এনআইডি-জন্ম সনদ বাগিয়ে অপরাধে জড়াচ্ছে বিদেশিরা
এস এম নূরুজ্জামান | ১৭ মে, ২০২২ ০০:০০
দেশে জন্মগ্রহণকারী পথশিশুরা যেখানে পাচ্ছে না জন্ম নিবন্ধন সনদ, বড় হয়ে পাচ্ছে না জাতীয় পরিচয়পত্র; সে দেশেই ভুয়া তথ্য-উপাত্ত দিয়ে জালিয়াত চক্রের সহায়তায় জন্ম নিবন্ধন সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বাগিয়ে নিচ্ছে ভিনদেশিরা। আর জাতীয়তার প্রমাণসংক্রান্ত এসব ভুয়া নথি ব্যাবহার করে তারা জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। যাদের মধ্যে রয়েছে অনেক ভারতীয় ও মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা। সম্প্রতি ভারতীয় দুই নাগরিকের নামে জন্ম নিবন্ধন সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার পর অভিযোগের মুখে তা বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষ। আর এ বিষয়টি আলোচনায় আসার পর ভিনদেশিদের এনআইডি ও জন্ম সনদ পাওয়ার নতুন নতুন তথ্য জানা যাচ্ছে।
ভুয়া তথ্য-উপাত্তে জালিয়াত চক্রের সহায়তায় জন্ম নিবন্ধন সনদ ও এনআইডি বাগিয়ে নেওয়াদের একজন রহিম উল্লাহ, যিনি রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) একজন নেতা। কক্সবাজারে বিয়ে করেছেন দুটি। প্রথম শ্বশুরবাড়ি টেকনাফের গোদারবিল ও দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন কক্সবাজারের জেলগেট এলাকায়। দুই সংসারেই দুজন করে চার সন্তান রয়েছে তার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আরএসও নেতা রহিম উল্লাহর প্রথম শ্বশুরের নামও রহিম উল্লাহ। টেকনাফের গোদারবিল এলাকার বাসিন্দা তিনি। শ্বশুরের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়েছেন আরএসও নেতা রহিম উল্লাহ। সেটা ব্যবহার করে পাসপোর্ট বানিয়ে নিয়মিত মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই রহিম উল্লাহর বিরুদ্ধে ইয়াবা বহনের অভিযোগে পল্লবী থানায় একটি মামলা আছে। বাহারছড়া ইউনিয়নে রহিম উল্লাহ পরিচিত রহিম উল্লা মোলই (মাওলানা) নামে। তার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শামলাপুর ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) আবদুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রহিম উল্লা মোলই তো বর্মাইয়া। এই দেশে আইছে সাত-আট বছর আগে। আলতু-ফালতু কাজে জড়িত।’
রহিম উল্লাহর জাতীয় পরিচয়পত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০০৮ সালের ১ মে তার নামে ওই জাতীয় পরিচয়পত্র ইস্যু করা হয়। পরিচয়পত্রে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে কক্সবাজারের টেকনাফের গোদারবিল।
শ্বশুরের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে রোহিঙ্গা নেতা রহিম উল্লাহর জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নির্বাচন কমিশনের প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন শাখার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘২০০৮ সালের দিকে কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় যারা ভোটার হয়েছিলেন, তাদের প্রায় ৬০-৭০ ভাগ রোহিঙ্গা ছিল। এদের সবার জাতীয় পরিচয়পত্র বাতিল করা হয়েছে। তবে যাদের বাতিল করা হয়নি তাদের মধ্যেও মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা আছে।’
নির্বাচন কমিশনের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গারা ভোটার হওয়ার জন্য নানা উপায়ে কাগজপত্র সংগ্রহ করে থাকে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সব কার্যালয় থেকেই তারা কাগজপত্র সংগ্রহ করে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়েছে। তবে নির্দিষ্ট কারও বিষয়ে অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।’
কক্সবাজারে দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচন কমিশনে দায়িত্ব পালন করা আরেক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি এমনও রোহিঙ্গা পেয়েছি, যার কোনো এনআইডি নেই, কিন্তু বাংলাদেশি পাসপোর্ট আছে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাহারছড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. সাইফুল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি নাগরিক হওয়ার জন্য মরিয়া। যেকোনো উপায়ে তারা এনআইডি ও পাসপোর্ট নেওয়ার চেষ্টা করে থাকে। তারা মনে করে, এনআইডি ও পাসপোর্ট বাগাতে পারলে স্থায়ীভাবে এ দেশে থেকে যাওয়া যাবে।’
শ্বশুরের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে এনআইডি বাগানোর বিষয়ে রহিম উল্লাহর বক্তব্য জানতে তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
তিন ভারতীয়ের জন্ম সনদ ও এনআইডি তৈরি : বাগেরহাটের চিতলমারীর সদর ইউনিয়নের আড়ুয়াবর্ণি গ্রামকে নিজের স্থায়ী ঠিকানা দেখিয়ে জন্ম সনদ বাগিয়েছেন ভারতীয় নাগরিক ফণিভূষণ ওরফে মনি মন্ডল। একই এলাকা থেকে জন্ম সনদ নিয়েছেন আরেক ভারতীয় নাগরিক শ্রী প্রতুল চন্দ্র মন্ডল। তবে তাদের বিষয়ে লিখিত অভিযোগ আসার পর স্থানীয় প্রশাসনের তদন্তে দেখা যায়, ওইসব নামের কোনো ব্যক্তির বসবাস নেই সেখানে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ১০ মার্চ বাগেরহাটের চিতলমারীর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাইয়েদা ফয়জুন্নেসা ফণিভূষণ ওরফে মনি মন্ডল ও শ্রী প্রতুল চন্দ্র মন্ডলের ভুয়া জন্ম নিবন্ধন সনদ বাতিলের জন্য বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, ফণিভূষণ ও প্রতুল চন্দ্রের নামে যে জন্ম সনদ তা অবৈধ উপায়ে করা হয়েছে। তাদের জন্ম নিবন্ধনের ক্ষেত্রে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বিধিমালা অনুসরণ করা হয়নি মর্মে তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন।
বাগেরহাটের স্থানীয় সরকার শাখার জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার মো. ইয়ানুর রহমান ভুয়া জন্ম সনদ তৈরির সঙ্গে জড়িত স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চিঠি দেন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দা মোর্তজা সরদার অভিযোগ করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘৬০ বছরের বেশি সময় ধরে ফণিভূষণ ওরফে মনি মন্ডল নামে কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব ছিল না আমাদের এলাকায়। এ দেশে কোথাও তার বসতভিটা ও আত্মীয়স্বজনও নেই। কিন্তু একটি জালিয়াত চক্র ২০১৭ সালে হঠাৎ করেই বাগেরহাটের ৩ নম্বর সোনাতলা ওয়ার্ডের বাসিন্দা হিসেবে তার জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে। একইভাবে প্রতুল চন্দ্র নামে আরেক ব্যক্তি ভুয়া জন্ম সনদ তৈরি করে ভূমি জালিয়াত চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিরীহ মানুষের জমি দখলের চেষ্টা করছে। আর এ চক্রের হোতা চিতলমারী সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শেখ মো. নিজাম উদ্দিন।’
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান শেখ মো. নিজাম উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি যাদের জন্ম সনদ দিয়েছি, তারা অনেক আগে এই দেশে ছিলেন। মাঝখানে অনেক বছর ছিলেন না। পরবর্তীকালে আমিই তাদের জন্ম সনদ বাতিলের সুপারিশ করেছি। বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকায় এ ধরনের ভুলভ্রান্তি হয়ে থাকে। দিন শেষে চেয়ারম্যানের ওপর সব অভিযোগ বর্তায়।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফণিভূষণ ও প্রতুল চন্দ্রের মতো বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন এলাকায় আরও অনেক ভারতীয় নাগরিকের নামে জন্ম সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেছে একটি চক্র। সম্প্রতি বাগেরহাট পৌরসভার বাসিন্দা হিসেবে ১০৫ বছর বয়সী মনীন্দ্রনাথ দাশ ওরফে অমূল্য দাশ চন্দ্র নামে আরেক ব্যক্তির ভুয়া জন্ম সনদ তৈরি করা হয়। পরবর্তী সময়ে সেই জন্ম সনদের সহায়তায় ৫ নম্বর ওয়ার্ডের আমলাপাড়া এলাকায় ১ কোটি ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকার জমি কেনাবেচা করে চক্রটি।
ভিনদেশি নাগরিকদের বাংলাদেশি পরিচয়পত্র ব্যবহার কতটা ঝুঁকিপূর্ণ জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাষ্ট্রের কাছে যারা মিথ্যা পরিচয় দেয় তারা অপরাধী। ভিনদেশি নাগরিকরা যদি এ দেশের নাগরিকত্ব নেয় তাহলে আমাদের সামগ্রিকভাবে তাদের উদ্দেশ্য খুঁজে বের করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দেশীয় চক্রের সঙ্গে যুক্তদের চিহ্নিত করতে হবে। অন্যথায় ভিনদেশি লোকজন এ দেশের জন্ম সনদ কিংবা জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে থাকলে তাতে যেমন দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়, তেমনি তাদের মাধ্যমে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ে। এসব তৎপরতা বন্ধের জন্য সামগ্রিক পদক্ষেপ দরকার।’
শেয়ার করুন
এস এম নূরুজ্জামান | ১৭ মে, ২০২২ ০০:০০

দেশে জন্মগ্রহণকারী পথশিশুরা যেখানে পাচ্ছে না জন্ম নিবন্ধন সনদ, বড় হয়ে পাচ্ছে না জাতীয় পরিচয়পত্র; সে দেশেই ভুয়া তথ্য-উপাত্ত দিয়ে জালিয়াত চক্রের সহায়তায় জন্ম নিবন্ধন সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বাগিয়ে নিচ্ছে ভিনদেশিরা। আর জাতীয়তার প্রমাণসংক্রান্ত এসব ভুয়া নথি ব্যাবহার করে তারা জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। যাদের মধ্যে রয়েছে অনেক ভারতীয় ও মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা। সম্প্রতি ভারতীয় দুই নাগরিকের নামে জন্ম নিবন্ধন সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার পর অভিযোগের মুখে তা বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষ। আর এ বিষয়টি আলোচনায় আসার পর ভিনদেশিদের এনআইডি ও জন্ম সনদ পাওয়ার নতুন নতুন তথ্য জানা যাচ্ছে।
ভুয়া তথ্য-উপাত্তে জালিয়াত চক্রের সহায়তায় জন্ম নিবন্ধন সনদ ও এনআইডি বাগিয়ে নেওয়াদের একজন রহিম উল্লাহ, যিনি রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) একজন নেতা। কক্সবাজারে বিয়ে করেছেন দুটি। প্রথম শ্বশুরবাড়ি টেকনাফের গোদারবিল ও দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন কক্সবাজারের জেলগেট এলাকায়। দুই সংসারেই দুজন করে চার সন্তান রয়েছে তার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আরএসও নেতা রহিম উল্লাহর প্রথম শ্বশুরের নামও রহিম উল্লাহ। টেকনাফের গোদারবিল এলাকার বাসিন্দা তিনি। শ্বশুরের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়েছেন আরএসও নেতা রহিম উল্লাহ। সেটা ব্যবহার করে পাসপোর্ট বানিয়ে নিয়মিত মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই রহিম উল্লাহর বিরুদ্ধে ইয়াবা বহনের অভিযোগে পল্লবী থানায় একটি মামলা আছে। বাহারছড়া ইউনিয়নে রহিম উল্লাহ পরিচিত রহিম উল্লা মোলই (মাওলানা) নামে। তার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শামলাপুর ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) আবদুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রহিম উল্লা মোলই তো বর্মাইয়া। এই দেশে আইছে সাত-আট বছর আগে। আলতু-ফালতু কাজে জড়িত।’
রহিম উল্লাহর জাতীয় পরিচয়পত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০০৮ সালের ১ মে তার নামে ওই জাতীয় পরিচয়পত্র ইস্যু করা হয়। পরিচয়পত্রে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে কক্সবাজারের টেকনাফের গোদারবিল।
শ্বশুরের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে রোহিঙ্গা নেতা রহিম উল্লাহর জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নির্বাচন কমিশনের প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন শাখার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘২০০৮ সালের দিকে কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় যারা ভোটার হয়েছিলেন, তাদের প্রায় ৬০-৭০ ভাগ রোহিঙ্গা ছিল। এদের সবার জাতীয় পরিচয়পত্র বাতিল করা হয়েছে। তবে যাদের বাতিল করা হয়নি তাদের মধ্যেও মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা আছে।’
নির্বাচন কমিশনের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গারা ভোটার হওয়ার জন্য নানা উপায়ে কাগজপত্র সংগ্রহ করে থাকে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সব কার্যালয় থেকেই তারা কাগজপত্র সংগ্রহ করে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়েছে। তবে নির্দিষ্ট কারও বিষয়ে অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।’
কক্সবাজারে দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচন কমিশনে দায়িত্ব পালন করা আরেক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি এমনও রোহিঙ্গা পেয়েছি, যার কোনো এনআইডি নেই, কিন্তু বাংলাদেশি পাসপোর্ট আছে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাহারছড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. সাইফুল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি নাগরিক হওয়ার জন্য মরিয়া। যেকোনো উপায়ে তারা এনআইডি ও পাসপোর্ট নেওয়ার চেষ্টা করে থাকে। তারা মনে করে, এনআইডি ও পাসপোর্ট বাগাতে পারলে স্থায়ীভাবে এ দেশে থেকে যাওয়া যাবে।’
শ্বশুরের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে এনআইডি বাগানোর বিষয়ে রহিম উল্লাহর বক্তব্য জানতে তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
তিন ভারতীয়ের জন্ম সনদ ও এনআইডি তৈরি : বাগেরহাটের চিতলমারীর সদর ইউনিয়নের আড়ুয়াবর্ণি গ্রামকে নিজের স্থায়ী ঠিকানা দেখিয়ে জন্ম সনদ বাগিয়েছেন ভারতীয় নাগরিক ফণিভূষণ ওরফে মনি মন্ডল। একই এলাকা থেকে জন্ম সনদ নিয়েছেন আরেক ভারতীয় নাগরিক শ্রী প্রতুল চন্দ্র মন্ডল। তবে তাদের বিষয়ে লিখিত অভিযোগ আসার পর স্থানীয় প্রশাসনের তদন্তে দেখা যায়, ওইসব নামের কোনো ব্যক্তির বসবাস নেই সেখানে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ১০ মার্চ বাগেরহাটের চিতলমারীর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাইয়েদা ফয়জুন্নেসা ফণিভূষণ ওরফে মনি মন্ডল ও শ্রী প্রতুল চন্দ্র মন্ডলের ভুয়া জন্ম নিবন্ধন সনদ বাতিলের জন্য বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, ফণিভূষণ ও প্রতুল চন্দ্রের নামে যে জন্ম সনদ তা অবৈধ উপায়ে করা হয়েছে। তাদের জন্ম নিবন্ধনের ক্ষেত্রে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বিধিমালা অনুসরণ করা হয়নি মর্মে তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন।
বাগেরহাটের স্থানীয় সরকার শাখার জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার মো. ইয়ানুর রহমান ভুয়া জন্ম সনদ তৈরির সঙ্গে জড়িত স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চিঠি দেন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দা মোর্তজা সরদার অভিযোগ করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘৬০ বছরের বেশি সময় ধরে ফণিভূষণ ওরফে মনি মন্ডল নামে কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব ছিল না আমাদের এলাকায়। এ দেশে কোথাও তার বসতভিটা ও আত্মীয়স্বজনও নেই। কিন্তু একটি জালিয়াত চক্র ২০১৭ সালে হঠাৎ করেই বাগেরহাটের ৩ নম্বর সোনাতলা ওয়ার্ডের বাসিন্দা হিসেবে তার জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে। একইভাবে প্রতুল চন্দ্র নামে আরেক ব্যক্তি ভুয়া জন্ম সনদ তৈরি করে ভূমি জালিয়াত চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিরীহ মানুষের জমি দখলের চেষ্টা করছে। আর এ চক্রের হোতা চিতলমারী সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শেখ মো. নিজাম উদ্দিন।’
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান শেখ মো. নিজাম উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি যাদের জন্ম সনদ দিয়েছি, তারা অনেক আগে এই দেশে ছিলেন। মাঝখানে অনেক বছর ছিলেন না। পরবর্তীকালে আমিই তাদের জন্ম সনদ বাতিলের সুপারিশ করেছি। বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকায় এ ধরনের ভুলভ্রান্তি হয়ে থাকে। দিন শেষে চেয়ারম্যানের ওপর সব অভিযোগ বর্তায়।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফণিভূষণ ও প্রতুল চন্দ্রের মতো বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন এলাকায় আরও অনেক ভারতীয় নাগরিকের নামে জন্ম সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেছে একটি চক্র। সম্প্রতি বাগেরহাট পৌরসভার বাসিন্দা হিসেবে ১০৫ বছর বয়সী মনীন্দ্রনাথ দাশ ওরফে অমূল্য দাশ চন্দ্র নামে আরেক ব্যক্তির ভুয়া জন্ম সনদ তৈরি করা হয়। পরবর্তী সময়ে সেই জন্ম সনদের সহায়তায় ৫ নম্বর ওয়ার্ডের আমলাপাড়া এলাকায় ১ কোটি ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকার জমি কেনাবেচা করে চক্রটি।
ভিনদেশি নাগরিকদের বাংলাদেশি পরিচয়পত্র ব্যবহার কতটা ঝুঁকিপূর্ণ জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাষ্ট্রের কাছে যারা মিথ্যা পরিচয় দেয় তারা অপরাধী। ভিনদেশি নাগরিকরা যদি এ দেশের নাগরিকত্ব নেয় তাহলে আমাদের সামগ্রিকভাবে তাদের উদ্দেশ্য খুঁজে বের করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দেশীয় চক্রের সঙ্গে যুক্তদের চিহ্নিত করতে হবে। অন্যথায় ভিনদেশি লোকজন এ দেশের জন্ম সনদ কিংবা জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে থাকলে তাতে যেমন দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়, তেমনি তাদের মাধ্যমে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ে। এসব তৎপরতা বন্ধের জন্য সামগ্রিক পদক্ষেপ দরকার।’