মধ্যরাতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রীর ভার্চুয়াল বৈঠক
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা ও শাবিপ্রবি প্রতিনিধি | ২৩ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) চলমান সংকট নিরসনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গতকাল রাত ১টায় ভার্চুয়ালি বৈঠক করেছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এম ওয়াজেদ মিয়া ভবনের ১২৯ নম্বর কক্ষে এ বৈঠকে শিক্ষার্থীদের ১৬ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন ইয়াসির সরকার। বাকিদের মধ্যে মুহাইমিনুল বাশার রাজ, শাহরিয়ার আবেদীন, মীর রানা, ওমর ফারুক, সাদিয়া, অপূর্ব, ইমু, সাব্বির আহমেদ, রোমিও ও শর্মিলা সিদ্দিকা মিলা উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলসহ মহানগর নেতারা ওই ভার্চুয়াল বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। গতকাল রাত সোয়া ২টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বৈঠক চলছিল।
এর আগে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর হেয়ার রোডের বাসায় শাবিপ্রবির একটি শিক্ষক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক শেষে অনশন কর্মসূচি পালনরত শিক্ষার্থীদের আলোচনায় বসার অনুরোধ জানিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী।
এদিকে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ দাবিতে অনশনে বসে অসুস্থ হওয়া শাবিপ্রবির আরও তিন শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে নিতে হয়েছে। আমরণ অনশন কর্মসূচির চতুর্থ দিনে গতকাল শনিবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাদের মধ্যে একজন অবশ্য হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে পরে অনশনস্থলে ফিরে যান।
সর্বশেষ গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত অনশনে বসে তীব্র শীত আর অনাহারে অসুস্থ হয়ে পড়া ১৬ শিক্ষার্থী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। তাদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
উপাচার্য কিংবা সরকারের তরফ থেকে শাবিপ্রবির সংকট নিরসনে এখনো কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। অনশনে যাওয়া ১৬ জনকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। অনশনরত বাকিদের শারীরিক অবস্থারও ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। সংকট নিরসনে কোনো কার্যকর উদ্যোগ না থাকা আর নিজের সহযোদ্ধাদের করুণ পরিণতি দেখে আন্দোলনকারীদের মধ্যে ক্ষোভ যেন আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সংবাদ সম্মেলনে আসেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় গতকাল রাত থেকে গণ-অনশন কর্মসূচি শুরুর ঘোষণা দেন তারা। আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র ইয়াসির সরকার বলেন, ‘শাবি উপাচার্য পদত্যাগের দাবিতে ৭৪ ঘণ্টা টানা অনশন করে শিক্ষার্থীরা যখন মৃত্যুর দোরগোড়ায়, তখন ফরিদ উদ্দিন আহমেদ নির্বিকার এবং উপাচার্যের পদ থেকে পদত্যাগ করেননি। অনশনরত শিক্ষার্থীরা তাদের অনশন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন। সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের সহযোদ্ধাদের মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে দেখে গণ-অনশনে বসার সংকল্প নিয়েছেন। ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ স্বচক্ষে দেখার আগ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের আমরণ অনশন চলবে।’
এর আগে গতকাল ক্যাম্পাসে চারশর বেশি শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে প্রতীকী মরদেহ নিয়ে কাফনের কাপড় পরে মৌন মিছিল করেন আন্দোলনকারীরা। বেলা ৩টার দিকে ক্যাম্পাসের গোলচত্বর থেকে মিছিলটি শুরু হয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে একই স্থানে গিয়ে শেষ হয়। এ সময় অনেক শিক্ষার্থীকে অনশনরত সহপাঠীদের জন্য কাঁদতে দেখা যায়।
পরে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে রাত ৯টায় ক্যাম্পাসের গোল চত্বরে মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা।
গতকাল দিনভর অ্যাম্বুলেন্সের শব্দে ভারী হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস। উপাচার্য ভবনের সামনে অনশনরত শিক্ষার্থীদের একটু পরপরই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালের একদল ইটার্ন চিকিৎসক।
ওই হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, হাসপাতালে ভর্তি সব শিক্ষার্থীর রক্তচাপ ও গ্লুকোজ লেভেল নেমে যাচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে যে কেউ ‘কোমায়’ চলে যেতে পারেন।
অনশনকারীদের চিকিৎসা দেওয়া চিকিৎসক দলের প্রধান ডা. নাজমুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যারা অনশনরত রয়েছেন তাদের কারও অবস্থা ভালো নেই। কী হবে বলা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে ৭৫ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। পানিশূন্যতায় নানা উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। রক্তচাপ নেমে যাচ্ছে। রক্তে শর্করার পরিমাণ ৪-এর নিচে নেমে গেছে। বলা যাচ্ছে না কী হতে যাচ্ছে। হাসপাতালে যারা আছেন তাদেরও অনশন ভাঙানো যাচ্ছে না।’
স্থান নির্ধারণে আটকে মন্ত্রীর আলোচনা : শাবিপ্রবির আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের চড়াও হওয়ার ঘটনাকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। মন্ত্রী বলেন, ‘শাবিতে পুলিশি আচরণ (অ্যাকশন) দুঃখজনক। কিন্তু শিক্ষকদেরও লাঞ্ছিত করা হয়েছে। দুটোই অনভিপ্রেত।’
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি ওই সময় বলেছিলেন, ‘শিক্ষার্থীরা অনশন করছেন। আমরা চাই তারা অনশন ভেঙে, আলোচনায় বসুক। ক্যাম্পাসে কোন ঘটনার পরে কী ঘটেছে, সেগুলো শিক্ষকরা জানিয়েছেন। একদিকে যেমন শিক্ষার্থীরা পুলিশের হামলায় আহত হয়েছেন। অন্যদিকে শিক্ষকরাও লাঞ্ছিত হয়েছেন। এটি আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করতে হবে। তাদের কোনো সমস্যা থাকলে সেটি অবশ্যই আলোচনা করতে হবে।’
শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, ‘যারা আন্দোলন করছেন সেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিদলের মাধ্যমে আমি কথা বলেছিলাম। তখন বলেছি আলোচনার মাধ্যমে সব সমাধান করা যায়। তারা বললেন, আমরা আজকেই আসতে চাই। আমরা এক ঘণ্টার মধ্যে জানাচ্ছি কারা কারা আসছি। কিন্তু তারা জানিয়েছেন অনশনরত বন্ধুদের রেখে তারা আসতে চান না।’
শাবিপ্রবির ঘটনায় কোনো ইন্ধন আছে কি না, জানতে চান সাংবাদিকরা। দীপু মনি বলেন, ‘তা আমরা জানি না। মূল কথা, শিক্ষার্থীরা অনশন করছেন; তাদের স্বাস্থ্যহানি হোক আমরা কোনোভাবেই তা চাই না।’
শাবিপ্রবিতে চলমান শিক্ষার্থী আন্দোলন নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসতে গত শুক্রবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসে। গতকালের বৈঠকে শিক্ষক প্রতিনিধিদলের মধ্যে ছিলেন শাবিপ্রবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি তুলসী কুমার দাস, সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মুহিবুল আলম, ফিজিক্যাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন মো. রাশেদ তালুকদার, অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সেস অনুষদের ডিন আরিফুল ইসলাম ও ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন খায়রুল ইসলাম। বৈঠকে আরও ছিলেন ইউজিসির চেয়ারম্যান কাজী শহীদুল্লাহ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মশিউর রহমান এবং ঢাকা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) উপাচার্য হাবিবুর রহমান।
ঢাকায় শিক্ষামন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের পর আন্দোলনকারীরা তাদের প্রতিক্রিয়া জানান। গতকাল রাত ৯টায় ইয়াসির সরকার ও মোহাইমিনুল বাশার রাজ শিক্ষার্থীদের পক্ষে প্রতিক্রিয়া জানান। তারা সাংবাদিকদের বলেন, তারা এখনই আলোচনা করতে রাজি। তবে সে ক্ষেত্রে ঢাকা থেকে প্রতিনিধিদল ক্যাম্পাসে এসে কিংবা ভার্চুয়ালি আলোচনা করতে হবে। এ ছাড়া শিক্ষকদের তাদের আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করার আহ্বান জানান তারা।
শাবিপ্রবি উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে এক সপ্তাহ ধরে উত্তাল শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়। সর্বশেষ গত বুধবার উপাচার্যের বাসার সামনে আমরণ অনশনে বসেন ২৪ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে একজনের বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ায় তিনি অনশন শুরুর পরের দিনই বাড়ি চলে যান। বাকি ২৩ অনশনকারীর মধ্যে এখন ১৬ জন হাসপাতালে ভর্তি আছেন। বাকি ৮ শিক্ষার্থী উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের শরীরে স্যালাইন পুশ করেছেন চিকিৎসকেরা।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সূত্রপাত ১৩ জানুয়ারি। ওই দিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ তুলে তার পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন হলের কয়েকশ ছাত্রী। ১৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ছাত্রলীগ ছাত্রীদের আন্দোলনে হামলা চালায়।
পরদিন বিকেলে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি ভবনে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেন। তখন শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা ও তাদের লক্ষ্য করে শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে পুলিশ। ওই দিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ও শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় কর্র্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীরা তা উপেক্ষা করে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। ওই হামলার প্রতিবাদে ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, খুলনা, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন নাগরিক ও রাজনৈতিক সংগঠন।
শেয়ার করুন
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা ও শাবিপ্রবি প্রতিনিধি | ২৩ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) চলমান সংকট নিরসনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গতকাল রাত ১টায় ভার্চুয়ালি বৈঠক করেছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এম ওয়াজেদ মিয়া ভবনের ১২৯ নম্বর কক্ষে এ বৈঠকে শিক্ষার্থীদের ১৬ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন ইয়াসির সরকার। বাকিদের মধ্যে মুহাইমিনুল বাশার রাজ, শাহরিয়ার আবেদীন, মীর রানা, ওমর ফারুক, সাদিয়া, অপূর্ব, ইমু, সাব্বির আহমেদ, রোমিও ও শর্মিলা সিদ্দিকা মিলা উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলসহ মহানগর নেতারা ওই ভার্চুয়াল বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। গতকাল রাত সোয়া ২টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বৈঠক চলছিল।
এর আগে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর হেয়ার রোডের বাসায় শাবিপ্রবির একটি শিক্ষক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক শেষে অনশন কর্মসূচি পালনরত শিক্ষার্থীদের আলোচনায় বসার অনুরোধ জানিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী।
এদিকে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ দাবিতে অনশনে বসে অসুস্থ হওয়া শাবিপ্রবির আরও তিন শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে নিতে হয়েছে। আমরণ অনশন কর্মসূচির চতুর্থ দিনে গতকাল শনিবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাদের মধ্যে একজন অবশ্য হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে পরে অনশনস্থলে ফিরে যান।
সর্বশেষ গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত অনশনে বসে তীব্র শীত আর অনাহারে অসুস্থ হয়ে পড়া ১৬ শিক্ষার্থী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। তাদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
উপাচার্য কিংবা সরকারের তরফ থেকে শাবিপ্রবির সংকট নিরসনে এখনো কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। অনশনে যাওয়া ১৬ জনকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। অনশনরত বাকিদের শারীরিক অবস্থারও ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। সংকট নিরসনে কোনো কার্যকর উদ্যোগ না থাকা আর নিজের সহযোদ্ধাদের করুণ পরিণতি দেখে আন্দোলনকারীদের মধ্যে ক্ষোভ যেন আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সংবাদ সম্মেলনে আসেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় গতকাল রাত থেকে গণ-অনশন কর্মসূচি শুরুর ঘোষণা দেন তারা। আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র ইয়াসির সরকার বলেন, ‘শাবি উপাচার্য পদত্যাগের দাবিতে ৭৪ ঘণ্টা টানা অনশন করে শিক্ষার্থীরা যখন মৃত্যুর দোরগোড়ায়, তখন ফরিদ উদ্দিন আহমেদ নির্বিকার এবং উপাচার্যের পদ থেকে পদত্যাগ করেননি। অনশনরত শিক্ষার্থীরা তাদের অনশন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন। সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের সহযোদ্ধাদের মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে দেখে গণ-অনশনে বসার সংকল্প নিয়েছেন। ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ স্বচক্ষে দেখার আগ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের আমরণ অনশন চলবে।’
এর আগে গতকাল ক্যাম্পাসে চারশর বেশি শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে প্রতীকী মরদেহ নিয়ে কাফনের কাপড় পরে মৌন মিছিল করেন আন্দোলনকারীরা। বেলা ৩টার দিকে ক্যাম্পাসের গোলচত্বর থেকে মিছিলটি শুরু হয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে একই স্থানে গিয়ে শেষ হয়। এ সময় অনেক শিক্ষার্থীকে অনশনরত সহপাঠীদের জন্য কাঁদতে দেখা যায়।
পরে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে রাত ৯টায় ক্যাম্পাসের গোল চত্বরে মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা।
গতকাল দিনভর অ্যাম্বুলেন্সের শব্দে ভারী হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস। উপাচার্য ভবনের সামনে অনশনরত শিক্ষার্থীদের একটু পরপরই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালের একদল ইটার্ন চিকিৎসক।
ওই হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, হাসপাতালে ভর্তি সব শিক্ষার্থীর রক্তচাপ ও গ্লুকোজ লেভেল নেমে যাচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে যে কেউ ‘কোমায়’ চলে যেতে পারেন।
অনশনকারীদের চিকিৎসা দেওয়া চিকিৎসক দলের প্রধান ডা. নাজমুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যারা অনশনরত রয়েছেন তাদের কারও অবস্থা ভালো নেই। কী হবে বলা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে ৭৫ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। পানিশূন্যতায় নানা উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। রক্তচাপ নেমে যাচ্ছে। রক্তে শর্করার পরিমাণ ৪-এর নিচে নেমে গেছে। বলা যাচ্ছে না কী হতে যাচ্ছে। হাসপাতালে যারা আছেন তাদেরও অনশন ভাঙানো যাচ্ছে না।’
স্থান নির্ধারণে আটকে মন্ত্রীর আলোচনা : শাবিপ্রবির আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের চড়াও হওয়ার ঘটনাকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। মন্ত্রী বলেন, ‘শাবিতে পুলিশি আচরণ (অ্যাকশন) দুঃখজনক। কিন্তু শিক্ষকদেরও লাঞ্ছিত করা হয়েছে। দুটোই অনভিপ্রেত।’
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি ওই সময় বলেছিলেন, ‘শিক্ষার্থীরা অনশন করছেন। আমরা চাই তারা অনশন ভেঙে, আলোচনায় বসুক। ক্যাম্পাসে কোন ঘটনার পরে কী ঘটেছে, সেগুলো শিক্ষকরা জানিয়েছেন। একদিকে যেমন শিক্ষার্থীরা পুলিশের হামলায় আহত হয়েছেন। অন্যদিকে শিক্ষকরাও লাঞ্ছিত হয়েছেন। এটি আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করতে হবে। তাদের কোনো সমস্যা থাকলে সেটি অবশ্যই আলোচনা করতে হবে।’
শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, ‘যারা আন্দোলন করছেন সেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিদলের মাধ্যমে আমি কথা বলেছিলাম। তখন বলেছি আলোচনার মাধ্যমে সব সমাধান করা যায়। তারা বললেন, আমরা আজকেই আসতে চাই। আমরা এক ঘণ্টার মধ্যে জানাচ্ছি কারা কারা আসছি। কিন্তু তারা জানিয়েছেন অনশনরত বন্ধুদের রেখে তারা আসতে চান না।’
শাবিপ্রবির ঘটনায় কোনো ইন্ধন আছে কি না, জানতে চান সাংবাদিকরা। দীপু মনি বলেন, ‘তা আমরা জানি না। মূল কথা, শিক্ষার্থীরা অনশন করছেন; তাদের স্বাস্থ্যহানি হোক আমরা কোনোভাবেই তা চাই না।’
শাবিপ্রবিতে চলমান শিক্ষার্থী আন্দোলন নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসতে গত শুক্রবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসে। গতকালের বৈঠকে শিক্ষক প্রতিনিধিদলের মধ্যে ছিলেন শাবিপ্রবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি তুলসী কুমার দাস, সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মুহিবুল আলম, ফিজিক্যাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন মো. রাশেদ তালুকদার, অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সেস অনুষদের ডিন আরিফুল ইসলাম ও ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন খায়রুল ইসলাম। বৈঠকে আরও ছিলেন ইউজিসির চেয়ারম্যান কাজী শহীদুল্লাহ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মশিউর রহমান এবং ঢাকা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) উপাচার্য হাবিবুর রহমান।
ঢাকায় শিক্ষামন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের পর আন্দোলনকারীরা তাদের প্রতিক্রিয়া জানান। গতকাল রাত ৯টায় ইয়াসির সরকার ও মোহাইমিনুল বাশার রাজ শিক্ষার্থীদের পক্ষে প্রতিক্রিয়া জানান। তারা সাংবাদিকদের বলেন, তারা এখনই আলোচনা করতে রাজি। তবে সে ক্ষেত্রে ঢাকা থেকে প্রতিনিধিদল ক্যাম্পাসে এসে কিংবা ভার্চুয়ালি আলোচনা করতে হবে। এ ছাড়া শিক্ষকদের তাদের আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করার আহ্বান জানান তারা।
শাবিপ্রবি উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে এক সপ্তাহ ধরে উত্তাল শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়। সর্বশেষ গত বুধবার উপাচার্যের বাসার সামনে আমরণ অনশনে বসেন ২৪ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে একজনের বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ায় তিনি অনশন শুরুর পরের দিনই বাড়ি চলে যান। বাকি ২৩ অনশনকারীর মধ্যে এখন ১৬ জন হাসপাতালে ভর্তি আছেন। বাকি ৮ শিক্ষার্থী উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের শরীরে স্যালাইন পুশ করেছেন চিকিৎসকেরা।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সূত্রপাত ১৩ জানুয়ারি। ওই দিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ তুলে তার পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন হলের কয়েকশ ছাত্রী। ১৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ছাত্রলীগ ছাত্রীদের আন্দোলনে হামলা চালায়।
পরদিন বিকেলে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি ভবনে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেন। তখন শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা ও তাদের লক্ষ্য করে শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে পুলিশ। ওই দিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ও শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় কর্র্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীরা তা উপেক্ষা করে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। ওই হামলার প্রতিবাদে ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, খুলনা, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন নাগরিক ও রাজনৈতিক সংগঠন।