ধর্ষণের শিকার বলে শিশুকে বের করে দিল মাদ্রাসা থেকে
নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী | ২২ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০
ধর্ষণের শিকার হয়েছিল এমন তথ্য পেয়ে ভর্তি বাতিল করে এক শিশুকে মাদ্রাসা থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে রাজশাহীর একটি মাদ্রাসা কর্র্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। এমনকি অভিভাবকদের না জানিয়েই শিশুকে ওই আবাসিক মাদ্রাসা থেকে বের করে ফটক আটকে দেওয়া হয়। মাদ্রাসা কর্র্তৃপক্ষ বলছে, অন্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা আপত্তি জানানোয় শিশুটির ভর্তি বাতিল করা হয়েছে। বাধ্য হয়ে শিশুকে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেছেন তার অভিভাবকরা।
মাদ্রাসা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া শিশুর বয়স এখন আট বছর। ২০২০ সালের ২১ মার্চ প্রতিবেশী এক কিশোরের হাতে ধর্ষণের শিকার হয় সে। ওই ঘটনায় হওয়া মামলায় গ্রেপ্তারের পর সেই কিশোর এখন বন্দি রয়েছে রাজশাহী কারাগারের কিশোর ওয়ার্ডে। পুলিশি তদন্তে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতাও মিলেছে।
মাদ্রাসা থেকে বিতাড়িত হওয়া শিশুর বাবা শারীরিক প্রতিবন্ধী। নিজের কোনো ভিটেমাটি নেই। রাজশাহী নগরীতে রেলওয়ের জমির ওপর গড়ে ওঠা বস্তির একটি ঘরে পরিবার নিয়ে তার বসবাস। সড়ক দুর্ঘটনায় শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে এখন অটোরিকশা চালিয়ে কোনোরকমে সংসার চালাচ্ছেন।
জানা গেছে, ২০২০ সালের ২০ মার্চ প্রতিবেশী এক কিশোর বাড়িতে গিয়ে শিশুটির কাছে দিয়াশলাই চায়। ওই শিশু দিয়াশলাই দিলে কিশোর সেটি নিয়ে হাঁটা ধরে। দিয়াশলাইয়ের জন্য শিশুটিও কিশোরের পিছু নেয়। একপর্যায়ে বাড়ির পাশের নির্জন স্থানে শিশুটিকে ধর্ষণ করে ওই কিশোর। ধারণ করে ভিডিও চিত্রও। পরে ঘটনাটি এলাকায় জানাজানি হলে শিশুর মা বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন। এরপর পুলিশ কিশোরকে আটকের পাশাপাশি তার মোবাইল ফোনটি জব্দ করে।
ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে চলতি মাসের শুরুতে রাজশাহী নগরীর হড়গ্রাম মুন্সিপাড়া এলাকার উম্মাহাতুল মু’মিনীন মহিলা মাদ্রাসায় শিশুকে ভর্তি করেন তার অভিভাবকরা। বেসরকারি এই মাদ্রাসাটিতে শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থাও রয়েছে। শিশুর মা ভেবেছিলেন, এই মাদ্রাসায় ভর্তি করলে তার সন্তান নিরাপদেই থাকবে। তবে তিন দিন পরই তাকে মাদ্রাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়। ফেরত দেওয়া হয়েছে ভর্তিবাবদ ও আবাসিক ছাত্রী হিসেবে মাদ্রাসায় থাকার জন্য জমা নেওয়া টাকা।
অভিভাবকদের না জানিয়েই শিশুকে মাদ্রাসা থেকে বের করে ফটক আটকে দেওয়া হয় জানিয়ে তার মা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভর্তির তিন দিন পর আমার মেয়েকে মাদ্রাসার গেটের বাইরে বের করে দেওয়া হয়। তারপর গেট লাগিয়ে দেয়। মেয়েটা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে তখন কাঁদছিল। পরে মাদ্রাসার পরিচালক আমাকে ডাকল। আমাকে বলল, “আপনার মেয়েকে নিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও ভর্তি করেন।” আমি বললাম, আমার মেয়ের কোনো সমস্যা? তখন বললেন, “না, দূরে কোথাও ভর্তি করেন।” আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, আপনার মেয়ের সঙ্গে যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে, তাহলে আপনি কী করবেন? তখন কোনো কথা বলছে না সে (মাদ্রাসা পরিচালক)। আমাকে টাকাটা ফেরত দিয়ে মেয়েকে বের করে দিল। আমার মেয়ের কোনো সমস্যা দেখাতে পারছে না, খালি বলছে “দূরে কোথাও ভর্তি করেন”।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদ্রাসাটির পরিচালক মাওলানা মোহা. হাবিবুল্লাহ বলেন, ‘মেয়েটার ব্যাপারে অন্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা এসে অভিযোগ করে আমাকে বলেছিল যে, তার সমস্যা আছে। আমি নাকি যাকে-তাকে ভর্তি নিয়ে নিচ্ছি। অভিভাবকদের আপত্তি থাকায় এ মেয়েটার ভর্তি বাতিল করতে হয়েছে। টাকাও ফেরত দেওয়া হয়েছে।’
অন্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের আপত্তির অজুহাতে ‘ধর্ষণের শিকার’ শিশুটিকে বের করে দিয়ে মাদ্রাসা কর্র্তৃপক্ষ দায় সারলেও মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম উদ্বেগে দিন কাটছে তার মায়ের। শিশুর মা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মেয়েটাকে নিয়ে আমি ভুক্তভোগী হচ্ছি। সমাজের কাছে এত লাঞ্ছনা শুনতে আমার খুবই খারাপ লাগছে। মেয়েটাকে সবাই খারাপ চোখে দেখছে। মেয়েটা ছোট, সেটাও কেউ বুঝছে না। ওই ঘটনাটাই (ধর্ষণের শিকার হওয়া) তুলে ধরছে সবাই। মেয়েটাকে একটা স্কুলে ভর্তি করেছি। ওখানেও যদি কেউ কিছু বলে, আবার যদি বের করে দেয়, এই ভয় পাচ্ছি। এখন আমি একটা সুষ্ঠু বিচার চাই। যে আমার মেয়ের ক্ষতি করেছে তার যেন শাস্তি হয়।’
শিশুটির পরিবারের পক্ষ থেকে করা ধর্ষণ মামলার অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা থানার ওসি এসএম মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘শিশুটার মায়ের করা মামলাটা তদন্তাধীন আছে। তদন্ত চলাকালে বেশি কিছু বলব না। তবে প্রাথমিকভাবে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। তদন্ত শেষে তারপর অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।’
শেয়ার করুন
নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী | ২২ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০

ধর্ষণের শিকার হয়েছিল এমন তথ্য পেয়ে ভর্তি বাতিল করে এক শিশুকে মাদ্রাসা থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে রাজশাহীর একটি মাদ্রাসা কর্র্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। এমনকি অভিভাবকদের না জানিয়েই শিশুকে ওই আবাসিক মাদ্রাসা থেকে বের করে ফটক আটকে দেওয়া হয়। মাদ্রাসা কর্র্তৃপক্ষ বলছে, অন্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা আপত্তি জানানোয় শিশুটির ভর্তি বাতিল করা হয়েছে। বাধ্য হয়ে শিশুকে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেছেন তার অভিভাবকরা।
মাদ্রাসা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া শিশুর বয়স এখন আট বছর। ২০২০ সালের ২১ মার্চ প্রতিবেশী এক কিশোরের হাতে ধর্ষণের শিকার হয় সে। ওই ঘটনায় হওয়া মামলায় গ্রেপ্তারের পর সেই কিশোর এখন বন্দি রয়েছে রাজশাহী কারাগারের কিশোর ওয়ার্ডে। পুলিশি তদন্তে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতাও মিলেছে।
মাদ্রাসা থেকে বিতাড়িত হওয়া শিশুর বাবা শারীরিক প্রতিবন্ধী। নিজের কোনো ভিটেমাটি নেই। রাজশাহী নগরীতে রেলওয়ের জমির ওপর গড়ে ওঠা বস্তির একটি ঘরে পরিবার নিয়ে তার বসবাস। সড়ক দুর্ঘটনায় শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে এখন অটোরিকশা চালিয়ে কোনোরকমে সংসার চালাচ্ছেন।
জানা গেছে, ২০২০ সালের ২০ মার্চ প্রতিবেশী এক কিশোর বাড়িতে গিয়ে শিশুটির কাছে দিয়াশলাই চায়। ওই শিশু দিয়াশলাই দিলে কিশোর সেটি নিয়ে হাঁটা ধরে। দিয়াশলাইয়ের জন্য শিশুটিও কিশোরের পিছু নেয়। একপর্যায়ে বাড়ির পাশের নির্জন স্থানে শিশুটিকে ধর্ষণ করে ওই কিশোর। ধারণ করে ভিডিও চিত্রও। পরে ঘটনাটি এলাকায় জানাজানি হলে শিশুর মা বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন। এরপর পুলিশ কিশোরকে আটকের পাশাপাশি তার মোবাইল ফোনটি জব্দ করে।
ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে চলতি মাসের শুরুতে রাজশাহী নগরীর হড়গ্রাম মুন্সিপাড়া এলাকার উম্মাহাতুল মু’মিনীন মহিলা মাদ্রাসায় শিশুকে ভর্তি করেন তার অভিভাবকরা। বেসরকারি এই মাদ্রাসাটিতে শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থাও রয়েছে। শিশুর মা ভেবেছিলেন, এই মাদ্রাসায় ভর্তি করলে তার সন্তান নিরাপদেই থাকবে। তবে তিন দিন পরই তাকে মাদ্রাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়। ফেরত দেওয়া হয়েছে ভর্তিবাবদ ও আবাসিক ছাত্রী হিসেবে মাদ্রাসায় থাকার জন্য জমা নেওয়া টাকা।
অভিভাবকদের না জানিয়েই শিশুকে মাদ্রাসা থেকে বের করে ফটক আটকে দেওয়া হয় জানিয়ে তার মা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভর্তির তিন দিন পর আমার মেয়েকে মাদ্রাসার গেটের বাইরে বের করে দেওয়া হয়। তারপর গেট লাগিয়ে দেয়। মেয়েটা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে তখন কাঁদছিল। পরে মাদ্রাসার পরিচালক আমাকে ডাকল। আমাকে বলল, “আপনার মেয়েকে নিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও ভর্তি করেন।” আমি বললাম, আমার মেয়ের কোনো সমস্যা? তখন বললেন, “না, দূরে কোথাও ভর্তি করেন।” আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, আপনার মেয়ের সঙ্গে যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে, তাহলে আপনি কী করবেন? তখন কোনো কথা বলছে না সে (মাদ্রাসা পরিচালক)। আমাকে টাকাটা ফেরত দিয়ে মেয়েকে বের করে দিল। আমার মেয়ের কোনো সমস্যা দেখাতে পারছে না, খালি বলছে “দূরে কোথাও ভর্তি করেন”।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদ্রাসাটির পরিচালক মাওলানা মোহা. হাবিবুল্লাহ বলেন, ‘মেয়েটার ব্যাপারে অন্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা এসে অভিযোগ করে আমাকে বলেছিল যে, তার সমস্যা আছে। আমি নাকি যাকে-তাকে ভর্তি নিয়ে নিচ্ছি। অভিভাবকদের আপত্তি থাকায় এ মেয়েটার ভর্তি বাতিল করতে হয়েছে। টাকাও ফেরত দেওয়া হয়েছে।’
অন্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের আপত্তির অজুহাতে ‘ধর্ষণের শিকার’ শিশুটিকে বের করে দিয়ে মাদ্রাসা কর্র্তৃপক্ষ দায় সারলেও মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম উদ্বেগে দিন কাটছে তার মায়ের। শিশুর মা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মেয়েটাকে নিয়ে আমি ভুক্তভোগী হচ্ছি। সমাজের কাছে এত লাঞ্ছনা শুনতে আমার খুবই খারাপ লাগছে। মেয়েটাকে সবাই খারাপ চোখে দেখছে। মেয়েটা ছোট, সেটাও কেউ বুঝছে না। ওই ঘটনাটাই (ধর্ষণের শিকার হওয়া) তুলে ধরছে সবাই। মেয়েটাকে একটা স্কুলে ভর্তি করেছি। ওখানেও যদি কেউ কিছু বলে, আবার যদি বের করে দেয়, এই ভয় পাচ্ছি। এখন আমি একটা সুষ্ঠু বিচার চাই। যে আমার মেয়ের ক্ষতি করেছে তার যেন শাস্তি হয়।’
শিশুটির পরিবারের পক্ষ থেকে করা ধর্ষণ মামলার অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা থানার ওসি এসএম মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘শিশুটার মায়ের করা মামলাটা তদন্তাধীন আছে। তদন্ত চলাকালে বেশি কিছু বলব না। তবে প্রাথমিকভাবে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। তদন্ত শেষে তারপর অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।’