দুর্ঘটনার তদন্তে কমিটি হয় বাস্তবায়ন হয় না সুপারিশ
এস এম নূরুজ্জামান | ৭ জুন, ২০২২ ০০:০০
মাত্র কয়েক দিন আগেই নিমতলী ট্র্যাজেডির এক যুগ পূর্ণ হয়েছে। রাজধানীর পুরান ঢাকার নিমতলীতে ২০১০ সালের ৩ জুন রাসায়নিকের গুদাম থেকে লাগা আগুনে পুড়ে মারা যান ১২৪ জন। ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডের পর সরকারের পক্ষ থেকে পুরান ঢাকাকে রাসায়নিক কারখানা ও গুদামমুক্ত করার ঘোষণা আসে। তবে তা শুধু ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ থাকে, বাস্তবায়ন হয়নি এখনো। নিমতলীর আগুনের ৯ বছরের মাথায় ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আবারও একইভাবে রাসায়নিকের আগুন কেড়ে নেয় ৭৭ প্রাণ। আহত হন দুই শতাধিক মানুষ। নিমতলী ও চুড়িহাট্টার আগুনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি সরকারের আরও বেশ কয়েকটি সংস্থার পক্ষ থেকে আলাদাভাবে তদন্ত শেষে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। যেসব প্রতিবেদনে রাসায়নিকের মজুদ থেকে নতুন করে দুর্ঘটনারোধে করণীয় সম্পর্কে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়। যেসব সুপারিশ শুধু সরকারের নথিপত্রেই থেকে গেছে, বাস্তবে প্রয়োগ হয়নি। এরই মধ্যে দেশের মানুষ সাক্ষী হলো রাসায়নিকের মজুদ থেকে দুর্ঘটনার আরও এক বিভীষিকার। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোতে রপ্তানির জন্য মজুদ থাকা রাসায়নিকে আগুনের পর বিস্ফোরণে সরকারি হিসাবে এরই মধ্যে প্রাণ গেছে ৪১ জনের। আহত হয়েছেন কয়েকশ, যাদের মধ্যে অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক।
চুড়িহাট্টায় আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল ওয়াহেদ ম্যানশন নামে একটি ভবন থেকে। ওই ঘটনায় ভবনটির মালিকের দুই ছেলে মো. হাসান ও সোহেল ওরফে শহীদসহ ৮-১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলার এজাহারে বলা হয়, ওয়াহেদ ম্যানসন নামে চারতলা বাড়িটির বিভিন্ন তলায় দাহ্য পদার্থ রাখা ছিল। মানুষের জীবনের ঝুঁকি জেনেও অবৈধভাবে রাসায়নিকের গুদাম ভাড়া দিয়েছিলেন বাড়ির মালিকরা। পরবর্তী সময়ে চকবাজার থানা পুলিশ তদন্ত করে দুই ভাইসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়।
চুড়িহাট্টার আগে নিমতলীর ভয়াবহ আগুনের পর দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দাবি ওঠে। যদিও ওই ঘটনায় কোনো মামলা করা হয়নি। তবে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। অবশ্য সেই জিডির কথা এখন আর মনে নেই কোনো পুলিশ কর্মকর্তার। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বংশাল থানার ওসি আবুল খায়ের দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘১২ বছর আগের জিডি সম্পর্কে এখন কিছুই জানি না।’
আর চুড়িহাট্টার আগুনের তদন্ত প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের চকবাজার জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার কুদরত-ই খুদা বলেন, ‘চুড়িহাট্টার আগুনের ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে যা যা করার ছিলÑ সবই করা হয়েছে। মামলার তদন্ত করে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। অভিযুক্ত অধিকাংশ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিষয়টি এখন আদালতের এখতিয়ারে। এর বাইরে বিভিন্ন সংস্থার যেসব সুপারিশমালা রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের এখতিয়ার নেই পুলিশের। পুরান ঢাকাকে রাসায়নিকমুক্ত করার জন্য যেসব সংস্থার দায়িত্ব তাদের বিষয়ে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই।’
ফায়ার সার্ভিসের সাবেক উপ-পরিচালক (অপারেশন) দেবাশীষ বর্ধন দেশ রূপান্তরকে বলেন, নিমতলী ও চুড়িহাট্টার আগুনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বিস্তারিত তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। এছাড়া শিল্প মন্ত্রণালয় ও ঢাকা জেলা প্রশাসন থেকেও পৃথক পৃথক তদন্ত প্রতিবেদন জমা হয়। তদন্ত করে বিস্ফোরক পরিদপ্তরও। সবগুলো প্রতিবেদনেই নগরবাসীর জীবনের ঝুঁকি কমানোর জন্য আবাসিক এলাকা থেকে সব ধরনের রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। এরপর কিছুদিন সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা অভিযান চালিয়ে রাসায়নিক অপসারণ ও জব্দ করে। তারপর এলাকার বাসিন্দাদের আপত্তির মুখে এক পর্যায়ে অভিযান বন্ধ হয়ে যায়।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, চুড়িহাট্টা ও এর আশপাশের এলাকায় বহাল তবিয়তেই ব্যবসা করে যাচ্ছেন রাসায়নিক ব্যবসায়ীরা। আবাসিক ভবনগুলোর ঘরে ঘরেই রাসায়নিক গুদাম, দোকান ও কারখানা গড়ে তুলছেন। তাদের শঙ্কা, আবারও যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নিমতলী ও চুড়িহাট্টার ট্র্যাজেডি থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটা কেউই নেয়নি। এমনকি সীতাকুণ্ডের কন্টেইনার ডিপোর মতো গুরুত্বপর্ণ স্থাপনায় দাহ্য পদার্থ এত অপরিপক্বভাবে হ্যান্ডেলিং করা হয়েছে যে তাতে বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের রাসায়নিক বিস্ফোরণে মানুষের হতাহতের বাইরে দেশের বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে। ঘটনাটি স্যাবোটাজ কি না সে বিষয়েও তদন্ত শুরু হয়েছে। সীতাকুণ্ডের ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে আমদানি-রপ্তানি দেখভালকারী যত প্রতিষ্ঠান সম্পৃক্ত ছিল, তাদের প্রত্যেকেরই অপেশাদারিত্বের বিষয়টি ধরা পড়েছে। ইতিমধ্যে আগুনের উৎস থেকে শুরু করে রাসায়নিক বিস্ফোরণের প্রত্যেকটি বিষয় নিবিড়ভাবে তদন্ত করা হচ্ছে।’
পুরান ঢাকায় রাসায়নিক গুদামে বারবার আগুন লাগার পর বিভিন্ন সরকারি সংস্থা তদন্ত করে। তাদের প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী রাসায়নিক ব্যবসার ১ হাজার ৯২৪টি পাইকারি ও খুচরা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। পুরান ঢাকার চকবাজার, লালবাগ, আরমানিটোলা, ইমামগঞ্জ, ইসলামবাগ, মিটফোর্ড, হাজারীবাগ ও কোতোয়ালিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে রাসায়নিকের অসংখ্য গুদাম।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, পুরান ঢাকায় দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের প্রায় ১৫ হাজার গুদাম আছে। নিমতলী ট্র্যাজেডির পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি ভবনের নিচের গুদামে রাখা রাসায়নিক সামগ্রী থেকে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে বলে জানিয়েছিল। একই সঙ্গে তারা পুরান ঢাকাকে ঝুঁকিমুক্ত করতে ১৭ দফা সুপারিশও করেছিল, যার মধ্যে ছিল রাসায়নিক কারখানা সরিয়ে নেওয়া, অনুমোদনহীন কারখানার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া, রাসায়নিক দ্রব্যের মজুদ, কেনাবেচা এবং লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই, বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করা। গত এক যুগেও রাসায়নিক ও প্লাস্টিক কারখানামুক্ত হয়নি পুরান ঢাকা। মাঝেমধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন অভিযান পরিচালনা করলেও কোনো ফল আসেনি। আবার মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানে প্লাস্টিক কারখানার জন্য আলাদা শিল্পনগরী গড়ে তোলার উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
সীতাকুন্ডের ঘটনার তদন্তে এটিইউ’র সিবিআরএন : এটিইউ’র আরেক কর্মকর্তা জানান, তাদের কেমিক্যাল, বায়োলজিক্যাল, রেডিওলজিক্যাল অ্যান্ড নিউক্লিয়ার টিমের দুই সদস্য গতকাল সোমবার ঢাকা থেকে সীতাকুণ্ডের দুর্ঘটনাস্থলে গেছেন। কী কী কারণে সেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, ব্যবস্থাপনার কী কী ঘাটতি ছিল, কীভাবে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের সঙ্গে অন্য কোনো অনুঘটক রাসায়নিক ছিল কি না, বাইরের কারও ইন্ধন আছে কি না সব বিষয়েই তদন্ত করা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সীতাকুণ্ডের বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো দিয়ে দেশে তৈরি হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের মতো দাহ্য পদার্থ রপ্তানির জন্য রাখা হয়েছিল। কিন্তু এই ধরনের পদার্থ সংরক্ষণের জন্য যেসব নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন ছিল তার কিছুই মানা হয়নি। এমনকি আগুনের সূত্রপাত নিয়েও সন্দেহ তৈরি হয়েছে। আবার সেই আগুন নেভাতে গিয়ে পানির ব্যবহার আরও আত্মঘাতী হয়েছে। যার কারণে এত প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
এটিইউ’র পুলিশ সুপার ও এক্সপ্লোসিভ বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সীতাকুণ্ডের বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোতে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিল, অন্যান্য সংস্থার পাশাপাশি এটিইউ’র কেমিক্যাল, বায়োলজিক্যাল, রেডিওলজিক্যাল ও নিউক্লিয়ার এক্সপার্ট টিমের দুই সদস্য তদন্ত শুরু করেছেন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিস্ফোরক পরিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা দেশ রপান্তরকে বলেন, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নিজে জ্বলে না। কিন্তু অন্যকে জ্বলতে সহায়তা করে। কন্টেইনার ডিপোতে প্রথমে গার্মেন্টস এক্সেসরিজে আগুন লেগেছিল বলে জানানো হয়। তারপর সেই অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভাতে পানি ব্যবহার করে। এতে সেখানে থাকা তরল হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড প্রায় দেড়শ সেন্টিগ্রেড তাপে বায়বীয় হতে থাকে। তারপর পানির সংস্পর্শে বিস্ফোরণ ঘটে। এটি ঘটেছে রাসায়নিকটির অসতর্কতামূলক মজুদের কারণেই।
বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক মো. নায়েব আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সীতাকুণ্ডের ঘটনাস্থলে আমাদের টিম কাজ করছে। কী কারণে এই ঘটনা ঘটেছে আমরা এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি। তবে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নামে যে দাহ্য পদার্থের কথা বলা হচ্ছে, সেটি আমাদের কার্যপরিধির তালিকাভুক্ত কোনো রাসায়নিক পদার্থ নয়। যার কারণে এটির লাইসেন্স প্রদানের বিষয়টি আমরা দেখি না।’
শেয়ার করুন
এস এম নূরুজ্জামান | ৭ জুন, ২০২২ ০০:০০

মাত্র কয়েক দিন আগেই নিমতলী ট্র্যাজেডির এক যুগ পূর্ণ হয়েছে। রাজধানীর পুরান ঢাকার নিমতলীতে ২০১০ সালের ৩ জুন রাসায়নিকের গুদাম থেকে লাগা আগুনে পুড়ে মারা যান ১২৪ জন। ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডের পর সরকারের পক্ষ থেকে পুরান ঢাকাকে রাসায়নিক কারখানা ও গুদামমুক্ত করার ঘোষণা আসে। তবে তা শুধু ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ থাকে, বাস্তবায়ন হয়নি এখনো। নিমতলীর আগুনের ৯ বছরের মাথায় ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আবারও একইভাবে রাসায়নিকের আগুন কেড়ে নেয় ৭৭ প্রাণ। আহত হন দুই শতাধিক মানুষ। নিমতলী ও চুড়িহাট্টার আগুনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি সরকারের আরও বেশ কয়েকটি সংস্থার পক্ষ থেকে আলাদাভাবে তদন্ত শেষে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। যেসব প্রতিবেদনে রাসায়নিকের মজুদ থেকে নতুন করে দুর্ঘটনারোধে করণীয় সম্পর্কে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়। যেসব সুপারিশ শুধু সরকারের নথিপত্রেই থেকে গেছে, বাস্তবে প্রয়োগ হয়নি। এরই মধ্যে দেশের মানুষ সাক্ষী হলো রাসায়নিকের মজুদ থেকে দুর্ঘটনার আরও এক বিভীষিকার। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোতে রপ্তানির জন্য মজুদ থাকা রাসায়নিকে আগুনের পর বিস্ফোরণে সরকারি হিসাবে এরই মধ্যে প্রাণ গেছে ৪১ জনের। আহত হয়েছেন কয়েকশ, যাদের মধ্যে অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক।
চুড়িহাট্টায় আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল ওয়াহেদ ম্যানশন নামে একটি ভবন থেকে। ওই ঘটনায় ভবনটির মালিকের দুই ছেলে মো. হাসান ও সোহেল ওরফে শহীদসহ ৮-১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলার এজাহারে বলা হয়, ওয়াহেদ ম্যানসন নামে চারতলা বাড়িটির বিভিন্ন তলায় দাহ্য পদার্থ রাখা ছিল। মানুষের জীবনের ঝুঁকি জেনেও অবৈধভাবে রাসায়নিকের গুদাম ভাড়া দিয়েছিলেন বাড়ির মালিকরা। পরবর্তী সময়ে চকবাজার থানা পুলিশ তদন্ত করে দুই ভাইসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়।
চুড়িহাট্টার আগে নিমতলীর ভয়াবহ আগুনের পর দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দাবি ওঠে। যদিও ওই ঘটনায় কোনো মামলা করা হয়নি। তবে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। অবশ্য সেই জিডির কথা এখন আর মনে নেই কোনো পুলিশ কর্মকর্তার। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বংশাল থানার ওসি আবুল খায়ের দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘১২ বছর আগের জিডি সম্পর্কে এখন কিছুই জানি না।’
আর চুড়িহাট্টার আগুনের তদন্ত প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের চকবাজার জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার কুদরত-ই খুদা বলেন, ‘চুড়িহাট্টার আগুনের ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে যা যা করার ছিলÑ সবই করা হয়েছে। মামলার তদন্ত করে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। অভিযুক্ত অধিকাংশ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিষয়টি এখন আদালতের এখতিয়ারে। এর বাইরে বিভিন্ন সংস্থার যেসব সুপারিশমালা রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের এখতিয়ার নেই পুলিশের। পুরান ঢাকাকে রাসায়নিকমুক্ত করার জন্য যেসব সংস্থার দায়িত্ব তাদের বিষয়ে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই।’
ফায়ার সার্ভিসের সাবেক উপ-পরিচালক (অপারেশন) দেবাশীষ বর্ধন দেশ রূপান্তরকে বলেন, নিমতলী ও চুড়িহাট্টার আগুনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বিস্তারিত তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। এছাড়া শিল্প মন্ত্রণালয় ও ঢাকা জেলা প্রশাসন থেকেও পৃথক পৃথক তদন্ত প্রতিবেদন জমা হয়। তদন্ত করে বিস্ফোরক পরিদপ্তরও। সবগুলো প্রতিবেদনেই নগরবাসীর জীবনের ঝুঁকি কমানোর জন্য আবাসিক এলাকা থেকে সব ধরনের রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। এরপর কিছুদিন সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা অভিযান চালিয়ে রাসায়নিক অপসারণ ও জব্দ করে। তারপর এলাকার বাসিন্দাদের আপত্তির মুখে এক পর্যায়ে অভিযান বন্ধ হয়ে যায়।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, চুড়িহাট্টা ও এর আশপাশের এলাকায় বহাল তবিয়তেই ব্যবসা করে যাচ্ছেন রাসায়নিক ব্যবসায়ীরা। আবাসিক ভবনগুলোর ঘরে ঘরেই রাসায়নিক গুদাম, দোকান ও কারখানা গড়ে তুলছেন। তাদের শঙ্কা, আবারও যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নিমতলী ও চুড়িহাট্টার ট্র্যাজেডি থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটা কেউই নেয়নি। এমনকি সীতাকুণ্ডের কন্টেইনার ডিপোর মতো গুরুত্বপর্ণ স্থাপনায় দাহ্য পদার্থ এত অপরিপক্বভাবে হ্যান্ডেলিং করা হয়েছে যে তাতে বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের রাসায়নিক বিস্ফোরণে মানুষের হতাহতের বাইরে দেশের বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে। ঘটনাটি স্যাবোটাজ কি না সে বিষয়েও তদন্ত শুরু হয়েছে। সীতাকুণ্ডের ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে আমদানি-রপ্তানি দেখভালকারী যত প্রতিষ্ঠান সম্পৃক্ত ছিল, তাদের প্রত্যেকেরই অপেশাদারিত্বের বিষয়টি ধরা পড়েছে। ইতিমধ্যে আগুনের উৎস থেকে শুরু করে রাসায়নিক বিস্ফোরণের প্রত্যেকটি বিষয় নিবিড়ভাবে তদন্ত করা হচ্ছে।’
পুরান ঢাকায় রাসায়নিক গুদামে বারবার আগুন লাগার পর বিভিন্ন সরকারি সংস্থা তদন্ত করে। তাদের প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী রাসায়নিক ব্যবসার ১ হাজার ৯২৪টি পাইকারি ও খুচরা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। পুরান ঢাকার চকবাজার, লালবাগ, আরমানিটোলা, ইমামগঞ্জ, ইসলামবাগ, মিটফোর্ড, হাজারীবাগ ও কোতোয়ালিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে রাসায়নিকের অসংখ্য গুদাম।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, পুরান ঢাকায় দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের প্রায় ১৫ হাজার গুদাম আছে। নিমতলী ট্র্যাজেডির পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি ভবনের নিচের গুদামে রাখা রাসায়নিক সামগ্রী থেকে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে বলে জানিয়েছিল। একই সঙ্গে তারা পুরান ঢাকাকে ঝুঁকিমুক্ত করতে ১৭ দফা সুপারিশও করেছিল, যার মধ্যে ছিল রাসায়নিক কারখানা সরিয়ে নেওয়া, অনুমোদনহীন কারখানার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া, রাসায়নিক দ্রব্যের মজুদ, কেনাবেচা এবং লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই, বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করা। গত এক যুগেও রাসায়নিক ও প্লাস্টিক কারখানামুক্ত হয়নি পুরান ঢাকা। মাঝেমধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন অভিযান পরিচালনা করলেও কোনো ফল আসেনি। আবার মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানে প্লাস্টিক কারখানার জন্য আলাদা শিল্পনগরী গড়ে তোলার উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
সীতাকুন্ডের ঘটনার তদন্তে এটিইউ’র সিবিআরএন : এটিইউ’র আরেক কর্মকর্তা জানান, তাদের কেমিক্যাল, বায়োলজিক্যাল, রেডিওলজিক্যাল অ্যান্ড নিউক্লিয়ার টিমের দুই সদস্য গতকাল সোমবার ঢাকা থেকে সীতাকুণ্ডের দুর্ঘটনাস্থলে গেছেন। কী কী কারণে সেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, ব্যবস্থাপনার কী কী ঘাটতি ছিল, কীভাবে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের সঙ্গে অন্য কোনো অনুঘটক রাসায়নিক ছিল কি না, বাইরের কারও ইন্ধন আছে কি না সব বিষয়েই তদন্ত করা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সীতাকুণ্ডের বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো দিয়ে দেশে তৈরি হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের মতো দাহ্য পদার্থ রপ্তানির জন্য রাখা হয়েছিল। কিন্তু এই ধরনের পদার্থ সংরক্ষণের জন্য যেসব নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন ছিল তার কিছুই মানা হয়নি। এমনকি আগুনের সূত্রপাত নিয়েও সন্দেহ তৈরি হয়েছে। আবার সেই আগুন নেভাতে গিয়ে পানির ব্যবহার আরও আত্মঘাতী হয়েছে। যার কারণে এত প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
এটিইউ’র পুলিশ সুপার ও এক্সপ্লোসিভ বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সীতাকুণ্ডের বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোতে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিল, অন্যান্য সংস্থার পাশাপাশি এটিইউ’র কেমিক্যাল, বায়োলজিক্যাল, রেডিওলজিক্যাল ও নিউক্লিয়ার এক্সপার্ট টিমের দুই সদস্য তদন্ত শুরু করেছেন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিস্ফোরক পরিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা দেশ রপান্তরকে বলেন, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নিজে জ্বলে না। কিন্তু অন্যকে জ্বলতে সহায়তা করে। কন্টেইনার ডিপোতে প্রথমে গার্মেন্টস এক্সেসরিজে আগুন লেগেছিল বলে জানানো হয়। তারপর সেই অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভাতে পানি ব্যবহার করে। এতে সেখানে থাকা তরল হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড প্রায় দেড়শ সেন্টিগ্রেড তাপে বায়বীয় হতে থাকে। তারপর পানির সংস্পর্শে বিস্ফোরণ ঘটে। এটি ঘটেছে রাসায়নিকটির অসতর্কতামূলক মজুদের কারণেই।
বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক মো. নায়েব আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সীতাকুণ্ডের ঘটনাস্থলে আমাদের টিম কাজ করছে। কী কারণে এই ঘটনা ঘটেছে আমরা এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি। তবে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নামে যে দাহ্য পদার্থের কথা বলা হচ্ছে, সেটি আমাদের কার্যপরিধির তালিকাভুক্ত কোনো রাসায়নিক পদার্থ নয়। যার কারণে এটির লাইসেন্স প্রদানের বিষয়টি আমরা দেখি না।’