
মুন্সীগঞ্জ শহরের উপকণ্ঠে মুক্তারপুর পুরাতন ফেরিঘাটে বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষের সময় গুলিতে নয়, ইটের আঘাতে যুবদলকর্মী শহিদুল ইসলাম শাওনের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছে পুলিশ। গতকাল বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ মাহফুজুর রহমান আল মামুন এমনটা দাবি করেন। তবে পুলিশ সুপারের দেওয়া এ তথ্য মিথ্যা ও বানোয়াট বলে দাবি করেছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপারের সম্মেলন কক্ষে গতকাল দুপুর ১২টার দিকে সংবাদ সম্মেলন শুরু হয়। সেখানে পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমান আল মামুন গত ২১ সেপ্টেম্বরের সংঘর্ষকে বিএনপির অন্তঃকোন্দল হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি বলেন, পুলিশের ওপর বিএনপি নেতাকর্মীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপের একপর্যায়ে যুবদলকর্মী শহিদুল ও তার সঙ্গে থাকা বিএনপির আরেক কর্মী পেছন থেকে ছোড়া ঢিলে আঘাত পান। পরে আত্মীয়স্বজন শাওনকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করান। পরদিন রাত ৯টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেখানে তিনি মারা যান।
পুলিশ সুপার বলেন, ‘ওই দিন বিকেলে পুরাতন ফেরিঘাটে সদর উপজেলা বিএনপি ও মুন্সীগঞ্জ পৌর বিএনপির নেতাকর্মীরা অবৈধ অনির্ধারিত সমাবেশ ও ঝটিকা মিছিল বের করে। এ সময় তাদের অন্তঃকোন্দলের জের ধরে নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু হয়। তারা শ্রমিক লীগের অফিস ভাঙচুর করলে জনমনে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। এমন পরিস্থিতিতে ঘটনাস্থলে পুলিশ উপস্থিত হলে বিএনপি নেতাকর্মীরা মারমুখী হয়ে ওঠে। এ সময় চারদিক থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। ইটের আঘাতে অন্তত ১৬ পুলিশ সদস্য আহত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে।’
মৃত্যুর পর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে শাওনের মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির কাজ শেষ হয় উল্লেখ করে মাহফুজুর রহমান আল মামুন বলেন, ‘ময়নাতদন্তের জন্য শাওনের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে হস্তান্তর করা হয়। এরপর ফরেনসিক বিভাগ লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করতে ভিসেরা পরীক্ষা করে। ভিসেরা পরীক্ষায় কোনো বিষ নেই মর্মে মতামত দেওয়া হয়। সুরতহাল ও ভিসেরা প্রতিবেদন পর্যালোচনায় ময়নাতদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে মাথায় আঘাতের কারণে শাওনের মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মাথার পেছনে থেঁতলানো আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এছাড়া গান শুটের কোনো আঘাত নেই। ইটের আঘাতেই শহিদুলের মৃত্যু হয়েছে।’
নিহত শহিদুল ইসলাম শাওন (২৩) মুন্সীগঞ্জের মিরকাদিম পৌরসভার মুরমা এলাকার ছোয়াব আলীর ছেলে। তিনি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালক ছিলেন। পাশাপাশি মিরকাদিম পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের কর্মী হিসেবে দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতেন।
জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ও দলীয় নেতাকর্মী ‘হত্যা’র প্রতিবাদে মুন্সীগঞ্জ শহরের পাশে মুক্তারপুরে গত ২১ সেপ্টেম্বর বেলা ৩টার দিকে বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচির আয়োজন করে জেলা বিএনপি। সেখানে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশ ও সাংবাদিকসহ অন্তত ৫০ জন আহত হয়। সংঘর্ষে যুবদলকর্মী শাওন ও বিএনপি সমর্থক জাহাঙ্গীর মাদবর (৩৮) গুরুতর আহত হন। তারা দুজনই পুলিশের ছোড়া গুলিতে আহত হন বলে দাবি তাদের স্বজন ও বিএনপি নেতাদের। এই সংঘর্ষের ঘটনায় পরদিন রাতে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দুটি আলাদা মামলা হয়। এসব মামলায় দলটির ১ হাজার ৩৬৫ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। দুটি মামলায় এরই মধ্যে ২৪ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশ সুপারের তথ্য বানোয়াট দাবি রিজভীর : বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘মুন্সীগঞ্জের যুবদলকর্মী শহীদুল ইসলাম শাওন পুলিশের গুলিতে মারা যাননি মর্মে মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) যে বক্তব্য দিয়েছেন তা মিথ্যা, বানোয়াট। পুলিশের গুলিতেই যে শাওন মারা গেছেন তার প্রমাণ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকদের দেওয়া ডেথ সার্টিফিকেট।’ গতকাল খুলনায় বিএনপি নেতা মরহুম আজিজুল হাসান দুলুর রাজনৈতিক জীবনের ওপর খুলনা জেলা ও মহানগর বিএনপির উদ্যোগে আয়োজিত এক স্মরণসভায় তিনি এসব কথা বলেন।
রিজভী বলেন, ‘মুন্সীগঞ্জের যুবদল নেতা শাওনের মৃত্যু হলো পুলিশের গুলিতে। তার বুক-মুখ গুলিতে ঝাঁঝরা হলো, সবাই দেখেছে। অথচ মুন্সীগঞ্জের পুলিশের এসপি বলছেন শাওন ঠেলাঠেলিতে নেতাকর্মীদের ছোড়া ঢিলে লেগে মারা গেছেন। আসলে তারা মিথ্যাচার করছে। এ ধরনের বিভ্রান্তিকর মিথ্যাচার চাপিয়ে দিচ্ছে। তারা মুন্সীগঞ্জে আক্রমণ করেছে। নারায়ণগঞ্জ, ভোলায় আক্রমণ করেছে। অধিকার আদায়ের প্রশ্নে যারা নির্ভীক আন্দোলন করছে সত্যিকারের সৈনিক তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে।’’
বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের মেছের আলীর জমি নিলাম হয়ে গিয়েছিল খাজনা দিতে না পারায়। নিলামের আগে ১৯৫২ সালে অর্থ জারি (মানি এক্সিকিউশন) মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। সেই যে মামলার শুরু, তা আজো শেষ হয়নি। এক আদালত থেকে আরেক আদালতে ঘুরতে ঘুরতে মেছের আলী, নিলামে জমি কিনে মামলার বিবাদী হওয়া আবদুর রশিদ তালুকদার ও তাদের সন্তানসহ মামলার কার্যক্রমে যুক্ত থাকা অন্তত ৯ জন মারা গেছেন।
নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত এসে ঝুলে থাকা এ দেওয়ানি মামলার বয়স এখন ৭০ বছর।
এ রকম অনেক দেওয়ানি মামলায় বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ যায় কিন্তু বাদী, বিবাদীদের অনেকেই বিচারের শেষ দেখে যেতে পারেন না। উত্তরসূরিদের রেখে যাওয়া মামলায় পক্ষভুক্ত হন পরবর্তী প্রজন্ম। এক মামলা থেকে আরেক মামলার উৎপত্তি। অধস্তন আদালত থেকে উচ্চ আদালত। ফের অধস্তন আদালত। মামলা চালাতে গিয়ে অনিঃশেষ দুর্ভোগের পাশাপাশি নিঃস্ব হয়ে যান বিচারপ্রার্থী।
আইন ও বিচারসংশ্লিষ্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশের উচ্চ ও অধস্তন আদালতে প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ দেওয়ানি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
আদালত ও বিচারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা প্রায়ই বলেন, দেওয়ানি মামলার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। এমন পরিস্থিতিতে উদ্বেগজনক উল্লেখ করে জ্যেষ্ঠ আইনবিদরা বলছেন, খুন, মারামারিসহ ফৌজদারি অপরাধের বড় একটি কারণ ভূমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ ও মামলা। দ্রুত এ সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ হতাশ কণ্ঠে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই যে দিনের পর দিন শুনানির তারিখ পড়ে। বিচারপ্রার্থী ফিরে যান। এটা তো ঠিক না। আমরা যদি এটা বুঝি যে মামলা এভাবে ঝুলিয়ে রাখা উচিত নয় তাহলে দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব। আর যদি এ যুক্তি না মানি, মামলা দীর্ঘায়িত হয় তাহলে তো তা চলতেই থাকবে।’
প্রবীণ এ আইনবিদ আরও বলেন, ‘আইনটা হয়তো পুরনো। কিন্তু আছে তো। প্রশ্ন হলো এটি সঠিকভাবে প্রয়োগ হচ্ছে কি না? এখন বিচারসংশ্লিষ্ট সবার মানসিকতার আরও পরিবর্তন হলেই শুধু সমাধান হতে পারে।’ সমাধান হিসেবে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) ওপর জোর দেন তিনি।
মেছের আলীর মামলার নথি ঘেঁটে দেখা যায়, মোরেলগঞ্জের চালিতাবুনিয়া মৌজায় চারটি দাগে ২ দশমিক ৯৯ একর জমির খাজনা না দেওয়ায় ১৯৫২ সালে অর্থ জারির মামলা হয়। তারপরও খাজনা না দেওয়া পরের বছরের ২২ জানুয়ারি ওই সম্পত্তি নিলাম হয়। নিলামে ওই জমি কিনে নেন আবদুর রশিদ তালুকদার। এ নিলাম আদেশ বাতিল চেয়ে ১৯৭৬ সালের ২৬ জানুয়ারি বাগেরহাটের মুন্সেফ আদালতে দেওয়ানি বিবিধ (মিস কেস) মামলা করেন মেছের আলী। এতে রশিদ তালুকদারকে বিবাদী করা হয়। ১৯৮০ সালের ২৮ জানুয়ারি মুন্সেফ আদালত এক রায়ে নিলাম বিক্রির আদেশ বাতিল করে দেয়। পরে ১৯৮৪ সালে এ রায়ের বিরুদ্ধে খুলনা জেলা জজ আদালতে আপিল করেন রশিদ। ২০০৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর খুলনা জেলা অতিরিক্ত জজ আদালত আপিল মঞ্জুর করে রায় দিলে ওই নিলাম বিক্রি বহাল থাকে। ইতিমধ্যে মেছের আলী মৃত্যুবরণ করায় তার উত্তরাধিকারী আবদুল হামিদ শেখসহ কয়েকজন আপিলের রায় চ্যালেঞ্জ করে ওই বছর নভেম্বরে হাইকোর্টে সিভিল রিভিশন (দেওয়ানি নিরীক্ষণ) মামলা করেন। ওই বছরের ৬ নভেম্বর হাইকোর্ট এক রুলে রশিদের উত্তরাধিকারী ও অন্যদের কারণ দর্শানোর রুল দেয়। এতে আপিলের রায় কেন বাতিল করা হবে না তা জানতে চায় হাইকোর্ট। ২০০৫ সালে রুলের জবাব দেয় বিবাদীপক্ষ। তবে হাইকোর্টে মামলাটি আসার আগেই মারা যান প্রথম বিবাদী রশিদ তালুকদার।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর তথ্যমতে, এ মামলায় ১৯৫৩, ১৯৭৬ ও ১৯৮০ সালে অধস্তন আদালতের এলসিআর (লোয়ার কোর্ট রেকর্ড) নথির হদিস মিলছে না। ফলে ১৮ বছরের বেশি সময় ধরে মামলাটি হাইকোর্টে অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে। উত্তরাধিকারী, ক্রয়সূত্রে মামলায় পক্ষভুক্ত হয়েছিলেন ২৫ জন।
হাইকোর্টে এক বিবাদীপক্ষের (মজিবুর রহমান ইতিমধ্যে মারা গেছেন) আইনজীবী মোশাররফ হোসেন মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতায় দুপক্ষই ত্যক্ত-বিরক্ত। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। কোনোপক্ষই এখন মামলার খোঁজ নেয় না। তারা আপস কিংবা সমঝোতায় যাবেন। কিন্তু এতেও তো আদালতের সম্মতি, সময় ও নথি লাগবে।’ তিনি বলেন, ‘দেশে দেওয়ানি মামলার যে বিচার কার্যক্রম সেটি যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। একেক ধাপের পর একেক ধাপ, একটি মামলা থেকে আরও মামলা চলে বছরের পর বছর। এ নিয়ে চিন্তাভাবনার সময় এসেছে।’
প্রয়াত বিবাদী মজিবুর রহমানের ছেলে এনামুল হক মোবাইল ফোনে হতাশ কণ্ঠে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। আমরা নিজেদের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করছি।’
আড়াই বছরে মামলা বেড়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার : ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত উচ্চ ও অধস্তন আদালতে অনিষ্পন্ন দেওয়ানি, ফৌজদারি ও অন্যান্য মামলা ছিল ৩৬ লাখ ৮৪ হাজার ৭২৮টি। এর মধ্যে বিচারিক আদালতে ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৬৭৮, হাইকার্টে ৯৭ হাজার ৬১৬ এবং আপিল বিভাগে ১৫ হাজার ৫৩৩ মামলা। তখনকার হিসাবে সব মিলিয়ে মোট দেওয়ানি মামলা ছিল ১৪ লাখ ৭৮ হাজার ৪২৭ মামলা। সম্প্রতি যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে গত জুন পর্যন্ত অধস্তন আদালতে ১৫ লাখ ৪৭ হাজার ৩৮২, হাইকোর্টে ৮৯ হাজার ২০৭টি এবং আপিল বিভাগে ১১ হাজার ৯৭৮টিসহ ১৬ লাখ ৪৮ হাজার ৫৬৭টি দেওয়ানি মামলা বিচারাধীন। অর্থাৎ গত জুন পর্যন্ত আড়াই বছরে উচ্চ ও অধস্তন আদালতে অনিষ্পন্ন মামলা বেড়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার ১৪০টি।
সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পৃথিবীর সব দেশেই দেওয়ানি মামলায় একটু সময় লাগে। কিন্তু এত বেশি কোথাও লাগে না। ব্রিটিশদের তৈরি এ আইন দিয়েই কিন্তু একসময় স্বল্প সময়ে মামলা নিষ্পত্তি হতো। এখন কেন হচ্ছে না সেটিই প্রশ্ন?’ বিচারক স্বল্পতাকে মূল কারণ চিহ্নিত করে তিনি বলেন, ‘যেখানে পাঁচ-ছয় হাজার বিচারক দরকার সেখানে প্রেষণ বাদে আদালতে কর্মরত আছেন ১ হাজার ৬০০ জন। কিছু ক্ষেত্রে বিচারকদের দক্ষতার ঘাটতি ও আইনজীবীদের দায়ের প্রশ্ন তো আসেই। কিন্তু বিচারকদের দোষ দিয়েও তো লাভ নেই। তাদের প্রচুর চাপ নিতে হয়।’
অ্যাটর্নি জেনারেল বিদেশ সফরে থাকায় এ পদে এখন দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এসএম মুনীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আসলে ভূমির রেকর্ড জটিলতা থেকেই প্রায় সব মামলার উৎপত্তি। এখন যেসব বিষয় বিরোধ তৈরি করে সেসব আইন পরিবর্তন করতে হবে। ব্রিটিশদের তৈরি দেওয়ানি আইন এখনকার পরিস্থিতি ও চিন্তাভাবনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।’
যেভাবে বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা : উচ্চ ও অধস্তন আদালতে নিয়মিত দেওয়ানি মামলা পরিচালনা করেন এমন আটজন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছেন এ প্রতিবেদক। তারা বলেন, মামলা শুরুর পর অন্তত ১০ বছরের মধ্যে নিষ্পত্তির নজির খুব বেশি নেই। এ ছাড়া প্রচলিত আইনে বিচারিক প্রক্রিয়া একটু সময়সাপেক্ষ। বাদীর আরজির (ফাইলিং) পর বিবাদীকে নোটিস বা সমন পাঠানো এবং জবাব দাখিলে চলে যায় দীর্ঘ সময়। এরপর দুপক্ষের বিরোধীয় বিষয় নিয়ে ইস্যু (মামলার কারণসহ বিবিধ) গঠন থেকে শুরু করে উভয়পক্ষের সাক্ষী হাজির ও নথি দাখিল এবং যুক্তিতর্কের শুনানির জন্য তারিখের পর তারিখ পড়ে। এরপর রায় পেলেও ডিক্রি জারি মামলা চলে বছরের পর বছর। এ ছাড়া অধস্তন এখতিয়ারসম্পন্ন দেওয়ানি আদালতের রায় ও ডিক্রির পর জেলা জজ আদালতে আপিল হয়। আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল মামলা (সিভিল রিভিশন) করে সংক্ষুব্ধ পক্ষ। এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যায় সংশ্লিষ্ট পক্ষ। আপিল বিভাগের রায়ের পর সিভিল রিভিউ (রায় পুনর্বিবেচনা) মামলা হয়। এ ছাড়া বিচারের পর্যায়ে আদালতের নিষেধাজ্ঞা, রিসিভার (তত্ত্বাবধানকারী) নিয়োগ বা কোনো আদেশের বিরুদ্ধে প্রতিকার পেতে সংশ্লিষ্ট আদালত কিংবা উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন পক্ষরা। এভাবে এক মামলা থেকে সৃষ্টি হয় আরেক মামলা। অধস্তন আদালত থেকে উচ্চ আদালত। ফের অধস্তন আদালত। এভাবেই চলে বছরের পর বছর।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল মেডিয়েশন সোসাইটির (বিমস) সভাপতি অ্যাডভোকেট এসএন গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আইনে কিন্তু বলা আছে সাক্ষ্য গ্রহণের আগে-পরে তিনবার করে সময় নেওয়া যাবে। কিন্তু এ বিধান তো কেউ মানছেন না। যদি দেওয়ানি আইনের বিধান সঠিকভাবে মেনে চলা হয় তাহলে ১৫০ দিনের মধ্যে অধস্তন আদালতে মামলা নিষ্পত্তি সম্ভব। আর যদি আইনজীবী ও বিচারকরা আরও আন্তরিক ও দায়িত্বশীল না হন তাহলে ৭০ বছর কেন, ১০০ বছরেও মামলা নিষ্পত্তি হবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে মেডিয়েশন (মধ্যস্থতা) বা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির পদ্ধতিকে কাজে লাগানোর এখনই উপযুক্ত সময়। না হলে বিচারপ্রার্থীর দুর্ভোগ আরও বাড়বে।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী চঞ্চল কুমার বিশ্বাস দেশ রূপান্তরকে বলেন, এ প্রযুক্তির যুগেও সমন জারি ও জবাব দাখিলে বছরের পর বছর চলে যায়। দেখা গেল, একপক্ষের গরহাজিরায় মামলা একতরফা নিষ্পত্তি হয়। অন্যপক্ষ এসে আবার দরখাস্ত করে মামলা পুনরুজ্জীবিত করে। আপিল শুনানি ও শেষ হওয়ার পরও একই অবস্থা হয়। তিনি বলেন, ‘ফৌজদারি বিচারে কতদিনের মধ্যে অভিযোগপত্র, বিচার করতে হবে সেটি বলা আছে। কিন্তু দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা নেই। এ জন্য আইনকে আরও সুস্পষ্ট করা উচিত।’
হিমালয়ের বুকে ফুটবলের ফুল ফুটিয়ে আসা নারী ফুটবলাররা সিক্ত হচ্ছেন একের পর এক সংবর্ধনায়। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ অনেক সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠান থেকেই তারা পাচ্ছেন আর্থিক পুরস্কার ও সম্মাননা। তবে গতকাল বুধবার রূপায়ণ সিটি উত্তরার আয়োজনে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সানজিদা-কৃষ্ণাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, সেটা বোধহয় অন্য কোথাও হয়নি। ব্যান্ড পার্টির বাজনায় লালগালিচা বিছানো পথ ধরে তারা প্রত্যেকে যখন হেঁটে আসছিলেন, দেখাচ্ছিল রানীর মতোই।
জমকালো আয়োজনে ফুটবলের রানীদের বরণ করে নিয়েছে রূপায়ণ সিটি উত্তরা। ঢাকার বুকে সাজানো-গোছানো এক স্বপ্ন শহর, দেশের প্রথম প্রিমিয়াম গেটেড কমিউনিটি কাল সেজেছিল রঙিন আলোর রোশনাইতে। অবশ্য কৃত্রিম সেই আলো ঢাকা পড়ে গেছে সাফজয়ী মেয়েদের হাসিমুখের আভায়। সেই হাসিটা আরও বড় হয়েছে যখন রূপায়ণ গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খাঁন মুকুল তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন ৩০ লাখ টাকার চেক। রূপায়ণ সিটি উত্তরায় গতকাল সন্ধ্যায় আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, ঢাকা-১৮ আসনের সংসদ সদস্য হাবিব হাসান, রূপায়ণ গ্রুপের কো-চেয়ারম্যান মাহির আলী খাঁন রাতুল, রূপায়ণ গ্রুপের উপদেষ্টা ও সাবেক জাতীয় ফুটবলার আব্দুল গাফফারসহ রূপায়ণ গ্রুপের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
নিজে ফুটবলার ছিলেন বলেই বোধহয় ফুটবলের প্রতি তার গভীর অনুরাগ। লিয়াকত আলী খাঁন মুকুল খেলেছেন ইস্টএন্ড ক্লাবের হয়ে, আবাহনীর জন্য ট্রায়ালে গিয়ে আঘাত পাওয়াতে দীর্ঘ হয়নি খেলোয়াড়ি জীবন। জড়িয়েছেন আবাসন ব্যবসার সঙ্গে। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল শহরে আবাসনের মতো কঠিন সমস্যার সমাধান নিয়ে কাজ করতে করতেও ফুটবলের প্রতি তার অনুরাগ কমেনি। সম্পৃক্ত আছেন শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রের সঙ্গে। তারই সুযোগ্য পুত্র, রূপায়ণ গ্রুপের কো-চেয়ারম্যান মাহির আলী খাঁন রাতুল বাবার ব্যবসাকে করেছেন সম্প্রসারিত। সেই সঙ্গে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ফুটবলপ্রেমটাও তিনি হারিয়ে ফেলেননি কর্মব্যস্ততায়। কাল রূপায়ণ সিটি উত্তরায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বাবার খেলোয়াড়ি জীবনের কথা বলতে গিয়ে হয়েছেন আবেগাপ্লুত, তেমনি জানিয়েছেন মঞ্চে যদি তার পায়ে একটা বল থাকত তাহলে আরও ভালো লাগত!
‘আমার স্কুলজীবনে শিক্ষক-শিক্ষিকা, বন্ধুবান্ধব সবাই আমাকে চিনত ফুটবলের মাধ্যমে। আমি পেশাদার ফুটবলার না হলেও পেশাদার ফুটবলে কী আন্তরিকতা লাগে, আমাদের এ মেয়েরা কী পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করেছেন, কত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এখানে এসেছেন, তা আমরা একটু হলেও উপলব্ধি করতে পারি।’
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করার প্রেক্ষাপট জানিয়ে মাহির আলী খাঁন রাতুল বলেন, ‘আমাদের অনেক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রূপায়ণের অবদান আবাসন খাতে সবচেয়ে বেশি। দেশের বাইরে গেলে আমরা উন্নতমানের আবাসন প্রকল্প দেখতে পাই। সেসব দেখে আমাদের মনে হয়েছিল, আমরা যদি দেশেও এরকম উন্নত আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি তাহলে আমরাও বিশ্বের বুকে পরিচয় দিতে পারব যে, আমরা বাংলাদেশিরাও উন্নতমানের আবাসন গড়ে তোলার সক্ষমতা রাখি। রূপায়ণ সিটি করা আমাদের স্বপ্ন ছিল, রূপায়ণ সিটি বাংলাদেশের প্রথম প্রিমিয়াম গেটেড কমিউনিটি, যেখানে জীবনযাপনের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা আছে। আমরা রূপায়ণ সিটিতে এজন্যই অনুষ্ঠানটি আয়োজন করেছি যেন যেভাবে নারী দল বিশ্বের বুকে আমাদের মাথা উঁচু করেছে তেমনি আমরাও তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই এবং বলতে চাই বাংলাদেশের আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরাও কোনো অংশে কম নয়।’
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জানান, দেশের খেলাধুলার মান উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করছে সরকার। বলছিলেন, ‘আমরা প্রতিটি উপজেলায় শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম বানিয়ে দিচ্ছি। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন প্রায় ৪৫০ কোটি টাকার একটি পরিকল্পনা দিয়েছে যেখানে চারটি ফুটবল একাডেমি তারা করতে চায়। মেয়েদের দলের এ সাফল্যে আমরা একাডেমির সংখ্যা আরও দুটি বাড়িয়েছি। কক্সবাজারে ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পাশে ফুটবল স্টেডিয়ামও হবে। পূর্বাচলেও শেখ হাসিনা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পাশে ফুটবল স্টেডিয়াম করার পরিকল্পনা রয়েছে।’
অনুষ্ঠানের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল জানান, একাডেমিগুলো হবে রাজশাহী, জামালপুর, গোপালগঞ্জ ও মাগুরাতে। পাশাপাশি বাফুফে ভবনে যেখানে মেয়েরা থাকে এবং কমলাপুর স্টেডিয়ামেও একাডেমি নির্মাণ করা হবে।
শুভেচ্ছা বক্তব্যের পর সাফজয়ী নারী ফুটবলার এবং ফুটবল দলের কোচিং প্যানেলের সদস্যদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, রূপায়ণ গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খাঁন মুকুল, কো-চেয়ারম্যান মাহির আলী খাঁন রাতুল ও রূপায়ণ গ্রুপের উপদেষ্টা আব্দুল গাফফার।
সাফজয়ী দলের সদস্য ও সহঅধিনায়ক মারিয়া মান্দা দলের পক্ষ থেকে পাশে থাকার জন্য রূপায়ণ গ্রুপকে ধন্যবাদ জানান। দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন রূপায়ণ গ্রুপকে ধন্যবাদ জানিয়ে আরও অনেক বিত্তবান সংস্থাকে ফুটবলের পাশে থাকার আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সবাইকে বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে হবে যে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং তাদের অবশ্যই দেশে ফিরে যেতে হবে। তিনি বলেন, ‘তাদের (রোহিঙ্গাদের) নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে। সবাইকে বুঝতে হবে পরিস্থিতি। আমাদের পক্ষে আর কোনো লোক নেওয়া সম্ভব নয়, রোহিঙ্গাদের অবশ্যই ফিরে যেতে হবে।’
গত মঙ্গলবার সম্প্রচারিত ওয়াশিংটনে ভয়েস অব আমেরিকার (ভোয়া) বাংলা সার্ভিসের সঙ্গে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।
রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের বারবার আহ্বানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এত বিশাল জনসংখ্যার (সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা প্রায়) দায়িত্ব একা একটি দেশের পক্ষে নেওয়া অসম্ভব। শুধু আশ্রয় দেওয়াই নয়, এত বিশাল জনসংখ্যার জন্য জীবিকার ব্যবস্থা করাও একটি বড় দায়িত্ব, যা কোনো দেশ একা বহন করতে পারে না। তিনি উল্লেখ করেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা নিষেধাজ্ঞা এবং চলমান কভিড-১৯-এর কারণে সমগ্র বিশ্ব এখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া হচ্ছে, যা বিশ্ববাসীকে চরম ভোগান্তিতে ফেলেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর শিশু-কিশোররা এখন ঘিঞ্জি বস্তিতে (রোহিঙ্গা ক্যাম্প) লালিতপালিত হয়ে বড় হচ্ছে, যেখানে মানবিক মূল্যবোধ ও সুস্থ স্বাস্থ্যের সঙ্গে বেড়ে ওঠার সুযোগ খুবই সীমিত।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ১৬ কোটি বাংলাদেশির পাশাপাশি কয়েক লাখ মানুষের (রোহিঙ্গাদের) দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তার ছোট বোন শেখ রেহানার আবেদনের কথাও স্মরণ করেন।
শেখ রেহানাকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, “আপনি ১৬ কোটি লোককে খাওয়াতে পারেন আর কয়েক লাখ লোকতে খাওয়াতে পারবেন না?” প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি ইতিবাচক জবাবে বলেছেন, প্রয়োজনে বাংলাদেশিরা একবেলা খাবার খেয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আরেক বেলার খাবার ভাগ করবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশি জনগণ, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রচুর খাবার নিয়ে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পরে এগিয়ে এসে রোহিঙ্গাদের সাহায্য করতে শুরু করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র সফর করছেন। এ সফরে তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে ভাষণ দেওয়াসহ নানা কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সময় শনিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সাক্ষাৎকারটি নেয় ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগ।
সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সংকট ছাড়াও বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলোর নানা অভিযোগ, মিডিয়ার স্বাধীনতা ও ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, মধ্য আয়ের দেশে উত্তরণের পথে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ, গৃহহীনদের জন্য নেওয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ তার সরকারের নেওয়া নানা কল্যাণমুখী নীতি ও কর্মসূচি, নারীর ক্ষমতায়ন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে প্রতিবন্ধী, ট্রান্সজেন্ডারদের কল্যাণে নেওয়া নানা পদক্ষেপ, জিয়া-এরশাদ আমলের সামরিক শাসন, আগামী নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন।
এ ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে তৎকালীন পাকিস্তান গোয়েন্দাদের গোপন রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে প্রকাশিত সিক্রেট ডকুমেন্টস বইটির সম্পাদনা ও প্রকাশনার প্রেক্ষাপট নিয়েও তিনি কথা বলেন। জলবায়ু পরিবর্তন, করোনা পরিস্থিতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইত্যাদির ফলে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশ কীভাবে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হয়ে উঠতে পারে তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার পরিকল্পনা ও স্বপ্নের কথাও তুলে ধরেন।
ভয়েস অব আমেরিকার পক্ষ থেকে প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী এ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শতরূপা বড়ুয়া।
আওয়ামী লীগ মানবাধিকার সংরক্ষণ করে : মানবাধিকার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার শুধু মানবাধিকার রক্ষা করেনি, মানবাধিকার সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করেও তা সংরক্ষণ করেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা সবসময় (অভিযোগের) তদন্ত করছি। কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়, এমনকি এটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো সদস্য দ্বারা সংঘটিত হলেও, যা অতীতে দেখা যায়নি।’
বিএনপির ঢালাও অভিযোগের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, তারা অনেক কথা বলার পর ৭০ জনের একটি তালিকা জমা দিয়েছে (কথিতভাবে নিখোঁজ)। তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ লোককে পরবর্তী সময়ে বিএনপির মিছিলে পাওয়া গেছে এবং কেউ কেউ তাদের ব্যক্তিগত কারণে আত্মগোপন করেছে এবং সাতটি ঘটনায় দেখা গেছে তারা মারা গেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর পাশাপাশি শত শত বিমানবাহিনী-সেনা অফিসার ও সৈনিককে হত্যা করেছিলেন। নিহতদের মৃতদেহ কখনোই পাওয়া যায়নি, এমনকি তাদের স্বজনরাও জানতে পারেননি তাদের কী অপরাধ ছিল।
গণমাধ্যম অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করছে : শেখ হাসিনা বলেছেন, আওয়ামী লীগের আমলে গণমাধ্যমের সংখ্যা বেড়েছে এবং তারা যা খুশি বলার স্বাধীনতা ভোগ করছে। তিনি বলেন, ‘সবকিছু বলার পর কেউ যদি বলে যে তাকে কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না, তার উত্তর কী হবে? এটাই আমি জানতে চাই।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে মাত্র একটি টিভি ও একটি রেডিও স্টেশন ছিল। যেগুলো ছিল সরকারের পরিচালনাধীন। ক্ষমতায় আসার পর বেসরকারি খাতকে উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশে এখন অনুমোদিত ৪৪টি টিভি চ্যানেলের মধ্যে ৩২টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল চালু রয়েছে। লোকজন টেলিভিশন টকশোতে অংশ নিচ্ছে এবং তারা স্বাধীনভাবে কথা বলছে, সত্য বা মিথ্যা এবং তারা সরকারের সমালোচনাও করছে।
প্রধানমন্ত্রী আবারও উল্লেখ করেন, কিন্তু দেশে সামরিক শাসকদের আমলে মানুষের কথা বলা বা চলাফেরার স্বাধীনতাটুকুও ছিল না।
অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে স্বাধীন ইসি : শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) যাতে অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করতে পারে এর জন্য তার সরকার সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য একটি আইন প্রণয়ন করেছেন এবং আইন অনুযায়ী কমিশন গঠিত হয়। নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে ছিল এবং তার সরকার এটিকে তার কর্র্তৃত্ব থেকে মুক্ত করেছে ও কমিশনকে আর্থিক স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য তাদের জন্য একটি পৃথক বাজেট বরাদ্দ করেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার দল আওয়ামী লীগ আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে এবং তখন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন, পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ হতে পারে না।
সরকারপ্রধান বলেন, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি দুটি দলের জন্ম অবৈধভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক শাসকদের হাত ধরে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সংগ্রামের মাধ্যমে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে বলে জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে তারা কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেবে না। জনগণ তাদের ভোট দিয়ে তাদের সরকার নির্বাচন করবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, আওয়ামী লীগকে ভোট না দিলে তার বলার কিছু নেই। বাসস
ইউনিয়ন পর্যায়ে টিআর কাবিখা ও লোকাল গভর্ন্যান্স সাপোর্ট প্রজেক্টের (এলজিএসপি) অর্থ ব্যয়ে অনিয়মের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অভিযোগ রয়েছে, এসব প্রকল্পের বেশিরভাগ অর্থ ভুয়া বিল ভাউচার বানিয়ে আত্মসাৎ করা হয়। বিভিন্ন সময়ে এসব অভিযোগের প্রমাণও মিলেছে অনেক ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের বিরুদ্ধে। প্রান্তিক পর্যায়ের এসব অনিয়ম বন্ধে ইউনিয়ন পর্যায়ে নিরীক্ষা কার্যক্রম শুরু করছে সরকার। চলতি মাসেই এই কার্যক্রম শুরু হতে পারে বলে স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের এসব প্রকল্পে সরাসরি নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচলানা করতে একটি ‘গাইড লাইন’ তৈরি করা হয়েছে। যেখানে এলজিএসপি প্রকল্পের ক্ষেত্রে ২২টি প্যাকেজের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দ্রুত নিরীক্ষকদের দল মাঠে নামানো হবে। তবে কেউ কেউ মনে করছেন এ ধরনের উদ্যোগের ফলে মাঠ পর্যায়ে কর্মরত প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের ক্ষমতা আরও বাড়ানো হলো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টিআর, কাবিখা ও উন্নয়ন তহবিলসংক্রান্ত বিষয়ে সরাসরি পরিদর্শন করে তা প্রতিবেদন আকারে প্রস্তুত করবে এই নিরীক্ষক দল। এসব কার্যক্রম শুরুর আগে জেলা প্রশাসক ও সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে ‘এন্ট্রি মিটিং’ করা হবে। আবার নিরীক্ষা কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর একইভাবে ‘এক্সিট মিটিং’ করা হবে। নিরীক্ষার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের মাঠ পর্যায়ের প্রতিবেদনে জেলা প্রশাসক ও ইউএনওর স্বাক্ষর নিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগে জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. মুহাম্মদ শের আলী স্বাক্ষরিত একটি চিঠি ইতিমধ্যে সকল জেলা প্রশাসক, স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক ও ইউএনওদের কাছে পাঠানো হয়েছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে নিরীক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে ইউনিয়ন পরিষদের আর্থিক ব্যবস্থাপনার প্রকৃত চিত্র নিয়ে প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে তদারকি ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখন থেকে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে বাস্তবায়নাধীন লোকাল গভর্ন্যান্স সাপোর্ট প্রজেক্ট-৩ (এলজিএসপি)-এর আওতায় দেশের সব ইউনিয়ন পরিষদের ২০২১-২২ অর্থবছরের নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনারও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এজন্য ২২টি প্যাকেজের মাধ্যমে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষকদের প্রশিক্ষণ শেষে চলতি মাসেই ইউনিয়ন পর্যায়ে নিরীক্ষা কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ২০২১-২২ অর্থবছরের ইউনিয়ন পরিষদের সব উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থের প্রাপ্তি ও ব্যয়ের বার্ষিক আর্থিক বিবরণী নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করবে। প্রতিটি ইউনিয়নে তিন সদস্যের একটি নিরীক্ষা দল (অডিটর-১ ও অডিটর-২ প্রতি ইউনিয়নে চার দিন এবং অডিট ম্যানেজার-১ জন প্রতি ইউনিয়নে ১ দিনব্যাপী) কাজ করবে। সেই সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদের সকল হিসাবসংশ্লিষ্ট রেজিস্টার/ডকুমেন্ট ছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদের সম্পদ রেজিস্টার ও এলজিডি/এলজিএসপি-৩ প্রকল্পের আওতায় এবং ১ শতাংশ ভূমি হস্তান্তর করা থেকে গৃহীত এবং বাস্তবায়িত স্কিমগুলো, নিজস্ব রাজস্ব এবং অন্যান্য তহবিল দ্বারা বাস্তবায়িত স্কিমগুলো নিরীক্ষা করবে। এ ছাড়া ওয়ার্ড কমিটি ও স্কিম বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যদের উপস্থিতিতে বাস্তবায়িত স্কিম সরেজমিন পরিদর্শন করবে।
মাঠ প্রশাসনে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ইউনিয়ন পরিষদ নিরীক্ষাকালে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের অর্থ ও ক্রয়সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সদস্যদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক এবং নিরীক্ষকদের উপস্থিতির প্রমাণস্বরূপ স্বাক্ষর গ্রহণ করবে। ইউনিয়ন পরিষদ নিরীক্ষকালে নিরীক্ষকরা উপজেলা পরিষদ থেকে ইউনিয়ন সংশ্লিষ্ট টিআর, কাবিখা, উন্নয়ন তহবিলসংক্রান্ত সংগ্রহ ও পর্যবেক্ষণ করবে।
নিরীক্ষকদের তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিতকল্পে প্রয়োজনীয় স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন ২০০৯-এর ৬০ অনুচ্ছেদের বর্ণনামতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। নিরীক্ষকরা ইউনিয়ন পরিষদ নিরীক্ষার আগে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক (ডিডিএলজি) দপ্তরে ‘এন্ট্রি মিটিং’ করে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে নিরীক্ষা কার্যক্রম শুরু করবে এবং প্রতি ফার্মের নিরীক্ষা দল উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দপ্তরে এন্ট্রি মিটিং করবে। একটি উপজেলার সকল ইউনিয়ন পরিষদের নিরীক্ষা কার্যক্রম শেষ করার পর সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দপ্তরে ‘এক্সিট মিটিং’ করতে হবে।
এক্সিট সভায় বিজিসিসির সদস্য, ইউআরটির সদস্য, সকল ইউপি চেয়ারম্যান, সচিব ও ডিএফের উপস্থিতিতে মাঠ পর্যায়ের নিরীক্ষাসংশ্লিষ্ট আলোচনা এবং কার্যবিবরণী প্রণয়ন করে উপজেলা নির্বাহী অফিসার নিজ দায়িত্বে ‘এক্সিট মিটিং’ করে কার্যবিবরণীতে স্বাক্ষর করবেন। নিরীক্ষা কার্যক্রম নির্বিঘ্নে পরিচালনার স্বার্থে প্রত্যেক নিরীক্ষা দল তাদের ছবি এবং তথ্য সংবলিত অডিট প্রোগ্রাম প্রদর্শন করবে। প্রয়োজনে স্থানীয় সরকার বিভাগকে অবহিত করে ডিডিএলজি এবং ইউএনওর সঙ্গে সমন্বয় করে অডিট প্রোগ্রাম পরিবর্তন করা যাবে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, জন অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে অগ্রাধিকারভিত্তিক বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ এবং ইউনিয়ন পরিষদ অপারেশনাল ম্যানুয়েল অনুসরণে ঠিকাদারের মাধ্যমে (সরাসরি ক্রয় ও কমিউনিটি ক্রয় ব্যতীত) তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা যেমন জরুরি, তেমনি দক্ষতা এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠাকল্পে সুষ্ঠুভাবে নিরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করতে সার্বিক সহায়তা দেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. মুহাম্মদ শের আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তৃণমূল পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ ব্যয়ে আরও স্বচ্ছতা আনতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করছি, এ কার্যক্রমের মাধ্যমে অনিয়ম রোধ করা সম্ভব হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে আসার পথে মঙ্গলবার ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয় ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতারা। তবে এই হামলাকে ছাত্রদলের অন্তর্কলহ বলে দাবি করেছে ছাত্রলীগ। সরকার সমর্থিত সংগঠনটির নেতারা বলছেন, শান্ত ক্যাম্পাসকে কেউ অশান্ত করতে চাইলে তারা তাদের প্রতিহত করবেন। অন্যদিকে ছাত্রদলের নেতারা জানিয়েছেন, তারা হামলা উপেক্ষা করে আবারও ক্যাম্পাসে আসবেন। দেশের এ দুই ছাত্র সংগঠনের মুখোমুখি অবস্থানের ফলে ক্যাম্পাসে উত্তেজনা বিরাজ করছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে সংঘর্ষের আশঙ্কায় আতঙ্ক বিরাজ করছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সংঘর্ষের পরদিন গতকাল বুধবার ক্যাম্পাসে ক্লাস পরীক্ষা স্বাভাবিক ছিল। প্রতিদিনের মতো মধুর ক্যান্টিন ও আশপাশের এলাকায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অবস্থান দেখা যায়। এদিন ছাত্রদলের কোনো নেতাকর্মী ক্যাম্পাসে আসেননি।
ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ-ছাত্রদল সংঘাতের বিষয়ে জানতে চাইলে ভাষা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আরমান হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, মঙ্গলবার বিকেলে ক্লাস শেষে বাসায় যাওয়ার পথে ছাত্রলীগ-ছাত্রদল মারমুখী অবস্থানে দেখেছি। আমার তো আজকে ক্যাম্পাসে আসতেই ভয় লাগছিল। আমরা শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ চাই। কোনো মারামারি চাই না!
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী আফসানা রহমান বলেন, ঘনঘন এ দুই সংগঠনের সংঘর্ষ আমাদের আতঙ্কিত করে তুলছে। আমরা সব সময় শঙ্কার মধ্যে আছি। ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হোক এটা আমরা চাই না। এদিকে ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি খোরশেদ আলম সোহেলের দাবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মদদে তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমরা ফুল ও মিষ্টি নিয়ে ভিসি স্যারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলাম। ছাত্রলীগ ফুল ও মিষ্টির বিপরীতে রড-লাঠি দিয়ে আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। ছাত্রদল জুলুমের ভয় পায় না। আমরা আবারও ক্যাম্পাসে যাব, কারণ ক্যাম্পাসটা তো আমারও। সব কিছুর আগে আমার পরিচয় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, আমরা তিন দিন আগে ভিসি স্যারের থেকে সময় নিয়েছি। তিনি আমাদের কোনো ধরনের ঝামেলা হবে না বলে আশ্বস্ত করেছিলেন। এমন কি হামলার ৫ মিনিট আগেও আমাদের প্রক্টরের সঙ্গে কথা হয়েছিল। তিনি আমাদের ক্যাম্পাসে আসতে বলেন। তিনি বলেছিলেন, ছাত্রলীগ তাদের হামলা করবে না। কিন্তু আমাদের ওপর হামলা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের ডেকে এনে ছাত্রলীগ দিয়ে মার খাইয়েছে।
তবে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাসের দাবি তারা কারও ওপর হামলা করেননি। ছাত্রদল নিজেরাই নিজেদের মধ্যে মারামারি করেছে। তিনি বলেন, ছাত্রলীগ সংঘাতের রাজনীতি করে না। আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করছি। কিন্তু ছাত্রদল ক্যাম্পাসে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। শিক্ষার পরিবেশ যারা নষ্ট করবে ছাত্রলীগ তাদের প্রতিহত করবে।
হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান বলেন, তারা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসার কথা ছিল। কিন্তু পরে তারা আসেনি। কেন তারা আসল না এটা তো আমি জানি না।
প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রাব্বানী বলেন, হামলার বিষয়টি শুনে সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিব।
গত মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে নীলক্ষেত মোড়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হামলার শিকার হয়েছেন ঢাবি ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। হামলায় ছাত্রদলের অন্তত ১০ নেতাকর্মী আহত হন বলে দাবি করেছে সংগঠনটি।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত বুকার পুরস্কারজয়ী ঔপন্যাসিক সালমান রুশদি তার ওপর সংঘটিত ছুরি হামলা নিয়ে প্রথমবারের মতো কথা বলেছেন। মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে আসা রুশদি এখনো পুরোপুরি সেরে ওঠেননি। কিন্তু বেঁচে ফেরায় তিনি নিজেকে ‘ভাগ্যবান’ মনে করছেন। পাশাপাশি প্রকাশ করেছেন কৃতজ্ঞতা।
সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। প্রতিবেদনটি সম্প্রতি দ্য নিউইয়র্কারকে দেওয়া রুশদির একটি সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে।
২০২২ সালের আগস্টে নিউইয়র্কে একটি সাহিত্যবিষয়ক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছিলেন রুশদি। এ সময় মঞ্চে তার ওপর হামলা চালান ২৪ বছর বয়সী যুবক হাদি মাতার। নিউ জার্সির এই বাসিন্দা সেদিন রুশদিকে ১০ থেকে ১৫ বার ছুরিকাঘাত করেন। এতে নিজের রক্তের ওপর লুটিয়ে পড়েন রুশদি। এর জের ধরে প্রায় ছয় সপ্তাহ হাসপাতালে কাটাতে হয় এই লেখককে। পরে এক চোখের দৃষ্টিশক্তিও হারিয়ে ফেলেন তিনি।
দ্য নিউইয়র্কারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রুশদি বলেন, ‘আমি অনেকটাই ভাল হয়েছি। যা ঘটেছিল তা বিবেচনা করে দেখলে খুব একটা খারাপ নেই। বড় ক্ষতগুলো সেরে গেছে। তবে বুড়ো আঙুল, তর্জনী ও তালুর নিচের অর্ধেকটা অনুভব করছি। আমাকে প্রচুর হাতের থেরাপি নিতে হচ্ছে। যদিও আমাকে বলা হয়েছে শারীরিকভাবে আমি উন্নতি করছি’।
রুশদি জানান, আঙ্গুলের কিছু অংশে অনুভূতি না থাকায় লিখতে অসুবিধা হচ্ছে তার। তিনি বলেন, ‘আমি উঠে দাঁড়াতে পারছি। হাঁটতে পারছি চারপাশে। তবে আমার শরীরে এমন কিছু অংশ আছে যেগুলো নিয়মিত চেকআপ করতে হবে। এটা ছিল একটি মারাত্মক আক্রমণ’। তিনি জানান, ছুরি হামলার ঘটনায় মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছেন। এর ফলে তাকে নিরাপত্তার বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
১৯৮১ সালে ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’ উপন্যাস দিয়ে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেন রুশদি। শুধু যুক্তরাজ্যেই বইটির ১০ লাখের বেশি কপি বিক্রি হয়েছিল। ১৯৮৮ সালে চতুর্থ উপন্যাস ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ লেখার পর থেকে প্রাণনাশের হুমকি পেয়ে আসছিলেন এই লেখক। এই উপন্যাস লেখার জন্য রুশদিকে ৯ বছর আত্মগোপনে থাকতে হয়। উপন্যাসটিতে ইসলাম ধর্মের অবমাননা করা হয়েছে বলে মনে করেন মুসলিমরা।
উপন্যাসটি প্রকাশের এক বছর পর ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি রুশদির মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া জারি করেন। সেই সঙ্গে তার মাথার দাম হিসেবে ঘোষণা করেন ৩ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার। রুশদি ২০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। মঙ্গলবার (০৭ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশিত হচ্ছে তার লেখা নতুন উপন্যাস ‘ভিক্টরি সিটি’। পুরুষতান্ত্রিক বিশ্বকে উপেক্ষা করে এই নারী কীভাবে একটি শহরকে পরিচালনা করেছেন, সে গল্পই উঠে এসেছে বইটিতে।
শ্রম পরিদর্শক পদে যোগ দেওয়ার ৩৪ বছর পর পদোন্নতি পেলেন মাহমুদুল হক। স্বপ্ন দেখতেন পদোন্নতির সিঁড়ি বেয়ে একসময় প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে যাবেন। সেই স্বপ্ন আট বছরেই লুটিয়ে পড়ল জ্যেষ্ঠতার তালিকায়।
১৯৮৮ সালে যোগ দেওয়ায় ’৯৫ সালেই পদোন্নতি পাওয়ার কথা ছিল মাহমুদুল হকের। কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর প্রতিষ্ঠানপ্রধানের অদূরদর্শিতা সে স্বপ্ন শুরুতেই বাধা পেল। এন্ট্রি পোস্টে যোগ দেওয়ার পর তার মতো অন্য কর্মচারীরা যখন পদোন্নতির স্বপ্নে বিভোর, তখন তাতে গা-ই করলেন না সেই সময়ের প্রতিষ্ঠানপ্রধান।
মাহমুদুল অপেক্ষায় রইলেন পরিবর্তিত পরিস্থিতির জন্য। সেই পরিবর্তন আসতে আসতে চাকরিতে কেটে গেল আঠারো বছর। আঠারোতে মানুষ প্রাপ্তবয়স্ক হয়। তিনিও ভাবলেন আঠারোতে তিনি না হয় ‘জব ম্যাচিউরিটি’তে পৌঁছালেন। চাকরির আঠারো বছরে পদোন্নতি পেলেও মন্দ হয় না।
কিন্তু অবাক ব্যাপার, কর্তৃপক্ষ পদোন্নতি দিল, তবে মাহমুদুলকে ছাড়া। পদোন্নতির প্রজ্ঞাপনে কোথাও তার নাম নেই। হতাশায় মুষড়ে পড়লেন তিনি। জুনিয়র কর্মকর্তারদের নাম আছে, অথচ তার নাম নেই। প্রতিষ্ঠানের নীতি-নির্ধারকদের দরজায় দরজায় ঘুরলেন ন্যায়বিচারের আশায়। কিন্তু তারা পাত্তাই দিলেন না বিষয়টি।
তারা আমলে না নিলেও মাহমুদুলের স্বপ্ন তো সেখানেই থেমে যাওয়ার নয়। সেই স্বপ্ন পুঁজি করে তিনি গেলেন আদালতে। সেই ভিন্ন জগৎটাও কম চ্যালেঞ্জিং ছিল না। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল তার পক্ষে রায় দিল। মাহমুদুল আনন্দে আত্মহারা হলেন। কিন্তু সেই আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হলো না। সরকার আপিল করল প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে। মামলার ফল উল্টে গেল। হতাশায় ভেঙে না পড়ে তিনি গেলেন উচ্চ আদালতে। আপিল বিভাগে সিভিল আপিল মামলা করলে প্রশাসনিক আপিল আদালতের রায় বাতিল হয়। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল থাকে।
জলে নেমে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করার মতো মাহমুদুল হকও যেন সরকারের সঙ্গে লড়াই করতে নামলেন। আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন করল সরকারপক্ষ। একপর্যায়ে সরকার বুঝতে পারল কোনোভাবেই তারা এ মামলায় জিততে পারবে না। সরকারপক্ষে রিভিউ পিটিশন প্রত্যাহার করা হলো। আদালত সরকারের পদোন্নতির প্রজ্ঞাপনকে আইনের কর্তৃত্ববহির্ভূত বলে ঘোষণা করল। জুনিয়র কর্মকর্তাকে যেদিন থেকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে এবং যতবার পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, একইভাবে মাহমুদুল হককে পদোন্নতি দেওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত। বকেয়া বেতন-ভাতাসহ সব পাওনা কড়ায়-গ-ায় পরিশোধের নির্দেশনা আসে।
আদালতের এই নির্দেশনা দেওয়া হয় ২০১৮ সালে। এরপর আদেশ বাস্তবায়ন করতে সরকারের লেগে যায় প্রায় চার বছর। ২০২২ সালের ১১ মে তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ৩৪ বছর পর পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন মাহমুদুল হক। আবারও তাকে ঠকিয়েছে সরকার। জুনিয়র কর্মকর্তা যুগ্ম মহাপরিদর্শক হলেও তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয় তার দুই ধাপ নিচের সহকারী মহাপরিদর্শক পদে। উপমহাপরিদর্শক ও যুগ্ম মহাপরিদর্শক আরও ওপরের পদ। আদালতের নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
কখনোই প্রজ্ঞাপন মাহমুদুল হকের জন্য ভালো বার্তা বয়ে আনেনি। পুরো চাকরিজীবন আদালতের বারান্দায় ঘুরে তিনি পৌঁছেছেন অবসরের প্রান্তসীমায়। আর তিন মাস পরে তিনি অবসরে যাবেন। যৌবন ও মধ্য বয়সের দিনগুলোতে আদালতে ঘুরে বেড়ানোর শক্তি ও সাহস থাকলেও মাহমুদুল হক এখন সেই সাহস দেখাতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করছেন। পারবেন তো শেষ সময়ে এসে সরকারের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপসহীন মনোভাব দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে?
মাহমুদুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, তিনি আদালতের কাছেই জানতে চাইবেন, আদালতের বিচার না মানার শাস্তি কী।
পুরো ঘটনা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা শুনিয়ে জানতে চাইলেন, কতজনের পক্ষে মাহমুদুল হকের মতো লড়াকু মনোভাব দেখানো সম্ভব?
সীমাহীন আনন্দ নিয়ে মানুষ সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়। এরপরই তার মধ্যে যে স্বপ্নটি দানা বাঁধে তা হচ্ছে পদোন্নতি। কার কীভাবে পদোন্নতি হবে তা আইনকানুন, নিয়ম-নীতি দিয়ে পোক্ত করা। পুরো বিষয়টি কাচের মতো স্বচ্ছ। এরপরও পদোন্নতি হয় না। দিন, মাস, বছর পার হয়ে যায়, কাক্সিক্ষত পদোন্নতির দেখা মেলে না।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ক্যাডারে নিয়মিত পদোন্নতি হয়। বাকি ক্যাডারে হতাশা। তার চেয়েও কঠিন পরিস্থিতি নন-ক্যাডারে। ক্যাডার কর্মকর্তারা নিজের পদোন্নতির ষোলো আনা বুঝে নিয়ে ঠেকিয়ে দেন নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি। সংখ্যায় বেশি হওয়ায় নন-ক্যাডাররা একজন আরেকজনকে নানা ইস্যুতে আটকাতে গিয়ে পুরো প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেন। সরকারের মোট কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ কর্মচারী। সেই হিসেবে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনবলের পদোন্নতি হয় না। পে-কমিশন হলেই কর্মচারীদের পদোন্নতির জন্য করুণা উথলে ওঠে। এমনকি ব্লকপোস্টে যারা আছেন, তাদের জন্যও পদোন্নতির বিকল্প সুবিধা বাতলে দেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কর্মচারীদের পদোন্নতি উপেক্ষিতই থাকে।
যখন সময়মতো পদোন্নতি হয় না, তখন নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে থাকে। এসব সমস্যা সংশ্লিষ্ট দপ্তর-অধিদপ্তরের চৌহদ্দি পেরিয়ে আমজনতাকেও প্রভাবিত করে। নন-ক্যাডার কর্মকর্তা আর সঙ্গে কর্মচারীরা যখন বুঝতে পারেন পদোন্নতির আশা তাদের নেই, তখন তারা দুহাতে টাকা কামানোর ধান্দায় মেতে ওঠেন। এতে করে ঘুষের সংস্কৃতি সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। অকার্যকর পথে হাঁটে রাষ্ট্র। সাধারণ মানুষ টাকা ছাড়া তাদের কাছ থেকে কোনো সেবা পায় না, ব্যবসায়ীরা নতুন কোনো আইডিয়া নিয়ে ব্যবসায় আসেন না, ব্যবসাবান্ধব পরিস্থিতি না থাকায় মুখ ফিরিয়ে নেন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। প্রধানমন্ত্রীর বারবার আহ্বানেও বিনিয়োগকারীরা সাড়া দেন না। সাধারণ মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে সেবা দেওয়ার বাণীতেও উদ্বুদ্ধ হন না সংশ্লিষ্টরা।
এই পরিস্থিতিতে অনিয়ম আটকে রাখার সব কৌশলই ব্যর্থ হচ্ছে। যথাযথ তদারকি না থাকায় বিভাগীয় ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে গেছে। ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৩৫০টি অডিট আপত্তি ঝুলে থাকায় অডিট প্রতিষ্ঠানগুলোও আগ্রহ হারিয়ে নিজেরাই জড়িয়ে পড়ছে অনিয়মে। দন্তহীন বাঘে পরিণত হওয়ার তথ্য সাংবাদিকদের জানান দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান নিজেই।
নন-ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারীর পদোন্নতির বড় একটা অংশ আটকে রাখে মন্ত্রণালয়গুলো। এই আটকে রাখার কারণ হচ্ছে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের স্বার্থ। বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তরে নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিলে নিয়ম অনুযায়ী পদোন্নতিপ্রাপ্তদের ওপরের পদে বসাতে হবে। এতে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের এককালীন লাভ; অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে একবার পদোন্নতি দেওয়া যাবে। কিন্তু পদোন্নতি না দিয়ে সংশ্লিষ্টদের চলতি দায়িত্ব দিলে বছরজুড়ে টাকা আয় করতে পারেন নীতিনির্ধারকরা। দপ্তর, অধিদপ্তরে বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়। চলতি দায়িত্বপ্রাপ্তদের আয় অনুসারে নীতিনির্ধারকদের মাসোহারা দিতে হয়। নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি দেওয়া হলে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের নিয়মিত আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে আইন বা বিধি-বিধানের ফাঁকফোকর গলিয়ে নন-ক্যাডার এবং কর্মচারীদের পদোন্নতি আটকে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়।
সরকারি কর্মচারী সংহতি পরিষদের সভাপতি নিজামুল ইসলাম ভূঁইয়া মিলন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সচিবালয় এবং সারা দেশের সরকারি কর্মচারীদের পদোন্নতির মধ্যে একটু পার্থক্য আছে। নন-ক্যাডারের কিছু বিষয় ছাড়া সচিবালয়ের কর্মচারীরা সময়মতো পদোন্নতি পায়। কিন্তু সচিবালয়ের বাইরে পদোন্নতি হয় না বললেই চলে। সচিবালয়ে মাত্র ১০ হাজার কর্মচারী আছেন। সচিবালয়ের বাইরে আছেন ১০ লাখের বেশি। এসব কর্মচারীর পদোন্নতি নিয়ে বহু বছর ধরে চেষ্টা করছি। কিন্তু কোনো ফল পাইনি। সর্বশেষ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ সমস্যা নিয়ে কাজ করার জন্য একটি কমিটি করে দিয়েছে। কমিটি কিছু সুপারিশ করেছে। ব্যস, ওই পর্যন্তই। এরপর এর কোনো অগ্রগতি নেই। যেখানে সরকারপ্রধান বলেন, চাকরিজীবনে সবাই যেন কমপক্ষে একটি পদোন্নতি পায়। সেখানে বহু কর্মচারী কোনো পদোন্নতি ছাড়াই অবসরে যাচ্ছেন। সরকারপ্রধানের নির্দেশনা উপেক্ষা করেন আমলারা। তাদের আগ্রহ কেনা-কাটায়, বিদেশ ভ্রমণে, নতুন জনবল নিয়োগে। এসব করলে তাদের লাভ। কর্মচারী পদোন্নতি দিতে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। এর নিশ্চয়ই একটা শেষ আছে। বৈষম্যের পরিণতি কী হয়, তা অনেক দাম দিয়ে বিডিআর বিদ্রোহে আমরা দেখেছি।’
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি ঝুলছে বছরের পর বছর। এই অধিদপ্তরের কয়েক শ কর্মকর্তা পাঁচ বছর আগেই পদোন্নতির যোগ্য হয়েছেন। নানা কায়দা-কানুন করে তাদের পদোন্নতি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক সংশ্লিষ্টদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করে তাদের পদোন্নতির প্রক্রিয়া এগিয়ে নিলেও শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নতুন করে জ্যেষ্ঠতার তালিকা করার নামে সময়ক্ষেপণ করছে। জ্যেষ্ঠতার তালিকা করার পর এখন তাদের পারিবারিক সদস্যদের তথ্য যাচাই-বাছাই করার জন্য একটি সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ওই সংস্থা নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদেরও তথ্য তালাশ করছে। তাদের আত্মীয়দের মধ্যে কে কোন দলের সমর্থক তার তথ্য নিচ্ছেন সংস্থার কর্মকর্তারা।
গত মাসে শেষ হওয়া জেলা প্রশাসক সম্মেলনে দায়িত্ব পালন করছিলেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের সুরম্য ভবনে দায়িত্ব পালন করলেও ওই নন-ক্যাডার কর্মকর্তার মনের অবস্থাটা মনোহর ছিল না। কেমন আছেন জানতে চাইলে ওই নন-ক্যাডার কর্মকর্তা বলেন, ‘ভালো নেই। চাকরি করছি, পদোন্নতি নেই। ২০১৫ সালের আগে পদোন্নতি না পেলেও টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড ছিল। তাও তুলে দেওয়া হয়েছে। তুলে দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল সময়মতো পদোন্নতি হবে, ব্লকপোস্টধারীদের দেওয়া হবে বিশেষ আর্থিক সুবিধা। এসবের কোনোটাই হয়নি।’
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে একটি প্রশাসনিক আদেশ খুবই পরিচিত। সেই প্রশাসনিক আদেশ ১৬/২০১৮ অনুযায়ী ৭০ ভাগ কর্মকর্তা সরাসরি নিয়োগ হবে। আর ৩০ ভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। ৭০ ভাগ কর্মকর্তা সরাসরি নিয়োগের ফলে বিমানে বর্তমানে প্রয়োজনের তুলনায় কর্মকর্তা বেশি। নীতিনির্ধারকদের নতুন জনবল নিয়োগে আগ্রহ বেশি। পুরনোদের পদোন্নতি দিয়ে ওপরের পদ পূরণের চেয়ে তারা নতুন নিয়োগে যান। ফলে কারও চাকরিজীবনে একবারও পদোন্নতি হয় না। নামমাত্র যে পদোন্নতি হয় তা অনিয়মে ভরপুর।
নন-ক্যাডার ছাড়াও ১৩তম গ্রেড থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত পদোন্নতি হয় না বললেই চলে। প্রতিটি দপ্তরে এসব গ্রেডের পদোন্নতি আটকে আছে। অথচ এসব গ্রেডেই বেশি লোক চাকরি করছেন। সরকারের মোট জনবল প্রায় ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৯২৭ জন। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ২৩ শতাংশ পদের মধ্যেও নন-ক্যাডার রয়েছেন। এ ছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৭৭ শতাংশ পদই ১৩তম থেকে তার পরের গ্রেডের। এতে করে সহজেই বোঝা যায় সরকারের জনবলের বড় অংশই পদোন্নতির চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে। সরকারের জনবলের এই বিশাল অংশ যখন পদোন্নতি নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগেন, তখন তারা নানা অনিয়মে ঝুঁকে পড়েন।
বেশির ভাগ দপ্তর, অধিদপ্তর পরিচালনা করেন বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তারা তাদের প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় থেকে প্রেষণে ক্যাডার কর্মকর্তাদের দপ্তর, অধিদপ্তরে পাঠান। প্রেষণে গিয়ে অনেক কর্মকর্তা শুধু রুটিন কাজটুকুই করতে চান। শূন্যপদে জনবল নিয়োগ বা পদোন্নতি রুটিন কাজ না হওয়ায় তা উপেক্ষিত থাকে। তা ছাড়া পদোন্নতি দিতে গিয়ে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়; বিশেষ করে মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রী বা সচিব তাদের পছন্দের লোককে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য সংস্থার প্রধানকে চাপ দেন। এই চাপ উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ না থাকায় অযোগ্য লোককে পদোন্নতি দিতে হয় সংস্থার প্রধানকে। এই জটিলতা থেকে দূরে থাকার জন্য সংশ্লিষ্টদের পদোন্নতি দেওয়া থেকেও দূরে থাকেন সংস্থার প্রধানরা।
নন-ক্যাডার কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের পদোন্নতি না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের ১৪ গ্রেডের একজন কর্মচারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাইরের লোকের ইচ্ছাটাই জাগে না আমাদের পদোন্নতি দিতে। আমাদের দপ্তরপ্রধান মহাপরিচালক প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। অতিরিক্ত মহাপরিচালকও অনেক সময় প্রশাসন ক্যাডার থেকে প্রেষণে আসেন। তাদের কেন ইচ্ছা জাগবে আমাদের পদোন্নতি নিয়ে। যদি এসব পদে ফুড ক্যাডারের কর্মকর্তা থাকতেন, তাহলে তারা খাদ্য বিভাগের সমস্যা বুঝতেন। তা ছাড়া নিয়োগ বিধি সংশোধনের নামে আমরা দীর্ঘদিন একই পদে আটকে আছি।’
গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে এক আবেদনে জানান, ‘বর্তমানে সচিবালয়ে প্রায় দুই হাজারের বেশি প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা কর্মরত। এর বিপরীতে ক্যাডারবহির্ভূত সংরক্ষিত পদের সংখ্যা ২৬৭টি, যা খুবই নগণ্য। ফলে একই পদে ২০-২২ বছরের বেশি সময় কর্মরত থাকার পরও অনেকে পদোন্নতি পাচ্ছেন না। পদোন্নতি না পাওয়ায় সৃষ্ট হতাশার ফলে কর্মস্পৃহা নষ্ট হচ্ছে।’
সরকার এ সমস্যা থেকে কীভাবে বের হতে পারে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এসব সমস্যা সমাধানে সরকার সব সময়ই কাজ করে। কিন্তু এ চেষ্টা জটিলতার তুলনায় কম। এ বিষয়ে আরও এফোর্ট দিতে হবে।
বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনের উপনির্বাচনে বেসরকারিভাবে ১১২ কেন্দ্রের ফলাফলে ৯৫১ ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছেন বহুল আলোচিত স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলম। একতারা প্রতীক নিয়ে তিনি পেয়েছেন ১৯ হাজার ৪৮৬ ভোট। এ আসনে জয় পেয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ (ইনু) সমর্থিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম তানসেন। মশাল প্রতীক নিয়ে তিনি পেয়েছেন ২০ হাজার ৪৩৭ ভোট।
বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে বগুড়ার দুইটিসহ মোট ৬ আসনে উপনির্বাচনের ভোট গ্রহণ শুরু হয়। ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর বিএনপির এমপিরা পদত্যাগের ঘোষণা দিলে এ আসনগুলো শূন্য হয়।
তখন, বগুড়া-৬ (সদর) এবং বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেন হিরো আলম। নির্বাচন কমিশন একদফা তার প্রার্থিতা বাতিল করলেও পরে আদালতে গিয়ে প্রার্থিতা ফিরে পান তিনি।
বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) ও বগুড়া-৬ (সদর) আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আশরাফুল হোসেন হিরো আলম বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) দুপুর পর্যন্ত ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘সদরের কেন্দ্র সব দখল হয়্যা গ্যাছে। ডিসি-এসপিক কয়্যাও কোনো কাম হচ্চে না। সদরের আশা সব শ্যাষ। কাহালু-নন্দীগামের অনেক কেন্দ্র ঘুরে ঘুরে দেকছি। ভোট খুব সুষ্ঠু হচ্চে। মাঠের অবস্থা ভালো। কাহালু-নন্দীগ্রামে নিশ্চিত এমপি হচ্চি।’
এর আগে, সকালে সদর উপজেলার এরুলিয়া উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে যান তিনি। ভোট দেওয়ার পর হিরো আলম বলেন, ‘বগুড়া-৬ আসনে আগে থেকেই গোলযোগের আশঙ্কা করেছিলাম, সেটাই সত্যি হয়েছে। নির্বাচনি এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তবে বগুড়া-৪ আসনে ভোট সুষ্ঠু হচ্ছে। এভাবে সুষ্ঠু ভোট হলে এই আসনে আমিই বিজয়ী হবো।’
এদিকে বগুড়া-৬ আসনের উপনির্বাচনে কয়েকটি কেন্দ্রে নৌকা প্রার্থীর এজেন্ট বাদে অন্য এজেন্টদের ভোটকক্ষ থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আজ সকালে হিরো আলমসহ তিনজন প্রার্থী এ অভিযোগ করেন। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাদের এজেন্টদের বের করে দিয়েছেন বলে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করা হয়।
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ লাখ ৫০ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা খরচের হিসাব ধরে বাজেট প্রস্তাব প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে সরকার। যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৭২ হাজার ১৩০ কোটি টাকা বেশি। অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে খরচের বেশিরভাগ অর্থ জোগাড়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ১৯ শতাংশ বাড়ানো হবে। আসছে জুনের প্রথমভাগে জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আগামী বাজেট হবে জাতীয় নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারের চলতি মেয়াদের শেষ বাজেট। তাই এখানে নেওয়া কোনো পদক্ষেপে যেন আওয়ামী লীগ সরকার সমালোচনার মুখে না পড়ে এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্টদের থাকছে বিশেষ নজর। এ ছাড়া রয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। তাই সংকট ও নির্বাচন দুটোই মাথায় রাখতে হচ্ছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের বাজেট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে মোটাদাগে একটি রূপরেখা পাঠানো হয়েছে। নতুন পরিকল্পনার পাশাপাশি গত তিন মেয়াদে সরকার কী কী উন্নয়ন করেছে আগামী বাজেট প্রস্তাবে তা মনে করিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি এবং উচ্চপর্যায়ের সরকারি নীতিনির্ধারকদের উপস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ‘বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ কমিটির বৈঠকে’ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো আগামী বাজেটের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আর গত সপ্তাহে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি পাঠিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে রাজস্ব আদায়ের কৌশল নির্ধারণে কাজ শুরু করতে বলা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, যে হিসাব ধরে অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেট প্রস্তাব প্রস্তুতির কাজ শুরু করেছে তা কয়েক দফা খতিয়ে দেখা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে চূড়ান্ত করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। তিনি প্রয়োজনীয় সংশোধন, যোগ-বিয়োগ করে আবারও অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন। বাজেট প্রস্তাব চূড়ান্ত হওয়ার আগেও অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে থাকে।
ডলার সংকটে পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খুলতে পারছেন না সাধারণ ব্যবসায়ীরা। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় পণ্যের দাম বাড়ছে। কাঁচামাল সংকটে বিপাকে শিল্প খাত। ব্যাংক খাতে অস্থিরতা। নতুন চাকরির সুসংবাদ নেই বললেই চলে। দফায় দফায় জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। খুব শিগগিরই এসব সংকট কেটে যাবে বলে মনে করছেন না অর্থনীতিবিদরা। অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে ঋণদাতা সংস্থার কঠিন শর্তের বেড়াজালে আছে সরকার। এমন পরিস্থিতিতেই আগামী অর্থবছরের বাজেট তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশি^ক অস্থিরতা মোকাবিলায় সরকার কী কী পদক্ষেপ নেবে তা আগামী বাজেটে স্পষ্ট করা হবে। দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে একগুচ্ছ পরিকল্পনার কথাও বলা হবে। তবে শত সংকটের মধ্যেও আগামী বাজেটে ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী যতটা সুবিধা দেওয়া সম্ভব তা দিতে সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে বাজেট প্রস্তুত কমিটির কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষভাবে কাঁচামাল আমদানিতে রাজস্ব ছাড় দিতে হিসাব কষা হচ্ছে।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডলার সংকটে আমদানি রপ্তানি প্রায় বন্ধ। ব্যবসা-বাণিজ্যে সংকটকাল চলছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী বাজেটে আমাদের দাবি অনুযায়ী নগদ সহায়তা দিতে হবে। রাজস্ব ছাড় দিতে হবে। কর অবকাশ ও কর অব্যাহতি বাড়াতে দিতে হবে।’
ঋণদাতা সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া সংস্কারের শর্ত মানার অঙ্গীকার করে সরকার ঋণ পেয়েছে। শর্ত পালনে ব্যর্থ হলে ঋণের যেকোনো কিস্তি আটকে দিতে পারে প্রতিষ্ঠানটি। পর্যায়ক্রমে প্রতি অর্থবছরের বাজেটে এসব সংস্কার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করে বাস্তবায়ন করা হবে। আসছে বাজেটে শর্ত মানার চেষ্টা থাকবে। বিশেষভাবে অতীতের মতো ঢালাওভাবে কর অব্যাহতি দেওয়া হবে না। আর্থিক খাতের সংস্কারের কিছু ঘোষণা থাকবে। বিশেষভাবে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জোর দেওয়া হবে। আইএমএফের সুপারিশে এরই মধ্যে ভ্যাট আইন চূড়ান্ত হয়েছে। আয়কর আইন মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন হয়েছে। শুল্ক আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ে আছে। এ তিন আইন অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ের কৌশল নির্ধারণ করা হবে। আসছে বাজেটে টেকসই অর্থনৈতিক সংস্কারের অংশ হিসেবে সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করার কথা বলা হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কিছু উদ্যোগের কথা শোনানো হবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঋণদাতা সংস্থার শর্ত মানার কথা বলা হলেও সব আগামী বাজেটে একবারে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করতে হবে। না হলে অর্থনীতির গতি কমে যাবে।’
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে এনবিআর-বহির্ভূত খাত এবং এনবিআর খাতের জন্য মোট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে ৪ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৯ শতাংশ বাড়িয়ে ধরা হতে পারে। এতে লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা হবে। এনবিআর এ লক্ষ্যমাত্রা কমানোর জোরালো আবেদন করেছে। কিন্তু তা আমলে আনেননি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। নতুন অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে প্রায় ৩৫ শতাংশ বা ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর (মূসক) হিসেবে, ৩৪ শতাংশ বা ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা আয়কর হিসেবে এবং ৩১ শতাংশ বা বাকি ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা শুল্ক হিসেবে সংগ্রহ করার কথা বলা হতে পারে বলে জানা গেছে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রার কথা শুধু বললেই হবে না। কীভাবে অর্জিত হবে, সেটি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা না থাকলে প্রতিবারের মতো ঘাটতি থাকবে। রাজস্ব ঘাটতি হলে অর্থনীতিতে আয় ব্যয়ের ভারসাম্য নষ্ট হয়। তাই এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবসম্মত হওয়া উচিত।’
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের জন্য নির্ধারিত এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এনবিআর উৎসে করের আওতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। সম্পদশালীদের ওপর নজর বাড়ানো হবে। শুধু বেশি সম্পদ থাকার কারণে অতিরিক্ত কর গুনতে হবে। সারচার্জ বহাল রাখা হবে। সুপারট্যাক্স গ্রুপকে উচ্চহারে গুনতে হবে কর। আগামী অর্থবছরেও অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুবিধা থাকবে। অর্থ পাচারোধে আইনের শাসন কঠোর করা হবে। অর্থ পাচার আটকাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হবে। করপোরেট কর কমানোর দাবি থাকলেও তা মানা হবে না। অন্যদিকে নির্বাচনের আগের বাজেট হওয়ায় করমুক্ত আয় সীমা বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করতে খোদ অর্থমন্ত্রী বললেও রাজস্ব আদায় কমে যাবে এমন যুক্তি দেখিয়ে এনবিআর রাজি নয় বলে জানিয়ে দিয়েছে। কমানো হবে শিল্পের অধিকাংশ কাঁচামাল আমদানি শুল্ক। ডলারের ওপর চাপ কমাতে বেশি ব্যবহৃত পণ্য আমদানিতে রাজস্ব ছাড় দেওয়া হবে। বিলাসবহুল পণ্য আমদানি কমাতে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হবে। তৈরি পোশাক খাতের সব সুবিধা বহাল রাখা হবে। শিল্পের অন্যান্য খাতেও কতটা সুবিধা বাড়ানো যায় তা নিয়ে এনবিআর হিসাব করছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া বাজেট প্রস্তুতিবিষয়ক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন প্রকল্পে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি এবং ঘাটতি ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হতে পারে। আগামী অর্থবছরে জিডিপির ৬ শতাংশ ঘাটতি ধরে ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হতে পারে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হতে পারে বলে জানা যায়। ঋণদাতা সংস্থার কাছ থেকে ভর্তুকি কমানোর চাপ থাকলেও আগামীবার এ খাতে বেশি ব্যয় ধরা হতে পারে। এ খাতে ১ লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে। চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি ব্যয় আছে ৮৬ হাজার কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, গত সোমবার রাতে আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ অনুমোদন করে। ঋণদাতা সংস্থাটির কাছ থেকে বাংলাদেশ ছয় কিস্তিতে তিন বছরে ৪৭০ কোটি ডলার পাচ্ছে। ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের দিন আইএমএফ ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক নিয়ে পূর্বাভাস দেয়। সংস্থাটি বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বেড়ে হতে পারে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা হতে পারে ৭ দশমিক ১ শতাংশ।
এতে রিজার্ভ সম্পর্কে বলা হয়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমে দাঁড়াবে ৩ হাজার কোটি ডলার। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে তা ধারাবাহিকভাবে বাড়বে এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছর শেষে প্রথমবারের মতো রিজার্ভ ৫ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।