কারখানার বদলে কলাগাছ
শোয়েব চৌধুরী, হবিগঞ্জ | ৯ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০
জমির অভাবে প্রকৃত শিল্প উদ্যোক্তারা যখন হবিগঞ্জে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) শিল্পনগরীতে কারখানা গড়তে পারছেন না, তখন এর উল্টো চিত্রও রয়েছে সেখানে। প্লট বরাদ্দের পর নীতিমালা ভঙ্গ করে কারখানা না গড়েই কিছু প্রভাবশালী বছরের পর বছর জমি খালি ফেলে রেখেছেন এ শিল্পনগরীটিতে। প্লট বরাদ্দ নিয়ে বছরের পর বছর কারখানা গড়েননি, সেখানে এমন তালিকায় রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের এমপি পরিবার থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। তারা ৮ থেকে ১৩ বছর ধরে প্লট বরাদ্দ নিয়ে খালি রেখেছেন। যদিও সুনির্দিষ্ট শিল্পকারখানা করার প্রকল্প প্রস্তাবের ভিত্তিতেই প্লট বরাদ্দ নিয়েছিলেন এরা।
নির্দিষ্ট সময়ে উৎপাদনে যেতে ব্যর্থ এসব প্লট মালিকের বরাদ্দ বাতিল করে তা প্রকৃত উদ্যোক্তাদের মধ্যে বরাদ্দের নিয়ম থাকলেও এ ব্যাপারে বিসিক কর্র্তৃপক্ষ কঠোর নয় বলে অভিযোগ উঠেছে। আর শুধু তাই নয়, বিসিকের জমির কিস্তি মূল্য, সার্ভিস চার্জ ও খাজনা বাবদ মোটা অঙ্কের টাকাও বকেয়া পড়ে আছে অনেকের কাছে। এসব ব্যর্থতার জন্য বিসিক কর্মকর্তাদের উদাসীনতা ও গাফিলতিকে দায়ী করছেন অনেক উদ্যোক্তা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ‘হবিগঞ্জ টেক্সটাইল’ নামে একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য ২০১২ সালে ১৮ জুলাই হবিগঞ্জ বিসিকে শিক্ষার্থী ইফাত জামিলের নামে সাড়ে ১৩ হাজার বর্গফুট (প্রায় ৩১ শতক) জমি বরাদ্দ নেওয়া হয়। তিনি হবিগঞ্জ সদর আসনের সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু জাহিরের একমাত্র ছেলে। ‘মুক্তি টেক্সটাইল’-এর নামে একই তারিখে একই পরিমাণ জমি বরাদ্দ পান যুবলীগের সৌদি আরবের জেদ্দা শাখার সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া চৌধুরী। হবিগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাচ্ছিরুল ইসলামকে টেক্সটাইল মিলের জন্য ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর সাড়ে ৪ হাজার বর্গফুট (৯ শতক) জমি হস্তান্তর করে বিসিক। এছাড়া হাজি শফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি সিরামিক কারখানার জন্য ২০০৮ সালের ১৬ অক্টোবর ৯ হাজার বর্গফুট (সাড়ে ২০ শতক) এবং শাহ আলম বাবু ২০১৭ সালের ২২ মার্চ সাড়ে ১৩ হাজার বর্গফুট (৩১ শতক) জমি বরাদ্দ নেন। কিন্তু আজও এসব ‘শিল্প উদ্যোক্তারা’ তাদের জায়গায় কারখানা গড়ে তোলেননি। একই অবস্থা সান কেমিক্যাল কমপ্লেক্সেরও। ২০০৮ সালে গোলাম মর্তুজা চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানটির নামে ৫ হাজার ২০০ বর্গফুট (প্রায় ১২ শতক) জায়গা বরাদ্দ পাওয়ার পরও এখনো কারখানা গড়ে তোলেননি।
সরেজমিন দেখা গেছে, সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু জাহিরের ছেলে ইফাত জামিলের শিল্পপ্লটে টেক্সটাইল মিলের জায়গায় কলাগাছ শোভা পাচ্ছে। আর ফাঁকা অন্যান্য প্লট লম্বা ঘাস আর লতাপাতায় ভরে আছে। শিল্পনগরীর কয়েকজন শ্রমিক জানান, খালি প্লটগুলোতে দিনে গরু চড়ে আর রাতে শিয়ালের হাঁকডাকে সরগরম থাকে।
বিসিক শিল্পনগরীর প্লট বরাদ্দের নীতিমালা অনুযায়ী, প্লটের দখল বুঝে নেওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে কারখানা ভবনের লে-আউট প্ল্যান শিল্পনগরীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে দাখিল করতে হবে। লে-আউট প্ল্যান ১৫ দিনের মধ্যে অনুমোদনের পর নির্মাণকাজ শেষ করতে হবে ১৮ মাসের মধ্যে। এছাড়া তিন মাসের মধ্যে যন্ত্রপাতি স্থাপনের পর এক মাসের মধ্যে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করতে হবে। পরীক্ষামূলক উৎপাদনের দুই মাসের মধ্যে শুরু করতে হবে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন। উল্লিখিত সময়সূচির কোনো ব্যত্যয় ঘটলে কোনো নোটিস ছাড়াই প্লটের বরাদ্দ বাতিল বলে গণ্য হবে বলে উল্লেখ রয়েছে নীতিমালায়। কিন্তু সেই নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কোনো কোনো প্লটমালিক প্রায় ৮ থেকে ১৩ বছর ধরে জমি খালি রেখেছেন। তাদের মধ্যে আট বছর প্লট খালি রাখার পর সম্প্রতি কারখানার ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন হবিগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি মোতাচ্ছিরুল ইসলাম।
হবিগঞ্জ বিসিক কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বছরে কমপক্ষে তিনবার ভূমি বরাদ্দ কমিটির (এলএসি) সভা করার নির্দেশ থাকলেও সর্বশেষ ২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর কমিটির ৩৯তম সভা তৎকালীন জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদের সভাপতিত্বে হয়। এরপর আর কোনো সভা আহ্বান করা হয়নি। ভূমি বরাদ্দ নেওয়ার পর কারখানা দৃশ্যমান হয়নি এমন প্লটমালিকদের বিরুদ্ধে বিসিক কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে বলেও তথ্য পাওয়া যায়নি।
দেশ রূপান্তরের হাতে আসা গত ২০১৬ থেকে ’১৮ সাল পর্যন্ত এলএসি সভার আলোচ্য বিষয় ও সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, উল্লিখিত সভাগুলোতে উদ্যোক্তা জমি বরাদ্দ পাওয়ার পরও শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা না করায় শুধু ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়া সভার সিদ্ধান্ত চিঠির মাধ্যমে পাঠানো ও ব্যক্তিগতভাবে তাগাদা প্রদান ছাড়া আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এদিকে প্রভাবশালীরা প্লট বরাদ্দ নিয়ে বছরের পর বছর খালি ফেলে রাখলেও জমির অভাবে প্রকৃত শিল্প উদ্যোক্তারা হবিগঞ্জ বিসিক শিল্পনগরীতে শিল্পকারখানা গড়তে পারছেন না বলে তথ্য মিলেছে। যুক্তরাজ্য প্রবাসী মিজানুর রহমান চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা কয়েকজন প্রবাসী মিলে বিসিক শিল্পনগরীতে একটি শিল্পকারখানা গড়ার ইচ্ছে ছিল। দেশে এসে বহুবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু জায়গা পাইনি।’
হবিগঞ্জ বিসিক থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সেখানে মোট ৬৮টি প্লটের মধ্যে ৫১টি বাস্তবায়িত শিল্প ইউনিট রয়েছে। তার মধ্যে বর্তমানে ৪৩টি কারখানা চালু এবং ৫টি বন্ধ রয়েছে। প্লট বরাদ্দ পাওয়া বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাছে মোট ৩৪ লাখ ২ হাজার টাকা বকেয়া পড়ে আছে। বকেয়ার মধ্যে রয়েছে জমির কিস্তি ১৫ লাখ ৬৪ হাজার ৩৮৮ টাকা, সার্ভিস চার্জ ১৭ লাখ ১৯ হাজার ১৮৭ টাকা এবং খাজনা বাবদ ১ লাখ ১৮ হাজার ২৫৮ টাকা।
জমি বরাদ্দ পাওয়ার আট বছরেও কারখানা না গড়ার কারণ জানতে হবিগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু জাহিরের মোবাইল ফোনে গত দুদিন ধরে কয়েকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে কল করার কারণ জানিয়ে মেসেজ পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
একই বিষয়ে জানতে চাইলে প্রস্তাবিত মুক্তি টেক্সটাইলের মালিক জাকারিয়া চৌধুরীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিসিক থেকে কয়টি নোটিস পেয়েছি তা এই মুহূর্তে বলতে পারব না। তবে দ্রুতই কারখানার কাজ শুরু করব।’
অন্যদিকে মেসার্স শামীম চায়না বাংলা সিরামিকসের মালিক হাজি শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বিসিক আমার প্লট বাতিল করলে আমি আদালতে মামলা করি। পরবর্তীকালে বিসিক চেয়ারম্যানের মধ্যস্থতায় মামলা শেষ হয়েছে। মিলের কাজ দ্রুতই শুরু করব।’ তবে শিল্পনগরীর কর্মকর্তা আল আমিন ভূঁইয়া বলেন, ‘শফিকুল ইসলাম মামলা তুলে নেওয়ার কথা বললেও মামলা তোলেননি। শুধু সময়ক্ষেপণ করছেন।’
এ বিসিক কর্মকর্তা আরও জানান, একইভাবে হাসান কটন রিফাইনারির মালিক আবদুল কাইয়ুম প্লট বাতিলের পর মামলা করে সেই মামলা তুলে নিয়ে মিলের কাজ শুরু করবেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনিও কাজ শুরু করেননি। ২০০২ সালে ৬ হাজার বর্গফুট (সাড়ে ১৩ শতক) জমি বরাদ্দ নিয়েছিলেন কাইয়ুম। কারখানা স্থাপন না করায় ভূমি বরাদ্দ বাতিল করা হলে তিনি আদালতে মামলা করেছিলেন।
বিসিক কর্মকর্তাদের উদাসীনতা ও গাফিলতির কারণে প্রভাবশালীরা প্লট বরাদ্দ নিয়ে তা খালি ফেলে রাখার সুযোগ পাচ্ছেন এমন অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে হবিগঞ্জ বিসিকের ভারপ্রাপ্ত সহকারী ব্যবস্থাপক নাজমুল হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘করোনার কারণে মূলত এলএসি সভা করতে পারিনি। এছাড়া ভূমি বরাদ্দ দেওয়ার জন্য জায়গা না থাকায় সে কারণেও বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তারপরও কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে শিগগিরই এলএসি সভা আহ্বান করব।’
অন্যদিকে হবিগঞ্জ বিসিকের ভূমি বরাদ্দ কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন এলএসি সভা হচ্ছে না এটা ঠিক। তবে চলতি জানুয়ারি মাসেই এ সম্পর্কিত সভা আহ্বান করা হবে।’
১৯৮৬ সালে হবিগঞ্জের শহরতলি ধূলিয়াখালে বিসিকের জন্য ১৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়। এরপর ১৯৮৭ সালে সেখানে রাস্তা, ড্রেন ও প্রশাসনিক ভবন বাদে ১১ দশমিক ৫৭ একর জায়গায় মোট ৬৯টি শিল্প প্লট গড়ে তোলা হয়।
শেয়ার করুন
শোয়েব চৌধুরী, হবিগঞ্জ | ৯ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০

জমির অভাবে প্রকৃত শিল্প উদ্যোক্তারা যখন হবিগঞ্জে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) শিল্পনগরীতে কারখানা গড়তে পারছেন না, তখন এর উল্টো চিত্রও রয়েছে সেখানে। প্লট বরাদ্দের পর নীতিমালা ভঙ্গ করে কারখানা না গড়েই কিছু প্রভাবশালী বছরের পর বছর জমি খালি ফেলে রেখেছেন এ শিল্পনগরীটিতে। প্লট বরাদ্দ নিয়ে বছরের পর বছর কারখানা গড়েননি, সেখানে এমন তালিকায় রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের এমপি পরিবার থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। তারা ৮ থেকে ১৩ বছর ধরে প্লট বরাদ্দ নিয়ে খালি রেখেছেন। যদিও সুনির্দিষ্ট শিল্পকারখানা করার প্রকল্প প্রস্তাবের ভিত্তিতেই প্লট বরাদ্দ নিয়েছিলেন এরা।
নির্দিষ্ট সময়ে উৎপাদনে যেতে ব্যর্থ এসব প্লট মালিকের বরাদ্দ বাতিল করে তা প্রকৃত উদ্যোক্তাদের মধ্যে বরাদ্দের নিয়ম থাকলেও এ ব্যাপারে বিসিক কর্র্তৃপক্ষ কঠোর নয় বলে অভিযোগ উঠেছে। আর শুধু তাই নয়, বিসিকের জমির কিস্তি মূল্য, সার্ভিস চার্জ ও খাজনা বাবদ মোটা অঙ্কের টাকাও বকেয়া পড়ে আছে অনেকের কাছে। এসব ব্যর্থতার জন্য বিসিক কর্মকর্তাদের উদাসীনতা ও গাফিলতিকে দায়ী করছেন অনেক উদ্যোক্তা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ‘হবিগঞ্জ টেক্সটাইল’ নামে একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য ২০১২ সালে ১৮ জুলাই হবিগঞ্জ বিসিকে শিক্ষার্থী ইফাত জামিলের নামে সাড়ে ১৩ হাজার বর্গফুট (প্রায় ৩১ শতক) জমি বরাদ্দ নেওয়া হয়। তিনি হবিগঞ্জ সদর আসনের সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু জাহিরের একমাত্র ছেলে। ‘মুক্তি টেক্সটাইল’-এর নামে একই তারিখে একই পরিমাণ জমি বরাদ্দ পান যুবলীগের সৌদি আরবের জেদ্দা শাখার সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া চৌধুরী। হবিগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাচ্ছিরুল ইসলামকে টেক্সটাইল মিলের জন্য ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর সাড়ে ৪ হাজার বর্গফুট (৯ শতক) জমি হস্তান্তর করে বিসিক। এছাড়া হাজি শফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি সিরামিক কারখানার জন্য ২০০৮ সালের ১৬ অক্টোবর ৯ হাজার বর্গফুট (সাড়ে ২০ শতক) এবং শাহ আলম বাবু ২০১৭ সালের ২২ মার্চ সাড়ে ১৩ হাজার বর্গফুট (৩১ শতক) জমি বরাদ্দ নেন। কিন্তু আজও এসব ‘শিল্প উদ্যোক্তারা’ তাদের জায়গায় কারখানা গড়ে তোলেননি। একই অবস্থা সান কেমিক্যাল কমপ্লেক্সেরও। ২০০৮ সালে গোলাম মর্তুজা চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানটির নামে ৫ হাজার ২০০ বর্গফুট (প্রায় ১২ শতক) জায়গা বরাদ্দ পাওয়ার পরও এখনো কারখানা গড়ে তোলেননি।
সরেজমিন দেখা গেছে, সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু জাহিরের ছেলে ইফাত জামিলের শিল্পপ্লটে টেক্সটাইল মিলের জায়গায় কলাগাছ শোভা পাচ্ছে। আর ফাঁকা অন্যান্য প্লট লম্বা ঘাস আর লতাপাতায় ভরে আছে। শিল্পনগরীর কয়েকজন শ্রমিক জানান, খালি প্লটগুলোতে দিনে গরু চড়ে আর রাতে শিয়ালের হাঁকডাকে সরগরম থাকে।
বিসিক শিল্পনগরীর প্লট বরাদ্দের নীতিমালা অনুযায়ী, প্লটের দখল বুঝে নেওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে কারখানা ভবনের লে-আউট প্ল্যান শিল্পনগরীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে দাখিল করতে হবে। লে-আউট প্ল্যান ১৫ দিনের মধ্যে অনুমোদনের পর নির্মাণকাজ শেষ করতে হবে ১৮ মাসের মধ্যে। এছাড়া তিন মাসের মধ্যে যন্ত্রপাতি স্থাপনের পর এক মাসের মধ্যে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করতে হবে। পরীক্ষামূলক উৎপাদনের দুই মাসের মধ্যে শুরু করতে হবে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন। উল্লিখিত সময়সূচির কোনো ব্যত্যয় ঘটলে কোনো নোটিস ছাড়াই প্লটের বরাদ্দ বাতিল বলে গণ্য হবে বলে উল্লেখ রয়েছে নীতিমালায়। কিন্তু সেই নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কোনো কোনো প্লটমালিক প্রায় ৮ থেকে ১৩ বছর ধরে জমি খালি রেখেছেন। তাদের মধ্যে আট বছর প্লট খালি রাখার পর সম্প্রতি কারখানার ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন হবিগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি মোতাচ্ছিরুল ইসলাম।
হবিগঞ্জ বিসিক কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বছরে কমপক্ষে তিনবার ভূমি বরাদ্দ কমিটির (এলএসি) সভা করার নির্দেশ থাকলেও সর্বশেষ ২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর কমিটির ৩৯তম সভা তৎকালীন জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদের সভাপতিত্বে হয়। এরপর আর কোনো সভা আহ্বান করা হয়নি। ভূমি বরাদ্দ নেওয়ার পর কারখানা দৃশ্যমান হয়নি এমন প্লটমালিকদের বিরুদ্ধে বিসিক কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে বলেও তথ্য পাওয়া যায়নি।
দেশ রূপান্তরের হাতে আসা গত ২০১৬ থেকে ’১৮ সাল পর্যন্ত এলএসি সভার আলোচ্য বিষয় ও সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, উল্লিখিত সভাগুলোতে উদ্যোক্তা জমি বরাদ্দ পাওয়ার পরও শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা না করায় শুধু ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়া সভার সিদ্ধান্ত চিঠির মাধ্যমে পাঠানো ও ব্যক্তিগতভাবে তাগাদা প্রদান ছাড়া আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এদিকে প্রভাবশালীরা প্লট বরাদ্দ নিয়ে বছরের পর বছর খালি ফেলে রাখলেও জমির অভাবে প্রকৃত শিল্প উদ্যোক্তারা হবিগঞ্জ বিসিক শিল্পনগরীতে শিল্পকারখানা গড়তে পারছেন না বলে তথ্য মিলেছে। যুক্তরাজ্য প্রবাসী মিজানুর রহমান চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা কয়েকজন প্রবাসী মিলে বিসিক শিল্পনগরীতে একটি শিল্পকারখানা গড়ার ইচ্ছে ছিল। দেশে এসে বহুবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু জায়গা পাইনি।’
হবিগঞ্জ বিসিক থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সেখানে মোট ৬৮টি প্লটের মধ্যে ৫১টি বাস্তবায়িত শিল্প ইউনিট রয়েছে। তার মধ্যে বর্তমানে ৪৩টি কারখানা চালু এবং ৫টি বন্ধ রয়েছে। প্লট বরাদ্দ পাওয়া বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাছে মোট ৩৪ লাখ ২ হাজার টাকা বকেয়া পড়ে আছে। বকেয়ার মধ্যে রয়েছে জমির কিস্তি ১৫ লাখ ৬৪ হাজার ৩৮৮ টাকা, সার্ভিস চার্জ ১৭ লাখ ১৯ হাজার ১৮৭ টাকা এবং খাজনা বাবদ ১ লাখ ১৮ হাজার ২৫৮ টাকা।
জমি বরাদ্দ পাওয়ার আট বছরেও কারখানা না গড়ার কারণ জানতে হবিগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু জাহিরের মোবাইল ফোনে গত দুদিন ধরে কয়েকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে কল করার কারণ জানিয়ে মেসেজ পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
একই বিষয়ে জানতে চাইলে প্রস্তাবিত মুক্তি টেক্সটাইলের মালিক জাকারিয়া চৌধুরীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিসিক থেকে কয়টি নোটিস পেয়েছি তা এই মুহূর্তে বলতে পারব না। তবে দ্রুতই কারখানার কাজ শুরু করব।’
অন্যদিকে মেসার্স শামীম চায়না বাংলা সিরামিকসের মালিক হাজি শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বিসিক আমার প্লট বাতিল করলে আমি আদালতে মামলা করি। পরবর্তীকালে বিসিক চেয়ারম্যানের মধ্যস্থতায় মামলা শেষ হয়েছে। মিলের কাজ দ্রুতই শুরু করব।’ তবে শিল্পনগরীর কর্মকর্তা আল আমিন ভূঁইয়া বলেন, ‘শফিকুল ইসলাম মামলা তুলে নেওয়ার কথা বললেও মামলা তোলেননি। শুধু সময়ক্ষেপণ করছেন।’
এ বিসিক কর্মকর্তা আরও জানান, একইভাবে হাসান কটন রিফাইনারির মালিক আবদুল কাইয়ুম প্লট বাতিলের পর মামলা করে সেই মামলা তুলে নিয়ে মিলের কাজ শুরু করবেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনিও কাজ শুরু করেননি। ২০০২ সালে ৬ হাজার বর্গফুট (সাড়ে ১৩ শতক) জমি বরাদ্দ নিয়েছিলেন কাইয়ুম। কারখানা স্থাপন না করায় ভূমি বরাদ্দ বাতিল করা হলে তিনি আদালতে মামলা করেছিলেন।
বিসিক কর্মকর্তাদের উদাসীনতা ও গাফিলতির কারণে প্রভাবশালীরা প্লট বরাদ্দ নিয়ে তা খালি ফেলে রাখার সুযোগ পাচ্ছেন এমন অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে হবিগঞ্জ বিসিকের ভারপ্রাপ্ত সহকারী ব্যবস্থাপক নাজমুল হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘করোনার কারণে মূলত এলএসি সভা করতে পারিনি। এছাড়া ভূমি বরাদ্দ দেওয়ার জন্য জায়গা না থাকায় সে কারণেও বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তারপরও কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে শিগগিরই এলএসি সভা আহ্বান করব।’
অন্যদিকে হবিগঞ্জ বিসিকের ভূমি বরাদ্দ কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন এলএসি সভা হচ্ছে না এটা ঠিক। তবে চলতি জানুয়ারি মাসেই এ সম্পর্কিত সভা আহ্বান করা হবে।’
১৯৮৬ সালে হবিগঞ্জের শহরতলি ধূলিয়াখালে বিসিকের জন্য ১৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়। এরপর ১৯৮৭ সালে সেখানে রাস্তা, ড্রেন ও প্রশাসনিক ভবন বাদে ১১ দশমিক ৫৭ একর জায়গায় মোট ৬৯টি শিল্প প্লট গড়ে তোলা হয়।