
চলমান অর্থনৈতিক সংকটে স্বল্প আয়ের মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। অন্যদিকে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। এর মধ্যেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার পর গ্রাহকপর্যায়ে দাম বাড়ানোর আবেদন করবে বিতরণ কোম্পানিগুলো। বিদ্যুতের দাম বাড়লে জীবনযাত্রার ব্যয়ও বাড়বে। পাল্লা দেবে মূল্যস্ফীতিও।
গ্রাহকপর্যায়ে এখনই বিদ্যুতের দাম বাড়ছে না বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় সারা পৃথিবীতেই বিদ্যুৎ-জ্বালানির দামে সমন্বয় করতে হচ্ছে। তবে গ্রাহকপর্যায়ে এখনই দাম বাড়ছে না। দাম বাড়বে কি না, সেটা নির্ভর করছে মাঠপর্যায়ের তথ্যের ওপর। যাচাই করে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিইআরসি তাদের মতো করে বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর আগে তারা ঘোষণা দিয়েও দাম বাড়ায়নি। সব যাচাই করেই করেছে।’
ভর্তুকি কমাতে পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। নতুন দাম আগামী ১ ডিসেম্বর কার্যকর হবে। গতকাল সোমবার দুপুরে অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন দাম বাড়ানোর এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, পাইকারি পর্যায়ে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম ৫ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ২২ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ দাম ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে। পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত এ দাম বহাল থাকবে।
এর আগে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৬৬ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। পিডিবির আবেদনে তথ্যের অস্পষ্টতা, বিতরণ কোম্পানি ও ভোক্তাপর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব-বিশ্লেষণ না থাকা প্রভৃতি কারণে দাম বাড়ানোর আবেদন খারিজ হয়ে যায়। গত ১৪ নভেম্বর পিডিবি ওই সিদ্ধান্ত আবার বিবেচনার আবেদন করে। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত জানাল বিইআরসি।
বিইআরসি চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিল ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে জানান, ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির কথা বিবেচনা করে বিদ্যুতের বাল্ক-মূল্য হার পুনর্নির্ধারণের এ সিদ্ধান্ত তারা দিচ্ছেন। ডিসেম্বর মাসের বিলে এ নতুন মূল্যহার কার্যকর হবে। কমিশন হিসাব করে দেখেছে, নতুন মূল্য কার্যকর হওয়ার ফলে পিডিবির আয় বছরে ৮ হাজার কোটি টাকা বাড়বে। ইউনিটপ্রতি দাম ৮ টাকা ২৮ পয়সা করলে পিডিবি পুরো ১৭ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি থেকে মুক্ত হতে পারত।
নতুন পাইকারি দাম অনুযায়ী শহরাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণে নিয়োজিত ডেসকোর ৩৩ কেভি লাইনে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে সর্বোচ্চ ৭ টাকা ৭৪ পয়সা। আর ডিপিডিসির ৩৩ কেভি লাইনের বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা ৭ টাকা ৭২ পয়সা।
বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সমিতিগুলোর ৩৩ কেভি লাইনের জন্য প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে ৫ টাকা ৩৯ পয়সা, যা পাইকারি বিদ্যুতের সর্বনিম্ন দর। এ ছাড়া, ছয় কোম্পানির ২৩০ কেভি, ১৩২ কেভি ও ৩৩ কেভি লাইনের জন্য আলাদা ট্যারিফ ঠিক করা হয়েছে।
পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়লে গ্রাহকপর্যায়েও এর প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেছেন, গ্রাহকপর্যায়ে দাম বাড়ানোর জন্য একটি প্রস্তাব তৈরি করেছে বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এ সপ্তাহের মধ্যে তারা আবেদন করবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগামী বছর মার্চে খুচরাপর্যায়ে দাম বাড়তে পারে।
বিদ্যুতের দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়বে বলে মনে করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। তিনি বলেন, ‘বিইআরসির গণশুনানিতে প্রমাণিত হয়েছে যদি সরকার তার অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা দূর করে তাহলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না। কিন্তু সেটাকে উপেক্ষা করে দাম বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। দ্রব্যাদির চড়া দামের কারণে সাধারণ মানুষের জীবন নাকাল। বিদ্যুতের দাম বাড়লে মানুষ আরও সংকটে পড়বে। কোনো দায়িত্বশীল সরকার এ ধরনের আচরণ করতে পারে না। আশা করি, সরকার এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে।’
বিদ্যুতের দাম বাড়ায় আতঙ্কিত ও বিস্মিত ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংগঠনের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম বলেন, ‘দাম বাড়াতে হলে গণশুনানির মাধ্যমে বাড়াতে হবে। বিইআরসি এ কাজ করল কার স্বার্থে? এভাবে মানুষের ঘাড়ে চড়ে ভর্তুকির টাকা আদায় কতটুকু যৌক্তিক!’
ঢাকার আদালত থেকে রবিবার জঙ্গি ছিনতাইয়ের পর প্রশ্ন উঠেছে আদালত পাড়ার নিরাপত্তা নিয়ে। রাজধানীর পুরান ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার নিম্ন আদালতে প্রতিদিন হাজার হাজার আসামি ও বিচারপ্রার্থীর সমাগম ঘটে। এদের মধ্যে জঙ্গি-দুর্ধর্ষ খুনের মামলার আসামিও থাকেন। ফলে কে আসামি কে বাদী তা আলাদা করার সুযোগ থাকে না। থাকেন ১৭ হাজার আইনজীবী। মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে প্রায়ই বাদী-বিবাদী পক্ষের মধ্যে বাগ্বিত-া, হাতাহাতিসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে। এই ভিড়বাট্টার মধ্যে গত ১৯ মাসে মৃত্যুদ ন্ড প্রাপ্ত তিনজনসহ পাঁচজন আসামি পালিয়েছেন পুলিশের হেফাজত থেকে। গত রবিবার সিজেএম আদালতের সামনে থেকে দুই জঙ্গি ছিনতাই অরক্ষিত ও অপ্রতুল নিরাপত্তারই প্রতিফলন। যদিও জঙ্গি ছিনতাইয়ের পর আদালতের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। কিন্তু আদালত প্রাঙ্গণের সার্বিক পরিস্থিতি আছে আগের মতোই।
২০১৯ সালের ১৬ জুলাই কুমিল্লার তৃতীয় অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে একটি হত্যা মামলায় হাজিরার দিন আদালতে বিচারক, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের সামনেই এক আসামি হাসান অতর্কিতে ছুরি চালিয়ে হত্যা করেন একই মামলার আরেক আসামি ফারুককে। ঘটনাটি তখন দেশজুড়ে বেশ আলোচনায় আসে। উচ্চ আদালত, ঢাকার আদালত এলাকাসহ দেশের সব অধস্তন আদালতে নেওয়া হয় কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা। কিন্তু সেই নিরাপত্তাব্যবস্থা শিথিল হতে সময় লাগেনি। আদালতের মতো স্পর্শকাতর স্থানে খুন, ফাঁসির আসামির পলায়ন, বিচারকের ওপর হামলার চেষ্টা, বাদীপক্ষের ওপর আসামিপক্ষের হামলার মতো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাও থামেনি।
এই নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের হাজতখানা থেকে কৌশলে পালিয়ে যান হারুনুর রশিদ নামে ডাকাতি মামলার এক আসামি। চলতি বছরের ২৩ মার্চ সিএমএম আদালত এলাকার হাজতখানা থেকে পালিয়েছেন সাইফুল ইসলাম নামে মাদক মামলার এক আসামি। আর গত ২৮ এপ্রিল ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতের হাজতখানা থেকে পালিয়ে যান হত্যা মামলায় ফাঁসির আসামি বাদশা মিয়া। অন্য একটি হত্যা মামলায় হাজিরা দেওয়ার জন্য তাকে আনা হয়েছিল আদালতে। নিরাপত্তার শিথিলতায় একের পর এক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী ও আদালত সংশ্লিষ্টরা হতবাক। আইনজীবীরা বলেন, নিরাপত্তাসহ নানা কারণে এখানে আদালতের পরিবেশ বলতে যা বোঝায় সেটি অনেক সময়ই থাকে না।
গত রবিবার দুপুরে ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম (সিজেএম) আদালত এলাকায় পুলিশের ওপর পিপার স্প্রে করে ছিনিয়ে নেওয়া হয় অভিজিত রায় ও প্রকাশক ফয়সল আরেফীন দীপন হত্যা মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে। ওই দিন সিজেএম আদালতে ভবনে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালে তাদের অন্য একটি মামলায় হাজিরার জন্য আনা হয়েছিল। এই ছিনতাইয়ের ঘটনার পর নিরাপত্তা জোরদার করা হয় আদালত প্রাঙ্গণের।
কিন্তু গতকাল ঢাকা মহানগর দায়রা আদালত, সিজেএম আদালত, সিএমএম (মুখ্য মহানগর হাকিম) আদালত ঘুরে দেখা বাড়তি নিরাপত্তার কিছু চোখে পড়েনি। এখানে সেখানে দেদার চলছে ভ্রাম্যমাণ দোকান। আদালতের বিভিন্ন করিডরে হকার ও ফকিরের অবাধ আনাগোনা। আসামিকে হাজির করা কিংবা হাজিরা দেওয়া হয় এমন আদালতগুলোর সামনের অবস্থা আরও বেশি বিশৃঙ্খল। আদালতগুলোতে প্রবেশে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ঘাটতিসহ সিসি ক্যামেরার অপ্রতুলতা তো আছেই।
গতকাল সিএমএম ভবনের পঞ্চম তলায় আদালতের করিডরের সামনে পেয়ারা, চা, সিগারেটের ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলোতে ভিড় চোখে পড়ে। নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশও এ বিষয়ে কিছুই বলছে না। আদালত এলাকার সরু গলিগুলোর ফুটপাতে মাছ, মাংস থেকে শুরু করে নিত্যপণ্য সবই বিক্রি হয় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত।
ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ কৌঁসুলি আজাদ রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এজলাস থেকে বেরুলে মনে হয় বাজারের মধ্যে আছি। আদালতের এই পরিবেশকে কোনোভাবেই স্বাভাবিক বলা যাবে না। নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও পুলিশের তেমন তৎপরতা চোখে পড়ে না। ফলে দিনের পর দিন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটছেই।’
অকুস্থলে যা দেখা গেল : রবিবার ঢাকার আদালত এলাকার যেখান থেকে (সিজেএম ভবন এলাকা) দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় গতকাল সেখানে গিয়ে দেখা যায় অনেক মানুষের জটলা। আদালতে আসা মানুষদের ওপর নেই কোনো কঠোর নজরদারি কিংবা তল্লাশি। পুলিশ ও গোয়েন্দারা সতর্ক অবস্থানে থাকলেও অন্যদিনের মতোই পরিস্থিতি স্বাভাবিক। প্রতিদিনের মতোই বসেছে চা, সিগারেট, পেয়ারা, পেঁপে, বই এমনকি ব্লাড সুগার ও রক্তচাপ পরীক্ষা করার অন্তত ১৫টি ভ্রাম্যমাণ দোকান। এখানে সেখানে ছড়িয়ে রয়েছে পার্কিং করা গাড়ি যার সবই ব্যক্তিগত। ভবনের নিচতলা ও পাশের ভবনে দুটি সিসি ক্যামেরা চোখে পড়ে।
নাম না প্রকাশের শর্তে একজন আইনজীবী বলেন, ‘এখানে একটি সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। প্রতিটি কর্মদিবসে এই আদালতে দুর্ধর্ষ সব আসামিকে হাজির করা হয়। প্রতিদিনই এখানে আইনজীবীসহ শত শত মানুষের আনাগোনা থাকে। পরিস্থিতি দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে দুদিন আগে জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার মতো বড় একটি ঘটনা ঘটেছে।’
ঘুপচি গলির ছোট এলাকায় আদালত নিয়ে অস্বস্তি আইনজীবীদের : ডিএমপির (ঢাকা মহানগর পুলিশ) প্রসিকিউশন বিভাগ বলছে, ঢাকা মহানগর দায়রা আদালত, ঢাকা জেলা আদালত, সিজেএম আদালত, সিএমএম আদালতের ভবনগুলোতে বিচারকাজের এজলাস রয়েছে ১২৭টি। অন্যদিকে ঢাকা জেলা আইনজীবী সমিতির নেতারা বলেন, প্রায় ২৭ হাজার আইনজীবী আছেন সমিতিতে। এদের মধ্যে অন্তত ১৫ হাজার আইনজীবী নিয়মিত আদালতে মামলা পরিচালনা করেন। এর বাইরে বিচারপ্রার্থী, আসামি মিলিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতিটি কর্মদিবসে হাজার হাজার মানুষের সমাগম থাকে আদালত এলাকায়। সব মিলিয়ে পুরান ঢাকার আদালত এলাকার যে পরিবেশ তাতে আইনজীবীদের অনেকের রয়েছে অস্বস্তি।
ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতের প্রধান কৌঁসুলি আব্দুল্লাহ আবু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আসলে যে ঘটনাটি (জঙ্গি ছিনতাই) ঘটেছে সেটি একেবারেই অনাকাক্সিক্ষত ও আকস্মিক। আমরা সবাই হতবাক হয়েছি। এ ঘটনা আসলেই আতঙ্কের।’ তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি এখানে আদালত অঙ্গনটির উপযুক্ত জায়গা নয়। আশপাশে বাড়িঘর ও অসংখ্য গলি রয়েছে। দুর্বৃত্তরা ঘটনা ঘটিয়েই খুব সহজে মানুষের সঙ্গে মিশে যায়। যদি এটি কোনো সংরক্ষিত জায়গায় হতো তাহলে পালিয়ে যেত পারত না।’ ঢাকা জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এমনিতেই এটি জনবহুল এলাকা। হাজার হাজার মানুষের সমাগম। বিভিন্ন সমিতির নামে এখানে কিছু ক্যান্টিন রয়েছে। ফুটপাতগুলোতে অসংখ্য ভ্রাম্যমাণ দোকান বসে। আদালতের নিরাপত্তার স্বার্থেই এগুলো সরিয়ে ফেলা উচিত। ইতিমধ্যে বিচারকদের সঙ্গে আমাদের এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।’
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আসলে দেশের সব ক্ষেত্রে এখন দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ছে। আদালতও এর বাইরে নেই। অথচ আদালতের পরিবেশ থাকবে আদালতের মতো। কিন্তু শুধু ঢাকা নয়, দেশের অধস্তন আদালতের কোথাও এখন সেটি নেই। যে কারণে আদালতের পরিবেশ ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। এটি আইন ও বিচার অঙ্গনের জন্য শোভন হবে না।
ডিএমপির উপ-কমিশনার (প্রসিকিউশন বিভাগ) মো. জসিম উদ্দীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের ৪০০ পুলিশ সদস্য রয়েছেন। আসামিদের হাজিরা নিশ্চিত করা, হাজিরা শেষে ফেরত পাঠানোসহ শুনানি কাজে আদালতকে সহযোগিতা করাই আমাদের কাজ। আদালত অঙ্গনের নিরাপত্তা, দোকান, হকার এসব বিষয় দেখে স্থানীয় থানা, আদালত ও আইনজীবী সমিতি।’
চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই আরেক পুলিশ সুপারকে (এসপি) অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ গত ১৬ নভেম্বর এক আদেশে পুলিশ সুপার ব্যারিস্টার মো. জিল্লুর রহমানকে অবসরে পাঠালেও জননিরাপত্তা বিভাগের ওয়েবসাইটে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে গত রবিবার।
পুলিশের বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ঢাকার ট্রাফিক অ্যান্ড ড্রাইভিং স্কুলের (টিডিএস) অতিরিক্ত কমান্ড্যান্ট জিল্লুর রহমানকে ‘জনস্বার্থে’ বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর কথা বলা হয়েছে আদেশে। সাম্প্রতিক সময়ে এ নিয়ে বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের মোট সাত কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠাল সরকার। এর মধ্যে দুজন অতিরিক্ত ডিআইজি ও পাঁচজন পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার কর্মকর্তা।
জিল্লুর রহমানকে অবসরে পাঠানোর প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারের সদস্য অতিরিক্ত কমান্ড্যান্ট (পুলিশ সুপার) ব্যারিস্টার মো. জিল্লুর রহমানকে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ (২০১৮ সালের ৫৭ নম্বর আইন) এর ৪৫ ধারার বিধান অনুযায়ী জনস্বার্থে সরকারি চাকরি থেকে অবসর দেওয়া হলো। জনস্বার্থে জারি করা এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে। সরকারি চাকরি আইনের ৪৫ নম্বর ধারায় বলা আছে, কোনো সরকারি কর্মচারীর চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর যেকোনো সময় সরকার জনস্বার্থে প্রয়োজনীয় মনে করলে কোনো কারণ না দেখিয়ে তাকে চাকরি থেকে অবসর প্রদান করতে পারবে। তবে শর্ত থাকে যে, যেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি নিয়োগকারী কর্র্তৃপক্ষ, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়া থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার পশ্চিমে মহেশখালীর মাতারবাড়ী ও ধলঘাট ইউনিয়নের সাগর উপকূল। সাগরের সুনীল জলরাশি থেকে উপকূলের দিকে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ, ৩৫০ মিটার চওড়া ও ১৬ মিটার গভীর চ্যালেন ঢুকেছে। সেই চ্যানেলের শেষ মাথায় নির্মাণ করা হয়েছে জাহাজ ভেড়ানোর জেটি। ইতিমধ্যে সেই জেটিতে মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য আনা পণ্য খালস করে গেছে শতাধিক জাহাজ। তবে ওই এলাকা ঘিরে সরকারের যে মহাপরিকল্পনা তার পুরোপুরি সুফল পেতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েক বছর। এখনো শুরু হয়নি সমুদ্রবন্দরের টার্মিনাল বা কোনো অবকাঠামো নির্মাণের কাজ। অবশ্য কর্র্তৃপক্ষের আশা, আগামী বছরের এপ্রিলে শুরু হবে কাক্সিক্ষত টার্মিনাল নির্মাণের কাজ আর তা হবে প্রকল্প মেয়াদের নির্ধারিত সময়েই।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, মাতারবাড়ীকে কেন্দ্র করে যে বিশাল বিনিয়োগ পরিকল্পনা করা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন হলে দেশের অর্থনীতির চেহারা পাল্টে যাবে। এখানে উন্নত যোগাযোগ, বিদ্যুৎ সরবরাহ, বন্দর, পর্যটনসহ বিভিন্ন খাত নতুন করে স্থাপন করা হচ্ছে। এতে শিল্পের উৎপাদন বাড়ানো, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।
গত সপ্তাহে সরেজমিনে দেখা যায়, মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জেটিতে কোনো জাহাজ নেই। চ্যানেলের নীল জলরাশির বুকে চলাচল করছে বন্দরের টাগবোট (ছোট জাহাজ)। শ্রমিকরা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের আওতায় স্থাপনা নির্মাণের কাজ করছেন। কিন্তু গভীর সমুদ্রবন্দরের টার্মিনাল নির্মাণ ও চ্যানেল (জাহাজ চলাচলের পথ) চওড়া করার কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। চ্যানেলের পশ্চিম প্রান্তে গিয়ে দেখা যায়, এই অংশে এখনো মাটি রয়েছে; অর্থাৎ কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় চ্যানেলের চওড়া ২৫০ মিটার ছিল, কিন্তু বন্দর নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় তা আরও ১০০ মিটার বাড়িয়ে ৩৫০ মিটারে উন্নীতকরণের কথা ছিল, তা হয়নি। তবে সাগরের দিকে অগ্রসর হলে দেখা যায়, ওই অংশে চ্যানেল চওড়া করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (চবক) চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা সাগর থেকে জেটির দিকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার এলাকায় চ্যানেলটি ১০০ মিটার চওড়া করে ৩৫০ মিটারে উন্নীত করেছি। শুধু কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জেটির পাশের কিছু অংশে চওড়া করা হয়নি। এ অংশের মাটি টার্মিনাল নির্মাণের আওতায় উঠিয়ে নেওয়া হবে এবং চওড়া বর্ধিত করা হবে।’
কিন্তু টার্মিনাল নির্মাণ কিংবা চ্যানেলের গভীরতা ১৮ মিটারে উন্নীতকরণের কাজ কবে নাগাদ হবে জানতে চাইলে বন্দর কর্র্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, ‘আগামী এপ্রিলের মধ্যে টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে। প্রথম দফায় ডাকা দরপত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাড়া কম পাওয়ায় দ্বিতীয় দফায় দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এই দরপত্রে শিগগিরই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হবে এবং বাস্তবিক অর্থে আগামী এপ্রিলে কাজ শুরু হবে।’
চ্যানেলে কত মিটার ড্রাফটের জাহাজ চলাচল করবে? এমন প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের চিফ হাইড্রোগ্রাফার আরিফুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদ্যমান চ্যানেল দিয়ে এখন ৮ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়ছে জেটিতে। তবে আগামীতে ১৬ মিটার ড্রাফটের বেশি জাহাজ ভিড়বে। আর এতেই গভীর সমুদ্রবন্দরের সুবিধা পাওয়া যাবে।’
বন্দরের জেটি কোন দিকে হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সাগরের প্রান্তের খালি জায়গায় হবে বন্দরের টার্মিনাল ও জেটি। পণ্য নিয়ে আসা জাহাজগুলো এই অংশে ভিড়বে।’
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প নেয় সরকার। জাইকার অর্থায়নে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৬ মিটার ড্রাফট (গভীরতা) এবং ২৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল নির্মাণ হয় বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায়। ইতিমধ্যে ১৪ মিটার ড্রাফট করাও হয়েছে। তবে ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’-এর আওতায় ড্রাফট ১৬ মিটারে উন্নীত করা হবে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষ কর্র্তৃক নির্মিত এই প্রকল্পের বাজেট ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (নিজস্ব তহবিল) ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। দেশে দিন দিন আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বাড়ছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশের ৯২ শতাংশ পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে। কিন্তু এখানে ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যরে বড় জাহাজ ভিড়তে পারে না। এই বন্দরের সর্বোচ্চ গভীরতা ৯ দশমিক ৫ মিটার। তাই বড় দৈর্ঘ্য ও বেশি ড্রাফটের জাহাজ ভেড়াতে মাতারবাড়ীর বিকল্প নেই। মাতারবাড়ী চালু হলে এর সঙ্গে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা বন্দরের মধ্যে নেটওয়ার্ক আরও বাড়বে। কারণ বড় জাহাজগুলো মাতারবাড়ীতে পণ্য নিয়ে আসবে। সেখান থেকে ছোট জাহাজে করে দেশের অন্যান্য বন্দরে পণ্য পরিবহন অনেক সহজ হবে।
ঢাকার আদালত থেকে দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলাজনিত কারণে পুলিশের পাঁচ সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে ঊর্ধ্বতন কারোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের পর গতকাল পুলিশ সদর দপ্তর আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। থানায় দায়ের হওয়া মামলাটি তদন্ত করছে সিটিটিসি। পালিয়ে যাওয়ার সময় ফেলে যাওয়া মোটরসাইকেলের মালিককে শনাক্ত করা হয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানায়, জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের প্রধান মেজর (বরখাস্ত) সৈয়দ জিয়াউল হকের পরিকল্পনায় আদালত প্রাঙ্গণ থেকে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। মোটরসাইকেলের মালিক পুরান ঢাকার এক বাসিন্দা। তবে ছিনিয়ে নেওয়া জঙ্গিরা এখনো ধরা না পড়লেও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দাবি করছে, তারা নজরদারিতেই রয়েছে। রাজধানীর আদালতপাড়া থেকে শুরু করে নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোর সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গিসহ তাদের সহযোগীদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।
সোমবার সন্ধ্যায় ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সিটিটিসির প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘দুই আসামিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়েছে। তার সঙ্গে আরও কারা কারা ছিল, এ রকম বেশ কয়েকজনের নাম আমরা পেয়েছি। কিন্তু এই মুহূর্তে তদন্তের স্বার্থে ব্যক্তির নাম-পরিচয় আমরা বলতে চাচ্ছি না।’
পুলিশের ৫ সদস্য সাময়িক বহিষ্কার : আদালতপাড়া থেকে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় দায়িত্বরত পাঁচ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগ। সোমবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) প্রসিকিউশন বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার জসিম উদ্দিন গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। সাময়িক বরখাস্ত পুলিশ সদস্যরা হচ্ছেন সিএমএম আদালতের হাজতখানার কোর্ট ইন্সপেক্টর মতিউর রহমান, হাজতখানার ইনচার্জ (এসআই) নাহিদুর রহমান ভূঁইয়া, আসামিদের আদালতে নেওয়ার দায়িত্বরত পুলিশের এটিএসআই মহিউদ্দিন, কনস্টেবল শরিফ হাসান ও আব্দুস সাত্তার।
ডিবির প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেছেন, আদালতপাড়া থেকে ছিনিয়ে নেওয়া মৃতুদ-প্রাপ্ত দুই জঙ্গিসহ তাদের সহযোগীদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। যেকোনো সময় তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। এ ছাড়া জঙ্গিদের আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রেও সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। জঙ্গি ছিনতাইয়ের মামলায় ২০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া ১২ জন আসামির ১০ জনকে ১০ দিনের রিমান্ডে আনা হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে সতর্ক অবস্থানে আছে পুলিশ। তিনি বলেন, ‘আইনজীবীদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আমাদের পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। এ ছাড়া জঙ্গি আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে টহল জোরদার করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত প্রত্যেককে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে।
জঙ্গি ছিনতাইয়ের মোটরসাইকেল উদ্ধার : জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল পুরান ঢাকার হাসান আল মামুনের। রবিবার দুপুরে দুই জঙ্গি আসামিকে ছিনিয়ে নিতে দুটি মোটরসাইকেল আদালত প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়েছিল। এ সময় ওই মোটরসাইকেল দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়ে আদালতের প্রধান ফটকের সামনে দিয়ে পালিয়ে যায়। পরে তাড়াহুড়ো করে পালানোর সময় একটি মোটরসাইকেল ফেলেই চলে যায় জঙ্গিরা। ঘটনার দিন পুলিশ সেই মোটরসাইকেলটি কোতোয়ালি থানায় নিয়ে যায়। পুলিশ জব্দ তালিকায় তা রেখেছে। বিআরটিএ জানায়, ঢাকা মেট্রো-ল-৩১-৫৭১০ নম্বরের ওই মোটরসাইকেলটি ১৬০ সিসির হোন্ডা ব্র্যান্ডের হরনেট মডেলের। মোটরসাইকেলটির নিবন্ধন হাসান আল মামুন নামে এক যুবকের। তিনি পুরান ঢাকার বাসিন্দা। মোটরসাইকেলটির রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছিল ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি। গাড়িটির ইঞ্জিন নম্বর কেসি৩৯ইএ০০০ এবং চেসিস নম্বর পিএস০কেসি ৩৯৯০কেএইচ। রেজিস্ট্রেশন আইডি ৬২-৩৮৪৪৫৯১। হাসান আল মামুনকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্ত কমিটির ঘটনাস্থল পরিদর্শন : ডিএমপির পর পুলিশ সদর দপ্তর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। সোমবার দুপুরে ঘটনাস্থলে আসেন পুলিশ হেড কোয়ার্টারের ডিআইজি আমিনুল ইসলাম, সিটিটিসির যুগ্ম কমিশনার এ এইচ এম কামরুজ্জামানসহ কমিটির অন্য সদস্যরা। তাদের সঙ্গে রয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) প্রসিকিউশন বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার জসিম উদ্দিন। কমিটির সদস্যরা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রধান ফটক, সিএমএম আদালতের হাজতখানা, ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধ ট্রাইব্যুনালসহ বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার জসিম উদ্দিন বলেন, তদন্তের কাজে সার্বিক বিষয় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এদিকে এ ঘটনার পর আদালতপাড়ায় নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থায় আসামিদের আদালতের এজলাসে তোলা হচ্ছে।
গাজীপুরে আদালত, কারাগারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিরাপত্তা জোরদারের ব্যবস্থা : সোমবার থেকে গাজীপুর আদালত এলাকা এবং কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। গতকাল কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটকে দেখা গেছে, প্রধান ফটকে অতিরিক্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। কারাগারের প্রধান ফটকে গিয়ে আরপি চেকপোস্টের দায়িত্বে থাকা কারারক্ষীদের ব্যাপক তৎপরতা দেখা গেছে। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে জনবলও বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ ছাড়া গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন কারাগার এলাকা কঠোর নজরদারিতে রাখছেন। আদালতে আসা বিচার প্রার্থীসহ সব শ্রেণির লোকদের ওপর নজরদারি করা হচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গার সীমান্ত এলাকাগুলোতে বিজিবির বাড়তি সতর্কতা : চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি জানান, দুই জঙ্গির ছবি ও ঠিকানা পাঠানো হয়েছে জয়নগর ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট পুলিশের কাছে। বিজিবির ৬ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল শাহ মো. ইশতিয়াক জানান, দুই জঙ্গি যেন সীমান্ত দিয়ে পালাতে না পারে, সে জন্য গতকাল বিকেলে বিজিবি সদর দপ্তর থেকে সীমান্তে নজরদারি বাড়ানোর জন্য নির্দেশনা আসে। জেলার সব সীমান্তে টহল জোরদার করা হয়েছে।
বেনাপোল বন্দর এবং সীমান্তে ‘রেড অ্যালার্ট’ : শার্শা (যশোর) প্রতিনিধি জানান, যশোর সীমান্তে ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ অবস্থায় চেকপোস্ট ইমিগ্রেশন ও যশোর সীমান্তে অতিরিক্ত সতর্কতার পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
আখাউড়া সীমান্তে সতর্কতা : আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি জানান, আখাউড়া স্থলবন্দর পুলিশ ইতিমধ্যেই ওই দুই জঙ্গিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। বিজিবির প্রতিটি বর্ডার পোস্টে সতর্ক থাকার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আখাউড়া আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশনের ভারপ্রাপ্ত ইনচার্জ দেওয়ান মোর্শেদুল হক জানান, ওই দুই জঙ্গির ছবি ও ঠিকানা তাদের দেওয়া হয়েছে। তাদের কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তাদের ছবি ইমিগ্রেশন কক্ষে সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সরকারের আমদানি ব্যয় মেটাতে গতকাল সোমবার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে আরও ৭ কোটি ১০ লাখ ডলার সরবরাহ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নিয়ে চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ৫৫৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার সরবরাহ করা হয়েছে। এতে প্রভাব পড়েছে রিজার্ভে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে বর্তমানে রিজার্ভে রয়েছে ৩৪ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার। তবে আইএমএফের হিসাব মূল্যায়ন করলে তা দাঁড়াবে ২৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলারে। এটি গত ৭ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রিজার্ভ ছিল ২৫ বিলিয়ন ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে প্রতি মাসে আমদানির জন্য ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করছে সরকার। অর্থাৎ এখন যে পরিমাণ রিজার্ভ আছে তা দিয়ে সাড়ে তিন মাসের আমদানি দায় পরিশোধ করা যাবে। যদিও রিজার্ভ সব সময় সব আমদানির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় না। আর সরকারিভাবে অতি প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য ডলার বিক্রি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
চলতি অর্থবছরের প্রথম দিকে আমদানি অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেলে দেশে ডলার সংকট দেখা দেয়। এতে রিজার্ভেও টান পড়ে। পরে আমদানি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে কমতে থাকে আমদানি খরচ। তবে বাকি বা দেরিতে পরিশোধের শর্তে আগের খোলা এলসির দায় এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় কমেনি। যে কারণে দিন দিন ডলারের সংকট বাড়ছে। চাপে পড়ছে অর্থনীতি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি মাসের ২১ দিনে ৯৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার বেশি বিক্রি করা হয়েছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের ২১ নভেম্বর পর্যন্ত এর পরিমাণ ৫৫৬ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার। আর গত ২১ অক্টোবরে ডলার বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪১০ কোটি ডলার। সে হিসাবে এক মাসে ডলার বিক্রি বেড়েছে ১৪৬ কোটি ডলার। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে রেকর্ড ৭৬২ কোটি ১৭ লাখ ডলার বিক্রি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এদিকে ডলার সংকটের কারণে আমদানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন পণ্যের এলসি খুলতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। আর বৈদেশিক বাণিজ্যে পাওনা পরিশোধেও ব্যর্থ হচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। গত রবিবার বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, ডলার সংকটের কারণে বিভিন্ন শিপিং লাইনের ১৫ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স মুলতবি থাকায় ব্যবসায়িক সম্পর্ক বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু এ অর্থ পাঠাতে না পারলে সাপ্লাই চেইন প্রক্রিয়া ভেঙে পড়বে।
নওগাঁ শহর থেকে আটকের পর র্যাবের হেফাজতে সুলতানা জেসমিন (৪৫) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। গত বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মুক্তির মোড় থেকে তাকে আটক করা হয়। এরপর গত শুক্রবার সকালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
সুলতানা জেসমিন নওগাঁ সদর উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ে অফিস সহকারী পদে চাকরি করতেন। র্যাবের দাবি, প্রতারণার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বুধবার সুলতানা জেসমিনকে আটক করা হয়। আটকের পর অসুস্থ হয়ে তিনি মারা গেছেন। তবে স্বজনদের অভিযোগ, হেফাজতে নির্যাতনের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। মারা যাওয়া সুলতানার মামা এবং নওগাঁ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর নাজমুল হক মন্টু দেশ রূপান্তরকে বলেন, তার ভাগনি বুধবার সকালে অফিসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হন। ওই দিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মুক্তির মোড় থেকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে র্যাবের লোকজন সুলতানাকে ধরে নিয়ে গেছে বলে মোবাইল ফোনে কল করে বিভিন্নজন তাকে জানান। একপর্যায়ে দুপুর ১২টার দিকে তার ভাগনি সুলতানা জেসমিনের ছেলে সাহেদ হোসেন সৈকত মোবাইল ফোনে কল করে জানান, তার মাকে র্যাব সদস্যরা ধরে নিয়ে গেছে। এরপর মন্টু তার ভাগনির সন্ধানে থানাসহ বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেন। কিন্তু সন্ধান পাননি। পরে বেলা ২টার দিকে সুলতানা জেসমিনের ছেলে তাকে আবার মোবাইল ফোনে কল করে জানান তার মা নওগাঁ সদর হাসপাতালে আছেন। এরপর হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারেন তার ভাগনি সেখানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। কিন্তু ভেতরে গিয়ে ভাগনির সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করলে র্যাব সদস্যরা বাধা দেন বলে অভিযোগ করেন মন্টু। তবে জেসমিনকে র্যাবের কোন ক্যাম্প নেওয়া হয়েছিল তারা তার কিছুই জানতেন না। এর কিছুক্ষণ পর জেসমিনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার সকালে তার মৃত্যু হয়। যদিও লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে গতকাল শনিবার। গতকাল বাদ আসর তার মরদেহ দাফন করা হয়েছে।
সুলতানা জেসমিনের ছেলে সাহেদ হোসেন সৈকত দেশ রূপান্তরকে বলেন, তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। বিভিন্নভাবে জানতে পারেন তার মাকে র্যাবের সদস্যরা তুলে নিয়ে গেছে। এর পরই তার সন্ধানের চেষ্টা করা হয়। একপর্যায়ে জানতে পারেন তার মা নওগাঁ হাসপাতালে রয়েছেন। সেখানে তার মায়ের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল।
সৈকতের দাবি, তার মা চক্রান্তের শিকার হয়েছেন। র্যাবের হেফাজতে থাকা অবস্থায় তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। যার কারণে মৃত্যু হয়।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাব-৫-এর উপ-অধিনায়ক এএসপি মাসুদ রানা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আর্থিক প্রতারণার অভিযোগে সুলতানা জেসমিনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মুক্তির মোড় এলাকা থেকে র্যাবের হেফাজতে নেওয়া হয়। কিন্তু আটকের পরপরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে দ্রুত তাকে নওগাঁ সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। প্রাথমিক চিকিৎসার পর চিকিৎসকরা তাকে রাজশাহীতে নেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু রাজশাহীতে নেওয়ার পর তার অবস্থা আরও খারাপ হয়। শুক্রবার রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্ট্রোক করে তিনি মারা যান।’
সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল দুপুরে স্বজনদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয় বলেও জানান এই র্যাব কর্মকর্তা।
নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা মৌমিতা জলিল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বুধবার দুপুরে সুলতানা জেসমিন নামে এক রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে আসেন র্যাবের সদস্যরা। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রোগীর অবস্থা গুরুতর হওয়ায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। হাসপাতালেই সুলতানা জেসমিনের পরিবারের লোকজন র্যাবের বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ করেন। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার ওই রোগী মারা যান বলে জানতে পেরেছি।’
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক এফ এম শামীম আহাম্মদ বলেন, তারা যতটুকু জানতে পেরেছেন, র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদের সময় সুলতানা জেসমিন পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পান। তারপর তাকে নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। সিটি স্ক্যান করে তারা জানতে পেরেছেন, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে ওই রোগীর মৃত্যু হয়। তার মাথায় ছোট্ট একটি লাল দাগ ছিল। শরীরে অন্য কোথাও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. কফিল উদ্দিন জানান, ময়নাতদন্ত শেষে সুলতানা জেসমিনের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। তবে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন হাতে না আসা পর্যন্ত তার মৃত্যুর কারণ বলা সম্ভব নয়।
মেধাতালিকা বাদ দিয়ে নতুন নিয়মে পদোন্নতি দিতে যাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। যার ফলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পদোন্নতিযোগ্য সোনালী ব্যাংকের শত শত কর্মী। এত দিন শূন্য পদের ভিত্তিতে মেধাতালিকা থেকে দুজন ও জ্যেষ্ঠতা (সিনিয়রিটি) তালিকা থেকে একজনকে পদোন্নতি দেওয়া হতো। কিন্তু হঠাৎ করেই নতুন নিয়ম চালু হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সবচেয়ে বড় ব্যাংকটিতে। পদোন্নতিতে মৌখিক পরীক্ষার জন্য শুধু জ্যেষ্ঠ তালিকার কর্মকর্তাদের বিবেচনা করা হয়েছে। বিশেষ কিছু ব্যক্তিকে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য মেধাবী ও কর্মঠ অফিসারদের বঞ্চিত করার পাঁয়তারা শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সোনালী ব্যাংকের কর্মীরা।
ইতিমধ্যে সোনালী ব্যাংকের অফিসার থেকে জিএম পদ পর্যন্ত পদোন্নতির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, যেখানে লঙ্ঘিত হচ্ছে সোনালী ব্যাংক লিমিটেড কর্মচারী পদোন্নতি নীতিমালা-২০২২। অনুসরণ করা হচ্ছে পর্ষদের ৮১০তম সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত। এই অনিয়ম বন্ধ ও আগের নিয়মে পদোন্নতির প্রক্রিয়া চালু করার জন্য ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর আবেদন জানিয়েছেন সোনালী ব্যাংকের শতাধিক কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সোনালী ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, নতুন নিয়ম অনুযায়ী পদোন্নতি দিলে বেশির ভাগ মেধাবী কর্মকর্তা বঞ্চিত হবেন। এতে কর্মকর্তারা কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। এই নীতি বাদ দেওয়ার জন্য ইতিমধ্যেই এমডির কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আশা করি, তিনি বিষয়টি বিবেচনা করবেন।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, পর্ষদের ৮১০তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘অফিসার/সমমান থেকে ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার/সমমান পদ পর্যন্ত পদোন্নতির ক্ষেত্রে সম্ভাব্য শূন্য পদের চেয়ে পদোন্নতিযোগ্য প্রার্থীর সংখ্যা তিন গুণের বেশি হলে জ্যেষ্ঠতা তালিকা থেকে প্রতিটি সম্ভাব্য শূন্য পদের বিপরীতে সর্বোচ্চ তিনজন (১:৩) প্রার্থী নির্বাচনী সাক্ষাৎকার/বাছাইয়ের জন্য বিবেচ্য হবেন,’ যা সোনালী ব্যাংক লিমিটেড কর্মচারী পদোন্নতি নীতিমালা-২০২২-এর সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। কারণ এর ফলে মেধাতালিকার কর্মীরা পদোন্নতি তো দূরের কথা, সাক্ষাৎকারেও অংশ নিতে পারবেন না।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘সোনালী ব্যাংক লিমিটেড কর্মচারী চাকরি প্রবিধানমালা, ২০২২’-এ পদোন্নতির মাধ্যমে নিয়োগ বিষয়ের ৮(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই প্রবিধানমালা মোতাবেক এবং তফসিলে বর্ণিত শর্তাবলী পরিপালন সাপেক্ষে, কোনো কর্মচারীকে পরবর্তী উচ্চতর পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে মেধা, কর্মদক্ষতা ও জ্যেষ্ঠতাকে প্রাধান্য দেওয়া হইবে। কিন্তু কেবল জ্যেষ্ঠতার কারণে কোনো কর্মচারী অধিকার হিসেবে তাহার পদোন্নতি বা পদায়ন দাবি করিতে পারিবেন না।’
এদিকে, ২০২৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকারদের পদোন্নতি বিষয়ক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ‘ব্যাংকের চাকরিতে সিনিয়র অফিসার (জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা) অথবা সমতুল্য পদের পরবর্তী সব পদে পদোন্নতি পেতে হলে ব্যাংকিং ডিপ্লোমার দুই পর্বেই পাস করতে হবে,’ অর্থাৎ সোনালী ব্যাংকের ১:৩ নীতিমালা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।
এ বছর সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার, অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার থেকে ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার, ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার থেকে জেনারেল ম্যানেজার পদে পদোন্নতিযোগ্য প্রার্থীর সংখ্যা যথাক্রমে ৭৫০, ৯১ ও ১৩ জন। এর বিপরীতে সম্ভাব্য পদোন্নতিযোগ্য পদের সংখ্যা যথাক্রমে ৬০, ১৯ ও ৩ জন। কিন্তু জ্যেষ্ঠ বিবেচনায় মৌখিক পরীক্ষার জন্য মনোনীত হবেন ১৮০, ৫৭ ও ৬ জন। এতে বঞ্চিত হবে মেধাতালিকা। সুতরাং আলোচ্য পদোন্নতি নীতিমালা স্ববিরোধী ও চাকরি প্রবিধানমালার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক এবং যেখানে সততা ও ন্যায়ের প্রতিফলন নেই।
সোনালী ব্যাংকের একাধিক সূত্র জানায়, গত কয়েক বছরের তথ্য যাচাই-বাছাই ও গভীর অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে যেখানে দ্রুত পদোন্নতি হয়ে যায়, সেখানে সোনালী ব্যাংকে ব্যক্তি/গোষ্ঠী স্বার্থে প্রতিবার নতুন নতুন ধ্যান-ধারণা আমদানি করে অনাকাক্সিক্ষত সময়ক্ষেপণ করে একেবারে বছরের শেষে এসে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এভাবে সোনালী ব্যাংকের দক্ষ ও মেধাবী কমকর্তারা এখন সব জায়গায় ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ছেন। এমন অবস্থায় সোনালী ব্যাংকে একটি স্থায়ী নীতিমালা করা প্রয়োজন। যেখানে কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থ প্রাধান্য পাবে না; বরং তা অপরিহার্য পছন্দরূপে সর্বমহলে প্রশংসিত ও গ্রহণযোগ্য হবে। যত দিন না এরূপ নীতিমালা করা সম্ভব, তত দিন কোনো বিতর্কিত নীতিমালা চাপিয়ে দেওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত বলে মনে করছেন সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা। কারণ মূল্যায়নের ক্ষেত্রে যদি সততা, দক্ষতা ও মেধার পরিবর্তে কেবল জ্যেষ্ঠতাকেই বেছে নেওয়া হয়, তাহলে মেধাবী ও দক্ষ কর্মকর্তারা চ্যালেঞ্জ গ্রহণে আগ্রহ ও উৎসাহ-উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলবেন। চ্যালেঞ্জিং পদগুলো সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তার অভাবে দুর্নীতির আখড়া হয়ে উঠবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী আফজাল করিম দেশ রূপান্তরকে বলেন, সোনালী ব্যাংকে যেই নীতিমালা রয়েছে, এটি অন্যান্য জায়গায়ও আছে; বিশেষ করে কৃষি ব্যাংক ও হাউজ বিল্ডিংয়েও একই নীতি মেনে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এখানে একজনের বিপরীতে তিনজনকে ডাকা হচ্ছে। তা ছাড়া এটা বোর্ডের সিদ্ধান্ত।
মেধাবীরা বঞ্চিত হবেন কি না এমন প্রশ্নে আফজাল করিম বলেন, ‘পদোন্নতির ক্ষেত্রে ১০০ নম্বরের মধ্যে ৮৫ হচ্ছে তার অর্জন। বাকি ১৫ নম্বর ভাইভা থেকে পাবেন। এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো বৈষম্য হবে বলে মনে করি না। গত বছর অন্যভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল। সে সময়ও কর্মকর্তাদের অনেকেই নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। এটা থাকবেই।’
বরিশালের উজিরপুরে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে এসে সংসদ সদস্যের সামনে আওয়ামী লীগের এক সহসভাপতিকে পিটিয়েছেন আরেক সহসভাপতি। গতকাল রবিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে উজিরপুর উপজেলা পরিষদের সামনে এ ঘটনা ঘটে। মারধরে আহত আওয়ামী লীগ নেতাকে উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
তিনি হলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। নাম মো. ইদ্রিস সরদার (৪৫)। তাকে পিটিয়েছেন একই কমিটির সহসভাপতি ও উজিরপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. হাফিজুর রহমান ওরফে ইকবাল। তারা দুজনই বরিশাল-২ আসনের সংসদ সদস্য মো. শাহ আলম তালুকদারের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। দুজনই এই সংসদ সদস্যের সঙ্গে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। এদিকে মারামারির এ ঘটনায় দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের দুই নেতা এবং ইউনিয়ন যুবলীগের এক নেতাকে সাময়িকভাবে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী, স্থানীয় লোকজন ও আহত আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে উজিরপুর উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গতকাল সকাল ১০টায় উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য মো. শাহ আলম তালুকদার। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে প্রধান অতিথি অনুষ্ঠানস্থলে হাজির হন। তার সঙ্গে ছিলেন হাফিজুর রহমান ও ইদ্রিস সরদার। এ সময় হাফিজুর সংসদ সদস্যের সামনে ইদ্রিসকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করলে ইদ্রিস তার প্রতিবাদ জানান। এরপর হাফিজুর তাকে সংসদ সদস্যের সামনেই মারধর শুরু করেন।
মারধরের শিকার ইদ্রিস অভিযোগ করে বলেন, ‘সংসদ সদস্যের সামনে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান হাফিজুর আমাকে নিয়ে কটূক্তি ও অশালীন মন্তব্য করে। আমি প্রতিবাদ করলে হাফিজ আমার ওপর হামলা চালিয়ে মারধর শুরু করে। এ সময় তার সঙ্গে থাকা ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ক্যাডার কাজী রিয়াজ, পলাশ তালুকদার ও রুবেল হোসেনসহ ৭-৮ জন সন্ত্রাসী আমাকে লাঠিপেটা করে রক্তাক্ত জখম করে।’
তবে ইদ্রিসকে মারধরের ঘটনা তার এবং সংসদ সদস্যের সামনে ঘটেনি বলে দাবি করেন অভিযুক্ত হাফিজুর।
উজিরপুর মডেল থানার ওসি মো. কামরুল হাসান গতকাল বিকেলে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘উপজেলা পরিষদের মাঠে ফুল দেওয়ার পরে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে হাতাহাতি হয়। এ ঘটনায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি যারা আছেন, তারা বসে বিষয়টি মিটমাট করেছেন।’
দল থেকে ৩ নেতা বহিষ্কর : মারামারির এ ঘটনায় দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বামরাইল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান পলাশ, শিকারপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ রিয়াজুল ইসলাম কাজী ও বামরাইল ইউনিয়ন যুবলীগের সদস্য জসিম উদ্দিন রুবেলকে সাময়িকভাবে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে তাদের বহিষ্কারের বিষয়টি উজিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. গিয়াস উদ্দিন বেপারী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মারামারির ঘটনায় দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে উজিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের এক জরুরি সভার সিদ্ধান্তে তাদের সাময়িকভাবে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে উজিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. গিয়াস উদ্দিন বেপারী বলেন, ‘দল থেকে সাময়িকভাবে তিনজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বিষয়টি আমাদের রাজনৈতিক অভিভাবক আলহাজ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহকে অবহিত করা হয়েছে। তিনি পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন।’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সংসদ সদস্য শাহ আলম তালুকদারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
নেত্রকোনায় র্যালিতে বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষ, আহত ৬০ : নেত্রকোনার দুর্গাপুরে মহান স্বাধীনতা দিবসে শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদনে র্যালি নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। গতকাল রবিবার সকাল ১০টার দিকে উপজেলার কাচারি মোড় থেকে ব্যানার নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা শহীদ বেদিতে যাওয়ার সময় এ ঘটনা ঘটে।
সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় নিজেদের অন্তত ৬০ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন বলে দাবি বিএনপি নেতাদের। অন্যদিকে বিএনপি নেতাকর্মীদের হামলায় পাঁচ সদস্য আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এছাড়া ঘটনার সময় বিএনপির চার কর্মীকে আটকের কথা জানানো হয়।
এদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দুর্গাপুরে বিএনপির স্বাধীনতা দিবসের র্যালিতে পুলিশ হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করে এর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
নেত্রকোনা পুলিশের দাবি, র্যালি নিয়ে শহীদ বেদিতে ফুল দিতে যাওয়ার সময় পুলিশকে লক্ষ্য করে গালিগালাজ শুরু করেন দুর্গাপুর বিএনপির নেতাকর্মীরা। একপর্যায়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। তখন তাদের বাধা দিলে সংঘর্ষে জড়ান। এ সময় উভয়পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে চার রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। পরে বিএনপির চার নেতাকর্মীকে আটক করা হয়।
তবে বিএনপি নেতাদের দাবি, র্যালি নিয়ে শহীদ বেদিতে ফুল দিতে যাওয়ার সময় ব্যানার নিতে বাধা দেয় পুলিশ। এ নিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয় পুলিশের। একপর্যায়ে লাঠিচার্জ করলে সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে নেতাকর্মীরা আহত হন।
বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, পুলিশ চার রাউন্ড গুলি ছোড়ার কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে ১৫-২০ রাউন্ড রাবার বুলেট ছোড়াসহ ঘটনাস্থল থেকে সাতজন নেতাকর্মীকে ধরে নিয়ে যায়।
উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জহিরুল আলম ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘কাচারি মোড় এলাকা থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণের জন্য শত শত নেতাকর্মীদের নিয়ে শহীদ মিনারে যাওয়ার প্রাক্কালে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশ তর্কবিতর্কে জড়িয়ে গিয়ে আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে আমাদের ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে। পরে আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর লাঠিচার্জ শুরু করে পুলিশ। এছাড়া সেখান থেকে বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে ধরে নিয়ে যায়।’
দুর্গাপুর উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব সম্রাট গণি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পুলিশের সঙ্গে প্রথমে আমাদের ব্যানার নিয়ে টানাটানি ও কাগজ ছোড়াছুড়ি হয়। পরে যুবদলের পক্ষ থেকে সেøাগান দিতে থাকে। একপর্যায়ে পুলিশ ১৫-২০ রাউন্ড রাবার বুলেট ছুড়ে। নিরস্ত্র অবস্থায় তখন আমরাও ঢিল দিই। মোবাইলে ভিডিও করার সময় আমাদের ৭-৮টি মোবাইল ছিনিয়ে নেয় পুলিশ। এছাড়াও মসজিদের ভেতরে নেতাকর্মীদের রাখা প্রায় তিনশ’ মোটরসাইকেলের খোঁজ নেই। কিন্তু পুলিশ বলছে, তারা ৩০-৪০টার মতো মোটরসাইকেল নিয়ে গেছে। আমার ডান হাঁটুতে বুলেট লেগেছে। ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক শিশিরের মাথায় গুলি লাগাসহ ৫০-৬০ জন নেতাকর্মী আহত হন।’
তবে দুর্গাপুর থানার ওসি মো. শিবিরুল ইসলাম উল্টো বিএনপি নেতাকর্মীরা আগে পুলিশের ওপর হামলা চালায় বলে অভিযোগ করেছেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপির লোকজন রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করেছে। ইট-পাটকেল মারাসহ ককটেল ও বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।’
আর নেত্রকোনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি ও মিডিয়া) মো. লুৎফর রহমান বলেন, ‘সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিএনপির লোকজন শহীদ মিনারে ফুল দিতে আসার সময় দুর্গাপুর পৌরসভার কাচারি মোড় এলাকায় পৌঁছার পরে পুলিশকে দেখে বিভিন্ন ধরনের সেøাগান ও অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। পুলিশ গালিগালাজের কারণ জিজ্ঞেস করলে তখন বিএনপির নেতাকর্মীরা ঠেলা ধাক্কা দেওয়া শুরু করে ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। পরে পুলিশ তাদের সতর্ক করে লাঠিচার্জ ও চার রাউন্ড ফায়ার করে এবং চারজনকে আটক করে।’
নিন্দা ও প্রতিবাদ ফখরুলের : বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করে বলেছেন, ‘স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও বিএনপিসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের ওপরই কেবল বাধা দেওয়া হচ্ছে না, বরং যেকোনো জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানের ওপরও ন্যক্কারজনক হামলা চালানো হচ্ছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলায় কেবল আওয়ামী সন্ত্রাসীরাই নয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এ ধরনের হামলায় পিছিয়ে নেই।’ গতকাল বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু স্বাক্ষরিত গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি এসব কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘দুর্গাপুর উপজেলা ও পৌর বিএনপিসহ সব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত মহান স্বাধীনতা দিবসের র্যালিতে পুলিশের বাধা দিয়েছে, টিয়ারশেল, গুলি ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করেছে। এতে ৬০ জনের অধিক নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধ এবং ৮ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আহত নেতাকর্মীরা গুরুতর আহতাবস্থায় বর্তমানে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আহতদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আমরা এ ধরনের পৈশাচিক ও ন্যক্কারজনক হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশে আইনের শাসন না থাকার কারণে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মাত্রা এখন আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। পুলিশ আইনের রক্ষক অথচ তারাই আইনভঙ্গের মাধ্যমে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম চালাচ্ছে।’
বিবৃতিতে বিএনপি মহাসচিব অবিলম্বে গ্রেপ্তার নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা ‘মিথ্যা মামলা’ প্রত্যাহারসহ তাদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানান। এছাড়া তিনি ‘পুলিশি গুলিবর্ষণে’ আহত নেতাকর্মীদের আশু সুস্থতা কামনা করেন।
প্রতিবেদনটি নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল প্রতিনিধি ও উজিরপুর সংবাদদাতার তথ্যে তৈরি
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ভবনেই গণপূর্ত অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র (ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট) নেই। বহুতল ভবন নির্মাণের আগে এবং পরে তা বসতের বা ব্যবহারের উপযোগী কি না, তার জন্য দুই প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন বা ছাড়পত্র লাগে।
কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলোর জন্য দুই প্রতিষ্ঠানের কোনোটির ছাড়পত্র নেই। অনুমোদন ছাড়াই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়টির একাডেমিক ও আবাসিক কার্যক্রম।
অনুমোদন তথা ছাড়পত্র না নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও ওয়ার্কস দপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. হাফিজুর রহমান।
অনুমোদন না নিয়ে বিধি অমান্য করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ময়মনসিংহ বিভাগের উপপরিচালক মো. মতিয়ার রহমান।
দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনা ঘটলে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, সে বিবেচনা থেকেই ভবন নির্মাণ করা হয়। সব ঠিক থাকলেই ছাড়পত্র (ক্লিয়ারেন্স সনদ) দেওয়া হয়। সনদের বাইরে গিয়ে ভবন নির্মাণ এবং ব্যবহারের সুযোগ নেই। অভিযোগ এলে আমরা জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় সুরাহা করার চেষ্টা করব। তবে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের কাছ থেকে ক্লিয়ারেন্স নেয়নি।’
ময়মনসিংহ গণপূর্ত দপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্কস ও প্ল্যানিং কমিটির সদস্য এ কে এম কামরুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। তারা তাদের মতো সিদ্ধান্ত নেয়। তবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ক্লিয়ারেন্স নেওয়া দরকার। না নিলে আইন অমান্য করা হয়। আমি উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থাগ্রহণের লক্ষ্যে কাজ করব।’
একদিকে ভবনের অনুমোদন নেই, অন্যদিকে অগ্নিনির্বাপণের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব। দশতলা বঙ্গমাতা ছাত্রী হলে অগ্নিনির্বাপণের জন্য ৬২টি ছোট সিলিন্ডার রয়েছে। এসবের কোনোটিরই মেয়াদ তথা কার্যকারিতা নেই। এ কথা নিশ্চিত করেছেন হলটির প্রাধ্যক্ষ নুসরাত শারমিন তানিয়া।
অগ্নিনির্বাপণের প্রস্তুতি কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা চিন্তিত। বারবার বলেও সমাধান পাইনি। আমাদের কিছু সিলিন্ডার থাকলেও সেগুলোর মেয়াদ নেই। তা ছাড়া এসব কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, সে বিষয়ে কাউকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। মোটকথা, এ ব্যাপারে প্রশিক্ষিত লোকবল নেই। কিছুদিন আগে হলে আগুন লাগার কথা ছড়িয়ে পড়লে আতঙ্কে হুড়োহুড়ি করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে অনেক শিক্ষার্থী আহত হয়। আমরা নিদানের ব্যবস্থার জন্য প্রকৌশল দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করেই যাচ্ছি।’
ফায়ার সার্ভিস ও গণপূর্তের ছাড়পত্রহীন ভবনে হলের কার্যক্রম চলছে কি না জানতে চাইলে নুসরাত শারমিন বলেন, ‘আমাদের ডিপিডি ও প্রকৌশল দপ্তর বলেছে, সব অনুমোদন আছে। তবে তারা আমাদের কোনো ডকুমেন্ট দেয়নি।’
একই চিত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দশতলা বঙ্গবন্ধু হল, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ভবন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ভবন, কলা ও বিজ্ঞান ভবনসহ শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ডরমিটোরি, কোয়ার্টার ও প্রশাসনিক ভবনের। এমনকি নির্মাণাধীন কোনো ভবনের নকশার অনুমোদন নেই।’
আগুন নেভানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫৪টি সিলিন্ডার থাকলেও অধিকাংশের মেয়াদ নেই; এসব ব্যবহারের নিয়মও কেউ জানে না। অগ্নিনির্বাপণের কোনো প্রশিক্ষণের আয়োজনও নেই। ১৫৪টি সিলিন্ডারের মধ্যে বঙ্গমাতা হলে ৬২টি, বঙ্গবন্ধু হলে ২২টি, সামাজিক বিজ্ঞান ও ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদে ৩০টি করে এবং প্রশাসনিক ভবনে ১০টি সিলিন্ডার রয়েছে বলে জানা গেলেও জায়গামতো সেগুলো দৃশ্যমান নয়।
চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গমাতা হলে আগুন লাগার গুজবে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে হাসপাতালেও নিতে হয়েছিল। এরপর প্রশাসন নড়েচড়ে বসলেও অগ্নিনির্বাপণ বিষয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যায়নি।
৫৭ একরের বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কোনো পানির উৎস নেই। বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে পানির ব্যবস্থা কীভাবে হবে তা নিয়ে শঙ্কিত ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। এত বড় ভবনের আগুন নেভানো তাদের রিজার্ভের পানি দিয়ে সম্ভব নয়।
আগুন নেভানোর সরঞ্জামের ঘাটতি ও ছাড়পত্র না থাকলেও তাদের প্রস্তুতি রয়েছে বলে মনে করেন পরিকল্পনা ও ওয়ার্কস দপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. হাফিজুর রহমান ও ইঞ্জিনিয়ার মাহবুব হোসেন। হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দুটি আন্ডারগ্রাউন্ড রিজার্ভার রয়েছে। আগুন লাগলে সেখান থেকে পানি সরবরাহ করা যাবে। আর জলাশয় নির্মাণের কাজ চলছে। ভবিষ্যতে ছাড়পত্রের বিষয়টি দেখা যাবে। আগুন লাগলে সৃষ্টিকর্তা না চাইলে আমাদের প্রস্তুতি দিয়েও লাভ হবে না। যা হয়ে গেছে, তা তো হয়েই গেছে।’
ভবনের গণপূর্ত ও ফায়ার সার্ভিসের সনদ না থাকার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কৃষিবিদ ড. হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার ধারণা নেই। সংশ্লিষ্ট দপ্তর বলতে পারবে। যদি সেসবের প্রয়োজন থাকে আর আমাদের সেসব না থেকে থাকে, তাহলে আমরা প্রশাসনিকভাবে সেসব নিয়ে কাজ করব। এসব বিষয়ে দ্রুতই চিঠি দেওয়া হবে।’
বঙ্গমাতা হলের শিক্ষার্থী ফাইজাহ ওমর তূর্ণা বলেন, ‘আমরা আতঙ্কে থাকি। সারা দেশে যেভাবে আগুন লাগছে, চিন্তা হয়। আমাদের এত বড় হল, তার আগুন নেভানোর কোনো ব্যবস্থা নেই; যা আছে তা ব্যবহার করতেও জানি না আমরা। আগুন লাগলে ভয়েই মরে যাব।’
বঙ্গবন্ধু হলের শিক্ষার্থী ফাহমিদ অর্ক বলেন, ‘আগুন নেভানোর যথেষ্ট ব্যবস্থা নেই। ব্যবস্থা না নিলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিক্ষার্থীরা। সত্বর সুরাহার ব্যবস্থা করা উচিত।’
অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার দুর্দশা নিয়ে চিন্তিত শিক্ষক সমিতির সভাপতি রিয়াদ হাসান। তিনি বলেন, ‘আমরা নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে কাজ শুরু করার উদ্যোগ নেব।’
জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সিনিয়র পেশ ইমাম। দারুস সুন্নাহ ওয়াল ফিকর, মিরপুরের প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম এবং মিরপুর সাংবাদিক এলাকার মসজিদে ফারুকের খতিব। হুফফাজুল কুরআন ফাউন্ডেশনের সহ-সভাপতি। দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন- রমজানের আমল, ইমামের গুণাবলি ও হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতাসহ সমসাময়িক নানা প্রসঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জামিল আহমদ
দেশ রূপান্তর : বায়তুল মোকাররমে প্রথম ইমামতির স্মৃতি?
মুফতি মিজানুর রহমান কাসেমি : ছাত্রজীবনে পল্টন ময়দানসহ আশপাশের এলাকায় অনুষ্ঠিত বিভিন্ন ইসলামি অনুষ্ঠানে মাঝে-মধ্যে আসতাম। তখন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম ঘুরে ঘুরে দেখতাম। নামাজের সময় নামাজ আদায় করতাম। তখন আকারে ছোট থাকলেও পরিবেশ ছিল খুব সুন্দর। এখন আকার বড় হলেও বিভিন্ন কারণে জাতীয় মসজিদে আগের সেই মনোরম পরিবেশ নেই।
২০০৬ সালের ডিসেম্বরে যখন প্রথমবার ইমামতি করলাম, জায়নামাজে দাঁড়ানোর আগে কিছুটা ভয় কাজ করছিল জাতীয় মসজিদ বলেই, ভয়ে ভয়ে নামাজ পড়ানোর পর অন্তর থেকে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছি। যেখানে নামাজ পড়ানোর স্বপ্ন ছিল সেখানের ইমাম হয়েছি। এখন সিনিয়র পেশ ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আর এটা হয়েছে আমার উস্তাদবৃন্দ ও মা-বাবার দোয়ার বরকতে।
দেশ রূপান্তর : ইমামদের কাছে রমজান মাস কি আলাদা কিছু?
মুফতি মিজানুর রহমান কাসেমি : সব মাসই ইমামদের কাছে সমান। তবে রমজান মাস একটু বেশি গুরুত্ববহ। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ইমামরা হলেন দায়িত্বশীল।’ সেই দায়িত্ব শুধু নামাজের ক্ষেত্রে নয়। তিনি সমাজকে নেতৃত্ব দেবেন। সাধারণ মানুষকে পথ দেখাবেন। সংগত কারণেই রমজান মাসে এ দায়িত্ব বেড়ে যায় বলে মনে করি। রমজান হলো- ইবাদতের বসন্তকাল। তাই নিজে বেশি বেশি ইবাদতে মশগুল হওয়ার পাশাপাশি সমাজের সবাই যেন ইবাদতে বেশি বেশি মশগুল থাকতে পারে সেই চিন্তা থেকে দাওয়াতি কাজ পরিচালনা করা। নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘রমজান হলো- একে অপরের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর মাস। অন্যের প্রতি ভালোবাসা ও দয়া দেখানোর মাস।’ কাজেই সমাজের বিরাজমান সমস্যাবলি (মানুষে মানুষে দূরত্ব, হিংসা ইত্যাদি খুব বেশি) দূরীকরণে ভূমিকা রাখো। সমাজের হতদরিদ্র, যারা আর্থিক সমস্যার কারণে মানবেতর জীবনযাপন করছে, তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসার জন্য বিত্তশালীদের পেছনে মেহনত করা। মানবিক কাজে সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসার জন্য সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা একজন ইমাম সাহেব সবচেয়ে বেশি করতে পারেন।
দেশ রূপান্তর : একজন আদর্শ ইমামের কী কী গুণ থাকা উচিত বলে মনে করেন।
মুফতি মিজানুর রহমান কাসেমি : আদর্শ ইমামের গুণাবলি অনেক। মৌলিকভাবে, ইমাম হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকবে। ব্যক্তিজীবেন তিনি তাকওয়াবান ও পরহেজগার হবেন। অর্জিত জ্ঞানের আমল থাকবে। আকিদাগতভাবে সহিহ আকিদার অনুসারী হবেন। দেশ ও জাতির উদ্ভূত নানাবিধ সংকট নিরসনে এগিয়ে আসা এবং সাধ্যানুযায়ী সহযোগিতার পাশাপাশি সংকটকালীন দিকনির্দেশনা দেবেন।
দেশ রূপান্তর : সমাজে ইমামদের আশাতীত প্রভাব নেই। কেন নেই?
মুফতি মিজানুর রহমান কাসেমি : সমাজে ইমামদের আশাতীত প্রভাব না থাকার অনেক কারণ রয়েছে। সবগুলো আলোচনা করার মতো নয়। তবে মোটাদাগে আমার কাছে মনে হয়, যারা ইমাম আছি তাদেরই দুর্বলতা বেশি। হয়তো আমলের কমতি, আখলাকে ঘাটতি কিংবা তাকওয়া কমসহ অনেক দুর্বলতা রয়েছে। তাই আশাতীত প্রভাব পড়ছে না। সমাজে প্রভাব বিস্তারের জন্য ইমামদের উচিত, নিজেকে আগে পরিশুদ্ধ করা, জ্ঞানার্জনে পাকাপোক্ত হওয়া এবং পরিপূর্ণ আখলাকি (চরিত্রবান) মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। এসবের সমন্বয়ে নিজেকে গড়তে পারলেই একজন ইমাম সমাজে প্রভাব বিস্তারে সফল হবেন। ইমাম তখন সত্যিকারের ইমামে (নেতা) পরিণত হবেন।
দেশ রূপান্তর : ইমামদের নিয়ে আপনার কোনো স্বপ্ন আছে?
মুফতি মিজানুর রহমান কাসেমি : অবশ্যই আছে। আমি মনে করি, দেশের সব ইমামের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ থাকা উচিত। এমন একটা প্লাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ থাকা, যেখানে দুনিয়ার কোনো স্বার্থ থাকবে না, থাকবে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি। আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকলে দুনিয়াতে লাভবান হবেন, মুক্তি পাবেন পরকালেও। তাদের কাজ হবে, দেশ-জাতি ও ধর্মীয় যেকোনো ইস্যুতে একযোগে ভূমিকা রাখা।
আরেকটা বিষয় হলো- শহর বা শহরতলি এলাকার মসজিদগুলোর ইমামরা মোটামুটি সম্মানী পেলেও মফস্বলের ইমামরা কিন্তু সেভাবে সম্মানী পান না। অনেক জায়গায় দেখা যায়, অনেকদিনের সম্মানী অপরিশোধিত রয়ে গেছে। এ অবস্থা নিরসনে সরকারি-বেসকারিভাবে একটি ফান্ড তৈরি করা, যেখান থেকে ইমামদের বিপদে-আপদে, সংকটে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করা যায়।
আমার কাছে মনে হয়, মসজিদ পরিচালনা কমিটিতে ইমামের অন্তর্ভুক্তি অত্যন্ত জরুরি বিষয়। ইমাম এমন হবেন না, কমিটি থেকে নির্দেশ এলো এটা করেন; ইমাম সাহেব তা পালন করবেন। বরং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়ই তিনি যুক্ত থাকবেন, নিজের মতপ্রকাশ করবেন। ইমামদের উদ্দেশ্যে আমার কথা হলো- আল্লাহ যাকে যে জ্ঞান দিয়েছেন তা চর্চার সঙ্গে সঙ্গে ইলম অনুযায়ী আমলি জিন্দেগি গঠনে সচেষ্ট হওয়া। মানসিকভাবে আরও উদার হওয়া, পরিচ্ছন্ন মনোভাব ধারণ করা। চিন্তাভাবনা পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর করা, সর্বোপরি নিজেকে আগে পরিশুদ্ধ করা।
দেশ রূপান্তর : সম্প্রতি হাফেজদের নিয়ে একটি হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রধান বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন, কেমন অভিজ্ঞতা হলো?
মুফতি মিজানুর রহমান কাসেমি : ভালো অভিজ্ঞতা হয়েছে। এমন কাজের সঙ্গে আমি অনেক আগে থেকেই যুক্ত। বিগত এক যুগ যাবৎ বাংলাদেশে হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতা বিভিন্নভাবে হয়। জেলা, থানা, বিভাগভিত্তিক হয়। যার অনেকগুলো মিডিয়াতে আসে না। এসব প্রতিযোগিতা আয়োজনে অনেকেই এগিয়ে আসছেন, আগামীতে আরও এগিয়ে আসবেন বলে আশা রাখি।
বেশকিছু টেলিভিশনেও এখন নিয়মিত হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতার আয়োজন ও প্রচার হয়। এসব প্রতিযোগিতাকে আমি ইতিবাচক হিসেবেই দেখি। এর দ্বারা কোরআন হিফজে অনেকেই আগ্রহী হচ্ছেন। প্রতিনিয়ত অল্প বয়সেই অনেকে হাফেজে কোরআন হচ্ছে। এখানে যেমন গরিবের সন্তানরা আছেন। আছেন সমাজের বিত্তশালী পরিবারের সন্তানও। আরও ব্যাপকভাবে হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতা আয়োজনে বড় বড় শিল্প পরিবারের এগিয়ে আসা দরকার।
দেশ রূপান্তর : বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় জয়ী হাফেজরা ভালোমানের আলেম হয় না, আপনি কী মনে করেন?
মুফতি মিজানুর রহমান কাসেমি : জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হলে অনেক পুরস্কারের পাশাপাশি নাম-যশ হয়। পুরস্কার আর নাম-যশের মোহ যাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে তাদের একটা অংশ নিয়ে আমরা ব্যথিত। তারা মেধাবী কিন্তু তাদের মেধার যথাযথ বিকাশ কাক্সিক্ষত লক্ষ্য আলেম হওয়া কিংবা কোরআন বুঝার জন্য ব্যয় করতে পারছে না। অনেকের শিক্ষাজীবন পূর্ণতাও পায় না। এদিকে তারা অমনোযোগী হয়ে যাচ্ছে। এর কারণ হলো- প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে হাতে টাকা আসে, পরিচিত হয় এবং সেটা আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বাহ্যত নাম-সুনাম হলেও এর দ্বারা সে কিন্তু দুনিয়ার পেছনে পড়ে যাচ্ছে। এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এখানে আমাদের উস্তাদরা কাজ করবেন, বুঝাবেন, প্রয়োজনে শাসন করবেন। এর পাশাপাশি অভিভাবক ও মা-বাবাসহ সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে সচেতন হলে আশা করি পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।
দেশ রূপান্তর : রমজান উপলক্ষে দেশবাসীকে কোনো পরামর্শ দিতে চান কি?
মুফতি মিজানুর রহমান কাসেমি : পবিত্র রমজান উপলক্ষে দেশবাসীর কাছে আমার আহ্বান হলো- রাসুলে আকরাম (সা.) বলেছেন, রমজান যখন শুরু হয়, তখন আসমান থেকে দুজন ফেরেশতা নেমে আসেন। একজন ফেরেশতা বলেন, হে কল্যাণকামী! তোমরা যারা কল্যাণের পথে আছো তোমরা আরও এগিয়ে চলো। দেশ ও জাতির কল্যাণে আরও এগিয়ে যাও। আরেকজন ফেরেশতা বলেন, তোমরা যারা অন্যায়ের পথে আছো। অন্যায় করে ফেলেছ। এবার থামো! রমজান শুরু হয়ে গেছে। এখন অন্যায়, পাপ, নাফরমানি বন্ধ করো। দেশ ও জাতির ক্ষতি হয়ে এমন কাজ বন্ধ করো।’ রাসুল (সা.) যে শিক্ষা আমাদের দিয়েছেন, তা সামনে নিয়ে পথ চলা। সব ধরনের অন্যায়-অনাচার পরিত্যাগ করে কল্যাণের পথে ফিরে আসা। অপরকে অন্যায়ের পথ থেকে ফিরে আসতে সহযোগিতা করা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
বাংলাদেশের অপরাধীরা আগে ভারতে গিয়ে আত্মগোপন করত। এরপর জানা গেল, সেখান থেকে দেশে অপরাধ ঘটায় তারা। কারও কারও নেপালে অবস্থানের কথাও জানা যায়। ভারতকে নিরাপদ মনে না করায় আরব আমিরাতের দুবাই বেছে নিচ্ছে অপরাধীরা। সেখানে তারা আস্তানা গেড়েছে।
পুলিশসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দেশের অপরাধজগতের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীরা অপরাধ করেই দুবাই চলে যাচ্ছে। সেখানে বসেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কলকাঠি নাড়ছে। এখন বিতর্কিত মডেল, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরাও দুবাইকে কেন্দ্র করে নানা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। সেখানে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যও আছে। তাদের কেউ কেউ সোনার কারবারও করছেন। ওই দেশে ভারতের দুর্ধর্ষ অপরাধী দাউদ ইব্রাহিমের শিষ্যত্ব নেওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ওইসব অপরাধীর তথ্য জানার পরও তাদের ফেরত আনতে পারছেন না। আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের ‘রেড নোটিসের’ দিকেই তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে পুলিশকে। তালিকাভুক্ত অপরাধীদের ধরতে রেড নোটিস জারি হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তারা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৮ সালে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান হত্যাকাণ্ডের পর অনেকে পার পেয়ে গেছে। যদিও মামলাটি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। তবে নতুন করে আলোচিত মামলাটির পুনঃতদন্ত করার কথা ভাবছে পুলিশ। এ নিয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠক করছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেশ রূপান্তরকে জানান, ২০২২ সালের ২৪ মার্চ সড়কে গুলি চালিয়ে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যা করা হয়। গুলিতে নিহত হন এক কলেজছাত্রী। চাঞ্চল্যকর এই জোড়া খুনের মূল হোতা সুমন শিকদার ওরফে মুসা ঘটনার রাতেই দেশ ছেড়ে চলে যায় দুবাইয়ে। সেখানে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও জয়ের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে আধিপত্য নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে মুসা চলে যায় ওমানে। জিসান ও জয় এখনো দুবাইতেই বসবাস করছে। যদিও ওমান থেকে মুসাকে ওই বছরের ৯ জুন ইন্টারপোলের মাধ্যমে ঢাকায় ফিরিয়ে আনে পুলিশ সদর দপ্তর। এ ঘটনার রেশ না কাটতেই ফের আলোচনায় আসে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও হিরো আলমের দুবাই সফরকে কেন্দ্র করে। তারা বনানীতে পুলিশ হত্যাকাণ্ডের আসামি আরাভ খান নামধারী রবিউল ইসলামের সোনার দোকান উদ্বোধন করতে সেখানে যান। দুবাই যাওয়ার কারণে সাকিব ও হিরো আলমকে যেকোনো সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি কার্যালয়ে ডাকা হতে পারে। এ ছাড়া ‘প্লেজার ট্যুরের’ জন্য এখন দেশের শিল্পপতিদের পছন্দের জায়গা হয়ে উঠেছে দুবাই। কারণ ঢাকাকে তারা নিরাপদ মনে করছেন না। পাশাপাশি দেশে আটক সোনার চালানের ৮০ শতাংশ জব্দ হচ্ছে দুবাইফেরত বিভিন্ন এয়ারলাইনস থেকে। সব মিলিয়ে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে দুবাই।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অপরাধীরা যে দেশেই থাকুক না কেন, তাদের চিহ্নিত করে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে আটক করার পর দুবাই থেকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফেরত আনতে চেয়েছিল পুলিশ। সম্প্রতি আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলার অন্যতম আসামি আরাভকে দুবাই থেকে ফেরত আনতে ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। আশা করি অল্প সময়ে সুখবর দেওয়া সম্ভব হবে।’
পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে জানান, সম্প্রতি আলোচনায় আসা আরাভ খানকে দেশে ফেরাতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি ভারতের পাসপোর্টধারী। দেশে তার নামে ১২টি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। ওইসব পরোয়ানার কপি ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে পাঠানোর পর দ্রুতই তাকে ফেরানো সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। যদিও এর আগে জিসান ও জয়কে দুবাই থেকে ফেরত আনার উদ্যেগ নিয়েও আনতে পারেনি। টের পেয়ে তারা দুবাই ছেড়ে কানাডায় চলে যায়। তারা আবার দুবাই এসেছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে।
ওই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে বিতর্কিত মডেল, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা এই দেশে অপরাধ করে দুবাই গিয়ে আস্তানা গাড়েন। ইতিমধ্যে পুলিশ একটি তালিকা করেছে। ওই তালিকায় গুলশান ও বনানী এলাকার মডেলের সংখ্যা বেশি। বছরখানেক আগে গ্রেপ্তার হওয়া ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও চলচ্চিত্র প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ বেশিরভাগ সময় দুবাই থাকেন। তাদের সঙ্গে অপরাধ জগতের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সখ্য আছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে। এমনকি বনানীতে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন হত্যাকান্ডে তাদেরও সম্পৃক্ততা ছিল বলেও অভিযোগ উঠেছিল। ঘটনার পর পিয়াসা, রাজ ও আরাভকে আটকও করা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের এক বড় মাপের নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তার অনুরোধে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এসব বিষয় নিয়ে পুনরায় তদন্ত করা হতে পারে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংগীতশিল্পী, এক ব্যবসায়ীর স্ত্রী ও কয়েকজন মডেল নিয়মিত দুবাই আসা-যাওয়া করেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, ২০০১ সালে তৎকালীন সরকার ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসী ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন ধরা পড়েছে। আবার কেউ ক্রসফায়ারে মারা গেছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার তাড়া খেয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মগোপনে আছে কেউ কেউ। আত্মগোপনে থেকেই তারা অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই দুবাই রয়েছে।
পুলিশ সূত্র আরও জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় আছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। এ নিয়ে পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তারা কয়েক দফায় বৈঠক করেছেন। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও আলাদাভাবে বৈঠক হয়েছে। ওইসব বৈঠকে বলা হয়েছে, ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করার পরও কেন তারা ধরা পড়ছে না তা খতিয়ে দেখতে হবে। ২০০৩ সালে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশের দুই সদস্যকে হত্যার পর শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দুবাই চলে যায়। সেখান থেকেও ঢাকায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে। তার সহযোগী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সোহেল শাহরিয়ার ওরফে শটগান সোহেল, কামরুল হাসান হান্নান, ইব্রাহীম, রবিন ও শাহাদৎ হোসেন বেশিরভাগ সময় দুবাই থাকে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্দিবিনিময় চুক্তি থাকায় বেশ কয়েকজন শীর্ষ অপরাধীকে বাংলাদেশে ফেরত আনা হয়। শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, শাহাদৎ, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার আসামি নুর হোসেনসহ অনেকেই কলকাতায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। নুর হোসেন ছাড়া অন্য সন্ত্রাসীদের দেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। সুব্রত, মোল্লা মাসুদ ও শাহাদৎ ভারতে সুবিধা করতে না পেরে মুম্বাই হয়ে দুবাই চলে যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকার অপরাধজগতের এক সন্ত্রাসী এ প্রতিবেদককে বলেন, অপরাধীরা এখন আর ভারত যেতে চায় না। কারণ ওই দেশে শান্তিতে থাকা যায় না। ফলে সবাই এখন দুবাইমুখী হচ্ছে। দুবাইয়ে সবাই নিরাপদে থাকতে পারছে।