চাঙ্গা বাজারে তদন্তের বাগড়া
নিজস্ব প্রতিবেদক | ১৩ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০
পুঁজিবাজার ধসের ১০ বছর পর করোনার মধ্যে সরকারের নানামুখী উদ্যোগে চাঙ্গাভাব ফিরে এসেছে। পুঁজিবাজারে তারল্য বাড়াতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর বিভিন্ন পদক্ষেপ তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারের দরের ওপরও প্রভাব ফেলেছে। অনেক শেয়ারের দর স্বল্প সময়ের ব্যবধানে কয়েকগুণ পর্যন্ত বেড়েছে। দীর্ঘদিন পর গতি ফিরে আসায় সাইড লাইনে থাকা বিনিয়োগকারীরাও ফিরে এসেছেন বাজারে। ফলে লেনদেনও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। সূচকও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। পুঁজিবাজারের এমন চাঙ্গাভাবের মধ্যেই কারসাজি হচ্ছে কি-না, তা খতিয়ে দেখতে এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় তদন্তে নেমেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)।
পুঁজিবাজারে গত ৩০ কার্যদিবসে যেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম ৫০ শতাংশ বেড়েছে বা কমেছে, সেসব কোম্পানির শেয়ার লেনদেন তদন্ত করতে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জকে নির্দেশ দিয়েছে এসইসি। এসব কোম্পানির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কোনো কারসাজি, ইনসাইডার ট্রেডিং বা অন্য কোনো কারণ রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতেই তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে যেসব কোম্পানির প্রান্তিক কিংবা বার্ষিক আয় আগের বছরের তুলনায় ৫০ শতাংশ বা তার বেশি তারতম্য ঘটেছে, তাও খতিয়ে দেখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গতকাল এসইসির উপপরিচালক মোহাম্মদ শামসুর রহমান স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত নির্দেশ স্টক এক্সচেঞ্জ দুটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তার (সিআরও) কাছে পাঠানো হয়েছে।
ওই নির্দেশনায় গত এক মাসে যেসব কোম্পানির শেয়ারের লেনদেন আগের ছয় মাসের তুলনায় পাঁচ গুণ বা তার চেয়ে বেশি বেড়েছে, তাও তদন্ত করতে বলেছে এসইসি। এছাড়া কোনো কোম্পানির মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশের আগের ১০ দিনে শেয়ারের মূল্য ও লেনদেন ৩০ শতাংশ বা তার কম-বেশি বেড়ে থাকলে তাতে কোনো কারসাজি বা ইনসাইডার ট্রেডিং হয়েছে কি না, সেটিও খুঁজে দেখবে স্টক এক্সচেঞ্জ। তবে এসইসির নির্দেশনায় সুনির্দিষ্টভাবে কোনো কোম্পানির বিরুদ্ধে তদন্তের কথা বলা হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদন ৪৫ কার্যবিসের মধ্যে এসইসিতে জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এসইসি তদন্তে যে ধরনের ক্রাইটেরিয়া নির্ধারণ করে দিয়েছে, তাতে করে অন্তত ৩০টি কোম্পানির শেয়ারের লেনদেন ও অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির বিষয়টি তদন্ত করতে হবে। এটি ২০১০ সালের পর কারসাজি ও ইনসাইডার ট্রেডিং ইস্যুতে সবচেয়ে বড় তদন্ত বলে জানা গেছে। কমিশনের এ ধরনের উদ্যোগের ফলে শেয়ারের দর ও লেনদেন দুটিরই পতন হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিনিয়োগকারীরা।
গত কয়েক মাস ধরে বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজারে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে হঠাৎ করেই বড় আকারের তদন্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বিনিয়োগকারীরা শঙ্কায় রয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্রোকারেজ হাউজের কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরে পুঁজিবাজারে মন্দা ভাব থাকার কারণে অধিকাংশ শেয়ার অবমূল্যায়িত ছিল। এখন চাঙ্গা ভাবের কারণে কিছু শেয়ারের দর বেড়েছে। আর এই চাঙ্গা ভাব দেখে যারা নতুন করে বিনিয়োগে এসেছেন, তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে পড়বেন। তবে কমিশন মনে করছে, বাজারের স্বচ্ছতা ও গভীরতা বাড়াতে কারসাজিকারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও প্রয়োজন রয়েছে এবং এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
এ বিষয়ে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বাণিজ্য অনুষদের অধ্যাপক মোহাম্মদ মুসা বলেন, এ ধরনের তদন্তের উদ্যোগের একটি ইতিবাচক দিক হলো, বাজারে যদি কারসাজি হয়ে থাকে, তাহলে সেটা সাময়িকভাবে বন্ধ হবে। আর নেতিবাচক দিক হলো, এ ধরনের তদন্তে পুরো পুঁজিবাজারে আবার শেয়ারের মূল্য কমবে। এ সময়ে অনেকেই ভীত হয়ে শেয়ার বিক্রি করতে চাইবে। শেয়ারের দর কমবে। এতে বাজারে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি হবে।
তবে এসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো ভীতি তৈরির উদ্দেশ্যে নয়, বরং বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তার জন্যই এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কোনো ধরনের ‘রং ডুয়িং’ যাতে না থাকে, সে জন্যই এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তদন্তের জন্য কিছু ক্রাইটেরিয়া ঠিক করে দেওয়া হয়েছে, যা শুধু এখনকার জন্য নয়, বছরব্যাপী চলবে। আর শুধু অস্বাভাবিকভাবে শেয়ারদর বৃদ্ধিই নয়, কমলেও তদন্ত হবে।
২০২০ সালের মে মাসে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের নেতৃত্বে নতুন কমিশন এসইসির দায়িত্ব নেওয়ার পর জুন মাস থেকে পুঁজিবাজার ধীরে ধীরে গতি ফিরে পায়। এ সময় সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এসইসির নানা উদ্যোগে পুঁজিবাজারে তহবিল বাড়ানোর উদ্যোগ ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিশেষ তহবিল গঠনে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিত শেয়ার ধারণ ৩০ শতাংশ করার নির্দেশনা এবং জেড ক্যাটাগরির কোম্পানির উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কমিশনের উদ্যোগ বাজারে চাঙ্গা ভাব ফেরাতে সহায়তা করে। এছাড়া ইলেকট্রনিক জায়ান্ট কোম্পানি ওয়ালটন ও দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ মোবাইল ফোন অপারেটর রবি আজিয়াটার তালিকাভুক্তি বাজারে গতি সঞ্চার করে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে দেশের ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ব্রোকারেজ হাউজের বুথ খোলার অনুমোদন দেয় এসইসি। ব্রোকারেজ হাউজের শাখা খোলার ওপর এক দশকের নিষেধাজ্ঞাও তুলে নেওয়া হয়।
কমিশনের বিভিন্ন পদক্ষেপে সাইডলাইনে থাকা বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারে নতুন করে বিনিয়োগে আসেন। এতে করে শেয়ারের চাহিদা বেড়ে গিয়ে স্বল্প সময়ে সূচক ও লেনদেনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) লেনদেন এক দিনে আড়াই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। আর শেয়ারের অব্যাহত দরবৃদ্ধিতে ডিএসইর প্রধান সূচক ছয় মাসে ৪০ শতাংশ বেশি বেড়ে ৫৮৬১ পয়েন্টে উন্নীত হয়।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পুঁজিবাজারে অস্বাভাবিক হারে শেয়ার দরবৃদ্ধি শুরু হয় বীমা খাত নিয়ে। গত জুলাই থেকে পুরো বীমা খাতের শেয়ার নিয়ে কারসাজি হয় এবং খাতটির অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারদর মাত্র দুই মাসে কয়েক গুণ পর্যন্ত বাড়ে। এরপর গত নভেম্বর থেকে উৎপাদনমুখী ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাতের শেয়ারদর বাড়তে শুরু করে। গত বছরের শেষ সময়ে এসে এসব শেয়ারের দর আরও বাড়তে শুরু করে। একই সঙ্গে লেনদেনও অস্বাভাবিক হারে বাড়তে দেখা যায়। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে ডিএসইর লেনদেন ২০০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়। আর নতুন আইপিওর লেনদেনে আরও বেশি অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। অভিহিত মূল্যে আসা শেয়ারগুলো অন্তত চারগুণ দাম বাড়ার পর সেকেন্ডারি বাজারের বিনিয়োগকারীদের হাতে আসে। আর রবি আজিয়াটার শেয়ার দর টানা ১২ কার্যদিবস ধরে সর্বোচ্চ দরে লেনদেন হচ্ছে। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের এ শেয়ারটির দর ৫৩২ শতাংশ বেড়ে ৬৩ টাকা ২০ পয়সায় উন্নীত হয়েছে। যদিও প্রথম নয় মাসে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) মাত্র ২৫ পয়সা। একই ধারা দেখা গেছে, আইপিওতে আসা অ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেনের ক্ষেত্রেও।
শুধু আইপিও শেয়ার নয়, পুরনো বেশকিছু কোম্পানি রয়েছে, যেগুলোর দর সম্প্রতি দ্বিগুণ-তিন গুণ হয়ে গেছে। গত এক মাসে বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারদর বেড়েছে ১৫৫ শতাংশ। গত এক মাসে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান বে-লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের শেয়ারদর বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। এছাড়া লংকাবাংলা ফাইন্যান্স, মাইডাস ফাইন্যান্স, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, প্রিমিয়ার লিজিং ও প্রাইম ফাইন্যান্সের শেয়ারদর ও লেনদেন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। ব্যাংক খাতের মধ্যে আইএফআইসি ও এনবিএলের শেয়ারদর ও লেনদন গত এক মাস ধরেই বাড়তে দেখা গেছে। এর বাইরে গত ৩০ কার্যদিবসে ৫০ শতাংশের বেশি দর বৃদ্ধি পাওয়া কোম্পানিগুলো হচ্ছে ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স, ডমিনেজ স্টিল, লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ, ম্যাকসন্স স্পিনিং, অ্যাপোলো ইস্পাত, অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যালস, সাইফ পাওয়ার, জিবিবি পাওয়ার, এসএস স্টিল, ওয়ালটন, অলটেক্স, ডেল্টা স্পিনিং ও আরডি ফুড।
এর আগে সব ধরনের বিনিয়োগকারীরা জড়িয়ে পড়ায় পুরো বীমা খাতের বাজার মূলধন মাত্র দুই মাসে দ্বিগুণ হয়। ওই সময় লেনদেনের ৪০ শতাংশের বেশি সাধারণ বীমা খাতে হতে দেখা গেছে। যদিও এসইসির ক্রাইটেরিয়ার কারণে বীমা খাতের কোনো শেয়ার তদন্তের আওতায় পড়বে না।
পুঁজিবাজারের এই চাঙ্গা ভাবের কারণে করোনাকালে সূচক বৃদ্ধির দিক দিয়ে ২০২০ সালের দ্বিতীয়ার্ধে এশিয়ার সেরা বাজারে পরিণত হয় ডিএসই। আর গত আগস্টে সূচক বৃদ্ধিতে বিশ^সেরার স্বীকৃতি পায় স্টক এক্সচেঞ্জটি। টানা ঊর্ধ্বগতির প্রেক্ষিতে গতকাল ডিএসইর বাজার মূলধন ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৭৫১ কোটি টাকায় উন্নীত হয়যা স্টক এক্সচেঞ্জটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
শেয়ার করুন
নিজস্ব প্রতিবেদক | ১৩ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০

পুঁজিবাজার ধসের ১০ বছর পর করোনার মধ্যে সরকারের নানামুখী উদ্যোগে চাঙ্গাভাব ফিরে এসেছে। পুঁজিবাজারে তারল্য বাড়াতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর বিভিন্ন পদক্ষেপ তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারের দরের ওপরও প্রভাব ফেলেছে। অনেক শেয়ারের দর স্বল্প সময়ের ব্যবধানে কয়েকগুণ পর্যন্ত বেড়েছে। দীর্ঘদিন পর গতি ফিরে আসায় সাইড লাইনে থাকা বিনিয়োগকারীরাও ফিরে এসেছেন বাজারে। ফলে লেনদেনও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। সূচকও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। পুঁজিবাজারের এমন চাঙ্গাভাবের মধ্যেই কারসাজি হচ্ছে কি-না, তা খতিয়ে দেখতে এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় তদন্তে নেমেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)।
পুঁজিবাজারে গত ৩০ কার্যদিবসে যেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম ৫০ শতাংশ বেড়েছে বা কমেছে, সেসব কোম্পানির শেয়ার লেনদেন তদন্ত করতে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জকে নির্দেশ দিয়েছে এসইসি। এসব কোম্পানির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কোনো কারসাজি, ইনসাইডার ট্রেডিং বা অন্য কোনো কারণ রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতেই তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে যেসব কোম্পানির প্রান্তিক কিংবা বার্ষিক আয় আগের বছরের তুলনায় ৫০ শতাংশ বা তার বেশি তারতম্য ঘটেছে, তাও খতিয়ে দেখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গতকাল এসইসির উপপরিচালক মোহাম্মদ শামসুর রহমান স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত নির্দেশ স্টক এক্সচেঞ্জ দুটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তার (সিআরও) কাছে পাঠানো হয়েছে।
ওই নির্দেশনায় গত এক মাসে যেসব কোম্পানির শেয়ারের লেনদেন আগের ছয় মাসের তুলনায় পাঁচ গুণ বা তার চেয়ে বেশি বেড়েছে, তাও তদন্ত করতে বলেছে এসইসি। এছাড়া কোনো কোম্পানির মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশের আগের ১০ দিনে শেয়ারের মূল্য ও লেনদেন ৩০ শতাংশ বা তার কম-বেশি বেড়ে থাকলে তাতে কোনো কারসাজি বা ইনসাইডার ট্রেডিং হয়েছে কি না, সেটিও খুঁজে দেখবে স্টক এক্সচেঞ্জ। তবে এসইসির নির্দেশনায় সুনির্দিষ্টভাবে কোনো কোম্পানির বিরুদ্ধে তদন্তের কথা বলা হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদন ৪৫ কার্যবিসের মধ্যে এসইসিতে জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এসইসি তদন্তে যে ধরনের ক্রাইটেরিয়া নির্ধারণ করে দিয়েছে, তাতে করে অন্তত ৩০টি কোম্পানির শেয়ারের লেনদেন ও অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির বিষয়টি তদন্ত করতে হবে। এটি ২০১০ সালের পর কারসাজি ও ইনসাইডার ট্রেডিং ইস্যুতে সবচেয়ে বড় তদন্ত বলে জানা গেছে। কমিশনের এ ধরনের উদ্যোগের ফলে শেয়ারের দর ও লেনদেন দুটিরই পতন হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিনিয়োগকারীরা।
গত কয়েক মাস ধরে বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজারে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে হঠাৎ করেই বড় আকারের তদন্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বিনিয়োগকারীরা শঙ্কায় রয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্রোকারেজ হাউজের কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরে পুঁজিবাজারে মন্দা ভাব থাকার কারণে অধিকাংশ শেয়ার অবমূল্যায়িত ছিল। এখন চাঙ্গা ভাবের কারণে কিছু শেয়ারের দর বেড়েছে। আর এই চাঙ্গা ভাব দেখে যারা নতুন করে বিনিয়োগে এসেছেন, তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে পড়বেন। তবে কমিশন মনে করছে, বাজারের স্বচ্ছতা ও গভীরতা বাড়াতে কারসাজিকারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও প্রয়োজন রয়েছে এবং এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
এ বিষয়ে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বাণিজ্য অনুষদের অধ্যাপক মোহাম্মদ মুসা বলেন, এ ধরনের তদন্তের উদ্যোগের একটি ইতিবাচক দিক হলো, বাজারে যদি কারসাজি হয়ে থাকে, তাহলে সেটা সাময়িকভাবে বন্ধ হবে। আর নেতিবাচক দিক হলো, এ ধরনের তদন্তে পুরো পুঁজিবাজারে আবার শেয়ারের মূল্য কমবে। এ সময়ে অনেকেই ভীত হয়ে শেয়ার বিক্রি করতে চাইবে। শেয়ারের দর কমবে। এতে বাজারে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি হবে।
তবে এসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো ভীতি তৈরির উদ্দেশ্যে নয়, বরং বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তার জন্যই এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কোনো ধরনের ‘রং ডুয়িং’ যাতে না থাকে, সে জন্যই এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তদন্তের জন্য কিছু ক্রাইটেরিয়া ঠিক করে দেওয়া হয়েছে, যা শুধু এখনকার জন্য নয়, বছরব্যাপী চলবে। আর শুধু অস্বাভাবিকভাবে শেয়ারদর বৃদ্ধিই নয়, কমলেও তদন্ত হবে।
২০২০ সালের মে মাসে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের নেতৃত্বে নতুন কমিশন এসইসির দায়িত্ব নেওয়ার পর জুন মাস থেকে পুঁজিবাজার ধীরে ধীরে গতি ফিরে পায়। এ সময় সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এসইসির নানা উদ্যোগে পুঁজিবাজারে তহবিল বাড়ানোর উদ্যোগ ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিশেষ তহবিল গঠনে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিত শেয়ার ধারণ ৩০ শতাংশ করার নির্দেশনা এবং জেড ক্যাটাগরির কোম্পানির উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কমিশনের উদ্যোগ বাজারে চাঙ্গা ভাব ফেরাতে সহায়তা করে। এছাড়া ইলেকট্রনিক জায়ান্ট কোম্পানি ওয়ালটন ও দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ মোবাইল ফোন অপারেটর রবি আজিয়াটার তালিকাভুক্তি বাজারে গতি সঞ্চার করে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে দেশের ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ব্রোকারেজ হাউজের বুথ খোলার অনুমোদন দেয় এসইসি। ব্রোকারেজ হাউজের শাখা খোলার ওপর এক দশকের নিষেধাজ্ঞাও তুলে নেওয়া হয়।
কমিশনের বিভিন্ন পদক্ষেপে সাইডলাইনে থাকা বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারে নতুন করে বিনিয়োগে আসেন। এতে করে শেয়ারের চাহিদা বেড়ে গিয়ে স্বল্প সময়ে সূচক ও লেনদেনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) লেনদেন এক দিনে আড়াই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। আর শেয়ারের অব্যাহত দরবৃদ্ধিতে ডিএসইর প্রধান সূচক ছয় মাসে ৪০ শতাংশ বেশি বেড়ে ৫৮৬১ পয়েন্টে উন্নীত হয়।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পুঁজিবাজারে অস্বাভাবিক হারে শেয়ার দরবৃদ্ধি শুরু হয় বীমা খাত নিয়ে। গত জুলাই থেকে পুরো বীমা খাতের শেয়ার নিয়ে কারসাজি হয় এবং খাতটির অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারদর মাত্র দুই মাসে কয়েক গুণ পর্যন্ত বাড়ে। এরপর গত নভেম্বর থেকে উৎপাদনমুখী ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাতের শেয়ারদর বাড়তে শুরু করে। গত বছরের শেষ সময়ে এসে এসব শেয়ারের দর আরও বাড়তে শুরু করে। একই সঙ্গে লেনদেনও অস্বাভাবিক হারে বাড়তে দেখা যায়। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে ডিএসইর লেনদেন ২০০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়। আর নতুন আইপিওর লেনদেনে আরও বেশি অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। অভিহিত মূল্যে আসা শেয়ারগুলো অন্তত চারগুণ দাম বাড়ার পর সেকেন্ডারি বাজারের বিনিয়োগকারীদের হাতে আসে। আর রবি আজিয়াটার শেয়ার দর টানা ১২ কার্যদিবস ধরে সর্বোচ্চ দরে লেনদেন হচ্ছে। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের এ শেয়ারটির দর ৫৩২ শতাংশ বেড়ে ৬৩ টাকা ২০ পয়সায় উন্নীত হয়েছে। যদিও প্রথম নয় মাসে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) মাত্র ২৫ পয়সা। একই ধারা দেখা গেছে, আইপিওতে আসা অ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেনের ক্ষেত্রেও।
শুধু আইপিও শেয়ার নয়, পুরনো বেশকিছু কোম্পানি রয়েছে, যেগুলোর দর সম্প্রতি দ্বিগুণ-তিন গুণ হয়ে গেছে। গত এক মাসে বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারদর বেড়েছে ১৫৫ শতাংশ। গত এক মাসে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান বে-লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের শেয়ারদর বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। এছাড়া লংকাবাংলা ফাইন্যান্স, মাইডাস ফাইন্যান্স, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, প্রিমিয়ার লিজিং ও প্রাইম ফাইন্যান্সের শেয়ারদর ও লেনদেন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। ব্যাংক খাতের মধ্যে আইএফআইসি ও এনবিএলের শেয়ারদর ও লেনদন গত এক মাস ধরেই বাড়তে দেখা গেছে। এর বাইরে গত ৩০ কার্যদিবসে ৫০ শতাংশের বেশি দর বৃদ্ধি পাওয়া কোম্পানিগুলো হচ্ছে ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স, ডমিনেজ স্টিল, লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ, ম্যাকসন্স স্পিনিং, অ্যাপোলো ইস্পাত, অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যালস, সাইফ পাওয়ার, জিবিবি পাওয়ার, এসএস স্টিল, ওয়ালটন, অলটেক্স, ডেল্টা স্পিনিং ও আরডি ফুড।
এর আগে সব ধরনের বিনিয়োগকারীরা জড়িয়ে পড়ায় পুরো বীমা খাতের বাজার মূলধন মাত্র দুই মাসে দ্বিগুণ হয়। ওই সময় লেনদেনের ৪০ শতাংশের বেশি সাধারণ বীমা খাতে হতে দেখা গেছে। যদিও এসইসির ক্রাইটেরিয়ার কারণে বীমা খাতের কোনো শেয়ার তদন্তের আওতায় পড়বে না।
পুঁজিবাজারের এই চাঙ্গা ভাবের কারণে করোনাকালে সূচক বৃদ্ধির দিক দিয়ে ২০২০ সালের দ্বিতীয়ার্ধে এশিয়ার সেরা বাজারে পরিণত হয় ডিএসই। আর গত আগস্টে সূচক বৃদ্ধিতে বিশ^সেরার স্বীকৃতি পায় স্টক এক্সচেঞ্জটি। টানা ঊর্ধ্বগতির প্রেক্ষিতে গতকাল ডিএসইর বাজার মূলধন ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৭৫১ কোটি টাকায় উন্নীত হয়যা স্টক এক্সচেঞ্জটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ।