বিমান হামলায় যুদ্ধ শুরু
এহ্সান মাহমুদ | ৩ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০
৩ ডিসেম্বর বিকেলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার এক জনসভায় বক্তৃতা করছিলেন। এমন সময়ে ভারতের বেশ কয়েকটি বিমানঘাঁটিতে পাকিস্তান বিমান আক্রমণ শুরু করে। অনুষ্ঠান শেষ না করেই ইন্দিরা গান্ধী দিল্লি ফিরে যান। দিল্লিতে ফিরে মন্ত্রিসভার একটি জরুরি বৈঠক করেন এবং সেই রাতেই বেতার ভাষণে তিনি ঘোষণা করেন, ‘বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলে আসছিল তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।’
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ থেকে যে যুদ্ধ চালিয়ে আসছিল তার কোনো মূল লক্ষ্য ছিল না। তাই যোদ্ধারা হতোদ্যম হয়ে পড়েছিল। ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে আসছিল। ওদিকে ইয়াহিয়া সরকার মনে করেছিল, যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে। আরও আশা করেছিল বাংলাদেশের অভ্যুদয় রোধে আমেরিকা যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ দেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আসলে কাজে আসেনি।
৩ ডিসেম্বর বিকেলের হামলা বিষয়ে আরও তথ্য পাওয়া যায় ১৯৭১-এ ভারতের ইস্টার্ন আর্মির চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জ্যাক জেকবের সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা বইটিতে। সেদিনের ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন : ৩ ডিসেম্বর সন্ধে ছটায় আমি অফিসেই ছিলাম। এর মধ্যে জেনারেল মানেকশ’র একটি টেলিফোন পাই। তিনি আমাকে বলেন যে, পাকিস্তান বিমান থেকে পশ্চিমাঞ্চলে আমাদের এয়ারফিল্ডের ওপরে বোমাবর্ষণ করা হচ্ছে এবং কলকাতার রাজভবনে অবস্থানরত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে আমি যেন এই সংবাদ জানাই। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা আমাদের সৈন্য পরিচালনা করব কি না, আমি তাকে সেটা জিজ্ঞাসা করলে তিনি আমাকে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বিমান হামলা শুরু হওয়ার আগে পকিস্তানের আরেকটি ক্ষতি হয়। এটি সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। জেনারেল জ্যাক জেকবের বইটিতে এই ঘটনার উল্লেখ আছে। বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের সময়ে পাকিস্তানের সাবমেরিন ‘গাজী’ মাইন পাততে গিয়ে বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায়। এই ঘটনাটিকে দৈব ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে রূপ দেওয়ার চেষ্টা চলছিল পাকিস্তানের পক্ষ থেকে, তখন পাকিস্তানের শাসকেরা আরও নতুন নতুন কৌশল গ্রহণ করে। তার মধ্যে একটি ছিলভারত সরকারকে বিব্রত করার জন্য পাকিস্তান সরকার ভারতের পাঞ্জাব এলাকায় একটি স্বাধীন শিখপ্রধান রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে চরমপন্থি শিখদের সমর্থন দেবে বলে আশ^াস দিয়েছে। এই বিষয়ক একটি খবর প্রকাশিত হয় ৩ ডিসেম্বর তারিখের ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায়।
পাকিস্তান ভারতের বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালায় ৩ ডিসেম্বর বিকেলে। আর বাংলাদেশে সেদিন চলছিল চরম উৎকণ্ঠা। বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় যুদ্ধ তখন জোরেশোরে শুরু হয়েছে। ওই দিনের ঘটনার বিবরণ জানা যায় জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইতে। তিনি লিখেছেন : ‘সবগুলো খবরের কাগজে মোটা হেডলাইন দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন সীমান্তে ‘ভারতের আক্রমণের’ নিন্দাসূচক খবর ফলাও করে বেরোচ্ছে। আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার, আকাশবাণী, বিবিসি’র খবর শুনে সব খবর চালাচালি করে বুঝে নিই মুক্তিবাহিনী কোথায় কতটা এগোচ্ছে, পাকবাহিনী কোথায় কতটা মার খাচ্ছে।
ঢাকায় ৩ ডিসেম্বর রাতের ঘটনা জাহানারা ইমামের জবানিতে এসেছে এইভাবে : রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলাম। আমার দেখদেখি বাড়ির অন্যরাও। রাত দুটোর দিকে হঠাৎ বিমান-বিধ্বংসী কামানের ট্রেসার মারার ফটাফট শব্দে জেগে গেলাম। কী হচ্ছে, ঠিক যেন বুঝতে পরছিলাম না। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখিশূন্যে আলোর ফুলঝুরি। বুঝলাম সারাদিন যে যুদ্ধের সম্ভাবনার কথা নিয়ে সবাই চনমন করছে, তা-ই সত্যি হতে চলেছে।
শেয়ার করুন
এহ্সান মাহমুদ | ৩ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০

৩ ডিসেম্বর বিকেলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার এক জনসভায় বক্তৃতা করছিলেন। এমন সময়ে ভারতের বেশ কয়েকটি বিমানঘাঁটিতে পাকিস্তান বিমান আক্রমণ শুরু করে। অনুষ্ঠান শেষ না করেই ইন্দিরা গান্ধী দিল্লি ফিরে যান। দিল্লিতে ফিরে মন্ত্রিসভার একটি জরুরি বৈঠক করেন এবং সেই রাতেই বেতার ভাষণে তিনি ঘোষণা করেন, ‘বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলে আসছিল তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।’
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ থেকে যে যুদ্ধ চালিয়ে আসছিল তার কোনো মূল লক্ষ্য ছিল না। তাই যোদ্ধারা হতোদ্যম হয়ে পড়েছিল। ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে আসছিল। ওদিকে ইয়াহিয়া সরকার মনে করেছিল, যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে। আরও আশা করেছিল বাংলাদেশের অভ্যুদয় রোধে আমেরিকা যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ দেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আসলে কাজে আসেনি।
৩ ডিসেম্বর বিকেলের হামলা বিষয়ে আরও তথ্য পাওয়া যায় ১৯৭১-এ ভারতের ইস্টার্ন আর্মির চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জ্যাক জেকবের সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা বইটিতে। সেদিনের ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন : ৩ ডিসেম্বর সন্ধে ছটায় আমি অফিসেই ছিলাম। এর মধ্যে জেনারেল মানেকশ’র একটি টেলিফোন পাই। তিনি আমাকে বলেন যে, পাকিস্তান বিমান থেকে পশ্চিমাঞ্চলে আমাদের এয়ারফিল্ডের ওপরে বোমাবর্ষণ করা হচ্ছে এবং কলকাতার রাজভবনে অবস্থানরত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে আমি যেন এই সংবাদ জানাই। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা আমাদের সৈন্য পরিচালনা করব কি না, আমি তাকে সেটা জিজ্ঞাসা করলে তিনি আমাকে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বিমান হামলা শুরু হওয়ার আগে পকিস্তানের আরেকটি ক্ষতি হয়। এটি সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। জেনারেল জ্যাক জেকবের বইটিতে এই ঘটনার উল্লেখ আছে। বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের সময়ে পাকিস্তানের সাবমেরিন ‘গাজী’ মাইন পাততে গিয়ে বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায়। এই ঘটনাটিকে দৈব ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে রূপ দেওয়ার চেষ্টা চলছিল পাকিস্তানের পক্ষ থেকে, তখন পাকিস্তানের শাসকেরা আরও নতুন নতুন কৌশল গ্রহণ করে। তার মধ্যে একটি ছিলভারত সরকারকে বিব্রত করার জন্য পাকিস্তান সরকার ভারতের পাঞ্জাব এলাকায় একটি স্বাধীন শিখপ্রধান রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে চরমপন্থি শিখদের সমর্থন দেবে বলে আশ^াস দিয়েছে। এই বিষয়ক একটি খবর প্রকাশিত হয় ৩ ডিসেম্বর তারিখের ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায়।
পাকিস্তান ভারতের বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালায় ৩ ডিসেম্বর বিকেলে। আর বাংলাদেশে সেদিন চলছিল চরম উৎকণ্ঠা। বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় যুদ্ধ তখন জোরেশোরে শুরু হয়েছে। ওই দিনের ঘটনার বিবরণ জানা যায় জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইতে। তিনি লিখেছেন : ‘সবগুলো খবরের কাগজে মোটা হেডলাইন দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন সীমান্তে ‘ভারতের আক্রমণের’ নিন্দাসূচক খবর ফলাও করে বেরোচ্ছে। আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার, আকাশবাণী, বিবিসি’র খবর শুনে সব খবর চালাচালি করে বুঝে নিই মুক্তিবাহিনী কোথায় কতটা এগোচ্ছে, পাকবাহিনী কোথায় কতটা মার খাচ্ছে।
ঢাকায় ৩ ডিসেম্বর রাতের ঘটনা জাহানারা ইমামের জবানিতে এসেছে এইভাবে : রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলাম। আমার দেখদেখি বাড়ির অন্যরাও। রাত দুটোর দিকে হঠাৎ বিমান-বিধ্বংসী কামানের ট্রেসার মারার ফটাফট শব্দে জেগে গেলাম। কী হচ্ছে, ঠিক যেন বুঝতে পরছিলাম না। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখিশূন্যে আলোর ফুলঝুরি। বুঝলাম সারাদিন যে যুদ্ধের সম্ভাবনার কথা নিয়ে সবাই চনমন করছে, তা-ই সত্যি হতে চলেছে।