শৈশবে কেমন ছিলেন সৌদি যুবরাজ
অনলাইন ডেস্ক | ৯ ডিসেম্বর, ২০১৮ ২২:২২
যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের গৃহশিক্ষক ছিলেন রাশিদ সেক্কাই। ছবি: বিবিসি বাংলা।
সৌদি আরবের বিতর্কিত যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের শৈশব সম্পর্কে জানিয়েছেন তার গৃহশিক্ষক। বিবিসি আরবি বিভাগে কর্মরত রাশিদ সেক্কাই যুবরাজের গৃহশিক্ষক হিসেবে তাকে ইংরেজি শেখাতেন।
রাশিদ সেক্কাইয়ের বর্ণনায় বিবিসির এক প্রতিবেদনে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের বেড়ে ওঠা এবং শৈশব সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়।
১৯৯৬ সালে সেক্কাই তখন জেদ্দার নামকরা স্কুল আল-আনজালে পড়ান। তখন রিয়াদের গভর্নর ছিলেন সৌদি আরবের বাদশাহ, এবং যুবারাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের পিতা প্রিন্স সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ।
ওই সময় সাময়িকভাবে পরিবার নিয়ে জেদ্দায় অবস্থান করায় সন্তানদের জন্য প্রিন্স সালমান বিন আবদুল আজিজের একজন ইংরেজির শিক্ষক দরকার হয়েছিল। আল-আনজাল স্কুলে এ জন্য যোগাযোগ করলে রাশিদ সেক্কাইকে রাজকীয় প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি ছাত্র হিসেবে প্রিন্স তুরকি, প্রিন্স নায়েফ, প্রিন্স খালিদ, এবং প্রিন্স মোহাম্মদকে।
তৎকালীন জেদ্দার একটি উঠতি এলাকার ফ্ল্যাটে বাসরত সেক্কাইকে প্রতিদিন সকাল সাতটায় একজন শোফার এসে স্কুলে দিয়ে আসত; এবং স্কুল শেষে তাকে নিয়ে যেতো রাজপ্রাসাদে।
রাজপ্রাসাদের বর্ণনা দিতে গিয়ে সেক্কাই বলেন, "প্রাসাদের গেটের কড়া পাহারা পার হয়ে যাবার পর গাড়িটি অনেকগুলো চোখ-ধাঁধানো বাগানওয়ালা ভিলা পার হয়ে রাজকীয় প্রাসাদের সামনে পৌঁছাতো। সামনের নিখুঁতভাবে সাজানো বাগানের পরিচর্যা করছে সাদা পোশাক পরা মালীরা। "
তিনি বিবিসিকে বলেন "সেখানে একটি কার পার্কে বহু বিলাসবহুল গাড়ি দেখলাম। একটা গাড়ি দেখলাম গোলাপি রঙের - মনে হলো ওটা একটা ক্যাডিলাক। এই প্রথম আমি নিজের চোখে ক্যাডিলাক দেখলাম।"
রাজকীয় দুর্গে ঢোকার পর প্রিন্স মোহাম্মদের খুবই প্রিয় প্রাসাদের পরিচালক মধ্যবয়স্ক মানসুর আল-শাহরি সেক্কাইকে স্বাগত জানান।
যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেখে মনে হলো- পড়ার চাইতে প্রাসাদের রক্ষীদের সাথে সময় কাটানোর ব্যাপারেই প্রিন্স মোহাম্মদের বেশি আগ্রহ। ভাইদের মধ্যে ছিল সে-ই বড়।
যুবরাজের শিক্ষক বলেন, "বয়েসে ছোট যে প্রিন্সরা, আমি তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারতাম। কিন্তু মোহাম্মদ সেখানে হাজির হলেই পরিস্থিতি হয়ে যেতো অন্য রকম।"
পাঠদানের সময় রক্ষীদের কাছ থেকে ধার করা একটি মোহাম্মদ একটা ওয়াকি-টকি ব্যবহার করতো জানিয়ে সেক্কাই বলেন, সে এটাকে ব্যবহার করতো আমাকে নিয়ে নানা রকম মন্তব্য করার জন্য এবং তার ভাই ও রক্ষীদের জোক শোনানোর জন্য।
একদিনের বর্ণনা দিয়ে যুবরাজের এই গৃহশিক্ষক জানান,
"মোহাম্মদ বললো, তার মা তাকে বলেছেন যে আমাকে দেখে নাকি 'একজন সত্যিকারের ভদ্রলোক' বলে মনে হয়।"
তিনি বলেন, "আমি এটা শুনে একটু থতমত খেয়ে গেলাম। কারণ, সৌদি রাজপরিবারের মেয়েরা অপরিচিতদের সামনে আসে না এবং আমার মনে পড়ে না যে কখনো আমি তাকে দেখেছি।"
তিনি বলেন, "আমাকে যে কেউ দেখছে এ ব্যাপারটা আমি আগে বুঝতে পারি নি। কিন্তু সৌদি সিংহাসনের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী তখন আমাকে দেয়ালে লাগানো কয়েকটি সিসিটিভি ক্যামেরা দেখালেন।"
"তার পর থেকে পড়ানোর সময় আমি আত্মসচেতন হয়ে গিয়েছিলাম।"
"কিছুদিনের মধ্যেই মোহাম্মদ এবং তার ভাইদের আমার বেশ পছন্দ হয়ে গেল। তারা ছিল রাজপুত্র, এবং তাদের জগত ছিল অর্থ-বিত্ত-বিলাসে ভরা। কিন্তু তাদের সাথে আমার স্কুলের ছাত্রদের বিশেষ কোন তফাৎ ছিল না। তাদের জানার আগ্রহ ছিল কিন্তু খেলাধূলা করতেই বেশি ভালোবাসতো।"
"একদিন প্রাসাদের পরিচালক মানসুর আল-শাহরি আমাকে বললেন ভবিষ্যৎ রাজার সাথে দেখা করতে। কারণ তিনি তার সন্তানদের শিক্ষায় কতটা অগ্রগতি হলো তা জানতে চান।"
"আমি ভাবলাম, প্রিন্স মোহাম্মদের দুষ্টামির ব্যাপারে কিছু করার এটা একটা সুযোগ হলো।"
"আমি প্রিন্স সালমানের অফিসের সামনে অপেক্ষা করছিলাম। আমার পাশে দাঁড়ানো ছিলেন যুবরাজদের অন্যান্য শিক্ষকরা। মনে হলো, প্রাসাদের আদবকায়দা সম্পর্কে আমার চাইতে তারা বেশি ওয়াকিবহাল।"
"প্রিন্স সালমান আসার সাথে সাথে তারা উঠে দাঁড়ালেন, মাথা নত করলেন, হাতে চুমু খেলেন, দ্রুতগতিতে প্রিন্সদের নিযে কিছু কথা বললেন এবং সামনে এগিয়ে গেলেন।"
"যখন আমার পালা এলো - আমি তাদের মতো মাথা নত করতে পারলাম না। আমি কখনো এটা করি নি। আমি আমার হাত বাড়িয়ে দিলাম এবং ভবিষ্যৎ রাজার সাথে করমর্দন করলাম।"
"আমার মনে আছে প্রিন্স সালমানের মুখে ফুটে ওঠা বিস্ময়সূচক মৃদু হাসির কথা। কিন্তু তিনি ব্যাপারটা উপেক্ষা করেছিলেন।"
"আমি তার সাথে কথা বলার সময় প্রিন্স মোহাম্মদের কথা তুলিনি। কারণ ততক্ষণে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি যে আমি এ কাজ ছেড়ে দেবো এবং যুক্তরাজ্যে ফিরে যাবো।"
"পরে মি. আল-শাহরি আমাকে রাজকীয় আদবকায়দা পালন করতে ব্যর্থ হবার জন্য আমাকে অনেক বকাঝকা করেছিলেন।"
"আমার ছাত্রদের মধ্যে প্রিন্স মোহাম্মদ ছাড়া প্রিন্স খালিদ - যুক্তরাষ্ট্রে সৌদি রাষ্ট্রদূত হয়েছেন। তবে অন্য প্রিন্সরা জনসমক্ষে ততটা পরিচিত নন।"
"সৌদি রাজপুত্রদের শিক্ষাদানের এই সময়টা ছিল আমার জীবনের একটা অনন্য পর্ব।"
প্রসঙ্গত, ভবিষ্যৎ সৌদি রাজা হিসেবে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের অভিষেক, রক্ষণশীল সৌদি সমাজ সংস্কারের নানা উদ্যোগ, ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ এবং সর্বশেষ জামাল খাসোগি হত্যাকান্ডের সঙ্গে তার নাম জড়িয়ে যাওয়ার কারণে সারা বিশ্বের নজর এখন তার দিকে।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
অনলাইন ডেস্ক | ৯ ডিসেম্বর, ২০১৮ ২২:২২

সৌদি আরবের বিতর্কিত যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের শৈশব সম্পর্কে জানিয়েছেন তার গৃহশিক্ষক। বিবিসি আরবি বিভাগে কর্মরত রাশিদ সেক্কাই যুবরাজের গৃহশিক্ষক হিসেবে তাকে ইংরেজি শেখাতেন।
রাশিদ সেক্কাইয়ের বর্ণনায় বিবিসির এক প্রতিবেদনে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের বেড়ে ওঠা এবং শৈশব সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়।
১৯৯৬ সালে সেক্কাই তখন জেদ্দার নামকরা স্কুল আল-আনজালে পড়ান। তখন রিয়াদের গভর্নর ছিলেন সৌদি আরবের বাদশাহ, এবং যুবারাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের পিতা প্রিন্স সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ।
ওই সময় সাময়িকভাবে পরিবার নিয়ে জেদ্দায় অবস্থান করায় সন্তানদের জন্য প্রিন্স সালমান বিন আবদুল আজিজের একজন ইংরেজির শিক্ষক দরকার হয়েছিল। আল-আনজাল স্কুলে এ জন্য যোগাযোগ করলে রাশিদ সেক্কাইকে রাজকীয় প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি ছাত্র হিসেবে প্রিন্স তুরকি, প্রিন্স নায়েফ, প্রিন্স খালিদ, এবং প্রিন্স মোহাম্মদকে।
তৎকালীন জেদ্দার একটি উঠতি এলাকার ফ্ল্যাটে বাসরত সেক্কাইকে প্রতিদিন সকাল সাতটায় একজন শোফার এসে স্কুলে দিয়ে আসত; এবং স্কুল শেষে তাকে নিয়ে যেতো রাজপ্রাসাদে।
রাজপ্রাসাদের বর্ণনা দিতে গিয়ে সেক্কাই বলেন, "প্রাসাদের গেটের কড়া পাহারা পার হয়ে যাবার পর গাড়িটি অনেকগুলো চোখ-ধাঁধানো বাগানওয়ালা ভিলা পার হয়ে রাজকীয় প্রাসাদের সামনে পৌঁছাতো। সামনের নিখুঁতভাবে সাজানো বাগানের পরিচর্যা করছে সাদা পোশাক পরা মালীরা। "
তিনি বিবিসিকে বলেন "সেখানে একটি কার পার্কে বহু বিলাসবহুল গাড়ি দেখলাম। একটা গাড়ি দেখলাম গোলাপি রঙের - মনে হলো ওটা একটা ক্যাডিলাক। এই প্রথম আমি নিজের চোখে ক্যাডিলাক দেখলাম।"
রাজকীয় দুর্গে ঢোকার পর প্রিন্স মোহাম্মদের খুবই প্রিয় প্রাসাদের পরিচালক মধ্যবয়স্ক মানসুর আল-শাহরি সেক্কাইকে স্বাগত জানান।
যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেখে মনে হলো- পড়ার চাইতে প্রাসাদের রক্ষীদের সাথে সময় কাটানোর ব্যাপারেই প্রিন্স মোহাম্মদের বেশি আগ্রহ। ভাইদের মধ্যে ছিল সে-ই বড়।
যুবরাজের শিক্ষক বলেন, "বয়েসে ছোট যে প্রিন্সরা, আমি তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারতাম। কিন্তু মোহাম্মদ সেখানে হাজির হলেই পরিস্থিতি হয়ে যেতো অন্য রকম।"
পাঠদানের সময় রক্ষীদের কাছ থেকে ধার করা একটি মোহাম্মদ একটা ওয়াকি-টকি ব্যবহার করতো জানিয়ে সেক্কাই বলেন, সে এটাকে ব্যবহার করতো আমাকে নিয়ে নানা রকম মন্তব্য করার জন্য এবং তার ভাই ও রক্ষীদের জোক শোনানোর জন্য।
একদিনের বর্ণনা দিয়ে যুবরাজের এই গৃহশিক্ষক জানান, "মোহাম্মদ বললো, তার মা তাকে বলেছেন যে আমাকে দেখে নাকি 'একজন সত্যিকারের ভদ্রলোক' বলে মনে হয়।"
তিনি বলেন, "আমি এটা শুনে একটু থতমত খেয়ে গেলাম। কারণ, সৌদি রাজপরিবারের মেয়েরা অপরিচিতদের সামনে আসে না এবং আমার মনে পড়ে না যে কখনো আমি তাকে দেখেছি।"
তিনি বলেন, "আমাকে যে কেউ দেখছে এ ব্যাপারটা আমি আগে বুঝতে পারি নি। কিন্তু সৌদি সিংহাসনের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী তখন আমাকে দেয়ালে লাগানো কয়েকটি সিসিটিভি ক্যামেরা দেখালেন।"
"তার পর থেকে পড়ানোর সময় আমি আত্মসচেতন হয়ে গিয়েছিলাম।"
"কিছুদিনের মধ্যেই মোহাম্মদ এবং তার ভাইদের আমার বেশ পছন্দ হয়ে গেল। তারা ছিল রাজপুত্র, এবং তাদের জগত ছিল অর্থ-বিত্ত-বিলাসে ভরা। কিন্তু তাদের সাথে আমার স্কুলের ছাত্রদের বিশেষ কোন তফাৎ ছিল না। তাদের জানার আগ্রহ ছিল কিন্তু খেলাধূলা করতেই বেশি ভালোবাসতো।"
"একদিন প্রাসাদের পরিচালক মানসুর আল-শাহরি আমাকে বললেন ভবিষ্যৎ রাজার সাথে দেখা করতে। কারণ তিনি তার সন্তানদের শিক্ষায় কতটা অগ্রগতি হলো তা জানতে চান।"
"আমি ভাবলাম, প্রিন্স মোহাম্মদের দুষ্টামির ব্যাপারে কিছু করার এটা একটা সুযোগ হলো।"
"আমি প্রিন্স সালমানের অফিসের সামনে অপেক্ষা করছিলাম। আমার পাশে দাঁড়ানো ছিলেন যুবরাজদের অন্যান্য শিক্ষকরা। মনে হলো, প্রাসাদের আদবকায়দা সম্পর্কে আমার চাইতে তারা বেশি ওয়াকিবহাল।"
"প্রিন্স সালমান আসার সাথে সাথে তারা উঠে দাঁড়ালেন, মাথা নত করলেন, হাতে চুমু খেলেন, দ্রুতগতিতে প্রিন্সদের নিযে কিছু কথা বললেন এবং সামনে এগিয়ে গেলেন।"
"যখন আমার পালা এলো - আমি তাদের মতো মাথা নত করতে পারলাম না। আমি কখনো এটা করি নি। আমি আমার হাত বাড়িয়ে দিলাম এবং ভবিষ্যৎ রাজার সাথে করমর্দন করলাম।"
"আমার মনে আছে প্রিন্স সালমানের মুখে ফুটে ওঠা বিস্ময়সূচক মৃদু হাসির কথা। কিন্তু তিনি ব্যাপারটা উপেক্ষা করেছিলেন।"
"আমি তার সাথে কথা বলার সময় প্রিন্স মোহাম্মদের কথা তুলিনি। কারণ ততক্ষণে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি যে আমি এ কাজ ছেড়ে দেবো এবং যুক্তরাজ্যে ফিরে যাবো।"
"পরে মি. আল-শাহরি আমাকে রাজকীয় আদবকায়দা পালন করতে ব্যর্থ হবার জন্য আমাকে অনেক বকাঝকা করেছিলেন।"
"আমার ছাত্রদের মধ্যে প্রিন্স মোহাম্মদ ছাড়া প্রিন্স খালিদ - যুক্তরাষ্ট্রে সৌদি রাষ্ট্রদূত হয়েছেন। তবে অন্য প্রিন্সরা জনসমক্ষে ততটা পরিচিত নন।"
"সৌদি রাজপুত্রদের শিক্ষাদানের এই সময়টা ছিল আমার জীবনের একটা অনন্য পর্ব।"
প্রসঙ্গত, ভবিষ্যৎ সৌদি রাজা হিসেবে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের অভিষেক, রক্ষণশীল সৌদি সমাজ সংস্কারের নানা উদ্যোগ, ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ এবং সর্বশেষ জামাল খাসোগি হত্যাকান্ডের সঙ্গে তার নাম জড়িয়ে যাওয়ার কারণে সারা বিশ্বের নজর এখন তার দিকে।