করোনা টিকাদানে নানা চ্যালেঞ্জ
প্রতীক ইজাজ | ৬ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০
দেড় বছরের মাথায় এসে দেশের করোনা টিকাদান কর্মসূচি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। গত বছর ৭ ফেব্রুয়ারি দেশজুড়ে করোনা টিকাদান কর্মসূচি শুরুর পর এতদিন বেশ ভালোভাবেই চলে আসছিল কর্মসূচি। মানুষও টিকা নিতে ভিড় করছিল কেন্দ্রে কেন্দ্রে। কিন্তু সংক্রমণ কমে আসায় এখন আর টিকা নিতে আগ্রহী হচ্ছে না মানুষ। বিশেষ কর্মসূচি দিয়েও মানুষকে টিকা নেওয়ানো যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় প্রায় দেড় কোটি টিকার মেয়াদ আগামী নভেম্বরে শেষ হতে যাচ্ছে। এ সময়ের মধ্যে টিকায় গতি আনা না গেলে অন্তত পৌনে এক কোটি টিকা নষ্ট হওয়ায় আশঙ্কা রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এই মুহূর্তে করোনা টিকাদান কর্মসূচি সফল করতে চার ধরনের চ্যালেঞ্জ দেখছেন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে টিকার দ্বিতীয় ডোজ সম্পন্ন করা নিয়ে। এছাড়া প্রথম ডোজ, তৃতীয় বা বুস্টার ডোজ, ১২-১৮ বছর বয়সী ও বয়স্কদের লক্ষ্যমাত্রার জনগোষ্ঠীর টিকা সম্পন্ন করা নিয়েও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। পাশাপাশি জেলাভেদে করোনা টিকাদানের সংখ্যার তারতম্যও চিন্তায় ফেলেছে কর্মকর্তাদের। এমনকি তৃতীয় ডোজের মধ্যেই করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরবর্তীকালে চতুর্থ ডোজের কর্মসূচি হাতে নেওয়াও সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন তারা।
অবশ্য এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার কাজ করছে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। তিনি গতকাল শুক্রবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা কিছুদিনের মধ্যেই করোনা টিকার আরেকটা ক্যাম্পেইন করছি। এ ক্যাম্পেইন বড় আকারের হবে। আগামী রবি-সোমবারের মধ্যে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে।’
এ ব্যাপারে করোনা টিকা ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্স কমিটির সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যেসব জেলা টিকায় পিছিয়ে আছে, সেসব জেলা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। কীভাবে সবাইকে টিকার আওতায় আনা যায়, সেজন্য কর্মসূচি নেওয়া হবে।’
বিশেষ করে টিকার প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের লক্ষ্যমাত্রা সম্পন্ন করার জন্য আগামী নভেম্বরের পর প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেওয়া বন্ধ হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন করোনা টিকা ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য সচিব এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর ডা. শামসুল হক। তিনি বলেন, ‘নভেম্বরের পর শুধু বুস্টার ডোজের টিকাই হাতে থাকবে। তখন প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের টিকা হাতে থাকবে না। সুতরাং যারা এখনো প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ নেয়নি, তাদের এ সময়ের মধ্যেই টিকা নিয়ে নিতে হবে।’
এমন অবস্থায় সবাইকে টিকা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এসব কর্মকর্তা। তারা বলেন, বর্তমানে প্রত্যেকটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টিকা কার্যক্রম চলমান আছে। যেকোনো জায়গায় রেজিস্ট্রেশন করে টিকা নিতে পারবেন। যার রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ নেই, তিনি টিকা কার্ড বা এনআইডির মাধ্যমে টিকা নিতে পারবেন।
টিকা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে এসব কর্মকর্তা আরও বলেন, বাংলাদেশে টিকা কার্যক্রমের কারণে সংক্রমণ হার অনেক কম। এখনো বিশ্বের অনেক দেশে প্রতিদিন প্রচুর মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু বাংলাদেশে টিকাগ্রহীতার হার বেশি হওয়াতে, যারা টিকা নিয়েছেন তাদের সংক্রমণ যেমন কম হচ্ছে; তেমনি সংক্রমণ যাদের হচ্ছে, তাদের মারাত্মক হচ্ছে না। জটিলতা অনেক কম হচ্ছে। সে কারণে হাসপাতালে এখন ভর্তির হারও অনেক কম। মৃত্যুর হারও অনেক কম। এজন্য যারা এখনো টিকা নেননি, তাদের টিকা নিতে হবে।
বড় চ্যালেঞ্জ দ্বিতীয় ডোজ : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ও টিকার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই মুহূর্তে দ্বিতীয় ডোজ সম্পন্ন করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। প্রথম ডোজ নিয়েছে এবং দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার সময় পার হয়ে গেছে এমন ৯৮ লাখ মানুষ এখনো দ্বিতীয় ডোজ নেয়নি। পাশাপাশি নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রার ৩৩ লাখ মানুষ এখনো টিকার প্রথম ডোজ নেয়নি। অথচ আগামী নভেম্বরের মধ্যে এসব মানুষ টিকা না নিলে তাদের জন্য মজুদ রাখা ১ কোটি ৩১ লাখ টিকার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে।
টিকার তথ্য অনুযায়ী, গত ২৫ জুলাই থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত দেশে দৈনিক গড়ে ৩৯ হাজার ৯২৬ জন টিকার দ্বিতীয় ডোজ ও ১০ হাজার ৬৩৮ জন প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছে। এ গতিতে টিকা নিতে থাকলে নভেম্বরের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া যাবে ৩৪ লাখ ৭৩ হাজার ৫৪৯ জনকে এবং প্রথম ডোজ দেওয়া যাবে ৯ লাখ ২৫ হাজার ৫৮০ জনকে। সে হিসাবে এ দুই শ্রেণির মানুষের জন্য মজুদ টিকার মধ্যে শেষ হবে ৪৩ লাখ টিকা এবং মজুদ থেকে যাবে ৮৮ লাখ। অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে টিকায় গতি আনা না গেলে ৮৮ লাখ টিকার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে।
টিকার তথ্য অনুযায়ী, গত ৩ আগস্ট পর্যন্ত দেশে টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছে ১২ কোটি ৯৭ লাখ ৪৩ হাজার ৪১ জন, যা মোট জনসংখ্যার ৭৬ দশমিক ১৮ শতাংশ এবং দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছে ১২ কোটি ৬ লাখ ৩৫ হাজার ৬১৩ জন, যা মোট জনসংখ্যার ৭০ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
বুস্টার ডোজও আরেকটি চ্যালেঞ্জ : বুস্টার ডোজ টিকা নেওয়ার ব্যাপারেও মানুষের মধ্যে তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তাদের তথ্য অনুযায়ী, এই মুহূর্তে সরকারের হাতে বুস্টার ডোজের জন্য প্রচুর টিকা আছে। পাইপলাইনে আরও টিকা আনার ব্যবস্থা করা আছে। এই মুহূর্তে ৭ কোটি ৩০ লাখ লোক বুস্টারের উপযোগী হয়ে গেছে। তাদের জন্য টিকাও তৈরি আছে। কিন্তু আশানুরূপ সাড়া মিলছে না।
টিকার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ৪ এপ্রিল থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত মাত্র চার মাসেই দ্বিতীয় ডোজের সঙ্গে তৃতীয় বা বুস্টার ডোজের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৪ লাখ। অর্থাৎ দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার চার মাস পার হয়েছে এমন ৬৩ লাখ ৯৯ হাজার ৬৮২ জন এখনো বুস্টার ডোজ নেয়নি। বর্তমানে যারা বুস্টার ডোজ নিচ্ছে, তাদের সবারই দ্বিতীয় ডোজ নেওয়া এই চার মাসের আগের। সে হিসাবে বুস্টার ডোজের টিকায় গতি না এলে সামনে এ ব্যবধান আরও বাড়বে। অবশ্য বর্তমানে বুস্টার ডোজ বেশি দেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ গত ২ আগস্ট দেশে বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৯১ হাজার ৫৫৭ ও দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে ৩২ হাজার ২৫ জনকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩ আগস্ট পর্যন্ত দেশে বুস্টার ডোজ পেয়েছে ৪ কোটি ২ লাখ ৯৩ হাজার ২৬৯ জন, যা মোট দ্বিতীয় ডোজের ৩৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। বিপরীতে দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছে ১২ কোটি ৬ লাখ ৩৫ হাজার ৬১৩ জন, যা মোট জনসংখ্যার ৭০ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
সব জেলায় টিকা সমান না : টিকার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে মানুষ সবচেয়ে বেশি টিকা পেয়েছে প্রথম ডোজ। সর্বোচ্চ ৭১ শতাংশ মানুষ প্রথম ডোজ পেয়েছে ৫৬ জেলায় ও মাত্র আট জেলার মানুষ ৭১ শতাংশের নিচে রয়েছে। অথচ দ্বিতীয় ডোজের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা সম্পূর্ণ বিপরীত। সর্বোচ্চ ৭১ শতাংশ মানুষ টিকার দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছে মাত্র ১৯ জেলায়। বাকি ৩৫ জেলায় ৭১ শতাংশের নিচে রয়েছে। এমনকি এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়েছে ৩৫ শতাংশ মানুষকে, বাগেরহাট জেলায়।
আরও যেসব চ্যালেঞ্জ : দেশে করোনা টিকাদান কর্মসূচির সার্বিক চ্যালেঞ্জের বিষয়ে দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন টিকা ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্স কমিটির সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। তিনি বলেন, ‘প্রথম ডোজের সঙ্গে দ্বিতীয় ডোজের একটা ফারাক আছে। টিকাদানের ৭০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়েছে। কিন্তু যারা প্রথম ডোজ নিয়েছেন, তাদের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ নেননি, এমন মানুষের সংখ্যা ৯৮ লাখের মতো। এদের মধ্যে কেউ কেউ বাইরে চেলে গেছেন। কেউ হয়তো বাইরে থেকে ডোজ নিয়ে এসেছেন। কিন্তু সেই সংখ্যা যদি বাদও দিই, তাহলেও কমপক্ষে ৫০ লাখ তো হবেই, যাদের দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার সময় পার হয়ে গেছে এবং দরকার ছিল। কিন্তু তারা নেননি।’
তিনি বলেন, ‘এ সংকট সমাধানে আমরা নিয়মিত টিকার ক্যাম্পেইন করব। কারণ সাধারণ সময়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে টিকা নিতে আসেন না। সেজন্য ক্যাম্পেইন করলে যারা একটু দূরে তাদের টিকার আওতায় আনা যায়।’
সামনে চ্যালেঞ্জ কী জানতে চাইলে এ বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা বলেন, ‘একটা চ্যালেঞ্জ আছে। সেটা হলো এ টিকার অ্যান্টিবডি কতদিন পর্যন্ত কার্যকর থাকবে, সেখানে একটা অনিশ্চয়তা আছে। অনেকের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি থাকছে না, অনেক দেশে ছয় মাস পর কমে যাচ্ছে। যদি নিয়মিতভাবে সবাইকে টিকা দিতে হয়, তাহলে সরকারের পক্ষে এ টিকা বারবার কিনে দেওয়া আসলেই চ্যালেঞ্জিং হবে। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এটা একেবারে খুব সহজ কাজ নয়। কভিড নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা টিকা দিতে পারি। কিন্তু ইপিআই কর্মসূচির মতো সারা দেশের মানুষকে টিকার আওতায় আনা খুব কঠিন। খরচসাপেক্ষ। আমরা রিসোর্স সীমিত। ইকোনমিক কন্ডিশন গ্লোবালি চ্যালেঞ্জের মুখে। সেখানে এ টিকা কিনে দেওয়া চ্যালেঞ্জিং বিষয়।’
অধ্যাপক ডা. মীরজাদী ফ্লোরা বলেন, ‘বুস্টার ডোজ পর্যন্ত দিচ্ছি। এরপর যদি আবার চতুর্থ ডোজ দিতে হয়, সেটা খুব কঠিন হবে। কভিড পরিস্থিতি কী হয়, এখনো বলা যাচ্ছে না। সামনে এটা একটা চ্যালেঞ্জ।’ তিনি আরও বলেন, ‘১২ বছরের ঊর্ধ্বে যত জনগোষ্ঠী, তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশকে আমরা দুই ডোজ টিকা দিয়েছি। ১০ শতাংশের মতো আছে যারা টিকা নেয়নি। যারা টিকা নেয়নি, তাদের মধ্যে ১২-১৮ বছর বয়সীদের সংখ্যাই বেশি। পাশাপাশি বয়স্ক মানুষের একটা সংখ্যাও আছে, যারা টিকা নেয়নি। আবার কোনো জায়গায় টিকা বেশি নিয়েছে, কোনো কোনো জেলায় কম নিয়েছে। এই যে তারতম্য, সেটা ওই এলাকার জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে। যেসব জেলা পিছিয়ে আছে, সেগুলো নিয়েও আমরা কাজ করছি।’
শেয়ার করুন
প্রতীক ইজাজ | ৬ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০

দেড় বছরের মাথায় এসে দেশের করোনা টিকাদান কর্মসূচি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। গত বছর ৭ ফেব্রুয়ারি দেশজুড়ে করোনা টিকাদান কর্মসূচি শুরুর পর এতদিন বেশ ভালোভাবেই চলে আসছিল কর্মসূচি। মানুষও টিকা নিতে ভিড় করছিল কেন্দ্রে কেন্দ্রে। কিন্তু সংক্রমণ কমে আসায় এখন আর টিকা নিতে আগ্রহী হচ্ছে না মানুষ। বিশেষ কর্মসূচি দিয়েও মানুষকে টিকা নেওয়ানো যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় প্রায় দেড় কোটি টিকার মেয়াদ আগামী নভেম্বরে শেষ হতে যাচ্ছে। এ সময়ের মধ্যে টিকায় গতি আনা না গেলে অন্তত পৌনে এক কোটি টিকা নষ্ট হওয়ায় আশঙ্কা রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এই মুহূর্তে করোনা টিকাদান কর্মসূচি সফল করতে চার ধরনের চ্যালেঞ্জ দেখছেন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে টিকার দ্বিতীয় ডোজ সম্পন্ন করা নিয়ে। এছাড়া প্রথম ডোজ, তৃতীয় বা বুস্টার ডোজ, ১২-১৮ বছর বয়সী ও বয়স্কদের লক্ষ্যমাত্রার জনগোষ্ঠীর টিকা সম্পন্ন করা নিয়েও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। পাশাপাশি জেলাভেদে করোনা টিকাদানের সংখ্যার তারতম্যও চিন্তায় ফেলেছে কর্মকর্তাদের। এমনকি তৃতীয় ডোজের মধ্যেই করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরবর্তীকালে চতুর্থ ডোজের কর্মসূচি হাতে নেওয়াও সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন তারা।
অবশ্য এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার কাজ করছে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। তিনি গতকাল শুক্রবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা কিছুদিনের মধ্যেই করোনা টিকার আরেকটা ক্যাম্পেইন করছি। এ ক্যাম্পেইন বড় আকারের হবে। আগামী রবি-সোমবারের মধ্যে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে।’
এ ব্যাপারে করোনা টিকা ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্স কমিটির সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যেসব জেলা টিকায় পিছিয়ে আছে, সেসব জেলা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। কীভাবে সবাইকে টিকার আওতায় আনা যায়, সেজন্য কর্মসূচি নেওয়া হবে।’
বিশেষ করে টিকার প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের লক্ষ্যমাত্রা সম্পন্ন করার জন্য আগামী নভেম্বরের পর প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেওয়া বন্ধ হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন করোনা টিকা ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য সচিব এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর ডা. শামসুল হক। তিনি বলেন, ‘নভেম্বরের পর শুধু বুস্টার ডোজের টিকাই হাতে থাকবে। তখন প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের টিকা হাতে থাকবে না। সুতরাং যারা এখনো প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ নেয়নি, তাদের এ সময়ের মধ্যেই টিকা নিয়ে নিতে হবে।’
এমন অবস্থায় সবাইকে টিকা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এসব কর্মকর্তা। তারা বলেন, বর্তমানে প্রত্যেকটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টিকা কার্যক্রম চলমান আছে। যেকোনো জায়গায় রেজিস্ট্রেশন করে টিকা নিতে পারবেন। যার রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ নেই, তিনি টিকা কার্ড বা এনআইডির মাধ্যমে টিকা নিতে পারবেন।
টিকা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে এসব কর্মকর্তা আরও বলেন, বাংলাদেশে টিকা কার্যক্রমের কারণে সংক্রমণ হার অনেক কম। এখনো বিশ্বের অনেক দেশে প্রতিদিন প্রচুর মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু বাংলাদেশে টিকাগ্রহীতার হার বেশি হওয়াতে, যারা টিকা নিয়েছেন তাদের সংক্রমণ যেমন কম হচ্ছে; তেমনি সংক্রমণ যাদের হচ্ছে, তাদের মারাত্মক হচ্ছে না। জটিলতা অনেক কম হচ্ছে। সে কারণে হাসপাতালে এখন ভর্তির হারও অনেক কম। মৃত্যুর হারও অনেক কম। এজন্য যারা এখনো টিকা নেননি, তাদের টিকা নিতে হবে।
বড় চ্যালেঞ্জ দ্বিতীয় ডোজ : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ও টিকার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই মুহূর্তে দ্বিতীয় ডোজ সম্পন্ন করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। প্রথম ডোজ নিয়েছে এবং দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার সময় পার হয়ে গেছে এমন ৯৮ লাখ মানুষ এখনো দ্বিতীয় ডোজ নেয়নি। পাশাপাশি নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রার ৩৩ লাখ মানুষ এখনো টিকার প্রথম ডোজ নেয়নি। অথচ আগামী নভেম্বরের মধ্যে এসব মানুষ টিকা না নিলে তাদের জন্য মজুদ রাখা ১ কোটি ৩১ লাখ টিকার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে।
টিকার তথ্য অনুযায়ী, গত ২৫ জুলাই থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত দেশে দৈনিক গড়ে ৩৯ হাজার ৯২৬ জন টিকার দ্বিতীয় ডোজ ও ১০ হাজার ৬৩৮ জন প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছে। এ গতিতে টিকা নিতে থাকলে নভেম্বরের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া যাবে ৩৪ লাখ ৭৩ হাজার ৫৪৯ জনকে এবং প্রথম ডোজ দেওয়া যাবে ৯ লাখ ২৫ হাজার ৫৮০ জনকে। সে হিসাবে এ দুই শ্রেণির মানুষের জন্য মজুদ টিকার মধ্যে শেষ হবে ৪৩ লাখ টিকা এবং মজুদ থেকে যাবে ৮৮ লাখ। অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে টিকায় গতি আনা না গেলে ৮৮ লাখ টিকার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে।
টিকার তথ্য অনুযায়ী, গত ৩ আগস্ট পর্যন্ত দেশে টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছে ১২ কোটি ৯৭ লাখ ৪৩ হাজার ৪১ জন, যা মোট জনসংখ্যার ৭৬ দশমিক ১৮ শতাংশ এবং দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছে ১২ কোটি ৬ লাখ ৩৫ হাজার ৬১৩ জন, যা মোট জনসংখ্যার ৭০ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
বুস্টার ডোজও আরেকটি চ্যালেঞ্জ : বুস্টার ডোজ টিকা নেওয়ার ব্যাপারেও মানুষের মধ্যে তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তাদের তথ্য অনুযায়ী, এই মুহূর্তে সরকারের হাতে বুস্টার ডোজের জন্য প্রচুর টিকা আছে। পাইপলাইনে আরও টিকা আনার ব্যবস্থা করা আছে। এই মুহূর্তে ৭ কোটি ৩০ লাখ লোক বুস্টারের উপযোগী হয়ে গেছে। তাদের জন্য টিকাও তৈরি আছে। কিন্তু আশানুরূপ সাড়া মিলছে না।
টিকার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ৪ এপ্রিল থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত মাত্র চার মাসেই দ্বিতীয় ডোজের সঙ্গে তৃতীয় বা বুস্টার ডোজের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৪ লাখ। অর্থাৎ দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার চার মাস পার হয়েছে এমন ৬৩ লাখ ৯৯ হাজার ৬৮২ জন এখনো বুস্টার ডোজ নেয়নি। বর্তমানে যারা বুস্টার ডোজ নিচ্ছে, তাদের সবারই দ্বিতীয় ডোজ নেওয়া এই চার মাসের আগের। সে হিসাবে বুস্টার ডোজের টিকায় গতি না এলে সামনে এ ব্যবধান আরও বাড়বে। অবশ্য বর্তমানে বুস্টার ডোজ বেশি দেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ গত ২ আগস্ট দেশে বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৯১ হাজার ৫৫৭ ও দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে ৩২ হাজার ২৫ জনকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩ আগস্ট পর্যন্ত দেশে বুস্টার ডোজ পেয়েছে ৪ কোটি ২ লাখ ৯৩ হাজার ২৬৯ জন, যা মোট দ্বিতীয় ডোজের ৩৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। বিপরীতে দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছে ১২ কোটি ৬ লাখ ৩৫ হাজার ৬১৩ জন, যা মোট জনসংখ্যার ৭০ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
সব জেলায় টিকা সমান না : টিকার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে মানুষ সবচেয়ে বেশি টিকা পেয়েছে প্রথম ডোজ। সর্বোচ্চ ৭১ শতাংশ মানুষ প্রথম ডোজ পেয়েছে ৫৬ জেলায় ও মাত্র আট জেলার মানুষ ৭১ শতাংশের নিচে রয়েছে। অথচ দ্বিতীয় ডোজের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা সম্পূর্ণ বিপরীত। সর্বোচ্চ ৭১ শতাংশ মানুষ টিকার দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছে মাত্র ১৯ জেলায়। বাকি ৩৫ জেলায় ৭১ শতাংশের নিচে রয়েছে। এমনকি এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়েছে ৩৫ শতাংশ মানুষকে, বাগেরহাট জেলায়।
আরও যেসব চ্যালেঞ্জ : দেশে করোনা টিকাদান কর্মসূচির সার্বিক চ্যালেঞ্জের বিষয়ে দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন টিকা ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্স কমিটির সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। তিনি বলেন, ‘প্রথম ডোজের সঙ্গে দ্বিতীয় ডোজের একটা ফারাক আছে। টিকাদানের ৭০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়েছে। কিন্তু যারা প্রথম ডোজ নিয়েছেন, তাদের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ নেননি, এমন মানুষের সংখ্যা ৯৮ লাখের মতো। এদের মধ্যে কেউ কেউ বাইরে চেলে গেছেন। কেউ হয়তো বাইরে থেকে ডোজ নিয়ে এসেছেন। কিন্তু সেই সংখ্যা যদি বাদও দিই, তাহলেও কমপক্ষে ৫০ লাখ তো হবেই, যাদের দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার সময় পার হয়ে গেছে এবং দরকার ছিল। কিন্তু তারা নেননি।’
তিনি বলেন, ‘এ সংকট সমাধানে আমরা নিয়মিত টিকার ক্যাম্পেইন করব। কারণ সাধারণ সময়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে টিকা নিতে আসেন না। সেজন্য ক্যাম্পেইন করলে যারা একটু দূরে তাদের টিকার আওতায় আনা যায়।’
সামনে চ্যালেঞ্জ কী জানতে চাইলে এ বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা বলেন, ‘একটা চ্যালেঞ্জ আছে। সেটা হলো এ টিকার অ্যান্টিবডি কতদিন পর্যন্ত কার্যকর থাকবে, সেখানে একটা অনিশ্চয়তা আছে। অনেকের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি থাকছে না, অনেক দেশে ছয় মাস পর কমে যাচ্ছে। যদি নিয়মিতভাবে সবাইকে টিকা দিতে হয়, তাহলে সরকারের পক্ষে এ টিকা বারবার কিনে দেওয়া আসলেই চ্যালেঞ্জিং হবে। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এটা একেবারে খুব সহজ কাজ নয়। কভিড নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা টিকা দিতে পারি। কিন্তু ইপিআই কর্মসূচির মতো সারা দেশের মানুষকে টিকার আওতায় আনা খুব কঠিন। খরচসাপেক্ষ। আমরা রিসোর্স সীমিত। ইকোনমিক কন্ডিশন গ্লোবালি চ্যালেঞ্জের মুখে। সেখানে এ টিকা কিনে দেওয়া চ্যালেঞ্জিং বিষয়।’
অধ্যাপক ডা. মীরজাদী ফ্লোরা বলেন, ‘বুস্টার ডোজ পর্যন্ত দিচ্ছি। এরপর যদি আবার চতুর্থ ডোজ দিতে হয়, সেটা খুব কঠিন হবে। কভিড পরিস্থিতি কী হয়, এখনো বলা যাচ্ছে না। সামনে এটা একটা চ্যালেঞ্জ।’ তিনি আরও বলেন, ‘১২ বছরের ঊর্ধ্বে যত জনগোষ্ঠী, তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশকে আমরা দুই ডোজ টিকা দিয়েছি। ১০ শতাংশের মতো আছে যারা টিকা নেয়নি। যারা টিকা নেয়নি, তাদের মধ্যে ১২-১৮ বছর বয়সীদের সংখ্যাই বেশি। পাশাপাশি বয়স্ক মানুষের একটা সংখ্যাও আছে, যারা টিকা নেয়নি। আবার কোনো জায়গায় টিকা বেশি নিয়েছে, কোনো কোনো জেলায় কম নিয়েছে। এই যে তারতম্য, সেটা ওই এলাকার জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে। যেসব জেলা পিছিয়ে আছে, সেগুলো নিয়েও আমরা কাজ করছি।’