কর দিয়ে অবৈধ সম্পদ বৈধ করেন গোল্ডেন মনির!
সরোয়ার আলম ও ইমন রহমান | ২৪ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০
‘অবৈধ পথে’ অর্জিত বিপুল অর্থসম্পদের অধিকাংশই সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে কর দিয়ে সাদা (বৈধ) করে রেখেছেন মো. মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনির (৫৩)। এ সংক্রান্ত সব কাগজপত্র আগে থেকেই গুছিয়েও রেখেছেন। ‘অবৈধ পথে’ হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জনকে নিজের ব্যবসায়িক সফলতাও বলছেন তিনি। এটাকে দীর্ঘদিনের কষ্টের ফসল দাবি করে বলেছেন, এক দিনে নয়, ধীরে ধীরে এই অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন। আর বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া সোনা ও স্বর্ণালঙ্কারগুলো আত্মীয়স্বজনরা তার কাছে গচ্ছিত রেখেছিল বলে জানান মনির। এছাড়া তার গাড়ির ব্যবসার ক্রেতা ছিলেন এমপি, মন্ত্রী, পুলিশ, আমলা, সচিব ও সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও বিদেশি মুদ্রা রাখার অভিযোগও মিথ্যা দাবি করেছেন। নিজেকে নির্দোষ উল্লেখ করে গতকাল সোমবার রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের প্রথম দিনে মনির তদন্ত কর্মকর্তাদের এসব কথা বলেছেন বলে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন।
জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, জিজ্ঞাসাবাদে এক মুহূর্তের জন্যও বিচলিত হননি মনির। পুরো সময় ধরেই ছিলেন খুবই আত্মবিশ্বাসী। তবে রিমান্ডের প্রথম দিনেই পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তার সম্পর্কে জানা গেছে আরও কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা ২৫টি অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ৯৩০ কোটি ২২ লাখ টাকার লেনদেন করার তথ্য মিলেছে। তার মধ্যে ৪১২ কোটি ২ লাখ টাকা জমা রয়েছে এবং ৫১৮ কোটি ২০ লাখ টাকা বিভিন্ন সময় উত্তোলন করা হয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১১০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। অথচ গত অর্থবছরে আয়কর রিটার্নে তার সম্পদের পরিমাণ দেখিয়েছেন মাত্র ২৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এছাড়াও গত অর্থবছরে গোল্ডেন মনিরের বাৎসরিক আয় ১ কোটি ৪ লাখ টাকা দেখানো হয়েছে।
এদিকে মনিরকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়ায় তার সহযোগী প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে মনিরের চার সহযোগীকে শনাক্ত করার পর তাদের বাসাবাড়ি ও অফিস নজরদারিতে রাখা হয়েছে। বাড্ডার সাবেক কমিশনার বিএনপির প্রভাবশালী নেতা কাইয়ুমের সমস্ত সম্পত্তি দেখভাল করার ঘটনা তদন্ত করতে গিয়েই গোয়েন্দারা এসব তথ্য পেয়ে যান।
রাজধানীর মেরুল বাড্ডার ১৩ নম্বর রোডের ৪১ নম্বর বাড়িতে গত শুক্রবার রাতভর অভিযান চালিয়ে পরদিন শনিবার সকালে মনিরের গ্রেপ্তারের বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানায় র্যাব। অভিযানে তার কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, কয়েক রাউন্ড গুলি, বিদেশি মদ এবং ১০টি দেশের বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা, ৬০০ ভরি সোনা ও স্বর্ণালঙ্কার এবং নগদ ১ কোটি ৯ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। গত রবিবার মনিরের বিরুদ্ধে অনুমোদনবিহীন বিদেশি মুদ্রা, অবৈধ অস্ত্র ও গুলি এবং মাদক রাখার অভিযোগে বাড্ডা থানায় আলাদা তিনটি মামলা করা হয়। তিন মামলায় আদালত তার ১৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।
পুলিশের তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা অস্ত্র, মাদক ও বিদেশি মুদ্রা এই তিনটি বিষয় নিয়ে তদন্ত করছি। প্রথম দিনে বেশকিছু তথ্য মনির জানিয়েছে। তার বক্তব্য আমরা শুনেছি। তবে সব বিষয়ে তদন্ত করার এখতিয়ার আমাদের নেই।’ রিমান্ডের প্রথম দিনে পাওয়া তথ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে এ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘মনিরের ক্ষেত্রে প্রথম বিষয় হচ্ছে তার টাকাটা কালো টাকা না সাদা টাকা? জিজ্ঞাসাবাদে সে জানিয়েছে তার যত অর্থসম্পদ, যা কিছু আছে সবকিছুর ট্যাক্স ফাইলে ট্যাক্স দেওয়া আছে। সে মূলত সব সাদা বানিয়ে রেখেছে। যে কারণে এ বিষয়ে প্রশ্ন করার মতো সুযোগ আমাদের নেই। তার বাসায় পাওয়া টাকার বিষয়ে বলেছে, গ্রেপ্তারের আগের দিন শুক্রবার গাড়ি বিক্রি করে ওই টাকা এনে বাসায় রাখে। ব্যাংক বন্ধ থাকায় টাকা বাসায় রাখে বলে জানিয়েছে। এছাড়া গোল্ডের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বলেছে, তার কাছে যে গোল্ড ছিল তা তার স্ত্রী, মা ও আত্মীয়দের গহনা। তাদের যে ব্যবহারের গহনা সবই তার বাসায় গচ্ছিত ছিল। সবকিছু তার কাছে স্পষ্ট হিসাব আছে বলে দাবি করেছে।’
নিজের ও স্ত্রীর নামে চারটি লাইসেন্স করা আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে উল্লেখ করে বাসায় কোনো অবৈধ অস্ত্র ছিল না বলে মনির দাবি করেছে বলেও জানান পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি আরও বলেন, অর্থসংক্রান্ত বিষয় তদন্ত করা দুদকের কাজ। আর মানি লন্ডারিংয়ের মামলা হলে তার তদন্ত করার একমাত্র এখতিয়ার আছে সিআইডির।
বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া বিদেশি মুদ্রার বিষয়ে মনিরের বক্তব্য জানতে চাইলে তদন্তসংশ্লিষ্টারা জানান, মনির বলেছে গত বছর ওমরা করে এসেছেন। কিছুদিন আগে দুবাইতে যাওয়া সংক্রান্ত একটি বিষয় ছিল, ওই সময় তার পাসপোর্টে কিছু বিদেশি মুদ্রা এনডোর্স করা ছিল। সেগুলোর হিসাব তিনি দিতে পারছেন। এছাড়া তিনি জানিয়েছেন, দেশের বাইরে বারবার যাওয়া-আসার কারণে কিছু রিয়াল, ডলার বা অন্যান্য মুদ্রা তার কাছে ছিল।
মনিরের বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া মাদকের বিষয়ে তদন্তসংশ্লিষ্ট আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘মাদকের বিষয়ে মনির বলেছে “আমি কখনো মাদক নিইনি। সিগারেট খাই না। দিনে এক কাপ চা খাই। আপনারা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডোপ টেস্ট করতে পারেন”।’ আর সেলসম্যান থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়ার বিষয়ে বলেছেন, ধীরে ধীরে ব্যবসা করে সম্পদ গড়েছেন। তার গাড়ির ব্যবসা রয়েছে। সেখানে ক্রেতা ছিলেন এমপি, মন্ত্রী, আমলা, সচিব এবং পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
জিজ্ঞাসাবাদে ‘গোল্ডেন মনির’ নামের বিষয়ে জানতে চাইলে মনির বলেছেন, ‘রাজধানীর ভাটারায় গোল্ডেন গিয়ার নামের গাড়ির বিদেশি পার্টসের একটি দোকান ছিল। ওই দোকানে বসার কারণে হতে পারে অথবা আমার প্রতিটি ব্যবসায় সোনা ফলেছে, সফল হয়েছি। সে কারণেও হতে পারে।’
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, মনির বাড্ডার সাবেক কমিশনার কাইয়ুমের সম্পত্তি ও ব্যবসার দেখভাল করার দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। এ নিয়ে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনে তার নাম উঠে আসে। কাইয়ুমের অনুপস্থিতিতে মূলত মনিরই সব দেখাশোনা করা, এমনকি বিদেশে টাকা পাঠানোর মতোও গুরুদায়িত্ব পালন করতেন। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের প্রথম দিনেই এসব তথ্য প্রকাশ করেন তিনি। পুলিশ আরও নিশ্চিত হয়েছে যে, ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে মনির বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের এবং তৎকালীন প্রভাবশালী মন্ত্রী, গণপূর্ত ও রাজউকের বিভিন্ন শ্রেণির কর্মকর্তাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তাছাড়া বর্তমান শাসক দলের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার সঙ্গেও তার গভীর সখ্য রয়েছে। এছাড়াও হুন্ডির মাধ্যমে দেশের বাইরে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন।
জানা গেছে, মনিরের অন্যান্য সহযোগীর বিরুদ্ধেও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তদন্তে মাঠে নেমেছে দুদকসহ একাধিক সংস্থা। এতে তার সহযোগী প্রভাবশালীরা আতঙ্কে রয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে মনিরের দুই সহযোগী গত শনিবার থেকেই লাপাত্তা। তাদের স্বজনদের এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানিয়েছে বাড্ডা থানা পুলিশ।
এদিকে র্যাব কর্মকর্তারা বলেছেন, মনির হোসেন এক দিনে ‘গোল্ডেন মনির’ হয়ে ওঠেননি। তিনি মূলত একজন সুবিধাবাদী। বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের কয়েকজন নেতা, রাজউক ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন শ্রেণির কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে প্রচুর সম্পদের মালিক হয়েছেন। তার এ উত্থানের পেছনে যারা জড়িত ও সহায়তা করেছেন তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে চেষ্টা চলছে। এছাড়া মনিরের সহযোগীদেরও শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের যেকোনো সময় আটক করা হতে পারে।
শেয়ার করুন
সরোয়ার আলম ও ইমন রহমান | ২৪ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০

‘অবৈধ পথে’ অর্জিত বিপুল অর্থসম্পদের অধিকাংশই সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে কর দিয়ে সাদা (বৈধ) করে রেখেছেন মো. মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনির (৫৩)। এ সংক্রান্ত সব কাগজপত্র আগে থেকেই গুছিয়েও রেখেছেন। ‘অবৈধ পথে’ হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জনকে নিজের ব্যবসায়িক সফলতাও বলছেন তিনি। এটাকে দীর্ঘদিনের কষ্টের ফসল দাবি করে বলেছেন, এক দিনে নয়, ধীরে ধীরে এই অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন। আর বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া সোনা ও স্বর্ণালঙ্কারগুলো আত্মীয়স্বজনরা তার কাছে গচ্ছিত রেখেছিল বলে জানান মনির। এছাড়া তার গাড়ির ব্যবসার ক্রেতা ছিলেন এমপি, মন্ত্রী, পুলিশ, আমলা, সচিব ও সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও বিদেশি মুদ্রা রাখার অভিযোগও মিথ্যা দাবি করেছেন। নিজেকে নির্দোষ উল্লেখ করে গতকাল সোমবার রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের প্রথম দিনে মনির তদন্ত কর্মকর্তাদের এসব কথা বলেছেন বলে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন।
জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, জিজ্ঞাসাবাদে এক মুহূর্তের জন্যও বিচলিত হননি মনির। পুরো সময় ধরেই ছিলেন খুবই আত্মবিশ্বাসী। তবে রিমান্ডের প্রথম দিনেই পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তার সম্পর্কে জানা গেছে আরও কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা ২৫টি অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ৯৩০ কোটি ২২ লাখ টাকার লেনদেন করার তথ্য মিলেছে। তার মধ্যে ৪১২ কোটি ২ লাখ টাকা জমা রয়েছে এবং ৫১৮ কোটি ২০ লাখ টাকা বিভিন্ন সময় উত্তোলন করা হয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১১০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। অথচ গত অর্থবছরে আয়কর রিটার্নে তার সম্পদের পরিমাণ দেখিয়েছেন মাত্র ২৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এছাড়াও গত অর্থবছরে গোল্ডেন মনিরের বাৎসরিক আয় ১ কোটি ৪ লাখ টাকা দেখানো হয়েছে।
এদিকে মনিরকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়ায় তার সহযোগী প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে মনিরের চার সহযোগীকে শনাক্ত করার পর তাদের বাসাবাড়ি ও অফিস নজরদারিতে রাখা হয়েছে। বাড্ডার সাবেক কমিশনার বিএনপির প্রভাবশালী নেতা কাইয়ুমের সমস্ত সম্পত্তি দেখভাল করার ঘটনা তদন্ত করতে গিয়েই গোয়েন্দারা এসব তথ্য পেয়ে যান।
রাজধানীর মেরুল বাড্ডার ১৩ নম্বর রোডের ৪১ নম্বর বাড়িতে গত শুক্রবার রাতভর অভিযান চালিয়ে পরদিন শনিবার সকালে মনিরের গ্রেপ্তারের বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানায় র্যাব। অভিযানে তার কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, কয়েক রাউন্ড গুলি, বিদেশি মদ এবং ১০টি দেশের বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা, ৬০০ ভরি সোনা ও স্বর্ণালঙ্কার এবং নগদ ১ কোটি ৯ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। গত রবিবার মনিরের বিরুদ্ধে অনুমোদনবিহীন বিদেশি মুদ্রা, অবৈধ অস্ত্র ও গুলি এবং মাদক রাখার অভিযোগে বাড্ডা থানায় আলাদা তিনটি মামলা করা হয়। তিন মামলায় আদালত তার ১৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।
পুলিশের তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা অস্ত্র, মাদক ও বিদেশি মুদ্রা এই তিনটি বিষয় নিয়ে তদন্ত করছি। প্রথম দিনে বেশকিছু তথ্য মনির জানিয়েছে। তার বক্তব্য আমরা শুনেছি। তবে সব বিষয়ে তদন্ত করার এখতিয়ার আমাদের নেই।’ রিমান্ডের প্রথম দিনে পাওয়া তথ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে এ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘মনিরের ক্ষেত্রে প্রথম বিষয় হচ্ছে তার টাকাটা কালো টাকা না সাদা টাকা? জিজ্ঞাসাবাদে সে জানিয়েছে তার যত অর্থসম্পদ, যা কিছু আছে সবকিছুর ট্যাক্স ফাইলে ট্যাক্স দেওয়া আছে। সে মূলত সব সাদা বানিয়ে রেখেছে। যে কারণে এ বিষয়ে প্রশ্ন করার মতো সুযোগ আমাদের নেই। তার বাসায় পাওয়া টাকার বিষয়ে বলেছে, গ্রেপ্তারের আগের দিন শুক্রবার গাড়ি বিক্রি করে ওই টাকা এনে বাসায় রাখে। ব্যাংক বন্ধ থাকায় টাকা বাসায় রাখে বলে জানিয়েছে। এছাড়া গোল্ডের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বলেছে, তার কাছে যে গোল্ড ছিল তা তার স্ত্রী, মা ও আত্মীয়দের গহনা। তাদের যে ব্যবহারের গহনা সবই তার বাসায় গচ্ছিত ছিল। সবকিছু তার কাছে স্পষ্ট হিসাব আছে বলে দাবি করেছে।’
নিজের ও স্ত্রীর নামে চারটি লাইসেন্স করা আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে উল্লেখ করে বাসায় কোনো অবৈধ অস্ত্র ছিল না বলে মনির দাবি করেছে বলেও জানান পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি আরও বলেন, অর্থসংক্রান্ত বিষয় তদন্ত করা দুদকের কাজ। আর মানি লন্ডারিংয়ের মামলা হলে তার তদন্ত করার একমাত্র এখতিয়ার আছে সিআইডির।
বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া বিদেশি মুদ্রার বিষয়ে মনিরের বক্তব্য জানতে চাইলে তদন্তসংশ্লিষ্টারা জানান, মনির বলেছে গত বছর ওমরা করে এসেছেন। কিছুদিন আগে দুবাইতে যাওয়া সংক্রান্ত একটি বিষয় ছিল, ওই সময় তার পাসপোর্টে কিছু বিদেশি মুদ্রা এনডোর্স করা ছিল। সেগুলোর হিসাব তিনি দিতে পারছেন। এছাড়া তিনি জানিয়েছেন, দেশের বাইরে বারবার যাওয়া-আসার কারণে কিছু রিয়াল, ডলার বা অন্যান্য মুদ্রা তার কাছে ছিল।
মনিরের বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া মাদকের বিষয়ে তদন্তসংশ্লিষ্ট আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘মাদকের বিষয়ে মনির বলেছে “আমি কখনো মাদক নিইনি। সিগারেট খাই না। দিনে এক কাপ চা খাই। আপনারা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডোপ টেস্ট করতে পারেন”।’ আর সেলসম্যান থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়ার বিষয়ে বলেছেন, ধীরে ধীরে ব্যবসা করে সম্পদ গড়েছেন। তার গাড়ির ব্যবসা রয়েছে। সেখানে ক্রেতা ছিলেন এমপি, মন্ত্রী, আমলা, সচিব এবং পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
জিজ্ঞাসাবাদে ‘গোল্ডেন মনির’ নামের বিষয়ে জানতে চাইলে মনির বলেছেন, ‘রাজধানীর ভাটারায় গোল্ডেন গিয়ার নামের গাড়ির বিদেশি পার্টসের একটি দোকান ছিল। ওই দোকানে বসার কারণে হতে পারে অথবা আমার প্রতিটি ব্যবসায় সোনা ফলেছে, সফল হয়েছি। সে কারণেও হতে পারে।’
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, মনির বাড্ডার সাবেক কমিশনার কাইয়ুমের সম্পত্তি ও ব্যবসার দেখভাল করার দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। এ নিয়ে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনে তার নাম উঠে আসে। কাইয়ুমের অনুপস্থিতিতে মূলত মনিরই সব দেখাশোনা করা, এমনকি বিদেশে টাকা পাঠানোর মতোও গুরুদায়িত্ব পালন করতেন। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের প্রথম দিনেই এসব তথ্য প্রকাশ করেন তিনি। পুলিশ আরও নিশ্চিত হয়েছে যে, ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে মনির বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের এবং তৎকালীন প্রভাবশালী মন্ত্রী, গণপূর্ত ও রাজউকের বিভিন্ন শ্রেণির কর্মকর্তাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তাছাড়া বর্তমান শাসক দলের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার সঙ্গেও তার গভীর সখ্য রয়েছে। এছাড়াও হুন্ডির মাধ্যমে দেশের বাইরে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন।
জানা গেছে, মনিরের অন্যান্য সহযোগীর বিরুদ্ধেও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তদন্তে মাঠে নেমেছে দুদকসহ একাধিক সংস্থা। এতে তার সহযোগী প্রভাবশালীরা আতঙ্কে রয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে মনিরের দুই সহযোগী গত শনিবার থেকেই লাপাত্তা। তাদের স্বজনদের এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানিয়েছে বাড্ডা থানা পুলিশ।
এদিকে র্যাব কর্মকর্তারা বলেছেন, মনির হোসেন এক দিনে ‘গোল্ডেন মনির’ হয়ে ওঠেননি। তিনি মূলত একজন সুবিধাবাদী। বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের কয়েকজন নেতা, রাজউক ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন শ্রেণির কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে প্রচুর সম্পদের মালিক হয়েছেন। তার এ উত্থানের পেছনে যারা জড়িত ও সহায়তা করেছেন তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে চেষ্টা চলছে। এছাড়া মনিরের সহযোগীদেরও শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের যেকোনো সময় আটক করা হতে পারে।