যত দোষ ‘সুইপার’ ঘোষ
আশরাফুল হক | ২ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০
পাইলটের সিটে ছিলেন এয়ারক্রাফট তদারককারী অফিসার নিজেই। এয়ারক্রাফটের বাইরে ডান দিকের ডানার কাছ থেকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন একজন সুইপার। বাঁদিকে নির্দেশনা দেওয়ার জন্য ফোন করে ডেকে আনা হয় তুলনামূলকভাবে এক ছোট এয়ারক্রাফটের দায়িত্বে থাকা অফিসারকে যার বড় এয়ারক্রাফট তদারকির কোনো অভিজ্ঞতাই নেই।
একটা এয়ারক্রাফট কতটা জায়গা নিয়ে ঘুরবে তা পুরোটাই গাণিতিক মাপজোকের বিষয়। একজন সুইপার বা অফিসারের তা বোঝার কথা নয়। এতে ফল যা হওয়ার তাই হলো। অদক্ষ ও অপেশাদারদের হাতে পড়ে এয়ারক্রাফটটি হ্যাঙ্গারে প্রবেশের আগে ধাক্কা দিল দাঁড়িয়ে থাকা (পার্কিং করা) অন্য এয়ারক্রাফটকে। দুই এয়ারক্রাফটেরই ক্ষতি হলো। ক্ষতির পরিমাণ ৫৬ লাখ টাকা হয়তো ২ হাজার কোটি টাকার এয়ারক্রাফটের জন্য কিছুই না, কিন্তু এতে বেরিয়ে পড়ল বিমানের অব্যবস্থাপনা কতদূর গড়িয়েছে। এর কিছুদিন আগেও একইভাবে দুই এয়ারক্রাফটের ঠোকাঠুকি হয়েছে।
এখানেই শেষ নয়, কাহিনী কেবল শুরু। ঠোকাঠুকির পর তোলপাড় সৃষ্টি হলো। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ঘিরে রাখল এয়ারক্রাফট। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী ছুটে গেলেন ক্ষতির পরিমাণ দেখতে। মন্ত্রিসভা বৈঠক থেকে প্রধানমন্ত্রীর কড়া অবস্থানের কথা জানিয়ে দেওয়া হলো।
এখন পরিস্থিতি সামাল দিতে তৎপর হচ্ছে বিমানের একটি প্রভাবশালী মহল। তারা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য সুইপার শুপ্রহ মল্লিককে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাচ্ছে। যারা শুপ্রহকে এ কাজে লাগিয়েছে তাদের বাঁচার পথ করে দিচ্ছে।
শুপ্রহ মল্লিক বিমানের কোনো স্থায়ী কর্মী নন। অস্থায়ীভাবে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে বিমানের এয়ারক্রাফট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেন। শুপ্রহ বিমানে যোগ দিয়েছেন ২০১৮ সালের ৬ জুন। তিনি ছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যাটারিয়াল ম্যানেজমেন্টের অধীনে। সেখান থেকে তাকে এয়ারক্রাফট পরিষ্কারের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
শুপ্রহকে দায়ী করেছেন বিমানের প্রধান প্রকৌশলী এ আর এম কায়সার জামান ও উপপ্রধান প্রকৌশলী রাবিউল আমিন। ঠোকাঠুকির জন্য দায়ী অন্য কর্মকর্তারাও নিজেরা বেঁচে যাওয়ার জন্য তাকেই টার্গেট করেছেন। এ কারণে যথাযথ তদন্ত হওয়ার আগেই শুপ্রহকে বলির পাঁঠা বানানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে দায়ী করে তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করার অভিযোগ উঠেছে।
তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই উপপ্রধান প্রকৌশলী রাবিউল আমিন এক চিঠিতে শুপ্রহকে চাকরি থেকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করে প্রধান প্রকৌশলীকে ফাইল পাঠান। সেখানে উপপ্রধান প্রকৌশলী শুপ্রহর বিরুদ্ধে নানা দিক থেকে তার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন না করার অভিযোগ তোলেন। তার কয়েক দিন পরই প্রকৌশলীদ্বয় শুপ্রহর বিরুদ্ধে জবানবন্দি দেন তদন্ত কমিটির সামনে।
গত ২৫ জুলাই মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমানের এয়ারক্রাফট দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করতে ভালোভাবে তদন্ত করার নির্দেশ দেন। তিনি সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেন। এ নির্দেশনা দেওয়ার পর কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় তা নিয়ে দফায় দফায় সভা করছে বিমান ব্যবস্থাপনা।
গত ৩ জুলাই রাত সোয়া ৯টায় বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গার এলাকায় আগে থেকেই পার্ক করা ৭৩৭-৮০০ মডেলের এয়ারক্রাফটের সঙ্গে ধাক্কা লাগে বিমানের বোয়িং ৭৮৭-৮ এয়ারক্রাফটের। এতে ৭৩৭-৮০০-এর বাঁদিকের এবং ৭৮৭-৮-এর ডানদিকের ডানার নিচের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ঘটনার দিন ৭৮৭-৮ এয়ারক্রাফটটি সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করে। পরবর্তী কোনো ফ্লাইট না থাকায় এয়ারক্রাফটটি হ্যাঙ্গারে রাখার নির্দেশ দেন মুখ্য প্রকৌশলী (শিফট ইনচার্জ) হারুন অর রশীদ। ‘বি’ শিফটের দায়িত্বরত প্রকৌশলী শাহ হক নাওয়াজ এয়ারক্রাফটটি হ্যাঙ্গারে পার্ক করতে যান। এয়ারক্রাফটটি টো (ইঞ্জিন বন্ধ টেনে নেওয়া) করে হ্যাঙ্গারে নিয়ে আসার সময় পার্ক করা এয়ারক্রাফটের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। এয়ারক্রাফটটি টো করার সময় ককপিটে ছিলেন শাহ হক নাওয়াজ, টোয়িংয়ে ছিলেন খসরু পারভেজ ও হেডসেটে ছিলেন নুরুল আলম। ডানদিকের ডানার দায়িত্বে ছিলেন শুপ্রহ মল্লিক। বাঁদিকের ডানার দায়িত্বে ছিলেন মুহাম্মদ শিবলী নোমানী।
টোয়িং করার সময় পুশকার্টের (ছোট আকারের ক্যারিয়ার) যে স্বাভাবিক গতি থাকার কথা তার থেকে বেশি গতি ছিল। রাতে মার্শালিং (দিকনির্দেশনা)-এর দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের হাতে ফ্ল্যাশলাইট থাকার কথা থাকলেও কারও হাতে তা ছিল না।
ঘটনার সময় উপস্থিত এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, এয়ারক্রাফটটি যখন পার্কিং করা অন্য একটা এয়ারক্রাফটের ওপর আছড়ে পড়ে তখন ডান পাশ থেকে শুপ্রহ থামানোর জন্য সিগ্যাল দিয়েছিলেন। তিনি চিৎকার করে বলেছিলেন ‘থামাও, থামাও’। কিন্তু তার সিগন্যাল বুঝতে পারেননি ককপিটে থাকা ব্যক্তিরা। বিমানের রক্ষণাবেক্ষণ লাইন অ্যান্ড বেজ মেইনটেন্যান্স প্রসিডিউর ম্যানুয়েল অনুযায়ী শুপ্রহর হাতে ফ্ল্যাশলাইট থাকার কথা থাকলেও তা ছিল না। হ্যাঙ্গার এরিয়ায় আলো কম থাকায় ফ্ল্যাশলাইট দরকার ছিল। ফ্ল্যাশলাইটের বিষয়টি শুপ্রহর বোঝার কথা নয়। যাদের বোঝার কথা তারা বিষয়টি নিশ্চিত করেননি। এখানে উদোর পি-ি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তাছাড়া এয়ারক্রাফটের বাঁদিক দেখতে বলা হয়েছিল মুহাম্মদ শিবলী নোমানীকে। অথচ তিনি এ দুই এয়ারক্রাফটের একটিরও দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন না।
ওই প্রত্যক্ষদর্শী কর্মকর্তা আরও জানান, ভারী জিনিস সরানোর জন্য সচরাচর এ বাড়ি-ও বাড়ির লোকজনদের ডেকে আনা হয়। বিমানেও তাই ঘটেছে। এয়ারক্রাফট ‘একে-তাকে দিয়ে’ হ্যাঙ্গারে নেওয়ার জিনিস নয়। এক পাশে সুইপার আর এক পাশে অন্য একজনকে ধরিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। এখানে শুপ্রহকে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানো হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
তদন্ত প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, তদন্ত কমিটির কাছে বিমানের প্রধান প্রকৌশলী এ আর এম কায়সার জামান অননুমোদিত (আনঅথরাইজড) ব্যক্তিকে ডানার দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টিকে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। উপপ্রধান প্রকৌশলী রাবিউল আমিনও একই বক্তব্য দিয়েছেন।
নুরুল আলম পুশকার্টে (ছোট আকারের ক্যারিয়ার) বসে দায়িত্ব পালন করেছেন। এয়ারক্রাফটে ধাক্কা লাগার পর পুশকার্ট থেকে নেমে ডানদিকের ডানার কাছে যান। এতে মনে হচ্ছে দায়িত্ব পালনের সময় নুরুল আলমেরও গাফিলতি আছে।
দুর্ঘটনার দুদিন পর বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় অতিরিক্ত সচিব মো. মুহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি গত ১৮ জুলাই প্রতিবেদন জমা দেয় বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোকাম্মেল হোসেনের কাছে। তদন্ত কমিটি বলেছে, দুই এয়ারক্রাফটের ঠোকাঠুকিতে ৫৬ লাখ ২৭ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ টাকা দায়ীদের কাছ থেকে আদায়ের সুপারিশ করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির প্রধান মো. মুহিদুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। তদন্তে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ রয়েছে। কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা বিমান ব্যবস্থাপনার বিষয়।’
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এয়ারক্রাফট পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা অতি সংবেদনশীল এবং টেকনিক্যাল। তাই যে কাজের জন্য যিনি নিয়োজিত তাকে দিয়েই সেই কাজ করানো উচিত। এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। একজন সুইপারের নির্দেশনায় বিমান চালানো দায়িত্বহীনতার পরিচয় বহন করে। ড্যাশ-৮-এর প্রকৌশলী হওয়ার পরও শিবলী নোমানীকে সামনে পেয়ে তাকে ডেকে ডানার ক্লিয়ারেন্সের দায়িত্ব দেওয়া একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির অপেশাদারিত্ব প্রকাশ করে। এয়ারক্রাফটের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে ওয়েল ইক্যুইপড না হয়ে কাজ করতে যাওয়া পেশাদারিত্বের দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করে বলে তারা মনে করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা জানান, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস লিমিটেডের সংশোধিত সাংগঠনিক কাঠামো জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি গ্রহণ না করে নতুন পদ সৃষ্টি করে তিনজন চিফ ইঞ্জিনিয়ার পদায়ন করা হয়েছে। কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানেই তিনজন চিফ ইঞ্জিনিয়ার নেই। তারা প্রকৌশল শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এক শাখা থেকে অন্য শাখায় বদলি করে পদোন্নতি এমনকি সার্টিফিকেট দেওয়ার কাজে ব্যস্ত থাকে। তারা কোনো দিনই এয়ারক্রাফট (উড়োজাহাজ) মেরামতের কাজ করেননি। বিমান প্রকৌশল শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলিজনিত কারণে পদ শূন্য করে পদোন্নতি দিয়ে আবার পূর্ব পদে ফিরে আনা হয়। প্রকৌশল শাখার ইঞ্জিনিয়াররা হোটেল-মোটেল, ডেভেলপার কোম্পানিসহ নানা ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। একাধিক গোয়েন্দা রিপোর্টেও বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে। বিমান প্রকৌশল বিভাগের কর্মচারীরা নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার পরও অতিরিক্ত আরও আট ঘণ্টা ওভারটাইম করেন। এখানে বড় ফাঁকিবাজি রয়েছে। বিমান প্রকৌশল বিভাগের কোনো শ্রমিক নেতা তাদের নির্ধারিত কাজ করেন না। দুই এয়ারক্রাফটের দুর্ঘটনার দিন যাদের দিয়ে রোস্টার অনুযায়ী কাজ করার কথা তাদের দিয়ে না করিয়ে অন্য কর্মচারীদের ডেকে এনে কাজ করানো হয়েছে।
শেয়ার করুন
আশরাফুল হক | ২ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০

পাইলটের সিটে ছিলেন এয়ারক্রাফট তদারককারী অফিসার নিজেই। এয়ারক্রাফটের বাইরে ডান দিকের ডানার কাছ থেকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন একজন সুইপার। বাঁদিকে নির্দেশনা দেওয়ার জন্য ফোন করে ডেকে আনা হয় তুলনামূলকভাবে এক ছোট এয়ারক্রাফটের দায়িত্বে থাকা অফিসারকে যার বড় এয়ারক্রাফট তদারকির কোনো অভিজ্ঞতাই নেই।
একটা এয়ারক্রাফট কতটা জায়গা নিয়ে ঘুরবে তা পুরোটাই গাণিতিক মাপজোকের বিষয়। একজন সুইপার বা অফিসারের তা বোঝার কথা নয়। এতে ফল যা হওয়ার তাই হলো। অদক্ষ ও অপেশাদারদের হাতে পড়ে এয়ারক্রাফটটি হ্যাঙ্গারে প্রবেশের আগে ধাক্কা দিল দাঁড়িয়ে থাকা (পার্কিং করা) অন্য এয়ারক্রাফটকে। দুই এয়ারক্রাফটেরই ক্ষতি হলো। ক্ষতির পরিমাণ ৫৬ লাখ টাকা হয়তো ২ হাজার কোটি টাকার এয়ারক্রাফটের জন্য কিছুই না, কিন্তু এতে বেরিয়ে পড়ল বিমানের অব্যবস্থাপনা কতদূর গড়িয়েছে। এর কিছুদিন আগেও একইভাবে দুই এয়ারক্রাফটের ঠোকাঠুকি হয়েছে।
এখানেই শেষ নয়, কাহিনী কেবল শুরু। ঠোকাঠুকির পর তোলপাড় সৃষ্টি হলো। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ঘিরে রাখল এয়ারক্রাফট। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী ছুটে গেলেন ক্ষতির পরিমাণ দেখতে। মন্ত্রিসভা বৈঠক থেকে প্রধানমন্ত্রীর কড়া অবস্থানের কথা জানিয়ে দেওয়া হলো।
এখন পরিস্থিতি সামাল দিতে তৎপর হচ্ছে বিমানের একটি প্রভাবশালী মহল। তারা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য সুইপার শুপ্রহ মল্লিককে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাচ্ছে। যারা শুপ্রহকে এ কাজে লাগিয়েছে তাদের বাঁচার পথ করে দিচ্ছে।
শুপ্রহ মল্লিক বিমানের কোনো স্থায়ী কর্মী নন। অস্থায়ীভাবে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে বিমানের এয়ারক্রাফট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেন। শুপ্রহ বিমানে যোগ দিয়েছেন ২০১৮ সালের ৬ জুন। তিনি ছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যাটারিয়াল ম্যানেজমেন্টের অধীনে। সেখান থেকে তাকে এয়ারক্রাফট পরিষ্কারের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
শুপ্রহকে দায়ী করেছেন বিমানের প্রধান প্রকৌশলী এ আর এম কায়সার জামান ও উপপ্রধান প্রকৌশলী রাবিউল আমিন। ঠোকাঠুকির জন্য দায়ী অন্য কর্মকর্তারাও নিজেরা বেঁচে যাওয়ার জন্য তাকেই টার্গেট করেছেন। এ কারণে যথাযথ তদন্ত হওয়ার আগেই শুপ্রহকে বলির পাঁঠা বানানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে দায়ী করে তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করার অভিযোগ উঠেছে।
তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই উপপ্রধান প্রকৌশলী রাবিউল আমিন এক চিঠিতে শুপ্রহকে চাকরি থেকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করে প্রধান প্রকৌশলীকে ফাইল পাঠান। সেখানে উপপ্রধান প্রকৌশলী শুপ্রহর বিরুদ্ধে নানা দিক থেকে তার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন না করার অভিযোগ তোলেন। তার কয়েক দিন পরই প্রকৌশলীদ্বয় শুপ্রহর বিরুদ্ধে জবানবন্দি দেন তদন্ত কমিটির সামনে।
গত ২৫ জুলাই মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমানের এয়ারক্রাফট দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করতে ভালোভাবে তদন্ত করার নির্দেশ দেন। তিনি সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেন। এ নির্দেশনা দেওয়ার পর কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় তা নিয়ে দফায় দফায় সভা করছে বিমান ব্যবস্থাপনা।
গত ৩ জুলাই রাত সোয়া ৯টায় বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গার এলাকায় আগে থেকেই পার্ক করা ৭৩৭-৮০০ মডেলের এয়ারক্রাফটের সঙ্গে ধাক্কা লাগে বিমানের বোয়িং ৭৮৭-৮ এয়ারক্রাফটের। এতে ৭৩৭-৮০০-এর বাঁদিকের এবং ৭৮৭-৮-এর ডানদিকের ডানার নিচের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ঘটনার দিন ৭৮৭-৮ এয়ারক্রাফটটি সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করে। পরবর্তী কোনো ফ্লাইট না থাকায় এয়ারক্রাফটটি হ্যাঙ্গারে রাখার নির্দেশ দেন মুখ্য প্রকৌশলী (শিফট ইনচার্জ) হারুন অর রশীদ। ‘বি’ শিফটের দায়িত্বরত প্রকৌশলী শাহ হক নাওয়াজ এয়ারক্রাফটটি হ্যাঙ্গারে পার্ক করতে যান। এয়ারক্রাফটটি টো (ইঞ্জিন বন্ধ টেনে নেওয়া) করে হ্যাঙ্গারে নিয়ে আসার সময় পার্ক করা এয়ারক্রাফটের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। এয়ারক্রাফটটি টো করার সময় ককপিটে ছিলেন শাহ হক নাওয়াজ, টোয়িংয়ে ছিলেন খসরু পারভেজ ও হেডসেটে ছিলেন নুরুল আলম। ডানদিকের ডানার দায়িত্বে ছিলেন শুপ্রহ মল্লিক। বাঁদিকের ডানার দায়িত্বে ছিলেন মুহাম্মদ শিবলী নোমানী।
টোয়িং করার সময় পুশকার্টের (ছোট আকারের ক্যারিয়ার) যে স্বাভাবিক গতি থাকার কথা তার থেকে বেশি গতি ছিল। রাতে মার্শালিং (দিকনির্দেশনা)-এর দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের হাতে ফ্ল্যাশলাইট থাকার কথা থাকলেও কারও হাতে তা ছিল না।
ঘটনার সময় উপস্থিত এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, এয়ারক্রাফটটি যখন পার্কিং করা অন্য একটা এয়ারক্রাফটের ওপর আছড়ে পড়ে তখন ডান পাশ থেকে শুপ্রহ থামানোর জন্য সিগ্যাল দিয়েছিলেন। তিনি চিৎকার করে বলেছিলেন ‘থামাও, থামাও’। কিন্তু তার সিগন্যাল বুঝতে পারেননি ককপিটে থাকা ব্যক্তিরা। বিমানের রক্ষণাবেক্ষণ লাইন অ্যান্ড বেজ মেইনটেন্যান্স প্রসিডিউর ম্যানুয়েল অনুযায়ী শুপ্রহর হাতে ফ্ল্যাশলাইট থাকার কথা থাকলেও তা ছিল না। হ্যাঙ্গার এরিয়ায় আলো কম থাকায় ফ্ল্যাশলাইট দরকার ছিল। ফ্ল্যাশলাইটের বিষয়টি শুপ্রহর বোঝার কথা নয়। যাদের বোঝার কথা তারা বিষয়টি নিশ্চিত করেননি। এখানে উদোর পি-ি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তাছাড়া এয়ারক্রাফটের বাঁদিক দেখতে বলা হয়েছিল মুহাম্মদ শিবলী নোমানীকে। অথচ তিনি এ দুই এয়ারক্রাফটের একটিরও দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন না।
ওই প্রত্যক্ষদর্শী কর্মকর্তা আরও জানান, ভারী জিনিস সরানোর জন্য সচরাচর এ বাড়ি-ও বাড়ির লোকজনদের ডেকে আনা হয়। বিমানেও তাই ঘটেছে। এয়ারক্রাফট ‘একে-তাকে দিয়ে’ হ্যাঙ্গারে নেওয়ার জিনিস নয়। এক পাশে সুইপার আর এক পাশে অন্য একজনকে ধরিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। এখানে শুপ্রহকে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানো হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
তদন্ত প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, তদন্ত কমিটির কাছে বিমানের প্রধান প্রকৌশলী এ আর এম কায়সার জামান অননুমোদিত (আনঅথরাইজড) ব্যক্তিকে ডানার দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টিকে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। উপপ্রধান প্রকৌশলী রাবিউল আমিনও একই বক্তব্য দিয়েছেন।
নুরুল আলম পুশকার্টে (ছোট আকারের ক্যারিয়ার) বসে দায়িত্ব পালন করেছেন। এয়ারক্রাফটে ধাক্কা লাগার পর পুশকার্ট থেকে নেমে ডানদিকের ডানার কাছে যান। এতে মনে হচ্ছে দায়িত্ব পালনের সময় নুরুল আলমেরও গাফিলতি আছে।
দুর্ঘটনার দুদিন পর বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় অতিরিক্ত সচিব মো. মুহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি গত ১৮ জুলাই প্রতিবেদন জমা দেয় বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোকাম্মেল হোসেনের কাছে। তদন্ত কমিটি বলেছে, দুই এয়ারক্রাফটের ঠোকাঠুকিতে ৫৬ লাখ ২৭ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ টাকা দায়ীদের কাছ থেকে আদায়ের সুপারিশ করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির প্রধান মো. মুহিদুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। তদন্তে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ রয়েছে। কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা বিমান ব্যবস্থাপনার বিষয়।’
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এয়ারক্রাফট পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা অতি সংবেদনশীল এবং টেকনিক্যাল। তাই যে কাজের জন্য যিনি নিয়োজিত তাকে দিয়েই সেই কাজ করানো উচিত। এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। একজন সুইপারের নির্দেশনায় বিমান চালানো দায়িত্বহীনতার পরিচয় বহন করে। ড্যাশ-৮-এর প্রকৌশলী হওয়ার পরও শিবলী নোমানীকে সামনে পেয়ে তাকে ডেকে ডানার ক্লিয়ারেন্সের দায়িত্ব দেওয়া একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির অপেশাদারিত্ব প্রকাশ করে। এয়ারক্রাফটের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে ওয়েল ইক্যুইপড না হয়ে কাজ করতে যাওয়া পেশাদারিত্বের দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করে বলে তারা মনে করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা জানান, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস লিমিটেডের সংশোধিত সাংগঠনিক কাঠামো জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি গ্রহণ না করে নতুন পদ সৃষ্টি করে তিনজন চিফ ইঞ্জিনিয়ার পদায়ন করা হয়েছে। কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানেই তিনজন চিফ ইঞ্জিনিয়ার নেই। তারা প্রকৌশল শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এক শাখা থেকে অন্য শাখায় বদলি করে পদোন্নতি এমনকি সার্টিফিকেট দেওয়ার কাজে ব্যস্ত থাকে। তারা কোনো দিনই এয়ারক্রাফট (উড়োজাহাজ) মেরামতের কাজ করেননি। বিমান প্রকৌশল শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলিজনিত কারণে পদ শূন্য করে পদোন্নতি দিয়ে আবার পূর্ব পদে ফিরে আনা হয়। প্রকৌশল শাখার ইঞ্জিনিয়াররা হোটেল-মোটেল, ডেভেলপার কোম্পানিসহ নানা ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। একাধিক গোয়েন্দা রিপোর্টেও বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে। বিমান প্রকৌশল বিভাগের কর্মচারীরা নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার পরও অতিরিক্ত আরও আট ঘণ্টা ওভারটাইম করেন। এখানে বড় ফাঁকিবাজি রয়েছে। বিমান প্রকৌশল বিভাগের কোনো শ্রমিক নেতা তাদের নির্ধারিত কাজ করেন না। দুই এয়ারক্রাফটের দুর্ঘটনার দিন যাদের দিয়ে রোস্টার অনুযায়ী কাজ করার কথা তাদের দিয়ে না করিয়ে অন্য কর্মচারীদের ডেকে এনে কাজ করানো হয়েছে।