বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ পাঁচ বছরে সর্বনিম্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক | ২ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০
ব্যাংকগুলোর বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে। ঋণ-আমানতের অনুপাত (এডি রেশিও) ও সুদহার কমার পাশাপাশি নির্বাচন ঘিরে বিনিয়োগে স্থবিরতাকেও ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার পেছনে কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী বছরের নভেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। ২০১৩ সালের
নভেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৭২ শতাংশ। সে হিসাবে ২০১৮ সালের নভেম্বরের ঋণপ্রবাহ পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ৮২ শতাংশে ছিল। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে ডিসেম্বর নাগাদ বেসরকারি খাতে ঋণ ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করে। নির্বাচনের সময়ের কারণে ব্যবসায়ীরাও নতুন করে বিনিয়োগে তেমন আগ্রহ দেখাননি। এক অঙ্ক (সিঙ্গেল ডিজিট) সুদে ঋণ দিতেও ব্যাংকগুলোর অনীহা রয়েছে। মূলত এসব কারণেই বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি তলানিতে চলে গেছে। বেসরকারি খাত জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে গেলে তাতে জিজিপির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা বাড়তে থাকে।
বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার প্রভাব সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘এটার তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ আমরা আগে থেকেই জানি নির্বাচনের সময়ে তেমন কোনো বিনিয়োগ হয় না। আমরা আশা করছি, নির্বাচনের সময়ে ঋণপ্রবাহ কিছুটা কম হলেও নতুন বছরের শুরুতে তা বাড়বে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ঋণ-আমানত অনুপাত কমানো এবং সুদহার কমানোর সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাংক খাতে তারল্যের (নগদ টাকা) সংকট হয়েছে। আমদানি বৃদ্ধিসহ কিছু কারণে ২০১৭ সালের মাঝামাঝি থেকে ঋণের চাহিদা ব্যাপক বাড়তে থাকে। ফলে তারল্যের ওপরও চাপ পড়ে। এক অংকের নিচে নেমে আসা ঋণের সুদহার বেড়ে দুই অংক হয়ে যায়। অনেক ব্যাংক ১০ শতাংশের বেশি সুদেও আমানত নিতে শুরু করে।
পরে ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি ব্যাংক খাতের এডিআর কমিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবি গত বছরের ২০ জুন সুদহার কমানোর বিষয়ে এক বৈঠক করে। সে খাতে তারা ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ এবং ৬ শতাংশ সুদে আমানত নেওয়ার ঘোষণা দেন। এরপর থেকে আশানুরূপ হারে আমানত পাচ্ছে না অধিকাংশ ব্যাংক। কারণ, ব্যাংকের আমানতের চেয়ে বেশি সুদ পাওয়া যাচ্ছে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে। ফলে মানুষ ব্যাংকের রাখা আমানত তুলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকছে। অবশ্য সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সমঝোতায় সরকারি অর্থ যাতে বেসরকারি ব্যাংকগুলো পায় সেজন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। সে অনুযায়ী নগদ অর্থও পেয়েছে ব্যাংকগুলো।
বর্তমানে যেসব ব্যাংকের এডিআর নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ওপরে রয়েছে, নানা উপায়ে তারা তা সমন্বয়ের চেষ্টার ফলে নতুন করে ঋণ বিতরণ করতে পারছে না। এডিআর যেন বেড়ে না যায় এ জন্য লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে থাকা ব্যাংকগুলোও সতর্কতার সঙ্গে ঋণ বিতরণ করছে। সব মিলিয়ে ব্যাপক চাপে পড়ে ব্যাংকগুলো আগের মতো আর ঋণ বাড়াতে পারছে না।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৮ সালের ৯ মাসে আল আরাফা, এনসিসি, প্রাইম, প্রিমিয়ার, পূবালী, শাহজালাল, উত্তরা, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকসহ অনেক ব্যাংকের ঋণপ্রবাহ কমে গেছে।
এ বিষয়ে ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এবিবির চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার মূল কারণ ছিল ঋণ-আমানত অনুপাত (এডি রেশিও) সমন্বয়। এটা আগামী মার্চে ৩ দশমিক ৫ করতে হবে। এছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে আমানত কমে যাওয়ায় ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। আমানত ও ঋণের সুদহার নয়-ছয় করার কারণও রয়েছে।
বাজেটে ঘোষিত সরকারের রাজস্ব নীতির সমর্থন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং কাক্সিক্ষত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি ছয় মাস অন্তর আগাম মুদ্রানীতি ঘোষণা করে থাকে। যাতে মুদ্রা ও ঋণ সরবরাহ সম্পর্কে একটি ধারণা দেওয়া হয়। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে আগামী ডিসেম্বর নাগাদ বেসরকারি খাতে ঋণ ১৬ দশমিক ৮০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
শেয়ার করুন
নিজস্ব প্রতিবেদক | ২ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০

ব্যাংকগুলোর বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে। ঋণ-আমানতের অনুপাত (এডি রেশিও) ও সুদহার কমার পাশাপাশি নির্বাচন ঘিরে বিনিয়োগে স্থবিরতাকেও ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার পেছনে কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী বছরের নভেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। ২০১৩ সালের
নভেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৭২ শতাংশ। সে হিসাবে ২০১৮ সালের নভেম্বরের ঋণপ্রবাহ পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ৮২ শতাংশে ছিল। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে ডিসেম্বর নাগাদ বেসরকারি খাতে ঋণ ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করে। নির্বাচনের সময়ের কারণে ব্যবসায়ীরাও নতুন করে বিনিয়োগে তেমন আগ্রহ দেখাননি। এক অঙ্ক (সিঙ্গেল ডিজিট) সুদে ঋণ দিতেও ব্যাংকগুলোর অনীহা রয়েছে। মূলত এসব কারণেই বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি তলানিতে চলে গেছে। বেসরকারি খাত জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে গেলে তাতে জিজিপির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা বাড়তে থাকে।
বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার প্রভাব সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘এটার তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ আমরা আগে থেকেই জানি নির্বাচনের সময়ে তেমন কোনো বিনিয়োগ হয় না। আমরা আশা করছি, নির্বাচনের সময়ে ঋণপ্রবাহ কিছুটা কম হলেও নতুন বছরের শুরুতে তা বাড়বে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ঋণ-আমানত অনুপাত কমানো এবং সুদহার কমানোর সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাংক খাতে তারল্যের (নগদ টাকা) সংকট হয়েছে। আমদানি বৃদ্ধিসহ কিছু কারণে ২০১৭ সালের মাঝামাঝি থেকে ঋণের চাহিদা ব্যাপক বাড়তে থাকে। ফলে তারল্যের ওপরও চাপ পড়ে। এক অংকের নিচে নেমে আসা ঋণের সুদহার বেড়ে দুই অংক হয়ে যায়। অনেক ব্যাংক ১০ শতাংশের বেশি সুদেও আমানত নিতে শুরু করে।
পরে ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি ব্যাংক খাতের এডিআর কমিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবি গত বছরের ২০ জুন সুদহার কমানোর বিষয়ে এক বৈঠক করে। সে খাতে তারা ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ এবং ৬ শতাংশ সুদে আমানত নেওয়ার ঘোষণা দেন। এরপর থেকে আশানুরূপ হারে আমানত পাচ্ছে না অধিকাংশ ব্যাংক। কারণ, ব্যাংকের আমানতের চেয়ে বেশি সুদ পাওয়া যাচ্ছে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে। ফলে মানুষ ব্যাংকের রাখা আমানত তুলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকছে। অবশ্য সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সমঝোতায় সরকারি অর্থ যাতে বেসরকারি ব্যাংকগুলো পায় সেজন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। সে অনুযায়ী নগদ অর্থও পেয়েছে ব্যাংকগুলো।
বর্তমানে যেসব ব্যাংকের এডিআর নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ওপরে রয়েছে, নানা উপায়ে তারা তা সমন্বয়ের চেষ্টার ফলে নতুন করে ঋণ বিতরণ করতে পারছে না। এডিআর যেন বেড়ে না যায় এ জন্য লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে থাকা ব্যাংকগুলোও সতর্কতার সঙ্গে ঋণ বিতরণ করছে। সব মিলিয়ে ব্যাপক চাপে পড়ে ব্যাংকগুলো আগের মতো আর ঋণ বাড়াতে পারছে না।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৮ সালের ৯ মাসে আল আরাফা, এনসিসি, প্রাইম, প্রিমিয়ার, পূবালী, শাহজালাল, উত্তরা, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকসহ অনেক ব্যাংকের ঋণপ্রবাহ কমে গেছে।
এ বিষয়ে ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এবিবির চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার মূল কারণ ছিল ঋণ-আমানত অনুপাত (এডি রেশিও) সমন্বয়। এটা আগামী মার্চে ৩ দশমিক ৫ করতে হবে। এছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে আমানত কমে যাওয়ায় ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। আমানত ও ঋণের সুদহার নয়-ছয় করার কারণও রয়েছে।
বাজেটে ঘোষিত সরকারের রাজস্ব নীতির সমর্থন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং কাক্সিক্ষত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি ছয় মাস অন্তর আগাম মুদ্রানীতি ঘোষণা করে থাকে। যাতে মুদ্রা ও ঋণ সরবরাহ সম্পর্কে একটি ধারণা দেওয়া হয়। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে আগামী ডিসেম্বর নাগাদ বেসরকারি খাতে ঋণ ১৬ দশমিক ৮০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।