রিশ গুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে। এভাবে দেশ দেনায় ডুবু ডুবু এবং অপরদিকে দেশের সম্পদ ও ঐশ্বর্য মুষ্টিমেয় লোকের কুক্ষিগত হইয়া পড়িয়াছে এবং এই কুক্ষিগত হইয়া পড়িবার ফলে শুধু মুনাফাশিকারীরাই আসকারা লাভ করে নাই, এই স্বার্থবাদী ব্যবসায়ী-শিল্পপতি এবং এক শ্রেণীর দুর্নীতিপরায়ণ গণবিরোধী আমলাতন্ত্রের বদৌলতে দেশের সর্বত্র দুর্নীতির তা-ব নৃত্য সৃষ্টি হইয়াছে।
মৌলিক গণতন্ত্রীদের ইলেকটোরাল কলেজে পরিণত করাও এই ধরনের জনগণকে ডিঙ্গানোর একটি ব্যবস্থা। গ্রামাঞ্চলের সত্যিকার উন্নয়ন বিধানই যদি তাঁর কাম্য হইত তাহা হইলে ইউনিয়ন কাউন্সিলের হস্তে উৎপাদনমূলক কার্যে ব্যয় করিবার জন্য অর্থ প্রদান করিতেন। ১০ কোটি মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে জনগণের ভোটাধিকার মাত্র ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রীর উপর ন্যস্ত করিয়া ইহাদেরও বিব্রত করিতেন না, আর জনগণকেও বিক্ষুব্ধ করিতেন না। কেনাবেচার আশ্রয় নেওয়াই যে আইয়ুব উদ্ভাবিত এই ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য, তাহাও আজ দেশবাসীর নিকট স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে।
যেখানে আজ জনগণের ভোটাধিকার ফিরাইয়া পাইবার সুনির্দিষ্ট ইস্যুর উপর ইলেকটোরাল কলেজের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইতেছে, যেখানে আজ ছদ্মবেশী প্রার্থীরাও কোথায়ও ‘আইয়ুব সাহেবকে ভোট দিব এই কথা বলিয়া ভোট যাচনা করিতে ভরসা পাইতেছে না, সেখানে গৃহকোণে বসিয়া আইয়ুব সাহেবের অনুগ্রহভোগীরা দাবী করিতেছেন যে, এই নির্বাচনে আইয়ুব সাহেবের সমর্থনে ৮০% আসন দখল করা হইতেছে প্রসঙ্গতঃ সম্মিলিত বিরোধী দল হইতে যাদেরকে কনভেনশনপন্থী বলিয়া স্বীকার করিয়া লওয়া হইতেছে, তারাও প্রকৃত প্রস্তাবে কোথায়ও কনভেনশনপন্থী বিশেষত: আইয়ুব সাহেবকে ভোট দিবেন এ পরিচয় দিতে পারেন নাই। তাই তাঁদের জয়ী হওয়ার প্রশ্ন অলীক হইলেও ইহার গূঢ় উদ্দেশ্য হইল ভোট ক্রয়ের পথ খোলা রাখা। এটা তাঁদের শেষ প্রচেষ্টা। কিন্তু জনসাধারণের বিরুদ্ধে সৃষ্ট বেড়াজাল যেমনি একে একে গণজাগরণের মুখে ছিন্ন ভিন্ন হইয়া পড়িতেছে, তেমনি এই শেষ প্রচেষ্টাও একইভাবে ব্যর্থ হইবে।
১৯৪৬ সালের পাকিস্তান ইস্যুর উপর নির্বাচনেও একই অবস্থা লক্ষ্য করিয়াছি, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনেও তাহাই দেখিয়াছি। গ্রামীণ জনগণের ঐক্য ও সচেতনতাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা সম্ভব করিয়াছিল; ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের বিজয় তাদের দ্বারাই সম্ভব হইয়াছিল। যুক্তফ্রন্টের দোষ-ত্রুটি সত্ত্বেও জনগণের এই ছত্র বৃথা যায় নাই। কারণ, সেই বিজয়ের প্রতিক্রিয়ায় বাংলা ভাষা বিরোধীরা নিরস্ত হয় এবং বাংলা ভাষা রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা লাভ করে। সেই বিজয়ের ফলেই এই প্রদেশে বিনাবিচারে আটক প্রথা রদ করা হয় এবং এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে ইহা একটি নজির হইয়া দাঁড়ায় : এই বিজয়ের ফলেই দেশবাসী ১৯৫৬ সালে একটি গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র লাভ করে; এই বিজয়ের সুফল হিসাবেই শিল্প-বাণিজ্য বিকেন্দ্রীকরণ করিয়া প্রদেশের হতে অর্পিত হয়; এই বিজয়ের ফলেই দেশে জনগণের সরাসরি ভোটে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাদি সম্পূর্ণ করা হয়। সেই কায়েমি স্বার্থবাদ আজ পাকিস্তানের বুকে জগদ্দল পাথরের মতো চাপিয়া বসিয়াছে, যারা দেশের শিল্প-বাণিজ্য ও সম্পদকে নিজেদের কুক্ষিগত করিয়া রাখিয়া আপামর জনগণকে পথে বসাইয়াছে, হয়তো তাদেরই পর্যালোচনায় আইয়ুব সাহেব দেশের সেই গণতান্ত্রিক অগ্রগতিকে এক আঘাতে গতিহীন করিয়া রাখিয়াছিলেন।
আজ জনতা জাগিয়াছে, রাষ্ট্রে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর হইয়াছে। এক্ষণে দুনিয়ায় এমন কোন শক্তি নাই, যাহা জনগণের এই অগ্রগতিকে প্রতিহত করিতে পারে। জনগণকে বিভ্রান্ত করিবার জন্য যে সকল ফন্দি-ফিকির আঁটা হইয়াছিল, তাহাও একে একে নস্যাৎ হইতেছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবেই পশ্চিম পাকিস্তানে নির্বাচন আগে দেওয়া হইয়াছিল এই আশায় যে, সেখানে ভয়-ভীতি-ত্রাস সৃষ্টি করিয়া এবং একচেটিয়া পুঁজিপতি শিল্পপতিদের অর্থে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে নির্বাচন প্রভাবিত করা যাইবে এবং তাহা দেখাইয়া রাজনীতি-সচেতন পূর্ব পাকিস্তানিদের মনোবল দাবাইয়া দিয়া কিস্তিমাত করা যাইবে। ফল দাঁড়াইয়াছে বিপরীত। সেখানেও ক্ষমতাসীনদের ভরাডুবি হইয়াছে। এক্ষণে সেখানে নির্বাচকম-লীর সদস্যদের ট্রেনিং প্রদানের বাহানা তুলিয়া এবং মৌলিক গণাস্থার প্রতি ভুয়া দরদ দেখাইয়া তাঁদেরকে বাগে আলিবার নিষ্ফল চেষ্টা চালাইতে হইতেছে। মুখে নির্লজ্জ বাগাড়ম্বর করা হইলেও পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতাসীনদের অবস্থা পশ্চিম পাকিস্তান অপেক্ষাও করুণ ও শোচনীয়। (ঈষৎ সংক্ষেপিত)
লেখক: তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া
প্রতিষ্ঠাতা, দৈনিক ইত্তেফাক ১৮ নভেম্বর, ১৯৬৪
দেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর অন্যতম বিষয় হচ্ছে, দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া। এ নিয়ে সংসদে উত্তপ্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, অর্থ পাচারকারী কারা, যদি সেই তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন, তাহলে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া অর্থমন্ত্রীর পক্ষে সহজ হবে। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘কারা অর্থ পাচার করে, সেই তালিকা আমার কাছে নেই। নামগুলো যদি আপনারা জানেন যে, এরা এরা অর্থ পাচার করেন, আমাদের দিন।’ তারপর সময় গড়িয়েছে অনেক। কিছু টাকা পাচারকারীর নাম এসেছে পত্রপত্রিকায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, দুদকের কিছু তৎপরতাও দেখেছে জনগণ। কিন্তু এ পর্যন্তই। পরবর্তী সময় এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য আর কোনো শোনা যায়নি।
ইতিমধ্যে খবর বেরিয়েছে, একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের মালিক সিঙ্গাপুরে কমপক্ষে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিদেশে বিনিয়োগ বা অর্থ স্থানান্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে এ সংক্রান্ত কোনো অনুমতি তিনি নেননি। সবাই জানেন, এই গ্রুপের মালিকানায় বাংলাদেশে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও একাধিক ব্যাংক আছে। এটা কোনো জাদুমন্ত্রে ঘটেনি। ইসলামী ব্যাংক থেকে তারা একাই ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। এর আগে দুটি ভুয়া কোম্পানি খুলে, একই ব্যাংক থেকে দুই হাজার ৪৬০ কোটি টাকা নেওয়া হয় ঋণের নামে এবং আরও কয়েকটি ব্যাংক থেকে নেওয়া হয় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ঋণ নিয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা। পুকুরে ঢিল ছুড়লে যেমন ঢেউ উঠে এবং কিছুক্ষণ পরে মিলিয়ে যায় তেমনি বাংলাদেশের দুর্নীতিসংক্রান্ত সংবাদের পুকুরে এসব খবর ঢেউ তুলে মিলিয়ে যায় বারবার। কিন্তু জনগণ হারায় তাদের সম্পদ আর আমানত। বিপরীতে সম্পদে ফুলে উঠে এসব প্রতিষ্ঠান।
বিশ^ব্যাপী টাকা পাচার নিয়ে কাজ করা যে সংস্থাটি বহুল পরিচিত সেটি হচ্ছে গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি বা জিএফআই। ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জিএফআই বাংলাদেশসহ ১৩৪টি দেশের অর্থ পাচারের যে তথ্য প্রকাশ করেছিল, সেখানে অন্য সব দেশের হালনাগাদ তথ্য থাকলেও বাংলাদেশের তথ্য ছিল পুরনো, ছয় বছর আগের, অর্থাৎ ২০১৫ সাল পর্যন্ত। এর মধ্যেও আবার সেখানে ২০১৪ সালের হিসাব ছিল না! ২০১৪ সাল বাদ দিয়ে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এই ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারের যে তথ্য দিয়েছে জিএফআই, সেখান থেকে প্রতিবছর পাচার হয়ে যাওয়া টাকার পরিমাণের একটা গড় ধারণা পাওয়া যায়। সংস্থাটির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছিল। রিপোর্ট প্রকাশকালের বিনিময় হার হিসেবে ধরলে (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা) ওই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭১ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। আবার রিপোর্ট অনুযায়ী কেবল ২০১৫ সালেই পাচার হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, ২০১৫ সালের পর থেকেই জাতিসংঘকে বৈদেশিক বাণিজ্যসংক্রান্ত তথ্য দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে বাংলাদেশ সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য নেই। তথ্য নেই বলে কি দেশ থেকে টাকা পাচার থেমে আছে? এক বাক্যে উত্তর হবে, না।
এই খবরও প্রকাশিত হয়েছে যে, সুইস ব্যাংকগুলোতেও বাংলাদেশিদের টাকার পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে, আবার আকস্মিকভাবে কমছে। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য নিয়ে বিবিসি বাংলা জানিয়েছিল, ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় আট হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। এর আগের বছর, অর্থাৎ ২০২০ সালে এই অর্থের পরিমাণ ছিল পাঁচ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরেই সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা করা অর্থের পরিমাণ দুই হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বেড়েছে।
সরকারের দায়িত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের অন্যতম পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত নভেম্বরে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে কানাডায় টাকা পাচারের যে গুঞ্জন আছে, তার সত্যতা কিছুটা তিনি পেয়েছেন। আর প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, টাকা পাচারের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের সংখ্যাই বেশি। টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া ২৮টি ঘটনার মধ্যে সরকারি কর্মচারীই বেশি।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণার মাধ্যমে জানা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের অবৈধ অর্থের প্রবাহের বড় উৎস হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা ও প্রভাবশালীদের ‘গ্র্যান্ড’ বা মহা দুর্নীতি, বিভিন্ন ধরনের সংঘবদ্ধ অপরাধ, যেমন চোরাচালান, মাদক ও মানব পাচার, ব্যাংকঋণ কেলেঙ্কারি ও দ্রুত অবলোপন, জাল-জালিয়াতি, অবৈধভাবে কর্মরতদের বিদেশিদের অর্থ অবৈধভাবে লেনদেন এবং বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকি দিয়ে ও প্রচলিত বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার আইন লঙ্ঘন করে তা পাচার। আর অর্থ পাচারের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, আর্থিকসহ সব ধরনের অপরাধ লুকানো, কর ফাঁকি, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার আইন ও বিনিয়োগ নীতি লঙ্ঘন, অন্য দেশে নিরাপদ বিনিয়োগ এবং উন্নত দেশের আধুনিক জীবনযাত্রার লোভে সেখানকার নাগরিকত্ব লাভ। এসব দেশও আবার প্রলোভনের জাল বিছিয়ে রাখে। ফলে বিনিয়োগ ভিসা, স্থায়ীভাবে বা দীর্ঘ সময়ের জন্য বসবাসের অনুমোদন, বিভিন্ন সেকেন্ড হোম প্রকল্প ও নমনীয় বিনিময় হারের ব্যবস্থা বাংলাদেশের নাগরিকদের অর্থ পাচারকে উৎসাহিত করছে।
এখানেই শেষ নয়, টাকা পাচারের পাশাপাশি চুরির ঘটনাও আছে। সম্প্রতি হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা নিয়ে নির্মিত বলিউডের তথ্যচিত্র ‘বিলিয়ন ডলার হাইস্ট’ মুক্তি পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ৮১ মিলিয়ন বা ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার অর্থ চুরির ঘটনা সারা বিশে^ আলোড়ন ফেলেছিল। মনে করা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে এই ঘটনা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আর্থিক অপরাধগুলোর একটি। ২০১৬ সালের সেই ঘটনা নিয়ে তথ্যচিত্র বা ডকুমেন্টারি বানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সাল পিকচার্স হোম এন্টারটেইনমেন্ট।
এক দল হ্যাকার কীভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেঙে ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি করতে সক্ষম হয়েছিল এবং তাদের সামান্য একটি ভুল টাইপের কারণে আরও ২০ মিলিয়ন বা ২ কোটি ডলার হাতিয়ে নেওয়া থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক রক্ষা পায় বাস্তব এই গল্পই দেখানো হয়েছে তথ্যচিত্রে। অর্থনীতিবিদরা বলে থাকেন, ৫ কারণে টাকা পাচার হয়। এগুলো হচ্ছে দেশে বিনিয়োগের পরিবেশের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার শঙ্কা, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর দুর্বল নজরদারি, আইনের শাসনের ঘাটতি এবং বেপরোয়া দুর্নীতি। ক্ষমতার ছায়া এবং ছোঁয়া পেলে তা যে আলাদিনের চেরাগের চেয়ে দ্রুতগতিতে সম্পদ বাড়িয়ে দিতে পারে, তার নজির অনেক। তাদের এই সম্পদ তারা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের দেশে দেশে জমা করছেন। অর্থ পাচারের বড় কেন্দ্র দুবাই, এরপর সিঙ্গাপুর হলো নিরাপদ পাচার কেন্দ্র।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের আবেগ। শোষণমুক্ত দেশ গড়ার সেই আবেগের পেছনে প্রশ্ন ছিল কারা শোষণ করে? ফলে শত্রু যেমন ছিল তেমনি শত্রুকে চিনে নেওয়ার তাগিদ ছিল। রাজনৈতিক আন্দোলন যেমন স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে পরিণতির দিকে নিয়ে গিয়েছে; তেমনি গান, কবিতা, নাটক, সিনেমার ভূমিকাও কম নয়। সেই সময় বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে রাজনৈতিক পোস্টারের ভূমিকা কম ছিল না। যে ঐতিহাসিক পোস্টার ’৭০-এর নির্বাচনে জনমতকে প্রভাবিত করেছিল তা হলো সোনার বাংলা শ্মশান কেন? সেদিনের বৈষম্য ও লুণ্ঠনের চিত্র এমনভাবে ফুটে উঠেছিল সেই সাদামাটা পোস্টারের লেখায়। এই পোস্টার কাউকে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হয়নি। আজ স্বাধীনতার ৫২ বছর পর প্রশ্ন তুলতে হবে বৈষম্য এত তীব্র কেন? পুঁজিবাদী শোষণ, দুর্নীতি, টাকা পাচার মিলে সোনার বাংলাকে ফাঁকা এবং ফাঁপা করে ফেলেছে যে শাসক গোষ্ঠী, তাদের চিহ্নিত করাই শুধু নয়, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তোলাটাও জরুরি।
আমাদের হাজারো সমস্যার মধ্যে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি অন্যতম। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। দেশে ১১ জুলাই ‘বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস’ পালিত হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এ বিষয়ে নানা নির্দেশনা জারি করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি এ দেশে বিভিন্ন এনজিও সংস্থাও জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের জন্য সুখবর হলো, দেশের মানুষ অনেক সচেতন হয়েছে। জানা গেছে, ১৯৬০ সালে এ ভূখণ্ডের মোট জনসংখ্যা ছিল মাত্র এক কোটি, যা বর্তমানে অনেক গুণ বেড়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, ১৯৮৭ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা ৫০০ কোটিতে পৌঁছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৮৯ সাল থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে বিভিন্ন প্রতিপাদ্য সামনে রেখে ‘বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস’ পালন করে আসছে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপি) প্রকাশিত এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৮০৪ সালে বিশ্ব জনসংখ্যা ছিল ১০০ কোটি। এর দ্বিগুণ হতে সময় লেগেছে প্রায় ১২৩ বছর। ১৯২৭ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ২০০ কোটিতে। এরপর ৩২ বছর অর্থাৎ ১৯৫৯ সালে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৩০০ কোটিতে। ১৯৭৪ সালে অর্থাৎ ১৫ বছর পর বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৪০০ কোটিতে। ৫০০ কোটিতে পৌঁছাতে সময় লেগেছিল আরও কম। মাত্র ১৩ বছরে ১৯৮৭ সালে জনসংখ্যা ৫০০ কোটিতে বৃদ্ধি পায়। প্রতি ১২ বছরে বিশ্বে জনসংখ্যা বেড়েছে ১০০ কোটি করে। ১৯৯৯ সালে ৬০০ কোটি। ২০১১ সালে ৭০০ কোটি। সর্বশেষ তথ্যে জানা যায়, ২০২২ সালের ১৫ নভেম্বরে বিশ্বের জনসংখ্যা দাঁড়ায়, প্রায় ৮০০ কোটিতে।
এভাবে বিশ্বে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে এই জনসংখ্যা বেড়ে ১০০০ কোটি অতিক্রম করতে পারে। বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়াতে সমস্যার বেড়াজালে আমরা আটকে যাচ্ছি, জনসংখ্যা বানের পানির মতো বাড়ার কারণে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বেশ উদ্বেগজনক। বিবিসি ও ইউএনএফপির প্রকাশিত এক তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর হলো ‘ঢাকা’।
জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন সমস্যা। প্রতিদিন বিশ্বে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে খাদ্যাভ্যাস ও অপুষ্টির কারণে। সুপেয় পানির অপ্রতুলতা, বাতাসের বিষাক্ততা, সম্পদের বিলুপ্তি, বাসস্থানের সমস্যা ও ওজন স্তরের ধ্বংসসহ বহু বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হচ্ছে বিশ্ব। তার ওপর ঘাড়ে চাপছে বৈশ্বিক উষ্ণতা। উল্লিখিত সমস্যাগুলোর মূলে রয়েছে একমাত্র জনসংখ্যা বৃদ্ধি।
সরকারের একক প্রচেষ্টায় এ দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করা যাবে না। দিবস পালনের সুফলও সুদূর পরাহত। যেখানে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে আগে সেই স্থান চিহ্নিত করতে হবে। ওই এলাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির সুফল-কুফল বিষয়ে প্রচার চালাতে হবে। আলোচনায় শামিল করতে হবে সাধারণ জনগণকে। শহরের বস্তিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রুত। কারণ এরা অশিক্ষিত। নিম্নশ্রেণির মানুষদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এ শ্রেণির অধিকাংশ মানুষ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিতে বিশ্বাসী নয়। তারা এ পদ্ধতিকে সহজভাবে মেনে নেয় না, গুরুত্বও দেয় না। দেশে বাড়ছে জনসংখ্যা, বাড়ছে না আবাদি জমি। বাড়ছে পরিবারে সদস্য সংখ্যা, বাড়ছে না আয় রোজগার। বাড়ছে প্রতিদিন নিত্যপণ্যের দাম। আয়-ব্যয়ের তাল মেলানো যাচ্ছে না। জিনিসপত্রের দাম সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের বদৌলতে আগের চেয়ে বর্তমানে মৃত্যুহার অনেক কমে গেছে। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বুঝতে পারব- মৃত্যুহার কমেছে ঠিকই, জন্মহার বেড়ে গেছে। এই জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে দৈনন্দিন জীবনে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের সংশ্লিষ্টরা নিঃস্বার্থভাবে মাঠে-ময়দানে কাজ করছে। অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে এ বিভাগের পরিবার কল্যাণ সহকারীরা।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধে সমাজের সব স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। সমাজে এখনো বেশকিছু কুসংস্কার রয়েছে। কুসংস্কার দূর করে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে পরিকল্পনা মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য। এ জন্য প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা চালালে হয়তো এর সুফল আগামী প্রজন্ম পাবে। নতুবা সব প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। আমাদের এগোতে হবে একটা বিষয় নির্ধারণে। আর সেটি হলো ‘পরিকল্পিত পরিবার’। এ সময়ে পরিকল্পিত পরিবারের কোনো বিকল্প নেই।
পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে সম্প্রতি কিছু নিয়মকানুন সৃষ্টি হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। পরিবার পরিকল্পনা সহকারীরা যার যার এলাকায় সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে পৌঁছে নিজের ছবি তুলে নির্দিষ্ট গ্রুপে দিতে হবে। অফিসাররা এগুলো মনিটরিং করে। কোনো কর্মী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কেনো ছবি পোস্ট করল না তা জানতে চায় সংশ্লিষ্ট অফিসাররা। এভাবে যদি কর্মীদের দায়িত্ব পালন করতে হয় তাহলে তাদের মনমানসিকতা কোন পর্যায়ে থাকতে পারে, তা ভাবার বিষয়। কর্মীরা কলুর বলদের মতো মাঠে কাজ করবে সারাদিনমান। আবার কর্তাদেরও হাজিরা দেখাতে হবে, স্ব-স্ব এলাকায় পৌঁছে সাড়ে ৯টার মধ্যে নিজের ছবি পোস্ট করে! এভাবে হলে নারীরা নিয়ম পালনে অধিকতর মনোযোগী হবে না।
সম্ভবত পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের নারী কর্মীদের কাজের মূল্যায়ন তেমন করেন না সংশ্লিষ্ট অফিসাররা। যে কোনো কাজে উৎসাহিত করা গেলে সন্তোষজনক আউটপুট আসে। কর্মক্ষেত্রে তাদের মানসিক চাপে রাখলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধে নিশ্চয় ব্যাঘাত ঘটবে। সরকারের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সমস্যা হতে পারে। বিজ্ঞজনদের অভিমত, বর্তমান ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেওয়া দরকার।
লেখক : কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক
সব পেশার চরিত্র এক নয়। যে কারণে কিছু পেশাকে চিহ্নিত করা হয় ‘জরুরি’ হিসেবে। দেশের কোনো দুর্যোগ মুহূর্তে সেই পেশার মানুষদের রাস্তাঘাটে চলাচল থাকে নির্বিঘ্ন। সরকারিভাবে ঘোষণা দিয়ে রাস্তায় চলাচলের ওপর তাদের প্রতি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু বাকি জনসাধারণের জন্য তা বহাল থাকে। সেই পেশার মধ্যে প্রথমেই থাকে চিকিৎসক (অ্যাম্বুলেন্সসহ), দমকল বাহিনী, সাংবাদিক এবং বিশেষভাবে বিবেচিত কয়েক শ্রেণির মানুষ। এর মানে হচ্ছে, সরকার মনে করছে এসব পেশার মানুষদের কর্মক্ষেত্রে বা বাইরে স্বাভাবিক চলাচলের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বাধার সৃষ্টি করা উচিত হবে না। ফলে তাদের সবসময়ই থাকতে হয় সেবার মানসিকতা নিয়ে। কিন্তু খোদ হাসপাতালেই যদি মানুষদের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয় পুলিশের অজুহাতে, বিষয়টি তখন হয়ে ওঠে অমানবিক। মৃত্যুপথ মানুষকে হাসপাতাল থেকে যখন বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে হয়, তখন একটা বিতর্ক তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। একমাত্র পুলিশি হয়রানির ভয়ে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বাধ্য হচ্ছে রোগী ভর্তি না করতে। সে ক্ষেত্রে রোগী যতই সংকটময় পরিস্থিতিতে থাকুক না কেন, পুলিশি জটিলতা শেষ না করে কোনো হাসপাতালই দায়িত্ব নেয় না রোগীর সেবা করার। কিন্তু এর সমাধান তাহলে কী?
আপাতদৃষ্টিতে কোনো সমাধান নেই। একমাত্র এ ধরনের নিয়মের আধুনিকায়ন এবং বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্তই মুমূর্ষু মানুষকে ফিরিয়ে আনতে পারে মৃত্যুর মুখ থেকে। এর জন্য পুলিশ ও চিকিৎসক কর্তৃপক্ষের মধ্যে একটা মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকা দরকার। সেটা লিখিত বা অলিখিত, মুখ্য বিষয় তা নয়। আসল বিষয় হচ্ছে, রোগীর জীবন বাঁচানো। সেটা কী ধরনের রোগী, তার বিবেচনা কখনই হাসপাতাল বা ক্লিনিকের থাকা উচিত নয়। তারা শুধু তৎক্ষণাৎ পুলিশ কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করবে। পাশাপাশি সেই ঘটনার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত রোগী হাসপাতালস্থল ত্যাগ করতে পারবে না। এরকম একটি আইন থাকলেই আর কোনো ধরনের জটিলতা তৈরি হওয়ার সুযোগ থাকে না। এ ক্ষেত্রে রোগীও সুস্থ থাকল, আইনি জটিলতাও থাকল না। ফলে হাসপাতালে মুমূর্ষু রোগী ভর্তির ক্ষেত্রে আপত্তির আর সুযোগ নেই। বিষয়টি মানবিক বিবেচনায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে উভয় কর্তৃপক্ষকে।
শুক্রবার দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত ‘হাসপাতালের দরজা বন্ধ পুলিশ কেসের ভয়ে’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে এ বিষয়ে। প্রত্যক্ষদর্শী ও পরিবারের সদস্যদের বরাতে জানা যাচ্ছে, নুর ইসলাম (৭০) গত ৭ আগস্ট ফজরের নামাজ শেষে ফেরার পথে যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন। ঘটনাস্থলে থাকা কয়েকজন যুবক মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে নিয়ে যান স্থানীয় স্পেশালাইজড মেডিকেল কেয়ার হাসপাতালে। সেখানে তাকে ৪০ মিনিটের বেশি সময় রাখা হলেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। পরে এক আত্মীয় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। পথেই তার মৃত্যু হয়।
মুক্তিযোদ্ধা নুর ইসলামের মতো সারা দেশে অসংখ্য মানুষের প্রাণ নিভছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর দায়িত্বহীনকা-ে। ‘পুলিশ কেস’, ‘আইনি ঝামেলা আছে’ প্রভৃতি কথা বলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে মুমূর্ষু রোগীদের। সর্বোচ্চ আদালতের আদেশের পরও বদলায়নি তারা। নানা অজুহাতে দুর্ঘটনায় আহত বা অপরাধীদের আক্রমণে মারাত্মক আহত রোগীদেরও ফিরিয়ে দিচ্ছে তারা দ্বিধা ছাড়াই। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দুর্ঘটনায় আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়টি তারা বিবেচনা করেন। গুরুতর আহতদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে নানা জটিলতায় পড়তে হয়। গুরুতর আহত রোগী মারা গেলে পরিবারের সদস্যরা অনেক ক্ষেত্রে ভুল বুঝে হাসপাতাল ভাঙচুর করে। টাকা পরিশোধ করতে চায় না। এসব ঘটনায় মামলা হলে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। কখনো চিকিৎসা দিতে পুলিশের অনুমতি নিতে হয়। ফলে জটিলতা এড়াতে চিকিৎসাদানে মালিকপক্ষ কড়াকড়ি আরোপ করে।
এ বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দ্রুত একটি সমাধানের পথ বের করবেন, সেটাই প্রত্যাশা। জনগণকে যেন কোনোভাবেই বিনা চিকিৎসায় জীবন দিতে না হয়।
১৯৩৪ সালের এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন কবি, গীতিকার ও গায়ক অতুলপ্রসাদ সেন। তার জন্ম ২০ অক্টোবর ১৮৭১ সালে ঢাকায়। বাল্যকালে বাবাকে হারিয়ে তিনি মাতামহ কালীনারায়ণ গুপ্তের আশ্রয়ে প্রতিপালিত হন। ১৮৯০ সালে প্রবেশিকা পাসের পর তিনি কিছুদিন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়ন করেন। পরে বিলাত থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে এসে কলকাতা ও রংপুরে আইন ব্যবসা শুরু করেন। তিনি বঙ্গ-সাহিত্য সম্মিলন প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। রাজনীতিতে সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও প্রথমে কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন, পরে তিনি লিবারেলপন্থি হন। সমগ্র জীবনের উপার্জিত অর্থের বৃহৎ অংশ স্থানীয় জনকল্যাণে তিনি ব্যয় করেন। বাংলাভাষীদের কাছে তিনি একজন সংগীতজ্ঞ ও সুরকার হিসেবেই পরিচিত। তার গানগুলো প্রধানত স্বদেশিসংগীত, ভক্তিগীতি ও প্রেমের গান এই তিন ধারায় বিভক্ত। তবে ব্যক্তিজীবনের বেদনা তার গানে কমবেশি প্রভাব ফেলেছে। রবীন্দ্র-প্রভাববলয়ের মধ্যে বিচরণ করেও যারা বাংলা কাব্যগীতি রচনায় নিজেদের বিশেষত্ব প্রকাশ করতে সক্ষম হন, তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। ১৯০২ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত তিনি আইন ব্যবসা উপলক্ষে লখেœৗতে অতিবাহিত করেন। সে সময় তার বাংলোয় প্রায় সন্ধ্যায়ই গানের আসর বসত। সেই আসরে গান শোনাতে আসতেন আহম্মদ খলিফ খাঁ, ছোটে মুন্নে খাঁ, বরকত আলী খাঁ, আবদুল করিম প্রমুখ। বাংলা সংগীতে তিনিই প্রথম ঠুংরির চাল সংযোজন করেন। ‘মোদের গরব, মোদের আশা/আ মরি বাংলা ভাষা’ গানটিতে তার মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধ ফুটে উঠেছে। এ গান বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালিদের মধ্যে অফুরন্ত প্রেরণা জুগিয়েছে। গানটির আবেদন আজও অম্লান।
আল হিলালের হয়ে অভিষেকের পর চার ম্যাচ খেলেছিলেন নেইমার। কিন্তু কোনো ম্যাচে তিনি পাননি কোনো গোলের দেখা। অবশেষে আরবের ক্লাবটির হয়ে নিজের পঞ্চম ম্যাচে তিনি পেয়েছেন গোলের দেখা। তাতে দলও পেয়েছে বড় জয়ের দেখা।
এএফসি চ্যাম্পিয়নস লিগে ইরানের ক্লাব নাসাজি মাজান্দারানকে হারিয়েছে ৩-০ ব্যবধানে। দুই ম্যাচে চার পয়েন্ট নিয়ে ডি গ্রুপের দুইয়ে আল হিলাল। ছয় পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে নাভবাহোর।
ম্যাচের ১৮ মিনিটেই এগিয়ে যায় হিলাল। মোহাম্মদ আল বুরায়েকের বাড়ানো বলে জাল খুঁজে নেন অ্যালেক্সান্ডার মিত্রোভিজ। ৩৮ মিনিটে দুই দলই পরিণত হয় দশ জনের দলে। তর্কে জড়িয়ে লাল কার্ড দেখেন দুই দলের দুই ফুটবলার।
৫৮ মিনিটে সেই কাঙ্খিত গোলের দেখা পান নেইমার। নাসের আল দাওয়াসারির পা ঘুরে বল পেয়ে বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া শটে লক্ষ্যভেদ করেন এই তারকা। আর শেষ দিকে সালেহ আল সাহেরির গোলে বড় নিশ্চিত হয় আল হিলালের।
‘অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প-৩’ শীর্ষক একটি প্রকল্প ২০২০ সালে অনুমোদন করিয়ে নিয়েছিলেন সংসদ সদস্যরা (এমপি)। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় তালিকা অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা তাদের চাহিদার পরিবর্তন আনেন। তারা ইউনিয়ন পর্যায়ে রাস্তা না করে সেতু তৈরির ওপর জোর দেন। কিছু ক্ষেত্রে খাতভিত্তিক ব্যয় না চেয়ে থোক বরাদ্দও চাওয়া হয়েছিল। চাহিদার জটিলতায় ধীরগতিতে চলে প্রকল্পের বাস্তবায়ন। ঠিক সময়ে প্রকল্পটি শেষ করতে না পারার শঙ্কায় ফের সংশোধনী প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে।
যদিও একই রকম আরেকটি প্রকল্পের কাজ তখনো চলমান ছিল। চলমান একটি প্রকল্প শেষ না হতেই সংসদ সদস্যদের জন্য আরেকটি প্রকল্প নিয়ে তখন বেশ আলোচনা-সমালোচনাও হয়েছিল।
প্রকল্প-৩-এর মেয়াদ আছে আর এক বছর। অথচ কাজ চলছে ঢিমেতালে। নির্বাচনের আগে তাদের চাহিদার পরিবর্তন নিয়ে প্রশ্নও উঠেছে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৬ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকার প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের পর ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। এর বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। গত আগস্ট পর্যন্ত প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি ৪১ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
এ প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে প্রত্যেক সংসদ সদস্য ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছিলেন। সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট নির্মাণে বছরে পাঁচ কোটি টাকা করে এই বরাদ্দ দেওয়া হয়।
প্রতি বছর পাঁচ কোটি করে চার বছরে এ অর্থে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা তাদের। সিটি করপোরেশন এলাকার ২০ সংসদ সদস্য এবং সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্যরা এ বরাদ্দের বাইরে রয়েছেন।
নিজ এলাকার উন্নয়নে এমন সুযোগ পেলেও সংসদ সদস্যরা কাজে লাগাতে পারেননি। প্রকল্পের মেয়াদ প্রায় শেষ। অথচ প্রকল্প বাস্তবায়ন অর্ধেকেরও কম হয়েছে। অধিকাংশ সংসদ সদস্যই তাদের প্রস্তাবিত প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেননি। কিন্তু তারা বলছেন, যে চাহিদা তারা দিয়েছিলেন তার অধিকাংশ পেয়েছেন।
জানতে চাইলে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি ও সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার আসনে যেসব চাহিদা দিয়েছিলাম সবগুলোই পেয়েছি। কিন্তু এ মুহূর্তে এসে বাস্তবায়নের অগ্রগতি ৪১ শতাংশ বলা হচ্ছে, এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। পরিকল্পনা কমিশনে কীসের ভিত্তিতে এই সংশোধনী প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তা জানি না।’
সংসদ সদস্যরা যে চাহিদা পরিবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছেন সে বিষয়ে ইনু বলেন, ‘কোনো এমপি চাহিদা পরিবর্তন করার কথা নয়। আমার এলাকায় যা চেয়েছি তাই তো পুরোটা তারা দিতে পারেননি। প্রতি বছর পাঁচ কোটির বরাদ্দ, তার বাইরে তো তারা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না।’ পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সম্প্রতি প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা (পিইসি) অনুষ্ঠিত হয়েছে। পিইসি সভায় প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ রুহুল আমিন খানের কাছে সংশোধনের যৌক্তিকতা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। সেখানে তিনি বলেন, এ প্রকল্পে জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে ইতিমধ্যে বেশ কিছু সড়ক ও সেতু-কালভার্ট নতুনভাবে নির্মাণের প্রস্তাব পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত স্কিমগুলোর গুরুত্ব বিবেচনায় বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। স্কিমগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পে অতিরিক্ত বরাদ্দ প্রয়োজন।
পিইসি সভার কার্যবিবরণী অনুযায়ী, এ বিষয়ে কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) মো. ছায়েদুজ্জামান বলেন, যেসব স্কিম অতীব জনগুরুত্বপূর্ণ সেগুলোর যৌক্তিকতাসহ সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (আরডিপিপি) অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তবে, নতুনভাবে গৃহীত স্কিমগুলো বাস্তবায়নের জন্য বরাদ্দ ৫০ কোটি টাকার কম করতে হবে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, তৃতীয় দফার এ প্রকল্পের আওতায় নতুন করে উপজেলা সড়ক নির্মাণ করা হবে ৩০৫ দশমিক ২১ কিলোমিটার। ইউনিয়ন সড়ক নির্মাণ করা হবে ৬৬০ দশমিক ৩৭ কিলোমিটার। গ্রাম সড়ক উন্নয়ন হবে ৫ হাজার ৭৫ দশমিক ৭৬ কিলোমিটার। গ্রামীণ সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ হবে ১ হাজার ৯০ দশমিক ৭৭ কিলোমিটার। গ্রামীণ সড়কে ১০০ মিটারের কম দৈর্ঘ্যরে সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করা হবে ৭ হাজার ৯৯২ দশমিক ২২ মিটার।
এসব প্রস্তাব সংসদ সদস্যদের চাহিদার ভিত্তিতেই করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবায়নের সময় ফের বাদ সাধেন তারাই। পরে মূল প্রকল্প প্রস্তাব থেকে প্রস্তাবিত প্রথম সংশোধনে ১৯৩ কিলোমিটার উপজেলা সড়ক, ৮৩ দশমিক ৯১ কিলোমিটার ইউনিয়ন সড়ক, ৫০৫ দশমিক ৪৪ কিলোমিটার গ্রাম সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম বাদ দেওয়ার আবদার করেছেন তারা। এর বিপরীতে ৩৯২ দশমিক শূন্য ১ কিলোমিটার গ্রাম সড়ক ও ২ হাজার ৬৭৪ দশমিক ৫১ মিটার সেতু-কালভার্টের প্রস্তাব এসেছে তাদের কাছ থেকে। সে অনুযায়ী সংশোধনী প্রস্তাব তৈরি করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ রুহুল আমিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা চিন্তা করেছি এ রাস্তাটি আজকে করব, কিন্তু দেখা গেল অন্য কোনো প্রকল্পের মাধ্যমে এ রাস্তাটি হয়ে গেছে। এমপিরা যেভাবে ডিও দেন প্রকল্পটি সেভাবে চলে, আমাদের ফ্রেমওয়ার্কটিই সেভাবে তৈরি করা।’
এ মুহূর্তে প্রকল্পটি সংশোধনের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আছে পরিবেশের জন্য ড্রেনেজ সুবিধা রাখতে হবে। একটি রাস্তা করতে গিয়ে দেখা গেল, একটি কালভার্ট বা সেতুর প্রয়োজন হয়েছে। এটি এখন প্রথম প্রায়োরিটি (অগ্রাধিকার)। এটি প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন হিসেবে কাজ করছে।’
বাস্তবায়নের ধীরগতির কারণ হিসেবে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘যখন প্রকল্পটি অনুমোদন হয়েছিল তখন করোনা মহামারী ছিল। করোনার কারণে প্রকল্পটির কাজ দেরিতে শুরু হয়েছিল, যার ফলে এ মুহূর্তে বাস্তবায়ন অগ্রগতি এ পর্যায়ে এসেছে।
পিইসি সভায় সংশোধনের কারণ জানতে চাওয়া হলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ১১তম জাতীয় সংসদ সদস্যদের প্রাথমিক চাহিদাপত্র (ডিও) গ্রহণ করে স্কিমের তালিকা প্রণয়ন করা হয়। তবে বাস্তবায়ন পর্যায়ে বিশেষ পরিস্থিতি ও অগ্রাধিকার ক্রমপরিবর্তনের ফলে আরডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত স্কিম তালিকা পরিবর্তন করে ডিওর মাধ্যমে সংশোধিত নতুন স্কিম তালিকা করা হয়েছে। পরিবর্তিত স্কিম তালিকা অনুযায়ী গ্রাম সড়ক ও সেতু-কালভার্টের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং উপজেলা-ইউনিয়ন সড়কের পরিমাণ কমেছে।
এ প্রকল্পের তথ্য-বিশ্লেষণে দেখা যায়, এতে সবচেয়ে বেশি ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ হাজার ৭৫ কিলোমিটারের গ্রামীণ সড়ক উন্নয়নের জন্য। এতে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪ হাজার ৬০ কোটি টাকা। ৬৬০ কিলোমিটার ইউনিয়ন সড়ক উন্নয়নের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫২৮ কোটি টাকা, ৩০৫ কিলোমিটার উপজেলা সড়ক উন্নয়নের জন্য ২৯০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। তা ছাড়া ১ হাজার ৯০ কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক সংরক্ষণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৮১ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, এর আগে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ প্রথম সরকার গঠনের পর প্রত্যেক সংসদ সদস্য নিজ আসনের অবকাঠামো উন্নয়নে ১৫ কোটি টাকা করে পেয়েছিলেন। সে সময় প্রকল্পের ব্যয় ছিল ৪ হাজার ৮৯২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এটি ২০১০ সালের মার্চ থেকে ২০১৬ সালের জুনে শেষ হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে সংসদ সদস্যদের ২০ কোটি টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এ পর্যায়ে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৬ হাজার ৭৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদে বাস্তবায়ন হয়েছে। এ প্রকল্পটি শেষ না করেই তৃতীয় মেয়াদে আবার ২০ কোটি টাকা করে দেওয়া হয়। এই উদ্যোগের কারণে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় প্রশ্নের মুখে পড়ে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এ প্রকল্পের আওতায় সংসদ সদস্যরা সরাসরি টাকা পাবেন না। তারা শুধু তাদের নির্বাচনী আসনে পছন্দ মোতাবেক প্রকল্পের নাম দেবেন। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর।
গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চত্বরে শোভন আচরণ এবং বিশৃঙ্খলা-সৃষ্টি করে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করার কারণে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের পাঁচ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
গতকাল সোমবার স্বাক্ষরিত এক পত্রে তাদের বহিষ্কারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এইচএম আবু বকর চৌধুরী।
বহিষ্কৃতরা হলেন মোক্তারপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আব্দুল হেকিম, সদস্য মো. জাকির হোসেন, ওই ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য মো. আকরাম হোসেন, একই ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. ফয়সাল ফকির এবং ওই ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. জাইদুল।
তবে ঘটনার উসকানিদাতা মোক্তারপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান মো. আলমগীর হোসেনের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের সাংগঠনিক ব্যবস্থা এখনো নেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এইচএম আবু বকর চৌধুরী বলেন, পুরো বিষয়টি আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা দেখছেন। এ ব্যাপারটি তারাই সিদ্ধান্ত নেবেন।
সারা দেশে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ১ হাজার ৫৭৭টি অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ঢাকায় ঘটেছে ১৫৫টি, যা আগস্ট মাসের চেয়ে ২৭টি বেশি। এ সময় আগুনে ৪ জন নিহত ও ১১ আহত হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স মিডিয়া সেল থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঢাকায় ১৫৫টি আগুনের ঘটনায় ৭ জন আহত হলেও কেউ মারা যায়নি। রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ, তেজগাঁও, বারিধারা, উত্তরা এলাকায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা বেশি ঘটেছে। এর মধ্যে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বারিধারা এলাকায় গত মাসে ১৬টি করে অগ্নিকান্ড ঘটেছে।
সেপ্টেম্বর মাসের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকা বিভাগে ৬০৩, ময়মনসিংহ বিভাগে ৬৩, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৮৯, রাজশাহী বিভাগে ২২৫, খুলনা বিভাগে ১৩২, সিলেট বিভাগে ৫৭, বরিশাল বিভাগে ৬০ ও রংপুর বিভাগে ২৪৮টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে।
ফায়ার সার্ভিস জানায়, আগস্ট মাসের চেয়ে সেপ্টেম্বরে অগ্নিকাণ্ড কমেছে। আগস্টে সারা দেশে ১ হাজার ৬৬৭টি আগুনের ঘটনা ঘটেছিল।
পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা সেপ্টেম্বরে সারা দেশে ৭৮৭টি বিভিন্ন দুর্ঘটনায় উদ্ধার কার্যক্রমে অংশ নেন। এর মধ্যে আছে ঢাকায় ১৫৯, ময়মনসিংহে ৫৫, চট্টগ্রামে ১০২, রাজশাহীতে ২০১, খুলনায় ৮৮, সিলেটে ২৭, বরিশালে ৪১ ও রংপুর বিভাগে
১১৪টি দুর্ঘটনা।
ফায়ার সার্ভিস আরও জানায়, বিভিন্ন দুর্ঘটনার মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা রয়েছে ৫৯০। এ ছাড়া রান্নাঘরের গ্যাস সিলিন্ডারজনিত দুর্ঘটনা ঘটেছে ১০, গ্যাসলাইনে ত্রুটিজনিত ঘটনা ১৩, লিফট দুর্ঘটনা ১৫, বজ্রপাতের ১৯, নদী ও পানিতে ডুবে যাওয়ার ১১৫ এবং অন্যভাবে আরও ২৫টি দুর্ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ১৮৪ জন নিহত ও ৭৭৭ জন আহত হয়েছে।
সেপ্টেম্বর মাসে শুধু ঢাকায় ৪৯টি বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনায় ১১ জন নিহত হয়েছে। রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও, পুরান ঢাকা এলাকায় দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে।
ফায়ার সার্ভিসের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গত মাসে সারা দেশ থেকে ফায়ার সার্ভিস আগুন ও বিভিন্ন দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৩৫৪টি কলের মাধ্যমে সেবা দিয়েছে। এ ছাড়া ১ হাজার ১৫২টি কলের মাধ্যমে ১ হাজার ৯৮ জন রোগী পরিবহনে অ্যাম্বুলেন্স সেবা দিয়েছে।
ঢাকায় অগ্নি দুর্ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলে গত ১৪ সেপ্টেম্বর ভোররাতে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। সেখানে আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ১৭টি ইউনিট কাজ করে। আর তখন তাদের সহযোগিতা করেছেন সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা। প্রায় ৫ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। কোনো ধরনের হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও মার্কেটের বিভিন্ন দোকানের মালামাল, আসবাবসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী ওই সময় বলেছিলেন, মার্কেটের ভেতরে কোনো ফায়ার সেফটি ও ফায়ার ফাইটিংয়ের ব্যবস্থা ছিল না। এ ছাড়া মার্কেটটি অনেকটা বঙ্গবাজার মার্কেটের মতো। ফুটপাত ও সড়কে দোকান থাকা এবং মানুষের ভিড়ের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হয়।
এর আগে বঙ্গবাজারের চারটি মার্কেটে অগ্নিকান্ডের পর ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটে অভিযান চালায় ফায়ার সার্ভিস। বেশিরভাগ মার্কেট আগুনের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছিল অগ্নিনির্বাপণ বাহিনী। এরপরই নিউ সুপার মার্কেটে আগুনের ঘটনা ঘটে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও লক্ষ্মীপুর-৩ শূন্য আসনের উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসির তফসিল অনুযায়ী আগামী ৫ নভেম্বর এই দুই আসনের উপনির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে কমিশন সভা ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ এ তথ্য জানান।
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ১১ অক্টোবর (বুধবার) মনোনয়ন দাখিলের শেষ দিন, মনোনয়নপত্র বাছাই হবে ১২ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার), মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের বিরুদ্ধে আপিল ১৩ থেকে ১৭ অক্টোবর, আপিল নিষ্পত্তি ১৮ অক্টোবর (বুধবার), প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ১৯ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার), প্রতীক বরাদ্দ ২০ অক্টোবর (শুক্রবার) এবং ভোটগ্রহণ ৫ নভেম্বর।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক। সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন সরাইল ও আশুগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তারা। লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন কুমিল্লা আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা। সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন লক্ষ্মীপুর জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা।
এর আগে, গত ১ অক্টোবর সংসদ সচিবালয় এই দুই আসন শূন্য ঘোষণা করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচিত এমপি আবদুস সাত্তার ভূঞা এবং লক্ষ্মীপুর-৩ আসনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত এমপি এ কে এম শাহজাহান কামাল রাজধানীর একটি হাসপাতালে গত ৩০ সেপ্টেম্বর মারা যান। এরপর আসন দুটি শূন্য ঘোষণা করা হয়।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বিএনপি নেতারা।
তারা বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জার্মানিতে নেওয়ার কথা ছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সে সময় শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়। এবার চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছি। জার্মানিতে খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে আমরা তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাব। জার্মানিতে তার ভালো চিকিৎসা হবে।’
এর অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খালেদা জিয়া ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে তার লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে আসছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লিভার সিরোসিসের কারণে খালেদা জিয়ার হৃদ্যন্ত্র ও কিডনির জটিলতা বেড়েছে। তিনি হাসপাতালে কখনো কিছুটা ভালো থাকছেন, পরক্ষণেই তার স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। ফলে তাকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘লিভার সমস্যার কারণে ম্যাডামের শ্বাস কষ্ট হয়। ইতোমধ্যে তাকে দুইবার করোনারী কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রাখা হয়েছিল। লিভার প্রতিস্থাপন করতে পারলে শ্বাসকষ্টটা হতো না।’
এদিকে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষণ না থাকায় তার পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি এখন সামনে এসেছে।
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়া হতে পারে এমন খবরে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও খোঁজখবর নিচ্ছেন জার্মান বিএনপি নেতারা।
জার্মান বিএনপির সভাপতি আকুল মিয়া বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জার্মানিতে ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হতে পারে বলে জানতে পেরেছি। আমরা খুবই খুশি। কারণ জার্মানিতে আসলে আমরা তার চিকিৎসার বিষয়ে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারব। চেয়ারপারসনের যে চিকিৎসা দরকার তা সকল ব্যবস্থা জার্মানিতে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ম্যাডামের মুক্তি, তার উন্নত চিকিৎসা ও গণতন্ত্র ফেরাতে দেশে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে জার্মানিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। আগামী ৯ অক্টোবর আমাদের কর্মসূচি রয়েছে। জার্মান বিএনপির উদ্যোগে রোডমার্চ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করব জার্মান পার্লামেন্টের সামনে। ’
আকুল মিয়া বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যখন বিদেশে নেওয়ার আলোচনা চলছিল তখনও জার্মানিতে নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়েছিল। সে সময় তারেক রহমানের সেবা করতে না পারলেও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সেবা করতে পারব বলে আশা করছি। তার চিকিৎসা জার্মানিতে করতে পারলে আমরা ধন্য হবো।’
গত ২৫ সেপ্টেম্বর সোমবার খালেদা জিয়ার ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনি মতামত জানতে চেয়ে আবেদনের কপি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। খালেদা জিয়ার ভাইয়ের আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃতিক বিস্ময় হাওরের ওপর অত্যাচারের যেন শেষ নেই। ধান-মাছের এই বিপুল ভান্ডার রক্ষার নামে একদিকে চলে স্থায়ী-অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি; যার কারণে যখন-তখন হাওরডুবিতে ঘটে ফসলহানি। পাশাপাশি আরেক দিকে চলে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের নামে অবৈজ্ঞানিকভাবে যত্রতত্র বাঁধ-রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের ধুম; ফলে পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মরতে বসেছে হাওর। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে শেষমেশ সরকারপ্রধান হুকুম দিয়েছেনে ‘হাওরে আর কোনো সড়ক নয়।’
এই পরিস্থিতিতে দেশ রূপান্তরের চোখে ধরা পড়েছে আরেক অশনিসংকেত। এবার শিল্পপতিদের চোখ পড়েছে হাওরে। কোথাও কোথাও থাবাও পড়তে শুরু করেছে। তেমনি সব ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে ভাটি অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হবিগঞ্জ জেলার সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে। এখানে গড়ে উঠেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদনের কারখানা। তৈরি হচ্ছে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প। হাওরের ‘লিলুয়া’ বাতাসে এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে কারখানার দুর্গন্ধ। ‘চান্নি পসর রাইতে’ এখন আর শোনা যায় না বাউলকণ্ঠের দরদি সুর। প্রায় দিনই শিল্পপতিদের আনাগোনার অশুভ পদধ্বনি শুনতে পান হাওরবাসী।
অথচ যেকোনো ধরনের স্থাপনা তৈরি বা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য হওরের স্বাভাবিক পরিবেশ ও জীবনাচরণ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখার নির্দেশনা আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। গত ১৮ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে হাওর অঞ্চলের সড়কগুলো এলিভেটেড করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপর থেকে হাওরাঞ্চলে কোনো সড়ক করতে হলে এলিভেটেড পদ্ধতিতে করতে হবে, যাতে সেখানকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা পায়। সরকারপ্রধানের এমন নির্দেশের পরও থামেনি হাওর ধ্বংসের তৎপরতা।
হাওরে জমি কেনাবেচার হিড়িক
বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট বাজারের অদূরে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের নিচু জমি ভরাট করে বিশাল আকৃতির ছয়টি শেডসহ অনেক স্থাপনা নিয়ে ‘কাজী ফার্ম’ গড়ে তুলেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদন কেন্দ্র। উপজেলার বাগদাইরসহ আরও কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, উপজেলা ও জেলা সদরে যাতায়াতের একমাত্র পথের ধারেই কাজী ফার্মের এই প্রতিষ্ঠান। এখনই নাকে কাপড় দিয়ে দ্রুত পার হতে হয় রাস্তা; আর প্রতিদিন প্রায় ১২ লাখ ডিম উৎপাদনের এই বিশাল কারখানাটি পুরোপুরি চালু হলে দুর্গন্ধে বসবাস করা যাবে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন এলাকাবাসী। স্নানঘাট ভূমি কার্যালয় থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ১৯ একর ৮০ শতক জমি নামজারি হয়েছে। আরও কয়েক একর জমি কিনেছে তারা, যা নামজারির অপেক্ষায়।
গত ১৮ জুন হাওর লাগোয়া বাগদাইর গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হয় স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের সদস্য আলেকজান বিবির সঙ্গে। তিনিসহ আরও কয়েকজন নারী-পুরুষ দেশ রূপান্তরকে বললেন, হাওরের ফসলি জমি ভরাট করে এ ফার্মটি গড়া হয়েছে। এভাবে শিল্প গড়ে উঠলে হাওরের অস্তিত্ব বিলীন হতে আর সময় লাগবে না।
স্থানীয় লিটন মিয়া বললেন, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের ইলাম এলাকায় আকিজ গ্রুপেরও ১৮ বিঘা জমি রয়েছে। উঁচু পাড় বেঁধে আপাতত মাছ চাষ করছে তারা। আগে জমিটির মালিক ছিলেন সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির চৌধুরী। আব্দুল কাদির চৌধুরী জানান, পাঁচ-ছয় বছর আগে তার নিজের জমি ছাড়াও আশপাশের আরও ৫০ বিঘা জমি কিনেছে আকিজ গ্রুপ। আপাতত পুকুর করেছে। ভবিষ্যতে কী করবে, কোম্পানিই জানে।
দীর্ঘদিন ধরে জমি কেনাবেচায় মধ্যস্থতা (দালালি) করেন হারুন মিয়া। তিনি জানান, শুকনো মৌসুমে মাসের ১০ দিনই তাকে হাওরে জমি দেখাতে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন শিল্পপতির সঙ্গে তার মাধ্যমে জমির মালিকদের কথাবার্তা চলছে।
একই পেশার আলী আমজদ বলেন, ইদানীং গুঙ্গিয়াজুরী হাওর এলাকায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লোকজনের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। সালাউদ্দিন নামে ঢাকার এক বাসিন্দা গত মার্চে বন্ধুদের নিয়ে হাওর ঘুরে গেছেন। রাস্তার পাশে তিনি কমপক্ষে ১৫-২০ একর জমি কিনতে চান। তার সঙ্গে আলাপ করে আমজাদ যা বুঝতে পেরেছেন, জমিতে তারা সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে আগ্রহী।
লন্ডনপ্রবাসী নাঈম চৌধুরী জানান, তার ১২ বিঘা জমি কেনার জন্য দামদর ঠিক করেন ঢাকার ব্যবসায়ী জুয়েল খান। সবকিছু ঠিকঠাক করার পর অজ্ঞাত কারণে তিনি সরে যান। নাঈম চৌধুরী পরে জানতে পারেন, কমিশন নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় আইনি পরামর্শক জুয়েল খানকে নিরুৎসাহিত করেন।
হাওর গ্রাসের যত কৌশল
নিচু এলাকা হওয়ায় হাওরে জমির দাম তুলনামূলক কম। এখনো এক বিঘা (৩৩ শতক) জমি ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে বেচাকেনা হয়। পুটিজুরী গ্রামের বাসিন্দা টেনু মিয়া বলেন, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলা অংশে গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই-চার কিলোমিটার দূরেই ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, বিবিয়ানা গ্যাস কূপ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। আবার হাওর এলাকা স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারিও তেমন থাকে না। ফলে ড্রেজিং মেশিন দিয়ে জমি থেকে বালু তুলে অন্য অংশ ভরাট করে ফেলা সহজ হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ভরাট করা হয়। এভাবে সহজেই হাওরের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ফেলা হয়।
স্থানীয় নবীর হোসেন বলেন, জমির শ্রেণি পরিবর্তনের অনুমোদন নেওয়া সময়সাপেক্ষ ও বেশ ঝামেলার কাজ। নবীগঞ্জ ও বাহুবল ভূমি অফিসের কয়েকজন তহশিলদারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে তাদের না জানিয়েই শিল্পপতিরা সব কাজ সেরে ফেলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী কৃষিজমিতে শিল্প বা আবাসিক এলাকা তৈরির জন্য জমি কেনার আগেই জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হয়। আবেদনটি প্রথমে জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে পাঠাবেন। ইউএনও তখন উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে প্রতিবেদন চাইবেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (তহশিলদার) সরেজমিন পরিদর্শন এবং কৃষি, মৎস্য ও বন বিভাগের মতামত পাওয়ার পর জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবেন। এর পর জেলা প্রশাসক সেই অনুমোদন দিতে পারেন।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কোনো অনুমোদনেরই তোয়াক্কা করেন না শিল্পপতিরা। আবার কেউ জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন করলে তখন চাপের মুখে স্থানীয় প্রশাসনকে শিল্পপতিদের পক্ষেই প্রতিবেদন দিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরেজমিন পরিদর্শনে ভূমির যে শ্রেণি পাওয়া যায়, সেই মোতাবেক ভূমি কর আদায় করে নতুন শ্রেণির বৈধতা দিয়ে দেওয়া হয়।
শিল্পপতিরা রাস্তার পাশে প্রথমে এক-দুই একর জমি একটু বেশি দাম দিয়ে কিনে পরে পেছনের জমি প্রায় পানির দরে কেনেন বলে জানান স্নানঘাট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার আবুল কালাম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, সাধারণত শিল্প মালিকরা দালাল দিয়ে জমি কিনতে চান। কারণ, তারা সরাসরি কিনতে এলে দাম বেশি চাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আরেক মধ্যস্থতাকারী শামসু মিয়া বলেন, ‘বেশি জমি কেনার ইচ্ছা থাকলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। আমরা কম দামে কিনে দিয়ে বেশি কমিশন নেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ, আমাদের আয়ের একটা অংশ ভূমি শাখার কর্মকর্তাদেরও দিতে হয়। নইলে জমির কাগজপত্র যত স্বচ্ছই হোক, তারা “ঘিয়ের মধ্যে কাঁটা” বের করার চেষ্টা করেন।’
এ ছাড়া স্থানীয় বা বহিরাগতদের উদ্যোগে পুকুরের নাম করে হাওর এলাকার যেখানে-সেখানে মাটি খনন করা হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, আইন বা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ড্রেজার বসিয়ে কৃষিজমি থেকে দেদার বালু তোলা হচ্ছে।
জমি নিয়ে লুকোচুরি
হবিগঞ্জের ১৩টি হাওরের মোট আয়তন ৭৩ লাখ ৫৭৯ একর। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের অবস্থান জেলার বাহুবল, নবীগঞ্জ, বানিয়াচঙ্গ ও সদর উপজেলা ঘেঁষে। এই হাওরে কী পরিমাণ জমি ছিল বা এখন কতটুকু আছে, তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায়নি সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেও।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সর্বশেষ হিসাবে, এই হাওরের জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ৮৩৩ একর। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ৬৪ হাজার ২২০ একর। ৮ বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৭ সালে পরিসংখ্যান বিভাগের প্রকাশিত হিসাবে হাওরের আয়তন দেখানো হয়েছে ১৬ হাজার ৪২৯ একর। জেলা মৎস্য অফিস জানিয়েছে, এই হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৩৯৯ একর ৪ শতক। চারটি অফিসের কর্মকর্তারাই তাদের হিসাব সঠিক বলে দাবি করছেন। আরেকটি রহস্যময় বিষয় হলো, চারটি উপজেলা ঘেঁষে এই হাওরের অবস্থান হলেও ওই চার সরকারি প্রতিষ্ঠানই বানিয়াচঙ্গ ছাড়া বাকি তিন উপজেলার হিসাব দেখাচ্ছে।
১০ বছর আগে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে জমির পরিমাণ কত ছিল জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এক মাস সময় নিয়েও কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
ওদিকে ২০১৬ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন হাওর ও জলাভূমি অধিদপ্তরের প্রকাশিত ‘ক্লাসিফিকেশন অব ওয়েটল্যান্ড অব বাংলাদেশ ভলিউম-৩’-এ দেখা যায়, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের মোট আয়তন ৬৯ হাজার ৮২৯ একর ৩৭ শতক। এর মধ্যে বাহুবল উপজেলায় ৩০ হাজার ১৫৬ একর ২০ শতক, বানিয়াচঙ্গ উপজেলায় ১৭ একর ২০ শতক, হবিগঞ্জ সদর ১৫ হাজার ৯০১ একর ৮৬ শতক ও নবীগঞ্জে ২৩ হাজার ৭৫৩ একর ৯৯ শতক।
হাওর এলাকায় দিনে দিনে জনবসতি বৃদ্ধি, হাজার হাজার পুকুর তৈরি, জমি ভরাট করে শিল্প-কারখানা স্থাপনের কারণে আগের চেয়ে এখন কৃষিজমির পরিমাণ অনেকটাই কমে আসছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. নূরে আলম সিদ্দিকী।
গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের আওতাধীন বাহুবল উপজেলার সাতকাপন ও স্নানঘাট ইউনিয়নের ছয়টি মৌজার নাম উল্লেখ করে গত ১০ বছরে কী পরিমাণ জমি বিক্রি করা হয়েছে, উল্লিখিত সময়ে জমির মূল্য কত ছিল জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার সুশান্ত ঘোষ এবং জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মৌজা হিসাব করে জমি কেনাবেচার তথ্য সংরক্ষণ করা হয় না। এসব উত্তর দিতে হলে প্রতিটি দলিল তল্লাশি করে বের করতে হবে, যা ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ।’
আবেদন-অনুমোদন খেলা
স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জানান, কাজী ফার্মের বিক্রি হওয়া জমির মধ্যে ৭৮ বিঘায় আগে তারা বর্গাচাষ করেছেন দীর্ঘদিন। ২০১৮ সালের দিকে জমির মালিকরা কাজী ফার্ম লিমিটেডের কাছে বিক্রি করে দেন। পরে কাজী ফার্ম প্রায় দুই বছর ধরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তুলে পুরো জমি উঁচু করে নেয়। তবে নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, এই জমির আগের মালিকের দলিল এবং বর্তমানে কাজী ফার্মের দলিল- দুই জায়গাতেই এটি এখনো ‘কৃষি’ শ্রেণি হিসেবেই আছে।
সরেজমিনে জানা যায়, চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের তলদেশ থেকে বালু তুলে বাহুবলে নির্মাণাধীন কয়েকটি স্থাপনা ও ছয় লেনের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করতে স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা মৎস্যজীবী লীগের নেতা তাজুল ইসলাম একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। হাওরে থাকা তার জমিতে ‘দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য’ বানানোর কথা বলে মাটি কেটে পাড় তৈরির অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন তিনি। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান এ বিষয়ে ইউএনও ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) প্রতিবেদন দিতে বলেন। অভিযোগ উঠেছে, ওই সিন্ডিকেট বাহুবল উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তাদের পক্ষে প্রতিবেদন করায়। প্রতিবেদন পেয়ে কয়েকটি শর্ত দিয়ে জেলা প্রশাসক মাটি কাটার অনুমোদন দেন। বাণিজ্যিক কাজে তাজুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের দীর্ঘদিন ধরে বালু তোলার বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানান স্থানীয় কৃষকরা। এ নিয়ে দেশ রূপান্তরসহ স্থানীয় পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে জেলা প্রশাসন তদন্ত করে এর সত্যতা পায় এবং অনুমোদন বাতিল করে। সরেজমিনে দেখা গেছে, বালু তোলা বন্ধ হলেও এখনো ড্রেজার মেশিন ও পাইপলাইন সরানো হয়নি।
গত ১৪ আগস্ট পরিবেশ অধিদপ্তর, হবিগঞ্জ কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, কাজী ফার্ম বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ডিজাইন না দেওয়ায় তাদের পরিবেশ ছাড়পত্রের আবেদন বাতিল করা হয়েছে। একই দিন জেলা প্রশাসন অফিসের রাজস্ব শাখায় যোগাযোগ করে জানা গেছে, কাজী ফার্ম বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য কোনো আবেদনই করেনি। অফিস সহকারী আব্দুল ওয়াদুদ বিভিন্ন ফাইলপত্র ঘেঁটে ওই কোম্পানির মাধবপুর উপজেলায় কয়েকটি প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন পেয়েছেন।
আব্দুল ওয়াদুদ জানান, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় ৫ একর ৭৪ শতক জমি শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ নামে একটি কোম্পানির আবেদন গত ২৩ জানুয়ারি মঞ্জুর হয়েছে। এ ছাড়া ওই কোম্পানি হাওর থেকে দুই-তিন কিলোমিটর দূরে পশ্চিম ম-লকাপন, হায়দরচক মৌজার ৬টি প্রজেক্টের জন্য প্রায় ৬৩ একর জমি কিনেছে। এগুলোর মধ্যে দুই-একটি বাদে বাকিগুলোর শ্রেণি পরিবর্তন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গড়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য হাওরের দিকেই ধাবিত হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনবে।
শিল্পপতি পক্ষের ভাষ্য
জানতে চাইলে কাজী ফার্মের ম্যানেজার (অ্যাডমিন) জিয়াউল হক দেশ রূপান্তরের কাছে দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা আছে। গত ৭ আগস্ট মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে জিয়াউল হক জানান, বাহুবল স্নানঘাটে তাদের প্রতিষ্ঠানে ডিম উৎপাদন পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। এখানে লেয়ার মুরগির ডিম ছাড়াও কম্পোস্ট সার উৎপাদন হবে। এসব মুরগি খুবই স্পর্শকাতর। পরিবেশ একটি বড় বিষয়। যদি এখানকার পরিবেশ অনুকূলে থাকে, তাহলে আরও কী কী উৎপাদন করা যাবে তা পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বায়ুদূষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশে^র নামকরা প্রতিষ্ঠান জার্মানির ‘বিগ ডাচম্যান’-এর সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। ফলে প্রকট দুর্গন্ধ বেরোনোর শঙ্কা খুবই কম। তবে তিনি এও বলেন, সব প্রাণীর শরীরেই গন্ধ থাকে। লাখ লাখ মুরগি যেখানে থাকবে, সেখানে কিছু গন্ধ তো হবেই।
মুরগির বিষ্ঠা সংরক্ষণের ব্যাপারে জিয়াউল হক বলেন, এর গন্ধ বের হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে গন্ধ দূর করা হয়। হাওরের জমি ভরাট করে শিল্প গড়ার আইনি দিক সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছাড়া এ-সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়।’
গত ২৪ আগস্ট বাহুবল উপজেলার আব্দাকামাল এলাকায় আকিজ ভেঞ্চার গ্রুপের নির্মাণাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্থানীয় ম্যানেজার (অ্যাডমিন) হাবিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, উপজেলার পুটিজুরী, সাতকাপন, স্নানঘাট ইউনিয়নের বিভিন্ন মৌজায় আকিজ গ্রুপের জমি রয়েছে। বর্তমানে আব্দাকামাল এলাকায় প্রায় ৬৫ একর জমিতে বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনের কাজ চলছে। গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই কিলোমিটারের মতো দূরে এই ‘শিল্পপার্ক’ নির্মাণের পর হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় তাদের আরও যে ৫৭৪ শতক জমি রয়েছে, তাতে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প গড়ে তোলা হবে। তিনি দাবি করেন, ইতিমধ্যে প্রশাসনের কাছ থেকে তারা জমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছেন।
‘খুবই অন্যায় হবে’
পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, হাওরে নিচু জমি ভরাট করে যদি শিল্প গড়া হয়, তাহলে পরিবেশের ওপর খুবই অন্যায় করা হবে। প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে হাওরের পানি প্রবাহ ও পানি ধরে রাখার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে এমন অবকাঠামো করা যাবে না। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের সময় হাওরের পানি প্রবাহ যাতে সঠিক থাকে, এ জন্য তিনি সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডিকে।
তিনি আরও বলেন, ‘উজান থেকে নেমে আসা পানির সঙ্গে বালু আসার ফলে অধিকাংশ হাওরের বুক বালুমাটি এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। হাওর ও বিলগুলোকে পুনঃখনন করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। এখন সেখানে যদি মাটি ভরাট করে শিল্প গড়া হয়, সেটা কখনোই কাম্য নয়।’
লাক্সারিয়াস জীবন পাওয়ার জন্য এখন মানুষ দিনরাত শুধুই কাজ করে চলেছেন। যার মধ্যে অফিস ডেস্কে বসে কাজ করেন এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চেয়ারে বসে ল্যাপটপের সামনে তাকিয়ে থাকা রীতিমতো যন্ত্রণাদায়ক।
শুধু তাই নয়, এটা স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। যারা অফিসে ডেস্কে কাজ করেন তাদের মোটা হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
সারাদিন যারা ডেস্কে বসে কাজ করেন তাদের অন্যতম অভিযোগও এটি। তারা বলে থাকেন, চেয়ারে বসে কাজ করে মোটা হয়ে যাচ্ছি! তবে এই অজুহাতকে একেবারে সত্য বলার সুযোগ নেই। কারণ ডেস্কে বসে কাজ করেও স্লিম ও ফিট থাকা সম্ভব। এজন্য মেনে চলুন পাঁচটি টিপস।
হাঁটুনফিট ও কর্মক্ষম থাকতে নিয়মিত হাঁটুন। দিনের পর দিন দীর্ঘ সময় বসে থাকলে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। সুস্থ থাকতে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করুন। এমনকি কাজের ফাঁকেও ১০ মিনিটের ব্রেক নিয়ে হেঁটে আসতে পারেন।
সোজা হয়ে বসুনচেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসুন। মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলোতে অনেক চাপ পড়ে, সেই সঙ্গে চাপ পড়ে মেরুদণ্ডের পাশের মাংসপেশি ও লিগামেন্টের ওপর। কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় মনিটরটি চোখের সমান স্তরে রাখুন। মাউস ব্যবহার করার সময় শুধু আপনার কব্জি নয় পুরো হাত ব্যবহার করুন।
চাপ এড়িয়ে চলুনএটা খুব কঠিন কাজ, চাপমুক্ত থাকা। বিশেষ করে যখন চারপাশ থেকে নানা ধরনের চাপ আসতে থাকে। তবে মানসিক স্থিরতা ধরে রাখুন, নিজেকে মোটিভেট করুন। কোনও চাপই বেশি দিন থাকে না, এগুলো নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট না করে নিজের কাজে মনোযোগ বাড়ান। এক্ষেত্রে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে অনলাইনে কিছু যোগা শিখে অভ্যাস করুন।
চোখের যত্নকম্পিউটারে কাজ করার সময় স্ক্রিনে একটানা ১০-১৫ মিনিটের বেশি তাকিয়ে থাকবেন না। নিয়মিত চোখের পাতা ফেলুন। স্ক্রিনে পর্যাপ্ত আলো রাখুন, যেন চোখের ওপর বাড়তি চাপ না পড়ে।
হাড়ের যত্ন বসে থাকার ফলে হাড় দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ক্যালসিয়ামের ঘাটতিও হতে পারে। এজন্য নজর দিতে হবে প্রতিদিনের খাবারে স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে নিয়মিত ডিম, দুধ, দই ও বাদাম রাখুন।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কোন দেশে ভালো চিকিৎসা হতে পারে তার খোঁজ নিচ্ছে বিএনপি। এর অংশ হিসাবে ঢাকায় জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসা জার্মানিতে হতে পারে কিনা জানতে চেয়েছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। মঙ্গলবার জানতে চাইলে ঢাকায় জার্মানির সিডিএ জান রল্ফ জানোস্কি বলেছেন, ‘মির্জা ফখরুলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। মিসেস জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার ধরন সম্পর্কে জেনেছি। তার ভালো চিকিৎসা বিশ্বের খুব কম দেশে সম্ভব। জার্মানিতে এসব সমস্যার খুব ভালো চিকিৎসা আছে। সরকারের অনুমোদন পেলে তিনি জার্মানিতে চিকিৎসা নিতে পারেন।’ এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি তিনি।
৯ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়লে খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর লিভারের জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কিডনির কর্মক্ষমতা কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ফলে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এ কারণে কয়েকবার তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করা হয়েছিল। এখন কেবিনে মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) লিভার, কিডনি, হার্ট, ফুসফুসসহ সার্বিক অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণে সম্প্রতি দুবার সিসিইউতে নিতে হয়। এখন মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন। ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ।
তিনি আরও জানান, মেডিকেল বোর্ড মনে করে সর্বসম্মতভাবে তাদের পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অতি দ্রুত বিদেশে লিভার প্রতিস্থাপনে সম্মিলিত আধুনিক মাল্টি ডিসিপ্ল্যানারি মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া জরুরি। তাহলেই তিনি শঙ্কা মুক্ত হতে পারেন বলে বোর্ড রিকমেন্ডেশনে বলেছেন।
এর আগে ১৩ জুন রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ওই সময় ৫ দিন পর তিনি বাসায় ফেরেন। গত বছরের জুনে খালেদা জিয়ার এনজিওগ্রাম করা হলে তার হৃদযন্ত্রে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর একটিতে রিং পরানো হয়। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রারাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ও হৃদরোগে ভুগছেন।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। এ অবস্থায় তাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে উন্নত চিকিৎসায় বিদেশে পাঠানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিবারই সরকার সেসব আমলে না নিয়ে খালেদা জিয়াকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখন দলীয় ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। আগের মতোই লিভারের জটিলতার পাশাপাশি ফুসফুসের জটিলতা নিয়ে শঙ্কিত তার চিকিৎসকরা। মেডিকেল বোর্ডের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার ফুসফুস থেকে পানি বের করা হয়েছে। শরীরে ক্যাথেডর লাগানো হয়েছে। আগে যেখানে দুই-তিন দিন পরপর পানি বের করা হয়েছে, এখন প্রতিদিনই পানি বের করতে হচ্ছে। তার কেবিনে মঙ্গলবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়েছে। ওই চিকিৎসক আরও বলেন, খালেদা জিয়ার অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি নেই। লিভার সিরোসিসের সঙ্গে কিডনির জটিলতাও বাড়ছে। তার লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া সামনে বিকল্প নেই। এর জন্য খুব দ্রুত উন্নত চিকিৎসায় বিদেশ পাঠানো দরকার।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা খুবই গুরুতর। গত সোমবার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন তার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। আবেদনটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ে আছে। গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত তাকে অনুমতি দেওয়ার কোনো খবর পাওয়া যায়নি বলে খালেদা জিয়ার একান্ত সহকারী জানিয়েছেন।
পাশাপাশি সরকারের অনুমতি পেলে দ্রুততম সময়ে তাকে বিদেশে নিতে ভিসা-প্রক্রিয়া শুরু থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ প্রয়োজনীয় সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। সরকারের সবুজ সংকেত না পাওয়ায় ভিসা করানো যাচ্ছে না।
গতকাল শুক্রবার দেশ রূপান্তরকে এসব কথা জানিয়েছেন খালেদা জিয়ার মেজো বোন সেলিমা ইসলাম।
তিনি বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালের খোঁজখবর নিচ্ছেন যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান। শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ থাকলে প্রথমে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হতে পারে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নত হলে অন্য দেশে নেওয়া হবে।
সেলিমা ইসলাম বলেন, ‘আমার বোন হেঁটে জেলে গেলেন। জেলে থাকাবস্থায় অসুস্থ হলে তাকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। এরপর করোনার কারণে সরকার তাকে দুটি শর্তে মুক্তি দেয়। তখন থেকেই আমরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে আবেদন করে আসছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার তাকে মুক্তি দেয়নি। বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে না পারায় দিনের পর দিন তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে আমার বোন।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী এবিএম আব্দুস সাত্তার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি নেতারা সার্বক্ষণিক চেয়ারপারসনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আমরা সরকারের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে আমরা দ্রুততম সময়ে চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠাতে পারব।’
জিয়া পরিবারের সদস্যরা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য তারা সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। অনুমতি পাওয়া মাত্র সব ধরনের পদক্ষেপ নেবেন। ইতিমধ্যে ভিসা প্রস্তুতিসহ অন্যান্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। বিদেশে নেওয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ অন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে যাবেন তার পুত্রবধূ শর্মিলা রহমান, ব্যক্তিগত সহকারী ফাতেমা ও ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসেন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি। তখন থেকেই তিনি হাসপাতালে খালেদা জিয়ার সেবায় সার্বক্ষণিক থাকছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আজ (গতকাল শুক্রবার) ম্যাডাম শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে বিকেলে তাকে তৃতীয়বারের মতো কেবিন থেকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নেওয়া হয়। রাতে আবার তাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। এর আগে ২২ সেপ্টেম্বর তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা অবনতি হওয়ায় হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে সিসিইউতে নেওয়া হয়েছিল। পরে অবস্থার উন্নতি হলে তাকে ফের কেবিনে স্থানান্তর করা হয়।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত চিকিৎসক দলের সদস্যরা জানান, খালেদা জিয়া ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। একই বছরের নভেম্বরে তার চিকিৎসকরা জানান, তিনি লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত দলীয় মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা তখন জানিয়েছিলেন, তাদের সাধ্য অনুযায়ী যতটুকু করার ছিল, তারা তা করেছেন। পরবর্তী চিকিৎসা যুক্তরাজ্য, জার্মানি অথবা যুক্তরাষ্ট্রে করার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পরিবারকে বলেছেন। পরের বছর জুন মাসে খালেদা জিয়ার হার্টে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর মধ্যে একটিতে রিং পরানো হয়। এখনো তার হার্টে দুটি ব্লক রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পাশাপাশি আমরা বিএনপি নেতারা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চেয়ারপারসনের পরিবারকে সার্বিক সহযোগিতা দিতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে দ্রুতই চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠানো হবে।’
গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহিলা দলের উদ্যোগে আয়োজিত সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘যে মানুষটি আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, তাকে আজ সরকার গৃহবন্দি করে রেখেছে। তিনি গুরুতর অসুস্থ হলেও তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। আমরা আশা করি, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে তার পরিবার যে আবেদন করেছে, তা সরকার বাস্তবায়ন করবে।’
সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ এক দফা দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে আটক রাখা হয়েছে। কারণ উনি মুক্ত থাকলে ওনাদের ক্ষমতায় থাকা কঠিন হয়ে যাবে। উনি মুক্ত থাকলে দেশের গণতন্ত্র মুক্ত থাকবে। উনি মুক্ত থাকলে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে না।’
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী, সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছে। ফলে এখন জেলে যাওয়া বা আদালতের আশ্রয় নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। ওই ৪০১ ধারাতেই বলা আছে, নির্বাহী আদেশে শর্ত ছাড়াই মুক্তি দেওয়া যায়। এমনকি সরকার সাজা মওকুফও করতে পারে। ফলে সরকারই শর্তহীন মুক্তি দিয়ে খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে।’
গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর বিষয়ে দুই-তিন দিন আগে তার ভাই শামীম এস্কান্দার এসেছিলেন। তিনি আবেদন জমা দিলে তা আইনমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে ব্যাখ্যার জন্য।
আবেদনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে থাকা বিএনপি নেতারা।
তারা গত বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছেন। খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। তারাও অপেক্ষা করছেন যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাবেন ওই নেতারা।
খালেদা জিয়াকে জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়ে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশে^র যে কয়েকটি দেশে সম্ভব, জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। এরপর থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এর আগেও অবশ্য খালেদা জিয়াকে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদযন্ত্রে জটিলতা, ফুসফুস, চোখ ও দাঁতের নানা সমস্যায় ভুগছেন। এ ছাড়া তার মেরুদ-, হাত ও হাঁটুতে বাতের সমস্যাসহ আরও কিছু শারীরিক জটিলতা রয়েছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার সাজা হয়। সেদিন থেকে প্রায় দুই বছর কারাবন্দি ছিলেন তিনি। এ ছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আরও সাত বছরের সাজা হয় খালেদা জিয়ার। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ করোনা মহামারির শুরুতে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার সাজা স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দিয়েছিল সরকার। এরপর থেকে তার মুক্তির মেয়াদ ছয় মাস করে বাড়ানো হচ্ছে।