
ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হবে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ। আগামী ১০ ডিসেম্বর সমাবেশের অনুমতি চেয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার ফারুকের কাছে আবেদন করা হয়েছে। আবেদনে শুধু নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের জায়গার কথাই উল্লেখ করা হয়েছে।
গতকাল সোমবার দেশ রূপান্তরকে বিএনপির একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, ‘আমরা নয়াপল্টনেই সমাবেশ করব। দলের সিদ্ধান্তেই নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার অনুমতি চাওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকার আমাদের কেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দিতে চায়; তা নিয়ে আমাদের সন্দেহ বাড়ছে। তারা অপকর্ম করে দায় আমাদের ওপর চাপাতে পারে।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নয়াপল্টনেই সমাবেশ করব। এটাই দলীয় সিদ্ধান্ত। আমরা আবেদনও করেছি নয়াপল্টনে অনুমতি চেয়ে। আমরা বলেছি, সমাবেশ হবে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। অন্য ৮ বিভাগীয় সমাবেশে সরকার পথে পথে বাধা দিলেও আমরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করেছি।’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশকে সামনে রেখে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হয়রানি করছে। ককটেল হামলা হয়নি অথচ ককটেল হামলার মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।’
নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, দলীয় নেতাকর্মীদের হত্যা, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি এ গণসমাবেশ করছে। গত ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামে প্রথম বিভাগীয় সমাবেশ হয়। এরপর ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর, সিলেট, ফরিদপুর, বরিশাল ও কুমিল্লায় সমাবেশ হয়েছে। আগামী ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে সমাবেশ হবে। ঢাকার সমাবেশের মধ্য দিয়ে এই কর্মসূচি শেষ হবে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুস সালাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডিএমপিকে আমরা দুই দফা চিঠি দিয়ে জানিয়েছি, আমরা নয়াপল্টনে সমাবেশ করব। অতীতে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করেছি, আগামীতেও করব।’
তিনি বলেন, ‘সরকার সব বিভাগীয় সমাবেশের অনুমতি নিয়ে টালবাহানা করেছে। হঠাৎ করে আগেভাগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি দিতে চায়; তা নিয়ে আমাদের সন্দেহ হচ্ছে। আমরা অনুমতি চাইলাম ডিএমপির কাছে। ডিএমপি জবাব দিল না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আগেভাগে কেন সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিচ্ছেন তা বুঝতে পারছি না।’
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী ১০ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে গণসমাবেশের অনুমতি চেয়ে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমরা আবেদন করেছি। একটি স্থানের কথাই উল্লেখ করেছি। একইসঙ্গে সারা দেশে সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিএনপির নেতাকর্মীদের গণগ্রেপ্তার বন্ধের দাবি জানিয়েছি। সমাবেশকে কেন্দ্র করে, যাতে গণপরিবহন বন্ধ করা না হয় সে ব্যাপারেও সহযোগিতা চেয়েছি। আমাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জানানো হয়, গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ ও থ্রেট অ্যানালাইসিস করে অনুমতির কথা ভাবা হবে। অনুমতি দেওয়া হলে সব ধরনের আইনি সহায়তা দেওয়া হবে বলে আমাদের জানানো হয়েছে।’
ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নয়াপল্টনেই আমরা দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৫টার মধ্যে সমাবেশ করব। সব দিক বিবেচনায় নয়াপল্টন অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। সরকার বাধা দিলে বুঝতে হবে তাদের দুরভিসন্ধি রয়েছে।’
গত ২৫ নভেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিএনপির দাবি ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। আমাদের তরফ থেকে জানিয়ে দেওয়ার জন্য ডিএমপি কমিশনারকে বলে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাও তা-ই। তাদের জানিয়ে দেওয়া হবে, কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটানো যাবে না। প্রতিবন্ধকতা ও জনদুর্ভোগ করা যাবে না। এটা তাদের প্রতি রিকোয়েস্ট থাকবে।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের জবাবে বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী সাংবাদিকদের বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কীভাবে বিএনপি সমাবেশ করবে? ১০ ডিসেম্বরের আগের দু’দিন সেখানে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের কর্মসূচি রয়েছে। সেখানে বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দিলে তা সাংঘর্ষিক হবে। গত বৃহস্পতিবার পুলিশের মতিঝিলের ডিসি আমাকে ফোন করেছিলেন। তিনি বলেছেন, গণসমাবেশের জন্য আপনারা বিকল্প ভেন্যু চেয়ে আবেদন করেন। আমি জানিয়েছি, আমরা নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গণসমাবেশ করার অনুমতি চেয়ে ইতিমধ্যে দুবার চিঠি দিয়েছি। নয়াপল্টনেই কর্মসূচি করতে চাই, অন্য কোথাও নয়। এটা দলের সিদ্ধান্ত। আরও বলেছি, আপনার (মতিঝিলের ডিসি) প্রস্তাব দলকে জানাব।’
১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ সফল করতে বিএনপি প্রচার উপ-কমিটি গঠন করেছে গত রবিবার। উপ-কমিটির সদস্যরা গতকাল দুপুরে রাজধানীর নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তখন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘আগামী ১০ ডিসেম্বর নয়াপল্টনেই বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ হবে। ঢাকার সমাবেশ নিয়ে এখনো বিএনপিকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। গণমাধ্যম মারফত জানতে পেরেছি সরকার অন্য জায়গায় অনুমতি দিতে চায়। দলের সিদ্ধান্ত হচ্ছে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনেই সমাবেশ হবে।’
অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ বলেন, ‘আমাদের দাবি-দাওয়া মেনে নিলে তো সমাবেশ করা লাগবে না। তারা আমাদের দাবি মানলেই হলো। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে চাই। আশা করি সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে।’
মতবিনিময় সভায় বক্তব্য দেন প্রচার উপ-কমিটির আহ্বায়ক মীর সরফত আলী সপু, সদস্য সচিব প্রকৌশলী আশরাফ উদ্দিন বকুল। উপস্থিত ছিলেন প্রচার উপ-কমিটির নেতা আ ক ম মোজাম্মেল হক, ওমর ফারুক সাফিন, আকরামুল হাসান, ফেরদৌস আহমেদ খোকন, তাঁতী দলের আবুল কালাম আজাদ, মজিবুর রহমান প্রমুখ।
বছর বছর মাথাপিছু আয় বাড়ছে। বাহাবা জুটছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। সরকারের স্মিত হাসি চওড়া হচ্ছে। এত ভালোর মধ্যেও নির্ধারিত আয়ের মানুষের পাতের খাবারের তালিকা সংকুচিত হচ্ছে। কেউ কম খাচ্ছেন, কেউবা খাবারের মান কমিয়েছেন। সংসারের অন্য সব খরচেও টান পড়েছে। শখের জিনিসের পেছনে খরচ বন্ধ হয়েছে অনেক আগেই। সবকিছু মিলে কষ্টে দিন পার করছেন সাধারণ মানুষ। মাথাপিছু আয় বাড়লেও এতে সাধারণ বা খেটে খাওয়া মানুষের পেট ভরছে না।
গত ১৪ নভেম্বর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। বৈঠকে গত অর্থবছরের (২০২১-২২) মাথাপিছুু আয় ২ হাজার ৮২৪ ডলারে উন্নীত হওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ২৩৩ ডলার বেশি। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হার প্রতি বছরই বাড়ছে।
নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জীবনে মাথাপিছু আয় বাড়ার যে কোনো প্রভাব নেই, তা বোঝা যায় বিক্রয়কর্মী বকুলের জবানিতে। ঢাকা নিউমার্কেটের একটি শাড়ির দোকানের এ বিক্রয়কর্মী জানান, তিনি মাসে বেতন ও কমিশন মিলে ২০ হাজার টাকা পান। তার দুই ছেলে গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে পড়ে। বড় ছেলে ফিজিকস ও কেমিস্ট্রির জন্য কোচিং করত। কুলিয়ে উঠতে না পারায় গত মার্চ থেকে কোচিং বন্ধ করে দিয়েছেন। বাবার অসহায়ত্ব টের পেয়ে ছেলে একটি অনলাইনভিত্তিক খাবার বিক্রি প্রতিষ্ঠানে সরবরাহকারীর চাকরি নিয়েছে। পাশাপাশি লেখাপড়াও চালাচ্ছে।
ঘটনাটি জানিয়ে বকুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সারা দিন সাইকেলে করে ছেলে এখানে-ওখানে খাবার পৌঁছে দেয়। রাতে ডিউটি শেষে ছেলে যখন বাসায় ফিরে ক্লান্ত শরীরে বই নিয়ে বসে, তখন আর সইতে পারি না। চোখের পাতা ভিজে উঠে। স্ত্রী টের পায়, কষ্টে সেও পাশে এসে দাঁড়াতে চায়। তখন বাবা হিসেবে নিজেকে অক্ষম মনে হয়। কিন্তু আমার যে আর করার কিছু নেই। একটাই পারি, পরিবারের সদস্যদের গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু ছেলেকে একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করেছি। তাও পারতাম না, লটারি পদ্ধতির কারণে আমার ছেলে স্কুলটিতে ভর্তি হতে পেরেছে। এ জন্য কষ্ট করে হলেও তাদের ঢাকায় রেখেছি।’
কিন্তু এভাবে আর চলতে পারছেন না জানিয়ে বকুল বলেন, ‘প্রতিদিনই কোনো না কোনো জিনিসের দাম বাড়ছে। ছেলের কোচিং না হয় বন্ধ করলাম। কাগজ, কলম, পেনসিল, গ্রাফপেপার, বই দাম বাড়ার তালিকা থেকে কোনো কিছুই বাদ যাচ্ছে না। আটা-ময়দা, চাল-চিনি, তেল-সাবান, তরিতরকারি যেটুকু কিনি তার সবটাই বাড়তি দামে।’
গত তিন বছরে নিউমার্কেটের বিক্রয়কর্মীদের কোনো বেতন বাড়েনি। প্রথম দুই বছর করোনা মহামারীর জন্য নিয়মিত বেতন হয়নি। তবে মহামারী নিয়ন্ত্রণে আসার পর থেকে নিয়মিত বেতন হচ্ছে। সরকারের মাথাপিছু আয়ের যে ফর্মুলা তাতে প্রতি বছরই বেতন বৃদ্ধির কথা বলা হয়ে থাকে। ফর্মুলা অনুযায়ী জিনিসপত্রের যেমন দাম বাড়ে, তেমনি শ্রমের মজুরিও বাড়ে বছর বছর।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) মতে, গত মাসে চারজনের একটি পরিবারের খরচ ছিল ২২ হাজার ৪২১ টাকা। এ হিসাব খাবার তালিকায় মাছ-মাংস ধরে। মাছ-মাংস বা আমিষের জোগান বাদ দিয়ে খরচ দাঁড়ায় ৯ হাজার ৫৯ টাকা। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে খরচ ছিল মাছ-মাংসসহ ১৭ হাজার ৫৩০ টাকা আর বাদ দিয়ে ৬ হাজার ৫৪১ টাকা।
বাজার দর কতটা বাড়ল তা নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি তথ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। গত ৫ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে ওই মাসের মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ, যা গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ওই সময় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। কিন্তু সিপিডি বলছে, ওই সময় খাদ্যপণ্যের প্রকৃত মূল্যস্ফীতি ২০ থেকে ৫০ শতাংশ।
খাদ্যের পেছনে মানুষকে এখন তার আয়ের বেশিরভাগ অংশ ব্যয় করতে হচ্ছে। এক বছরের ব্যবধানে জরুরি খাদ্যপণ্যের দাম ৩৬ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এক বছর আগে বাজারে মোটা চালের দাম ছিল প্রতি কেজি ৪৪ থেকে ৪৮, যা এখন ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় উন্নীত হয়েছে। এ সময়ে নাজিরশাইল চাল ৬০ থেকে ৮০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ৩৪ টাকার খোলা আটা এখন ৬৫ থেকে ৬৮ টাকা। গত এক বছরে খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে অন্তত ২৫ শতাংশ। এ সময়ে বিভিন্ন ধরনের মসুর ডাল ২০ থেকে ৪৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। আর চিনির দাম ৭৫ থেকে ১১০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৪ ডলারে উঠলেও বাস্তবে দেশের প্রতিটি মানুষের আয় তা নয়। কারণ, মাথাপিছু আয় কোনো ব্যক্তির একক আয় নয়। দেশের অভ্যন্তরের পাশাপাশি রেমিট্যান্সসহ যত আয় হয়, তা দেশের মোট জাতীয় আয়। সেই জাতীয় আয়কে দেশের মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে মাথাপিছু আয় বের হয়। ফলে দেশে মাথাপিছু আয় বাড়লেও, তাতে ব্যক্তির আয়ে কোনো তারতম্য হয় না।
মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) হিসাব করার জন্য সম্প্রতি নতুন ভিত্তিবছর চূড়ান্ত করেছে সরকার। ২০১৫-১৬ ভিত্তিবছর ধরে জিডিপি, প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ বা মাথাপিছু আয় গণনা করা হয়। এতদিন ২০০৫-০৬ ভিত্তিবছর ধরে এসব গণনা করা হতো।
মাথাপিছু আয়ের যে হিসাব দেওয়া হচ্ছে তা সঠিকভাবে করা হচ্ছে কি না, সেটি নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের একজনের আয় আসলেই ২ হাজার ৮২৪ ডলার হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। সেটা যদি হয়েও থাকে, তাহলে আয়টা কার কাছে যাচ্ছে সেটাও দেখা দরকার। কারণ এত আয়ের পরও সাধারণ মানুষ সংসার চালাতে পারছে না। বাস্তবতা হচ্ছে, কতিপয় মানুষের কাছে সম্পদ কুক্ষিগত হচ্ছে, যারা হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ফলে সমাজে বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করছে।’
দেশে বর্তমানে দারিদ্র্যের হার কত, সরকারিভাবে তা প্রকাশ করা হয়নি। চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী দেশে দারিদ্র্যের যে হার উল্লেখ করেছেন তা পুরনো, অর্থাৎ ২০২০ ও ’২১ সালের করোনাভাইরাসের প্রকোপকালের আগের। গত জুনে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ আইপিসি ক্রনিক ফুড ইনসিকিউরিটি রিপোর্ট’টি ২০০৯-১৯ সময়কালের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রণীত। এতে করোনা মহামারী-পরবর্তী সময়ের অর্থাৎ ২০২০ ও ’২১ সাল শেষে দেশে দারিদ্র্যের হার সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। দারিদ্র্যের হার নির্ধারণে কাজ করা সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০১৬ সালের পর এ সম্পর্কিত কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। সংস্থাটির সর্বশেষ ‘হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (হায়েস) ২০১৬’-এ জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্যের হার দেখানো হয়েছে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। দেশের কয়েকটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদনে দারিদ্র্যের হারে যে ঊর্ধ্বগতি উঠে এসেছে তা গ্রহণে সরকার অনীহা প্রকাশ করেছে। তাই দেশে দারিদ্র্যের বর্তমান হার নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে।
অর্থমন্ত্রীর ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় আওয়ামী লীগের একটানা এক যুগের শাসনামলের অর্জন নিয়ে একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘দারিদ্র্যের হার ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে এবং অতিদারিদ্র্যের হার ১০ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।’
গত দুই বছরে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশের অর্থনীতি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কর্মসংস্থানে মূল ভূমিকা পালনকারী বেসরকারি খাতে চাকরিচ্যুতি, বেতন বা মজুরি কর্তনে মানুষের আয় কমেছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক জনমত জরিপ প্রতিষ্ঠান গ্যালাপ পরিচালিত ‘স্টেট অব দ্য গ্লোবাল ওয়ার্কপ্লেস ২০২১’ অনুযায়ী, করোনার সময় বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৫৫ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। আর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সৃষ্ট উচ্চ মূল্যস্ফীতি আয় কমে যাওয়া মানুষের দুর্গতি বাড়িয়েছে বহুগুণ।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ। একই বছর শ্রম মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ। অর্থাৎ শ্রম মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি ছিল। ২০২০ সালে মহামারী দেখা দেওয়ার আগপর্যন্ত মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির হারের চেয়ে শ্রম মজুরি বৃদ্ধির হার বেশি ছিল। কিন্তু মহামারী শুরুর পর শ্রম মজুরির চেয়ে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির হার বেশি, যা এখনো বহাল রয়েছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে দেশের স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষ যখন দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন দেশে কোটিপতির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত ১৩ বছরে দেশের ব্যাংকগুলোতে এক কোটি বা তার চেয়ে বেশি পরিমাণের আমানত রয়েছে এমন ব্যক্তির সংখ্যা চার গুণেরও বেশি বেড়েছে। এ সময়ে কোটিপতি আমানতকারীদের টাকার পরিমাণ বেড়েছে সাত গুণেরও বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০০৯ সালের মার্চে দেশে কোটিপতি ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ৬৩৬ জন, যা চলতি বছরের জুন শেষে ১ লাখ ৮ হাজার ৪৫৭তে উন্নীত হয়েছে। ১৩ বছরে কোটিপতি আমানতকারী বেড়েছে ৮৮ হাজার ৮২১ জন বা ৪৫২ শতাংশ।
২০০৯ সালে ব্যাংকে রাখা কোটিপতি আমানতকারীদের টাকার পরিমাণ ছিল ৭৯ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের জুন শেষে ৬ লাখ ৮০ হাজার ৩৬২ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এ হিসাবে ১৩ বছরে কোটিপতি আমানতকারীদের ব্যাংকে গচ্ছিত সম্পদ বেড়েছে ৬ লাখ ৪৯৬ কোটি টাকা। এ সময়ে কোটিপতি আমানতকারী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকে রাখা তাদের সম্পদ বেড়েছে ৭৫১ শতাংশ।
গত বছরের চেয়ে এবার এসএসসি ও সমমানের ফলাফলে পাসের হার কমেছে ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। কিন্তু জিপিএ-৫ বেড়েছে ৮৬ হাজার ২৬২ জন। যা মোট উত্তীর্ণের ১৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এসএসসি পরীক্ষায় গ্রেডিং পদ্ধতি চালুর পর এ বছরই সবচেয়ে বেশি জিপিএ ৫ পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। মূলত বেশি প্রশ্নের মধ্য থেকে খুবই কম উত্তরের সুযোগ থাকায় জিপিএ ৫-এর এ উল্লম্ফন বলে মনে করছেন পরীক্ষাসংশ্লিষ্টরা।
গতকাল সোমবার বেলা ১১টায় বোর্ড চেয়ারম্যানদের সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ বছরের এসএসসি ও সমমানের ফলাফলের অনুলিপি হস্তান্তর করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। এরপর দুপুর ১টায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এক সংবাদ সম্মেলনে ফলাফলের বিস্তারিত তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী।
এবার ৯টি সাধারণ বোর্ডসহ ১১ শিক্ষা বোর্ডে ১৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৩৭ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে ১৭ লাখ ৪৩ হাজার ৬১৯ জন। গড় পাসের হার ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। জিপিএ ৫ পেয়েছে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন। এর মধ্যে শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২ হাজার ৯৭৫টি। তবে একজনও পাস করেনি এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫০টি।
আর গত বছর পাসের হার ছিল ৯৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং জিপিএ ৫ পেয়েছিল ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ জন শিক্ষার্থী। ওই বছর শূন্য পাস প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ১৮টি আর ৫ হাজার ৪৯৪টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা শতভাগ পাস করেছিল।
একাধিক শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে জিপিএ ৫-এর উল্লম্ফনের পেছনে তিনটি কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। প্রথমত এ বছর প্রত্যেক পরীক্ষার রচনামূলক অংশে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল বেশি। রচনামূলকে কোনো পরীক্ষায় ১১টির মধ্যে ৪টি এবং ব্যবহারিক থাকা পরীক্ষায় ৮টির মধ্যে ৩টির উত্তর দিতে হয়েছে। নৈর্ব্যক্তিক অংশে কোনো পরীক্ষায় ৩০টির মধ্যে ১৫টি এবং ব্যবহারিক থাকা পরীক্ষায় ২৫টির মধ্যে ১৫টির উত্তর দিতে হয়েছে। আর সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা হয়েছে ৫০ নম্বরের, সেখানে তুলনামূলক আগের চেয়ে বেশি সময় দেওয়া হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীদের পক্ষে খুব সহজেই উত্তর করা সম্ভব হয়েছে।
দ্বিতীয় কারণ সাবজেক্ট ম্যাপিং। এবার ১২টি বিষয়ের মধ্যে ৯টির পরীক্ষা হয়েছে। বাকি তিনটিতে এসএসসির ক্ষেত্রে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি), দাখিলের ক্ষেত্রে জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) এবং এসএসসি ও দাখিলের (ভোকেশনাল) ক্ষেত্রে নবম শ্রেণির ফলের ভিত্তিতে নম্বর দেওয়া হয়েছে। সাধারণত এসএসসির চেয়ে জেএসসি বা জেডিসিতে বেশি পাস করলেও বাংলা, ইংরেজি, গণিত, পদার্থ, রসায়ন, উচ্চতর গণিতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নম্বর কম পায়। আবার তুলনামূলক সহজ বিষয়গুলোতে নম্বর বেশি পায়। এবার যেহেতু বাংলাদেশ ও বিশ^ পরিচয়/সাধারণ বিজ্ঞান, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ে সাবজেক্ট ম্যাপিং হয়েছে। সেগুলোতে জেএসসি ও জেডিসিতে বেশি নম্বর পাওয়ায় অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থীর জিপিএ ৫ পাওয়ার পথ সুগম হয়েছে। তৃতীয় কারণ হচ্ছে, পরীক্ষার জন্য অনেক বেশি সময় পাওয়া। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে পরীক্ষা শুরু হলেও এবার করোনা এবং বন্যার কারণে তা পিছিয়ে গত ১৫ সেপ্টেম্বর শুরু হয়। এতে শিক্ষার্থীরা অন্যান্য বছরের চেয়ে সাত মাসেরও বেশি সময় পায়। অথচ এ বছরের এসএসসির সিলেবাস ছিল সংক্ষিপ্ত। যা তাদের পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নিতে সহায়তা করে।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীরা এ বছর প্রস্তুতির জন্য অনেক বেশি সময় পেয়েছে। করোনার সময় অনলাইনে ক্লাস হয়েছে। আবার করোনার প্রাদুর্ভাব কমলে সরাসরি ক্লাস করেছে। শিক্ষার্থীরা বেশি পড়াশোনা করতে পেরেছে। এতে জিপিএ ৫ বেড়েছে। তবে আমরা চাই আমাদের সব শিক্ষার্থীই পাস করুক।’
জানতে চাইলে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এবার সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে কম নম্বরের পরীক্ষা হয়েছে। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার অপশন ছিল বেশি। এমনকি শিক্ষার্থীরা নৈর্ব্যক্তিকেও অপশন পেয়েছে। যার কারণে প্রতিটি প্রশ্নই ভালো করে লেখার সুযোগ পেয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে সাবজেক্ট ম্যাপিং হয়নি। এতে কোনো শিক্ষার্থী জেএসসি বা জেডিসিতে খারাপ করলেও এসএসসিতে সে প্রভাব পড়েনি। ফলে জিপিএ ৫ বেড়ে গেছে।’
গত বছরের চেয়ে পাসের হার কিছুটা কমার কারণ জানিয়ে অধ্যাপক তপন কুমার বলেন, ‘এসএসসির ১২টি বিষয়ের মধ্যে গত বছর ৯টি বিষয়ে সাবজেক্ট ম্যাপিং হয়েছিল। বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরীক্ষা হয়নি। শুধু তিনটি ঐচ্ছিক বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। জেএসসিতে বেশি পাস করলেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে ভালো ফল করে না। অথচ ওই বিষয়গুলোতেই গত বছর সাবজেক্ট ম্যাপিং হয়েছিল। এতে পাসের হার বেড়ে গেলেও এ বছরের চেয়ে জিপিএ ৫ কম ছিল। আর এ বছর ঠিক তার বিপরীত। তিনটি সহজ বিষয়ে সাবজেক্ট ম্যাপিং হয়েছে। ফলে পাসের হার কিছুটা কমলেও জিপিএ ৫ বেড়েছে।’
শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, ‘গত বছরের চেয়ে সাবজেক্ট ম্যাপিং কম বিষয়ে হওয়ায় এবার শূন্য পাস প্রতিষ্ঠান বেড়েছে। কেন তারা খারাপ করল সে বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখব।’
ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে : এ বছর পাসের ও জিপিএ ৫ প্রাপ্তির দিক দিয়ে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে আছে। ৯ লাখ ৯৮ হাজার ১৯৩ জন ছেলে অংশ নিয়ে পাস করেছে ৮ লাখ ৭০ হাজার ৪৬ জন। ছেলেদের পাসের হার ৮৭ দশমিক ১৬ শতাংশ ও জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লাখ ২১ হাজার ১৫৬ জন। অন্যদিকে ৯ লাখ ৯৫ হাজার ৯৪৪ জন মেয়ে অংশ নিয়ে পাস করেছে ৮ লাখ ৭৩ হাজার ৫৭৩ জন। মেয়েদের পাসের হার ৮৭ দশমিক ৭১ শতাংশ ও জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৪৪৬ জন। অর্থাৎ ছেলেদের চেয়ে ৩ হাজার ৫২৭ জন বেশি মেয়ে পাস করেছে এবং ২৭ হাজার ২৯০ জন বেশি ছাত্রী জিপিএ ৫ পেয়েছে।
শিক্ষার্থী বেশি মানবিকে, ফল ভালো বিজ্ঞানে : বিজ্ঞান বিভাগে ৫ লাখ ৭ হাজার ২৫৪ শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে পাস করেছে ৪ লাখ ৯২ হাজার ৪৭৪ জন, পাসের হার ৯৭ দশমিক ৮ শতাংশ। এই বিভাগ থেকে জিপিএ ৫ পেয়েছে ২ লাখ ৬ হাজার ৯৮৯ জন, অর্থাৎ বিজ্ঞান বিভাগের ৪০ দশমিক ৮১ শতাংশই জিপিএ ৫ পেয়েছে। মানবিক বিভাগ থেকে ৭ লাখ ৮১ হাজার ২৫৬ জন অংশ নিয়ে পাস করেছে ৬ লাখ ৩১ হাজার ৪২৯ জন, পাসের হার ৮০ দশমিক ৮২ শতাংশ। এই বিভাগ থেকে জিপিএ ৫ পেয়েছে মাত্র ১১ হাজার ৭২৫ জন, অর্থাৎ ১ দশমিক ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছে।
অন্যদিকে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে ৩ লাখ ১৪৭ জন অংশ নিয়ে পাস করেছে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৬৬৮ জন, পাসের হার ৯১ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এই বিভাগ থেকে জিপিএ ৫ পেয়েছে ১৫ হাজার ৪৯ জন, অর্থাৎ ৫ দশমিক ০১ শতাংশ জিপিএ ৫ পেয়েছে।
তবে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে দাখিল পরীক্ষায় পাস করেছে ২ লাখ ১৩ হাজার ৮৮৩ জন। পাসের হার ৮২ দশমিক ২২ শতাংশ ও জিপিএ ৫ পেয়েছে ১৫ হাজার ৪৫৭ জন। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিলে (ভোকেশনাল) পাস করেছে ১ লাখ ৩০ হাজার ১৬৫ জন। পাসের হার ৮৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ ও জিপিএ ৫ পেয়েছে ১৮ হাজার ৬৫৫ জন।
সর্বোচ্চ পাস যশোর বোর্ডে : এ বছর সবচেয়ে ভালো ফল করেছে যশোর বোর্ড, তাদের পাসের হার ৯৫ দশমিক ১৭ শতাংশ। এরপর কুমিল্লা ৯১ দশমিক ২৮ শতাংশ, ঢাকা ৯০ দশমিক ৩ শতাংশ, বরিশাল ৮৯ দশমিক ৬১ শতাংশ, কারিগরি বোর্ডে ৮৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ, ময়মনসিংহ ৮৯ দশমিক ২, চট্টগ্রাম ৮৭ দশমিক ৫৩, রাজশাহী ৮৫ দশমিক ৮৮, মাদ্রাসা বোর্ডে ৮২ দশমিক ২২, দিনাজপুর ৮১ দশমিক ১৬ এবং সিলেট বোর্ডে পাস করেছে ৭৮ দশমিক ৮২ শতাংশ।
সিলেট বোর্ডের ফল তুলনামূলক খারাপ হওয়ার পেছনে বন্যা পরিস্থিতিকে দায়ী করেন সিলেট বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রমা বিজয় সরকার।
বিষয়ভিত্তিক ফল : ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বিষয়ভিত্তিক ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলায় পাসের হার ৯৯.৭৭ শতাংশ, ইংরেজিতে ৯৬.৬৫ শতাংশ, গণিতে ৯৪.৬৩ শতাংশ, পদার্থবিজ্ঞানে ৯৮.৪৩ শতাংশ, রসায়নে ৯৮.৭৬ শতাংশ, উদ্ভিদবিজ্ঞানে ৯৯ দশমিক ৫১ শতাংশ, অ্যাকাউন্টিংয়ে ৯৭.৬৯ শতাংশ, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিংয়ে ৯৭.৮৯ শতাংশ, অর্থনীতিতে ৯৭.৪৫ শতাংশ, কৃষি শিক্ষায় ৯৯.৬৩ শতাংশ এবং গার্হস্থ্য বিজ্ঞানে ৯৯.০৭ শতাংশ।
ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদন শুরু আজ : এসএসসির ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদন শুরু হচ্ছে আজ মঙ্গলবার। আগামী ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এসএমএসের মাধ্যমে ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদন করা যাবে। প্রতিটি বিষয় ও প্রতি পত্রের জন্য ১২৫ টাকা হারে চার্জ কাটা হবে। যেসব বিষয়ের দুটি পত্র (প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র) রয়েছে, সেসব বিষয়ের ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদন করলে ২৫০ টাকা ফি কাটা হবে। তবে পরীক্ষা না হওয়া বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়/সাধারণ বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি এবং ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ে ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদন করার প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছে বোর্ড।
মেক্সিকোকে বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে হারিয়ে আর্জেন্টিনা তাদের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন টিকিয়ে রেখেছে। এখন শেষ ম্যাচে তারা কী করে তার ওপর নির্ভর করবে আর্জেন্টিনা পরের পর্বে যেতে পারবে কিনা। এখনই এত উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে চাইছি না। সত্যি কথাটা হচ্ছে আর্জেন্টিনা ভালো খেলছে না। এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে তারা সৌদি আরবের বিপক্ষে ১০ মিনিট আর মেক্সিকোর বিপক্ষে ৩০ মিনিট ভালো ফুটবল খেলেছে।
আমার চোখে, আর্জেন্টিনা যে ফুটবলটা খেলে কোপা আমেরিকা জিতেছিল ব্রাজিলকে হারিয়ে, তারা এখন সেই মানের ফুটবল থেকে অনেক অনেক দূরে। এমনকি ইতালিকে হারিয়ে যে দলটা ফিনালিসিমো জিতেছিল, সেই মানেরও ধারেকাছে নেই তারা।
কোচ লিওনেল স্কালোনির সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ। আর্জেন্টিনা দল নিয়ে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাত্রা বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে আর্জেন্টিনা দলের প্রতিটি ফুটবলারকেই নিজের সামর্থ্যরে সীমা বাড়িয়ে তুলতে হবে, যাতে লোকে বুঝতে পারে দলটা অনেক উঁচুমানের এবং সেই বিশ্বাস থেকেই যেন মনে করে এই দলটার অনেক বেশি সাফল্য পাওয়া উচিত। দলে এমন সব খেলোয়াড় আছে যারা শতভাগ ফিট নয়। রিজার্ভ বেঞ্চের খেলোয়াড়দের নিজেদের সামর্থ্যরে কথা জানান দিতে হবে এই মুহূর্তে। আর্জেন্টিনা গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচটা খেলবে পোল্যান্ডের বিপক্ষে। এই ম্যাচটা জিতলেই নিশ্চিত হবে পরের রাউন্ডে খেলা। এই ম্যাচেই বোঝা যাবে, দলটা কি আদৌ উন্নতি করছে নাকি এখনো দলে অনেক কমতি আছে। একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, বিশ্বকাপে কোনো দলই সহজ প্রতিপক্ষ নয় আর কোনো ম্যাচই সহজ নয়।
কোচের কৌশলে রদ্রিগো ডি পল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন খেলোয়াড় আর ব্রাজিলে কোপা আমেরিকা জয়ে তার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত তার পারফরম্যান্স অনেকের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ, যদিও সেটা আমি মনে করি না। এটা হোক রদ্রিগো বা গোটা দল, সবার জন্যই আমার একটা উপদেশ, সামনে এগিয়ে যাও। আত্মবিশ্বাস হারিও না। তোমাদের অনেক কিছু প্রমাণ করা বাকি।
দক্ষিণ আমেরিকার অন্য দল ব্রাজিল টুর্নামেন্টটা বেশ ভালোভাবেই শুরু করেছে, তবে নেইমারের চোট ব্রাজিলের জয়ের আনন্দ ছাপিয়ে বড় শংকার জায়গা হয়ে উঠেছে। যদিও ব্রাজিলের এখনো সেরা পারফরম্যান্সে পৌঁছানো বাকি আর নেইমারকে ছাড়া সেটা সহজ হবে না। পরের দুটো ম্যাচে ব্রাজিলের কোচকে একটা ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে, তারা কি শুধুই নেইমারের বদলে অন্য কাউকে দলে নেবে নাকি কৌশলেই পরিবর্তন আনবে? তার হাতে বিকল্প আছে আরও আক্রমণাত্মক একটা দল সাজানো অথবা আরেকটু রক্ষণাত্মক কৌশল অবলম্বন করে রক্ষণশীল একাদশ সাজানো। দলের সেরা তারকা যখন চোট পায়, তখন শুধুই তার বদলি কাউকে নামিয়ে দিলে কাজ হয় না। আমার মনে হয় এখন ব্রাজিলের উচিত দলের সমন্বয়ে পরিবর্তন আনা আর খেলার কৌশল বদল করা।
ইউরোপের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী স্পেন আর জার্মানি ড্র করেছে। এই ম্যাচে দুই দলের খেলা দেখে মনে হচ্ছে, একটা দল খুব ভালোভাবে জানত তারা কী করতে চায় আর অন্য দলটাকে মনে হয়েছে ভঙ্গুর। বল পায়ে এলে স্পেন তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ, অননুমেয় আর অনন্য ফুটবল খেলে। আর জার্মানি এখন এমন একটা জাতীয় দল যাকে কেউ ভয় পায় না। তারা সাধারণ মানের একটা দলে পরিণত হয়েছে। তাদের সেই সামর্থ্য নেই, শক্তি নেই। তবুও তারা প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দিতে চায়। এখন পর্যন্ত জার্মানি দলকে খুব একটা কার্যকর মনে হয়নি। তাদের মধ্যে আগের সেই নির্দয় মানসিকতা আর ধারাবাহিকতা দেখা যায় না। ২০২২-এর জার্মানি খানিকটা রোমাঞ্চ জাগায় তবে ভঙ্গুর। এখন তাদের শেষ ম্যাচটা জিতলেই শুধু চলবে না, তাকিয়ে থাকতে হবে স্পেনের দিকেও।
বরিশালে বিএনপির গণসমাবেশে যাওয়ার পথে হামলার শিকার পটুয়াখালী-৩ (গলাচিপা, দশমিনা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও পটুয়াখালী জেলা বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য শাহজাহান খান মারা গেছেন। গতকাল সোমবার ঢাকার ধানমন্ডি ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
গত ৫ নভেম্বর বরিশালে অনুষ্ঠিত বিএনপির গণসমাবেশে যাওয়ার পথে ৪ নভেম্বর রাতে পটুয়াখালী-বরিশাল মহাসড়কের তেলিখালী এলাকায় শাহজাহান খান এবং তার সঙ্গে থাকা নেতাকর্মীরা হামলার শিকার হন। হামলার গুরুতর আহত শাহজাহান খান সেই থেকে গত ২৪ দিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। পটুয়াখালী জেলা বিএনপির সদস্য সচিব স্নেহাংশু সরকার কুট্টি বলেন, ‘গত ৪ নভেম্বর রাতে তার (শাহজাহান খান) ওপর যে হামলা হয় সে সময় তার কিডনি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।’
শাহজাহান খান পটুয়াখালী জেলার একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, পাশাপাশি তিনি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক, পটুয়াখালী রেড ক্রিসেন্ট ইউনিটের সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
পুরনো হয়ে যাওয়া ৯৭৪টি কনটেইনারকে ব্যবহারযোগ্য করে গড়ে তোলা হয়েছে দোহার স্টেডিয়াম ৯৭৪। নানা রঙের কনটেইনারে সাজানো এ স্টেডিয়ামে হলুদ উৎসবের সব প্রস্তুতিই সেরে রেখেছিল প্রায় ৩০ হাজার ব্রাজিল সমর্থক। লুসাইলের পর এই মাঠে প্রিয় দলকে জেতাতে পুরোটা সময় গলা ফাটিয়েছেন তারা। তবে কেন যেন হচ্ছিলই না। তবে কি নেইমারবিহীন ব্রাজিল থমকে যাবে? না, সেটা হতে দেননি অভিজ্ঞ কাসেমিরো। ৮৪ মিনিটে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এ তারকা। বক্সের ওপর থেকে তার ডান পায়ের জোরালো হাফ ভলিতে ঠিকই খুঁজে নেয় গোলের ঠিকানা। তাতে যেমন নিশ্চিত হয়েছে শেষ ষোলো, তেমনই বিশ্বকাপ মঞ্চে সুইজারল্যান্ড আর ব্রাজিলের গলার কাঁটা হয়ে থাকল না। তৃতীয়বারের চেষ্টায় ঠিকই জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছে সেলেসাওরা।
১৯৫০ সালে পারেনি। ২০১৮ সালেও না। সেই ধারাবাহিকতা কি দোহাতেও বজায় থাকবে? ম্যাচের গতিপ্রকৃতি দেখে তাই মনে হচ্ছিল। তবে তারায় ভরা তিতের আক্রমণভাগকে রোখা অত সহজ নয়। প্রথমার্ধে রোখা গেছে। দ্বিতীয়ার্ধেরও অনেক সময় সুইজারল্যান্ডের রক্ষণে ফাটল ধরাতে পারেনি। তবে কাসেমিরো ঠিকই দেখালেন বুড়ো হারের ভেলকি। ভিনিসিয়ুস, রিচার্লিসন, রাফিনহা, রদ্রিগোদের একের পর এক আক্রমণ যখন ব্যর্থ হচ্ছে, তখনই গোলের দায়িত্ব নিলেন এ মৌসুমে রিয়াল ছেড়ে ম্যানইউতে আসা কাসেমিরো।
ব্রাজিল কোচ তিতে একাদশে দুটি পরিবর্তন আনেন। সামনে ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, রিচার্লিসন ও রাফিনহাকে রেখে, মাঝখানে খেলান লুকাস পাকেতা, কাসেমিরো ও নেইমারের জায়গায় ফ্রেদকে। গোলকিপার আলিসনের সামনে স্টপারব্যাক পজিশনে থিয়াগো সিলভা ও মার্কুইনোসের সঙ্গে লেফটব্যাকে অ্যালেক্স সান্দ্রো ও দানিলোর জায়গায় খেলান মিলিতাওকে। সুইজারল্যান্ড কোচ মুরাত ইয়াকিন ব্রাজিলের বিপক্ষে ৪-২-৩-১ ফরমেশন সাজান। তাতেই বোঝা যায় ঘর সামলে প্রতিআক্রমণ যাওয়াই এ কোচের লক্ষ্য। সেই পরিকল্পনাটা ফলেই যাচ্ছিল প্রায়। সার্বিয়ার বিপক্ষে জোড়া গোল করা রিচার্লিসনকে সেভাবে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে ভিনিসিয়ুস ছিলেন আগের মতোই আগ্রাসী। ২৭ মিনিটে গোলের প্রথম সুযোগ নষ্ট করেন এ তারকা। ডানদিক থেকে রাফিনহার ক্রস ছোট ডি-বক্সে পেয়েও প্লেসিংটা ঠিকঠাক করতে পারেননি। সুইজারল্যান্ড কিপার ইয়ান সোমার সহজেই রুখে দেন তার দুর্বল প্রচেষ্টা। ৩১ মিনিটে মিলিতাওয়ের সঙ্গে বল দেওয়া-নেওয়া করে বক্সে ঢুকে জোরালো শট নিয়েছিলেন রাফিনহা। তবে কিপার সোমার সহজেই বল আয়ত্তে নেন।
বিরতি থেকে ফেরা ব্রাজিল মাঠে আসে পাকেতাকে রেখে রিয়াল মাদ্রিদ তারকা রদ্রিগোকে নিয়ে। তার আগমনে আক্রমণের ধার বাড়ে সেলেসাওদের। ৫৬ মিনিটে ভিনিসিয়ুসের আড়াআড়ি ক্রসে পা ছোঁয়াতে ব্যর্থ হন রিচার্লিসন। তবে ৬৪ মিনিটে ভিনিসিয়ুসের লক্ষ্যভেদে ব্রাজিল ভেবেছিল অবশেষে কাক্সিক্ষত লিডটা তারা পেয়ে গেছে। তবে প্রযুক্তি তাদের এগিয়ে যেতে দেয়নি। কাসেমিরোর বাড়ানো বল ধরে দ্রুত বক্সের বাঁদিক দিয়ে আক্রমণে উঠে বল জালে জড়ান রিয়াল মাদ্রিদ তারকা। তবে রিচার্লিসন অফসাইড থেকে ফিরে সেই মুভে যোগ দেওয়ায় হয়েছে সর্বনাশ। বেহায়া ভিএআর ঠিকই ধরে ফেলে তা। তবে ৮৩ মিনিটে কাসেমিরোর হাফ ভলি ঠিকই পোস্টের ডান দিকটা খুঁজে নিলে বিশ্বকাপের গ্রুপে প্রথমবারের মতো পরপর দুই ম্যাচে ইউরোপিয়ান দুই দলকে হারানোর রেকর্ড হয়ে যায় এই ব্রাজিলের।
রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেলের আলো ঝলমলে অডিটোরিয়ামে দেশি-বিদেশী মডেল ভাড়া করে এনে সাড়ম্বরে ঘোষণা করা হয়েছিল প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক নারী ফুটবল আসর ওমেন্স সুপার লিগের। সিনে জগতের তারকাদের সঙ্গে মঞ্চে র্যাম্প করতে করতে প্রত্যাশার ঘুড়িটা দূর আকাশে উড়িয়েছিলেন সাবিনা-সানজিদারা। দেশের ফুটবলের বড় বিজ্ঞাপন এখন তারা। ফুটবলপ্রেমীদের তাদের নিয়ে অসীম আগ্রহকে পুঁজি করে কে-স্পোর্টস আর বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন চেয়েছিল ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট করে ফায়দা লুটতে। তবে দিন যত গড়িয়েছে, মেয়েদের স্বপ্ন ধূসর হয়েছে। এখন তো তা মিলিয়ে গেছে বহুদূরে।
কে-স্পোর্টস-বাফুফের কর্তারা বুঝেছেন, তাদের লেখা চিত্রনাট্য আর বাস্তবতায় বড্ড ফাঁরাক। তাই তারা বারবার টুর্নামেন্ট শুরুর তারিখ দিয়েও আলোচিত টুর্নামেন্টকে মাঠে নিয়ে যেতে পারেননি। সর্বশেষ ১০ জুন আসর শুরুর ঘোষণা দিয়েছিলেন খোদ বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। সেটাও মিথ্যে হয়ে গেছে। তাই হতাশা ছাঁপিয়ে নারী ফুটবলারদের মনে ভর করেছে রাজ্যের ক্ষোভ।
কে-স্পোর্টস আর বাফুফের কর্তারা ভেবেছিলেন এমন একটা টুর্নামেন্টের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে হামলে পড়বে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। গত বছর নেপালে সাফ শিরোপা জয়ের পর মেয়েদের নিয়ে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, সেটাই আসলে স্বপ্নবাজ করে তোলে সালাউদ্দিন-মাহফুজা আক্তার-ফাহাদ করিমদের। তবে হয়েছে উল্টো। সেটাই যে হওয়ার কথা! কে-স্পোর্টস কিংবা বাফুফে, দুটি প্রতিষ্ঠানই যে এখন ভীষণভাবে ইমেজ সঙ্কটে ভুগছে। এর মাঝে অগোচরে একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে, যেটা কখনই প্রত্যাশিত ছিল না। কে-স্পোর্টস আর বাফুফের দেখানো স্বপ্নে বুদ হয়ে গিয়েছিলেন ফুটবলাররা। এমন একটা টুর্নামেন্টে খেলতে মুখিয়ে ছিলেন তারা। এমনিতে ঘরোয়া ফুটবল খেলে সেভাবে পারিশ্রমিক জুটে না। ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে হলে একটা আকর্ষণীয় পারিশ্রমিকের হাতছানি ছিল। তারচেয়েও বেশি ছিল নানা দেশের নামী-দামী ফুটবলারদের সঙ্গে ড্রেসিং রুম শেয়ার করার সুবর্ণ সুযোগ। দারুণ একটা স্বপ্ন বাস্তবায়নে মুখ বুজে মেয়েরা কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন দিনের পর দিন। এর মাঝেই তারা দেখেছেন বাবার মতো কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের বিদায়। বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর ন্যায্য দাবী পুরোপুরি পূরণ না হওয়ার পরও তারা বাফুফের কঠোর অনুশাসন মেনে দুঃসহ গরমে সকাল-বিকাল ঘাম ঝড়িয়েছেন। এরপর যখন দেখলেন এই স্বপ্ন বারবার হোচট খাচ্ছে কে-স্পোর্টসের ব্যর্থতা আর বাফুফের অদূরদর্শীতায়, তখন আর মুখ বুজে থাকতে পারলেন না। হতাশার কথা জানাতে গিয়ে অগোচরে তাদের কণ্ঠ থেকে বের হয়ে এসেছে ক্ষোভের আগুন।
অবস্থা বেগতিক দেখে তড়িঘড়ি বৃহস্পতিবার ক্যাম্প বন্ধ ঘোষণা করে বাফুফে। সিনিয়র খেলোয়াড়দের দেওয়া হয় পাঁচ দিনের ছুটি। বৃহস্পতিবার রাতে বাসে করে সাতক্ষীরাগামী সাফজয়ের অগ্রনায়ক সাবিনা খাতুন দেশ রূপান্তরকে মুঠোফোনে বলছিলেন, 'ওমেন্স সুপার লিগ স্রেফ আমাদের আবেগ নিয়ে খেললো।' একটু থেমে আবার বলতে শুরু করেন বাংলাদেশ অধিনায়ক, 'প্রথমত সাফের পর কোন খেলা নেই। তারপর এই লিগ মেয়েদের নিয়ে দুই দফা এত কিছু করলো, এত আশা দিলো, মেয়েরা খেলার জন্য মুখিয়ে ছিল। আর সব থেকে বড় ব্যাপার বিদেশী খেলোয়াড় যারা দক্ষিণ এশিয়ার, তাদের নিয়ে আমি নিজেও কাজ করছিলাম। তাদের কাছে এখন আমার সম্মান কই থাকলো! বারবার তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে। মেয়েরা অনেক আশায় ছিল। কিন্তু... । এটা নিয়ে অবশ্য মেয়েরা অনেক আগেই আশা ছেড়ে দিয়েছিল। এখন আমিও কোন আশা দেখছি না।'
সতীর্থদের সংগে ময়মনসিংহের কলসিন্দুরে বাড়ির যেতে যেতে জাতীয় দলের রাইট উইঙ্গার সানজিদা বলছিলেন, 'আসলে কিছু বলার ভাষাই হারায় ফেলেছি। একটা টুর্নামেন্ট হওয়ার কথা ছিল। এর জন্য আমরা কঠোর অনুশীলণ করছিলাম। আশা ছিল খেলবো। এখন সেটা হচ্ছে না বলে খুব কষ্ট লাগছে। যখন শুনলাম লিগটা হবে না, তখন মনের অবস্থা কেমন হতে পারে, বুঝতেই পারছেন।'
সাফের পর কোন ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি সিনিয়র ফুটবলাররা। এ নিয়ে ভীষণ হতাশ সানজিদা বলেন, 'নয়টা মাস ধরে অপেক্ষায় আছি খেলার। প্রীতি ম্যাচ বলেন কিংবা কোন টুর্নামেন্ট, একটা ম্যাচও আমরা খেলতে পারিনি সাফের পর। অথচ আমাদের সঙ্গে যারা সাফে খেলেছে, তারা প্রায় সবাই পাঁচটা-ছয়টা করে প্রীতি ম্যাচ খেলে ফেলেছে এর মধ্যে।' মেয়েদের সিঙ্গাপুরে গিয়ে প্রীতি ম্যাচ খেলার কথা ছিল, মিয়ানমারে অলিম্পিক বাছাই খেলার কথা ছিল। অথচ বাফুফে অর্থ সঙ্কটসহ নানা অযুহাতে তাদের খেলতে পাঠায়নি। সানজিদা বললেন, 'আমরা আসলে হতাশ হতেও ভুলে গেছি। বারবার টুর্নামেন্টে খেলার কথা বলা হয়, আবার সেটা বাতিল হয়। এরকমটা হতে হতে আসলে আমরা পরিস্থিতির শিকার হয়ে গেছি।'
হতাশা, বঞ্চনায় বাফুফের চাকুরি থেকে পদত্যাগ করেছেন নারী দলের প্রধান কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। প্রিয় কোচের জন্য কষ্ট পান সানজিদা, 'ছোটন স্যারের হাত ধরেই আমার এখানে আসা। তার কাছেই আমার ফুটবলার হয়ে গড়ে ওঠা। তিনি চলে গেছেন। এতে খুব কষ্ট পাই। তিনি আমাদের অনেক আদর-যত্ন করতেন। বাবা-মেয়ের সম্পর্ক যেমন হয়, ঠিক তেমন সম্পর্ক ছিল।'
১৩ জুন সাবিনা-সানজিদাদের ক্যাম্পে ফেরার নির্দেশ দিয়েছে বাফুফে। বিকল্প নেই বলে তারা হয়তো ফিরবেন। তবে ফেরার সময় তাদের চোখে থাকবে না বড় কোন স্বপ্ন। সেটা দেখাই বারণ। কে-স্পোর্টস আর বাফুফে মিলে যে মেয়েদের সব স্বপ্ন গলা টিপে মেরে ফেলেছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর মেয়ের জামাতাকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার, কাস্টমস ব্যাগেজ, ইমিগ্রেশনসহ অন্যান্য প্রটোকল দেওয়ার একটি চিঠি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
অনেকেই চিঠিটি শেয়ার করে সমালোচনা করছেন। কেউ বলছেন, মন্ত্রীর মেয়ের জামাই বলে কথা! কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন, মন্ত্রীর মেয়ের জামাই প্রটোকল কোন হিসেবে পান? আবার কেউবা বলছেন, একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে!
জানা যায়, গত ৬ জুন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি ইস্যু করা হয়। পরে ৭ জুন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালককে চিঠিটি পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গিয়ে চিঠিটির সত্যতাও পাওয়া যায়।
মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখার উপসচিব ড. অমিতাভ চক্রবর্ত্তী স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম মোজাম্মেল হকের মেয়ের জামাতা মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান ৯ জুন শুক্রবার স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট নম্বর ইকে ৫৮৬ যোগে দুবাই থেকে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে পৌঁছাবেন। তাকে বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের অনুমতিসহ মন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার মশিউর রহমানকে কাস্টমস ব্যাগেজ, ইমিগ্রেশন এবং বিমানবন্দরের অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য বোর্ডিং ব্রিজ পাস দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিমানবন্দর পরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গুরুত্বপূর্ণ ও অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ব্যবহারের জন্য পৃথক লাউঞ্জ রয়েছে। যেটাকে ভিআইপি লাউঞ্জ বলা হয়। ভিআইপি লাউঞ্জ কারা ব্যবহার করতে পারবেন এমন একটি স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের।
লাউঞ্জ রজনীগন্ধা, বকুল, দোলনচাঁপা ও চামেলি নামে বিমানবন্দরে ৪টি ভিআইপি লাউঞ্জ রয়েছে। রজনীগন্ধা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ভিআইপিরা ব্যবহার করেন। বকুল ব্যবহার করেন অতিরিক্ত সচিব বা তার পদমযার্দার ও সমমর্যাদার ব্যক্তিরা। দোলনচাঁপা ব্যবহার করেন সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। আর চামেলি দিয়ে একুশে পদক পাওয়া ব্যক্তি, সংবাদপত্রের সম্পাদক ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা প্রবেশ ও বের হতে পারেন।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।