ছবির মিথ, মিথ্যে ম্যারাডোনা, মেসি...,
কাশীনাথ ভট্টাচার্য | ২৬ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০
মিথ মানেই কি মিথ্যে? কিংবা, উল্টোটাও মিথ্যে থেকেই কি জন্ম মিথের?
জানা নেই। তবে, ‘১৭ রানে ৫ উইকেট পড়ার পর’ মাঠে নেমে কপিল দেবের ১৭৫ রান করার মতো এবং টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যানদের বন্ধ-এর কারণে সেই ম্যাচের সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ থাকা সত্ত্বেও বহু ভারতীয়র তা ‘টিভিতে স্বচক্ষে দেখার’ মতো ‘মিথ্যে’ হয়ে উঠতে পারলে তবেই তা ‘মিথ’ স্তরে উন্নীত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করে, নির্জলা সত্যি!
ডিয়েগো ম্যারাডোনার একটি ছবি আছে। বহু আলোচিত। বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে। আজ্ঞে না, ছিয়াশি বিশ্বকাপের নয়, বিরাশির! খেলা হয়েছিল বার্সেলোনার কাম্প ন্যুতে। বিশ্বকাপের ঠিক আগে যে ক্লাবে সই করেছিলেন ম্যারাদোনা। ১৯৭৮-এ নিজেদের দেশে (যেভাবেই হোক!) বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে আর্জেন্টিনা খেলতে এসেছিল স্পেনে। আক্ষরিক অর্থে গোটাবিশ্ব তখন তাকিয়ে ম্যারাডোনার দিকে। সেই প্রথম ম্যাচ, বিশ্বকাপে, ম্যারাডোনার।
ম্যাচটা আর্জেন্টিনা হারে ০-১ গোলে। ম্যারাডোনা একেবারেই খেলতে পারেননি। গ্রুপ পর্বে আর্জেন্টিনা দ্বিতীয় হিসেবে শেষ করেছিল বেলজিয়ামের পেছনে। তারপর তো লিগের দ্বিতীয় পর্যায়ে ইতালি আর ব্রাজিলের কাছে হেরে, ব্রাজিলের বিরুদ্ধে খেলতে না-পারার হতাশায় লাথি মেরে লাল কার্ড দেখে ম্যারাডোনার বিদায়।
এই ছবিটা কিন্তু তখনো বেরোয়ইনি, কাগজে!
ডিজিটাল যুগ নয়। ছবি তখনো তোলা হতো ফিল্মে। আন্তর্জাতিক মঞ্চেও প্রতিবার শাটার টেপার আগে ভাবতেন চিত্রগ্রাহকরা। উদ্দিষ্ট যে ছবি আলোচনায়, ফটোগ্রাফার ছিলেন স্টিভ পাওয়েল। ছবি তুলছিলেন ‘স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড’-এর হয়ে। আন্তর্জাতিক ক্রীড়া পত্রিকার তরফে নিজের প্রথম ‘বড়’ কাজ। বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচে ক্যামেরা হাতে মাঠের ধারে। ক্যামেরার চোখে ধরে রাখতে হবে সবচেয়ে বড় তারকা হতে চলেছেন যিনি, ম্যারাডোনাকে। তাই ক্যামেরার চোখে সজাগ দৃষ্টি স্টিভের।
উদ্দিষ্ট ছবিটি তার ভালো লেগেছিল রঙের বৈপরীত্যে। ক্যাম্প ন্যুর সবুজ গালিচায় বেলজিয়ামের লাল জার্সি, সাতজনের মধ্যে ছয়জন তাকিয়ে আছে একজনের দিকে, কোন দিকে এগিয়ে যেতে পারেন ভাবনা নিয়ে পাওয়েল খুশিই হয়েছিলেন ছবিটা তুলে।
কিন্তু কাগজে কাজের ডেস্কে যা হয়, আর্জেন্টিনা হেরে গিয়েছে জঘন্য খেলে, ম্যারাডোনাও একেবারেই ভালো খেলেননি এই ছবি ছাপবে কেন? সংবাদপত্রের খেলা-ডেস্কে দীর্ঘদিন সময় কাটানোয় আন্দাজ করতেই পারি, সম্পাদক কী বলেছিলেন সংশ্লিষ্ট ফটোগ্রাফারকে। ‘এই ছবিটা পেয়েছ? অন্য কিছু দাও। বেলজিয়ামের গোলের ছবিটা নেই? নিয়ে এসো!’
তখনকার দিনে ফিল্ম থেকে প্রিন্ট করিয়ে ছবি দেওয়া হতো ক্রীড়া সম্পাদকের কাছে। যে-ছবি ছাপা হতো, মাপ নেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হতো স্কেল আর পেন বা পেনসিল। প্রথমে ছবিটা উল্টে পেছনের সাদা জমিতে কর্ণ আঁকতে হতো। এই বার এক/দুই বা তিন/চার কলমের মাপ অনুযায়ী ছবির একেবারে নিচ থেকে সেই কলমের মাপ পর্যন্ত সেন্টিমিটারের জায়গায় একটা বিন্দু দিয়ে বা সরলরেখা টেনে, ওই কর্ণ থেকে ওই বিন্দু যুক্ত হতো সরলরেখায়। সমকোণী ত্রিভুজের সেই লম্বই হলো তখন ছবির ‘হাইট’ আর কলম অনুযায়ী ভূমি ‘উইডথ’। এই বিরাট জ্ঞানভাণ্ডারের উৎস নয়ের দশকের শুরুর দিকে হাতে-কলমে দৈনিকের স্পোর্টস ডেস্কে কাজ!
যাক গে, ছবির মাপ শিক্ষার ক্লাস ছেড়ে ফুটবল মাঠে ফেরা যাক। পাওয়েলের সেই ছবি তো আর ছাপা হলো না! তাহলে, ছবিটা আজ ‘মিথ’ হয়ে উঠল কী করে?
কারণ, চার বছর পর যখন সত্যিই বেলজিয়ামকে ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা হারাল সেমিফাইনালে এবং দুটি গোল করলেন ম্যারাডোনা যার একটি উৎকর্ষে সেরা, ছবিটা পেল অযাচিত মূল্য!
ম্যারাডোনা এমনই ফুটবলার ছিলেন যে, ছয়জন সামনে এসেও আটকাতে পারছে না, এই ছবির চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী বোঝানো ও শেখানো হতো আমাদের মতো শিক্ষানবিস ক্রীড়া সাংবাদিকদের তো বটেই, বলা বা লেখাও হতো, হয়, এখনো হবে। ছিয়াশির পর যতবার বিশ্বকাপ ফুটবল হয়েছে, কোনো না কোনো সূত্রে সব কাগজের পাতায় বা বিশ্বকাপ সংক্রান্ত ‘স্পেশাল’-এ এই ছবির নিশ্চিত উপস্থিতি।
সত্যিটা অবশ্য তুলে ধরেছিল ম্যানচেস্টারের দ্য গার্ডিয়ান কাগজ, ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ চলাকালীন।
এই ছবি যা বলছে বাঁ পা দিয়ে ম্যারাডোনা বলটা পাস দিতে চলেছেন। তার সামনে ছয়জনের মুখ, যাদের তিনজন মাঝখানে প্রায় একলাইনে, দুজন ডানদিকে, একজন বাঁদিকে (আপনি ছবিটা যেভাবে দেখছেন, দিকের হিসাব সেভাবে)।
ছবির ‘ইন্টারপ্রিটেশন’ ছয়জনকে কাটিয়ে বল গোলে ঠেলতে চলেছেন ম্যারাডোনা। ছয়জন মিলেও তাকে ধরে রাখা যায় না, ঠিক পেরিয়ে আসেন এবং এভাবেই গোল করেন ম্যারাডোনা!
ঘটনা ফ্রিকিক পেয়েছিল আর্জেন্টিনা। নিয়েছিলেন আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি ওসভালদো আরদিলেস। শট না নিয়ে তিনি পাস দিয়েছিলেন ম্যারাডোনাকে যিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন বিপক্ষের ১৮ গজের বক্সের বাইরে, নিজের গোলের দিকে মুখ করে, বিপক্ষের ‘ওয়াল’-এর সঙ্গে এক লাইনে। বল যখন তার পায়ে কেউ তাকে বাধা দিতে আসার সুযোগই পাননি তখনো! সবে দেয়াল ছেড়ে বেরোতে শুরু করেছেন ফুটবলাররা, যে কারণে দুজন ছিটকেছেন বাঁদিকে, একজন ডানদিকে। মাঠে ফ্রিকিক হয়ে যাওয়ার পর যেভাবে ভাঙে দেয়াল।
কোথায় গোল, কোথায় গোলে বল ঠেলা, কোথায় ছয়জন মিলে তার অগ্রগতি আটকানোর চেষ্টা! এ তো ‘কপিলের ১৭ রানে ৫ উইকেট পড়ার পর’-এর লক্ষকোটিগুণ মিথ্যে! টেনব্রিজ ওয়েলস-এ সেই ১৮ জুন তো তবু ৯ রানে ৪ উইকেট পড়ার পর কপিল মাঠে এসেছিলেন এবং সত্যিই ১৭ রানে ভারতের পঞ্চম উইকেটের (যশপাল শর্মা) পতনও ঘটেছিল, যাতে এক শতাংশও মিথ্যে নেই। ঠিক তার এক বছর আগে। বিরাশির ক্যাম্প ন্যুতে ১৩ জুনের ঘটনা আর তার ‘ইন্টারপ্রিটেশন’, এখন পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলের মতো বললেও কম!
ম্যারাডোনার এই ছবিটা এবং ঘটনার কথা মনে পড়ে যাওয়ার কারণ সম্পূর্ণ অন্য। লন্ডন টাইমসে লিওনেল মেসিসংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো পড়তে পড়তে আরও একটি ছবিতে চোখ আটকে যাওয়া। গত বছর অ্যানফিল্ডে যে মাঠে বার্সেলোনা রক্ষণের শিশুসুলভ আত্মসমর্পণ ছিল লিভারপুলের বিরুদ্ধে (০-৪), সেই ম্যাচের।
এই ছবিতে কোনো ফ্রিকিক নেই, দূরে দাঁড়িয়ে পাস দেওয়ার তো কোনো ব্যাপারই নেই। যা ঘটেছে তারই ছবি। বল নিয়ে বেরোতে চাইছে মেসির বাঁ পা, লিভারপুলের পাঁচজন তাকে পাঁচদিক দিয়ে ঘিরে রয়েছেন, মেসির ভঙ্গিতে পরিষ্কার সামনের দিকে এগোচ্ছেন, নিজের গোলের দিকে মুখ করে নয়, বিপক্ষের গোলের দিকেই মুখ। একমাত্র তার পেছনদিকেই কেউ নেই। এবং লিভারপুলের পাঁচজনই বেশ কাছাকাছি, নজর প্রত্যেকেরই মেসির বাঁ পায়ে। জিল ফন ডিইককে দেখুন, তিনি কিন্তু নিজের বাঁ হাতের তর্জনী উঁচিয়ে ওই অবস্থাতেও নির্দেশ দিচ্ছেন দূরে-থাকা ডিফেন্ডারকে যে, বলটা ওই দিকেই পাঠাতে পারেন মেসি। এই মুহূর্তে ফুটবলবিশ্বের সেরা ডিফেন্ডার তো আর তাকে এমনি এমনিই বলা হচ্ছে না!
সমস্যা হলো, আজকের এই ডিজিটাইজড দুনিয়ায় ইন্টারনেট কানেকশনসহ একটি স্মার্টফোনের মালিক হলেই ফুটবল বিশেষজ্ঞ শুধু নয়, সব ব্যাপারেই বিশেষজ্ঞ যারা, এই ছবিটি কখনো ফরোয়ার্ড করেননি, করেন না। তারা ব্যাকওয়ার্ড বাটন টিপে বিরাশির সেই ছবিকে ছিয়াশির ছবি হিসাবে চালিয়ে যাচ্ছেন এখনো! লন্ডন টাইমস আবার পয়সা দিয়ে পড়তে হয়, গ্রাহক না হলে প্রতিটি লেখার তিন-চার লাইন বরাদ্দ, ব্যস! বিশ্বকাপে সব দলের প্র্যাকটিসে যেমন পনেরো মিনিট বরাদ্দ থাকে সাংবাদিকদের জন্য, যা শুনে এখন আইএসএল, এমনকি আই লিগেও চালু হয়েছে পনেরোর গেরো, তেমন। মাসে মাসে পাউন্ড গুনে লন্ডন টাইমস পড়ার চেয়ে ইংল্যান্ডের ফ্রি ট্যাবলোগুলো দেখে-দেখে (ওগুলোয় দেখার উপাদান বেশিই থাকে পড়ার চেয়ে!) ‘শিক্ষিত’ হয়ে-ওঠা অনেক বেশি সস্তা-সহজ।
লন্ডন টাইমসের লেখকদের বক্তব্য, কেন মেসির সিটিতে যোগদান উচিত বা অনুচিত, অন্য বিষয়। কিন্তু যা নিয়ে সন্দেহ নেই, লিভারপুলের বিরুদ্ধে ‘অভিমন্যু’ মেসির এই ছবিটা বাংলা সংবাদপত্রের পাতায় দেখবেন না কখনো!
ভারতের বিখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক
রাইট স্পোর্টসের সৌজন্যে
শেয়ার করুন
কাশীনাথ ভট্টাচার্য | ২৬ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০

মিথ মানেই কি মিথ্যে? কিংবা, উল্টোটাও মিথ্যে থেকেই কি জন্ম মিথের?
জানা নেই। তবে, ‘১৭ রানে ৫ উইকেট পড়ার পর’ মাঠে নেমে কপিল দেবের ১৭৫ রান করার মতো এবং টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যানদের বন্ধ-এর কারণে সেই ম্যাচের সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ থাকা সত্ত্বেও বহু ভারতীয়র তা ‘টিভিতে স্বচক্ষে দেখার’ মতো ‘মিথ্যে’ হয়ে উঠতে পারলে তবেই তা ‘মিথ’ স্তরে উন্নীত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করে, নির্জলা সত্যি!
ডিয়েগো ম্যারাডোনার একটি ছবি আছে। বহু আলোচিত। বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে। আজ্ঞে না, ছিয়াশি বিশ্বকাপের নয়, বিরাশির! খেলা হয়েছিল বার্সেলোনার কাম্প ন্যুতে। বিশ্বকাপের ঠিক আগে যে ক্লাবে সই করেছিলেন ম্যারাদোনা। ১৯৭৮-এ নিজেদের দেশে (যেভাবেই হোক!) বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে আর্জেন্টিনা খেলতে এসেছিল স্পেনে। আক্ষরিক অর্থে গোটাবিশ্ব তখন তাকিয়ে ম্যারাডোনার দিকে। সেই প্রথম ম্যাচ, বিশ্বকাপে, ম্যারাডোনার।
ম্যাচটা আর্জেন্টিনা হারে ০-১ গোলে। ম্যারাডোনা একেবারেই খেলতে পারেননি। গ্রুপ পর্বে আর্জেন্টিনা দ্বিতীয় হিসেবে শেষ করেছিল বেলজিয়ামের পেছনে। তারপর তো লিগের দ্বিতীয় পর্যায়ে ইতালি আর ব্রাজিলের কাছে হেরে, ব্রাজিলের বিরুদ্ধে খেলতে না-পারার হতাশায় লাথি মেরে লাল কার্ড দেখে ম্যারাডোনার বিদায়।
এই ছবিটা কিন্তু তখনো বেরোয়ইনি, কাগজে!
ডিজিটাল যুগ নয়। ছবি তখনো তোলা হতো ফিল্মে। আন্তর্জাতিক মঞ্চেও প্রতিবার শাটার টেপার আগে ভাবতেন চিত্রগ্রাহকরা। উদ্দিষ্ট যে ছবি আলোচনায়, ফটোগ্রাফার ছিলেন স্টিভ পাওয়েল। ছবি তুলছিলেন ‘স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড’-এর হয়ে। আন্তর্জাতিক ক্রীড়া পত্রিকার তরফে নিজের প্রথম ‘বড়’ কাজ। বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচে ক্যামেরা হাতে মাঠের ধারে। ক্যামেরার চোখে ধরে রাখতে হবে সবচেয়ে বড় তারকা হতে চলেছেন যিনি, ম্যারাডোনাকে। তাই ক্যামেরার চোখে সজাগ দৃষ্টি স্টিভের।
উদ্দিষ্ট ছবিটি তার ভালো লেগেছিল রঙের বৈপরীত্যে। ক্যাম্প ন্যুর সবুজ গালিচায় বেলজিয়ামের লাল জার্সি, সাতজনের মধ্যে ছয়জন তাকিয়ে আছে একজনের দিকে, কোন দিকে এগিয়ে যেতে পারেন ভাবনা নিয়ে পাওয়েল খুশিই হয়েছিলেন ছবিটা তুলে।
কিন্তু কাগজে কাজের ডেস্কে যা হয়, আর্জেন্টিনা হেরে গিয়েছে জঘন্য খেলে, ম্যারাডোনাও একেবারেই ভালো খেলেননি এই ছবি ছাপবে কেন? সংবাদপত্রের খেলা-ডেস্কে দীর্ঘদিন সময় কাটানোয় আন্দাজ করতেই পারি, সম্পাদক কী বলেছিলেন সংশ্লিষ্ট ফটোগ্রাফারকে। ‘এই ছবিটা পেয়েছ? অন্য কিছু দাও। বেলজিয়ামের গোলের ছবিটা নেই? নিয়ে এসো!’
তখনকার দিনে ফিল্ম থেকে প্রিন্ট করিয়ে ছবি দেওয়া হতো ক্রীড়া সম্পাদকের কাছে। যে-ছবি ছাপা হতো, মাপ নেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হতো স্কেল আর পেন বা পেনসিল। প্রথমে ছবিটা উল্টে পেছনের সাদা জমিতে কর্ণ আঁকতে হতো। এই বার এক/দুই বা তিন/চার কলমের মাপ অনুযায়ী ছবির একেবারে নিচ থেকে সেই কলমের মাপ পর্যন্ত সেন্টিমিটারের জায়গায় একটা বিন্দু দিয়ে বা সরলরেখা টেনে, ওই কর্ণ থেকে ওই বিন্দু যুক্ত হতো সরলরেখায়। সমকোণী ত্রিভুজের সেই লম্বই হলো তখন ছবির ‘হাইট’ আর কলম অনুযায়ী ভূমি ‘উইডথ’। এই বিরাট জ্ঞানভাণ্ডারের উৎস নয়ের দশকের শুরুর দিকে হাতে-কলমে দৈনিকের স্পোর্টস ডেস্কে কাজ!
যাক গে, ছবির মাপ শিক্ষার ক্লাস ছেড়ে ফুটবল মাঠে ফেরা যাক। পাওয়েলের সেই ছবি তো আর ছাপা হলো না! তাহলে, ছবিটা আজ ‘মিথ’ হয়ে উঠল কী করে?
কারণ, চার বছর পর যখন সত্যিই বেলজিয়ামকে ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা হারাল সেমিফাইনালে এবং দুটি গোল করলেন ম্যারাডোনা যার একটি উৎকর্ষে সেরা, ছবিটা পেল অযাচিত মূল্য!
ম্যারাডোনা এমনই ফুটবলার ছিলেন যে, ছয়জন সামনে এসেও আটকাতে পারছে না, এই ছবির চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী বোঝানো ও শেখানো হতো আমাদের মতো শিক্ষানবিস ক্রীড়া সাংবাদিকদের তো বটেই, বলা বা লেখাও হতো, হয়, এখনো হবে। ছিয়াশির পর যতবার বিশ্বকাপ ফুটবল হয়েছে, কোনো না কোনো সূত্রে সব কাগজের পাতায় বা বিশ্বকাপ সংক্রান্ত ‘স্পেশাল’-এ এই ছবির নিশ্চিত উপস্থিতি।
সত্যিটা অবশ্য তুলে ধরেছিল ম্যানচেস্টারের দ্য গার্ডিয়ান কাগজ, ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ চলাকালীন।
এই ছবি যা বলছে বাঁ পা দিয়ে ম্যারাডোনা বলটা পাস দিতে চলেছেন। তার সামনে ছয়জনের মুখ, যাদের তিনজন মাঝখানে প্রায় একলাইনে, দুজন ডানদিকে, একজন বাঁদিকে (আপনি ছবিটা যেভাবে দেখছেন, দিকের হিসাব সেভাবে)।
ছবির ‘ইন্টারপ্রিটেশন’ ছয়জনকে কাটিয়ে বল গোলে ঠেলতে চলেছেন ম্যারাডোনা। ছয়জন মিলেও তাকে ধরে রাখা যায় না, ঠিক পেরিয়ে আসেন এবং এভাবেই গোল করেন ম্যারাডোনা!
ঘটনা ফ্রিকিক পেয়েছিল আর্জেন্টিনা। নিয়েছিলেন আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি ওসভালদো আরদিলেস। শট না নিয়ে তিনি পাস দিয়েছিলেন ম্যারাডোনাকে যিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন বিপক্ষের ১৮ গজের বক্সের বাইরে, নিজের গোলের দিকে মুখ করে, বিপক্ষের ‘ওয়াল’-এর সঙ্গে এক লাইনে। বল যখন তার পায়ে কেউ তাকে বাধা দিতে আসার সুযোগই পাননি তখনো! সবে দেয়াল ছেড়ে বেরোতে শুরু করেছেন ফুটবলাররা, যে কারণে দুজন ছিটকেছেন বাঁদিকে, একজন ডানদিকে। মাঠে ফ্রিকিক হয়ে যাওয়ার পর যেভাবে ভাঙে দেয়াল।
কোথায় গোল, কোথায় গোলে বল ঠেলা, কোথায় ছয়জন মিলে তার অগ্রগতি আটকানোর চেষ্টা! এ তো ‘কপিলের ১৭ রানে ৫ উইকেট পড়ার পর’-এর লক্ষকোটিগুণ মিথ্যে! টেনব্রিজ ওয়েলস-এ সেই ১৮ জুন তো তবু ৯ রানে ৪ উইকেট পড়ার পর কপিল মাঠে এসেছিলেন এবং সত্যিই ১৭ রানে ভারতের পঞ্চম উইকেটের (যশপাল শর্মা) পতনও ঘটেছিল, যাতে এক শতাংশও মিথ্যে নেই। ঠিক তার এক বছর আগে। বিরাশির ক্যাম্প ন্যুতে ১৩ জুনের ঘটনা আর তার ‘ইন্টারপ্রিটেশন’, এখন পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলের মতো বললেও কম!
ম্যারাডোনার এই ছবিটা এবং ঘটনার কথা মনে পড়ে যাওয়ার কারণ সম্পূর্ণ অন্য। লন্ডন টাইমসে লিওনেল মেসিসংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো পড়তে পড়তে আরও একটি ছবিতে চোখ আটকে যাওয়া। গত বছর অ্যানফিল্ডে যে মাঠে বার্সেলোনা রক্ষণের শিশুসুলভ আত্মসমর্পণ ছিল লিভারপুলের বিরুদ্ধে (০-৪), সেই ম্যাচের।
এই ছবিতে কোনো ফ্রিকিক নেই, দূরে দাঁড়িয়ে পাস দেওয়ার তো কোনো ব্যাপারই নেই। যা ঘটেছে তারই ছবি। বল নিয়ে বেরোতে চাইছে মেসির বাঁ পা, লিভারপুলের পাঁচজন তাকে পাঁচদিক দিয়ে ঘিরে রয়েছেন, মেসির ভঙ্গিতে পরিষ্কার সামনের দিকে এগোচ্ছেন, নিজের গোলের দিকে মুখ করে নয়, বিপক্ষের গোলের দিকেই মুখ। একমাত্র তার পেছনদিকেই কেউ নেই। এবং লিভারপুলের পাঁচজনই বেশ কাছাকাছি, নজর প্রত্যেকেরই মেসির বাঁ পায়ে। জিল ফন ডিইককে দেখুন, তিনি কিন্তু নিজের বাঁ হাতের তর্জনী উঁচিয়ে ওই অবস্থাতেও নির্দেশ দিচ্ছেন দূরে-থাকা ডিফেন্ডারকে যে, বলটা ওই দিকেই পাঠাতে পারেন মেসি। এই মুহূর্তে ফুটবলবিশ্বের সেরা ডিফেন্ডার তো আর তাকে এমনি এমনিই বলা হচ্ছে না!
সমস্যা হলো, আজকের এই ডিজিটাইজড দুনিয়ায় ইন্টারনেট কানেকশনসহ একটি স্মার্টফোনের মালিক হলেই ফুটবল বিশেষজ্ঞ শুধু নয়, সব ব্যাপারেই বিশেষজ্ঞ যারা, এই ছবিটি কখনো ফরোয়ার্ড করেননি, করেন না। তারা ব্যাকওয়ার্ড বাটন টিপে বিরাশির সেই ছবিকে ছিয়াশির ছবি হিসাবে চালিয়ে যাচ্ছেন এখনো! লন্ডন টাইমস আবার পয়সা দিয়ে পড়তে হয়, গ্রাহক না হলে প্রতিটি লেখার তিন-চার লাইন বরাদ্দ, ব্যস! বিশ্বকাপে সব দলের প্র্যাকটিসে যেমন পনেরো মিনিট বরাদ্দ থাকে সাংবাদিকদের জন্য, যা শুনে এখন আইএসএল, এমনকি আই লিগেও চালু হয়েছে পনেরোর গেরো, তেমন। মাসে মাসে পাউন্ড গুনে লন্ডন টাইমস পড়ার চেয়ে ইংল্যান্ডের ফ্রি ট্যাবলোগুলো দেখে-দেখে (ওগুলোয় দেখার উপাদান বেশিই থাকে পড়ার চেয়ে!) ‘শিক্ষিত’ হয়ে-ওঠা অনেক বেশি সস্তা-সহজ।
লন্ডন টাইমসের লেখকদের বক্তব্য, কেন মেসির সিটিতে যোগদান উচিত বা অনুচিত, অন্য বিষয়। কিন্তু যা নিয়ে সন্দেহ নেই, লিভারপুলের বিরুদ্ধে ‘অভিমন্যু’ মেসির এই ছবিটা বাংলা সংবাদপত্রের পাতায় দেখবেন না কখনো!
ভারতের বিখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক
রাইট স্পোর্টসের সৌজন্যে