সতর্ক বাংলাদেশ, প্রস্তুতি নিতে চিঠি
প্রতীক ইজাজ | ২৭ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০
দক্ষিণ আফ্রিকায় দেখা দেওয়া করোনাভাইরাসের নতুন ধরনের ওপর সতর্ক নজর রাখছে বাংলাদেশ। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ধরনটির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। ইতিমধ্যেই এ ধরনটির বাংলাদেশে প্রবেশ ঠেকাতে আগাম প্রস্তুতি নিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইইডিসিআরকে চিঠি লিখেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কার্যাবলির সঙ্গে সম্পৃক্ত আইইডিসিআরের উপদেষ্টা। চিঠিতে দেশের ‘পয়েন্ট অব এন্ট্রিতে’ কঠোর নজরদারি বাড়ানো এবং যত রোগী পাওয়া যাচ্ছে সবার জিনোম সিকোয়েন্স করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন গতকাল শুক্রবার রাতে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ইতিমধ্যেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব ও রোগ নির্ণয় বিভাগের পরিচালক এবং আইইডিসিআরের পরিচালককে ই-মেইলে চিঠি দিয়েছি। চিঠিতে লিখা হয়েছে যে, আমাদের অবিলম্বে দেশের সবগুলোকে “পয়েন্ট অব এন্ট্রিতে” কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। এসব পয়েন্টে পাবলিক হেলথের জনবল বাড়াতে হবে। প্রত্যেকটা কেসের জিনোম সিকোয়েন্স করা দরকার। এটা ছাড়া নতুন ভ্যারিয়েন্ট ধরা যাবে না।’
এ বিশেষজ্ঞ করোনার নতুন ধরনটি ঠেকাতে বাংলাদেশের আগাম পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বলে মনে করেন। তিনি বলেন, ‘তা না হলে করোনা নিয়ন্ত্রণে যতটুকু এগিয়েছি, আবার পিছিয়ে যাব।’
অবশ্য দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন ধরন নিয়ে বাংলাদেশে এখনই অত বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই বলে মনে করছেন আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকায় দেখা দেওয়া করোনার নতুন ধরনের রোগী এখন পর্যন্ত খুবই কম পাওয়া গেছে। মূলত দক্ষিণ আফ্রিকা ও বতসোয়ানাতে পাওয়া গেছে। বলা হচ্ছে, এ ধরনের স্পাইক প্রোটিনে ৩২টা মিউটেশন রয়েছে। এখন স্পাইক প্রোটিন যেহেতু ভ্যাকসিনের একটা কার্যকরী অবস্থা তৈরি করে, এই ধরন সেটা কমিয়ে দিতে পারে। তবে এখনো তেমন কোনো প্রমাণিত হয়নি। যেহেতু অনেকগুলো মিউটেশন হয়ে গেছে, সেজন্য এ সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। এটা নিয়ে এখনো এত আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এটা সারা পৃথিবীতে মাত্র ১০-১২টা কেস। কিন্তু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। দেশের ভাইরাসের সিকোয়েন্স করছি। আমাদের এ অঞ্চলে এখনো এই রকম কিছু পাওয়া যায়নি।’
এ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এখনই বিমান চলাচল বন্ধ করার মতো পরিস্থিতি আসেনি। কারণ এটা এখনো মানুষ থেকে মানুষে অনেক বেশি ছড়ায়নি। দক্ষিণ আফ্রিকাতেই সংক্রমিত। সাবধানতা ভালো। তবে অতি উৎসাহী হয়ে কিছু করা ভালো নয়। বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত আসছে। সেগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে যেটা বাংলাদেশের জন্য ভালো হয়, সেটাই করা হবে। বাংলাদেশ পর্যবেক্ষণ করছে।’
বিশ্বজুড়ে নতুন উদ্বেগ : ইতিমধ্যেই বিশ্বজুড়ে এ নতুন ধরন নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ধরনটির নাম ‘বি.১.১.৫২৯’। এখন পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার গৌতেং প্রদেশে ৭৭ জনের দেহে এ ধরনটি পাওয়া গেছে। এর বাইরে বতসোয়ানায় চারজন ও হংকংয়ে একজনের দেহে এ ধরন শনাক্ত হয়েছে। এসব রোগী মূলত দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে যাওয়া। ধরনটি বেশ দ্রুতগতিতে ছড়ায় বলে প্রাথমিকভাবে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
করোনার নতুন ধরন নিয়ে গতকাল বৈঠক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। তারা বলছে, বৈঠকের পর নতুন নির্দেশনা জারি করা হবে। সংস্থাটি বর্তমানে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছে এবং সরকারকে ঝুঁকিভিত্তিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের পরামর্শ দিচ্ছে।
নতুন ধরনের বিস্তার ঠেকাতে আবার ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি কোয়ারেন্টাইনের বিধিনিষেধ আরোপ করতে শুরু করেছে বিভিন্ন দেশ। ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর ও জাপান কোয়ারেন্টাইন জোরদারের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা ও আশপাশের দেশগুলো থেকে ফ্লাইট নিষিদ্ধ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের জোটভুক্ত সব দেশেই দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ওই অঞ্চলের সঙ্গে ফ্লাইট চলাচল বন্ধের প্রস্তাব করেছে। গত ১৪ দিনে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলীয় দেশগুলো ভ্রমণ করে আসা ব্যক্তিদের ওপর ইতালিতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকাকে ভাইরাসের নতুন ধরনের এলাকা (ভাইরাস ভ্যারিয়েন্ট এরিয়া) ঘোষণা করছে জার্মানি। দক্ষিণ আফ্রিকাসহ অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের পরীক্ষা ও নজরদারিতে রাখতে রাজ্য সরকারগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে ভারত। সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও আফ্রিকার ওই অঞ্চল থেকে লোকজন আসায় বিধিনিষেধ আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকাসহ আরও পাঁচটি আফ্রিকান দেশ থেকে ভ্রমণকারীদের জন্য সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করেছে জাপান।
ডেল্টার চেয়ে বেশি মারাত্মক : বিজ্ঞানীরা এখনো করোনার এ নতুন ধরন সম্পর্ক খুব বেশি জানতে পারেননি। তবে এটা খুবই উদ্বেগের বলে সতর্ক করেছেন তারা। করোনার এ ধরন কতটা সংক্রামক, তা বোঝার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এটা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যাবে।
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যনিরাপত্তা সংস্থা বলেছে, করোনার নতুন এ ধরনে যে স্পাইক প্রোটিন রয়েছে, সেটি মূল করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন থেকে ভিন্ন। আর ওই স্পাইক প্রোটিনকে বিবেচনায় নিয়েই করোনার টিকাগুলো তৈরি করা হয়েছে। সে কারণে এসব টিকা করোনার নতুন ধরনটির ক্ষেত্রে কার্যকর হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশের আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এ ভ্যারিয়েন্টের নাম সম্ভবত নিউ (এনইউ) ভ্যারিয়েন্ট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈঠকে বসেছে। শিগগির ভ্যারিয়েন্টের নাম জানতে পারব। ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটাকে “ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন”ও বলতে পারে। কারণ এই ভ্যারিয়েন্ট খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকার যারা পাবলিক হেলথ নিয়ে কাজ করেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তারা এই ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। এটা ডেল্টাকে হটিয়ে দিয়ে এই ভ্যারিয়েন্ট জায়গা করে ফেলেছে। কারণ এটি ডেল্টার চেয়েও শক্তিশালী। দক্ষিণ আফ্রিকার পাশাপাশি হংকং ও বোতসোয়ানায় এ ধরন শনাক্ত হয়েছে। তারাও মূলত দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে যাওয়া।’
টিকা মাত্র ২৫ শতাংশ কার্যকর : বাংলাদেশে এ ধরনের ভ্যারিয়েন্ট এখনো পাওয়া যায়নি, তবে সতর্ক হতেই হবে বলে মত দিয়েছেন ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকার করোনার নতুন ধরন নিয়ে সতর্ক হতেই হবে। কারণ আমাদের ভ্যাকসিনেশনের (টিকাদান) মাত্রা খুবই কম। এর মধ্যে যদি এই ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে পরিস্থিতি খুবই খারাপ হয়ে যাবে। কারণ এই ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে টিকা মাত্র ২৫ শতাংশ কার্যকর। ডেল্টার বিরুদ্ধে টিকা ৪০ শতাংশ কার্যকর। কাজেই আমাদের উপায় নেই। আমাদের ভ্যাকসিনেশন কাভারেজ এ অঞ্চলে সবচেয়ে কম। ভারতে নতুন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। কারণ দক্ষিণ আফ্রিকা ও দক্ষিণ আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে দেশটির যাতায়াত বেশি। আবার ভারতের সঙ্গে আমাদের স্থলপথে যাতায়াত বেশি। কাজেই আগে থেকে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিলে নতুন ভ্যারিয়েন্ট ছড়াতে সময় লাগবে। একেবারেই ঠেকানো যাবে না। ডেল্টার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। এক মাস পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখা গেছে। ওই এক মাসে ভারতে ডেল্টা ধরনের দাপট কমে গেছে। আমরা সেখান অক্সিজেনের সরবরাহ পেয়েছি। এখানে অক্সিজেনের অভাবে করোনায় মৃত্যু ভারতের মতো হয়নি।’
দরকার জিনোম সিকোয়েন্স : করোনার নতুন ধরন শনাক্তে প্রত্যেক রোগীর জিনোম সিকোয়েন্স করার পরামর্শ দিয়েছেন ডা. মুশতাক হোসেন ও বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) জিনোমিক রিসার্চ সেন্টারের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সেলিম খান। এ ব্যাপারে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘দেশে যত রোগী শনাক্ত হচ্ছে, প্রত্যেকের জিনোম সিকোয়েন্স করা উচিত। বিমানবন্দর ও নৌবন্দরে পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। এখন সেটার ব্যাপ্তি আরও বাড়াতে হবে। বেশি জনবল দরকার। ইউরোপে ছড়াতে পারে। ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা ও দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যান্য দেশগুলোর বিমান যোগাযোগ বেশি। সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশি আসে। তারা দুবাই হয়ে আসে।’
ড. সেলিম খান বলেন, ‘এ পর্যন্ত বাইরে যত ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে, আমরা সব পেয়েছি। একটাও বাদ পড়েনি। দক্ষিণ আফ্রিকায় দেখা দেওয়া নতুন ধরনটি কেবল ছড়াতে শুরু করেছে। যদি সেখান থেকে ছড়ায়, তাহলে আমাদের দেশে আসবে। এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে আসেনি। বাংলাদেশে আফ্রিকার লোকজনের আসা-যাওয়া কম। তবে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ওইসব দেশের যাতায়াত বেশি। ফলে যুক্তরাজ্য থেকে আসতে পারে। আফ্রিকাতেই প্রাথমিক অবস্থা।’
এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যে তথ্য পেয়েছি, তাতে এটা ডেল্টার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি মারাত্মক। ডেল্টা আফ্রিকাতে মারাত্মক ছিল। সেই ডেল্টারই আরেকটা ধরন এটা। এ ধরন নিজে নিজেই পাল্টায় এবং দ্রুত ছড়ায়। টিকাকে অকার্যকর করে দেয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমে দেখতে হবে আমাদের দেশে এটা এসেছে কি না। এর জন্য জিনোম সিকোয়েন্স করা দরকার। ইতিমধ্যেই যুক্তরাজ্য আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে। ওইসব দেশ থেকে যেসব লোকজন আসবে, তাদের ওপর অবশ্যই নজর রাখতে হবে। ওইসব দেশ থেকে আমাদের দেশে লোকজন কম আসে। সরাসরি বিমান চলাচল নেই। তাই এখনই ফ্লাইট বন্ধ করার দরকার নেই। তবে ইউরোপের দেশগুলো থেকে আসতে পারে। কারণ ইউরোপের সঙ্গে আফ্রিকার দেশগুলোর যাতায়াত আছে। সেই ক্ষেত্রে বিমান চলাচল বন্ধ করতে হবে।’
শেয়ার করুন
প্রতীক ইজাজ | ২৭ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০

দক্ষিণ আফ্রিকায় দেখা দেওয়া করোনাভাইরাসের নতুন ধরনের ওপর সতর্ক নজর রাখছে বাংলাদেশ। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ধরনটির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। ইতিমধ্যেই এ ধরনটির বাংলাদেশে প্রবেশ ঠেকাতে আগাম প্রস্তুতি নিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইইডিসিআরকে চিঠি লিখেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কার্যাবলির সঙ্গে সম্পৃক্ত আইইডিসিআরের উপদেষ্টা। চিঠিতে দেশের ‘পয়েন্ট অব এন্ট্রিতে’ কঠোর নজরদারি বাড়ানো এবং যত রোগী পাওয়া যাচ্ছে সবার জিনোম সিকোয়েন্স করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন গতকাল শুক্রবার রাতে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ইতিমধ্যেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব ও রোগ নির্ণয় বিভাগের পরিচালক এবং আইইডিসিআরের পরিচালককে ই-মেইলে চিঠি দিয়েছি। চিঠিতে লিখা হয়েছে যে, আমাদের অবিলম্বে দেশের সবগুলোকে “পয়েন্ট অব এন্ট্রিতে” কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। এসব পয়েন্টে পাবলিক হেলথের জনবল বাড়াতে হবে। প্রত্যেকটা কেসের জিনোম সিকোয়েন্স করা দরকার। এটা ছাড়া নতুন ভ্যারিয়েন্ট ধরা যাবে না।’
এ বিশেষজ্ঞ করোনার নতুন ধরনটি ঠেকাতে বাংলাদেশের আগাম পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বলে মনে করেন। তিনি বলেন, ‘তা না হলে করোনা নিয়ন্ত্রণে যতটুকু এগিয়েছি, আবার পিছিয়ে যাব।’
অবশ্য দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন ধরন নিয়ে বাংলাদেশে এখনই অত বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই বলে মনে করছেন আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকায় দেখা দেওয়া করোনার নতুন ধরনের রোগী এখন পর্যন্ত খুবই কম পাওয়া গেছে। মূলত দক্ষিণ আফ্রিকা ও বতসোয়ানাতে পাওয়া গেছে। বলা হচ্ছে, এ ধরনের স্পাইক প্রোটিনে ৩২টা মিউটেশন রয়েছে। এখন স্পাইক প্রোটিন যেহেতু ভ্যাকসিনের একটা কার্যকরী অবস্থা তৈরি করে, এই ধরন সেটা কমিয়ে দিতে পারে। তবে এখনো তেমন কোনো প্রমাণিত হয়নি। যেহেতু অনেকগুলো মিউটেশন হয়ে গেছে, সেজন্য এ সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। এটা নিয়ে এখনো এত আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এটা সারা পৃথিবীতে মাত্র ১০-১২টা কেস। কিন্তু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। দেশের ভাইরাসের সিকোয়েন্স করছি। আমাদের এ অঞ্চলে এখনো এই রকম কিছু পাওয়া যায়নি।’
এ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এখনই বিমান চলাচল বন্ধ করার মতো পরিস্থিতি আসেনি। কারণ এটা এখনো মানুষ থেকে মানুষে অনেক বেশি ছড়ায়নি। দক্ষিণ আফ্রিকাতেই সংক্রমিত। সাবধানতা ভালো। তবে অতি উৎসাহী হয়ে কিছু করা ভালো নয়। বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত আসছে। সেগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে যেটা বাংলাদেশের জন্য ভালো হয়, সেটাই করা হবে। বাংলাদেশ পর্যবেক্ষণ করছে।’
বিশ্বজুড়ে নতুন উদ্বেগ : ইতিমধ্যেই বিশ্বজুড়ে এ নতুন ধরন নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ধরনটির নাম ‘বি.১.১.৫২৯’। এখন পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার গৌতেং প্রদেশে ৭৭ জনের দেহে এ ধরনটি পাওয়া গেছে। এর বাইরে বতসোয়ানায় চারজন ও হংকংয়ে একজনের দেহে এ ধরন শনাক্ত হয়েছে। এসব রোগী মূলত দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে যাওয়া। ধরনটি বেশ দ্রুতগতিতে ছড়ায় বলে প্রাথমিকভাবে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
করোনার নতুন ধরন নিয়ে গতকাল বৈঠক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। তারা বলছে, বৈঠকের পর নতুন নির্দেশনা জারি করা হবে। সংস্থাটি বর্তমানে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছে এবং সরকারকে ঝুঁকিভিত্তিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের পরামর্শ দিচ্ছে।
নতুন ধরনের বিস্তার ঠেকাতে আবার ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি কোয়ারেন্টাইনের বিধিনিষেধ আরোপ করতে শুরু করেছে বিভিন্ন দেশ। ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর ও জাপান কোয়ারেন্টাইন জোরদারের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা ও আশপাশের দেশগুলো থেকে ফ্লাইট নিষিদ্ধ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের জোটভুক্ত সব দেশেই দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ওই অঞ্চলের সঙ্গে ফ্লাইট চলাচল বন্ধের প্রস্তাব করেছে। গত ১৪ দিনে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলীয় দেশগুলো ভ্রমণ করে আসা ব্যক্তিদের ওপর ইতালিতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকাকে ভাইরাসের নতুন ধরনের এলাকা (ভাইরাস ভ্যারিয়েন্ট এরিয়া) ঘোষণা করছে জার্মানি। দক্ষিণ আফ্রিকাসহ অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের পরীক্ষা ও নজরদারিতে রাখতে রাজ্য সরকারগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে ভারত। সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও আফ্রিকার ওই অঞ্চল থেকে লোকজন আসায় বিধিনিষেধ আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকাসহ আরও পাঁচটি আফ্রিকান দেশ থেকে ভ্রমণকারীদের জন্য সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করেছে জাপান।
ডেল্টার চেয়ে বেশি মারাত্মক : বিজ্ঞানীরা এখনো করোনার এ নতুন ধরন সম্পর্ক খুব বেশি জানতে পারেননি। তবে এটা খুবই উদ্বেগের বলে সতর্ক করেছেন তারা। করোনার এ ধরন কতটা সংক্রামক, তা বোঝার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এটা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যাবে।
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যনিরাপত্তা সংস্থা বলেছে, করোনার নতুন এ ধরনে যে স্পাইক প্রোটিন রয়েছে, সেটি মূল করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন থেকে ভিন্ন। আর ওই স্পাইক প্রোটিনকে বিবেচনায় নিয়েই করোনার টিকাগুলো তৈরি করা হয়েছে। সে কারণে এসব টিকা করোনার নতুন ধরনটির ক্ষেত্রে কার্যকর হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশের আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এ ভ্যারিয়েন্টের নাম সম্ভবত নিউ (এনইউ) ভ্যারিয়েন্ট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈঠকে বসেছে। শিগগির ভ্যারিয়েন্টের নাম জানতে পারব। ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটাকে “ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন”ও বলতে পারে। কারণ এই ভ্যারিয়েন্ট খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকার যারা পাবলিক হেলথ নিয়ে কাজ করেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তারা এই ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। এটা ডেল্টাকে হটিয়ে দিয়ে এই ভ্যারিয়েন্ট জায়গা করে ফেলেছে। কারণ এটি ডেল্টার চেয়েও শক্তিশালী। দক্ষিণ আফ্রিকার পাশাপাশি হংকং ও বোতসোয়ানায় এ ধরন শনাক্ত হয়েছে। তারাও মূলত দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে যাওয়া।’
টিকা মাত্র ২৫ শতাংশ কার্যকর : বাংলাদেশে এ ধরনের ভ্যারিয়েন্ট এখনো পাওয়া যায়নি, তবে সতর্ক হতেই হবে বলে মত দিয়েছেন ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকার করোনার নতুন ধরন নিয়ে সতর্ক হতেই হবে। কারণ আমাদের ভ্যাকসিনেশনের (টিকাদান) মাত্রা খুবই কম। এর মধ্যে যদি এই ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে পরিস্থিতি খুবই খারাপ হয়ে যাবে। কারণ এই ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে টিকা মাত্র ২৫ শতাংশ কার্যকর। ডেল্টার বিরুদ্ধে টিকা ৪০ শতাংশ কার্যকর। কাজেই আমাদের উপায় নেই। আমাদের ভ্যাকসিনেশন কাভারেজ এ অঞ্চলে সবচেয়ে কম। ভারতে নতুন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। কারণ দক্ষিণ আফ্রিকা ও দক্ষিণ আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে দেশটির যাতায়াত বেশি। আবার ভারতের সঙ্গে আমাদের স্থলপথে যাতায়াত বেশি। কাজেই আগে থেকে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিলে নতুন ভ্যারিয়েন্ট ছড়াতে সময় লাগবে। একেবারেই ঠেকানো যাবে না। ডেল্টার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। এক মাস পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখা গেছে। ওই এক মাসে ভারতে ডেল্টা ধরনের দাপট কমে গেছে। আমরা সেখান অক্সিজেনের সরবরাহ পেয়েছি। এখানে অক্সিজেনের অভাবে করোনায় মৃত্যু ভারতের মতো হয়নি।’
দরকার জিনোম সিকোয়েন্স : করোনার নতুন ধরন শনাক্তে প্রত্যেক রোগীর জিনোম সিকোয়েন্স করার পরামর্শ দিয়েছেন ডা. মুশতাক হোসেন ও বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) জিনোমিক রিসার্চ সেন্টারের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সেলিম খান। এ ব্যাপারে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘দেশে যত রোগী শনাক্ত হচ্ছে, প্রত্যেকের জিনোম সিকোয়েন্স করা উচিত। বিমানবন্দর ও নৌবন্দরে পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। এখন সেটার ব্যাপ্তি আরও বাড়াতে হবে। বেশি জনবল দরকার। ইউরোপে ছড়াতে পারে। ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা ও দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যান্য দেশগুলোর বিমান যোগাযোগ বেশি। সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশি আসে। তারা দুবাই হয়ে আসে।’
ড. সেলিম খান বলেন, ‘এ পর্যন্ত বাইরে যত ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে, আমরা সব পেয়েছি। একটাও বাদ পড়েনি। দক্ষিণ আফ্রিকায় দেখা দেওয়া নতুন ধরনটি কেবল ছড়াতে শুরু করেছে। যদি সেখান থেকে ছড়ায়, তাহলে আমাদের দেশে আসবে। এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে আসেনি। বাংলাদেশে আফ্রিকার লোকজনের আসা-যাওয়া কম। তবে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ওইসব দেশের যাতায়াত বেশি। ফলে যুক্তরাজ্য থেকে আসতে পারে। আফ্রিকাতেই প্রাথমিক অবস্থা।’
এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যে তথ্য পেয়েছি, তাতে এটা ডেল্টার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি মারাত্মক। ডেল্টা আফ্রিকাতে মারাত্মক ছিল। সেই ডেল্টারই আরেকটা ধরন এটা। এ ধরন নিজে নিজেই পাল্টায় এবং দ্রুত ছড়ায়। টিকাকে অকার্যকর করে দেয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমে দেখতে হবে আমাদের দেশে এটা এসেছে কি না। এর জন্য জিনোম সিকোয়েন্স করা দরকার। ইতিমধ্যেই যুক্তরাজ্য আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে। ওইসব দেশ থেকে যেসব লোকজন আসবে, তাদের ওপর অবশ্যই নজর রাখতে হবে। ওইসব দেশ থেকে আমাদের দেশে লোকজন কম আসে। সরাসরি বিমান চলাচল নেই। তাই এখনই ফ্লাইট বন্ধ করার দরকার নেই। তবে ইউরোপের দেশগুলো থেকে আসতে পারে। কারণ ইউরোপের সঙ্গে আফ্রিকার দেশগুলোর যাতায়াত আছে। সেই ক্ষেত্রে বিমান চলাচল বন্ধ করতে হবে।’