
১৯১৩ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন কবি দীনেশ দাস। বাবা হৃষিকেশ দাস, মা কাত্যায়নী দেবী। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় গান্ধীর ‘লবণ সত্যাগ্রহ’ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ফলে পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটে। এর মধ্যেও ১৯৩০ সালে ম্যাট্রিক ও ১৯৩২ সালে আইএ পাস করেন। ১৯৩৩ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ায় বিএ পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। তার প্রথম কবিতা ‘শ্রাবণে’ দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯৩৪ সালে। বাবা সরকারি চাকরি নিতে বলায় অভিমান করে কবি ১৯৩৫ সালে চা বাগানে চাকরি নিয়ে কলকাতা ছাড়েন। পরের বছরই তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন এবং সাম্যবাদী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। ১৯৩৭ সালে লেখেন কালজয়ী কবিতা ‘কাস্তে’। কবিতাটি তাকে দ্রুত কবি খ্যাতি এনে দেয়। ১৯৩৮ সালে তিনি বিএ পাস করেন। ১৯৩৯ সালে ঢাকাবাসী উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী যামিনী বিশ্বাসের তৃতীয় মেয়ে মণিকা বিশ্বাসের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। পেশা হিসেবে বেছে নেন সাংবাদিকতাকে। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন। পরে চলে যান শিক্ষকতায়। তার কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে কবিতা, ভুখা মিছিল, দীনেশ দাসের কবিতা, অহল্যা, কাচের মানুষ, শ্রেষ্ঠ কবিতা/প্রথম পর্যায়, শ্রেষ্ঠ কবিতা, অসঙ্গতি, রাম গেছে বনবাসে। কবি ত্রিশ বছর স্কুলে শিক্ষকতা করে ১৯৭৮ সালে অবসর নিয়েছিলেন। ১৯৮০ সালে তিনি নজরুল একাডেমির ‘নজরুল পুরস্কার’-এ ভূষিত হন। দীনেশ দাস ‘উল্টোরথ’ পুরস্কারও লাভ করেছিলেন। তার শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘রাম গেছে বনবাসে’ রবীন্দ্র পুরস্কারে সম্মানিত হয়। ১৯৮৫ সালের ১৩ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং মানুষের মনোভাব নিয়ে প্রতিনিয়ত জরিপ হচ্ছে এবং ফলাও করে প্রচার হচ্ছে জরিপের ফল। দেশে এবং বিদেশে জরিপ নিয়ে নানা মুখরোচক কথা চালু আছে। কৌতুক আছে পরিসংখ্যান নিয়ে। কারণ মানুষ বাস্তবে যা দেখে, তা সবসময় জরিপে বা পরিসংখ্যানে উঠে আসে না। যেমন একটা কৌতুক আছে এ রকম যে শার্লক হোমস এবং তার গোয়েন্দা সঙ্গী ডা. ওয়াটসন বনের ধারে তাঁবু খাটিয়ে শুয়ে আছেন। রাতে ঘুম ভেঙে গেলে শার্লক হোমস ওয়াটসনকে জিজ্ঞেস করলেন, আকাশের দিকে তাকাও। কিছু দেখতে পাচ্ছ কি? ওয়াটসন খুব স্মার্ট ভঙ্গিতে বললেন, পাচ্ছি। কী দেখতে পাচ্ছ? হোমসের প্রশ্ন। ওয়াটসন বললেন, আমি দেখতে পাচ্ছি আকাশ জুড়ে লাখ লাখ তারা। এর মানে কী? হোমস জানতে চাইলেন। ওয়াটসন বললেন, আবহাওয়াবিদের দৃষ্টিতে দেখলে আগামীকাল রোদ হবে, দার্শনিকের দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে, এই বিশাল মহাকাশের তুলনায় আমরা কত ছোট।
হোমস চুপ করে আছেন দেখে ওয়াটসন জানতে চাইলেন, আপনি কী দেখছেন? গম্ভীর হোমস বললেন, ‘দেখছি তাঁবুটা নেই। আমরা যে তাঁবুটাতে ছিলাম কোনো এক চোর সেটা চুরি করে নিয়ে গেছে।’ আসলেই অনেক ক্ষেত্রে আমরা দূরের তারা গুনি, কিন্তু মাথার ওপরের তাঁবুটা যে চুরি হয়ে গেছে সেটা খেয়াল করি না। জরিপে তেমনি দূরের মানুষের সমস্যার কথা উঠে আসে। কিন্তু চোখ মেলে তাকালেই তো দেখতে পাওয়া যায় কী সমস্যায় ডুবে আছে মানুষ, ডুবে আছি আমরা। এর জন্য কি জরিপ লাগে?
তারপরও জরিপ করা হয়। প্রতিটি আলাদা ব্যক্তি মানুষের সমস্যাকে সমষ্টিগত সাধারণরূপে প্রকাশ করার জন্য। এর ফলে একটা গড় চিত্র পাওয়া যায়, কিন্তু গড় চিত্র দিয়ে ব্যক্তিগত সংকট দূর করা যায় না। যেমন ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে ১৫ জন মানুষ ডেঙ্গুতে মৃত্যুবরণ করছেন। ঢাকার অধিবাসীর তুলনায় এটা কত শতাংশ? এই শতাংশের হিসাবে কি মৃত্যুর বেদনা, সংকটের ভয়াবহতা, চিকিৎসার দুরবস্থা, মানুষের আতঙ্ক প্রকাশ করা যাবে? কেন ডেঙ্গু রোগীকে তরল খাওয়াতে হবে এ কারণে ডাব এবং স্যালাইনের দাম বহুগুণ বেড়ে যায়?
কারা বাড়িয়ে দিল এই দাম কিংবা কেন তারা ডাব লুকিয়ে রাখে দাম বাড়ানোর জন্য? ডিমের দাম কেন শ্রমজীবী মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়, আলু কৃষক বিক্রি করেন ১০ টাকা কেজি আর দুই মাস পরেই বাজারে তার দাম হয়ে যায় ৩৫ টাকা, পেঁয়াজ, রসুন, আদা তো বটেই, কাঁচা মরিচ কেন কখনো কখনো হাজার টাকা কেজিতে বিক্রি হয়? এসবের উত্তর সব জরিপ থেকে পাওয়া যাবে না। উত্তর খুঁজতে হলে ক্ষমতার রাজনীতি আর ব্যবসায়ীদের রাজনীতিকরণের বিষয় খেয়াল করতে হবে। এর শিকড় আছে গভীরে, কিন্তু প্রভাব সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে।
যেমন ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা দেশের অর্থনীতি যে ভালো নেই, সেটা তিনি নিজের জীবন থেকেই উপলব্ধি করে বলেছেন, ‘অর্থনীতি বড়দের ব্যাপার, সেটা ভালো বুঝি না। কিন্তু কঠোর পরিশ্রম করার পরও আমার অর্থনৈতিক অবস্থা দুই বছরে আগের তুলনায় খারাপ হয়েছে। বেতন যা বাড়ছে, জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। দুটি সেভিংস ছিল, ভেঙে ফেলতে হয়েছে। আশপাশের অন্যদের অবস্থাও তো ভালো না। আমার এক বন্ধু এলসি খোলার জন্য ব্যাংকে ব্যাংকে ঘোরে, এলসি খুলতে পারছে না। আমাদের মতো যাদের অবৈধ উপার্জন নেই, তাদের জন্য সংসার চালানো, তিন বেলা ডাল-ভাত খাওয়াই কষ্টকর হয়ে উঠছে।’ এ ধরনের কর্মকর্তারা ৪০-৫০ হাজার টাকা বেতন পেয়ে থাকেন। তারপরও তার এই কথার সঙ্গে দ্বিমত করার কিছু আছে কি? আর যাদের আয় ১৫ হাজার টাকা তাদের জীবন চলছে কেমন করে?
একটা জরিপে উঠে এসেছে ৭০ শতাংশ মানুষ বলেছেন, দেশের অর্থনীতি ঠিক পথে চলছে না এবং এর প্রভাবে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে উঠছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকারত্ব, আয় না বাড়া আর শিক্ষা, চিকিৎসার ব্যয় বৃদ্ধি। ফলে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। অবশ্য এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে কেউ কেউ বলে ওঠেন, এসব বানানো কথা। বাজারে প্রচুর জিনিস আছে, কোনো সংকট নেই। মানুষের আয় আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদের মতে, অর্থনীতি ঠিকমতো চলছে কিনা, তিনটি পক্ষ তা ভালোমতো বুঝতে পারছেন।
প্রথম পক্ষ হলেন দেশের জনগণ, তারা সংখ্যায় বেশি এবং তারাই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আয় না বাড়ার কারণে তাদের খাওয়া কমাতে হচ্ছে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় পক্ষ হলেন ব্যবসায়ীরা, যারা ডলারের অভাবে এলসি খুলতে পারছেন না, আমদানি হচ্ছে না, ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে।
আর তৃতীয় পক্ষ হলেন সরকারি কর্মকর্তারা। কারণ তারা দেখছেন রিজার্ভ কমে যাচ্ছে, দারিদ্র্য বেড়ে যাচ্ছে, মূল্যস্ফীতি আটকানো যাচ্ছে না, ক্রমাগত বাড়ছে। এসব তথ্য সরকারি পরিসংখ্যানেই দেখা যাচ্ছে। তিন পক্ষই তো সমস্যাটা বুঝলেন, কিন্তু সমাধান করবে কোন পক্ষ? সমাধানের উদ্যোগ কিংবা দ্রুত অবসানের তো কোনো লক্ষণ কোথাও দেখা যাচ্ছে না। বরং ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে সমস্যাকে উপেক্ষা করার প্রবণতাই বেশি। তুলনা দেন তারা ইউরোপের সঙ্গে, যুক্তি করেন কোথায় বাড়ছে না জিনিসের দাম? কেউ আবার আগ বাড়িয়ে বলেন, দাম বেড়েছে সত্যি, কিন্তু সাধারণ মানুষের আয় বেড়েছে তার চেয়েও বেশি। ফলে সমস্যা নেই কোনো। কিন্তু সাধারণ মানুষ বোঝেন, জীবনযাপনের কষ্ট কত বেড়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করছেন, সাধারণ মানুষেরা তাদের ব্যক্তিজীবনের আর্থিক চাপ, মূল্যস্ফীতির কারণে ‘অর্থনীতি ভুল পথে’ রয়েছে বলে মন্তব্য করলেও বাস্তবে অর্থনীতির সমস্যাগুলো আরও ব্যাপক। সে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ১০ শতাংশ মানুষ ধনী এবং উচ্চবিত্ত হলে তার সংখ্যা দাঁড়ায় এক কোটি ৭০ লাখ। ৪ জনের পরিবার ধরলে তার সংখ্যাও দাঁড়ায় ৪২ লাখ। অর্থাৎ ৪২ লাখ ধনীর কাছে ট্যাক্স আদায় কি হয়? সাধারণ মানুষের কিন্তু পরোক্ষ করের হাত থেকে রেহাই নেই। খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধ, সন্তানের শিক্ষা, ব্যাংকের টাকা, যাতায়াত খরচ, মোবাইল ব্যবহার কোথায় নেই ট্যাক্সের হাত? কিন্তু আমাদের রাজস্ব আদায়ের নিম্ন হার, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো খাতে বিনিয়োগ করতে না পারা, বৈদেশিক খাতের আর বিনিয়োগের ভঙ্গুর অবস্থা, রিজার্ভের খারাপ অবস্থা, এমনকি আইএমএফের কাছে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে না পারা সব সূচকই তো নেতিবাচক হয়ে পড়ছে। ডলারের তুলনায় টাকার দাম কমে যাওয়া আর ডলার হয়ে টাকা পাচার হওয়া তো সমানতালেই চলছে। এর প্রভাব অর্থনীতিতে এবং মানুষের জীবনে ব্যাপক।
পরিসংখ্যান ব্যুরো আর বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, মূল্যস্ফীতি আগস্ট মাসে ৯.৯২ শতাংশ, জুন মাসের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯.৭৪ শতাংশ, জুলাই মাসে ছিল ৯.৬৯ শতাংশ। ভারতে আগস্ট মাসে ৭ শতাংশ, অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত শ্রীলংকায় ৪ শতাংশ, নেপালের রাষ্ট্র ব্যাংক সূত্রে জানা যায় সেখানে ৬.৮৩ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ৬ শতাংশ, মূল্যস্ফীতি কমেছে ইউরোপ, আমেরিকা আর কানাডাতেও। মূল্যস্ফীতির এই হিসাব থাকে খাতায় কিন্তু এর প্রভাব দেখা যায় বাজারে আর সাধারণ মানুষের খাবারের পাতে।
দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না, শ্রমজীবীদের মজুরি। বাংলাদেশের ৭ কোটি ৩৪ লাখ শ্রমজীবী মানুষ যাদের ৮৫ শতাংশের বেশি শ্রমিকের নিয়মিত কাজ নেই, মাসিক মজুরি নেই আছে শুধু অনিশ্চয়তা। রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশ আসে যে গার্মেন্টস খাত থেকে, সেই খাতের প্রায় ৩৫ লাখ শ্রমিকের সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮ হাজার টাকা ২০১৮ সালে। এই পাঁচ বছরে দ্রব্যমূল্য কত শতাংশ বেড়েছে আর মজুরি কত টাকা বেড়েছে এই প্রশ্নের জবাব কী? অথচ এই শ্রমিকের শ্রম যুক্ত হয়ে গার্মেন্টসে দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলেছে।
নানা রিপোর্টে দেখা গেছে, বাংলাদেশ গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানিতে দ্বিতীয় হলেও শ্রমিকের মজুরিতে সর্বনিম্ন। শ্রমিকরা যা খায় আর যা ব্যবহার করে সব কিছুর দাম বাড়ছে, শ্রমিকরা যা উৎপাদন করে তার দাম বাড়ছে কিন্তু বাড়ছে না শ্রমিকের মজুরি। এই শ্রমিকরাই তো উৎপাদন করে, তার ফলে দেশের প্রয়োজন মেটে আর বিদেশে রপ্তানি হয়, আসে বৈদেশিক মুদ্রা। জীবনমান না বাড়লে উন্নয়ন যতই হোক না কেন, তাদের জীবনকে তা স্পর্শ করবে না।
আসলে জরিপ প্রয়োজন প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য, সমস্যা চিহ্নিত করার জন্য আর সমাধানের পথ বের করার জন্য। একটা সংকট মানুষের জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করে এবং মানুষ সে বিষয়ে কী ভাবে তা জানা খুবই জরুরি। তাই জরিপ নিয়ে তাচ্ছিল্য করে আর সমস্যাকে উপেক্ষা করে সাময়িক তৃপ্তি পাওয়া যাবে কিন্তু সমস্যার জটিল আবর্ত থেকে বের হওয়া যাবে না। মানুষের কষ্ট নিয়ে উপহাস নয়, সমবেদনা দরকার। দূরের উদাহরণ দেখানো নয়, কাছের সমাধান সূত্র বের করা দরকার। সবচেয়ে বেশি দরকার জবাবদিহি।
রাজনীতিতে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন। নির্বাচনের সময় জনগণ যেন বাছাই করতে পারে তাদের প্রতিনিধিদের আর নির্বাচিত হলে প্রতিনিধিরা যেন শাসক হয়ে না উঠেন, সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। প্রশাসনের দুর্বৃত্তপনা, রাজনীতির দুর্র্বৃত্তায়ন বন্ধ কোনো জাদুর মন্ত্রে হবে না। এর জন্য প্রয়োজন প্রতিবাদের সংস্কৃতি, রাজনীতি ও রাজনৈতিক জবাবদিহিতা, অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচন। দেশের অর্থনৈতিক সংকট যেমন রাজনীতির বাইরে নয়, তেমনি সমাধানটাও খুঁজতে হবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতেই। লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলাম লেখক
এসএসসি পরীক্ষায় খাতা মূল্যায়নে অবহেলা করায় পরীক্ষকের দায়িত্বে থাকা ৩৯ জন শিক্ষককে কালো তালিকাভুক্ত করেছে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড। তারা আগামী পাঁচ বছর বোর্ডের অধীনে কোনো পাবলিক পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। ৫ সেপ্টেম্বর কালো তালিকাভুক্ত শিক্ষকদের নামের তালিকা প্রকাশ করে ঢাকা বোর্ড। কর্তৃপক্ষ জানায়, পরীক্ষার খাতা দেখায় অবহেলা আর সহ্য করা হবে না। এসব পরীক্ষক খাতা দেখায় অবহেলা করায় চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষায় বহু শিক্ষার্থীর ফল ফেল আসে। পরে খাতা পুনর্নিরীক্ষণ করে দেখা যায়, তারা পাস করেছে। বোর্ড পরীক্ষা খাতা দেখায় অবহেলার কারণে বোর্ড কর্তৃপক্ষ অন্তত কিছু একটি করেছে, এটি ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। ২৮ জুলাই চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। ফল প্রকাশের পর ঢাকা বোর্ডে ৭৩ হাজার শিক্ষার্থী ফল পুনর্নিরীক্ষার বা খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন করে। ২৮ আগস্ট খাতা চ্যালেঞ্জের ফল প্রকাশের পর দেখা যায়, এ বোর্ডে ফেল থেকে পাস করেছে ১০৪ জন শিক্ষার্থী। আর নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩৬২ জন পরীক্ষার্থী। এ বোর্ডের মোট ৩ হাজার ৮৫ জন পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। ঢাকা বোর্ডের ৭৩ হাজার ৪৬ জন পরীক্ষার্থী এক লাখ ৯১ খাতা পুনর্নিরীক্ষার আবেদন করেছিল। খাতা দেখায় মূল্যায়নে দায়িত্বহীনতা ও অবহেলার কারণে কালো তালিকাভুক্ত হওয়াদের তালিকায় আছেন বাংলা দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষক, ইংরেজি প্রথম পত্রের পরীক্ষক, ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষক, গণিতের পরীক্ষক, উচ্চতর গণিতের পরীক্ষক, বিজ্ঞান বিষয়ের পরীক্ষক, রসায়ন, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিষয়ের পরীক্ষক। বোর্ডের খাতা মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে শুধু অভিজ্ঞ কিংবা নামকরা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হলেই চলে না, সর্বোপরি যারা সিনিয়র এবং পেশার প্রতি যাদের কমিটমেন্ট আছে এবং যারা প্রাইভেট কম পড়ান তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
১৯৯১ সালে আমি ঘাটাইল ক্যান্টনমেন্ট কলেজে শিক্ষকতা শুরু করি। ঢাকা বোর্ড থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের খাতা পরীক্ষণের জন্য চিঠি পেলাম। সে এক আলাদা আনন্দ ও নিজেকে অনেক সম্মানিত বোধ করছিলাম। চিঠিতে লেখা সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে বোর্ড অফিসের সম্মেলন কক্ষে এক আলোচনা সভা ও খাতা পরীক্ষণের নিয়মকানুনের ওপর একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হবে। আমি ওই তারিখে সকাল ৮টায় বোর্ডে হাজির হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সকাল সাড়ে ৮টায় কেন, আধা ঘণ্টা আগে উপস্থিত হই এবং আরও ভেবেছিলাম যে, ঢাকা বোর্ডের সম্মেলন কক্ষ নিশ্চয়ই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোনো কক্ষ এবং শিক্ষকদের বসার স্থানও সে রকম উন্নতমানের হবে। কারণ এখানে বসেই সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু সকাল সাড়ে ৮টা তো দূরের কথা, দুপুর ১২টার দিকে দেখলাম দু’একজন শিক্ষক হাতে একটি করে চটের বস্তা নিয়ে আস্তে আস্তে সম্মেলন কক্ষের দিকে আসছেন। আর সম্মেলন কক্ষটি এসি তো দূরের কথা, ভাঙাচোরা শব্দ করা ফ্যান আর বসার জন্য বিয়ের ডেকোরেটর থেকে সম্ভবত ভাড়া করা কাঠের ফোল্ডিং চেয়ার। গ্রীষ্মকাল, বেশ গরম পড়ছিল। দুপুর ১টার দিকে মিটিং শুরু হলো। মাননীয় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এসে শিক্ষকদের সামনে কথা বলা শুরু করলেন। অমনি সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু শিক্ষক দাঁড়িয়ে বললেন, ‘গত বছর খাতা দেখার বিল এখনো পাইনি, এবার বিল না পাওয়া পর্যন্ত কোনো খাতা নেব না।’ শুরু হলো চিৎকার-চেঁচামেচি। মোটামুটি উপস্থিত সবাই তাতে অংশ নিলেন। একপর্যাযে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তার অসহায়ত্বের কথা বললেন। শিক্ষার এই করুণ হাল দেখে পুরোটাই আশা ভঙ্গ হয়েছিল আমার। তখন ভেবেছিলাম আমার দেশের শিক্ষার এই করুণ হাল! কবে দূর হবে এসব? সেখানে শিক্ষকদের বসার ভালো ব্যবস্থা এবং অন্যান্য বিষয় অনেকটাই স্মার্ট হতে পারত। এতদিনে হয়তো অনেক পরিবর্তন হয়েছে! পরের বছর ঢাকা বোর্ডের ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষক। ঢাকা সিটির দুটি কলেজের খাতা পেলাম। খাতা পাওয়ার সপ্তাহখানেকের মধ্যে ঢাকা থেকে ১৮-২০ জন শিক্ষার্থীর একটি দল ঘাটাইলে চলে গেছে। ক্যান্টনমেন্ট বিধায় ভেতরে কেউ যায়নি বা যেতে পারেনি। আমাদের কলেজেরই লোকাল এক ছাত্রের মাধ্যম খবর পাঠাল, তাদের পাস করিয়ে দিলে তারা সবাই মিলে মোটা একটি অঙ্কের টাকা আমাকে দেবে। আমি ওই ছেলেকে বলেছিলাম জীবনে কী হবো জানি না, আমার মনের এখন যে অবস্থা সেটি কতদিন থাকবে তাও জানি না, তবে মনে রেখো আমাকে এসব বলে লাভ নেই।
তারপর ক্যাডেট কলেজে যোগদান করি, সিলেট ক্যাডেট কলেজ। তারপর কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজে বদলি হই। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে খাতা আনতে গিয়ে প্রতি বছরই একই চিত্র, বরং আরও ভয়াবহ চিত্র দেখতাম। একবার পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হাতজোড় করে শিক্ষকদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছেন আর বলছেন, ‘এই চেয়ারে আপনারা আসেন, বসেন, দেখেন কত কঠিন। আপনাদের সহযোগিতা ছাড়া আমি কীভাবে কাজ করব?’ বুঝলাম কলেজ থেকে ডেপুটেশনে যাওয়া শিক্ষকগণ যত বড় পদেই থাকুন না কেন, তারা অনেকটাই অসহায়।
কুমিল্লা থেকে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে চলে এলাম, আবার ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষক। মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে চাকরি ইস্তফা দিয়ে রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে যোগদান করলাম। অর্থাৎ ঢাকা বোর্ডেরই পরীক্ষক। প্রতি বছরই বোর্ডে খাতা আনতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতাম। ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শিক্ষকদের খাতা মূল্যায়নের বিভিন্ন কা-কারখানা প্রমাণসহ দেখাতেন। কিছু শিক্ষক বোর্ডের খাতা নিয়ে পাশের দেশে চলে গেছেন, জীবনে আর ফিরে আসেননি। এক শিক্ষক খাতা নিয়ে লঞ্চে উঠেছিলেন, লঞ্চডুবি হয়েছে সঙ্গে খাতা ডুবিও হয়েছে। স্বভাবতই, ফল বিড়ম্বনা। আমার জানা এক শিক্ষক উচ্চ মাধ্যমিকের ইংরেজি খাতা দেখিয়েছিলেন তার স্ত্রীর দ্বারা, যিনি নিজেও ওই বছরই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন এবং ইংরেজিতে ফেল করেছিলেন। এক পরীক্ষক এক বান্ডেল খাতা বাসে ফেলে রেখে বাসায় চলে গেছেন। বাসের কন্ডাক্টর রাতের বেলা গাড়ি পরিষ্কার করার সময় বান্ডিলটি পান এবং পরদিন সকালে পরিচিত কারোর সঙ্গে আলাপ করার পর এক সাংবাদিকের হাতে খাতার বান্ডেল তুলে দেন। তিনি জায়গামতো বান্ডিলটি পৌঁছে দিয়েছিলেন, ফলে মন্ত্রণালয় থেকে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে ডেকে পাঠিয়েছেন তৎকালীন মাননীয় মন্ত্রী।
বোর্ডগুলো স্বায়ত্তশাসিত কিন্তু নিজেদের সেই স্বায়ত্তশাসন তারা কতটুকু কাজে লাগাতে পারে বা লাগায় সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। দেখা যায়, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ বা ইশারা ছাড়া তারা কিছুই করতে চায় না। ফলে একটি ট্র্যাডিশন হয়ে গেছে এবং মন্ত্রণালয়ের আমলারা সেভাবেই আচরণ করেন বোর্ডের সঙ্গে।
জীবনে কিছু পরীক্ষককে দেখেছি সর্বোচ্চ সততার সঙ্গে, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বোর্ডের খাতা মূল্যায়ন করেছেন যাদের অনেকেই আজ পৃথিবীতে নেই। আবার এমন কিছু পরীক্ষককেও দেখেছি যারা বলতেন খাতায় বেশি বেশি নম্বর দেবেন। বেশি নম্বর দিলে রিস্ক কম। কেউ আপনাকে কিছু বলবে না। কিন্তু যদি কম দেন তাহলেই দেখবেন যত ঝামেলা। অর্থাৎ মূল্যায়ন কিন্তু হচ্ছে না এসব শিক্ষকদের কাছে। আবার কিছু পরীক্ষক বোর্ডের খাতা বারবার নিয়ে আসতেন। তারা বলতেন, একটি খাতা ফেলতে পারলেই তো ১২-১৫ টাকা খাড়া। এত সময় নষ্ট করার কী আছে। শেক্সপিয়ারের ‘এস’ দেখলেই নম্বর দিয়েছি। এর ফলে আমরা দেখি যেসব শিক্ষার্থী ফেলের খাতায় থাকত তারাও কল্পনার বাইরে নম্বর পেয়ে পাস করে। এখন যেটি হয়েছে, শিক্ষার্থীদের কোনোভাবেই নাকি ফেল করানো যাবে না! ফলে শিক্ষকরাও সেই রকম করেন। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আমরা মূল্যায়ন নিয়ে যত আলোচনা, যত কথা বলি, কীভাবে শিক্ষার্থীদের শেখানো হবে বা তারা কীভাবে শিখবে, এসব নিয়ে সিকিভাগের এক ভাগ কথাও বলি না। যদি শিক্ষার্থীদের কোনো বিষয় শেখাতেই না পারি, তাহলে কী মূল্যায়ন করব?
লেখক : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক
দৈনিক ইত্তেফাকে কলাম লিখতেন- ‘মোসাফির’ নামে। অসাধারণ শব্দনৈপুণ্যে বিদ্ধ করতেন পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আইয়ুব খানকে। সেইসময় অসংখ্যবার তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন, কারাবরণ করেছেন। অতীতের সঙ্গে অধুনার সংযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে আজ ছাপা হলো সেই উপসম্পাদকীয় পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী কাম পশ্চিম পাকিস্তানের কনভেনশন লীগের মনোনীত প্রেসিডেন্ট মাসুদ সাদিকের তুলনা মাসুদ সাদিক সাহেবই। গৃহের কোণে বসিয়া এ যাবৎ তিনি মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচনে ৮০ পার্সেন্ট আসন দখলের কথা প্রকাশ করিয়াছেন। এক্ষণে তিনি নবনির্বাচিত মৌলিক গণতন্ত্রীদের সভা আহ্বান করিয়া বক্তৃতাও ঝাড়িতেছেন। এই ‘সভায়’ শতকরা ৮০ জন মৌলিক গণতন্ত্রী যোগদান করেন কি-না, তার কোন উল্লেখ থাকে না কিংবা নবনির্বাচিত মৌলিক গণতন্ত্রীরা কে কি বক্তৃতা দেন, তারও উল্লেখ থাকে না। তবে মাসুদ সাদিকের বক্তৃতা হইতে বোঝা যায় যে, এই ‘সভায়’ আইয়ুব-শাসনামলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এবং শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের প্রভাব প্রতিপত্তি-দৌরাত্ম্যের অভিযোগ ওঠে।
মি. মাসুদ সাদিক এ ধরনের একটি সভায় হুঙ্কার দিয়ে বলিয়াছেন যে, কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান যদি কখনো মুনাফা শিকারে প্রবৃত্ত হয়, তাহা হইলে সরকার সর্বশক্তিতে তাদের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িবেন এবং দোষী সাব্যস্ত হইলে ঐ সব প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করিবেন না। অতঃপর তিনি দাবী করিয়াছেন যে, আইয়ুব সরকার জনগণের কল্যাণেই নিবেদিত এবং ইহা শিল্পপতিদের সরকার নহে।
কনভেনশনপন্থীরা ধাপ্পাবাজি সম্বল করিয়াই নির্বাচনী বৈতরণী পার হইতে চায়। মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচনে পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলে চরমভাবে বিপর্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও তাঁদেরকে কেহ শতকরা আশির নিচে নামাইতেও পারিতেছে না। এহেন ব্যক্তিদের পক্ষে প্রয়োজন-বোধে যে কোন উক্তি করা সম্ভব, সত্য-মিথ্যার কোন বালাই তাঁদের নাই। জনাব মাসুদ সাদিক শিল্পপতিদের উদ্দেশে যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়াছেন, তাহা তাঁদের প্রয়োজনেই করিয়াছেন; কেননা উভয় অঞ্চলের মানুষ আজ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির চাপে যেভাবে নিষ্পেষিত হইতেছে, তাতে ঐ ধরনের উক্তি না করিয়া তাঁদের উপায় নাই। কিন্তু এই উক্তি যে সম্পূর্ণ অসার ও ধোঁকামূলক, কার্যক্ষেত্রেই তার প্রমাণ রহিয়াছে।
প্রথমত, বর্তমান শাসনামলে সকল জিনিসপত্রের উপর হইতে কন্ট্রোল তুলিয়া লওয়া হইয়াছে। ইহার ফলে দ্রব্যমূল্য শোঁ শোঁ করিয়া বৃদ্ধি পাইয়াছে; শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা দ্বিগুণ-তিনগুণ মুনাফা অর্জন করিতেছে; কিন্তু যেহেতু দ্রব্যমূল্য নির্ধারিত হয় নাই, সেই হেতু তারা যে হারে মুনাফা হাঁকুন না কেন, আইনের চক্ষে তাঁরা অপরাধী নন।
অতএব, শিল্পপতিরা মুনাফা অর্জনে প্রবৃত্ত হইলে তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে বলিয়া মি. মাসুদ সাদিক যে হুমকি প্রদান করিয়াছেন, তাহা কেবল অসারই নয়, ধাপ্পাবাজিও বটে। গত ৬ বছরে অতি মুনাফা অর্জনের ‘অপরাধে’ একজন শিল্পপতির বিরুদ্ধেও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নাই। বস্তুতপক্ষে, প্রচলিত আইনে এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের কোন বিধানও নাই। অবাধ অর্থনীতির নামে অবাধ লুণ্ঠনের ব্যবস্থাই প্রচলন করা হইয়াছে।
দ্বিতীয়ত, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্প, মায় ব্যাংক ও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীগুলি যে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি পরিবারের কুক্ষিগত হইয়াছে, এই বাস্তব অবস্থা শাসন কর্তৃপক্ষ এমনকি ‘অর্থের যাদুকর’ অর্থমন্ত্রী মি. শোয়েবও অস্বীকার করিতে পারেন নাই। বিগত বাজেট অধিবেশনে তিনি এই একচেটিয়া পুঁজিবাদ তথা কার্টেলের বিরুদ্ধে সতর্কবাণীও উচ্চারণ করিয়াছিলেন। তৎপূর্বেও তিনি মাঝে মাঝে এ ধরনের সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়াছেন নিছক জনমতের চাপে। অবশ্য এই কার্টেল ব্যবস্থা রোধের কোন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নাই।
তৃতীয়ত, শুধু বুনিয়াদী ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরাই বর্তমান শাসনামলে শিল্পে-বাণিজ্যে একচেটিয়া প্রভুত্ব কায়েম করে নাই; কর্তাব্যক্তিদের কোন কোন আত্মীয়-স্বজনও এই কয়েক বৎসরের মধ্যে বিরাট শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী বনিয়াছেন। সুতরাং এই একচেটিয়া ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের গায়ে হাত দেওয়া মি. মাসুদ সাদিক কিংবা অন্য কোন অনুগ্রহভোগীর পক্ষে সম্ভব নয়।
চতুর্থত, এই সকল বৃহৎ শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের নিকট হইতে দেড় কোটির অধিক টাকা সংগ্রহ করিয়া ‘জাতীয় প্রেসট্রাক্ট’ গঠন করা হইয়াছে; এ খবর দেশের প্রত্যেকটি মানুষ রাখে। পুঁজিপতিদের নিকট হইতে সংগৃহীত অর্থে পরিচালিত পত্রিকাগুলি জনাব আইয়ুবকে ক্ষমতায় বহাল রাখিবার জন্য কীভাবে দিনকে রাত ও রাতকে দিন করিয়া প্রচার করিতেছে, দেশবাসী তাহাও লক্ষ করিতেছে।
তাই বর্তমান ক্ষমতাসীন মহল এবং একচেটিয়া পুঁজিপতি-শিল্পপতিদের মধ্যকার এই আঁতাত সত্ত্বেও যাঁরা দাবী করিতে পারেন যে, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের উপর ক্ষমতাসীনরা ‘ঝাঁপাইয়া পড়িবেন, ধাপ্পাবাজিই যে তাঁদের একমাত্র সম্বল তাহা না বলিলেও চলে।
তদুপরি শুধু প্রেস ট্রাস্টের অর্থ সংকুলানই নয়, ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচন পরিচালনার জন্যও শিল্পপতিদের নিকট হইতে কি বিপুল পরিমাণ টাকা সংগ্রহ করা হইয়াছে ও হইতেছে, তার খবরাখবর অনেকেরই আছে এবং প্রয়োজনবোধে তার মোটামুটি হিসাবও প্রকাশ করা যাইতে পারে। অবশ্য এদেশে অর্থ বিলাইয়া এখানে-ওখানে কিছুটা অনর্থ অর্থাৎ গুন্ডা-শুন্ডার উৎপাত সৃষ্টি করা যাইতে পারে; কিন্তু ভোটারদের প্রভাবিত করা চলে না।
গ্রামাঞ্চল হইতে বহু খবর আসিয়াছে যেখানে একশ্রেণির প্রার্থীরা ভোটারদের খানাপিনার জন্য বহু অর্থ ব্যয় করিয়াছে। ভোটাররা খানাপিনার অংশও গ্রহণ করিয়াছে, কিন্তু সময়কালে কুপোকাৎ। আমরা জানি, অসৎ পথে উপার্জিত অর্থের এভাবেই অপচয় ঘটে। সেই জন্য কে কোথায় টাকা উড়াইল, তাহা নিয়া কেহ মাথা ঘামায় না। কিন্তু যাঁরা পুঁজিপতি-শিল্পপতিদের অবাধ মুনাফা অর্জনের পোয়াবারো করিয়া দিয়াছেন, যাঁরা পুঁজিপতিদের অর্থে নিজেকে প্রচারের জন্য সংবাদপত্র পরিচালনা করিয়েছেন, যাঁরা পুঁজিপতিদের চাঁদায় নির্বাচনী অভিযান চালাইতেছেন, তাঁদের মুখে শিল্পপতিদের উপর ‘ঝাঁপাইয়া’ পড়িবার কিংবা তাদেরকে ‘শায়েস্তা’ করিবার লম্বা লম্বা বুলি শুনিলে মানুষকে ‘লা-হাওলা-অলা’ বলিতে হয় বৈ কি। মনে হয়, লজ্জাও ইহাদের নিকট হইতে লজ্জায় পলায়ন করিয়াছে।
লেখক: তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া
প্রতিষ্ঠাতা, দৈনিক ইত্তেফাক
১৯ নভেম্বর, ১৯৬৪
মূল্যস্ফীতির রাজনৈতিক অভিঘাত প্রবল। মনে হচ্ছে, এই সমস্যাটি বহুলাংশে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কিন্তু সুযোগ ছিল, মূল্যস্ফীতির গতি ধীর করার। সরকার সেই সুযোগ ছাড়বে কি ছাড়বে না, তা এখনো স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। কিন্তু একটি কথা অবধারিতভাবেই সত্য, কাঠামোগত উন্নয়নের জোয়ারে দেশ ভাসলেও, সাধারণ জনগণের মানোন্নয়নে তেমন কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের আগে, কোনো উন্নয়নই সর্বজনগ্রাহ্য হয় না। এমনকি যেসব মানুষ আদর্শগতভাবে সরকারের সমালোচক, তারা দেশের কাঠামোগত উন্নয়নের সুবিধা নিলেও, ব্যক্তিপর্যায়ে কোনোভাবেই সরকারের প্রশংসা করবে না। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া নিয়ন্ত্রণহীনভাবে এমন করে দৌড়াচ্ছে যে, সরকারদলীয় আদর্শগত সমর্থকরাও ধীরে ধীরে ন্যুব্জ হয়ে পড়ছেন। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তারাও কোনো যুক্তি দাঁড় করাতে পারছেন না। ফলে বাজারে যদি আটা, তেল, পেঁয়াজ এবং সবজির দাম বাড়ে; অথবা যদি চালের উৎপাদনে টান পড়ে, তাহলে বৈশ্বিক ক্ষুধার মানচিত্রে এর প্রভাব কতখানি? কিন্তু এই সমস্যাটা যখন হয় অভ্যন্তরীণ, তখন অর্থনীতির কোনো সূচকেই বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা যায় না। এটা ঠিক যে বাংলাদেশের খাদ্যবাজার স্থিতিশীল রাখতে, অনেক আমদানিকৃত পণ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু যেসব পণ্য একেবারেই দেশজ উৎপাদননির্ভর, সেই পণ্যগুলোর দামও হয়েছে আকাশছোঁয়া। সবাই জানে, এই সংকট তৈরি করতে সর্বদাই তৎপর রয়েছে একদল মুনাফাখোর। যারা অপেক্ষায় থাকে, কখন দেশে দেখা দেবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। এর সঙ্গে আবার যখন আমদানি বন্ধ হয়ে যায়, তখন এ ধরনের মজুদদারদের পোয়াবারো। তারা ইচ্ছেমতো পণ্যমূল্য নির্ধারণ করে।
এ বিষয়ে শুক্রবার দেশ রূপান্তরে ‘দাম বেঁধে সামালের চেষ্টা’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে, বিশ্বে খাদ্যপণ্যের মূল্য দুই বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ অবস্থানে নেমে এলেও বাংলাদেশে উল্টো চিত্র। কিছু অসৎ ব্যবসায়ী ও ফড়িয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় এখন বিভিন্ন খাদ্যপণ্যে নানা সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। শুধু আমদানি পণ্যই নয়, এসব সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে এখন স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কৃষিপণ্যও অস্বাভাবিক মূল্যে কিনতে হচ্ছে জনসাধারণকে। এর ফলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এক দশকের সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছে। এমন পরিস্থিতিতে বাজারদর নিয়ন্ত্রণে ভোজ্য তেল, চিনির মতো খুচরা পর্যায়ে ডিম, পেঁয়াজ ও আলুর দামও নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। বেঁধে দেওয়া দাম অনুযায়ী, এখন থেকে প্রতিটি ফার্মের ডিম ১২, আলু খুচরা পর্যায়ে ৩৫-৩৬ (হিমাগার পর্যায়ে ২৬-২৭) এবং দেশি পেঁয়াজের দাম হবে ৬৪-৬৫ টাকা। শুধু তা-ই নয়, সরকারের বেঁধে দেওয়া ডিমের দাম ব্যবসায়ীরা না মানলে পণ্য আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে।
আসলে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকারের কোনো সংস্থাই তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করছে না। এ ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা কমিশন ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। করপোরেট সিন্ডিকেটের কারণে দেশে কয়েক মাস ধরেই ডিমের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। বর্তমানে কাজী ফার্মস, প্যারাগন পোলট্রি, সিপি বাংলাদেশ, ডায়মন্ড এগ, নারিশ অ্যাগ্রোসহ ১০টি শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের প্রতিদিনের ডিম উৎপাদনের ক্ষমতা প্রায় ৫৬ লাখ। এর বাইরে প্রান্তিক খামারিদের সঙ্গে কন্ট্রাক ফার্মিংয়ের মাধ্যমেও ডিম ও পোলট্রি মুরগির বাজার নিয়ন্ত্রণ করে এই সিন্ডিকেট। এ ছাড়া ফড়িয়াদের মাধ্যমেও প্রান্তিক খামারিদের কাছ থেকে ডিম সংগ্রহ করে বাজারব্যবস্থার পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তারা। প্রতিদিন মোবাইল এসএমএসের মাধ্যমে ডিমের মূল্য নির্ধারণ করে বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীদের জানিয়ে দেয় এই সিন্ডিকেট। এভাবেই ডিমের বাজার ও দাম নিয়ন্ত্রণ করছে সিন্ডিকেটটি। শুধু ডিম কিংবা পোলট্রি মুরগি নয়, এখন আলুর মতো সবজি নিয়েও সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। দেশে আলুর কোনো ঘাটতি না থাকলেও দ্বিগুণেরও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে পণ্যটি।
বাণিজ্যমন্ত্রী যখন বলেন, ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত দাম না মানলে পণ্য আমদানি করা হবে! এর মানে কী? আমদানির হুমকি দিলেই পণ্যমূল্য হ্রাস পায়! যদি তাই-ই হয়, তাহলে এত দিন সেটা করা হয়নি কেন? নাকি এর পেছনেও অন্য কোনো কারণ রয়েছে? জানি না, এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির পাল্টাপাল্টি আলটিমেটামের কারণে চলমান রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে নতুন করে উত্তাপ তৈরি হয়েছে। দুই দলের এ পাল্টাপাল্টি আলটিমেটামের মূল টার্গেট ঢাকা দখলে নেওয়া। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন অসুস্থ খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে চিকিৎসা নিতে বিদেশ পাঠাতে রবিবার বিএনপি ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে। পাল্টা জবাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও একই পথে হেঁটেছে। বিএনপিকে ‘আগুন সন্ত্রাস, অপরাজনীতি ও নাশকতার রাজনীতি’ ছাড়ার জন্য সোমবার ৩৬ দিনের আলটিমেটাম দিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। এরপর পাল্টা ৩৬ ঘণ্টার হুঁশিয়ারি এসেছে বিএনপির কাছ থেকে।
তার আগে গত শনিবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিতে আবেদন করলে অনুমতির বিষয়টি দেখা যাবে। তবে তার কাছে এরকম কোনো কাগজপত্র আসেনি। ওইদিনই খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এবিএম আবদুস সাত্তার বলেছেন, সরকারের মনোভাব ইতিবাচক হলে তারা আবারও আবেদন করবেন।
পরদিন রবিবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আলটিমেটাম দেন। ওইদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আইনগত জটিলতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আদালতের অনুমোদন প্রয়োজন। তবে বিএনপি বলছে, সরকার চাইলে নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে পারে।
দুই দলের রাজনীতি ও ঘোষিত আলটিমেটাম মাঠের রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তন আনবে কি না, সে সম্পর্কে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। বিএনপির আলটিমেটামের ফল কী হবে আর আওয়ামী লীগেরও দীর্ঘ ৩৬ দিনের আলটিমেটাম কেন এ নিয়ে সাধারণ মানুষের ভেতর বেশ কৌতূহল দেখা দিয়েছে।
দুই দলের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত রাজধানী ঢাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এমন পাল্টাপাল্টি আলটিমেটাম। ঢাকায় বিএনপির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার কৌশলের অংশ হিসেবেই খালেদা জিয়ার চিকিৎসা ইস্যুতে দলটি আলটিমেটাম দিয়েছে। অন্যদিকে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতেই তার পাল্টা জবাব দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
দুই দলের ওই নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির রাজনীতির মূল লক্ষ্য হয়ে উঠেছে ঢাকা শহর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারা। ঢাকার রাজনীতি আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ থেকে বের করে আনতে না পারলে রাজনীতিতে জুতসই অবস্থান সৃষ্টি করতে পারবে না বিএনপি।
সারা দেশের নিয়ন্ত্রণে রাখা ও নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেয়ে ঢাকা শহর নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে রাজনৈতিক জয়-পরাজয় নির্ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন বিএনপির ওই শীর্ষসারির নেতারা। তাই বিএনপি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে ঢাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার চিকিৎসাকে ইস্যু করে নেতাকর্মীদের ঢাকায় ডেকে পাঠানোর কৌশল গ্রহণ করেছে। পর্যাপ্ত নেতাকর্মী ঢাকায় ঢুকে গেলে অবস্থা বুঝে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। তাই ইস্যু খালেদার চিকিৎসা, কিন্তু লক্ষ্য ঢাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ৩৬ দিনের আলটিমেটামের পেছনে রয়েছে নভেম্বরে তফসিল ঘোষণার আগপর্যন্ত ঢাকায় নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখা। সেই সঙ্গে নেতাকর্মীদের সতর্ক অবস্থানে থাকতে নির্দেশনা দিয়ে রাখা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, বিএনপি নির্বাচন বানচাল করতে ততই ষড়যন্ত্রের নীল নকশা আঁকছে।’ তিনি বলেন, ‘জনগণের শান্তি যেন বিঘিœত না হয়, সেজন্যই আমরা বিএনপির কর্মসূচির দিন মাঠে থাকি। বিএনপিকে জনগণ বিশ্বাস করে না। খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য বিদেশে সত্যিই নিতে চাইলে আলটিমেটাম কেন দেবে বিএনপি? আইনি জটিলতা নিরসন করে বিদেশ নেওয়ার চেষ্টা করবে।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ বলেন, ‘বিএনপি সন্ত্রাস-সহিংসতানির্ভর রাজনীতি করে, বিশ্বাস করে। তারা পাকিস্তানের প্রেতাত্মা।’ তিনি বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশ নিয়ে চিকিৎসা করাতে চাইলে কেন বিএনপি আইনি প্রক্রিয়ায় যাচ্ছে না? তার কিছু হলে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের দায় নিতে হবে।’
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দুই দলের ঘোষিত আলটিমেটামকে কথার বাকযুদ্ধ হিসেবে নিয়েছেন। নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় এগুলো হচ্ছে। আওয়ামী লীগের অবস্থান ধরে নেওয়া যায় খালেদা জিয়ার চিকিৎসার ব্যাপারে তাদের কোনো গা নেই। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বিভিন্ন বক্তব্যে সেটাই স্পষ্ট করেছেন। জানিয়ে দিয়েছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশ নিতে হলে আইনগতভাবে যেতে হবে। নির্বাহী কোনো সিদ্ধান্তে এ সুযোগ দেওয়া হবে না। ফলে আলটিমেটাম মূলত নিষ্ফল হয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দাবি আদায় করার জন্য জনগণ থেকে দাবি উঠতে হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত জনগণকে রাস্তায় নামাতে পারবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দল আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারবে না।’ তিনি বলেন, ‘এখন যেসব বক্তব্য এগুলো মঞ্চের বাকযুদ্ধ।’
বিএনপির আলটিমেটাম নিয়ে জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. খোন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম সম্পর্কে আমি কিছু বলতে পারব না। আমি (গতকাল মঙ্গলবার) সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা শেষ করে এসেছি।’ আলটিমেটামের পেছনে ঢাকা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পরিকল্পনা আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঢাকায় তো আমরা সভা-সমাবেশ করছিই।’
জানতে চাইলে বিএনপির আরেক নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘আলটিমেটাম সম্পর্কে ক্লিয়ার কিছু জানি না।’
বিএনপিকে ‘অপরাজনীতি’ ছাড়তে ৩৬ দিন সময় বেঁধে দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ সময়ের মধ্যে ‘সঠিক পথে’ না এলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপির ‘অপরাজনীতির কালো হাত’ গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে আলটিমেটাম দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘এটি বিএনপির জন্য শেষ বার্তা।’ গত সোমবার রাজধানীর উত্তরায় এবং যাত্রাবাড়ীতে পৃথক সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ। উত্তরার সমাবেশে ওবায়দুল কাদের এ আলটিমেটাম দেন।
সরকার পতনের এক দফা দাবিতে বিএনপি দুই সপ্তাহের কর্মসূচি নিয়ে এখন রাজপথে আছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগও ২১ সেপ্টেম্বর থেকে আগামী ৪ অক্টোবর পর্যন্ত সভা-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। এর অংশ হিসেবে ঢাকায় গত সোমবার দুটি সমাবেশ হয়।
এর আগে থেকেই ঢাকায় বিএনপির কর্মসূচির দিন শান্তি সমাবেশের কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীনরা বিএনপির সভা-সমাবেশের বিষয়ে নমনীয়তা প্রদর্শন করলেও মাঠের নিয়ন্ত্রণ ছাড়েনি।
তামিম ইকবাল দলে না থাকাতে যেন অনেকেরই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে! আবার বিশ্বকাপের দলে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের অন্তর্ভুক্তিতেও অনেকের চোখ কপালে! দল ঘোষণার পর যখন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচকরা এলেন সংবাদ সম্মেলনে, তখন আলোচনায় শুধু ছিলেন এই দুজনেই। তাদের এই বিরহ বেদনায় চাপা পড়ে যায় অনেক প্রশ্ন। লিটন দাসকে বাদ দিয়ে নাজমুল হোসেন শান্ত কেন সহ-অধিনায়ক! বাড়তি কোনো ওপেনার ছাড়া কিংবা পাঁচ পেসারকে নিয়ে কেন দল গড়া?
প্রায় মিনিট পনেরোর সংবাদ সম্মেলনে ঘুরে ফিরে এসেছে একই প্রশ্ন। প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নুও ঘুরেফিরে বন্দী ছিলেন একই কথার বৃত্তে। প্রশ্নোত্তর শেষে বেরিয়ে যান তিন নির্বাচক। যেতে যেতে কথা হয় তাদেরই একজন হাবিবুল বাশারের সঙ্গে। তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল চাপা পড়া সেইসব প্রশ্নের উত্তর।
শুরুতেই জানতে চাওয়া হয় লিটনকে বাদ দিয়ে শান্তকে কেন সহ-অধিনায়ক করা হয়েছে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘ভবিষ্যৎ একটা কারণ। আর লিটনের অনাগ্রহও তাকে নেতৃত্ব থেকে সরানোর একটি কারণ। লিটন নিজেও চায় না নেতৃত্বের চাপ নিতে। সে একটু ব্যাটিংয়ে বেশি মনোযোগ দিতে চায়।’
বিশ্বকাপ দলে বিকল্প ওপেনার না থাকার কারণও জানা গেল এই নির্বাচকের কথায়। তিনি জানালেন, ‘আমরা ব্যাকআপ ওপেনার হিসেবে মিরাজকে ভাবছি।’
বিকল্প ওপেনার হিসেবে বিশেষজ্ঞ কাউকে না নেওয়ায় একজন বাড়তি বোলার দলে রাখার সুযোগ হয়েছে। বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দলে শেখ মেহেদি হাসান সুযোগ পেয়েছেন সে কারণে। পাশাপাশি জায়গা হয়েছে পাঁচ পেসারেরও। এর পেছনে বাশার ভারতের কন্ডিশনের কথাটা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ভারতে এখন আর্লি সিজন। উইকেট সতেজ থাকবে। স্বাভাবিকভাবেই পাঁচজন পেসার দরকার হবে।’
যেতে যেতে আরও বাংলাদেশ দলের সাবেক এই অধিনায়ক মুখোমুখি হলেন, এই দলটা বিশ্বকাপে কেমন করবে? এই প্রশ্নটা শুনেই ঘুরে দাঁড়ালেন হাবিবুল। উত্তরে মজা করে বললেন, ‘চ্যাম্পিয়ন হবে এই দল।’ এরপর একটু গাম্ভীর্য ফিরিয়ে এনে যোগ করলেন, ‘আমি এদের অনেক দিন ধরে দেখছি। ওরা কয়টা ম্যাচ জিতবে জানি না। তবে বিশ্বকাপে প্রতিটি দলকে ভোগাবে, এটা জানি।’
ভারতের বিপক্ষেই খেলেছিলেন বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ। এবার বিশ্বকাপটাই ভারতে, যে ধর্মশালা দিয়ে শুরু হবে বিশ্বকাপ অভিযান, সেখানেই আছে বাংলাদেশের হয়ে একমাত্র টি-টোয়েন্টি সেঞ্চুরির কৃতিত্ব। হিমালয়ের কোলে, ছবির মতো সুন্দর সেই মাঠে আবারও খেলবে বাংলাদেশ, কিন্তু খেলবেন না তামিম ইকবাল।
অনেক নাটকীয়তার পর অবশেষে বিশ্বকাপ দল ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। বরাবরের মতো সংবাদ সম্মেলনে নিরাবেগ কণ্ঠে একের পর এক নাম পড়ে শোনাননি প্রধান নির্বাচক, গভীর রাতে কোনো ইমেইলেও আসেনি খেলোয়াড় তালিকা। বিশ্বকাপগামী ১৫ ক্রিকেটারের প্রত্যেকের হাতে হাতে সুন্দর করে বাক্সবন্দি বিশ্বকাপ জার্সি তুলে দেওয়ার ভিডিও নিজেদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করে ২০২৩ বিশ্বকাপের জন্য নির্বাচিতদের পরিচিত করেছে বিসিবি। এজন্য বিসিবির সংশ্লিষ্টরা বাহবা পেতেই পারেন, নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড যেমনটা হৃদয় জিতে নিয়েছে ক্রিকেটারদের পরিবারের আপনজনদের দিয়ে বিশ্বকাপের দল ঘোষণা করিয়ে।
কারা থাকছেন আর কারা থাকছেন না, তা নিয়ে খুব বড় কোনো চমক ছিল না বিশ্বকাপ দলে। সবাই শুধু একটাই কোটি টাকার প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলেন। তামিম ইকবাল শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ দলে আছেন নাকি নেই। অবসর, প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে প্রত্যাবর্তন, ব্যক্তিগত কাজে দুবাই ভ্রমণ, ইংল্যান্ডে ইনজেকশন, দেশে অনুশীলন, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এক ইনিংসে ব্যাট করে ৪৪ রান এবং পরে নিজেকে আবারও পুরোপুরি ফিট নয় বলে পরের ম্যাচে বিশ্রাম। স্বভাবতই এই তামিম ইকবালকে বিশ্বকাপে দেখতে চাইবেন না কোনো কোচ এবং অধিনায়ক। সোমবার গভীর রাতে বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের বাসায় সাকিবের ছুটে যাওয়া এবং সিডনি থেকে নেমে তড়িঘড়ি করে বোর্ড সভাপতির বাসায় কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের পা রাখাই প্রমাণ করে, বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা করতেই তাদের এ তৎপরতা।
তামিমের মতো ক্রিকেটারকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তটা সহজ নয়। নিঃসন্দেহে দেশের সফলতম ব্যাটসম্যান, ওয়ানডেতে ১৪টা সেঞ্চুরি। হুট করে অবসর নিলে যাকে ফিরিয়ে আনেন স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী। সাক্ষাৎকারেও তামিম বলেছেন, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগের কথাও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেশাদারির কাছে হার মেনেছে আবেগ, যুক্তির কাছে হেরে গেছে অতীত। তামিম নামটা আছে বিশ্বকাপ দলে, তবে পদবিটা ইকবাল নয়। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী দলের বাঁহাতি উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান তানজিদ হাসান তামিমকে নিয়েই বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছেন সাকিব আল হাসান, যার বয়স আর তামিম ইকবালের ক্যারিয়ারের বয়স প্রায় কাছাকাছি।
২০১৯ বিশ্বকাপে সাকিবের পারফরম্যান্স ছিল অতিমানবীয়। ৬০৬ রান আর ১১ উইকেট। তবু দল হলো অষ্টম। গোটা আসর চোটজর্জর অধিনায়ককে বইল দল। প্রতিটি সকাল শুরু হতো এক অনিশ্চয়তা নিয়ে, খেলতে পারবেন তো মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা? শুরুর দিকে নতুন বলে কোনো উইকেট ফেলতে পারেনি বাংলাদেশ, প্রতিপক্ষ গড়েছে রানের পাহাড়। সেই অভিজ্ঞতা কী করে ভুলবেন সাকিব। অস্ট্রেলিয়ান জেমি সিডন্স আর অধিনায়ক সাকিব এজন্যই ২০১১ সালের বিশ্বকাপে দলে রাখেননি চোটগ্রস্ত মাশরাফীকে। হাথুরুসিংহে জাতীয়তায় শ্রীলঙ্কান হলেও অস্ট্রেলিয়ায় থাকতে থাকতে হয়ে গেছেন তাদের মতোই পেশাদার। তাই তো কঠিন সিদ্ধান্তটা নেওয়ার সাহস দেখিয়েছেন।
কাল বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডের পর সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন জাতীয় নির্বাচকরা। প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন এবং দুই নির্বাচক হাবিবুল বাশার ও আবদুর রাজ্জাক। তামিমকে বাদ দেওয়া প্রসঙ্গে মিনহাজুল শুনিয়েছেন মুখস্থ কথাই, ‘আপনারা তো এবারের বিশ্বকাপের দলটা এরই মধ্যে পেয়ে গেছেন। তামিম ইকবালের তো অনেক দিন ধরেই ইনজুরি নিয়ে চিন্তা আছে। নিউজিল্যান্ড সিরিজের পর... সবকিছু বিবেচনা করেই, সবাই আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া। বিশ্বকাপে অনেক দিনের ব্যাপার। অনেক ম্যাচ আছে।’
তামিমের চোটটা তো নতুন নয়। অনেক দিন ধরেই এ চোট নিয়ে তিনি ভুগছেন, নিজের ইচ্ছামতো ভারতের বিপক্ষে সিরিজ, আফগানিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ এসব থেকে নিজেকে সরিয়েও রেখেছিলেন। চিকিৎসাও করিয়ে আনা হয়েছে। সবকিছু জেনেশুনে কেন তাকে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে সুযোগ দেওয়া এবং ম্যাচ খেলিয়ে বাদ দেওয়া এ প্রসঙ্গে মিনহাজুলের উত্তর, ‘দেখুন, কিছু কিছু ইনজুরি আছে আপনি ঝুঁকি নিতে পারেন না। টিম ম্যানেজমেন্ট কিন্তু বেকায়দায় পড়বে। আপনি দেখুন, নিউজিল্যান্ড সিরিজের প্রথম ম্যাচ খেলার পর দ্বিতীয় ম্যাচে... প্রথম ম্যাচ খেলেছে, দ্বিতীয় ম্যাচটা খেলেছে... এরপর কিন্তু শেষ ম্যাচে বিশ্রাম দিতে হয়েছে।’
‘তামিম অন্যতম সেরা। কিন্তু চোটের দুশ্চিন্তা থাকলে নিজেকে মেলে ধরা কঠিন। মেডিকেলের সঙ্গে আলোচনা করেছি, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছি। এটা আগেই বলেছি, এখন দল ঘোষণা করা হয়েছে’বলছিলেন প্রধান নির্বাচক। বিসিবি সভাপতি বা সাকিব ও কোচের সঙ্গে আলাপ হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কী আলাপ হয়েছে সেটা তো এখানে প্রকাশ করব না।’
১০ দলের বিশ্বকাপে দশম দল হিসেবে বিশ্বকাপের স্কোয়াড ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ। কেন এত দেরি, ফ্লাইটে ওঠার ২৪ ঘণ্টারও কম সময় আগে বিশ্বকাপের দল দেওয়া হলো কেন এ নিয়ে হাবিবুল বাশারের ব্যাখ্যা, ‘আমাদের সঙ্গে কী হয়েছে সেটা তো আমাদের সঙ্গের ব্যাপার। দল নির্বাচন করতে যখন বসি... খেলোয়াড় হিসেবে তামিমের... আমরা সুস্থ-সবল তামিমকে পেতে... এটা নিয়ে আমাদের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত ভাবতে হয়েছে। তাই দেরি হয়েছে।’
তামিমের বাদ পড়ার ডামাডোলে হারিয়ে গেছে মাহমুদউল্লাহর ফেরাটাও। সেই ইংল্যান্ড সিরিজের পর বিশ্রামের মোড়কে বাদ পড়েছিলেন। তার বদলে অনেক বিকল্প খুঁজেও শেষ পর্যন্ত ঘুরেফিরে আবার তার কাছেই ফিরলেন নির্বাচকরা। নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ৪৯ আর ২১ রানের দুটো ইনিংসেই হয়ে গেছে বিশ্বকাপের টিকিট। প্রধান নির্বাচক বললেন, ‘আগেই বলেছি, বিশ্বকাপের আগে যেকোনো খেলোয়াড়কে যেকোনো সিরিজে দেখব। ও পরিকল্পনাতেই ছিল। নিউজিল্যান্ড সিরিজে দেখেছি।’
২০১৫ সালের বিশ্বকাপের আগে, মাত্র দুই ম্যাচ দেখে সৌম্য সরকারকে দলে নিয়েছিলেন হাথুরুসিংহে। তানজিদ তামিম আর তানজিম সাকিব নিজেদের ভাগ্যবান ভাবতে পারেন। যথাক্রমে মাত্র পাঁচ আর দুই ম্যাচ খেলে তারা বিশ্বকাপ যাত্রার সঙ্গী হয়েছেন। এমন নয় যে, এ স্বল্প সময়ে দারুণ কিছু করে দেখিয়েছেন, প্রধান কারণ বিকল্পের অভাব।
শুধু তামিম ইকবালই নয়, দলের লজিস্টিক ম্যানেজারের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে তার বড় ভাই ও সাবেক খেলোয়াড় নাফিস ইকবালকেও। তামিমের অবসর-কা-ে তিনি বিসিবি সভাপতির মেসেজের জবাব দেননি, যা পাপন নিজে বলেছেন গণমাধ্যমে। হয়তো তারই প্রতিশোধ, সেই সঙ্গে ড্রেসিংরুমের সঙ্গে তামিমের সব সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া।
অবসর ভেঙে ফিরেছিলেন তামিম, দুটি ম্যাচ খেললেন। কিন্তু যেভাবে বাদ পড়লেন, তাতে মনে হতে পারে অবসরের সিদ্ধান্তটাই ছিল সঠিক। বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আগামীতেও তামিমের দলে ফেরাটা বোধহয় অনিশ্চিতই হয়ে গেল।
তামিম প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে দলটা কেমন হয়েছে দেখা যাক। পাঁচ পেসার, দুই অফ স্পিনার, দুই বাঁহাতি স্পিনার মিলিয়ে বোলিং আক্রমণটা নেহায়েত খারাপ নয়। লিটন দাসের সঙ্গে তানজিদ তামিম অথবা মেকশিফট ওপেনার মিরাজ। সহঅধিনায়কের পদ থেকে বাদ পড়েছেন লিটন, সেটা করা হয়েছে নাজমুল হোসেন শান্তকে। সাকিব, মুশফিক, তাওহীদ হৃদয়দের নিয়ে মিডল অর্ডারের পর ফিনিশার রোলে মাহমুদউল্লাহ। এ নিয়েই ধর্মশালায় আফগানদের বিপক্ষে লড়াইয়ের শুরু। প্রত্যাশা অনেক বড়, প্রস্তুতি গোলমেলে। ভরসা একটাই, শুরুর আগে পরিস্থিতি এমন গোলমেলে হলেই কেন যেন ভালো করে বাংলাদেশ!
বিশ্বকাপ দল : সাকিব আল হাসান (অধিনায়ক), মুশফিকুর রহিম, লিটন দাস, নাজমুল হোসেন (সহঅধিনায়ক), তাওহীদ হৃদয়, মেহেদী হাসান মিরাজ, তাসকিন আহমেদ, মোস্তাফিজুর রহমান, হাসান মাহমুদ, শরীফুল ইসলাম, নাসুম আহমেদ, মেহেদি হাসান, তানজিদ হাসান, তানজিম হাসান ও মাহমুদউল্লাহ।
নেক সন্তান আল্লাহর অপূর্ব নেয়ামত। পবিত্র কোরআনে সন্তান-সন্ততিকে জীবনের শোভা বলা হয়েছে। হাদিসের ভাষায় তাদের আখ্যা দেওয়া হয়েছে সদকায়ে জারিয়া হিসেবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যখন কোনো লোক মারা যায়, তখন তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তিন প্রকার আমল (জারি থাকে)। (প্রথম) সদকায়ে জারিয়া; (দ্বিতীয়) ওই ইলম, যা দ্বারা অন্য লোক উপকৃত হয়; (তৃতীয়) নেক সন্তান, যে তার জন্য দোয়া করে। -সুনানে নাসায়ি : ৩৬৫১
সন্তানকে নেক সন্তান হিসেবে গড়ে তুলতে ছোটবেলা থেকেই তাকে সেভাবে গড়ে তুলতে হবে। অন্যথায় এই সন্তানই মা-বাবার ইহকাল-পরকালের অশান্তির কারণ হতে পারে। এখানে কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো- যা সন্তানকে সঠিকভাবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োগ করা যেতে পারে।
গোনাহমুক্ত পরিবেশ : শিশুদের নেক সন্তান হিসেবে গড়ে তুলতে ছোটবেলা থেকেই তার প্রতি যতœবান হতে হবে। তার মানসিক বিকাশে গুরুত্ব দিতে হবে। তার জন্য গোনাহমুক্ত পবিত্র পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ইমানদাররা! তোমরা নিজেদের ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন থেকে রক্ষা করো।’ -সুরা তাহরিম : ৬
একটি শিশু যখন বড় হয়, তখন চারদিকের পরিবেশ তাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে এবং এর প্রতিফলন ঘটে তার বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে। শিশুর সামগ্রিক বিকাশের সঙ্গে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা নিবিড়ভাবে জড়িত।
তাই তাদের সামনে কোনো ধরনের অসৌজন্যমূলক কথা ও কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। তাদের সামনে ঝগড়াঝাটি, পরনিন্দা ইত্যাদি কাজ থেকেও বিরত থাকতে হবে।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি রাখা : ছোটবেলা থেকেই শিশুদের পরিচ্ছন্নতার প্রতি সচেতন করে তুলতে হবে। মানুষের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার জন্য পরিচ্ছন্নতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) পরিচ্ছন্নতাকে ইমানের অঙ্গ বলেছেন। ছোট মানুষ বলে তাদের যেনতেনভাবে লালন-পালন করা উচিত নয়। কারণ এটিও ব্যক্তিত্ব গঠনে জোরালো ভূমিকা পালন করে।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বলেন, ‘রাসুল (সা.) দিনের এক অংশে বের হন, তিনি আমার সঙ্গে কথা বলেননি এবং আমিও তার সঙ্গে কথা বলিনি। অবশেষে তিনি বনু কাইনুকা বাজারে এলেন (সেখান থেকে ফিরে এসে) ফাতেমা (রা.)-এর ঘরের আঙিনায় বসলেন। অতঃপর বলেন, এখানে খোকা [হাসান (রা.)] আছে কি? এখানে খোকা আছে কি? হজরত ফাতেমা (রা.) তাকে কিছুক্ষণ সময় দিলেন। আমার ধারণা হলো, তিনি তাকে পুঁতির মালা, সোনা-রুপা ছাড়া যা বাচ্চাদের পরানো হতো, পরাচ্ছিলেন (সাজিয়ে দিচ্ছিলেন)। তারপর তিনি দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং চুমু খেলেন। তখন তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহ, তুমি তাকে (হাসানকে) ভালোবাসো এবং তাকে যে ভালোবাসে তাকেও ভালোবাসো।’ -সহিহ বোখারি : ২১২২
সৃজনশীল খেলনা : শিশুর খেলনা হতে হবে আবিষ্কারধর্মী ও সৃজনশীল। বয়সভেদে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ উপযোগী খেলনা নির্বাচন করতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে। ঘরে ও বাইরে দুই জায়গায়ই খেলা যায়- এমন খেলনা শিশুর মানসিক বিকাশে বেশি সহায়ক। শিশুকে এমন ধরনের খেলনা দিতে হবে, যা তার বুদ্ধি বাড়াতে সাহায্য করে। তবে ইসলামের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ খেলনা দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
অনেকে সন্তানকে ঘরে নিরাপদে রাখতে ভিডিও গেম বা কার্টুনের প্রতি আকৃষ্ট করেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিনিয়ত ভিডিও গেম খেললে শরীরে এক ধরনের হরমোন নিঃসরণ হয়। এতে শিশু সব কিছু নিয়েই উত্তেজিত হয়ে পড়ে। মা-বাবার অবাধ্য হয়ে যায়। মেজাজ খিটমিটে হয়ে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গেমিংয়ে আসক্ত ব্যক্তি মূলত অন্য সব কিছুর প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। এ ছাড়া কারও সঙ্গে মিশতে না পারা, ঘুম, খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম তো রয়েছেই।
দীনি ইলম শিক্ষা দেওয়া : দীনি ইলম শিক্ষা করা সব মুসলমানের ওপর ফরজ। তাই সন্তানকে তার দৈনন্দিন ইবাদতের জন্য যতটুকু ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা দরকার, কমপক্ষে ততটুকু ইলম শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করতেই হবে। তাকে পবিত্রতা শিক্ষা দিতে হবে, আল্লাহ-রাসুল ও ইসলামের সাধারণ জ্ঞানগুলো অল্প অল্প করে শেখাতে হবে। কোরআন শিক্ষা দিতে হবে, প্রয়োজনীয় মাসয়ালা-মাসায়েল শিক্ষা দিতে হবে। পাশাপাশি তাকে আস্তে আস্তে বিভিন্ন গোনাহ সম্পর্কে সতর্ক করাও মা-বাবার দায়িত্ব।
নামাজে অভ্যস্ত করা : শৈশব থেকে সন্তানকে নামাজে অভ্যস্ত করে না তুললে ভবিষ্যতে সে নামাজের প্রতি যতœবান হতে পারবে না। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘তোমরা সন্তানদের নামাজের প্রতি যতœবান হও এবং তাদের ভালো কাজে অভ্যস্ত করো। কেননা কল্যাণ লাভ অভ্যাসের ব্যাপার।’ -সুনানে বায়হাকি : ৫০৯৪
উল্লেখ্য, ১০ বছর বয়সে সন্তানের বিছানা আলাদা করে দেওয়ার বিষয়টিও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তারা ঘুমিয়ে গেলেও তাদের অবচেতন মন বড়দের অনেক কার্যক্রমই অনুসরণ করতে পারে।
এক কথায় সন্তানকে দীনদার হিসেবে গড়ে তুলতে হলে, মা-বাবা ও পরিবারের সদস্যদেরও অত্যন্ত সচেতনভাবে চলতে হবে। ঘরে আমলের পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে, যাতে পরিবেশের কারণে তাদের মধ্যে আমল করার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
প্রত্যেক মানুষ কোনো না কোনো বয়সে ঘাড়, পিঠ বা কোমরের বাত-ব্যথা ভোগেন। কোনো আঘাত পাওয়া ছাড়াই মেরুদণ্ডের এসব অংশে ব্যথা হতে পারে।
ব্যথার উৎস : মেরুদণ্ডের হাড়গুলোর ভেতর দিয়ে মাথার খুলি থেকে নেমে আসা নার্ভে বা স্পাইনাল কর্ডে দুই হাড়ের মধ্যবর্তী ডিস্কের কিছু অংশ বের হয়ে গিয়ে চাপের সৃষ্টি করলে ওই স্নায়ুমূলে ও সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া নার্ভের বিচরণ অঙ্গে ব্যথা হয়। এ জাতীয় ব্যথার নাম মেরুদণ্ড হাড়ের ক্ষয়। হাড়ের ফাঁক হয়ে যাওয়া বা হাড়ের বৃদ্ধিও বলা হয়। চিকিৎসাশাস্ত্রে এ জটিলতা ডিস্ক প্রোল্যাপ্স, হার্নিয়েটেড ডিস্ক বা স্পাইনাল স্টেনোসিস বলা হয়। ডিস্কের সরে যাওয়া মাত্রার ওপর নির্ভর করে ডিস্ক প্রোল্যাপ্স বা পিএলআইডি রোগের জটিলতা।
লক্ষণ : দাঁড়ানো বা বসা অবস্থায় ঘাড়ে ব্যথা অনুভূত হওয়া, ঘাড় থেকে ব্যথা হাতে ছড়িয়ে পড়া, প্রাথমিক পর্যায়ে কাঁধ ও হাতে ব্যথা, হাতের বিভিন্ন অংশে ঝিনঝিন, শিনশিন করা, হাতের বোধশক্তি কমে আসা, পর্যায়ক্রমে হাতের অসাড়তা, ধীরে ধীরে হাত দুর্বল হয়ে হাতের কার্যক্ষমতা লোপ পাওয়া এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে পঙ্গুত্ব বরণ করা। মেরুদণ্ডের পিঠের অংশে ব্যথার লক্ষণের মধ্যে রয়েছে বসা ও দাঁড়ানো অবস্থায় পিঠব্যথা ও পিঠ থেকে বুকের চারপাশে ব্যথা ছড়িয়ে পড়া। আর কোমরের দিকের মেরুদণ্ডে ব্যথার লক্ষণ হলো দাঁড়ানো বা বসা অবস্থায় কোমর ব্যথা অনুভূত হওয়া, কোমর থেকে উৎপন্ন ব্যথা পায়ে ছড়িয়ে পড়া, নিতম্ব ও পায়ের মাংসপেশিতে ব্যথা, পায়ের বিভিন্ন অংশে ঝিনঝিন, শিনশিন করা, পায়ের বোধশক্তি কমে আসা, পর্যায়ক্রমে পায়ের অসাড়তা, ক্রমে পা দুর্বল হয়ে কার্যক্ষমতা হারানো।
চিকিৎসা : ব্যথায় রোগী সাধারণত ব্যথানাশক ওষুধ খেয়ে উপশমের চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু এ ধরনের ওষুধ নিয়মিত ও দীর্ঘদিন খেলে কিডনিতে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। ব্যথা বাড়লে অপারেশনের মাধ্যমে ব্যথা নিবারণের ব্যবস্থা করা হয়। লেজার চিকিৎসার মাধ্যমে মেরুদণ্ডের ব্যথা নিরাময়ের ব্যবস্থা করা যায়।
পুলিশের পদোন্নতির তালিকায় থাকা পদ কাটছাঁট করায় অসন্তোষ কমছে না। এ নিয়ে পুলিশ কর্তারা একাধিক বৈঠক করছেন। প্রধানমন্ত্রী দেশে এলে পদোন্নতি নিয়ে তার সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে। পুলিশের অসন্তোষ ঠেকাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ উদ্যোগও নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিকেলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে পদোন্নতির পদ আরও বাড়াতে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে। চিঠি পেয়ে জনপ্রশাসনও কাজ শুরু করে দিয়েছে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, পদোন্নতির সংখ্যাটি প্রধানমন্ত্রী ঠিক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কাটছাঁট করে পুলিশকে বিব্রত করেছে। অন্য ক্যাডাররা একের পর এক পদোন্নতি পেলেও পুলিশ পিছিয়ে আছে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিনিয়র সচিব আশ্বাস দিয়েছেন, বিষয়টি দ্রুত সমাধান করা হবে।
এদিকে ক্যাডারদের পাশাপাশি নন-ক্যাডারদেরও পদোন্নতির বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। ইতিমধ্যে সাব-ইন্সপেক্টর ও ইন্সপেক্টরদের পদোন্নতির উদ্যোগ নিতে পুলিশ সদর দপ্তর বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে। পদোন্নতির তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তিন দিন আগে পদোন্নতি পেতে বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। ওই সময় রাজধানীর ৫০ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। আজ বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইন্সপেক্টর থেকে এএসপি পদে পদোন্নতির বৈঠক ডাকা হয়েছে। ওই বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ও আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পুলিশের ক্যাডার ও নন-ক্যাডারদের পদোন্নতির বিষয়ে আমরা কাজ করছি। যাদের পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্যতা আছে তারা অবশ্যই পদোন্নতি পাবেন। বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তাদের পদোন্নতির পদ বাড়াতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আশা করি শিগগির বিষয়টি সুরাহা হবে। নন-ক্যাডারদের কর্তারাও কিছুদিন আগে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। তাদের বিষয়টিও সমাধান হবে বলে আশা করছি।’ তিনি বলেন, বর্তমান সরকার পুলিশের জন্য যা করেছে, অতীতের কোনো সরকারই তা করেনি। পুলিশের কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পুুলিশের পদোন্নতির তালিকা কাটছাঁটের বিষয়ে গত মঙ্গলবার আইজিপিসহ পুলিশ কর্মকর্তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রের সিনিয়র সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওইদিন বিকেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পুলিশের পদোন্নতির বিষয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নুর-এ- মাহবুবা জয়া।
ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ পুলিশ রাষ্ট্রের আইনশৃক্সক্ষলা রক্ষাবাহিনী প্রধানতম বাহিনী, যা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত। নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, পেশাদায়িত্ব ও শৃঙ্খলা রক্ষায় তদারকি ও ব্যবস্থাপনা এ বাহিনীর নেতৃত্বের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশ বাহিনীকে নেতৃত্ব প্রদানে পুলিশ সুপার থেকে তদূর্ধ্ব পদে পর্যাপ্তসংখ্যক পদ এবং দক্ষ জনবল থাকা বাঞ্ছনীয়। পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামোতে উপপুলিশ মহাপরিদর্শক (গ্রেড-৩) ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (গ্রেড-২) তুলনামূলক কম। বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামোর আলোকে (বিদ্যমান পদে অতিরিক্ত) অতিরিক্ত উপপুলিশ মহাপরিদর্শক হতে উপপুলিশ মহাপরিদর্শক এবং উপপুলিশ মহাপরিদর্শক হতে অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক পদোন্নতি দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হবে। প্রয়োজনীয়সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি প্রদানের জন্য পদ সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বিদ্যমান পদের অতিরিক্ত সুপারনিউমারারি পদ রাজস্ব খাতে অস্থায়ীভাবে সৃজনের প্রস্তাবে পদের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজিপি) থেকে পুলিশ সুপার (এসপি) পর্যন্ত ৭২০ কর্মকর্তার পদোন্নতি পেতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল পুলিশ সদর দপ্তর। তালিকাটি সংশোধন করতে ফেরত পাঠায় মন্ত্রণালয়। পরে পুলিশ সদর দপ্তর ৫২৯টি পদ চূড়ান্ত করে আরেকটি তালিকা পাঠায়। সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দিতে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, গত ১ আগস্ট এ প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় তালিকা কাটছাঁট করেছে। অতিরিক্ত আইজিপি পদে দুজন, ডিআইজি পদে ৫০ জন, অতিরিক্ত ডিআইজি পদে ১৪০ ও পুলিশ সুপার পদে ১৫০ জনকে পদোন্নতি দিতে ১৪ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় জনপ্রশাসন। পুলিশের তালিকায় ছিল অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-১) ১৫, অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-২) ৩৪, ডিআইজি ১৪০, অতিরিক্ত ডিআইজি ১৫০ ও এসপি ১৯০ পদে পদোন্নতি দিতে। এ তালিকা কাটছাঁট হওয়ায় পুলিশে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এ অসন্তোষ এখনো অব্যাহত আছে। অসন্তোষ ঠেকাতে আবার জনপ্রশাসনকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি দ্রুত সমাধান হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
পুলিশ সদর দপ্তরে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, পুলিশে সংখ্যাতিরিক্ত (সুপারনিউমারারি) পদোন্নতিতে অতিরিক্ত আইজিপি, ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি ও এসপি পদে পদোন্নতির নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৫২৯টি সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি করতে গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন। পদোন্নতির বিষয়ে সিগন্যাল আসার পর ২০ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে এ-সংক্রান্ত একটি সভা হয়েছিল। সভায় অতিরিক্ত সচিবসহ (পুলিশ ও এনটিএমসি) পুলিশের মহাপরিদর্শক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলেন, পুলিশে বর্তমানে একজন অতিরিক্ত আইজিপির পদ খালি রয়েছে। সুপারনিউমারারি পদে অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে ১৫ ও ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। ১৮, ২০, ২১, ২২ ও ২৪তম ব্যাচের প্রায় সবাই ডিআইজি ও অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পাওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছেন নীতিনির্ধারকরা। পাশাপাশি ২৭, ২৮ ও ২৯তম ব্যাচের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারদের এসপি হিসেবে পদোন্নতির বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, নন-ক্যাডাররা পদোন্নতি পাবেন। সাব-ইন্সপেক্টর থেকে ইন্সপেক্টর ও ইন্সপেক্টর থেকে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে পদোন্নতি দেওয়া হবে। আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সুপারনিউমারারি পদে বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মতোই নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি দেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা হবে। ইন্সপেক্টর থেকে এএসপি পদে পদোন্নতি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। কারা পাবেন তার তালিকা তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের দাবিগুলো ছিল পুলিশ পরিদর্শকদের (ইন্সপেক্টর) ১০ বছর পূর্তিতে ষষ্ঠ গ্রেড দেওয়া। ১০ বছর পূর্তিতে ব্যাজ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রেড পরিবর্তন করা। ১০ বছরের মধ্যে পদোন্নতি না হলে সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দেওয়া। সাব-ইন্সপেক্টরদের (এসআই) ক্ষেত্রেও একই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে এসআই/সার্জেন্ট পদটি দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তাদের র্যাংক ব্যাজের নীল বা লাল ফিতা তুলে নেওয়া। কনস্টেবলদের বিভাগীয় পরীক্ষায় একবার পাস করলে সেখান থেকে প্রমোশন লিস্ট করে ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে মন্ত্রীর কাছে।’
গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত অভিযোগে দেশের কিছু ব্যক্তির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করার কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টা বক্তব্য দিতেও শুরু করেছে। এতে বিরোধীপক্ষেরই ঝুঁকি দেখছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এই সবপক্ষই চাপে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থান নিয়ে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা হলেও মূলত নির্বাচনী রাজনীতিতে এক ধরনের পরিবর্তন আসবে। একপক্ষ নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিলেও সেই পথ থেকে তাদেরও সরতে হবে। আবার সরকারপক্ষ যেনতেন নির্বাচন করে ক্ষমতায় বসে যাবে সেই সুযোগও থাকছে না। যে যাই বলুক নির্বাচনী রাজনীতিতে সামনের দিনগুলোতে এ পরিবর্তন আসতেই হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সবপক্ষের জন্য। তাদের অবস্থানে বিএনপি উৎফুল্ল হয়ে যাবে, আর আওয়ামী লীগ ধরাশায়ী হয়ে যাবে ব্যাপারটা এমন নয়। বরং এতে এক ধরনের সমাধানের পথ খুলে যেতে পারে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ না দিলেও জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হবে এমন আভাস দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
কিন্তু গত বছর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে আসছে। তাদের একাধিক প্রতিনিধি বাংলাদেশ সফর করে সরকার ও বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে। সুষ্ঠু নির্বাচনে সমর্থনের কথা জানিয়ে গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। যার প্রয়োগের কথা জানানো হলো গত শুক্রবার।
এর আগে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তা ও র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
ভিসানীতি প্রয়োগের প্রক্রিয়া শুরুর মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার অনড় অবস্থানের বিষয়টি আবার জানাল। দেশটির এ অনড় অবস্থানকে আওয়ামী লীগ দেখছে দুভাবে। একটি হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা। দ্বিতীয়টি হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলন করা বিএনপিকে নির্বাচনে আনা। এর বাইরে অন্য কোনো বিরূপ প্রভাব দেখছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকার এত দিন যেটা চেয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র সেটাই আশা করছে।
তবে বিএনপি ভিসানীতির জন্য সরকারকে দায়ী করেছে এবং সেটা তাদের নেতাকর্মীদের এক দফা আন্দোলনে আরও উজ্জীবিত করবে, এমন দাবি করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের কারণে আগামী নির্বাচন যেনতেনভাবে হয়ে যাবে সেটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের প্রস্তুতি সবাইকে নিতে হবে। এর বাইরে কোনো রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী, বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তা যেই হোক শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করা বা একপেশে করার চিন্তা বা পদক্ষেপ গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে চাইলে, পড়তে হবে ভিসানীতির আওতায়। যুক্তরাষ্ট্রের অনড় অবস্থান এখন পর্যন্ত সেটাই ইঙ্গিত করে।’
সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে এক দফা দিয়ে আন্দোলনে আছে বিএনপি। অন্যদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করার জন্য এক দফা ঘোষণা করেছে। তারাও শান্তি-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকারও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। সেটা নিশ্চিত করতে তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ এটাও বলে আসছে, তাদের সরকারের চাওয়া আর যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া একই।
নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অনড় অবস্থানকে আওয়ামী লীগ দুভাবে দেখলেও দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে নানা রকম কানাঘুষা রয়েছে। ভেতরে-ভেতরে ‘ভেঙে পড়লেও’ ওপরে শক্ত মনোভাব ধরে রাখার চেষ্টা করছেন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের কথা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তারা বেশ বিরক্তি প্রকাশ করেন। তারা বলেন, সরকার ও আওয়ামী লীগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নতুন কিছু নয়। দুপক্ষের অবস্থান একই বলেও দাবি করেন ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা।
সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচনে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে আমেরিকার যে অবস্থান তাতে বিএনপিরই ক্ষতি, কারণ তারা ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন হতে দেবে না।’ তিনি বলেন, সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ও আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় সরকার। সেখানে সব দল নির্বাচনে আসুক সেই আহ্বানও জানানো হয়েছে।
শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত এবং সহযোগিতা করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই ব্যক্তিদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা রয়েছেন। শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা জোরালোভাবে দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র তো বিএনপির দাবি সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান সেখানে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে এসব বলা হয়নি। ফলে ভিসা বিধিনিষেধ আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করায় আওয়ামী লীগ বা সরকার কেন বেকায়দায় পড়বে? আমরা মনে করি, বিএনপিই তো বেকায়দায় রয়েছে। কারণ, তাদের দাবি অসাংবিধানিক। আর অসাংবিধানিক উপায় অবলম্বন করছে। তাদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের এই অনড় অবস্থান বিএনপির বিরুদ্ধে গেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খানের দাবি, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে শঙ্কিত বিএনপি। তারা তো বিএনপির একটা দাবির কথাও বলে নাই।’ সরকার বা আওয়ামী লীগ ভীত ও শঙ্কিত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনাদের উচিত বিএনপির প্রতিক্রিয়া জানা।’
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ বলেন, ‘আমরা যেমন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই, আমেরিকারও একই রকম চাওয়া।’
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্র যে এমন কিছু করবে এটা প্রত্যাশিতই ছিল। এটা সিম্পল ব্যাপার আমাদের জন্য।’
ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় বিরোধী দল আছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে যে বক্তব্য এসেছে সে সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিবৃতিতে কোন বিরোধী দলের কথা বলা হয়েছে তা স্পষ্ট করা হয়নি। তাই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। তবে আজকে দেশে গণতন্ত্রের যে সংকট তার জন্য সরকার এককভাবে দায়ী। তা ছাড়া এর আগে বাইডেন প্রশাসন তাদের দেশে যে গণতন্ত্রের সম্মেলন করেছে তাতে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি।’
ভিসানীতি প্রয়োগের জন্য সরকারকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘আজকে আওয়ামী লীগ বিগত দুটি বিতর্কিত সংসদ নির্বাচন করার পর আবারও আগামী নির্বাচন একতরফা করতে যে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। এর দায় সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী লীগকে নিতে হবে। আজকে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ আগের ঘোষণার ধারাবাহিকতা। প্রথমদিকে নিষেধাজ্ঞা ও ভিসানীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে, সাধারণ মানুষের ভেতর যে বড় ধাক্কা মনে হয়েছিল, ঘোষণা আসার পর সেটা মনে হয়নি। তবে কোনো একটা সমীকরণ থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এই পদক্ষেপ নিয়েছে। এর প্রভাব কত দূর যাবে সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনে কী বার্তা যাবে সেটা পরিষ্কার নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা তাদের বৈশি^ক চর্চারই অংশ। মূল কথা হলো, এটা সবার জন্যই চাপ।’
বাংলাদেশের কিছু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের সদস্য ও রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র বলে জানিয়েছেন ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর আজ শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় বাধাদানকারী ব্যক্তিদের ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপের পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করার ঘোষণা পর তিনি এ তথ্য জানান। তবে কতজনের ওপর এই বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তা তিনি জানাননি ।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার বলেছেন, ‘আমরা যখন এই ভিসা নীতি ঘোষণা করেছি, তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার ঘটনাবলির ওপর গভীর দৃষ্টি রাখছে। সতর্কতার সঙ্গে তথ্য-প্রমাণ পর্যালোচনার পর আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের সদস্য ও রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করেছি।’
মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্রকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় আসা ব্যক্তিদের নাম যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ করবে কি না। জবাবে তিনি বলেন, ‘না, এসব ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় আসা ব্যক্তিদের নাম আমরা প্রকাশ করব না।’ কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আইনে ভিসা রেকর্ড গোপনীয়।
ব্রায়ান শিলার এই কথা বলার ঘণ্টাখানেক আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আজ (শুক্রবার) স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত থাকা বাংলাদেশি ব্যক্তিদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করার পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ ব্যক্তিদের মধ্যে আইন প্রয়োগকারী, ক্ষমতাসীন দল এবং রাজনৈতিক বিরোধী দলের সদস্য রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয় তার সমর্থনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে প্রমাণিত অতিরিক্ত ব্যক্তিরাও ভবিষ্যতে এই নীতির অধীনে মার্কিন ভিসার জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। এর মধ্যে বর্তমান এবং প্রাক্তন বাংলাদেশী কর্মকর্তা, বিরোধী ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা পরিষেবার সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আমাদের আজকের পদক্ষেপগুলি শান্তিপূর্ণভাবে অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাংলাদেশের লক্ষ্যকে সমর্থন করার জন্য এবং বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে চায় তাদের সমর্থন করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে।’
মে মাসে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের স্বার্থে ভিসানীতির ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যান্থনি ব্লিংকেন ওই ঘোষণা দেন।
তার নাম শেখ মোহাম্মদ আসলাম। একসময় সুইডেন ছিলেন বলে পরিচিত হয়ে ওঠেন স্ইুডেন আসলাম নামে। তেজগাঁও এলাকার এই শীর্ষ সন্ত্রাসী একসময় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড বা অপরাধ জগৎ কাঁপাতেন। ২৭ বছর ধরে আছেন কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে। হত্যাসহ ১৭ মামলার একটি ছাড়া বাকিগুলোতে জামিন পেয়েছেন তিনি। কিন্তু বহু দিনের পুরনো প্রতিপক্ষের হাতে প্রাণ হারানোর শঙ্কায় জামিনের জন্য আবেদন করছেন না তিনি।
মোহাম্মদপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালও জামিনের আবেদন করছেন না। প্রায় ২০ বছর ধরে কারাগারে থাকা হেলালের বিরুদ্ধে আছে অন্তত এক ডজন মামলা। বেশিরভাগ মামলায় জামিন হয়ে গেছে। এই দুজনের মতোই কারা হাজতে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছেন না। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে কেউ সাক্ষ্যও দিতে আসেন না আদালতে। তারা বছরের পর বছর ধরে কারাগারে থাকলেও সমস্যা হচ্ছে না। অনেকেই অসুস্থ না হয়েও বছরের পর বছর হাসপাতালে আরামে
থাকছেন। বাইরে থাকা তাদের সহযোগীদের সঙ্গেও যোগাযোগ থাকছে। এই সহযোগীরাই তাদের হয়ে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ করছেন।
পুলিশের তালিকায় ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম আছে যাদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। অবশ্য এই তালিকায় সুইডেন আসলাম নেই। তালিকা করা হয় ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর। এদের মধ্যে ১৩ জন বিদেশে আত্মগোপন করে আছেন। কারাগারে আছেন ৬ জন, মারা গেছেন ৩ জন। একজনের কোনো হদিস নেই।
এই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আটজনকে ১ লাখ টাকা এবং ১৫ জনকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়। এর মধ্যে পিচ্চি হান্নান র্যাবের ক্রসফায়ার, গণপিটুনিতে আলাউদ্দিন ও কামাল পাশা ওরফে পাশা কারাগারে মারা গেছেন। কালা জাহাঙ্গীর বেঁচে আছেন নাকি আত্মগোপনে, কেউ বলতে পারছেন না। পিচ্চি হেলাল, টিটন, ফ্রিডম সোহেল ও কিলার আব্বাস কারাগারে আছেন। খোরশেদ আলম ওরফে রাশু কিছুদিন আগে ছাড়া পেলেও কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ তাকে আবার আটক করেছে। মশিউর রহমান কচি, সুব্রত বাইন, আমিন রসুল সাগর. ইমাম হোসেন, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, মোল্লা মাসুদ, শামীম আহমেদ, হারিস আহমেদ, তানভিরুল ইসলাম জয়, জাব্বার মুন্না, জাফর আহমেদ, কামরুল হাসান হান্নান ওরফে ছোট হান্নান দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তাদের ধরতে ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করা আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, আত্মগোপনে থাকা সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তাদের ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি আন্ডারওয়ার্ল্ডে একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা চলছে। সম্প্রতি রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনকে গাড়ি থামিয়ে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ভাগ্যক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও গুলিবিদ্ধ এক পথচারী সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে আছেন। এ ঘটনায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন জড়িত বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আন্ডারওয়ার্ল্ড উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও। দেশের বাইরে থাকা সন্ত্রাসীরা নিজেদের সহযোগীদের মাধ্যমে নতুন করে আধিপত্য বিস্তারের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এমনকি কারাগারে থাকা সন্ত্রাসীরাও সহযোগীদের নানা বিষয়ে বার্তা দিচ্ছে। এর মধ্যে কেউ কেউ রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত হতে চাইছে। যে কারণে সন্ত্রাসীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে পুলিশ সদর দপ্তর সব কটি ইউনিট, রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার এসপিদের বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে আত্মগোপনে থাকা সন্ত্রাসীদের বিষয়ে নতুন করে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কারাগার কর্তৃপক্ষকেও হাজতি ও বন্দি সন্ত্রাসীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, যেসব সন্ত্রাসী দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আটক আছে, তাদের একটি তালিকা করেছে একটি সংস্থা। এ বিষয়ে বলা হয়েছে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও তারা জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছে না। তারা কারাগারকেই নিরাপদ মনে করছে।
কারা সূত্র জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম একটি মামলায় জামিন না নেওয়ায় কারাগারে আছেন। বাকি সব মামলার জামিন হয়ে গেছে। ২৭ বছরের কারাজীবনে তার দুইবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। বেশিরভাগ সময় কেটে যাচ্ছে হাসপাতালে থেকেই। হুইলচেয়ারে করে চলাফেরা করেন সব সময়। মোবাইল ফোনে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ করেন সহযোগীদের সঙ্গে। তার স্ত্রী আয়েশা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।
সুইডেন আসলামের বিষয়ে তার এক আত্মীয় দেশ রূপান্তরকে বলেন, এলাকায় তার যখন একক আধিপত্য ছিল, তখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। তারাই এখন তার বিরুদ্ধে। সুইডেন আসলাম বের হয়ে এলে প্রতিপক্ষরাই তাকে মেরে ফেলবে, এমন শঙ্কা আছে। এসব দিক বিবেচনা করেই তিনি বের হতে চাইছেন না। কারাগারেই তিনি ভালো আছেন।
জানা গেছে, সুইডেন আসলামের বিরুদ্ধে মামলাগুলোতে কোনো সাক্ষীও পাওয়া যায় না। ১৯৮৬ সালে তিনি অপরাধ জগতে যুক্ত হন। ওই বছর পূর্ব রাজাবাজারে স্কুলের সামনে কিশোর শাকিলকে গুলি করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। তারপর থেকে তার বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যাকা-সহ নানা অপরাধের তথ্য বের হয়ে আসে। এরই মধ্যে নিজেকে রক্ষা করতে সুইডেন চলে যান। বছর পাঁচেক ওই দেশে থেকে আবার ফিরে আসেন দেশে। তারপর সুইডেন শব্দটি নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। ১৯৯৭ সালের ২৩ মার্চ গালিব খুন হন। এ ঘটনায় আসলামসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ১৯৯৮ সালের ৮ এপ্রিল অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ২৪ সাক্ষীর মধ্যে পুলিশ চারজনকে আদালতে হাজির করতে পেরেছে। বাকিরা আর আসেননি এবং এই মামলায় তিনি জামিনও নেননি।
দীর্ঘদিন কারাগারে থাকলেও আসলাম মোবাইল ফোনে সহযোগীদের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন। স্ত্রী আয়েশা আকতার নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। বলা চলে রাজার হালেই আছেন তিনি।
মিরপুর ও কাফরুল এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার আব্বাস ২২ বছর ধরে কারাগারে আটক আছেন। তার বিরুদ্ধে থাকা ১১টি মামলার জামিন হয়েছে। একটি মামলার জামিন হতে বাকি আছে। তা ছাড়া কমিশনার নিউটন হত্যা মামলায় ফাঁসির আদেশ হলেও উচ্চ আদালতে খালাস পেয়েছেন তিনি। আরেকটি মামলার শুনানি চলছে উচ্চ আদালতে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কিলার আব্বাসের এক সহযোগী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভাইয়ের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কাশিমপুর কারাগারে গিয়ে দেখা করে আসি। দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি কারাগার থেকে বের হতে চাচ্ছেন না। জামিন চাইলে তিনি জামিন পেয়ে যাবেন। কিন্তু ভাই তা করবেন না। কারণ প্রতিপক্ষ সক্রিয় আছে। তার প্রাণ শঙ্কা আছে। আমরা ইচ্ছা করলে যেকোনো সময় জামিন নিয়ে ভাইকে বের করে আনতে পারি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আরেক সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালেরও প্রায় সব মামলার জামিন হয়ে গেছে। শুধু একটা মামলার জামিন বাকি আছে। তিনি যখন কারাগারে, তখন বিএনপি তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করেছিল। অথচ হেলাল বিএনপির রাজনীতি করেন। জেলে বসেই মোহাম্মদপুর, আদাবর ও ধানম-ি, মিরপুর এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন। মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড দখল ও চাঁদাবাজি চালাচ্ছেন। তার সঙ্গে মিরপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদতের ভালো যোগাযোগ। মোবাইল ফোনে নিয়মিত কথা বলেন তারা। তার আরেক সহযোগী হাবিবুর রহমান তাজ ১৩ বছর ধরে কারাগারে আটক আছেন। মামলার সাক্ষীদের হাজির করতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। ইচ্ছে করে জামিনও নিচ্ছেন না তাজ। গ্রেপ্তারের আগে দীর্ঘদিন ভারত পালিয়ে ছিলেন। ২০০৮ সালে ভারতে গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক মাস পর তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে রাজধানীর কাফরুলে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ইসমাইল হোসেনকে হত্যা করার অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তা ছাড়া কলেজছাত্র কামরুল ইসলাম ওরফে মোমিন হত্যার সঙ্গেও জড়িত তাজ। মতিঝিল থানার সাবেক ওসি এ কে এম রফিকুল ইসলামের আশ্রয়-প্রশয়ে থাকতেন তিনি। কয়েক বছর আগে ওসি রফিক মারা যান।’
মতিঝিলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার দুই কর্মকর্তাকে হত্যা করে আলোচনায় আসে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ঈদুল। প্রায় ১৫ বছর ধরে কাশিমপুর কারাগারে আটক আছেন তিনি। একবার পঙ্গু হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকে আটক করে ফেলে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে আটটি মামলা থাকলেও দুটি মামলা বাদে সব কটিতে জামিন পেয়েছেন। বাকি মামলাগুলোতে ইচ্ছা করে জামিন নিচ্ছেন না বলে তার এক স্বজন জানিয়েছেন।
সেভেন স্টার গ্রুপের একসময়ের সদস্য ফ্রিডম সোহেল ধানম-ি ৩২ নম্বরে গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজার আসামি। সাজা কমিয়ে কারাগারেই থাকার চেষ্টা করছেন সোহেল। তার বিরুদ্ধে ১১টি মামলা আছে। ৯টি মামলায় জামিন পেয়েছেন। একটি মামলায় সাজা হয়েছে। আরেকটি মামলায় জামিন নিচ্ছেন না।
তার সহযোগী পুরস্কারঘোষিত সন্ত্রাসী রাশু কিছুদিন আগে কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ তাকে আটক করে। তার এক স্বজন দেশ রূপান্তরকে জানান, মাস দুয়েক আগে সর্বশেষ মামলায় জামিন হয় রাশুর। তার কোনো ইচ্ছা ছিল না কারাগার থেকে বের হওয়ার। আর এ কারণে ইচ্ছা করেই একটি সংস্থাকে কারাগার থেকে বের হওয়ার তথ্য দিয়ে আবার গ্রেপ্তার হন। কারণ তিনি বের হলে প্রতিপক্ষের লোকজন তাকে মেরে ফেলবে এমন আশঙ্কা ছিল। আরেক সন্ত্রাসী লম্বু সেলিম একটি মামলা বাদে সব মামলায় জামিনে আছেন। ভারতের কলকাতা থেকে তাকে পুশব্যাক করা হয়েছিল। প্রায় আট বছর ধরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। বেশিরভাগ সময় হাসপাতালে থাকেন। নিরাপত্তাহীনতার কারণে জেল থেকে বের হচ্ছেন না তিনি।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, সন্ত্রাসীদের কর্মকা- রোধ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নানা কৌশলে কাজ করছে। তারা সরগরম হলেও কাজ হবে না। যারা দেশের বাইরে আছে, তাদের চিহ্নিত করে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ধরার চেষ্টা চলছে। যারা দেশে আছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে পুলিশ-র্যাব কাজ করছে। তবে আন্ডারওয়ার্ল্ডের কেউ বিশ্ঙ্খৃলা তৈরি করতে পারবে না। তিনি বলেন, ‘কোনো সন্ত্রাসী জামিন না নিলে এটা আমাদের করার কিছু নেই। তবে তাদের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, সেদিকে নজর দেওয়া হচ্ছে।’
পুলিশ সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি, চোরাকারবারিসহ ভিন্ন ধরনের অপরাধীরা দুবাই, মালয়েশিয়া, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মগোপন করে আছেন। তাদের সহযোগীরা বাংলাদেশে অবস্থান করে অপরাধমূলক কর্মকা- চালিয়ে আসছেন। তাদের নির্দেশে হত্যাকান্ডের মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছেন তারা। মতিঝিলে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যাকান্ডের পেছনে বিদেশ কানেকশন।
২০০৩ সালে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশের দুই সদস্যকে হত্যার পর পালিয়ে যাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দুবাইয়ে আত্মগোপন করে আছেন। টিপু হত্যাকান্ডের পর তিনি আলোচনায় এসেছিলেন। দুবাইয়ে থাকলেও ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে সবচেয়ে বেশি প্রভাব তার। জিসানের সহযোগী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক ভারতে পালিয়ে আছেন। কিন্তু দেশে তার দখলবাজি, টেন্ডারবাণিজ্য ও চাঁদাবাজিতে নিয়ন্ত্রণ এখনো আছে। মোল্লা মাসুদ ও সুব্রত বাইন ভারতে থেকে সক্রিয় আছেন। তানভীর ইসলাম জয়ও সক্রিয় আছেন। কলকাতা, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ঘুরে তার অবস্থান এখন থাইল্যান্ডে। সেখানে বসেই তিনি কলকাঠি নাড়ছেন।
বিশ্বকাপের দল ঘোষণা নিয়ে চলছে নানা নাটকীয়তা। রাতটা পোহালেই বাংলাদেশ দল উড়াল দেবে ভারতের গোয়াহাটিতে। তবে এখনও ঘোষণা করা হয়নি দল। বিসিবি জানিয়েছে, নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে চলমান তৃতীয় ওয়ানডের ম্যাচ শেষেই জানানো হবে বিশ্বকাপের দল।
প্রচুর আলোচনা ও জল্পনা–কল্পনার পর আজ বিশ্বকাপে নিজেদের স্কোয়াড ঘোষণা করবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। বিসিবির ফেসবুক পেজে আজ দুপুর ১টা ২৮ মিনিটে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়। সেখানে দেখা যায় বিসিবির লোগোসংবলিত বক্সে করে গুরুত্বপুর্ণ কিছু নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভিডিও–র শেষে প্রশ্ন করা হয়েছে, বলুন তো ভেতরে কি?
বিকেল ৫টা ৪৩ মিনিটে আরেকটি পোস্টে জানানো হয় সন্ধ্যা পৌণে ৬টায় ঘোষণা করা হবে দল। কিন্তু ৫টা ৪০ মিনিটে আরেকটি পোস্টে জানানো হয় তৃতীয় ওয়ানডের শেষেই দল ঘোষনা করা হবে।