পি কে হালদার ভারতে গ্রেপ্তার
শিবশংকর নামে নাগরিকত্ব নিয়েছেন
আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি বাংলাদেশকে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী
নিজস্ব প্রতিবেদক | ১৫ মে, ২০২২ ০০:০০
এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পিটিআইসহ দেশটির একাধিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, হাজার কোটি টাকা পাচারকারী পি কে হালদার নাম পাল্টে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে বসবাস করতেন। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার অশোকনগরের একটি বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন তিনি।
গতকাল শনিবার পি কে হালদারসহ মোট ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। পরে উত্তর চব্বিশ পরগনার একটি আদালতে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হয়।
এর আগে গত শুক্রবার দিনভর কলকাতা ও উত্তর চব্বিশ পরগনার অন্তত ৯টি স্থানে অভিযান চালায় ইডি। সে সময় উত্তর চব্বিশ পরগনার অশোকনগর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার পোলেরহাটে দুটি বাড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় পি কে হালদারের ব্যক্তিগত আইনজীবী সুকুমার মৃধার অবৈধ সম্পত্তির খোঁজে অভিযান শুরু করে সংস্থাটি। কর্মকর্তারা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে এই তল্লাশি অভিযান পরিচালনা করেন। এ সময় তাদের সঙ্গে প্রচুর নিরাপত্তাকর্মী ছিলেন।
এরপর গতকাল পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার অন্তত ৯টি জায়গায় একাধিক অভিযান চালিয়ে পি কে হালদারকে গ্রেপ্তার করা হয়। হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সব সন্দেহভাজনই জালিয়াতি করে ভারতীয় নাগরিকত্বের কাগজপত্র নিয়েছিলেন। পি কে হালদার ভারতীয় নাগরিক হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে বাস করছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রেশন কার্ড, ভারতীয় ভোটার আইডি কার্ডসহ প্যান ও আধার কার্ড সংগ্রহ করে তিনি শিবশঙ্কর হালদার নাম ব্যবহার করছিলেন বলে জানানো হয়েছে ইডির এক বিবৃতিতে।
ইডির কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন যে এসব কার্ড ব্যবহার করে সন্দেহভাজনরা ভারতে কোম্পানি খুলেছিলেন। এ ছাড়া কলকাতাসহ বিভিন্ন জায়গায় স্থাবর সম্পত্তিও কেনেন। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে আত্মসাৎ করা অর্থ অন্যান্য দেশেও পাচার করা হয়েছে।
এর আগে গত শুক্রবার ডয়চে ভেলে, পিটিআই ও আনন্দবাজার জানায়, পি কে হালদারের সহযোগী সুকুমার মৃধা, প্রীতিশ কুমার হালদার, প্রাণেশ কুমার হালদার ও তাদের সহযোগীদের নামে থাকা বাড়ি ও সম্পত্তিতে সেদিন অভিযান চালায় ইডি। তাদের সবাইকে বাংলাদেশি নাগরিক উল্লেখ করে তাদের নামে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে সম্পত্তির খোঁজ পেয়েছে বলে জানিয়েছে ইডি।
গত বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে সুকুমার মৃধা ও তার মেয়ে অনিন্দিতা মৃধাকে দুদক গ্রেপ্তারের পর থেকে তারা এখনো বাংলাদেশের কারাগারে রয়েছেন।
এর আগে ২০১৮ সালে পিকে হালদার এবং তার ভাই প্রীতিশ কুমার হালদার কানাডার পাশাপাশি ভারতেও হাল ট্রিপ টেকনোলজি নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। সেই প্রতিষ্ঠানের সূত্র ধরেই পিকে হালদার ও তার সহযোগীরা ভারতে অবৈধভাবে অর্থ পাচার করে বিপুল সম্পত্তি গড়ে তুলেছেন বলে দাবি ভারতীয় গোয়েন্দাদের। পলাতক পি কে হালদারের ব্যক্তিগত আইনজীবী এবং তার অর্থ দেখভাল করতেন সুকুমার।
আনন্দবাজারের খবরে বলা হয়েছে, সুকুমার অশোকনগরের বিভিন্ন জায়গায় জমি কিনে ব্যবসা করেন। সেখানে তার একাধিক বাড়ি ও দোকান রয়েছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্ট পিটিআইর বরাত দিয়ে লিখেছে, ইডি নিশ্চিত হয়েছে যে এসব বাংলাদেশি ভুয়া পরিচয় দিয়ে ভারতে কোম্পানিও খুলেছে এবং কলকাতার অভিজাত এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সম্পত্তি কিনেছে। অভিযানকালে সুকুমারের একটি বাড়িতে প্রচুর অর্থ পাওয়া গেছে বলে অসমর্থিত সূত্রকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে ডয়চে ভেলে।
ডয়চে ভেলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুকুমার বাংলাদেশে বসবাস করলেও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় তার অনেক মাছের ঘের আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখছে ইডি।
দুদকের যত মামলা : পি কে হালদারের বিরুদ্ধে ৩০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের নামে ১০ হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন কৌশলে আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা যায়, পি কে হালদার প্রায় হাজার কোটি টাকা সিঙ্গাপুর, কানাডা ও ভারতে পাচার করেন। কানাডায় তার ৪০০ কোটি টাকা পাচারের তথ্য আছে দুদকের কাছে। কানাডার টরন্টোতে মার্কেট, বিলাসবহুল বাড়ি ও গাড়ি কিনেছেন তিনি।
পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৯ সালে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় প্রথম পি কে হালদারের নাম সামনে আসে। ওই সময় দুদক ৪৩ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছিল। এর মধ্যে পি কে হালদার ছিলেন অন্যতম। ১৭৮টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করেন তিনি। এসব ব্যাংক হিসাবে ৬ হাজার ৮০ কোটি টাকা জমা রেখেছিলেন। পাশাপাশি এসব হিসাব থেকে তার নামে ও বেনামে আরও ৬ হাজার ৭৬ কোটি টাকা উত্তোলন করারও তথ্য পাওয়া গেছে।
দুদক সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মোট ৩৭টি মামলা করেছে দুদক। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করে সংস্থাটি। গত বছর ওই মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এরপর বিভিন্ন সময় পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে বাকি মামলাগুলো করা হয়। এর মধ্যে তিনটির অভিযোগপত্র কমিশনের অনুমোদনের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে।
আসামিদের মধ্যে ১৩ জনকে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। ১১ আসামি আদালতে নিজেদের দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। ৬৪ জনের বিদেশ যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে আদালতে।
এই অর্থ কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে পি কে হালদারের ৮৩ সহযোগীর ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়েছে। প্রায় এক হাজার কোটি টাকা মূল্যের জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ অন্যান্য স্থাবর সম্পদ ক্রোক করা হয়েছে।
পি কে হালদার প্রথমে রিলায়েন্স ফিন্যান্স ও পরে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ব্যাংকবহির্ভূত আরও চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিজ কর্তৃত্বে ও নিয়ন্ত্রণে নেন। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের নামে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ ওঠে পি কে হালদার, তার পরিবারের কতিপয় সদস্য ও সহযোগীদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ ওঠার পরপরই শোনা যায় কানাডায় পাড়ি দিয়েছেন পি কে হালদার। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা এবং তাকে গ্রেপ্তারে পদক্ষেপের বিষয়ে জানাতে ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর স্বতঃপ্রণোদিত এক আদেশে দুদককে বিস্তারিত জানাতে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। পরে দুদক একটি প্রতিবেদন উপস্থাপনের মাধ্যমে আদালতকে জানায়, তাকে (পি কে হালদার) গ্রেপ্তারে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে সংশ্লিষ্ট বিচারিক আদালতে আবেদন করা হয়েছে। পরে এক বিনিয়োগকারীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি পি কে হালদার ও তার পরিবারের কয়েকজন সদস্যসহ ২০ জনের ব্যাংক হিসাব ও পাসপোর্ট জব্দের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট।
পরে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে বিদেশে অবস্থান করে পি কে হালদার আইনজীবীর মাধ্যমে হাইকোর্টে একটি আবেদন করে বলেন, দেশে ফিরে নিরাপদে আইনি হেফাজতে যেতে হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ চান তিনি। বিনিয়োগকারীদের অর্থ পরিশোধ করতেই তার এ উদ্যোগ বলে আবেদনে উল্লেখ করা হয়। তবে ৭ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট তার আবেদন নামঞ্জুর করে আদেশে বলে, দেশে ফিরে তবেই তাকে আইনি হেফাজতে যেতে হবে। এরপর বিনিয়োগকারীদের অর্থ কীভাবে ফেরত দেওয়া যায়, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের পাঁচ আমানতকারীর করা আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি পি কে হালদার, তার মাসহ ২৫ ব্যক্তির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা এবং তারা যাতে বিদেশে যেতে না পারেন, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আদেশ দেয় হাইকোর্ট।
পাসপোর্ট জব্দের পরেও পি কে হালদার কীভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছিল হাইকোর্ট। ২০২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে একটি প্রতিবেদন দেয় পুলিশের ইমিগ্রেশন বিভাগ। তাতে বলা হয়, বিমানবন্দর নয়, যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে সড়কপথে দেশ ছাড়েন পি কে হালদার। তার বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে দুদকের চিঠি ইস্যুর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর বিকেল ৩টা ৩৮ মিনিটে দেশত্যাগ করেন তিনি। দুদক এ বিষয়ে ইমিগ্রেশন বিভাগকে ২২ অক্টোবর ডাকযোগে চিঠি পাঠিয়েছিল। সেটি ইমিগ্রেশন বিভাগ পরদিন সাড়ে ৪টায় পায়। এরপর পি কে হালদারসহ ২৪ জনের ফাইল প্রস্তুত করে দেশের সব বিমান ও স্থলবন্দরকে ওই দিন ৫টা ৪৭ মিনিটে অবহিত করা হয়। এর আগেই পি কে হালদার বেনাপোল দিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি বাংলাদেশকে : বাংলাদেশে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও বিদেশে অর্থ পাচারে অভিযুক্ত এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদাররের (পি কে হালদার) ভারতে গ্রেপ্তার হওয়ার বিষয়ে এখনো কিছুই জানে না বাংলাদেশ। ভারত পিকে হালদারের গ্রেপ্তারের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জানালে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। গতকাল শনিবার ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি এ তথ্য জানান।
ড. মোমেন বলেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এখনো আমাকে এ সম্পর্কে কেউ কিছুই জানায়নি এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও জানায়নি। বিষয়টি আপনাদের মতো আমিও মিডিয়াতে দেখেছি। আমাদের জানালে যা যা করা দরকার সেটি আমরা করব। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি বলবেন।’
বাংলাদেশের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে পিকে হালদারকে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তারা (ডিরেক্টরেট অব এনফোর্সমেন্ট- ইডি) তথ্য সংগ্রহ করে গেছেন। এর পরের বিষয়গুলো আমি জানি না।’
বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের ফিরিয়ে আনতে দুর্নীতি দমন কমিশন বহু আগে থেকেই কাজ করছে উল্লেখ করে মোমেন বলেন, ‘অনেক লোকজন আমাদের টাকা নামে-বেনামে বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে। এরা দেশের শত্রু, সুতরাং এদের ধরে আনতে পারলে ভালো।’
শেয়ার করুন
শিবশংকর নামে নাগরিকত্ব নিয়েছেন আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি বাংলাদেশকে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী
নিজস্ব প্রতিবেদক | ১৫ মে, ২০২২ ০০:০০

এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পিটিআইসহ দেশটির একাধিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, হাজার কোটি টাকা পাচারকারী পি কে হালদার নাম পাল্টে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে বসবাস করতেন। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার অশোকনগরের একটি বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন তিনি।
গতকাল শনিবার পি কে হালদারসহ মোট ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। পরে উত্তর চব্বিশ পরগনার একটি আদালতে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হয়।
এর আগে গত শুক্রবার দিনভর কলকাতা ও উত্তর চব্বিশ পরগনার অন্তত ৯টি স্থানে অভিযান চালায় ইডি। সে সময় উত্তর চব্বিশ পরগনার অশোকনগর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার পোলেরহাটে দুটি বাড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় পি কে হালদারের ব্যক্তিগত আইনজীবী সুকুমার মৃধার অবৈধ সম্পত্তির খোঁজে অভিযান শুরু করে সংস্থাটি। কর্মকর্তারা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে এই তল্লাশি অভিযান পরিচালনা করেন। এ সময় তাদের সঙ্গে প্রচুর নিরাপত্তাকর্মী ছিলেন।
এরপর গতকাল পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার অন্তত ৯টি জায়গায় একাধিক অভিযান চালিয়ে পি কে হালদারকে গ্রেপ্তার করা হয়। হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সব সন্দেহভাজনই জালিয়াতি করে ভারতীয় নাগরিকত্বের কাগজপত্র নিয়েছিলেন। পি কে হালদার ভারতীয় নাগরিক হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে বাস করছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রেশন কার্ড, ভারতীয় ভোটার আইডি কার্ডসহ প্যান ও আধার কার্ড সংগ্রহ করে তিনি শিবশঙ্কর হালদার নাম ব্যবহার করছিলেন বলে জানানো হয়েছে ইডির এক বিবৃতিতে।
ইডির কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন যে এসব কার্ড ব্যবহার করে সন্দেহভাজনরা ভারতে কোম্পানি খুলেছিলেন। এ ছাড়া কলকাতাসহ বিভিন্ন জায়গায় স্থাবর সম্পত্তিও কেনেন। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে আত্মসাৎ করা অর্থ অন্যান্য দেশেও পাচার করা হয়েছে।
এর আগে গত শুক্রবার ডয়চে ভেলে, পিটিআই ও আনন্দবাজার জানায়, পি কে হালদারের সহযোগী সুকুমার মৃধা, প্রীতিশ কুমার হালদার, প্রাণেশ কুমার হালদার ও তাদের সহযোগীদের নামে থাকা বাড়ি ও সম্পত্তিতে সেদিন অভিযান চালায় ইডি। তাদের সবাইকে বাংলাদেশি নাগরিক উল্লেখ করে তাদের নামে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে সম্পত্তির খোঁজ পেয়েছে বলে জানিয়েছে ইডি।
গত বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে সুকুমার মৃধা ও তার মেয়ে অনিন্দিতা মৃধাকে দুদক গ্রেপ্তারের পর থেকে তারা এখনো বাংলাদেশের কারাগারে রয়েছেন।
এর আগে ২০১৮ সালে পিকে হালদার এবং তার ভাই প্রীতিশ কুমার হালদার কানাডার পাশাপাশি ভারতেও হাল ট্রিপ টেকনোলজি নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। সেই প্রতিষ্ঠানের সূত্র ধরেই পিকে হালদার ও তার সহযোগীরা ভারতে অবৈধভাবে অর্থ পাচার করে বিপুল সম্পত্তি গড়ে তুলেছেন বলে দাবি ভারতীয় গোয়েন্দাদের। পলাতক পি কে হালদারের ব্যক্তিগত আইনজীবী এবং তার অর্থ দেখভাল করতেন সুকুমার।
আনন্দবাজারের খবরে বলা হয়েছে, সুকুমার অশোকনগরের বিভিন্ন জায়গায় জমি কিনে ব্যবসা করেন। সেখানে তার একাধিক বাড়ি ও দোকান রয়েছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্ট পিটিআইর বরাত দিয়ে লিখেছে, ইডি নিশ্চিত হয়েছে যে এসব বাংলাদেশি ভুয়া পরিচয় দিয়ে ভারতে কোম্পানিও খুলেছে এবং কলকাতার অভিজাত এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সম্পত্তি কিনেছে। অভিযানকালে সুকুমারের একটি বাড়িতে প্রচুর অর্থ পাওয়া গেছে বলে অসমর্থিত সূত্রকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে ডয়চে ভেলে।
ডয়চে ভেলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুকুমার বাংলাদেশে বসবাস করলেও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় তার অনেক মাছের ঘের আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখছে ইডি।
দুদকের যত মামলা : পি কে হালদারের বিরুদ্ধে ৩০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের নামে ১০ হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন কৌশলে আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা যায়, পি কে হালদার প্রায় হাজার কোটি টাকা সিঙ্গাপুর, কানাডা ও ভারতে পাচার করেন। কানাডায় তার ৪০০ কোটি টাকা পাচারের তথ্য আছে দুদকের কাছে। কানাডার টরন্টোতে মার্কেট, বিলাসবহুল বাড়ি ও গাড়ি কিনেছেন তিনি।
পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৯ সালে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় প্রথম পি কে হালদারের নাম সামনে আসে। ওই সময় দুদক ৪৩ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছিল। এর মধ্যে পি কে হালদার ছিলেন অন্যতম। ১৭৮টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করেন তিনি। এসব ব্যাংক হিসাবে ৬ হাজার ৮০ কোটি টাকা জমা রেখেছিলেন। পাশাপাশি এসব হিসাব থেকে তার নামে ও বেনামে আরও ৬ হাজার ৭৬ কোটি টাকা উত্তোলন করারও তথ্য পাওয়া গেছে।
দুদক সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মোট ৩৭টি মামলা করেছে দুদক। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করে সংস্থাটি। গত বছর ওই মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এরপর বিভিন্ন সময় পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে বাকি মামলাগুলো করা হয়। এর মধ্যে তিনটির অভিযোগপত্র কমিশনের অনুমোদনের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে।
আসামিদের মধ্যে ১৩ জনকে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। ১১ আসামি আদালতে নিজেদের দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। ৬৪ জনের বিদেশ যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে আদালতে।
এই অর্থ কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে পি কে হালদারের ৮৩ সহযোগীর ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়েছে। প্রায় এক হাজার কোটি টাকা মূল্যের জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ অন্যান্য স্থাবর সম্পদ ক্রোক করা হয়েছে।
পি কে হালদার প্রথমে রিলায়েন্স ফিন্যান্স ও পরে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ব্যাংকবহির্ভূত আরও চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিজ কর্তৃত্বে ও নিয়ন্ত্রণে নেন। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের নামে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ ওঠে পি কে হালদার, তার পরিবারের কতিপয় সদস্য ও সহযোগীদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ ওঠার পরপরই শোনা যায় কানাডায় পাড়ি দিয়েছেন পি কে হালদার। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা এবং তাকে গ্রেপ্তারে পদক্ষেপের বিষয়ে জানাতে ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর স্বতঃপ্রণোদিত এক আদেশে দুদককে বিস্তারিত জানাতে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। পরে দুদক একটি প্রতিবেদন উপস্থাপনের মাধ্যমে আদালতকে জানায়, তাকে (পি কে হালদার) গ্রেপ্তারে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে সংশ্লিষ্ট বিচারিক আদালতে আবেদন করা হয়েছে। পরে এক বিনিয়োগকারীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি পি কে হালদার ও তার পরিবারের কয়েকজন সদস্যসহ ২০ জনের ব্যাংক হিসাব ও পাসপোর্ট জব্দের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট।
পরে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে বিদেশে অবস্থান করে পি কে হালদার আইনজীবীর মাধ্যমে হাইকোর্টে একটি আবেদন করে বলেন, দেশে ফিরে নিরাপদে আইনি হেফাজতে যেতে হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ চান তিনি। বিনিয়োগকারীদের অর্থ পরিশোধ করতেই তার এ উদ্যোগ বলে আবেদনে উল্লেখ করা হয়। তবে ৭ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট তার আবেদন নামঞ্জুর করে আদেশে বলে, দেশে ফিরে তবেই তাকে আইনি হেফাজতে যেতে হবে। এরপর বিনিয়োগকারীদের অর্থ কীভাবে ফেরত দেওয়া যায়, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের পাঁচ আমানতকারীর করা আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি পি কে হালদার, তার মাসহ ২৫ ব্যক্তির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা এবং তারা যাতে বিদেশে যেতে না পারেন, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আদেশ দেয় হাইকোর্ট।
পাসপোর্ট জব্দের পরেও পি কে হালদার কীভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছিল হাইকোর্ট। ২০২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে একটি প্রতিবেদন দেয় পুলিশের ইমিগ্রেশন বিভাগ। তাতে বলা হয়, বিমানবন্দর নয়, যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে সড়কপথে দেশ ছাড়েন পি কে হালদার। তার বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে দুদকের চিঠি ইস্যুর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর বিকেল ৩টা ৩৮ মিনিটে দেশত্যাগ করেন তিনি। দুদক এ বিষয়ে ইমিগ্রেশন বিভাগকে ২২ অক্টোবর ডাকযোগে চিঠি পাঠিয়েছিল। সেটি ইমিগ্রেশন বিভাগ পরদিন সাড়ে ৪টায় পায়। এরপর পি কে হালদারসহ ২৪ জনের ফাইল প্রস্তুত করে দেশের সব বিমান ও স্থলবন্দরকে ওই দিন ৫টা ৪৭ মিনিটে অবহিত করা হয়। এর আগেই পি কে হালদার বেনাপোল দিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি বাংলাদেশকে : বাংলাদেশে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও বিদেশে অর্থ পাচারে অভিযুক্ত এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদাররের (পি কে হালদার) ভারতে গ্রেপ্তার হওয়ার বিষয়ে এখনো কিছুই জানে না বাংলাদেশ। ভারত পিকে হালদারের গ্রেপ্তারের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জানালে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। গতকাল শনিবার ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি এ তথ্য জানান।
ড. মোমেন বলেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এখনো আমাকে এ সম্পর্কে কেউ কিছুই জানায়নি এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও জানায়নি। বিষয়টি আপনাদের মতো আমিও মিডিয়াতে দেখেছি। আমাদের জানালে যা যা করা দরকার সেটি আমরা করব। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি বলবেন।’
বাংলাদেশের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে পিকে হালদারকে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তারা (ডিরেক্টরেট অব এনফোর্সমেন্ট- ইডি) তথ্য সংগ্রহ করে গেছেন। এর পরের বিষয়গুলো আমি জানি না।’
বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের ফিরিয়ে আনতে দুর্নীতি দমন কমিশন বহু আগে থেকেই কাজ করছে উল্লেখ করে মোমেন বলেন, ‘অনেক লোকজন আমাদের টাকা নামে-বেনামে বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে। এরা দেশের শত্রু, সুতরাং এদের ধরে আনতে পারলে ভালো।’