চামড়া কারসাজি
| ১৫ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০
সারা দেশে কোরবানির পশুর চামড়ার যৌক্তিক দাম না পেয়ে ক্ষুব্ধ খুচরা চামড়া বিক্রেতারা রাস্তায়, নদীতে ফেলে ও মাটিতে পুঁতে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। মৌসুমি ও খুচরা চামড়া ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, ট্যানারি মালিক ও কাঁচা চামড়ার ক্রেতা বড় ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণেই ধস নেমেছে এই বাজারে। তিন বছর আগে ঈদুল আজহার সময় পশুর চামড়া নিয়ে সিন্ডিকেটের কারসাজি শুরু হয় এবং চামড়ার দাম কমতে শুরু করে। এর মধ্যে এ বছর স্মরণকালের সর্বনিম্ন দরে চামড়া বিক্রি হচ্ছে। এ নিয়ে বিপাকে খুচরা চামড়া ব্যবসায়ীরা। একটি গরুর চামড়া ৫০ থেকে ৫০০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। বিগত বছরগুলোর তুলনায় যা চার ভাগের এক ভাগ। আর ছাগলের চামড়া বিক্রি হচ্ছে ৫ টাকায়ও।
এদিকে খুচরা ব্যবসায়ীরা এর চেয়ে দ্বিগুণ দামে চামড়া কিনে বেকায়দায় পড়েছেন। তাই তারা নামমাত্র মূল্যে চামড়া বিক্রি না করে এগুলো যেখানে-সেখানে ফেলে দিচ্ছেন। বড় ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙতে তারা সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন। মূলত ঈদের দিন বিকেল থেকেই চামড়ার দাম পড়ে গেলে ‘সিন্ডিকেটের কারসাজির’ অভিযোগ তোলেন চামড়ার খুচরা ব্যবসায়ীরা।
গতকাল বুধবার চামড়ার সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘চামড়া শিল্পের সঙ্গে কোনো সিন্ডিকেট জড়িত থাকলে আমরা তা খতিয়ে দেখব। সিন্ডিকেটের কারণে চামড়া শিল্পের কোনো সমস্যা হলে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ চামড়ার দাম কমে যাওয়ার পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজি আছে বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। রংপুরের শালবন এলাকায় গতকাল নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের কাছে এই মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, ‘ঈদের আগে ট্যানারি মালিক ও চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলো, তার কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।’ এ কারণেই সরকার কাঁচা চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে আগামী ১৭ আগস্ট শনিবার থেকে কাঁচা চামড়া কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন। এর আগে গতকাল সকালে সংবাদ সম্মেলন করে ২০ অগাস্ট থেকে চামড়া কেনা শুরু করবেন বলে জানিয়েছিলেন ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. শাহিন আহমেদ।
এদিকে গত মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাঁচা চামড়া রপ্তানির অনুমতি প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সরকার। নির্ধারিত মূল্যে কোরবানির পশুর চামড়া কেনাবেচা না হওয়ার তথ্য তুলে ধরে চামড়া ব্যবসায়ীদের দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানানো হয় বিবৃতিতে।
সরকারের নেওয়া এই সিদ্ধান্তকে কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীরা স্বাগত জানালেও কাঁচা চামড়া রপ্তানির সুযোগ দিলে দেশের চামড়া শিল্প ‘হুমকির মুখে পড়বে’ বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন। গতকাল রাজধানীর ধানমণ্ডিতে সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানান সংগঠনটির নেতারা। সভাপতি মো. শাহিন আহমেদ বলেন, ‘কাঁচা চামড়া রপ্তানি করা হলে চামড়া শিল্প নগরীতে ৭ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়বে। সাভারের আধুনিক চামড়া শিল্প নগরী তখন কাঁচামালের অভাবে অকেজো হয়ে পড়বে। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিস্তর জনগোষ্ঠী বেকার হয়ে যাবে।’
ঈদের দিন গত সোমবার বিকেল থেকে রাজধানীর কাঁচা চামড়ার আড়ত লালবাগের পোস্তায় আসতে থাকে কোরবানির পশুর চামড়া। ট্রাকে ট্রাকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চামড়া নিয়ে পোস্তার রাস্তার দুই পাশে সারি সারি স্তূপ করে রাখেন মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা। স্তূপ থেকে কিনে আড়তে চামড়ায় লবণ দিয়ে মজুদ শুরু করা হয়। ওই সময় শ্রমিকদের ব্যস্ততা বাড়ে আড়তগুলোতে। চামড়া সংগ্রহ ও লবণ ছিটিয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণে তখন দম ফেলার সময় থাকে না আড়তদার এবং কর্মচারীদের। তবে গত মঙ্গলবার পোস্তায় কর্মচারীদের কিছুটা ব্যস্ত সময় কাটাতে দেখা গেলেও বুধবার ছিল অনেকটা নীরব। পোস্তায় অনেকে দাম না পেয়ে রাস্তায় ফেলে দিয়ে যায় চামড়া। পরে সিটি করপোরেশনের গাড়ি এসে রাস্তা থেকে এগুলো তুলে নিয়ে যায়।
কাঁচা চামড়ার আড়ত ঘুরে দেখা যায়, প্রতি গরুর চামড়া ৫০ টাকা থেকে আকৃতিভেদে ৫০০ টাকা এবং ছাগলের চামড়া ১৫ থেকে ২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী বলেন, চামড়ার বাজারে সর্বশ্রেষ্ঠ ধস। এরকম বাজার আগে কখনো ছিল না। ১৯৮০ সালে চামড়ার দাম ছিল ২০০ টাকা এখন ২০১৯ সালেও ২০০ টাকা। এ রকম বাজে পরিস্থিতি আগে কখনো তৈরি হয়নি। সরকারের কাঁচা চামড়ার রপ্তানির সিদ্ধান্ত উপকারে আসবে না।
কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী বাবুল বলেন, ‘সরকার কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের দিকে নজর দেয় না। ট্যানারি অ্যালাগো লোন দিয়া রাখে তারা আমগো পয়সা ফেরত দেয় না মাল কিমনু কেমনে। আবার গত বছরের মাল রইয়া গেছে। চোখের সামনে অনেকে দাম না পাইয়া চামড়া ফালাইয়া দিছে। ফড়িয়াগো দিকে তো আমরাও তাকাইতে পারি না। পানির দামে চলছে চামড়া।’ কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ট্যানারি থেকে টাকা দেয়নি, যার ফলে এই সমস্যা হয়েছে। বাজারের এই অধঃপতনের পেছনে তারা দায়ী। আমাদের টাকা না দিলে আমরা চামড়া কিনব কী করে?’
কাঁচা চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বলেন, ‘আমরা মনে করি, সরকারের এই সিদ্ধান্ত সাময়িক। আমরা সরকার ও জনগণকে আশ্বস্ত করে বলতে চাই, আমরা সরকার নির্ধারিত দামেই লবণ দেওয়া চামড়া কেনা শুরু করব। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের বলব, আপনারা লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করুন।’
ট্যানারিগুলোর কাছে ৩০০ কোটি টাকা বকেয়া থাকার যে অভিযোগ পাইকাররা করছে, তা অস্বীকার করে শাহিন বলেন, ‘আড়তদাররা বকেয়া টাকা না পাওয়ার কথা বলে প্রান্তিক মানুষের কাছ থেকে কম দামে চামড়া কিনেছে। বড় আড়তদাররা এবার চামড়ার বাজারটাকে ম্যানুপুলেট করেছে।’
এ বিষয়ে কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ট্যানারি সাভারে স্থানান্তর করায় তাদের কাছে পুঁজি নাই। তাই তারা আবোল-তাবোল বকছে। আমরা টাকা পাই না পাই তা তো আমাদের কাছে প্রমাণ আছে। চামড়ার অধঃপতনের নাটকের জন্ম দিয়েছে তারা। কাঁচা চামড়া রপ্তানি হলে চামড়া শিল্পের জন্য সমস্যা হবে।’
সারা দেশ থেকে চামড়ার বাজার সম্পর্কে দেশ রূপান্তরের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :
এক লাখ চামড়া ফেলা হলো চসিকের ভাগাড়ে : চামড়ার অস্বাভাবিক দরপতনে চামড়াগুলোর ঠিকানা হয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ভাগাড়ে। এবার কোরবানির ঈদের পর এমন চিত্রই দেখা গেছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায়। আকাশ থেকে কালো মেঘ ভেঙে নেমে আসা বৃষ্টি আর মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের চোখের পানি একাকার হয়ে মিশেছে নগরীর পথে-ঘাটে।
চলতি বছর সরকার ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। আর চট্টগ্রামের আড়তদাররা এ বছর প্রায় সাড়ে ৫ লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার কথা জানিয়ে রেখেছিল আগেই। সরকার কর্র্তৃক নির্ধারিত দাম ও আড়তদারদের লক্ষ্যমাত্রা মাথায় রেখেই এবারও চামড়া সংগ্রহে মাঠে নেমেছিল মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এসব চামড়া নিয়ে আড়তদারদের কাছে পৌঁছার পর মাথায় হাত পড়ে তাদের। গড়ে প্রতি পিস চামড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা দিয়ে কিনে গাড়ি ভাড়া করে আড়তে নেওয়ার পর নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করতে হয়েছে অনেককে। আবার অনেকে প্রতিবাদ হিসেবে নিজের কেনা চামড়া রাস্তায় ফেলে দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঈদের দিন রাত ১০টা পর্যন্ত প্রতি পিস চামড়া ২০০ থেকে ৩০০ টাকা দামে কিনেছে আড়তদাররা। কিন্তু পরদিন সকাল থেকে তারা একযোগে দাম কমিয়ে দেয়। এদিন মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতি পিস গরুর চামড়ার জন্য ৫০ টাকার বেশি দিতে রাজি হয়নি তারা। এতে চামড়ার কেনা দাম নয়, চামড়া বহন করে আনার গাড়ি ভাড়াটাও হচ্ছিল না। দীর্ঘদিনের চেনা আড়তদারদের এমন ব্যবহারে অনেকটা অসহায় আর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে তারা। পচনশীল হওয়ায় এবং দুর্গন্ধ ছড়ানোর কারণে এই চামড়া নিজেদের কাছে রাখারও কোনো সুযোগ নেই মৌসুমি ব্যবসায়ীদের। শেষ পর্যন্ত বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়ে তারা। কেউ কেউ আড়তদারদের কাছে পানির দামে চামড়া দিয়ে দিলেও অনেকেই রাগে-ক্ষোভে-অভিমানে রাস্তায় ফেলে দেয় নিজেদের পকেটের টাকায় কেনা এসব চামড়া।
নগরীর হালিশহর ধোপার দীঘির পাড় এলাকার মৌসুমি ব্যবসায়ী নঈমুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঈদের আগেই একজন আড়তদারের সঙ্গে প্রতি পিস ৪০০ টাকা দরে চামড়া কেনার মৌখিক চুক্তি হয়েছিল। সেই হিসাবে ৩০০ চামড়া সংগ্রহ করে ওই আড়তে যাওয়ার পর আড়তদার চামড়া প্রতি ২৫০ টাকার বেশি দিতে রাজি হয়নি। এর ফলে লোকসান দিয়েই ওই দামে আড়তদারকে চামড়া দিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
তবে সরকার নির্ধারিত মূল্যে চামড়া কেনার ক্ষেত্রে অনীহার কারণ হিসেবে নিজেদের আর্থিক সংকটের বিষয়টি তুলে ধরলেন বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমিতির সভাপতি আবদুল কাদের। দেশ রূপান্তরের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, আমাদের সমিতিতে ১১২ জন সদস্য থাকলেও অর্থ সংকটের কারণে এর তিন-চতুর্থাংশ আড়তদারই এবার চামড়া কিনতে পারছেন না। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে এখন একটি মাত্র ট্যানারি রয়েছে। যে কারণে আমাদের ব্যবসা ঢাকার ট্যানারিগুলোর ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। কিন্তু ঢাকার ট্যানারি মালিকরা বিগত বছরগুলোতে চামড়া নিয়ে যথাসময়ে দাম পরিশোধ করেনি। বর্তমানে তাদের কাছে চট্টগ্রামের আড়তদারদের বকেয়া পাওনা রয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। বারবার ধরনা দিয়েও এই টাকা না পাওয়ার কারণে অনেকে নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে।
এদিকে এবার কোরবানির বর্জ্য সরানোর ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ওপর বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়ায় মৌসুমি ব্যবসায়ীদের ফেলে দেওয়া চামড়া। নগরীর আগ্রাবাদ চৌমুহনী, বহদ্দার হাট, মুরাদপুর, বিবিরহাট ও আতুরার ডিপো এলাকা থেকে মঙ্গলবার বিকেলে চামড়া পরিষ্কার করতে দেখা যায় সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের।
চসিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মনিটরিং টিমের আঞ্চলিক প্রধান পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোবারক আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, অন্যবার কোরবানির গরুর নাড়িভুঁড়ি, রক্ত এসব পরিষ্কারের মধ্যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ সীমাবদ্ধ থাকত। এবার বাড়তি ঝামেলা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ব্যবসায়ীদের ফেলে যাওয়া চামড়া। তিনি বলেন, দাম কম থাকায় বিক্রি না করে কোনো ধরনের প্রক্রিয়াজাত ছাড়াই রেখে দেওয়ার কারণে প্রায় এক লাখ চামড়া এবার নষ্ট হয়েছে। রাস্তায় পড়ে থাকা এসব চামড়া থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে থাকায় সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এসব চামড়া বায়েজীদের আরেফিন নগর এলাকায় আবর্জনার ভাগাড়ে নিয়ে গর্ত খুঁড়ে মাটি চাপা দেওয়া হচ্ছে।
কুমিল্লায় ন্যায্যমূল্য না পেয়ে গোমতী নদীতে চামড়া : কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কুমিল্লার গোমতী নদীতে চামড়া ফেলে দিয়েছে স্থানীয় খুচরা ক্রেতারা। অনেক স্থানে চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে। সারা দেশের মতো কুমিল্লায়ও চামড়া বাজারে ধস নেমেছে। স্থানীয় সবচেয়ে বড় চামড়া বাজার নগরীর ঋষি পট্টিতে কমে গেছে বেচাকেনা। পাড়া-মহল্লা থেকে চামড়া সংগ্রহ করে বিক্রি করতে পারেনি অনেকেই। দাম নেই কোথাও।
খুলনায় কোরবানির চামড়া বিক্রয় নিয়ে ক্ষুব্ধ বিক্রেতারা : খুলনায় পশুর চামড়া বিক্রি করতে এসে অনেক বিক্রেতাকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। চামড়া বিক্রেতাদের অভিযোগ, চামড়া সংগ্রহের জন্য পরিশ্রম ও পরিবহন ভাড়াও উঠছে না। একটি গরুর চামড়া ১০০ থেকে ১২০ টাকা। ছাগলের চামড়া প্রতি ৫-১০ টাকা আবার কোথায় ২৫-৩৫ টাকা। ছাগলের চামড়ার সঠিক মূল্য না পেয়ে অনেকেই ছাগলের চামড়া নদীতে ফেলে দিয়েছে।
নগরীর জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন মাদানী নগর মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মাওলানা মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘মাদ্রাসার ইয়াতিম খানা ও লিল্লাহ বোডিংয়ের পরিচালনার জন্য কোরবানির পশুর চামড়া একটি অন্যতম বড় মাধ্যম। এ চামড়া বিক্রির অর্থে এতিম ছাত্রদের বছরের বেশিরভাগ সময়ের খাবারের সংস্থান হয়। ছয়টি গরুর ও সাতটি ছাগলের চামড়ার দাম দিয়েছে মাত্র ৮০০ টাকা। এতে চামড়া সংগ্রহের জন্য পরিশ্রম এবং বহনের জন্য রিকশা ভাড়াও ওঠেনি।’
নগরীর লবণচরার আহমদিয়া এতিমখানা ও মাদ্রাসার শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘শেখপাড়া বাজারে চামড়ার দাম নেই। এখানে গরুর পাঁচটি ও ছাগলের একটি চামড়া নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু ছয়টি চামড়ায় মাত্র ৪৫০ টাকা দিয়েছে। যাতে রিকশা ভাড়াও ওঠে না।’
ফুলতলার সুপার ট্যানারির পরিচালক ফিরোজ ভূঁইয়া বলেন, আমরা চেষ্টা করি চামড়ার যথাযথ দাম পরিশোধ করতে। এখানে চামড়া দিয়ে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, নড়াইল, যশোর ও মাগুরার মাদ্রাসা থেকে চামড়া এখানে চলে আসছে। চামড়ার দামও ১০-১৫ দিনের মধ্যে পরিশোধ করা হবে। এখানে মাদ্রাসা থেকে চামড়া আসার পর তা প্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে।
স্মরণকালের সর্বনিম্ন দামে চামড়া বিক্রি বগুড়ায় : স্মরণকালের মধ্যে সর্বনিম্ন দামে কোরবানির চামড়া কেনাবেচা হয়েছে বগুড়ায়। চামড়া বিক্রির টাকায় রিকশা-ভ্যান ভাড়ার টাকাই তুলতে পারেনি অনেকে। চামড়া বাজারে এমন ধস দেখে ক্ষুব্ধ বিক্রেতারা। শুধু যে কোরবানিদাতারাই চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়েছে তা নয়, মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও চামড়া কেনার পর পাইকারি বাজারে এসে দাম পায়নি, লোকসান গুনতে হয়েছে। মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী আবদুল খালেক জানান, গত বছর মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অনেকেই আসল টাকা তুলতে পারেনি। এ কারণে অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ীই এবার চামড়া কেনার ঝুঁকি নেয়নি। এবারও লোকসান দিয়ে চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে তাদের।
বগুড়া জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন সরকার জানান, মূলত নগদ টাকার অভাবে এবার চামড়া ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনতে পারেনি। ট্যানারিতে বছরের পর বছর টাকা পড়ে থাকলেও আড়তদাররা সেই টাকা তুলতে পারছে না, এদিকে ব্যাংক থেকেও কোনো ঋণ দেওয়া হচ্ছে না। ফলে চামড়া ব্যবসায় ধস নেমেছে।
বরিশালে গরুর চামড়া কিনতে অনীহা পাইকারদের : বরিশালের স্থানীয় পাইকারি বাজারেও চামড়ার আশাব্যঞ্জক দর পাচ্ছে না মাঠপর্যায়ের ব্যবসায়ীরা। ছাগলের চামড়া তো কিনছেই না। গরুর চামড়া কিনতেও অনীহা পাইকারদের। ফলে বরিশাল নগরের পদ্মাবতী এলাকার পাইকারি চামড়ার বাজার থেকে অনেকেই ফিরে গেছে হতাশ হয়ে। পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীদের দাবি, তাদের ট্যানারি মালিকরা একপ্রকার চামড়া সংগ্রহে নিরুৎসাহিত করছেন। গত সোম এবং মঙ্গলবার বরিশালের চামড়ার বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ছাগলের চামড়া কেউ কিনছে না। এছাড়া গরুর চামড়াও অনেক স্থানে বিনামূল্যেই দিয়ে দিচ্ছে।
বরিশাল চামড়া ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শহীদুর রহমান শাহিন বলেন, ট্যানারি মালিক বা ব্যবসায়ীদের কাছে বরিশালের চামড়া ব্যবসায়ীদের লাখ লাখ টাকা বকেয়া পাওনা রয়েছে। প্রতি বছর কোরবানির আগে কিছু টাকা ট্যানারি ব্যবসায়ীরা দিলেও এবারে খালি হাতেই ফিরিয়ে দিয়েছে। তাই নতুন করে দেনাগ্রস্ত হতে রাজি হয়নি অনেকেই। এজন্য তিনিসহ বহু ব্যবসায়ী এবার চামড়া কেনা থেকে বিরত থেকেছেন।
পাবনার ঈশ্বরদীতে নিম্ন দামে বিক্রি হচ্ছে চামড়া : গরুর চামড়া ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা এবং ছাগল-ভেড়ার চামড়া বিক্রি হয়েছে ৫ থেকে ৩০ টাকা দরে। আর মহিষের চামড়ার দাম বলেনি কেউ। গত সোমবার পবিত্র ঈদুল আজহা ও পরের দিন মঙ্গলবার এমন চিত্র ছিল ঈশ্বরদীতে। চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম বলেন, এবার আমরা চামড়া নিচ্ছি না। বাজার খুব খারাপ। পাইকারি ব্যবসায়ীরা এবার আগে থেকে সাবধান করে দিয়েছে। সরকার চামড়ার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে ঢাকার ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে চামড়ায় ত্রুটি দেখিয়ে সেই দাম দেয় না। যার কারণে এ বছর চামড়া না কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
যশোরে চামড়া কিনছে না ব্যবসায়ীরা : চামড়ার রেকর্ড পরিমাণ দরপতনে হতাশ যশোরের রাজারহাটের চামড়া ব্যবসায়ীরা। গরুর বড় চামড়া প্রতিপিস ৪০০ টাকা, ছোট চামড়া ২০০-৩০০ এবং ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে প্রতি পিস মাত্র ৩০ টাকায়। শহরের শংকরপুরের তরিকুল ইসলাম জানান, কোরবানি ঈদে তিনি কমপক্ষে আড়াই হাজার পিস গরু ও এক হাজার পিস ছাগলের চামড়া কিনে থাকেন। কিন্তু এবার টাকার অভাবে সব মিলিয়ে এক হাজার পিস চামড়া সংগ্রহ করেছেন। মঙ্গলবারের হাটে চামড়া যে দামে বিক্রি হয়েছে তা গত ২০ বছরেও দেখেননি। এভাবে চামড়ার দরপতন হলে এ খাতের ব্যবসায়ীরা পেশাবদল করতে বাধ্য হবে।
নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডে চামড়ার স্তূপ : ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের পাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এনে চামড়া ফেলে রেখে গেছে ব্যবসায়ীরা। দুদিন ধরে চামড়ায় এই অবস্থায় মানুষ দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। স্থানীয় এলাকাবাসী ও এ পথে চলাচল করা সাধারণ মানুষসহ সবাই এ অবস্থায় দ্রুত যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা মাসুদুর রহমান দেশ রূপান্তরকে জানান, এভাবে ময়লা-আবর্জনার সঙ্গে চামড়াগুলো ফেলা ঠিক হয়নি। দুর্গন্ধে টেকা যায় না এদিকে। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদা বারিক দেশ রূপান্তরকে জানান, আমার কাছে আরও কয়েকজন অভিযোগ করেছে। আমি সংবাদটি পেয়েছি। এটা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মধ্যে। তবুও আমি যাব নিজের কিছু কাজ শেষ করেই। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) প্রধান নির্বাহী (সিইও) এহতেশামুল হক দেশ রূপান্তরকে জানান, এটি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের বাইরে ইউনিয়ন পরিষদের অধীনের জায়গায়। আমি দায়িত্ব নিয়েই বলছি, আমার সিটি করপোরেশনের মধ্যে কোনো আবর্জনা নেই, থাকলে আমাকে জানান, আমরা সঙ্গে সঙ্গেই তা পরিষ্কার করে দেব।
রংপুরে চামড়া নিয়ে লোকসানে মৌসুমি ব্যাবসায়ীরা : চামড়া নিয়ে চরম লোকসানে পড়েছে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। এদিকে ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে বকেয়া টাকা না পাওয়ায় চামড়া কিনতে আড়তদাররা খুব একটা আগ্রহী নয়। তারা ধারদেনা করে চামড়া কিনছে।
চামড়ার দাম কমার পেছনে ব্যবসায়ীরা : বাণিজ্যমন্ত্রী
কোরবানির পশুর চামড়ার দাম কমার পেছনে ব্যবসায়ীদের দুষলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। গতকাল রংপুরের শালবন এলাকায় নিজ বাসভবনে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, দাম কমে যাওয়ার পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজি রয়েছে। চামড়া নিয়ে যখনই ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করি, তখনই তার বিরুদ্ধাচরণ করা হচ্ছে। তাই তাৎক্ষণিকভাবে কাঁচা চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ঈদের আগে ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলো, তার কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। চামড়ার দাম একেবারেই কমে গেছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণেই সরকার কাঁচা চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চামড়া রপ্তানির সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা বলেছেন। আজ (বুধবার) তারা বৈঠক ডেকেছেন। তাদের সিদ্ধান্ত দেখে সরকার পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। কোনোভাবেই চামড়াশিল্পকে ধ্বংস করতে দেওয়া যাবে না।
সরকার গরিবদের হক মারছে বিএনপির এমন মন্তব্যের ব্যাপারে মন্ত্রী বলেন, সমালোচনা করাই হচ্ছে বিএনপির কাজ। ভালো কাজ কখনোই তাদের চোখে পড়ে না।
তিনি আরও বলেন, মূলত কোরবানির চামড়া মসজিদ-মাদ্রাসায় দান করা হয়। সেই চামড়া অনেক কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ে ব্যবসায়ীরা লবণ দিয়ে এটা সংরক্ষণ করতে পারলে রপ্তানি করে ভালো দাম পাওয়া যাবে।
শেয়ার করুন
| ১৫ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০

সারা দেশে কোরবানির পশুর চামড়ার যৌক্তিক দাম না পেয়ে ক্ষুব্ধ খুচরা চামড়া বিক্রেতারা রাস্তায়, নদীতে ফেলে ও মাটিতে পুঁতে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। মৌসুমি ও খুচরা চামড়া ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, ট্যানারি মালিক ও কাঁচা চামড়ার ক্রেতা বড় ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণেই ধস নেমেছে এই বাজারে। তিন বছর আগে ঈদুল আজহার সময় পশুর চামড়া নিয়ে সিন্ডিকেটের কারসাজি শুরু হয় এবং চামড়ার দাম কমতে শুরু করে। এর মধ্যে এ বছর স্মরণকালের সর্বনিম্ন দরে চামড়া বিক্রি হচ্ছে। এ নিয়ে বিপাকে খুচরা চামড়া ব্যবসায়ীরা। একটি গরুর চামড়া ৫০ থেকে ৫০০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। বিগত বছরগুলোর তুলনায় যা চার ভাগের এক ভাগ। আর ছাগলের চামড়া বিক্রি হচ্ছে ৫ টাকায়ও।
এদিকে খুচরা ব্যবসায়ীরা এর চেয়ে দ্বিগুণ দামে চামড়া কিনে বেকায়দায় পড়েছেন। তাই তারা নামমাত্র মূল্যে চামড়া বিক্রি না করে এগুলো যেখানে-সেখানে ফেলে দিচ্ছেন। বড় ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙতে তারা সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন। মূলত ঈদের দিন বিকেল থেকেই চামড়ার দাম পড়ে গেলে ‘সিন্ডিকেটের কারসাজির’ অভিযোগ তোলেন চামড়ার খুচরা ব্যবসায়ীরা।
গতকাল বুধবার চামড়ার সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘চামড়া শিল্পের সঙ্গে কোনো সিন্ডিকেট জড়িত থাকলে আমরা তা খতিয়ে দেখব। সিন্ডিকেটের কারণে চামড়া শিল্পের কোনো সমস্যা হলে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ চামড়ার দাম কমে যাওয়ার পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজি আছে বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। রংপুরের শালবন এলাকায় গতকাল নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের কাছে এই মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, ‘ঈদের আগে ট্যানারি মালিক ও চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলো, তার কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।’ এ কারণেই সরকার কাঁচা চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে আগামী ১৭ আগস্ট শনিবার থেকে কাঁচা চামড়া কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন। এর আগে গতকাল সকালে সংবাদ সম্মেলন করে ২০ অগাস্ট থেকে চামড়া কেনা শুরু করবেন বলে জানিয়েছিলেন ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. শাহিন আহমেদ।
এদিকে গত মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাঁচা চামড়া রপ্তানির অনুমতি প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সরকার। নির্ধারিত মূল্যে কোরবানির পশুর চামড়া কেনাবেচা না হওয়ার তথ্য তুলে ধরে চামড়া ব্যবসায়ীদের দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানানো হয় বিবৃতিতে।
সরকারের নেওয়া এই সিদ্ধান্তকে কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীরা স্বাগত জানালেও কাঁচা চামড়া রপ্তানির সুযোগ দিলে দেশের চামড়া শিল্প ‘হুমকির মুখে পড়বে’ বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন। গতকাল রাজধানীর ধানমণ্ডিতে সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানান সংগঠনটির নেতারা। সভাপতি মো. শাহিন আহমেদ বলেন, ‘কাঁচা চামড়া রপ্তানি করা হলে চামড়া শিল্প নগরীতে ৭ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়বে। সাভারের আধুনিক চামড়া শিল্প নগরী তখন কাঁচামালের অভাবে অকেজো হয়ে পড়বে। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিস্তর জনগোষ্ঠী বেকার হয়ে যাবে।’
ঈদের দিন গত সোমবার বিকেল থেকে রাজধানীর কাঁচা চামড়ার আড়ত লালবাগের পোস্তায় আসতে থাকে কোরবানির পশুর চামড়া। ট্রাকে ট্রাকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চামড়া নিয়ে পোস্তার রাস্তার দুই পাশে সারি সারি স্তূপ করে রাখেন মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা। স্তূপ থেকে কিনে আড়তে চামড়ায় লবণ দিয়ে মজুদ শুরু করা হয়। ওই সময় শ্রমিকদের ব্যস্ততা বাড়ে আড়তগুলোতে। চামড়া সংগ্রহ ও লবণ ছিটিয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণে তখন দম ফেলার সময় থাকে না আড়তদার এবং কর্মচারীদের। তবে গত মঙ্গলবার পোস্তায় কর্মচারীদের কিছুটা ব্যস্ত সময় কাটাতে দেখা গেলেও বুধবার ছিল অনেকটা নীরব। পোস্তায় অনেকে দাম না পেয়ে রাস্তায় ফেলে দিয়ে যায় চামড়া। পরে সিটি করপোরেশনের গাড়ি এসে রাস্তা থেকে এগুলো তুলে নিয়ে যায়।
কাঁচা চামড়ার আড়ত ঘুরে দেখা যায়, প্রতি গরুর চামড়া ৫০ টাকা থেকে আকৃতিভেদে ৫০০ টাকা এবং ছাগলের চামড়া ১৫ থেকে ২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী বলেন, চামড়ার বাজারে সর্বশ্রেষ্ঠ ধস। এরকম বাজার আগে কখনো ছিল না। ১৯৮০ সালে চামড়ার দাম ছিল ২০০ টাকা এখন ২০১৯ সালেও ২০০ টাকা। এ রকম বাজে পরিস্থিতি আগে কখনো তৈরি হয়নি। সরকারের কাঁচা চামড়ার রপ্তানির সিদ্ধান্ত উপকারে আসবে না।
কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী বাবুল বলেন, ‘সরকার কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের দিকে নজর দেয় না। ট্যানারি অ্যালাগো লোন দিয়া রাখে তারা আমগো পয়সা ফেরত দেয় না মাল কিমনু কেমনে। আবার গত বছরের মাল রইয়া গেছে। চোখের সামনে অনেকে দাম না পাইয়া চামড়া ফালাইয়া দিছে। ফড়িয়াগো দিকে তো আমরাও তাকাইতে পারি না। পানির দামে চলছে চামড়া।’ কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ট্যানারি থেকে টাকা দেয়নি, যার ফলে এই সমস্যা হয়েছে। বাজারের এই অধঃপতনের পেছনে তারা দায়ী। আমাদের টাকা না দিলে আমরা চামড়া কিনব কী করে?’
কাঁচা চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বলেন, ‘আমরা মনে করি, সরকারের এই সিদ্ধান্ত সাময়িক। আমরা সরকার ও জনগণকে আশ্বস্ত করে বলতে চাই, আমরা সরকার নির্ধারিত দামেই লবণ দেওয়া চামড়া কেনা শুরু করব। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের বলব, আপনারা লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করুন।’
ট্যানারিগুলোর কাছে ৩০০ কোটি টাকা বকেয়া থাকার যে অভিযোগ পাইকাররা করছে, তা অস্বীকার করে শাহিন বলেন, ‘আড়তদাররা বকেয়া টাকা না পাওয়ার কথা বলে প্রান্তিক মানুষের কাছ থেকে কম দামে চামড়া কিনেছে। বড় আড়তদাররা এবার চামড়ার বাজারটাকে ম্যানুপুলেট করেছে।’
এ বিষয়ে কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ট্যানারি সাভারে স্থানান্তর করায় তাদের কাছে পুঁজি নাই। তাই তারা আবোল-তাবোল বকছে। আমরা টাকা পাই না পাই তা তো আমাদের কাছে প্রমাণ আছে। চামড়ার অধঃপতনের নাটকের জন্ম দিয়েছে তারা। কাঁচা চামড়া রপ্তানি হলে চামড়া শিল্পের জন্য সমস্যা হবে।’
সারা দেশ থেকে চামড়ার বাজার সম্পর্কে দেশ রূপান্তরের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :
এক লাখ চামড়া ফেলা হলো চসিকের ভাগাড়ে : চামড়ার অস্বাভাবিক দরপতনে চামড়াগুলোর ঠিকানা হয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ভাগাড়ে। এবার কোরবানির ঈদের পর এমন চিত্রই দেখা গেছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায়। আকাশ থেকে কালো মেঘ ভেঙে নেমে আসা বৃষ্টি আর মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের চোখের পানি একাকার হয়ে মিশেছে নগরীর পথে-ঘাটে।
চলতি বছর সরকার ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। আর চট্টগ্রামের আড়তদাররা এ বছর প্রায় সাড়ে ৫ লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার কথা জানিয়ে রেখেছিল আগেই। সরকার কর্র্তৃক নির্ধারিত দাম ও আড়তদারদের লক্ষ্যমাত্রা মাথায় রেখেই এবারও চামড়া সংগ্রহে মাঠে নেমেছিল মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এসব চামড়া নিয়ে আড়তদারদের কাছে পৌঁছার পর মাথায় হাত পড়ে তাদের। গড়ে প্রতি পিস চামড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা দিয়ে কিনে গাড়ি ভাড়া করে আড়তে নেওয়ার পর নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করতে হয়েছে অনেককে। আবার অনেকে প্রতিবাদ হিসেবে নিজের কেনা চামড়া রাস্তায় ফেলে দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঈদের দিন রাত ১০টা পর্যন্ত প্রতি পিস চামড়া ২০০ থেকে ৩০০ টাকা দামে কিনেছে আড়তদাররা। কিন্তু পরদিন সকাল থেকে তারা একযোগে দাম কমিয়ে দেয়। এদিন মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতি পিস গরুর চামড়ার জন্য ৫০ টাকার বেশি দিতে রাজি হয়নি তারা। এতে চামড়ার কেনা দাম নয়, চামড়া বহন করে আনার গাড়ি ভাড়াটাও হচ্ছিল না। দীর্ঘদিনের চেনা আড়তদারদের এমন ব্যবহারে অনেকটা অসহায় আর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে তারা। পচনশীল হওয়ায় এবং দুর্গন্ধ ছড়ানোর কারণে এই চামড়া নিজেদের কাছে রাখারও কোনো সুযোগ নেই মৌসুমি ব্যবসায়ীদের। শেষ পর্যন্ত বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়ে তারা। কেউ কেউ আড়তদারদের কাছে পানির দামে চামড়া দিয়ে দিলেও অনেকেই রাগে-ক্ষোভে-অভিমানে রাস্তায় ফেলে দেয় নিজেদের পকেটের টাকায় কেনা এসব চামড়া।
নগরীর হালিশহর ধোপার দীঘির পাড় এলাকার মৌসুমি ব্যবসায়ী নঈমুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঈদের আগেই একজন আড়তদারের সঙ্গে প্রতি পিস ৪০০ টাকা দরে চামড়া কেনার মৌখিক চুক্তি হয়েছিল। সেই হিসাবে ৩০০ চামড়া সংগ্রহ করে ওই আড়তে যাওয়ার পর আড়তদার চামড়া প্রতি ২৫০ টাকার বেশি দিতে রাজি হয়নি। এর ফলে লোকসান দিয়েই ওই দামে আড়তদারকে চামড়া দিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
তবে সরকার নির্ধারিত মূল্যে চামড়া কেনার ক্ষেত্রে অনীহার কারণ হিসেবে নিজেদের আর্থিক সংকটের বিষয়টি তুলে ধরলেন বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমিতির সভাপতি আবদুল কাদের। দেশ রূপান্তরের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, আমাদের সমিতিতে ১১২ জন সদস্য থাকলেও অর্থ সংকটের কারণে এর তিন-চতুর্থাংশ আড়তদারই এবার চামড়া কিনতে পারছেন না। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে এখন একটি মাত্র ট্যানারি রয়েছে। যে কারণে আমাদের ব্যবসা ঢাকার ট্যানারিগুলোর ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। কিন্তু ঢাকার ট্যানারি মালিকরা বিগত বছরগুলোতে চামড়া নিয়ে যথাসময়ে দাম পরিশোধ করেনি। বর্তমানে তাদের কাছে চট্টগ্রামের আড়তদারদের বকেয়া পাওনা রয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। বারবার ধরনা দিয়েও এই টাকা না পাওয়ার কারণে অনেকে নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে।
এদিকে এবার কোরবানির বর্জ্য সরানোর ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ওপর বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়ায় মৌসুমি ব্যবসায়ীদের ফেলে দেওয়া চামড়া। নগরীর আগ্রাবাদ চৌমুহনী, বহদ্দার হাট, মুরাদপুর, বিবিরহাট ও আতুরার ডিপো এলাকা থেকে মঙ্গলবার বিকেলে চামড়া পরিষ্কার করতে দেখা যায় সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের।
চসিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মনিটরিং টিমের আঞ্চলিক প্রধান পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোবারক আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, অন্যবার কোরবানির গরুর নাড়িভুঁড়ি, রক্ত এসব পরিষ্কারের মধ্যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ সীমাবদ্ধ থাকত। এবার বাড়তি ঝামেলা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ব্যবসায়ীদের ফেলে যাওয়া চামড়া। তিনি বলেন, দাম কম থাকায় বিক্রি না করে কোনো ধরনের প্রক্রিয়াজাত ছাড়াই রেখে দেওয়ার কারণে প্রায় এক লাখ চামড়া এবার নষ্ট হয়েছে। রাস্তায় পড়ে থাকা এসব চামড়া থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে থাকায় সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এসব চামড়া বায়েজীদের আরেফিন নগর এলাকায় আবর্জনার ভাগাড়ে নিয়ে গর্ত খুঁড়ে মাটি চাপা দেওয়া হচ্ছে।
কুমিল্লায় ন্যায্যমূল্য না পেয়ে গোমতী নদীতে চামড়া : কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কুমিল্লার গোমতী নদীতে চামড়া ফেলে দিয়েছে স্থানীয় খুচরা ক্রেতারা। অনেক স্থানে চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে। সারা দেশের মতো কুমিল্লায়ও চামড়া বাজারে ধস নেমেছে। স্থানীয় সবচেয়ে বড় চামড়া বাজার নগরীর ঋষি পট্টিতে কমে গেছে বেচাকেনা। পাড়া-মহল্লা থেকে চামড়া সংগ্রহ করে বিক্রি করতে পারেনি অনেকেই। দাম নেই কোথাও।
খুলনায় কোরবানির চামড়া বিক্রয় নিয়ে ক্ষুব্ধ বিক্রেতারা : খুলনায় পশুর চামড়া বিক্রি করতে এসে অনেক বিক্রেতাকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। চামড়া বিক্রেতাদের অভিযোগ, চামড়া সংগ্রহের জন্য পরিশ্রম ও পরিবহন ভাড়াও উঠছে না। একটি গরুর চামড়া ১০০ থেকে ১২০ টাকা। ছাগলের চামড়া প্রতি ৫-১০ টাকা আবার কোথায় ২৫-৩৫ টাকা। ছাগলের চামড়ার সঠিক মূল্য না পেয়ে অনেকেই ছাগলের চামড়া নদীতে ফেলে দিয়েছে।
নগরীর জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন মাদানী নগর মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মাওলানা মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘মাদ্রাসার ইয়াতিম খানা ও লিল্লাহ বোডিংয়ের পরিচালনার জন্য কোরবানির পশুর চামড়া একটি অন্যতম বড় মাধ্যম। এ চামড়া বিক্রির অর্থে এতিম ছাত্রদের বছরের বেশিরভাগ সময়ের খাবারের সংস্থান হয়। ছয়টি গরুর ও সাতটি ছাগলের চামড়ার দাম দিয়েছে মাত্র ৮০০ টাকা। এতে চামড়া সংগ্রহের জন্য পরিশ্রম এবং বহনের জন্য রিকশা ভাড়াও ওঠেনি।’
নগরীর লবণচরার আহমদিয়া এতিমখানা ও মাদ্রাসার শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘শেখপাড়া বাজারে চামড়ার দাম নেই। এখানে গরুর পাঁচটি ও ছাগলের একটি চামড়া নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু ছয়টি চামড়ায় মাত্র ৪৫০ টাকা দিয়েছে। যাতে রিকশা ভাড়াও ওঠে না।’
ফুলতলার সুপার ট্যানারির পরিচালক ফিরোজ ভূঁইয়া বলেন, আমরা চেষ্টা করি চামড়ার যথাযথ দাম পরিশোধ করতে। এখানে চামড়া দিয়ে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, নড়াইল, যশোর ও মাগুরার মাদ্রাসা থেকে চামড়া এখানে চলে আসছে। চামড়ার দামও ১০-১৫ দিনের মধ্যে পরিশোধ করা হবে। এখানে মাদ্রাসা থেকে চামড়া আসার পর তা প্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে।
স্মরণকালের সর্বনিম্ন দামে চামড়া বিক্রি বগুড়ায় : স্মরণকালের মধ্যে সর্বনিম্ন দামে কোরবানির চামড়া কেনাবেচা হয়েছে বগুড়ায়। চামড়া বিক্রির টাকায় রিকশা-ভ্যান ভাড়ার টাকাই তুলতে পারেনি অনেকে। চামড়া বাজারে এমন ধস দেখে ক্ষুব্ধ বিক্রেতারা। শুধু যে কোরবানিদাতারাই চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়েছে তা নয়, মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও চামড়া কেনার পর পাইকারি বাজারে এসে দাম পায়নি, লোকসান গুনতে হয়েছে। মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী আবদুল খালেক জানান, গত বছর মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অনেকেই আসল টাকা তুলতে পারেনি। এ কারণে অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ীই এবার চামড়া কেনার ঝুঁকি নেয়নি। এবারও লোকসান দিয়ে চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে তাদের।
বগুড়া জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন সরকার জানান, মূলত নগদ টাকার অভাবে এবার চামড়া ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনতে পারেনি। ট্যানারিতে বছরের পর বছর টাকা পড়ে থাকলেও আড়তদাররা সেই টাকা তুলতে পারছে না, এদিকে ব্যাংক থেকেও কোনো ঋণ দেওয়া হচ্ছে না। ফলে চামড়া ব্যবসায় ধস নেমেছে।
বরিশালে গরুর চামড়া কিনতে অনীহা পাইকারদের : বরিশালের স্থানীয় পাইকারি বাজারেও চামড়ার আশাব্যঞ্জক দর পাচ্ছে না মাঠপর্যায়ের ব্যবসায়ীরা। ছাগলের চামড়া তো কিনছেই না। গরুর চামড়া কিনতেও অনীহা পাইকারদের। ফলে বরিশাল নগরের পদ্মাবতী এলাকার পাইকারি চামড়ার বাজার থেকে অনেকেই ফিরে গেছে হতাশ হয়ে। পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীদের দাবি, তাদের ট্যানারি মালিকরা একপ্রকার চামড়া সংগ্রহে নিরুৎসাহিত করছেন। গত সোম এবং মঙ্গলবার বরিশালের চামড়ার বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ছাগলের চামড়া কেউ কিনছে না। এছাড়া গরুর চামড়াও অনেক স্থানে বিনামূল্যেই দিয়ে দিচ্ছে।
বরিশাল চামড়া ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শহীদুর রহমান শাহিন বলেন, ট্যানারি মালিক বা ব্যবসায়ীদের কাছে বরিশালের চামড়া ব্যবসায়ীদের লাখ লাখ টাকা বকেয়া পাওনা রয়েছে। প্রতি বছর কোরবানির আগে কিছু টাকা ট্যানারি ব্যবসায়ীরা দিলেও এবারে খালি হাতেই ফিরিয়ে দিয়েছে। তাই নতুন করে দেনাগ্রস্ত হতে রাজি হয়নি অনেকেই। এজন্য তিনিসহ বহু ব্যবসায়ী এবার চামড়া কেনা থেকে বিরত থেকেছেন।
পাবনার ঈশ্বরদীতে নিম্ন দামে বিক্রি হচ্ছে চামড়া : গরুর চামড়া ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা এবং ছাগল-ভেড়ার চামড়া বিক্রি হয়েছে ৫ থেকে ৩০ টাকা দরে। আর মহিষের চামড়ার দাম বলেনি কেউ। গত সোমবার পবিত্র ঈদুল আজহা ও পরের দিন মঙ্গলবার এমন চিত্র ছিল ঈশ্বরদীতে। চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম বলেন, এবার আমরা চামড়া নিচ্ছি না। বাজার খুব খারাপ। পাইকারি ব্যবসায়ীরা এবার আগে থেকে সাবধান করে দিয়েছে। সরকার চামড়ার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে ঢাকার ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে চামড়ায় ত্রুটি দেখিয়ে সেই দাম দেয় না। যার কারণে এ বছর চামড়া না কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
যশোরে চামড়া কিনছে না ব্যবসায়ীরা : চামড়ার রেকর্ড পরিমাণ দরপতনে হতাশ যশোরের রাজারহাটের চামড়া ব্যবসায়ীরা। গরুর বড় চামড়া প্রতিপিস ৪০০ টাকা, ছোট চামড়া ২০০-৩০০ এবং ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে প্রতি পিস মাত্র ৩০ টাকায়। শহরের শংকরপুরের তরিকুল ইসলাম জানান, কোরবানি ঈদে তিনি কমপক্ষে আড়াই হাজার পিস গরু ও এক হাজার পিস ছাগলের চামড়া কিনে থাকেন। কিন্তু এবার টাকার অভাবে সব মিলিয়ে এক হাজার পিস চামড়া সংগ্রহ করেছেন। মঙ্গলবারের হাটে চামড়া যে দামে বিক্রি হয়েছে তা গত ২০ বছরেও দেখেননি। এভাবে চামড়ার দরপতন হলে এ খাতের ব্যবসায়ীরা পেশাবদল করতে বাধ্য হবে।
নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডে চামড়ার স্তূপ : ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের পাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এনে চামড়া ফেলে রেখে গেছে ব্যবসায়ীরা। দুদিন ধরে চামড়ায় এই অবস্থায় মানুষ দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। স্থানীয় এলাকাবাসী ও এ পথে চলাচল করা সাধারণ মানুষসহ সবাই এ অবস্থায় দ্রুত যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা মাসুদুর রহমান দেশ রূপান্তরকে জানান, এভাবে ময়লা-আবর্জনার সঙ্গে চামড়াগুলো ফেলা ঠিক হয়নি। দুর্গন্ধে টেকা যায় না এদিকে। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদা বারিক দেশ রূপান্তরকে জানান, আমার কাছে আরও কয়েকজন অভিযোগ করেছে। আমি সংবাদটি পেয়েছি। এটা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মধ্যে। তবুও আমি যাব নিজের কিছু কাজ শেষ করেই। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) প্রধান নির্বাহী (সিইও) এহতেশামুল হক দেশ রূপান্তরকে জানান, এটি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের বাইরে ইউনিয়ন পরিষদের অধীনের জায়গায়। আমি দায়িত্ব নিয়েই বলছি, আমার সিটি করপোরেশনের মধ্যে কোনো আবর্জনা নেই, থাকলে আমাকে জানান, আমরা সঙ্গে সঙ্গেই তা পরিষ্কার করে দেব।
রংপুরে চামড়া নিয়ে লোকসানে মৌসুমি ব্যাবসায়ীরা : চামড়া নিয়ে চরম লোকসানে পড়েছে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। এদিকে ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে বকেয়া টাকা না পাওয়ায় চামড়া কিনতে আড়তদাররা খুব একটা আগ্রহী নয়। তারা ধারদেনা করে চামড়া কিনছে।
চামড়ার দাম কমার পেছনে ব্যবসায়ীরা : বাণিজ্যমন্ত্রী
কোরবানির পশুর চামড়ার দাম কমার পেছনে ব্যবসায়ীদের দুষলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। গতকাল রংপুরের শালবন এলাকায় নিজ বাসভবনে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, দাম কমে যাওয়ার পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজি রয়েছে। চামড়া নিয়ে যখনই ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করি, তখনই তার বিরুদ্ধাচরণ করা হচ্ছে। তাই তাৎক্ষণিকভাবে কাঁচা চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ঈদের আগে ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলো, তার কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। চামড়ার দাম একেবারেই কমে গেছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণেই সরকার কাঁচা চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চামড়া রপ্তানির সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা বলেছেন। আজ (বুধবার) তারা বৈঠক ডেকেছেন। তাদের সিদ্ধান্ত দেখে সরকার পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। কোনোভাবেই চামড়াশিল্পকে ধ্বংস করতে দেওয়া যাবে না।
সরকার গরিবদের হক মারছে বিএনপির এমন মন্তব্যের ব্যাপারে মন্ত্রী বলেন, সমালোচনা করাই হচ্ছে বিএনপির কাজ। ভালো কাজ কখনোই তাদের চোখে পড়ে না।
তিনি আরও বলেন, মূলত কোরবানির চামড়া মসজিদ-মাদ্রাসায় দান করা হয়। সেই চামড়া অনেক কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ে ব্যবসায়ীরা লবণ দিয়ে এটা সংরক্ষণ করতে পারলে রপ্তানি করে ভালো দাম পাওয়া যাবে।