
পৃথিবীর যে কোনো দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের আন্দোলনে যুবদের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। যুবদের সঠিক পথে পরিচালনা এবং তাদের গঠনমূলক কাজে লড়াই সংগ্রামে শামিল করার লক্ষ্যে পৃথিবীর দেশে দেশে গড়ে উঠেছে যুব সংগঠন। বিশ্ব যুব আন্দোলনের এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে। আমরা যদি পেছন ফিরে তাকাই তাহলে দেখব বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির অভ্যুদয়ে অনন্য অবদান রেখেছে তরুণ-যুবারা। কিন্তু আজ যুব সংগঠন মাত্রই চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি নিয়ে ব্যস্ত থাকে এমন একটা ধারণা আছে আমাদের অনেকের মধ্যেই। তার ওপর যুব সংগঠনটি যদি ক্ষমতাসীন দলের হয় তাহলে তো কথাই নেই। অন্যদিকে বিরোধী দলের যুব সংগঠনও যে এর ব্যতিক্রম তা নয়। গত জুলাই মাসের ৮ তারিখেই খবরের কাগজের শিরোনাম ‘বিএনপির তারুণ্যের সমাবেশ প্রতিহত করবে যুবলীগ’। যেন এই পাল্টাপাল্টি রাজনীতির লেঠেল হওয়া ছাড়া এসব সংগঠনের আর কোনো তাৎপর্য নেই। এই বাস্তবতায় ২৮ আগস্ট বাংলাদেশের যুব আন্দোলনের এক ঐতিহাসিক দিন।
এক : যুব সমাজের সমস্যা সমাধান, তাদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন এবং দেশ-জাতির প্রতি তাদের দায়িত্ব পালনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে যুব সমাজের নিজস্ব সংগঠন হিসেবে এই দিনে জন্মলাভ করেছিল বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন। এই সংগঠন যুবসমাজের স্বার্থের প্রতি বিশ্বস্ত ও অবিচল থেকে যুবকদের প্রকৃত আন্দোলনের নিরলস সংগ্রাম করে আসছে।
দুই : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধুর হত্যার মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে স্বরূপে নতুনভাবে জেগে ওঠে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, অগণতান্ত্রিক সামরিকতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন। এ অবস্থায় যুব আন্দোলন, যুব মানসিকতা, নতুন কাজের ধারা, মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় অসীম তারুণ্য নিয়ে ১৯৭৬ সালের এই দিনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন। গোপীবাগে শ্রমিক নেতা ও রাজনৈতিক নেতা সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিকের একটি বাসার ছাদে সদ্য ছাত্র আন্দোলন শেষ করা কজন যুবক, যাদের অধিকাংশই ছিলেন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা, তাদের মধ্যে নুরুল ইসলাম নাহিদ, প্রকৌশলী আবুল কাশেম, প্রকৌশলী মুহম্মদ হিলালউদ্দিন, শহীদুল আলম বাদল, হারুনূর রশীদ, নজরুল ইসলাম, শামসুল বারী, জীবন কৃষ্ণ সাহা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তী সময় যুক্ত হন আরও অনেকে। তাদের ওপর কারাবরণ, হুলিয়া, শাসকগোষ্ঠীদের আঘাত এসেছে বারবার। তবু তারা মাথানত করেননি। অবরুদ্ধ-টালমাতাল সময়ে সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য যে সংগঠন গড়ে উঠেছিল, প্রথম তার নাম ছিল ‘গণতান্ত্রিক যুব ইউনিয়ন’।
তিন : ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর নবাবপুর মাহবুব আলী ইনস্টিটিউটে প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সংগঠনের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন সদ্য বিদায়ী ডাকসুর ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। সেই দিনই বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক যুব ইউনিয়নের প্রথম আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়। আহ্বায়ক নির্বাচিত হন প্রকৌশলী আবুল কাশেম। ১৯৭৭ সালের ৯-১০ জানুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে সংগঠনের প্রথম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন’। সেই সম্মেলনে প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন প্রকৌশলী আবুল কাশেম।
চার : বৈরী সময়ের গুমোট পরিবেশে যুব ইউনিয়ন জ¦লে উঠে ১৯৮৬-১৯৮৯ পর্বে। সব প্রচেষ্টা ছিল একটি বিপ্লবী যুব আন্দোলন গড়ে তোলার। সংকট, সমস্যায় হতাশ যুবকের ভেতর প্রাণের স্পন্দন ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যুব ইউনিয়নের নিরলস প্রয়াস অব্যাহত ছিল। এ সময়কালে যুব ইউনিয়নে নতুন মাত্রা ও সফলতার যুগ শুরু হয়।
পাঁচ: ১৯৮৭ ও ৮৮ সালে দুই দফা দেশে ভয়াবহ বন্যা হয়। সে সময় বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের সেগুনবাগিচা অফিসে কেন্দ্রীয়ভাবে খাবার স্যালাইন তৈরি করার কাজ শুরু হয়। দলে দলে ছাত্র-তরুণরা এ কাজে অংশগ্রহণ করে। সবাই স্বেচ্ছাশ্রম দেয়। যুব আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠে। যুবকরা ছাড়াও সেই সময়ের বহু রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এ কাজে সরাসরি জড়িত হন। ১০ লক্ষাধিক স্যালাইন সে সময় উৎপাদন করা হয়। তা ছাড়া নিজেরা রুটি বানানোসহ বিভিন্ন বাসাবাড়িতে রুটি সংগ্রহ করে সারা দেশে তা বিতরণ করা হয়।
বন্যা-পরবর্তী কলেরা মহামারী ঠেকাতে স্যালাইন প্রকল্পের পাশাপাশি শহর পরিচ্ছন্ন কর্ম-অভিযান শুরু করা হয়। দরিদ্রদের মাঝে রিকশা, সেলাই মেশিন বিতরণ করা হয়। গাজীপুর খালিয়াজুরিসহ কয়েক স্থানে গৃহহীনদের ঘর করে দেওয়া হয়। বন্যাকবলিত এলাকার নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে রাতে পাহারার ব্যবস্থা করা হয়।
১৯৮৭ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের কাণ্ডারি মোহাম্মদ ফরহাদ চিকিৎসার জন্য মস্কোতে ছিলেন। একদিন তিনি যুব ইউনিয়নের সবার উদ্দেশে লিখলেন, ‘আপনারা এতদিন পর বোধহয় পথ খুঁজে পেয়েছেন। আপনাদের দীর্ঘদিনের পরিশ্রম বৃথা যায়নি। এ ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’
ছয় : স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থান, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন, জাতীয় সম্পদ রক্ষা আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদবিরোধী আন্দোলন, কর্মসংস্থানের দাবিতে যুব কনভেনশন, জঙ্গিবাদবিরোধী আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও গণজাগরণ মঞ্চ সৃষ্টি, নারী যুব ক্যাম্প, করোনাকালীন হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি, খাদ্য সহায়তা, চিকিৎসা সহায়তা ইত্যাদি বহুবিধ কাজে বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন এক সাহসী-উদ্যোগী ভূমিকা রেখেছে। এ ছাড়া ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ডেঙ্গু প্রতিরোধে গণসচেতনতা সৃষ্টি ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, কর্মসংস্থানের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। সংগঠনটি সবসময় চেয়েছে যুবকদের অংশগ্রহণে সমাজতান্ত্রিক ধারায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক বিকাশ, প্রতিটি নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করার গণআন্দোলন। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এ লক্ষ্যে দেশের যুবকদের কর্মসংস্থানের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে। প্রতিকূল অবস্থায় সিলেটে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নামকরণ নিয়ে কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ আহুত অনশন আয়োজন করেছে। যুব ইউনিয়নের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী এতে অংশগ্রহণ করেছেন। এ কর্মসূচির নেপথ্য ভূমিকা পালন করেছে বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে চাকরিক্ষেত্রে ব্যাংক ড্রাফট প্রথা প্রত্যাহার যুব ইউনিয়নের নিরন্তর আন্দোলনে সম্ভব হয়েছে। ২০০৯ সালের ১৫ নভেম্বর টিপাইমুখ বাঁধের প্রতিবাদে যুব ইউনিয়ন ঢাকা থেকে সিলেট রোডমার্চ করে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ২০১০ সালের ২৬ মার্চ সাভার মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ থেকে শুরু করে প্রায় ১৪ কিলোমিটার হেঁটে যুব ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পর্যন্ত পদযাত্রা করেন। ২০১৬ সালের ২৭ আগস্ট ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় জঙ্গিবাদবিরোধী জাতীয় যুব কনভেনশন।
সাত : কর্মসংস্থান সংকটে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে ‘নিয়োগ বাণিজ্য’। একজন সাধারণ যুবককে তার শিক্ষাজীবনের পরীক্ষা প্রস্তুতির পাশাপাশি, শিক্ষা শেষে চাকরি পেতে আর্থিক প্রস্তুতিও গ্রহণ করতে হচ্ছে। একদিকে কর্মহীন যুবকদের ব্যাপকতা, অন্যদিকে সীমিত কর্মসংস্থান সংকটকে আরও তীব্র করেছে। বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সারা দেশে ‘ঘুষ ছাড়া চাকরি চাই’ দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে।
আট : বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন ১৯৮২ সাল থেকে বিশ্ব যুব ফেডারেশনের সাধারণ পরিষদের (জিসি) সদস্য। বিশে^র ১২৩টি দেশের ১৯৫টি পূর্ণ সদস্য সংগঠনসহ ৩ শতাধিক সংগঠন নিয়ে গঠিত বিশ^ গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন (উফডি)। বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন ‘উফডি’র জিসি সদস্য হিসেবে আন্তর্জাতিক যুব আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে।
নয় : যুব ইউনিয়নের সঙ্গে এ দেশের বামপন্থি রাজনৈতিক শক্তির সম্পর্ক পুরনো। ১৯৫১ সালের মার্চে এ ভূখণ্ডে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়েছিল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে এই সংগঠনের নেতাকর্মীরা ঢাকাসহ প্রদেশের সর্বত্র তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ভাষা আন্দোলনকে শক্তিমান করে তোলার বিষয়টিও তাদের চিন্তায় ছিল। তবে বিশেষ সতর্কতা ছিল একে কমিউনিস্ট পার্টির অঙ্গসংগঠনের বদলে উদার গণতন্ত্রী প্রগতিবাদী ধারায় সংগঠিত করা, যাতে উদার ভিন্ন চিন্তার রাজনীতিমনস্ক যুবকরাও এতে অংশ নিতে পারেন। বাস্তবে তা-ই ঘটেছিল। এই সংগঠন সম্পর্কে যে যেমনই বলুন, এর মিশ্র রাজনৈতিক চরিত্র সত্ত্বেও এতে ছিল প্রগতিবাদী সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের প্রাধান্য। গণতান্ত্রিক যুবলীগকে চিন্তায় রেখে যুব ইউনিয়নের নামের আগে ‘গণতান্ত্রিক’ শব্দটি যুক্ত হয়।
১৯২০ সালে লেনিন যুবকদের উদ্দেশে বলেন, আগামী দিনে সাম্রাজ্যবাদ-ফ্যাসিবাদবিরোধী ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব গড়ে তোলার লাল ঝাণ্ডা ওড়াতে যুবকদের এগিয়ে নিতে হবে। তিনি যুবসমাজকে তার লড়াই-সংগ্রামে স্বপ্ন দেখিয়ে গেছেন। কাজেই বিশ্বব্যাপী সংগ্রামে শুরু হয়েছিল নবধারার যুব আন্দোলন। বর্তমান বিশ্বে সংগ্রামের চেহারা বদলে যাচ্ছে। আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যুবকদের রাজনৈতিক সংগঠন থাকা অত্যন্ত জরুরি। এই বাস্তবতায় রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, দেশপ্রেমিক মানস গঠনে জন্মলগ্ন থেকেই ভূমিকা রেখে চলেছে যুব ইউনিয়ন।
তথ্য সহায়তায় : মাহবুব জামান, মুহম্মদ হিলাল উদ্দিন, কামরুজ্জামান ননী।
লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক
সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ব্রিকসের ১৫তম শীর্ষ সম্মেলন শেষ হলো। ব্রিকস নিয়ে বিশ্বের বিকাশমান অর্থনীতি ও উদীয়মান বাজারগুলোর আগ্রহ চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশও এই আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক জোটে যোগ দিতে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছে, ইতিমধ্যে দেশটি ব্রিকসের গড়ে তোলা নতুন উন্নয়ন ব্যাংক (New Development Bank, NDB)-এর সদস্য পদ লাভ করেছে। জানা গেছে, এ পর্যন্ত ৪০টি দেশ এই জোটে যোগদান করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং ২২টি দেশ ইতিমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদনও করে ফেলেছে। সর্বশেষ শীর্ষ সম্মেলনে তাদের মধ্য থেকে ৬টি দেশকে সদস্য হিসেবে গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশ নেই। এখন বাংলাদেশের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই।
শীর্ষস্থানীয় মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংকিং ও বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান সাক্সের একজন অর্থনীতিবিদ জিম ও’ নীল ২০০১ সালে তার একটা গবেষণার প্রতিবেদনে এই ‘ব্রিকস’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। তাতে ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া ও চায়নার আদ্যাক্ষর দিয়ে কাল্পনিকভাবে গঠিত ‘BRIC শব্দ-সংক্ষেপের শেষে দেশগুলোর বহুবাচনিকতা অর্থে ‘ং’ বর্ণটা যুক্ত করেন, তখন শব্দ সংক্ষেপটা হয়ে পড়ে BRICs। তবে ২০১০ সালে এই জোটে দক্ষিণ আফ্রিকা যোগদান করায় শব্দ-সংক্ষেপটার প্রতিটি বর্ণ জোটভুক্ত একেকটা দেশের আদ্যাক্ষরের প্রতিনিধিত্ব শুরু করে; নাম হয়ে যায় ইজওঈঝ। গোল্ডম্যান সাক্সের দাবি ছিল যে, বিকস দেশগুলো জি-৭ ভুক্ত দেশগুলোর তুলনায় দ্রুততর গতিতে উন্নতি লাভ করতে থাকবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে এই চারটি দেশ উন্নতিতে জি-৭ কে ছাড়িয়ে যাবে। কারণ তাদের উন্নয়নের হার তখনই ছিল অত্যন্ত দ্রুতগতিসম্পন্ন। তা ছাড়া তাদের রয়েছে অনেক তুলনামূলক সুবিধা- উদীয়মান বাজার, পর্যাপ্ত জনগোষ্ঠী বা ভোক্তা শ্রেণি, বিপুল ভূ-সম্পত্তি, সস্তা শ্রমশক্তি, অবারিত প্রাকৃতিক সম্পদ, অনুকূল জনমিতি প্রভৃতি।
ও’ নীলের এই কাল্পনিক জোটকে বাস্তবে রূপ দিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ২০০৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় অংশ গ্রহণকালে সাইড লাইনে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা করেন। এরপর ২০০৮ সালে মন্ত্রিপর্যায়ের আনুষ্ঠানিক বৈঠকে সমঝোতার পর ২০০৯ সালে ব্রিক্সের প্রথম শীর্ষপর্যায়ের সভা অনুষ্ঠান করেন। সেই থেকে প্রতিবছর এই জোটের শীর্ষপর্যায়ের সভা অনুষ্ঠান হয়ে আসছে; চক্রাকারে এক বছরের জন্য প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্রের সরকার প্রধান/রাষ্ট্রপ্রধান চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তবে এটা বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা ওপেকের মতো আনুষ্ঠানিক কোনো বহুমুখী প্রতিষ্ঠান না। এখানে জোটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হচ্ছে সর্বসম্মতির ভিত্তিতে। অভিন্ন উন্নয়ন স্বার্থ ও বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থার অন্বেষণে পরস্পরের সংযোগ স্থাপন করাই এর মূল লক্ষ্য।
অনেকেই মনে করেন, এটা আসলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তি প্রভাবিত বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থার একটা বিকল্প আয়োজন। তবে এই জোটের অন্যতম দুই সদস্য ভারত ও ব্রাজিল প্রথম থেকেই বলে আসছে যে, এটা মার্কিন বিরোধী কোনো সংস্থা নয়। কিন্তু এটা ঠিক যে, এই দেশগুলোতে বিগত দুটি দশকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে উন্নতি হয়েছে ও সাফল্য এসেছে, তা ছিল অভূতপূর্ব। এমন কি, বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকটের সময়ও তাদের আর্থিক সাফল্য ছিল উন্নত দেশগুলোর চেয়ে ভালো। অথচ সে তুলনায় বিশ্ব অর্থব্যবস্থা পরিচালনায় তাদের তেমন কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, বা সেখানে তাদের কোনো আওয়াজও আমলে নেওয়া হয়নি। সে জন্য উন্নত বিশ্বের ওপর তাদের চাপা ক্ষোভ রয়েছে। ফলে নিজেদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সমন্বয় সাধন ও অর্থায়ন এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লেনদেন সহজ ও গতিশীল করতে এই জোট ইতিমধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিয়েছে এবং আরও কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থা গড়ে তোলার পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে, যেগুলো মার্কিন নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে; যেমন এই জোট ২০১৪ সালে নতুন উন্নয়ন ব্যাংক (New Development Bank, NDA) ও কন্টিনজেন্ট রিজার্ভ ব্যবস্থা (Contingent Reserve Arrangement, CRA) গড়ে তুলেছে, যেগুলোকে পশ্চিমা শক্তির প্রভাবাধীন ব্রেটন উডস প্রতিষ্ঠান বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ছায়ারূপ হিসেবে অনেকে গণ্য করেন।
শুরুতে এই জোটের সদস্য সংখ্যা ছিল চার, তারপর ২০১০ সালে সেটা দাঁড়ায় ৫। কিন্তু এই মুহূর্তে এই জোটের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে; ৪০টি দেশ জোটে যোগ দিতে আগ্রহী, তার মধ্যে ২২টি ইতিমধ্যে যোগদানের জন্য আবেদন করেছে। এর প্রধান কারণ বর্তমান ইউনিপোলার বৈশ্বিক ব্যবস্থায় পশ্চিমা বিশে^র দাদাগিরি ও মোড়লিপনা। কভিড ১৯-এর সময় উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো পশ্চিমাদের জ্বালাতন ভালোভাবে টের পায়; উন্নত বিশ্ব তখন কভিডের প্রয়োজনাতিরিক্ত টিকা সংরক্ষণ করে রাখায় এসব দেশগুলোর নিরাপত্তাহীনতা, অস্থিরতা ও দুর্দশা বাড়ে। বর্তমানে চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ ও তার দুষ্ট প্রভাবে এসব উন্নয়নশীল দেশ ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে, অথচ এ যুদ্ধ উন্নত বিশ্বের একদেশদর্শী সিদ্ধান্তের ফসল বলে তারা মনে করছে। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের যুগে উভয় মেরু থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে তৃতীয় বিশ্ব যেমন ১৯৫৫ সালে বান্দুং সম্মেলনের মাধ্যমে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন গড়ে তোলে, তেমনি এখন তারা ব্রিকসের মতো উন্নয়নশীল দেশের জোটে যোগ দিয়ে ইউনিপোলার কর্র্তৃত্বের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে চাচ্ছে। তা ছাড়া, এর পেছনে আরও রয়েছে তাদের অদমিত উন্নয়ন প্রত্যাশা।
ব্রিকস দেশগুলোর লোকসংখ্যা বৈশ্বিক মোট জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ, এদের জিডিপি বিশে^র ২৬ শতাংশ এবং বাণিজ্য বিশে^র ১৮ শতাংশ এবং ভূখণ্ড পৃথিবীর ৩০ শতাংশ। যোগদানের জন্য অপেক্ষমাণ থাকা দেশগুলো বিবেচনায় নিলে এ জোটের শক্তি ও সম্ভাবনা সহজেই আঁচ করা যায়; ঠাহর করা যায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দরকষাকষিতে এর শক্তিমত্তা। ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর যেভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, কূটনৈতিক দিক থেকে সেসব নিষেধাজ্ঞা ব্রিকস প্রচ্ছন্নভাবে খাটো করে ফেলেছে। এখন ডলারকে দুর্বল করে দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী মুদ্রার মর্যাদা থেকে তাকে নামিয়ে আনার পদক্ষেপও ব্রিকস নেবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। তারা বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেন সহজ ও নির্বিঘœ করতে নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তনের চিন্তাভাবনা করছেন, সুইফটের বিকল্প চৌকস কোনো আন্তঃরাষ্ট্রীয় লেনদেনের ব্যবস্থা প্রবর্তনের চেষ্টাও তাদের আছে। এসব ব্যবস্থা উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়ন প্রচেষ্টা যেমন ত্বরান্বিত করবে, তেমনি তাদের সক্ষমতাও বাড়াবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব শান্তি, ন্যায়বিচার ও স্থিতিশীলতার দায়িত্ব নিতে ব্রিকসকে বিশ্বের বাতিঘর হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন এবং বর্তমান সময়ের প্রয়োজনে এটিকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্ল্যাটফরম হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার আশা পোষণ করেছেন। তিনি নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার চক্র বন্ধ করারও অনুরোধ করেছেন। এখানেই এই জোটে বাংলাদেশের যোগদান করার কারণ নিহিত, এখানে দেশের অবদান রাখার ক্ষেত্রও অবারিত।
ব্রিকসের স্বপ্নদ্রষ্টা জিম ও’ নীল যেসব সুবিধার জন্য দেশগুলোর দ্রুততর উন্নয়ন প্রাক্কলন করেছিলেন, বাংলাদেশে সেসব অধিকাংশ সুবিধা বিরাজমান; এখানে রয়েছে সস্তা শ্রমশক্তি, অনুকূল জনমিতিক সুবিধা, ক্রমবর্ধমান বাজার, বিশাল মধ্যবিত্ত ভোক্তা শ্রেণি, উদার বিনিয়োগ ও বাণিজ্যনীতি, প্রতিশ্রুতিশীল অবকাঠামো এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ। এর ফলে ব্রিকস দেশগুলোর মতো বাংলাদেশও কভিডের আগ পর্যন্ত দুই দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে আসছিল; এমনকি কভিডের মধ্যেও তার প্রবৃদ্ধি আশাজাগানিয়া। তার নমিনাল জিডিপি দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়েও কিছু বেশি, মাথাপিছু আয় ভারতের চেয়েও বেশি। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের অনেক নামিদামি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক বাংলাদেশকে অদূর ভবিষ্যতে ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির দেশ হিসেবে প্রাক্কলন করছে। বাংলাদেশ আবার ইতিমধ্যে ব্রিকসের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এনডিবির সদস্য পদও লাভ করেছে। এত কিছু অনুকূল শর্ত থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ কেন এবার ব্রিকসের সদস্যপদ পেল না, সদস্য পদ পেল ১১১ বিলিয়ন ডলারের জিডিপি ও ৮৫৭ ডলার মাথাপিছু আয়ের দেশ ইথিওপিয়া, সেটা আমার কাছে এক মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন বটে।
ব্রিকস একটা বড় সম্ভাবনাময় জোট হলেও এর কাঠামোর মধ্যে অনেক দুর্বলতা রয়েছে। এখানে নানা মত ও পথের সমাহার যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে সাংঘর্ষিক স্বার্থের বিস্তৃত উপস্থিতি। এমন একটা মিশ্র স্বার্থের জোটে স্থান করে নিতে শুধু দরখাস্ত দিয়ে বসে থাকলে চলবে না, তার জন্য চালাতে হবে বহুমুখী তদবির ও তৎপরতা। আবার কেউ যাতে তার প্রার্থিতাকে কোনো পক্ষের অন্ধ অনুসারী হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারে, তার জন্য অবলম্বন করতে হবে বিশেষ কৌশল। পত্রিকায় দেখলাম বাংলাদেশ শুধু দরখাস্ত দেওয়া ছাড়া আর কোনো অনুশীলন কর্ম সম্পাদন করেনি। সেটা যে করেনি, তা আগের দিন সাংবাদিকদের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রার অতি বিনয়ী অথচ সংক্ষিপ্ত কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছিল। এই জাতীয় গুণমানসম্পন্ন কূটনৈতিক দক্ষতা নিয়ে দেশ কীভাবে ২০২৬ সাল পর স্নাতকোত্তরকালে কঠিন প্রতিযোগিতা মোকাবিলা করবে, কীভাবে এফটিএ (Free Trade Agreemen), পিটিএ (Preferential Trade Agreement) ও সেপার (Comprehensive Economic Partnership Agreement)-এর জন্য নেগোশিয়েশন চালাবে, সেটাও আরেকটা প্রশ্ন।
ব্রিকসের সদস্য দেশগুলোর অধিকাংশেরই উন্নয়ন প্রচেষ্টা আমাদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। তাদের অনেকের যেমন আছে অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদ, তেমনি আমাদের আছে কঠোর পরিশ্রমী জনশক্তি। বাংলাদেশ এই জোটে যোগদান করতে পারলে পারস্পরিক উন্নয়নের ক্ষেত্র যেমন তৈরি করতে পারত, তেমনি তার দর-কষাকষির অবস্থানও শক্ত হতো। এবার ছয়জন নতুন সদস্য যুক্ত হওয়ায় এবং জোটে সর্বসম্মতির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের নিয়ম থাকায় আগামীতে এই ক্লাবে প্রবেশাধিকারের জন্য এখনকার ৫ জনের পরিবর্তে ১১ জনের কাছে ধরনা দিতে হবে। জ্ঞান, দক্ষতা ও পারঙ্গমতা থাকলে সেটাও কোনো বিষয় নয়। আশা করি আগামীতে স্মার্ট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পারদর্শী কুশীলবরা এক্ষেত্রে সরাসরি মঞ্চে উপস্থিত হয়ে তাদের দক্ষতার মহড়া প্রদর্শন করবেন।
লেখক: খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও কলামিস্ট
সমাজে খুব প্রচলিত একটা কথা আছে যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশজুড়ে কোনো প্রতিবাদ হয়নি। হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধুর মতো একটা মহান মানুষ হত্যার প্রতিবাদে যেভাবে বিক্ষোভে ফেটে পড়ার কথা ছিল সেভাবে হয়নি! তবে প্রতিবাদ হয়েছে। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ দলের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা প্রতিবাদ করেছে। প্রতিবাদ করেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ অন্যান্য দলের নেতারাও। ডাকসুর নেতৃত্বে রাজধানীতে সীমিত পরিসরে বিক্ষোভ হয়। নীরবে নিভৃতে লেখালেখি ও স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমেও প্রতিবাদ হয়। ইতিহাসের জঘন্যতম এই হত্যার প্রতিবাদে ‘টুঁ শব্দটিও’ হয়নি এই কথা যারা বলেন তারা খুব সচেতনভাবেই বলেন। তাদের ‘কৌশলী’ এই বক্তব্য অবচেতনভাবে গ্রহণ করে নেয় আওয়ামী লীগেরও অনেকে। তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার এই বক্তব্য যে সত্য নয় তার জ্বলন্ত প্রমাণ আছে।
এখনো বঙ্গবন্ধু হতাকান্ডের প্রতিবাদ জানানো ব্যক্তিত্বদের অনেকেই জীবিত রয়েছেন। অবশ্য কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করেই মারা গেছেন। ডা. আখলাকুল হোসাইন আহমেদ এমনি একজন মানুষ। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মহেশখলা ইয়ুথ ক্যাম্পে অনিশ্চিত জীবন যাপন করেছেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিশ্চিত জীবনের প্রত্যয়ে প্রবাসী সরকার ও সীমান্ত ক্যাম্পসমূহের মধ্যে সমন্বয়কারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার পদক্ষেপ নেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতিতে উন্নয়নের পাশাপাশি মানুষের মনন উন্নয়নের জন্য সাংস্কৃতিক জাগরণ সৃষ্টির লক্ষ্যেও তিনি কাজ শুরু করেন। কিন্তু তাকে সময় দেয়নি ঘাতকরা। দেশ যখন উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই একাত্তরের পরাজিত শক্তি জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করে। দেশ থমকে যায়। উন্নয়ন অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোররাত পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার যারা সদস্য ছিলেন, তাদের অনেককেই দেখা গেল ওই দিন বিকেলবেলা খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় শপথ নেন। কিন্তু আবার কেউ কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিবাদে, বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে অস্ত্র ধারণেও পিছপা হননি। রাজধানী থেকে প্রায় দুইশ কিলোমিটার দূরে মোহনগঞ্জে বিক্ষোভ ও বঙ্গবন্ধুর গায়েবানা জানাজা হয়। যার নেতৃত্বে ছিলেন ডা. আখলাকুল হোসাইন আহমেদ। এই জন্য তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী তাকে নানাভাবে হয়রানি, অত্যাচার করেছে। কিন্তু তিনি আমৃত্যু অবিচল ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়।
প্রাক্তন গণপরিষদ সদস্য, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত ও ১৫ আগস্টের প্রতিরোধযোদ্ধা ডা. আখলাকুল হোসাইন আহমেদ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও তিন সুযোগ্য সন্তান ও অসংখ্য অনুসারী রেখে গেছেন, যারা তার চেতনা লালন করছেন। সেটা কীভাবে? ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর সংগঠিত হওয়া মোহনগঞ্জের গণ-আদালতের বিচারক ছিলেন ডা. আখলাকুল হোসাইন আহমেদ। আর তার বড় সন্তান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান মানবতাবিরোধী অপরাধীদের (যুদ্ধাপরাধীদের) বিচারকাজে যুক্ত ছিলেন। তার দ্বিতীয় সন্তান সাবেক সিনিয়র সচিব সাজ্জাদুল হাসান জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। পিতা সংস্কৃতিমনস্ক ছিলেন তাই সন্তান হিসেবে সাজ্জাদুল হাসান এমপি হওয়ার আগেই এলাকায় উকিল মুন্সি ও শৈলজারঞ্জন মজুমদারের স্মরণে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। যা কেবল এই দুই মহান মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাই নয় বরং হাওর এলাকায় সাংস্কৃতিক জাগরণের কাজ করছে। আর ছোট সন্তান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সাইফুল হাসান পিতার মতোই সহজ জীবনে বিশ্বাসী। পরম্পরার কী নান্দনিক সাযুজ্য। পরোপকারী এই নেতার পরবর্তী প্রজন্মও পিতার মতো বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ধারক ও বাহক। এরা যেন আদর্শের প্রবহমান উত্তরসূরি।
ফেরা যাক মূল লেখায়। ইতিহাসের আরেক কাকতালীয় ঘটনা হলো, যে মানুষটির আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, ১৫ আগস্টের পর প্রতিরোধযুদ্ধ করেছেন সেই মাসের ২৮ তারিখেই তিনিও মৃত্যুবরণ করেন। শোকের মাসেই তার এই চলে যাওয়া। দিবসটিতে এলাকার মানুষও তাকে শ্রদ্ধা-অবনতচিত্তে স্মরণ করে। সে কারণে ডা. আখলাকুল হোসাইন আহমেদের প্রয়াণ দিনে মোহনগঞ্জে দিনব্যাপী কর্মসূচি পালিত হয়। আখলাকুল হোসাইন আহমেদ মেমোরিয়াল ট্রাস্টের উদ্যোগেও স্মরণানুষ্ঠান করা হয়।
যখন অর্থের মোহে মানুষ দিগি¦দিক ঘুরছে, বিপথগামী হচ্ছে, ঠিক তখন তরুণদের সামনে আলোচ্য বিষয় হতে পারে নির্মোহ নেতা ডা. আখলাকুল হোসাইন আহমেদের জীবন ও কর্ম। পিতার কর্মময় জীবন নিয়ে বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের সম্পাদনায় একাধিক বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া মেজ ছেলে সাজ্জাদুল হাসানের ‘ধামার বাবা ও একাত্তরের অম্লান স্মৃতি’ বইটি বহুল পঠিত। এছাড়া, স্থানীয়দের স্মৃতিচারণায়ও ডা. আখলাকুল হোসাইন আহমেদের কথা ঘুরেফিরে আসে।
পাঠকের কাছে আমার কৈফিয়ত এই যে, এই লেখাটি ডা. আখলাকুল হোসাইন আহমেদকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করবার উপায়মাত্র। তাকে স্মরণ করার আরও একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। কারণ তাকে জানতে গেলে এটাও জানা হয় যে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-কে জাতি মেনে নেয়নি বরং সামরিক রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মানুষ তাৎক্ষণিক এর প্রতিবাদ করেছে। আবার কেউ বা নীরবে নিভৃতে কেঁদে জাতির পিতার শোক বয়ে বেরিয়েছে। এই শোক আমাদের অনন্তকালের।
লেখক : আইনজীবী
উদ্ভিদের মধ্যে প্রকারভেদ আছে। মানুষের মধ্যে রয়েছে আরও বিচিত্র প্রকারভেদ। উদ্ভিদকে মূলত তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। বিরুৎ, গুল্ম এবং বৃক্ষ।
বিরুৎ-এর কাণ্ড, শাখা-প্রশাখা নরম হয়, আকারে ছোট। এটি হচ্ছে, পুঁই ধরনের গাছ। আবার গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ বৃক্ষ থেকে ছোট থাকে। এর কাণ্ড, শাখা-প্রশাখা শক্ত হলেও বৃক্ষের কাণ্ড, শাখা-প্রশাখা থেকে চিকন। গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ হচ্ছে লেবু বা করমচা ধরনের গাছ। এই গুল্মের মূল মাটির খুব বেশি গভীরে যায় না। আর বৃক্ষ বহুবর্ষজীবী কাষ্ঠবহুল উদ্ভিদ। যা ‘আদিপ্রাণ’ হিসেবে পুরো পৃথিবীতেই টিকে আছে। আমাদের দেশে অনেকটা যেমন টিকে আছেন একজন বৃক্ষপালনবিদ। যদিও তিনি আদিপ্রাণ নন, তবু বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি করে বহালতবিয়তেই রয়েছেন। গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান বৃক্ষপালনবিদ দুর্নীতিবাজ মো. কুদরত-ই খুদা রহস্যজনক ক্যারিশমা দেখিয়ে, ভুয়া বিলে কর্মীদের পোশাকের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। বাগান পরিষ্কারের টাকা তুলে পকেট ভরেছেন। ঠিকাদারের সঙ্গে আঁতাত করে চারা রোপণ, সীমানাপ্রাচীর তৈরি, হেজবেড ও ফুলের বেড প্রস্তুতের বরাদ্দ হাওয়া করে দিয়েছেন। এ ধরনের অর্থপিপাসু, দুর্নীতিবাজ প্রধান বৃক্ষপালনবিদ গণপূর্তের মতো জায়গায় কীভাবে বছরের পর বছর টিকে থাকেন, সেটাই অবাক করার। আবার তিনি দিনে একবার অফিসে আসেন! ১০ থেকে ৩০ মিনিট থাকেন অফিসে। এরপর চলে যান। কোন দিন কখন আসবেন, কেউ তা বলতে পারে না। এ রকম মামাবাড়ির সরকারি কর্মকর্তার সন্ধান খুব একটা চোখে পড়ে না। তবে রবিবার দেশ রূপান্তরে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
‘বৃক্ষ পালনের বদলে দুর্নীতি লালন’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে প্রধান বৃক্ষপালনবিদ শেখ মো. কুদরত-ই খুদাকে ২০১৬ সালের ২৮ জানুয়ারি ওই সব কাগজপত্র জমা দিতে বলা হয়েছিল। দুদকের চাহিদার বিষয়ের মধ্যে ছিল ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ভুয়া পোশাক ভাতা বিলের মাধ্যমে ৫ লাখ টাকা উত্তোলন, কাজ না করে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্নতা খাতের ৩ লাখ ৯৯ হাজার ৩৯৯ টাকা আত্মসাৎ, সীমানাপ্রাচীর ও বহিঃবিভাগে হেজবেড এবং ফুলের বেড প্রস্তুত, চারা রোপণসহ বিভিন্ন খাতের ১৩ লাখ ৭৭ হাজার ৭২ টাকার কাজ না করে বিল উত্তোলন, ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঘাস কর্তন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও নার্সারির উন্নয়ন কার্যক্রম এবং শিখা চিরন্তন এলাকায় ফুলের বেড প্রস্তুত ও চারা রোপণের হিসাব, বাংলাদেশ সচিবালয়ের ১ নম্বর ভবন, ২ নম্বর ভবন, ৩ নম্বর ভবন, ৪ নম্বর ভবন, ৮ নম্বর ভবন, ৯ নম্বর ভবনসংলগ্ন মাঠে গ্রীষ্ম ও শীতকালীন মৌসুমি ফুলের বেড প্রস্তুত ও চারা রোপণের তথ্য-উপাত্ত, ২০১৩-১৪ অর্থবছরের আরবরিকালচার (বৃক্ষপালন শাখার) কর্মীদের পোশাকের নথি এবং বাংলাদেশ সচিবালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর দিকের সীমানাপ্রাচীরের বহিঃবিভাগ হেজবেড প্রস্তুত ও চারা রোপণ এবং শাখাতে চারা কলম উৎপাদনের হিসাব, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটের ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন প্রাঙ্গণে গ্রীষ্ম ও শীতকালীন মৌসুমের ফুলের বেড প্রস্তুত ও চারা রোপণ এবং পূর্ত ভবন প্রাঙ্গণের ফুলের বেড প্রস্তুত, চারা রোপণ ও শোভাবর্ধন গাছ সরবরাহকরণ এবং ইস্কাটন গার্ডেনে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের বাড়ির আঙিনায় শীতকালীন মৌসুমি ফুলের বেড প্রস্তুত ও চারা রোপণের খরচের হিসাব। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, দুদকের কাছে প্রধান বৃক্ষপালনবিদের বিষয়ে দুর্নীতির তথ্য দেওয়ায় নানা হয়রানির শিকার হয়েছেন গণপূর্ত উপবিভাগ-১-এর আরবরিকালচারের মেকানিক মো. সোলেমান। ২০১৬ সালের ৩ মে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হন প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ। এরপর আদালত থেকে নোটিস ইস্যু হলে প্রধান প্রকৌশলীর হস্তক্ষেপে তার বদলির আদেশ স্থগিত করা হয়েছে।
এর মানে কী? কেউ দুর্নীতি করবেন আর তা বলা যাবে না? যিনি বলবেন, তাকেই হয়রানির শিকার হতে হবে! আমরা জানি না, এই বৃক্ষ দুর্নীতিবাজের ক্ষমতার জোর কোথায়? এভাবে দুর্নীতিকে লালন করা হলে, একদিন সুনীতির কোনো জায়গা থাকবে না প্রশাসনে। আদৌ কি আছে!
১৯৮০ সালের এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন রম্যলেখক শিবরাম চক্রবর্তী। তার জন্ম ১৯০৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর উত্তর কলকাতায়। তার বাবার নাম শিবপ্রসাদ চক্রবর্তী, যিনি মাঝেমধ্যেই পথে বেরিয়ে পড়তেন পরম প্রাপ্তির সন্ধানে। বাবার এই বেরিয়ে পড়ার নেশা শিবরাম পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে। কৈশোরে একবার তিনি বাড়ি থেকে পালিয়েও যান, যার অভিজ্ঞতায় পরবর্তীকালে রচনা করেন ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’। কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে তার সাহিত্যজীবনের শুরু। প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ভারতী পত্রিকায়। প্রথম প্রকাশিত বই দুটিও কবিতার, যা প্রকাশিত হয় ১৯২৯ সালে। এরপর অজস্র লেখা লিখেছেন। প্রবন্ধ, নাটক ও তুলনাহীন অনেক হাসির গল্প। লিখেছেন স্মৃতিকথামূলক বইও। বিচিত্র জীবন ছিল তার। রাজনীতি করেছেন, জেল খেটেছেন, রাস্তায় কাগজ ফেরি করেছেন, ফুটপাতে রাত্রিবাস করেছেন। এক সময় তিনি জীবিকার তাগিদে সংবাদপত্রের হকারিও করেছেন। সে সময় কলকাতার বিখ্যাত সংবাদপত্র বসুমতী বিক্রি করেছেন। এরপর সওদাগরি অফিসে কম মাইনের চাকরি করেছেন। কিন্তু তখনো লেখালেখিতে হাত দেননি। অবশেষে একটা সময় এসে তাকে লিখতে হয়। দৈনিক বসুমতীর সম্পাদক হেমন্ত প্রসাদ ঘোষই তাকে লেখালেখিতে নিয়ে আসেন। সাহিত্যসাধনা শুরু করে তিনি বাংলা সাহিত্যে আলোড়ন তোলেন। তিনি আজীবন মেসজীবনযাপন করেছেন। করেননি যা, তা হলো বিয়ে। তার সর্বাধিক আলোচিত উপন্যাস ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’। তার অমর সৃষ্টি হর্ষবর্ধন গোবর্ধনের গল্প, যা আজও পাঠকমহলে সমাদৃত। প্রবন্ধ ও গল্পের পাশাপাশি তিনি কিছু রম্য গোয়েন্দা কাহিনিও লিখেছিলেন। তার গোয়েন্দা চরিত্রের নাম কল্কেকাশি। তার ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ উপন্যাসটি ঋত্বিক ঘটকের পরিচালনায় ১৯৫৮ সালে চলচ্চিত্র আকারে মুক্তি পায়।
ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ১৮ আগস্ট ৯ বছরের শিশু আরাফাতের মৃত্যু হয়। সপ্তাহ না যেতেই ২৫ আগস্ট মারা যায় আরাফাতের ছোট বোন ৬ বছরের রাইদা। রাজধানীর মধ্যপাইকপাড়ার ছাপাখানা মোড়ের একটি বাসায় দুই সন্তান আরাফাত ও রাইদাকে নিয়ে থাকতেন মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও রাবেয়া আক্তার দম্পতি। সন্তানদের মৃত্যুর পর জীবনটাই বদলে গেছে তাদের। তছনছ হয়ে গেছে সাজানো সংসার। ইব্রাহিম ও রাবেয়া দম্পতির মতো বহু পরিবার এবার সর্বস্বান্ত হয়েছে ডেঙ্গুজ¦রের থাবায়। সন্তান হারানো এমন বাবা-মায়েরা পাগলপ্রায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর ডেঙ্গুতে শূন্য থেকে ২০ বছর বয়সী ১৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ১৮ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ ৮৬ এবং নারী ৯১ জন। এবার শুধু শহর নয়, গ্রামেও ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। সেখানেও মারা গেছে অনেক শিশু। এ বছর ডেঙ্গুতে শিশুমৃত্যু নিয়মিত ঘটনা হয়ে দেখা দিয়েছে। এই রোগে এত শিশুর মৃত্যু আগে কখনো হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ বছর শূন্য থেকে ২০ বছর বয়সীরা আক্রান্ত হয়েছে ৬৩ হাজার ৯১৯ জন; যা মোট আক্রান্তের ৩২ শতাংশ। এর মধ্যে নারী ২৩ হাজার ৬১৭ এবং পুরুষ ৪০ হাজার ৩০২ জন। ডেঙ্গুতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। তথ্য বলছে, ডেঙ্গুতে শিশুদের আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুর হার কম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া শিশুদের যারা সুস্থ হয়ে উঠছে, তাদের মধ্যে ভবিষ্যতে শারীরিক জটিলতা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ডেঙ্গুর বর্তমান সংক্রমণের মধ্য দিয়ে শিশুদের জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তাদের মানসিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ডেঙ্গুর এই পরিস্থিতি শিশুদের নতুন বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার বিরূপ প্রভাব শিশুদের মধ্যে ভবিষ্যতে দেখা যেতে পারে। মস্তিষ্ক ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এর প্রভাব থাকতে পারে। এতে তাদের মেধাবিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাদের যদি কিডনি কিংবা লিভারের মতো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সেই ভার সারা জীবন বহন করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শিশুদের মৃত্যু নিয়ে ভালোভাবে অ্যানালাইসিস করতে পারছি না। এসব মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে অটোপসি করতে পারলে ভালো হতো। বিভিন্ন দেশে মৃত্যু নিয়ে ডেথ রিভিউ বা অটোপসি করা হয়। এটি করতে পারলে বাংলাদেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যেত।’
এদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দিতেও হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। কোনো শিশুর শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন হলে পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (পিআইসিইউ) চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, ১ মাস থেকে ১২ বছর বয়সী মুমূর্ষু শিশু রোগীদের পৃথক পিআইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দিতে হয়। তবে দেশে পিআইসিইউ সংকট রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে পিআইসিইউর জন্য স্বজনদের হাহাকার করতে দেখা গেছে। হাসপাতালগুলোতে দেখা গেছে ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ শিশুকে সেবা দিতে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক) ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা যেমন বেশি, সেখানে শিশু রোগীও উল্লেখযোগ্য। এই দুটি হাসপাতালে একেকটি শয্যায় একাধিক শিশু রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। ঢামেক হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের জন্য পৃথক ওয়ার্ড খুলেছে কর্তৃপক্ষ। ৭০ থেকে ৮০ জনের সেবা পাওয়ার কথা, কিন্তু সেখানে প্রতিদিন সেবা নিচ্ছে প্রায় ৩০০ শিশু। ঢামেক হাসপাতালের ২৫ শিশুকে একসঙ্গে পিআইসিইউতে সেবা দেওয়ার সক্ষমতা আছে। কিন্তু মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোনো পিআইসিইউ নেই।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এখানে শিশুদের ওয়ার্ডেই ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। পিআইসিইউ নেই, তবে এনআইসিইউ (নিউনেটাল আইসিইউ বা নবজাতকদের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র) আছে।
এদিকে শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের শরীরে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু শনাক্তে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। শিশুদের ডেঙ্গুর চিকিৎসা প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শামীমা ইয়াসমীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিশুদের জ্বর আসার তিন দিনের মধ্যে পরীক্ষা করাতে হবে। এবার অনেকের মধ্যে হঠাৎ করে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। ফলে তারা দেরিতে চিকিৎসা নিতে আসছে। দেখা গেছে, ডেঙ্গুজ্বরে যেসব শিশু মারা গেছে, তারা বাড়ি থেকেই জটিলতা নিয়ে এসেছে। এখানে একটি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে, শুধু প্লাটিলেট কমা আশঙ্কার নয়, রক্তচাপ কমে যাওয়া প্লাটিলেট কমার চেয়ে ভয়ের। তাই আমাদের শিশুদের রক্তচাপ নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে।’
স্যাংশন নিয়ে ভয় না পাওয়ার বার্তা দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার মেথডিস্ট সেন্ট্রাল হলে নাগরিক সংবর্ধনায় দেওয়া বক্তব্যে তিনি পাল্টা স্যাংশন দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন।
সংবিধান অনুযায়ী সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে জানান তিনি। খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা ইস্যু সম্পর্কে প্রশ্ন রাখেন, সাজাপ্রাপ্ত কাউকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠায় কোন দেশ?
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্ন রেখে বলেন, পৃথিবীর কোন দেশের সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠায় বলতে পারেন? কোনো দেশে পাঠায়? তারা এটা দাবি করে। আমাদের কেউ কেউ আঁতেল আছে। তারা বলে, একটু কী সহানুভূতি দেখাতে পারেন না! সে এভারকেয়ার, বাংলাদেশের সবথেকে দামি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। আর রোজই শুনি এই মরে মরে, এই যায় যায়। বয়সতো আশির ওপর। মৃত্যুর সময় তো হয়ে গেছে। তার মধ্যে অসুস্থ। এখানে এত কান্নাকাটি করে লাভ নাই।
স্যাংশনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। আপনাদেরও বলব, স্যাংশন নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।
বিএনপি চেয়ারপারসন ‘অসুস্থ’ খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে শর্ত দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সেই শর্তের অন্যতম ইস্যু হচ্ছে, বিএনপিকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে। এমন ঘোষণার পরপরই খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিদেশে যাওয়ার অনুমতি মিলবে। কিন্তু সরকারের সেই শর্তে রাজি নন খালেদা জিয়া। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কোনো শর্তের বিনিময়ে তিনি মুক্তি চান না। ফলে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার সরকারের যে চেষ্টা, সেটা এ দফায় সফল হচ্ছে না বলে মনে করছেন আন্দোলনে থাকা নেতারা। তাদের মতে, সরকার ফাঁদ পাতলেও এতে পা না দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে বেগম জিয়ার। বরং আন্দোলনে এ সরকারকে বিদায় করে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দরজা খুলতে চান তারা। একই সঙ্গে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করেই আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবেন। এ লক্ষ্যে প্রায় অর্ধশত দল নিয়ে গত প্রায় এক বছর ধরে আন্দোলনে রয়েছেন তারা।
শর্তের বিনিময়ে মুক্তির বিষয়টি তুলে ধরে গত রবিবার রাতে কিশোরগঞ্জে বিএনপির রোডমার্চের সমাপনী সমাবেশে দলটির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে শর্ত দেওয়া হয়েছিল তিনি যদি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে চান, তাহলে বিএনপিকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে আসতে হবে। বিএনপি থেকে উত্তর দেওয়ার আগেই অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতাল থেকে খালেদা জিয়া বিদ্রোহ করে বলেছেন, তার জীবনে গণতন্ত্রের জন্য কোনো শর্ত নেই। ভোটের অধিকারের জন্য, এই দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য কোনো শর্ত নেই। কোনো শর্ত খালেদা জিয়ার নামের সঙ্গে যায় না এবং আমরাও তা মানি না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খালেদা জিয়া ৫৪ দিন ধরে টানা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিতই খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের সর্বশেষ অবস্থা খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। এ সময় বেশ কয়েকবার শারীরিকভাবে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লে দলের কয়েকজন নেতার মাধ্যমে মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের দেওয়ার বক্তব্যের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি দলের মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, যুগ্ম মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির কয়েকজন সম্পাদক ও সদস্য খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন। সূত্রগুলো বলছে, একজন ভাইস চেয়ারম্যান ও স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য কথা প্রসঙ্গে এ ধরনের প্রসঙ্গেও ইঙ্গিত দিলে খালেদা জিয়ার শর্ত দিয়ে মুক্ত হতে চান না বলে পুনর্ব্যক্ত করেন। যদিও এর আগে শর্ত দিয়ে দেশের বাইরে চিকিৎসার বিষয়ে দল যাতে সম্মত না হয়, সে কথা নেতাদের আগেই বলে রেখেছিলেন একসময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এ নেত্রী। কোনো অবস্থায় শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়া যাবে না এবং এ ব্যাপারে কোনো ধরনের সমঝোতাও নয়Ñ এ ব্যাপারেও খালেদা জিয়ার স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করেন। সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে এসে মঞ্চের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের এ আন্দোলনে উনার সমর্থন আছে। আমাদের একজন নেতা (ওই বৈঠকে) বলেছেন, সরকার একটা নির্বাচনের জাল বিছানোর চেষ্টা করছে। উনি (খালেদা জিয়া) বলেছেন, কোনো অবস্থায় এ সরকারের অধীনে নির্বাচনী ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না।’
এর আগে ৮ মে রাতে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় সাক্ষাৎ শেষে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছিলেন, কেউ কেউ বলছেন আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যাওয়া উচিত। এমন প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া তাদের বলেছেন, প্রশ্নই আসে না। এ বিষয়ে আমি কোনো অনুমতি দেব না।
এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি মনে করছে, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি এখন সরকারের বিদায়ের ওপর নির্ভর করছে। আন্দোলনে এ সরকারকে বিদায় করতে না পারলে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দরজা খুলবে না। তাই এখন আন্দোলনের মাধ্যমে এ ইস্যুর সমাধান করবে তারা। এজন্য চলমান এক দফার আন্দোলনের সঙ্গে এখন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসা ইস্যুটি জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করতে চান তারা। এতে সরকারবিরোধী আন্দোলন বড় ধরনের মোড় নিতে পারে বলে তাদের বিশ্বাস।
গতকাল সোমবার স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভা হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে সভায় খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। আগামী ৫ অক্টোবর বিএনপি ঘোষিত রোডমার্চ কর্মসূচি শেষ হবে। এর আগেই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে বিএনপি।
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু বলেন, ‘দাবার ঘুঁটি হিসেবে খালেদা জিয়াকে ব্যবহারের চিন্তা তারা কীভাবে করে সেটাই বোধগম্য নয়। সরকারের এ ধরনের চিন্তা বা পরিকল্পনা কোনো কাজে আসবে না।’
উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে বিএনপিপ্রধানের পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদনের ওপর গত রবিবার আইন মন্ত্রণালয় মতামত দিয়ে বলেছে, সাজা স্থগিত থাকাবস্থায় তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর সুযোগ নেই। যদি যেতে হয়, তাহলে সাজা স্থগিতের আদেশ বাতিল করতে হবে। কিন্তু সেটা করে তাকে আবার কারাগারে পাঠানো হবে না বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তবে বিদেশে পাঠানোর অনুমতির জন্য আদালতে যেতে রাজি নয় খালেদা জিয়ার পরিবার ও বিএনপি।
আবার গতকাল নিজ কার্যালয়ে সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাছান চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতি কিংবা আপিল বিভাগে আবেদন করতে পারেন। তবে তার আগে তাকে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জেলে যেতে হবে। রাষ্ট্রপতি বা আপিল বিভাগের খালেদা জিয়ার পরিবার আবেদন করবে না বলে দলীয় আইনজীবী সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশে আইনের শাসন নেই বলেই বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভয়ংকর তামাশা করা হয়েছে। যে নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়া এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন, সেখানে বলা হয়েছে, তাকে “দেশে চিকিৎসা নিতে হবে”, তার বদলে “দেশে বা বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারবেন” বলাই যথেষ্ট। এর বাইরে দলের পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নেই।’
এদিকে চিকিৎসক সূত্র জানা গেছে, বর্তমানে খালেদা জিয়ার অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। গতকাল তার আলট্রাসনোগ্রাম ও ইকো করা হয়েছে।
তিনি জাতির পিতার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য প্রণীত আইনের অধীনে ধানমন্ডিতে যে বাড়ি পেয়েছিলেন শেখ রেহানা, বিএনপি ক্ষমতায় এসে সে বাড়ি উচ্ছেদ করে। সেখানে পুলিশ ফাঁড়ি করছে আর ‘লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে’ সেই পুলিশ ফাঁড়ি উদ্বোধন করেছে খালেদা জিয়া। ছেলে কোকোর মৃত্যুর পর তাকে (শেখ হাসিনা) খালেদা জিয়ার বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি না দেওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা কীভাবে খালেদা জিয়ার জন্য আমার কাছ থেকে আরও সহানুভূতি আশা করে।’
লন্ডনের মেথোডিস্ট সেন্ট্রাল হল ওয়েস্টমিনস্টারে তার সম্মানে আয়োজিত একটি কমিউনিটি সংবর্ধনায় তিনি এসব কথা বলেন।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, গণতন্ত্রের কথা বলা বিএনপির পক্ষে শোভা পায় না কারণ তারা জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে ধোকাবাজি খেলেছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি একটি প্রহসনমূলক নির্বাচন করে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার দেড় মাসের মধ্যেই দেশের জনগণ তাদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে। তিনি বলেন, দেশের জনগণ কখনই ভোট কারচুপিকারীদের ক্ষমতায় বসতে দেয় না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার প্রধান হিসেবে তার ওপর ন্যস্ত নির্বাহী ক্ষমতা দিয়ে এতিমদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতির মামলায় কারাদণ্ড স্থগিত করার পর খালেদা জিয়াকে তিনি বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে তার কিছুই করার নেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি আইন অনুযায়ী যা করতে পারেন তাই করেছেন। অনেকেই এখন যুক্তি দিচ্ছেন, ‘আইন নিজের গতিতে চললেও খালেদা জিয়ার প্রতি আমি বেশি সহানুভূতি দেখাতে পারি’।
অনুষ্ঠানের মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এবং আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান শরীফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজেদুর রহমান ফারুক।
উত্তর-পূর্ব পাকিস্তানে একটি অঙ্গ পাচারকারী চক্রের আট সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, পুলিশ বলছে। চক্রটির নেতা ফাওয়াদ মুখতারের বিরুদ্ধে ৩০০ জনেরও বেশি মানুষের কিডনি চুরি করে বের করে ধনী গ্রাহকদের মধ্যে প্রতিস্থাপন করার অভিযোগ রয়েছে।
মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা বিবিসি নিউজ।
বিবিসি জানায়, অস্ত্রোপচারের সময় রোগীর দেহ থেকে কিডনি সরিয়ে ফেলা এবং ধনী গ্রাহকদের কাছে বিক্রির অভিযোগে ফাওয়াদ মুখতার নামের এক চিকিৎসক ও তার দলের আট সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছে পাকিস্তান পুলিশ। ফাওয়াদ এ পর্যন্ত তিন শতাধিক রোগীর কিডনি চুরি করেছেন।
এমনকি অস্ত্রোপচারকালে কিডনি চুরির সময় তার হাতে অন্তত তিনজন রোগী মারা গেছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
ফাওয়াদ এর আগে পাঁচবার অসদাচরণের জন্য গ্রেপ্তার হলেও প্রতিবারই জামিন নিয়ে মুক্তি পেয়ে যান। রোববার (১ অক্টোবর) পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোর থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানায় পাকিস্তান পুলিশ। চক্রটি পূর্ব পাঞ্জাব প্রদেশের পাশাপাশি পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে কাজ করছে বলে ধারণা করছে পুলিশ।
পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মহসিন নকভি রবিবার একটি সংবাদ সম্মেলনে জানান, “কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টগুলি বিভিন্ন ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবনকে ক্লিনিক আকারে সাজিয়ে সেখানে রোগীদের অস্ত্রোপচার করার সময় রোগীদের অজান্তেই কিডনি সরিয়ে নেয়া হত।“
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ফাওয়াদ মুখতার জানিয়েছেন, তার নেতৃত্বাধীন চক্র এখন পর্যন্ত মোট ৩২৮ রোগীর দেহ থেকে কিডনি চুরি করেছে। প্রতিটি কিডনি বিক্রি হয়েছে ১ কোটি রুপি করে।
২০১০ সালে মানবদেহের প্রত্যঙ্গ ব্যবসা নিষিদ্ধ করে পাকিস্তান। এ অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও মোটা অঙ্কের জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বিএনপি নেতারা।
তারা বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জার্মানিতে নেওয়ার কথা ছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সে সময় শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়। এবার চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছি। জার্মানিতে খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে আমরা তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাব। জার্মানিতে তার ভালো চিকিৎসা হবে।’
এর অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খালেদা জিয়া ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে তার লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে আসছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লিভার সিরোসিসের কারণে খালেদা জিয়ার হৃদ্যন্ত্র ও কিডনির জটিলতা বেড়েছে। তিনি হাসপাতালে কখনো কিছুটা ভালো থাকছেন, পরক্ষণেই তার স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। ফলে তাকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘লিভার সমস্যার কারণে ম্যাডামের শ্বাস কষ্ট হয়। ইতোমধ্যে তাকে দুইবার করোনারী কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রাখা হয়েছিল। লিভার প্রতিস্থাপন করতে পারলে শ্বাসকষ্টটা হতো না।’
এদিকে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষণ না থাকায় তার পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি এখন সামনে এসেছে।
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়া হতে পারে এমন খবরে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও খোঁজখবর নিচ্ছেন জার্মান বিএনপি নেতারা।
জার্মান বিএনপির সভাপতি আকুল মিয়া বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জার্মানিতে ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হতে পারে বলে জানতে পেরেছি। আমরা খুবই খুশি। কারণ জার্মানিতে আসলে আমরা তার চিকিৎসার বিষয়ে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারব। চেয়ারপারসনের যে চিকিৎসা দরকার তা সকল ব্যবস্থা জার্মানিতে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ম্যাডামের মুক্তি, তার উন্নত চিকিৎসা ও গণতন্ত্র ফেরাতে দেশে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে জার্মানিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। আগামী ৯ অক্টোবর আমাদের কর্মসূচি রয়েছে। জার্মান বিএনপির উদ্যোগে রোডমার্চ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করব জার্মান পার্লামেন্টের সামনে। ’
আকুল মিয়া বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যখন বিদেশে নেওয়ার আলোচনা চলছিল তখনও জার্মানিতে নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়েছিল। সে সময় তারেক রহমানের সেবা করতে না পারলেও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সেবা করতে পারব বলে আশা করছি। তার চিকিৎসা জার্মানিতে করতে পারলে আমরা ধন্য হবো।’
গত ২৫ সেপ্টেম্বর সোমবার খালেদা জিয়ার ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনি মতামত জানতে চেয়ে আবেদনের কপি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। খালেদা জিয়ার ভাইয়ের আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃতিক বিস্ময় হাওরের ওপর অত্যাচারের যেন শেষ নেই। ধান-মাছের এই বিপুল ভান্ডার রক্ষার নামে একদিকে চলে স্থায়ী-অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি; যার কারণে যখন-তখন হাওরডুবিতে ঘটে ফসলহানি। পাশাপাশি আরেক দিকে চলে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের নামে অবৈজ্ঞানিকভাবে যত্রতত্র বাঁধ-রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের ধুম; ফলে পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মরতে বসেছে হাওর। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে শেষমেশ সরকারপ্রধান হুকুম দিয়েছেনে ‘হাওরে আর কোনো সড়ক নয়।’
এই পরিস্থিতিতে দেশ রূপান্তরের চোখে ধরা পড়েছে আরেক অশনিসংকেত। এবার শিল্পপতিদের চোখ পড়েছে হাওরে। কোথাও কোথাও থাবাও পড়তে শুরু করেছে। তেমনি সব ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে ভাটি অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হবিগঞ্জ জেলার সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে। এখানে গড়ে উঠেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদনের কারখানা। তৈরি হচ্ছে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প। হাওরের ‘লিলুয়া’ বাতাসে এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে কারখানার দুর্গন্ধ। ‘চান্নি পসর রাইতে’ এখন আর শোনা যায় না বাউলকণ্ঠের দরদি সুর। প্রায় দিনই শিল্পপতিদের আনাগোনার অশুভ পদধ্বনি শুনতে পান হাওরবাসী।
অথচ যেকোনো ধরনের স্থাপনা তৈরি বা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য হওরের স্বাভাবিক পরিবেশ ও জীবনাচরণ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখার নির্দেশনা আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। গত ১৮ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে হাওর অঞ্চলের সড়কগুলো এলিভেটেড করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপর থেকে হাওরাঞ্চলে কোনো সড়ক করতে হলে এলিভেটেড পদ্ধতিতে করতে হবে, যাতে সেখানকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা পায়। সরকারপ্রধানের এমন নির্দেশের পরও থামেনি হাওর ধ্বংসের তৎপরতা।
হাওরে জমি কেনাবেচার হিড়িক
বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট বাজারের অদূরে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের নিচু জমি ভরাট করে বিশাল আকৃতির ছয়টি শেডসহ অনেক স্থাপনা নিয়ে ‘কাজী ফার্ম’ গড়ে তুলেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদন কেন্দ্র। উপজেলার বাগদাইরসহ আরও কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, উপজেলা ও জেলা সদরে যাতায়াতের একমাত্র পথের ধারেই কাজী ফার্মের এই প্রতিষ্ঠান। এখনই নাকে কাপড় দিয়ে দ্রুত পার হতে হয় রাস্তা; আর প্রতিদিন প্রায় ১২ লাখ ডিম উৎপাদনের এই বিশাল কারখানাটি পুরোপুরি চালু হলে দুর্গন্ধে বসবাস করা যাবে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন এলাকাবাসী। স্নানঘাট ভূমি কার্যালয় থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ১৯ একর ৮০ শতক জমি নামজারি হয়েছে। আরও কয়েক একর জমি কিনেছে তারা, যা নামজারির অপেক্ষায়।
গত ১৮ জুন হাওর লাগোয়া বাগদাইর গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হয় স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের সদস্য আলেকজান বিবির সঙ্গে। তিনিসহ আরও কয়েকজন নারী-পুরুষ দেশ রূপান্তরকে বললেন, হাওরের ফসলি জমি ভরাট করে এ ফার্মটি গড়া হয়েছে। এভাবে শিল্প গড়ে উঠলে হাওরের অস্তিত্ব বিলীন হতে আর সময় লাগবে না।
স্থানীয় লিটন মিয়া বললেন, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের ইলাম এলাকায় আকিজ গ্রুপেরও ১৮ বিঘা জমি রয়েছে। উঁচু পাড় বেঁধে আপাতত মাছ চাষ করছে তারা। আগে জমিটির মালিক ছিলেন সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির চৌধুরী। আব্দুল কাদির চৌধুরী জানান, পাঁচ-ছয় বছর আগে তার নিজের জমি ছাড়াও আশপাশের আরও ৫০ বিঘা জমি কিনেছে আকিজ গ্রুপ। আপাতত পুকুর করেছে। ভবিষ্যতে কী করবে, কোম্পানিই জানে।
দীর্ঘদিন ধরে জমি কেনাবেচায় মধ্যস্থতা (দালালি) করেন হারুন মিয়া। তিনি জানান, শুকনো মৌসুমে মাসের ১০ দিনই তাকে হাওরে জমি দেখাতে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন শিল্পপতির সঙ্গে তার মাধ্যমে জমির মালিকদের কথাবার্তা চলছে।
একই পেশার আলী আমজদ বলেন, ইদানীং গুঙ্গিয়াজুরী হাওর এলাকায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লোকজনের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। সালাউদ্দিন নামে ঢাকার এক বাসিন্দা গত মার্চে বন্ধুদের নিয়ে হাওর ঘুরে গেছেন। রাস্তার পাশে তিনি কমপক্ষে ১৫-২০ একর জমি কিনতে চান। তার সঙ্গে আলাপ করে আমজাদ যা বুঝতে পেরেছেন, জমিতে তারা সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে আগ্রহী।
লন্ডনপ্রবাসী নাঈম চৌধুরী জানান, তার ১২ বিঘা জমি কেনার জন্য দামদর ঠিক করেন ঢাকার ব্যবসায়ী জুয়েল খান। সবকিছু ঠিকঠাক করার পর অজ্ঞাত কারণে তিনি সরে যান। নাঈম চৌধুরী পরে জানতে পারেন, কমিশন নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় আইনি পরামর্শক জুয়েল খানকে নিরুৎসাহিত করেন।
হাওর গ্রাসের যত কৌশল
নিচু এলাকা হওয়ায় হাওরে জমির দাম তুলনামূলক কম। এখনো এক বিঘা (৩৩ শতক) জমি ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে বেচাকেনা হয়। পুটিজুরী গ্রামের বাসিন্দা টেনু মিয়া বলেন, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলা অংশে গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই-চার কিলোমিটার দূরেই ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, বিবিয়ানা গ্যাস কূপ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। আবার হাওর এলাকা স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারিও তেমন থাকে না। ফলে ড্রেজিং মেশিন দিয়ে জমি থেকে বালু তুলে অন্য অংশ ভরাট করে ফেলা সহজ হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ভরাট করা হয়। এভাবে সহজেই হাওরের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ফেলা হয়।
স্থানীয় নবীর হোসেন বলেন, জমির শ্রেণি পরিবর্তনের অনুমোদন নেওয়া সময়সাপেক্ষ ও বেশ ঝামেলার কাজ। নবীগঞ্জ ও বাহুবল ভূমি অফিসের কয়েকজন তহশিলদারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে তাদের না জানিয়েই শিল্পপতিরা সব কাজ সেরে ফেলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী কৃষিজমিতে শিল্প বা আবাসিক এলাকা তৈরির জন্য জমি কেনার আগেই জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হয়। আবেদনটি প্রথমে জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে পাঠাবেন। ইউএনও তখন উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে প্রতিবেদন চাইবেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (তহশিলদার) সরেজমিন পরিদর্শন এবং কৃষি, মৎস্য ও বন বিভাগের মতামত পাওয়ার পর জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবেন। এর পর জেলা প্রশাসক সেই অনুমোদন দিতে পারেন।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কোনো অনুমোদনেরই তোয়াক্কা করেন না শিল্পপতিরা। আবার কেউ জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন করলে তখন চাপের মুখে স্থানীয় প্রশাসনকে শিল্পপতিদের পক্ষেই প্রতিবেদন দিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরেজমিন পরিদর্শনে ভূমির যে শ্রেণি পাওয়া যায়, সেই মোতাবেক ভূমি কর আদায় করে নতুন শ্রেণির বৈধতা দিয়ে দেওয়া হয়।
শিল্পপতিরা রাস্তার পাশে প্রথমে এক-দুই একর জমি একটু বেশি দাম দিয়ে কিনে পরে পেছনের জমি প্রায় পানির দরে কেনেন বলে জানান স্নানঘাট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার আবুল কালাম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, সাধারণত শিল্প মালিকরা দালাল দিয়ে জমি কিনতে চান। কারণ, তারা সরাসরি কিনতে এলে দাম বেশি চাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আরেক মধ্যস্থতাকারী শামসু মিয়া বলেন, ‘বেশি জমি কেনার ইচ্ছা থাকলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। আমরা কম দামে কিনে দিয়ে বেশি কমিশন নেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ, আমাদের আয়ের একটা অংশ ভূমি শাখার কর্মকর্তাদেরও দিতে হয়। নইলে জমির কাগজপত্র যত স্বচ্ছই হোক, তারা “ঘিয়ের মধ্যে কাঁটা” বের করার চেষ্টা করেন।’
এ ছাড়া স্থানীয় বা বহিরাগতদের উদ্যোগে পুকুরের নাম করে হাওর এলাকার যেখানে-সেখানে মাটি খনন করা হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, আইন বা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ড্রেজার বসিয়ে কৃষিজমি থেকে দেদার বালু তোলা হচ্ছে।
জমি নিয়ে লুকোচুরি
হবিগঞ্জের ১৩টি হাওরের মোট আয়তন ৭৩ লাখ ৫৭৯ একর। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের অবস্থান জেলার বাহুবল, নবীগঞ্জ, বানিয়াচঙ্গ ও সদর উপজেলা ঘেঁষে। এই হাওরে কী পরিমাণ জমি ছিল বা এখন কতটুকু আছে, তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায়নি সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেও।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সর্বশেষ হিসাবে, এই হাওরের জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ৮৩৩ একর। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ৬৪ হাজার ২২০ একর। ৮ বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৭ সালে পরিসংখ্যান বিভাগের প্রকাশিত হিসাবে হাওরের আয়তন দেখানো হয়েছে ১৬ হাজার ৪২৯ একর। জেলা মৎস্য অফিস জানিয়েছে, এই হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৩৯৯ একর ৪ শতক। চারটি অফিসের কর্মকর্তারাই তাদের হিসাব সঠিক বলে দাবি করছেন। আরেকটি রহস্যময় বিষয় হলো, চারটি উপজেলা ঘেঁষে এই হাওরের অবস্থান হলেও ওই চার সরকারি প্রতিষ্ঠানই বানিয়াচঙ্গ ছাড়া বাকি তিন উপজেলার হিসাব দেখাচ্ছে।
১০ বছর আগে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে জমির পরিমাণ কত ছিল জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এক মাস সময় নিয়েও কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
ওদিকে ২০১৬ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন হাওর ও জলাভূমি অধিদপ্তরের প্রকাশিত ‘ক্লাসিফিকেশন অব ওয়েটল্যান্ড অব বাংলাদেশ ভলিউম-৩’-এ দেখা যায়, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের মোট আয়তন ৬৯ হাজার ৮২৯ একর ৩৭ শতক। এর মধ্যে বাহুবল উপজেলায় ৩০ হাজার ১৫৬ একর ২০ শতক, বানিয়াচঙ্গ উপজেলায় ১৭ একর ২০ শতক, হবিগঞ্জ সদর ১৫ হাজার ৯০১ একর ৮৬ শতক ও নবীগঞ্জে ২৩ হাজার ৭৫৩ একর ৯৯ শতক।
হাওর এলাকায় দিনে দিনে জনবসতি বৃদ্ধি, হাজার হাজার পুকুর তৈরি, জমি ভরাট করে শিল্প-কারখানা স্থাপনের কারণে আগের চেয়ে এখন কৃষিজমির পরিমাণ অনেকটাই কমে আসছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. নূরে আলম সিদ্দিকী।
গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের আওতাধীন বাহুবল উপজেলার সাতকাপন ও স্নানঘাট ইউনিয়নের ছয়টি মৌজার নাম উল্লেখ করে গত ১০ বছরে কী পরিমাণ জমি বিক্রি করা হয়েছে, উল্লিখিত সময়ে জমির মূল্য কত ছিল জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার সুশান্ত ঘোষ এবং জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মৌজা হিসাব করে জমি কেনাবেচার তথ্য সংরক্ষণ করা হয় না। এসব উত্তর দিতে হলে প্রতিটি দলিল তল্লাশি করে বের করতে হবে, যা ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ।’
আবেদন-অনুমোদন খেলা
স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জানান, কাজী ফার্মের বিক্রি হওয়া জমির মধ্যে ৭৮ বিঘায় আগে তারা বর্গাচাষ করেছেন দীর্ঘদিন। ২০১৮ সালের দিকে জমির মালিকরা কাজী ফার্ম লিমিটেডের কাছে বিক্রি করে দেন। পরে কাজী ফার্ম প্রায় দুই বছর ধরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তুলে পুরো জমি উঁচু করে নেয়। তবে নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, এই জমির আগের মালিকের দলিল এবং বর্তমানে কাজী ফার্মের দলিল- দুই জায়গাতেই এটি এখনো ‘কৃষি’ শ্রেণি হিসেবেই আছে।
সরেজমিনে জানা যায়, চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের তলদেশ থেকে বালু তুলে বাহুবলে নির্মাণাধীন কয়েকটি স্থাপনা ও ছয় লেনের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করতে স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা মৎস্যজীবী লীগের নেতা তাজুল ইসলাম একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। হাওরে থাকা তার জমিতে ‘দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য’ বানানোর কথা বলে মাটি কেটে পাড় তৈরির অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন তিনি। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান এ বিষয়ে ইউএনও ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) প্রতিবেদন দিতে বলেন। অভিযোগ উঠেছে, ওই সিন্ডিকেট বাহুবল উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তাদের পক্ষে প্রতিবেদন করায়। প্রতিবেদন পেয়ে কয়েকটি শর্ত দিয়ে জেলা প্রশাসক মাটি কাটার অনুমোদন দেন। বাণিজ্যিক কাজে তাজুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের দীর্ঘদিন ধরে বালু তোলার বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানান স্থানীয় কৃষকরা। এ নিয়ে দেশ রূপান্তরসহ স্থানীয় পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে জেলা প্রশাসন তদন্ত করে এর সত্যতা পায় এবং অনুমোদন বাতিল করে। সরেজমিনে দেখা গেছে, বালু তোলা বন্ধ হলেও এখনো ড্রেজার মেশিন ও পাইপলাইন সরানো হয়নি।
গত ১৪ আগস্ট পরিবেশ অধিদপ্তর, হবিগঞ্জ কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, কাজী ফার্ম বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ডিজাইন না দেওয়ায় তাদের পরিবেশ ছাড়পত্রের আবেদন বাতিল করা হয়েছে। একই দিন জেলা প্রশাসন অফিসের রাজস্ব শাখায় যোগাযোগ করে জানা গেছে, কাজী ফার্ম বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য কোনো আবেদনই করেনি। অফিস সহকারী আব্দুল ওয়াদুদ বিভিন্ন ফাইলপত্র ঘেঁটে ওই কোম্পানির মাধবপুর উপজেলায় কয়েকটি প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন পেয়েছেন।
আব্দুল ওয়াদুদ জানান, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় ৫ একর ৭৪ শতক জমি শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ নামে একটি কোম্পানির আবেদন গত ২৩ জানুয়ারি মঞ্জুর হয়েছে। এ ছাড়া ওই কোম্পানি হাওর থেকে দুই-তিন কিলোমিটর দূরে পশ্চিম ম-লকাপন, হায়দরচক মৌজার ৬টি প্রজেক্টের জন্য প্রায় ৬৩ একর জমি কিনেছে। এগুলোর মধ্যে দুই-একটি বাদে বাকিগুলোর শ্রেণি পরিবর্তন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গড়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য হাওরের দিকেই ধাবিত হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনবে।
শিল্পপতি পক্ষের ভাষ্য
জানতে চাইলে কাজী ফার্মের ম্যানেজার (অ্যাডমিন) জিয়াউল হক দেশ রূপান্তরের কাছে দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা আছে। গত ৭ আগস্ট মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে জিয়াউল হক জানান, বাহুবল স্নানঘাটে তাদের প্রতিষ্ঠানে ডিম উৎপাদন পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। এখানে লেয়ার মুরগির ডিম ছাড়াও কম্পোস্ট সার উৎপাদন হবে। এসব মুরগি খুবই স্পর্শকাতর। পরিবেশ একটি বড় বিষয়। যদি এখানকার পরিবেশ অনুকূলে থাকে, তাহলে আরও কী কী উৎপাদন করা যাবে তা পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বায়ুদূষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশে^র নামকরা প্রতিষ্ঠান জার্মানির ‘বিগ ডাচম্যান’-এর সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। ফলে প্রকট দুর্গন্ধ বেরোনোর শঙ্কা খুবই কম। তবে তিনি এও বলেন, সব প্রাণীর শরীরেই গন্ধ থাকে। লাখ লাখ মুরগি যেখানে থাকবে, সেখানে কিছু গন্ধ তো হবেই।
মুরগির বিষ্ঠা সংরক্ষণের ব্যাপারে জিয়াউল হক বলেন, এর গন্ধ বের হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে গন্ধ দূর করা হয়। হাওরের জমি ভরাট করে শিল্প গড়ার আইনি দিক সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছাড়া এ-সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়।’
গত ২৪ আগস্ট বাহুবল উপজেলার আব্দাকামাল এলাকায় আকিজ ভেঞ্চার গ্রুপের নির্মাণাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্থানীয় ম্যানেজার (অ্যাডমিন) হাবিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, উপজেলার পুটিজুরী, সাতকাপন, স্নানঘাট ইউনিয়নের বিভিন্ন মৌজায় আকিজ গ্রুপের জমি রয়েছে। বর্তমানে আব্দাকামাল এলাকায় প্রায় ৬৫ একর জমিতে বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনের কাজ চলছে। গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই কিলোমিটারের মতো দূরে এই ‘শিল্পপার্ক’ নির্মাণের পর হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় তাদের আরও যে ৫৭৪ শতক জমি রয়েছে, তাতে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প গড়ে তোলা হবে। তিনি দাবি করেন, ইতিমধ্যে প্রশাসনের কাছ থেকে তারা জমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছেন।
‘খুবই অন্যায় হবে’
পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, হাওরে নিচু জমি ভরাট করে যদি শিল্প গড়া হয়, তাহলে পরিবেশের ওপর খুবই অন্যায় করা হবে। প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে হাওরের পানি প্রবাহ ও পানি ধরে রাখার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে এমন অবকাঠামো করা যাবে না। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের সময় হাওরের পানি প্রবাহ যাতে সঠিক থাকে, এ জন্য তিনি সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডিকে।
তিনি আরও বলেন, ‘উজান থেকে নেমে আসা পানির সঙ্গে বালু আসার ফলে অধিকাংশ হাওরের বুক বালুমাটি এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। হাওর ও বিলগুলোকে পুনঃখনন করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। এখন সেখানে যদি মাটি ভরাট করে শিল্প গড়া হয়, সেটা কখনোই কাম্য নয়।’
লাক্সারিয়াস জীবন পাওয়ার জন্য এখন মানুষ দিনরাত শুধুই কাজ করে চলেছেন। যার মধ্যে অফিস ডেস্কে বসে কাজ করেন এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চেয়ারে বসে ল্যাপটপের সামনে তাকিয়ে থাকা রীতিমতো যন্ত্রণাদায়ক।
শুধু তাই নয়, এটা স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। যারা অফিসে ডেস্কে কাজ করেন তাদের মোটা হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
সারাদিন যারা ডেস্কে বসে কাজ করেন তাদের অন্যতম অভিযোগও এটি। তারা বলে থাকেন, চেয়ারে বসে কাজ করে মোটা হয়ে যাচ্ছি! তবে এই অজুহাতকে একেবারে সত্য বলার সুযোগ নেই। কারণ ডেস্কে বসে কাজ করেও স্লিম ও ফিট থাকা সম্ভব। এজন্য মেনে চলুন পাঁচটি টিপস।
হাঁটুনফিট ও কর্মক্ষম থাকতে নিয়মিত হাঁটুন। দিনের পর দিন দীর্ঘ সময় বসে থাকলে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। সুস্থ থাকতে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করুন। এমনকি কাজের ফাঁকেও ১০ মিনিটের ব্রেক নিয়ে হেঁটে আসতে পারেন।
সোজা হয়ে বসুনচেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসুন। মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলোতে অনেক চাপ পড়ে, সেই সঙ্গে চাপ পড়ে মেরুদণ্ডের পাশের মাংসপেশি ও লিগামেন্টের ওপর। কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় মনিটরটি চোখের সমান স্তরে রাখুন। মাউস ব্যবহার করার সময় শুধু আপনার কব্জি নয় পুরো হাত ব্যবহার করুন।
চাপ এড়িয়ে চলুনএটা খুব কঠিন কাজ, চাপমুক্ত থাকা। বিশেষ করে যখন চারপাশ থেকে নানা ধরনের চাপ আসতে থাকে। তবে মানসিক স্থিরতা ধরে রাখুন, নিজেকে মোটিভেট করুন। কোনও চাপই বেশি দিন থাকে না, এগুলো নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট না করে নিজের কাজে মনোযোগ বাড়ান। এক্ষেত্রে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে অনলাইনে কিছু যোগা শিখে অভ্যাস করুন।
চোখের যত্নকম্পিউটারে কাজ করার সময় স্ক্রিনে একটানা ১০-১৫ মিনিটের বেশি তাকিয়ে থাকবেন না। নিয়মিত চোখের পাতা ফেলুন। স্ক্রিনে পর্যাপ্ত আলো রাখুন, যেন চোখের ওপর বাড়তি চাপ না পড়ে।
হাড়ের যত্ন বসে থাকার ফলে হাড় দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ক্যালসিয়ামের ঘাটতিও হতে পারে। এজন্য নজর দিতে হবে প্রতিদিনের খাবারে স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে নিয়মিত ডিম, দুধ, দই ও বাদাম রাখুন।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কোন দেশে ভালো চিকিৎসা হতে পারে তার খোঁজ নিচ্ছে বিএনপি। এর অংশ হিসাবে ঢাকায় জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসা জার্মানিতে হতে পারে কিনা জানতে চেয়েছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। মঙ্গলবার জানতে চাইলে ঢাকায় জার্মানির সিডিএ জান রল্ফ জানোস্কি বলেছেন, ‘মির্জা ফখরুলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। মিসেস জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার ধরন সম্পর্কে জেনেছি। তার ভালো চিকিৎসা বিশ্বের খুব কম দেশে সম্ভব। জার্মানিতে এসব সমস্যার খুব ভালো চিকিৎসা আছে। সরকারের অনুমোদন পেলে তিনি জার্মানিতে চিকিৎসা নিতে পারেন।’ এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি তিনি।
৯ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়লে খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর লিভারের জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কিডনির কর্মক্ষমতা কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ফলে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এ কারণে কয়েকবার তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করা হয়েছিল। এখন কেবিনে মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) লিভার, কিডনি, হার্ট, ফুসফুসসহ সার্বিক অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণে সম্প্রতি দুবার সিসিইউতে নিতে হয়। এখন মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন। ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ।
তিনি আরও জানান, মেডিকেল বোর্ড মনে করে সর্বসম্মতভাবে তাদের পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অতি দ্রুত বিদেশে লিভার প্রতিস্থাপনে সম্মিলিত আধুনিক মাল্টি ডিসিপ্ল্যানারি মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া জরুরি। তাহলেই তিনি শঙ্কা মুক্ত হতে পারেন বলে বোর্ড রিকমেন্ডেশনে বলেছেন।
এর আগে ১৩ জুন রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ওই সময় ৫ দিন পর তিনি বাসায় ফেরেন। গত বছরের জুনে খালেদা জিয়ার এনজিওগ্রাম করা হলে তার হৃদযন্ত্রে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর একটিতে রিং পরানো হয়। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রারাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ও হৃদরোগে ভুগছেন।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। এ অবস্থায় তাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে উন্নত চিকিৎসায় বিদেশে পাঠানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিবারই সরকার সেসব আমলে না নিয়ে খালেদা জিয়াকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখন দলীয় ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। আগের মতোই লিভারের জটিলতার পাশাপাশি ফুসফুসের জটিলতা নিয়ে শঙ্কিত তার চিকিৎসকরা। মেডিকেল বোর্ডের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার ফুসফুস থেকে পানি বের করা হয়েছে। শরীরে ক্যাথেডর লাগানো হয়েছে। আগে যেখানে দুই-তিন দিন পরপর পানি বের করা হয়েছে, এখন প্রতিদিনই পানি বের করতে হচ্ছে। তার কেবিনে মঙ্গলবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়েছে। ওই চিকিৎসক আরও বলেন, খালেদা জিয়ার অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি নেই। লিভার সিরোসিসের সঙ্গে কিডনির জটিলতাও বাড়ছে। তার লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া সামনে বিকল্প নেই। এর জন্য খুব দ্রুত উন্নত চিকিৎসায় বিদেশ পাঠানো দরকার।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা খুবই গুরুতর। গত সোমবার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন তার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। আবেদনটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ে আছে। গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত তাকে অনুমতি দেওয়ার কোনো খবর পাওয়া যায়নি বলে খালেদা জিয়ার একান্ত সহকারী জানিয়েছেন।
পাশাপাশি সরকারের অনুমতি পেলে দ্রুততম সময়ে তাকে বিদেশে নিতে ভিসা-প্রক্রিয়া শুরু থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ প্রয়োজনীয় সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। সরকারের সবুজ সংকেত না পাওয়ায় ভিসা করানো যাচ্ছে না।
গতকাল শুক্রবার দেশ রূপান্তরকে এসব কথা জানিয়েছেন খালেদা জিয়ার মেজো বোন সেলিমা ইসলাম।
তিনি বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালের খোঁজখবর নিচ্ছেন যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান। শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ থাকলে প্রথমে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হতে পারে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নত হলে অন্য দেশে নেওয়া হবে।
সেলিমা ইসলাম বলেন, ‘আমার বোন হেঁটে জেলে গেলেন। জেলে থাকাবস্থায় অসুস্থ হলে তাকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। এরপর করোনার কারণে সরকার তাকে দুটি শর্তে মুক্তি দেয়। তখন থেকেই আমরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে আবেদন করে আসছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার তাকে মুক্তি দেয়নি। বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে না পারায় দিনের পর দিন তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে আমার বোন।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী এবিএম আব্দুস সাত্তার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি নেতারা সার্বক্ষণিক চেয়ারপারসনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আমরা সরকারের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে আমরা দ্রুততম সময়ে চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠাতে পারব।’
জিয়া পরিবারের সদস্যরা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য তারা সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। অনুমতি পাওয়া মাত্র সব ধরনের পদক্ষেপ নেবেন। ইতিমধ্যে ভিসা প্রস্তুতিসহ অন্যান্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। বিদেশে নেওয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ অন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে যাবেন তার পুত্রবধূ শর্মিলা রহমান, ব্যক্তিগত সহকারী ফাতেমা ও ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসেন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি। তখন থেকেই তিনি হাসপাতালে খালেদা জিয়ার সেবায় সার্বক্ষণিক থাকছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আজ (গতকাল শুক্রবার) ম্যাডাম শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে বিকেলে তাকে তৃতীয়বারের মতো কেবিন থেকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নেওয়া হয়। রাতে আবার তাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। এর আগে ২২ সেপ্টেম্বর তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা অবনতি হওয়ায় হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে সিসিইউতে নেওয়া হয়েছিল। পরে অবস্থার উন্নতি হলে তাকে ফের কেবিনে স্থানান্তর করা হয়।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত চিকিৎসক দলের সদস্যরা জানান, খালেদা জিয়া ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। একই বছরের নভেম্বরে তার চিকিৎসকরা জানান, তিনি লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত দলীয় মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা তখন জানিয়েছিলেন, তাদের সাধ্য অনুযায়ী যতটুকু করার ছিল, তারা তা করেছেন। পরবর্তী চিকিৎসা যুক্তরাজ্য, জার্মানি অথবা যুক্তরাষ্ট্রে করার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পরিবারকে বলেছেন। পরের বছর জুন মাসে খালেদা জিয়ার হার্টে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর মধ্যে একটিতে রিং পরানো হয়। এখনো তার হার্টে দুটি ব্লক রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পাশাপাশি আমরা বিএনপি নেতারা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চেয়ারপারসনের পরিবারকে সার্বিক সহযোগিতা দিতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে দ্রুতই চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠানো হবে।’
গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহিলা দলের উদ্যোগে আয়োজিত সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘যে মানুষটি আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, তাকে আজ সরকার গৃহবন্দি করে রেখেছে। তিনি গুরুতর অসুস্থ হলেও তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। আমরা আশা করি, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে তার পরিবার যে আবেদন করেছে, তা সরকার বাস্তবায়ন করবে।’
সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ এক দফা দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে আটক রাখা হয়েছে। কারণ উনি মুক্ত থাকলে ওনাদের ক্ষমতায় থাকা কঠিন হয়ে যাবে। উনি মুক্ত থাকলে দেশের গণতন্ত্র মুক্ত থাকবে। উনি মুক্ত থাকলে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে না।’
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী, সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছে। ফলে এখন জেলে যাওয়া বা আদালতের আশ্রয় নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। ওই ৪০১ ধারাতেই বলা আছে, নির্বাহী আদেশে শর্ত ছাড়াই মুক্তি দেওয়া যায়। এমনকি সরকার সাজা মওকুফও করতে পারে। ফলে সরকারই শর্তহীন মুক্তি দিয়ে খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে।’
গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর বিষয়ে দুই-তিন দিন আগে তার ভাই শামীম এস্কান্দার এসেছিলেন। তিনি আবেদন জমা দিলে তা আইনমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে ব্যাখ্যার জন্য।
আবেদনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে থাকা বিএনপি নেতারা।
তারা গত বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছেন। খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। তারাও অপেক্ষা করছেন যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাবেন ওই নেতারা।
খালেদা জিয়াকে জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়ে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশে^র যে কয়েকটি দেশে সম্ভব, জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। এরপর থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এর আগেও অবশ্য খালেদা জিয়াকে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদযন্ত্রে জটিলতা, ফুসফুস, চোখ ও দাঁতের নানা সমস্যায় ভুগছেন। এ ছাড়া তার মেরুদ-, হাত ও হাঁটুতে বাতের সমস্যাসহ আরও কিছু শারীরিক জটিলতা রয়েছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার সাজা হয়। সেদিন থেকে প্রায় দুই বছর কারাবন্দি ছিলেন তিনি। এ ছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আরও সাত বছরের সাজা হয় খালেদা জিয়ার। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ করোনা মহামারির শুরুতে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার সাজা স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দিয়েছিল সরকার। এরপর থেকে তার মুক্তির মেয়াদ ছয় মাস করে বাড়ানো হচ্ছে।