হাসি-কান্নায় ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’
পাভেল রহমান | ১ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০
গানের দল ভেঙে দেবেন বাউলশিল্পী মজিদ মিয়া। নিজের হাতে হারমোনিয়ামে আগুন লাগিয়ে দিলেন। এমন একটি চমকে দেওয়ার মতো দৃশ্য দিয়ে নাটকের শুরু। নাটকের নাম ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’। নির্মাণ করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। এরপর সম্ভবত আর কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু এত বছর পর কেন ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’? অন্তর্জাল দুনিয়ায় হঠাৎ করেই সামনে এলো নাটকটির লিংক। এরপরই লিংকটিতে ক্লিক করে আবার দেখতে বসা সেই ছোটবেলায় বিটিভিতে দেখা নাটক ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’। নাটকের গল্পটা খুবই সাধারণ। মজিদ মিয়ার গানের দল এবং গ্রামের কিছু সাধারণ চরিত্রের অসাধারণ জার্নি। নাটকের পরতে পরতে যেন সময়কে অতিক্রম করে যাওয়া সংলাপ। নাটকের একটি দৃশ্যের বর্ণনা এখানে দেওয়া যাক রাস্তায় ফজলু-পুষ্প-তয়ুব মিয়ার কথোপকথন। তয়ুব বলছে ‘ঘড়ি মার্কায় ভোট দিলে ১০০ করে ট্যাকা দিচ্ছে। আমারে দিছে ২০০ ট্যাকা।’ পুষ্পের সংলাপ ‘তয়ুব ভাই, আপনি সোলেমান চাচারে ভোট দেন নাই?’ জবাবে তয়ুবের সরল উত্তর ‘ভোট জায়গামতোই দিছি। নিজে একজন দুষ্টু লোক হয়ে আরেকজন দুষ্টু লোকরে ভোট দেয় ক্যামনে?’ সরল এই সংলাপটি সমকালীন বাংলাদেশের বাস্তবতায়ও যে খুবই প্রাসঙ্গিক, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভোট-বাণিজ্যের বিরুদ্ধে যেন এক সরল প্রতিবাদ।
২৬ পর্বের নাটকের শেষের দিকে যখন লন্ডনে গান করার আমন্ত্রণ আসে মজিদ মিয়ার গানের দলের, তখন এই শিল্পীর বাড়িতে এসে হাজির ক্যানসারে আক্রান্ত উস্তাদ জালাল খাঁ। ‘যার কাছে ট্যাকা হইলো তেজপাতা’। নিজের সকল সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা বিলিয়ে বেড়ায়। জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে জালাল খাঁর উপলব্ধি ‘ট্যাকা জীবনে কিছুই না।’ জালাল খাঁ মরার আগে কয়েকটা দিন মজিদ মিয়ার বাড়িতে থাকতে চায়। এমন একজন অসুস্থ মানুুষকে বাড়িতে রেখে লন্ডন যেতে পারবে না মজিদ মিয়ার গানের দল। সেটা জানিয়ে দেওয়া হয় ব্রিটিশ অ্যাম্বাসির কর্মকর্তাকে। এতটা সরলভাবে মানবিকতা উপস্থাপন। যার সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই, সেই জালাল খাঁর জন্য লন্ডন যাত্রা বাতিল করে মজিদ মিয়া ও তার গানের দলের সদস্যরা, যেন মানবিকবোধের অনন্য দৃষ্টান্ত। তাই তো এমন সরল মানুষের সান্নিধ্য পাওয়া লন্ডন থেকে আসা মিউজিকের ছাত্র হাসান হয়ে উঠে মজিদ মিয়ার পরিবারের একজন। অন্যদিকে কোনো এক পতিতার ঘরে জন্ম নেওয়া পুষ্প ও ফুলেশ্বরি। দুজনের জীবন হয়ে যায় দুই রকম। একজন ছোটবেলায় আশ্রয় পায় মজিদ মিয়ার ঘরে, অন্যজন পথে পথে ঘুরে জীবনের নানা নেতিবাচক অভিজ্ঞতায় একদিন মজিদ মিয়ার বাড়িতে এসে আত্মহত্যা করে। বোনের কবরে একটা গাছ লাগিয়ে পুষ্প বলে ‘বইন গো জীবনে কোনোদিন ছায়া পাও নাই। তাই তোমার কবরে এই ছায়ার ব্যবস্থা করলাম।’ এ যেন নিয়তির নির্মম ট্র্যাজেডি।
সংসার হারানো দোতারাবাদক ফজলু, বেহালাবাদক তৈয়ব এবং গ্রামের চরিত্রগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ধরা দেয় ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’ নাটকে। একের পর এক দৃশ্য, হাসায়-কাঁদায় এবং ভাবনাকে উসকে দেয়। অর্থবিত্তহীন মজিদ মিয়ার বাড়িটা যেন হয়ে ওঠে স্বর্গপুরি। হুমায়ূন আহমেদ যে বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটকের অনন্য কারিগড়, এ কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু গল্পকে সহজ-সরল এবং অর্থপূর্ণ করে তুলে ধরার এই কৌশল দেখতে এ প্রজন্মের নির্মাতাদেরও ফিরতে হবে হুমায়ূন আহমেদের কাছেই। জীবনবোধের এমন নানা বিশ্লেষণ এবং উপস্থাপনার সারল্য এ তো হুমায়ূন আহমেদের নাটকেই পাওয়া যায়। তাই তো ইউটিউব জুড়ে এখনো জনপ্রিয় হুমায়ূন আহমেদের নাটক।
শেয়ার করুন
পাভেল রহমান | ১ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০

গানের দল ভেঙে দেবেন বাউলশিল্পী মজিদ মিয়া। নিজের হাতে হারমোনিয়ামে আগুন লাগিয়ে দিলেন। এমন একটি চমকে দেওয়ার মতো দৃশ্য দিয়ে নাটকের শুরু। নাটকের নাম ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’। নির্মাণ করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। এরপর সম্ভবত আর কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু এত বছর পর কেন ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’? অন্তর্জাল দুনিয়ায় হঠাৎ করেই সামনে এলো নাটকটির লিংক। এরপরই লিংকটিতে ক্লিক করে আবার দেখতে বসা সেই ছোটবেলায় বিটিভিতে দেখা নাটক ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’। নাটকের গল্পটা খুবই সাধারণ। মজিদ মিয়ার গানের দল এবং গ্রামের কিছু সাধারণ চরিত্রের অসাধারণ জার্নি। নাটকের পরতে পরতে যেন সময়কে অতিক্রম করে যাওয়া সংলাপ। নাটকের একটি দৃশ্যের বর্ণনা এখানে দেওয়া যাক রাস্তায় ফজলু-পুষ্প-তয়ুব মিয়ার কথোপকথন। তয়ুব বলছে ‘ঘড়ি মার্কায় ভোট দিলে ১০০ করে ট্যাকা দিচ্ছে। আমারে দিছে ২০০ ট্যাকা।’ পুষ্পের সংলাপ ‘তয়ুব ভাই, আপনি সোলেমান চাচারে ভোট দেন নাই?’ জবাবে তয়ুবের সরল উত্তর ‘ভোট জায়গামতোই দিছি। নিজে একজন দুষ্টু লোক হয়ে আরেকজন দুষ্টু লোকরে ভোট দেয় ক্যামনে?’ সরল এই সংলাপটি সমকালীন বাংলাদেশের বাস্তবতায়ও যে খুবই প্রাসঙ্গিক, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভোট-বাণিজ্যের বিরুদ্ধে যেন এক সরল প্রতিবাদ।
২৬ পর্বের নাটকের শেষের দিকে যখন লন্ডনে গান করার আমন্ত্রণ আসে মজিদ মিয়ার গানের দলের, তখন এই শিল্পীর বাড়িতে এসে হাজির ক্যানসারে আক্রান্ত উস্তাদ জালাল খাঁ। ‘যার কাছে ট্যাকা হইলো তেজপাতা’। নিজের সকল সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা বিলিয়ে বেড়ায়। জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে জালাল খাঁর উপলব্ধি ‘ট্যাকা জীবনে কিছুই না।’ জালাল খাঁ মরার আগে কয়েকটা দিন মজিদ মিয়ার বাড়িতে থাকতে চায়। এমন একজন অসুস্থ মানুুষকে বাড়িতে রেখে লন্ডন যেতে পারবে না মজিদ মিয়ার গানের দল। সেটা জানিয়ে দেওয়া হয় ব্রিটিশ অ্যাম্বাসির কর্মকর্তাকে। এতটা সরলভাবে মানবিকতা উপস্থাপন। যার সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই, সেই জালাল খাঁর জন্য লন্ডন যাত্রা বাতিল করে মজিদ মিয়া ও তার গানের দলের সদস্যরা, যেন মানবিকবোধের অনন্য দৃষ্টান্ত। তাই তো এমন সরল মানুষের সান্নিধ্য পাওয়া লন্ডন থেকে আসা মিউজিকের ছাত্র হাসান হয়ে উঠে মজিদ মিয়ার পরিবারের একজন। অন্যদিকে কোনো এক পতিতার ঘরে জন্ম নেওয়া পুষ্প ও ফুলেশ্বরি। দুজনের জীবন হয়ে যায় দুই রকম। একজন ছোটবেলায় আশ্রয় পায় মজিদ মিয়ার ঘরে, অন্যজন পথে পথে ঘুরে জীবনের নানা নেতিবাচক অভিজ্ঞতায় একদিন মজিদ মিয়ার বাড়িতে এসে আত্মহত্যা করে। বোনের কবরে একটা গাছ লাগিয়ে পুষ্প বলে ‘বইন গো জীবনে কোনোদিন ছায়া পাও নাই। তাই তোমার কবরে এই ছায়ার ব্যবস্থা করলাম।’ এ যেন নিয়তির নির্মম ট্র্যাজেডি।
সংসার হারানো দোতারাবাদক ফজলু, বেহালাবাদক তৈয়ব এবং গ্রামের চরিত্রগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ধরা দেয় ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’ নাটকে। একের পর এক দৃশ্য, হাসায়-কাঁদায় এবং ভাবনাকে উসকে দেয়। অর্থবিত্তহীন মজিদ মিয়ার বাড়িটা যেন হয়ে ওঠে স্বর্গপুরি। হুমায়ূন আহমেদ যে বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটকের অনন্য কারিগড়, এ কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু গল্পকে সহজ-সরল এবং অর্থপূর্ণ করে তুলে ধরার এই কৌশল দেখতে এ প্রজন্মের নির্মাতাদেরও ফিরতে হবে হুমায়ূন আহমেদের কাছেই। জীবনবোধের এমন নানা বিশ্লেষণ এবং উপস্থাপনার সারল্য এ তো হুমায়ূন আহমেদের নাটকেই পাওয়া যায়। তাই তো ইউটিউব জুড়ে এখনো জনপ্রিয় হুমায়ূন আহমেদের নাটক।