
পরিবহন ধর্মঘট ও পথে পথে পুলিশি তল্লাশিসহ বিভিন্ন বাধা পেরিয়ে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর ও বরিশালের মতো ফরিদপুরেও বড় সমাবেশ করেছে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল শনিবার ফরিদপুর শহরতলির কোমরপুরের আব্দুল আজিজ ইনস্টিটিউট মাঠে হওয়া এই সমাবেশে দলটির নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের মানুষের প্রাণের দাবি। গত দুটি নির্বাচনে আপনারা মানুষের সঙ্গে প্রবঞ্চনা করে, মিথ্যা কথা বলে, ভুল বুঝিয়ে নির্বাচন নির্বাচন খেলা করে ক্ষমতায় চলে গেছেন। এবার আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি, মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এবার দেশে আর কোনো নির্বাচন হবে না, যতক্ষণ না নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেওয়া হবে।’
ফরিদপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এ এস এম কাইয়ুমের সভাপতিত্বে এবং জেলা বিএনপির সদস্যসচিব এ কে কিবরিয়ার সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান এ জেড এম জাহিদ হোসেন, সহসাংগঠনিক সম্পাদক মাশুকুর রহমান, মো. সেলিমুজ্জামান, ফরিদপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ প্রমুখ।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার বক্তব্যে বলেছেন তাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে সরিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। তিনি বলেন, ‘তারেক জিয়ার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট সরকারকে হটিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। জাতীয় সরকার কেমন হবে তা আগামীতে সমাবেশের মাধ্যমে আমাদের নেতা তারেক রহমান নির্দেশনা দেবেন।’
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই শেখ হাসিনার পদত্যাগ, আমরা চাই এই সংসদকে বিলুপ্ত করতে হবে, আমরা চাই অন্তর্বর্তীকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। সেই সরকার নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করবে। সেই নির্বাচন কমিশন নতুন নির্বাচন করবে, নতুন পার্লামেন্ট করবে। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেছেন, সেই নির্বাচনে আমরা জয়ী হলে একটা জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। জাতীয় সরকার গঠন করে আমরা রাষ্ট্রের মেরামত করতে চাই। আগামীতে রাষ্ট্রনায়ক হবেন তারেক জিয়া।’
বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে এক যুগে ১০ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ করেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘দেশের সম্পদ লুট করে তারা বিদেশে পাচার করছে। সরকার কোথায় চুরি করেনি? মেগা প্রজেক্ট থেকে শুরু করে বেকার ভাতা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা পর্যন্ত চুরি করেছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। রাজনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে, দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আমাদের ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করে দিয়েছে।’
বিকেল ৪টা ২৮ মিনিটে শুরু করে প্রায় আধা ঘণ্টা বক্তব্য দেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নাকি গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। এটা ভূতের মুখে রাম নাম। প্রশ্ন করি, আপনাদের কাছে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা কী? আপনাদের গণতন্ত্র মানে কি এই যে অন্য কাউকে কিছু বলতে দেব না?’
আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘তারা মনে করে এ দেশ তাদের বাবার দেশ, দেশের আর সকলে চাকরবাকর। কিন্তু এ অবস্থা আর চলবে না, মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তারা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত ঘরে ফিরে যাবে না।’
বেলা আড়াইটায় সমাবেশের প্রধান অতিথি ও অন্য অতিথিরা মঞ্চে উঠলেও মূলত নেতাদের বক্তব্য দেওয়া শুরু হয় বেলা ১১টা থেকেই। এর আগেই সমাবেশের মাঠ কানায় কানায় ভরে যায়। ফরিদপুরের ৯টি উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড থেকে খ- খ- মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে জড়ো হন নেতাকর্মীরা। রংবেরঙের টি-শার্ট-ক্যাপ পরে তারা দলের নেতাদের ছবিসংবলিত প্ল্যাকার্ড-ফেস্টুন বহন করেন।
পথে পথে বাধা পেরিয়ে মুখর সমাবেশস্থল : গত শুক্রবার সকাল থেকে শুরু হওয়া বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে বিএনপি এবং এর সহযোগী সংগঠনের হাজারো নেতাকর্মী ও অনুসারী দলটির সমাবেশে যোগ দেন। গণসমাবেশ বিকেল ৩টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সকাল থেকেই মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে যোগ দেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। ফরিদপুরসহ আশপাশের জেলা থেকে আসা নেতাকর্মীদের ভিড়ে পরিপূর্ণ হয়ে যায় সমাবেশস্থল আব্দুল আজিজ ইনস্টিটিউট মাঠ। খণ্ড খণ্ড মিছিলে মুখরিত হয়ে ওঠে মাঠ ও সংলগ্ন এলাকা। অবশ্য এই সমাবেশের তিন দিন আগে থেকেই ওই মাঠে আসতে শুরু করেছিলেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। গত শুক্রবার রাতেই তাদের ভিড়ে পরিপূর্ণ হয়ে যায় মাঠটি।
বিএনপির এই বিভাগীয় গণসমাবেশের আগের দিন শুক্রবার সকাল থেকে ফরিদপুরে পরিবহন ধর্মঘট শুরু হয়। ফলে ফরিদপুরের সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। এতে বিএনপির নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। বিএনপি নেতাতের অভিযোগ, তাদের সমাবেশ বাধাগ্রস্ত করতে সরকারের ইন্ধনে বাস-মিনিবাস ধর্মঘট ডাকা হয়।
এর আগে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর ও বরিশালে বিএনপির পাঁচটি গণসমাবেশ হয়েছে। সেসব সমাবেশেও নানাভাবে বাধার মুখে পড়েন সমাবেশমুখী নেতাকর্মী-সমর্থকরা। পরিবহন ধর্মঘট ছাড়াও নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে। বিএনপির এই গণসমাবেশের আগের দিন শুক্রবার বিকেলে শহরে কয়েক হাজার নেতাকর্মী নিয়ে গণমিছিল করে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগ।
গতকাল বিএনপির সমাবেশে যাওয়ার পথে শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশের তল্লাশির ফলে ভোগান্তিতে পড়ে মানুষ। সকাল থেকে শহরে যান চলাচল ছিল একেবারেই কম। এতে দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা। হাতে গোনা কিছু ভ্যান, অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল চলাচল করলেও পুলিশি বাধার মুখে পড়তে হয় বলে অভিযোগ করেছেন যাত্রী ও চালকরা।
ইন্টারনেট সেবা বিঘ্নিত : গতকাল সকাল ১০টা থেকে ফরিদপুর জেলায় মোবাইল ইন্টারনেট সেবায় বিঘ্ন ঘটে বলে দাবি করেছেন অনেকেই। মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীরা জানান, সকাল ১০টার পর থেকে তারা মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেননি।
বিএনপির ফরিদপুর বিভাগীয় সমাবেশের প্রেস উপকমিটির আহ্বায়ক এ বি সিদ্দিক মিতুল অভিযোগ করে বলেন, ‘সরকার নানাভাবে আমাদের এই সমাবেশ বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছে। সর্বশেষ তারা জেলার মোবাইল ইন্টারনেটের গতি স্থির করেছে, কিন্তু তাদের অপচেষ্টা সফল হবে না।’
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, লোডশেডিং, ‘দুর্নীতি-দুঃশাসন’, ‘লুটপাট’, মামলা-হামলা, ‘গুম’, ‘হত্যা’, ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশ করবে বিএনপি। তারই অংশ হিসেবে সারা দেশে হচ্ছে দলটির বিভাগীয় সমাবেশ। এর আগে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর ও বরিশালে সমাবেশ করেছে দলটি।
বিএনপি এখনই মনোনয়ন বাণিজ্য শুরু করেছে বলে অভিযোগ তুলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘ফরিদপুরে আজ টাকা উড়ছে, মির্জা ফখরুল কাকে কাকে মনোনয়ন দেবেন, কাকে মন্ত্রী বানাবেন এসব কথা বলে বস্তায় বস্তায় টাকা নিচ্ছেন। তারেক রহমান বস্তায় বস্তায় টাকা সুইস ব্যাংকে পাঠিয়েছেন। এফবিআই এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দিয়েছে। এবার ডিসেম্বরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তাদের এই বাণিজ্যের বিরুদ্ধে খেলা হবে, খেলা হবে আন্দোলনে, খেলা হবে নির্বাচনে। বিএনপি ফাউল করলে তাদের লাল কার্ড দেখাবে জনগণ।’
গতকাল শনিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে এসব কথা বলেন ওবায়দুল কাদের। দীর্ঘ আট বছর পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হলো। নিয়াজ মোহাম্মদ স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলন উদ্বোধন করেন দলের সাধারণ সম্পাদক।
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এই বাংলার ইতিহাস বীরের ইতিহাস, বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। যদি জিয়াউর রহমান হত্যাকারীদের সঙ্গে না থাকতেন, তাহলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সাহস হতো না। জিয়াউর রহমান খুনিদের পুরস্কৃত করেছেন। এই জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষা করতে আইন সংশোধন করেছিলেন। ১৫ আগস্টের মাস্টারমাইন্ড জিয়াউর রহমান, আর ২১ আগস্টের মাস্টারমাইন্ড তারেক রহমান।’
সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর কারণে যারা মেজর থেকে মেজর জেনারেল হয়েছেন তারাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা জিয়াউর রহমান ও খালেদ মোশাররফের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। জেনারেল শফিউল্লাহ জীবিত থাকলেও জীবন্মৃত, মানুষ তাকে ঘৃণা করে।’
শেখ সেলিম আরও বলেন, ‘তারেক রহমান দেশে আসলে গণপিটুনির শিকার হবেন।’
সম্মেলনে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কামরুল ইসলাম, সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সবুর, কেন্দ্রীয় সদস্য পারভীন সুলতানা কল্পনা ও ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম (অব.)।
সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য অ্যারোমা দত্ত, এবাদুল করিম বুলবুল ও বিএম ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হেলাল উদ্দিন, পৌর মেয়র মিসেস নায়ার কবীর, যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবুল বারী চৌধুরী প্রমুখ।
সম্মেলনের শেষদিকে সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীকে সভাপতি, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আল মামুন সরকারকে সাধারণ সম্পাদক, সাবেক মেয়র হেলাল উদ্দিনকে এক নম্বর সহসভাপতি, মো. হেলাল উদ্দিনকে সহসভাপতি ও মাহাবুবুল বারী চৌধুরী মন্টুকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করেন। এ সময় তিনি বলেন, এই পাঁচ নেতা দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ ও সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনকে সঙ্গে নিয়ে আগামী এক মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করবেন।
সম্মেলন শুরু হয় দুপুর আড়াইটার পর। তবে সকাল ১১টার পর জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার নেতাকর্মী বাদ্য-বাজনা, ব্যানার ফেস্টুনসহ সম্মেলন যোগ দিতে আসেন। দুপুর ২টার মধ্যেই পুরো স্টেডিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। সম্মেলন উপলক্ষে জেলা প্রশাসন ও পুলিশের পক্ষ ব্যাপক ও কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। গত এক সপ্তাহ থেকে জেলা শহর সেজে ওঠে ব্যানার-ফেস্টুন ও তোরণে।
অমর একুশে গ্রন্থমেলা ১৯৯৫, ২১ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টার দিকে মেলায় ঢুকেই ‘সময় প্রকাশন’-এর স্টলে চলে এলেন হুমায়ূন আহমেদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের হাউজ টিউটরের কোয়ার্টার এবং এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় বসবাসকালে প্রায় প্রতিদিনই মেলায় আসতেন তিনি। হলের বাসা থেকে মাঝেমধ্যে স্ত্রী ও সন্তানদেরসহ আনতেন। সেই দিন সঙ্গে ছিলেন অভিনেতা মোজাম্মেল হক, যিনি নাটকের চরিত্রের নাম ‘হানিফ’ ও ‘খাদক’ নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ ‘সময় প্রকাশন’-এর স্টলে প্রবেশের আগেই অনেক পাঠক জড়ো হয়েছিলেন। সে বছর সময় থেকে লেখকের ‘এবং হিমু...’ বইটি প্রকাশিত হয়। তখন ফেব্রুয়ারি বইমেলার দৃশ্যই ছিল এরকম হুমায়ূন আহমেদের নতুন বই কবে মেলায় আসবে? হুমায়ূন আহমেদ কখন আসবেন? পাঠক-ভক্তরা খোঁজ রাখতেন। নতুন বই যে প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়েছে সেই স্টলের সামনে এসে পাঠকরা জড়ো হয়ে লেখকের জন্য অপেক্ষা করতেন। লেখককে একনজর দেখবেন আর তার অটোগ্রাফ নেবেন। সময় প্রকাশনের স্টলের সামনে ভিড় তখন উপচে পড়ছে, সবাইকে এক লাইনে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু উৎসুক ভক্তদের ভিড় সামাল দেওয়া যাচ্ছে না পুলিশ দিয়েও। এক পর্যায়ে জনতার চাপে স্টলের সামনের কাউন্টার টেবিল ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হলো, পুলিশ কোনোক্রমে বাইরের জনতা ঠেকাচ্ছে আর স্টলের ভেতর থেকে সময়ের বিক্রয়কর্মীরা টেবিল চাপ দিয়ে ধরে রেখেছে। হুমায়ূন আহমেদ নিজমনে অটোগ্রাফ দিয়ে চলেছেন। ক্রেতাকে বই দেওয়ার লোক নেই। আমি এবং কবি হাসান হাফিজ বই দিচ্ছি। হাসান হাফিজ এসেছিলেন হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা করতে।
সে সময় বাংলা একাডেমির একজন পরিচালক ছিলেন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, তিনি বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করছিলেন। ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে নূরুল হুদা হুমায়ূন আহমেদকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। এতে অপেক্ষমাণরা খুব অসন্তুষ্ট। তাদের চাপে হুমায়ূন আহমেদের বসার ব্যবস্থা করা হলো বর্ধমান হাউজের একটি কক্ষে। বর্ধমান হাউজের পূর্বদিকে গোলাকৃতির যে বারান্দা আছে তার সংলগ্ন রুমে বসতেন একাডেমির ফোকলোর পরিচালক শামসুজ্জামান খান। তার রুমেই লেখককে বসিয়ে অটোগ্রাফ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। পরবর্তী সময়ে জনাব খান বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হন এবং মুহম্মদ নূরুল হুদা বর্তমান মহাপরিচালক।
বাংলাদেশে হুমায়ূন আহমেদ নামের একজন লেখকের অবিশ্বাস্য পরিমাণ বই বিক্রি হয় এবং ফেব্রুয়ারি বইমেলায় তার অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য মানুষের ভিড় কিংবদন্তি পর্যায়ে চলে গেছে এই সংবাদ কলকাতার বইয়ের সঙ্গে সম্পৃক্তদের বেশ উৎসুক করে তোলে। ১৯৯৪ সালের বইমেলায় কলকাতা থেকে ‘আনন্দ পাবলিশার্স’-এর ম্যানেজার বাদল বসু কলকাতার কয়েকজন জনপ্রিয় লেখকসহ বইমেলা দেখতে আসেন, সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা।
ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল থাকতেন আমেরিকায়। ১৮ বছর পর স্ত্রী, পুত্র-কন্যাসহ বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছিলেন। বড় ভাইয়ের এই জনপ্রিয়তার কথা শুনে থাকলেও চোখে দেখা হয়নি। ১৯৯২ সালে তার আসা এবং যাওয়া নভেম্বর-ডিসেম্বরে সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৯৪ বা ’৯৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে এলেন। বইমেলায় বেড়াতে এলেন। হুমায়ূন আহমেদ তখন ভক্তদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। দীর্ঘকাল বিদেশে থাকা জাফর ইকবালের স্ত্রী ড. ইয়াসমীন হক এই কালচারের সঙ্গে তেমন পরিচিত নন। উনি খুবই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন এবং আমাকে বারবার বলতে লাগলেন, ‘দাদা ভাইয়ের নিরাপত্তা কই? এভাবে তো যেকোনো সময় কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।’
এসব স্মৃতি এখন গল্প। এখন আর বইমেলাতে এমন ভিড় হয় না। দর্শক অধীর হয়ে কোনো প্রিয় লেখকের বইয়ের অপেক্ষায় থাকেন না! এই বিষয়গুলো বইমেলার একটি অতিরিক্ত আকর্ষণ সৃষ্টি করত। দলে দলে ক্রেতা, এমনকি দর্শক বইমেলায় আসতেন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। ইদানীংকালের বইমেলায় সেই আকর্ষণ নেই, তাই সেরকম দৃশ্যের অবতারণাও হয় না।
বাংলাদেশের সৃজনশীল বইয়ের জনপ্রিয়তা সৃষ্টির পেছনে হুমায়ূন আহমেদের অনেক অবদান। এরকম অনেক গল্প আছে যা বললে বোঝা যাবে কীভাবে তিনি চেষ্টা করেছেন পাঠক বৃদ্ধিতে। তার শুরুটা খুব সুখকর ছিল না। গত শতকের নয় দশকে আমেরিকা থেকে ফিরে যখন আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন, তখন অধ্যাপনার সঙ্গে সঙ্গে আবার শুরু করলেন লেখালেখি। কিন্তু পাঠক কই বা প্রকাশক কই? যে কয়েকজন প্রকাশক আছেন তাদের শুধু সৃজনশীল প্রকাশক বলা যায় না। তিনি চাইছিলেন এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে কেউ শুধু এদেশের লেখকদের সৃজনশীল বই-ই প্রকাশ করবেন। তখন কয়েকজন প্রকাশককে দিয়ে এ কাজটি তিনি করাতে পেরেছিলেন। আমদানিনির্ভরতা ঝেড়ে ফেলে দেশি বইয়ের প্রকাশনায় সম্পৃক্ত করাতে পেরেছিলেন দুয়েকজনকে। হুমায়ূন আহমেদ বলতেন, ‘আমি এমন ২৫ হাজার পাঠক সৃষ্টি করব। যেসব পরিবার তাদের বাসার বুক শেলফে হুমায়ূন আহমেদের প্রতিটি বই সাজিয়ে রাখবে।’ যদিও পরবর্তীকালে তার পাঠক সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি হয়েছিল। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, হুমায়ূন আহমেদ নিজের পাঠক সৃষ্টি করতে গিয়ে দেশের এক বৃহৎ অংশকে পাঠকে পরিণত করেছিলেন। এই পাঠকদের বইপড়া নেশায় পরিণত হয়েছিল, আর তারা শুধু হুমায়ূন আহমেদের বইয়ে সীমাবদ্ধ থাকেননি। অন্য লেখকদের বইও পড়েছেন। তাই তো ১৯৯০ সাল থেকে সারা দেশে বইয়ের পাঠক বৃদ্ধি পেতে থাকে, সৃষ্টি হয় অনেক নতুন লেখক, তারাও জনপ্রিয়তা পেতে থাকেন। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর এক দশক পরও এই প্রভাব সৃজনশীল বইয়ের বাজার এবং বইমেলায় পরিলক্ষিত হয়।
কিন্তু একথা তো সত্য যে, হুমায়ূন আহমেদের নতুন কোনো বই আর আসছে না, আসার উপায় নেই। সেই আকর্ষণ, সেই ক্রেজ সৃষ্টি হচ্ছে না, কেউ পারছেন না। কিংবদন্তিতুল্য লেখক হুমায়ূন আহমেদ এখনো পাঠকের হৃদয়ে বসবাস করছেন। পাঠক এখনো বইমেলা বা বইয়ের ঘাঁটি বাংলাবাজারে এসে হুমায়ূন আহমেদের বইগুলো খুঁজে ফেরে। একথা কেউ অস্বীকার করবেন না যে, অন্য যেকোনো লেখকের তুলনায় এখনো পাঠক হুমায়ূন আহমেদেই আটকে আছেন বেশি করে। যদিও লেখকের মৃত্যুর পর অনেক প্রকাশক তার পুরনো বই কয়েকটি একত্রিত করে নতুন একটি নাম দিয়ে প্রকাশ করছেন এবং এই ধারা অব্যাহত আছে। এতে করে পাঠক নষ্ট হচ্ছে। পাঠক একটি বই কিনে বাসায় নিয়ে যে ৫-৭টি উপন্যাস বা ২০-২৫টি গল্প দেখতে পান, সেগুলোর অধিকাংশই হয়তো আগে পড়েছেন। এ ধরনের সংকলন প্রকাশ থেকে বিরত থাকা আমাদের উচিত প্রকাশনার স্বার্থে। আমরা যদি সঠিকভাবে বিশ্বস্ততার সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশনাগুলো লালন করি, তবে আরও দীর্ঘদিন সৃজনশীল সাহিত্য উপকৃত হবে এই লেখকের বই থেকে। আমাদের ভালো আমাদেরই বুঝতে হবে।
গত শতাব্দীর নয় দশকের একজন সৃজনশীল প্রকাশক হিসেবে আমার উত্তরণের জন্য আমি ঋণী হুমায়ূন আহমেদের কাছে। তার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। প্রকাশক, সময় প্রকাশন
মেলবোর্নে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে পাকিস্তান আর ইংল্যান্ডেরই দেখা হওয়াটা আসলে দুটো ভিন্ন ক্রিকেট দর্শনেরও মুখোমুখি অবস্থান। ইংল্যান্ড, ক্রিকেটের জনক এবং খেলাটাকে ঘিরে তাদের যত চিন্তা, গবেষণা এবং তত্ত্বের প্রয়োগ সবই খেলাটাকে করেছে সমৃদ্ধ। অন্যদিকে পাকিস্তান, প্রকৃতির খেয়ালে এখানে অনাদরে অযতেœ বেড়ে ওঠে অদ্ভুত সব প্রতিভা। নানান ধরনের বৈপরীত্য আর গোলমালের ভেতরেও কেমন করে যেন ঠিকই সাফল্যের সন্ধান পেয়ে যায় তারা। ঠিক খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ছিনিয়ে নেয় শিরোপা। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালটা যেন পেশাদারি আর প্রতিভার মুখোমুখি অবস্থান।
প্রায় এক বছর আগে, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের গত আসরেই সেমিফাইনালে খেলেছিল পাকিস্তান ও ইংল্যান্ড। নিউজিল্যান্ডের কাছে হেরে ফাইনালে খেলা হয়নি গ্রুপ পর্বে দারুণ খেলা ইংল্যান্ডের, অস্ট্রেলিয়ার ম্যাথু ওয়েডের ক্যাচটা হাসান আলী ছেড়ে দিয়ে পাকিস্তানের বিশ্বকাপ অভিযানটাই শেষ করে দিলেন সেমিফাইনালে।
ভাগ্য তাদেরই আবার মুখোমুখি করে দিল মেলবোর্নে। হয়তো ১৯৯২’র স্মৃতি ফিরিয়ে আনতেই। রাজনৈতিক সমাবেশে পায়ে গুলিবিদ্ধ হওয়া ইমরান খান কি বাড়িতে টিভি সেটের সামনে বসে দেখবেন, ৩০ বছর পর এমসিজিতে বিশ্বকাপটা উঁচিয়ে ধরেছেন বাবর আজম? গ্রাহাম গুচের কি আক্ষেপ মিটবে জস বাটলারের হাতে কাপটা দেখতে পেলে?
পাকিস্তান এবং ইংল্যান্ড, দুই দলেরই পথচলায় ছিল হোঁচট। ইংল্যান্ড হেরে যায় আয়ারল্যান্ডের কাছে, পাকিস্তানের হার জিম্বাবুয়ের সঙ্গে। তবে পাকিস্তানের ফাইনালে খেলাটা মনে করিয়ে দেয় সেই ১৯৯২’র বিশ্বকাপকেই। নেদারল্যান্ডসের অবিশ্বাস্য কীর্তিতে সৌভাগ্যের দরজা খুলে যায় পাকিস্তানের সামনে, গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে বাংলাদেশকে হারিয়ে তারা পৌঁছে যায় সেমিফাইনালে। সেখানে প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড, একাধিকবার যাদের বিপক্ষে নকআউটে জয়ের নজির আছে পাকিস্তানের। ব্ল্যাকক্যাপদের হারিয়ে সবার আগে ফাইনালে পাকিস্তান, অথচ আসরের প্রথম দুটো ম্যাচেই হেরেছিল তারা।
অন্যদিকে ইংল্যান্ড, শুরু থেকেই ফেভারিটের তকমা গায়ে সেঁটে থাকলেও আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে হার আর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটা বৃষ্টিতে পয়েন্ট ভাগাভাগি হওয়াতে সেমিফাইনালে ওঠা নিয়ে তৈরি হয়েছিল শঙ্কা। শেষ চারে জায়গা করলেও ভারত-পাকিস্তান ফাইনাল, আইসিসির ষড়যন্ত্রৃ নানান তত্ত্ব ঘিরে ধরেছিল ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচকে। জস বাটলার আর অ্যালেক্স হেলস নির্মম প্রহারে সব কানাঘুষাকে একদম তাসমান সাগরে নিয়ে ফেলেছেন। ভারতের ১৬৮ রান ১৬ ওভারে কোনো উইকেট না হারিয়ে যেভাবে জিতেছে ইংল্যান্ড, তার তুলনা দেওয়া যায় কেবল ২০১৪ ফুটবল বিশ্বকাপে জার্মানির কাছে ব্রাজিলের ৭-১ গোলের হারকে। এতটা একপেশে সেমিফাইনালে কোনো ফেভারিট দলকে নিকট অতীতে এভাবে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে দেখার স্মৃতি অনেকেরই নেই।
পাকিস্তান অধিনায়ক বাবর আজম ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, ১৯৯২’র বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য এবং পিসিবির চেয়ারম্যান রমিজ রাজা দেখা করেছেন দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে। তাতে বেড়েছে মনোবল। অন্যদিকে জস বাটলার অধিনায়ক হিসেবে তার প্রথম বছরে, প্রথম বড় আসরেই শিরোপা জয়ের খুব কাছাকাছি। ২০১৯ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপজয়ী ইংল্যান্ড বছর তিনেকের মাথায় আরও একটা বিশ্বকাপ জয়ের দ্বারপ্রান্তে।
বাটলারের কাছে যখন প্রশ্নটা করা হয়েছিল, তখনো মেয়েদের রাগবি বিশ্বকাপের ফাইনালটা হয়নি। যেখানে নিউজিল্যান্ডের কাছে হেরে গেছে ইংল্যান্ড। রাগবি লিগ ওয়ার্ল্ড কাপেরও সেমিফাইনালে ইংল্যান্ড, আসছে ফুটবল বিশ্বকাপও। এত কিছুর ভিড়ে ইংল্যান্ডের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়টা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
বাটলারের জবাব ছিল, ‘২০১৯ সালের বিশ্বকাপ জয়ের প্রভাব আমরা দেখেছি। ট্রাফলগার স্কয়ার লোকারণ্য ছিল, জানি না এবারও সকাল ৮টায় ট্রাফলগার স্কয়ারে কেউ খেলা দেখতে আসবে কি না তবে বাড়িতে থাকলেও তাদের শুভকামনা পাব।’ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলায় সেদেশের ফ্রি-টু-এয়ার চ্যানেলে সরাসরি দেখা যাবে সম্প্রচার, এতদিন পর্যন্ত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের খেলা দেখা যাচ্ছিল কেবল পে-চ্যানেলেই।
অন্য অনেকগুলো খেলায় সাফল্য আসে বলেই হয়তো ক্রিকেটের বিশ্বকাপ জেতা বা না জেতায় খুব বড় কোনো অদলবদল হবে না ইংল্যান্ডের ক্রিকেটে। যেমনটা হয়েছিল ২০১৫ সালে, বাংলাদেশের কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাওয়ার পর। অন্যদিকে পাকিস্তান বা উপমহাদেশের বেলায় ক্রিকেট যতটা না খেলা, তা চেয়ে বেশি রাজনৈতিক যন্ত্র। পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সহিংসতা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা সবই কিছুদিনের জন্য চাপা পড়ে যাবে শিরোপা জয়ের উচ্ছ্বাসে।
প্রায় একই দল নিয়ে এশিয়া কাপের ফাইনালে শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে যাওয়ার নজির আছে পাকিস্তানের, আবার নিউজিল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজ জেতার উদাহরণও আছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের মাটিতেই পাকিস্তানকে ৭ টি-২০ ম্যাচের সিরিজে ৪-৩ ব্যবধানে হারিয়ে আসার স্মৃতিটাও ইংল্যান্ডের টাটকা।
মুখোমুখি দুই দলের ভেতর শক্তি আর সামর্থ্যরে ফারাকটা খুবই কম, তবে মানসিকতায় বিস্তর। একদিকে ইংল্যান্ড, পেশাদার এবং নির্মোহ। অন্যদিকে পাকিস্তান, আবেগি এবং খেয়ালি। পেশাদারি মানসিকতা হয়তো ঝুঁকি নিতে দেবে না, আবার অন্ধ আবেগ কী করতে পারে তার উদাহরণ দেখিয়ে গেছে বাংলাদেশ।
এমন ম্যাচে তাই হতে পারে যে কোনো কিছুই। সেমিফাইনালে অমন রুদ্রমূর্তির পর ইংল্যান্ডকে কেউ কেউ খানিকটা এগিয়ে রাখছেন, কিন্তু মনে রাখতে হবে ভুবনেশ্বর কুমার আর শাহিন শাহ আফ্রিদিতে ততটাই ফারাক যতটা আম আর আমড়ায়!
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকার কখনো রিজার্ভ থেকে এক পয়সাও নষ্ট করে না; বরং প্রতিটি অর্থ ব্যয় করে বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থে ও কল্যাণে।
গতকাল শনিবার ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজের উদ্বোধনের সময় এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। গণভবন থেকে সাভারের আশুলিয়া বাজারসংলগ্ন কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন তিনি। ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ব্যয় হবে ১৭ হাজার ৫৫৩ কোটি ৪ লাখ টাকা।
সরকারপ্রধান বলেন, ‘আজকাল বিরোধী দল থেকে প্রশ্ন করে রিজার্ভের টাকা গেল কোথায়, সারা দেশে অপপ্রচার করে। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল রিজার্ভ ছিল তখন ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ইউএস ডলার। তারা পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিল, ওই সময় রিজার্ভ ৫ বিলিয়নের মতো বৃদ্ধি পেয়েছিল। আর আমরা সেই রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়নে পৌঁছাই। এর মধ্যে করোনার আঘাত এবং একই সঙ্গে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা তৈরি হয়েছে। আমাদের অর্থনীতিতেও প্রভাব পড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা করোনার ভ্যাকসিন কিনে এনেছি। বিনা পয়সায় টেস্ট করিয়েছি, টিকা দিয়েছি। কোনো উন্নত দেশও বিনা পয়সায় টেস্ট করেনি, ভ্যাকসিন দেয়নি।’
খাদ্যশস্য, জ্বালানি তেলসহ এখনো অনেক পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যা কিছু আমদানি করতে হচ্ছে, সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। রিজার্ভ যা খরচ করছি জনগণের কল্যাণে, জনগণের মঙ্গলে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রিজার্ভের অর্থ থেকে বিমান কেনা হয়েছে। নদীতে ড্রেজিং করা হয়েছে এবং উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অন্য দেশের ডলার আনলে সুদ দিতে হয়। দেশের টাকা নিজেদের দেশে বিনিয়োগ করলে দেশের টাকা দেশই থাকে। পয়সা কেউ তুলে নিয়ে চলে যায়নি।’
শেখ হাসিনা এ সময় দেশের যোগাযোগব্যবস্থায় উন্নয়নের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘আজ সকাল সাড়ে ৭টায় ফোন পেলাম। বলল, “আপা, আপনার জন্য ইলিশ পাঠিয়েছি।” সাড়ে ৭টায় মেসেজ পেলাম, সাড়ে ৯টায় ইলিশ চলে আসল। এটি হয়েছে যোগাযোগটা সহজ হওয়ার কারণে।’
সরকারপ্রধান এ সময় বিএনপির সমালোচনা করে বলেন, ‘চুরি করে বিএনপি অর্থ-সম্পদ বানিয়েছে। জিয়া মারা যাওয়ার সময় একটা স্যুটকেস ছাড়া কিছু রেখে যায়নি। পরে দেখি হাজার হাজার কোটি টাকা। মানি লন্ডারিং মামলায় তারেক রহমানের সাত বছরের সাজা হয়েছে, এ কারণে তাদের মুখে সমালোচনা মানায় না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গত ১৩ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ বদলে গেছে। একটি মানুষও গৃহহীন, ভূমিহীন থাকবে না, আমরা বলেছি। যত টাকা, সব আমরা মানুষের কল্যাণে খরচ করছি। করোনায় সহায়তা দিয়েছি। প্রণোদনা দিয়েছি। মালিকদের হাতে না দিয়ে মোবাইলের মাধ্যমে সরাসরি শ্রমিকদের হাতে দিয়েছি। কৃষকদের ভর্তুকি দিচ্ছি। মানুষের কল্যাণই আমাদের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে চলেছি।’
আসন্ন বৈশি^ক সংকট মোকাবিলায় আবারও পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, ‘নিজেদের ফসল উৎপাদন করতে হবে, খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। প্রতিটি বক্তৃতায় এ কথা বলি। পৃথিবীর কোথাও দুর্ভিক্ষ হলেও বাংলাদেশে যেন ধাক্কা না লাগে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করে দিচ্ছি চলাচল ও পরিবহন সহজ হয় যাতে। নৌ, সড়ক, আকাশপথ সহজ করেছি। এগুলো আকাশ থেকে পড়েনি। উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখে এগিয়ে যেতে হবে।’
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শুরু করে আব্দুল্লাহপুর-আশুলিয়া-বাইপাইল হয়ে নবীনগর মোড় এবং ইপিজেড হয়ে চন্দ্রা মোড় পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হবে। ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে শীর্ষক এ প্রকল্প ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। এটি বাস্তবায়িত হলে ঢাকার সঙ্গে ৩০টি জেলার সংযোগ স্থাপনকারী আব্দুল্লাহপুর-আশুলিয়া ও বাইপাইল-চন্দ্রা করিডরে যানজট অনেকাংশে কমবে। উত্তরবঙ্গসহ ৩০টি জেলার চার কোটিরও বেশি মানুষ এক্সপ্রেসওয়ে থেকে উপকৃত হবে। এ ছাড়া জনগণ ও পণ্য পরিবহন সহজ ও দ্রুত করে তুলবে এবং যানজট কমাতে সহায়তা করবে। এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের নথিতে শূন্য দশমিক ২১৭ শতাংশ দেশের মোট জিডিপি বাড়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের ব্যয়ের বেশির ভাগ অর্থ দেবে চীন।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বক্তব্য দেন। সেতু বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মঞ্জুর হোসেন এক্সপ্রেসওয়ে সম্পর্কে পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপন করেন।
অনুষ্ঠানে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়। আশুলিয়ায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমানসহ সর্বস্তরের মানুষ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল শনিবার ফরিদপুরে হয়েছে বিএনপির ষষ্ঠ বিভাগীয় গণসমাবেশ। এর আগে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর ও বরিশালে হওয়া গণসমাবেশগুলোর মতো ফরিদপুরের সমাবেশেও দলটির নেতাকর্মীদের বিভিন্ন বাধা পেরিয়ে অংশ নিতে হয়েছে। সমাবেশে অংশ নিতে যাওয়ার পথে শহরের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে বাধার মুখে পড়তে হয় বিএনপি নেতাকর্মীদের। এছাড়া পাশের অন্য জেলাগুলো থেকে সমাবেশগামী বিএনপি নেতাকর্মীরাও পুলিশি বাধার মুখে পড়েন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অন্যদিকে বিএনপির সমাবেশ শুরুর আগে গতকাল সকাল ১০টা থেকে পুরো ফরিদপুর জেলায় মোবাইল ইন্টারনেট সেবায় বিঘ্ন ঘটে বলে জানিয়েছেন অনেকেই।
বিএনপি নেতাকর্মীদের অভিযোগ, সকাল থেকে শহরের ভাঙ্গা রাস্তার মোড়, রাজবাড়ী রাস্তার মোড়, বদরপুরের মোড়, বাহিরদিয়া সেতু এলাকা ও নগরকান্দার তালমা মোড়ে পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়ে বিভিন্ন যানবাহন চলাচলে বাধা দেয়। কাগজপত্র পরীক্ষা ও তল্লাশির নামে করা হয় হয়রানি। এ সময় ইজিবাইক, ছোট পিকআপ ভ্যান, মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ভ্যানসহ বিভিন্ন ছোট যান থেকে বিএনপির নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ যাত্রীদেরও নামিয়ে দেওয়া হয়। দিনভর বিএনপির সমাবেশস্থলে যাওয়ার প্রধান পথ শহরের ভাঙ্গা রাস্তার মোড় ও রাজবাড়ী রাস্তার মোড়ে পুলিশের তৎপরতা বেশি দেখা গেছে। ফরিদপুর শহরে ঢোকা কিংবা শহর থেকে আশপাশের জেলায় যেতে হলে ওই দুই মোড় ব্যবহার করতে হয়। তবে পুলিশের দাবি, সমাবেশস্থলের আশপাশে যানজট ও জনদুর্ভোগ কমাতে এসব এলাকায় যান চলাচল করতে দেওয়া হয়নি।
ফরিদপুরে বিএনপির গণসমাবেশের আগের দিন গত শুক্রবার সকাল থেকে জেলা মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ডাকে আঞ্চলিক বাস, মিনিবাসসহ দূরপাল্লার সব রুটে বাস ধর্মঘট শুরু হয়। গতকাল সকাল থেকে ফরিদপুর শহরে যান চলাচল একেবারেই কম দেখা গেছে। এতে দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা। হাতেগোনা কিছু ভ্যান, অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল চলাচল করলেও পুলিশি বাধার মুখে পড়তে হয় বলে অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা।
জেলার প্রবেশ দ্বার শহরের রাজবাড়ী রাস্তার মোড়, বদরপুরের মোড়, ভাঙ্গা রাস্তার মোড় ও ইমাম উদ্দিন স্কয়ার এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পুলিশ তল্লাশি চৌকি বসিয়েছে। এ সময় ইজিবাইক, ভ্যান, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন ছোট যান থেকে বিএনপির নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ যাত্রীদেরও নামিয়ে দিতে দেখা যায়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমন রঞ্জন সরকার বলেন, ‘সমাবেশকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য আমরা এই তল্লাশি করিনি। এটা আমাদের নিয়মিত চেকিংয়ের অংশ। মোটরসাইকেল বা গাড়ির কাগজপত্র দেখা নিয়মিত দায়িত্ব। এটা আমরা নিয়মিত করে থাকি। আর সন্দেহ মনে করলে কোনো গাড়িতে তল্লাশি করেছি। এটা জনগণের জানমাল ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ আইন অনুযায়ী করে থাকে।’
ইন্টারনেট সেবা বিঘ্নিত : গতকাল সকাল ১০টা থেকে ফরিদপুর জেলায় মোবাইল ইন্টারনেট সেবায় বিঘ্ন ঘটে বলে দাবি করেছেন অনেকেই। মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীরা জানান, সকাল ১০টার পর থেকে তারা মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেননি।
বিএনপির ফরিদপুর বিভাগীয় সমাবেশের প্রেস উপ-কমিটির আহ্বায়ক এ বি সিদ্দিক মিতুল অভিযোগ করে বলেন, ‘সরকার নানাভাবে আমাদের এই সমাবেশকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। সর্বশেষ তারা জেলার মোবাইল ইন্টারনেটের গতি স্থির করেছে, কিন্তু তাদের অপচেষ্টা সফল হবে না।’
পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে সমাবেশে মাগুরা বিএনপির নেতাকর্মীরা : পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে ফরিদপুরের বিভাগীয় গণসমাবেশে যোগ দেন মাগুরা জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা। গতকাল সকাল ১০টার দিকে পাঁচ শতাধিক মোটরসাইকেল নিয়ে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের শ্রীপুর উপজেলার ওয়াপদা বাজার এলাকায় জড়ো হন বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। জেলা বিএনপির নেতা অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান অভিযোগ করেন, মাগুরা জেলার বিএনপি নেতাকর্মীরা শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশস্থলে যেতে চাইলেও পুলিশ তাদের নানাভাবে হয়রানি করে। সকালে শ্রীপুরের ওয়াপদাহ কামারখালী ব্রিজের কাছে সমাবেশে যোগ দিতে যাওয়া মোটরসাইকেল বহর পুলিশ আটকে দেয়। পরে গড়াই ও মধমুতি নদীর তীর দিয়ে শ্রীপুরের গোয়ালদহ ও মহম্মদপুরের বাবুখালী মাঝিবাড়ির ঘাট পার হয়ে বিকল্প পথে ফরিদপুরের সমাবেশস্থলে পৌঁছেন নেতাকর্মীরা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মাগুরার পুলিশ সুপার মসিউদ্দোলা রেজা বলেন, ‘হাইওয়েতে পুলিশের চেকপোস্ট রয়েছে। হেলমেটবিহীন অবস্থায় কোনো মোটরসাইকেলে ২-৩ জন মানুষ বহন করলে নিয়মানুয়ায়ী তাদের বাধা দেবে এটাই স্বাভাবিক। পুলিশ উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাউকে হয়রানি করেনি।’
শিবচর থেকে ট্রলারে ফরিদপুরর সমাবেশে বিএনপি নেতাকর্মীরা : শিবচর থেকে ট্রলারে করে ফরিদপুরের সমাবেশে যোগ দেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান, যানবাহন না পাওয়া, ধরপাকড় ও হয়রানি এড়াতে নদীপথ বেছে নিয়েছিলেন তারা। ট্রলারে উপজেলার দত্তপাড়া, সন্ন্যাসীর চর, বন্দরখোলা, পাঁচ্চর, কাঁঠালবাড়ি ও কুতুবপুর ইউনিয়নের চারশতাধিক নেতাকর্মী সমাবেশে যোগ দেন। এরমধ্যে গত শুক্রবার রাত ২টার দিকে আড়িয়াল খাঁ নদের তীরবর্তী মাদবরেরচর হাটের কাছ থেকে তিনটি ট্রলারে ফরিদপুরের উদ্দেশে রওনা হন বিএনপি নেতাকর্মীরা। তারা গতকাল সকাল ৯টার দিকে সমাবেশস্থলে পৌঁছান।
মাদবরেরচর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ইমারাত বেপারী বলেন, ‘শিবচর থেকে কোনো বাস, মাইক্রোবাস ভাড়া পাওয়া যায়নি। পরে আমরা আমাদের এলাকা থেকে বড় একটি ট্রলার ভাড়া করি। কিন্তু গতকাল (শুক্রবার) রাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বাধা দিলে পরে আমরা ছোট তিনটি ট্রলার ভাড়া করে রওনা হই।’
প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন মাগুরা এবং শিবচর (মাদারীপুর) প্রতিনিধি
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার সকালে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এরপর দুপুরে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। এই বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তিন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখানে মূলত আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে দেশের রাজনীতিতে যে উত্তাপ দেখা দিয়েছে তা নিয়েই আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে আনিসুল হক গণমাধ্যমে বলেছেন, তাদের এ বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মূলত শ্রম আইন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরামর্শ ছিল। বৈঠকে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এ মাসেই জেনেভা যাওয়ার কথা রয়েছে।
পরে বেলা ১টা ১০ মিনিটে মার্কিন দূতাবাসে প্রবেশ করেন বিএনপি মহাসচিব। এরপর বেলা আড়াইটার দিকে তিনি দূতাবাস থেকে বের হন। রাতে মির্জা ফখরুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই নীতি দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক হবে আমরা মনে করি বলে রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রদূতকে আমি জানিয়েছি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া আওয়ামী লীগের অধীনে দেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। দেশের জনগণও তাই মনে করে। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমাদের কোনো আলাপ হয়নি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সম্প্রতি আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছিলেন, “নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন।” তার এমন বক্তব্য নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠলে পরে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেয় আইন মন্ত্রণালয়। এরপর গতকাল মঙ্গলবার সকালে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কীভাবে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দেশের সংবিধানে কী আছে তা-ও জানতে চেয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।’
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আরও বেশি দৌড়ঝাঁপ শুরু করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দূরত্ব এখন স্পষ্ট। আলোচনা আছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা এ দেশটি হঠাৎ আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য ছিল না। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে দেশটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ নিয়ে কোনো দ্বিমত করেনি। এরই মধ্যে, ভিসানীতি ঘোষণা করে সরকারকে বড় চাপ দেওয়ার পূর্বাভাস দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। তবে ভিসানীতি যে সরকারের ও আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি চাপ তৈরি করেছে, সেটা ভেতরে-বাইরে আলোচনা আছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও কূটনীতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পাল্টে নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনে সংবিধানের বাইরে যেতে হবে সরকারকে এমন প্রস্তাব দিতে চলেছে। ওই সূত্রগুলো দাবি করেছে, গত মাসের শেষের দিকে অথবা চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাসভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিটার হাস ওই বৈঠকে রাজনৈতিক সমঝোতায় না আসলে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সরকারের আদলে একটা কিছু করার বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। তা না হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানসম্মত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও দেওয়া হয়েছে। আনিসুল হকের সঙ্গে শ্রম আইন নিয়েও দীর্ঘ আলাপ করেন এ রাষ্ট্রদূত।
আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের ওই প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেলে তাতে বড় আপত্তি তোলা হয়। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়া যাবে না এটা ধরেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর বার্তা দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তারা স্বীকার করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তবে নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতা করবে ধরে নিয়েই সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পিটার হাস সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও নির্ধারিত-অনির্ধারিত বৈঠক করা শুরু করেছেন। গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে পিটার হাসকে উদ্দেশ্য করে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রাষ্ট্রদূতরা সীমা লঙ্ঘন করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে সরকার।
আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘নাহি ছাড়ি’ অবস্থান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
সরকারের দুই মন্ত্রীও দেশ রূপান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের বিপক্ষে যেতে শুরু করেছে। ‘অন্যায় হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে পিটার হাসের।
আওয়ামী লীগের কূটনীতিসম্পৃক্ত এক নেতা বলেন, সরকার বিকল্প হিসেবে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে চলেছে। বিকল্প দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে নির্বাচন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে মাইনাস করে চলার এক ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হবে। এ কৌশলে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করা হবে নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভিসানীতি মূলত সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই ভিসানীতিকে সব গেল বলে ধরে নিয়ে অবস্থান টলমলে করে তুলতে চায়। এরকম অবস্থা আওয়ামী লীগকে একটু চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা যেন সাহস হারিয়ে না ফেলে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করার কৌশল গ্রহণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ কি তাদের অবস্থান থেকে সরতে শুরু করবে? আবার প্রশ্নও আছে যে, নির্বাচন কি হবে? জাতীয় সরকার আসবে খুব শিগগিরই, এমন গুঞ্জনও রয়েছে জোরালোভাবে। শুধু তাই নয়, বাতিল হওয়া নির্বাচন পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমন গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। যদিও এসবে কোনো ভিত্তি রয়েছে মনে করেন না আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা দাবি করেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। এ ইস্যুতে কোনো শক্তির সঙ্গেই আপস করবেন না আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো দেশের চাওয়ায় বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হবে না। দেশের মানুষের চাওয়া অনুযায়ী সংবিধানসম্মতভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, সবার মতো করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে বদ্ধপরিকর।
কূটনীতিসম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরেক নেতা বলেন, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মনে করা হলেও সেপ্টেম্বরের আগে পশ্চিমা এ দেশটি তার চূড়ান্ত অবস্থান পরিষ্কার করবে না বলে তারা মনে করছেন। ওই নেতা বলেন, সেপ্টেম্বরে ভারত সফর রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। মূলত সেই সফরেই বোঝা যাবে সরকার কোনদিকে যাবে। এ নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের ডিপ্লোম্যাসি (পররাষ্ট্রনীতি) পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতি। কূটনীতিতে প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি অনেক নেতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। সেই আস্থা-বিশ্বাসও প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের রয়েছে।’
এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে না ওঠায় সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করতেন, দেশটিকে তারা বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রমাণ করে না যে, ক্ষমতাধর দেশটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া ঠিক আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণার পরই দেশটির অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে এমন কথা কেউ আর বিশ্বাস করছে না।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমেরিকাকে মাইনাস ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় রাজনীতিতে তারা ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি একটাই বুঝি, একটাই জানি, আগামী নির্বাচন সংবিধানসম্মতভাবেই হবে। এ জায়গা থেকে একটুও নড়বে না সরকার।’
রাজধানীর বনানীর একটি রেস্তোরাঁ থেকে জামায়াতে ইসলামীর বনানী শাখার ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তাদের মধ্যে বনানী থানা জামায়াতের আমির তাজুল ইসলাম এবং সেক্রেটারি আব্দুর রাফি রয়েছেন।
বনানী থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওয়ারলেস গেটে অবস্থিত নবাবী রেস্টুরেন্টে গোপন মিটিং করাকালে বনানী থানা জামায়াতে ইসলামী আমির তাজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা রাফিসহ ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
আটক ১০ জনের মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাও রয়েছেন।
পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকার ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয় ব্যবসায়ীদের। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেনাপোল, হিলি ও ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে গত সোমবার থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হয়েছে। ট্রান্সপোর্ট খরচ, ট্যাক্স পরিশোধ ও লেবার খরচসহ আমদানিকরদের হাতে ভারতীয় পেঁয়াজের মূল্য দাঁড়িয়েছে ২৭ টাকা। যা ভারতের বাজারে ১৪-১৫ রুপি দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে এখানেও মধ্যস্বত্বভোগীর কারসাজি রয়েছে। দেশি পেঁয়াজের মতো কয়েক হাত ঘুরে অস্বাভাবিক দামে ২৭ টাকার পেঁয়াজ পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ৫৬-৬০ টাকায়। তবে আমদানি করা পেঁয়াজ এখনো খুচরা বাজারে পৌঁছায়নি।
গতকাল মঙ্গলবার কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সোমবার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন দেওয়া শুরু হয়। প্রথম দিনে ২ লাখ ৮০ হাজার ৮০০ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। গতকাল দ্বিতীয় দিন শেষে আইপি বা আমদানি অনুমোদনের পরিমাণ ৪ লাখ ৩৩ হাজার টনে দাঁড়িয়েছে।
দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বছরে প্রায় ২৮ থেকে ৩০ লাখ টন। চলতি বছর পেঁয়াজের নিট উৎপাদন ধরা হচ্ছে ২৪ লাখ ৫৩ হাজার টন। ফলে বাকি পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬ লাখ ৬৫ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছিল। গতকাল কৃষি মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, এদিন বিকেল ৫টা পর্যন্ত বিভিন্ন স্থলবন্দর হয়ে ১ হাজার ২৮৮ টন পেঁয়াজ দেশে এসেছে।
চলতি বছর পেঁয়াজের দর রোজার ঈদের পর থেকেই বাড়তে শুরু করেছিল। এক মাসের ব্যবধানে তা ৩০ থেকে ৮০ টাকায় উঠে যায়। গত কয়েক দিন ধরে ১০০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছিল।
কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার কথা বলে এতদিন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি কৃষি মন্ত্রণালয় না দিলেও পরিস্থিতি দেখে রবিবার সায় দেয়। পরদিনই পাইকারি বাজারে এর প্রভাব দেখা যায়। দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় পেঁয়াজ আসা শুরু হলে পাইকারিতে দাম কমে যায় এক ধাক্কায় ৩০ টাকা। প্রতি কেজি পেঁয়াজের খুচরা মূল্য এখন ৪৫ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয় বলে সরকার মনে করে। আর প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে যে পেঁয়াজ দেশে এসেছে, সেগুলো কেনা প্রতি কেজি ২১ থেকে ২২ টাকার মধ্যে ছিল বলে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা জানিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সব খরচ মিলিয়ে বন্দর পর্যন্ত প্রতি কেজি পেঁয়াজের ক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ২৭ টাকায়। আমদানিকারকরা কেজিপ্রতি ২ টাকা লাভে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে ২৯ টাকায় বিক্রি করছেন। স্থানীয়রা আরও ৫ টাকা লাভে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ঢাকার পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন ৩৪ টাকায়। ঢাকার পাইকাররা শ্যামবাজারে সেই পেঁয়াজ বিক্রি করেন ৫০-৫৬ টাকায়। শ্যামবাজার ব্যবসায়ীর হাতবদল হয়ে কারওয়ান বাজার পাইকারি মার্কেটে এসে বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা করে।
ভোমরা স্থলবন্দরের আমদানিকারক আমির হামজা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভারতীয় বাজার থেকে ১৪-১৫ রুপিতে কিনে সব খরচসহ বন্দর পর্যন্ত প্রতি কেজি পেঁয়াজের মূল্য দাঁড়িয়েছে ২৭ টাকা। কেজিতে ২ টাকা লাভে ভোমরা স্থলবন্দরের স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে ২৯ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
হিলির বন্দর এলাকার আরেক ব্যবসায়ী আহমেদ আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মূলত আমদানিকারকদের থেকে আমরা পেঁয়াজ কিনে থাকি। আমাদের কাছ থেকে ঢাকার ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ সংগ্রহ করেন। কেজিপ্রতি ৩১-৩২ টাকা আমাদের কেনা পড়ে। ঘরভাড়া, লেবার খরচসহ প্রতি কেজি পেঁয়াজে সামান্য লাভ করে ৩৪-৩৫ টাকা বিক্রি করতে হয়। এর নিচে বিক্রি করলে আমাদের ৭০-৮০ পয়সার মতো লোকসান হয়।’
গতকাল রাজধানীর শ্যামবাজার ঘুরে দেখা যায়, ভারত থেকে আসা পেঁয়াজ বাছাই করে দুই ভাগে বিক্রি করছেন শ্যামবাজারের ব্যবসায়ীরা। আকারে কিছুটা ছোট পেঁয়াজের কেজি ৪০-৪৫ ও ভালো মানের পেঁঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৬ টাকায়।
শ্যামবাজারের মেসার্স নিউ সেবা এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার শেখর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আজই (গতকাল) আমদানি করা পেঁয়াজের চালান শ্যামবাজারে এসেছে। হাতেগোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী ভারতীয় পেঁয়াজ পেলেও অধিকাংশ ব্যবসায়ী আমদানি করা এসব পেঁয়াজ পাননি। বেশ কিছু পেঁয়াজ ট্রাকে পচে যাওয়ায় দুই ভাগে তা বিক্রি হয়েছে। তুলনামূলক ভালো প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৪০-৪৫ ও ভালো মানের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৬ টাকা করে।’
জানতে চাইলে শ্যামবাজার পেঁয়াজ সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজি মোহাম্মদ মাজেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বর্তমানে ভারতের বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৩-১৫ রুপিতে। সেই হিসাবে সব খরচ মিলিয়ে আমাদের দেশের পাইকারি বাজারগুলোতে ৩৫-৩৬ টাকায় ভোক্তারা কিনতে পারবেন। তবে এ পেঁয়াজ কেন ৫০ টাকার ওপর বিক্রি হচ্ছে সে বিষয়ে আমার জানা নেই।’
এদিকে ভারত থেকে আসা প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৬০ টাকা করে বিক্রি করতে দেখা গেছে কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীদের। পেঁয়াজ ব্যবসায়ী ময়না মিঞা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভারতীয় পেঁয়াজ দেশের বাজারে আসায় আমাদের অনেক লস হয়েছে। আগের কেনা দেশি পেঁয়াজের কেজিপ্রতি ২০-২৫ টাকা করে লস দিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে আমদানি করা যেসব পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে, তা শ্যামবাজার থেকে বেশি দামে কিনতে হয়েছে। মার্কেটে ক্রেতা না থাকায় সব খরচ মিলিয়ে প্রতি কেজিতে ২ টাকা লাভ করতেও এখন কষ্ট হচ্ছে।’
এদিকে খুচরা বাজারগুলোতে খবর নিয়ে জানা যায়, এখনো ভারত থেকে আসা আমদানি করা পেঁয়াজ খুচরা বাজারে প্রবেশ করেনি। আমদানি করা পেঁয়াজ খুচরা বাজারে না এলেও দেশি পেঁয়াজের দামে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০-৯০ টাকা দরে। যা গত তিন দিন আগেও বিক্রি হয়েছে ১০০-১০৫ টাকায়।
এদিকে ভারতীয় পেঁয়াজ আসায় স্থানীয় বাজারে পেঁয়াজের দাম কমেছে বলে জানান দিনাজপুর ও সাতক্ষীরা প্রতিনিধি। তাদের তথ্যমতে, সোমবার বিকেলে ভোমরা বন্দর দিয়ে ২৮৭ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও ৫০ ট্রাক পেঁয়াজ দেশে প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে।
অন্যদিকে হাকিমপুর প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুরের হিলি বন্দর দিয়ে গত দুদিনে ১৬ ট্রাক পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। আমদানি করা পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকা দরে। আর দেশি পেঁয়াজ ৬০-৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।