সেই পাপুল আর এমপি নেই
লক্ষ্মীপুর-২ আসন শূন্য ঘোষণা, ৯০ দিনের মধ্যে উপনির্বাচন কুয়েতের আদালতে নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে চার বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত
নিজস্ব প্রতিবেদক | ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০
লক্ষ্মীপুর-২ আসন থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র এমপি কাজী শহিদ ইসলাম ওরফে পাপুলের সংসদ সদস্য পদ শূন্য ঘোষণা করেছে জাতীয় সংসদ। গতকাল সোমবার তার আসন শূন্য ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করেছে জাতীয় সংসদ সচিবালয়। দেশের ইতিহাসে কোনো এমপির বিদেশের মাটিতে ফৌজদারি অপরাধে দন্ডিত হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম। একই সঙ্গে বিদেশে দন্ডিত হয়ে সংসদীয় আসন শূন্য হওয়ার নজিরও আগে ছিল না।
এখন বিধি অনুযায়ী আগামী ৯০ দিনের মধ্যে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে উপনির্বাচন দিতে হবে। নির্বাচন কমিশন সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার গতকাল রাতে দেশ রূপান্তরকে বলেন, সন্ধ্যার পর (গতকাল) তারা সংসদ সচিবালয় থেকে প্রজ্ঞাপনের কপি হাতে পেয়েছেন। বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কুয়েতের আদালতে পাপুলের সাজা হওয়ার বিষয়টি গত বৃহস্পতিবার চিঠি দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাস। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওইদিনই চিঠিটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সংসদ সচিবালয়ে পাঠিয়ে দেয়। এরপরই লক্ষ্মীপুর-২ আসন শূন্য ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ বিষয়ে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন। গতকাল জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব জাফর আহমেদ খান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘কুয়েতের ফৌজদারি আদালতে ঘোষিত রায়ে নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে চার বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হয়েছেন লক্ষ্মীপুর-২ থেকে নির্বাচিত সাংসদ কাজী শহিদ ইসলাম। এ কারণে বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্য থাকার যোগ্য নন তিনি। সে কারণে সংবিধানের ৬৭(১)(ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রায় ঘোষণার তারিখ (গত ২৮ জানুয়ারি) থেকে তার আসন শূন্য হয়েছে।’
অর্থ ও মানব পাচারের মামলায় ২৮ জানুয়ারি পাপুলকে সাজা দেয় কুয়েতের ফৌজদারি আদালত। বিচারক রায়ে এই সাংসদকে চার বছরের সশ্রম কারাদন্ডের পাশাপাশি ১৯ লাখ কুয়েতি দিনার বা ৫৩ কোটি ১৯ লাখ ৬২ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন। গত বছর ৬ জুন রাতে কুয়েতের মুশরিফ আবাসিক এলাকার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় পাপুলকে। গ্রেপ্তারের সাড়ে সাত মাস আর বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর সাড়ে তিন মাসের মাথায় তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত হন।
সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সংসদীয় আসন শূন্য ঘোষণার আগে বিষয়টি নিয়ে স্পিকার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। ওই সময় কুয়েত থেকে পাঠানো পাপুলের মামলার রায়ের কপি পর্যালোচনা করা হয়। আরবি ও ইংরেজিতে লেখা ৬১ পৃষ্ঠার রায়ের কপি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের স্পিকারের দপ্তরে ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সংবিধান, কার্যপ্রণালি বিধি ও আইন অনুযায়ী তার সংসদীয় আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়।
দুর্নীতি দমন কমিশনে প্রাপ্ত নথি থেকে জানা গেছে, কুয়েতে মানব পাচার ও ভিসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল টাকার মালিক হন শহিদ ইসলাম। টাকার জোরে স্ত্রী সেলিনা ইসলামকেও সংরক্ষিত আসনের সাংসদ বানান তিনি। ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের সময় লক্ষ্মীপুরে অনেকটা প্রকাশ্য আলোচনা ছিল যে ১২ কোটি টাকার বিনিময়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রার্থী জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ নোমানকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেন পাপুল। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও নির্বাচনের আগেই অনেকটা জয় নিশ্চিত করে ফেলেন। এ দম্পতির সাংসদ হওয়ার প্রক্রিয়ায় অর্ধশত কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে বলে প্রচার আছে।
এদিকে কুয়েতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর দেশেও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের দুই মামলায় পাপুল ও তার স্ত্রীসহ ছয়জনের ৬৭০টি ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দেয় ঢাকার একটি আদালত। মানব পাচার ও অর্থ পাচারের অভিযোগে পাপুলসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে গত বছর ২২ ডিসেম্বর একটি মামলা করে সিআইডি। ওই মামলার আসামিদের মধ্যে তার মেয়ে, ভাই ও শ্যালিকাও রয়েছেন। গত বছর ১১ নভেম্বর অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ১৪৮ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে পাপুল ও তার স্ত্রী সাংসদ সেলিনা ইসলাম, শ্যালিকা ও মেয়েকে আসামি করে আরেকটি মামলা করে দুদক। দুদক কর্মকর্তা সালাউদ্দিন বাদী হয়ে করা ওই মামলায় পাপুলের শ্যালিকা জেসমিন প্রধানকে এক নম্বর আসামি করা হয়েছে। এছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারে সহযোগিতা করার অভিযোগে পাপুল-সেলিনার মেয়ে ওয়াফা ইসলামকেও আসামি করা হয়। অর্থ পাচারের পাশাপাশি মামলায় জেসমিন ২ কোটি ৩১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৮ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।
দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কমিশনে পাপুলের বিরুদ্ধে ১৭৪ পাতার অভিযোগ জমা হয়। তাতে বলা হয়, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের এই পরিচালক বিদেশে ব্যবসার আড়ালে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা অবৈধভাবে অর্জন করে বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন। এর মধ্যে তিনি ২০১৬ সালে বাংলাদেশ থেকে ২৮০ কোটি টাকা হুন্ডি ও বিভিন্ন ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে পাচার করেছেন। এ টাকার মধ্যে তিনি মার্কেন্টাইল ব্যাংকের মতিঝিল শাখার একটি হিসাবের মাধ্যমে ১৩২ কোটি টাকা ও প্রাইম ব্যাংকের এক কর্মকর্তার মাধ্যমে ৪০ কোটি টাকা পাচার করেন। ইউসিবিএলের মাধ্যমে ১০ কোটি ও প্রাইম ব্যাংকে ঋণ সৃষ্টি করে ১০ কোটি টাকা পাচার করেন। বাকি টাকা পাপুল তার শ্যালিকা জেসমিন প্রধান এবং জেডডব্লিউ লীলাবালি নামে প্রতিষ্ঠানের হিসাবে জমা করেন। অভিযোগে আরও বলা হয়, কয়েকজন ব্যাংক মালিক অর্থ পাচারে পাপুলকে সহযোগিতা করেছেন। ৫০ কোটি টাকার শেয়ার ক্রয় করে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালক হয়েছেন পাপুল, স্ত্রীর নামে একই ব্যাংকের ৩০ কোটি টাকার শেয়ার কিনে অংশীদার হয়েছেন। গুলশান-১-এর ১৬ নম্বর সড়কে গাউসিয়া ডেভেলপমেন্টের প্রকল্পে মেয়ে ও স্ত্রীর নামে দুটি ফ্ল্যাট, গুলশান-২-এর পিংক সিটির পেছনে গাউসিয়া ইসলামিয়া প্রকল্পে স্ত্রীর নামে ৯ হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট, স্ত্রী ও নিজ নামে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরসহ বিভিন্ন স্থানে ৯১ কোটি টাকার সম্পদ আছে তার। এছাড়া সোনালী ব্যাংকের ঢাকার ওয়েজ অনার্স শাখায় স্ত্রীর নামে ৫০ কোটি টাকার ওয়েজ ওনার্স বন্ড ও মেয়ের নামে ২০ কোটি টাকার বন্ড আছে। শ্যালিকার নামে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে দুটি বিলাসবহুল গাড়ি কিনে নিজে ব্যবহার করছেন। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে নিজ নামে ৪০ কোটি, মেয়ের নামে ১০ কোটি ও স্ত্রীর নামে ২০ কোটি টাকার স্থায়ী আমানত রয়েছে। এছাড়া রাজধানীর একটি আবাসিক এলাকায় তার স্ত্রীর নামে একটি ছয়তলা বাড়ি আছে। শ্যালিকার নাম ব্যবহার করে ‘দিগন্ত মিডিয়ায়’ বেনামে পরিচালক ছিলেন তিনি। যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা কাশেম আলীর সঙ্গে তার ব্যবসা ছিল। তিনি কাশেম আলীর বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেন বলেও অভিযোগে বলা হয়।
দুদকে জমা পড়া অভিযোগে আরও বলা হয়, ব্যাংক পরিচালক হয়েও বেআইনিভাবে ইউসিবিএল ব্যাংক থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি ইস্যু করে বোর্ডসভার অনুমতি ছাড়া ব্যাংক গ্যারান্টি সুবিধা ভোগ করছেন পাপুল। এ ব্যাংক গ্যারান্টি নিয়ে তিনি পাথর সরবরাহের ব্যবসা করছেন। তার সহযোগী হিসেবে অভিযোগে লক্ষ্মীপুরের একটি উপজলোর চেয়ারম্যান ও জেলা পরিষদের এক সদস্যের নামও উল্লেখ করা হয়েছে।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দৈনিক আরব টাইমস, আরবি দৈনিক আল কাবাস, কুয়েতি টাইমসসহ কয়েকটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশি এক সাংসদের বিরুদ্ধে মানব পাচারে জড়িত থাকার তথ্য উঠে আসে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মানব পাচার চক্রটিতে সন্দেহভাজন তিন ব্যক্তি রয়েছেন। একজন গ্রেপ্তার হলে বাকি দুজন কুয়েত থেকে দেশে চলে এসেছেন।
কুয়েত পুলিশের বরাত দিয়ে আল কাবাসের প্রতিবেদনে বলা হয়, চক্রটি ২০ হাজারের বেশি বাংলাদেশিকে কুয়েতে নিয়েছিল। যাতে তাদের ৫ কোটিরও বেশি কুয়েতি দিনার আয় হয়। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
শেয়ার করুন
লক্ষ্মীপুর-২ আসন শূন্য ঘোষণা, ৯০ দিনের মধ্যে উপনির্বাচন কুয়েতের আদালতে নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে চার বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত
নিজস্ব প্রতিবেদক | ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০

লক্ষ্মীপুর-২ আসন থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র এমপি কাজী শহিদ ইসলাম ওরফে পাপুলের সংসদ সদস্য পদ শূন্য ঘোষণা করেছে জাতীয় সংসদ। গতকাল সোমবার তার আসন শূন্য ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করেছে জাতীয় সংসদ সচিবালয়। দেশের ইতিহাসে কোনো এমপির বিদেশের মাটিতে ফৌজদারি অপরাধে দন্ডিত হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম। একই সঙ্গে বিদেশে দন্ডিত হয়ে সংসদীয় আসন শূন্য হওয়ার নজিরও আগে ছিল না।
এখন বিধি অনুযায়ী আগামী ৯০ দিনের মধ্যে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে উপনির্বাচন দিতে হবে। নির্বাচন কমিশন সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার গতকাল রাতে দেশ রূপান্তরকে বলেন, সন্ধ্যার পর (গতকাল) তারা সংসদ সচিবালয় থেকে প্রজ্ঞাপনের কপি হাতে পেয়েছেন। বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কুয়েতের আদালতে পাপুলের সাজা হওয়ার বিষয়টি গত বৃহস্পতিবার চিঠি দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাস। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওইদিনই চিঠিটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সংসদ সচিবালয়ে পাঠিয়ে দেয়। এরপরই লক্ষ্মীপুর-২ আসন শূন্য ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ বিষয়ে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন। গতকাল জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব জাফর আহমেদ খান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘কুয়েতের ফৌজদারি আদালতে ঘোষিত রায়ে নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে চার বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হয়েছেন লক্ষ্মীপুর-২ থেকে নির্বাচিত সাংসদ কাজী শহিদ ইসলাম। এ কারণে বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্য থাকার যোগ্য নন তিনি। সে কারণে সংবিধানের ৬৭(১)(ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রায় ঘোষণার তারিখ (গত ২৮ জানুয়ারি) থেকে তার আসন শূন্য হয়েছে।’
অর্থ ও মানব পাচারের মামলায় ২৮ জানুয়ারি পাপুলকে সাজা দেয় কুয়েতের ফৌজদারি আদালত। বিচারক রায়ে এই সাংসদকে চার বছরের সশ্রম কারাদন্ডের পাশাপাশি ১৯ লাখ কুয়েতি দিনার বা ৫৩ কোটি ১৯ লাখ ৬২ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন। গত বছর ৬ জুন রাতে কুয়েতের মুশরিফ আবাসিক এলাকার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় পাপুলকে। গ্রেপ্তারের সাড়ে সাত মাস আর বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর সাড়ে তিন মাসের মাথায় তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত হন।
সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সংসদীয় আসন শূন্য ঘোষণার আগে বিষয়টি নিয়ে স্পিকার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। ওই সময় কুয়েত থেকে পাঠানো পাপুলের মামলার রায়ের কপি পর্যালোচনা করা হয়। আরবি ও ইংরেজিতে লেখা ৬১ পৃষ্ঠার রায়ের কপি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের স্পিকারের দপ্তরে ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সংবিধান, কার্যপ্রণালি বিধি ও আইন অনুযায়ী তার সংসদীয় আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়।
দুর্নীতি দমন কমিশনে প্রাপ্ত নথি থেকে জানা গেছে, কুয়েতে মানব পাচার ও ভিসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল টাকার মালিক হন শহিদ ইসলাম। টাকার জোরে স্ত্রী সেলিনা ইসলামকেও সংরক্ষিত আসনের সাংসদ বানান তিনি। ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের সময় লক্ষ্মীপুরে অনেকটা প্রকাশ্য আলোচনা ছিল যে ১২ কোটি টাকার বিনিময়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রার্থী জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ নোমানকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেন পাপুল। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও নির্বাচনের আগেই অনেকটা জয় নিশ্চিত করে ফেলেন। এ দম্পতির সাংসদ হওয়ার প্রক্রিয়ায় অর্ধশত কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে বলে প্রচার আছে।
এদিকে কুয়েতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর দেশেও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের দুই মামলায় পাপুল ও তার স্ত্রীসহ ছয়জনের ৬৭০টি ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দেয় ঢাকার একটি আদালত। মানব পাচার ও অর্থ পাচারের অভিযোগে পাপুলসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে গত বছর ২২ ডিসেম্বর একটি মামলা করে সিআইডি। ওই মামলার আসামিদের মধ্যে তার মেয়ে, ভাই ও শ্যালিকাও রয়েছেন। গত বছর ১১ নভেম্বর অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ১৪৮ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে পাপুল ও তার স্ত্রী সাংসদ সেলিনা ইসলাম, শ্যালিকা ও মেয়েকে আসামি করে আরেকটি মামলা করে দুদক। দুদক কর্মকর্তা সালাউদ্দিন বাদী হয়ে করা ওই মামলায় পাপুলের শ্যালিকা জেসমিন প্রধানকে এক নম্বর আসামি করা হয়েছে। এছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারে সহযোগিতা করার অভিযোগে পাপুল-সেলিনার মেয়ে ওয়াফা ইসলামকেও আসামি করা হয়। অর্থ পাচারের পাশাপাশি মামলায় জেসমিন ২ কোটি ৩১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৮ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।
দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কমিশনে পাপুলের বিরুদ্ধে ১৭৪ পাতার অভিযোগ জমা হয়। তাতে বলা হয়, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের এই পরিচালক বিদেশে ব্যবসার আড়ালে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা অবৈধভাবে অর্জন করে বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন। এর মধ্যে তিনি ২০১৬ সালে বাংলাদেশ থেকে ২৮০ কোটি টাকা হুন্ডি ও বিভিন্ন ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে পাচার করেছেন। এ টাকার মধ্যে তিনি মার্কেন্টাইল ব্যাংকের মতিঝিল শাখার একটি হিসাবের মাধ্যমে ১৩২ কোটি টাকা ও প্রাইম ব্যাংকের এক কর্মকর্তার মাধ্যমে ৪০ কোটি টাকা পাচার করেন। ইউসিবিএলের মাধ্যমে ১০ কোটি ও প্রাইম ব্যাংকে ঋণ সৃষ্টি করে ১০ কোটি টাকা পাচার করেন। বাকি টাকা পাপুল তার শ্যালিকা জেসমিন প্রধান এবং জেডডব্লিউ লীলাবালি নামে প্রতিষ্ঠানের হিসাবে জমা করেন। অভিযোগে আরও বলা হয়, কয়েকজন ব্যাংক মালিক অর্থ পাচারে পাপুলকে সহযোগিতা করেছেন। ৫০ কোটি টাকার শেয়ার ক্রয় করে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালক হয়েছেন পাপুল, স্ত্রীর নামে একই ব্যাংকের ৩০ কোটি টাকার শেয়ার কিনে অংশীদার হয়েছেন। গুলশান-১-এর ১৬ নম্বর সড়কে গাউসিয়া ডেভেলপমেন্টের প্রকল্পে মেয়ে ও স্ত্রীর নামে দুটি ফ্ল্যাট, গুলশান-২-এর পিংক সিটির পেছনে গাউসিয়া ইসলামিয়া প্রকল্পে স্ত্রীর নামে ৯ হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট, স্ত্রী ও নিজ নামে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরসহ বিভিন্ন স্থানে ৯১ কোটি টাকার সম্পদ আছে তার। এছাড়া সোনালী ব্যাংকের ঢাকার ওয়েজ অনার্স শাখায় স্ত্রীর নামে ৫০ কোটি টাকার ওয়েজ ওনার্স বন্ড ও মেয়ের নামে ২০ কোটি টাকার বন্ড আছে। শ্যালিকার নামে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে দুটি বিলাসবহুল গাড়ি কিনে নিজে ব্যবহার করছেন। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে নিজ নামে ৪০ কোটি, মেয়ের নামে ১০ কোটি ও স্ত্রীর নামে ২০ কোটি টাকার স্থায়ী আমানত রয়েছে। এছাড়া রাজধানীর একটি আবাসিক এলাকায় তার স্ত্রীর নামে একটি ছয়তলা বাড়ি আছে। শ্যালিকার নাম ব্যবহার করে ‘দিগন্ত মিডিয়ায়’ বেনামে পরিচালক ছিলেন তিনি। যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা কাশেম আলীর সঙ্গে তার ব্যবসা ছিল। তিনি কাশেম আলীর বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেন বলেও অভিযোগে বলা হয়।
দুদকে জমা পড়া অভিযোগে আরও বলা হয়, ব্যাংক পরিচালক হয়েও বেআইনিভাবে ইউসিবিএল ব্যাংক থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি ইস্যু করে বোর্ডসভার অনুমতি ছাড়া ব্যাংক গ্যারান্টি সুবিধা ভোগ করছেন পাপুল। এ ব্যাংক গ্যারান্টি নিয়ে তিনি পাথর সরবরাহের ব্যবসা করছেন। তার সহযোগী হিসেবে অভিযোগে লক্ষ্মীপুরের একটি উপজলোর চেয়ারম্যান ও জেলা পরিষদের এক সদস্যের নামও উল্লেখ করা হয়েছে।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দৈনিক আরব টাইমস, আরবি দৈনিক আল কাবাস, কুয়েতি টাইমসসহ কয়েকটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশি এক সাংসদের বিরুদ্ধে মানব পাচারে জড়িত থাকার তথ্য উঠে আসে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মানব পাচার চক্রটিতে সন্দেহভাজন তিন ব্যক্তি রয়েছেন। একজন গ্রেপ্তার হলে বাকি দুজন কুয়েত থেকে দেশে চলে এসেছেন।
কুয়েত পুলিশের বরাত দিয়ে আল কাবাসের প্রতিবেদনে বলা হয়, চক্রটি ২০ হাজারের বেশি বাংলাদেশিকে কুয়েতে নিয়েছিল। যাতে তাদের ৫ কোটিরও বেশি কুয়েতি দিনার আয় হয়। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।