মান্টো দর্শন, মান্টো পঠন
জান্নাতুন নাহার
জান্নাতুন নাহার | ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০
বায়োপিক নিয়ে কিছু বলাটা খুব কঠিন একটা ব্যাপার। এর জন্য চলচ্চিত্রটা দেখাই যথেষ্ট নয়, বরং কেন্দ্রীয় চরিত্রের ‘কাজ’ সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা থাকতে হয়। মান্টোর ব্যাপারে আমার জানাশোনা সামান্য। কিন্তু কোনো কোনো মানুষকে যেমন একবার দেখলেই ভালো লেগে যায়, মান্টো তেমন একজন। আর মুভি ‘মান্টো’ যেন মান্টোকে নিয়ে নন্দিতা দাসের সংকলন। যারা মান্টো পড়েননি, তারা ‘মান্টো’ দেখবেন না, এমনটা ভাবা যৌক্তিক নয় বরং নওয়াজউদ্দীন সিদ্দিকীর মধ্য দিয়ে মাত্র দুই ঘণ্টায় মান্টো চেনা-অচেনা সবার কাছেই যেন জীবন্ত হয়ে উঠবেন।
একজন নতুন দর্শক ছবিটা দেখতে শুরু করলে মনে হবে তিনি হয়তো কোনো সিক্যুয়ালের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। কিন্তু দুর্বোধ্যতার পরিবর্তে গল্পটা তাকে টানবে আর তিনি হয়তো ভাববেন আগের পর্বগুলো দেখতে পারলে বেশ হতো। এই আগের পর্বই হলো মান্টোকে জানা। আর এই জানাশোনার মধ্যে আনতে হয় মান্টোর বন্ধু অভিনেতা অশোক কুমার আর বিখ্যাত উর্দু লেখিকা ইসমত চুঘতাইকে। মান্টো শুধু তার সময় নয়, উপমহাদেশের অন্যতম আধুনিক লেখকদের একজন, একসঙ্গে মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্রের কাহিনী ও চিত্রনাট্যকার। ৪৭-এর দাঙ্গার পর দেশ ছেড়ে একপ্রকার অভিমান নিয়ে লাহোর চলে যান। আপাতদৃষ্টিতে পাকিস্তানিরাও তাকে সাদরে গ্রহণ করেছিল; তারাও জানত মান্টোর হাতে সোনা ফলে।
মান্টো এমন এক লেখক যিনি তার স্থান-কালের নৈর্ব্যক্তিক রূপকার। তাই তো ‘ঠান্ডা গোশত’ নিয়ে আদালতে নিজের পক্ষে ওকালতে বলেছিলেন আমি তাই লিখি যা আমি জানি, যা আমি দেখি। কাহিনির আয়নায় সমজের প্রতিফলন যতই বাস্তবিক হোক না কেন, কদর্যতার ভেতর সত্যকে আবিষ্কার করা মান্টোকে সমসাময়িক সমাজ নিতে পারেনি। না এপার, না ওপার। মান্টোর জীবনের টানাপোড়েন দাঁড়িয়েছিল তাই দু-তরফের। রক্ষণশীল সমাজের ভেতর অগ্রগামীর যে পীড়ন, তা প্রকাশিত ‘ঠান্ডা গোশত’-এর বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ নিয়ে মোকদ্দমায়। কিন্তু মান্টোর জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি যে সেটা নয়- চলচ্চিত্রটিও নির্ভুলভাবে সেই কথাই বলে।
ডানাকাটা পাখির স্বাধীনতা কেমন নন্দিতা দাসের ‘মান্টো’ দেখে বোঝা যায়। দেশভাগের বেদনা গত অর্ধশতাব্দীতে বহুভাবে সাহিত্যে এবং চলচ্চিত্রে এসেছে। মান্টোর মতো সংবেদনশীল আধুনিক মানুষকে কী অভিমানে বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছিল, তার কিছুটা নন্দিতা তুলে এনেছেন প্রিয় বন্ধু অশোক এবং ইসমত চুঘতাইয়ের সঙ্গে মান্টোর যোগাযোগ ছিন্নতার মধ্য দিয়ে। যত্নে তুলে রাখা তাদের চিঠিগুলো পড়ার হিম্মত হয়তো মান্টোর ছিল। কিন্তু নিজের মাটির (ভূখণ্ড নয়) সঙ্গে বিযুক্ততার বেদনা যে অভিমানী মান্টোকে অস্তিত্বহীন করে দিয়েছিল, তার প্রমাণ মাত্র ৪২ বছর বয়সে সাদাত হোসেনের চলে যাওয়াটা।
সৃষ্টিশীল মানুষের রুদ্ধতার ট্র্যাজিডি তাই স্পর্শ করে অগ্রসর বা অনগ্রসর সব দর্শককেই আর এভাবেই মান্টো চিরদিনের জন্য বেঁচে থাকেন তার ঠান্ডা গোশতের ভেতর।
শেয়ার করুন
জান্নাতুন নাহার
জান্নাতুন নাহার | ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০

বায়োপিক নিয়ে কিছু বলাটা খুব কঠিন একটা ব্যাপার। এর জন্য চলচ্চিত্রটা দেখাই যথেষ্ট নয়, বরং কেন্দ্রীয় চরিত্রের ‘কাজ’ সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা থাকতে হয়। মান্টোর ব্যাপারে আমার জানাশোনা সামান্য। কিন্তু কোনো কোনো মানুষকে যেমন একবার দেখলেই ভালো লেগে যায়, মান্টো তেমন একজন। আর মুভি ‘মান্টো’ যেন মান্টোকে নিয়ে নন্দিতা দাসের সংকলন। যারা মান্টো পড়েননি, তারা ‘মান্টো’ দেখবেন না, এমনটা ভাবা যৌক্তিক নয় বরং নওয়াজউদ্দীন সিদ্দিকীর মধ্য দিয়ে মাত্র দুই ঘণ্টায় মান্টো চেনা-অচেনা সবার কাছেই যেন জীবন্ত হয়ে উঠবেন।
একজন নতুন দর্শক ছবিটা দেখতে শুরু করলে মনে হবে তিনি হয়তো কোনো সিক্যুয়ালের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। কিন্তু দুর্বোধ্যতার পরিবর্তে গল্পটা তাকে টানবে আর তিনি হয়তো ভাববেন আগের পর্বগুলো দেখতে পারলে বেশ হতো। এই আগের পর্বই হলো মান্টোকে জানা। আর এই জানাশোনার মধ্যে আনতে হয় মান্টোর বন্ধু অভিনেতা অশোক কুমার আর বিখ্যাত উর্দু লেখিকা ইসমত চুঘতাইকে। মান্টো শুধু তার সময় নয়, উপমহাদেশের অন্যতম আধুনিক লেখকদের একজন, একসঙ্গে মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্রের কাহিনী ও চিত্রনাট্যকার। ৪৭-এর দাঙ্গার পর দেশ ছেড়ে একপ্রকার অভিমান নিয়ে লাহোর চলে যান। আপাতদৃষ্টিতে পাকিস্তানিরাও তাকে সাদরে গ্রহণ করেছিল; তারাও জানত মান্টোর হাতে সোনা ফলে।
মান্টো এমন এক লেখক যিনি তার স্থান-কালের নৈর্ব্যক্তিক রূপকার। তাই তো ‘ঠান্ডা গোশত’ নিয়ে আদালতে নিজের পক্ষে ওকালতে বলেছিলেন আমি তাই লিখি যা আমি জানি, যা আমি দেখি। কাহিনির আয়নায় সমজের প্রতিফলন যতই বাস্তবিক হোক না কেন, কদর্যতার ভেতর সত্যকে আবিষ্কার করা মান্টোকে সমসাময়িক সমাজ নিতে পারেনি। না এপার, না ওপার। মান্টোর জীবনের টানাপোড়েন দাঁড়িয়েছিল তাই দু-তরফের। রক্ষণশীল সমাজের ভেতর অগ্রগামীর যে পীড়ন, তা প্রকাশিত ‘ঠান্ডা গোশত’-এর বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ নিয়ে মোকদ্দমায়। কিন্তু মান্টোর জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি যে সেটা নয়- চলচ্চিত্রটিও নির্ভুলভাবে সেই কথাই বলে।
ডানাকাটা পাখির স্বাধীনতা কেমন নন্দিতা দাসের ‘মান্টো’ দেখে বোঝা যায়। দেশভাগের বেদনা গত অর্ধশতাব্দীতে বহুভাবে সাহিত্যে এবং চলচ্চিত্রে এসেছে। মান্টোর মতো সংবেদনশীল আধুনিক মানুষকে কী অভিমানে বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছিল, তার কিছুটা নন্দিতা তুলে এনেছেন প্রিয় বন্ধু অশোক এবং ইসমত চুঘতাইয়ের সঙ্গে মান্টোর যোগাযোগ ছিন্নতার মধ্য দিয়ে। যত্নে তুলে রাখা তাদের চিঠিগুলো পড়ার হিম্মত হয়তো মান্টোর ছিল। কিন্তু নিজের মাটির (ভূখণ্ড নয়) সঙ্গে বিযুক্ততার বেদনা যে অভিমানী মান্টোকে অস্তিত্বহীন করে দিয়েছিল, তার প্রমাণ মাত্র ৪২ বছর বয়সে সাদাত হোসেনের চলে যাওয়াটা। সৃষ্টিশীল মানুষের রুদ্ধতার ট্র্যাজিডি তাই স্পর্শ করে অগ্রসর বা অনগ্রসর সব দর্শককেই আর এভাবেই মান্টো চিরদিনের জন্য বেঁচে থাকেন তার ঠান্ডা গোশতের ভেতর।