ভয় দেখাচ্ছে ওমিক্রন
প্রতীক ইজাজ ও পাঠান সোহাগ | ৩০ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০
দেশে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনে শনাক্তের সংখ্যা বাড়ছে। গতকাল বুধবার রাজধানীতে এক দিনেই তিনজনের শনাক্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তারা সবাই বনানীর বাসিন্দা। এ নিয়ে গত এক মাসে সাতজনের শনাক্তের খবর পাওয়া গেল। এর মধ্যে গত তিন দিনেই পাঁচজনের শনাক্তের তথ্য পাওয়া গেছে। বাকি দুজনের শনাক্তের খবর পাওয়া যায় গত ১১ ডিসেম্বর। ওমিক্রনে আক্রান্ত এ সাতজনের মধ্যে পাঁচজনই নারী এবং দুজন পুরুষ। তাদের মধ্যে দুজন নারী ক্রিকেটার আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়ে সফর করে আসা ও বাকি পাঁচজন ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে আসা এবং তাদের সংস্পর্শে যাওয়া।
ওমিক্রন সংক্রমণকে দেশের জন্য উদ্বেগজনক বলে মনে করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হঠাৎ করে যেভাবে করোনার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে, তাতে দ্রুত ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ ওমিক্রন ডেল্টা ধরনের চেয়ে ৭০-৮০ গুণ বেশি ছড়ায়।
বিশেষজ্ঞরা দেশে ওমিক্রনের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে কি না, তা জানতে এখন করোনা শনাক্তদের বেশি করে জিনোম সিকোয়েন্স করার ওপরও জোর দিয়েছেন।
এদিকে গত দুই মাস ধরে দেশে করোনা সংক্রমণ ধীরে ধীরে বাড়ছে। সর্বশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন ৪৯৫ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ ধরা পড়েছে, মৃত্যু হয়েছে আরও একজনের। এক দিনে শনাক্ত রোগীর এ সংখ্যা ১১ সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে সর্বশেষ ১৩ অক্টোবর এর চেয়ে বেশি রোগীর সংক্রমণ ধরা পড়েছিল। সেদিন শনাক্ত হয়েছিল ৫১৮ জন রোগী। এরপর থেকে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা পাঁচশোর নিচেই ছিল।
গতকাল পরীক্ষার বিপরীতে দৈনিক শনাক্ত রোগীর হারও আড়াই মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৩৭ শতাংশে পৌঁছেছে। এর আগের দিন গত মঙ্গলবার শনাক্ত হার ছিল ২ দশমিক ১০ শতাংশ। এর আগে গত ৯ অক্টোবর সর্বোচ্চ শনাক্ত হার ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ ছিল।
ওমিক্রন নিয়ে উদ্বিগ্ন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইইডিসিআর : ইতিমধ্যেই দেশে সাতজনের শরীরে ওমিক্রন শনাক্ত হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে গতকাল আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ওমিক্রন আমাদের দেশের জন্য অবশ্যই উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। কিছুদিনের মধ্যেই এটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। কারণ করোনার সংক্রমণ যদি অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে, দুই-তিন দিনে দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে, বুঝতে হবে যে ওমিক্রনের প্রভাব। কারণ ওমিক্রন দ্রুত ছড়ায়। এখন দৈনিক গড়ে ৩০০ শনাক্ত হচ্ছে। সেটা যদি এক সপ্তাহের মাথায় ৭০০-৮০০ হয়ে যায়, বা দুদিন পর ৬০০ হয়ে যাচ্ছে, তাহলে ধরতে হবে যে এটা ওমিক্রনের কারণে হচ্ছে।’
এর আগে গত রবিবার ওমিক্রন নিয়ে উদ্বেগ জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন। তিনি বলেন, করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন নিয়ে হেলাফেলার সুযোগ নেই। কারণ দক্ষিণ আফ্রিকায় এই ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার পর ইউরোপের বিভিন্ন হাসপাতালে শিশু এবং কমবয়সীদের ভর্তির হার বেড়েছে। এ বিষয়টি আমাদের মাথায় রাখতে হবে।
অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, বিশ্বের প্রায় ১১০টির মতো দেশে ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়েছে। এ পর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে এবং গবেষণা প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ওমিক্রমনের বিষয়ে কতগুলো বিষয় জানা গেছে অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে ওমিক্রনের সংক্রমণের ক্ষমতা দুই থেকে তিনগুণ বেশি। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, যেসব ঝুঁকির কারণে কভিড-১৯-এ হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়, দেখা গেছে ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজনীয়তা ৩০ ভাগ কম। এটা আমাদের জন্য একটা ভালো খবর। ডেল্টা বা আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ওমিক্রনে আক্রান্ত হলে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজনীয়তা ২০ ভাগ কম থাকবে।
অ্যান্টিজেন টেস্ট ও জিনোম সিকোয়েন্স বাড়ানোর পরামর্শ : ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এখন জিনোম সিকোয়েন্স আরও বাড়াতে হবে। এখন যত লোক শনাক্ত হচ্ছে, তাদের মধ্যে জিনোম সিকোয়েন্স আরও বেশি করা উচিত। কারণ প্রথম দিকে জিনোম সিকোয়েন্স খুব বেশি করা দরকার। পরের দিকে এত বেশি না করলেও চলে। কারণ ওমিক্রনের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হলো কি না, এটা বুঝতে জিনোম সিকোয়েন্স আরও বাড়াতে হয়।’
এই বিশেষজ্ঞ জানান, দেশে আইডিসিআরসহ সাতটি প্রতিষ্ঠান একটা কনসোর্টিয়াম করে একসঙ্গে জিনোম সিকোয়েন্স করে। এভাবেই এখন করা হচ্ছে। এর বাইরেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাদের সক্ষমতা আছে, তারাও করতে পারে।
ওমিক্রন নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের যেসব দেশে ওমিক্রনের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হচ্ছে, সেসব দেশের যাত্রীদের প্রত্যেককে র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট করা দরকার বলে মনে করেন ডা. মুশতাক হোসেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হলে র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টে ধরা পড়ে। কোন কোন দেশে ওমিক্রনের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিয়মিত রিপোর্ট করে থাকে। এর মধ্যে ইউরোপের অনেক দেশ, আমেরিকা, ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে। কারণ দেশে করোনা সংক্রমণ ধীরে ধীরে বাড়ছে।
অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন ওমিক্রন রোধে করণীয় বিষয়ে বলেন, ‘আগে যেসব প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছিল সেগুলোই থাকবে। কাপড়ের মাস্কের চেয়ে মেডিকেল গ্রেডের মাস্ক ব্যবহার করলে ওমিক্রন থেকে বেশি সুরক্ষা পাওয়া যায়। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলে, খোলামেলা আবহাওয়ায় থাকলে এবং বারবার হাত ধুতে পারলে আমরা অনেক বেশি ট্রান্সমিশন রোধ করতে পারব।’
তিনি বলেন, ‘যদি কেউ আগে কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে থাকেন এবং পরবর্তী সময়ে টিকা নেন তাহলে তাদের সংক্রমণের সম্ভাবনা কম থাকবে। তবে যেহেতু এটি দ্রুত ছড়ায় তাই আমরা যদি অসংখ্য রোগী পেয়ে যাই, সে ক্ষেত্রে অন্য রোগের কারণে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের জন্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে। যুক্তরাজ্যে প্রতিদিন লাখ ছাড়াচ্ছে সংক্রমণের হার। সেজন্য তারা বুস্টার ডোজের মাধ্যমে সংক্রমণের হার কমানো যায় কি না সে চেষ্টা করে যাচ্ছে।’
আক্রান্তরা ইউরোপ, আমেরিকা ও জিম্বাবুয়ে ফেরত : এ ব্যাপারে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘ওমিক্রনের আক্রান্তদের মধ্যে বিদেশ থেকে আগত আছে। আবার এদের সংস্পর্শে এসেছে এমন রোগীও আছে। এই সাতজনের মধ্যে দুজন আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়ে থেকে আসা, বাকি পাঁচজন ইউরোপ-আমেরিকা থেকে আসা। বিদেশ থেকে আসাদের পাশাপাশি তাদের সংস্পর্শে যাওয়ার কারণে এখন দেশের ভেতরও সংক্রমিত হচ্ছে।’
ওমিক্রনের তথ্য দিচ্ছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর : এ পর্যন্ত দেশে যে সাতজনের ওমিক্রন শনাক্তের খবর পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে মাত্র দুজনের তথ্য দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। বাকি পাঁচজনের তথ্য পাওয়া গেছে করোনাভাইরাসের জিনোমের উন্মুক্ত বৈশ্বিক তথ্যভান্ডার জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটা (জিআইএসএআইডি) থেকে। আইইডিসিআর জিআইএসএআইডিতে তথ্য সরবরাহ করলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য থাকছে না। এমনকি জিআইএসএআইডি থেকে তথ্য জেনে আইইডিসিআর কর্র্তৃপক্ষকে ফোন করলে তারা শনাক্তের কথা স্বীকার করলেও এ ব্যাপারে বিস্তারিত কোনো তথ্য দিচ্ছেন না।
১ মাসে আক্রান্ত ৭ : গতকাল বুধবার দেশে ওমিক্রনে আরও তিনজন সংক্রমিত হয়েছেন। এ নিয়ে দেশে সাতজন ওমিক্রন ধরনে সংক্রমিত হলেন। নতুন সংক্রমিত ব্যক্তিরা বনানীর বাসিন্দা। তাদের মধ্যে দুজনই নারী। গতকাল সকালে জিআইএসএআইডি জানিয়েছে, নতুন করে সংক্রমিত দুই নারীর একজনের বয়স ৩০, আরেকজনের বয়স ৪৭ বছর। তাদের একজনের নমুনা নেওয়া হয়েছে ১৯ ডিসেম্বর এবং আরেকজনের ৮ ডিসেম্বর। ওমিক্রনে আক্রান্ত হওয়া পুরুষ ব্যক্তির বয়স ৮৪ বছর। তার কাছ থেকে নমুনা নেওয়া হয় ১৯ ডিসেম্বর। নতুন করে ওমিক্রনে সংক্রমিত এ তিনজনই সুস্থ আছেন।
বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপিং সায়েন্স অ্যান্ড হেলথ ইনিশিয়েটিভস (আইডিসি) ওই তিনজনের নমুনা সংগ্রহ করে এবং সে নমুনা আইইডিসিআর বিশ্লেষণ করে জিআইএসএআইডিতে পাঠিয়েছে। নতুন সংক্রমিত ব্যক্তিদের সম্পর্কে এর বেশি বিস্তারিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
এর আগে গত মঙ্গলবার ওমিক্রনে আরও এক নারী সংক্রমিত হয়েছেন বলে জানা যায়। সংক্রমিত এই নারী রাজধানীর বাসাবোর বাসিন্দা। তার বয়স ৩৩ বছর। ২০ ডিসেম্বর ওই নারীর নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর আগের দিন সোমবার ঢাকার ৫৬ বছর বয়সী আরেক ব্যক্তি ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জিআইএসএআইডির তথ্যে জানা যায়।
এর আগে দেশে প্রথম ওমিক্রনে আক্রান্ত হন জিম্বাবুয়েফেরত বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের দুই নারী ক্রিকেটার। তারা দুজনই অবশ্য সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরেছেন। এই নারী ক্রিকেট দল জিম্বাবুয়ে থেকে ১ ডিসেম্বর দেশে ফেরে। ৬ ডিসেম্বর জানা যায়, দুই ক্রিকেটার করোনায় আক্রান্ত। আর ১১ ডিসেম্বর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, তারা ওমিক্রন ধরনে আক্রান্ত হয়েছেন। এরপর ১৪ ডিসেম্বর দলের আরেক পুরুষ সদস্যের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর জানা যায়। তিনি অবশ্য ওমিক্রনে নয়, ডেল্টা ধরনে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনজনকেই রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
শেয়ার করুন
প্রতীক ইজাজ ও পাঠান সোহাগ | ৩০ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০

দেশে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনে শনাক্তের সংখ্যা বাড়ছে। গতকাল বুধবার রাজধানীতে এক দিনেই তিনজনের শনাক্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তারা সবাই বনানীর বাসিন্দা। এ নিয়ে গত এক মাসে সাতজনের শনাক্তের খবর পাওয়া গেল। এর মধ্যে গত তিন দিনেই পাঁচজনের শনাক্তের তথ্য পাওয়া গেছে। বাকি দুজনের শনাক্তের খবর পাওয়া যায় গত ১১ ডিসেম্বর। ওমিক্রনে আক্রান্ত এ সাতজনের মধ্যে পাঁচজনই নারী এবং দুজন পুরুষ। তাদের মধ্যে দুজন নারী ক্রিকেটার আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়ে সফর করে আসা ও বাকি পাঁচজন ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে আসা এবং তাদের সংস্পর্শে যাওয়া।
ওমিক্রন সংক্রমণকে দেশের জন্য উদ্বেগজনক বলে মনে করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হঠাৎ করে যেভাবে করোনার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে, তাতে দ্রুত ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ ওমিক্রন ডেল্টা ধরনের চেয়ে ৭০-৮০ গুণ বেশি ছড়ায়।
বিশেষজ্ঞরা দেশে ওমিক্রনের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে কি না, তা জানতে এখন করোনা শনাক্তদের বেশি করে জিনোম সিকোয়েন্স করার ওপরও জোর দিয়েছেন।
এদিকে গত দুই মাস ধরে দেশে করোনা সংক্রমণ ধীরে ধীরে বাড়ছে। সর্বশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন ৪৯৫ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ ধরা পড়েছে, মৃত্যু হয়েছে আরও একজনের। এক দিনে শনাক্ত রোগীর এ সংখ্যা ১১ সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে সর্বশেষ ১৩ অক্টোবর এর চেয়ে বেশি রোগীর সংক্রমণ ধরা পড়েছিল। সেদিন শনাক্ত হয়েছিল ৫১৮ জন রোগী। এরপর থেকে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা পাঁচশোর নিচেই ছিল।
গতকাল পরীক্ষার বিপরীতে দৈনিক শনাক্ত রোগীর হারও আড়াই মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৩৭ শতাংশে পৌঁছেছে। এর আগের দিন গত মঙ্গলবার শনাক্ত হার ছিল ২ দশমিক ১০ শতাংশ। এর আগে গত ৯ অক্টোবর সর্বোচ্চ শনাক্ত হার ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ ছিল।
ওমিক্রন নিয়ে উদ্বিগ্ন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইইডিসিআর : ইতিমধ্যেই দেশে সাতজনের শরীরে ওমিক্রন শনাক্ত হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে গতকাল আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ওমিক্রন আমাদের দেশের জন্য অবশ্যই উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। কিছুদিনের মধ্যেই এটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। কারণ করোনার সংক্রমণ যদি অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে, দুই-তিন দিনে দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে, বুঝতে হবে যে ওমিক্রনের প্রভাব। কারণ ওমিক্রন দ্রুত ছড়ায়। এখন দৈনিক গড়ে ৩০০ শনাক্ত হচ্ছে। সেটা যদি এক সপ্তাহের মাথায় ৭০০-৮০০ হয়ে যায়, বা দুদিন পর ৬০০ হয়ে যাচ্ছে, তাহলে ধরতে হবে যে এটা ওমিক্রনের কারণে হচ্ছে।’
এর আগে গত রবিবার ওমিক্রন নিয়ে উদ্বেগ জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন। তিনি বলেন, করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন নিয়ে হেলাফেলার সুযোগ নেই। কারণ দক্ষিণ আফ্রিকায় এই ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার পর ইউরোপের বিভিন্ন হাসপাতালে শিশু এবং কমবয়সীদের ভর্তির হার বেড়েছে। এ বিষয়টি আমাদের মাথায় রাখতে হবে।
অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, বিশ্বের প্রায় ১১০টির মতো দেশে ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়েছে। এ পর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে এবং গবেষণা প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ওমিক্রমনের বিষয়ে কতগুলো বিষয় জানা গেছে অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে ওমিক্রনের সংক্রমণের ক্ষমতা দুই থেকে তিনগুণ বেশি। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, যেসব ঝুঁকির কারণে কভিড-১৯-এ হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়, দেখা গেছে ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজনীয়তা ৩০ ভাগ কম। এটা আমাদের জন্য একটা ভালো খবর। ডেল্টা বা আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ওমিক্রনে আক্রান্ত হলে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজনীয়তা ২০ ভাগ কম থাকবে।
অ্যান্টিজেন টেস্ট ও জিনোম সিকোয়েন্স বাড়ানোর পরামর্শ : ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এখন জিনোম সিকোয়েন্স আরও বাড়াতে হবে। এখন যত লোক শনাক্ত হচ্ছে, তাদের মধ্যে জিনোম সিকোয়েন্স আরও বেশি করা উচিত। কারণ প্রথম দিকে জিনোম সিকোয়েন্স খুব বেশি করা দরকার। পরের দিকে এত বেশি না করলেও চলে। কারণ ওমিক্রনের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হলো কি না, এটা বুঝতে জিনোম সিকোয়েন্স আরও বাড়াতে হয়।’
এই বিশেষজ্ঞ জানান, দেশে আইডিসিআরসহ সাতটি প্রতিষ্ঠান একটা কনসোর্টিয়াম করে একসঙ্গে জিনোম সিকোয়েন্স করে। এভাবেই এখন করা হচ্ছে। এর বাইরেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাদের সক্ষমতা আছে, তারাও করতে পারে।
ওমিক্রন নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের যেসব দেশে ওমিক্রনের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হচ্ছে, সেসব দেশের যাত্রীদের প্রত্যেককে র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট করা দরকার বলে মনে করেন ডা. মুশতাক হোসেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হলে র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টে ধরা পড়ে। কোন কোন দেশে ওমিক্রনের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিয়মিত রিপোর্ট করে থাকে। এর মধ্যে ইউরোপের অনেক দেশ, আমেরিকা, ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে। কারণ দেশে করোনা সংক্রমণ ধীরে ধীরে বাড়ছে।
অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন ওমিক্রন রোধে করণীয় বিষয়ে বলেন, ‘আগে যেসব প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছিল সেগুলোই থাকবে। কাপড়ের মাস্কের চেয়ে মেডিকেল গ্রেডের মাস্ক ব্যবহার করলে ওমিক্রন থেকে বেশি সুরক্ষা পাওয়া যায়। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলে, খোলামেলা আবহাওয়ায় থাকলে এবং বারবার হাত ধুতে পারলে আমরা অনেক বেশি ট্রান্সমিশন রোধ করতে পারব।’
তিনি বলেন, ‘যদি কেউ আগে কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে থাকেন এবং পরবর্তী সময়ে টিকা নেন তাহলে তাদের সংক্রমণের সম্ভাবনা কম থাকবে। তবে যেহেতু এটি দ্রুত ছড়ায় তাই আমরা যদি অসংখ্য রোগী পেয়ে যাই, সে ক্ষেত্রে অন্য রোগের কারণে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের জন্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে। যুক্তরাজ্যে প্রতিদিন লাখ ছাড়াচ্ছে সংক্রমণের হার। সেজন্য তারা বুস্টার ডোজের মাধ্যমে সংক্রমণের হার কমানো যায় কি না সে চেষ্টা করে যাচ্ছে।’
আক্রান্তরা ইউরোপ, আমেরিকা ও জিম্বাবুয়ে ফেরত : এ ব্যাপারে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘ওমিক্রনের আক্রান্তদের মধ্যে বিদেশ থেকে আগত আছে। আবার এদের সংস্পর্শে এসেছে এমন রোগীও আছে। এই সাতজনের মধ্যে দুজন আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়ে থেকে আসা, বাকি পাঁচজন ইউরোপ-আমেরিকা থেকে আসা। বিদেশ থেকে আসাদের পাশাপাশি তাদের সংস্পর্শে যাওয়ার কারণে এখন দেশের ভেতরও সংক্রমিত হচ্ছে।’
ওমিক্রনের তথ্য দিচ্ছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর : এ পর্যন্ত দেশে যে সাতজনের ওমিক্রন শনাক্তের খবর পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে মাত্র দুজনের তথ্য দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। বাকি পাঁচজনের তথ্য পাওয়া গেছে করোনাভাইরাসের জিনোমের উন্মুক্ত বৈশ্বিক তথ্যভান্ডার জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটা (জিআইএসএআইডি) থেকে। আইইডিসিআর জিআইএসএআইডিতে তথ্য সরবরাহ করলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য থাকছে না। এমনকি জিআইএসএআইডি থেকে তথ্য জেনে আইইডিসিআর কর্র্তৃপক্ষকে ফোন করলে তারা শনাক্তের কথা স্বীকার করলেও এ ব্যাপারে বিস্তারিত কোনো তথ্য দিচ্ছেন না।
১ মাসে আক্রান্ত ৭ : গতকাল বুধবার দেশে ওমিক্রনে আরও তিনজন সংক্রমিত হয়েছেন। এ নিয়ে দেশে সাতজন ওমিক্রন ধরনে সংক্রমিত হলেন। নতুন সংক্রমিত ব্যক্তিরা বনানীর বাসিন্দা। তাদের মধ্যে দুজনই নারী। গতকাল সকালে জিআইএসএআইডি জানিয়েছে, নতুন করে সংক্রমিত দুই নারীর একজনের বয়স ৩০, আরেকজনের বয়স ৪৭ বছর। তাদের একজনের নমুনা নেওয়া হয়েছে ১৯ ডিসেম্বর এবং আরেকজনের ৮ ডিসেম্বর। ওমিক্রনে আক্রান্ত হওয়া পুরুষ ব্যক্তির বয়স ৮৪ বছর। তার কাছ থেকে নমুনা নেওয়া হয় ১৯ ডিসেম্বর। নতুন করে ওমিক্রনে সংক্রমিত এ তিনজনই সুস্থ আছেন।
বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপিং সায়েন্স অ্যান্ড হেলথ ইনিশিয়েটিভস (আইডিসি) ওই তিনজনের নমুনা সংগ্রহ করে এবং সে নমুনা আইইডিসিআর বিশ্লেষণ করে জিআইএসএআইডিতে পাঠিয়েছে। নতুন সংক্রমিত ব্যক্তিদের সম্পর্কে এর বেশি বিস্তারিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
এর আগে গত মঙ্গলবার ওমিক্রনে আরও এক নারী সংক্রমিত হয়েছেন বলে জানা যায়। সংক্রমিত এই নারী রাজধানীর বাসাবোর বাসিন্দা। তার বয়স ৩৩ বছর। ২০ ডিসেম্বর ওই নারীর নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর আগের দিন সোমবার ঢাকার ৫৬ বছর বয়সী আরেক ব্যক্তি ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জিআইএসএআইডির তথ্যে জানা যায়।
এর আগে দেশে প্রথম ওমিক্রনে আক্রান্ত হন জিম্বাবুয়েফেরত বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের দুই নারী ক্রিকেটার। তারা দুজনই অবশ্য সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরেছেন। এই নারী ক্রিকেট দল জিম্বাবুয়ে থেকে ১ ডিসেম্বর দেশে ফেরে। ৬ ডিসেম্বর জানা যায়, দুই ক্রিকেটার করোনায় আক্রান্ত। আর ১১ ডিসেম্বর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, তারা ওমিক্রন ধরনে আক্রান্ত হয়েছেন। এরপর ১৪ ডিসেম্বর দলের আরেক পুরুষ সদস্যের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর জানা যায়। তিনি অবশ্য ওমিক্রনে নয়, ডেল্টা ধরনে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনজনকেই রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।