সাভারের দখলরাজ ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড’ শাহাদাৎ
খাইরুল বাশার ও ওমর ফারুক | ২৫ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০
ঢাকার সাভার উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও আশুলিয়া থানা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহাদাৎ হোসেন খান এলাকার ভূমি মালিকদের কাছে যেন এক ‘আতঙ্ক’। ক্ষমতার অপব্যবহার করে জমি দখল, চাঁদাবাজি ও ঝুট সন্ত্রাসের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলাসহ বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে এ জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে। সম্প্রতি তার বিভিন্ন অপকর্মের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, অনেকের কাছে শাহাদাৎ ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড’ নামে পরিচিত। কয়েক বছরের ব্যবধানেই তিনি শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। মানিকগঞ্জে তৈরি করেছেন বিলাসবহুল বাগানবাড়ি। বরিশালে বাগানবাড়ির পাশাপাশি তার রয়েছে মৎস্য খামার। জমি দখলে নিতে তিনি নিজস্ব বাহিনীর মাধ্যমে মালিকদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন ও হত্যার হুমকির পাশাপাশি চাঁদাবাজির মিথ্যা মামলা ঠুকে দেন। এভাবে তার দখলে নেওয়া জমির আনুমানিক বাজারমূল্য কয়েকশ কোটি টাকা। স্থানীয় বিভিন্ন নির্বাচনে নৌকা মার্কার প্রার্থীর পক্ষে লোক দেখানো ভূমিকা রাখলেও গোপনে অর্থের বিনিময়ে তার বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে কাজ করারও অভিযোগ রয়েছে।
তবে শাহাদাৎ হোসেন খান তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি কারও জায়গা দখল করি না। কোনো জায়গা কিনিও না, কোনো জায়গা বেচিও না। মোবাইলে কথা বলা নিষেধ। মোবাইলে কথা বলি না। সামনাসামনি আইসা চা খাইয়া যাইয়েন।’
এলাকাবাসী জানিয়েছে, যুবলীগের আশুলিয়া থানা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর থেকেই আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন শাহাদাৎ। তার জমি দখলের বিশেষ কৌশলের কারণে সবাই রীতিমতো ভয়ে থাকেন। কোনো জায়গা পছন্দ হলেই ভুয়া কাগজপত্র বানানোর পর সেখানে সাইনবোর্ড টানিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে রাতারাতি সীমানাপ্রাচীর তুলে ফেলেন তিনি। এরপর তার বাহিনী দিয়ে দখলে নেন সেই জমি। প্রয়োজনে ভুয়া বাদী সাজিয়ে ওই জমির মালিকের বিরুদ্ধে ঠুকে দেন চাঁদাবাজির মিথ্যা মামলা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১০ সালের ৩০ জুন আশুলিয়া থানায় সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির একটি মামলায় (এফআই আর নং-৭৯, ধারা ১৪৩/৩২৩/৩৮৫/৩৭৯/৫০৬) শাহাদাৎ ছিলেন এজাহারভুক্ত আসামি। ২০১৭ সালের ২১ জুলাই আলিফ এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচয়ে ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ডিইপিজেড) ইউএস টেক্সটাইল লিমিটেড থেকে ঝুটের আড়ালে বিপুল পরিমাণ কাপড় পাচারকালে তাকে আটক করে বেপজা কর্তৃপক্ষ।
অনুসন্ধান এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মানিকগঞ্জের নয়াডিঙ্গি কাটিগ্রাম এলাকায় প্রায় ৩০ বিঘা জমির ওপর শাহাদাৎ গড়ে তুলেছেন বিলাসবহুল বাগানবাড়ি। যার বর্তমান বাজারমূল্য অন্তত ৫০ কোটি টাকা। বরিশালের নাজিরপুরের কুমারখালী এলাকায় ৬০ বিঘা জমিতে তৈরি করেছেন বাগানবাড়ি ও মৎস্য খামার; যার আনুমানিক মূল্য ৩০ কোটি টাকা। আশুলিয়ার বাইপাইল বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সিটি সেন্টার নামে বিশাল একটি মার্কেটের মালিকও তিনি। যার আনুমানিক বাজারমূল্য ৪০ কোটি টাকা। এছাড়া আশুলিয়া, উত্তরা, টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তার নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার জমি, বাড়ি, গাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাট এবং বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে জমা রয়েছে কাড়ি কাড়ি টাকা।
কানাডা প্রবাসী আশুলিয়ার এমএ মতিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত অক্টোবর মাসের ২ তারিখে আমার বাড়ির সাড়ে ৫ শতাংশ জমি সাইনবোর্ড লাগিয়ে দখলে নেয় শাহাদাৎ বাহিনী। সেই জায়গাতে মসজিদ নির্মাণ করেছেন তিনি। ৩ অক্টোবর তার বাহিনীর লোকজন এসে আমার বাড়িতে হামলা চালিয়ে ককটেল বিস্ফোরণ, ইটপাথর নিক্ষেপসহ তিন রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে। এরপর গত ১২ নভেম্বর বাড়ির পাশের ১৬ শতাংশ পরিমাণ আরেকটি জমি দখল করে বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ করেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘হামলার জন্য থানায় জিডি করতে গেলেও তা নেওয়া হয়নি। উল্টো আমার বিরুদ্ধে নিজের লোক দিয়ে শাহাদাৎ চাঁদাবাজির মামলা করেন।’
বাইপাইলের বগাবাড়ী এলাকার জেনিস শোরুমের মালিক নাসির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি একটি কোম্পানির কাছ থেকে ২৩ কাঠা জমি কিনে বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভোগদখল করে আসছিলাম। হঠাৎ ২০১০ সালে স্থানীয় যুবলীগ নেতা শাহাদাৎ একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে জোরপূর্বক আমার ১৮ কাঠা জমি দখল করে অফিস তৈরি করে। এ বিষয়ে মামলা করে আমি আদালত থেকে রায় পেলেও তারা আবার সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে।’
ভুক্তভোগী আরেক জমির মালিক রুহুল আমীন বলেন, ‘আমার প্রায় ১২ কোটি টাকা মূল্যের ২৮ শতাংশ জমিতে মার্কেট নির্মাণ করে দীর্ঘদিন ধরে ভোগদখল করছিলাম। ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পরপরই শাহাদাৎ দুই বছর আগে আমার ছেলেদের কাছ থেকে জমি কেনার একটি ভুয়া দলিল তৈরি করে মার্কেটটি জোরপূর্বক দখল করে নেয়। বর্তমানে পুরো জমিটিই তার দখলে।’
স্থানীয়দের অভিযোগ, যুবলীগ থেকে বহিষ্কৃত শাহাদাতের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর জমি দখল, ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণসহ নানা অপকর্মে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ। কেউ কেউ পুলিশে অভিযোগ করে পাল্টা তোপের মুখে পড়েছেন। সাভারের গাজীরচট এএম স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ খন্দকার মোজাফফর হোসেন তার বাল্যবন্ধু। সেই সুবাদে তিনি টাকার বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানটিতে সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগসহ ব্যাপক অনিয়ম করেছেন। ২০১৮ সালের ৯ জুন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি অধ্যক্ষ মোজাফফরকে ২০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বরখাস্ত করে। পরে শাহাদাৎ খান মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে পরিচালনা কমিটির সবাইকে ম্যানেজ করে তাকে আবারও স্বপদে বহাল করেন। বর্তমানে তিনি দাপটের সঙ্গে অধ্যক্ষ হিসেবে বহাল তবিয়তে কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন।
বাইপাইল মৌজায় শাহাদাৎ তার ৯২ শতাংশ জমি দখল করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন সাঈদুল বাকীন নামে এক ব্যক্তি। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘২০০৯ সালে যুবলীগ নেতা শাহাদাৎ হোসেন খান আমার ৫০ কোটি টাকা মূল্যের জমিটি সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে জোরপূর্বক দখল করে নেয়। এ ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়। এরপর তারা ভুয়া বাদী সাজিয়ে উল্টো আমার বিরুদ্ধে মামলা করে। কেন্দ্রীয় যুবলীগের এক সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক তাকে এসব দখলবাজিতে সহায়তা করে থাকেন। আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত থাকার পরও তারা আমার জমিটি দখল করে নেয়। বর্তমানে প্রতি মাসে সেখান থেকে আড়াই লাখ টাকা ভাড়া তোলে শাহাদাৎ বাহিনী। আমি একবার ভাড়া আনতে গেলে শাহাদাৎসহ তার সন্ত্রাসীরা আমাকে হত্যার চেষ্টা করে। এ বিষয়ে তার বিরুদ্ধে থানাসহ আদালতেও মামলা করেছি। আমার জমি জবরদখলকারীর বিচার চাই।’
বাইপাইল বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এক বিঘা জমির ওপর সিটি সেন্টার নামে একটি টিনশেড মার্কেট শাহাদাৎ দখল করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই জমির মালিকদের একজন মোশারফ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার বৈধ জমির ২৬ শতাংশ জায়গা জবরদখল করে নিয়েছেন শাহাদাৎ খান। আদালতে এ নিয়ে একটি মামলা চলছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার মালিকানার জমির একটি অংশ এখনো আমাদের দখলে থাকলেও ২৬ শতাংশ জমি রাতের আঁধারে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে দখল করে নেওয়া হয়। নাসরীন নামে এক নারীর ১৬ শতাংশ জমি দখল করে শাহাদাৎ ও মনসুর বাহিনী। এসব অপকর্ম ও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে ২০১৭ সালে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে (শাহাদাৎ) সরিয়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়।’
আশুলিয়া থানা যুবলীগের বেশ কজন নেতা বলেন, শাহাদাৎ রাজনৈতিক পরিচয়ে ঝুট ব্যবসা ও অন্যের জমি দখলের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। এজন্য গড়ে তুলেছেন একটি বাহিনী। বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে সরকারি দলের পক্ষে প্রকাশ্যে ভূমিকা রাখলেও গোপনে বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে কাজ করেন তিনি। বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে আঁতাতের কারণেই যুবলীগের পদটি হারিয়েছেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে সাভার উপজেলা চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজীবের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথোপকথন শুরুর পরই সংযোগটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
শাহাদাতের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আশুলিয়া থানার ওসি কামরুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগে কী হয়েছে জানি না। তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ সম্প্রতি এমএ মতিনের জমি দখল হয়েছে এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘মতিন নিজেই চাঁদাবাজ। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।’
শেয়ার করুন
খাইরুল বাশার ও ওমর ফারুক | ২৫ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০

ঢাকার সাভার উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও আশুলিয়া থানা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহাদাৎ হোসেন খান এলাকার ভূমি মালিকদের কাছে যেন এক ‘আতঙ্ক’। ক্ষমতার অপব্যবহার করে জমি দখল, চাঁদাবাজি ও ঝুট সন্ত্রাসের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলাসহ বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে এ জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে। সম্প্রতি তার বিভিন্ন অপকর্মের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, অনেকের কাছে শাহাদাৎ ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড’ নামে পরিচিত। কয়েক বছরের ব্যবধানেই তিনি শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। মানিকগঞ্জে তৈরি করেছেন বিলাসবহুল বাগানবাড়ি। বরিশালে বাগানবাড়ির পাশাপাশি তার রয়েছে মৎস্য খামার। জমি দখলে নিতে তিনি নিজস্ব বাহিনীর মাধ্যমে মালিকদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন ও হত্যার হুমকির পাশাপাশি চাঁদাবাজির মিথ্যা মামলা ঠুকে দেন। এভাবে তার দখলে নেওয়া জমির আনুমানিক বাজারমূল্য কয়েকশ কোটি টাকা। স্থানীয় বিভিন্ন নির্বাচনে নৌকা মার্কার প্রার্থীর পক্ষে লোক দেখানো ভূমিকা রাখলেও গোপনে অর্থের বিনিময়ে তার বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে কাজ করারও অভিযোগ রয়েছে।
তবে শাহাদাৎ হোসেন খান তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি কারও জায়গা দখল করি না। কোনো জায়গা কিনিও না, কোনো জায়গা বেচিও না। মোবাইলে কথা বলা নিষেধ। মোবাইলে কথা বলি না। সামনাসামনি আইসা চা খাইয়া যাইয়েন।’
এলাকাবাসী জানিয়েছে, যুবলীগের আশুলিয়া থানা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর থেকেই আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন শাহাদাৎ। তার জমি দখলের বিশেষ কৌশলের কারণে সবাই রীতিমতো ভয়ে থাকেন। কোনো জায়গা পছন্দ হলেই ভুয়া কাগজপত্র বানানোর পর সেখানে সাইনবোর্ড টানিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে রাতারাতি সীমানাপ্রাচীর তুলে ফেলেন তিনি। এরপর তার বাহিনী দিয়ে দখলে নেন সেই জমি। প্রয়োজনে ভুয়া বাদী সাজিয়ে ওই জমির মালিকের বিরুদ্ধে ঠুকে দেন চাঁদাবাজির মিথ্যা মামলা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১০ সালের ৩০ জুন আশুলিয়া থানায় সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির একটি মামলায় (এফআই আর নং-৭৯, ধারা ১৪৩/৩২৩/৩৮৫/৩৭৯/৫০৬) শাহাদাৎ ছিলেন এজাহারভুক্ত আসামি। ২০১৭ সালের ২১ জুলাই আলিফ এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচয়ে ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ডিইপিজেড) ইউএস টেক্সটাইল লিমিটেড থেকে ঝুটের আড়ালে বিপুল পরিমাণ কাপড় পাচারকালে তাকে আটক করে বেপজা কর্তৃপক্ষ।
অনুসন্ধান এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মানিকগঞ্জের নয়াডিঙ্গি কাটিগ্রাম এলাকায় প্রায় ৩০ বিঘা জমির ওপর শাহাদাৎ গড়ে তুলেছেন বিলাসবহুল বাগানবাড়ি। যার বর্তমান বাজারমূল্য অন্তত ৫০ কোটি টাকা। বরিশালের নাজিরপুরের কুমারখালী এলাকায় ৬০ বিঘা জমিতে তৈরি করেছেন বাগানবাড়ি ও মৎস্য খামার; যার আনুমানিক মূল্য ৩০ কোটি টাকা। আশুলিয়ার বাইপাইল বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সিটি সেন্টার নামে বিশাল একটি মার্কেটের মালিকও তিনি। যার আনুমানিক বাজারমূল্য ৪০ কোটি টাকা। এছাড়া আশুলিয়া, উত্তরা, টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তার নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার জমি, বাড়ি, গাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাট এবং বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে জমা রয়েছে কাড়ি কাড়ি টাকা।
কানাডা প্রবাসী আশুলিয়ার এমএ মতিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত অক্টোবর মাসের ২ তারিখে আমার বাড়ির সাড়ে ৫ শতাংশ জমি সাইনবোর্ড লাগিয়ে দখলে নেয় শাহাদাৎ বাহিনী। সেই জায়গাতে মসজিদ নির্মাণ করেছেন তিনি। ৩ অক্টোবর তার বাহিনীর লোকজন এসে আমার বাড়িতে হামলা চালিয়ে ককটেল বিস্ফোরণ, ইটপাথর নিক্ষেপসহ তিন রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে। এরপর গত ১২ নভেম্বর বাড়ির পাশের ১৬ শতাংশ পরিমাণ আরেকটি জমি দখল করে বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ করেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘হামলার জন্য থানায় জিডি করতে গেলেও তা নেওয়া হয়নি। উল্টো আমার বিরুদ্ধে নিজের লোক দিয়ে শাহাদাৎ চাঁদাবাজির মামলা করেন।’
বাইপাইলের বগাবাড়ী এলাকার জেনিস শোরুমের মালিক নাসির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি একটি কোম্পানির কাছ থেকে ২৩ কাঠা জমি কিনে বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভোগদখল করে আসছিলাম। হঠাৎ ২০১০ সালে স্থানীয় যুবলীগ নেতা শাহাদাৎ একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে জোরপূর্বক আমার ১৮ কাঠা জমি দখল করে অফিস তৈরি করে। এ বিষয়ে মামলা করে আমি আদালত থেকে রায় পেলেও তারা আবার সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে।’
ভুক্তভোগী আরেক জমির মালিক রুহুল আমীন বলেন, ‘আমার প্রায় ১২ কোটি টাকা মূল্যের ২৮ শতাংশ জমিতে মার্কেট নির্মাণ করে দীর্ঘদিন ধরে ভোগদখল করছিলাম। ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পরপরই শাহাদাৎ দুই বছর আগে আমার ছেলেদের কাছ থেকে জমি কেনার একটি ভুয়া দলিল তৈরি করে মার্কেটটি জোরপূর্বক দখল করে নেয়। বর্তমানে পুরো জমিটিই তার দখলে।’
স্থানীয়দের অভিযোগ, যুবলীগ থেকে বহিষ্কৃত শাহাদাতের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর জমি দখল, ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণসহ নানা অপকর্মে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ। কেউ কেউ পুলিশে অভিযোগ করে পাল্টা তোপের মুখে পড়েছেন। সাভারের গাজীরচট এএম স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ খন্দকার মোজাফফর হোসেন তার বাল্যবন্ধু। সেই সুবাদে তিনি টাকার বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানটিতে সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগসহ ব্যাপক অনিয়ম করেছেন। ২০১৮ সালের ৯ জুন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি অধ্যক্ষ মোজাফফরকে ২০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বরখাস্ত করে। পরে শাহাদাৎ খান মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে পরিচালনা কমিটির সবাইকে ম্যানেজ করে তাকে আবারও স্বপদে বহাল করেন। বর্তমানে তিনি দাপটের সঙ্গে অধ্যক্ষ হিসেবে বহাল তবিয়তে কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন।
বাইপাইল মৌজায় শাহাদাৎ তার ৯২ শতাংশ জমি দখল করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন সাঈদুল বাকীন নামে এক ব্যক্তি। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘২০০৯ সালে যুবলীগ নেতা শাহাদাৎ হোসেন খান আমার ৫০ কোটি টাকা মূল্যের জমিটি সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে জোরপূর্বক দখল করে নেয়। এ ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়। এরপর তারা ভুয়া বাদী সাজিয়ে উল্টো আমার বিরুদ্ধে মামলা করে। কেন্দ্রীয় যুবলীগের এক সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক তাকে এসব দখলবাজিতে সহায়তা করে থাকেন। আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত থাকার পরও তারা আমার জমিটি দখল করে নেয়। বর্তমানে প্রতি মাসে সেখান থেকে আড়াই লাখ টাকা ভাড়া তোলে শাহাদাৎ বাহিনী। আমি একবার ভাড়া আনতে গেলে শাহাদাৎসহ তার সন্ত্রাসীরা আমাকে হত্যার চেষ্টা করে। এ বিষয়ে তার বিরুদ্ধে থানাসহ আদালতেও মামলা করেছি। আমার জমি জবরদখলকারীর বিচার চাই।’
বাইপাইল বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এক বিঘা জমির ওপর সিটি সেন্টার নামে একটি টিনশেড মার্কেট শাহাদাৎ দখল করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই জমির মালিকদের একজন মোশারফ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার বৈধ জমির ২৬ শতাংশ জায়গা জবরদখল করে নিয়েছেন শাহাদাৎ খান। আদালতে এ নিয়ে একটি মামলা চলছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার মালিকানার জমির একটি অংশ এখনো আমাদের দখলে থাকলেও ২৬ শতাংশ জমি রাতের আঁধারে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে দখল করে নেওয়া হয়। নাসরীন নামে এক নারীর ১৬ শতাংশ জমি দখল করে শাহাদাৎ ও মনসুর বাহিনী। এসব অপকর্ম ও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে ২০১৭ সালে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে (শাহাদাৎ) সরিয়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়।’
আশুলিয়া থানা যুবলীগের বেশ কজন নেতা বলেন, শাহাদাৎ রাজনৈতিক পরিচয়ে ঝুট ব্যবসা ও অন্যের জমি দখলের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। এজন্য গড়ে তুলেছেন একটি বাহিনী। বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে সরকারি দলের পক্ষে প্রকাশ্যে ভূমিকা রাখলেও গোপনে বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে কাজ করেন তিনি। বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে আঁতাতের কারণেই যুবলীগের পদটি হারিয়েছেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে সাভার উপজেলা চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজীবের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথোপকথন শুরুর পরই সংযোগটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
শাহাদাতের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আশুলিয়া থানার ওসি কামরুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগে কী হয়েছে জানি না। তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ সম্প্রতি এমএ মতিনের জমি দখল হয়েছে এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘মতিন নিজেই চাঁদাবাজ। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।’