জিতবে কে
রায়ান বণিক | ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০
নির্বাচনী মাঠের উত্তাপ সকালেই কেন্দ্রে গিয়ে মিলবে আজ। ভোটের লাইনে দাঁড়ানো ভোটারের মনের কথা ফুটে উঠবে ব্যালটে। তাতেই নির্ধারিত হবে প্রার্থীদের ভাগ্য, জয়-পরাজয়। তাতে দলীয় সমর্থকদের সঙ্গে বড় ভূমিকা রাখবে গত ১০ বছরে ভোটার হওয়া প্রায় আড়াই কোটি তরুণ ও পাঁচ বছর পরপর মত পাল্টানো প্রায় এক-দেড় কোটি ভোটার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে বড় ভূমিকা রাখে নতুন ও মত পাল্টানো ভোটাররা। মত পাল্টানো ভোটারের হার প্রায় ১০-১৫ শতাংশ। এর সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি ভোটার, যাদের প্রায় অর্ধেক গত নির্বাচনের আগে ভোটার হলেও ভোট দিতে পারেনি। বাকি এক কোটি নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছে এবার। দলীয় ভোটারদের সমর্থনের পাশাপাশি তরুণ ও পাঁচ বছর পরপর সিদ্ধান্ত বদল করা প্রায় চার কোটি ভোটারের বড় অংশ যে দিকে পড়বে, জয় পাবে তারাই। গত কয়েকটি নির্বাচনের ভোটচিত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বেশিরভাগ আসনেই অল্প ভোটের ব্যবধানে জয়ী-দলের প্রার্থীরা জয়লাভ করেছে। কোনো কোনো আসনে আগে বড় ব্যবধানে জয়ী-প্রার্থীও সরকারি দলে থাকার পরের নির্বাচনে হেরেছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৩০ দশমিক ৮১ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৪০টি আসনে জয়লাভ করে। তার চেয়ে মাত্র ২৫ লাখ কম বা ৩০ দশমিক ০৮ শতাংশ ভোট পেয়ে ৮৮টি আসন পায় আওয়ামী লীগ। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৪৬টি আসনে জয়লাভ করে, ৩৩ দশমিক ৬০ শতাংশ ভোট নিয়ে ১১৬টি পায় বিএনপি।
২০০১ সালে প্রথম জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। ওই নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট প্রায় ৪৬ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়লাভ করে। মূল শরিক দল বিএনপি পায় ৪০ দশমিক ৯৭ শতাংশ ভোট। এককভাবে অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগ ভোট পায় ৪০ শতাংশের মতো।
পরের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি, ১৪ দল নিয়ে মহাজোট গঠন করে আওয়ামী লীগ। ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৬৪ আসনে প্রার্থী দিয়ে ৪৮ দশমিক ০৪ শতাংশ ভোট পায়। তাদের শরিক জাতীয় পার্টি পায় ৭ দশমিক ০৪ শতাংশ ভোট। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট প্রায় ৫৮ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়লাভ করে। অন্যদিকে বিএনপি ৩২ দশমিক ৫০ শতাংশ, জামায়াতের ৪ দশমিক ৭ শতাংশসহ চারদলীয় জোট পায় প্রায় ৩৬ শতাংশ ভোট।
সংসদ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আমারএমপি.কম ১৯৯১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত নির্বাচনে ৩০০ আসনের ভোট পর্যালোচনা করে বলেছে, এর মধ্যে ২১৯টি আসনেই জয়-পরাজয়ে মত পাল্টানো ও নতুন ভোটাররা বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশ করা তাদের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৯৯ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের জয় পাওয়ার মতো ভোট আছে ৪৩টিতে, বিএনপির ২৮টি ও জাতীয় পার্টির ১০টি। পাঁচ বছর পরপর সমর্থন পরিবর্তন করা ভোটাররা বাকি আসনগুলোর জয়-পরাজয়ে নিয়ামক ভূমিকা রাখে। ফলে এসব আসনে যে দলের প্রার্থীই জিতুক না কেন, কম ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করে।
বিএনপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা জানিয়েছেন, সারা দেশে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬টি আসনে তাদের কোনো প্রার্থী নেই। এর বাইরে ১৮ প্রার্থী কারাগারে রয়েছেন। এসব আসন বিএনপি-জামায়াতের ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত। যেসব আসনে প্রার্থী নেই সেসব আসনে শেষ মুহূর্তে বিকল্প প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে দলটি। শূন্য আসনগুলোতে স্বতন্ত্র ও ভিন্ন দলের প্রার্থীদের সমর্থন দিচ্ছে বিএনপি। শেষ মুহূর্তে প্রার্থী হওয়া কিংবা ভিন্ন দলের যেসব প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে, ভোটাররা তাদের কতটুকু গ্রহণ করবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৯৯১ সাল থেকে নির্বাচনগুলোর তথ্য বিশ্লেষণে বোঝা যায়, সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা ভোটাররা সাধারণত সরকারবিরোধী পক্ষকে ভোট দেয়। ফলে তখন থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সব কটি নির্বাচনেই সরকারি দল পরাজিত হয়েছে, বিরোধী পক্ষ জিতেছে। তবে আজকের নির্বাচনে এ ধরনের ভোটাররা কোন দিকে সায় দেবে, তা অনুমান করতে পারছেন না তারা।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বক্তব্য অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারদলীয়রা আশা করছেন, নতুন ভোটাররা নৌকা মার্কাতেই ভোট দেবেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির সঙ্গে থাকবে তরুণরা। গত ১০ বছরে সরকার নানা উন্নয়নমূলক কর্মকা- বাস্তবায়ন করেছে, নির্বাচনী ইশতেহারেও অধিকতর উন্নয়নের স্বপ্ন দেখানো হয়েছে, দেশের ৯১ শতাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে গেছে, আগের মতো দরিদ্রতাও নেই দেশে। ফলে সাধারণ ভোটাররা সরকারের ওপর খুশি আছে বলে মনে করছে দলটি।
তা ছাড়া, আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রচারে প্রতিপক্ষের চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে। মিছিল, মিটিং, সমাবেশ করতে পেরেছে সব এলাকাতে, সরাসরি বেশিরভাগ ভোটারের কাছে পৌঁছতে পেরেছেন দলটির প্রার্থী ও কর্মীরা। প্রতিপক্ষ বিএনপির প্রার্থী ও কর্মীরা গ্রেপ্তার এবং হামলার ভয়ে ভোটারদের কাছেই পৌঁছাতে পারেনি। দুর্নীতির দায়ে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে আছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও সাজাপ্রাপ্ত অবস্থায় লন্ডনে দিন কাটাচ্ছেন। প্রচারের মাঠে বড় ধরনের শোডাউন দেখাতে না-পারা দলটি জয়ী হবেÑএ ধরনের ধারণা ভোটারদের মধ্যে নেই বলে মনে করছে তারা। ফলে তাদের আশা, অন্যবারের মতো ভোটারদের মধ্যে সরকারবিরোধী মনোভাব এবার কাজ করছে না। দলটি মনে করছে, সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয় পাবে তারা।
তরুণ ভোটারদের বড় অংশই আওয়ামী লীগ পাবে বলে আশা করছে দলটির নেতাকর্মীরা। তাদের ধারণা, তরুণদের দাবির প্রেক্ষিতে সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় কার্যকর করেছে। তাদের দাবি অনুযায়ী চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোটা প্রথাও তুলে দেওয়া হয়েছে। এ সরকারের আমলেই দেশে থ্রিজি-ফোরজি এসেছে, যার বড় সুবিধা ভোগ করছে তরুণ সমাজ।
বিএনপি মনে করছে, অন্য নির্বাচনগুলোর চেয়ে এবার বেশি সংখ্যক ভোটার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ধানের শীষে ভোট দেবে। তাদের যুক্তি, অন্য নির্বাচনগুলো হয়েছে পাঁচ বছর একটি দল ক্ষমতায় থাকার পর। তাতেই যদি ১০-১৫ শতাংশ ভোটার সিদ্ধান্ত বদল করে, এবার ১০ বছরে এ হার আরো বেড়েছে। তা ছাড়া, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে নতুন ভোটার হওয়া প্রায় এক কোটি ভোটার ভোট দিতে পারেনি। সরকারের ওপর তাদের ক্ষোভ রয়েছে। ফলে ২০০৮ সালে যারা নৌকায় ভোট দিয়েছে, তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ এবার ধানের শীষে ভোট দেবে।
বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের নীতিনির্ধারকরা জানান, তরুণ বা নতুন ভোটারদের বড় অংশের সমর্থন তাদের দিকে থাকবে। কারণ হিসেবে তারা বলেন, সরকার কোটা আন্দোলনকারীদের দাবি শেষ মুহূর্তে মানলেও তাদের যে নির্যাতন ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেটি তরুণরা ভালোভাবে নেয়নি। সড়কে শৃঙ্খলার দাবিতে ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগের কর্মীদের করা হামলা তরুণ ও অভিভাবকরা খারাপভাবে নিয়েছে। নির্বাচনী প্রচারে পিছিয়ে থাকার কারণে ভোট খুব একটা কমবে না বলে মনে করছেন তারা।
বিএনপি নেতাদের যুক্তি, তারা দেশের মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নির্যাতনের কারণেই তারা প্রচার চালাতে পারছে না। তাছাড়া, খালেদা জিয়া কারাগারে রয়েছেন। সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভের পাশাপাশি এসব কারণে ভোটারদের মধ্যে বিএনপির প্রতি সমর্থন বেড়েছে বলে আশা করছেন দলটির নেতারা। তারা মনে করছেন, ভোটাররা নির্বিঘেœ কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারলে তাদের জয় নিশ্চিত। এ কারণেই ঐক্যফ্রন্টের প্রধান ড. কামাল হোসেন ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বার বার ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছেন।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিপপের চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, গত ১০ বছরে আড়াই কোটি নতুন ভোটার হয়েছে। তারাই এবার নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে বড় ভূমিকা রাখবে। তারাই সুইং ভোটার হবেন। আমি মনে করি, তরুণরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সুফল ভোগ করছে। আবার অতীতাশ্রয়ী না হয়ে তরুণরা ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছে বেশি। এর ভিত্তিতেই তারা সিদ্ধান্ত নেবে, কোন দলকে ভোট দেবে।
তিনি বলেন, জানিপপের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ৩১ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছে। অবশ্য নির্বাচন কমিশনের হিসাবে তা ৪০ শতাংশ। আমি মনে করি, এবার ৭০ শতাংশের মতো ভোটার ভোট দেবে।
তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রতি নির্বাচনেই আগেরবারের সিদ্ধান্ত বদল করে সরকারি দলের বিপক্ষে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভোটার ভোট দেয়। এবার কেমন হবে তা বলা সম্ভব নয়। নির্বাচনের যে পরিবেশ, তাতে ভোটাররা নির্বিঘেœ ভোট দিতে পারবে কি-না, তা নিয়েই সংশয় রয়েছে।
শেয়ার করুন
রায়ান বণিক | ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০

নির্বাচনী মাঠের উত্তাপ সকালেই কেন্দ্রে গিয়ে মিলবে আজ। ভোটের লাইনে দাঁড়ানো ভোটারের মনের কথা ফুটে উঠবে ব্যালটে। তাতেই নির্ধারিত হবে প্রার্থীদের ভাগ্য, জয়-পরাজয়। তাতে দলীয় সমর্থকদের সঙ্গে বড় ভূমিকা রাখবে গত ১০ বছরে ভোটার হওয়া প্রায় আড়াই কোটি তরুণ ও পাঁচ বছর পরপর মত পাল্টানো প্রায় এক-দেড় কোটি ভোটার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে বড় ভূমিকা রাখে নতুন ও মত পাল্টানো ভোটাররা। মত পাল্টানো ভোটারের হার প্রায় ১০-১৫ শতাংশ। এর সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি ভোটার, যাদের প্রায় অর্ধেক গত নির্বাচনের আগে ভোটার হলেও ভোট দিতে পারেনি। বাকি এক কোটি নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছে এবার। দলীয় ভোটারদের সমর্থনের পাশাপাশি তরুণ ও পাঁচ বছর পরপর সিদ্ধান্ত বদল করা প্রায় চার কোটি ভোটারের বড় অংশ যে দিকে পড়বে, জয় পাবে তারাই। গত কয়েকটি নির্বাচনের ভোটচিত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বেশিরভাগ আসনেই অল্প ভোটের ব্যবধানে জয়ী-দলের প্রার্থীরা জয়লাভ করেছে। কোনো কোনো আসনে আগে বড় ব্যবধানে জয়ী-প্রার্থীও সরকারি দলে থাকার পরের নির্বাচনে হেরেছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৩০ দশমিক ৮১ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৪০টি আসনে জয়লাভ করে। তার চেয়ে মাত্র ২৫ লাখ কম বা ৩০ দশমিক ০৮ শতাংশ ভোট পেয়ে ৮৮টি আসন পায় আওয়ামী লীগ। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৪৬টি আসনে জয়লাভ করে, ৩৩ দশমিক ৬০ শতাংশ ভোট নিয়ে ১১৬টি পায় বিএনপি।
২০০১ সালে প্রথম জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। ওই নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট প্রায় ৪৬ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়লাভ করে। মূল শরিক দল বিএনপি পায় ৪০ দশমিক ৯৭ শতাংশ ভোট। এককভাবে অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগ ভোট পায় ৪০ শতাংশের মতো।
পরের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি, ১৪ দল নিয়ে মহাজোট গঠন করে আওয়ামী লীগ। ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৬৪ আসনে প্রার্থী দিয়ে ৪৮ দশমিক ০৪ শতাংশ ভোট পায়। তাদের শরিক জাতীয় পার্টি পায় ৭ দশমিক ০৪ শতাংশ ভোট। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট প্রায় ৫৮ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়লাভ করে। অন্যদিকে বিএনপি ৩২ দশমিক ৫০ শতাংশ, জামায়াতের ৪ দশমিক ৭ শতাংশসহ চারদলীয় জোট পায় প্রায় ৩৬ শতাংশ ভোট।
সংসদ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আমারএমপি.কম ১৯৯১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত নির্বাচনে ৩০০ আসনের ভোট পর্যালোচনা করে বলেছে, এর মধ্যে ২১৯টি আসনেই জয়-পরাজয়ে মত পাল্টানো ও নতুন ভোটাররা বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশ করা তাদের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৯৯ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের জয় পাওয়ার মতো ভোট আছে ৪৩টিতে, বিএনপির ২৮টি ও জাতীয় পার্টির ১০টি। পাঁচ বছর পরপর সমর্থন পরিবর্তন করা ভোটাররা বাকি আসনগুলোর জয়-পরাজয়ে নিয়ামক ভূমিকা রাখে। ফলে এসব আসনে যে দলের প্রার্থীই জিতুক না কেন, কম ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করে।
বিএনপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা জানিয়েছেন, সারা দেশে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬টি আসনে তাদের কোনো প্রার্থী নেই। এর বাইরে ১৮ প্রার্থী কারাগারে রয়েছেন। এসব আসন বিএনপি-জামায়াতের ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত। যেসব আসনে প্রার্থী নেই সেসব আসনে শেষ মুহূর্তে বিকল্প প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে দলটি। শূন্য আসনগুলোতে স্বতন্ত্র ও ভিন্ন দলের প্রার্থীদের সমর্থন দিচ্ছে বিএনপি। শেষ মুহূর্তে প্রার্থী হওয়া কিংবা ভিন্ন দলের যেসব প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে, ভোটাররা তাদের কতটুকু গ্রহণ করবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৯৯১ সাল থেকে নির্বাচনগুলোর তথ্য বিশ্লেষণে বোঝা যায়, সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা ভোটাররা সাধারণত সরকারবিরোধী পক্ষকে ভোট দেয়। ফলে তখন থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সব কটি নির্বাচনেই সরকারি দল পরাজিত হয়েছে, বিরোধী পক্ষ জিতেছে। তবে আজকের নির্বাচনে এ ধরনের ভোটাররা কোন দিকে সায় দেবে, তা অনুমান করতে পারছেন না তারা।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বক্তব্য অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারদলীয়রা আশা করছেন, নতুন ভোটাররা নৌকা মার্কাতেই ভোট দেবেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির সঙ্গে থাকবে তরুণরা। গত ১০ বছরে সরকার নানা উন্নয়নমূলক কর্মকা- বাস্তবায়ন করেছে, নির্বাচনী ইশতেহারেও অধিকতর উন্নয়নের স্বপ্ন দেখানো হয়েছে, দেশের ৯১ শতাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে গেছে, আগের মতো দরিদ্রতাও নেই দেশে। ফলে সাধারণ ভোটাররা সরকারের ওপর খুশি আছে বলে মনে করছে দলটি।
তা ছাড়া, আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রচারে প্রতিপক্ষের চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে। মিছিল, মিটিং, সমাবেশ করতে পেরেছে সব এলাকাতে, সরাসরি বেশিরভাগ ভোটারের কাছে পৌঁছতে পেরেছেন দলটির প্রার্থী ও কর্মীরা। প্রতিপক্ষ বিএনপির প্রার্থী ও কর্মীরা গ্রেপ্তার এবং হামলার ভয়ে ভোটারদের কাছেই পৌঁছাতে পারেনি। দুর্নীতির দায়ে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে আছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও সাজাপ্রাপ্ত অবস্থায় লন্ডনে দিন কাটাচ্ছেন। প্রচারের মাঠে বড় ধরনের শোডাউন দেখাতে না-পারা দলটি জয়ী হবেÑএ ধরনের ধারণা ভোটারদের মধ্যে নেই বলে মনে করছে তারা। ফলে তাদের আশা, অন্যবারের মতো ভোটারদের মধ্যে সরকারবিরোধী মনোভাব এবার কাজ করছে না। দলটি মনে করছে, সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয় পাবে তারা।
তরুণ ভোটারদের বড় অংশই আওয়ামী লীগ পাবে বলে আশা করছে দলটির নেতাকর্মীরা। তাদের ধারণা, তরুণদের দাবির প্রেক্ষিতে সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় কার্যকর করেছে। তাদের দাবি অনুযায়ী চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোটা প্রথাও তুলে দেওয়া হয়েছে। এ সরকারের আমলেই দেশে থ্রিজি-ফোরজি এসেছে, যার বড় সুবিধা ভোগ করছে তরুণ সমাজ।
বিএনপি মনে করছে, অন্য নির্বাচনগুলোর চেয়ে এবার বেশি সংখ্যক ভোটার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ধানের শীষে ভোট দেবে। তাদের যুক্তি, অন্য নির্বাচনগুলো হয়েছে পাঁচ বছর একটি দল ক্ষমতায় থাকার পর। তাতেই যদি ১০-১৫ শতাংশ ভোটার সিদ্ধান্ত বদল করে, এবার ১০ বছরে এ হার আরো বেড়েছে। তা ছাড়া, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে নতুন ভোটার হওয়া প্রায় এক কোটি ভোটার ভোট দিতে পারেনি। সরকারের ওপর তাদের ক্ষোভ রয়েছে। ফলে ২০০৮ সালে যারা নৌকায় ভোট দিয়েছে, তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ এবার ধানের শীষে ভোট দেবে।
বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের নীতিনির্ধারকরা জানান, তরুণ বা নতুন ভোটারদের বড় অংশের সমর্থন তাদের দিকে থাকবে। কারণ হিসেবে তারা বলেন, সরকার কোটা আন্দোলনকারীদের দাবি শেষ মুহূর্তে মানলেও তাদের যে নির্যাতন ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেটি তরুণরা ভালোভাবে নেয়নি। সড়কে শৃঙ্খলার দাবিতে ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগের কর্মীদের করা হামলা তরুণ ও অভিভাবকরা খারাপভাবে নিয়েছে। নির্বাচনী প্রচারে পিছিয়ে থাকার কারণে ভোট খুব একটা কমবে না বলে মনে করছেন তারা।
বিএনপি নেতাদের যুক্তি, তারা দেশের মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নির্যাতনের কারণেই তারা প্রচার চালাতে পারছে না। তাছাড়া, খালেদা জিয়া কারাগারে রয়েছেন। সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভের পাশাপাশি এসব কারণে ভোটারদের মধ্যে বিএনপির প্রতি সমর্থন বেড়েছে বলে আশা করছেন দলটির নেতারা। তারা মনে করছেন, ভোটাররা নির্বিঘেœ কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারলে তাদের জয় নিশ্চিত। এ কারণেই ঐক্যফ্রন্টের প্রধান ড. কামাল হোসেন ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বার বার ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছেন।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিপপের চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, গত ১০ বছরে আড়াই কোটি নতুন ভোটার হয়েছে। তারাই এবার নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে বড় ভূমিকা রাখবে। তারাই সুইং ভোটার হবেন। আমি মনে করি, তরুণরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সুফল ভোগ করছে। আবার অতীতাশ্রয়ী না হয়ে তরুণরা ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছে বেশি। এর ভিত্তিতেই তারা সিদ্ধান্ত নেবে, কোন দলকে ভোট দেবে।
তিনি বলেন, জানিপপের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ৩১ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছে। অবশ্য নির্বাচন কমিশনের হিসাবে তা ৪০ শতাংশ। আমি মনে করি, এবার ৭০ শতাংশের মতো ভোটার ভোট দেবে।
তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রতি নির্বাচনেই আগেরবারের সিদ্ধান্ত বদল করে সরকারি দলের বিপক্ষে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভোটার ভোট দেয়। এবার কেমন হবে তা বলা সম্ভব নয়। নির্বাচনের যে পরিবেশ, তাতে ভোটাররা নির্বিঘেœ ভোট দিতে পারবে কি-না, তা নিয়েই সংশয় রয়েছে।