আশাই এখন ভেলা
জফির সেতু | ২৩ জুন, ২০২২ ০০:০০
মানুষ খুব খুশি হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিলেটে আসার খবর পেয়ে। প্রধানমন্ত্রী মহাপ্লাবনের গুরুত্ব অনুধাবন করেই তাৎক্ষণিক এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু জেলাপ্রশাসনের উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রীর মতবিনিময় অনুষ্ঠানটিকে দলীয় নেতাকর্মী ও প্রশাসনের লোকেরা জননেত্রীর আগমনের মূল কারণ থেকে দূরে নিয়ে গিয়েছিলেন। অন্তত আমার তা-ই মনে হয়েছে। সরকারি দলের নেতাকর্মীরা নিজেদের কাজের ফিরিস্তি দিয়েছেন, নিজেদের কষ্টের কথা বলেছেন; দায়িত্বশীল কোনো বক্তব্য দিতে পারেননি। বন্যা পরিস্থিতিটা কেমন ছিল, দুর্যোগের ভয়াবহতা কতটুকু ছিল, মানুষের ক্ষয়ক্ষতিটাই-বা কেমন ছিল এটা নিয়ে তেমন কথা বলেননি। অনেকে অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে প্রধানমন্ত্রীর মূল্যবান সময় নষ্ট করেছেন, যদিও তিনি বারবার তাড়া দিয়েছিলেন মূল বক্তব্য সংক্ষেপে প্রকাশ করার জন্য। প্রশাসন থেকেও ওইরকম কোনো পরিসংসখ্যান তুলে ধরা হয়নি, কাজের পরিকল্পনা কিংবা পরিস্থিতি মোকাবিলায় পরবর্তী পদক্ষেপগুলো কেমন হবে তাও তুলে ধরেননি কর্মকর্তারা। দুর্যোগের সূচনা থেকেই সাধারণ মানুষ নিজ উদ্যোগে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা সামাজিক সংগঠন; যুক্ত হয়েছেন এনজিওকর্মীরা। এখনো আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন অনেকে। তাদের এই সময়োপযোগী সাহায্য-সহযোগিতার স্বীকৃতিও দেননি কেউ। আমি শুরু থেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে বলে আসছি, এ ধরনের দুর্যোগ সরকার একার পক্ষে মোকাবিলা করতে পারে না। সবাই মিলেই একটা মূল লক্ষ্যে এগোতে হয়, এগোয়ও।
সরকারি দলের এক নেতা বন্যার স্থায়ী সমাধানের কথা বলেছেন; প্রধানমন্ত্রী নিজেও বন্যার কারণ পর্যবেক্ষণ করেছেন। স্থায়ী সমাধানের কথা ভাবছেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু সিলেটের অপরাপর নেতাকর্মীর বক্তব্য থেকে কীভাবে স্থায়ী সমাধান করা সম্ভব তার রূপরেখা দিয়ে দাবি তোলেননি কেউ। এ মহাদুর্যোগকে উপলক্ষ করে প্রধানমন্ত্রী যেখানে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে সিলেটে এসেছেন। এ সুযোগে সুরমা-কুশিয়ারা-পিয়াইন-ধলাই-মনু-কালনী নদীর খননকে নিশ্চিত করে মজে-যাওয়া নদীর গভীরতা বাড়ানোর প্রকল্পও আদায় করা সম্ভব ছিল। এছাড়া হাওর অঞ্চলে বছরে একাধিক বন্যার মোকাবিলা এবং প্রতি বছর লাখ লাখ টন ফসলরক্ষার বিষয়টা তুলেও সিলেট-সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের মানুষের জীবনকে সুনিশ্চিতের বিষয়টিও প্রধানমন্ত্রীর গোচরে আনা যেত। সব মিলিয়ে মহাপ্লাবনে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সিলেট আগমনের মতো আবেগের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো সিলেটের মানুষ। যদিও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণের আভাস রয়েছে। হয়তো তিনি তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন একে একে। সেটা হোক প্রত্যাশা করি।
এখন বন্যা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে আসি। বন্যার পানি চলে যাচ্ছে। আজও আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ কমেছে। বিভিন্ন গ্রামে আজও আমি ঘুরেছি। আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছি। অনেকের সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যে জিনিসটা আমি বুঝতে পারছি; পানি কমার সঙ্গে, ঘরের ফেরার সঙ্গে সংকটও বাড়ছে। যেমন রাজাপুরের রাজিয়া বেগমের ৩০০ হাঁস মারা গেছে; একই বাড়ির এক মহিলার ১৭টি মোরগ-মুরগি মরে গেছে। বেতমুড়ার একজন বললেন তার মাছ ধরার জাল পানিতে ভেসে গেছে। তো টাকা উপার্জনের উপায়ই যদি না থাকে তাহলে লোকে কী করবে? এছাড়া গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের ঘরের বেহাল অবস্থা; বোরো ধান পানিতে ডুবে গিয়েছিল বলে ঘরেও খাবার নেই। কোম্পানীগঞ্জে পাথর কুয়ারি খোলা নেই বলে শ্রমিকরা বেকার হয়ে বসেছিল আগে থেকেই। কভিড পরিস্থিতিতে অনেক প্রবাসী দেশে চলে এসেছেন। ফলে প্রবাসনির্ভর রোজগারও নেই। তাই দুরবস্থার একশেষ সর্বত্রই বলা যায়। ভয়াবহ বন্যা মানুষকে যেন একেবারে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছে। সুতরাং এসব বিষয় সঠিকভাবে উপস্থাপন করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে থেকে বড় ধরনের বরাদ্দ কিংবা প্রতিজ্ঞা আদায় করা ছিল সময়ের দাবি। সেটা হয়নি বলে মানুষকে হতাশ বলেই মনে হয়েছে। কেননা তারা ভেবেছিল প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিতই ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় কিছু একটা ঘোষণা করবেন। আর সিলেটের নেতারা তা আদায় করে নেবেনই! তা তো হলো না। মানুষের আশঙ্কা তাদের কপালে বুঝি দুর্ভোগই রয়েছে। কিন্তু মানুষ ভরসা করে জননেত্রীর ওপর। আর ভরসা করে বলেই এ মহাদুর্যোগের পরও আশায় বুক বেঁধে আছে সবাই। আশাই এখন ভেলা।
শেয়ার করুন
জফির সেতু | ২৩ জুন, ২০২২ ০০:০০

মানুষ খুব খুশি হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিলেটে আসার খবর পেয়ে। প্রধানমন্ত্রী মহাপ্লাবনের গুরুত্ব অনুধাবন করেই তাৎক্ষণিক এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু জেলাপ্রশাসনের উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রীর মতবিনিময় অনুষ্ঠানটিকে দলীয় নেতাকর্মী ও প্রশাসনের লোকেরা জননেত্রীর আগমনের মূল কারণ থেকে দূরে নিয়ে গিয়েছিলেন। অন্তত আমার তা-ই মনে হয়েছে। সরকারি দলের নেতাকর্মীরা নিজেদের কাজের ফিরিস্তি দিয়েছেন, নিজেদের কষ্টের কথা বলেছেন; দায়িত্বশীল কোনো বক্তব্য দিতে পারেননি। বন্যা পরিস্থিতিটা কেমন ছিল, দুর্যোগের ভয়াবহতা কতটুকু ছিল, মানুষের ক্ষয়ক্ষতিটাই-বা কেমন ছিল এটা নিয়ে তেমন কথা বলেননি। অনেকে অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে প্রধানমন্ত্রীর মূল্যবান সময় নষ্ট করেছেন, যদিও তিনি বারবার তাড়া দিয়েছিলেন মূল বক্তব্য সংক্ষেপে প্রকাশ করার জন্য। প্রশাসন থেকেও ওইরকম কোনো পরিসংসখ্যান তুলে ধরা হয়নি, কাজের পরিকল্পনা কিংবা পরিস্থিতি মোকাবিলায় পরবর্তী পদক্ষেপগুলো কেমন হবে তাও তুলে ধরেননি কর্মকর্তারা। দুর্যোগের সূচনা থেকেই সাধারণ মানুষ নিজ উদ্যোগে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা সামাজিক সংগঠন; যুক্ত হয়েছেন এনজিওকর্মীরা। এখনো আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন অনেকে। তাদের এই সময়োপযোগী সাহায্য-সহযোগিতার স্বীকৃতিও দেননি কেউ। আমি শুরু থেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে বলে আসছি, এ ধরনের দুর্যোগ সরকার একার পক্ষে মোকাবিলা করতে পারে না। সবাই মিলেই একটা মূল লক্ষ্যে এগোতে হয়, এগোয়ও।
সরকারি দলের এক নেতা বন্যার স্থায়ী সমাধানের কথা বলেছেন; প্রধানমন্ত্রী নিজেও বন্যার কারণ পর্যবেক্ষণ করেছেন। স্থায়ী সমাধানের কথা ভাবছেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু সিলেটের অপরাপর নেতাকর্মীর বক্তব্য থেকে কীভাবে স্থায়ী সমাধান করা সম্ভব তার রূপরেখা দিয়ে দাবি তোলেননি কেউ। এ মহাদুর্যোগকে উপলক্ষ করে প্রধানমন্ত্রী যেখানে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে সিলেটে এসেছেন। এ সুযোগে সুরমা-কুশিয়ারা-পিয়াইন-ধলাই-মনু-কালনী নদীর খননকে নিশ্চিত করে মজে-যাওয়া নদীর গভীরতা বাড়ানোর প্রকল্পও আদায় করা সম্ভব ছিল। এছাড়া হাওর অঞ্চলে বছরে একাধিক বন্যার মোকাবিলা এবং প্রতি বছর লাখ লাখ টন ফসলরক্ষার বিষয়টা তুলেও সিলেট-সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের মানুষের জীবনকে সুনিশ্চিতের বিষয়টিও প্রধানমন্ত্রীর গোচরে আনা যেত। সব মিলিয়ে মহাপ্লাবনে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সিলেট আগমনের মতো আবেগের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো সিলেটের মানুষ। যদিও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণের আভাস রয়েছে। হয়তো তিনি তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন একে একে। সেটা হোক প্রত্যাশা করি।
এখন বন্যা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে আসি। বন্যার পানি চলে যাচ্ছে। আজও আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ কমেছে। বিভিন্ন গ্রামে আজও আমি ঘুরেছি। আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছি। অনেকের সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যে জিনিসটা আমি বুঝতে পারছি; পানি কমার সঙ্গে, ঘরের ফেরার সঙ্গে সংকটও বাড়ছে। যেমন রাজাপুরের রাজিয়া বেগমের ৩০০ হাঁস মারা গেছে; একই বাড়ির এক মহিলার ১৭টি মোরগ-মুরগি মরে গেছে। বেতমুড়ার একজন বললেন তার মাছ ধরার জাল পানিতে ভেসে গেছে। তো টাকা উপার্জনের উপায়ই যদি না থাকে তাহলে লোকে কী করবে? এছাড়া গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের ঘরের বেহাল অবস্থা; বোরো ধান পানিতে ডুবে গিয়েছিল বলে ঘরেও খাবার নেই। কোম্পানীগঞ্জে পাথর কুয়ারি খোলা নেই বলে শ্রমিকরা বেকার হয়ে বসেছিল আগে থেকেই। কভিড পরিস্থিতিতে অনেক প্রবাসী দেশে চলে এসেছেন। ফলে প্রবাসনির্ভর রোজগারও নেই। তাই দুরবস্থার একশেষ সর্বত্রই বলা যায়। ভয়াবহ বন্যা মানুষকে যেন একেবারে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছে। সুতরাং এসব বিষয় সঠিকভাবে উপস্থাপন করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে থেকে বড় ধরনের বরাদ্দ কিংবা প্রতিজ্ঞা আদায় করা ছিল সময়ের দাবি। সেটা হয়নি বলে মানুষকে হতাশ বলেই মনে হয়েছে। কেননা তারা ভেবেছিল প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিতই ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় কিছু একটা ঘোষণা করবেন। আর সিলেটের নেতারা তা আদায় করে নেবেনই! তা তো হলো না। মানুষের আশঙ্কা তাদের কপালে বুঝি দুর্ভোগই রয়েছে। কিন্তু মানুষ ভরসা করে জননেত্রীর ওপর। আর ভরসা করে বলেই এ মহাদুর্যোগের পরও আশায় বুক বেঁধে আছে সবাই। আশাই এখন ভেলা।