আইভী আইভী এবং আইভী
উম্মুল ওয়ারা সুইটি, প্রতীক ইজাজ নারায়ণগঞ্জ থেকে ফিরে ও কমল খান, নারায়ণগঞ্জ | ১৭ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০
নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ এলাকায় ‘চুনকা কুটির’ আবারও বিজয়োল্লাসে মেতেছে গতকাল রবিবার সন্ধ্যার পর থেকেই। টানা তৃতীয়বারের মতো নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের হাল ধরবেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। বিপুল ব্যবধানে হারিয়ে দিলেন বিএনপি থেকে অব্যাহতি পাওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারকে। ১৯২টি কেন্দ্রের মধ্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত আইভী নৌকা প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ১ লাখ ৫৯ হাজার ৯৭ ভোট। অন্যদিকে হাতি প্রতীকে তৈমূর আলম খন্দকার পেয়েছেন ৯২ হাজার ৫৬২ ভোট। সে হিসাবে তৈমূরের চেয়ে ৬৬ হাজার ৫৩৫ ভোট বেশি পেয়েছেন আইভী। এই হ্যাটট্রিক জয়ে আনন্দে ভাসছেন আওয়ামী লীগ ও আইভীর কর্মী-সমর্থকরা। স্বস্তি পেল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
একদিকে নৌকার প্রার্থী আইভীর দলের প্রভাবশালী নেতা সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বিরোধ এবং এই বিরোধকে কেন্দ্র করে নৌকার ভোট বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারের বাক্সে চলেই গেল এসব নানা আলোচনা-সমালোচনায় সারা দেশের নজর ছিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিকে। আবার গত ছয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীদের বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হার ক্ষমতাসীনদের মধ্যে চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছিল। ফলে নাসিক নির্বাচন ছিল ক্ষমতাসীনদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জের। একইভাবে শামীম ওসমানের সঙ্গে বিরোধ এবং তৃণমূলে দলের টানা হার থেকে নিজের জয় বের করে আনা আইভীর জন্যও ছিল অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের। তাই ভোটের ফল ঘোষণার আগপর্যন্ত ছিল টান টান উত্তেজনা।
শামীম ওসমানের প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে ‘নৌকার পক্ষেই তার সমর্থন রয়েছে’ এরকম প্রতিশ্রুতির পরও গত কয়েক দিন এবং গতকাল দিনভর ছিল একটা আশঙ্কা। নৌকার ভোট নৌকায় যাবে কি না এ আশঙ্কাই নয়, সেই সঙ্গে আইভী ও তৈমূরসহ সব মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যেই ছিল সংশয় আর শঙ্কা শেষ পর্যন্ত কেমন হবে নির্বাচন ও নির্বাচনের পরিবেশ।
দেশের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও স্থানীয়ভাবে তৈমূরকে সমর্থন দিয়েছে। তিনিও আওয়ামী লীগের স্থানীয় বিরোধে অনেকটাই আশার আলো দেখেছেন। ফলে গতকাল সকাল ভোট দিয়ে আইভী এবং তৈমূর দুজনই মন্তব্য করেছেন সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে তারা জিতবেন। যদিও পরাজয়ের পর তৈমূর বলেছেন, ভোটে প্রশাসনিক ইঞ্জিনিয়ারিং হয়েছে। জয়ের পর আইভী বলেছেন, এ জয় নৌকার। এ জয় জনগণের।
গতকাল নাসিকের নির্বাচন কেন্দ্র সরেজমিন ঘুরে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, কোনো ধরনের সহিংসতা ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবেই হয়েছে নির্বাচন। প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে নির্বাচনের আগে বিশৃঙ্খলতা বা সহিংসতার আশঙ্কা থাকলেও এর ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি।
গতকাল দিনভর ভোটগ্রহণের পর নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে স্থাপিত ফলাফল সংগ্রহ ও পরিবেশন কেন্দ্র থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তা মাহফুজা আক্তার ফল ঘোষণা শুরু করেন। প্রথম থেকেই কেন্দ্রগুলোর ফলাফলে আইভীর পাল্লাই ভারী হতে থাকে। আর সেই সঙ্গে শুরু হয় পাড়ায় পাড়ায় আইভীর পক্ষে ও নৌকার পক্ষের মিছিল।
শহরের দেওভোগ এলাকায় আইভীর বাসভবন ‘চুনকা কুটির’-এর পাশে প্রধান নির্বাচনী ক্যাম্পে সমবেত হন কয়েক হাজার সমর্থক। তারা স্লোগান দিয়ে আতশবাজি ফুটিয়ে উল্লাস করেন। রাত ৮টার দিকে আইভী সমর্থকদের একটি মিছিল জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের প্রাঙ্গণে ঢুকে, যেখানে তখনো নির্বাচনের ফল পরিবেশন করছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।
মধ্যরাতে মেয়র পদে আইভীকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। সর্বশেষ ফল অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী ১ লাখ ৫৯ হাজার ৯৭ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার পেয়েছেন ৯২ হাজার ৫৬২ ভোট। সে হিসাবে তৈমূরের চেয়ে ৬৬ হাজার ৫৩৫ ভোট বেশি পেয়েছেন আইভী।
এ নির্বাচনে ভোটার ৫ লাখ ১৭ হাজার ৩৫১ জন। ভোট পড়েছে ২ লাখ ৯১ হাজার ৩৮২টি। এর মধ্যে ৪৭১ ভোট বাতিল হয়েছে। প্রদত্ত ভোটের হার ৫৬ দশমিক ৩২ শতাংশ।
অপর মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাছুম বিল্লাহ হাতপাখা প্রতীকে ২৩ হাজার ৯৮৭ ভোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের এ বি এম সিরাজুল মামুন দেয়ালঘড়ি প্রতীকে ১০ হাজার ৭২৪ ভোট, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির রাশেদ ফেরদৌস হাতঘড়ি প্রতীকে ১ হাজার ৯২৭ ভোট, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মো. জসিম উদ্দিন বটগাছ প্রতীকে ১ হাজার ৩০৯ ভোট এবং স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী কামরুল ইসলাম ঘোড়া প্রতীকে ১ হাজার ৩০৫ ভোট পেয়েছেন।
এর আগে ২০১১ সালের প্রথম নির্বাচনে এবং ২০১৬ সালের দ্বিতীয় নির্বাচনেও আইভী মেয়র পদে জয়লাভ করেছিলেন।
আইভী নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি। তার বাবা আলী আহাম্মদ চুনকা নারায়ণগঞ্জ জেলা ও শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি দুই মেয়াদে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি মারা যান। আলী আহাম্মদ চুনকার পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার বড় হলেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। তিনি ১৯৭৯ সালে ট্যালেন্টপুলে জুনিয়র স্কলারশিপ পান এবং ১৯৮২ সালে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় স্টারমার্কসহ উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ১৯৮৫ সালে রাশিয়ান সরকারের স্কলারশিপ নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানে শিক্ষাগ্রহণের জন্য ওদেসা পিরাগোব মেডিকেল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন এবং ১৯৯২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে ডক্টর অব মেডিসিন ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীকালে ১৯৯২-৯৩ সালে ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালে ইন্টার্নি সম্পন্ন করেন। ডা. আইভী তার সুদীর্ঘ শিক্ষাজীবনের পর ১৯৯৩-৯৪ সালে মিটফোর্ড হাসপাতালে এবং ১৯৯৪-৯৫ সালে নারায়ণগঞ্জ ২০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে অনারারি চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন।
১৯৯৩ সালে আইভী নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০৩ সালে অনুষ্ঠিত বিলুপ্ত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। নির্বাচনের মাত্র ১৭ দিন আগে নিউজিল্যান্ড থেকে তাকে উড়িয়ে দেশে আনা হয়। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দিয়ে তার পক্ষে নারায়ণগঞ্জে জোর প্রচারণা চালান দলের কেন্দ্রীয় অনেক নেতা। তখন বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও বিপুল ভোটে জয়ী হন তিনি। ওই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণ করে ২০১১ সালের ২৫ জুন পর্যন্ত একটানা পৌর চেয়ারম্যান পদে ছিলেন। ২০১১ সালে ৫ মে নারায়ণগঞ্জের তিনটি পৌরসভা যথাক্রমে নারায়ণগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ ও কদমরসুলকে একীভূত করে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) প্রতিষ্ঠা বিধিমালা ২০১০ এর বিধি ৬-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার প্রায় ৭২.৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত প্রথম সিটি নির্বাচনে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী মেয়র নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে এক লাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন আইভী।
২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। বিএনপি দলীয়ভাবে এ নির্বাচন বয়কট করলেও দলের কেন্দ্রীয় নেতা তৈমূর আলম খন্দকার স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী হিসেবে হাতি প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় তাকে প্রথমে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক এবং পরে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তারপরও স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মী ও নগরীর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সমর্থনে ভোটযুদ্ধে নামেন তৈমূর। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটগ্রহণ পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন হয়েছে।
এদিকে নিজেদের মেয়াদের শেষ সময়ে বড় নির্বাচনটি দেখতে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তবে কেমন ভোট হচ্ছে তা নিয়ে মন্তব্য না করে শুধু বলেছেন, বিদায়লগ্নে ভালো একটা নির্বাচন দেখতে চাই। তাই এখানে এসেছি। পরে ঢাকায় ফিরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন আমাদের কার্যকালে সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এটি ছিল আমার অনেক প্রত্যাশার স্থান। কারণ আমি ইতিপূর্বে বলেছি যার শেষ ভালো, তার সব ভালো।
২০১১ ও ’১৬ সালের নির্বাচনে পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি কেন্দ্রে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ হলেও এবারই প্রথম এ সিটির ২৭টি ওয়ার্ডের ১৯২টি কেন্দ্রের ১ হাজার ৩৩৩টি বুথে একযোগে ইভিএমে ভোট হয়। যন্ত্রে ভোট দেওয়ার বিষয়টি অধিকাংশের জন্য ছিল নতুন এক অভিজ্ঞতা।
এ নির্বাচনে সংরক্ষিত ৯টি ওয়ার্ডে নারী কাউন্সিলর পদে ৩৪ এবং ২৭টি সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ভোটে লড়েছেন ১৪৮ জন। মোট ভোটকেন্দ্র ১৯২টি।
বেলা ১১টার দিকে নগরীর শিশুবাগ বিদ্যালয়ের নারী কেন্দ্রে ভোট দেওয়া শেষে সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের মানুষ নির্ধারণ করে ফেলেছেন আমাকেই ভোট দেবেন। ইনশাআল্লাহ নৌকার জয় হবেই হবে, আইভীর জয় হবেই হবে।’
সকাল সাড়ে ৮টায় নারায়ণগঞ্জ ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে ভোট প্রদান করেন মেয়র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার। ভোট দেওয়া শেষে তিনি নির্বাচনে লক্ষাধিক ভোটে জয় পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ভোটগ্রহণ শেষে বিকেলে দৃশ্যমান কোনো কারচুপি না হলে জনগণের রায় মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন। নির্বাচনের ফল মেনে নেবেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তৈমূর বলেন, ‘সরকার বা নির্বাচন কমিশনের দৃশ্যমান কোনো কারচুপি না হলে জনগণের যেকোনো রায় মেনে নেব। গোলযোগ ছাড়াই ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। তবে বিতর্কিত কিছু হয়েছে কি না, সেটা দেখতে হবে। কারণ ইভিএমের বিষয়ে আমাদের শঙ্কা আছে।’
শেয়ার করুন
উম্মুল ওয়ারা সুইটি, প্রতীক ইজাজ নারায়ণগঞ্জ থেকে ফিরে ও কমল খান, নারায়ণগঞ্জ | ১৭ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০

নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ এলাকায় ‘চুনকা কুটির’ আবারও বিজয়োল্লাসে মেতেছে গতকাল রবিবার সন্ধ্যার পর থেকেই। টানা তৃতীয়বারের মতো নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের হাল ধরবেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। বিপুল ব্যবধানে হারিয়ে দিলেন বিএনপি থেকে অব্যাহতি পাওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারকে। ১৯২টি কেন্দ্রের মধ্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত আইভী নৌকা প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ১ লাখ ৫৯ হাজার ৯৭ ভোট। অন্যদিকে হাতি প্রতীকে তৈমূর আলম খন্দকার পেয়েছেন ৯২ হাজার ৫৬২ ভোট। সে হিসাবে তৈমূরের চেয়ে ৬৬ হাজার ৫৩৫ ভোট বেশি পেয়েছেন আইভী। এই হ্যাটট্রিক জয়ে আনন্দে ভাসছেন আওয়ামী লীগ ও আইভীর কর্মী-সমর্থকরা। স্বস্তি পেল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
একদিকে নৌকার প্রার্থী আইভীর দলের প্রভাবশালী নেতা সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বিরোধ এবং এই বিরোধকে কেন্দ্র করে নৌকার ভোট বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারের বাক্সে চলেই গেল এসব নানা আলোচনা-সমালোচনায় সারা দেশের নজর ছিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিকে। আবার গত ছয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীদের বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হার ক্ষমতাসীনদের মধ্যে চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছিল। ফলে নাসিক নির্বাচন ছিল ক্ষমতাসীনদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জের। একইভাবে শামীম ওসমানের সঙ্গে বিরোধ এবং তৃণমূলে দলের টানা হার থেকে নিজের জয় বের করে আনা আইভীর জন্যও ছিল অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের। তাই ভোটের ফল ঘোষণার আগপর্যন্ত ছিল টান টান উত্তেজনা।
শামীম ওসমানের প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে ‘নৌকার পক্ষেই তার সমর্থন রয়েছে’ এরকম প্রতিশ্রুতির পরও গত কয়েক দিন এবং গতকাল দিনভর ছিল একটা আশঙ্কা। নৌকার ভোট নৌকায় যাবে কি না এ আশঙ্কাই নয়, সেই সঙ্গে আইভী ও তৈমূরসহ সব মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যেই ছিল সংশয় আর শঙ্কা শেষ পর্যন্ত কেমন হবে নির্বাচন ও নির্বাচনের পরিবেশ।
দেশের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও স্থানীয়ভাবে তৈমূরকে সমর্থন দিয়েছে। তিনিও আওয়ামী লীগের স্থানীয় বিরোধে অনেকটাই আশার আলো দেখেছেন। ফলে গতকাল সকাল ভোট দিয়ে আইভী এবং তৈমূর দুজনই মন্তব্য করেছেন সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে তারা জিতবেন। যদিও পরাজয়ের পর তৈমূর বলেছেন, ভোটে প্রশাসনিক ইঞ্জিনিয়ারিং হয়েছে। জয়ের পর আইভী বলেছেন, এ জয় নৌকার। এ জয় জনগণের।
গতকাল নাসিকের নির্বাচন কেন্দ্র সরেজমিন ঘুরে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, কোনো ধরনের সহিংসতা ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবেই হয়েছে নির্বাচন। প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে নির্বাচনের আগে বিশৃঙ্খলতা বা সহিংসতার আশঙ্কা থাকলেও এর ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি।
গতকাল দিনভর ভোটগ্রহণের পর নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে স্থাপিত ফলাফল সংগ্রহ ও পরিবেশন কেন্দ্র থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তা মাহফুজা আক্তার ফল ঘোষণা শুরু করেন। প্রথম থেকেই কেন্দ্রগুলোর ফলাফলে আইভীর পাল্লাই ভারী হতে থাকে। আর সেই সঙ্গে শুরু হয় পাড়ায় পাড়ায় আইভীর পক্ষে ও নৌকার পক্ষের মিছিল।
শহরের দেওভোগ এলাকায় আইভীর বাসভবন ‘চুনকা কুটির’-এর পাশে প্রধান নির্বাচনী ক্যাম্পে সমবেত হন কয়েক হাজার সমর্থক। তারা স্লোগান দিয়ে আতশবাজি ফুটিয়ে উল্লাস করেন। রাত ৮টার দিকে আইভী সমর্থকদের একটি মিছিল জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের প্রাঙ্গণে ঢুকে, যেখানে তখনো নির্বাচনের ফল পরিবেশন করছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।
মধ্যরাতে মেয়র পদে আইভীকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। সর্বশেষ ফল অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী ১ লাখ ৫৯ হাজার ৯৭ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার পেয়েছেন ৯২ হাজার ৫৬২ ভোট। সে হিসাবে তৈমূরের চেয়ে ৬৬ হাজার ৫৩৫ ভোট বেশি পেয়েছেন আইভী।
এ নির্বাচনে ভোটার ৫ লাখ ১৭ হাজার ৩৫১ জন। ভোট পড়েছে ২ লাখ ৯১ হাজার ৩৮২টি। এর মধ্যে ৪৭১ ভোট বাতিল হয়েছে। প্রদত্ত ভোটের হার ৫৬ দশমিক ৩২ শতাংশ।
অপর মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাছুম বিল্লাহ হাতপাখা প্রতীকে ২৩ হাজার ৯৮৭ ভোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের এ বি এম সিরাজুল মামুন দেয়ালঘড়ি প্রতীকে ১০ হাজার ৭২৪ ভোট, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির রাশেদ ফেরদৌস হাতঘড়ি প্রতীকে ১ হাজার ৯২৭ ভোট, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মো. জসিম উদ্দিন বটগাছ প্রতীকে ১ হাজার ৩০৯ ভোট এবং স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী কামরুল ইসলাম ঘোড়া প্রতীকে ১ হাজার ৩০৫ ভোট পেয়েছেন।
এর আগে ২০১১ সালের প্রথম নির্বাচনে এবং ২০১৬ সালের দ্বিতীয় নির্বাচনেও আইভী মেয়র পদে জয়লাভ করেছিলেন।
আইভী নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি। তার বাবা আলী আহাম্মদ চুনকা নারায়ণগঞ্জ জেলা ও শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি দুই মেয়াদে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি মারা যান। আলী আহাম্মদ চুনকার পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার বড় হলেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। তিনি ১৯৭৯ সালে ট্যালেন্টপুলে জুনিয়র স্কলারশিপ পান এবং ১৯৮২ সালে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় স্টারমার্কসহ উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ১৯৮৫ সালে রাশিয়ান সরকারের স্কলারশিপ নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানে শিক্ষাগ্রহণের জন্য ওদেসা পিরাগোব মেডিকেল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন এবং ১৯৯২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে ডক্টর অব মেডিসিন ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীকালে ১৯৯২-৯৩ সালে ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালে ইন্টার্নি সম্পন্ন করেন। ডা. আইভী তার সুদীর্ঘ শিক্ষাজীবনের পর ১৯৯৩-৯৪ সালে মিটফোর্ড হাসপাতালে এবং ১৯৯৪-৯৫ সালে নারায়ণগঞ্জ ২০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে অনারারি চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন।
১৯৯৩ সালে আইভী নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০৩ সালে অনুষ্ঠিত বিলুপ্ত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। নির্বাচনের মাত্র ১৭ দিন আগে নিউজিল্যান্ড থেকে তাকে উড়িয়ে দেশে আনা হয়। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দিয়ে তার পক্ষে নারায়ণগঞ্জে জোর প্রচারণা চালান দলের কেন্দ্রীয় অনেক নেতা। তখন বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও বিপুল ভোটে জয়ী হন তিনি। ওই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণ করে ২০১১ সালের ২৫ জুন পর্যন্ত একটানা পৌর চেয়ারম্যান পদে ছিলেন। ২০১১ সালে ৫ মে নারায়ণগঞ্জের তিনটি পৌরসভা যথাক্রমে নারায়ণগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ ও কদমরসুলকে একীভূত করে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) প্রতিষ্ঠা বিধিমালা ২০১০ এর বিধি ৬-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার প্রায় ৭২.৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত প্রথম সিটি নির্বাচনে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী মেয়র নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে এক লাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন আইভী।
২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। বিএনপি দলীয়ভাবে এ নির্বাচন বয়কট করলেও দলের কেন্দ্রীয় নেতা তৈমূর আলম খন্দকার স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী হিসেবে হাতি প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় তাকে প্রথমে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক এবং পরে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তারপরও স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মী ও নগরীর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সমর্থনে ভোটযুদ্ধে নামেন তৈমূর। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটগ্রহণ পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন হয়েছে।
এদিকে নিজেদের মেয়াদের শেষ সময়ে বড় নির্বাচনটি দেখতে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তবে কেমন ভোট হচ্ছে তা নিয়ে মন্তব্য না করে শুধু বলেছেন, বিদায়লগ্নে ভালো একটা নির্বাচন দেখতে চাই। তাই এখানে এসেছি। পরে ঢাকায় ফিরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন আমাদের কার্যকালে সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এটি ছিল আমার অনেক প্রত্যাশার স্থান। কারণ আমি ইতিপূর্বে বলেছি যার শেষ ভালো, তার সব ভালো।
২০১১ ও ’১৬ সালের নির্বাচনে পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি কেন্দ্রে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ হলেও এবারই প্রথম এ সিটির ২৭টি ওয়ার্ডের ১৯২টি কেন্দ্রের ১ হাজার ৩৩৩টি বুথে একযোগে ইভিএমে ভোট হয়। যন্ত্রে ভোট দেওয়ার বিষয়টি অধিকাংশের জন্য ছিল নতুন এক অভিজ্ঞতা।
এ নির্বাচনে সংরক্ষিত ৯টি ওয়ার্ডে নারী কাউন্সিলর পদে ৩৪ এবং ২৭টি সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ভোটে লড়েছেন ১৪৮ জন। মোট ভোটকেন্দ্র ১৯২টি।
বেলা ১১টার দিকে নগরীর শিশুবাগ বিদ্যালয়ের নারী কেন্দ্রে ভোট দেওয়া শেষে সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের মানুষ নির্ধারণ করে ফেলেছেন আমাকেই ভোট দেবেন। ইনশাআল্লাহ নৌকার জয় হবেই হবে, আইভীর জয় হবেই হবে।’
সকাল সাড়ে ৮টায় নারায়ণগঞ্জ ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে ভোট প্রদান করেন মেয়র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার। ভোট দেওয়া শেষে তিনি নির্বাচনে লক্ষাধিক ভোটে জয় পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ভোটগ্রহণ শেষে বিকেলে দৃশ্যমান কোনো কারচুপি না হলে জনগণের রায় মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন। নির্বাচনের ফল মেনে নেবেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তৈমূর বলেন, ‘সরকার বা নির্বাচন কমিশনের দৃশ্যমান কোনো কারচুপি না হলে জনগণের যেকোনো রায় মেনে নেব। গোলযোগ ছাড়াই ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। তবে বিতর্কিত কিছু হয়েছে কি না, সেটা দেখতে হবে। কারণ ইভিএমের বিষয়ে আমাদের শঙ্কা আছে।’