
‘কিন্ডারগার্টেন’ শব্দটি জার্মান। যার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে শিশুদের বাগান। জার্মান শিশু-শিক্ষানুরাগী ফ্রেডরিখ ফ্রোয়েবল ১৮৩৭ সালে ব্যাড ব্ল্যাংকেনবার্গে শিশুদের বাড়ি থেকে বিদ্যালয় পর্যন্ত গমন এবং খেলা ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণের ধারণাকে কেন্দ্র করে এ শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল, শিশুরা উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে প্রতিপালিত হবে এবং ‘শিশুদের বাগান’ হিসেবে কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে বাগানে রোপণকৃত চারাগাছের মতো পরিচর্যা পাবে। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতা কি তাই বলে?
সরকারিভাবে নিবন্ধনের আইন হওয়ার এক যুগ পরও অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয় অনিবন্ধিত রয়ে গেছে। সারা দেশে এসব স্কুলের সঠিক সংখ্যা নিয়ে যেমন অস্পষ্টতা রয়েছে, একইভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাব্যবস্থার তেমন কোনো তদারকি নেই। জীবনের শুরুতেই যখন, সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উন্নাসিকতায় হোঁচট খায় কোমলমতি শিশু তখন বিষয়টি পরিষ্কার আন্দাজ করা যায়।
কর্তৃপক্ষ বলছে, নিবন্ধন ও অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতি ছাড়া বেসরকারি পর্যায়ের কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় চালানো যাবে না। কিন্ডারগার্টেন, নার্সারি স্কুল এমনকি বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয় সংযুক্ত যেসব প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে, সবারই নিবন্ধন নিতে হবে। তাহলে এত বছর, অনিবন্ধিতভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে চলেছে? এর মানে কী, সরকারের কাছে এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কিন্ডারগার্টেন, নার্সারি স্কুল ও বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয় সংক্রান্ত কোনো প্রকৃত তথ্য নেই! দেশে কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা প্রায় ১৮ হাজার ৫০০। আবার কিন্ডারগার্টেন ঐক্য পরিষদ বলছে, এমন স্কুল আছে প্রায় ৬৪ হাজার! ১৯৬২ সালের রেজিস্ট্রেশন অব প্রাইভেট স্কুল অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, ২০১১ সালে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিবন্ধন বিধিমালা প্রণীত হয়। কিন্তু এরপর পার হয়েছে এক যুগ। তবুও এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসা হয়নি। কেন হয়নি, তার উত্তর কে দেবে? দেশ রূপান্তরে শুক্রবার ‘নিবন্ধন ছাড়া চলবে না কিন্ডারগার্টেন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে জানা যাচ্ছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব বলছেন, এ ব্যাপারে আমরা তিন-চার মাস ধরে কাজ করেছি। আইন মন্ত্রণালয় থেকে চূড়ান্ত ভেটিং শেষ হয়েছে। এখন এসআরও নম্বরের জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। এটি পেলে হয়তো আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই গেজেট জারি হয়ে যাবে। এতে আমাদের প্রাথমিক পর্যায়ের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একটা নির্দিষ্ট নিয়মনীতির আওতায় আসবে। এর মানে হচ্ছে এতদিন দেশের এ ধরনের লাখ লাখ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনো সরকারি নিয়মনীতির বাইরেই চলেছে, কিমাশ্চর্য! দেশের প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে এ ধরনের হেঁয়ালিপূর্ণ আচরণই প্রমাণ করে, এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কতটুকু আন্তরিক?
এ কথা সবাই জানেন যে, দেশের প্রতিটি জেলায় অলিগলিতে গজিয়ে উঠেছে কিন্ডারগার্টেন। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এসব প্রতিষ্ঠান পাড়া-মহল্লায় চটকদার ভর্তি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের আকৃষ্ট করছে। অভিভাবকরাও তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তুলে দিচ্ছেন, সেই কিন্ডারগার্টেন কর্তৃপক্ষের হাতে। আবার অনেকেই বলেন কিন্ডারগার্টেন চালাতে আবার সরকারি অনুমতি কীসের? সবাই করছে, আমিও করছি। এভাবেই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে কিন্ডারগার্টেনের নামে ইচ্ছাশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সরকারের কোনো বিধিনিষেধ না থাকায়, এখন কিন্ডারগার্টেন যেন পরিণত হয়েছে এলাকার কোনো ক্লাবে! তাও আবার একটা নয়, একই এলাকায় অনেকগুলো।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব জানাচ্ছেন, বেসরকারি পর্যায়ে প্রায় ৪০ হাজারের বেশি প্রাথমিক স্কুল রয়েছে। এর ৯০ শতাংশই চলছে নিবন্ধন ও অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতি ছাড়া। তবে আমাদের ২০১১ সালের যে বিধিমালা ছিল, তাতে নিবন্ধনের জন্য সচিব পর্যন্ত ফাইল আসতে হতো। এখন এটাকে আমরা সহজ করে দিচ্ছি। উপজেলা শিক্ষা অফিসার তদন্ত করে রিপোর্ট দেবেন এবং এর ভিত্তিতে বিভাগীয় উপপরিচালক নিবন্ধন দেবেন। এখন পর্যন্ত দেশে যত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের বাইরে রয়েছে, তাদের বিষয়ে যেন কঠোর নিয়মনীতি অনুসরণ করেই নিবন্ধন দেওয়া হয়। এ বিষয়ে কোনো ধরনের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি বা জোরজবরদস্তির ঘটনা যাতে না ঘটে সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে সতর্ক থাকতে হবে।
বিদেশ থেকে মূল্যবান জিনিস যা আসে, তার মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে দুটি বিষয়। একটি ডলার, অন্যটি সোনা। দুটোই দেশের রিজার্ভ হিসেবে বিবেচিত। ডলার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে প্রথমত, প্রবাসী শ্রমিকদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা, যা ডলার হিসেবে ব্যাংকে জমা হয়। আর টাকা হিসেবে স্বজনদের হাতে যায়। দ্বিতীয়ত, রপ্তানি, বিশেষত গার্মেন্টস দ্রব্য রপ্তানি। যদিও গার্মেন্টস শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করতে ডলারের প্রয়োজন হয়। আর অন্য যে মূল্যবান দ্রব্য সোনা, তার খনি বাংলাদেশে নেই, কিন্তু প্রতিনিয়ত বিমানবন্দরে যে পরিমাণ সোনা আটক হয় এবং বাংলাদেশ যে পরিমাণ সোনা পেয়ে থাকে তাতে বিমানবন্দরকে সোনার খনি বলে মনে হতেও পারে। এখানে যে সোনা পাওয়া যায়, তা খনি থেকে উত্তোলন করতে হয় না। পরিশ্রম করে সংগ্রহ করতে হয় না। বরং সতর্ক থাকলেই সংগ্রহ করা যায়। ডলার এবং সোনা এই দুই সম্পদ নিয়েই চলছে তুলকালাম কাণ্ড। কারণ রপ্তানির মাধ্যমে যে ডলার আসার কথা তার খানিকটা যাচ্ছে পাচার হয়ে আর বিমানবন্দরে ধরা পড়া সোনা লকার থেকে হচ্ছে চুরি।
সংবাদে প্রকাশিত হয়েছে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শুল্ক বিভাগের গুদামে থাকা একটি লকার থেকে ৫৫ কেজির বেশি সোনা চুরি হয়ে গেছে। ব্যাপারটা যতটা আতঙ্কের তার চেয়েও বেশি সন্দেহের। টার্মিনাল ভবনের ভেতরে সুরক্ষিত স্থান থেকে কীভাবে এমন চুরির ঘটনা ঘটল? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে খুঁজতে হবে অনেক কিছু আর খুলতে হবে অনেক জট। জানা গেছে, শাহজালাল বিমানবন্দরের ভেতরে শুল্ক বিভাগে দুটি গুদাম বা লকার আছে। একটি লকার আছে নিচতলায়। শুল্ক বিভাগের স্ক্যানার দিয়ে যাত্রীদের বের হওয়ার পথে তল্লাশি টেবিলের পাশে। এটি ছোট, এখানে মূলত তল্লাশির সময় তাৎক্ষণিকভাবে জব্দ করা পণ্য রাখা হয়। তবে সোনা বা বেশি মূল্যবান সামগ্রী হলে, সেসব নিয়ে রাখা হয় নিচতলায় ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ শাখার পাশেই শুল্ক হাউজের গুদামে। এই গুদামের ভেতর আলাদা লকার রয়েছে। এখানে অনেক লকার থাকলেও, সোনা চুরি হয়েছে একটি লকার থেকে। সেই লকার থেকে ৫৫ কেজি সোনা গায়েব হয়ে গেছে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদগুলো থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তা থেকে বিষয়টাকে সহজ বা হালকা মনে করার কোনো কারণ নেই।
প্রাথমিকভাবে শুল্ক বিভাগের ভাষ্য অনুযায়ী, চুরি হওয়া এসব সোনা ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময় উদ্ধার করা হয়েছিল। এখানেই বড় প্রশ্ন, এত দিন ধরে এই পরিমাণ সোনা বিমানবন্দরের গুদামে রাখা হয়েছিল কেন?
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধারণা এক দিনে নয়, বিভিন্ন সময়ে লকার থেকে সোনা সরানো হয়েছে। আর সাধারণ মানুষের ধারণা, ভেতরের লোকজন জড়িত না থাকলে এ রকম ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়।
শুল্ক বিভাগ সূত্র থেকে জানা যায়, বিমানবন্দরের ওই গুদাম পাহারায় ২৪ ঘণ্টায় চারটি পালায় (শিফট) তাদের কর্মীরা দায়িত্ব পালন করেন। শনিবার সকালে গুদামের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একজন কর্মী, গুদামে ঢুকে চিৎকার শুরু করেন। তার চিৎকারে এসে দেখা যায়, লকার ভেঙে সোনা চুরি হয়েছে।
একজন কর্মকর্তার বক্তব্য অনুযায়ী, কয়েকদিন আগে গুদামটিতে অটোমেশনের কাজ শুরু হয়েছে। এ কাজের অংশ হিসেবে গুদামে থাকা সোনা গণনা করা হচ্ছে। তার ধারণা, সোনা চুরির ঘটনা আগেই ঘটেছে। গুদামের অটোমেশনের কাজ শুরু হওয়ায় সেটা ধরা পড়বে; তাই লকার ভাঙার ‘নাটক’ তৈরি করা হয়েছে।
দীর্ঘদিন শুল্ক বিভাগে যারা কাজ করেছেন, এনবিআরের কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা হলো, বিমানবন্দর থেকে চোরাচালানের সোনা উদ্ধার হলে সেটার একটা জব্দ তালিকা করা হয়। তারপর যত দ্রুত সম্ভব সেই সোনা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে পাঠানো হয়। তার আগে আরও কিছু দাপ্তরিক কাজ আছে, বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিতে হয়। ব্যাংকের পক্ষ থেকে যেদিন সময় ধার্য করা হয়, সেদিন কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে সোনা বাংলাদেশ ব্যাংকে পৌঁছানো হয়। এই পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সাধারণত এক-দুই দিন লাগে। এর বাইরে যাত্রীদের আনা (ব্যাগেজ রুলের আওতায়) সোনা যদি তারা ঠিকভাবে শুল্ক পরিশোধ করতে না পারেন বা নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি সোনা আনেন, তাহলে তা বিমানবন্দর থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার আগ পর্যন্ত ওই গুদামে রাখা হয়। এসব ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকতা এবং আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে, সোনা ছাড়িয়ে নিতে কখনো কারও কয়েক মাসও লেগে যেতে পারে। সাত-আট মাস বা এক বছরও লেগেছে, এমন উদাহরণও আছে। কিন্তু চুরি হওয়া ৫৫ কেজি সোনার মধ্যে দু-তিন বছর আগের সোনাও নাকি ছিল। এত দিন লকারে সোনা রাখাটা কোনোভাবেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া নয়।
বিমানবন্দর হলো কোনো দেশের সুরক্ষিত এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিমানবন্দরের ভেতরের সব জায়গা সিসি ক্যামেরায় নজরদারিসহ সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার মধ্যে থাকে। শাহজালাল বিমানবন্দরে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্র্তৃপক্ষ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাসহ সরকারি বেশ কয়েকটি সংস্থা সম্মিলিতভাবে কাজ করে। এত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা আর এত শক্তিশালী নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে গুদাম থেকে সোনা চুরি হয়ে যাওয়ার বিষয়টি বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকে প্রশ্নের মুখে আর কর্তব্য অবহেলার বিষয়টিকে সামনে এনেছে।
বিমানবন্দরে সোনা চুরির পাশাপাশি আর একটি খবর নিশ্চয়ই কারও চোখ এড়িয়ে যায়নি। খবর বেরিয়েছে, দেশের ১০টি তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান পোশাক রপ্তানির আড়ালে ৩ কোটি ৫৩ লাখ ৬৬ হাজার ১১৮ ডলার বা প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। ঘটনাটি জানিয়েছে, কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। অধিদপ্তরের দেওয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে এই ১০টি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান হচ্ছে প্রজ্ঞা ফ্যাশন লিমিটেড, ফ্যাশন ট্রেড, এম ডি এস ফ্যাশন, হংকং ফ্যাশন লিমিটেড, থ্রি-স্টার ট্রেডিং, ফরচুন ফ্যাশন, অনুপম ফ্যাশনওয়্যার লিমিটেড, পিক্সি নিটওয়্যারস লিমিটেড, স্টাইলাইজ বিডি লিমিটেড ও ইডেন স্টাইল টেক্স। অভিনব কায়দায় রপ্তানি জালিয়াতির মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্যের চালান বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে, কিন্তু রপ্তানি আয়ের সেই বৈদেশিক মুদ্রা প্রত্যাবসিত হচ্ছে না, এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর তদন্ত করে এই অর্থ পাচারের ঘটনা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে বলে তারা বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন। এই ১০টি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ১ হাজার ২৩৪টি পণ্যচালানে এই জালিয়াতি করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে এ বিষয়ে জানিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো ১ হাজার ২৩৪টি চালানে ৯ হাজার ১২১ মেট্রিক টন রপ্তানি করেছে, যার মূল্য ৩ কোটি ৫৩ লাখ ৬৬ হাজার ১১৮ মার্কিন ডলার (৩০০ কোটি টাকা), কিন্তু এই টাকা দেশে আসেনি। শুল্ক গোয়েন্দারা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্ট দলিল পর্যালোচনা করে দেখেছেন, এসব প্রতিষ্ঠান টি-শার্ট, টপস, নারীদের পোশাক, ট্রাউজার, বেবি সেট, পোলো শার্ট প্রভৃতি পণ্য সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কাতার, সৌদি আরব, নাইজেরিয়া প্রভৃতি দেশে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে রপ্তানি দেখিয়েছে। পণ্য পাঠিয়েছে কিন্তু টাকা আসেনি অর্থাৎ অর্থ পাচার হয়েছে।
আমদানি রপ্তানির ঘাটতি মেটানো, বিদেশি ঋণের সুদ আর আসল শোধ করার জন্য দরকার বৈদেশিক মুদ্রা বা ডলার। এর অন্যতম জোগানদাতা আমাদের দেশের প্রবাসী শ্রমিক। এই আয় কমে গেলে দুশ্চিন্তা আর বাড়লে স্বস্তি। কিন্তু আগস্টে দেশে আসা প্রবাসী আয় বেশ বড় পরিমাণে কমেছে। এ মাসে প্রবাসী আয় এসেছে প্রায় ১৬০ কোটি মার্কিন ডলার, গত বছরের একই মাসে যার পরিমাণ ছিল ২০৪ কোটি ডলার। গত বছরের আগস্ট মাসের তুলনায় এ বছর ২১ দশমিক ৫৬ শতাংশ আয় কম এসেছে। কোনো একক মাসে আয় এত কমে যাওয়ার ঘটনা সম্প্রতি ঘটেনি। প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো বৈধ চ্যানেলে প্রবাসী আয় না আসা। সরকারিভাবে প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয় ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। কিন্তু খোলাবাজারে নগদ ডলারের দাম ক্রমাগত বাড়ছে, গোপনে এবং প্রকাশ্যে ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১৭-১১৮ টাকায়। খোলাবাজার ও সরকার কর্র্তৃক নির্ধারণ করা দামের মধ্যে পার্থক্য অনেক বেশি। এর সুযোগ নিচ্ছে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা। এত পার্থক্য থাকলে আনুষ্ঠানিক মাধ্যমে আসা প্রবাসী আয় বাড়বে না। বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে হয়রানি ও ব্যয়ের বোঝা, বিদেশে গিয়ে স্বল্প মজুরিতে কষ্টকর কাজ করে প্রবাসী শ্রমিকরা। ফলে কোথাও দুটো টাকা বেশি পেলে তারা সেদিকে ঝুঁকবেই। তাই বৈধ চ্যানেলে প্রবাসী আয় আনতে হলে হুন্ডি বন্ধ করতে হবে সরকারকেই।
প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় অর্থনীতিতে সংকট বাড়ার আশঙ্কা আছে। এমনিতেই ডলার সংকট নিয়ে চাপে আছে বাংলাদেশ ব্যাংক, প্রতিনিয়ত কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল যে পরিমাণ রিজার্ভ রাখার শর্ত দিয়েছিল বর্তমানে তার চেয়ে কম রিজার্ভ রয়েছে। ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি ঋণপত্র খোলা বেড়েছে, ফলে আমদানি দায় মেটাতে ভবিষ্যতে আরও বেশি ডলারের প্রয়োজন হবে। আবার সরকারি-বেসরকারি ঋণ পরিশোধ করার জন্যও ডলারের প্রয়োজন বাড়বে। একদিকে দেশের প্রয়োজন বাড়ছে, অন্যদিকে প্রবাসী আয় কমে যাচ্ছে, অর্থনীতির জন্য ব্যাপারটা উদ্বেগজনক। দেশের অর্থনীতির আকার বড় হচ্ছে, মাথা পিছু আয় বাড়ছে এসব সূচক অর্থনীতির জন্য ভালো। কিন্তু যদি জনগণের জীবনে তার ইতিবাচক প্রভাব না পড়ে, তাহলে অসন্তোষ তীব্র হয়ে ওঠে। যখন বৈষম্য, বেকারত্ব এবং মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনে প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে তখন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড আর প্রবৃদ্ধির কাগুজে হিসাব তার কাছে হয়ে পড়ে মূল্যহীন। এর সঙ্গে যদি চুরি, দুর্নীতি আর পাচারের ঘটনা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে তখন এই প্রশ্ন ওঠা তো স্বাভাবিক, এই চুরি দুর্নীতির বোঝা জনগণ আর কতদিন বহন করবে?
লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট
পশ্চিম মিয়ানমারের ‘এনগা ইয়েন্ট চেঞ্জ’ গ্রামের বাসিন্দা আমি। সেখানে একটি সুখী, শান্তিময় শৈশব ছিল। বাবার ছিল সমৃদ্ধ দোকান। আম, নারকেল ও কলা গাছে ঘেরা একটি প্রশস্ত আঙিনার বাড়িতে থাকতাম আমরা। আমি, বাবা-মা এবং ছয়জন ছোট ছোট ভাইবোন। আমার শৈশবে কোনো সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দেখিনি। মুসলিম হলেও প্রতিবেশী রাখাইনদের সঙ্গে বড় কোনো সমস্যা ছিল না। পাশের রাখাইন গ্রামে অনেক বন্ধু ছিল। গ্রামের মাঠে আমাদের দেখা হতো। আমরা ‘চিনলোন’ খেলতাম। অনেক মজা করতাম। আশা ও আনন্দে ভরা সুন্দর জীবন আজ কেবল অস্তপারের স্মৃতি। ছয় বছর ধরে সীমান্তের ওপারের বাংলাদেশের কক্সবাজার নামক একটি শরণার্থী শিবিরে বাস করছি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির বোধহয় এটাই। লক্ষাধিক মানুষ গাদাগাদি করে বাঁশ ও তেরপলি নির্মিত ক্ষুদ্র আশ্রয়ে মাথা গুঁজে আছে। প্রতিটি মুহূর্ত যেন সংগ্রামের। পর্যাপ্ত খাবার বা বিশুদ্ধ পানি তেমন থাকে না। প্রায়ই আগুন লাগছে, খুন হচ্ছে।
কীভাবে এখানে এসে পৌঁছলাম?
এর পেছনে দায়ী ফেসবুক এবং প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ। তারা পরিস্থিতি উস্কে দিয়েছে, ফলে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী আমাদের ওপর হামলে পড়েছে। তার পেজগুলো রোহিঙ্গাবিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তুলতে সহায়তা করেছে। ফেসবুকের অ্যালগরিদম ভুল তথ্য প্রচার করেছে, যা একসময় বাস্তব সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। যদিও মিয়ানমারে রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের উত্তেজনার ইতিহাস আজকের নয়। কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ‘স্মার্টফোন ও ফেসবুক’ আমাদের জীবনে প্রবেশ না করা পর্যন্ত এবং রাজনীতিবিদ ও ধর্মান্ধরা ঘৃণাত্মক বক্তব্য না ছড়ানো পর্যন্ত দুই জাতির মধ্যে নিত্যনৈমিত্তিক শত্রুতা অন্তত ছিল না।
ফেসবুক যে ঘৃণার হাতিয়ার হতে পারে, ২০১২ সালে প্রথম বুঝেছি। আমার বয়স তখন এগারো। একদল রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে বৌদ্ধধর্মী এক মেয়েকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ ওঠে। সেই জঘন্য অপরাধের সুরাহা তখন হয়নি। কোনো প্রমাণও ছিল না। তবু সমগ্র সম্প্রদায়ের ওপর দোষ চাপানো হয়। বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য ফেসবুক পোস্ট হতে থাকে। রাখাইন প্রতিবেশীদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব শীতল হতে শুরু করে।
২০১৬ সাল নাগাদ ফেসবুকে রোহিঙ্গাবিরোধী মনোভাব বাড়তে থাকে। ফলে তা নিপীড়নকে উৎসাহিত করে এবং বৈধতা দেয়। বিষয়টি আমার পরিবারে সরাসরি প্রভাব ফেলে। বাবা এবং কয়েকজন সচ্ছল রোহিঙ্গা থানায় হামলা করেছেন বলে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করা হয়ে। বড়সড় জরিমানার মুখে পড়েন তারা। জরিমানা না দেওয়ায় চাচা আবু সুফিয়ান ও তার ছেলে বুশাকে গ্রেপ্তার করে বিনা বিচারে কারাগারে পাঠানো হয়। ততদিনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য ও ধর্মবিদ্বেষী পোস্ট ফেসবুকে অহরহ চলছে। ‘দেশ বাঁচাতে এবং অবৈধ বাঙালিদের তাড়াতে সমবেত হওয়ার আহ্বান’ জানানো পোস্টগুলো আমি নিজে দেখেছি। রাখাইন বন্ধুদের সঙ্গে ‘চিনলোন’ খেলার দিন শেষ হয়ে গেল। এমন প্রতিটি পোস্টে আমি রিপোর্ট করেছি, কিন্তু ফেসবুক কিছুই করেনি। উল্টা দাবি করেছে যে, উদ্দেশ্যমূলক এসব ঘৃণ্য পোস্ট এবং বার্তাগুলো নাকি ‘(ফেসবুকের) কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড লঙ্ঘন করে না।’
এরপরই শুরু হয় হত্যাকাণ্ড। হামলা শুরু হয়, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সকালের দিকে। তখন বয়স আমার মাত্র ১৫। ভালো ছাত্র ছিলাম। আইনজীবী হওয়ার আশা। এসএসসি পরীক্ষার পড়ার চাপ ছিল, তাই খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছি। হঠাৎ শুনি গুলির শব্দ। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। ঘরেই থাকলাম। আওয়াজ চলল প্রায় ৩ ঘণ্টা। ততক্ষণে মিলিটারি চলে এসেছে। বাইরে বের হয়ে দেখি, বাজারের দোকান মালিক মোহাম্মদ শামীমের লাশ পড়ে আছে রাস্তায়। অভিযানের সময় নিরাপত্তা বাহিনী গ্রামের বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরক রেখে দেয়। বিপদ সম্পর্কে আমরা সচেতন ছিলাম না। হোসেন আহমেদ নামে গ্রামের একজন বোমায় পা দেয় এবং চোখের সামনেই বিকট বিস্ফোরণে সে মারা যায়। ভয়ে অনেকে জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ে। বেশ কয়েকটি পরিবার পরদিনই বাংলাদেশে যাত্রা করে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম বাড়িতেই থাকব।
সামরিক বাহিনী গ্রামের অবশিষ্ট সকলকে রেড ক্রিসেন্ট অফিসের কাছে একটি মাঠে জড়ো হওয়ার নির্দেশ দেয়। আমরা যাইনি। নিশ্চিত ছিলাম, গেলে তারা আমাদের মেরে ফেলবে। শুনেছি, অন্য গ্রামে তারা রোহিঙ্গাদের জবাই করছে। গ্রাম ছেড়ে তাই অন্য গ্রামে পরিবার এবং বন্ধুদের সঙ্গে কয়েক রাত থাকি। এক ফাঁকে বাড়ি ফিরে দেখি, কোথাও কেউ নেই। সর্বত্র সহিংসতার লক্ষণ ছড়ানো। অনেককে হত্যা করা হয়েছে।
মিয়ানমারে আর নিরাপত্তা নেই বুঝে পায়ে হেঁটে বাংলাদেশের পথ ধরি। চলতে চলতে দেখি অগণিত মৃতদেহ পড়ে আছে পরিত্যক্ত গ্রামে, রাস্তায়, ধানক্ষেতে। বেশির ভাগ বাড়িঘর পুড়ে গেছে। ঠাণ্ডা ও বৃষ্টি মাথায় জঙ্গল-পাহাড় পেরিয়ে দিনভর হাঁটতে থাকি আমরা। কয়েকদিন খাইনি। ১৫ দিন পরে বাংলাদেশে পৌঁছি। ফেসবুকই আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে। শুধু আমরা রোহিঙ্গারা নয়, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পর্যন্ত বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও বিভ্রান্ত ও ঘৃণাত্মক কন্টেন্ট রোধ করতে তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এই দায় কি তাদের নিতে হবে না? স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে আমাদের সহায়তা করা কি তাদের দায়িত্ব নয়? জাকারবার্গসহ যারা ফেসবুক পরিচালনা করেন, আমাদের দেখতে কি তারা কক্সবাজারে একবার আসবেন? এটা কি অপরিহার্য নয়? শরণার্থী শিবিরে কয়েক রাত কাটিয়ে তারা দেখুক, আমরা কেমন আছি, কী নিদারুণ অবস্থায় আছি। তখন বুঝবেন, আমার এবং আমার লোকদের সঙ্গে কী করেছে তারা। হতে পারে, তখন তারা আমাদের সহযোগিতার জন্য কিছু করবেন। গণহত্যায় প্রাণ হারিয়েছেন যারা ফেসবুক তো তাদের ফিরিয়ে দিতে পারবে না। মিয়ানমারে খুইয়ে আসা আমাদের জীবন ও সম্পদও তারা উদ্ধার করতে পারবেন না। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, তাদের কিছুই করার নেই। জাকারবার্গ কি কক্সবাজারে আমার মতো তরুণদের শিক্ষায় অর্থায়ন করার সামর্থ্য রাখেন না? নিশ্চয়ই রাখেন। আমাদের একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়তে তিনি এগিয়ে আসতে পারেন। তার কোম্পানি আমার যে ক্ষতি করেছে, অন্তত এইটুকু করলে খানিকটা হয়তো লাঘব হবে।
লেখক : বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী
আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর : মনযূরুল হক
তখন বয়স ছিল ৩১ বছর। এত অল্প বয়সে ‘ভীমরুল’ ছদ্মনামে দৈনিক ইত্তেফাকে কলাম লিখে প্রবল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তার লেখনী শক্তিতে পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরাচার আইয়ুব খানের ভিত নড়ে ওঠে। কিন্তু ২০ মে, ১৯৬৫ সালে ৩২ বছর বয়সে কায়রোতে বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। অতীতের সঙ্গে অধুনার সংযোগ ঘটানোর উদ্দেশ্যে ছাপা হচ্ছে ভীমরুলের সেই উপসম্পাদকীয়
জনাব জেড, এ, সুলেরী একজন কৃতবিদ্য ব্যক্তি। কর্তার ইচ্ছার কীর্তন গাহিবার আর্টে তিনি বহু পূর্বেই সিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। সত্য-বাস্তব-ন্যায়বিচার, এমনকি সম্ভবত: নিজের বিবেকের বালাইও তিনি অনেক আগেই ঘুচাইয়া ফেলিয়াছেন। প্রাপ্তিযোগই এখন তাহার পরমারাধ্য এবং এই পরমারাধ্য বিষয়টির যোগাযোগ ঘটিলে হেন কথা নাই, যাহা তিনি বলিতে বা লিখিতে পারেন না। এদেশের সংবাদপত্র পাঠক এই প্রতিথযশা মোসাহেবের কীর্তিকলাপ সম্পর্কে সম্যকভাবেই অবহিত। সুতরাং, অধিক ভূমিকা ছাড়াই সুলেরী সাহেবের সর্বাধুনিক কীর্তি সম্পর্কে আলোচনার অবতারণা করা যায়।
জনাব সুলেরী গত ১২ই নভেম্বরে পশ্চিম পাকিস্তানের একটি ইংরেজী দৈনিকে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখিয়াছেন। তাহার প্রবন্ধের দৃশ্যতঃ দুইটি প্রতিপাদ্যের একটি হইতেছে গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব ও সম্মিলিত বিরোধী দলের মনোনীত প্রার্থী মিস ফাতেমা জিন্নাহর বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং অন্যটি হইতেছে বিগত ছয় বৎসরের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ও জনাব আইয়ুব খানের প্রশংসা কীর্তন। এই দুই প্রতিপাদ্যের পটভূমিতে প্রচ্ছন্নভাবে আরো একটি প্রতিপাদ্য ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা। সত্য-মিথ্যার জগাখিচুড়ি পাকাইয়া এবং ঐতিহাসিক তথ্যের বিকৃতি ঘটাইয়া তিনি বেশ দক্ষতার সহিতই তাঁহার দায়িত্ব সম্পাদন করিয়াছেন। জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্বহীনতার হেতু বর্ণনা করিয়া এবং ১৯৪৭ সালে ‘বাউন্ডারী ফোর্সে’ নিযুক্ত থাকাকালে জনাব আইয়ুবের আচরণ সম্পর্কে মিস জিন্নাহ সম্প্রতি যে বিবৃতি প্রদান করেন, তার বিরুদ্ধে এবং জনাব আাইয়ুবের পক্ষে সাফাই গাহিবার পবিত্র দায়িত্ব পালনের ব্রত লইয়াই তিনি কলম ধারণ করেন। প্রথমেই তিনি অভিযোগ করেন যে, মিস জিন্নাহ উপরোক্ত বিবৃতি প্রদান করিয়া একটি অত্যন্ত অন্যায় কাজ করিয়াছেন। কারণ, তাঁহার এই বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানের ‘চরমপন্থী’, ‘কম্যুনিষ্ট’ ও ‘ভারতীয় এজেন্টরা’ উৎসাহিত হইয়া নূতন উদ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচারে লিপ্ত হইবে। জনাব সুলেরী সেখানেই ক্ষান্ত হন নাই। মিস জিন্নাহর উদ্দেশ্যের প্রতি কটাক্ষ করিয়া তিনি আরো অভিযোগ করিয়াছেন যে, পূর্ব পাকিস্তানীদের প্রাদেশিকতাপূর্ণ মনোভাবকে উস্কাইয়া দিয়া একটা অনর্থ ঘটাইবার মতলবেই মিস জিন্নাহ উপরোক্ত বিবৃতি প্রচার করিয়াছেন। এ প্রসঙ্গে মিস জিন্নাহর সহিত সুলেরী সাহেবের এক ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারের কথাও উল্লেখ করা হয়। জনাব সুলেরী জানান যে, সম্মিলিত বিরোধী দল কর্তৃক মিস জিন্নাহকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন দানের কিছুদিন পূর্বে তাঁহার সহিত তিনি সাক্ষাৎ করেন। সেই সাক্ষাৎকারে অনেক কথাবার্তার পর নাকি এক সময়ে মিস জিন্নাহ বলিয়া বসেন যে, দেশে যদি ‘রক্তপাত হয় ত হোক’ (‘লেট দ্যায়ার বি ব্লাডশেড’)। মিস জিন্নাহর সাম্প্রতিক বিবৃতির পর নাকি সেই উক্তির কথা সুলেরী সাহেবের নতুনভাবে মনে পড়িয়াছে। এবং ফলে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন যে, দেশকে রক্তগঙ্গায় ডুবাইয়া দিতেও তাহার আপত্তি নাই।
জনাব সুলেরীর মস্তিষ্কের উর্বরতা সম্পর্কে কোনদিন কাহারো মনে কোন সংশয় ছিল না। এই প্রবন্ধ লিখিয়া তিনি সে বিষয়ে সকলকে আরো সুনিশ্চিত করিয়াছেন। মিস জিন্নাহ দেশে রক্তস্রোত বহাইতে চান অর্থাৎ অন্য কথায় দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়া যাইতে চান, এই তত্ত্ব আবিষ্কারের জন্য মস্তিষ্কের উর্বরতা দরকার। সেই উর্বরতা একমাত্র সুলেরী সাহেবদের নিকট ছাড়া অন্য কাহারো নিকট হইতে আশা করা যায় না। ক্ষমতাসীন কনভেনশন লীগের ছোট-বড় সকল মুখে এ যাবৎ কম অপপ্রচার চালানো হয় নাই। ধর্মের দোহাই, বয়সের দোহাই, রাজনীতিতে অনভিজ্ঞতার দোহাই, মেজাজের দোহাই ইত্যাদি কোন কিছুই বাদ রাখা হয় নাই। মিস জিন্নাহ সত্তর বৎসরের বৃদ্ধা, রাজনীতিক্ষেত্রে তার কোন অভিজ্ঞতা নাই, তাহার মেজাজ খারাপ, কায়েদে আজম সময়ে সময়ে তাহাকে ঘরে তালাবদ্ধ করিয়া রাখিতেন, তিনি ‘বিকৃত রাজনীতিক’দের দ্বারা পরিবৃত ইত্যাদি অকল্পনীয় কুৎসা তাঁহার বিরুদ্ধে রটনা করা হইয়াছে। আর এক শ্রেণীর ধর্মব্যবসায়ীর ক্রমাগত ফতোয়া ত আছেই। রাষ্ট্রপ্রধানের পদে কোন নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতে পারেন না বলিয়া এমনকি আল- আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের নামেও এক অসত্য ফতোয়া জারি করা হইয়াছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের বল্গাহীন অপপ্রচার ও যাবতীয় কলাকৌশল একেবারেই ব্যর্থ হইয়াছে। পরিশেষে কনভেনশনপন্থীদের ভাড়াটিয়া প্রচারকরা মিস জিন্নাহর বিবৃতির বিকৃতি ও কদর্থ সাধনে লিপ্ত হইয়াছেন।
মিস জিন্নাহর যে বিবৃতি সম্পর্কে বিভ্রান্তির ধূম্রজাল সৃষ্টি করা জনাব সুলেরীর প্রবন্ধ ফাঁদার উদ্দেশ্য, সেই বিবৃতির বক্তব্য পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণের নিকটই নয়, পশ্চিম পাকিস্তানের সচেতন মানুষের নিকটও বিপুলভাবে আদৃত হইয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা এবং অন্যান্য সকল পর্যায়ে যে অবিচার করা হইয়াছে, তাহা দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার। গত ছয় বৎসর যাবৎ যাঁহারা ক্ষমতাসীন আছেন, তাঁহারাও এই বাস্তব সত্যকে অস্বীকার করিতে পারেন নাই। উপরন্তু, বর্তমান শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের অভাব-অভিযোগের প্রতিকারকল্পে এ-যাবৎ যতসব লম্বা-চওড়া প্রতিশ্রুতিই দিয়া থাকুন না কেন, কার্যক্ষেত্রে তার কোনটাই ফলপ্রসূ হয় নাই। উন্নয়নের নামে গত কয়েক বৎসরে বিপুল অর্থ ব্যয়িত হইলেও এবং ১৯৫৮ সালের পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় তৎপরবর্তী ছয় বৎসরে তেত্রিশগুণ অধিক বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করা হইলেও জনসাধারণের কিছু মাত্র ভাগ্যোন্নতি ঘটে নাই; পোয়াবারো ঘটিয়াছে এক শ্রেণীর ধনিক-বণিক ও কায়েমী স্বার্থবাদীদেরই। ঘটনাক্রমে উহাদের অধিকাংশই পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী। পূর্ব পাকিস্তানবাসীগণ তাহাদের প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদ করিতে গিয়া বরাবর সেই কায়েমী স্বার্থবাদীগোষ্ঠী ও উহার পৃষ্ঠপোষকদের প্রতিই অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়াছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে পূর্ব-পাকিস্তানীদের কোন অভিযোগ আগেও যেমন ছিল না, আজো তেমনি নাই। কারণ, তাহারা ইহা ভালোভাবেই জানে যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের মতই পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণও নিপীড়িত এবং বঞ্চিত। সুতরাং, পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণের বিরুদ্ধে কোন প্রকার অভিযোগ উত্থাপনের প্রশ্নই কখনো উঠে নাই। বস্তুতঃ মিস জিন্নাহ এই বিষয়টির প্রতি সম্পূর্ণ সচেতন থাকিয়াই প্রকৃতপক্ষে কাহারা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অন্যায় করিয়াছে, তাহা নির্দেশ করিবার প্রয়াস পান। অথচ, জনাব সুলেরী উহাকেই বিকৃত করিয়া দেখাইতে চাহিয়াছেন যে, মিস জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানীদের প্রাদেশিকতাপূর্ণ মনোভাবকে উস্কাইয়া দেশের সংহতি বিপন্ন করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। আর সেই বিকৃতি সাধনের উদ্দেশ্যে তিনি তাঁহার সহিত মিস জিন্নাহর ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ হাজির করিতেও দ্বিধাবোধ করেন নাই।
অসততা কোন্ পর্যায়ে পৌঁছালে এরূপ কাজ করা যায়, তাহা সত্যি ভাবিবার বিষয়। সুলেরী সাহেবের সহিত আলোচনা প্রসংগে মিস জিন্নাহ দেশে রক্তপাত ঘটাইবার কথা বলিয়াছিলেন ইহা অবিশ্বাস্য। কিন্তু, তর্কের খাতিরে যদি ধরিয়াও লওয়া যায় যে, সেই ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে ঐরকম কথা উচ্চারিত হইয়াছিল, তাহা হইলেও উহাকে প্রবন্ধের বিষয়বস্তুতে পরিণত করার মত অন্যায় কাজ আর কিছুই হইতে পারে না। ব্যক্তিগত আলোচনায় অনেক সময় অনেক কথাই হয় কথার পিঠেই কথা আসে। সুতরাং, মিস জিন্নাহর উক্তি বলিয়া সুলেরী সাহেব যে কথাটা চালাইতে চাহিতেছেন, সে কথা আদৌ বলা হইয়া থাকিলে সুলেরী সাহেবের কোন্ কথার পিঠে বলা হইয়াছিল, তাহাও প্রকাশ করা তাঁহার উচিত ছিল। কিন্তু সুলেরী সাহেবদের মত ব্যক্তিদের নিকট হইতে কোন উচিত কাজ আশা করা বাতুলতা মাত্র। কাজেই জনাব সুলেরীর মত একটি চেনামুখের অপপ্রচারে দেশের একটি প্রাণীও বিভ্রান্ত হইবে না এ বিষয়ে আমাদের কোন সন্দেহ নাই।
কনভেনশন দলীয় মনোনীত প্রার্থী জনাব আইয়ুব খানের প্রশংসা কীর্তন করিতে গিয়া জনাব সুলেরী বহু অবান্তর কথাই বলিয়াছেন। তন্মধ্যে একটি কথা ভারী মজাদার। নির্বাচনী প্রচারে অবতীর্ণ হইয়া জনাব আইয়ুব প্রায় সমস্ত বিরোধী দলকেই দেশানুগত্যহীন প্রতিষ্ঠানরূপে চিত্রিত করিতেছেন এবং প্রায় সকল রাজনৈতিক নেতাকেই ইঁদুর-বিড়াল ইত্যাদি নামে গালাগালি করিতেছেন। এমনকি একজন প্রবীণ নেতার দাড়ি কামাইয়া ফেলিবার মত অচিন্তিতপূর্ব অশোভন উক্তিও তাঁহার মুখ হইতে নির্গত হইয়াছে। এমতাবস্থায় স্বভাবতই জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে আইয়ুব সাহেবের অবদানের প্রশ্ন উঠিয়াছে। আইয়ুব সাহেব এবং তাঁহার পোষ্যরা যদিও এই বেকায়দা প্রশ্নে নিতান্তই নাচার, তবু সে সম্পর্কে এক সাফাই গাহিয়াছেন সুলেরী সাহেব। তিনি বলিয়াছেন, ‘জনাব আইয়ুব তখন সশস্ত্র বাহিনীতে নিযুক্ত।’ এই পর্যন্ত বলিয়াই তিনি থামিয়া গিয়াছেন; বাকী অংশটা তিনি পূরণ করিতে চাহিয়াছেন কিছু না বলিয়া। অর্থাৎ আইয়ুব সাহেব তখন সশস্ত্র বাহিনীতে নিযুক্ত ছিলেন বলিয়াই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করিতে পারে নাই; নিযুক্ত না থাকিলে তিনি নিশ্চয়ই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করিতেন! কিন্তু প্রশ্ন হইতেছে, বৃটিশের বেতনভুক তদানীন্তন সশস্ত্র বাহিনী হইতে পদত্যাগ করিতে তাঁহাকে কে বারণ করিয়াছিল? দেশে তখন কোটি কোটি মানুষ বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম-লিপ্ত; হাজার হাজার মানুষ বিদেশি শাসকদের হাতে নির্যাতিত; দেশের এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের তরঙ্গ। ইচ্ছা করিলেই জনাব আইয়ুব বিদেশিদের বেতনভুক সশস্ত্র বাহিনী হইতে পদত্যাগ করিয়া সেই জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করিতে পারিতেন। এরূপ দৃষ্টান্ত সেকালে হাজারে হাজারেই দেখা গিয়াছে। আইয়ুব সাহেবই বা কেন একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারিলেন না? পক্ষান্তরে, বিদেশি শাসকদের বেতনভুক সশস্ত্র বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত থাকিয়া তিনি কি স্বাধীনতা সংগ্রামের দমনকার্যেই সহায়ক হন নাই? অথচ, আজ তিনি এবং তাঁহার চাটুকারবৃন্দই দেশপ্রেমের মনোপলি দাবী করিতেছেন; আর যাঁহারা ত্যাগ, তিতিক্ষা ও নির্যাতনের বিনিময়ে স্বাধীনতা সংগ্রামকে সফল করিয়া তুলিয়াছিলেন, তাঁহাদেরই দেশপ্রেমের প্রতি করা হইতেছে কটাক্ষ। এমনকি দেশ-ধ্বংসের অপবাদ মাদারে মিল্লাতের বিরুদ্ধে উত্থাপন করিতেও ইহাদের রসনা অবশ এবং কলম অচল হইতেছে না। প্রকৃতির রাজ্যে ইহারা কি ক্ষমা পাইতে পারেন?
লেখক: আহমেদুর রহমান
দৈনিক ইত্তেফাক, ১৫ নভেম্বর ১৯৬৪
২০১৪ সালের এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন নজরুল সংগীত শিল্পী ফিরোজা বেগম। তার জন্ম ১৯৩০ সালের ২৮ জুলাই তৎকালীন ফরিদপুর জেলায়। তার বাবার নাম খান বাহাদুর মোহাম্মদ ইসমাইল এবং মা বেগম কওকাবুন্নেসা। শৈশবেই তার সংগীতের প্রতি অনুরাগ জন্মে। চল্লিশের দশকে তিনি সংগীত ভুবনে পদার্পণ করেন। ষষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে গানে কণ্ঠ দেন। ১৯৪২ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি এইচএমভি থেকে তার প্রথম রেকর্ড বের হয়। কিছুদিন পর কমল দাশগুপ্তের তত্ত্বাবধানে উর্দু গানের রেকর্ড হয়। ১০ বছর বয়সে তিনি কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিধ্যে আসেন এবং তার কাছ থেকে তালিম গ্রহণ করেন। নজরুলের গান নিয়ে প্রকাশিত তার প্রথম রেকর্ড বের হয় ১৯৪৯ সালে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তিনি ৩৮০টির বেশি একক সংগীতানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। নজরুলগীতি ছাড়া তিনি আধুনিক গান, গজল, কাওয়ালি, ভজন, হামদ, নাতসহ বিভিন্ন ধরনের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। ১৯৫৪ সাল থেকে তিনি কলকাতায় বসবাস করতে শুরু করেন। ১৯৫৫ সালে সুরকার, গায়ক ও গীতিকার কমল দাশগুপ্তের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। জীবদ্দশায় তার ১২টি এলপি, চারটি ইপি, ছয়টি সিডি ও ২০টিরও বেশি অডিও ক্যাসেট প্রকাশিত হয়েছে। শিল্পচর্চায় অবদানের জন্য ১৯৭৯ সালে তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি একুশে পদক, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র পুরস্কার, সত্যজিৎ রায় পুরস্কার, নজরুল আকাদেমি পদক, চুরুলিয়া স্বর্ণপদকসহ নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করে।
ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ১৮ আগস্ট ৯ বছরের শিশু আরাফাতের মৃত্যু হয়। সপ্তাহ না যেতেই ২৫ আগস্ট মারা যায় আরাফাতের ছোট বোন ৬ বছরের রাইদা। রাজধানীর মধ্যপাইকপাড়ার ছাপাখানা মোড়ের একটি বাসায় দুই সন্তান আরাফাত ও রাইদাকে নিয়ে থাকতেন মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও রাবেয়া আক্তার দম্পতি। সন্তানদের মৃত্যুর পর জীবনটাই বদলে গেছে তাদের। তছনছ হয়ে গেছে সাজানো সংসার। ইব্রাহিম ও রাবেয়া দম্পতির মতো বহু পরিবার এবার সর্বস্বান্ত হয়েছে ডেঙ্গুজ¦রের থাবায়। সন্তান হারানো এমন বাবা-মায়েরা পাগলপ্রায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর ডেঙ্গুতে শূন্য থেকে ২০ বছর বয়সী ১৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ১৮ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ ৮৬ এবং নারী ৯১ জন। এবার শুধু শহর নয়, গ্রামেও ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। সেখানেও মারা গেছে অনেক শিশু। এ বছর ডেঙ্গুতে শিশুমৃত্যু নিয়মিত ঘটনা হয়ে দেখা দিয়েছে। এই রোগে এত শিশুর মৃত্যু আগে কখনো হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ বছর শূন্য থেকে ২০ বছর বয়সীরা আক্রান্ত হয়েছে ৬৩ হাজার ৯১৯ জন; যা মোট আক্রান্তের ৩২ শতাংশ। এর মধ্যে নারী ২৩ হাজার ৬১৭ এবং পুরুষ ৪০ হাজার ৩০২ জন। ডেঙ্গুতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। তথ্য বলছে, ডেঙ্গুতে শিশুদের আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুর হার কম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া শিশুদের যারা সুস্থ হয়ে উঠছে, তাদের মধ্যে ভবিষ্যতে শারীরিক জটিলতা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ডেঙ্গুর বর্তমান সংক্রমণের মধ্য দিয়ে শিশুদের জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তাদের মানসিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ডেঙ্গুর এই পরিস্থিতি শিশুদের নতুন বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার বিরূপ প্রভাব শিশুদের মধ্যে ভবিষ্যতে দেখা যেতে পারে। মস্তিষ্ক ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এর প্রভাব থাকতে পারে। এতে তাদের মেধাবিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাদের যদি কিডনি কিংবা লিভারের মতো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সেই ভার সারা জীবন বহন করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শিশুদের মৃত্যু নিয়ে ভালোভাবে অ্যানালাইসিস করতে পারছি না। এসব মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে অটোপসি করতে পারলে ভালো হতো। বিভিন্ন দেশে মৃত্যু নিয়ে ডেথ রিভিউ বা অটোপসি করা হয়। এটি করতে পারলে বাংলাদেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যেত।’
এদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দিতেও হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। কোনো শিশুর শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন হলে পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (পিআইসিইউ) চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, ১ মাস থেকে ১২ বছর বয়সী মুমূর্ষু শিশু রোগীদের পৃথক পিআইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দিতে হয়। তবে দেশে পিআইসিইউ সংকট রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে পিআইসিইউর জন্য স্বজনদের হাহাকার করতে দেখা গেছে। হাসপাতালগুলোতে দেখা গেছে ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ শিশুকে সেবা দিতে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক) ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা যেমন বেশি, সেখানে শিশু রোগীও উল্লেখযোগ্য। এই দুটি হাসপাতালে একেকটি শয্যায় একাধিক শিশু রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। ঢামেক হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের জন্য পৃথক ওয়ার্ড খুলেছে কর্তৃপক্ষ। ৭০ থেকে ৮০ জনের সেবা পাওয়ার কথা, কিন্তু সেখানে প্রতিদিন সেবা নিচ্ছে প্রায় ৩০০ শিশু। ঢামেক হাসপাতালের ২৫ শিশুকে একসঙ্গে পিআইসিইউতে সেবা দেওয়ার সক্ষমতা আছে। কিন্তু মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোনো পিআইসিইউ নেই।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এখানে শিশুদের ওয়ার্ডেই ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। পিআইসিইউ নেই, তবে এনআইসিইউ (নিউনেটাল আইসিইউ বা নবজাতকদের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র) আছে।
এদিকে শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের শরীরে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু শনাক্তে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। শিশুদের ডেঙ্গুর চিকিৎসা প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শামীমা ইয়াসমীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিশুদের জ্বর আসার তিন দিনের মধ্যে পরীক্ষা করাতে হবে। এবার অনেকের মধ্যে হঠাৎ করে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। ফলে তারা দেরিতে চিকিৎসা নিতে আসছে। দেখা গেছে, ডেঙ্গুজ্বরে যেসব শিশু মারা গেছে, তারা বাড়ি থেকেই জটিলতা নিয়ে এসেছে। এখানে একটি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে, শুধু প্লাটিলেট কমা আশঙ্কার নয়, রক্তচাপ কমে যাওয়া প্লাটিলেট কমার চেয়ে ভয়ের। তাই আমাদের শিশুদের রক্তচাপ নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে।’
স্যাংশন নিয়ে ভয় না পাওয়ার বার্তা দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার মেথডিস্ট সেন্ট্রাল হলে নাগরিক সংবর্ধনায় দেওয়া বক্তব্যে তিনি পাল্টা স্যাংশন দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন।
সংবিধান অনুযায়ী সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে জানান তিনি। খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা ইস্যু সম্পর্কে প্রশ্ন রাখেন, সাজাপ্রাপ্ত কাউকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠায় কোন দেশ?
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্ন রেখে বলেন, পৃথিবীর কোন দেশের সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠায় বলতে পারেন? কোনো দেশে পাঠায়? তারা এটা দাবি করে। আমাদের কেউ কেউ আঁতেল আছে। তারা বলে, একটু কী সহানুভূতি দেখাতে পারেন না! সে এভারকেয়ার, বাংলাদেশের সবথেকে দামি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। আর রোজই শুনি এই মরে মরে, এই যায় যায়। বয়সতো আশির ওপর। মৃত্যুর সময় তো হয়ে গেছে। তার মধ্যে অসুস্থ। এখানে এত কান্নাকাটি করে লাভ নাই।
স্যাংশনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। আপনাদেরও বলব, স্যাংশন নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।
বিএনপি চেয়ারপারসন ‘অসুস্থ’ খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে শর্ত দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সেই শর্তের অন্যতম ইস্যু হচ্ছে, বিএনপিকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে। এমন ঘোষণার পরপরই খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিদেশে যাওয়ার অনুমতি মিলবে। কিন্তু সরকারের সেই শর্তে রাজি নন খালেদা জিয়া। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কোনো শর্তের বিনিময়ে তিনি মুক্তি চান না। ফলে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার সরকারের যে চেষ্টা, সেটা এ দফায় সফল হচ্ছে না বলে মনে করছেন আন্দোলনে থাকা নেতারা। তাদের মতে, সরকার ফাঁদ পাতলেও এতে পা না দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে বেগম জিয়ার। বরং আন্দোলনে এ সরকারকে বিদায় করে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দরজা খুলতে চান তারা। একই সঙ্গে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করেই আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবেন। এ লক্ষ্যে প্রায় অর্ধশত দল নিয়ে গত প্রায় এক বছর ধরে আন্দোলনে রয়েছেন তারা।
শর্তের বিনিময়ে মুক্তির বিষয়টি তুলে ধরে গত রবিবার রাতে কিশোরগঞ্জে বিএনপির রোডমার্চের সমাপনী সমাবেশে দলটির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে শর্ত দেওয়া হয়েছিল তিনি যদি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে চান, তাহলে বিএনপিকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে আসতে হবে। বিএনপি থেকে উত্তর দেওয়ার আগেই অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতাল থেকে খালেদা জিয়া বিদ্রোহ করে বলেছেন, তার জীবনে গণতন্ত্রের জন্য কোনো শর্ত নেই। ভোটের অধিকারের জন্য, এই দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য কোনো শর্ত নেই। কোনো শর্ত খালেদা জিয়ার নামের সঙ্গে যায় না এবং আমরাও তা মানি না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খালেদা জিয়া ৫৪ দিন ধরে টানা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিতই খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের সর্বশেষ অবস্থা খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। এ সময় বেশ কয়েকবার শারীরিকভাবে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লে দলের কয়েকজন নেতার মাধ্যমে মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের দেওয়ার বক্তব্যের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি দলের মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, যুগ্ম মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির কয়েকজন সম্পাদক ও সদস্য খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন। সূত্রগুলো বলছে, একজন ভাইস চেয়ারম্যান ও স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য কথা প্রসঙ্গে এ ধরনের প্রসঙ্গেও ইঙ্গিত দিলে খালেদা জিয়ার শর্ত দিয়ে মুক্ত হতে চান না বলে পুনর্ব্যক্ত করেন। যদিও এর আগে শর্ত দিয়ে দেশের বাইরে চিকিৎসার বিষয়ে দল যাতে সম্মত না হয়, সে কথা নেতাদের আগেই বলে রেখেছিলেন একসময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এ নেত্রী। কোনো অবস্থায় শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়া যাবে না এবং এ ব্যাপারে কোনো ধরনের সমঝোতাও নয়Ñ এ ব্যাপারেও খালেদা জিয়ার স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করেন। সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে এসে মঞ্চের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের এ আন্দোলনে উনার সমর্থন আছে। আমাদের একজন নেতা (ওই বৈঠকে) বলেছেন, সরকার একটা নির্বাচনের জাল বিছানোর চেষ্টা করছে। উনি (খালেদা জিয়া) বলেছেন, কোনো অবস্থায় এ সরকারের অধীনে নির্বাচনী ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না।’
এর আগে ৮ মে রাতে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় সাক্ষাৎ শেষে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছিলেন, কেউ কেউ বলছেন আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যাওয়া উচিত। এমন প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া তাদের বলেছেন, প্রশ্নই আসে না। এ বিষয়ে আমি কোনো অনুমতি দেব না।
এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি মনে করছে, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি এখন সরকারের বিদায়ের ওপর নির্ভর করছে। আন্দোলনে এ সরকারকে বিদায় করতে না পারলে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দরজা খুলবে না। তাই এখন আন্দোলনের মাধ্যমে এ ইস্যুর সমাধান করবে তারা। এজন্য চলমান এক দফার আন্দোলনের সঙ্গে এখন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসা ইস্যুটি জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করতে চান তারা। এতে সরকারবিরোধী আন্দোলন বড় ধরনের মোড় নিতে পারে বলে তাদের বিশ্বাস।
গতকাল সোমবার স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভা হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে সভায় খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। আগামী ৫ অক্টোবর বিএনপি ঘোষিত রোডমার্চ কর্মসূচি শেষ হবে। এর আগেই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে বিএনপি।
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু বলেন, ‘দাবার ঘুঁটি হিসেবে খালেদা জিয়াকে ব্যবহারের চিন্তা তারা কীভাবে করে সেটাই বোধগম্য নয়। সরকারের এ ধরনের চিন্তা বা পরিকল্পনা কোনো কাজে আসবে না।’
উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে বিএনপিপ্রধানের পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদনের ওপর গত রবিবার আইন মন্ত্রণালয় মতামত দিয়ে বলেছে, সাজা স্থগিত থাকাবস্থায় তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর সুযোগ নেই। যদি যেতে হয়, তাহলে সাজা স্থগিতের আদেশ বাতিল করতে হবে। কিন্তু সেটা করে তাকে আবার কারাগারে পাঠানো হবে না বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তবে বিদেশে পাঠানোর অনুমতির জন্য আদালতে যেতে রাজি নয় খালেদা জিয়ার পরিবার ও বিএনপি।
আবার গতকাল নিজ কার্যালয়ে সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাছান চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতি কিংবা আপিল বিভাগে আবেদন করতে পারেন। তবে তার আগে তাকে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জেলে যেতে হবে। রাষ্ট্রপতি বা আপিল বিভাগের খালেদা জিয়ার পরিবার আবেদন করবে না বলে দলীয় আইনজীবী সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশে আইনের শাসন নেই বলেই বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভয়ংকর তামাশা করা হয়েছে। যে নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়া এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন, সেখানে বলা হয়েছে, তাকে “দেশে চিকিৎসা নিতে হবে”, তার বদলে “দেশে বা বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারবেন” বলাই যথেষ্ট। এর বাইরে দলের পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নেই।’
এদিকে চিকিৎসক সূত্র জানা গেছে, বর্তমানে খালেদা জিয়ার অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। গতকাল তার আলট্রাসনোগ্রাম ও ইকো করা হয়েছে।
তিনি জাতির পিতার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য প্রণীত আইনের অধীনে ধানমন্ডিতে যে বাড়ি পেয়েছিলেন শেখ রেহানা, বিএনপি ক্ষমতায় এসে সে বাড়ি উচ্ছেদ করে। সেখানে পুলিশ ফাঁড়ি করছে আর ‘লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে’ সেই পুলিশ ফাঁড়ি উদ্বোধন করেছে খালেদা জিয়া। ছেলে কোকোর মৃত্যুর পর তাকে (শেখ হাসিনা) খালেদা জিয়ার বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি না দেওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা কীভাবে খালেদা জিয়ার জন্য আমার কাছ থেকে আরও সহানুভূতি আশা করে।’
লন্ডনের মেথোডিস্ট সেন্ট্রাল হল ওয়েস্টমিনস্টারে তার সম্মানে আয়োজিত একটি কমিউনিটি সংবর্ধনায় তিনি এসব কথা বলেন।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, গণতন্ত্রের কথা বলা বিএনপির পক্ষে শোভা পায় না কারণ তারা জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে ধোকাবাজি খেলেছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি একটি প্রহসনমূলক নির্বাচন করে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার দেড় মাসের মধ্যেই দেশের জনগণ তাদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে। তিনি বলেন, দেশের জনগণ কখনই ভোট কারচুপিকারীদের ক্ষমতায় বসতে দেয় না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার প্রধান হিসেবে তার ওপর ন্যস্ত নির্বাহী ক্ষমতা দিয়ে এতিমদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতির মামলায় কারাদণ্ড স্থগিত করার পর খালেদা জিয়াকে তিনি বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে তার কিছুই করার নেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি আইন অনুযায়ী যা করতে পারেন তাই করেছেন। অনেকেই এখন যুক্তি দিচ্ছেন, ‘আইন নিজের গতিতে চললেও খালেদা জিয়ার প্রতি আমি বেশি সহানুভূতি দেখাতে পারি’।
অনুষ্ঠানের মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এবং আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান শরীফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজেদুর রহমান ফারুক।
উত্তর-পূর্ব পাকিস্তানে একটি অঙ্গ পাচারকারী চক্রের আট সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, পুলিশ বলছে। চক্রটির নেতা ফাওয়াদ মুখতারের বিরুদ্ধে ৩০০ জনেরও বেশি মানুষের কিডনি চুরি করে বের করে ধনী গ্রাহকদের মধ্যে প্রতিস্থাপন করার অভিযোগ রয়েছে।
মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা বিবিসি নিউজ।
বিবিসি জানায়, অস্ত্রোপচারের সময় রোগীর দেহ থেকে কিডনি সরিয়ে ফেলা এবং ধনী গ্রাহকদের কাছে বিক্রির অভিযোগে ফাওয়াদ মুখতার নামের এক চিকিৎসক ও তার দলের আট সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছে পাকিস্তান পুলিশ। ফাওয়াদ এ পর্যন্ত তিন শতাধিক রোগীর কিডনি চুরি করেছেন।
এমনকি অস্ত্রোপচারকালে কিডনি চুরির সময় তার হাতে অন্তত তিনজন রোগী মারা গেছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
ফাওয়াদ এর আগে পাঁচবার অসদাচরণের জন্য গ্রেপ্তার হলেও প্রতিবারই জামিন নিয়ে মুক্তি পেয়ে যান। রোববার (১ অক্টোবর) পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোর থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানায় পাকিস্তান পুলিশ। চক্রটি পূর্ব পাঞ্জাব প্রদেশের পাশাপাশি পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে কাজ করছে বলে ধারণা করছে পুলিশ।
পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মহসিন নকভি রবিবার একটি সংবাদ সম্মেলনে জানান, “কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টগুলি বিভিন্ন ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবনকে ক্লিনিক আকারে সাজিয়ে সেখানে রোগীদের অস্ত্রোপচার করার সময় রোগীদের অজান্তেই কিডনি সরিয়ে নেয়া হত।“
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ফাওয়াদ মুখতার জানিয়েছেন, তার নেতৃত্বাধীন চক্র এখন পর্যন্ত মোট ৩২৮ রোগীর দেহ থেকে কিডনি চুরি করেছে। প্রতিটি কিডনি বিক্রি হয়েছে ১ কোটি রুপি করে।
২০১০ সালে মানবদেহের প্রত্যঙ্গ ব্যবসা নিষিদ্ধ করে পাকিস্তান। এ অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও মোটা অঙ্কের জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বিএনপি নেতারা।
তারা বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জার্মানিতে নেওয়ার কথা ছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সে সময় শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়। এবার চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছি। জার্মানিতে খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে আমরা তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাব। জার্মানিতে তার ভালো চিকিৎসা হবে।’
এর অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খালেদা জিয়া ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে তার লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে আসছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লিভার সিরোসিসের কারণে খালেদা জিয়ার হৃদ্যন্ত্র ও কিডনির জটিলতা বেড়েছে। তিনি হাসপাতালে কখনো কিছুটা ভালো থাকছেন, পরক্ষণেই তার স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। ফলে তাকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘লিভার সমস্যার কারণে ম্যাডামের শ্বাস কষ্ট হয়। ইতোমধ্যে তাকে দুইবার করোনারী কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রাখা হয়েছিল। লিভার প্রতিস্থাপন করতে পারলে শ্বাসকষ্টটা হতো না।’
এদিকে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষণ না থাকায় তার পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি এখন সামনে এসেছে।
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়া হতে পারে এমন খবরে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও খোঁজখবর নিচ্ছেন জার্মান বিএনপি নেতারা।
জার্মান বিএনপির সভাপতি আকুল মিয়া বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জার্মানিতে ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হতে পারে বলে জানতে পেরেছি। আমরা খুবই খুশি। কারণ জার্মানিতে আসলে আমরা তার চিকিৎসার বিষয়ে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারব। চেয়ারপারসনের যে চিকিৎসা দরকার তা সকল ব্যবস্থা জার্মানিতে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ম্যাডামের মুক্তি, তার উন্নত চিকিৎসা ও গণতন্ত্র ফেরাতে দেশে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে জার্মানিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। আগামী ৯ অক্টোবর আমাদের কর্মসূচি রয়েছে। জার্মান বিএনপির উদ্যোগে রোডমার্চ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করব জার্মান পার্লামেন্টের সামনে। ’
আকুল মিয়া বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যখন বিদেশে নেওয়ার আলোচনা চলছিল তখনও জার্মানিতে নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়েছিল। সে সময় তারেক রহমানের সেবা করতে না পারলেও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সেবা করতে পারব বলে আশা করছি। তার চিকিৎসা জার্মানিতে করতে পারলে আমরা ধন্য হবো।’
গত ২৫ সেপ্টেম্বর সোমবার খালেদা জিয়ার ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনি মতামত জানতে চেয়ে আবেদনের কপি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। খালেদা জিয়ার ভাইয়ের আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃতিক বিস্ময় হাওরের ওপর অত্যাচারের যেন শেষ নেই। ধান-মাছের এই বিপুল ভান্ডার রক্ষার নামে একদিকে চলে স্থায়ী-অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি; যার কারণে যখন-তখন হাওরডুবিতে ঘটে ফসলহানি। পাশাপাশি আরেক দিকে চলে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের নামে অবৈজ্ঞানিকভাবে যত্রতত্র বাঁধ-রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের ধুম; ফলে পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মরতে বসেছে হাওর। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে শেষমেশ সরকারপ্রধান হুকুম দিয়েছেনে ‘হাওরে আর কোনো সড়ক নয়।’
এই পরিস্থিতিতে দেশ রূপান্তরের চোখে ধরা পড়েছে আরেক অশনিসংকেত। এবার শিল্পপতিদের চোখ পড়েছে হাওরে। কোথাও কোথাও থাবাও পড়তে শুরু করেছে। তেমনি সব ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে ভাটি অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হবিগঞ্জ জেলার সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে। এখানে গড়ে উঠেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদনের কারখানা। তৈরি হচ্ছে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প। হাওরের ‘লিলুয়া’ বাতাসে এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে কারখানার দুর্গন্ধ। ‘চান্নি পসর রাইতে’ এখন আর শোনা যায় না বাউলকণ্ঠের দরদি সুর। প্রায় দিনই শিল্পপতিদের আনাগোনার অশুভ পদধ্বনি শুনতে পান হাওরবাসী।
অথচ যেকোনো ধরনের স্থাপনা তৈরি বা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য হওরের স্বাভাবিক পরিবেশ ও জীবনাচরণ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখার নির্দেশনা আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। গত ১৮ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে হাওর অঞ্চলের সড়কগুলো এলিভেটেড করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপর থেকে হাওরাঞ্চলে কোনো সড়ক করতে হলে এলিভেটেড পদ্ধতিতে করতে হবে, যাতে সেখানকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা পায়। সরকারপ্রধানের এমন নির্দেশের পরও থামেনি হাওর ধ্বংসের তৎপরতা।
হাওরে জমি কেনাবেচার হিড়িক
বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট বাজারের অদূরে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের নিচু জমি ভরাট করে বিশাল আকৃতির ছয়টি শেডসহ অনেক স্থাপনা নিয়ে ‘কাজী ফার্ম’ গড়ে তুলেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদন কেন্দ্র। উপজেলার বাগদাইরসহ আরও কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, উপজেলা ও জেলা সদরে যাতায়াতের একমাত্র পথের ধারেই কাজী ফার্মের এই প্রতিষ্ঠান। এখনই নাকে কাপড় দিয়ে দ্রুত পার হতে হয় রাস্তা; আর প্রতিদিন প্রায় ১২ লাখ ডিম উৎপাদনের এই বিশাল কারখানাটি পুরোপুরি চালু হলে দুর্গন্ধে বসবাস করা যাবে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন এলাকাবাসী। স্নানঘাট ভূমি কার্যালয় থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ১৯ একর ৮০ শতক জমি নামজারি হয়েছে। আরও কয়েক একর জমি কিনেছে তারা, যা নামজারির অপেক্ষায়।
গত ১৮ জুন হাওর লাগোয়া বাগদাইর গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হয় স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের সদস্য আলেকজান বিবির সঙ্গে। তিনিসহ আরও কয়েকজন নারী-পুরুষ দেশ রূপান্তরকে বললেন, হাওরের ফসলি জমি ভরাট করে এ ফার্মটি গড়া হয়েছে। এভাবে শিল্প গড়ে উঠলে হাওরের অস্তিত্ব বিলীন হতে আর সময় লাগবে না।
স্থানীয় লিটন মিয়া বললেন, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের ইলাম এলাকায় আকিজ গ্রুপেরও ১৮ বিঘা জমি রয়েছে। উঁচু পাড় বেঁধে আপাতত মাছ চাষ করছে তারা। আগে জমিটির মালিক ছিলেন সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির চৌধুরী। আব্দুল কাদির চৌধুরী জানান, পাঁচ-ছয় বছর আগে তার নিজের জমি ছাড়াও আশপাশের আরও ৫০ বিঘা জমি কিনেছে আকিজ গ্রুপ। আপাতত পুকুর করেছে। ভবিষ্যতে কী করবে, কোম্পানিই জানে।
দীর্ঘদিন ধরে জমি কেনাবেচায় মধ্যস্থতা (দালালি) করেন হারুন মিয়া। তিনি জানান, শুকনো মৌসুমে মাসের ১০ দিনই তাকে হাওরে জমি দেখাতে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন শিল্পপতির সঙ্গে তার মাধ্যমে জমির মালিকদের কথাবার্তা চলছে।
একই পেশার আলী আমজদ বলেন, ইদানীং গুঙ্গিয়াজুরী হাওর এলাকায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লোকজনের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। সালাউদ্দিন নামে ঢাকার এক বাসিন্দা গত মার্চে বন্ধুদের নিয়ে হাওর ঘুরে গেছেন। রাস্তার পাশে তিনি কমপক্ষে ১৫-২০ একর জমি কিনতে চান। তার সঙ্গে আলাপ করে আমজাদ যা বুঝতে পেরেছেন, জমিতে তারা সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে আগ্রহী।
লন্ডনপ্রবাসী নাঈম চৌধুরী জানান, তার ১২ বিঘা জমি কেনার জন্য দামদর ঠিক করেন ঢাকার ব্যবসায়ী জুয়েল খান। সবকিছু ঠিকঠাক করার পর অজ্ঞাত কারণে তিনি সরে যান। নাঈম চৌধুরী পরে জানতে পারেন, কমিশন নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় আইনি পরামর্শক জুয়েল খানকে নিরুৎসাহিত করেন।
হাওর গ্রাসের যত কৌশল
নিচু এলাকা হওয়ায় হাওরে জমির দাম তুলনামূলক কম। এখনো এক বিঘা (৩৩ শতক) জমি ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে বেচাকেনা হয়। পুটিজুরী গ্রামের বাসিন্দা টেনু মিয়া বলেন, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলা অংশে গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই-চার কিলোমিটার দূরেই ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, বিবিয়ানা গ্যাস কূপ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। আবার হাওর এলাকা স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারিও তেমন থাকে না। ফলে ড্রেজিং মেশিন দিয়ে জমি থেকে বালু তুলে অন্য অংশ ভরাট করে ফেলা সহজ হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ভরাট করা হয়। এভাবে সহজেই হাওরের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ফেলা হয়।
স্থানীয় নবীর হোসেন বলেন, জমির শ্রেণি পরিবর্তনের অনুমোদন নেওয়া সময়সাপেক্ষ ও বেশ ঝামেলার কাজ। নবীগঞ্জ ও বাহুবল ভূমি অফিসের কয়েকজন তহশিলদারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে তাদের না জানিয়েই শিল্পপতিরা সব কাজ সেরে ফেলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী কৃষিজমিতে শিল্প বা আবাসিক এলাকা তৈরির জন্য জমি কেনার আগেই জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হয়। আবেদনটি প্রথমে জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে পাঠাবেন। ইউএনও তখন উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে প্রতিবেদন চাইবেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (তহশিলদার) সরেজমিন পরিদর্শন এবং কৃষি, মৎস্য ও বন বিভাগের মতামত পাওয়ার পর জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবেন। এর পর জেলা প্রশাসক সেই অনুমোদন দিতে পারেন।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কোনো অনুমোদনেরই তোয়াক্কা করেন না শিল্পপতিরা। আবার কেউ জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন করলে তখন চাপের মুখে স্থানীয় প্রশাসনকে শিল্পপতিদের পক্ষেই প্রতিবেদন দিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরেজমিন পরিদর্শনে ভূমির যে শ্রেণি পাওয়া যায়, সেই মোতাবেক ভূমি কর আদায় করে নতুন শ্রেণির বৈধতা দিয়ে দেওয়া হয়।
শিল্পপতিরা রাস্তার পাশে প্রথমে এক-দুই একর জমি একটু বেশি দাম দিয়ে কিনে পরে পেছনের জমি প্রায় পানির দরে কেনেন বলে জানান স্নানঘাট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার আবুল কালাম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, সাধারণত শিল্প মালিকরা দালাল দিয়ে জমি কিনতে চান। কারণ, তারা সরাসরি কিনতে এলে দাম বেশি চাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আরেক মধ্যস্থতাকারী শামসু মিয়া বলেন, ‘বেশি জমি কেনার ইচ্ছা থাকলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। আমরা কম দামে কিনে দিয়ে বেশি কমিশন নেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ, আমাদের আয়ের একটা অংশ ভূমি শাখার কর্মকর্তাদেরও দিতে হয়। নইলে জমির কাগজপত্র যত স্বচ্ছই হোক, তারা “ঘিয়ের মধ্যে কাঁটা” বের করার চেষ্টা করেন।’
এ ছাড়া স্থানীয় বা বহিরাগতদের উদ্যোগে পুকুরের নাম করে হাওর এলাকার যেখানে-সেখানে মাটি খনন করা হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, আইন বা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ড্রেজার বসিয়ে কৃষিজমি থেকে দেদার বালু তোলা হচ্ছে।
জমি নিয়ে লুকোচুরি
হবিগঞ্জের ১৩টি হাওরের মোট আয়তন ৭৩ লাখ ৫৭৯ একর। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের অবস্থান জেলার বাহুবল, নবীগঞ্জ, বানিয়াচঙ্গ ও সদর উপজেলা ঘেঁষে। এই হাওরে কী পরিমাণ জমি ছিল বা এখন কতটুকু আছে, তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায়নি সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেও।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সর্বশেষ হিসাবে, এই হাওরের জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ৮৩৩ একর। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ৬৪ হাজার ২২০ একর। ৮ বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৭ সালে পরিসংখ্যান বিভাগের প্রকাশিত হিসাবে হাওরের আয়তন দেখানো হয়েছে ১৬ হাজার ৪২৯ একর। জেলা মৎস্য অফিস জানিয়েছে, এই হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৩৯৯ একর ৪ শতক। চারটি অফিসের কর্মকর্তারাই তাদের হিসাব সঠিক বলে দাবি করছেন। আরেকটি রহস্যময় বিষয় হলো, চারটি উপজেলা ঘেঁষে এই হাওরের অবস্থান হলেও ওই চার সরকারি প্রতিষ্ঠানই বানিয়াচঙ্গ ছাড়া বাকি তিন উপজেলার হিসাব দেখাচ্ছে।
১০ বছর আগে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে জমির পরিমাণ কত ছিল জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এক মাস সময় নিয়েও কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
ওদিকে ২০১৬ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন হাওর ও জলাভূমি অধিদপ্তরের প্রকাশিত ‘ক্লাসিফিকেশন অব ওয়েটল্যান্ড অব বাংলাদেশ ভলিউম-৩’-এ দেখা যায়, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের মোট আয়তন ৬৯ হাজার ৮২৯ একর ৩৭ শতক। এর মধ্যে বাহুবল উপজেলায় ৩০ হাজার ১৫৬ একর ২০ শতক, বানিয়াচঙ্গ উপজেলায় ১৭ একর ২০ শতক, হবিগঞ্জ সদর ১৫ হাজার ৯০১ একর ৮৬ শতক ও নবীগঞ্জে ২৩ হাজার ৭৫৩ একর ৯৯ শতক।
হাওর এলাকায় দিনে দিনে জনবসতি বৃদ্ধি, হাজার হাজার পুকুর তৈরি, জমি ভরাট করে শিল্প-কারখানা স্থাপনের কারণে আগের চেয়ে এখন কৃষিজমির পরিমাণ অনেকটাই কমে আসছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. নূরে আলম সিদ্দিকী।
গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের আওতাধীন বাহুবল উপজেলার সাতকাপন ও স্নানঘাট ইউনিয়নের ছয়টি মৌজার নাম উল্লেখ করে গত ১০ বছরে কী পরিমাণ জমি বিক্রি করা হয়েছে, উল্লিখিত সময়ে জমির মূল্য কত ছিল জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার সুশান্ত ঘোষ এবং জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মৌজা হিসাব করে জমি কেনাবেচার তথ্য সংরক্ষণ করা হয় না। এসব উত্তর দিতে হলে প্রতিটি দলিল তল্লাশি করে বের করতে হবে, যা ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ।’
আবেদন-অনুমোদন খেলা
স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জানান, কাজী ফার্মের বিক্রি হওয়া জমির মধ্যে ৭৮ বিঘায় আগে তারা বর্গাচাষ করেছেন দীর্ঘদিন। ২০১৮ সালের দিকে জমির মালিকরা কাজী ফার্ম লিমিটেডের কাছে বিক্রি করে দেন। পরে কাজী ফার্ম প্রায় দুই বছর ধরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তুলে পুরো জমি উঁচু করে নেয়। তবে নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, এই জমির আগের মালিকের দলিল এবং বর্তমানে কাজী ফার্মের দলিল- দুই জায়গাতেই এটি এখনো ‘কৃষি’ শ্রেণি হিসেবেই আছে।
সরেজমিনে জানা যায়, চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের তলদেশ থেকে বালু তুলে বাহুবলে নির্মাণাধীন কয়েকটি স্থাপনা ও ছয় লেনের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করতে স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা মৎস্যজীবী লীগের নেতা তাজুল ইসলাম একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। হাওরে থাকা তার জমিতে ‘দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য’ বানানোর কথা বলে মাটি কেটে পাড় তৈরির অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন তিনি। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান এ বিষয়ে ইউএনও ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) প্রতিবেদন দিতে বলেন। অভিযোগ উঠেছে, ওই সিন্ডিকেট বাহুবল উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তাদের পক্ষে প্রতিবেদন করায়। প্রতিবেদন পেয়ে কয়েকটি শর্ত দিয়ে জেলা প্রশাসক মাটি কাটার অনুমোদন দেন। বাণিজ্যিক কাজে তাজুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের দীর্ঘদিন ধরে বালু তোলার বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানান স্থানীয় কৃষকরা। এ নিয়ে দেশ রূপান্তরসহ স্থানীয় পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে জেলা প্রশাসন তদন্ত করে এর সত্যতা পায় এবং অনুমোদন বাতিল করে। সরেজমিনে দেখা গেছে, বালু তোলা বন্ধ হলেও এখনো ড্রেজার মেশিন ও পাইপলাইন সরানো হয়নি।
গত ১৪ আগস্ট পরিবেশ অধিদপ্তর, হবিগঞ্জ কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, কাজী ফার্ম বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ডিজাইন না দেওয়ায় তাদের পরিবেশ ছাড়পত্রের আবেদন বাতিল করা হয়েছে। একই দিন জেলা প্রশাসন অফিসের রাজস্ব শাখায় যোগাযোগ করে জানা গেছে, কাজী ফার্ম বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য কোনো আবেদনই করেনি। অফিস সহকারী আব্দুল ওয়াদুদ বিভিন্ন ফাইলপত্র ঘেঁটে ওই কোম্পানির মাধবপুর উপজেলায় কয়েকটি প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন পেয়েছেন।
আব্দুল ওয়াদুদ জানান, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় ৫ একর ৭৪ শতক জমি শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ নামে একটি কোম্পানির আবেদন গত ২৩ জানুয়ারি মঞ্জুর হয়েছে। এ ছাড়া ওই কোম্পানি হাওর থেকে দুই-তিন কিলোমিটর দূরে পশ্চিম ম-লকাপন, হায়দরচক মৌজার ৬টি প্রজেক্টের জন্য প্রায় ৬৩ একর জমি কিনেছে। এগুলোর মধ্যে দুই-একটি বাদে বাকিগুলোর শ্রেণি পরিবর্তন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গড়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য হাওরের দিকেই ধাবিত হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনবে।
শিল্পপতি পক্ষের ভাষ্য
জানতে চাইলে কাজী ফার্মের ম্যানেজার (অ্যাডমিন) জিয়াউল হক দেশ রূপান্তরের কাছে দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা আছে। গত ৭ আগস্ট মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে জিয়াউল হক জানান, বাহুবল স্নানঘাটে তাদের প্রতিষ্ঠানে ডিম উৎপাদন পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। এখানে লেয়ার মুরগির ডিম ছাড়াও কম্পোস্ট সার উৎপাদন হবে। এসব মুরগি খুবই স্পর্শকাতর। পরিবেশ একটি বড় বিষয়। যদি এখানকার পরিবেশ অনুকূলে থাকে, তাহলে আরও কী কী উৎপাদন করা যাবে তা পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বায়ুদূষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশে^র নামকরা প্রতিষ্ঠান জার্মানির ‘বিগ ডাচম্যান’-এর সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। ফলে প্রকট দুর্গন্ধ বেরোনোর শঙ্কা খুবই কম। তবে তিনি এও বলেন, সব প্রাণীর শরীরেই গন্ধ থাকে। লাখ লাখ মুরগি যেখানে থাকবে, সেখানে কিছু গন্ধ তো হবেই।
মুরগির বিষ্ঠা সংরক্ষণের ব্যাপারে জিয়াউল হক বলেন, এর গন্ধ বের হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে গন্ধ দূর করা হয়। হাওরের জমি ভরাট করে শিল্প গড়ার আইনি দিক সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছাড়া এ-সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়।’
গত ২৪ আগস্ট বাহুবল উপজেলার আব্দাকামাল এলাকায় আকিজ ভেঞ্চার গ্রুপের নির্মাণাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্থানীয় ম্যানেজার (অ্যাডমিন) হাবিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, উপজেলার পুটিজুরী, সাতকাপন, স্নানঘাট ইউনিয়নের বিভিন্ন মৌজায় আকিজ গ্রুপের জমি রয়েছে। বর্তমানে আব্দাকামাল এলাকায় প্রায় ৬৫ একর জমিতে বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনের কাজ চলছে। গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই কিলোমিটারের মতো দূরে এই ‘শিল্পপার্ক’ নির্মাণের পর হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় তাদের আরও যে ৫৭৪ শতক জমি রয়েছে, তাতে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প গড়ে তোলা হবে। তিনি দাবি করেন, ইতিমধ্যে প্রশাসনের কাছ থেকে তারা জমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছেন।
‘খুবই অন্যায় হবে’
পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, হাওরে নিচু জমি ভরাট করে যদি শিল্প গড়া হয়, তাহলে পরিবেশের ওপর খুবই অন্যায় করা হবে। প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে হাওরের পানি প্রবাহ ও পানি ধরে রাখার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে এমন অবকাঠামো করা যাবে না। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের সময় হাওরের পানি প্রবাহ যাতে সঠিক থাকে, এ জন্য তিনি সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডিকে।
তিনি আরও বলেন, ‘উজান থেকে নেমে আসা পানির সঙ্গে বালু আসার ফলে অধিকাংশ হাওরের বুক বালুমাটি এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। হাওর ও বিলগুলোকে পুনঃখনন করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। এখন সেখানে যদি মাটি ভরাট করে শিল্প গড়া হয়, সেটা কখনোই কাম্য নয়।’
লাক্সারিয়াস জীবন পাওয়ার জন্য এখন মানুষ দিনরাত শুধুই কাজ করে চলেছেন। যার মধ্যে অফিস ডেস্কে বসে কাজ করেন এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চেয়ারে বসে ল্যাপটপের সামনে তাকিয়ে থাকা রীতিমতো যন্ত্রণাদায়ক।
শুধু তাই নয়, এটা স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। যারা অফিসে ডেস্কে কাজ করেন তাদের মোটা হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
সারাদিন যারা ডেস্কে বসে কাজ করেন তাদের অন্যতম অভিযোগও এটি। তারা বলে থাকেন, চেয়ারে বসে কাজ করে মোটা হয়ে যাচ্ছি! তবে এই অজুহাতকে একেবারে সত্য বলার সুযোগ নেই। কারণ ডেস্কে বসে কাজ করেও স্লিম ও ফিট থাকা সম্ভব। এজন্য মেনে চলুন পাঁচটি টিপস।
হাঁটুনফিট ও কর্মক্ষম থাকতে নিয়মিত হাঁটুন। দিনের পর দিন দীর্ঘ সময় বসে থাকলে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। সুস্থ থাকতে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করুন। এমনকি কাজের ফাঁকেও ১০ মিনিটের ব্রেক নিয়ে হেঁটে আসতে পারেন।
সোজা হয়ে বসুনচেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসুন। মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলোতে অনেক চাপ পড়ে, সেই সঙ্গে চাপ পড়ে মেরুদণ্ডের পাশের মাংসপেশি ও লিগামেন্টের ওপর। কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় মনিটরটি চোখের সমান স্তরে রাখুন। মাউস ব্যবহার করার সময় শুধু আপনার কব্জি নয় পুরো হাত ব্যবহার করুন।
চাপ এড়িয়ে চলুনএটা খুব কঠিন কাজ, চাপমুক্ত থাকা। বিশেষ করে যখন চারপাশ থেকে নানা ধরনের চাপ আসতে থাকে। তবে মানসিক স্থিরতা ধরে রাখুন, নিজেকে মোটিভেট করুন। কোনও চাপই বেশি দিন থাকে না, এগুলো নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট না করে নিজের কাজে মনোযোগ বাড়ান। এক্ষেত্রে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে অনলাইনে কিছু যোগা শিখে অভ্যাস করুন।
চোখের যত্নকম্পিউটারে কাজ করার সময় স্ক্রিনে একটানা ১০-১৫ মিনিটের বেশি তাকিয়ে থাকবেন না। নিয়মিত চোখের পাতা ফেলুন। স্ক্রিনে পর্যাপ্ত আলো রাখুন, যেন চোখের ওপর বাড়তি চাপ না পড়ে।
হাড়ের যত্ন বসে থাকার ফলে হাড় দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ক্যালসিয়ামের ঘাটতিও হতে পারে। এজন্য নজর দিতে হবে প্রতিদিনের খাবারে স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে নিয়মিত ডিম, দুধ, দই ও বাদাম রাখুন।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কোন দেশে ভালো চিকিৎসা হতে পারে তার খোঁজ নিচ্ছে বিএনপি। এর অংশ হিসাবে ঢাকায় জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসা জার্মানিতে হতে পারে কিনা জানতে চেয়েছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। মঙ্গলবার জানতে চাইলে ঢাকায় জার্মানির সিডিএ জান রল্ফ জানোস্কি বলেছেন, ‘মির্জা ফখরুলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। মিসেস জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার ধরন সম্পর্কে জেনেছি। তার ভালো চিকিৎসা বিশ্বের খুব কম দেশে সম্ভব। জার্মানিতে এসব সমস্যার খুব ভালো চিকিৎসা আছে। সরকারের অনুমোদন পেলে তিনি জার্মানিতে চিকিৎসা নিতে পারেন।’ এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি তিনি।
৯ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়লে খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর লিভারের জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কিডনির কর্মক্ষমতা কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ফলে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এ কারণে কয়েকবার তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করা হয়েছিল। এখন কেবিনে মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) লিভার, কিডনি, হার্ট, ফুসফুসসহ সার্বিক অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণে সম্প্রতি দুবার সিসিইউতে নিতে হয়। এখন মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন। ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ।
তিনি আরও জানান, মেডিকেল বোর্ড মনে করে সর্বসম্মতভাবে তাদের পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অতি দ্রুত বিদেশে লিভার প্রতিস্থাপনে সম্মিলিত আধুনিক মাল্টি ডিসিপ্ল্যানারি মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া জরুরি। তাহলেই তিনি শঙ্কা মুক্ত হতে পারেন বলে বোর্ড রিকমেন্ডেশনে বলেছেন।
এর আগে ১৩ জুন রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ওই সময় ৫ দিন পর তিনি বাসায় ফেরেন। গত বছরের জুনে খালেদা জিয়ার এনজিওগ্রাম করা হলে তার হৃদযন্ত্রে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর একটিতে রিং পরানো হয়। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রারাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ও হৃদরোগে ভুগছেন।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। এ অবস্থায় তাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে উন্নত চিকিৎসায় বিদেশে পাঠানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিবারই সরকার সেসব আমলে না নিয়ে খালেদা জিয়াকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখন দলীয় ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। আগের মতোই লিভারের জটিলতার পাশাপাশি ফুসফুসের জটিলতা নিয়ে শঙ্কিত তার চিকিৎসকরা। মেডিকেল বোর্ডের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার ফুসফুস থেকে পানি বের করা হয়েছে। শরীরে ক্যাথেডর লাগানো হয়েছে। আগে যেখানে দুই-তিন দিন পরপর পানি বের করা হয়েছে, এখন প্রতিদিনই পানি বের করতে হচ্ছে। তার কেবিনে মঙ্গলবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়েছে। ওই চিকিৎসক আরও বলেন, খালেদা জিয়ার অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি নেই। লিভার সিরোসিসের সঙ্গে কিডনির জটিলতাও বাড়ছে। তার লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া সামনে বিকল্প নেই। এর জন্য খুব দ্রুত উন্নত চিকিৎসায় বিদেশ পাঠানো দরকার।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা খুবই গুরুতর। গত সোমবার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন তার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। আবেদনটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ে আছে। গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত তাকে অনুমতি দেওয়ার কোনো খবর পাওয়া যায়নি বলে খালেদা জিয়ার একান্ত সহকারী জানিয়েছেন।
পাশাপাশি সরকারের অনুমতি পেলে দ্রুততম সময়ে তাকে বিদেশে নিতে ভিসা-প্রক্রিয়া শুরু থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ প্রয়োজনীয় সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। সরকারের সবুজ সংকেত না পাওয়ায় ভিসা করানো যাচ্ছে না।
গতকাল শুক্রবার দেশ রূপান্তরকে এসব কথা জানিয়েছেন খালেদা জিয়ার মেজো বোন সেলিমা ইসলাম।
তিনি বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালের খোঁজখবর নিচ্ছেন যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান। শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ থাকলে প্রথমে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হতে পারে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নত হলে অন্য দেশে নেওয়া হবে।
সেলিমা ইসলাম বলেন, ‘আমার বোন হেঁটে জেলে গেলেন। জেলে থাকাবস্থায় অসুস্থ হলে তাকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। এরপর করোনার কারণে সরকার তাকে দুটি শর্তে মুক্তি দেয়। তখন থেকেই আমরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে আবেদন করে আসছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার তাকে মুক্তি দেয়নি। বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে না পারায় দিনের পর দিন তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে আমার বোন।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী এবিএম আব্দুস সাত্তার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি নেতারা সার্বক্ষণিক চেয়ারপারসনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আমরা সরকারের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে আমরা দ্রুততম সময়ে চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠাতে পারব।’
জিয়া পরিবারের সদস্যরা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য তারা সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। অনুমতি পাওয়া মাত্র সব ধরনের পদক্ষেপ নেবেন। ইতিমধ্যে ভিসা প্রস্তুতিসহ অন্যান্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। বিদেশে নেওয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ অন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে যাবেন তার পুত্রবধূ শর্মিলা রহমান, ব্যক্তিগত সহকারী ফাতেমা ও ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসেন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি। তখন থেকেই তিনি হাসপাতালে খালেদা জিয়ার সেবায় সার্বক্ষণিক থাকছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আজ (গতকাল শুক্রবার) ম্যাডাম শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে বিকেলে তাকে তৃতীয়বারের মতো কেবিন থেকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নেওয়া হয়। রাতে আবার তাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। এর আগে ২২ সেপ্টেম্বর তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা অবনতি হওয়ায় হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে সিসিইউতে নেওয়া হয়েছিল। পরে অবস্থার উন্নতি হলে তাকে ফের কেবিনে স্থানান্তর করা হয়।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত চিকিৎসক দলের সদস্যরা জানান, খালেদা জিয়া ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। একই বছরের নভেম্বরে তার চিকিৎসকরা জানান, তিনি লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত দলীয় মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা তখন জানিয়েছিলেন, তাদের সাধ্য অনুযায়ী যতটুকু করার ছিল, তারা তা করেছেন। পরবর্তী চিকিৎসা যুক্তরাজ্য, জার্মানি অথবা যুক্তরাষ্ট্রে করার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পরিবারকে বলেছেন। পরের বছর জুন মাসে খালেদা জিয়ার হার্টে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর মধ্যে একটিতে রিং পরানো হয়। এখনো তার হার্টে দুটি ব্লক রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পাশাপাশি আমরা বিএনপি নেতারা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চেয়ারপারসনের পরিবারকে সার্বিক সহযোগিতা দিতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে দ্রুতই চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠানো হবে।’
গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহিলা দলের উদ্যোগে আয়োজিত সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘যে মানুষটি আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, তাকে আজ সরকার গৃহবন্দি করে রেখেছে। তিনি গুরুতর অসুস্থ হলেও তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। আমরা আশা করি, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে তার পরিবার যে আবেদন করেছে, তা সরকার বাস্তবায়ন করবে।’
সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ এক দফা দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে আটক রাখা হয়েছে। কারণ উনি মুক্ত থাকলে ওনাদের ক্ষমতায় থাকা কঠিন হয়ে যাবে। উনি মুক্ত থাকলে দেশের গণতন্ত্র মুক্ত থাকবে। উনি মুক্ত থাকলে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে না।’
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী, সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছে। ফলে এখন জেলে যাওয়া বা আদালতের আশ্রয় নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। ওই ৪০১ ধারাতেই বলা আছে, নির্বাহী আদেশে শর্ত ছাড়াই মুক্তি দেওয়া যায়। এমনকি সরকার সাজা মওকুফও করতে পারে। ফলে সরকারই শর্তহীন মুক্তি দিয়ে খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে।’
গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর বিষয়ে দুই-তিন দিন আগে তার ভাই শামীম এস্কান্দার এসেছিলেন। তিনি আবেদন জমা দিলে তা আইনমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে ব্যাখ্যার জন্য।
আবেদনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে থাকা বিএনপি নেতারা।
তারা গত বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছেন। খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। তারাও অপেক্ষা করছেন যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাবেন ওই নেতারা।
খালেদা জিয়াকে জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়ে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশে^র যে কয়েকটি দেশে সম্ভব, জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। এরপর থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এর আগেও অবশ্য খালেদা জিয়াকে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদযন্ত্রে জটিলতা, ফুসফুস, চোখ ও দাঁতের নানা সমস্যায় ভুগছেন। এ ছাড়া তার মেরুদ-, হাত ও হাঁটুতে বাতের সমস্যাসহ আরও কিছু শারীরিক জটিলতা রয়েছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার সাজা হয়। সেদিন থেকে প্রায় দুই বছর কারাবন্দি ছিলেন তিনি। এ ছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আরও সাত বছরের সাজা হয় খালেদা জিয়ার। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ করোনা মহামারির শুরুতে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার সাজা স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দিয়েছিল সরকার। এরপর থেকে তার মুক্তির মেয়াদ ছয় মাস করে বাড়ানো হচ্ছে।