‘ভাই পার্টি’তে নৌকা ভাটিতে
পাভেল হায়দার চৌধুরী | ২০ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০
নির্বাচনের দিন দশেক বাকি থাকলেও দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারে নামতে চাইছেন না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা। বেশির ভাগ জেলায় ‘ভাই পার্টি’র দৌরাত্ম্যের কারণে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের কাছেই ভিড়তে পারছেন না বলে অভিযোগ করেছেন তারা। ক্ষুব্ধ তৃণমূলের নেতারা যেমন মাঠে নামছেন না, তেমনি প্রার্থীরাও তাদের এড়িয়ে চলছেন। ফলে নৌকার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
তৃণমূল নেতাকর্মীদের ভাষ্য, তাদের বাদ দিয়ে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের ঘিরে ‘ভাই পার্টি’ নামে সুবিধাবাদীদের একটি বলয় গড়ে উঠেছে। এদের দৌরাত্ম্যে তারা দলে ‘নিজ ঘরে পরবাসী’র মতো। যাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ, তারা তা অস্বীকার করলেও দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় কোথাও কোথাও এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ভোটের আগেই এ সমস্যা কাটবে। কারণ তৃণমূলই আওয়ামী লীগের শক্তি।
টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুক দেশ রূপান্তরকে বলেন, দীর্ঘদিন দল ক্ষমতায় থাকার কারণে সারা দেশেই নেতাকর্মীদের ভেতরে ক্ষোভ-বিক্ষোভ, দুঃখ-কষ্ট রয়েছে। এর মধ্যে ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে প্রার্থীদের আশপাশে পছন্দের লোকদের ভিড়ে থাকতে পারছে না আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এসব কিছু মিলে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের প্রচারের কাজে মাঠে নামাতে কষ্ট হচ্ছে। টাঙ্গাইল-৭ (মির্জাপুর)
আসনে নৌকার প্রার্থী একাব্বর হোসেন ও টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনের প্রার্থী হাসান ইমাম খান সোহেলকে নিয়ে নেতাকর্মীদের ক্ষোভ রয়েছে জানিয়ে ফজলুর রহমান বলেন, ‘মনোনয়ন পাওয়ার পর বর্ষীয়ান নেতা একাব্বর জেলা কমিটির অনুমতি ছাড়া মির্জাপুর থানার সবগুলো কমিটি ভেঙে দিয়েছেন। এটা মির্জাপুরের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। এ রকম একটা অভিযোগের কথা বললাম।’
তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে একাব্বর হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, তিনি (ফজলু) মনগড়া অভিযোগ করেছেন। এর বেশি কিছ বলতে চাননি তিনি।
রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, ‘দলের ভেতরে ক্ষমতাশালীদের ভাই পার্টি আছে। এই ভাই পার্টির কাছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নিজের ঘরে পর হয়ে বসবাস করছেন। এছাড়া দল মনোনীত প্রার্থীদের বিমাতাসুলভ আচরণ তো আছেই। তবু নৌকার পক্ষে কাজ করছি। শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী করব তাই। রাজনীতি যারা করে, তাদের অবস্থান আজ কোথায়? তবুও ক্ষোভ-বিক্ষোভ সেগুলো দূরে ঠেলে দিয়ে নৌকার বিজয়ের লক্ষ্যে কাজ করছি।’
এ ছাড়া বিভিন্ন আসনে অনেক স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাকে বাদ দিয়ে নতুন প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। মনোনয়ন না পাওয়া এই নেতাদের সঙ্গে প্রার্থীদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। প্রার্থীরাও তাদের কাছে গিয়ে দূরত্ব কমিয়ে তাদেরকে প্রচারে নামানোর চেষ্টা করছে না। এর ফলে প্রচারে দলীয় ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেই।
নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজামউদ্দিন খান নিলু বলেন, ‘প্রার্থীদের মধ্যে গা ছাড়া ভাব আছে, তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যেও সে ভাব আছে। এগুলো মীমাংসা করতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। তবে এখন কিছু বলব না।’
ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুল কাদের মজনু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কেউ মনোনয়ন চেয়েছেন, পাননি। মনোনয়ন চাওয়ার অপরাধে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এগুলোও ভোটের প্রচারকাজে বাধার সৃষ্টি করছে। এসব কারণে নৌকার প্রার্থীদের সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের দূরত্ব বাড়ছে।’
মাদারীপুর-৩ (কালকিনি ডাসার-সাহেব রামপুর) আসনটিতে নৌকার প্রার্থী আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ। এই আসনে আগে সংসদ সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। সেখানেও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।
মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজল কৃষ্ণ দে বলেন, গোলাপ তার নিজস্ব বলয় নিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন। দলীয় লোকজনকে উনি আস্থায় রাখেন না। তিনি তৃণমূল নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করছেন না। তার ওপর বিরক্ত জেলা-উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগ নেতারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবদুস সোবহান গোলাপ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজল কৃষ্ণ দের অভিযোগ সত্যি নয়। আমার আসনে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করছেন।’
কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাফর আলী বলেন, ‘ভাই পার্টির আধিপত্য নেতাকর্মীদের হতাশ করে। দুঃখ-কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে কাজ করছেন আমার জেলা-উপজেলার অনেক নেতা।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক তৃণমূল নেতাদের অভিযোগের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ না করে বলেন, দীর্ঘদিন দল ক্ষমতায় থাকার কারণে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় এই চিত্র আছে। তবে নির্বাচনের আগে একে অপরের ভুল বোঝাবুঝি দূর হয়ে যাবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান দেশ রূপান্তকে বলেন, ‘তৃণমূলের সমস্যা নিয়ে প্রতিদিনই কেন্দ্রে অভিযোগ আসছে। আমরা বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করছি।’
শেয়ার করুন
পাভেল হায়দার চৌধুরী | ২০ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০

নির্বাচনের দিন দশেক বাকি থাকলেও দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারে নামতে চাইছেন না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা। বেশির ভাগ জেলায় ‘ভাই পার্টি’র দৌরাত্ম্যের কারণে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের কাছেই ভিড়তে পারছেন না বলে অভিযোগ করেছেন তারা। ক্ষুব্ধ তৃণমূলের নেতারা যেমন মাঠে নামছেন না, তেমনি প্রার্থীরাও তাদের এড়িয়ে চলছেন। ফলে নৌকার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
তৃণমূল নেতাকর্মীদের ভাষ্য, তাদের বাদ দিয়ে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের ঘিরে ‘ভাই পার্টি’ নামে সুবিধাবাদীদের একটি বলয় গড়ে উঠেছে। এদের দৌরাত্ম্যে তারা দলে ‘নিজ ঘরে পরবাসী’র মতো। যাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ, তারা তা অস্বীকার করলেও দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় কোথাও কোথাও এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ভোটের আগেই এ সমস্যা কাটবে। কারণ তৃণমূলই আওয়ামী লীগের শক্তি।
টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুক দেশ রূপান্তরকে বলেন, দীর্ঘদিন দল ক্ষমতায় থাকার কারণে সারা দেশেই নেতাকর্মীদের ভেতরে ক্ষোভ-বিক্ষোভ, দুঃখ-কষ্ট রয়েছে। এর মধ্যে ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে প্রার্থীদের আশপাশে পছন্দের লোকদের ভিড়ে থাকতে পারছে না আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এসব কিছু মিলে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের প্রচারের কাজে মাঠে নামাতে কষ্ট হচ্ছে। টাঙ্গাইল-৭ (মির্জাপুর)
আসনে নৌকার প্রার্থী একাব্বর হোসেন ও টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনের প্রার্থী হাসান ইমাম খান সোহেলকে নিয়ে নেতাকর্মীদের ক্ষোভ রয়েছে জানিয়ে ফজলুর রহমান বলেন, ‘মনোনয়ন পাওয়ার পর বর্ষীয়ান নেতা একাব্বর জেলা কমিটির অনুমতি ছাড়া মির্জাপুর থানার সবগুলো কমিটি ভেঙে দিয়েছেন। এটা মির্জাপুরের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। এ রকম একটা অভিযোগের কথা বললাম।’
তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে একাব্বর হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, তিনি (ফজলু) মনগড়া অভিযোগ করেছেন। এর বেশি কিছ বলতে চাননি তিনি।
রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, ‘দলের ভেতরে ক্ষমতাশালীদের ভাই পার্টি আছে। এই ভাই পার্টির কাছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নিজের ঘরে পর হয়ে বসবাস করছেন। এছাড়া দল মনোনীত প্রার্থীদের বিমাতাসুলভ আচরণ তো আছেই। তবু নৌকার পক্ষে কাজ করছি। শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী করব তাই। রাজনীতি যারা করে, তাদের অবস্থান আজ কোথায়? তবুও ক্ষোভ-বিক্ষোভ সেগুলো দূরে ঠেলে দিয়ে নৌকার বিজয়ের লক্ষ্যে কাজ করছি।’
এ ছাড়া বিভিন্ন আসনে অনেক স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাকে বাদ দিয়ে নতুন প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। মনোনয়ন না পাওয়া এই নেতাদের সঙ্গে প্রার্থীদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। প্রার্থীরাও তাদের কাছে গিয়ে দূরত্ব কমিয়ে তাদেরকে প্রচারে নামানোর চেষ্টা করছে না। এর ফলে প্রচারে দলীয় ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেই।
নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজামউদ্দিন খান নিলু বলেন, ‘প্রার্থীদের মধ্যে গা ছাড়া ভাব আছে, তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যেও সে ভাব আছে। এগুলো মীমাংসা করতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। তবে এখন কিছু বলব না।’
ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুল কাদের মজনু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কেউ মনোনয়ন চেয়েছেন, পাননি। মনোনয়ন চাওয়ার অপরাধে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এগুলোও ভোটের প্রচারকাজে বাধার সৃষ্টি করছে। এসব কারণে নৌকার প্রার্থীদের সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের দূরত্ব বাড়ছে।’
মাদারীপুর-৩ (কালকিনি ডাসার-সাহেব রামপুর) আসনটিতে নৌকার প্রার্থী আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ। এই আসনে আগে সংসদ সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। সেখানেও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।
মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজল কৃষ্ণ দে বলেন, গোলাপ তার নিজস্ব বলয় নিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন। দলীয় লোকজনকে উনি আস্থায় রাখেন না। তিনি তৃণমূল নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করছেন না। তার ওপর বিরক্ত জেলা-উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগ নেতারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবদুস সোবহান গোলাপ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজল কৃষ্ণ দের অভিযোগ সত্যি নয়। আমার আসনে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করছেন।’
কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাফর আলী বলেন, ‘ভাই পার্টির আধিপত্য নেতাকর্মীদের হতাশ করে। দুঃখ-কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে কাজ করছেন আমার জেলা-উপজেলার অনেক নেতা।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক তৃণমূল নেতাদের অভিযোগের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ না করে বলেন, দীর্ঘদিন দল ক্ষমতায় থাকার কারণে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় এই চিত্র আছে। তবে নির্বাচনের আগে একে অপরের ভুল বোঝাবুঝি দূর হয়ে যাবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান দেশ রূপান্তকে বলেন, ‘তৃণমূলের সমস্যা নিয়ে প্রতিদিনই কেন্দ্রে অভিযোগ আসছে। আমরা বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করছি।’