টাকায় আটায় পুঁজিতে ধাক্কা
শেয়ারে ব্যাপক দরপতন
নিজস্ব প্রতিবেদক | ১৭ মে, ২০২২ ০০:০০
অস্বাভাবিক আমদানি ব্যয়ের চাপে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে সরকারের সতর্ক অবস্থান, ডলারের বিপরীতে টাকা অবমূল্যায়নসহ দেশের অর্থনীতিতে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভকে কেন্দ্র করে দেশের অর্থনীতির নেতিবাচক ধারার শঙ্কায় বিনিয়োগকারীরা ভীত হয়ে পড়েছেন। এতে শেয়ারের বিক্রি চাপ বেড়ে যাওয়ায় দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ভয়াবহ দরপতন হয়েছে। গতকাল কেনাবেচা হওয়া ৯১ শতাংশ শেয়ারের দরপতনে স্টক এক্সচেঞ্জটির প্রধান মূল্যসূচক ১৩৪ পয়েন্ট বা ২ শতাংশ হারিয়েছে। এ পতন গত ৭ মার্চের পর সর্বোচ্চ।
বাজার পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে দরপতনের সর্বনিম্ন সীমা ৫ শতাংশে সীমিত করে রেখেছে এসইসি। স্বাভাবিক দরপতনের সীমা বহাল থাকলে গতকাল সূচকের আরও বড় পতন দেখা যেত বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। গতকালের পতনের পর ডিএসইর প্রধান সূচক নেমে এসেছে ৬৪৩১ পয়েন্টে। মূলত গত বছরের অক্টোবরের ™ি^তীয় সপ্তাহে ডিএসইএক্স সূচক ৭৪০০ পয়েন্ট ছাড়ানোর পর থেকে দরপতন শুরু হয়। এরপর থেমে থেমে টানা সাত মাস ধরে দরপতন চলছে। এ দরপতনে তালিকাভুক্ত ৩৮৫টি শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিটের মধ্যে সিংহভাগ দর হারিয়েছে। এ সময়ে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত দর হারিয়েছে প্রায় ১৫০টি শেয়ার। এর মধ্যে মৌলভিত্তিসম্পন্ন অনেক দামি শেয়ারও রয়েছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত যাদের বিনিয়োগে পুঁজিবাজারে বড় উত্থান হয়েছিল, তাদের অনেকে মুনাফা তুলে নিতে গত সাত মাসে শেয়ার বিক্রি করেছেন। এ তালিকায় দেশীয় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা যেমন রয়েছেন, তেমনি ব্যক্তিশ্রেণির বড় বিনিয়োগকারীরা আছেন। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বিদেশিরাও শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। এর ফলে শেয়ার দরের সঙ্গে সূচক ও লেনদেনও কমতে থাকে।
বড় বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও নতুন করে বিনিয়োগ না করে সতর্ক অবস্থানে যাচ্ছেন। অবশ্য গতকালের দরপতনে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ভূমিকা থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কিনে সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টায় ছিলেন বলে জানিয়েছেন এসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গতকালসহ সর্বশেষ চার কার্যদিবসে ২৬৭ পয়েন্ট হারিয়েছে ডিএসইএক্স সূচক। এর মধ্যে গত সপ্তাহের শেষ তিন কার্যদিবসে সূচক হারিয়েছিল ১৩২ পয়েন্ট। তবে দরপতন থামাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি গত সপ্তহে যতটা তৎপর ছিল গতকাল ততটা ছিল না। অবশ্য বড় পতন হলেও গতকাল পি কে হালদারের মালিকানাধীন দুই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দর সর্বোচ্চ বেড়েছে।
গতকাল ৩৮১ কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ৩৪৮টিই দর হারিয়েছে, বেড়েছে মাত্র ২৬টির এবং অপরিবর্তিত থেকেছে ৭টির দর। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গতকাল ১৪৪ কোম্পানির শেয়ার লেনদেনের মাঝে সার্কিট ব্রেকারের সর্বনিম্ন দরে নেমেছিল। শেষ পর্যন্ত ওই দরে ছিল ৬৭ শেয়ার। শেয়ারদর ও সূচকের পতন কমিয়ে রাখতে সার্কিট ব্রেকারের নিম্নসীমা এখন ৫ শতাংশে সীমিত করে রেখেছে এসইসি। যদিও দরবৃদ্ধির ঊর্ধ্বসীমা ১০ শতাংশ বহাল আছে।
খাতওয়ারি লেনদেন পর্যালোচনায় দেখা যায়, গতকাল সেবা ও নির্মাণ, কাগজ ও ছাপাখানা এবং ভ্রমণ ও অবকাশ খাতের ১৩ কোম্পানির শেয়ারদর গড়ে প্রায় ৫ শতাংশ দরপতন হয়েছে। এছাড়া বড় খাতগুলোর মধ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বীমা, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, প্রকৌশল, বস্ত্র, সিমেন্ট এবং তথ্য ও প্রযুক্তি খাতের দরপতন হয়েছে ৩ থেকে প্রায় ৪ শতাংশ পর্যন্ত। মূলধন বিবেচনায় সবচেয়ে বড় খাত ব্যাংক এবং টেলিযোগাযোগ খাতের দরপতনের হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ওষুধ ও রসায়নসহ অন্য খাতগুলোর সার্বিক দরপতনের হার ছিল ২ শতাংশের বেশি।
এমন দরপতনের কারণ জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অনারারি অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজারে এখন ‘প্যানিক সেল’ হচ্ছে। নানা ইস্যুতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে। ফলে একটু অস্থিরতা তৈরি হলে অনেকে শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করেন। দরপতন হলে অনেক প্রতিষ্ঠান মার্জিন ঋণ আদায়ে ‘ফোর্স সেল’ করছে। এর বাইরে বড় বিনিয়োগকারী এবং বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চাপও বাজারকে নাজুক করে তুলছে বলে মনে করেন তিনি।
শেয়ার করুন
নিজস্ব প্রতিবেদক | ১৭ মে, ২০২২ ০০:০০

অস্বাভাবিক আমদানি ব্যয়ের চাপে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে সরকারের সতর্ক অবস্থান, ডলারের বিপরীতে টাকা অবমূল্যায়নসহ দেশের অর্থনীতিতে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভকে কেন্দ্র করে দেশের অর্থনীতির নেতিবাচক ধারার শঙ্কায় বিনিয়োগকারীরা ভীত হয়ে পড়েছেন। এতে শেয়ারের বিক্রি চাপ বেড়ে যাওয়ায় দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ভয়াবহ দরপতন হয়েছে। গতকাল কেনাবেচা হওয়া ৯১ শতাংশ শেয়ারের দরপতনে স্টক এক্সচেঞ্জটির প্রধান মূল্যসূচক ১৩৪ পয়েন্ট বা ২ শতাংশ হারিয়েছে। এ পতন গত ৭ মার্চের পর সর্বোচ্চ।
বাজার পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে দরপতনের সর্বনিম্ন সীমা ৫ শতাংশে সীমিত করে রেখেছে এসইসি। স্বাভাবিক দরপতনের সীমা বহাল থাকলে গতকাল সূচকের আরও বড় পতন দেখা যেত বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। গতকালের পতনের পর ডিএসইর প্রধান সূচক নেমে এসেছে ৬৪৩১ পয়েন্টে। মূলত গত বছরের অক্টোবরের ™ি^তীয় সপ্তাহে ডিএসইএক্স সূচক ৭৪০০ পয়েন্ট ছাড়ানোর পর থেকে দরপতন শুরু হয়। এরপর থেমে থেমে টানা সাত মাস ধরে দরপতন চলছে। এ দরপতনে তালিকাভুক্ত ৩৮৫টি শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিটের মধ্যে সিংহভাগ দর হারিয়েছে। এ সময়ে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত দর হারিয়েছে প্রায় ১৫০টি শেয়ার। এর মধ্যে মৌলভিত্তিসম্পন্ন অনেক দামি শেয়ারও রয়েছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত যাদের বিনিয়োগে পুঁজিবাজারে বড় উত্থান হয়েছিল, তাদের অনেকে মুনাফা তুলে নিতে গত সাত মাসে শেয়ার বিক্রি করেছেন। এ তালিকায় দেশীয় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা যেমন রয়েছেন, তেমনি ব্যক্তিশ্রেণির বড় বিনিয়োগকারীরা আছেন। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বিদেশিরাও শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। এর ফলে শেয়ার দরের সঙ্গে সূচক ও লেনদেনও কমতে থাকে।
বড় বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও নতুন করে বিনিয়োগ না করে সতর্ক অবস্থানে যাচ্ছেন। অবশ্য গতকালের দরপতনে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ভূমিকা থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কিনে সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টায় ছিলেন বলে জানিয়েছেন এসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গতকালসহ সর্বশেষ চার কার্যদিবসে ২৬৭ পয়েন্ট হারিয়েছে ডিএসইএক্স সূচক। এর মধ্যে গত সপ্তাহের শেষ তিন কার্যদিবসে সূচক হারিয়েছিল ১৩২ পয়েন্ট। তবে দরপতন থামাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি গত সপ্তহে যতটা তৎপর ছিল গতকাল ততটা ছিল না। অবশ্য বড় পতন হলেও গতকাল পি কে হালদারের মালিকানাধীন দুই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দর সর্বোচ্চ বেড়েছে।
গতকাল ৩৮১ কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ৩৪৮টিই দর হারিয়েছে, বেড়েছে মাত্র ২৬টির এবং অপরিবর্তিত থেকেছে ৭টির দর। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গতকাল ১৪৪ কোম্পানির শেয়ার লেনদেনের মাঝে সার্কিট ব্রেকারের সর্বনিম্ন দরে নেমেছিল। শেষ পর্যন্ত ওই দরে ছিল ৬৭ শেয়ার। শেয়ারদর ও সূচকের পতন কমিয়ে রাখতে সার্কিট ব্রেকারের নিম্নসীমা এখন ৫ শতাংশে সীমিত করে রেখেছে এসইসি। যদিও দরবৃদ্ধির ঊর্ধ্বসীমা ১০ শতাংশ বহাল আছে।
খাতওয়ারি লেনদেন পর্যালোচনায় দেখা যায়, গতকাল সেবা ও নির্মাণ, কাগজ ও ছাপাখানা এবং ভ্রমণ ও অবকাশ খাতের ১৩ কোম্পানির শেয়ারদর গড়ে প্রায় ৫ শতাংশ দরপতন হয়েছে। এছাড়া বড় খাতগুলোর মধ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বীমা, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, প্রকৌশল, বস্ত্র, সিমেন্ট এবং তথ্য ও প্রযুক্তি খাতের দরপতন হয়েছে ৩ থেকে প্রায় ৪ শতাংশ পর্যন্ত। মূলধন বিবেচনায় সবচেয়ে বড় খাত ব্যাংক এবং টেলিযোগাযোগ খাতের দরপতনের হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ওষুধ ও রসায়নসহ অন্য খাতগুলোর সার্বিক দরপতনের হার ছিল ২ শতাংশের বেশি।
এমন দরপতনের কারণ জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অনারারি অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজারে এখন ‘প্যানিক সেল’ হচ্ছে। নানা ইস্যুতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে। ফলে একটু অস্থিরতা তৈরি হলে অনেকে শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করেন। দরপতন হলে অনেক প্রতিষ্ঠান মার্জিন ঋণ আদায়ে ‘ফোর্স সেল’ করছে। এর বাইরে বড় বিনিয়োগকারী এবং বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চাপও বাজারকে নাজুক করে তুলছে বলে মনে করেন তিনি।