
সাংবাদিক ও লেখক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের জন্ম ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার খোশবাসপুরে ১৪ অক্টোবর ১৯৩০ সালে। প্রথম জীবনে বাড়ি থেকে পলাতক কিশোরের জীবন অতিবাহিত করেছেন। সেখানে গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। সেই নবগ্রাম গোপালপুরের প্রেক্ষাপটে তিনি লিখেছিলেন ‘প্রেমের প্রথম পাঠ’ উপন্যাস। গোপালপুর থেকে পাস করে তিনি ভর্তি হন বহরমপুর কলেজে। রাঢ় বাংলার লোকনাট্য আলকাপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নাচ-গান-অভিনয়ে অংশ নিয়ে জেলায় জেলায় ঘুরেছেন। তিনি ছিলেন আলকাপ দলের ওস্তাদ ও নাচ-গানের প্রশিক্ষক। দীর্ঘদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে চাকরি ও লেখালেখি চালিয়ে গেছেন। তার জ্ঞান ও অধীত বিদ্যা এবং প্রগতিশীল মুক্তচিন্তা তাকে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিদ্বানসমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার লেখকসত্তায় জড়িয়ে ছিল রাঢ়ের রুক্ষ মাটি। মুর্শিদাবাদের পাশের জেলা বীরভূম। যেখানে লাভপুর গ্রামে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম। তারাশঙ্কর বলতেন, ‘আমার পরেই সিরাজ, সিরাজই আমার পরে অধিষ্ঠান করবে’। তিনি গল্প, উপন্যাস, গোয়েন্দা কাহিনিসহ নানা ধরনের লেখা লিখেছেন। ‘অলীক মানুষ’ তার বিখ্যাত উপন্যাস। এ উপন্যাসটি তাকে খ্যাতির চূড়ান্ত শিখরে উন্নীত করেছে। কিশোর পাঠকদের জন্য লিখেছেন ‘গোয়েন্দা কর্নেল’ নামের চরিত্র। তিনি আনন্দ পুরস্কার, সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, বঙ্কিম পুরস্কার, ভুয়ালকা পুরস্কারসহ নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ২০১২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান।
জ্বালানি হলো সেসব পদার্থ, যাদের ভৌত বা রাসায়নিক গঠন বা অবস্থার পরিবর্তন ঘটলে শক্তির নিঃসরণ ঘটে। আর যেসব জ্বালানিতে এই শক্তি-নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেগুলো হলো ব্যবহারযোগ্য জ্বালানি। আধুনিক যুগে উন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে জালানির ভূমিকা অপরিহার্য। বর্তমানে জ্বালানি চাহিদার প্রায় ৮০ ভাগ পূরণ করে আসছে জীবাশ্ম জ্বালানি। এর মধ্যে প্রধান হলো পেট্রোলিয়াম, তেল, কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাস। আমরাও এসব জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর বেশির ভাগ নির্ভরশীল, তবে স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। এ জন্য আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানি করতে হচ্ছে। এই জীবাশ্ম-জ্বালানি নির্ভরতা এবং জ্বালানির আমদানি-নির্ভরতা দুটোই এখন আমাদের বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে, ভবিষ্যতেও এই অবস্থা ভিন্ন হবে তা ভাবার কোনো কারণ নেই; জ্বালানি নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন ও ভূরাজনীতি-পরস্পর পরস্পরকে জটিল করে ফেলছে।
বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বর্ধিত উন্নয়ন প্রচেষ্টার কারণে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে চলেছে। ফলে দিন দিন ভূমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধি ও পরিবেশ দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করছে। এখন বাংলাদেশ এই জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান শিকার; আইপিসিসির (International Panel on Climate Change, IPCC) এক প্রাক্কলনে বলা হয়েছে যে, সমুদ্রপৃষ্ঠের প্রাক্কলিত ৫০ সেন্টিমিটার উচ্চতা বৃদ্ধিতে দেশের আনুমানিক ১১ শতাংশ ভূমি ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রের পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়বে এবং ১৮ মিলিয়ন মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে যাবে। কাজেই এখন থেকেই বিকল্প জ্বালানির সংস্থান করা অতীব জরুরি এবং সেটা হতে হবে সাশ্রয়ী, সবুজ ও টেকসই পন্থায়। অন্যথায় শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো ধরিত্রীই বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি হলো এমন এক শক্তির উৎস, যা স্বল্প সময়ের ব্যবধানে পুনঃপুন ব্যবহার করা যায় এবং তা কখনোই নিঃশেষ হয়ে যায় না। এগুলো হলো বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎসজাত শক্তি; সূর্যের আলো ও তাপ, বায়ুপ্রবাহ, জলপ্রবাহ, জৈবভর, ভূ-তাপ, সমুদ্র তরঙ্গ, সমুদ্র-তাপ, জোয়ারভাটা, আবর্জনা শক্তি, হাইড্রোজেন ফুয়েল প্রভৃতি। নবায়নযোগ্য জ্বালানির সুবিধা হলো এর পুনঃব্যবহার যোগ্যতা; শক্তি উৎপাদনের জন্য বারবার অর্থ বিনিয়োগ করার প্রয়োজন পড়ে না। তা ছাড়া এটা হলো পরিবেশবান্ধব সবুজ জ্বালানি; এতে পরিবেশদূষণ নেই বলেই চলে। বাংলাদেশ কয়েকটি সবুজ জ্বালানিতে অনেক দেশের চেয়ে বেশ সমৃদ্ধ বলে ধারণা করা হয়। এসব উৎস থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি আহরণ করে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও স্বয়ম্ভরতা নিশ্চিত করতে দেশে অনেক নীতি, পথ-নকশা, পরিকল্পনা, মহাপরিকল্পনা ও প্রেক্ষিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। যেমন ১৯৯৭ সালে বেসরকারি খাতে অবকাঠামো ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি শক্তি উৎপাদনে অর্থায়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড ((IDCOL)। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে সবুজ জ্বালানির প্রসার ঘটাতে ২০১২ সালে গঠন করা হয় টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষ (স্রেডা)। ২০১৫ সালে গঠন করা হয়েছে বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিল। টেকসই উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য ২০২১ সালে অনুমোদন করা হয় মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা ২০২২-৪১।
২০০৮ সালের নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিতে এ উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল ২০১০ সালের মধ্যে মোট উৎপাদনের ৫ শতাংশ এবং ২০২০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ পূরণ করা। এখন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন মাত্র ৩.৪৯ শতাংশ। অথচ এ সময়ে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা চাহিদার চেয়ে দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে উৎপাদন ক্ষমতার একটা বড় অংশ (৪৮ শতাংশ) অলস পড়ে রয়েছে এবং তার জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হচ্ছে (Institute for Energy Economics and Financial Analysis Report, dt. 28.07.2023, IEEFA)।
এ অবস্থার কারণ সবুজ জ্বালানির প্রতি নীতিবিরুদ্ধ পশ্চাৎদেশ প্রদর্শন এবং জীবাশ্ম জ্বালানির প্রতি অন্ধ পক্ষপাতিত্ব গ্রহণ। জাইকার সহযোগিতায় ২০১৬ সালের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা মহাপরিকল্পনায় উচ্চাকাক্সক্ষী প্রবৃদ্ধি অভিক্ষেপের ভিত্তিতে জ্বালানি চাহিদা প্রাক্কলন করায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে এই একপেশে অবস্থান গ্রহণ যৌক্তিকতা পায়। এখন আবার প্রণয়ন করা হচ্ছে সমন্বিত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনা ((Integrated Energy & Power Master Plan, IEPMP). এই পরিকল্পনায় কিছু ইতিবাচক দিক থাকলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উপেক্ষিত এবং এলএনজি ও কয়লা আশীর্বাদ প্রাপ্ত হয়েছে। মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনায় মোট জ্বালানিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অংশ ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ, ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ১০০ শতাংশ ধরা হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও ২০২১ সালের জলবায়ু সম্মলনে একই কথার প্রতিধ্বনি করেন। কিন্তু আইইপিএমপি মতে, ২০৪০ সালের মধ্যে মোট জ্বালানির ৪০ শতাংশ হবে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি, আর ২০৫০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অংশ হবে মাত্র ১৭.১০ শতাংশ। এর অর্থ কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কারখানায় বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত থাকবে, শুধু উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে দূষণ ক্লিন বা পরিচ্ছন্ন করা হবে। তা ছাড়া আগের পরিকল্পনার মতো এখানেও বিদ্যুৎ চাহিদার অভিক্ষেপ করা হয়েছে বাড়িয়ে; ২০৫০ সালে বিদ্যুৎ চাহিদার প্রাক্কলন করা হয়েছে ৯০ গিগাওয়াট। এভাবে অতিরঞ্জিত চাহিদার ভিত্তিতে হিসাব করা নবায়নযোগ্য জ্বালানির অংশ ফেলে রেখে আগের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি অংশের উৎপাদন ক্ষমতা গড়ে তোলা হলে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়বে, আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে এবং পরিবেশদূষণ আগ্রাসী হয়ে উঠবে।
এ দেশে যেমন রয়েছে কোটি কোটি মানুষ, তেমনি তাদের থাকার জন্য রয়েছে লাখ লাখ বাড়িঘর। আবার প্রতিদিন মানুষ ও কলকারখানা হাজার হাজার টন বর্জ্য উৎপাদন করে চলেছে। এসব বাড়িঘরের ছাদ থেকে সৌরবিদ্যুৎ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কলকারখানার ছাদ, নদী অববাহিকা ও অব্যবহৃত ভূমি সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা যেতে পারে। National Solar Energy Roadmap-2021-41 অনুযায়ী এসব সুবিধা ব্যবহার করে দেশে ২০ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। IEEFA-এর এক হিসাব মতে, বাংলাদেশ বর্তমান কাঠামতেই দিনের বেলায় প্রতিদিন ১,৭০০ থেকে ৩,৪০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে, আর বায়ুশক্তি থেকেও পারে ২,৫০০ থেকে ৪,০০০ মেগাওয়াট। মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান The National Renewable Energy Lab (NREL)-এর হিসাব অনুযায়ী এ দেশে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের যে সম্ভাবনা রয়েছে, তার সদ্ব্যবহার করে ৩০,০০০ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। এসব হিসাব ও প্রাক্কলন থেকে এটা স্পষ্ট যে, হাইড্রোজেন, অ্যামোনিয়া ও সিসিএস (Carbon Capture & Storage)-)-এর মতো অতি উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর এবং আমদানিনির্ভর ব্যয়বহুল জ্বালানি ছাড়াও দেশে সাধারণ নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিস্তর সম্ভাবনা রয়েছে। সেগুলোরই আগে সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। গ্রিড ও অফ-গ্রিড ব্যবস্থাপনায় সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে সেগুলোকে শুধু সমৃদ্ধ ও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির সুবিধা এটা যে শুধু গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনে, তাই না; এটা জ্বালানি নিরাপত্তাকেও সুসংহত করে। নবায়নযোগ্যতার কারণে একবার একটা স্থাপনা গড়ে উঠলে তা প্রতিস্থাপনের আগ পর্যন্ত প্রায় বিনা বিনিয়োগে দীর্ঘদিন বিদ্যুৎ শক্তি সরবরাহ অব্যাহত রাখতে পারে। জীবাশ্ম জ্বালানির প্রতিকূল প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে বিশ্ব আজ নবায়নযোগ্য জ্বালানির পথে হাঁটছে। ২০২২ সালে বিশ্বে ২৯৫ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনে যুক্ত হয়। এর মধ্যে ৮৩ শতাংশই আসে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস থেকে। আগের বছর এই হার ছিল ৮১ শতাংশ। এ সময় একই উৎস থেকে চীন উৎপাদন করেছে ১৪১ গিগাওয়াট ও ভারত করেছে ১৫.৭ গিগাওয়াট। ফলে জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানিতে ২০২০-২২ সালে ভারতের ৪.২০ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হয়েছে (আজকের পত্রিকা, অনলাইন ডেস্ক, ০২.৮.২০২৩)। ভারত ২০৩০ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুতের ৫০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে। ইতিমধ্যে তাদের উৎপাদনক্ষমতা ৬৪ গিগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। তাদের ২০২২ সালে গৃহীত বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের ৮৪ শতাংশই ছিল নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর (ডেইলি স্টার, ১৪.০৪.২০২৩)।
দেশে এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট চলছে। এ জন্য আমদানিতে চলছে নিয়ন্ত্রণ। দেশের আমদানি করা পণ্যের মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো জীবাশ্ম জ্বালানি। বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে এ পণ্যটির আমদানিও সীমিত হয়ে পড়ায় অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখতে হচ্ছে; করতে হচ্ছে লোডশেডিং। এই অবস্থা থেকে টেকসই পদ্ধতিতে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর আস্থাশীল হয়ে তার উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। IEEFA-এর এপ্রিল ৫, ২০২৩ তারিখের এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে যে, ২০৪১ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী নবায়নযোগ্য জ্বালানির অংশ ৪০ শতাংশে উন্নীত করতে ২০২৪ সাল থেকে প্রতিবছর ১.৫৩ বিলিয়ন থেকে ১.৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করার প্রয়োজন হবে। যদিও এর মধ্যে সংরক্ষণ প্রযুক্তির ব্যয় অন্তর্ভুক্ত নয়। আপাতদৃষ্টিতে এই অঙ্ক অনেক স্ফীত বলে মনে হলেও এটা ২০২১-২২ সালের জ্বালানি খাতে প্রদত্ত ভর্তুকির চেয়ে কম। এক বছরের ভর্তুকির সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় করে যদি বছরভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী নবায়নযোগ্য জ্বালানির স্থাপনা গড়ে তোলা যায়, তার চেয়ে আর কি ভালো হতে পারে? লেখক: খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক
অনেকটা নীরবে চলে গেলেন কিংবদন্তি চিত্রগ্রাহক ও আলোকচিত্রী আফজাল এইচ চৌধুরী। গত ৩১ আগস্ট, বৃহস্পতিবার দুপুরে ইউনাইটেড হাসপাতালে প্রায় ৯৩ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হন। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০), উভয় পাকিস্তানের প্রথম আংশিক রঙিন ছবি ‘গুলে বাঁকালি’ (১৯৬১), প্রথম জনন্দিত লো-কি সিনেমা ‘কাঁচের দেয়াল’ (১৯৬৩), প্রথম সম্পূর্ণ রঙিন ছবি ‘সঙ্গম’ (১৯৬৪), প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র ‘বাহানা’ (১৯৬৫) ও প্রথম ট্রিপল রোলের চলচ্চিত্র ‘জ¦লতে সুরুজ কে নিচে’ (১৯৭০)-এর চিত্রগ্রাহক ছিলেন তিনি। তৎকালীন পাকিস্তানের সবচেয়ে ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র ‘আয়না’ চলচ্চিত্রও তারই সেলুলয়েডে আঁকা। এ ছাড়াও বাংলাদেশের অসংখ্য চলচ্চিত্রে তিনি ক্যামেরায় যেন কথা বলেছেন। অথচ তারই মৃত্যুতে এ দেশের মিডিয়াগুলো কেন যেন একেবারেই নীরব! জীবিতকালেও তাকে যে খুব সম্মান দেওয়া হয়েছে এমন নয়। আফজাল চৌধুরীর সঙ্গে আমার খুব বেশি ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল না। তাকে একবারই দেখেছিলাম পাঠশালায়। সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব ফটোগ্রাফি আয়োজিত সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সেই সময় আফজাল চৌধুরী ও পাঠশালার অধ্যক্ষ ড. শহিদুল আলমের হাত থেকে সনদ গ্রহণ করেছিলাম। পরবর্তী সময়ে জেনেছি, তিনি ছিলেন পাঠশালার প্রতিষ্ঠাকালীন উপদেষ্টা কমিটির সদস্য।
আফজাল এইচ চৌধুরী, যিনি এক কথায় সেলুলয়েড শিল্পী, তাকে নিয়ে তেমন চর্চা হয়নি। তুলে ধরা হয়নি তার সৃজনকর্ম, নতুন প্রজন্মের কাছে। ফলে অনেকটা অন্তরালেই থেকে যান এই শক্তিমান চিত্রগ্রাহক। অবশ্য নিজেও ছিলেন এক নিভৃতচারী মানুষ। কয়েক বছর আগে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর তার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেটি দেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। সামাজিক দুনিয়ায় সাক্ষাৎকারটি থেকে যাওয়ায় আফজাল চৌধুরী বিস্মৃতি হয়ে যাওয়া থেকে কিছুটা রক্ষা পেয়ে যান।
হাইস্কুলে পড়ার সময় ফটোগ্রাফি শুরু করেন আফজাল চৌধুরী। পরবর্তী জীবনে জড়ান চলচ্চিত্রের সঙ্গে। তার জন্ম ১৯৩১ সালের ৩১ অক্টোবর সিরাজগঞ্জে। পিতা হাজী আবদুল ওয়াহাব চৌধুরী রংপুরের মহিমাগঞ্জে কাঠের ব্যবসা করতেন। এক মাস ২২ দিন বয়সে মা আমেনা খাতুনকে হারান। ফলে তাকে মহিমাগঞ্জে মামির কাছে পাঠানো হয়। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত তিনি সেখানে পড়াশোনা করেন। এরপর সিরাজগঞ্জের জ্ঞানদায়িনী স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে ভর্তি হন বিএল হাইস্কুলে। ১৯৪৭ সালে সেখান থেকেই তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। ফলে তারাই ছিলেন কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের শেষ ব্যাচের শিক্ষার্থী।
একদিন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখলেন, কোডাক কোম্পানি ৬ টাকা ১২ আনায় বক্স ক্যামেরা বিক্রি করছে; সঙ্গে এক রোল ফিল্ম। বড় ভাইকে চিঠি লিখলেন, টাকা পাঠানোর জন্য। সেই টাকায় কিনলেন কোডাক ব্রাউনি ক্যামেরা। সিরাজগঞ্জে তখন স্টুডিও ছিল। ওখানে গিয়ে শিখলেন, ফটোগ্রাফির টুকিটাকি। কিছু বইপত্র সংগ্রহ করলেন। ঢাকা থেকে কিনে আনলেন কেমিক্যাল। বাড়িতে ডার্করুম নেই। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে, দরজা-জানালা বন্ধ করে লালবাতি জ¦ালিয়ে ডিশের মধ্যে নেগেটিভ ডেভেলপ করতেন। প্রথমে প্রিন্ট করতে জানতেন না। স্টুডিওতে নেগেটিভ নিয়ে গিয়ে প্রিন্টং করা শিখলেন। তখন কন্ট্রাক্ট প্রিন্টের একটা ফ্রেম পাওয়া যেত। তাতে নেগেটিভ রেখে ১৫ সেকেন্ড আলো ফেলে কন্টাক্ট প্রিন্ট করা যেত। কিন্তু ছবি বড় করবেন কেমন করে? এনলার্জারের তখন অনেক দাম। বাবার কাঠের দোকানে মিস্ত্রিরা কাজ করত। ওই কাঠ দিয়ে তিনি এনলার্জার বানিয়ে তাতে কনডেক্সার আর ক্যামেরার লেন্স লাগালেন। ছবি তোলা তখন তার নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল। যখন ক্লাস টেনে পড়েন তখন কলকাতায় গিয়ে রোলিফ্লেক্স ক্যামেরা ও ফ্ল্যাশগান কিনে আনেন।
১৯৪৮ সালে ঢাকা কলেজে পড়ার সময়ে ১৪ আগস্টে রাষ্ট্রীয় একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখলেন, প্রখ্যাত পরিচালক এ জে কারদার সিক্সটিন মিলিমিটার মুভি ক্যামেরায় ছবি তুলছেন। ওই দিনই তিনি মুভি ক্যামেরা শেখার সিদ্ধান্ত নেন। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর কয়েকজন বন্ধু মিলে হিচহাইকিংয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন। তখন শামসুদ্দীন আবুল কালাম তাকে একটা ৮ মিলিমিটার ক্যামেরা দেন। ওই ক্যামেরায় তিনি চা বাগানের ওপর সাড়ে তিন মিনিটের একটি ডকুমেন্টারি বানান। কিছু দিন পর মাইকেল টডের একটা ইউনিট ঢাকায় আসে। ইউনিটটি ঢাকা থেকে ট্রেনে করে সিলেটে যায়। তখন এফডিসির অপারেটিভ ডিরেকটর নাজির আহমেদ তাকে একটা ক্যামেরা ও ৩৫ মিলিমিটার চারশ ফিটের একটি রোল দিলেন স্যুট করার জন্য। পরে নাজির আহমেদ ওই রোলটা মাইকেল টড কোম্পানির কাছে পাঠান। কিছুদিন পর তারা আফজাল চৌধুরীর কাজের প্রশংসা করে নাজির আহমেদের কাছে একটা চিঠি পাঠায়। এরপর আফজাল চৌধুরী সিনেমাটোগ্রাফার হওয়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন।
’৫১ সালের শেষ দিকে বম্বে গিয়ে ওখানকার বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান সুধীন মজুমদারের স্টুডিওতে যোগ দেন। স্টুডিওতে ওই সময়ের টপ ক্যামেরাম্যান ফলি মিস্ত্রি ও জাল মিস্ত্রির কাছে কাজ শেখেন। দেড় বছর পর বাবার চিঠি পেয়ে দেশে ফিরে আসেন। বাড়িতে থাকলেন কিছুদিন। এক বন্ধু তাকে নিয়ে গেলেন ইউএসআইএসের পরিচালকের কাছে। পরিচালক সব শুনে বললেন, ‘কালই যোগদান করো।’ ইউএসআইএসে তাকে নিউজ ফটোগ্রাফি করতে হতো। দেড় বছর কাজ করার পর মনে হয়েছে, এটা তার কাজ না। ’৫৭ সালে তিনি করাচিতে গিয়ে ইস্ট্রার্ন ফিল্ম স্টুডিওতে চিফ অ্যাসিসট্যান্ট হিসেবে যোগ দেন। ওখানেই প্রথমে কালার ফিল্মে কিছু নৃত্য ও গানের চিত্রায়ণ করেন।
১৯৬০ সালে ‘আর ভি গাম হ্যায়’ চিত্রায়ণ করে। ছবিটা ওই সময় প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিল। এরপর ডব্লিউ জেড আহমেদের সঙ্গে কাজ করেন করাচি ও লাহোরে। তখন লোকে জেনে গেছে আফজাল চৌধুরীর কালার ফিল্মে কাজ করেন। ’৬২ সালে জহির রায়হান অভিনেতা খান আতাকে দিয়ে চিঠি পাঠিয়ে আফজাল চৌধুরীকে লাহোর থেকে দেশে নিয়ে আসেন। এরপর তিনি জহির রায়হানের বেশ কয়েকটি ছবিতে কাজ করেন। ১৯৬৯ সালে জহির রায়হানের পরিচালনায় আফজাল চৌধুরী ‘জ¦লতে সুরুজ কে নিচে’ নামে একটা ছবি বানান। চলচ্চিত্রে ফরিদা আক্তার পপির নাম ‘ববিতা’ রাখেন আফজাল চৌধুরীর স্ত্রী সুরাইয়া চৌধুরী।
শেষ জীবনে স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় বসবাস করতেন। দুই মেয়ে সীমা, সাদিয়া আর নাতি-নাতনিদের সান্নিধ্যে তার ভালোই কাটছিল। ৬৫ বছর তিনি চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ চিত্রগ্রাহক তার শিষ্য। কী নির্মম বাস্তবতা, এ দেশে তার কোনো মূল্যায়নই হলো না!
লেখক : আলোকচিত্র সম্পাদক, দেশ রূপান্তর
বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের প্রতি জনসমর্থন এখনো যথেষ্ট বেশি। পিওর জরিপে ৩৮টি দেশে দেখা গেছে, ৭৮ শতাংশ লোক মনে করে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা যে আইন প্রণীত হয়, এমন ব্যবস্থা উত্তম। কিন্তু গণতন্ত্রের বিকল্প ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন আছে, এমন লোকের সংখ্যাও কম নয়। প্রকৃত হুমকিটা হলো অপেক্ষাকৃত কম পরিণত বা অপরিণত গণতন্ত্রের বেলায়, যেখানে প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল এবং গণতান্ত্রিক অভ্যাসগুলো জনগণের মধ্যে তেমন গ্রথিত নয়। তারপরও পাশ্চাত্যে যা ঘটে, তা এসব দেশকেও প্রভাবিত করে। আমেরিকা একসময় পদানত মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিল। আজ সেই আমেরিকার রাষ্ট্রক্ষমতায় এমন এক ব্যক্তি বসে আছেন, যিনি অনুপ্রেরণা সৃষ্টি তো পরের কথা, বরং বিরাগেরই শুধু জন্ম দিতে পারেন। নবীন গণতন্ত্রকে চারপর্যায়ে নস্যাৎ করে দেওয়া হয়। প্রথম পর্যায়ে ঘটে স্ট্যাটাসকো নিয়ে জনগণের সত্যিকারের অভিযোগ ও অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ। তুরস্কের ধর্মপ্রাণ সংখ্যাগরিষ্ঠরা সেক্যুলার এলিট শ্রেণির দ্বারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে বলে মনে করে এবং সেই কারণে বর্তমান ব্যবস্থায় অসন্তুষ্ট। কয়েক দশক ধরে বিজয়কেতন উড়িয়ে চলার পর গণতন্ত্র কি এখন পিছু হটতে শুরু করেছে? প্রশ্ন উঠছে, এ জন্য যে, বেশ কিছু লক্ষণ দেখা দিয়েছে, যা থেকে বলা যায় গণতন্ত্র আজ আর আগের অবস্থায় নেই। স্নœায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির আগে সামরিক শাসন ছিল বিশ্বরাজনীতিতে একটি অনিবার্য বাস্তবতা। স্নায়ুযুদ্ধোত্তর রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপের প্রবণতা অনেকটা কমে গেলেও তা একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। এখনো আফ্রো-এশিয়ার অনেক দেশেই সামরিক শাসনের উপস্থিতি লক্ষণীয়। সামরিক বাহিনী কোনো কোনো দেশে প্রত্যক্ষভাবে শাসন না করলেও, পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করছে। দুটো কারণে সামরিক বাহিনীর প্রভাব স্নায়ুযুদ্ধকালীন অবস্থা থেকে দুর্বল হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
যুগে যুগে কর্র্তৃত্ববাদী শাসকের আবির্ভাব হয়েছে পৃথিবীতে এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য যে, কর্র্তৃত্ববাদী শাসকের নির্মম পতনও প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ববাসী। তা সত্ত্বেও কর্র্তৃত্ববাদী শাসকরা শিক্ষা নেননি কখনো। এমনকি নতুন নতুন অবাস্তব আদর্শ প্রচার করে এবং জনগণের কল্যাণ ও উন্নয়ন নিশ্চিতের দোহাই দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে সমকালীন বাস্তবতাকে বিবেচনায় না নিয়ে কর্র্তৃত্ববাদী শাসন জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়ে কর্র্তৃত্ববাদী শাসকরা রাষ্ট্র শাসন করে গেছেন বা বিদ্যমান বিশ্ব ব্যবস্থায়ও তেমন ধরনের শাসকরা জনগণের ওপর কর্র্তৃত্ববাদ চাপিয়ে দিয়ে দেশ শাসন করে চলেছেন।
জনগণ জেনে-বুঝেও শাসকের প্রতি এক প্রকারের আনুগত্য প্রকাশ করে বলে মনে করা হলেও, মূলত জনগণ ভয়ের মধ্যে থাকে বলেই শাসকের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করে না। কেননা শাসক তার প্রতি আনুগত্য আদায় করার জন্য জনগণের মধ্যে ভীতি সঞ্চারের উদ্দেশ্যে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগ করে জনগণকে অত্যাচার-নির্যাতন ও জেল-জুলুমের ভয় দেখিয়ে ভিন্ন মত দমন করে শাসকের প্রতি জনগণের আনুগত্য আদায় করার জন্য সচেষ্ট থাকে।
কাগামির মতানুযায়ী, বিরোধী মতের লোকেরা শাসকের প্রতি টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করে না ওই ভয়ের কারণেই। পক্ষান্তরে কর্র্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত এক শাসন ব্যবস্থা। যেখানে মানুষের সব প্রকার মৌলিক অধিকারের ওপর এক ধরনের ঘোষিত এবং অঘোষিত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয় বলে মানুষের মৌলিক অধিকার বিপন্ন হয়ে পড়ে। সর্বদাই শাসকের গুণগান করা কর্র্তৃত্ববাদী শাসনের এক মৌলিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়। শাসকের বিরুদ্ধে যায়, এমন ধরনের সর্বপ্রকারের মত প্রকাশ ও প্রচারের অধিকার নিষিদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত থাকে বলে এ ধরনের শাসনাধীন সমাজকে ‘বদ্ধ সমাজ’ বলে অভিহিত করা হয়। বিশ শতকে গণতন্ত্রের জোয়ার বয়ে গিয়েছিল বিশ্ব ব্যবস্থায়। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ছিল, উন্নয়ন মডেলের একটি মৌলিক উপাদান। এর মধ্যেই জনগণের প্রকৃত মৌলিক অধিকারের বিষয়টি খোঁজা হয়েছিল। তাই দেশে দেশে ছিল গণতন্ত্রের জয়জয়কার। তবে একুশ শতকের পৃথিবীতে গণতন্ত্রের বিপরীতে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থাকে একটি উন্নয়ন মডেল হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে। ‘আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র’ এমন একটি প্রচারণা সামনে নিয়ে আসা হয়েছে
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয়। ফলে বিশ্বের দেশগুলোয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে এবং পক্ষান্তরে কর্র্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার রাষ্ট্রের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে এবং বদ্ধ সমাজ ব্যবস্থার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এসব দেশে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে একজন মাত্র শাসকের পদতলে নিয়ে এসে সব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ক্ষুদ্র একটি পরিবার ও চক্রী দলের হাতে কেন্দ্রীভূত করে গণতন্ত্রের কফিনের ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে আধুনিক কর্র্তৃত্ববাদী শাসনের মিনার। আর এখানে মানুষের সব অধিকার অস্বীকার করে শাসন ব্যবস্থার মিনারের চূড়ায় বসে থাকা শাসকের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে জনগণের ওপর। জনগণের সমর্থন আছে কি নেই, সে সম্পর্কে ভ্রুক্ষেপ করা হয় না।
কর্র্তৃত্ববাদী শাসনে দেশের সংবিধানকে এমনভাবে সাজানো হয়, যা একমাত্র শাসকের অনুকূল ক্ষেত্র সৃষ্টি করে মাত্র। সংবিধানের দোহাই দিয়ে শাসকরা রাষ্ট্রযন্ত্র এবং এর সব প্রতিষ্ঠানের ওপর অবাধ ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। অর্থাৎ শাসক নিজের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন করার লক্ষ্যে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত মধ্যবর্তী সব প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে দিয়ে এর ওপর নিজের কর্র্তৃত্ব স্থাপন ও কায়েম করেন, যাতে বাধাহীনভাবে শাসকের আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়। আধুনিককালের লোকরঞ্জনবাদী কর্র্তৃত্বপরায়ণ শাসকরা নিজেদের সাধারণত চার স্তরবিশিষ্ট পিরামিডের সর্বোচ্চ চূড়ায় স্থাপন করেন, যেখানে শাসকই হলেন একমাত্র পূজনীয়; রাষ্ট্রের সবকিছুই পরিচালিত এবং নিয়ন্ত্রিত হয় একমাত্র শাসকের কর্র্তৃত্বে। যেমন- সক্রিয়, অন্ধ অনুগত একদল সমর্থকগোষ্ঠী, বাহ্যত দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী জনগোষ্ঠী, সমর্থকগোষ্ঠী; যারা সত্যিকারভাবেই বিশ^াস করে শাসকের অধীনে দেশ ও জনগণের উন্নতি নিশ্চিত হয়েছে। এ ধরনের শাসনে এমন একদল লোকের উদ্ভব হয়, যারা শাসকের বদৌলতে সুবিধাপ্রাপ্ত ও সুবিধাভোগী এবং খুন, গুম, ভয়ভীতির কারণে একদল লোক শাসককে সমর্থন দিয়ে থাকে, শাসকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে।
তুরস্কের অভ্যুত্থান থেকে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বেঁচে যাওয়ার পর রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কের ভাটা পড়ে। প্রকৃত অর্থে পশ্চিমা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যে কর্র্তৃত্ববাদী ঐক্যের সৃষ্টি হয়। ব্রেক্সিটের পর চীন সরকার নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্র পিপলস ডেইলির মন্তব্য হচ্ছে, এটা পশ্চিমা গণতন্ত্রের মৌলিক ভুলের ফসল। দ্য গ্লোবাল টাইমস লিখেছে, পশ্চিমের সন্ত্রাসী হামলাগুলো আসলে গণতন্ত্র ধসে পড়ার ইঙ্গিত। এ বিষয়ে রবার্ট কেগান লিখেছেন, মানবসভ্যতার শাসনের ইতিহাসে গণতান্ত্রিক শাসনের চেয়ে কর্র্তৃত্বপরায়ণ শাসনের ইতিহাসই দীর্ঘ। বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎ যদি বিবর্ণই হয়, তবে হয়তো পুরো বিশ্ব আর অভিন্ন সুরে গলা মেলাতে পারবে না। হয়তো এশিয়ার কিছু দেশ যে পথে এগোতে চাইবে, ইউরোপের দেশগুলো তাকে ভুল মনে করবে। অঞ্চলভেদে বদলে যাবে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা। কোনো একক নীতিতে আর বিশ^বাসী তাল মেলাতে চাইছে না। তবে তা ভালো হবে, নাকি মন্দ হবে সময়ই তা বলে দেবে।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক
উপাচার্য বা ভাইস চ্যান্সেলর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী পদ। কিন্তু আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলছে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়। দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৩টি। এর মধ্যে ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, ৮৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি এবং ৪৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রেজারারের পদ শূন্য রয়েছে। আইনের বিধান মতে, ব্যয় ভাউচার, দেনা পরিশোধ, সব অর্থ লেনদেনে চ্যান্সেলর নিযুক্ত ট্রেজারারের সই থাকতে হবে। কিন্তু অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈধ ট্রেজারার নেই। অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে গতিশীলতা নিয়ে আসতে ও শিক্ষার মান বজায় রাখতে উপ-উপাচার্য থাকারও বিধান রয়েছে আইনে। উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারার ছাড়াই দিব্যি চলছে কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এর অন্তর্নিহিত কারণ অনেকেরই অজানা। ভিসি ও ট্রেজারার না থাকলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়মে সুবিধা হয়। যে কারণে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষ চ্যান্সেলর অনুমোদিত ভিসি নিয়োগে বিলম্ব করে দিনের পর দিন ভারপ্রাপ্ত ভিসি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার ট্রেজারার পদে ট্রাস্টি বোর্ড সদস্যদের আত্মীয়স্বজনই দিব্যি বসে আছেন। এ বিষয়ে রবিবার দেশ রূপান্তরে ‘ভিসি-প্রোভিসি পেতে হয়রান’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলো ভিসি-প্রোভিসি-ট্রেজারার ছাড়াই কীভাবে বছরের পর বছর চলছে এবং বিশ^বিদ্যালয়ের সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হ্যাঁ-না খেলার কথাও চমৎকারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তখন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। সে সময় ৪৮তম বার্ষিক প্রতিবেদন-২০২১ পেশ করেন ইউজিসি চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কাজী শহীদুল্লাহ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) ক্ষমতা দিতে সরকারের কাছে সুপারিশ করে সংস্থাটি। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিসি, প্রোভিসি এবং ট্রেজারার নিয়োগে ইউজিসির মতামত গ্রহণ এবং একটি নীতিমালা তৈরি করারও সুপারিশ করা হয়। এরপর সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক ও নিয়োগ-সংক্রান্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টদের জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণের নির্দেশ দেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু সেই নির্দেশও অজানা কারণে কার্যকর হয়নি!
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আশা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য (ভিসি) পদ দীর্ঘদিন ধরেই শূন্য। গত বছর তারা তিনজনের একটি ভিসি প্যানেল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। কিন্তু গত বছরের ২৯ নভেম্বর সে ফাইলটি মন্ত্রণালয় থেকে ফিরে আসে। এরপর চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি চিটাগংয়ের উপাচার্য নিয়োগের ফাইলটি ফেরত আসে। মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছিল, প্রস্তাবিত ব্যক্তিদের মধ্যে অধ্যাপক ড. মো. জাহিদ হোসেন শরীফের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকায় তার পরিবর্তে বিকল্প প্রস্তাবসহ নতুন করে তিনজনের প্যানেল প্রস্তাব পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হলো। এখনো এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির পদটি শূন্য রয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভের (ইউডা) প্রোভিসি নিয়োগের ফাইল ফেরত আসে এ বছরের ৯ এপ্রিল। গত বছরের ১০ নভেম্বর প্রাইম ইউনিভার্সিটির ট্রেজারার নিয়োগের ফাইল ফেরত আসে। প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকায় গত বছরের ৯ নভেম্বর সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির ট্রেজারার নিয়োগের ফাইলও ফেরত আসে। মন্ত্রণালয় এই বিশ্ববিদ্যালয়কে পুনরায় ট্রেজারার নিয়োগের প্যানেল পাঠানোর অনুরোধ করেছে। কিন্তু ১০ মাস পার হলেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রেজারার নিয়োগ হয়নি। এখন প্রোভিসি পদটিও খালি রয়েছে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এবং ট্রেজারার নিয়োগের কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা ও পদ্ধতি নেই। এমনকি ইউজিসি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মানসম্পন্ন শিক্ষা ও গবেষণার উৎকর্ষসহ উচ্চশিক্ষার সার্বিক তদারকির দায়িত্ব পালন করলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ণিত তিনটি পদে (উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারার) নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ইউজিসির কোনো ধরনের মতামত নেওয়া হয় না। তবে ইউজিসির মতামতের ভিত্তিতে দেশের খ্যাতনামা শিক্ষাবিদদের মধ্য থেকে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারার নিয়োগ দেওয়ার জন্য সরকার একটি বাস্তবায়নযোগ্য নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯ ধরনের কমিটি থাকতে হয়। এর মধ্যে তিনটি কমিটির সভাপতি থাকেন ভিসি। তিনটি কমিটিতে ভিসি মনোনীত শিক্ষক সভাপতি হন। আর বাকি তিনটি কমিটিতে সভাপতি থাকেন বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যরা। এই তিন কমিটিতেও সদস্য হিসেবে থাকেন ভিসি আর একটিতে ট্রেজারারের থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আর্থিক লেনদেন পরিচালিত হয় ভিসি ও ট্রেজারারের স্বাক্ষরে। এর জন্যই কি এই ইচ্ছাকৃত শূন্যতা! এই অচলায়তন কীভাবে ভাঙবে, কে জানে?
ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ১৮ আগস্ট ৯ বছরের শিশু আরাফাতের মৃত্যু হয়। সপ্তাহ না যেতেই ২৫ আগস্ট মারা যায় আরাফাতের ছোট বোন ৬ বছরের রাইদা। রাজধানীর মধ্যপাইকপাড়ার ছাপাখানা মোড়ের একটি বাসায় দুই সন্তান আরাফাত ও রাইদাকে নিয়ে থাকতেন মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও রাবেয়া আক্তার দম্পতি। সন্তানদের মৃত্যুর পর জীবনটাই বদলে গেছে তাদের। তছনছ হয়ে গেছে সাজানো সংসার। ইব্রাহিম ও রাবেয়া দম্পতির মতো বহু পরিবার এবার সর্বস্বান্ত হয়েছে ডেঙ্গুজ¦রের থাবায়। সন্তান হারানো এমন বাবা-মায়েরা পাগলপ্রায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর ডেঙ্গুতে শূন্য থেকে ২০ বছর বয়সী ১৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ১৮ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ ৮৬ এবং নারী ৯১ জন। এবার শুধু শহর নয়, গ্রামেও ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। সেখানেও মারা গেছে অনেক শিশু। এ বছর ডেঙ্গুতে শিশুমৃত্যু নিয়মিত ঘটনা হয়ে দেখা দিয়েছে। এই রোগে এত শিশুর মৃত্যু আগে কখনো হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ বছর শূন্য থেকে ২০ বছর বয়সীরা আক্রান্ত হয়েছে ৬৩ হাজার ৯১৯ জন; যা মোট আক্রান্তের ৩২ শতাংশ। এর মধ্যে নারী ২৩ হাজার ৬১৭ এবং পুরুষ ৪০ হাজার ৩০২ জন। ডেঙ্গুতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। তথ্য বলছে, ডেঙ্গুতে শিশুদের আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুর হার কম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া শিশুদের যারা সুস্থ হয়ে উঠছে, তাদের মধ্যে ভবিষ্যতে শারীরিক জটিলতা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ডেঙ্গুর বর্তমান সংক্রমণের মধ্য দিয়ে শিশুদের জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তাদের মানসিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ডেঙ্গুর এই পরিস্থিতি শিশুদের নতুন বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার বিরূপ প্রভাব শিশুদের মধ্যে ভবিষ্যতে দেখা যেতে পারে। মস্তিষ্ক ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এর প্রভাব থাকতে পারে। এতে তাদের মেধাবিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাদের যদি কিডনি কিংবা লিভারের মতো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সেই ভার সারা জীবন বহন করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শিশুদের মৃত্যু নিয়ে ভালোভাবে অ্যানালাইসিস করতে পারছি না। এসব মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে অটোপসি করতে পারলে ভালো হতো। বিভিন্ন দেশে মৃত্যু নিয়ে ডেথ রিভিউ বা অটোপসি করা হয়। এটি করতে পারলে বাংলাদেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যেত।’
এদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দিতেও হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। কোনো শিশুর শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন হলে পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (পিআইসিইউ) চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, ১ মাস থেকে ১২ বছর বয়সী মুমূর্ষু শিশু রোগীদের পৃথক পিআইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দিতে হয়। তবে দেশে পিআইসিইউ সংকট রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে পিআইসিইউর জন্য স্বজনদের হাহাকার করতে দেখা গেছে। হাসপাতালগুলোতে দেখা গেছে ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ শিশুকে সেবা দিতে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক) ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা যেমন বেশি, সেখানে শিশু রোগীও উল্লেখযোগ্য। এই দুটি হাসপাতালে একেকটি শয্যায় একাধিক শিশু রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। ঢামেক হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের জন্য পৃথক ওয়ার্ড খুলেছে কর্তৃপক্ষ। ৭০ থেকে ৮০ জনের সেবা পাওয়ার কথা, কিন্তু সেখানে প্রতিদিন সেবা নিচ্ছে প্রায় ৩০০ শিশু। ঢামেক হাসপাতালের ২৫ শিশুকে একসঙ্গে পিআইসিইউতে সেবা দেওয়ার সক্ষমতা আছে। কিন্তু মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোনো পিআইসিইউ নেই।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এখানে শিশুদের ওয়ার্ডেই ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। পিআইসিইউ নেই, তবে এনআইসিইউ (নিউনেটাল আইসিইউ বা নবজাতকদের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র) আছে।
এদিকে শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের শরীরে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু শনাক্তে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। শিশুদের ডেঙ্গুর চিকিৎসা প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শামীমা ইয়াসমীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিশুদের জ্বর আসার তিন দিনের মধ্যে পরীক্ষা করাতে হবে। এবার অনেকের মধ্যে হঠাৎ করে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। ফলে তারা দেরিতে চিকিৎসা নিতে আসছে। দেখা গেছে, ডেঙ্গুজ্বরে যেসব শিশু মারা গেছে, তারা বাড়ি থেকেই জটিলতা নিয়ে এসেছে। এখানে একটি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে, শুধু প্লাটিলেট কমা আশঙ্কার নয়, রক্তচাপ কমে যাওয়া প্লাটিলেট কমার চেয়ে ভয়ের। তাই আমাদের শিশুদের রক্তচাপ নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে।’
স্যাংশন নিয়ে ভয় না পাওয়ার বার্তা দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার মেথডিস্ট সেন্ট্রাল হলে নাগরিক সংবর্ধনায় দেওয়া বক্তব্যে তিনি পাল্টা স্যাংশন দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন।
সংবিধান অনুযায়ী সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে জানান তিনি। খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা ইস্যু সম্পর্কে প্রশ্ন রাখেন, সাজাপ্রাপ্ত কাউকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠায় কোন দেশ?
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্ন রেখে বলেন, পৃথিবীর কোন দেশের সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠায় বলতে পারেন? কোনো দেশে পাঠায়? তারা এটা দাবি করে। আমাদের কেউ কেউ আঁতেল আছে। তারা বলে, একটু কী সহানুভূতি দেখাতে পারেন না! সে এভারকেয়ার, বাংলাদেশের সবথেকে দামি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। আর রোজই শুনি এই মরে মরে, এই যায় যায়। বয়সতো আশির ওপর। মৃত্যুর সময় তো হয়ে গেছে। তার মধ্যে অসুস্থ। এখানে এত কান্নাকাটি করে লাভ নাই।
স্যাংশনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। আপনাদেরও বলব, স্যাংশন নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।
বিএনপি চেয়ারপারসন ‘অসুস্থ’ খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে শর্ত দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সেই শর্তের অন্যতম ইস্যু হচ্ছে, বিএনপিকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে। এমন ঘোষণার পরপরই খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিদেশে যাওয়ার অনুমতি মিলবে। কিন্তু সরকারের সেই শর্তে রাজি নন খালেদা জিয়া। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কোনো শর্তের বিনিময়ে তিনি মুক্তি চান না। ফলে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার সরকারের যে চেষ্টা, সেটা এ দফায় সফল হচ্ছে না বলে মনে করছেন আন্দোলনে থাকা নেতারা। তাদের মতে, সরকার ফাঁদ পাতলেও এতে পা না দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে বেগম জিয়ার। বরং আন্দোলনে এ সরকারকে বিদায় করে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দরজা খুলতে চান তারা। একই সঙ্গে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করেই আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবেন। এ লক্ষ্যে প্রায় অর্ধশত দল নিয়ে গত প্রায় এক বছর ধরে আন্দোলনে রয়েছেন তারা।
শর্তের বিনিময়ে মুক্তির বিষয়টি তুলে ধরে গত রবিবার রাতে কিশোরগঞ্জে বিএনপির রোডমার্চের সমাপনী সমাবেশে দলটির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে শর্ত দেওয়া হয়েছিল তিনি যদি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে চান, তাহলে বিএনপিকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে আসতে হবে। বিএনপি থেকে উত্তর দেওয়ার আগেই অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতাল থেকে খালেদা জিয়া বিদ্রোহ করে বলেছেন, তার জীবনে গণতন্ত্রের জন্য কোনো শর্ত নেই। ভোটের অধিকারের জন্য, এই দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য কোনো শর্ত নেই। কোনো শর্ত খালেদা জিয়ার নামের সঙ্গে যায় না এবং আমরাও তা মানি না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খালেদা জিয়া ৫৪ দিন ধরে টানা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিতই খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের সর্বশেষ অবস্থা খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। এ সময় বেশ কয়েকবার শারীরিকভাবে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লে দলের কয়েকজন নেতার মাধ্যমে মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের দেওয়ার বক্তব্যের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি দলের মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, যুগ্ম মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির কয়েকজন সম্পাদক ও সদস্য খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন। সূত্রগুলো বলছে, একজন ভাইস চেয়ারম্যান ও স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য কথা প্রসঙ্গে এ ধরনের প্রসঙ্গেও ইঙ্গিত দিলে খালেদা জিয়ার শর্ত দিয়ে মুক্ত হতে চান না বলে পুনর্ব্যক্ত করেন। যদিও এর আগে শর্ত দিয়ে দেশের বাইরে চিকিৎসার বিষয়ে দল যাতে সম্মত না হয়, সে কথা নেতাদের আগেই বলে রেখেছিলেন একসময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এ নেত্রী। কোনো অবস্থায় শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়া যাবে না এবং এ ব্যাপারে কোনো ধরনের সমঝোতাও নয়Ñ এ ব্যাপারেও খালেদা জিয়ার স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করেন। সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে এসে মঞ্চের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের এ আন্দোলনে উনার সমর্থন আছে। আমাদের একজন নেতা (ওই বৈঠকে) বলেছেন, সরকার একটা নির্বাচনের জাল বিছানোর চেষ্টা করছে। উনি (খালেদা জিয়া) বলেছেন, কোনো অবস্থায় এ সরকারের অধীনে নির্বাচনী ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না।’
এর আগে ৮ মে রাতে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় সাক্ষাৎ শেষে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছিলেন, কেউ কেউ বলছেন আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যাওয়া উচিত। এমন প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া তাদের বলেছেন, প্রশ্নই আসে না। এ বিষয়ে আমি কোনো অনুমতি দেব না।
এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি মনে করছে, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি এখন সরকারের বিদায়ের ওপর নির্ভর করছে। আন্দোলনে এ সরকারকে বিদায় করতে না পারলে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দরজা খুলবে না। তাই এখন আন্দোলনের মাধ্যমে এ ইস্যুর সমাধান করবে তারা। এজন্য চলমান এক দফার আন্দোলনের সঙ্গে এখন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসা ইস্যুটি জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করতে চান তারা। এতে সরকারবিরোধী আন্দোলন বড় ধরনের মোড় নিতে পারে বলে তাদের বিশ্বাস।
গতকাল সোমবার স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভা হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে সভায় খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। আগামী ৫ অক্টোবর বিএনপি ঘোষিত রোডমার্চ কর্মসূচি শেষ হবে। এর আগেই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে বিএনপি।
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু বলেন, ‘দাবার ঘুঁটি হিসেবে খালেদা জিয়াকে ব্যবহারের চিন্তা তারা কীভাবে করে সেটাই বোধগম্য নয়। সরকারের এ ধরনের চিন্তা বা পরিকল্পনা কোনো কাজে আসবে না।’
উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে বিএনপিপ্রধানের পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদনের ওপর গত রবিবার আইন মন্ত্রণালয় মতামত দিয়ে বলেছে, সাজা স্থগিত থাকাবস্থায় তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর সুযোগ নেই। যদি যেতে হয়, তাহলে সাজা স্থগিতের আদেশ বাতিল করতে হবে। কিন্তু সেটা করে তাকে আবার কারাগারে পাঠানো হবে না বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তবে বিদেশে পাঠানোর অনুমতির জন্য আদালতে যেতে রাজি নয় খালেদা জিয়ার পরিবার ও বিএনপি।
আবার গতকাল নিজ কার্যালয়ে সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাছান চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতি কিংবা আপিল বিভাগে আবেদন করতে পারেন। তবে তার আগে তাকে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জেলে যেতে হবে। রাষ্ট্রপতি বা আপিল বিভাগের খালেদা জিয়ার পরিবার আবেদন করবে না বলে দলীয় আইনজীবী সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশে আইনের শাসন নেই বলেই বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভয়ংকর তামাশা করা হয়েছে। যে নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়া এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন, সেখানে বলা হয়েছে, তাকে “দেশে চিকিৎসা নিতে হবে”, তার বদলে “দেশে বা বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারবেন” বলাই যথেষ্ট। এর বাইরে দলের পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নেই।’
এদিকে চিকিৎসক সূত্র জানা গেছে, বর্তমানে খালেদা জিয়ার অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। গতকাল তার আলট্রাসনোগ্রাম ও ইকো করা হয়েছে।
তিনি জাতির পিতার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য প্রণীত আইনের অধীনে ধানমন্ডিতে যে বাড়ি পেয়েছিলেন শেখ রেহানা, বিএনপি ক্ষমতায় এসে সে বাড়ি উচ্ছেদ করে। সেখানে পুলিশ ফাঁড়ি করছে আর ‘লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে’ সেই পুলিশ ফাঁড়ি উদ্বোধন করেছে খালেদা জিয়া। ছেলে কোকোর মৃত্যুর পর তাকে (শেখ হাসিনা) খালেদা জিয়ার বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি না দেওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা কীভাবে খালেদা জিয়ার জন্য আমার কাছ থেকে আরও সহানুভূতি আশা করে।’
লন্ডনের মেথোডিস্ট সেন্ট্রাল হল ওয়েস্টমিনস্টারে তার সম্মানে আয়োজিত একটি কমিউনিটি সংবর্ধনায় তিনি এসব কথা বলেন।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, গণতন্ত্রের কথা বলা বিএনপির পক্ষে শোভা পায় না কারণ তারা জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে ধোকাবাজি খেলেছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি একটি প্রহসনমূলক নির্বাচন করে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার দেড় মাসের মধ্যেই দেশের জনগণ তাদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে। তিনি বলেন, দেশের জনগণ কখনই ভোট কারচুপিকারীদের ক্ষমতায় বসতে দেয় না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার প্রধান হিসেবে তার ওপর ন্যস্ত নির্বাহী ক্ষমতা দিয়ে এতিমদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতির মামলায় কারাদণ্ড স্থগিত করার পর খালেদা জিয়াকে তিনি বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে তার কিছুই করার নেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি আইন অনুযায়ী যা করতে পারেন তাই করেছেন। অনেকেই এখন যুক্তি দিচ্ছেন, ‘আইন নিজের গতিতে চললেও খালেদা জিয়ার প্রতি আমি বেশি সহানুভূতি দেখাতে পারি’।
অনুষ্ঠানের মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এবং আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান শরীফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজেদুর রহমান ফারুক।
উত্তর-পূর্ব পাকিস্তানে একটি অঙ্গ পাচারকারী চক্রের আট সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, পুলিশ বলছে। চক্রটির নেতা ফাওয়াদ মুখতারের বিরুদ্ধে ৩০০ জনেরও বেশি মানুষের কিডনি চুরি করে বের করে ধনী গ্রাহকদের মধ্যে প্রতিস্থাপন করার অভিযোগ রয়েছে।
মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা বিবিসি নিউজ।
বিবিসি জানায়, অস্ত্রোপচারের সময় রোগীর দেহ থেকে কিডনি সরিয়ে ফেলা এবং ধনী গ্রাহকদের কাছে বিক্রির অভিযোগে ফাওয়াদ মুখতার নামের এক চিকিৎসক ও তার দলের আট সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছে পাকিস্তান পুলিশ। ফাওয়াদ এ পর্যন্ত তিন শতাধিক রোগীর কিডনি চুরি করেছেন।
এমনকি অস্ত্রোপচারকালে কিডনি চুরির সময় তার হাতে অন্তত তিনজন রোগী মারা গেছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
ফাওয়াদ এর আগে পাঁচবার অসদাচরণের জন্য গ্রেপ্তার হলেও প্রতিবারই জামিন নিয়ে মুক্তি পেয়ে যান। রোববার (১ অক্টোবর) পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোর থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানায় পাকিস্তান পুলিশ। চক্রটি পূর্ব পাঞ্জাব প্রদেশের পাশাপাশি পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে কাজ করছে বলে ধারণা করছে পুলিশ।
পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মহসিন নকভি রবিবার একটি সংবাদ সম্মেলনে জানান, “কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টগুলি বিভিন্ন ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবনকে ক্লিনিক আকারে সাজিয়ে সেখানে রোগীদের অস্ত্রোপচার করার সময় রোগীদের অজান্তেই কিডনি সরিয়ে নেয়া হত।“
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ফাওয়াদ মুখতার জানিয়েছেন, তার নেতৃত্বাধীন চক্র এখন পর্যন্ত মোট ৩২৮ রোগীর দেহ থেকে কিডনি চুরি করেছে। প্রতিটি কিডনি বিক্রি হয়েছে ১ কোটি রুপি করে।
২০১০ সালে মানবদেহের প্রত্যঙ্গ ব্যবসা নিষিদ্ধ করে পাকিস্তান। এ অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও মোটা অঙ্কের জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বিএনপি নেতারা।
তারা বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জার্মানিতে নেওয়ার কথা ছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সে সময় শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়। এবার চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছি। জার্মানিতে খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে আমরা তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাব। জার্মানিতে তার ভালো চিকিৎসা হবে।’
এর অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খালেদা জিয়া ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে তার লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে আসছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লিভার সিরোসিসের কারণে খালেদা জিয়ার হৃদ্যন্ত্র ও কিডনির জটিলতা বেড়েছে। তিনি হাসপাতালে কখনো কিছুটা ভালো থাকছেন, পরক্ষণেই তার স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। ফলে তাকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘লিভার সমস্যার কারণে ম্যাডামের শ্বাস কষ্ট হয়। ইতোমধ্যে তাকে দুইবার করোনারী কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রাখা হয়েছিল। লিভার প্রতিস্থাপন করতে পারলে শ্বাসকষ্টটা হতো না।’
এদিকে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষণ না থাকায় তার পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি এখন সামনে এসেছে।
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়া হতে পারে এমন খবরে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও খোঁজখবর নিচ্ছেন জার্মান বিএনপি নেতারা।
জার্মান বিএনপির সভাপতি আকুল মিয়া বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জার্মানিতে ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হতে পারে বলে জানতে পেরেছি। আমরা খুবই খুশি। কারণ জার্মানিতে আসলে আমরা তার চিকিৎসার বিষয়ে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারব। চেয়ারপারসনের যে চিকিৎসা দরকার তা সকল ব্যবস্থা জার্মানিতে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ম্যাডামের মুক্তি, তার উন্নত চিকিৎসা ও গণতন্ত্র ফেরাতে দেশে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে জার্মানিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। আগামী ৯ অক্টোবর আমাদের কর্মসূচি রয়েছে। জার্মান বিএনপির উদ্যোগে রোডমার্চ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করব জার্মান পার্লামেন্টের সামনে। ’
আকুল মিয়া বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যখন বিদেশে নেওয়ার আলোচনা চলছিল তখনও জার্মানিতে নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়েছিল। সে সময় তারেক রহমানের সেবা করতে না পারলেও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সেবা করতে পারব বলে আশা করছি। তার চিকিৎসা জার্মানিতে করতে পারলে আমরা ধন্য হবো।’
গত ২৫ সেপ্টেম্বর সোমবার খালেদা জিয়ার ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনি মতামত জানতে চেয়ে আবেদনের কপি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। খালেদা জিয়ার ভাইয়ের আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃতিক বিস্ময় হাওরের ওপর অত্যাচারের যেন শেষ নেই। ধান-মাছের এই বিপুল ভান্ডার রক্ষার নামে একদিকে চলে স্থায়ী-অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি; যার কারণে যখন-তখন হাওরডুবিতে ঘটে ফসলহানি। পাশাপাশি আরেক দিকে চলে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের নামে অবৈজ্ঞানিকভাবে যত্রতত্র বাঁধ-রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের ধুম; ফলে পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মরতে বসেছে হাওর। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে শেষমেশ সরকারপ্রধান হুকুম দিয়েছেনে ‘হাওরে আর কোনো সড়ক নয়।’
এই পরিস্থিতিতে দেশ রূপান্তরের চোখে ধরা পড়েছে আরেক অশনিসংকেত। এবার শিল্পপতিদের চোখ পড়েছে হাওরে। কোথাও কোথাও থাবাও পড়তে শুরু করেছে। তেমনি সব ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে ভাটি অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হবিগঞ্জ জেলার সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে। এখানে গড়ে উঠেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদনের কারখানা। তৈরি হচ্ছে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প। হাওরের ‘লিলুয়া’ বাতাসে এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে কারখানার দুর্গন্ধ। ‘চান্নি পসর রাইতে’ এখন আর শোনা যায় না বাউলকণ্ঠের দরদি সুর। প্রায় দিনই শিল্পপতিদের আনাগোনার অশুভ পদধ্বনি শুনতে পান হাওরবাসী।
অথচ যেকোনো ধরনের স্থাপনা তৈরি বা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য হওরের স্বাভাবিক পরিবেশ ও জীবনাচরণ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখার নির্দেশনা আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। গত ১৮ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে হাওর অঞ্চলের সড়কগুলো এলিভেটেড করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপর থেকে হাওরাঞ্চলে কোনো সড়ক করতে হলে এলিভেটেড পদ্ধতিতে করতে হবে, যাতে সেখানকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা পায়। সরকারপ্রধানের এমন নির্দেশের পরও থামেনি হাওর ধ্বংসের তৎপরতা।
হাওরে জমি কেনাবেচার হিড়িক
বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট বাজারের অদূরে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের নিচু জমি ভরাট করে বিশাল আকৃতির ছয়টি শেডসহ অনেক স্থাপনা নিয়ে ‘কাজী ফার্ম’ গড়ে তুলেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদন কেন্দ্র। উপজেলার বাগদাইরসহ আরও কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, উপজেলা ও জেলা সদরে যাতায়াতের একমাত্র পথের ধারেই কাজী ফার্মের এই প্রতিষ্ঠান। এখনই নাকে কাপড় দিয়ে দ্রুত পার হতে হয় রাস্তা; আর প্রতিদিন প্রায় ১২ লাখ ডিম উৎপাদনের এই বিশাল কারখানাটি পুরোপুরি চালু হলে দুর্গন্ধে বসবাস করা যাবে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন এলাকাবাসী। স্নানঘাট ভূমি কার্যালয় থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ১৯ একর ৮০ শতক জমি নামজারি হয়েছে। আরও কয়েক একর জমি কিনেছে তারা, যা নামজারির অপেক্ষায়।
গত ১৮ জুন হাওর লাগোয়া বাগদাইর গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হয় স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের সদস্য আলেকজান বিবির সঙ্গে। তিনিসহ আরও কয়েকজন নারী-পুরুষ দেশ রূপান্তরকে বললেন, হাওরের ফসলি জমি ভরাট করে এ ফার্মটি গড়া হয়েছে। এভাবে শিল্প গড়ে উঠলে হাওরের অস্তিত্ব বিলীন হতে আর সময় লাগবে না।
স্থানীয় লিটন মিয়া বললেন, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের ইলাম এলাকায় আকিজ গ্রুপেরও ১৮ বিঘা জমি রয়েছে। উঁচু পাড় বেঁধে আপাতত মাছ চাষ করছে তারা। আগে জমিটির মালিক ছিলেন সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির চৌধুরী। আব্দুল কাদির চৌধুরী জানান, পাঁচ-ছয় বছর আগে তার নিজের জমি ছাড়াও আশপাশের আরও ৫০ বিঘা জমি কিনেছে আকিজ গ্রুপ। আপাতত পুকুর করেছে। ভবিষ্যতে কী করবে, কোম্পানিই জানে।
দীর্ঘদিন ধরে জমি কেনাবেচায় মধ্যস্থতা (দালালি) করেন হারুন মিয়া। তিনি জানান, শুকনো মৌসুমে মাসের ১০ দিনই তাকে হাওরে জমি দেখাতে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন শিল্পপতির সঙ্গে তার মাধ্যমে জমির মালিকদের কথাবার্তা চলছে।
একই পেশার আলী আমজদ বলেন, ইদানীং গুঙ্গিয়াজুরী হাওর এলাকায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লোকজনের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। সালাউদ্দিন নামে ঢাকার এক বাসিন্দা গত মার্চে বন্ধুদের নিয়ে হাওর ঘুরে গেছেন। রাস্তার পাশে তিনি কমপক্ষে ১৫-২০ একর জমি কিনতে চান। তার সঙ্গে আলাপ করে আমজাদ যা বুঝতে পেরেছেন, জমিতে তারা সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে আগ্রহী।
লন্ডনপ্রবাসী নাঈম চৌধুরী জানান, তার ১২ বিঘা জমি কেনার জন্য দামদর ঠিক করেন ঢাকার ব্যবসায়ী জুয়েল খান। সবকিছু ঠিকঠাক করার পর অজ্ঞাত কারণে তিনি সরে যান। নাঈম চৌধুরী পরে জানতে পারেন, কমিশন নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় আইনি পরামর্শক জুয়েল খানকে নিরুৎসাহিত করেন।
হাওর গ্রাসের যত কৌশল
নিচু এলাকা হওয়ায় হাওরে জমির দাম তুলনামূলক কম। এখনো এক বিঘা (৩৩ শতক) জমি ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে বেচাকেনা হয়। পুটিজুরী গ্রামের বাসিন্দা টেনু মিয়া বলেন, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলা অংশে গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই-চার কিলোমিটার দূরেই ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, বিবিয়ানা গ্যাস কূপ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। আবার হাওর এলাকা স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারিও তেমন থাকে না। ফলে ড্রেজিং মেশিন দিয়ে জমি থেকে বালু তুলে অন্য অংশ ভরাট করে ফেলা সহজ হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ভরাট করা হয়। এভাবে সহজেই হাওরের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ফেলা হয়।
স্থানীয় নবীর হোসেন বলেন, জমির শ্রেণি পরিবর্তনের অনুমোদন নেওয়া সময়সাপেক্ষ ও বেশ ঝামেলার কাজ। নবীগঞ্জ ও বাহুবল ভূমি অফিসের কয়েকজন তহশিলদারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে তাদের না জানিয়েই শিল্পপতিরা সব কাজ সেরে ফেলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী কৃষিজমিতে শিল্প বা আবাসিক এলাকা তৈরির জন্য জমি কেনার আগেই জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হয়। আবেদনটি প্রথমে জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে পাঠাবেন। ইউএনও তখন উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে প্রতিবেদন চাইবেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (তহশিলদার) সরেজমিন পরিদর্শন এবং কৃষি, মৎস্য ও বন বিভাগের মতামত পাওয়ার পর জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবেন। এর পর জেলা প্রশাসক সেই অনুমোদন দিতে পারেন।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কোনো অনুমোদনেরই তোয়াক্কা করেন না শিল্পপতিরা। আবার কেউ জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন করলে তখন চাপের মুখে স্থানীয় প্রশাসনকে শিল্পপতিদের পক্ষেই প্রতিবেদন দিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরেজমিন পরিদর্শনে ভূমির যে শ্রেণি পাওয়া যায়, সেই মোতাবেক ভূমি কর আদায় করে নতুন শ্রেণির বৈধতা দিয়ে দেওয়া হয়।
শিল্পপতিরা রাস্তার পাশে প্রথমে এক-দুই একর জমি একটু বেশি দাম দিয়ে কিনে পরে পেছনের জমি প্রায় পানির দরে কেনেন বলে জানান স্নানঘাট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার আবুল কালাম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, সাধারণত শিল্প মালিকরা দালাল দিয়ে জমি কিনতে চান। কারণ, তারা সরাসরি কিনতে এলে দাম বেশি চাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আরেক মধ্যস্থতাকারী শামসু মিয়া বলেন, ‘বেশি জমি কেনার ইচ্ছা থাকলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। আমরা কম দামে কিনে দিয়ে বেশি কমিশন নেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ, আমাদের আয়ের একটা অংশ ভূমি শাখার কর্মকর্তাদেরও দিতে হয়। নইলে জমির কাগজপত্র যত স্বচ্ছই হোক, তারা “ঘিয়ের মধ্যে কাঁটা” বের করার চেষ্টা করেন।’
এ ছাড়া স্থানীয় বা বহিরাগতদের উদ্যোগে পুকুরের নাম করে হাওর এলাকার যেখানে-সেখানে মাটি খনন করা হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, আইন বা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ড্রেজার বসিয়ে কৃষিজমি থেকে দেদার বালু তোলা হচ্ছে।
জমি নিয়ে লুকোচুরি
হবিগঞ্জের ১৩টি হাওরের মোট আয়তন ৭৩ লাখ ৫৭৯ একর। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের অবস্থান জেলার বাহুবল, নবীগঞ্জ, বানিয়াচঙ্গ ও সদর উপজেলা ঘেঁষে। এই হাওরে কী পরিমাণ জমি ছিল বা এখন কতটুকু আছে, তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায়নি সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেও।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সর্বশেষ হিসাবে, এই হাওরের জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ৮৩৩ একর। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ৬৪ হাজার ২২০ একর। ৮ বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৭ সালে পরিসংখ্যান বিভাগের প্রকাশিত হিসাবে হাওরের আয়তন দেখানো হয়েছে ১৬ হাজার ৪২৯ একর। জেলা মৎস্য অফিস জানিয়েছে, এই হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৩৯৯ একর ৪ শতক। চারটি অফিসের কর্মকর্তারাই তাদের হিসাব সঠিক বলে দাবি করছেন। আরেকটি রহস্যময় বিষয় হলো, চারটি উপজেলা ঘেঁষে এই হাওরের অবস্থান হলেও ওই চার সরকারি প্রতিষ্ঠানই বানিয়াচঙ্গ ছাড়া বাকি তিন উপজেলার হিসাব দেখাচ্ছে।
১০ বছর আগে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে জমির পরিমাণ কত ছিল জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এক মাস সময় নিয়েও কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
ওদিকে ২০১৬ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন হাওর ও জলাভূমি অধিদপ্তরের প্রকাশিত ‘ক্লাসিফিকেশন অব ওয়েটল্যান্ড অব বাংলাদেশ ভলিউম-৩’-এ দেখা যায়, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের মোট আয়তন ৬৯ হাজার ৮২৯ একর ৩৭ শতক। এর মধ্যে বাহুবল উপজেলায় ৩০ হাজার ১৫৬ একর ২০ শতক, বানিয়াচঙ্গ উপজেলায় ১৭ একর ২০ শতক, হবিগঞ্জ সদর ১৫ হাজার ৯০১ একর ৮৬ শতক ও নবীগঞ্জে ২৩ হাজার ৭৫৩ একর ৯৯ শতক।
হাওর এলাকায় দিনে দিনে জনবসতি বৃদ্ধি, হাজার হাজার পুকুর তৈরি, জমি ভরাট করে শিল্প-কারখানা স্থাপনের কারণে আগের চেয়ে এখন কৃষিজমির পরিমাণ অনেকটাই কমে আসছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. নূরে আলম সিদ্দিকী।
গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের আওতাধীন বাহুবল উপজেলার সাতকাপন ও স্নানঘাট ইউনিয়নের ছয়টি মৌজার নাম উল্লেখ করে গত ১০ বছরে কী পরিমাণ জমি বিক্রি করা হয়েছে, উল্লিখিত সময়ে জমির মূল্য কত ছিল জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার সুশান্ত ঘোষ এবং জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মৌজা হিসাব করে জমি কেনাবেচার তথ্য সংরক্ষণ করা হয় না। এসব উত্তর দিতে হলে প্রতিটি দলিল তল্লাশি করে বের করতে হবে, যা ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ।’
আবেদন-অনুমোদন খেলা
স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জানান, কাজী ফার্মের বিক্রি হওয়া জমির মধ্যে ৭৮ বিঘায় আগে তারা বর্গাচাষ করেছেন দীর্ঘদিন। ২০১৮ সালের দিকে জমির মালিকরা কাজী ফার্ম লিমিটেডের কাছে বিক্রি করে দেন। পরে কাজী ফার্ম প্রায় দুই বছর ধরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তুলে পুরো জমি উঁচু করে নেয়। তবে নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, এই জমির আগের মালিকের দলিল এবং বর্তমানে কাজী ফার্মের দলিল- দুই জায়গাতেই এটি এখনো ‘কৃষি’ শ্রেণি হিসেবেই আছে।
সরেজমিনে জানা যায়, চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের তলদেশ থেকে বালু তুলে বাহুবলে নির্মাণাধীন কয়েকটি স্থাপনা ও ছয় লেনের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করতে স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা মৎস্যজীবী লীগের নেতা তাজুল ইসলাম একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। হাওরে থাকা তার জমিতে ‘দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য’ বানানোর কথা বলে মাটি কেটে পাড় তৈরির অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন তিনি। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান এ বিষয়ে ইউএনও ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) প্রতিবেদন দিতে বলেন। অভিযোগ উঠেছে, ওই সিন্ডিকেট বাহুবল উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তাদের পক্ষে প্রতিবেদন করায়। প্রতিবেদন পেয়ে কয়েকটি শর্ত দিয়ে জেলা প্রশাসক মাটি কাটার অনুমোদন দেন। বাণিজ্যিক কাজে তাজুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের দীর্ঘদিন ধরে বালু তোলার বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানান স্থানীয় কৃষকরা। এ নিয়ে দেশ রূপান্তরসহ স্থানীয় পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে জেলা প্রশাসন তদন্ত করে এর সত্যতা পায় এবং অনুমোদন বাতিল করে। সরেজমিনে দেখা গেছে, বালু তোলা বন্ধ হলেও এখনো ড্রেজার মেশিন ও পাইপলাইন সরানো হয়নি।
গত ১৪ আগস্ট পরিবেশ অধিদপ্তর, হবিগঞ্জ কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, কাজী ফার্ম বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ডিজাইন না দেওয়ায় তাদের পরিবেশ ছাড়পত্রের আবেদন বাতিল করা হয়েছে। একই দিন জেলা প্রশাসন অফিসের রাজস্ব শাখায় যোগাযোগ করে জানা গেছে, কাজী ফার্ম বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য কোনো আবেদনই করেনি। অফিস সহকারী আব্দুল ওয়াদুদ বিভিন্ন ফাইলপত্র ঘেঁটে ওই কোম্পানির মাধবপুর উপজেলায় কয়েকটি প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন পেয়েছেন।
আব্দুল ওয়াদুদ জানান, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় ৫ একর ৭৪ শতক জমি শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ নামে একটি কোম্পানির আবেদন গত ২৩ জানুয়ারি মঞ্জুর হয়েছে। এ ছাড়া ওই কোম্পানি হাওর থেকে দুই-তিন কিলোমিটর দূরে পশ্চিম ম-লকাপন, হায়দরচক মৌজার ৬টি প্রজেক্টের জন্য প্রায় ৬৩ একর জমি কিনেছে। এগুলোর মধ্যে দুই-একটি বাদে বাকিগুলোর শ্রেণি পরিবর্তন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গড়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য হাওরের দিকেই ধাবিত হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনবে।
শিল্পপতি পক্ষের ভাষ্য
জানতে চাইলে কাজী ফার্মের ম্যানেজার (অ্যাডমিন) জিয়াউল হক দেশ রূপান্তরের কাছে দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা আছে। গত ৭ আগস্ট মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে জিয়াউল হক জানান, বাহুবল স্নানঘাটে তাদের প্রতিষ্ঠানে ডিম উৎপাদন পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। এখানে লেয়ার মুরগির ডিম ছাড়াও কম্পোস্ট সার উৎপাদন হবে। এসব মুরগি খুবই স্পর্শকাতর। পরিবেশ একটি বড় বিষয়। যদি এখানকার পরিবেশ অনুকূলে থাকে, তাহলে আরও কী কী উৎপাদন করা যাবে তা পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বায়ুদূষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশে^র নামকরা প্রতিষ্ঠান জার্মানির ‘বিগ ডাচম্যান’-এর সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। ফলে প্রকট দুর্গন্ধ বেরোনোর শঙ্কা খুবই কম। তবে তিনি এও বলেন, সব প্রাণীর শরীরেই গন্ধ থাকে। লাখ লাখ মুরগি যেখানে থাকবে, সেখানে কিছু গন্ধ তো হবেই।
মুরগির বিষ্ঠা সংরক্ষণের ব্যাপারে জিয়াউল হক বলেন, এর গন্ধ বের হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে গন্ধ দূর করা হয়। হাওরের জমি ভরাট করে শিল্প গড়ার আইনি দিক সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছাড়া এ-সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়।’
গত ২৪ আগস্ট বাহুবল উপজেলার আব্দাকামাল এলাকায় আকিজ ভেঞ্চার গ্রুপের নির্মাণাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্থানীয় ম্যানেজার (অ্যাডমিন) হাবিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, উপজেলার পুটিজুরী, সাতকাপন, স্নানঘাট ইউনিয়নের বিভিন্ন মৌজায় আকিজ গ্রুপের জমি রয়েছে। বর্তমানে আব্দাকামাল এলাকায় প্রায় ৬৫ একর জমিতে বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনের কাজ চলছে। গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই কিলোমিটারের মতো দূরে এই ‘শিল্পপার্ক’ নির্মাণের পর হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় তাদের আরও যে ৫৭৪ শতক জমি রয়েছে, তাতে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প গড়ে তোলা হবে। তিনি দাবি করেন, ইতিমধ্যে প্রশাসনের কাছ থেকে তারা জমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছেন।
‘খুবই অন্যায় হবে’
পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, হাওরে নিচু জমি ভরাট করে যদি শিল্প গড়া হয়, তাহলে পরিবেশের ওপর খুবই অন্যায় করা হবে। প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে হাওরের পানি প্রবাহ ও পানি ধরে রাখার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে এমন অবকাঠামো করা যাবে না। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের সময় হাওরের পানি প্রবাহ যাতে সঠিক থাকে, এ জন্য তিনি সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডিকে।
তিনি আরও বলেন, ‘উজান থেকে নেমে আসা পানির সঙ্গে বালু আসার ফলে অধিকাংশ হাওরের বুক বালুমাটি এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। হাওর ও বিলগুলোকে পুনঃখনন করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। এখন সেখানে যদি মাটি ভরাট করে শিল্প গড়া হয়, সেটা কখনোই কাম্য নয়।’
লাক্সারিয়াস জীবন পাওয়ার জন্য এখন মানুষ দিনরাত শুধুই কাজ করে চলেছেন। যার মধ্যে অফিস ডেস্কে বসে কাজ করেন এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চেয়ারে বসে ল্যাপটপের সামনে তাকিয়ে থাকা রীতিমতো যন্ত্রণাদায়ক।
শুধু তাই নয়, এটা স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। যারা অফিসে ডেস্কে কাজ করেন তাদের মোটা হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
সারাদিন যারা ডেস্কে বসে কাজ করেন তাদের অন্যতম অভিযোগও এটি। তারা বলে থাকেন, চেয়ারে বসে কাজ করে মোটা হয়ে যাচ্ছি! তবে এই অজুহাতকে একেবারে সত্য বলার সুযোগ নেই। কারণ ডেস্কে বসে কাজ করেও স্লিম ও ফিট থাকা সম্ভব। এজন্য মেনে চলুন পাঁচটি টিপস।
হাঁটুনফিট ও কর্মক্ষম থাকতে নিয়মিত হাঁটুন। দিনের পর দিন দীর্ঘ সময় বসে থাকলে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। সুস্থ থাকতে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করুন। এমনকি কাজের ফাঁকেও ১০ মিনিটের ব্রেক নিয়ে হেঁটে আসতে পারেন।
সোজা হয়ে বসুনচেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসুন। মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলোতে অনেক চাপ পড়ে, সেই সঙ্গে চাপ পড়ে মেরুদণ্ডের পাশের মাংসপেশি ও লিগামেন্টের ওপর। কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় মনিটরটি চোখের সমান স্তরে রাখুন। মাউস ব্যবহার করার সময় শুধু আপনার কব্জি নয় পুরো হাত ব্যবহার করুন।
চাপ এড়িয়ে চলুনএটা খুব কঠিন কাজ, চাপমুক্ত থাকা। বিশেষ করে যখন চারপাশ থেকে নানা ধরনের চাপ আসতে থাকে। তবে মানসিক স্থিরতা ধরে রাখুন, নিজেকে মোটিভেট করুন। কোনও চাপই বেশি দিন থাকে না, এগুলো নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট না করে নিজের কাজে মনোযোগ বাড়ান। এক্ষেত্রে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে অনলাইনে কিছু যোগা শিখে অভ্যাস করুন।
চোখের যত্নকম্পিউটারে কাজ করার সময় স্ক্রিনে একটানা ১০-১৫ মিনিটের বেশি তাকিয়ে থাকবেন না। নিয়মিত চোখের পাতা ফেলুন। স্ক্রিনে পর্যাপ্ত আলো রাখুন, যেন চোখের ওপর বাড়তি চাপ না পড়ে।
হাড়ের যত্ন বসে থাকার ফলে হাড় দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ক্যালসিয়ামের ঘাটতিও হতে পারে। এজন্য নজর দিতে হবে প্রতিদিনের খাবারে স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে নিয়মিত ডিম, দুধ, দই ও বাদাম রাখুন।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কোন দেশে ভালো চিকিৎসা হতে পারে তার খোঁজ নিচ্ছে বিএনপি। এর অংশ হিসাবে ঢাকায় জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসা জার্মানিতে হতে পারে কিনা জানতে চেয়েছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। মঙ্গলবার জানতে চাইলে ঢাকায় জার্মানির সিডিএ জান রল্ফ জানোস্কি বলেছেন, ‘মির্জা ফখরুলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। মিসেস জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার ধরন সম্পর্কে জেনেছি। তার ভালো চিকিৎসা বিশ্বের খুব কম দেশে সম্ভব। জার্মানিতে এসব সমস্যার খুব ভালো চিকিৎসা আছে। সরকারের অনুমোদন পেলে তিনি জার্মানিতে চিকিৎসা নিতে পারেন।’ এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি তিনি।
৯ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়লে খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর লিভারের জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কিডনির কর্মক্ষমতা কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ফলে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এ কারণে কয়েকবার তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করা হয়েছিল। এখন কেবিনে মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) লিভার, কিডনি, হার্ট, ফুসফুসসহ সার্বিক অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণে সম্প্রতি দুবার সিসিইউতে নিতে হয়। এখন মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন। ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ।
তিনি আরও জানান, মেডিকেল বোর্ড মনে করে সর্বসম্মতভাবে তাদের পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অতি দ্রুত বিদেশে লিভার প্রতিস্থাপনে সম্মিলিত আধুনিক মাল্টি ডিসিপ্ল্যানারি মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া জরুরি। তাহলেই তিনি শঙ্কা মুক্ত হতে পারেন বলে বোর্ড রিকমেন্ডেশনে বলেছেন।
এর আগে ১৩ জুন রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ওই সময় ৫ দিন পর তিনি বাসায় ফেরেন। গত বছরের জুনে খালেদা জিয়ার এনজিওগ্রাম করা হলে তার হৃদযন্ত্রে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর একটিতে রিং পরানো হয়। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রারাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ও হৃদরোগে ভুগছেন।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। এ অবস্থায় তাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে উন্নত চিকিৎসায় বিদেশে পাঠানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিবারই সরকার সেসব আমলে না নিয়ে খালেদা জিয়াকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখন দলীয় ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। আগের মতোই লিভারের জটিলতার পাশাপাশি ফুসফুসের জটিলতা নিয়ে শঙ্কিত তার চিকিৎসকরা। মেডিকেল বোর্ডের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার ফুসফুস থেকে পানি বের করা হয়েছে। শরীরে ক্যাথেডর লাগানো হয়েছে। আগে যেখানে দুই-তিন দিন পরপর পানি বের করা হয়েছে, এখন প্রতিদিনই পানি বের করতে হচ্ছে। তার কেবিনে মঙ্গলবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়েছে। ওই চিকিৎসক আরও বলেন, খালেদা জিয়ার অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি নেই। লিভার সিরোসিসের সঙ্গে কিডনির জটিলতাও বাড়ছে। তার লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া সামনে বিকল্প নেই। এর জন্য খুব দ্রুত উন্নত চিকিৎসায় বিদেশ পাঠানো দরকার।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা খুবই গুরুতর। গত সোমবার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন তার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। আবেদনটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ে আছে। গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত তাকে অনুমতি দেওয়ার কোনো খবর পাওয়া যায়নি বলে খালেদা জিয়ার একান্ত সহকারী জানিয়েছেন।
পাশাপাশি সরকারের অনুমতি পেলে দ্রুততম সময়ে তাকে বিদেশে নিতে ভিসা-প্রক্রিয়া শুরু থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ প্রয়োজনীয় সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। সরকারের সবুজ সংকেত না পাওয়ায় ভিসা করানো যাচ্ছে না।
গতকাল শুক্রবার দেশ রূপান্তরকে এসব কথা জানিয়েছেন খালেদা জিয়ার মেজো বোন সেলিমা ইসলাম।
তিনি বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালের খোঁজখবর নিচ্ছেন যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান। শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ থাকলে প্রথমে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হতে পারে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নত হলে অন্য দেশে নেওয়া হবে।
সেলিমা ইসলাম বলেন, ‘আমার বোন হেঁটে জেলে গেলেন। জেলে থাকাবস্থায় অসুস্থ হলে তাকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। এরপর করোনার কারণে সরকার তাকে দুটি শর্তে মুক্তি দেয়। তখন থেকেই আমরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে আবেদন করে আসছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার তাকে মুক্তি দেয়নি। বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে না পারায় দিনের পর দিন তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে আমার বোন।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী এবিএম আব্দুস সাত্তার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি নেতারা সার্বক্ষণিক চেয়ারপারসনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আমরা সরকারের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে আমরা দ্রুততম সময়ে চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠাতে পারব।’
জিয়া পরিবারের সদস্যরা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য তারা সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। অনুমতি পাওয়া মাত্র সব ধরনের পদক্ষেপ নেবেন। ইতিমধ্যে ভিসা প্রস্তুতিসহ অন্যান্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। বিদেশে নেওয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ অন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে যাবেন তার পুত্রবধূ শর্মিলা রহমান, ব্যক্তিগত সহকারী ফাতেমা ও ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসেন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি। তখন থেকেই তিনি হাসপাতালে খালেদা জিয়ার সেবায় সার্বক্ষণিক থাকছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আজ (গতকাল শুক্রবার) ম্যাডাম শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে বিকেলে তাকে তৃতীয়বারের মতো কেবিন থেকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নেওয়া হয়। রাতে আবার তাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। এর আগে ২২ সেপ্টেম্বর তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা অবনতি হওয়ায় হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে সিসিইউতে নেওয়া হয়েছিল। পরে অবস্থার উন্নতি হলে তাকে ফের কেবিনে স্থানান্তর করা হয়।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত চিকিৎসক দলের সদস্যরা জানান, খালেদা জিয়া ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। একই বছরের নভেম্বরে তার চিকিৎসকরা জানান, তিনি লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত দলীয় মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা তখন জানিয়েছিলেন, তাদের সাধ্য অনুযায়ী যতটুকু করার ছিল, তারা তা করেছেন। পরবর্তী চিকিৎসা যুক্তরাজ্য, জার্মানি অথবা যুক্তরাষ্ট্রে করার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পরিবারকে বলেছেন। পরের বছর জুন মাসে খালেদা জিয়ার হার্টে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর মধ্যে একটিতে রিং পরানো হয়। এখনো তার হার্টে দুটি ব্লক রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পাশাপাশি আমরা বিএনপি নেতারা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চেয়ারপারসনের পরিবারকে সার্বিক সহযোগিতা দিতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে দ্রুতই চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠানো হবে।’
গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহিলা দলের উদ্যোগে আয়োজিত সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘যে মানুষটি আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, তাকে আজ সরকার গৃহবন্দি করে রেখেছে। তিনি গুরুতর অসুস্থ হলেও তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। আমরা আশা করি, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে তার পরিবার যে আবেদন করেছে, তা সরকার বাস্তবায়ন করবে।’
সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ এক দফা দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে আটক রাখা হয়েছে। কারণ উনি মুক্ত থাকলে ওনাদের ক্ষমতায় থাকা কঠিন হয়ে যাবে। উনি মুক্ত থাকলে দেশের গণতন্ত্র মুক্ত থাকবে। উনি মুক্ত থাকলে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে না।’
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী, সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছে। ফলে এখন জেলে যাওয়া বা আদালতের আশ্রয় নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। ওই ৪০১ ধারাতেই বলা আছে, নির্বাহী আদেশে শর্ত ছাড়াই মুক্তি দেওয়া যায়। এমনকি সরকার সাজা মওকুফও করতে পারে। ফলে সরকারই শর্তহীন মুক্তি দিয়ে খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে।’
গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর বিষয়ে দুই-তিন দিন আগে তার ভাই শামীম এস্কান্দার এসেছিলেন। তিনি আবেদন জমা দিলে তা আইনমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে ব্যাখ্যার জন্য।
আবেদনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে থাকা বিএনপি নেতারা।
তারা গত বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছেন। খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। তারাও অপেক্ষা করছেন যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাবেন ওই নেতারা।
খালেদা জিয়াকে জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়ে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশে^র যে কয়েকটি দেশে সম্ভব, জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। এরপর থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এর আগেও অবশ্য খালেদা জিয়াকে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদযন্ত্রে জটিলতা, ফুসফুস, চোখ ও দাঁতের নানা সমস্যায় ভুগছেন। এ ছাড়া তার মেরুদ-, হাত ও হাঁটুতে বাতের সমস্যাসহ আরও কিছু শারীরিক জটিলতা রয়েছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার সাজা হয়। সেদিন থেকে প্রায় দুই বছর কারাবন্দি ছিলেন তিনি। এ ছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আরও সাত বছরের সাজা হয় খালেদা জিয়ার। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ করোনা মহামারির শুরুতে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার সাজা স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দিয়েছিল সরকার। এরপর থেকে তার মুক্তির মেয়াদ ছয় মাস করে বাড়ানো হচ্ছে।