৭ দিন ধরে ভাসছে বাক্সবন্দি মরদেহ
মৃত্যু বেড়ে ৪২
এ আর জুয়েল, সুনামগঞ্জ | ২৩ জুন, ২০২২ ০০:০০
বানের জলে ভাসছে পুরো সুনামগঞ্জ। ডুবেছে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি। বানভাসিরা গেল এক সপ্তাহ ধরে কোনোমতে টিকে আছেন নৌকা, ঘরের চাল কিংবা আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়ে। কিন্তু এর মধ্যে যারা মারা গেছেন তাদের আশ্রয় হচ্ছে না কোথায়ও। শুকনো মাটির অভাবে হচ্ছে না দাফন ও সৎকার। বন্যায় মারা যাওয়া সুনামগঞ্জের ইব্রাহিমপুরে দুইজনের মরদেহ সাত দিন ধরে বাক্সবন্দি করে ঝুলিয়ে রেখেছেন স্বজনরা। প্রিয়জনের মরদেহ দাফনের জন্য হন্যে হয়ে খুঁজছেন একটু উঁচু জমি।
সুনামগঞ্জ শহরতলির ইব্রাহিমপুর গ্রামেই দুটি মরদেহ আছে দাফনের অপেক্ষায়। এর মধ্যে আশরাফ আলী নামের একজন মারা যান গত শুক্রবার। আর বন্যার পানিতে ডুবে মারা যাওয়া সাজুল মিয়া নামের আরেকজনের মরদেহও সেদিন থেকে আছে দাফনের অপেক্ষায়।
আশরাফ আলীর ছেলে ইব্রাহিম মিয়া জানান, তার বাবা মারা গেছেন গত শুক্রবার রাত ১২টায়। কবরস্থান ডুবে থাকায় পাঁচ দিন ধরে মরদেহ পড়ে আছে। দাফন করার জায়গা নেই। জেলার সর্বত্র বন্যার পানি থাকায় নিজের বাবার লাশ দাফন করতে পারেননি ইব্রাহিম মিয়া।
হাওর এলাকায় বন্যার সময় সাধারণত মরদেহ দাফন করতে না পারলে পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু নিজের বাবার লাশ বন্যার পানিতে ভাসিয়ে দেওয়ার সাহস হয়নি ইব্রাহিমের। তাই পলিথিন মুড়িয়ে বাক্সবন্দি করে বাঁশের ওপর বেঁধে রেখেছেন বাবার মরদেহ। একই জায়গাতে আরও একটি মরদেহ পড়ে আছে। সেটি একই গ্রামের মিনা বেগমের বাবা সাজুল মিয়ার। মিনা বেগমের বাবাও গেল শুক্রবার ঢাকা থেকে ফেরার পথে পানিতে পড়ে মারা যান। তার লাশটাও বাক্সবন্দি অবস্থায় ভাসছে পানিতে।
মিনা বেগম বলেন, বাবারে কবর দেওয়ার জন্য এক টুকরো শুকনো মাঠির জন্য কত জায়গায় ঘুরেছি। বাবারে দাফন করতে পারিনি। এখন পানি কমার অপেক্ষা।
এলাকাবাসী জানায়, বন্যার সময় কবরস্থান পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মরদেহ দাফন করা যায় না। তাই হাওর এলাকার কবরস্থানগুলো উঁচু করার উদ্যোগ নেওয়া খুব জরুরি।
সুরমা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বলেন, কবরস্থানের পাশে মরদেহ দাফন না করে ফেলে রাখা হয়েছে। এটা খুবই অমানবিক। সরকার উদ্যোগ নিয়ে কবরস্থানগুলো উঁচু করলে বর্ষায় মরদেহ দাফন করা নিয়ে সমস্যায় পড়তে হবে না।
সারা সুনামগঞ্জ জেলা ছয় দিন ধরে ডুবে আছে থৈথৈ পানির নিচে। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, বাজার এমনকি উঁচু কবরস্থানও পানির নিচে ডুবে আছে। পা ফেলার এতটুকু শুকনো জায়গা নেই। মানুষের বাড়িঘরে গলা পর্যন্ত পানি। সাজুল মিয়ার মেয়ে মিনা বেগম ও ইব্রাহিম মিয়ার মতো করুণ এমন গল্প সারা জেলাতেই। কেউ স্বজনের লাশ খুঁজছেন, কেউ পাচ্ছেন কেউবা মরদেহ পেলেও দাফন করতে পারছেন না।
দেশে বন্যায় মৃত্যু বেড়ে ৪২ : দেশের ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, রংপুর ও সিলেট বিভাগের ১৮৫টি উপজেলার মধ্যে ৬১টি উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। বন্যাদুর্গত এসব এলাকায় ডায়রিয়া, সাপের কামড়, পানিতে ডুবে, ভূমিধসে এবং নানা আঘাতজনিত কারণে ৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। বন্যায় মৃতদের মধ্যে সিলেট বিভাগে ২১ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ১৮ জন এবং রংপুর বিভাগে মারা গেছেন ১৮ জন। এসব উপজেলায় পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৪০৩ জন।
গতকাল বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে এ তথ্য জানানো হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাব অনুযায়ী, পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ৩ হাজার ৪০৩ জনের মধ্যে ডায়রিয়ায় ২ হাজার ৫১৬ জন, শ্বাসনালির প্রদাহজনিত রোগ রেসপেরেটরি ট্রাক ইনফেকশনে (আরটিআই) ১০৩ জন, বজ্রপাতে ১৩ জন, সাপের কামড়ে ৪ জন, পানিতে ডোবায় ২৩ জন, চর্মরোগে ১৬৩ জন, চোখের প্রদাহে ৬১ জন, অন্যান্য আঘাতে ৩৯ জন। এছাড়া অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৮১ জন। এছাড়া বজ্রপাতে ১২ জন, সাপের কামড়ে ১ জন, পানিতে ডোবায় ২৩ জন এবং অন্যান্য আঘাতে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ ডা. মো. জাহিদুল ইসলাম জানান, সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতিতে গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩৩৭ জন, আরটিআইতে ১৬, পানিতে ডুবে ৪ জন, চর্মরোগে ২৩ জন, চোখের প্রদাহে ১৫ জন, অন্যান্যভাবে আঘাত পেয়েছেন ১৪ জন এবং অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ৬০ জন। এসব নিয়ে ২৪ ঘণ্টায় মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৪৬৯ জন। এছাড়া একই সময়ে পানিতে ডুবে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
তিনি জানান, বন্যাদুর্গত ৬৩ উপজেলার ৪২১টি ইউনিয়নে ১ হাজার ৯৭৬টি মেডিকেল টিম কাজ করছে।
শেয়ার করুন
মৃত্যু বেড়ে ৪২
এ আর জুয়েল, সুনামগঞ্জ | ২৩ জুন, ২০২২ ০০:০০

বানের জলে ভাসছে পুরো সুনামগঞ্জ। ডুবেছে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি। বানভাসিরা গেল এক সপ্তাহ ধরে কোনোমতে টিকে আছেন নৌকা, ঘরের চাল কিংবা আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়ে। কিন্তু এর মধ্যে যারা মারা গেছেন তাদের আশ্রয় হচ্ছে না কোথায়ও। শুকনো মাটির অভাবে হচ্ছে না দাফন ও সৎকার। বন্যায় মারা যাওয়া সুনামগঞ্জের ইব্রাহিমপুরে দুইজনের মরদেহ সাত দিন ধরে বাক্সবন্দি করে ঝুলিয়ে রেখেছেন স্বজনরা। প্রিয়জনের মরদেহ দাফনের জন্য হন্যে হয়ে খুঁজছেন একটু উঁচু জমি।
সুনামগঞ্জ শহরতলির ইব্রাহিমপুর গ্রামেই দুটি মরদেহ আছে দাফনের অপেক্ষায়। এর মধ্যে আশরাফ আলী নামের একজন মারা যান গত শুক্রবার। আর বন্যার পানিতে ডুবে মারা যাওয়া সাজুল মিয়া নামের আরেকজনের মরদেহও সেদিন থেকে আছে দাফনের অপেক্ষায়।
আশরাফ আলীর ছেলে ইব্রাহিম মিয়া জানান, তার বাবা মারা গেছেন গত শুক্রবার রাত ১২টায়। কবরস্থান ডুবে থাকায় পাঁচ দিন ধরে মরদেহ পড়ে আছে। দাফন করার জায়গা নেই। জেলার সর্বত্র বন্যার পানি থাকায় নিজের বাবার লাশ দাফন করতে পারেননি ইব্রাহিম মিয়া।
হাওর এলাকায় বন্যার সময় সাধারণত মরদেহ দাফন করতে না পারলে পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু নিজের বাবার লাশ বন্যার পানিতে ভাসিয়ে দেওয়ার সাহস হয়নি ইব্রাহিমের। তাই পলিথিন মুড়িয়ে বাক্সবন্দি করে বাঁশের ওপর বেঁধে রেখেছেন বাবার মরদেহ। একই জায়গাতে আরও একটি মরদেহ পড়ে আছে। সেটি একই গ্রামের মিনা বেগমের বাবা সাজুল মিয়ার। মিনা বেগমের বাবাও গেল শুক্রবার ঢাকা থেকে ফেরার পথে পানিতে পড়ে মারা যান। তার লাশটাও বাক্সবন্দি অবস্থায় ভাসছে পানিতে।
মিনা বেগম বলেন, বাবারে কবর দেওয়ার জন্য এক টুকরো শুকনো মাঠির জন্য কত জায়গায় ঘুরেছি। বাবারে দাফন করতে পারিনি। এখন পানি কমার অপেক্ষা।
এলাকাবাসী জানায়, বন্যার সময় কবরস্থান পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মরদেহ দাফন করা যায় না। তাই হাওর এলাকার কবরস্থানগুলো উঁচু করার উদ্যোগ নেওয়া খুব জরুরি।
সুরমা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বলেন, কবরস্থানের পাশে মরদেহ দাফন না করে ফেলে রাখা হয়েছে। এটা খুবই অমানবিক। সরকার উদ্যোগ নিয়ে কবরস্থানগুলো উঁচু করলে বর্ষায় মরদেহ দাফন করা নিয়ে সমস্যায় পড়তে হবে না।
সারা সুনামগঞ্জ জেলা ছয় দিন ধরে ডুবে আছে থৈথৈ পানির নিচে। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, বাজার এমনকি উঁচু কবরস্থানও পানির নিচে ডুবে আছে। পা ফেলার এতটুকু শুকনো জায়গা নেই। মানুষের বাড়িঘরে গলা পর্যন্ত পানি। সাজুল মিয়ার মেয়ে মিনা বেগম ও ইব্রাহিম মিয়ার মতো করুণ এমন গল্প সারা জেলাতেই। কেউ স্বজনের লাশ খুঁজছেন, কেউ পাচ্ছেন কেউবা মরদেহ পেলেও দাফন করতে পারছেন না।
দেশে বন্যায় মৃত্যু বেড়ে ৪২ : দেশের ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, রংপুর ও সিলেট বিভাগের ১৮৫টি উপজেলার মধ্যে ৬১টি উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। বন্যাদুর্গত এসব এলাকায় ডায়রিয়া, সাপের কামড়, পানিতে ডুবে, ভূমিধসে এবং নানা আঘাতজনিত কারণে ৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। বন্যায় মৃতদের মধ্যে সিলেট বিভাগে ২১ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ১৮ জন এবং রংপুর বিভাগে মারা গেছেন ১৮ জন। এসব উপজেলায় পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৪০৩ জন।
গতকাল বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে এ তথ্য জানানো হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাব অনুযায়ী, পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ৩ হাজার ৪০৩ জনের মধ্যে ডায়রিয়ায় ২ হাজার ৫১৬ জন, শ্বাসনালির প্রদাহজনিত রোগ রেসপেরেটরি ট্রাক ইনফেকশনে (আরটিআই) ১০৩ জন, বজ্রপাতে ১৩ জন, সাপের কামড়ে ৪ জন, পানিতে ডোবায় ২৩ জন, চর্মরোগে ১৬৩ জন, চোখের প্রদাহে ৬১ জন, অন্যান্য আঘাতে ৩৯ জন। এছাড়া অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৮১ জন। এছাড়া বজ্রপাতে ১২ জন, সাপের কামড়ে ১ জন, পানিতে ডোবায় ২৩ জন এবং অন্যান্য আঘাতে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ ডা. মো. জাহিদুল ইসলাম জানান, সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতিতে গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩৩৭ জন, আরটিআইতে ১৬, পানিতে ডুবে ৪ জন, চর্মরোগে ২৩ জন, চোখের প্রদাহে ১৫ জন, অন্যান্যভাবে আঘাত পেয়েছেন ১৪ জন এবং অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ৬০ জন। এসব নিয়ে ২৪ ঘণ্টায় মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৪৬৯ জন। এছাড়া একই সময়ে পানিতে ডুবে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
তিনি জানান, বন্যাদুর্গত ৬৩ উপজেলার ৪২১টি ইউনিয়নে ১ হাজার ৯৭৬টি মেডিকেল টিম কাজ করছে।