রেলমন্ত্রী বিব্রত টিটিই বহাল
রূপান্তর ডেস্ক | ৯ মে, ২০২২ ০০:০০
বিনা টিকিটে আত্মীয়দের ট্রেন ভ্রমণ ও জরিমানাকাণ্ডে ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরিদর্শককে (টিটিই) বরখাস্তের ঘটনায় নিজে বিব্রত বলে জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। গতকাল রবিবার দুপুরে রেল ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে একথা জানান তিনি।
রেলমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বিব্রত। আমি যেভাবে এখানে স্বচ্ছভাবে কাজ করার চেষ্টা করেছি, সেখানে এ ধরনের একটি ঘটনা সেটি যেভাবেই ঘটুক না কেন, তাতে আমি অবশ্যই বিব্রত।’ এ সময় তিনি টিটিই শফিকুল ইসলামকে বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার ও বরখাস্তের আদেশদাতাকে কারণ দর্শানো হবে বলে জানান।
পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজার (ডিআরএম) শাহীদুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেয়ে টিটিই শফিকুল ইসলামকে স্বপদে বহাল এবং তাকে তড়িঘড়ি বরখাস্তের আদেশ দেওয়া পাকশী বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) নাসির উদ্দিনকে কারণ দর্শানোর চিঠি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির মেয়াদ আগামী বুধবার পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
গত ৫ মে রাতে খুলনা থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর সুন্দরবন এক্সপ্রেসে বিনা টিকিটে ভ্রমণের দায়ে তিন যাত্রীকে (ইমরুল কায়েস প্রান্ত, ওমর ও হাসান) জরিমানা করেন টিটিই শফিকুল ইসলাম। যাত্রীরা রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দেওয়ার পরও জরিমানা করায় পরদিন ডিসিও নাসির উদ্দিন তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেন।
এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর রেলমন্ত্রী ওই যাত্রীদের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক অস্বীকার করেন। পরে এক যাত্রীর মা দাবি করেন, তারা রেলমন্ত্রীর স্ত্রী শাম্মী আক্তার মণির নিকটাত্মীয় এবং ঘটনার দিন বিষয়টি জানানো হলে শাম্মীর ফোন পেয়েই ডিসিও টিটিইকে বরখাস্ত করেন।
গতকাল সংবাদ সম্মেলনে এ প্রসঙ্গে রেলমন্ত্রী বলেন, ‘যাত্রীর সঙ্গে খারাপ আচরণ করলে যে কেউ অভিযোগ করতে পারেন। যাত্রীর আত্মীয় হিসেবে তিনিও (মন্ত্রীর স্ত্রী) ফোন দিতে পারেন। তবে মন্ত্রীর স্ত্রী হিসেবে ফোন দিতে পারেন না। তিনি আমাকেও বলতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটি করেননি। এখানে কিছুটা ব্যত্যয় হয়েছে। যে কারণে আমি মনে করি, বরখাস্তের আদেশটি সঠিক হয়নি। প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রীর অভিযোগে টিটিইকে বরখাস্ত করা হয়েছে কিনা তা আমি নিশ্চিত নই। কেন বরখাস্ত করা হলো, তা তদন্ত করা হবে। যাত্রীর অভিযোগ তো এত তাড়াতাড়ি ডিসিও পাওয়ার কথা না।’
এক প্রশ্নের জবাবে নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আপনারা যেভাবে অভিযোগ শুনেছেন, আমিও সেভাবেই শুনেছি। তারা আমার আত্মীয়, আমি আগাম কিছু জানতাম না, পরে জেনেছি। নয় মাস হলো আমার বিয়ে হয়েছে। স্ত্রী ঢাকাতেই থাকে। তার নানার বাড়ি, মামার বাড়ি ঈশ্বরদী। নতুন যাকে আমি স্ত্রী হিসেবে নিলাম, আমাকে বুঝে উঠতে তারও সময় লাগবে। ভুলভ্রান্তি হলে মানুষ তো সেভাবেই দেখবে। এখানে যদি দেখা যায়, আমার স্ত্রী কোনো দোষ করে থাকে, ইয়ে করে থাকে, এটা কিন্তু আমার নলেজে ছিল না।’
তিনি বলেন, ‘মন্ত্রী, ডিজি ও সচিব ছাড়া আর কারও বিনা টিকিটে ভ্রমণের সুযোগ নেই। মন্ত্রীর ছেলে হোক, স্ত্রী হোক, রাজনৈতিক নেতা হোক, কারও বিনা টিকিটে ভ্রমণের সুযোগ নেই।’
টিআইবির পদত্যাগ দাবির বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে রেলমন্ত্রী বলেন, ‘টিআইবি হঠাৎ করে এলো কোত্থেকে? টিআইবি কে? তাদের (বিবৃতি প্রদানে) আরও অপেক্ষা করা উচিত ছিল। তাদের দেখা উচিত ছিল এ ঘটনায় মন্ত্রীর কোনো সম্পৃক্ততা আছে কিনা।’
টিটিইকে বরখাস্ত ও কারণ দর্শানো নোটিসের বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি ডিসিও নাসির উদ্দিন। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, মন্ত্রীর সুনজরে এসে পদোন্নতির আশায় তার স্ত্রীর ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি টিটিইর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন নাসির উদ্দিন।
তবে টিটিইকে বরখাস্তের কারণ ব্যাখ্যা করে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছেন নাসির উদ্দিন। সেখানে তিনি বলেছেন, শফিকুল ইসলাম আইনে স্নাতক। তার বেশিরভাগ বন্ধু জজ। ভালো চাকরি না পাওয়ায় হীনমন্যতায় ভোগেন ও সহকর্মীদের সঙ্গে বাজে আচরণ করেন। তার ঊর্ধ্বতন এসআরআই সাধারণ ডিগ্রি পাস বলে তাকেও তিনি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। মানসিক স্টিগমার কারণে তিনি যাত্রীদের সঙ্গেও অযাচিত আচরণ করেন।
এ বিষয়ে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) শাহীদুল ইসলাম বলেন, ‘তদন্তের আগেই সহকর্মীর বিরুদ্ধে এ ধরনের বক্তব্য অনভিপ্রেত। ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব কিংবা অতি উৎসাহী হয়ে নাসির উদ্দিন বরখাস্তের আদেশ দিয়েছেন কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কারণ দর্শানো নোটিসের জবাব পেয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তদন্ত শুরু : এদিকে গতকাল দুপুরে রেলের পাকশী বিভাগীয় কার্যালয়ে সহকারী পরিবহন কর্মকর্তা (এটিও) সাজেদুল ইসলাম বাবুর নেতৃত্বে কাজ শুরু করেছে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির কাছে বক্তব্য তুলে ধরেন জরিমানার শিকার রেলযাত্রী ইমরুল কায়েস প্রান্ত, টিটিই শফিকুল ইসলামসহ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা। তদন্ত কমিটি তাদের মৌখিক ও লিখিত বক্তব্য নেন।
পরে তদন্ত কমিটির প্রধান সাজেদুল ইসলাম বাবু সাংবাদিকদের জানান, তারা অভিযোগকারী, অভিযুক্তসহ আটজনের বক্তব্য নিয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যও জানার চেষ্টা হয়েছে। ওইদিন অসদাচরণের ঘটনা ঘটেছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্ত কমিটির ওপর কোনো ধরনের চাপ নেই বলে জানান তিনি।
তদন্ত কমিটির কাছে বক্তব্য তুলে ধরার পর টিটিই শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আদেশ প্রত্যাহার করায় আমি খুশি। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। আমি রেলওয়ের জন্য কাজ করি, দেশের জন্য কাজ করি। আমাকে কাজে যোগদানের সুযোগ দেওয়ায় ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষের কাছে কৃতজ্ঞ।’
এ সময় তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে এটিই প্রথম বিভাগীয় আদেশ। ডিসিও স্যার কেন আমাকে মাদকাসক্ত ও মানসিক বিকারগ্রস্ত বলেছেন, তা বুঝতে পারছি না। ঘটনার রাতে আমি আপ-ডাউন মিলে ৭৮ হাজার টাকা রাজস্ব আদায় করে জমা দিয়েছি। বিকারগ্রস্ত ব্যক্তি কি এ কাজ করতে পারবে?’
সাংবাদিকরা বেশি বাড়াবাড়ি করছেন : গতকাল রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর বোনের ছেলে ও অভিযোগকারী ইমরুল কায়েস প্রান্ত নির্ধারিত সময়ে দুই ঘণ্টা পরে এসে তদন্ত কমিটির কাছে বক্তব্য তুলে ধরেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের দেখে বিষোদগার করেন।
সাংবাদিকদের ‘সরকারবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে প্রান্ত বলেন, ‘গণমাধ্যমই বাংলাদেশের একমাত্র বিরোধী দল। কয়েকদিন ধরে তাদের (সাংবাদিক) ফোন, প্রশ্নবাণে আমি ও আমার পরিবার বিরক্ত। ঘটনাটি আমরা ইতিবাচকভাবে দেখছিলাম। অথচ সাংবাদিকরা সামান্য বিষয়কে অহেতুক টানাহেঁচড়া ও বেশি বাড়াবাড়ি করছেন, যেটি না করলেও পারতেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি যা বলার তদন্ত কমিটিকে বলেছি। আপনাদের সঙ্গে আমার কোনো কথা নেই।’
মন্ত্রীর স্বজন হলেও বিশেষ সুবিধা দেওয়া যাবে না :
মন্ত্রীর স্বজন হলেও রেল ভ্রমণে বিশেষ সুবিধা দেওয়া যাবে না বলে রেলকর্মীদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। গতকাল রবিবার রেলপথ মন্ত্রণালয় এমন এক আদেশ জারি করে তা রেলওয়ের বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালক, সব স্টেশনের ম্যানেজার, স্টেশন মাস্টার, ট্রেনের পরিচালককে পাঠানো হয়েছে।
রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের স্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দিয়ে বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণের ঘটনার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এ ধরনের নির্দেশনা আসল।
রেলমন্ত্রীর একান্ত সচিব (যুগ্ম-সচিব) মোহাম্মদ আতিকুর রহমান স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে বলা হয়, সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, রেলমন্ত্রীর একান্ত সচিব, সহকারী একান্ত সচিব এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের অগোচরে তাদের রেফারেন্সে আত্মীয়/পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন স্টেশনে টিকিট দাবি করা, ট্রেনে উঠে বিশেষ সুবিধা চাওয়া হচ্ছে। এছাড়া অনেকেই মন্ত্রীর একান্ত সচিব, সহকারী সচিব এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের নিকটাত্মীয় পরিচয় দিয়ে রেলের পরিচালকদের কাছ থেকে বিভিন্ন অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার জন্য মোবাইলে যোগাযোগ করছেন।
এসব বিষয় জানার পর তা রেলমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়েছে। এ ধরনের সুবিধা যারা চাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা এবং যেসব মোবাইল নম্বর থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে, সেগুলো আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কাছে পাঠিয়ে ওই ব্যক্তিদের সঠিক পরিচয় জানার নির্দেশ দিয়েছেন মন্ত্রী। এই ধরনের ক্ষেত্রে রেল কর্মকর্তাদের বিভ্রান্ত না হয়ে দাপ্তরিক প্রক্রিয়া অনুসরণ ছাড়া কোনো কার্যক্রম গ্রহণ না করতে বলা হয়েছে অফিস আদেশে।
এই প্রতিবেদনটি
শেয়ার করুন
রূপান্তর ডেস্ক | ৯ মে, ২০২২ ০০:০০

বিনা টিকিটে আত্মীয়দের ট্রেন ভ্রমণ ও জরিমানাকাণ্ডে ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরিদর্শককে (টিটিই) বরখাস্তের ঘটনায় নিজে বিব্রত বলে জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। গতকাল রবিবার দুপুরে রেল ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে একথা জানান তিনি।
রেলমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বিব্রত। আমি যেভাবে এখানে স্বচ্ছভাবে কাজ করার চেষ্টা করেছি, সেখানে এ ধরনের একটি ঘটনা সেটি যেভাবেই ঘটুক না কেন, তাতে আমি অবশ্যই বিব্রত।’ এ সময় তিনি টিটিই শফিকুল ইসলামকে বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার ও বরখাস্তের আদেশদাতাকে কারণ দর্শানো হবে বলে জানান।
পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজার (ডিআরএম) শাহীদুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেয়ে টিটিই শফিকুল ইসলামকে স্বপদে বহাল এবং তাকে তড়িঘড়ি বরখাস্তের আদেশ দেওয়া পাকশী বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) নাসির উদ্দিনকে কারণ দর্শানোর চিঠি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির মেয়াদ আগামী বুধবার পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
গত ৫ মে রাতে খুলনা থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর সুন্দরবন এক্সপ্রেসে বিনা টিকিটে ভ্রমণের দায়ে তিন যাত্রীকে (ইমরুল কায়েস প্রান্ত, ওমর ও হাসান) জরিমানা করেন টিটিই শফিকুল ইসলাম। যাত্রীরা রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দেওয়ার পরও জরিমানা করায় পরদিন ডিসিও নাসির উদ্দিন তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেন।
এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর রেলমন্ত্রী ওই যাত্রীদের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক অস্বীকার করেন। পরে এক যাত্রীর মা দাবি করেন, তারা রেলমন্ত্রীর স্ত্রী শাম্মী আক্তার মণির নিকটাত্মীয় এবং ঘটনার দিন বিষয়টি জানানো হলে শাম্মীর ফোন পেয়েই ডিসিও টিটিইকে বরখাস্ত করেন।
গতকাল সংবাদ সম্মেলনে এ প্রসঙ্গে রেলমন্ত্রী বলেন, ‘যাত্রীর সঙ্গে খারাপ আচরণ করলে যে কেউ অভিযোগ করতে পারেন। যাত্রীর আত্মীয় হিসেবে তিনিও (মন্ত্রীর স্ত্রী) ফোন দিতে পারেন। তবে মন্ত্রীর স্ত্রী হিসেবে ফোন দিতে পারেন না। তিনি আমাকেও বলতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটি করেননি। এখানে কিছুটা ব্যত্যয় হয়েছে। যে কারণে আমি মনে করি, বরখাস্তের আদেশটি সঠিক হয়নি। প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রীর অভিযোগে টিটিইকে বরখাস্ত করা হয়েছে কিনা তা আমি নিশ্চিত নই। কেন বরখাস্ত করা হলো, তা তদন্ত করা হবে। যাত্রীর অভিযোগ তো এত তাড়াতাড়ি ডিসিও পাওয়ার কথা না।’
এক প্রশ্নের জবাবে নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আপনারা যেভাবে অভিযোগ শুনেছেন, আমিও সেভাবেই শুনেছি। তারা আমার আত্মীয়, আমি আগাম কিছু জানতাম না, পরে জেনেছি। নয় মাস হলো আমার বিয়ে হয়েছে। স্ত্রী ঢাকাতেই থাকে। তার নানার বাড়ি, মামার বাড়ি ঈশ্বরদী। নতুন যাকে আমি স্ত্রী হিসেবে নিলাম, আমাকে বুঝে উঠতে তারও সময় লাগবে। ভুলভ্রান্তি হলে মানুষ তো সেভাবেই দেখবে। এখানে যদি দেখা যায়, আমার স্ত্রী কোনো দোষ করে থাকে, ইয়ে করে থাকে, এটা কিন্তু আমার নলেজে ছিল না।’
তিনি বলেন, ‘মন্ত্রী, ডিজি ও সচিব ছাড়া আর কারও বিনা টিকিটে ভ্রমণের সুযোগ নেই। মন্ত্রীর ছেলে হোক, স্ত্রী হোক, রাজনৈতিক নেতা হোক, কারও বিনা টিকিটে ভ্রমণের সুযোগ নেই।’
টিআইবির পদত্যাগ দাবির বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে রেলমন্ত্রী বলেন, ‘টিআইবি হঠাৎ করে এলো কোত্থেকে? টিআইবি কে? তাদের (বিবৃতি প্রদানে) আরও অপেক্ষা করা উচিত ছিল। তাদের দেখা উচিত ছিল এ ঘটনায় মন্ত্রীর কোনো সম্পৃক্ততা আছে কিনা।’
টিটিইকে বরখাস্ত ও কারণ দর্শানো নোটিসের বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি ডিসিও নাসির উদ্দিন। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, মন্ত্রীর সুনজরে এসে পদোন্নতির আশায় তার স্ত্রীর ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি টিটিইর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন নাসির উদ্দিন।
তবে টিটিইকে বরখাস্তের কারণ ব্যাখ্যা করে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছেন নাসির উদ্দিন। সেখানে তিনি বলেছেন, শফিকুল ইসলাম আইনে স্নাতক। তার বেশিরভাগ বন্ধু জজ। ভালো চাকরি না পাওয়ায় হীনমন্যতায় ভোগেন ও সহকর্মীদের সঙ্গে বাজে আচরণ করেন। তার ঊর্ধ্বতন এসআরআই সাধারণ ডিগ্রি পাস বলে তাকেও তিনি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। মানসিক স্টিগমার কারণে তিনি যাত্রীদের সঙ্গেও অযাচিত আচরণ করেন।
এ বিষয়ে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) শাহীদুল ইসলাম বলেন, ‘তদন্তের আগেই সহকর্মীর বিরুদ্ধে এ ধরনের বক্তব্য অনভিপ্রেত। ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব কিংবা অতি উৎসাহী হয়ে নাসির উদ্দিন বরখাস্তের আদেশ দিয়েছেন কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কারণ দর্শানো নোটিসের জবাব পেয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তদন্ত শুরু : এদিকে গতকাল দুপুরে রেলের পাকশী বিভাগীয় কার্যালয়ে সহকারী পরিবহন কর্মকর্তা (এটিও) সাজেদুল ইসলাম বাবুর নেতৃত্বে কাজ শুরু করেছে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির কাছে বক্তব্য তুলে ধরেন জরিমানার শিকার রেলযাত্রী ইমরুল কায়েস প্রান্ত, টিটিই শফিকুল ইসলামসহ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা। তদন্ত কমিটি তাদের মৌখিক ও লিখিত বক্তব্য নেন।
পরে তদন্ত কমিটির প্রধান সাজেদুল ইসলাম বাবু সাংবাদিকদের জানান, তারা অভিযোগকারী, অভিযুক্তসহ আটজনের বক্তব্য নিয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যও জানার চেষ্টা হয়েছে। ওইদিন অসদাচরণের ঘটনা ঘটেছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্ত কমিটির ওপর কোনো ধরনের চাপ নেই বলে জানান তিনি।
তদন্ত কমিটির কাছে বক্তব্য তুলে ধরার পর টিটিই শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আদেশ প্রত্যাহার করায় আমি খুশি। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। আমি রেলওয়ের জন্য কাজ করি, দেশের জন্য কাজ করি। আমাকে কাজে যোগদানের সুযোগ দেওয়ায় ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষের কাছে কৃতজ্ঞ।’
এ সময় তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে এটিই প্রথম বিভাগীয় আদেশ। ডিসিও স্যার কেন আমাকে মাদকাসক্ত ও মানসিক বিকারগ্রস্ত বলেছেন, তা বুঝতে পারছি না। ঘটনার রাতে আমি আপ-ডাউন মিলে ৭৮ হাজার টাকা রাজস্ব আদায় করে জমা দিয়েছি। বিকারগ্রস্ত ব্যক্তি কি এ কাজ করতে পারবে?’
সাংবাদিকরা বেশি বাড়াবাড়ি করছেন : গতকাল রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর বোনের ছেলে ও অভিযোগকারী ইমরুল কায়েস প্রান্ত নির্ধারিত সময়ে দুই ঘণ্টা পরে এসে তদন্ত কমিটির কাছে বক্তব্য তুলে ধরেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের দেখে বিষোদগার করেন।
সাংবাদিকদের ‘সরকারবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে প্রান্ত বলেন, ‘গণমাধ্যমই বাংলাদেশের একমাত্র বিরোধী দল। কয়েকদিন ধরে তাদের (সাংবাদিক) ফোন, প্রশ্নবাণে আমি ও আমার পরিবার বিরক্ত। ঘটনাটি আমরা ইতিবাচকভাবে দেখছিলাম। অথচ সাংবাদিকরা সামান্য বিষয়কে অহেতুক টানাহেঁচড়া ও বেশি বাড়াবাড়ি করছেন, যেটি না করলেও পারতেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি যা বলার তদন্ত কমিটিকে বলেছি। আপনাদের সঙ্গে আমার কোনো কথা নেই।’
মন্ত্রীর স্বজন হলেও বিশেষ সুবিধা দেওয়া যাবে না :
মন্ত্রীর স্বজন হলেও রেল ভ্রমণে বিশেষ সুবিধা দেওয়া যাবে না বলে রেলকর্মীদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। গতকাল রবিবার রেলপথ মন্ত্রণালয় এমন এক আদেশ জারি করে তা রেলওয়ের বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালক, সব স্টেশনের ম্যানেজার, স্টেশন মাস্টার, ট্রেনের পরিচালককে পাঠানো হয়েছে।
রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের স্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দিয়ে বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণের ঘটনার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এ ধরনের নির্দেশনা আসল।
রেলমন্ত্রীর একান্ত সচিব (যুগ্ম-সচিব) মোহাম্মদ আতিকুর রহমান স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে বলা হয়, সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, রেলমন্ত্রীর একান্ত সচিব, সহকারী একান্ত সচিব এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের অগোচরে তাদের রেফারেন্সে আত্মীয়/পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন স্টেশনে টিকিট দাবি করা, ট্রেনে উঠে বিশেষ সুবিধা চাওয়া হচ্ছে। এছাড়া অনেকেই মন্ত্রীর একান্ত সচিব, সহকারী সচিব এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের নিকটাত্মীয় পরিচয় দিয়ে রেলের পরিচালকদের কাছ থেকে বিভিন্ন অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার জন্য মোবাইলে যোগাযোগ করছেন।
এসব বিষয় জানার পর তা রেলমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়েছে। এ ধরনের সুবিধা যারা চাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা এবং যেসব মোবাইল নম্বর থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে, সেগুলো আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কাছে পাঠিয়ে ওই ব্যক্তিদের সঠিক পরিচয় জানার নির্দেশ দিয়েছেন মন্ত্রী। এই ধরনের ক্ষেত্রে রেল কর্মকর্তাদের বিভ্রান্ত না হয়ে দাপ্তরিক প্রক্রিয়া অনুসরণ ছাড়া কোনো কার্যক্রম গ্রহণ না করতে বলা হয়েছে অফিস আদেশে।
এই প্রতিবেদনটি