
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সবাইকে বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে হবে যে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং তাদের অবশ্যই দেশে ফিরে যেতে হবে। তিনি বলেন, ‘তাদের (রোহিঙ্গাদের) নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে। সবাইকে বুঝতে হবে পরিস্থিতি। আমাদের পক্ষে আর কোনো লোক নেওয়া সম্ভব নয়, রোহিঙ্গাদের অবশ্যই ফিরে যেতে হবে।’
গত মঙ্গলবার সম্প্রচারিত ওয়াশিংটনে ভয়েস অব আমেরিকার (ভোয়া) বাংলা সার্ভিসের সঙ্গে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।
রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের বারবার আহ্বানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এত বিশাল জনসংখ্যার (সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা প্রায়) দায়িত্ব একা একটি দেশের পক্ষে নেওয়া অসম্ভব। শুধু আশ্রয় দেওয়াই নয়, এত বিশাল জনসংখ্যার জন্য জীবিকার ব্যবস্থা করাও একটি বড় দায়িত্ব, যা কোনো দেশ একা বহন করতে পারে না। তিনি উল্লেখ করেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা নিষেধাজ্ঞা এবং চলমান কভিড-১৯-এর কারণে সমগ্র বিশ্ব এখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া হচ্ছে, যা বিশ্ববাসীকে চরম ভোগান্তিতে ফেলেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর শিশু-কিশোররা এখন ঘিঞ্জি বস্তিতে (রোহিঙ্গা ক্যাম্প) লালিতপালিত হয়ে বড় হচ্ছে, যেখানে মানবিক মূল্যবোধ ও সুস্থ স্বাস্থ্যের সঙ্গে বেড়ে ওঠার সুযোগ খুবই সীমিত।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ১৬ কোটি বাংলাদেশির পাশাপাশি কয়েক লাখ মানুষের (রোহিঙ্গাদের) দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তার ছোট বোন শেখ রেহানার আবেদনের কথাও স্মরণ করেন।
শেখ রেহানাকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, “আপনি ১৬ কোটি লোককে খাওয়াতে পারেন আর কয়েক লাখ লোকতে খাওয়াতে পারবেন না?” প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি ইতিবাচক জবাবে বলেছেন, প্রয়োজনে বাংলাদেশিরা একবেলা খাবার খেয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আরেক বেলার খাবার ভাগ করবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশি জনগণ, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রচুর খাবার নিয়ে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পরে এগিয়ে এসে রোহিঙ্গাদের সাহায্য করতে শুরু করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র সফর করছেন। এ সফরে তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে ভাষণ দেওয়াসহ নানা কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সময় শনিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সাক্ষাৎকারটি নেয় ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগ।
সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সংকট ছাড়াও বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলোর নানা অভিযোগ, মিডিয়ার স্বাধীনতা ও ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, মধ্য আয়ের দেশে উত্তরণের পথে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ, গৃহহীনদের জন্য নেওয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ তার সরকারের নেওয়া নানা কল্যাণমুখী নীতি ও কর্মসূচি, নারীর ক্ষমতায়ন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে প্রতিবন্ধী, ট্রান্সজেন্ডারদের কল্যাণে নেওয়া নানা পদক্ষেপ, জিয়া-এরশাদ আমলের সামরিক শাসন, আগামী নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন।
এ ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে তৎকালীন পাকিস্তান গোয়েন্দাদের গোপন রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে প্রকাশিত সিক্রেট ডকুমেন্টস বইটির সম্পাদনা ও প্রকাশনার প্রেক্ষাপট নিয়েও তিনি কথা বলেন। জলবায়ু পরিবর্তন, করোনা পরিস্থিতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইত্যাদির ফলে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশ কীভাবে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হয়ে উঠতে পারে তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার পরিকল্পনা ও স্বপ্নের কথাও তুলে ধরেন।
ভয়েস অব আমেরিকার পক্ষ থেকে প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী এ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শতরূপা বড়ুয়া।
আওয়ামী লীগ মানবাধিকার সংরক্ষণ করে : মানবাধিকার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার শুধু মানবাধিকার রক্ষা করেনি, মানবাধিকার সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করেও তা সংরক্ষণ করেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা সবসময় (অভিযোগের) তদন্ত করছি। কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়, এমনকি এটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো সদস্য দ্বারা সংঘটিত হলেও, যা অতীতে দেখা যায়নি।’
বিএনপির ঢালাও অভিযোগের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, তারা অনেক কথা বলার পর ৭০ জনের একটি তালিকা জমা দিয়েছে (কথিতভাবে নিখোঁজ)। তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ লোককে পরবর্তী সময়ে বিএনপির মিছিলে পাওয়া গেছে এবং কেউ কেউ তাদের ব্যক্তিগত কারণে আত্মগোপন করেছে এবং সাতটি ঘটনায় দেখা গেছে তারা মারা গেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর পাশাপাশি শত শত বিমানবাহিনী-সেনা অফিসার ও সৈনিককে হত্যা করেছিলেন। নিহতদের মৃতদেহ কখনোই পাওয়া যায়নি, এমনকি তাদের স্বজনরাও জানতে পারেননি তাদের কী অপরাধ ছিল।
গণমাধ্যম অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করছে : শেখ হাসিনা বলেছেন, আওয়ামী লীগের আমলে গণমাধ্যমের সংখ্যা বেড়েছে এবং তারা যা খুশি বলার স্বাধীনতা ভোগ করছে। তিনি বলেন, ‘সবকিছু বলার পর কেউ যদি বলে যে তাকে কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না, তার উত্তর কী হবে? এটাই আমি জানতে চাই।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে মাত্র একটি টিভি ও একটি রেডিও স্টেশন ছিল। যেগুলো ছিল সরকারের পরিচালনাধীন। ক্ষমতায় আসার পর বেসরকারি খাতকে উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশে এখন অনুমোদিত ৪৪টি টিভি চ্যানেলের মধ্যে ৩২টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল চালু রয়েছে। লোকজন টেলিভিশন টকশোতে অংশ নিচ্ছে এবং তারা স্বাধীনভাবে কথা বলছে, সত্য বা মিথ্যা এবং তারা সরকারের সমালোচনাও করছে।
প্রধানমন্ত্রী আবারও উল্লেখ করেন, কিন্তু দেশে সামরিক শাসকদের আমলে মানুষের কথা বলা বা চলাফেরার স্বাধীনতাটুকুও ছিল না।
অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে স্বাধীন ইসি : শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) যাতে অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করতে পারে এর জন্য তার সরকার সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য একটি আইন প্রণয়ন করেছেন এবং আইন অনুযায়ী কমিশন গঠিত হয়। নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে ছিল এবং তার সরকার এটিকে তার কর্র্তৃত্ব থেকে মুক্ত করেছে ও কমিশনকে আর্থিক স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য তাদের জন্য একটি পৃথক বাজেট বরাদ্দ করেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার দল আওয়ামী লীগ আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে এবং তখন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন, পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ হতে পারে না।
সরকারপ্রধান বলেন, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি দুটি দলের জন্ম অবৈধভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক শাসকদের হাত ধরে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সংগ্রামের মাধ্যমে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে বলে জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে তারা কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেবে না। জনগণ তাদের ভোট দিয়ে তাদের সরকার নির্বাচন করবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, আওয়ামী লীগকে ভোট না দিলে তার বলার কিছু নেই। বাসস
বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের মেছের আলীর জমি নিলাম হয়ে গিয়েছিল খাজনা দিতে না পারায়। নিলামের আগে ১৯৫২ সালে অর্থ জারি (মানি এক্সিকিউশন) মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। সেই যে মামলার শুরু, তা আজো শেষ হয়নি। এক আদালত থেকে আরেক আদালতে ঘুরতে ঘুরতে মেছের আলী, নিলামে জমি কিনে মামলার বিবাদী হওয়া আবদুর রশিদ তালুকদার ও তাদের সন্তানসহ মামলার কার্যক্রমে যুক্ত থাকা অন্তত ৯ জন মারা গেছেন।
নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত এসে ঝুলে থাকা এ দেওয়ানি মামলার বয়স এখন ৭০ বছর।
এ রকম অনেক দেওয়ানি মামলায় বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ যায় কিন্তু বাদী, বিবাদীদের অনেকেই বিচারের শেষ দেখে যেতে পারেন না। উত্তরসূরিদের রেখে যাওয়া মামলায় পক্ষভুক্ত হন পরবর্তী প্রজন্ম। এক মামলা থেকে আরেক মামলার উৎপত্তি। অধস্তন আদালত থেকে উচ্চ আদালত। ফের অধস্তন আদালত। মামলা চালাতে গিয়ে অনিঃশেষ দুর্ভোগের পাশাপাশি নিঃস্ব হয়ে যান বিচারপ্রার্থী।
আইন ও বিচারসংশ্লিষ্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশের উচ্চ ও অধস্তন আদালতে প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ দেওয়ানি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
আদালত ও বিচারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা প্রায়ই বলেন, দেওয়ানি মামলার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। এমন পরিস্থিতিতে উদ্বেগজনক উল্লেখ করে জ্যেষ্ঠ আইনবিদরা বলছেন, খুন, মারামারিসহ ফৌজদারি অপরাধের বড় একটি কারণ ভূমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ ও মামলা। দ্রুত এ সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ হতাশ কণ্ঠে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই যে দিনের পর দিন শুনানির তারিখ পড়ে। বিচারপ্রার্থী ফিরে যান। এটা তো ঠিক না। আমরা যদি এটা বুঝি যে মামলা এভাবে ঝুলিয়ে রাখা উচিত নয় তাহলে দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব। আর যদি এ যুক্তি না মানি, মামলা দীর্ঘায়িত হয় তাহলে তো তা চলতেই থাকবে।’
প্রবীণ এ আইনবিদ আরও বলেন, ‘আইনটা হয়তো পুরনো। কিন্তু আছে তো। প্রশ্ন হলো এটি সঠিকভাবে প্রয়োগ হচ্ছে কি না? এখন বিচারসংশ্লিষ্ট সবার মানসিকতার আরও পরিবর্তন হলেই শুধু সমাধান হতে পারে।’ সমাধান হিসেবে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) ওপর জোর দেন তিনি।
মেছের আলীর মামলার নথি ঘেঁটে দেখা যায়, মোরেলগঞ্জের চালিতাবুনিয়া মৌজায় চারটি দাগে ২ দশমিক ৯৯ একর জমির খাজনা না দেওয়ায় ১৯৫২ সালে অর্থ জারির মামলা হয়। তারপরও খাজনা না দেওয়া পরের বছরের ২২ জানুয়ারি ওই সম্পত্তি নিলাম হয়। নিলামে ওই জমি কিনে নেন আবদুর রশিদ তালুকদার। এ নিলাম আদেশ বাতিল চেয়ে ১৯৭৬ সালের ২৬ জানুয়ারি বাগেরহাটের মুন্সেফ আদালতে দেওয়ানি বিবিধ (মিস কেস) মামলা করেন মেছের আলী। এতে রশিদ তালুকদারকে বিবাদী করা হয়। ১৯৮০ সালের ২৮ জানুয়ারি মুন্সেফ আদালত এক রায়ে নিলাম বিক্রির আদেশ বাতিল করে দেয়। পরে ১৯৮৪ সালে এ রায়ের বিরুদ্ধে খুলনা জেলা জজ আদালতে আপিল করেন রশিদ। ২০০৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর খুলনা জেলা অতিরিক্ত জজ আদালত আপিল মঞ্জুর করে রায় দিলে ওই নিলাম বিক্রি বহাল থাকে। ইতিমধ্যে মেছের আলী মৃত্যুবরণ করায় তার উত্তরাধিকারী আবদুল হামিদ শেখসহ কয়েকজন আপিলের রায় চ্যালেঞ্জ করে ওই বছর নভেম্বরে হাইকোর্টে সিভিল রিভিশন (দেওয়ানি নিরীক্ষণ) মামলা করেন। ওই বছরের ৬ নভেম্বর হাইকোর্ট এক রুলে রশিদের উত্তরাধিকারী ও অন্যদের কারণ দর্শানোর রুল দেয়। এতে আপিলের রায় কেন বাতিল করা হবে না তা জানতে চায় হাইকোর্ট। ২০০৫ সালে রুলের জবাব দেয় বিবাদীপক্ষ। তবে হাইকোর্টে মামলাটি আসার আগেই মারা যান প্রথম বিবাদী রশিদ তালুকদার।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর তথ্যমতে, এ মামলায় ১৯৫৩, ১৯৭৬ ও ১৯৮০ সালে অধস্তন আদালতের এলসিআর (লোয়ার কোর্ট রেকর্ড) নথির হদিস মিলছে না। ফলে ১৮ বছরের বেশি সময় ধরে মামলাটি হাইকোর্টে অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে। উত্তরাধিকারী, ক্রয়সূত্রে মামলায় পক্ষভুক্ত হয়েছিলেন ২৫ জন।
হাইকোর্টে এক বিবাদীপক্ষের (মজিবুর রহমান ইতিমধ্যে মারা গেছেন) আইনজীবী মোশাররফ হোসেন মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতায় দুপক্ষই ত্যক্ত-বিরক্ত। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। কোনোপক্ষই এখন মামলার খোঁজ নেয় না। তারা আপস কিংবা সমঝোতায় যাবেন। কিন্তু এতেও তো আদালতের সম্মতি, সময় ও নথি লাগবে।’ তিনি বলেন, ‘দেশে দেওয়ানি মামলার যে বিচার কার্যক্রম সেটি যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। একেক ধাপের পর একেক ধাপ, একটি মামলা থেকে আরও মামলা চলে বছরের পর বছর। এ নিয়ে চিন্তাভাবনার সময় এসেছে।’
প্রয়াত বিবাদী মজিবুর রহমানের ছেলে এনামুল হক মোবাইল ফোনে হতাশ কণ্ঠে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। আমরা নিজেদের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করছি।’
আড়াই বছরে মামলা বেড়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার : ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত উচ্চ ও অধস্তন আদালতে অনিষ্পন্ন দেওয়ানি, ফৌজদারি ও অন্যান্য মামলা ছিল ৩৬ লাখ ৮৪ হাজার ৭২৮টি। এর মধ্যে বিচারিক আদালতে ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৬৭৮, হাইকার্টে ৯৭ হাজার ৬১৬ এবং আপিল বিভাগে ১৫ হাজার ৫৩৩ মামলা। তখনকার হিসাবে সব মিলিয়ে মোট দেওয়ানি মামলা ছিল ১৪ লাখ ৭৮ হাজার ৪২৭ মামলা। সম্প্রতি যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে গত জুন পর্যন্ত অধস্তন আদালতে ১৫ লাখ ৪৭ হাজার ৩৮২, হাইকোর্টে ৮৯ হাজার ২০৭টি এবং আপিল বিভাগে ১১ হাজার ৯৭৮টিসহ ১৬ লাখ ৪৮ হাজার ৫৬৭টি দেওয়ানি মামলা বিচারাধীন। অর্থাৎ গত জুন পর্যন্ত আড়াই বছরে উচ্চ ও অধস্তন আদালতে অনিষ্পন্ন মামলা বেড়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার ১৪০টি।
সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পৃথিবীর সব দেশেই দেওয়ানি মামলায় একটু সময় লাগে। কিন্তু এত বেশি কোথাও লাগে না। ব্রিটিশদের তৈরি এ আইন দিয়েই কিন্তু একসময় স্বল্প সময়ে মামলা নিষ্পত্তি হতো। এখন কেন হচ্ছে না সেটিই প্রশ্ন?’ বিচারক স্বল্পতাকে মূল কারণ চিহ্নিত করে তিনি বলেন, ‘যেখানে পাঁচ-ছয় হাজার বিচারক দরকার সেখানে প্রেষণ বাদে আদালতে কর্মরত আছেন ১ হাজার ৬০০ জন। কিছু ক্ষেত্রে বিচারকদের দক্ষতার ঘাটতি ও আইনজীবীদের দায়ের প্রশ্ন তো আসেই। কিন্তু বিচারকদের দোষ দিয়েও তো লাভ নেই। তাদের প্রচুর চাপ নিতে হয়।’
অ্যাটর্নি জেনারেল বিদেশ সফরে থাকায় এ পদে এখন দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এসএম মুনীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আসলে ভূমির রেকর্ড জটিলতা থেকেই প্রায় সব মামলার উৎপত্তি। এখন যেসব বিষয় বিরোধ তৈরি করে সেসব আইন পরিবর্তন করতে হবে। ব্রিটিশদের তৈরি দেওয়ানি আইন এখনকার পরিস্থিতি ও চিন্তাভাবনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।’
যেভাবে বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা : উচ্চ ও অধস্তন আদালতে নিয়মিত দেওয়ানি মামলা পরিচালনা করেন এমন আটজন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছেন এ প্রতিবেদক। তারা বলেন, মামলা শুরুর পর অন্তত ১০ বছরের মধ্যে নিষ্পত্তির নজির খুব বেশি নেই। এ ছাড়া প্রচলিত আইনে বিচারিক প্রক্রিয়া একটু সময়সাপেক্ষ। বাদীর আরজির (ফাইলিং) পর বিবাদীকে নোটিস বা সমন পাঠানো এবং জবাব দাখিলে চলে যায় দীর্ঘ সময়। এরপর দুপক্ষের বিরোধীয় বিষয় নিয়ে ইস্যু (মামলার কারণসহ বিবিধ) গঠন থেকে শুরু করে উভয়পক্ষের সাক্ষী হাজির ও নথি দাখিল এবং যুক্তিতর্কের শুনানির জন্য তারিখের পর তারিখ পড়ে। এরপর রায় পেলেও ডিক্রি জারি মামলা চলে বছরের পর বছর। এ ছাড়া অধস্তন এখতিয়ারসম্পন্ন দেওয়ানি আদালতের রায় ও ডিক্রির পর জেলা জজ আদালতে আপিল হয়। আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল মামলা (সিভিল রিভিশন) করে সংক্ষুব্ধ পক্ষ। এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যায় সংশ্লিষ্ট পক্ষ। আপিল বিভাগের রায়ের পর সিভিল রিভিউ (রায় পুনর্বিবেচনা) মামলা হয়। এ ছাড়া বিচারের পর্যায়ে আদালতের নিষেধাজ্ঞা, রিসিভার (তত্ত্বাবধানকারী) নিয়োগ বা কোনো আদেশের বিরুদ্ধে প্রতিকার পেতে সংশ্লিষ্ট আদালত কিংবা উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন পক্ষরা। এভাবে এক মামলা থেকে সৃষ্টি হয় আরেক মামলা। অধস্তন আদালত থেকে উচ্চ আদালত। ফের অধস্তন আদালত। এভাবেই চলে বছরের পর বছর।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল মেডিয়েশন সোসাইটির (বিমস) সভাপতি অ্যাডভোকেট এসএন গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আইনে কিন্তু বলা আছে সাক্ষ্য গ্রহণের আগে-পরে তিনবার করে সময় নেওয়া যাবে। কিন্তু এ বিধান তো কেউ মানছেন না। যদি দেওয়ানি আইনের বিধান সঠিকভাবে মেনে চলা হয় তাহলে ১৫০ দিনের মধ্যে অধস্তন আদালতে মামলা নিষ্পত্তি সম্ভব। আর যদি আইনজীবী ও বিচারকরা আরও আন্তরিক ও দায়িত্বশীল না হন তাহলে ৭০ বছর কেন, ১০০ বছরেও মামলা নিষ্পত্তি হবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে মেডিয়েশন (মধ্যস্থতা) বা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির পদ্ধতিকে কাজে লাগানোর এখনই উপযুক্ত সময়। না হলে বিচারপ্রার্থীর দুর্ভোগ আরও বাড়বে।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী চঞ্চল কুমার বিশ্বাস দেশ রূপান্তরকে বলেন, এ প্রযুক্তির যুগেও সমন জারি ও জবাব দাখিলে বছরের পর বছর চলে যায়। দেখা গেল, একপক্ষের গরহাজিরায় মামলা একতরফা নিষ্পত্তি হয়। অন্যপক্ষ এসে আবার দরখাস্ত করে মামলা পুনরুজ্জীবিত করে। আপিল শুনানি ও শেষ হওয়ার পরও একই অবস্থা হয়। তিনি বলেন, ‘ফৌজদারি বিচারে কতদিনের মধ্যে অভিযোগপত্র, বিচার করতে হবে সেটি বলা আছে। কিন্তু দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা নেই। এ জন্য আইনকে আরও সুস্পষ্ট করা উচিত।’
হিমালয়ের বুকে ফুটবলের ফুল ফুটিয়ে আসা নারী ফুটবলাররা সিক্ত হচ্ছেন একের পর এক সংবর্ধনায়। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ অনেক সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠান থেকেই তারা পাচ্ছেন আর্থিক পুরস্কার ও সম্মাননা। তবে গতকাল বুধবার রূপায়ণ সিটি উত্তরার আয়োজনে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সানজিদা-কৃষ্ণাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, সেটা বোধহয় অন্য কোথাও হয়নি। ব্যান্ড পার্টির বাজনায় লালগালিচা বিছানো পথ ধরে তারা প্রত্যেকে যখন হেঁটে আসছিলেন, দেখাচ্ছিল রানীর মতোই।
জমকালো আয়োজনে ফুটবলের রানীদের বরণ করে নিয়েছে রূপায়ণ সিটি উত্তরা। ঢাকার বুকে সাজানো-গোছানো এক স্বপ্ন শহর, দেশের প্রথম প্রিমিয়াম গেটেড কমিউনিটি কাল সেজেছিল রঙিন আলোর রোশনাইতে। অবশ্য কৃত্রিম সেই আলো ঢাকা পড়ে গেছে সাফজয়ী মেয়েদের হাসিমুখের আভায়। সেই হাসিটা আরও বড় হয়েছে যখন রূপায়ণ গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খাঁন মুকুল তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন ৩০ লাখ টাকার চেক। রূপায়ণ সিটি উত্তরায় গতকাল সন্ধ্যায় আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, ঢাকা-১৮ আসনের সংসদ সদস্য হাবিব হাসান, রূপায়ণ গ্রুপের কো-চেয়ারম্যান মাহির আলী খাঁন রাতুল, রূপায়ণ গ্রুপের উপদেষ্টা ও সাবেক জাতীয় ফুটবলার আব্দুল গাফফারসহ রূপায়ণ গ্রুপের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
নিজে ফুটবলার ছিলেন বলেই বোধহয় ফুটবলের প্রতি তার গভীর অনুরাগ। লিয়াকত আলী খাঁন মুকুল খেলেছেন ইস্টএন্ড ক্লাবের হয়ে, আবাহনীর জন্য ট্রায়ালে গিয়ে আঘাত পাওয়াতে দীর্ঘ হয়নি খেলোয়াড়ি জীবন। জড়িয়েছেন আবাসন ব্যবসার সঙ্গে। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল শহরে আবাসনের মতো কঠিন সমস্যার সমাধান নিয়ে কাজ করতে করতেও ফুটবলের প্রতি তার অনুরাগ কমেনি। সম্পৃক্ত আছেন শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রের সঙ্গে। তারই সুযোগ্য পুত্র, রূপায়ণ গ্রুপের কো-চেয়ারম্যান মাহির আলী খাঁন রাতুল বাবার ব্যবসাকে করেছেন সম্প্রসারিত। সেই সঙ্গে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ফুটবলপ্রেমটাও তিনি হারিয়ে ফেলেননি কর্মব্যস্ততায়। কাল রূপায়ণ সিটি উত্তরায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বাবার খেলোয়াড়ি জীবনের কথা বলতে গিয়ে হয়েছেন আবেগাপ্লুত, তেমনি জানিয়েছেন মঞ্চে যদি তার পায়ে একটা বল থাকত তাহলে আরও ভালো লাগত!
‘আমার স্কুলজীবনে শিক্ষক-শিক্ষিকা, বন্ধুবান্ধব সবাই আমাকে চিনত ফুটবলের মাধ্যমে। আমি পেশাদার ফুটবলার না হলেও পেশাদার ফুটবলে কী আন্তরিকতা লাগে, আমাদের এ মেয়েরা কী পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করেছেন, কত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এখানে এসেছেন, তা আমরা একটু হলেও উপলব্ধি করতে পারি।’
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করার প্রেক্ষাপট জানিয়ে মাহির আলী খাঁন রাতুল বলেন, ‘আমাদের অনেক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রূপায়ণের অবদান আবাসন খাতে সবচেয়ে বেশি। দেশের বাইরে গেলে আমরা উন্নতমানের আবাসন প্রকল্প দেখতে পাই। সেসব দেখে আমাদের মনে হয়েছিল, আমরা যদি দেশেও এরকম উন্নত আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি তাহলে আমরাও বিশ্বের বুকে পরিচয় দিতে পারব যে, আমরা বাংলাদেশিরাও উন্নতমানের আবাসন গড়ে তোলার সক্ষমতা রাখি। রূপায়ণ সিটি করা আমাদের স্বপ্ন ছিল, রূপায়ণ সিটি বাংলাদেশের প্রথম প্রিমিয়াম গেটেড কমিউনিটি, যেখানে জীবনযাপনের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা আছে। আমরা রূপায়ণ সিটিতে এজন্যই অনুষ্ঠানটি আয়োজন করেছি যেন যেভাবে নারী দল বিশ্বের বুকে আমাদের মাথা উঁচু করেছে তেমনি আমরাও তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই এবং বলতে চাই বাংলাদেশের আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরাও কোনো অংশে কম নয়।’
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জানান, দেশের খেলাধুলার মান উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করছে সরকার। বলছিলেন, ‘আমরা প্রতিটি উপজেলায় শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম বানিয়ে দিচ্ছি। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন প্রায় ৪৫০ কোটি টাকার একটি পরিকল্পনা দিয়েছে যেখানে চারটি ফুটবল একাডেমি তারা করতে চায়। মেয়েদের দলের এ সাফল্যে আমরা একাডেমির সংখ্যা আরও দুটি বাড়িয়েছি। কক্সবাজারে ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পাশে ফুটবল স্টেডিয়ামও হবে। পূর্বাচলেও শেখ হাসিনা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পাশে ফুটবল স্টেডিয়াম করার পরিকল্পনা রয়েছে।’
অনুষ্ঠানের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল জানান, একাডেমিগুলো হবে রাজশাহী, জামালপুর, গোপালগঞ্জ ও মাগুরাতে। পাশাপাশি বাফুফে ভবনে যেখানে মেয়েরা থাকে এবং কমলাপুর স্টেডিয়ামেও একাডেমি নির্মাণ করা হবে।
শুভেচ্ছা বক্তব্যের পর সাফজয়ী নারী ফুটবলার এবং ফুটবল দলের কোচিং প্যানেলের সদস্যদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, রূপায়ণ গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খাঁন মুকুল, কো-চেয়ারম্যান মাহির আলী খাঁন রাতুল ও রূপায়ণ গ্রুপের উপদেষ্টা আব্দুল গাফফার।
সাফজয়ী দলের সদস্য ও সহঅধিনায়ক মারিয়া মান্দা দলের পক্ষ থেকে পাশে থাকার জন্য রূপায়ণ গ্রুপকে ধন্যবাদ জানান। দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন রূপায়ণ গ্রুপকে ধন্যবাদ জানিয়ে আরও অনেক বিত্তবান সংস্থাকে ফুটবলের পাশে থাকার আহ্বান জানান।
ইউনিয়ন পর্যায়ে টিআর কাবিখা ও লোকাল গভর্ন্যান্স সাপোর্ট প্রজেক্টের (এলজিএসপি) অর্থ ব্যয়ে অনিয়মের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অভিযোগ রয়েছে, এসব প্রকল্পের বেশিরভাগ অর্থ ভুয়া বিল ভাউচার বানিয়ে আত্মসাৎ করা হয়। বিভিন্ন সময়ে এসব অভিযোগের প্রমাণও মিলেছে অনেক ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের বিরুদ্ধে। প্রান্তিক পর্যায়ের এসব অনিয়ম বন্ধে ইউনিয়ন পর্যায়ে নিরীক্ষা কার্যক্রম শুরু করছে সরকার। চলতি মাসেই এই কার্যক্রম শুরু হতে পারে বলে স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের এসব প্রকল্পে সরাসরি নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচলানা করতে একটি ‘গাইড লাইন’ তৈরি করা হয়েছে। যেখানে এলজিএসপি প্রকল্পের ক্ষেত্রে ২২টি প্যাকেজের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দ্রুত নিরীক্ষকদের দল মাঠে নামানো হবে। তবে কেউ কেউ মনে করছেন এ ধরনের উদ্যোগের ফলে মাঠ পর্যায়ে কর্মরত প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের ক্ষমতা আরও বাড়ানো হলো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টিআর, কাবিখা ও উন্নয়ন তহবিলসংক্রান্ত বিষয়ে সরাসরি পরিদর্শন করে তা প্রতিবেদন আকারে প্রস্তুত করবে এই নিরীক্ষক দল। এসব কার্যক্রম শুরুর আগে জেলা প্রশাসক ও সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে ‘এন্ট্রি মিটিং’ করা হবে। আবার নিরীক্ষা কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর একইভাবে ‘এক্সিট মিটিং’ করা হবে। নিরীক্ষার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের মাঠ পর্যায়ের প্রতিবেদনে জেলা প্রশাসক ও ইউএনওর স্বাক্ষর নিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগে জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. মুহাম্মদ শের আলী স্বাক্ষরিত একটি চিঠি ইতিমধ্যে সকল জেলা প্রশাসক, স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক ও ইউএনওদের কাছে পাঠানো হয়েছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে নিরীক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে ইউনিয়ন পরিষদের আর্থিক ব্যবস্থাপনার প্রকৃত চিত্র নিয়ে প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে তদারকি ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখন থেকে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে বাস্তবায়নাধীন লোকাল গভর্ন্যান্স সাপোর্ট প্রজেক্ট-৩ (এলজিএসপি)-এর আওতায় দেশের সব ইউনিয়ন পরিষদের ২০২১-২২ অর্থবছরের নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনারও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এজন্য ২২টি প্যাকেজের মাধ্যমে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষকদের প্রশিক্ষণ শেষে চলতি মাসেই ইউনিয়ন পর্যায়ে নিরীক্ষা কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ২০২১-২২ অর্থবছরের ইউনিয়ন পরিষদের সব উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থের প্রাপ্তি ও ব্যয়ের বার্ষিক আর্থিক বিবরণী নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করবে। প্রতিটি ইউনিয়নে তিন সদস্যের একটি নিরীক্ষা দল (অডিটর-১ ও অডিটর-২ প্রতি ইউনিয়নে চার দিন এবং অডিট ম্যানেজার-১ জন প্রতি ইউনিয়নে ১ দিনব্যাপী) কাজ করবে। সেই সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদের সকল হিসাবসংশ্লিষ্ট রেজিস্টার/ডকুমেন্ট ছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদের সম্পদ রেজিস্টার ও এলজিডি/এলজিএসপি-৩ প্রকল্পের আওতায় এবং ১ শতাংশ ভূমি হস্তান্তর করা থেকে গৃহীত এবং বাস্তবায়িত স্কিমগুলো, নিজস্ব রাজস্ব এবং অন্যান্য তহবিল দ্বারা বাস্তবায়িত স্কিমগুলো নিরীক্ষা করবে। এ ছাড়া ওয়ার্ড কমিটি ও স্কিম বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যদের উপস্থিতিতে বাস্তবায়িত স্কিম সরেজমিন পরিদর্শন করবে।
মাঠ প্রশাসনে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ইউনিয়ন পরিষদ নিরীক্ষাকালে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের অর্থ ও ক্রয়সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সদস্যদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক এবং নিরীক্ষকদের উপস্থিতির প্রমাণস্বরূপ স্বাক্ষর গ্রহণ করবে। ইউনিয়ন পরিষদ নিরীক্ষকালে নিরীক্ষকরা উপজেলা পরিষদ থেকে ইউনিয়ন সংশ্লিষ্ট টিআর, কাবিখা, উন্নয়ন তহবিলসংক্রান্ত সংগ্রহ ও পর্যবেক্ষণ করবে।
নিরীক্ষকদের তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিতকল্পে প্রয়োজনীয় স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন ২০০৯-এর ৬০ অনুচ্ছেদের বর্ণনামতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। নিরীক্ষকরা ইউনিয়ন পরিষদ নিরীক্ষার আগে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক (ডিডিএলজি) দপ্তরে ‘এন্ট্রি মিটিং’ করে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে নিরীক্ষা কার্যক্রম শুরু করবে এবং প্রতি ফার্মের নিরীক্ষা দল উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দপ্তরে এন্ট্রি মিটিং করবে। একটি উপজেলার সকল ইউনিয়ন পরিষদের নিরীক্ষা কার্যক্রম শেষ করার পর সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দপ্তরে ‘এক্সিট মিটিং’ করতে হবে।
এক্সিট সভায় বিজিসিসির সদস্য, ইউআরটির সদস্য, সকল ইউপি চেয়ারম্যান, সচিব ও ডিএফের উপস্থিতিতে মাঠ পর্যায়ের নিরীক্ষাসংশ্লিষ্ট আলোচনা এবং কার্যবিবরণী প্রণয়ন করে উপজেলা নির্বাহী অফিসার নিজ দায়িত্বে ‘এক্সিট মিটিং’ করে কার্যবিবরণীতে স্বাক্ষর করবেন। নিরীক্ষা কার্যক্রম নির্বিঘ্নে পরিচালনার স্বার্থে প্রত্যেক নিরীক্ষা দল তাদের ছবি এবং তথ্য সংবলিত অডিট প্রোগ্রাম প্রদর্শন করবে। প্রয়োজনে স্থানীয় সরকার বিভাগকে অবহিত করে ডিডিএলজি এবং ইউএনওর সঙ্গে সমন্বয় করে অডিট প্রোগ্রাম পরিবর্তন করা যাবে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, জন অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে অগ্রাধিকারভিত্তিক বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ এবং ইউনিয়ন পরিষদ অপারেশনাল ম্যানুয়েল অনুসরণে ঠিকাদারের মাধ্যমে (সরাসরি ক্রয় ও কমিউনিটি ক্রয় ব্যতীত) তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা যেমন জরুরি, তেমনি দক্ষতা এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠাকল্পে সুষ্ঠুভাবে নিরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করতে সার্বিক সহায়তা দেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. মুহাম্মদ শের আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তৃণমূল পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ ব্যয়ে আরও স্বচ্ছতা আনতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করছি, এ কার্যক্রমের মাধ্যমে অনিয়ম রোধ করা সম্ভব হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে আসার পথে মঙ্গলবার ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয় ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতারা। তবে এই হামলাকে ছাত্রদলের অন্তর্কলহ বলে দাবি করেছে ছাত্রলীগ। সরকার সমর্থিত সংগঠনটির নেতারা বলছেন, শান্ত ক্যাম্পাসকে কেউ অশান্ত করতে চাইলে তারা তাদের প্রতিহত করবেন। অন্যদিকে ছাত্রদলের নেতারা জানিয়েছেন, তারা হামলা উপেক্ষা করে আবারও ক্যাম্পাসে আসবেন। দেশের এ দুই ছাত্র সংগঠনের মুখোমুখি অবস্থানের ফলে ক্যাম্পাসে উত্তেজনা বিরাজ করছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে সংঘর্ষের আশঙ্কায় আতঙ্ক বিরাজ করছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সংঘর্ষের পরদিন গতকাল বুধবার ক্যাম্পাসে ক্লাস পরীক্ষা স্বাভাবিক ছিল। প্রতিদিনের মতো মধুর ক্যান্টিন ও আশপাশের এলাকায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অবস্থান দেখা যায়। এদিন ছাত্রদলের কোনো নেতাকর্মী ক্যাম্পাসে আসেননি।
ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ-ছাত্রদল সংঘাতের বিষয়ে জানতে চাইলে ভাষা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আরমান হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, মঙ্গলবার বিকেলে ক্লাস শেষে বাসায় যাওয়ার পথে ছাত্রলীগ-ছাত্রদল মারমুখী অবস্থানে দেখেছি। আমার তো আজকে ক্যাম্পাসে আসতেই ভয় লাগছিল। আমরা শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ চাই। কোনো মারামারি চাই না!
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী আফসানা রহমান বলেন, ঘনঘন এ দুই সংগঠনের সংঘর্ষ আমাদের আতঙ্কিত করে তুলছে। আমরা সব সময় শঙ্কার মধ্যে আছি। ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হোক এটা আমরা চাই না। এদিকে ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি খোরশেদ আলম সোহেলের দাবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মদদে তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমরা ফুল ও মিষ্টি নিয়ে ভিসি স্যারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলাম। ছাত্রলীগ ফুল ও মিষ্টির বিপরীতে রড-লাঠি দিয়ে আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। ছাত্রদল জুলুমের ভয় পায় না। আমরা আবারও ক্যাম্পাসে যাব, কারণ ক্যাম্পাসটা তো আমারও। সব কিছুর আগে আমার পরিচয় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, আমরা তিন দিন আগে ভিসি স্যারের থেকে সময় নিয়েছি। তিনি আমাদের কোনো ধরনের ঝামেলা হবে না বলে আশ্বস্ত করেছিলেন। এমন কি হামলার ৫ মিনিট আগেও আমাদের প্রক্টরের সঙ্গে কথা হয়েছিল। তিনি আমাদের ক্যাম্পাসে আসতে বলেন। তিনি বলেছিলেন, ছাত্রলীগ তাদের হামলা করবে না। কিন্তু আমাদের ওপর হামলা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের ডেকে এনে ছাত্রলীগ দিয়ে মার খাইয়েছে।
তবে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাসের দাবি তারা কারও ওপর হামলা করেননি। ছাত্রদল নিজেরাই নিজেদের মধ্যে মারামারি করেছে। তিনি বলেন, ছাত্রলীগ সংঘাতের রাজনীতি করে না। আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করছি। কিন্তু ছাত্রদল ক্যাম্পাসে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। শিক্ষার পরিবেশ যারা নষ্ট করবে ছাত্রলীগ তাদের প্রতিহত করবে।
হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান বলেন, তারা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসার কথা ছিল। কিন্তু পরে তারা আসেনি। কেন তারা আসল না এটা তো আমি জানি না।
প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রাব্বানী বলেন, হামলার বিষয়টি শুনে সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিব।
গত মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে নীলক্ষেত মোড়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হামলার শিকার হয়েছেন ঢাবি ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। হামলায় ছাত্রদলের অন্তত ১০ নেতাকর্মী আহত হন বলে দাবি করেছে সংগঠনটি।
ফেইসবুকে পবিত্র কোরআন অবমাননাকর ছবি পোস্ট করার অভিযোগ তুলে কক্সবাজারের রামু ও উখিয়ার বৌদ্ধ পল্লীতে হামলার ১০ বছর পূর্ণ হয়েছে আজ। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের রামু, উখিয়া ও টেকনাফে একযোগে এ হামলা চালানো হয়। এসময় ১৩টি বৌদ্ধ বিহার ও ৩০টি বসতবাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়।
উত্তম বড়ুয়া নামে যে যুবকের ফেইসবুক আইডিতে পবিত্র কোরআন অবমাননাকর ছবি পোস্ট করার অভিযোগ তোলা হয়, ১০ বছরে এসেও তার কোনো খোঁজ জানেন না তার বাবা ও মা।
উত্তম বড়ুয়ার বাবা সুদত্ত বড়ুয়া জানান, পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে অর্থকষ্টে চরম দুরবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন তারা। ছেলের সঙ্গে কোনোভাবেই এ পর্যন্ত তাদের কোনো যোগাযোগ হয়নি। তবে বিভিন্ন মাধ্যমে জেনেছেন উত্তম বেঁচে আছেন। উত্তম বড়ুয়ার মা মাধু বড়ুয়া জানান, ১০ বছর আগে সংঘটিত ঘটনাটিতে উত্তম কোনোভাবেই জড়িত নন। উত্তমকে ফিরিয়ে আনা হলে প্রকৃত সত্য জানা যাবে। তার ছেলে ফিরিয়ে আনার দাবি মায়েরও।
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতের ঘটনার পর পুলিশ বাদী হয়ে এজাহারভুক্ত ৩৭৫ জন এবং অজ্ঞাত আরও ১৫-১৬ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করে ১৮টি মামলা করে পুলিশ। পরবর্তীকালে এসব মামলায় প্রায় ১ হাজারেরও বেশি মানুষকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। কিন্তু ১০ বছর পার হলেও এখনো পর্যন্ত একটি মামলারও বিচারকাজ শেষ হয়নি। এ অবস্থায় বিচার নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতারা। তারা বলেছেন, এখন বিচারের নামে নিরপরাধ কোনো ব্যক্তি হয়রানি হোক তা চান না তারা। তারা চান শান্তি ও সম্প্রীতি।
বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতা কেতন বড়ুয়া জানান, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা থেকে রামুতে মিছিল, মিটিং হয়েছে। অনেককেই চেনা গেছে। কিন্তু মামলার পরবর্তী যে প্রক্রিয়া তাতে অনেক চিহ্নিত ব্যক্তি যেমন বাদ পড়েছে তেমনি নিরপরাধ অনেককেই হয়রানির শিকার হতে দেখা গেছে। বৌদ্ধ শান্তির ধর্ম। এখন সকলেই শান্তি চান; যে সম্প্রীতিতে রামুবাসী বসবাস করছে তা যে রক্ষা হয়।
বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতা বিপুল বড়ুয়াও বলেছেন একই কথা। তিনি বলেন, ‘ঘটনার ১০ বছরে এসে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ ভুলতে বসেছে। পুড়িয়ে দেওয়া বিহার নান্দনিকভাবে নির্মিত করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শান্তিতে আছি; সম্প্রীতিতে আছি। এর চেয়ে বেশি পাওয়ার নেই।’
কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি ও রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের আবাসিক ভিক্ষুক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু জানান, আলোচিত এ হামলার ঘটনায় এলাকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে যে সংকট তৈরি হয়েছিল তা অনেকটা ঘুছে গেছে। এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা জরুরি। বিচারের নামে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করা জরুরি। এটা করতে গিয়ে নিরপরাধ কেউ হয়রানির শিকার হোক তা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
কক্সবাজার জেলা দায়রা ও জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম জানান, ওই ঘটনায় মামলা হয়েছিল ১৯টি। এরমধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে ১৮টি মামলা করে। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি বাদী হয়ে মামলা করলেও পরবর্তীকালে বিবাদীদের সঙ্গে আপোসনামা দিয়ে খালাস করেছেন। বিচারাধীন ১৮টি মামলায় সাক্ষী না পাওয়ায় বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘসূত্রতা।
রাষ্ট্রপক্ষের এই আইন কর্মকর্তা জানান, মামলায় কোনোভাবেই সাক্ষীরা আদালতে এসে সাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছে না। ফলে মামলা নিয়ে অনিশ্চয়তা প্রকট হচ্ছে। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতাও সাক্ষ্য দিতে বা হাজির হওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহী হচ্ছেন না।
যশরাজ ফিল্মসের হাত ধরে বড় পর্দায় শাহরুখ খানের রাজকীয় প্রত্যাবর্তনের সাক্ষী বলিউড। তার 'পাঠান' বক্স অফিসে নজির গড়ছে। ভারতীয় ছবির সাফল্য পাড়ি দিয়েছে আমেরিকাতেও।
৪ বছর পর বড় পর্দায় ফিরেছেন শাহরুখ। 'পাঠান'-এ তার অ্যাকশন দেখতে দলে দলে হলে যাচ্ছেন অনুরাগীরা। মুক্তির পর প্রথম কয়েক দিনেই বিপুল টাকার ব্যবসা করে ফেলেছে এই ছবি। গড়েছে একাধিক নজির। গত বুধবার, ২৫ জানুয়ারি মুক্তি পায় 'পাঠান'। রবিবার পঞ্চম দিনে ছবিটি বিশ্বজুড়ে ৫০০ কোটির বেশি টাকার ব্যবসা করে ফেলেছে। কোনো কোনো পরিসংখ্যানে দাবি, পঞ্চম দিনের শেষে 'পাঠান'-এর আয় সাড়ে ৫০০ কোটি। মুক্তির প্রথম ৪ দিনই দেশের বাজারে হাফ সেঞ্চুরি করেছিল 'পাঠান'। রবিবারও তার অন্যথা হয়নি। ৫০ কোটির গণ্ডি পেরিয়ে এই ছবি রবিবার দেশে প্রায় ৭০ কোটি টাকার ব্যবসা করে। ভারতে এখন পর্যন্ত 'পাঠান'-এর মোট আয় ২৮২ কোটি টাকা। শনি ও রবিবার সপ্তাহান্তেই আরও বেশি করে এই ছবি দেখতে হলে যান মানুষ। চতুর্থ দিনে দেশের বক্স অফিসে শাহরুখের ছবির আয় ছিল ৫১ কোটি টাকা। সারা বিশ্বে এ ছবির মোট রোজগার শনিবার পর্যন্ত ছিল ৪২৯ কোটি টাকা। রবিবার এক লাফে ৫০০ কোটির গণ্ডি ছাড়িয়েছে 'পাঠান'।
দেশের বাইরে 'পাঠান' মোট ১০০টি দেশে মুক্তি পেয়েছে। বিদেশে ২৫০০টি পর্দায় এই ছবি দেখানো হচ্ছে। ভারতে এই ছবি চলছে সাড়ে ৫ হাজার পর্দায়। শুধুমাত্র আমেরিকাতেই ৬৯৪টি সিনেমা হলে 'পাঠান' মুক্তি পেয়েছে। সেখানে রমরমিয়ে চলছে শাহরুখ, দীপিকা পাডুকোন এবং জন আব্রাহাম অভিনীত ছবিটি। নজির গড়েছে। উত্তর আমেরিকার বক্স অফিসে হিন্দি ছবি হিসাবে 'পাঠান'-এর প্রথম দিনের আয় সর্বোচ্চ। ছবিটি মুক্তির দিন ১৮ লাখ ৬০ হাজার ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় ১৫ কোটি টাকা) আয় করেছে আমেরিকায়। উত্তর আমেরিকার ৬৯৪টি সিনেমা হলে সাম্প্রতিককালে মুক্তিপ্রাপ্ত যেকোনো ছবির তুলনায় 'পাঠান'-এর গড় সবচেয়ে বেশি।
আয়ের গড় হিসাবে হলিউডকেও টেক্কা দিচ্ছেন শাহরুখ। এই নিরিখে হলিউডের ৩টি ছবি কেবল 'পাঠান'-এর সামনে রয়েছে। সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে সেরা গড়ের তালিকায় তৃতীয় কিংবা চতুর্থ স্থানে শেষ করতে পারে 'পাঠান'। তালিকায় 'পাঠান'-এর আগে রয়েছে 'অ্যাভাটার : দ্য ওয়ে অব ওয়াটার’, 'পুস ইন দ্য বুটস : দ্য লাস্ট উইশ' এবং 'এ ম্যান কলড ওটো'।
কাস্টমস লাইসেন্সিং বিধিমালা বাতিলের দাবিতে আজ থেকে দুই দিন দেশের সব কাস্টম হাউস ও শুল্ক স্টেশনে কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন।
রোববার (২৯ জানুয়ারি) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মো. সুলতান হোসেন খান।
লিখিত বক্তব্যে সুলতান হোসেন খান জানান, কাস্টমস এজেন্টস লাইসেন্সিং বিধিমালা-২০১৬ তে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের মৌলিক অধিকার পরিপন্থী বিধি সন্নিবেশিত থাকায় বিধিমালা জারির পর ফেডারেশন অব বাংলাদেশ কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে মৌলিক অধিকার পরিপন্থী বিধি সংশোধনের দাবি জানিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি দেওয়া হলেও দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাজস্ব বোর্ড কর্তৃপক্ষ বিধিমালা সংশোধনের কোন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
‘উপরন্তু ২০২০-২০২১ সালের বাজেট প্রস্তাবনার সঙ্গে আরও কঠিন শর্ত যুক্ত করে লাইসেন্সিং বিধিমালা-২০২০ জারি করা হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরের বাজেট প্রস্তাবনায় অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে উত্থাপিত লাইসেন্সিং রুলের কয়েকটি বিধি ও উপবিধি সংশোধনীর প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়েছিল। কিন্তু গত বাজেটেও কোনোরূপ সংশোধনী আনা হয়নি।’
তিনি আরও জানান, দীর্ঘদিন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকরী কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় গত বছরের জুনে সারা দেশে একদিনের কর্মবিরতি পালন করে সিঅ্যান্ডএফ সংশ্লিষ্টরা। জুন মাসের শেষে আবারও দুই দিনের কর্মবিরতি ঘোষণা দিলে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে ৩০ দিনের মধ্যে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড হতে লাইসেন্সিং রুলসহ অন্যান্য বিধিসমূহ সংশোধনের জন্য কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নাই। এ বিষয়ে ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেও কার্যকর কোন ফলাফল পাওয়া যায়নি। তাই বাধ্য হয়ে লাইসেন্সিং বিধিমালা-২০২০ এর আইন ও বিধি পরিবর্তন ও সংশোধনের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আগামী ৩০ ও ৩১ জানুয়ারি সোম ও মঙ্গলবার দেশের সকল কাস্টম হাউস ও শুল্ক স্টেশনে পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ফেডারেশন যে সকল বিধিবিধান সংশোধনের দাবি জানিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আমদানিকারকের কাছে শুল্ক করাদি পাওনা থাকলে সংশ্লিষ্ট সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের লাইসেন্স নবায়ন না করার বিধান বাতিল করা, উত্তরাধিকারের অনুকূলে লাইসেন্স হস্তান্তর সংশ্লিষ্ট শর্ত শিথিল করা, শুল্ককর পরিশোধ না করলে লাইসেন্স বাতিল ও অর্থদণ্ড আরোপের বিধান বাতিল করা, মূল লাইসেন্স বাতিল হলে রেফারেন্স লাইসেন্স বাতিলের বিধি বাদ দেওয়া, দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিকে লাইসেন্স প্রদান না করা, শুল্ক মূল্যায়ন বিধিমালা-২০০০ এর যথাযথ বাস্তবায়ন এবং ভুলের অজুহাতে ২০০ থেকে ৪০০ শতাংশ জরিমানার আদেশ বাতিলের দাবি উল্লেখযোগ্য।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্টস্ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলহাজ্ব শামছুর রহমান, সহসভাপতি জনাব শেখ মো. মোখলেছুর রহমান (লাভলু), অর্থ সচিব এ কে এম আকতার হোসেন, বন্দর বিষয়ক সচিব জনাব মো. খায়রুল বাশার প্রমুখ।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইলেকট্রিক্যাল ও মেশিনারি পণ্য নিয়ে রাশিয়া থেকে আসা বিদেশি জাহাজ ‘এম,ভি আনকা সান’ ও ‘এম,ভি সাপোডিলা’ মোংলা বন্দরে ভিড়েছে। রবিবার বিকেল পৌনে ৫টার দিকে বন্দরের ৭ নম্বর জেটিতে ভিড়ে আনকা সান ও সন্ধ্যা ৭টায় ৮ নম্বর জেটিতে ভিড়ে সাপোডিলা।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার মাস্টার ক্যাপ্টেন শাহীন মজিদ জানান, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইলেকট্রিক্যাল মালামাল নিয়ে ভেনুটা পতাকাবাহী জাহাজ এম,ভি আনকা সান রবিবার বিকেল পৌনে ৫টায় মোংলা বন্দরের ৭ নম্বর জেটিতে ভিড়েছে। ১ হাজার ৯৭৯ প্যাকেজের ১ হাজার ৪শ মেট্রিক টন ইলেকট্রিক্যাল পণ্য নিয়ে গত ২৬ ডিসেম্বর রাশিয়ার নভরস্কি বন্দর থেকে ছেড়ে আসে এ জাহাজটি। এ ছাড়া রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ বন্দর থেকে ৪৩৬ প্যাকেজের ৫১৮ মেট্রিক টন মেশিনারি পণ্য নিয়ে সন্ধ্যা ৭টায় বন্দরের ৮ নম্বর জেটিতে ভিড়ে বিদেশি জাহাজ এম,ভি সাপোডিলা।
বিদেশি জাহাজ আনকা সান’র স্থানীয় শিপিং এজেন্ট কনভেয়ার শিপিং লাইনসের খুলনার ম্যানেজার (অপারেশন শিপিং) সাধন কুমার চক্রবর্তী ও সাপোডিলা’র স্থানীয় শিপিং এজেন্ট ইন্টারপোর্ট’র খুলনার ম্যানেজার অসিম মন্ডল জানান, বন্দর জেটিতে অবস্থান নেয়া এ জাহাজ দুটি থেকে রবিবার সন্ধ্যার পর অর্থাৎ রাত থেকে পণ্য খালাস শুরু হবে। এরপর জাহাজের এ পণ্য খালাস করে জেটিতে রাখা হবে। তারপর সোম বা মঙ্গলবার থেকে তা সড়ক পথে নেয়া হবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে।
এর আগে গত ২২ জানুয়ারি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালামাল নিয়ে মোংলা বন্দরে এসেছিল বিদেশি জাহাজ এম,ভি কামিল্লা। এ জাহাজগুলো মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত।
উল্লেখ্যে, সম্প্রতি ৭টি জাহাজ কোম্পানির ৬৯টি জাহাজে রূপপুরের মালামাল পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যার প্রেক্ষিতে রূপপুরের মালামাল নিয়ে রাশিয়া থেকে মোংলা বন্দরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা এম,ভি উসরা মেজরকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হয়নি তখন। ওই জাহাজটির ২৪ ডিসেম্বর মোংলা বন্দরে ভেড়ার শিডিউল ছিল। কিন্তু মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় তা আর সম্ভব হয়নি। পরে অবশ্য ওই জাহাজটি পণ্য খালাসে ভারতে গেলে সেখানেও পণ্য খালাস করতে না পারায় ফেরত যায় উসরা মেজর। যা মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, বাংলাদেশ ও ভারতসহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মহলে নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
চলছে শীত মৌসুম। এই সময় ফুলকপি খাবেন না, তা কি হয়? ফুলকপি খুবই পুষ্টিকর একটি সবজি; যা রান্না কিংবা কাঁচা যে কোন প্রকারে খাওয়া যায়। তবে ফুলকপির পাতাও কম উপকারী নয়। অনেকেই ফুলকপির পাতা ফেলে দেন। কিন্তু এর গুণ জানলে এমন করার আগে দু’বার ভাববেন।
ফুলকপিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, প্রোটিন, খনিজ পদার্থ, ক্যালসিয়াম প্রভৃতি রয়েছে। যা দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন রোগের হাত থেকে মানবদেহকে রক্ষা করে।
ওজন কমাতে
মেদ ঝরাতে পরিশ্রম কম করেন না কেউই। অথচ হাতের সামনে এমন উপকারী জিনিস থাকতেও, অপ্রয়োজনীয় ভেবে ফেলে দিচ্ছি। ফুলকপির পাতায় রয়েছে ভরপুর পরিমাণে ফাইবার। ওজন কমাতে চাইলে অতি অবশ্যই রোজের ডায়েটে রাখতে পারেন এই পাতা। শুধু লেটুস নয়, সালাদেও এই পাতা রাখতে পারেন।
দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে
গবেষণা বলছে, ফুলকপির পাতায় রয়েছে ভিটামিন এ। যা দৃষ্টিশক্তি বাড়িয়ে তোলার পাশাপাশি, চোখ সংক্রান্ত নানা সমস্যার সমাধান করে। চোখের স্বাস্থ্য ভাল রাখতে চোখ বন্ধ করে ভরসা রাখতে পারেন ফুলকপির পাতার উপর। রাতকানা রোগের আশঙ্কা দূর করতে এই পাতা কার্যকর।
হাড়ের যত্নে
শীতকালে হাড়ের বাড়তি খেয়াল রাখার দরকার পড়ে। তাই চিকিৎসকরা ক্যালশিয়ামে সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার কথা বলে থাকেন। ফুলকপির পাতা হল ক্যালশিয়ামের সমৃদ্ধ উৎস। এমনকি, ঋতুবন্ধের পরেও অনেক শারীরিক সমস্যা এড়াতে খেতে পারেন ফুলকপির পাতা।
সন্তানের বেড়ে ওঠায়
ফুলকপির পাতায় রয়েছে ভরপুর পরিমাণে প্রোটিন এবং খনিজ পদার্থ, যা শিশুর বেড়ে ওঠায় সাহায্য করবে। পুষ্টিবিদরা শিশুর বা়ড়ন্ত বয়সে এমন কিছু খাবার খাওয়ার কথা বলে থাকেন, যেগুলো তাদের উচ্চতা, ওজন এবং হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করবে। ফুলকপির পাতা সেই খাবারগুলোর মধ্যে অন্যতম।
‘শনিবার বিকেল’ মুক্তির বাধা কাটার খবর মিলেছিল গত ২১ জানুয়ারি। সেই দিনও ছিল শনিবার। এরপর দশ দিন কেটে গেলেও এখনও আনুষ্ঠানিক চিঠি হাতে পাননি ছবিটির নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। সেন্সর বোর্ডের প্রতি দ্রুত চিঠি পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
ফেসবুকে পেজে দেওয়া পোস্টে সোমবার ফারুকী লিখেছেন, ‘সেন্সর বোর্ডের প্রিয় ভাই-বোনেরা, আমরা এখনও আপনাদের চিঠির অপেক্ষায়। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী আপিল বোর্ড একটা সিনেমার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার সর্বোচ্চ ক্ষমতা রাখে। শনিবার বিকেলের ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্ত দেশি-আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকা এবং টেলিভিশনের কল্যাণে সারা দুনিয়ার মানুষ জানে। তারা সবাই তাকিয়ে আছে। আর দেরি না করে চিঠিটা তাড়াতাড়ি পাঠান।’
বাংলাদেশকে আর বিব্রতকর অবস্থায় না ফেলার অনুরোধ রাখেন ফারুকী, ‘আমরা বাংলাদেশকে আর বিব্রতকর অবস্থায় না ফেলি। ওদিকে ফারাজ রিলিজ হচ্ছে তিন তারিখ (৩ ফেব্রুয়ারি)। বাংলাদেশের মানুষ তাকিয়ে আছে শনিবার বিকেল মুক্তির দিকে, ফারাজের সাথে একই দিন বা এক ঘণ্টা আগে হলেও।’
গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ২০১৬ সালের জঙ্গি হামলার প্রেক্ষাপটে ‘শনিবার বিকেল’ সিনেমাটি নির্মিত। এতে অভিনয় করেছেন জাহিদ হাসান, পরমব্রত, তিশা, ইরেশ যাকেরের সঙ্গে ফিলিস্তিনি অভিনেতা ইয়াদ হুরানিও। বাংলাদেশ-ভারত-জার্মান এই তিন দেশের যৌথ প্রযোজনায় সিনেমাটি বানাতে টানা ১৫ দিন মহড়ায় মাত্র ৭ দিনেই শুটিং শেষ করেন ফারুকী। এরপর বিদেশের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমাটি প্রদর্শিত এবং প্রশংসিত হলেও দেশে সেন্সর বোর্ডে এটি আটকে দেয়।
২০১৯ সালে সেন্সর বোর্ডের সদস্যরা দুবার দেখার পর এটি আটকে দেন মূলত বোর্ডে থাকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধির আপত্তিতে। তখন বলা হয়েছিল, ‘স্পর্শকাতর’ বিষয়টি নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে।
যদিও ফারুকী বরাবরই বলে আসছিলেন, চলচ্চিত্রটি হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনা নিয়ে নয়, ওই ঘটনার ‘অনুপ্রেরণায়’ নির্মিত একটি কাহিনিচিত্র। তারপর ফারুকী ছাড়াও চলচ্চিত্র অঙ্গনের সবাই সিনেমাটি মুক্তির দাবি জানিয়ে আসছিল।
গুলশান হামলা নিয়ে সম্প্রতি ভারতে নির্মিত সিনেমা ফারাজ এর মুক্তির দিন ঘোষণার পর নতুন করে শনিবার বিকেল নিয়ে সবাই সরব হয়। এর মধ্যে ফারুকীর করা আপিল আবেদন নিয়ে শুনানিতে বসে আপিল বোর্ড।
মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে সভাপতি ও সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যানকে আহ্বায়ক করে গঠিত সাত সদস্যের সেই আপিল কমিটিতে রয়েছেন সংসদ সদস্য অভিনয়শিল্পী সুবর্ণা মুস্তাফা, সাবেক অতিরিক্ত সচিব নূরুল করিম, অভিনেত্রী সুচরিতা ও সাংবাদিক শ্যামল দত্ত।
ফারুকী তার এদিনের স্ট্যাটাসে সেন্সর বোর্ডকে উদ্দেশ্য করে লিখেন, ‘এটা দ্রুত সমাধান করেন। আমরা হাসিমুখে সিনেমাটা রিলিজ করি। পৃথিবীর নানা দেশে সিনেমাটা দেখানো হয়েছে, হচ্ছে। এবার বাংলাদেশের মানুষের পালা।’
সেন্সর বোর্ডে সিনেমা আটকে দেওয়াকে সেকেলে চিন্তা উল্লেখ করে ফারুকী লিখেন, ‘এটাও আপনাদের ভাবার সময় আসছে, এই নতুন মিডিয়ার যুগে সিনেমা আটকানোর মতো সেকেলে চিন্তা আদৌ কোনো কাজে আসে কিনা। কারণ যে কেউ চাইলে তার ছবি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে উন্মুক্ত করে দিতে পারে। ফলে ছবি আটকানোর চেষ্টা একটা পণ্ডশ্রম যা কেবল দেশের জন্য বদনাম-ই বয়ে আনতে পারে।’
রাজপথে খালি পায়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক পথশিশু। পেছনে বিক্ষুব্ধ মিছিল। শিশুটির পরনে চার পকেটের হাফপ্যান্ট; গেঞ্জিটা কোমরে বাঁধা। কণ্ঠে স্বৈরতন্ত্রের কবর রচনার হুঙ্কার। দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিস্পর্ধী সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পাঁজরগুলো যেন শরীরের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা অপ্রতিরোধ্য শিশুটি সেদিন সবার নজর কাড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের এ প্রতিবাদী মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার।
সেই সময়ে দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদচিত্রী ছিলেন তিনি। ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষীর আলোকচিত্রী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এ ছবি। ছবিটি আমাদের সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দে য়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশুটির চোখ-মুখের ভাষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের কথা। ছবিটির দৃশ্য-ভাষা এতই শক্তিশালী যে, এখনো মানুষের মনে শিহরন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছাত্রসমাজের ১১ দফা মুক্তিসনদকে সামনে নিয়ে ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি দাবানলের মতো জ্বলে উঠে পূর্ব বাংলা ও তার রাজধানী ঢাকা। এর ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঢাকার রাজপথে নামে জনতার ঢল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালাকেও ম্লান করে দেয় সেদিনের জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিদল। অধিকার-সচেতন জনতার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর আসন। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গর্জে উঠে স্বৈরাচারের বন্দুক। বুলেটের আঘাতে রাজপথে ঝরে পড়ে কয়েকটি প্রাণ। শহীদের লাশ নিয়ে রাজপথে মিছিলের ঢল নামে। রাত ৮টায় কারফিউ জারির মাধ্যমে জনতাকে নিবৃত্ত করার সর্বশেষ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাতের নৈঃশব্দ্যকে প্রকম্পিত করে মুক্তিপাগল জনতা। এর কয়েক দিন পর জনতার অদম্য আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী সরকারকে পালাতে হয়। সমাধি রচিত হয় আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের।
সেদিন ছিল আধাবেলা হরতাল। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে পুলিশ দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফা গুলিবর্ষণ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে। দুপুরে দ্বিতীয় দফা। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক ও নোয়াখালীর নান্দিয়াপাড়া হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ রুস্তম আলী। প্রেস ট্রাস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে আহত হয় ২১ জন। পরদিন সব দৈনিক পত্রিকা হতাহতদের নাম, বাবার নাম, বয়স, পেশা, কার-কোথায় গুলি লেগেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ ছাপায়। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ মতিউর ও রুস্তমের মৃত মুখের ছবি ছাপা হয়। সেদিন কোনো পত্রিকায় কোনো পথশিশুর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি।
আইকনিক ফটো : রশীদ তালুকদারের তোলা পথশিশুর ছবিটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার লেখনীর সঙ্গে ছবিটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করে। রশীদ তালুকদার ১৯৭৫ সালে সংবাদ ছেড়ে ইত্তেফাকে যোগদান দেন। এরপর ইত্তেফাকও ছবিটি প্রতি বছর প্রকাশ করে। অনেক দিন এ ছবির নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধান হয়নি। কোনো পত্রিকায় ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধও লেখা হয়নি। রশীদ তালুকদারও এই ছবি সম্পর্কে কোথাও কিছু লিখে যাননি। দীর্ঘ ৫৪ বছর শিশুটির কথা অজানাই রয়ে গেছে। খোঁজ মেলেনি বলে সবাই ধরে নিয়েছে শিশুটি সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গোলাম রাব্বানী তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে শিশুটির পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটির নাম মো. হোসেন আলী। সেই সূত্রেই পাওয়া যায় হোসেন আলীর খোঁজ।
হোসেন আলীর কথা : ৬৪ বছর বয়সী হোসেন আলী বলেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটি তিনিই। তার বক্তব্য, ‘ঊনসত্তরে আমার বয়স আছিল দশ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারে ডাকতেন পালোয়ান বইলা। ওই দিন জগন্নাথ কলেজের দিক থাইক্যা ছাত্রলীগের একটা মিছিল আইতেছিল। আমি তখন ফুলবাড়িয়া ইস্টিশনে থাকি। “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” স্লোগান শুইন্যা আমিও যোগ দিলাম ওই মিছিলে। মিছিলে আমার মতো কয়েকটি শিশুও আছিল। রেগওলা (স্ট্রাইপ) হাফশার্ট গায়ে ছেলেডা আমার পেছনে আছিল। মিছিল পলাশী ব্যারাক হইয়া শাহবাগের দিকে আইলো। আমি কিন্তু মিছিলের সামনে। গরমে ঘামাইয়া গেছি। তাই গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁধলাম। শাহবাগের সামনে আইসা দেখি, রেডিও অফিসের সামনে ইপিআর পজিশন লইয়া আছে। দুইবার মাইকিং করছে “চল যাও, চল যাও”। কে কার কথা শুনে? আমি জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছি। তিন-চারজন ছবি তুলতাছে। তিনবার বলার পর দেখি বন্দুক রেডি করতাছে। সাথে সাথে একটা গুলির আওয়াজ পাইলাম। দৌড়াইয়া তারের ঘের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। এরপর মন্দির, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট হয়ে জিন্নাহ অ্যাভিনিউর রুচিতা হোটেলে আইলাম। কাঙালি হিসেবে আমারে তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর অনেকে চিনতো। একদিন কয়েকজন আমারে পত্রিকার ছবি দেখাইয়া কইলো ‘তোরে তো পাঞ্জাবিরা মাইরালাইবো।’
হোসেন আলী বলেন, ‘আমি বহুদিন বহু লোকরে কইছি ওই শিশুটা আমি। আমি তো কাঙাল মানুষ, তাই আমার কথা কেউ শোনে না, পাত্তা দেয় না। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দীন ভাই তো এখনো বাঁইচা আছে। আমারে তাগো কাছে লইয়া যান।’ বুকে একটা কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আসল ছবিটার সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখেন। সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যাইবো।’ হোসেন আলীর ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বাবু বলেন, ‘ছোটবেলা বেলা থেকে বাবার মুখে এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। বাবার চুলের শেপটা দেখেন, মিল পাবেন।’
হোসেন আলীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দিতে। মফিজ উদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। পথশিশু পরিচয়ে শৈশব কাটে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে। ৭৭ সালে ২২ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শুরু করেন টোকানো কাগজের ব্যবসা। আটাশির বন্যায় দোকান তলিয়ে গেলে আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক দিন রিকশা চালিয়েছেন। এখন আট হাজার টাকা বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেকার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মান্ডার কদমতলী এলাকার ঝিলপাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে : ছবিটি কেমন করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই গল্প বলেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী টি কাশীনাথ। বাহাত্তরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফেয়ারে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নেগেটিভগুলো ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিল্লিতে যান ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ জহিরুল হক। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেন। জহিরুল হক সেই চিঠি পৌঁছান ভারতের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর হাতে। তথ্যমন্ত্রী ফটোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক টি কাশীনাথকে ডেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। কাশীনাথের তত্ত্বাবধানে ২০ ফুট বাই ৩০ ফুট সাইজে ছবিগুলো পরিবর্ধিত (এনলার্জ) করা হয়। রশীদ তালুকদারের তোলা ঊনসত্তরের পথশিশুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবিটি প্রদর্শন করা হয় স্টলের প্রবেশমুখে। ছবি দুটি দেখার জন্য মেলায় আসা লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্টলের সামনের ভিড় সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার এই চমকপদ তথ্যটি অনেক দিন এ দেশের মানুষের অজানা ছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) রিসোর্স পারসন হিসেবে টি কাশীনাথ বাংলাদেশে এসে এ গল্পটি করেন।
নীরব অভিমান : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালে রশীদ তালুকদারের কর্মজীবন শুরু। বাষট্টিতে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আগে তিন বছর ৮০ টাকা বেতনে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন পিআইডিতে। সংবাদে কাজ করেছেন টানা ১৩ বছর। এরপর তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার ঘটনা প্রভৃতির অসংখ্য ছবি তুলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অল রোভস প্রোগ্রামে প্রতি বছর বিশ্বের একজন সেরা ফটোসাংবাদিককে পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান রশীদ তালুকদার। তার তোলা ছবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এনসাইক্লোপিডিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের রাষ্ট্র তাকে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রের অন্যমনস্কতায় নীরব অভিমানে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণকালের এই রূপকার।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গড়ে উঠছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। এই সমুদ্রবন্দরে প্রবেশ করতে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নীল পানির চ্যানেল (জাহাজ চলাচলের পথ) দেখে মনে হবে যেন উন্নত কোনো দেশের বন্দর। এই নীল জলরাশির তীরেই গড়ে উঠবে উপমহাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। কিন্তু এই নীল পানি দেখে আশাবাদী হওয়ার বদলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (চবক) কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ। যার কারণ হলো কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত চ্যানেলের জন্য খরচ হওয়া প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার দায় পড়তে যাচ্ছে চবকের কাঁধে।
গত রবিবার মাতারবাড়ী ঘুরে দেখা যায়, ৩৫০ মিটার চওড়া ও ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল নির্মাণের কাজ শেষ। কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় জেটি নির্মাণও হয়ে গেছে, সেই জেটিতে ইতিমধ্যে ১১২টি জাহাজ ভিড়েছেও। কিন্তু চ্যানেলের জন্য চবককে পরিশোধ করতে হবে ৯ হাজার ৩৫০ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ঋণ হিসেবে রয়েছে ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ এবং বাংলাদেশ সরকারের ১ হাজার ৪২৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এই টাকা কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় খরচ করা হয়েছিল। আর কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্যই চ্যানেলটি নির্মাণ হয়েছিল। এখন যেহেতু এই চ্যানেলকে ব্যবহার করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠছে, তাই তা নির্মাণের সব খরচ চবককে পরিশোধ করতে হবে বলে গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবকে প্রধান করে একটি সাব কমিটি গঠন করা হয়, যে কমিটি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাছ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের কাছে চ্যানেলটি ও তা নির্মাণের ব্যয় হস্তান্তরের পদ্ধতি নির্ধারণ করবে।
কিন্তু এই টাকা পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছে চবক। এ বিষয়ে বন্দর কর্র্তৃপক্ষের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এই সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে জাইকার ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ ঋণের পরিশোধ শুরু হবে আগামী বছর থেকে। সেই হিসাবে প্রথম বছরে পরিশোধ করতে হবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা এবং পরবর্তী বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। শুধু কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় ঋণ নয়, মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের জন্য জাইকা থেকে ৬ হাজার ৭৪২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে চবক। এই টাকার বিপরীতে ২০২৯ সালে জাইকাকে দিতে হবে ১ হাজার ৮১৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা, পরে প্রতি বছর ঋণ ও সুদ বাবদ দিতে হবে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া মাতারবাড়ী বন্দরের ড্রেজিং বাবদ বছরে খরচ হবে প্রায় ৫০ কোটি এবং এই বন্দর পরিচালনায় প্রতি বছর ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে শুধু ঋণ শোধ বাবদ চবককে পরিশোধ করতে হবে ৪ হাজার ৪২৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে আগামী বছর লাগবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। বাকি টাকা পর্যায়ক্রমে ২০২৬ সাল থেকে প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া বে টার্মিনালের ব্রেক ওয়াটার ও চ্যানেল নির্মাণের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে চবক। অন্যদিকে চবকের বার্ষিক গড় আয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। তাহলে চবক এত টাকা কীভাবে পরিশোধ করবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
চবকের দাবি, চ্যানেল নির্মাণের খরচ যাতে তাদের কাঁধে দেওয়া না হয়। কিন্তু এই টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে জানিয়েছেন কয়লাবিদ্যুৎ (কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড সিপিজিসিবিএল) প্রকল্পের পরিচালক আবুল কালাম আজাদ। এ প্রসঙ্গে তিনি গতকাল সোমবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই চ্যানেল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নিমির্ত হয়েছে। এখন যেহেতু বন্দর কর্র্তৃপক্ষ চ্যানেল ব্যবহার করবে, তাহলে তো তাদের টাকা দিতেই হবে। আর এই টাকা তো ৪০ বছরে পরিশোধ করতে হবে।’
উল্লেখ্য, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। জাইকার অর্থায়নে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৬ মিটার ড্রাফট (গভীরতা) এবং ২৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল নির্মাণ হয় বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায়। কয়লাবিদ্যুতের চ্যানেলের ওপর ভিত্তি করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা যায় বলে জাইকা একটি প্রস্তাবনা দেয়। সেই প্রস্তাবনা ও পরে সমীক্ষার পর ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। আর এরই আওতায় চ্যানেলের প্রশস্ততা ১০০ মিটার বাড়ানোর পাশাপাশি গভীরতাও ১৮ মিটারে উন্নীত করা হয়। এ জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষ ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকার বাজেট একনেক থেকে অনুমোদন করে। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (নিজস্ব তহবিল) ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মাতারবাড়ীতে ৩৫০ মিটার দীর্ঘ ও ১৬ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের গভীরতা) জাহাজ ভিড়তে পারবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ২০০ মিটার দীর্ঘ ও ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। মাতারবাড়ী চালু হলে এর সঙ্গে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রাবন্দরের নেটওয়ার্ক আরও বাড়বে। ফলে গভীর সমুদ্রবন্দরের অভাব পূরণ করবে মাতারবাড়ী বন্দর।
আর কখনো রাজনীতিতে জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। মুচলেকা দিয়ে এ কথা বলেছে তারা। সংগঠনটির নেতারা আরও বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক দলের অংশও হবেন না তারা। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রকাশ্য বা গোপন কোনো সম্পর্কেই জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম।
হেফাজতে ইসলাম বেশ কিছু শর্তও দিয়েছে। শর্তে তারা বলেছে, হেফাজত নেতা মামুনুল হকসহ যেসব নেতা কারাবন্দি রয়েছেন তাদের সবাইকে ছেড়ে দিতে হবে এবং মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। আওয়ামী লীগ ও হেফাজতে ইসলাম গত বছর ১৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে এ মুচলেকা দেয় এবং এসব শর্ত বা দাবি জানায়।
আগে হেফাজত নেতারা তিন মন্ত্রীর সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেন। তারপর দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে মুচলেকা দেন। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা হেফাজতের মুচলেকা দেওয়ার কথা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন। সরকারের সহযোগী হিসেবে থাকার অঙ্গীকার করেছে হেফাজত।
১৪ দলের অন্যতম শরিক তরিকত ফেডারেশনের নেতা নজিবুল বশর মাইজভা-ারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতে ইসলামের চেয়ারম্যান তাকে জানিয়েছেন তারা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়; তারা রাজনীতি করবে না। কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে তারা জোটবদ্ধও হবে না।
হেফাজতে ইসলাম আরও কিছু শর্ত দিয়েছে, যেমন কাদিয়ানি সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে এবং বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর বৃহত্তম বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশকে (বেফাক) সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে থেকে হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার ও তাদের মুক্তির আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তবে মামুনুল হক এবং আরও কয়েকজনকে এখনই মুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছে সরকারি মহল। একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মামুনুলকে ছাড়তে হবে, যা সময়সাপেক্ষ।
সূত্রে আরও জানা গেছে, কাদিয়ানি সম্প্রদায় বিষয়ে হেফাজতের দাবি আপাতত আমলে নেওয়া হয়নি। কারণ, তাদের অমুসলিম ঘোষণা করা হলে বিদেশি চাপ আসবে। যে চাপ সামলানো প্রায় অসম্ভব। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন ঝামেলায় জড়ানো যাবে না বলে হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে। বেফাক ইস্যুতেও আপাতত কোনো উদ্যোগ নিতে চায় না সরকার। বেফাককে সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি মানাও আপাতত অসম্ভব, জানিয়েছে সরকার। তবে হেফাজত নেতাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, অন্য শর্তগুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে আরও বৈঠক হবে।
হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে, ধর্মীয় বিভিন্ন অপপ্রচার চলছে সরকারের বিরুদ্ধে; এসব ব্যাপারে কথা বলতে হবে তাদের। জামায়াতবিরোধী অবস্থান নিয়ে কাজ করতে হবে হেফাজতকে। হেফাজত নেতারা বলেছেন, জামায়াত ইস্যুতে তারা কোনো ছাড় দেবে না। জামায়াতকে তারা ইসলামের ধারক-বাহক মনে করে না।
বলা যায়, হেফাজতের সঙ্গে সরকারের রাজনৈতিক বোঝাপড়া হয়েছে। এটা একটা ‘পলিটিক্যাল ডিল অর আন্ডারস্ট্যান্ডিং’। জানা গেছে, এ সমঝোতার ভিত্তিতেই হেফাজতের বিরুদ্ধে ২০৩টি মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে এবং নেতারা জামিন পেতে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে পুলিশকে বিশেষ বার্তা দেওয়া হয়েছে। হেফাজত ইসলামী বাংলাদেশের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে সরকার।
২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় এখনো তদন্ত হচ্ছে ২০৩টি মামলার। অনেক দিন ধরেই তদন্ত হচ্ছে। কিন্তু সুরাহা করতে পারছে না তদন্তকারী সংস্থাগুলো। হেফাজত নেতাকর্মীদের অনেকে কারাগারেও আছেন। তবে বেশিরভাগ আসামি প্রকাশ্যে চলাফেরা করছেন।
পুলিশের পাশাপাশি হেফাজত নেতারা মামলাগুলো নিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত। তারা এগুলোর নিষ্পত্তি চান। এ নিয়ে কয়েক দফা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন হেফাজত নেতারা। সর্বশেষ গত ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে হয়েছে। বৈঠকে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির অনুরোধ জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীও তাদের অনুরোধ বিবেচনায় নিয়ে সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
সরকারের নির্দেশনা পেয়ে পুলিশও কাজ শুরু করে দিয়েছে। গত এক মাসে অন্তত ১০ জন নেতা জামিন পেয়েছেন। তারা যেকোনো সময় কারামুক্ত হবেন। তবে মামুনুল হক আপাতত মুক্ত হচ্ছেন না।
হেফাজত নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর তারা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারাও ‘সবুজ সংকেত’ দিয়েছেন। তারা বলেন, এসবের জন্যই সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় গিয়েছি আমরা। তবে সমঝোতার কথা সবিস্তারে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতের মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে মৌখিক নির্দেশনা পাওয়া গেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করার পরিকল্পনা আছে আমাদের। হেফাজত নেতারা সরকারের অঙ্গীকার করেছে, তারা রাজনৈতিক কর্মকা- চালাবেন না। শুধু ইসলাম নিয়ে কথা বলবেন। জামায়াতে ইসলামীর কর্মকা-ের সমালেচনাও করবে বলে সরকারের নীতিনির্ধারকদের আশ্বস্ত করেছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।
নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন তদন্তকারী কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পুলিশ সদর দপ্তর নির্দেশনা এসেছে। আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। মামলাগুলোর অনেক আসামি জামিনে আছে, কেউ কেউ জামিন ছাড়াই প্রকাশ্যে ঘুরছে। দীর্ঘদিন ধরে মামলাগুলোর নিষ্পত্তি না হওয়ায় সমালোচনাও হচ্ছে সবখানে। এগুলোর দ্রুত সুরাহা চাচ্ছি আমরাও।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছিল হেফাজতে ইসলাম। ওই বছরের ৫ মে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবরোধ করে তারা। একপর্যায়ে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়। সে সময় হেফাজতের বিপুলসংখ্যক কর্মী-সমর্থকের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। তারা রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে যানবাহন ভাঙচুর করে এবং বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। সহিংসতায় হতাহতের ঘটনাও ঘটে।
২০২১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার সফরের বিরোধিতা করে মাঠে নামে হেফাজতে ইসলাম। ২৬ মার্চ রাজধানীর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ এলাকায় বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় তাদের সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। সংঘর্ষে ১৯ জনের মৃত্যু হয় এবং পুলিশসহ সহস্রাধিক হেফাজত নেতাকর্মী আহত হয়। হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয় সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায়। এসব ঘটনায় সারা দেশে ১৫৪টি মামলা হয়। ওইসব মামলার কোনোটাতেই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।
হেফাজত ইসলামীর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিস দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মাসখানেক আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। বৈঠকে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় সবাই ছিলেন। বৈঠকে আমরা বলেছি, আমরা কোনো ধরনের রাজনীতি করি না। ইসলাম নিয়ে কাজ করি। একটি মহল আমাদের নামে অপবাদ দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি, আমরা রাজনীতি করছি না, আর করবও না।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশ রূপান্তরকে বলেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। আমরাও চাচ্ছি মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। হেফাজতের কেন্দ্রীয় এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারপ্রধানের সঙ্গে আমরা গত ১৭ ডিসেম্বর বৈঠক করেছি। তাতে সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। প্রায় ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট বৈঠক হয়েছে। অনেক কথা হয়েছে। আমাদের শর্তও তাকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, সমঝোতা ছাড়া কোনো কিছুরই সমাধান হয় না। আমরা চাই না সরকারের সঙ্গে আমাদের ভুল বোঝাবুঝি হোক। আমরা কথা বলেছি। সরকারপ্রধান ইতিবাচক হিসেবে বিষয়টি আমলে নিয়েছেন।
রাজপথে খালি পায়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক পথশিশু। পেছনে বিক্ষুব্ধ মিছিল। শিশুটির পরনে চার পকেটের হাফপ্যান্ট; গেঞ্জিটা কোমরে বাঁধা। কণ্ঠে স্বৈরতন্ত্রের কবর রচনার হুঙ্কার। দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিস্পর্ধী সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পাঁজরগুলো যেন শরীরের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা অপ্রতিরোধ্য শিশুটি সেদিন সবার নজর কাড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের এ প্রতিবাদী মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার।
সেই সময়ে দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদচিত্রী ছিলেন তিনি। ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষীর আলোকচিত্রী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এ ছবি। ছবিটি আমাদের সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশুটির চোখ-মুখের ভাষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের কথা। ছবিটির দৃশ্য-ভাষা এতই শক্তিশালী যে, এখনো মানুষের মনে শিহরন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছাত্রসমাজের ১১ দফা মুক্তিসনদকে সামনে নিয়ে ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি দাবানলের মতো জ্বলে উঠে পূর্ব বাংলা ও তার রাজধানী ঢাকা। এর ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঢাকার রাজপথে নামে জনতার ঢল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালাকেও ম্লান করে দেয় সেদিনের জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিদল। অধিকার-সচেতন জনতার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর আসন। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গর্জে উঠে স্বৈরাচারের বন্দুক। বুলেটের আঘাতে রাজপথে ঝরে পড়ে কয়েকটি প্রাণ। শহীদের লাশ নিয়ে রাজপথে মিছিলের ঢল নামে। রাত ৮টায় কারফিউ জারির মাধ্যমে জনতাকে নিবৃত্ত করার সর্বশেষ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাতের নৈঃশব্দ্যকে প্রকম্পিত করে মুক্তিপাগল জনতা। এর কয়েক দিন পর জনতার অদম্য আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী সরকারকে পালাতে হয়। সমাধি রচিত হয় আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের।
সেদিন ছিল আধাবেলা হরতাল। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে পুলিশ দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফা গুলিবর্ষণ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে। দুপুরে দ্বিতীয় দফা। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক ও নোয়াখালীর নান্দিয়াপাড়া হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ রুস্তম আলী। প্রেস ট্রাস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে আহত হয় ২১ জন। পরদিন সব দৈনিক পত্রিকা হতাহতদের নাম, বাবার নাম, বয়স, পেশা, কার-কোথায় গুলি লেগেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ ছাপায়। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ মতিউর ও রুস্তমের মৃত মুখের ছবি ছাপা হয়। সেদিন কোনো পত্রিকায় কোনো পথশিশুর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি।
আইকনিক ফটো : রশীদ তালুকদারের তোলা পথশিশুর ছবিটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার লেখনীর সঙ্গে ছবিটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করে। রশীদ তালুকদার ১৯৭৫ সালে সংবাদ ছেড়ে ইত্তেফাকে যোগদান দেন। এরপর ইত্তেফাকও ছবিটি প্রতি বছর প্রকাশ করে। অনেক দিন এ ছবির নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধান হয়নি। কোনো পত্রিকায় ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধও লেখা হয়নি। রশীদ তালুকদারও এই ছবি সম্পর্কে কোথাও কিছু লিখে যাননি। দীর্ঘ ৫৪ বছর শিশুটির কথা অজানাই রয়ে গেছে। খোঁজ মেলেনি বলে সবাই ধরে নিয়েছে শিশুটি সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে শিশুটির পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটির নাম মো. হোসেন আলী। সেই সূত্রেই পাওয়া যায় হোসেন আলীর খোঁজ।
হোসেন আলীর কথা : ৬৪ বছর বয়সী হোসেন আলী বলেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটি তিনিই। তার বক্তব্য, ‘ঊনসত্তরে আমার বয়স আছিল দশ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারে ডাকতেন পালোয়ান বইলা। ওই দিন জগন্নাথ কলেজের দিক থাইক্যা ছাত্রলীগের একটা মিছিল আইতেছিল। আমি তখন ফুলবাড়িয়া ইস্টিশনে থাকি। “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” স্লোগান শুইন্যা আমিও যোগ দিলাম ওই মিছিলে। মিছিলে আমার মতো কয়েকটি শিশুও আছিল। রেগওলা (স্ট্রাইপ) হাফশার্ট গায়ে ছেলেডা আমার পেছনে আছিল। মিছিল পলাশী ব্যারাক হইয়া শাহবাগের দিকে আইলো। আমি কিন্তু মিছিলের সামনে। গরমে ঘামাইয়া গেছি। তাই গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁধলাম। শাহবাগের সামনে আইসা দেখি, রেডিও অফিসের সামনে ইপিআর পজিশন লইয়া আছে। দুইবার মাইকিং করছে “চল যাও, চল যাও”। কে কার কথা শুনে? আমি জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছি। তিন-চারজন ছবি তুলতাছে। তিনবার বলার পর দেখি বন্দুক রেডি করতাছে। সাথে সাথে একটা গুলির আওয়াজ পাইলাম। দৌড়াইয়া তারের ঘের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। এরপর মন্দির, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট হয়ে জিন্নাহ অ্যাভিনিউর রুচিতা হোটেলে আইলাম। কাঙালি হিসেবে আমারে তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর অনেকে চিনতো। একদিন কয়েকজন আমারে পত্রিকার ছবি দেখাইয়া কইলো ‘তোরে তো পাঞ্জাবিরা মাইরালাইবো।’
হোসেন আলী বলেন, ‘আমি বহুদিন বহু লোকরে কইছি ওই শিশুটা আমি। আমি তো কাঙাল মানুষ, তাই আমার কথা কেউ শোনে না, পাত্তা দেয় না। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দীন ভাই তো এখনো বাঁইচা আছে। আমারে তাগো কাছে লইয়া যান।’ বুকে একটা কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আসল ছবিটার সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখেন। সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যাইবো।’ হোসেন আলীর ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বাবু বলেন, ‘ছোটবেলা বেলা থেকে বাবার মুখে এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। বাবার চুলের শেপটা দেখেন, মিল পাবেন।’
হোসেন আলীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দিতে। মফিজ উদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। পথশিশু পরিচয়ে শৈশব কাটে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে। ৭৭ সালে ২২ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শুরু করেন টোকানো কাগজের ব্যবসা। আটাশির বন্যায় দোকান তলিয়ে গেলে আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক দিন রিকশা চালিয়েছেন। এখন আট হাজার টাকা বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেকার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মান্ডার কদমতলী এলাকার ঝিলপাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে : ছবিটি কেমন করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই গল্প বলেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী টি কাশীনাথ। বাহাত্তরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফেয়ারে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নেগেটিভগুলো ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিল্লিতে যান ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ জহিরুল হক। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেন। জহিরুল হক সেই চিঠি পৌঁছান ভারতের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর হাতে। তথ্যমন্ত্রী ফটোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক টি কাশীনাথকে ডেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। কাশীনাথের তত্ত্বাবধানে ২০ ফুট বাই ৩০ ফুট সাইজে ছবিগুলো পরিবর্ধিত (এনলার্জ) করা হয়। রশীদ তালুকদারের তোলা ঊনসত্তরের পথশিশুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবিটি প্রদর্শন করা হয় স্টলের প্রবেশমুখে। ছবি দুটি দেখার জন্য মেলায় আসা লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্টলের সামনের ভিড় সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার এই চমকপদ তথ্যটি অনেক দিন এ দেশের মানুষের অজানা ছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) রিসোর্স পারসন হিসেবে টি কাশীনাথ বাংলাদেশে এসে এ গল্পটি করেন।
নীরব অভিমান : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালে রশীদ তালুকদারের কর্মজীবন শুরু। বাষট্টিতে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আগে তিন বছর ৮০ টাকা বেতনে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন পিআইডিতে। সংবাদে কাজ করেছেন টানা ১৩ বছর। এরপর তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার ঘটনা প্রভৃতির অসংখ্য ছবি তুলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অল রোভস প্রোগ্রামে প্রতি বছর বিশ্বের একজন সেরা ফটোসাংবাদিককে পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান রশীদ তালুকদার। তার তোলা ছবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এনসাইক্লোপিডিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের রাষ্ট্র তাকে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রের অন্যমনস্কতায় নীরব অভিমানে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণকালের এই রূপকার।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
নাগরিকত্ব বিষয়ক জটিলতার জেরে সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে দেশের উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ ও পার্লামেন্টে আসন হারিয়েছেন নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী রবি লামিছানে। শুক্রবারের রায়ে আদালত জানিয়েছে, এই মুহূর্তে নেপালের নাগরিকত্বও নেই তার।
সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র বিমল পৌদেল বার্তা সংস্থা এএফপিকে এ সম্পর্কে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের রায় অনুযায়ী, ২০২২ সালের জাতীয় নির্বাচনে নাগরিকত্ব বিষয়ক আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গেছে রবি লামিছানের বিরুদ্ধে। এ কারণে এখন থেকে আর পার্লামেন্টের সদস্য নন তিনি।’
নেপালের এক সময়ের জনপ্রিয় টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব রবি লামিছানে দেশটির রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল ইনডিপেনডেন্ট পার্টির শীর্ষ নেতা। ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর নেপালের পার্লামেন্ট প্রতিনিধিসভার নির্বাচনে তার দল ২০টি আসনে জয়ী হয়েছে। তারপর গত ডিসেম্বরে ক্ষমতাসীন জোট সরকারে নিজের দলসহ যোগ দিয়ে নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন লামিছান।
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিত্ব ছিল লামিছানের; কিন্তু নেপালের সংবিধানে দ্বৈত নাগরিকত্ব স্বীকৃত না হওয়ায় ২০১৮ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করে নির্বাচন করেছিলেন তিনি। শুক্রবারের রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, নিয়ম অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর নেপালের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার কথা ছিল লামিছানের; কিন্তু তা করেননি তিনি। ফলে এই মুহূর্তে নেপালের নাগরিকও নন লামিছান। এদিকে, শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর লামিছানের প্রতিক্রিয়া জানতে তার মন্ত্রণালয়ের দপ্তরে গিয়েছিলেন সাংবাদিকরা; কিন্তু লামিছানে তাদের বলেন, ‘যেহেতু এই মুহূর্তে আমি কোনো দেশেরই নাগরিক নই, তাই আদালতের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো মন্তব্য করা আমার পক্ষে উচিত নয়, সম্ভবও নয়।’