
বিএনপি যখন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে ব্যস্ত রয়েছে, ঠিক সেই সময় আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত কয়েকটি রিপোর্ট দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকা এবং ডয়চে ভেলেতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন ও দ্য টেলিগ্রাফের একটি প্রতিবেদন বাংলাদেশের রাজনীতির পরিবর্তিত পটভূমি সম্পর্কে আলোকপাত করেছে।
তিনটি রিপোর্টের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারত সরকারের অবস্থান যা সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত অস্পষ্ট ছিল। তবে প্রতিবেদনগুলোতে বাংলাদেশকেন্দ্রিক ভূ-রাজনৈতিক বিষয় এবং ভারতের অবস্থান স্পষ্ট হয়েছে। আনন্দবাজার এবং ডয়চে ভেলেতে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, নয়াদিল্লি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা বার্তা পাঠিয়ে জানিয়েছে যে, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার দুর্বল হলে তা ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য সহায়ক হবে না। কূটনৈতিক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, নয়াদিল্লি একাধিক স্তরের কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বাইডেন প্রশাসনকে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। এর থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন সরকারের যে হস্তক্ষেপ সেটি সম্পর্কে ভারতের কিছুটা হলেও আপত্তি রয়েছে। যদিও ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ একটি স্বচ্ছ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করে। তবে নয়াদিল্লি বিশ্বাস করে যে, বাংলাদেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা গৃহীত কিছু পদক্ষেপ শেখ হাসিনা সরকারকে দুর্বল করতে পারে, যা ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যান্য প্রতিবেশীদের জন্য হুমকি হতে পারে।
দ্য টেলিগ্রাফে প্রকাশিত একটি পৃথক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে যে, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সংক্রান্ত বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। প্রথমত, উভয় দেশই বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ধারণাকে সমর্থন করে এবং দ্বিতীয়ত, তারা চীনপন্থি এবং ইসলামপন্থি নেতাদের বাদ দিয়ে দলে অসাম্প্রদায়িক এবং জনপ্রিয় প্রার্থীদের গুরুত্ব প্রদানের ব্যাপারে আওয়ামী লীগকে আহ্বান জানাবে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, উভয় দেশই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করতে চায় না।
ফলে এসব তথ্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। প্রতিবেদনগুলো এ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য আপাতদৃষ্টিতে সুবিধাজনক বলে মনে হচ্ছে। এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ভারত সরকার যদি বাংলাদেশি জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার পরিপন্থি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তবে তা হবে উদ্বেগের বিষয়। তিনি এ ধরনের হস্তক্ষেপকে দুর্ভাগ্যজনক এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে লঙ্ঘন বলে মনে করেন। অন্যদিকে, মির্জা ফখরুল এবং তার দল বাংলাদেশের জন্য কার্যকর করা মার্কিন ভিসা নীতির প্রশংসা করেছেন, যা ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’-এর উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
জঙ্গিবাদের প্রতি সরকারের জিরো টলারেন্স প্রদর্শন এবং চরমপন্থার বিরুদ্ধে তাদের সক্রিয় পদক্ষেপ ভারতের প্রশংসা অর্জন করেছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নাজুক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কার্যকরভাবে জঙ্গিবাদ দমন এবং বাংলাদেশের মাটিকে সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করতে না দিয়ে, শেখ হাসিনার সরকার ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এলাকায় একটি নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তুলতে অবদান রেখেছে। এই সহযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি শুধু উভয় দেশকে সরাসরি উপকৃত করেনি, বরং বৃহত্তর দক্ষিণ এশীয় প্রেক্ষাপটে আস্থা ও সহযোগিতার পরিবেশ গড়ে তুলতেও অবদান রেখেছে।
অন্যদিকে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি শাসনামলের তিক্ত অতীতের স্মৃতি এখনো ভারত সরকারের চেতনায় রয়ে গেছে, যা তাদের বাংলাদেশে বিএনপি সরকারের সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তনকে সমর্থন করার বিষয়ে সতর্ক করে তুলেছে। এই সময়কালে ভারত ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম (উলফা)-এর মতো গোষ্ঠীগুলোর জন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের ভূখণ্ডের দুর্ভাগ্যজনক ব্যবহার প্রত্যক্ষ করেছে, যা তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে অশান্তি সৃষ্টিতে সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রেখেছিল। ফলে এই বিষয়গুলো নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিয়ে ভারতের উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর্মীয় আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির ঘনিষ্ঠতা। এই ঐতিহাসিক ঘটনা ও অনুষঙ্গের সংমিশ্রণ আঞ্চলিক শান্তি ও সহযোগিতার প্রতি বিএনপির প্রতিশ্রুতি নিয়ে ভারতের মনে সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। ফলে অতীতের অভিজ্ঞতা এবং বিএনপি সরকারের সঙ্গে জড়িত সম্ভাব্য নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে বাংলাদেশে এ ধরনের প্রশাসনকে স্বাগত জানানো ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মতো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশি রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কাম্য না হলেও খুবই স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এ ধরনের বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক বা বৈশ্বিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের শক্তিশালী অবস্থানকে নির্দেশ করে। কারণ এর আগে পরাশক্তিগুলোকে বাংলাদেশকে নিয়ে এত শক্ত অবস্থান গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। ফলে সরকার, বিরোধী দল এবং বাংলাদেশের জনগণ কীভাবে আন্তর্জাতিক পরাশক্তিদের হস্তক্ষেপ মোকাবিলা করে জাতির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে সেটাই দেখার বিষয়।
বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো যদি সত্য হয়, তাহলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে। আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি যৌথ অঙ্গীকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব, ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ধারাবাহিকতার গুরুত্বের ওপর জোর দেওয়াটাই স্বাভাবিক। বিভিন্ন ধরনের আলোচনা থাকলেও, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলের জিরো টলারেন্সের অবস্থান এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য তাদের প্রচেষ্টা বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ইতিবাচকভাবে অনুরণিত হচ্ছে, যা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থন আদায় করার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলকেই সাহায্য করবে। শেষ পর্যন্ত আসন্ন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের জয়ের পাল্লাকেই তা ভারী করবে।
লেখক : অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
দিনরাত্রি মিলে হয় চব্বিশ ঘণ্টা। কিন্তু সব চব্বিশ ঘণ্টা কি সমান মনে হয়? নিশ্চয়ই নয়। কোনো কোনো চব্বিশ ঘণ্টা যেন মুহূর্তেই চলে যায়। যখন মানুষের হাতে টাকা-পয়সা থাকে অথবা প্রিয়জন পাশে থাকে। কিন্তু যখন প্রয়োজন তীব্র কিন্তু টাকা-পয়সার সংকট, তখন চব্বিশ ঘণ্টা যে কত বড় তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। আবার এটাও তো সত্যি যে, আর্থিক সংকট যত তীব্রই হোক না কেন পৃথিবী তার ঘোরা থামাবে না বা গতি কমাবে না। ফলে চব্বিশ ঘণ্টা কমবে বা বাড়বে না। চব্বিশ ঘণ্টাই থাকবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়ে সমাধানের আশায় মানুষ আপ্তবাক্য আওড়ায়। যেমন দিন বদলাবেই, এ রকম থাকবে না বা যত মুশকিল তত আসান। এতে সমস্যার সমাধান না হলেও, মানুষ একটু মানসিক সান্ত্বনা পায়। আজকের এই নিরবান্ধব হয়ে যাওয়ার কালে এটুকু সান্ত্বনাই বা কম কী?
কিন্তু সান্ত্বনারও রকমফের আছে। কোনো কোনো সান্ত্বনার বাণীতে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আবার কোনো সান্ত্বনার বাণী শুনলে গা জ্বালা করে। যদি দেখা যায়, ভুক্তভোগীকে সান্ত্বনা দেওয়া আর দুষ্কৃতকারীকে সহযোগিতা করা হয় তখন রাগ এবং ক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। আর যদি দেখা যায় পরামর্শ দেওয়া হয় এভাবে যে, অপরাধী তো অপরাধ করবেই, তোমার কাজ হচ্ছে কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া। তখন ভুক্তভোগী ক্ষুব্ধ হয় আর সুবিধাভোগী আনন্দিত হয়। নানা কায়দায় মানুষকে নিপীড়নের বিপরীতে ‘কায়দা করে বেঁচে থাক’ এ নীতি নিয়ে চললে নিপীড়ন তো কমেই না বরং বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। তারপরও মানুষ এমন কথা বলে, এভাবে সান্ত্বনা দেয় এবং অসহায়ের মতো ভুক্তভোগীরা শুনতেই থাকে।
মানুষের জীবনে কোনো কোনো সংকট আসে তা সে বুঝতে পারে। কিন্তু সমাধানের পথ খুঁজে পায় না। এরও আবার দুটো ভাগ আছে। প্রত্যক্ষ সংকট আর পরোক্ষ সংকট। প্রথমে পরোক্ষ সংকটের কথা ভাবা যাক। যেমন দেশ থেকে টাকা পাচার, বড় বড় প্রকল্পে অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধি, ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ ইত্যাদি। যখন ফলাও করে প্রচার হয় তখন মানুষ এসব কথা শোনে, সমাজে তার প্রভাব টের পায়, সংকট নিয়ে নিজেরা কথাবার্তা বলে আর ভাবে এসব বিষয়ে আমার কী করার আছে? সরকার আছে, সরকার দেখবে। কিন্তু কিছু বিষয় আছে, প্রত্যক্ষ সংকট এবং জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলে। দ্রব্যমূল্য তার মধ্যে অন্যতম। সাধারণ মানুষের যা আয়, তা পুরোটা ব্যয় করার পরও যখন সংসার চলে না তখন সে ক্ষুব্ধ হয়। কী করা উচিত তা নিয়ে ভাবে না বরং কী করতে হবে সেটা করে। সাধারণ মানুষের দৌড় তো তার আয়ের সীমানা পর্যন্তই। তাই সে খাওয়া কমায়, কাপড় কেনা কমায়, প্রয়োজনীয় জিনিসের তালিকা ছোট করতে থাকে। সমস্যার কারণ দূর করতে না পেরে নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি করে। প্রধানত দাম্পত্য কলহে লিপ্ত হয়, স্ত্রীকে মারধর করে, সন্তানদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে, বাবা-মাকে অপমান করে আর নিজেকে অপদার্থ ভাবতে থাকে।
এ রকম সময়ে যাদের দায়িত্ব সমস্যার সমাধান করা, তারা যদি দায়িত্ব এড়িয়ে যান, তাহলে কেমন হয়? অথবা যদি তারা এমন পরামর্শ দেন যাতে সমস্যা দূর না হয়ে বরং যাদের জীবনে সমস্যার আঘাত আছে তাদেরকেই সহ্য করার বা বিকল্প পথ বের করার কথা বলা হয়, তাহলে কেমন লাগে? কাঁচা মরিচের দাম এক হাজার টাকা উঠার পর আমদানির ঘোষণা আসতে না আসতেই কেজিপ্রতি তিনশ টাকা কমে গেল। এই কমে যাওয়াকে অর্থনীতির ডিমান্ড সাপ্লাই তত্ত্বের সঙ্গে মেলানো যাবে কেমন করে?
একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, বাংলাদেশে দেখা যায়, মজুদ আছে, সরবরাহ আছে, তারপরও হঠাৎ করে জিনিসের দাম বেড়ে যায়। পেঁয়াজ, ডাবের ক্ষেত্রে দেখলাম। কাঁচা মরিচের কেজি এক হাজার টাকা দেখলাম। সিন্ডিকেটের কথা দায়িত্বশীল মন্ত্রীরাও বলেন। আমরা মনে করি, সরকার দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে। এই নিত্যপণ্যের মৌসুমি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে কি না, তা জানতে চান তিনি।
এর জবাব দিতে গিয়ে এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন ডিম নিয়ে শুরু করেছে। ডিমের দাম কমলে বেশি সেদ্ধ করে ফ্রিজে রেখে দেবেন। অনেক দিন ভালো থাকবে, সহসা নষ্ট হবে না। রান্না করতে পারবেন, ভর্তা বানাতে পারবেন।’ তিনি বলেন, ‘সিন্ডিকেটের ওপর নির্ভরশীলতা কমায় দেব, বিকল্প ব্যবস্থা করব। সিন্ডিকেট এভাবেই ভেঙে যাবে।’ বর্ষাকালে কাঁচা মরিচের দাম বাড়ে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিকল্প ব্যবস্থা তো রয়েছে। কাঁচা মরিচ এখন শুকনা করে রেখে দেওয়া যায়, পেঁয়াজ শুকিয়ে সুন্দর করে রেখে দেওয়া যায়। যে জিনিসটা বেশি হবে, সেটা ভালো করে রোদে শুকিয়ে রেখে দিলে অনেক দিন ব্যবহার করা যায়।
সেই একই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘খাদ্যপণ্য নিয়ে কয়েকটা হাউজ ব্যবসা করে। যখনই তারা আর্টিফিশিয়ালি (কৃত্রিমভাবে) দাম বাড়ায়, আমরা আমদানি করি, বিকল্প ব্যবস্থা করি। যাতে তারা বাধ্য হয় দাম কমাতে। আমরা তো সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেই।’ এর আগে কাঁচা মরিচের দাম বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২১ জুন গণভবনে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বর্ষা হলে কাঁচা মরিচের দাম বেড়ে যায়। তাই কাঁচা মরিচ উৎপাদন করে রোদে শুকিয়ে রেখে দেন। পরে পানি ছিটিয়ে দিলে এটি তাজা হয়ে যায়। খরচ কমিয়ে সংসার চালানোর ক্ষেত্রে এই পরামর্শ কাজে লাগতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যারা প্রধানমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী, আর্টিফিশিয়ালি দাম বাড়িয়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করল, তাদের কি শাস্তি হবে না?
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে দৈনিক ডিমের চাহিদা সাড়ে তিন থেকে চার কোটি পিস আর পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সংগঠনগুলোর হিসাব মতে, ডিমের দৈনিক চাহিদা ৪ কোটি ৭০ লাখ থেকে ৮০ লাখ পিস। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ডিম উৎপাদন হয়েছে ২ হাজার ৩৩৫ কোটি। প্রতিবছর দেশে ডিমের উৎপাদন বাড়ছে। সে হিসেবে দৈনিক গড় উৎপাদন দাঁড়ায় ৬ কোটি ৪০ লাখের কাছাকাছি। তাহলে তো ডিমের ঘাটতি থাকার কথা নয়। জুলাই মাসে খুচরা বাজারেও ডিম বিক্রি হয়েছে ১০ টাকা পিস, আগস্ট মাসে ডিমের দাম ১৫ টাকা পিস। প্রতিদিন চার কোটি ডিম বিক্রি হলে ক্রেতাদের পকেট থেকে বাড়তি চলে যায় ২০ কোটি টাকা। তাহলে এক মাসে ভোক্তারা বেশি খরচ করেছেন ৬০০ কোটি টাকা। গত কয়েক মাস ধরে মুরগির খাদ্যের দাম তো একই পর্যায়ে আছে, বিদ্যুৎ এবং পরিবহন খরচও আগের মতোই। তাহলে দাম বাড়ানোর কারণ কী? বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অভিযোগ করেছেন, কাজী ফার্ম, প্যারগন, নারিশ গ্রুপই ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।
বাংলাদেশে ডিম বেশি খায় কারা? যারা মাছ, মাংস খেতে পারে না দামের কারণে তাদের জন্য আমিষের একমাত্র বিকল্প ডিম। এক কেজি মাংসের দাম ৮০০ টাকা। প্রতি কেজিতে ১২ পিস করলে প্রতি পিসের দাম পড়ে প্রায় ৬৭ টাকা। ব্রয়লার মুরগির প্রতি পিসের দাম পড়ে ২৫ টাকা, সবচেয়ে সস্তা পাঙাশ মাছের এক পিসের দাম পড়ে ২০ টাকা। এর সঙ্গে আছে রান্নার তেল মসলার খরচ। ডিমের ক্ষেত্রে সে খরচ খুবই কম, সহজে রান্না করা এবং খাওয়া যায়। সে কারণেই শ্রমিক, মেসে বাস করে যারা এবং স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে ডিম শুধু প্রিয়ই নয়, প্রয়োজনীয় খাবার। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে যে খাত থেকে সেই গার্মেন্টস খাতের শ্রমিকদের আমিষের প্রধান উৎস ডিম। মাসে ১০ হাজার টাকা আয় করে যে শ্রমিক সে আর কী খেতে পারে? এসব শ্রমিক এবং দিন এনে দিন খাওয়া মানুষদের ডিম সিদ্ধ করে ফ্রিজে রেখে দেওয়ার পরামর্শ কতটা কার্যকরী? কিংবা ফ্রিজে মরিচ, পেঁয়াজ সংরক্ষণ করার পরামর্শ কতটা বাস্তবসম্মত? কারা দাম বাড়ায়, কারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, কারা মাঠের ফসল আর পাতের খাবার নিয়ে একচেটিয়া ব্যবসা করে এবং সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে তা কি সরকারের জানা নেই?
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণ মতামত দেয়। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব সরকারের। ফলে শুধু সাফল্যের প্রশংসা নয়, ব্যর্থতার দায় তাদেরই নিতে হবে। প্রশ্ন উঠবে, উন্নয়ন হচ্ছে অবকাঠামোর কিন্তু জনগণের জীবনমানের উন্নতি হচ্ছে কি? এই প্রশ্নের সমাধানের লক্ষ্যে যে বিতর্ক তা শুধু জনগণের জীবনমানের উন্নতি ঘটাবে না, উন্নতি ঘটাবে গণতান্ত্রিক চেতনার। মানুষ যুক্তি করবে, নির্বাচনে তার যুক্তি অনুযায়ী ভোট দেবে। রাজনীতিতেও বিকল্প খোঁজার পরিবেশ গণতন্ত্র ও জবাবদিহিতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কথা সত্য যে, সব বিকল্প সব সময় ভালো হয় না। তাই শুধু বিকল্প নয়, চেষ্টা করতে হবে উন্নততর বিকল্প প্রতিষ্ঠার। বিকল্প প্রতিষ্ঠার এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকুক। লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট
ফয়েজ আহ্মদ। প্রখ্যাত সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন আর্ট গ্যালারি ‘শিল্পাঙ্গন’। প্রগতিশীল পাঠাগার ‘সমাজতান্ত্রিক পাঠাগার’-এর প্রতিষ্ঠাতা। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) প্রথম প্রধান সম্পাদক অকৃতদার এই কবি ও ছড়াকার মারা যান ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। অতীতের সঙ্গে অধুনার সংযোগ ঘটাতে চিন্তা পাতায় ছাপা হলো তার লেখা উপসম্পাদকীয়
নির্বাচন অত্যন্ত নিষ্ঠুর হতে পারে না; নির্বাচনের সঠিক ফলাফল সম্পর্কে এ বক্তব্য নয় নির্বাচন পদ্ধতি ও তার প্রচারাভিযান। পদ্ধতি সম্পর্কেই-বা কী বলা চলে? নির্বাচন ফলবান করতে হলে সাধারণত বলবান হতে হবে; শুধু তাই নয়, অর্থ বলিদান একটি প্রধান উপায় বলে অনেকে সম্প্রতি প্রতিপন্ন করেছেন। মিথ্যা, অর্থ, ব্যালেট বাক্স হরণ, শক্তি প্রয়োগ, শাসনযন্ত্রের অপব্যবহার (কোনো কোনো, ক্ষেত্রে বন্দুক চালনা) ইত্যাদি প্রয়োগ সম্পর্কেও বলছি না। এই অদ্ভুত প্রচারাভিযানের মাধ্যমেও নির্বাচনে জয়লাভ করা সম্ভব। যেমন ঐতিহাসিক সত্য ফাঁস করে দিয়ে অথবা পারিবারিক সত্য দেশবাসীর কাছে প্রচার করে মুষ্টিবদ্ধ উড়ন্ত পতাকা নিয়ে পরিষদ কক্ষে প্রবেশ দুঃসাধ্য নয়।
তবে সত্য এমনই মোক্ষম হতে হবে যে, তার মূল তথ্য যেন সত্যের অপলাপ না হয়। অর্থাৎ সত্য প্রচারণাটি হবে উত্তেজক, অসাধারণ বা আপাতদৃষ্টিতে অদ্ভুত ও ব্যঞ্জনাপূর্ণ, যা শ্রবণের পর প্রতীয়মান ভোটদাতাগণ প্রদ্যোতিত হয়ে উঠবেন। ইংল্যান্ডের যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী ও নোবেল পুরস্কার বিজয়ী স্যার উন্সটন চার্চিল পঞ্চান্ন সালের প্রথম সিকিতে নিজ এলাকায় নির্বাচনী বক্তৃতামালার শুরুতেই এমন এক ঐতিহাসিক গোপন সত্য প্রকাশ করেছিলেন যে, তারপরে উক্ত নির্বাচনে রক্ষণশীল দলের প্রার্থীর বিজয়ের জন্যে আর যে কোনো প্রকার প্রচারণাই যেন বাহুল্য ছিল। একটি মাত্র দূরদর্শিতাপূর্ণ নির্দেশ সংক্রান্ত সত্য তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করেই তিনি এলাকার ভোটারদের পকেটে পুরে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। চার্চিল নির্বাচন এলাকায় প্রথম বক্তৃতায় প্রকাশ করেন যে, ‘দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মিত্রপক্ষের জার্মানি ও বার্লিন বিজয়ের সময় আমি মন্টিকে (ফিল্ড মার্শাল মন্টেগোমারি) জার্মানদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অস্ত্র মাটির নিচে লুকিয়ে রাখতে বলেছিলাম, যাতে সোভিয়েত রাশিয়ার হাতে এ সমস্ত অস্ত্র না পৌঁছায়। কারণ, এই অস্ত্র ভবিষ্যতে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে হতে পারে (তাই ঘটেছে পরে)।
সে সময় চার্চিলের এই তথ্য প্রকাশের ফলে যুদ্ধকালীন মিত্র পক্ষের শিবিরে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ব্রিটেনের কম্যুনিস্ট পার্টির সে সময়কার মুখপত্র ডেইলি ওয়ার্কার পত্রিকায় সেদিনই প্রতিবাদী কণ্ঠে বিশাল হেডিং-এ প্রথম পৃষ্ঠাব্যাপী খবর বের হয় ‘রিজাইন চার্চিল।’ সম্পাদক কর্তৃক লিখিত সংবাদ নিবন্ধে স্যার উন্সটনকে বিশ্বাসঘাতক বলে আখ্যায়িত করে অবিলম্বে পদত্যাগের দাবি করা হয়েছিল। সম্পাদক বলেন, দ্বিতীয় ফ্রন্টের দ্বিতীয় অধিনায়ক ব্রিটিশ ফিল্ড মার্শাল মন্টেগোমারিকে অস্ত্র লুকিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়ে চার্চিল মিত্রপক্ষের অংশীদার সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। চার্চিলের নির্দেশ ঐতিহাসিকভাবে রূঢ় সত্য হলেও কঠোর মন্তব্য ও অভিযোগের কোনো উত্তর ছিল না বললেই চলে। কিন্তু নির্বাচনী অভিযান তাঁর এই উক্তি রক্ষণশীল দলের সমর্থকদের কাছে তাঁকে ‘দূরদর্শী ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন’ নেতা হিসেবে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করে।
এ ধরনের বিশ্ব রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত নয়, কিন্তু পারিবারিক উত্তেজনাকর ও ব্যঞ্জনাপূর্ণ একটি ঘটনা চুয়ান্ন সালের নির্বাচনের যুক্তফ্রন্টের জনৈক প্রার্থীর জয়লাভ সহায়কই শুধু হয়নি, প্রদেশের রাজনৈতিক আলোচনার রসাত্মক বিষয়বস্তুতেও পরিণত হয়েছিল।
যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থীদের নামের তালিকা অভ্যন্তরীণ কলহের ফলে একদিনে বা একবারে প্রকাশিত হয়নি। প্রতি রাত্রে খন্ড খন্ড লিস্ট আসত বলে পত্রিকার অফিস রিপোর্টার ও অন্যদের অপেক্ষা করতে হতো অধিক রাত্রি পর্যন্ত। প্রার্থীদের মনোনয়নের পর স্ব-স্ব এলাকা থেকে প্রার্থীরা প্রতি রাতেই বক্তৃতার অসংখ্য টেলিগ্রাম পাঠাতেন এবং টেলিফোন পেলে তো কথাই ছিল না। সুতরাং আমাদের অধিক রাত্রি না জেগে উপায় ছিল না। এ ছিল উৎসাহী প্রতিটি পত্রিকারই অবস্থা। সে ক্ষেত্রে কাজ শেষে নিউজ টেবিলে ফাইল মাথায় দিয়ে ঘুমিয়ে পড়া ছিল নিয়মিত ব্যাপার।
কিন্তু প্রভুভক্ত পিয়ন বশীর ছিল বেরসিক। ভোর ছ’টার দিকে কেউ ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাবে, তা আমরা চাইনি। সে টেবিলের পাশে এসে কারো নাম উচ্চারণ না করে এক সুরে বলে যেতে লাগলো স্যার! স্যার! স্যার!
ঘুমের মধ্য থেকে কে একজন বলল হুঁ! স্যার, বেশি কাগজ চায়।
ক্ষেপে উঠলাম। আমরা কি জানি! বলেন গিয়ে সম্পাদক সাহেবকে (তখন থেকেই জনাব তফাজ্জল হোসেন মানিক মিঞা ইত্তেফাকের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী সম্পাদক)।
বশীর নাছোড়বান্দা। বললাম ওয়াদুদ সাহেবকে খুঁজে বের করুন। আবদুল ও ওয়াদুদ সাহেব তখন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং নব প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের একনিষ্ঠ ম্যানেজার। বশীর এক অসাধারণ প্রকৃতির পিয়ন ও হকার। পত্রিকার প্রতি তার দরদ ছিল অপরিসীম, একটি কপিও যেন অবিক্রীত না থাকে। তাই সে অতিরিক্ত সংখ্যক কাগজের খদ্দের ছেড়ে দিতে নারাজ। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে হতো হকার। হকার বশীরের কাগজ বিক্রয় করার অভিনব পন্থা ছিল। প্রতিদিনের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বা মুখরোচক খবরের মূল শিরোনাম চিৎকার করে উচ্চারণ করতো সে এবং ঢাকার বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে প্রধানত ইত্তেফাক বিক্রয় করে বেড়াত। রাজনৈতিক বা ঘটনার দিক থেকে কোন হেডিংটা ক্রেতাদের কাছে আকর্ষণীয়, সে বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা ছিল প্রচুর। একবার বশীর হাটখোলা রোডে চিৎকার করে কাগজ ‘হক’ করছিল ‘খবর নেই, খবর নেই। ভাসানীর কোনো খবর নেই!’
পথচারী, দোকানদার, গাড়িচালক সবাই এসে উৎকণ্ঠার সাথে তাকে ঘিরে ধরলো এবং প্রায় বলপূর্বক ইত্তেফাক কিনে নিতে লাগলো। মুহূর্তের মধ্যে তার কয়েকশ’ পত্রিকা বিক্রয় হয়ে গেল। সবাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে দ্রুত কাগজটার ওপর চোখ বুলিয়ে অবাক। কোথায় ভাসানীর খবর? পাঠক ক্রেতাগণ ভেবেছিলেন, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী সম্ভবত নিখোঁজ! তারই বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ আছে অর্থাৎ পুলিশ রাতের অন্ধকারে মওলানা সাহেবকে তুলে নিয়ে গোপন স্থানে আটক রেখেছে। অথবা মওলানা ভাসানী নিজেই নৌকা করে যমুনা পাড়ি দেয়ার সময় নিখোঁজ হয়েছেন। মওলানা সাহেব মাঝে মাঝে নৌকায় করে গ্রামাঞ্চলে ঘুরে বেড়াতেন এবং সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে তাদের রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতেন। সে সময় তাঁর নিজের দলের সাথেও তিনি কোনো কোনো ক্ষেত্রে যোগাযোগ রাখতে পারতেন না। সবাই চেপে ধরলো বশীরকে, কোথায় ভাসানীর খবর? কাগজে তো ভাসানীর কোনো খবর নাই?
বশীর : আমি তো তাই বলছি, আজকের কাগজে ভাসানীর কোনো খবর নাই, (তখন প্রতিদিনই পত্রিকায় মওলানা সাহেবকে নিয়ে কোনো না কোনো খবর থাকতো। সেদিনটা ছিল ব্যতিক্রম)! অবাক ক্রেতাদের সামনে বশীর পুনরায় চিৎকার করে উঠলো খবর নাই, ভাসানীর কোনো খবর নাই! পরবর্তীকালে ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক ভাই কোনো একটা কারণে বশীরের ওপর রেগে গিয়ে তাকে বরখাস্ত করার নির্দেশ দেন। এ জাতীয় বরখাস্ত তাকে (এবং অনেককে) ইতোপূর্ব বহুবারই করা হয়েছিল। দ্বিতীয় দিন সম্পাদক তা ভুলে গেছেন এবং কোনোদিনই তা কার্যকর হয়নি। কিন্তু এবার সম্পাদক সাহেব একটু কঠোর ছিলেন। অবস্থা লক্ষ করে বশীর তার বাসায় ফিরে যায়। বিকেলে সে পুনরায় ইত্তেফাক অফিস এসে উপস্থিত; কিন্তু সে একা নয় বশীরের স্ত্রী ও পাঁচটি শিশুসন্তানসহ!
সোজা সম্পাদকের কক্ষে গিয়ে বলল স্যার, আমি যখন ইত্তেফাকে আসি, তখন ছিলাম একা। ইত্তেফাকে চাকরিকালেই এই ঘর-সংসার ও সন্তান। এরা ইত্তেফাকের সন্তান। একা এসেছিলাম, একা চলে গেলাম। ইত্তেফাকই এদের দেখবো। স্ত্রী-সন্তানদের ইত্তেফাক অফিসে রেখে বশীর নিরুদ্দেশ যাত্রার উদ্যোগ নিল। প্রভাবশালী পত্রিকার প্রখ্যাত সম্পাদক অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইলেন।
সেই বশীর এখনও দৈনিক ইত্তেফাকে অব্যাহত চাকরিতে কাজ করে যাচ্ছে, তার পদোন্নতিও হয়েছে। ইত্তেফাক বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করলে সিঁড়ির কাছাকাছি শ্মশ্রুম-িত যে ভদ্রলোককে এক সময় একটি ছোট টেবিলের পাশে বসে থাকতে দেখা যেত, সে-ই আমাদের বহু পরিচিত বশীর। ইত্তেফাকের প্রাণের সাথে সম্পর্কিত জনাব বশীর পুত্রগণ এখন স্কুল-কলেজে। এহেন বশীরের হাত থেকে রেহাই পাওয়া ছিল দুঃসাধ্য কাজ। টেবিলের ওপর উঠে বসে বললাম, কোথায় তোমার সেই ভদ্রলোক? দেখি কথা বলে, কত কপি চান তিনি? যত সব ঝামেলা।
খদ্দের ভদ্রলোক কক্ষে প্রবেশ করতেই মনে হলো, চিনি। মুসলিম লীগ নেতা জনাব সবুর খানের ভাই, ব্যারিস্টার জনাব আবদুল গনি। যুক্তফ্রন্ট খুলনায় সবুর সাহেবের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রার্থী মনোনয়নদানের জন্যে চেষ্টা করছিল। শেষ পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে তাঁরই ভাই ব্যারিস্টার সাহেবকে মনোনয়ন প্রদান করা হয়েছিল। সৎ, শান্ত প্রকৃতির ও ঝামেলাবিহীন ব্যারিস্টার গনি সাহেব সোলার হ্যাট মাথায় দিয়ে সাইকেলে চড়ে হাইকোর্ট যেতেন। সে কারণে তিনি অনেক চক্ষু এড়াতে পারেননি। সবুর খানের বিপরীতে ব্যারিস্টারের জয়লাভের সম্ভাবনা ক্ষীণ ছিল, যুক্তফ্রন্টের নৌকাই ছিল তাঁর একমাত্র প্রধান সহায়।
গনি সাহেব যে। আমি এসেছি আজকের কাগজের পাঁচ হাজার কপি নিতে। এ কপি পেলেই লঞ্চে করে খুলনায় যাত্রা করবো। আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম, সেদিনের পত্রিকায় বড় হরফে প্রকাশিত সবুর খান সাহেব সম্পর্কিত একটি বিশেষ কোর্ট নিউজের কথা। আগের দিন খুলনা থেকে এক ভদ্রলোক এসে জানিয়ে গিয়েছিলেন যে, ঢাকার লোয়ার কোর্টে সবুর সাহেবের বিরুদ্ধে একটা মামলা সেদিনই রুজু করা হবে। রাজনৈতিক মামলার কথা বিবেচনা করে, আজাদ পত্রিকার সন্তোষ বসাক ও ইত্তেফাকের আমি কোর্টে সময়মতো উপস্থিত। অন্য কাগজের কোর্ট রিপোর্টারও সম্ভবত ছিলেন। নতুন কাগজ বলে কোর্ট রিপোর্টার তখন আমাদের ছিল না। উকিলের সাহায্য নিয়ে প্রয়োজনবোধে কোর্টের বিশেষ বিশেষ রিপোর্ট করা হতো। কিন্তু কোর্টে বাদীপক্ষের অর্জিত ব্যাপারে ভিন্নতর, রাজনৈতিক নয়। বাদীপক্ষের বক্তব্যে সবুর খান সাহেবকে (নামের পূর্বে খান সংযোজন পরবর্তীকালে আইয়ুব আমাদের অলঙ্করণ খান এ. সবুর) জড়িয়ে একটি বিবাহ সংক্রান্ত অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। আমরা হতবাক। বাদী সংশ্লিষ্ট মহিলার নাম উল্লেখ করে তাঁকে নিজের স্ত্রী বলে দাবি করেছেন। অফিসে ফিরে সম্পাদকের সাথে পরামর্শ করেই খবরটা প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপানোর জন্যে লেখা হলো। রাত্রে এক উকিলকে দেখিয়েই পরদিন সকালের কাগজে কোর্টে উত্থাপিত, এই বিবাহ সংক্রান্ত খবরটি প্রকাশিত হয়।
ক্ষমতার লড়াইয়ের নিষ্ঠুর নির্বাচনে ব্যক্তিগত ঘটনা কি ভয়ঙ্কর অস্ত্ররূপে ব্যবহৃত হতে পারে! আপন প্রতিদ্বন্দ্বী ভাই (উর্দুতে যাকে বলে ‘হামশিরা’ এক মায়ের দুধ যারা পান করেছেন!) ভয়ানক এক শাণিত অস্ত্র, ইত্তেফাকে প্রকাশিত সংবাদটির জন্যে, পাঁচ হাজার কপি ক্রয় করতে এসেছেন প্রতুষ্যে!
ইত্তেফাক থেকে যতসংখ্যক সম্ভব কপি নগদ পয়সায় ক্রয় করে ব্যারিস্টার গনি সাহেব খুলনা যাত্রা করলেন। নির্বাচনী এলাকায় প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ইত্তেফাক টাঙিয়ে দেয়া হলো, প্রত্যেকটি নির্বাচনী বক্তৃতায় লীগবিরোধী বক্তাগণ এই কোর্টে উত্থাপিত খবরটি উল্লেখ করতে দ্বিধা করলেন না। এবং এই ধারালো খবরই প্রতাপশালী সবুর সাহেবের পরাজয়ের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ালো।
মুসলিম লীগের নেতা জনাব সবুর যিনি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন, সেই নির্বাচনে নিজের ভাই যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী ব্যারিস্টার জনাব আবদুল গনির কাছে পরাজয়বরণ করতে বাধ্য হন। নির্বাচন প্রায়ই এমন নিষ্ঠুর হয় প্রচারের শাণিত অস্ত্র সহোদরকেও নিদারুণ আঘাত হানতে দ্বিধাবোধ করে না।
লেখক: বরেণ্য সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
যেকোনো জেলা শহরে, ব্যাচেলরদের জন্য বাসাভাড়া একটা বিড়ম্বনার বিষয়। আর রাজধানী ঢাকা শহরে কী যে অবস্থা, তা কেবল ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন। অধিকাংশ আবাসিক এলাকায় ব্যাচেলরদের জন্য বাসা ভাড়া দেওয়া হয় না। তবু কোনো কোনো ফ্যামিলির সঙ্গে গোপনে সাবলেটে অনেকেই থাকেন। সেখানে ছেলে বা মেয়ে, যা-ই হোক না কেন, শুধু নিরাপত্তা এবং নিশ্চয়তা থাকলেই কোনো আগপিছ ভাবেন না তারা। বাড়িওয়ালাদের কাছে অবিবাহিত কেউ যেন ‘আপদ’ কিংবা ‘আতঙ্কে’র নাম। যে কারণে তারা বাধ্য হয়েই মেসের সন্ধান করেন। এ সুযোগটিই কাজে লাগাচ্ছে কিছু পক্ষ। এখন পর্যন্ত সন্ধান পাওয়া গেছে, তৃতীয় পক্ষের। তবে এর বাইরেও অন্য কোনো পক্ষ রয়েছে কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি।
রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট মেস গড়ে উঠেছে। সেখানে তারা মোটামুটি নিশ্চিন্তে এবং নিরাপদেই থাকতে পারেন। কিন্তু পুরুষ ব্যাচেলর শিক্ষার্থী ও চাকরিজীবীদের জন্য সেভাবে কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই। যে কারণে হন্যে হয়ে তাদের বাসা খুঁজতে হয়। যদিও তারা পান, তবু সেখানে রয়েছে নানা ধরনের জটিলতা। দ্বিতীয় বা তৃতীয় পক্ষের ব্যাপারে বাড়ির মালিক যতই না জানার ভান করুক, তার অগোচরে কিছু করা একেবারেই অসম্ভব।
এ বিষয়ে শুক্রবার দেশ রূপান্তরে ‘বাসাভাড়ায় “তৃতীয় পক্ষ” আতঙ্ক’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে ব্যাচেলর এবং চাকরিজীবীদের নানা ধরনের সমস্যা এবং অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে কীভাবে তৃতীয় পক্ষ তৈরি হয়েছে, তার বিস্তারিত করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, এলাকাভেদে একটি ফ্ল্যাট কয়েক হাত বদল হয়ে শিক্ষার্থী ও চাকরিজীবীদের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়। প্রথম পক্ষ বাড়ির মালিক। তারা দ্বিতীয় পক্ষকে নির্ধারিত হারে ফ্ল্যাট ভাড়া দেন। দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা লাভে তৃতীয় পক্ষের কাছে ভাড়া দেয় দ্বিতীয় পক্ষ। ব্যাচেলরদের কাছ থেকে রুমের ভাড়া ২ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা এবং সিটপ্রতি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা বেশি আদায় করে ফ্ল্যাট ভাড়া নেয় তৃতীয় পক্ষ। এ ব্যাপারে মালিকরা কিছুই জানেন না বলে তাদের দাবি।
বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১ রয়েছে। প্রচারের অভাবে বাড়ির মালিক বা ভাড়াটিয়া কেউ আইনটি সম্পর্কে তেমন অবহিত নন। কয়েকজন বাড়ির মালিক জানলেও স্বীকার করেন না। ভাড়ানৈরাজ্য রোধে আইনের ৭ ধারায় বলা হয়েছে, বাড়িভাড়া বাবদ ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা যাবে না। বাস্তবতা ভিন্ন। কোথাও কোথাও কয়েকগুণ বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এই আইনে ব্যাচেলর এবং চাকরিজীবীদের বাড়ি ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে যে ঝামেলার মুখোমুখি হতে হচ্ছে, তা থেকে উত্তরণের কোনো কথা নেই। না থাকার ফলে, উদ্ভব হয়েছে তৃতীয় পক্ষের। একজন বাড়ির মালিক, আইনের বাইরে বাড়তি ভাড়া কোনোভাবেই আদায় করতে পারেন না। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পক্ষ তো দূরের কথা। তিনি জানেন, কত বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের ভাড়া কত হতে পারে? তা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত রয়েছে। এটাও ঠিক, গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলা, শোলাকিয়া ঈদগাহে হামলার চেষ্টার পর থেকে সারা দেশে ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া দিতে মালিকরা হিসাবনিকাশ করছেন। আবার কল্যাণপুরে একটি বাড়িতে অভিযানে ৯ জঙ্গি নিহত হওয়ার পর অবিবাহিত তরুণ, যুবকদের বাসা ভাড়া দেওয়া থেকে একরকম মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বাড়ির মালিকরা। অনেকের কথা, প্রয়োজনে বাসা খালি থাকবে তা-ও একজন ব্যাচেলর ভাড়াটিয়া চান না তারা।
এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মাত্র ১০-১৫ শতাংশ হল বা ছাত্রাবাসে থাকেন। বাকি ৮৫-৯০ শতাংশই ভাড়া বাসায় থাকছেন। আর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন এমন ব্যাচেলরের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। সঙ্গে ব্যাচেলর পোশাককর্মী আছেন ৫-৬ লাখ। সব মিলিয়ে প্রায় ৬০ লাখ ব্যাচেলর থাকেন রাজধানীতে।
কোনো বৈধ নাগরিককেই বাসা ভাড়া না দেওয়ার আইন নেই। যদি না তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অপরাধের প্রমাণ থাকে। এসব বিষয় বাড়িওয়ালারা পাত্তা দেন না বলেই তৈরি হয়েছে তৃতীয় পক্ষেরযারা সুযোগ নিচ্ছে অসহায়ত্বের। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ দেখাবে কোন কর্তৃপক্ষ, জানা নেই কারও।
১৯৬৭ সালের এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন উচ্চাঙ্গ সংগীতশিল্পী ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ। তার জন্ম ২৬ এপ্রিল ১৮৮৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তার বাবা সবদর হোসেন খাঁ-ও একজন সংগীতজ্ঞ ছিলেন। ১০ বছর বয়সে তিনি অগ্রজ ফকির আফতাবউদ্দিন খাঁর কাছে সংগীতশিক্ষা শুরু করেন। পরে তিনি ভারতের মাইহারে যান বড় ভাই ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কাছে এবং তার কাছে সেতার, সুরবাহার এবং বাদনকৌশল ও রাগ রূপায়ণের সূক্ষ্ম বিষয়গুলো নিষ্ঠার সঙ্গে আয়ত্ত করেন। পরে শিক্ষা সমাপনান্তে তিনি মাইহার রাজ্যের সভাবাদকরূপে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৩৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমন্ত্রণে তিনি শান্তিনিকেতন যান এবং বিশ্বভারতীর যন্ত্রসংগীত বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে কিছুদিন পর চাকরি ছেড়ে তিনি স্বগ্রামে চলে আসেন। উচ্চাঙ্গ সংগীতের ঐতিহ্যবাহী ধারা সচল রাখা, নতুনদের এর প্রতি আকৃষ্ট করা এবং বিশেষভাবে যন্ত্রবাদনের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ‘আলম ব্রাদার্স’ নামে একটি বাদ্যযন্ত্র তৈরির কারখানা খুলে গবেষণার মাধ্যমে কয়েকটি নতুন বাদ্যযন্ত্রও উদ্ভাবন করেন। মনোহরা ও মন্দ্রনাদ বাদ্যযন্ত্র দুটি তার সৃষ্টি। তিনি সুরবাহার ও সরোদ যন্ত্রেরও নতুনরূপ দেন। বিশুদ্ধ রাগসংগীতের চর্চা, সংরক্ষণ ও প্রসারের জন্য তিনি ১৯৪৮ সালে কুমিল্লায় এবং ১৯৫৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আলাউদ্দিন মিউজিক কলেজ নামে দুটি সংগীতপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। সংগীতে কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬০ সালে তিনি গভর্নর পদক, ১৯৬১ সালে তমঘা-ই-ইমতিয়াজ খেতাব এবং ১৯৬১ সালে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাইড অব পারফরম্যান্স লাভ করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি মরণোত্তর স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার লাভ করেন।
ব্যাংকপাড়াখ্যাত মতিঝিল এখন মৃতপ্রায়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে না পারায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যত্র সরে যাচ্ছে। দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতির চাকা ঘোরানো মতিঝিলে আবাসিক ভবন, শপিং মল, হোটেল, উন্মুক্ত স্থান তৈরি না হলে দেশের প্রধান এই বাণিজ্যিক অঞ্চল প্রাণ হারাবে বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
তাদের মতে, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বড় অবদান রয়েছে মতিঝিলের টাকার। শুধু তা-ই নয়, মতিঝিলে উপার্জিত অর্থে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে দুবাই, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, কানাডাসহ আরও অনেক দেশে। এখানকার উপার্জিত টাকা অনেকে জমা রেখেছেন সুইস ব্যাংকেও। শুধু উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি মতিঝিলে। এ যেন মা কাঁকড়ার আত্মত্যাগের গল্প। মা কাঁকড়া বাচ্চাদের আগলে রাখে বুকের ভেতর; যেদিন বাচ্চাগুলো বের হয়ে আসে, সেদিন খোলস ছাড়া মা কাঁকড়ার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। মা কাঁকড়ার মতো দুঃখী ও ত্যাগী বাণিজ্যিক মতিঝিল।
ষাটের দশকে মতিঝিলে গড়ে ওঠে দেশের কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চল (সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট-সিবিডি)। সেই থেকে এখনো দেশের প্রধান বাণিজ্যিক অঞ্চল মতিঝিল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা ৬১। এর মধ্যে সরকারি ৮টি, বেসরকারি ৪৫টি এবং বিদেশি ব্যাংক রয়েছে ৮টি। এ ছাড়া ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ৮১টি বীমা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্ধেকের বেশির প্রধান কার্যালয় চলে গেছে কারওয়ান বাজার, গুলশান-বনানী ও উত্তরায়। নতুন করে যেসব ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পাচ্ছে, সেগুলোর প্রধান কার্যালয় মতিঝিলের বাইরে করা হচ্ছে।
জানা গেছে, মতিঝিলের আশপাশে পরিকল্পিত কোনো আবাসিক এলাকা, অভিজাত হোটেল, কাজের ফাঁকে অবসর কাটানোর মতো উন্মুক্ত স্থান, শপিং কমপ্লেক্স না থাকায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজের সুবিধার জন্য অন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান কার্যালয়গুলোও মতিঝিলের বাইরের এলাকা, অর্থাৎ কারওয়ান বাজার, গুলশান অ্যাভিনিউ, কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউতে গড়ে উঠছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দৈনিক বাংলা, শাপলা চত্বর, মধুমিতা সিনেমা হল এবং ইত্তেফাক মোড় পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে এবং দিলকুশা, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ভবন এবং বঙ্গভবনের পাশের এলাকাজুড়ে মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চল। বিশ্বের বাণিজ্যিক অঞ্চলের ভবনগুলো সুউচ্চ হয়ে থাকে। কিন্তু মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চলের পাশেই বঙ্গভবন। নিরাপত্তার কারণে বঙ্গভবনের ৫০০ মিটার পরিধির ভেতর কোনো বহুতল ভবন করতে দেওয়া হচ্ছে না। যদিও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, মতিঝিলের প্লটগুলোর ‘নন-রেসট্রিকটেড’ উচ্চতা দেওয়া রয়েছে। কিন্তু বঙ্গভবনের ৫০০ মিটার পরিধির ভেতর সাড়ে চারতলার বেশি উচ্চতার ভবনের অনুমোদন মেলে না। ফলে মূল্যবান ওই প্লটগুলোর সঠিক ব্যবহার করতে পারছেন না মালিকরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার স্থাপনাগুলোর বেশিরভাগ জরাজীর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণও রয়েছে কয়েকটি ভবন। একটির সঙ্গে অন্যটি লাগানো। দুটি ভবনের মাঝখানে উন্মুক্ত জায়গা নেই বেশিরভাগ ভবনের। দিলকুশা এলাকার বঙ্গভবন লাগানো ভবনগুলোর মাঝখানেও কোনো ফাঁকা জায়গা দেখা যায় না।
সরেজমিনে আরও দেখা গেছে, মতিঝিল এলাকার ফুটপাতগুলো হকারদের দখলে। ভাঙাচোরা এবড়োখেবড়ো সড়ক। সড়ক বিভাজকগুলো শ্রীহীন। এগুলোতে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ হয়নি। প্রধান সড়ক থেকে একটু ভেতরে গেলে মতিঝিলের আরও করুণ দশা চোখে পড়ে। দেশের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকার সড়কের ফুটপাতে গড়ে উঠেছে চটের ছালা দিয়ে ঘেরা খাবারের হোটেল, চায়ের দোকান এবং নানা পণ্যের অস্থায়ী দোকান। সামান্য বৃষ্টিতে মতিঝিল এলাকার সড়কগুলো তলিয়ে থাকে পানির নিচে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চলটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৯ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাভুক্ত। ডিএসসিসি এলাকার জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ চলছে। খসড়া মাস্টারপ্ল্যানে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দাবি করেছে, কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চল হিসেবে মূল্যায়ন করলে মতিঝিল ইতিমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে। যদিও এটা মানতে নারাজ ডিএসসিসির কারিগরি কমিটি।
মতিঝিল এলাকার বেহাল অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় কাউন্সিলর মো. মোজাম্মেল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, মতিঝিল এলাকার সংস্কার ও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে কাজ করছে ডিএসসিসি। পরিত্যক্ত প্রায় ১০ কাঠা জায়গার ওপর একটি পার্ক তৈরি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে পার্কটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, মতিঝিলের সড়ক, নর্দমা, ফুটপাত ও সড়ক বিভাজকের অনেক সমস্যা রয়েছে। সেগুলোর সংস্কার ও আধুনিকায়ন করা দরকার। পর্যায়ক্রমে এ এলাকার বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে কাজ করবে ডিএসসিসি। তবে মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চলের মূল সংস্কার ও আধুনিকায়নের দায়িত্ব রাজউকের। রাজউককে সেসব বিষয় পরিকল্পনা করে বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব কাজে সিটি করপোরেশনের সহযোগিতা লাগলে করপোরেশন সব ধরনের সহযোগিতা করবে।
মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে তোলে রাজউক। রাজউক সূত্রে জানা যায়, ষাটের দশক থেকেই মতিঝিলের পুরোপুরি বাণিজ্যিক বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত। বিশে^র উন্নত দেশগুলোর বাণিজ্যিক অঞ্চলে শপিং মল, হোটেল, উন্মুক্ত স্থান থাকে। আর কাছাকাছি এলাকায় পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা থাকে। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার ক্ষেত্রে সেটা ছিল না। অভিজাত মানের হোটেল পূর্বাণী গড়ে উঠলেও আশপাশে সময় কাটানোর মতো ব্যবস্থা নেই। সে কারণে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দেশ-বিদেশ থেকে আসা লোকজন গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় থাকেন। মতিঝিলের সৌন্দর্য নিশ্চিত করতে ও আধুনিকায়নে যেসব বিষয়ে দৃষ্টি রাখা দরকার ছিল রাজউক ও সিটি করপোরেশন সেটা করেনি।
রাজউক সূত্রে আরও জানা যায়, ঢাকার অভিজাত আবাসিক এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধরা, উত্তরা। সেই সব এলাকা থেকে মানুষ মতিঝিলে আসেন। শহরের জনসংখ্যা বাড়ায় দিন দিন যানজট বাড়ছে। ওই সব এলাকা থেকে মতিঝিলে আসতে সড়কে এক থেকে দেড় ঘণ্টা চলে যায়। দৈনিক ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা কর্মঘণ্টার মধ্যে ৩০ শতাংশ সময় সড়কে নষ্ট হচ্ছে। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে চিন্তা করেছে, তার কর্মস্থল এমন একটা জায়গায় হবে যা তার আবাসনের কাছাকাছি। মতিঝিল থেকে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অন্যত্র সরে যাওয়ার ক্ষেত্রে এসব বিষয়ও ভূমিকা রেখেছে।
কালের বিবর্তনে গুলশান হয়ে উঠেছে বাণিজ্যিক এলাকা। কারওয়ান বাজার, উত্তরায়ও গেছে কিছু। এসব জায়গায় ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক কার্যক্রমও সেখানে চলে গেছে। এসব এলাকার আশপাশে গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় তাদের বসবাস। আবাসিক এলাকা ছাড়া, পৃথিবীর কোথাও শতভাগ জায়গা শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা অথবা একই শ্রেণির কর্মকান্ডের জন্য ব্যবহার হয় না।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও মুখপাত্র মো. আশরাফুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, নগর পরিকল্পনায় ভূমির ব্যবহার সম্পর্কে বলা হয়, যেকোনো জায়গার ব্যবহার হবে ২৪ ঘণ্টা। দেশের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল কর্মচঞ্চল থাকে মাত্র ১২ ঘণ্টা। এরপর ওই জায়গার ব্যবহার হয় না। রাতে নীরব ও ভুতুড়ে এলাকায় পরিণত হয়।
তিনি বলেন, যে মতিঝিলে দিনের বেলায় হাঁটা যায় না; গাড়ির কারণে, যানজটে; সেই মতিঝিলে রাত ৮টার পরে আবার একাও হাঁটা যায় না; অনিরাপদ বোধ হয়। এ জন্য যারা দিনে বাণিজ্য করতে আসেন, তারা মতিঝিল এলাকার হোটেলগুলোতে থাকেন না। অন্যদিকে গুলশান-বনানী এলাকায় থাকলে তারা শপিংয়ে যেতে পারেন, কফি শপে যেতে পারেন। এসব কারণে সারা বিশ্বে ভূমির মিশ্র ব্যবহারকে উৎসাহিত করেছে।
আশরাফুল ইসলাম বলেন, মতিঝিল এলাকা যেহেতু ইতিমধ্যে তার আভিজাত্য হারিয়ে ফেলেছে, এ জন্য মতিঝিলের জমির শ্রেণিকে মিশ্র ব্যবহার হিসেবে ঢেলে সাজানোর প্রস্তুতি নিয়েছে রাজউক। সংশোধিত ড্যাপে সে বিষয়ে নির্দেশনা রাখা হয়েছে। পৃথিবীর নগর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ৫০, ৬০ বা ১০০ বছর অন্তর সেসব ঢেলে সাজানো হয়। সেটা বিবেচনায় নিয়েই মতিঝিল এলাকাকেও ঢেলে সাজাতে হবে। এখানে আবাসিকের বৈশিষ্ট্য দিতে হবে; কনডোমিনিয়াম গড়ে তুলতে হবে। ইতিমধ্যে রাজউক বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনে ১৬ একর জায়গা নিয়ে একটি পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। সেখানে লাইব্রেরি, ওয়াকওয়ে থাকবে। বসার ব্যবস্থা থাকবে। মতিঝিল এলাকায় ঝিল ছিল, ওই ঝিলকে প্রাধান্য দিয়ে পার্কটি তৈরি করা হবে। বহুমুখী ব্যবহার ছাড়া মতিঝিলকে আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, মতিঝিলের আধুনিকায়ন ও ভূমির মিশ্র ব্যবহারে বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে। তাহলে মতিঝিল সচল থাকবে; তবে ঢাকা শহর বড় হওয়ায় আরও বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে ওঠা ইতিবাচক। এসব পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা দরকার ছিল; কিন্তু ঢাকার ক্ষেত্রে সে রকম হয়নি। এটা দুঃখজনক। এ জন্য শহরে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ঢাকায় এখন অনেকগুলো বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সেই সব অঞ্চলে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় স্থাপনের অনুমোদন দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত বড় বড় ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় মতিঝিলে রয়েছে। তবে ব্যবসা গুলশান, বনানী, উত্তরা, গাজীপুরে সরে যাওয়ায় ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানও ব্যবসা কেন্দ্রের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে।
উত্তরাধিকার সূত্রে বা পারিবারিক পরিচয়ে রাজনীতির চর্চা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এ উপমহাদেশে। বাবার সূত্রে কিংবা দাদার সূত্রে রাজনীতিতে এসে অনেকে পূর্বসূরিকে ছাড়িয়ে গেছেন। আদর্শের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে নিজেদের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। রাজনীতিতে হয়েছেন বটবৃক্ষ। আবার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকলেও উত্তরাধিকার সূত্রে পদ-পদবি পেয়ে যাওয়ার উদাহরণও আছে। যারা এভাবে রাজনীতিতে এসেছেন, তারা কার্যত বনসাই হয়ে আছেন।
দেশের সবচেয়ে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগ, স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ প্রায় সব দলেই উত্তরাধিকারের চর্চা রয়েছে। পারিবারিক সূত্রে এমপি হওয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান একাদশ সংসদে এ সংখ্যা ৯৮। স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহ জাগায় যে, আগামী দ্বাদশ সংসদে এ সংখ্যা কত হবে? যদিও বর্তমান সংসদের ৩৪টি উপনির্বাচনে উত্তরাধিকার সূত্রে এমপি হয়েছেন কমই।
রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের চর্চা যে খারাপ সেটা মোটেও বলা যাবে না। বরং উত্তরাধিকারের কারণে দেশের জন্য, জনগণের জন্য অবদান রাখা ঐতিহ্যবাহী দল আরও শক্তিশালী হওয়ার উজ্জ্বল উদাহরণও আছে। যেমন ভারতের রাজনীতিতে ইন্দিরা গান্ধী। বাবা নেহরু গান্ধীর উত্তরসূরি হলেও নিজের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে কংগ্রেসের রাজনীতিকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছেন। তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত ও আদর্শের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। টানা তিনবারসহ চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে পঁচাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান ঘটেছে। আরও শক্তিশালী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরেছে।
বিএনপির ক্ষেত্রেও বলা যায়, দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দলটির হাল ধরেন তার স্ত্রী খালেদা জিয়া। তাদের ছেলে তারেক রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
সংসদের ৩০০ আসনে উত্তরসূরি হিসেবে বা পারিবারিক পরিচয়ে মনোনয়ন পাওয়ার পাশাপাশি সংরক্ষিত ৫০ আসনেও এই চর্চা আছে। বরং হিসাব করলে বেশিই দেখা যায়।
সব মিলিয়ে একাদশ সংসদেই উত্তরসূরি বা পারিবারিক পরিচয়ে এমপি রয়েছেন শতাধিক। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৫৭টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে। পারিবারিক সূত্রে রাজনীতিতে আসা সরকারি দলের এমপির সংখ্যা ৮৬। এর মধ্যে প্রায় ৭০ জনই মাঠের রাজনীতি করে আসেননি। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ২৯ জনের মধ্যে এই সংখ্যা ৭। এ ছাড়া সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন নেসা খান সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিজে ও তার স্ত্রী বেগম আফরোজা হকও এমপি।
একাদশ সংসদে বিএনপির সাতটি আসন ছিল। এর মধ্যে একটি সংরক্ষিত নারী আসন। তাদের মধ্যে রুমিন ফারহানা সংরক্ষিত আসনে এমপি হন। তার বাবা অলি আহাদ আওয়ামী লীগের প্রথম প্রচার সম্পাদক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বা সংশ্লিষ্ট এলাকায় দলের প্রভাব ধরে রাখতে নেতার পরিবারের সদস্যদের রাজনীতিতে আনা হয়। আবার অনেক সময় যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে না ওঠায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
তবে উত্তরাধিকার চর্চার প্রভাব নিয়ে সতর্ক করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এমন চর্চার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতির ভারসাম্য নষ্ট হয়। সংসদে দেখা যায়, অনেকে বক্তব্য দিতে পারেন না। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিও বোঝেন না। আবার জনসমাবেশে অরাজনৈতিক আচরণ করেন, যা সরকার বা দলকে বেকায়দায় ফেলে দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘উত্তরাধিকারের রাজনীতি গণতন্ত্র ও আধুনিক রাজনীতির বিরোধী। দলের জন্য ও রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর।’ তিনি বলেন, ‘গত ১৫-২০ বছরে এ ধারার রাজনীতির চর্চা বেশি হচ্ছে বলেই দুর্বল হয়েছে রাজনীতি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘রাজনৈতিক ত্যাগ-তিতিক্ষা বা যোগ্যতা থাকলে এটা গ্রহণ করা যায়। উত্তরাধিকার সূত্রে সংসদে এত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা অবশ্যই দুশ্চিন্তার। আমি মনে করি, এ সংখ্যা নিয়ে প্রত্যেক দলেরই চিন্তার ব্যাপার আছে। কারণ দাদা, বাবার যোগ্যতায় এসব পদ পেয়ে থাকলে গণতন্ত্র কতটা মজবুত করবে, সেটাও ভাবতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রজাতন্ত্রে উত্তরাধিকারের সুযোগ নেই। আবার এটাকে ধর্মগ্রন্থের বাণী মনে করলেও চলবে না। কারও যদি যোগ্যতা থেকে থাকে, তাহলে বাবা-দাদা থাকলে আসতে পারবেন না সেটাও তো হতে পারে না।’
আওয়ামী লীগের যারা : এমপি ও মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন পঞ্চগড় থেকে নির্বাচিত। তার বড় ভাই সিরাজুল ইসলাম ১৯৭০, ’৭৩, ’৭৯ ও ’৮৬ সালের এমপি। দিনাজপুর থেকে নির্বাচিত খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর বাবা প্রয়াত আবদুর রউফ চৌধুরী। তিনি ১৯৯৬ সালের এমপি ও দলের নেতা ছিলেন। ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। খালিদ মাহমুদ চৌধুরীও বর্তমানে প্রতিমন্ত্রী। তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে উঠে আসা। এ ছাড়া তিনবার দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
দিনাজপুরের আরেকটি আসন থেকে নির্বাচিত ইকবালুর রহিমের বাবা প্রয়াত আবদুর রহিম। তিনি সত্তরের এমপি ছিলেন। তবে ইকবালুর রহিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দিনাজপুরের আরেকটি আসনের এমপি শিবলী সাদিক। তার বাবা মোস্তাফিজুর রহমান ফিজুও এমপি ছিলেন।
রংপুর-২ আসনের আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরীর চাচা আনিসুল হক চৌধুরী এমপি ছিলেন। গাইবান্ধা-২ আসনের মাহাবুব আরা গিনি পারিবারিক বিবেচনায় এমপি হয়েছেন। বগুড়া-১ আসনের সাহাদারা মান্নান প্রয়াত এমপি আবদুল মান্নানের স্ত্রী। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল ১৯৭৩ সালের এমপি প্রয়াত মইন উদ্দীন আহমদের ছেলে। নওগাঁ-৫ আসনের নিজাম উদ্দিন জলিলের (জন) বাবা প্রয়াত আবদুল জলিল ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী। সিরাজগঞ্জ-১ আসনের তানভীর শাকিল জয় প্রয়াত মন্ত্রী ও নেতা মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে। তার দাদা জাতীয় চার নেতার অন্যতম মনসুর আলী। সিরাজগঞ্জ-২ আসনের ডা. হাবিবে মিল্লাত সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের মেয়ের জামাই। সিরাজগঞ্জ-৪ আসনের তানভীর ইমাম প্রয়াত নেতা এইচ টি ইমামের ছেলে। সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের মেরিনা জাহান দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য প্রয়াত মযহারুল ইসলামের মেয়ে। তার ভাই চয়ন ইসলামও এমপি ছিলেন। পাবনা-২ আসনের আহমেদ ফিরোজ কবির প্রয়াত আহমেদ তফিজ উদ্দিনের ছেলে। তিনি ১৯৭৩ ও ’৯৬ সালের এমপি ছিলেন। মেহেরপুর-১ আসনের ফরহাদ হোসেনের বাবা প্রয়াত মোহাম্মদ সহিউদ্দিন ছিলেন ১৯৭০, ’৭৩ ও ’৮৬ সালের এমপি। কুষ্টিয়া-৪ আসনের এমপি সেলিম আলতাফ জর্জের দাদা গোলাম কিবরিয়া ছিলেন এমপি। ঝিনাইদহ-২ আসনের তাহজীব আলম সিদ্দিকীর বাবা প্রয়াত নুরে আলম সিদ্দিকী ছিলেন দলের নেতা। ঝিনাইদহ-৩ আসনের এমপি শফিকুল আজম খান। তার বাবা প্রয়াত শামসুল হুদা জাতীয় পার্টির এমপি ছিলেন। যশোর-৫ আসনের স্বপন ভট্টাচার্যের ভাই পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য দলের নেতা। অবশ্য রাজনীতিতে স্বপনেরও অবদান রয়েছে। রংপুর-৬ আসন থেকে নির্বাচিত স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর বাবা প্রয়াত রফিকুল্লাহ চৌধুরী ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন। মাগুরা-১ আসনের এমপি সাইফুজ্জামান শিখর। তার বাবা মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান তিনবারের এমপি ছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতা শেখ হেলালের ছেলে শেখ ফারহান নাসের তন্ময় বাগেরহাট-২ আসনের এমপি। বাগেরহাট-৩ আসনের হাবিবুন নাহার খুলনার মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের স্ত্রী। খুলনা-২ আসনের শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল শেখ নাসেরের ছেলে। খুলনা-৩ আসনের মন্নুজান সুফিয়ানের স্বামী আবু সুফিয়ান এ আসনের এমপি ছিলেন। তিনি নিজেও অবশ্য রাজনীতি করেছেন। ভোলা-২ আসনের আলী আজম মুকুল দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদের ভাতিজা। ভোলা-৪ আসনের আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের বাবা প্রয়াত এমএম নজরুল ইসলাম ১৯৭৯ ও ’৯১ সালের এমপি। টাঙ্গাইল-৬ আসনের আহসানুল ইসলাম সাবেক এমপি হাজি মকবুল আহমেদের ছেলে। টাঙ্গাইলের আরেক আসনের এমপি খান আহমেদ শুভ দলের জেলা সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুকের ছেলে। ফারুক ১৯৭৩ সালে এমপি ছিলেন। ময়মনসিংহ-১ আসনের জুয়েল আরেং সাবেক প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিনের ছেলে। ময়মনসিংহ-২ আসনের শরীফ আহমেদের বাবা শামসুল হক চারবারের এমপি। ময়মনসিংহ-১০ আসনের ফাহমী গোলন্দাজ বাবেলের বাবা প্রয়াত এমপি আলতাফ হোসেন গোলন্দাজ। নেত্রকোনার এমপি সাজ্জাদ হাসানের বাবা প্রয়াত আখলাকুল হোসাইন আহমেদ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। কিশোরগঞ্জ-১ আসনের সৈয়দা জাকিয়া নূর চার জাতীয় নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের মেয়ে ও দলের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বোন। কিশোরগঞ্জের আরেক এমপি রেজওয়ান আহম্মেদ তৌফিক সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ছেলে। অন্য এমপি নাজমুল হাসান পাপনের বাবা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুুর রহমান। তার মা মহিলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আইভি রহমান। মানিকগঞ্জের নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের বাবা প্রয়াত সায়েদুর রহমান এমপি ছিলেন। ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে নির্বাচিত নসরুল হামিদের বাবা হামিদুর রহমান দলের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। মা হাসনা হামিদও রাজনীতি করতেন। গাজীপুরের জাহিদ আহসান রাসেল প্রয়াত নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে। সিমিন হোসেন রিমি প্রয়াত জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে। মেহের আফরোজ চুমকির বাবা প্রয়াত ময়েজউদ্দিন ১৯৭০ ও ’৭৩ সালের এমপি। কাজী কেরামত আলীর বাবা কাজী হেদায়েত হোসেন গণপরিষদ সদস্য ছিলেন। মুজিবুর রহমান চৌধুরীর (নিক্সন) বাবা ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধু পরিবারের আত্মীয়। তার আরেক ছেলে নূর-ই-আলম চৌধুরীও এমপি। ফরিদপুর-৩ আসনের ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন আত্মীয় পরিচয়ে এমপি হন। ফরিদপুরের আরেকটি আসনের এমপি শাহদাব আকবরের মা প্রয়াত এমপি দলের নেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। নাহিম রাজ্জাকের বাবা প্রয়াত নেতা ও এমপি আবদুর রাজ্জাক। জয়া সেনগুপ্তা প্রয়াত এমপি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী। এ কে আবদুল মোমেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ভাই। গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজের (মিলাদ গাজী) বাবা প্রয়াত এমপি দেওয়ান ফরিদ গাজী। মাহবুব আলীর বাবা আছাদ আলী প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। আনিসুল হকের বাবা প্রয়াত সিরাজুল হক ১৯৭০ সালের এমপি ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা। রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের বাবা এএফএম ফখরুল ইসলাম মুন্সী ছিলেন জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের এমপি। দীপু মনির বাবা প্রয়াত এমএ ওয়াদুদ ছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। আয়েশা ফেরদাউসের স্বামী প্রয়াত এমপি মোহাম্মদ আলী। মাহফুজুর রহমানের বাবা মুস্তাফিজুর রহমান ১৯৯১ ও ’৯৬ সালের এমপি ছিলেন। এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর বাবা প্রয়াত ফজলুল কবির চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। মহিবুল হাসান চৌধুরীর বাবা চট্টগ্রামের প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বাবা প্রয়াত এমপি আখতারুজ্জামান চৌধুরী। সাইমুম সরওয়ার কমলের বাবা প্রয়াত ওসমান সরওয়ার চৌধুরী ছিলেন ১৯৭৩ সালের এমপি। শাহিনা আক্তার চৌধুরীর স্বামী সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি। শিরীন আহমেদের স্বামী প্রয়াত বজলুর রহমান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। নাহিদ ইজাহার খানের বাবা খন্দকার নাজমুল হুদা পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর নিহত সেনা কর্মকর্তা। খাদিজাতুল আনোয়ারের বাবা প্রয়াত এমপি রফিকুল আনোয়ার। ওয়াসিকা আয়শা খানের বাবা প্রয়াত আতাউর রহমান খান কায়সার দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ছিলেন। কানিজ ফাতেমা আহমেদের স্বামী মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী আওয়ামী লীগ নেতা। আঞ্জুম সুলতানা সীমার বাবা কুমিল্লার প্রয়াত নেতা আফজল খান। উম্মে ফাতেমা নাজমা বেগমের (শিউলী আজাদ) স্বামী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ইকবাল আজাদ। রুমানা আলীর বাবা প্রয়াত এমপি রহমত আলী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের এমপি বদরুদ্দোজা মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম। তার মামা খালেদ মোশাররফ। পারিবারিক পরিচয়ে এমপি হলেও সংগ্রাম এমপি হওয়ার আগে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। সুলতানা নাদিরার স্বামী প্রয়াত নেতা গোলাম সবুর টুলু। হাবিবা রহমান খান শেফালীর বাবা প্রয়াত ফজলুর রহমান খান তিনবারের এমপি ছিলেন। জাকিয়া পারভীন খানমের বাবা সাবেক এমপি মোস্তাফিজুর রহমান খান চুন্নু মিয়া। তার স্বামী আওয়ামী আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন। অপরাজিতা হকের বাবা প্রয়াত খন্দকার আসাদুজ্জামান ছিলেন তিনবারের এমপি। তামান্না নুসরাত বুবলীর স্বামী প্রয়াত লোকমান হোসেন ছিলেন নরসিংদীর মেয়র। জাকিয়া তাবাসসুমের বাবা প্রয়াত আজিজুর রহমান দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। ফরিদা খানম নারী মুক্তিযোদ্ধা। তার স্বামী নোয়াখালী জেলা মুজিব বাহিনী প্রধান মাহমুদুর রহমান বেলায়েত। রাজবাড়ীর সালমা চৌধুরীর বাবা প্রয়াত আবদুল ওয়াজেদ চৌধুরী ছিলেন এমপি। সৈয়দা রাশিদা বেগমের স্বামী কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত সৈয়দ নিজাম উদ্দিন লাইট। ফেরদৌসী ইসলাম জেসীর বাবা প্রয়াত ভাষাসৈনিক ও সংসদ সদস্য আ আ ম মেসবাহুল হক বাচ্চু। পারভীন হক সিকদারের বাবা প্রয়াত ব্যবসায়ী জয়নুল হক সিকদার। জামালপুরের আবুল কালাম আজাদ শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ভায়রা। এ ছাড়া শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ হেলাল উদ্দীন, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও শামীম ওসমানের পারিবারিক পরিচয় থাকলেও তারা এখন প্রত্যেকে রাজনীতিতে স্বনামে প্রতিষ্ঠিত।
জাতীয় পার্টি : বিরোধী দলনেতা রওশন এরশাদ প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী। তাদের ছেলে সাদ এরশাদও এমপি। আহসান আদেলুর রহমান প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এরশাদ ও দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের ভাগ্নে। জিএম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরও এমপি। নীলফামারী-৪ আসনে আদেলুর রহমান আদেল, তার বাবা ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টি থেকে এমপি ছিলেন। নাসরীন জাহান রত্না দলের কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদারের স্ত্রী। আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের ভাই নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি সেলিম ওসমান।
অন্যান্য : ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন নেসা খান সংরক্ষিত নারীর আসনে এমপি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিজে ও তার স্ত্রী বেগম আফরোজা হকও এমপি। মাহী বি চৌধুরীর বাবা সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সেলিনা ইসলামের স্বামী পদচ্যুত এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল।
সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে ৫টি রোডমার্চসহ টানা ১৫ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত কর্মসূচি পালন করবে দলটি। তবে মাঝে তিন দিন ২০, ২৪ ও ২৮ সেপ্টেম্বর কোনো কর্মসূচি নেই। বিএনপির নতুন ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমাবেশ, রোডমার্চ ও দোয়া মাহফিল।
গতকাল সোমবার দুপুরে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বাতিল, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আমরা আন্দোলন শুরু করেছি। আমাদের অনেক রাজনৈতিক জোট ও দল যুগপৎ আন্দোলন সফল করার লক্ষ্যে আমরা কতগুলো কর্মসূচি হাতে নিয়েছি।
কর্মসূচি ঘোষণার সময় অসুস্থতার কারণে মহাসচিবের অনুরোধে সেটি পড়ে শোনান স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
পাঁচটি রোডমার্চ : ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব থেকে সিলেট (সিলেট বিভাগ), ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল থেকে পটুয়াখালী (বরিশাল বিভাগ), ২৬ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগ, ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ (ময়মনসিংহ বিভাগ) এবং ৩ অক্টোবর কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম (কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম বিভাগ) রোডমার্চ অনুষ্ঠিত হবে।
ঢাকায় হবে সমাবেশ : ১৯ সেপ্টেম্বর জিঞ্জিরা/কেরানীগঞ্জ, গাজীপুরের টঙ্গী; ২২ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী, উত্তরা; ২৫ সেপ্টেম্বর নয়াবাজার, আমিনবাজার; ২৭ সেপ্টেম্বর গাবতলী এবং নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়। ঢাকায় ২৯ সেপ্টেম্বর মহিলা সমাবেশ, ৩০ সেপ্টেম্বর শ্রমজীবী সমাবেশ এবং ২ অক্টোবর কৃষক সমাবেশ হবে। এসব কর্মসূচিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।
তবে ২০, ২৪ ও ২৮ সেপ্টেম্বর বিএনপির কোনো কর্মসূচি না থাকলেও যুগপৎ আন্দোলনের অংশীজনদের কর্মসূচি রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, ‘আমাদের যুগপৎ আন্দোলনে যে জোট ও দলগুলো আছে, তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থান থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করবে। তারা হয়তো সবগুলো করবে না।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় নেতা খায়রুল কবির খোকন, ফজলুল হক মিলন, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকাকেন্দ্রিক সমাবেশ-পদযাত্রার কর্মসূচি গণতন্ত্র মঞ্চের : এদিকে গতকাল দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের দারুস সালাম ভবনে ভাসানী অনুসারী পরিষদের কেন্দ্রীয় দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে কর্মসূচি ঘোষণা করে গণতন্ত্র মঞ্চ। নতুন এই কর্মসূচি হচ্ছে ১৯ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা; ২৩ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকার কারওয়ান বাজারে পেট্রোবাংলার সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা; ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা এবং ২৭ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা।
সংবাদ সম্মেলনে গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম জোটের পক্ষে লিখিত বক্তব্যে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচির বাইরে জোটের নিজস্ব কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। তারা বলছে, গণতন্ত্র মঞ্চের উদ্যোগে সেমিনার ও আলোচনা সভাও হবে। সেসবের তারিখ-স্থানসহ বিস্তারিত পরে জানানো হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম।
গণফোরাম ও বাংলাদেশ পিপলস পার্টির কর্মসূচি: ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা জেলা জিঞ্জিরা/কেরানীগঞ্জ এবং গাজীপুর জেলার টঙ্গীতে, ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-হবিগঞ্জ-মৌলভীবাজার-সিলেট রোডমার্চ, ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পেশাজীবী সমাবেশ, ২৩ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী ও উত্তরায় সমাবেশ, ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল-ঝালকাঠি-পিরোজপুর-পটুয়াখালী রোডমার্চ, ২৫ সেপ্টেম্বর নয়াবাজার ও ঢাকা জেলার আমিনবাজারে সমাবেশ, ২৬ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগ রোডমার্চ, ২৭ সেপ্টেম্বর গাবতলী ও নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লায় জনসমাবেশ, ঢাকায় ২৯ সেপ্টেম্বর মহিলা সমাবেশ ও ৩০ সেপ্টেম্বর কৃষক-শ্রমিক সমাবেশ, ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ রোডমার্চ, ৩ অক্টোবর কুমিল্লা-ফেনী-মিরসরাই-চট্টগ্রাম রোডমার্চের কর্মসূচি ঘোষণা করেন দলটির নেতারা। এ ছাড়া আইনজীবীদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে এবং আন্দোলনরত সব দল সমর্থন জানাবে বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় দলটি।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৪০-৫০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতির অঙ্ক কষছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটি মনে করছে, সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ৪০ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রমুখী করতে পারলে নির্বাচন বিতর্ক সামাল দিতে কোনো বেগ পেতে হবে না।
আগামী নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেওয়া নানা পরিকল্পনার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা হলো ভোটের দিন কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। এ ছাড়া জনআকাক্সক্ষা পূরণ ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে নির্বাচন নিয়ে জনমত আওয়ামী লীগের পক্ষেই থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর আওয়ামী লীগ এ তিন পরিকল্পনাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে দলের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান।
চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করেন। এর আগে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল সফর করে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের পর আওয়ামী লীগে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে বলে দাবি করছেন দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা।
তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিগত দুই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি আওয়ামী লীগ তথা সরকারকে দেশ-বিদেশে বেশ বিপাকে ফেলেছিল। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চায় না সরকারি দল। সেজন্য আগে থেকেই আটঘাট বেঁধে নামতে চায় ক্ষমতাসীনরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে না ধরেই কমপক্ষে ৪০ ভাগ ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয়ে যাবে। সেই নির্বাচনে এ সংখ্যক ভোটার ভোট দিতে কেন্দ্রে এলে ভোটের পরে ভোট প্রশ্নবিদ্ধ করার যে চক্রান্ত বিএনপির রয়েছে, সেটি ব্যর্থ হয়ে যাবে। এমন লক্ষ্য নির্ধারণ করার অন্যতম কারণ হলো এটি।
সরকারের ওপর অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের চাপ রয়েছে বিদেশিদের। গত আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন থেকে ফেরার পর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জনগণ ভোট দিতে পারলেই সেটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, ৫০-৪০ শতাংশ ভোট কাস্টিং করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে আওয়ামী লীগ। তা সম্ভব হলেই ভোট বিতর্ক এড়ানো যাবে। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের পরে সব নির্বাচনেই ভোটার উপস্থিতি হতাশাজনক ছিল। এ বিষয়টি নিয়ে নানা সমালোচনা ও প্রশ্ন উঠেছে। কোনো কোনো ফোরামে আলোচনায় সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে কম ভোটার উপস্থিতির উদাহরণ। তাই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্য নির্ধারণ করে নির্বাচন প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ।
দলের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে আসবে না এটা ধরে নিয়েই তিন পরিকল্পনায় সফল হতে পারবেন তারা। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর শেষে আওয়ামী লীগ মনে করে নির্বাচন পর্যন্ত জনআকাক্সক্ষা পূরণ ও দ্রব্যমূল্য বেঁধে রাখা পারলেই নির্বাচন পর্যন্ত আর সমস্যাগুলো বড় বাধা হয়ে আসবে না সরকারের সামনে। বাকিটা হলো ভোটের দিন লক্ষ্য অনুযায়ী ভোটার উপস্থিতি ঘটানো।
ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা আরও বলেন, ভোটার উপস্থিতি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তেমন আধুনিক উদ্যোগ নেই। কম ভোট উপস্থিতির এটিও একটি কারণ। প্রত্যেক ভোটারকে ভোট দিতে কেন্দ্রে আসতে হবে এমনকি পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে, সেটি ইসিকে ভাবতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোও কেন্দ্রে ভোটার আনতে যথাযথ দায়িত্ব পালন করেন না। এ নির্বাচনে ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করতে কী কী উপায় নেওয়া যেতে পারে তা নিয়ে গবেষণা চলছে। ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, স্বল্প সময়ে যে বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা যায়, সেগুলো আগামী নির্বাচনে করা হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মানুষের কর্মব্যস্ততা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। কর্মব্যস্ত জীবনে সময় পেলে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার চেয়ে পরিবারকে একটু সময় দেওয়াকে বেশি গুরুত্বের মনে করেন ভোটাররা।’ ভোট দেওয়ার প্রবণতা পৃথিবীর অনেক দেশেই কমেছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে একটি দল নির্বাচনে না যাওয়ায় নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে মনে করে না ভোটাররা। ফলে নির্বাচন বর্জন করা দলের ভোটাররা কেন্দ্রে যান না এবং দলের প্রার্থী বিজয়ী হবেন এ ভেবে আওয়ামী লীগের ভোটাররাও যান না। গত নির্বাচনগুলোতে ভোট কম পড়ার বড় কারণ এগুলো। তবে আগামী নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, সেগুলো নিয়ে কাজ করছেন তারা। জাফরউল্যাহ আরও বলেন, ‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বেড়ে যাবে।’
আওয়ামী লীগের হিসাবে মোট ভোটারের প্রায় ৩৫ শতাংশই তাদের ভোটার। এবার দলীয় ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় দলটি।
সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ভোটার কেন্দ্রে আনার উদ্যোগ সফল হলে ভোট নিয়ে সব প্রশ্নই দূর করতে পারবে আওয়ামী লীগ। ২০১৪ ও ’১৮ সালের দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্নের মধ্যে কম ভোটার উপস্থিতিও অন্যতম। তারা চান না এবার সেই প্রশ্ন উঠুক।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ছোট ছোট কিছু জনআকাক্সক্ষা পূরণেও ঘাটতি রয়েছে। ফলে সরকার বড় বড় কাজ করছে ঠিকই, ছোট কিছু জনআকাক্সক্ষা পূরণ করা সম্ভব হয়নি বলে সাধারণ জনগণের একটি অংশ সরকারের প্রতি পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছে না, এমনটাই মনে করছেন তারা। তাই ভোটের আগে বাকি সময়ে ছোট বিষয়গুলো আমলে নিয়ে তা পূরণ করা হলে সাধারণ জনগণের ওই অংশটি আওয়ামী লীগের ওপরই আস্থা রাখবে বলে তারা বিশ্বাস করেন।
সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে বাড়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সব শ্রেণির মানুষকে। সংসার জীবনের কশাঘাতে পড়ে সরকারের অবিশ্বাস্য উন্নয়ন ওই শ্রেণির মানুষের কাছে তেমন গুরুত্ব বহন করে না। সংসার সামলাতে যে বিষয়গুলো বেশ বেগ পেতে হচ্ছে সেগুলোকে নির্বাচন পর্যন্ত কড়া মনিটরিংয়ে রেখে সামাল দেওয়া সম্ভব হলে মধ্যবিত্ত/নিম্নবিত্ত অংশের আস্থা অর্জন করতে পারবে বলে তারা মনে করছেন। আর আস্থা অর্জন করতে পারলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে বলে তাদের বিশ্বাস।
জনআকাক্সক্ষা পূরণের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে বারবার একই চেহারা দেখছেন এলাকার মানুষ। অন্যদিকে জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে প্রতিবারই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন নির্বাচিত ওই জনপ্রতিনিধি। তাতে মানুষ বিরক্ত হন। এলাকার ভোটাররা মনে করেন, একজনকে কতবার ভোট দেব? এটি হলো জনআকাক্সক্ষা। এ জায়গায় নতুন মুখ নিয়ে আসা সম্ভব হলে মানুষের মধ্যে নতুন করে আশা জাগবে। রাজনীতিতে সক্রিয় নন, এমন লোকজনও আগ্রহী হবেন। নতুন প্রার্থীকে ভোট দিতে কেন্দ্রে ভোটাররা আসবেন।
এদিকে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপি বিপাকে পড়েছে বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খুব ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়ে যাবে এ বিষয়টি বিএনপির কাছেও পরিষ্কার হয়ে গেছে। নির্বাচন সময়মতো হয়ে যাবে এটা এখন বিএনপিও বিশ্বাস করে। দলটি ভাবছে, আন্দোলন জমছে না, নির্বাচনও ঠেকানো যাবে না। আর সেটাই তাদের বিপাকের কারণ।’
রুবেলা বা জার্মান মিজেলস একটি সংক্রামক রোগ। এটি রুবেলাভাইরাস থেকে হয়ে থাকে। একে জার্মান হাম বা তিন দিনের হামও বলা হয়। এটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে একটি রোগ। করোনা ভাইরাসের মতই আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি থেকেই এই রোগ ছড়ায়। গর্ভাবস্থায় এই রোগ গর্ভস্থ শিশুর নানা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
রুবেলা সাধারণত ভাইরাসের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির ড্রপলেটসের মাধ্যমে বাতাসে ছড়ায় এবং পরবর্তীতে শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে দিয়ে আরেকজনকে আক্রান্ত করে। এ ছাড়া গর্ভবতী মা থেকে গর্ভস্থ সন্তানের রুবেলাভাইরাস হতে পারে।
তবে একবার এই রোগটি হয়ে গেলে সাধারণত স্থায়ীভাবে আর এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
রুবেলার লক্ষণ বোঝা করা কঠিন, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে। কারণ রোগের লক্ষণ প্রকাশের আগে ভাইরাসটি রোগীর দেহে সাত থেকে ২১ দিন পর্যন্ত সুপ্তাবস্থায় থাকতে পারে।
এই রোগের লক্ষণ এবং উপসর্গ সাধারণত ভাইরাসের আক্রান্ত হওয়ার দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে দেখা যায় এবং সাধারণত ১ থেকে ৫ দিন স্থায়ী হয়।
হালকা জ্বর ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৮.৯ C) বা তার কম
মাথাব্যথা
নাকে সর্দি বা বন্ধ নাক।
চোখ লাল হয়ে যাওয়া ও চুলকানি হওয়া।
মাথা ও ঘাড়ের পেছনের গ্রন্থি ফুলে যাওয়া এবং ব্যথা হওয়া, কানের পিছনের লিম্ফ নড পিণ্ডর মতো ফুলে যাওয়া
লাল বা গোলাপি ফুসকুড়ি যা মুখে শুরু হয় এবং দ্রুত ঘাড়, শরীর, বাহু ও পায়ে ছড়িয়ে পড়ে
জয়েন্টগুলোতে ব্যথা, বিশেষ করে তরুণীদের মধ্যে
হাঁচি-কাশি এবং নাক দিয়ে পানি পড়া
শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা
ক্ষুধা মন্দা, বমি বমি ভাব, দুর্বলতা
রুবেলাভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া যেতে পারে। এটি সাধারণত চিকিৎসা ছাড়াই ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়।
এমনকি গর্ভবতী নারী আক্রান্ত হলে মা বা শিশুর ও কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে গর্ভবতী নারী রুবেলা আক্রান্ত কারও সংস্পর্শে এলে তাকে ইমিউনোগ্লোবিউলিন দেওয়া যেতে পারে। তাই রুবেলাকে টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা খুব জরুরি।
তবে একবার আক্রান্ত হলে সে সময় যা যা করতে হবে,
১. যেহেতু রোগটি অনেক ছোঁয়াচে তাই আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলতে হবে।
২. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে এবং আক্রান্ত হলে কঠোর পরিশ্রমের কাজ না করাই ভালো
৩. সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে
৪. ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ যুক্ত ফলমূল খেতে হবে বেশি করে।
৫. প্রতিদিন গোসল করাতে হবে, শরীরে জ্বর থাকলে ভেজা কাপড় একটু পর পর শরীর মুছতে হবে।
৬. কোনও ওষুধ খাওয়ানোর আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে
কেউ যদি গর্ভাবস্থায় রুবেলায় আক্রান্ত হন তবে রুবেলা অনাগত শিশুর ক্ষতি করার পাশাপাশি গর্ভপাতের ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। এ ছাড়া শিশুর জন্মের পরে তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
হার্টের ত্রুটি
ছানি
বধিরতা
বিলম্বিত শেখা
লিভার এবং প্লীহার ক্ষতি
ডায়াবেটিস
থাইরয়েড সমস্যা
রুবেলার সুনির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা না থাকায় টিকা হলো উত্তম প্রতিষেধক। এই রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হল হাম-মাম্পস-রুবেলা (এমএমআর) টিকার দুই ডোজ টিকা প্রয়োগ। সব বয়সেই এই টিকা নেয়া যায়।
টিকার প্রথম ডোজটি সাধারণত শিশুর নয় থেকে ১৫ মাসের মধ্যে দেয়া হয় এবং দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয় শিশুর সাড়ে তিন থেকে ছয় বছর বয়সের মধ্যে। এছাড়া প্রাপ্তবয়স্করা এই টিকা নিতে পারেন। সাধারণত প্রথম ডোজ নেয়ার কমপক্ষে এক মাস থেকে তিন মাস পর দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়।
কিশোরীদের ১৫ বছর বয়সে টিটি টিকার সঙ্গে এক ডোজ হাম-রুবেলা টিকা দিতে হয়। এ ছাড়া গর্ভধারণে ইচ্ছুক নারীদের রুবেলা অ্যান্টিবডি টেস্ট করে প্রয়োজন হলে ৩ মাস ব্যবধানে ২ ডোজ টিকা দেওয়া হয় এবং দ্বিতীয় ডোজ টিকা পরবর্তী এক মাসের মধ্যে সন্তান নিতে নিষেধ করা হয়।
১. অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। কেউ হাঁচি-কাশি দিলে তার থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করতে হবে।
২. হাত সবসময় সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে পরিস্কার রাখতে হবে।
৩. নাকে, চোখে, মুখে হাত দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪. কাশি বা হাঁচি আসলে সে সময় টিস্যু ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যবহৃত টিস্যু ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হবে।
৫. যাদের শরীরে ফুসকুড়ি বা র্যাশ জাতীয় আছে তাদের সাথে শারীরিক যোগাযোগ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে।
৬. অতিরিক্ত ভীর বা জনসমাগম এলাকা এড়িয়ে চলতে হবে।