ইন্টারকন্টিনেন্টাল হয়ে উঠবে রক্তাক্ত হাসপাতাল
এম এ মোমেন | ৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০
২৫ মার্চ ১৯৭১-এর প্রত্যক্ষদর্শী ইউপিআই প্রতিনিধি রবার্ট কেয়লরসহ আরও অনেকেই তখন ঢাকায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। কেয়লর লিখছেন, বৃহস্পতিবার ২৫ মার্চ রাত ১১টায় আমি হোটেলের লবিতে নেমে আসি। জনগণের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর ব্যবহার অব্যাহত রাখার ‘ভয়াবহ পরিণতি’ সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বক্তব্য অবলম্বন
করেই আমার হাতের বার্তাটি রচিত। ট্যাক্সি ভাড়া করে টেলিগ্রাফ অফিসে গিয়ে বার্তাটি প্রেরণের পরিকল্পনা করছি, দেখলাম লবিতে অনেকের জটলা যুদ্ধসাজে সজ্জিত সৈন্যরা এসেছে, হেলমেট মাথায়, হাতে খোলা অস্ত্র। হোটেলের কর্মচারীরা একটি ব্ল্যাকবোর্ড বসিয়ে তাতে নোটিস লিখেছে ‘অনুগ্রহ করে বাইরে যাবেন না’, একেবারে দরজার সামনে চক দিয়ে লেখা। শনিবার হরতাল পালনের জন্য শেখের আহ্বান সংবলিত বিবৃতিটি কেউ একজন ব্ল্যাকবোর্ডের ওপর সেঁটে দিয়েছে। অন্যরা জানালেন, তারা যখন বাইরে যেতে চেষ্টা করেছেন সৈন্যরা তাদের বাধা দিয়ে ভেতরে ঢোকার নির্দেশ দিয়েছে। এই সৈন্যদের নেতা বলে দিয়েছে, যে বাইরে যেতে চেষ্টা করবে তাকে গুলি করা হবে।
রাত ১১.৪৫ : কী যে ঘটছে সবাই তা বের করার চেষ্টা করছে। একটি তত্ত্ব হচ্ছে, সামরিক গার্ডরা হোটেলে অবস্থানরত পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টোর প্রতিরক্ষার চেষ্টা করছে ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানে ঘৃণিত ব্যক্তি। হোটেলের সর্বোচ্চ তলায় তিনি অবস্থান করছেন। অন্য একটি তত্ত্ব হচ্ছে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটতে যাচ্ছে, সে জন্যই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অন্য কোনো জেনারেলের স্বার্থে হার্ডলাইনে যাননি।
সময় যতটা গড়াতে থাকে ততটাই অভ্যুত্থানের মতোই মনে হয়। সন্ধ্যার পর সৈন্যদের গাড়ির বহর দুবার হোটেলের সামনে দিয়ে অতিক্রম করতে দেখা গেছে। প্রেসিডেন্টের মূল সহযোগীদের একজনের ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করলামÑ উদ্দেশ্য একটি গুজব প্রেসিডেন্ট ঢাকা থেকে চলে গেছেনÑ এর যথার্থতা যাচাই করা। কেউ একজন ফোন ধরল কিন্তু কথা বলল না। কেয়লর স্থানীয় একটি সংবাদ সংস্থায় ফোন করেন এবং কী ঘটছে এ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা আছে কি-না জানতে চান। তারাও বলতে পারলেন না।
দিল্লিতে কর্মরত নিউ ইয়র্ক টাইমস সংবাদদাতা সিডনি শনবার্গও ঢাকায় এই হোটেলেই। তিনি লিখছেন : পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কামান ও ভারী মেশিনগান নিরস্ত্র বেসামরিক জনতার ওপর চালিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন নস্যাৎ করে দিতে চেয়েছে। কোনোরকম সতর্ক সংকেত না দিয়েই বৃহস্পতিবার রাতে তারা আক্রমণ শুরু করে। তাদের লক্ষ্য স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান ঘাঁটিগুলো যেমনÑ বিশ্ববিদ্যালয় অবরোধ। ক’জন মৃত্যুবরণ করেছে বা জখম হয়েছে জানার উপায় নেই। তারা ঢাকায় আঘাত হানার আগে থেকেই দেশের ভেতর বেসামরিক জনতা ও পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের মধ্যে সংঘর্ষের খবর আসছিল।
সিডনি শনবার্গ ঢাকায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে থেকে শহরের বিভিন্ন অংশে আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে পাচ্ছিলেন। ভয়াবহ আগুন জ্বলছিল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। প্যারামিলিটারি ফোর্স পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসে এখনো আগুন জ্বলছে। গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসছে। হোটেলের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে একজন পাকিস্তানি ছাত্র বলছে, হায় আল্লাহ, হায় আল্লাহ, তারা ওদের মেরে ফেলছে, ওদের জবাই করছে।
সামরিক ট্রাকবহরের পাহারায় এয়ারপোর্টে যাওয়ার পথে সাংবাদিকরা দেখেছেন, রাস্তার দু’পাশের বস্তিতে এবং স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের জোরদার সমর্থকদের বাড়িতে সেনাসদস্যরা আগুন দিচ্ছে। বৃহস্পতিবার রাতে যখন এই অভিযান শুরু হয়, সৈন্যরা বিজয়ধ্বনি দিয়ে শহরের বিভিন্ন অংশে প্রবেশ করে অটোমেটিক রাইফেল, মেশিনগান ও রিকয়েললেস রাইফেল থেকে অবিরাম গুলিবর্ষণ করে এবং বিভিন্ন স্থানে আগুন ধরিয়ে দেয়। কী ঘটছে জানার জন্য হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থানরত বিদেশি সাংবাদিকরা বাইরে যেতে চান, সেনাবাহিনী জোর করে তাদের আবার ভেতরে ঢুকিয়ে দেয় এবং বলে, ভবনের বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করলে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করা হবে।
হোটেলের চারপাশে আগুন ও গোলাগুলি বাড়তে থাকে, রাত ১টা নাগাদ গোটা শহরেই তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বাইরের মিলিটারি গার্ডের আদেশে রাত ১.২৫ মিনিটে হোটেলের টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। একই সময় টেলিগ্রাফ অফিস টাওয়ারের বাতিও নিভে যায়। ভারী স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসে বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরের অন্যান্য অংশ থেকে। রাত ২.১৫ মিনিটের দিকে মেশিনগানবাহী একটি জিপ ময়মনসিংহ রোড ধরে এগিয়ে একটি বাজারের সামনে থামে। দোতলার জানালা বরাবর মেশিনগান তাক করা এক ডজন সশস্ত্র সৈন্য হেঁটে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। তাদের একটি দল বহন করছে রকেট জাতীয় অস্ত্র।
দোতলা থেকে হঠাৎ চিৎকারধ্বনি শোনা গেল ‘বাঙালি এক হও’ আর তখনই সৈন্যদল ভবনটির ওপর অবিরাম গোলাবর্ষণ করতে শুরু করল। যে গাড়ি দিয়ে এই কানাগলিতে ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছিল, সে গাড়ি উল্টে দিল। হোটেলের দশ তলার ছাদ থেকে গুলির ঝলক বিদেশি সাংবাদিকরা দেখেছেন এ ছিল এক অবিশ্বাস্য নাটক।
সেনাসদস্যরা যখন গুলি করতে করতে এগোয়, ১৫ থেকে ২০ জন বাঙালি যুবক প্রায় ২০০ গজ দূরে তাদের মুখোমুখি হয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। কিন্তু মনে হলো তারা নিরস্ত্র, খালি হাত। জিপের ওপরের মেশিনগান ঘুরিয়ে ধরল তাদের দিকে, এরপর চলল গুলি। স্বয়ংক্রিয় রাইফেলধারী সৈন্যরাও তাদের সঙ্গে যোগ দিল। যুবকরা রাস্তার দুপাশে ছড়িয়ে পড়ল। কেউ নিহত কিংবা আহত হয়েছে কি-না এখান থেকে বোঝা মুশকিল। এবার তারা এগিয়ে গেল গলির দিকে। একটি স্পেয়ার পার্টসের দোকানে আগুন ধরিয়ে দিল। তাদের মূল লক্ষ্য দ্য পিপল অফিস ও প্রেস। এই ইংরেজি দৈনিক পত্রিকাটি শেখ মুজিবকে সমর্থন এবং সেনাবাহিনীকে বিদ্রপ করে যাচ্ছিল।
পশ্চিম পাকিস্তানি ভাষা উর্দুতে তারা চিৎকার করে সতর্ক করল, ভেতরে কেউ থাকলে আত্মসমর্পণ করো, নতুবা গুলি করে হত্যা করা হবে। কোনো উত্তর এলো না, কেউ বেরও হলো না। তারা পত্রিকাটির অফিসে রকেট শেল নিক্ষেপ করল। একই সঙ্গে চালাল মেশিনগান ও ছোট অস্ত্রের গুলি। এরপর ভবনে আগুন লাগিয়ে ছাপাখানা ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি ভাঙতে লাগল। ভোর পৌনে ৫টায় পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস সদর দপ্তরের দিকে ভয়াবহ অগ্নিশিখা দেখা গেল। পৌনে ৬টার দিকে আবছা আলোয় চোখে পড়ল চাইনিজ টি-৫১ হালকা ট্যাংকে চড়ে সৈন্যরা শহরের প্রধান প্রধান সড়কে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে।
গত ভোর থেকে মাথার ওপর হেলিকপ্টার ঘুরঘুর করছে লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ চালানোর জরিপ চালাচ্ছে। নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর ত্রাণ সহায়তার জন্য সৌদি আরব পাকিস্তানকে চারটি হেলিকপ্টার দিয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, সেই হেলিকপ্টার পূর্ব পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সিডনি শনবার্গসহ বিদেশি সাংবাদিকদের যখন পূর্ব পাকিস্তান থেকে বহিষ্কারের উদ্দেশে ঢাকা থেকে বের করে দেওয়া হয় একজন হোটেল কর্মকর্তা বললেন, ‘এটা এখন আর হোটেল থাকবে না, হয়ে উঠবে রক্তাক্ত হাসপাতাল।’
শেয়ার করুন
এম এ মোমেন | ৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০

২৫ মার্চ ১৯৭১-এর প্রত্যক্ষদর্শী ইউপিআই প্রতিনিধি রবার্ট কেয়লরসহ আরও অনেকেই তখন ঢাকায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। কেয়লর লিখছেন, বৃহস্পতিবার ২৫ মার্চ রাত ১১টায় আমি হোটেলের লবিতে নেমে আসি। জনগণের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর ব্যবহার অব্যাহত রাখার ‘ভয়াবহ পরিণতি’ সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বক্তব্য অবলম্বন
করেই আমার হাতের বার্তাটি রচিত। ট্যাক্সি ভাড়া করে টেলিগ্রাফ অফিসে গিয়ে বার্তাটি প্রেরণের পরিকল্পনা করছি, দেখলাম লবিতে অনেকের জটলা যুদ্ধসাজে সজ্জিত সৈন্যরা এসেছে, হেলমেট মাথায়, হাতে খোলা অস্ত্র। হোটেলের কর্মচারীরা একটি ব্ল্যাকবোর্ড বসিয়ে তাতে নোটিস লিখেছে ‘অনুগ্রহ করে বাইরে যাবেন না’, একেবারে দরজার সামনে চক দিয়ে লেখা। শনিবার হরতাল পালনের জন্য শেখের আহ্বান সংবলিত বিবৃতিটি কেউ একজন ব্ল্যাকবোর্ডের ওপর সেঁটে দিয়েছে। অন্যরা জানালেন, তারা যখন বাইরে যেতে চেষ্টা করেছেন সৈন্যরা তাদের বাধা দিয়ে ভেতরে ঢোকার নির্দেশ দিয়েছে। এই সৈন্যদের নেতা বলে দিয়েছে, যে বাইরে যেতে চেষ্টা করবে তাকে গুলি করা হবে।
রাত ১১.৪৫ : কী যে ঘটছে সবাই তা বের করার চেষ্টা করছে। একটি তত্ত্ব হচ্ছে, সামরিক গার্ডরা হোটেলে অবস্থানরত পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টোর প্রতিরক্ষার চেষ্টা করছে ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানে ঘৃণিত ব্যক্তি। হোটেলের সর্বোচ্চ তলায় তিনি অবস্থান করছেন। অন্য একটি তত্ত্ব হচ্ছে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটতে যাচ্ছে, সে জন্যই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অন্য কোনো জেনারেলের স্বার্থে হার্ডলাইনে যাননি।
সময় যতটা গড়াতে থাকে ততটাই অভ্যুত্থানের মতোই মনে হয়। সন্ধ্যার পর সৈন্যদের গাড়ির বহর দুবার হোটেলের সামনে দিয়ে অতিক্রম করতে দেখা গেছে। প্রেসিডেন্টের মূল সহযোগীদের একজনের ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করলামÑ উদ্দেশ্য একটি গুজব প্রেসিডেন্ট ঢাকা থেকে চলে গেছেনÑ এর যথার্থতা যাচাই করা। কেউ একজন ফোন ধরল কিন্তু কথা বলল না। কেয়লর স্থানীয় একটি সংবাদ সংস্থায় ফোন করেন এবং কী ঘটছে এ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা আছে কি-না জানতে চান। তারাও বলতে পারলেন না।
দিল্লিতে কর্মরত নিউ ইয়র্ক টাইমস সংবাদদাতা সিডনি শনবার্গও ঢাকায় এই হোটেলেই। তিনি লিখছেন : পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কামান ও ভারী মেশিনগান নিরস্ত্র বেসামরিক জনতার ওপর চালিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন নস্যাৎ করে দিতে চেয়েছে। কোনোরকম সতর্ক সংকেত না দিয়েই বৃহস্পতিবার রাতে তারা আক্রমণ শুরু করে। তাদের লক্ষ্য স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান ঘাঁটিগুলো যেমনÑ বিশ্ববিদ্যালয় অবরোধ। ক’জন মৃত্যুবরণ করেছে বা জখম হয়েছে জানার উপায় নেই। তারা ঢাকায় আঘাত হানার আগে থেকেই দেশের ভেতর বেসামরিক জনতা ও পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের মধ্যে সংঘর্ষের খবর আসছিল।
সিডনি শনবার্গ ঢাকায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে থেকে শহরের বিভিন্ন অংশে আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে পাচ্ছিলেন। ভয়াবহ আগুন জ্বলছিল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। প্যারামিলিটারি ফোর্স পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসে এখনো আগুন জ্বলছে। গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসছে। হোটেলের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে একজন পাকিস্তানি ছাত্র বলছে, হায় আল্লাহ, হায় আল্লাহ, তারা ওদের মেরে ফেলছে, ওদের জবাই করছে।
সামরিক ট্রাকবহরের পাহারায় এয়ারপোর্টে যাওয়ার পথে সাংবাদিকরা দেখেছেন, রাস্তার দু’পাশের বস্তিতে এবং স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের জোরদার সমর্থকদের বাড়িতে সেনাসদস্যরা আগুন দিচ্ছে। বৃহস্পতিবার রাতে যখন এই অভিযান শুরু হয়, সৈন্যরা বিজয়ধ্বনি দিয়ে শহরের বিভিন্ন অংশে প্রবেশ করে অটোমেটিক রাইফেল, মেশিনগান ও রিকয়েললেস রাইফেল থেকে অবিরাম গুলিবর্ষণ করে এবং বিভিন্ন স্থানে আগুন ধরিয়ে দেয়। কী ঘটছে জানার জন্য হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থানরত বিদেশি সাংবাদিকরা বাইরে যেতে চান, সেনাবাহিনী জোর করে তাদের আবার ভেতরে ঢুকিয়ে দেয় এবং বলে, ভবনের বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করলে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করা হবে।
হোটেলের চারপাশে আগুন ও গোলাগুলি বাড়তে থাকে, রাত ১টা নাগাদ গোটা শহরেই তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বাইরের মিলিটারি গার্ডের আদেশে রাত ১.২৫ মিনিটে হোটেলের টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। একই সময় টেলিগ্রাফ অফিস টাওয়ারের বাতিও নিভে যায়। ভারী স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসে বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরের অন্যান্য অংশ থেকে। রাত ২.১৫ মিনিটের দিকে মেশিনগানবাহী একটি জিপ ময়মনসিংহ রোড ধরে এগিয়ে একটি বাজারের সামনে থামে। দোতলার জানালা বরাবর মেশিনগান তাক করা এক ডজন সশস্ত্র সৈন্য হেঁটে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। তাদের একটি দল বহন করছে রকেট জাতীয় অস্ত্র।
দোতলা থেকে হঠাৎ চিৎকারধ্বনি শোনা গেল ‘বাঙালি এক হও’ আর তখনই সৈন্যদল ভবনটির ওপর অবিরাম গোলাবর্ষণ করতে শুরু করল। যে গাড়ি দিয়ে এই কানাগলিতে ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছিল, সে গাড়ি উল্টে দিল। হোটেলের দশ তলার ছাদ থেকে গুলির ঝলক বিদেশি সাংবাদিকরা দেখেছেন এ ছিল এক অবিশ্বাস্য নাটক।
সেনাসদস্যরা যখন গুলি করতে করতে এগোয়, ১৫ থেকে ২০ জন বাঙালি যুবক প্রায় ২০০ গজ দূরে তাদের মুখোমুখি হয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। কিন্তু মনে হলো তারা নিরস্ত্র, খালি হাত। জিপের ওপরের মেশিনগান ঘুরিয়ে ধরল তাদের দিকে, এরপর চলল গুলি। স্বয়ংক্রিয় রাইফেলধারী সৈন্যরাও তাদের সঙ্গে যোগ দিল। যুবকরা রাস্তার দুপাশে ছড়িয়ে পড়ল। কেউ নিহত কিংবা আহত হয়েছে কি-না এখান থেকে বোঝা মুশকিল। এবার তারা এগিয়ে গেল গলির দিকে। একটি স্পেয়ার পার্টসের দোকানে আগুন ধরিয়ে দিল। তাদের মূল লক্ষ্য দ্য পিপল অফিস ও প্রেস। এই ইংরেজি দৈনিক পত্রিকাটি শেখ মুজিবকে সমর্থন এবং সেনাবাহিনীকে বিদ্রপ করে যাচ্ছিল।
পশ্চিম পাকিস্তানি ভাষা উর্দুতে তারা চিৎকার করে সতর্ক করল, ভেতরে কেউ থাকলে আত্মসমর্পণ করো, নতুবা গুলি করে হত্যা করা হবে। কোনো উত্তর এলো না, কেউ বেরও হলো না। তারা পত্রিকাটির অফিসে রকেট শেল নিক্ষেপ করল। একই সঙ্গে চালাল মেশিনগান ও ছোট অস্ত্রের গুলি। এরপর ভবনে আগুন লাগিয়ে ছাপাখানা ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি ভাঙতে লাগল। ভোর পৌনে ৫টায় পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস সদর দপ্তরের দিকে ভয়াবহ অগ্নিশিখা দেখা গেল। পৌনে ৬টার দিকে আবছা আলোয় চোখে পড়ল চাইনিজ টি-৫১ হালকা ট্যাংকে চড়ে সৈন্যরা শহরের প্রধান প্রধান সড়কে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে।
গত ভোর থেকে মাথার ওপর হেলিকপ্টার ঘুরঘুর করছে লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ চালানোর জরিপ চালাচ্ছে। নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর ত্রাণ সহায়তার জন্য সৌদি আরব পাকিস্তানকে চারটি হেলিকপ্টার দিয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, সেই হেলিকপ্টার পূর্ব পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সিডনি শনবার্গসহ বিদেশি সাংবাদিকদের যখন পূর্ব পাকিস্তান থেকে বহিষ্কারের উদ্দেশে ঢাকা থেকে বের করে দেওয়া হয় একজন হোটেল কর্মকর্তা বললেন, ‘এটা এখন আর হোটেল থাকবে না, হয়ে উঠবে রক্তাক্ত হাসপাতাল।’