
দেশে ইসলামি ধারার ব্যাংক ব্যবস্থা প্রচলনের মাধ্যমে গ্রাহকের আস্থায় স্বল্পতম সময়ে বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক সময়ে ঋণ ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিতর্ক চলছে ব্যাংকটিকে ঘিরে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকটির সার্বিক অবস্থা নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ মনিরুল মাওলা।
২০১৭ সালে মালিকানা পরিবর্তনের প্রায় পাঁচ বছর পর ব্যাংকটির ঋণ বিতরণ নিয়ে বিতর্ক চলছে। সম্প্রতি গণমাধ্যমে ব্যাংকটি নিয়ে কয়েকটি সংবাদ প্রকাশের পর ইসলামী ব্যাংকের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ কিছু তথ্য ছড়িয়েছে। এতে গ্রাহকদের মধ্যে কিছুটা শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তবে গ্রাহকদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই বলে জানিয়েছেন ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ মনিরুল মাওলা।
মনিরুল মাওলা বলেন, একটি ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের পরিবর্তন খুবই সাধারণ বিষয়। কিন্তু মালিকানা পরিবর্তনের পর গত পাঁচ বছরে ইসলামী ব্যাংক সব সূচকেই উন্নতি করেছে। মালিকানা পরিবর্তনের সময় ব্যাংকটির আমানত ছিল ৫৮ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে তার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকা। আমানত বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঋণ বিতরণও বেড়েছে স্বাভাবিক নিয়মে। ব্যাংকটির আর্থিক স্বাস্থ্যেও ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। সে হিসেবে আমরা মনে করি অল্প সময়ের মধ্যে ইসলামী ব্যাংক আরও এগিয়ে যাবে।
বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক বিশ্বে তুলে ধরছে ইসলামী ব্যাংক জানিয়ে মনিরুল মাওলা বলেন, একটি ব্যাংককে পরিমাপ করার জন্য যতগুলো সূচক আছে, অর্থাৎ ব্যাংকের আমানত, বিনিয়োগ, প্রবাসী আয়, পরিচালন লাভ থেকে শুরু করে আমদানি, রপ্তানিসহ সব সূচকেই ইসলামী ব্যাংক সবার শীর্ষে অবস্থান করছে। এ অবস্থায় ইসলামী ব্যাংকের বিষয়ে বেশ কয়েকটি সংবাদ গণমাধ্যমে এসেছে। বাংলাদেশের গতিশীল অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য এসব সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে। কারণ ব্যাংকিং খাতকে মানুষ সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে। এ বিশ্বাসে যদি ফাটল ধরানো যায় তাহলে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে। এ জন্য কিছু লোক এ জায়গাটিকে বেছে নিয়েছে। দেশের এমন কোনো খাত নেই যেখানে ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ নেই। এমনকি দেশের সব বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের সঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়েগের কারণে দেশে প্রায় ৮৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিং এবং ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড একসঙ্গেই চলছে। প্রতিষ্ঠার ৪০ বছরে অনেক গ্রাহক আমাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। ইসলামী ব্যাংকের এমডি বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের আমানতকারী সংখ্যা ১ কোটি ৯০ লাখ। পারিবারিক সদস্য সংখ্যা বিবেচনা করা হলে এর সংখ্যা ৮ কোটি ছাড়াবে। বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাতে ইসলামী ব্যাংক সব প্যারামিটারেই সেরা। গ্রাহকরা গত ৪০ বছর আমাদের সঙ্গে ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাংক হিসেবে ইসলামী ব্যাংক আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে এক হাজার ব্যাংকের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বর্তমানে আমাদের অবস্থান ৮৮২তম। আর দ্রুত সময়ের মধ্যে শীর্ষ ৫০০ ব্যাংকের মধ্যে আসতে চাই।
দেশে বৈদেশিক মুদ্রার দুটি খাত রয়েছে। রপ্তানি আয় এবং প্রবাসী আয়। বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক প্রবাসী আয় সংগ্রহে সবার শীর্ষে অবস্থান করছে। দেশের মোট প্রবাসী আয়ের ৩০ শতাংশই আসে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। এ ছাড়া যে তিনটি দেশ (সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্র) থেকে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় আসে, সেই দেশগুলো বিবেচনায় নিলে এ ব্যাংকের মাধ্যমেই ৫২ শতাংশ প্রবাসী আয় আসে বলেও জানিয়েছেন ইসলামী ব্যাংকের এমডি।
সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ঋণ অনিয়মের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার বাইরে কোনো ঋণ বিতরণ হয়নি। গণমাধ্যমে যেসব তথ্য দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে আংশিক সত্য রয়েছে। যেমন তারা উল্লেখ করেছে, নভেম্বরে সবচেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। বিষয়টি সঠিক। দেশের খাদ্যপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে আমরা যেসব বিনিয়োগ করেছি তার অধিকাংশ এলসির দায় নভেম্বরে পরিশোধ করা হয়েছে। যে কারণে এ মাসে ঋণ বিতরণের পরিমাণ বেশি ছিল। তবে যেসব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া হয়েছে, তা খেলাপি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান খেলাপি হয়েও যায় তাদের অর্থ জামানত থেকে উঠে আসবে। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব প্রতিষ্ঠান ঋণের টাকা পরিশোধ করবে বলেও আশা করছি আমরা।
নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ঋণের বিষয়ে মনিরুল মাওলা বলেন, যে বিনিয়োগগুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সেগুলো দেশ ও জাতির কল্যাণে দেওয়া হয়েছে। করোনাকালীন দেশে আমদানি করার সুযোগ হয়নি। করোনার পর আমদানির চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। বিশেষ করে খাদ্যপূর্ণ আমদানির চাহিদা বাড়ার কারণে আমরা বেশ কিছু বিনিয়োগ করেছি। প্রধানমন্ত্রী পক্ষ থেকে নির্দেশনা ছিল, দেশের কোনো জায়গায় যাতে খাদ্যপণ্যের ঘাটতি তৈরি না হয়। এ জন্য ইসলামী ব্যাংক বিভিন্ন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছে।
তবে অনেক ক্ষেত্রে আমদানিকারকরা দেশের সব জায়গায় পণ্য সরবরাহ করতে না পারায় স্থানীয় পর্যায়ে যেসব প্রতিষ্ঠান পাইকারি বিক্রি করে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে কিছু বিনিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অপরিচিত এসব প্রতিষ্ঠানকেই গণমাধ্যম বেনামি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আখ্যায়িত করছে। তবে আমাদের টিম ওই প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিদর্শন করে ও তাদের ঋণ পরিশোধের সম্ভাব্যতা যাচাই করেই এসব বিনিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের টিম বর্তমানেও ওইসব প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি অব্যাহত রেখেছে। পণ্য বিক্রি হলেই আমরা তাদের ঋণ সমন্বয় করে নেব।
সম্প্রতি আলোচিত রাজশাহীকেন্দ্রিক নাবিল গ্রুপকে দেওয়া ঋণ প্রসঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের এমডি বলেন, নাবিল গ্রুপ একটি বড় প্রতিষ্ঠান। আমরা ২০০২ সাল থেকে তাদের সঙ্গে ব্যবসা করছি। তাদের বর্তমান বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার কোটি ছাড়িয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনায় বেশ কয়েকটি ফিড মিল রয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় অটোরাইস মিল নাবিল গ্রুপের। এ ছাড়া তাদের কোল্ড স্টোরেজ, হ্যাচারি, পোলট্রিসহ নানা ধরনের ব্যবসা রয়েছে। এই গ্রুপের শুরুও হয়েছে ইসলামী ব্যাংকে থেকে নেওয়া ১৫ লাখ টাকা ঋণ দিয়ে। এখন এটি একটি বড় গ্রুপে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির এখন পর্যন্ত কোনো ঋণ একদিনের জন্যও খেলাপি হয়নি। এই গ্রুপটিকে দেওয়া ঋণগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে ফেরত আসবে বলেও জানান তিনি।
খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে মনিরুল মাওলা বলেন, ইসলামী ব্যাংকের আমানত সর্বোচ্চ। আমাদের বর্তমানে ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। ঋণের দিকে দ্বিতীয় অবস্থানে যে ব্যাংক রয়েছে, তার ঋণের পরিমাণ ৫২ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ আমানত এবং ঋণ বিতরণে ইসলামী ব্যাংক সবার শীর্ষ অবস্থান করছে। আমাদের যে ঋণ রয়েছে, তার মধ্যে খেলাপির পরিমাণ মাত্র ৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ। যদিও ৫ শতাংশ খেলাপি থাকলেও তাকে স্ট্যান্ডার্ড ধরা হয়। তবুও আমরা এ খেলাপি ঋণের পরিমাণ দ্রুত সময়ের মধ্যে তিন শতাংশের নিচে নিয়ে আসতে কাজ করছি।
বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে এবং এ কথা স্বীকার করছে রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন সংস্থাও। অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই আমদানি-রপ্তানিতে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে-কমিয়ে দেখানো হয়। সাধারণত উৎপাদনে থাকা কোম্পানিগুলো এমন পদ্ধতিতে অর্থ পাচারের সঙ্গে যুক্ত থাকে। কিন্তু এবার উৎপাদনে নেই এমন কোম্পানিও আমদানি-রপ্তানির আড়ালে বড় অঙ্কের অর্থ পাচার করেছে। সব মিলিয়ে ৮০৬টি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যের আড়ালে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক তদন্ত প্রতিবেদনে বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারের এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রায় ছয় মাস থেকে যৌথভাবে তদন্ত পরিচালনা করেছে এনবিআরের কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর, ভ্যাট নিরীক্ষা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত ১৭ সদস্যের টাস্কফোর্স কমিটি। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। আর্থিক অনিয়মে জড়িতদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে। জড়িতদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তা চাওয়া হবে।
অর্থ পাচারে জড়িত অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান তৈরি পোশাকশিল্পসংশ্লিষ্ট। দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশের বেশি আসে তৈরি পোশাক থেকে। একইভাবে আমদানি ব্যয়ের বড় অংশও ব্যয় হয় এ খাতের প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল জোগানে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাঁচামাল আমদানিতে মূল্য বাড়িয়ে দেখিয়ে অর্থ পাচার করা হয়েছে।
এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, একসময় উৎপাদনে থাকলেও দীর্ঘদিন থেকে ৮০৬ প্রতিষ্ঠানের একটিও উৎপাদনে নেই। এসব প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহর করে ব্যবসায়ী নামধারী কিছু অসাধু ব্যক্তি ৪ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা পাচার করেছেন।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবদুর রউফ দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমদানি-রপ্তানিতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আর্থিক অনিয়ম করলে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে। এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দারা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। আর্থিক অনিয়ম করেছে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে চিহ্নিত হয়েছে।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভালো-মন্দ সব ক্ষেত্রেই আছে। প্রকৃত ব্যবসায়ীরা আমদানি-রপ্তানিতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে দুর্নীতি করেন না। ব্যবসায়ী নামধারী ব্যক্তিরাই মিথ্যা তথ্য দিয়ে আর্থিক অনিয়ম করে থাকেন। তারাই প্রকৃত ব্যবসায়ীদের সুনাম নষ্ট করেছেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে ওসাকা স্টিল লিমিটেড (১৬-কাস্ট-পিবিডব্লিউ-২০০১, সার্কেল ৪১), সিওয়েভ একসেসরিজ লিমিটেড (লাইসেন্স ৯৬৩-কাস্ট-পিবিডব্লিউ ২০১৪, সার্কেল ২), নিকিতা করপোরেশন লিমিটেড (৩৯৯-কাস্ট-এসডব্লিউবি ৯৬), টিজেএন্ডকো (১০৮-কাস্ট-এসবিডব্লিউ ৯১, সার্র্কেল ২৭), শামসুল আলামিন কটন মিল লিমিটেড (১২৮/কাস্ট-এসবিডব্লিউ ২০০১, সার্র্কেল ৪০), আদনান সোয়েটার লিমিটেড (২২২/ কাস্ট-এসবিডব্লিউ-২০০২, সার্কেল ১৬), ইউলি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড (১৭৬৮/ কাস্ট-এসবিডব্লিউ-৯৩, সার্কেল ৬), ভেনাস অ্যাপারেল লিমিটেড (৩২৫/ কাস্ট-এসবিডব্লিউ-২০০৩, সার্কেল ৬), উইনস গামেন্টস লিমিটেডসহ (১৬৩৬/কাস্ট-এসবিডব্লিউ-৯৩, সার্কেল ২৭) ৬০৩ প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ আছে।
এনবিআরের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে বলা যায়, আশির দশকে তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা গতিশীল করতে বিনা শুল্কে কাঁচামাল আমদানির সুবিধা দেয় এনবিআর, যা বন্ড সুবিধা নামে পরিচিত। এই সুবিধা পাওয়ার শর্ত থাকে আমদানিকৃত পণ্যের সবটাই রপ্তানিকৃত পণ্য উৎপাদনে ব্যবহার করতে হবে। খোলাবাজারে বিক্রি করা যাবে না। এসব শর্ত ভঙ্গ করলে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। আমদানিকারকের বিরুদ্ধে এনবিআর প্রয়োজনে ফৌজদরি মামলা করতে পারবে। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স এবং বন্ড সুবিধা বাতিল করা হবে। কাঁচামালের ৮০৬ প্রতিষ্ঠানই এনবিআরের বন্ড সুবিধাপ্রাপ্তির তালিকায় আছে। এনবিআরের তদন্তে ধরা পড়ার পর শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিল করা হয়েছে।
বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি এবং তৈরি পোশাক খাতের অন্যতম প্রতিষ্ঠান এনভয় গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস সালাম মুর্শেদী দেশ রূপান্তরকে বলেন, রপ্তানি খাতকে গতিশীল করতে শুল্কমুক্ত সুবিধায় পণ্য আমদানির সুবিধা দিয়েছে সরকার। কিছু প্রতিষ্ঠান এ সুবিধা নিয়েও আর্থিক অনিয়ম করেছে বলে অভিযোগ আছে। তবে কোনো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের একার পক্ষে শুল্কমুক্ত সুবিধা নিয়ে অর্থ পাচার করা সম্ভব নয়। অবশ্যই এ কাজে এনবিআর ও ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা জড়িত। তাই অসাধু ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি অসাধু কর্মকর্তাদেরও দুষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
এনবিআরের তদন্ত কর্মকর্তারা সরেজমিনে ৮০৬ প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা অনুযায়ী গিয়ে দেখতে পেয়েছেন, কারখানার অবকাঠামো থাকলেও ২১৯টি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে এবং ১১৭টি শুধু গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রধান ফটকে নিরাপত্তারক্ষী রয়েছে। তারা জানে না এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক কারা। মাস গেলে তাদের কাছে বেতন পৌঁছে যায়। বাকি ২৬৭টির ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায়, দোকানপাট ও ঘরবাড়ি করে ভোগদখল করে আছে। মাস গেলে কেউ এসে ভাড়া নিয়ে যায়। এনবিআরের তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এসব প্রতিষ্ঠানের জমির মালিকের সন্ধান করা হলে প্রত্যেকেই বলেছেন, একসময়ে উৎপাদনে থাকলেও দীর্ঘদিন থেকে কারখানা বন্ধ রেখেছেন। তারা জানেন না কে বা কারা তাদের কারখানার ঠিকানা ব্যবহার করে অনৈতিক কাজ করেছেন। ৮০৬ কারখানার প্রতিনিধিরা রপ্তানিকৃত পণ্য উৎপাদনে ব্যবহার করার কথা জানিয়ে এনবিআর থেকে কাঁচামালের পরিমাণ উল্লেখ করে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানির অনুমতি নিয়েছে।
যে কাঁচামালের নাম উল্লেখ করা হয়েছে প্রকৃতপক্ষে আনা হয়েছে তার চেয়ে নিম্নমানের কম দামি পণ্য। বিনিময়ে ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলে পণ্যের দাম হিসেবে বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে পাঠানো হয়েছে কয়েক গুণ বেশি পরিমাণ অর্থ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমদানিকারকরা বিদেশে নামসর্বস্ব কোম্পানি খুলে বছরের পর বছর এই প্রক্রিয়ায় অর্থ পাচার করে এসেছেন। ব্যবসায়ী নামধারী অসাধু ব্যক্তিরা আমদানিকৃত নি¤œমানের পণ্য বন্দর থেকে নিজস্ব প্রতিনিধি পাঠিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন। এভাবেও তারা বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।
সারা দেশে প্রায় ৯ হাজার প্রতিষ্ঠান শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির সরকারি সুবিধা পেয়েছে। এর মধ্যে রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় আছে প্রায় ৬ হাজার প্রতিষ্ঠান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, লোকবলের অভাবে এনবিআর কর্মকর্তারা সরেজমিনে কারখানার অস্তিত্ব আছে কি না, তা যাচাই করতে পারেন না। তবে আগের ধারা থেকে বের হয়ে এনবিআর কাজ করছে। ভবিষ্যতে সম্পূর্ণ অটোমেশনে যাচ্ছে এনবিআর। এতে আমদানি-রপ্তানিতে স্বচ্ছতা আসবে। অর্থ পাচারও কমবে।
এর আগে এনবিআরের তদন্তে দেখা গেছে, দেশ থেকে পাচারকৃত মোট অর্থের প্রায় ৮০ ভাগই আমদানি-রপ্তানিতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাণিজ্যের আড়ালে পাচার হয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনেও বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত তথ্যের পরিসংখ্যান প্রকাশ পেয়েছে। ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে শুধু বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে ৫ হাজার কোটি ডলার পাচার হয়েছে। আর সুইস ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, সেখানে বাংলাদেশিদের জমা আছে প্রায় ৫ হাজার ২০৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি বলেছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে মোট ৮ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং ব্যাংকে তারল্য নিয়ে কোনো অপপ্রচারে কর্ণপাত না করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অনেক উন্নত দেশ বিপদের মধ্যে থাকলেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী গতকাল সোমবার মিরপুর সেনানিবাসের ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজের (ডিএসসিএসসি) শেখ হাসিনা কমপ্লেক্সে ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স-২০২২ ও ‘আর্মড ফোর্সেস ওয়ার কোর্স’-এর গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। অনেক উন্নত দেশ অর্থনৈতিকভাবে বিপদে এবং সমস্যার সম্মুখীন, তাদের রিজার্ভ কমছে। সে অবস্থায় আমরা বলতে পারি যে বাংলাদেশকে স্থিতিশীল অবস্থায় রাখতে পেরেছি।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য হচ্ছে যখনই দেশ একটা শান্তিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে অর্থনৈতিক অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যায় তখন সবার কাছে (স্বার্থান্বেষী মহল) এটা পছন্দ হয় না, এটা হলো বাস্তবতা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলে প্রবৃদ্ধি ৯ ভাগে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর কভিডের আগে আওয়ামী লীগ তুলেছিল ৮ শতাংশের ওপরে। কিন্তু কভিড-১৯ ও এর পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং একে কেন্দ্র করে স্যাংশনে অনেক উন্নত দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
এ সময় নানা কথা বলে ভয়-ভীতি ছড়ানোর অপচেষ্টায় কান না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধকালীন এই সংকটে অনেক ধনী দেশ জ্বালানি সাশ্রয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমরাও নানা পদক্ষেপ নিই। অথচ জ্বালানি নিয়ে নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে মানুষকে পক্ষে টানা হচ্ছে।’
দেশের অতীত ও বর্তমান রিজার্ভের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ’৯৬ সালে একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সময় রিজার্ভ পেয়েছিল মাত্র ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তখন তার সরকার সেই রিজার্ভ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার যখন সরকার গঠন করে তখন রিজার্ভ পায় ৫ বিলিয়ন ডলার যেটাকে টানা সরকারে থাকায় তারা ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে সক্ষম হয়।
তিনি বলেন, ‘করোনার সময় যাতায়াত ও আমদানি বন্ধ ছিল। এ জন্য রিজার্ভ জমে যায়। পরে সব চ্যানেল খুলে গেলে আমাদের আমদানিতে রিজার্ভ ব্যয় করতে হয়েছে। ভ্যাকসিন কেনা, টিকা গবেষণায় অর্থ দেওয়াসহ করোনা চিকিৎসার সরঞ্জাম ক্রয় করতে আমাদের অনেক টাকা লেগেছে। এগুলোর জন্য আমাদের ডলার খরচ হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখন কেবলমাত্র ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা চলছে তখন তার সরকার ১২০০ কোটি টাকা খরচ করে ভ্যাকসিন আনার জন্য বুকিং দেয় এবং দেশের মানুষের জন্য ঝুঁকি নেয়। অথচ অনেক উন্নত দেশও বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেয়নি। সে সময় দেশের ব্যবসায়ীসহ সব শ্রেণিকে তার সরকার যে আর্থিক প্রণোদনা দেয় তাতেও অর্থ ব্যয় হয় এবং তৃণমূল পর্যায়ে অর্থ সরবরাহ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করে। ফলে করোনা মোকাবিলার পাশাপাশি অর্থনীতিও ধরে রাখতে সক্ষম হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধ এবং স্যাংশনের কারণে ইতিমধ্যে আমদানি ব্যয় বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, যে গম এক সময় ২০০ ডলারে পাওয়া যেত তা এখন ৬০০ ডলারে কিনতে হচ্ছে। যে পরিবহন ব্যয় ৮০০ ডলার ছিল তা ৩৮০০ ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। কিন্তু এখানে রিজার্ভ খরচ করতে হলেও তার সরকার দেশের জনগণের কথা বিবেচনা করে কোনো কার্পণ্য করেনি। পাশাপাশি সরকারের রপ্তানি এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে তিনি দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি কাজে লাগিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধিতে তার সরকারের আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রী বিলাসিতা পরিহার করে সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশ ও সম্পদ আমাদেরই রক্ষা করতে হবে। আমরা কারও কাছে হাত পেতে চলব না, নিজেরা ফসল উৎপাদন করব এবং নিজেদের দেশকে গড়ে তুলব। এই আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে চলতে পারলেই ইনশাল্লাহ বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে, কেউ রুখতে পারবে না।’
তিনি বলেন, ‘আমার ও আমার পরিবারের সবার বিরুদ্ধে পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক অপবাদ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু প্রমাণ হয়েছে, এখানে কোনো দুর্নীতি হয়নি। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম নিজের অর্থে পদ্মা সেতু করব। তখন অনেকে বলেছে, এটা কখনো সম্ভব নয়। অসম্ভবকে সম্ভব করাই বাঙালির চরিত্র। এটা আমরা করতে পারব এটা আমরা করেছি।’
যেকোনো দুর্যোগে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী মানুষের পাশে দাঁড়ায় উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তারা এজন্য দেশে যেমন মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছে তেমনি বিদেশের শান্তিরক্ষা মিশনে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ভূমিকা রাখছে।
এটা সবসময় মনে রাখতে হবে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী গড়ে উঠেছে। কাজেই আমাদের দেশের মান-মর্যাদা সবসময় সমুন্নত রাখা এবং তাদের পাশে থাকা ও সহযোগিতা করা সবচেয়ে বড় লক্ষ্য।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা ২ কোটি ৫৩ লাখ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দিয়ে থাকি। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। ভূমিহীন ৩৫ লাখ মানুষকে ঘরবাড়ি তৈরি করে দিচ্ছি।’ এ কাজে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর অবদান রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানে সনদপ্রাপ্তদের আন্তরিক অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি কোর্স পরিচালনাকারী সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের সর্বাঙ্গীন সাফল্য কামনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী পরে মিরপুর সেনানিবাসের শেখ হাসিনা কমপ্লেক্স, ডিএসসিএসসিতে অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ (এনডিসি) এবং ডিএসসিএসসি গভর্নিং বডির ১৯০০তম যৌথ সভায় যোগ দেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন এনডিসি ও ডিএসসিএসসির চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা। বাসস
চোট কাটিয়ে নেইমার ফিরেছেন। তাতে ব্রাজিলও ফিরেছে কক্ষপথে, ঠিক রাজার মতোই। ম্যাচের ১৩ মিনিটেই ভিনিসিয়ুস ও নেইমারের গোলে ২-০ লিড। ২৯ মিনিটে সেটা ৩-০ করেন রিচার্লিসন। আর ৩৬ মিনিটে লুকাস পাকেতার পায়ের ঝলকে হয় ৪-০। ব্রাজিলের আগ্রাসনে কোরিয়া শিবির তখন পুরোপুরি বিধ্বস্ত। সেই ঝড় কিছুটা থেমেছে দ্বিতীয়ার্ধে। আর সেভাবে গোলের জন্য ঝাঁপায়নি রুদ্রমূর্তি ধারণ করা ব্রাজিলের আক্রমণভাগ। তাই আর গোলও হয়নি। এক গোল পরিশোধ করে কোরিয়া হারের ব্যবধানটাই শুধু কমিয়েছে। প্রথমার্ধে ৪-০ লিডের পর এই ম্যাচে আর কীইবা বাকি থাকে? গতকাল দোহার স্টেডিয়াম ৯৭৪-এ ৪-১ গোলের জয়ে ব্রাজিল কেটেছে কোয়ার্টার ফাইনালের টিকিট। যেখানে তাদের জন্য আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিল ক্রোয়েশিয়া। দিনের প্রথম ম্যাচে আরেক এশিয়ান জায়ান্ট জাপানকে টাইব্রেকারে ৩-১ গোলে হারিয়ে শেষ আট নিশ্চিত করে গত আসরের ফাইনালিস্টরা। ম্যাচটি নির্ধারিত সময়ে ১-১ গোলে ড্র ছিল।
গোড়ালির চোট গ্রুপের শেষ দুই ম্যাচ খেলতে দেয়নি নেইমারকে। তবে সেরে উঠে এ ম্যাচের প্রায় পুরোটাই খেলেছেন। নেইমারকে পেয়ে সতীর্থরা যেমন উজ্জীবিত হয়েছেন, একইভাবে তার উপস্থিতি হলুদরঙা গ্যালারিতে এনে দিয়েছে স্বস্তির পরশ। তাই তো ম্যাচ শুরুর আগে থেকেই ব্রাজিল সমর্থকদের নেইমার, নেইমার স্লোগানে মুখরিত পুরো স্টেডিয়াম। এ ম্যাচে তৃতীয় গোলরক্ষক ও বেঞ্চে থাকা দুই ফুটবলারকে নামিয়ে দলে থাকা ২৬ খেলোয়াড়কেই মাঠে নামান তিতে। ইতিহাসে প্রথমবার কোন ফুটবল দল দলের সবাইকে বিশ^কাপ ম্যাচে রাখল। নাহ, নেইমার খুব বেশি কিছু করেননি। পেনাল্টি থেকে দলের হয়ে একটি গোলই করেছেন মাত্র। তবে তার উপস্থিতি ঠিক ম্যাজিকের মতো বদলে দিয়েছে পুরো দলকে। দুর্ভাগ্য কোরিয়ার। ব্রাজিল রাজসিক প্রত্যাবর্তনের গল্পটা লিখতে প্রতিপক্ষ হিসেবে বেছে নিয়েছে তাদেরই। ব্রাজিলেরও করার কিছু ছিল না। এ যে নকআউট পর্ব। এখানে দুর্বল প্রতিপক্ষ বলে দয়া-মায়ার সুযোগই নেই।
ক্যামেরুনের বিপক্ষে ৯টি পরিবর্তন এনে তিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে দলকে একটা বাজে অভিজ্ঞতার সামনে ফেলেছিলেন। তবে ব্রাজিল কোচ কাল কোনো পরীক্ষার পথে হাঁটেননি। ৪-২-৩-১ ফরমেশনে রিচার্লিসনকে নাম্বার নাইনে রেখে নেইমার, ভিনিসিয়ুস জুনিয়র ও রাফিনহাকে দেন আক্রমণের মূল দায়িত্ব। ঠিক পেছন থেকে পাকেতা আর কাসেমিরো দিয়েছেন সংগত। আর রক্ষণ সামলাতে এলিসনের সামনে রেখেছেন থিয়াগো সিলভা, দানিলো, এদের মিলিতাও ও মার্কুইনহোসকে।
শুরু থেকেই ঝাঁপানোর লক্ষ্য নিয়ে মাঠে আসা ব্রাজিলকে সপ্তম মিনিটে এগিয়ে নেন ভিনিসিয়ুস। ডানদিক দিয়ে রাফিনহার আড়াআড়ি পাস ধরে ঠান্ডা মাথায় দূরের পোস্টে বল জমা করেন রিয়াল মাদ্রিদ তারকা। ৬ মিনিট পর পেনাল্টি থেকে গোল করে ব্যবধান বাড়ান নেইমার। বক্সের ভেতরে রিচার্লিসনকে ফেলে দিয়েছিলেন কোরিয়ার এক ডিফেন্ডার। নেইমার সেই সুযোগটা ঠান্ডা মাথায় কাজে লাগিয়ে এই বিশ্বকাপে প্রথম ও সব আসর মিলিয়ে সপ্তম গোলের দেখা পান। দেশের হয়ে সর্বোচ্চ ৭৭ গোল করা পেলের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন ৩০ বছরের তারকা। আর এক গোল করলেই তিনি ছুঁয়ে ফেলবেন আইডলকে।
ম্যাচে ফেরার ইঙ্গিত দিয়েছিল কোরিয়া। ১৭ মিনিটে হি চিনের জোরালো শট রুখে দেন ব্রাজিল কিপার এলিসন। ২৯ মিনিটে ৩-০ করেন রিচার্লিসন। আক্রমণের শুরুটা করেছিলেন নিজেই। অসামান্য স্কিলে পাকেতার কাছে বল বাড়িয়েই দ্রুত আক্রমণ ওঠেন। পাকেতার আড়াআড়ি পাস ডামি করে ছাড়েন কাসেমিরোর কাছে। ম্যানইউ তারকা সেটা এক টাচে রিচার্লিসনকে দিলে গোলের আনুষ্ঠানিকতা সারতে সময় নেননি টটেনহ্যাম স্ট্রাইকার। সার্বিয়ার বিপক্ষে জোড়া গোল করা রিচার্লিসন পেয়ে যান আসরে তৃতীয় গোল। সাত মিনিট পর প্রতিআক্রমণ থেকে গোল করে উৎসবে যোগ দেন পাকেতা। নিজেদের অর্ধ থেকে দ্রুত বল নিয়ে রিচার্লিসন বাঁদিকে বাড়ান ভিনিসিয়ুসকে। বক্সে ঢুকে আলতো চিপে পাকেতার পায়ে বল তুলে দেন রিয়াল মাদ্রিদ তারকা। তাতে পাকেতার প্লেসিং রোখার সাধ্যি ছিল না কোরিয়া কিপার কিম সিউংয়ের। প্রথমার্ধের অতিরিক্ত সময়ে কোরিয়া কিপার দুটি দারুণ সুযোগ রুখে দিলে ব্রাজিলকে চার গোলের লিড নিয়েই বিরতিতে যেতে হয়।
বিরতি থেকে ফিরেই ব্যবধান কমানোর সুযোগ এসেছিল কোরিয়ার সামনে। তবে আক্রমণভাগের সতীর্থদের মতো কাল জ্বলে উঠেছিলেন ব্রাজিল কাস্টডিয়ান এলিসনও। সনের ডান পায়ের জোরালো শট এগিয়ে এসে হাত ছুঁইয়ে পোস্টে যেতে দেননি লিভারপুল কিপার। ওদিকে ব্রাজিলের আক্রমণের গতি খানিকটা শ্লথ হলেও বেশ কবার গোলের সুযোগ পেয়েছিলেন রাইট উইঙ্গার রাফিনহা। তবে কিম সিউংয়ের দৃঢ়তায় আর গোল খায়নি কোরিয়া। বরং আক্রমণে উঠে তারা জোরচেষ্টা করেছে ব্যবধান কমানোর। ৬৮ মিনিটে এলিসনের অসামান্য কৃতিত্বে ব্রাজিলের গোলের দরজা খুলতে পারেননি হোয়াং ও সন। তবে ৭৬ মিনিটে বক্সের বেশ বাইরে থেকে বাঁ পায়ের জোরালো শটে হারের ব্যবধান কমান পাইক সিউং-হো।
এমন জয়ের পর ব্রাজিলের উদযাপনটা মাত্রা ছাড়ায়নি। হেক্সা জয়ের স্বপ্ন সত্যি করতে যে তাদের আরও তিন ম্যাচ জেতা বাকি। বরং নেইমার নিজে গ্যালারি থেকে পেলের ছবি সংবলিত প্ল্যাকার্ড মাঠে এনে প্রিয় মানুষটাকে জানিয়েছেন শুভকামনা। সাও পাওলোর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন পেলেকে জয়টাও উৎসর্গ করেছেন সেলেসাওরা।
ক্রোয়েশিয়ায় জাপানি সূর্যাস্ত : এই ক্রোয়েশিয়া লম্বা রেসের ঘোড়া। গত বিশ্বকাপে লম্বা দৌড়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েই ফাইনালে উঠেছিল তারা। শেষ পর্যন্ত শিরোপা আসেনি তবে তিনটি নকআউট ম্যাচের তিনটিতেই নির্ধারিত সময়ের বাইরে গিয়ে জিতেছিল ক্রোয়াটরা। এই একটি দিকেই ভয় ছিল এবারের উজ্জীবিত জাপানের। কাল সেই ভয়ই কাল হলো। ক্রোয়েশিয়ার কাছে পেনাল্টিতে ৩-১ গোলে হেরে বিশ্বকাপ থেকে অস্ত গেল জাপানি সূর্য। ক্রোয়েশিয়ান গোলকিপার ডমিনিক লিভাকোভিচের অতিমানবীয় পারফরম্যান্স এগিয়ে নিল ক্রোয়েশিয়াকে। পেনাল্টিতে পাঁচ শটের তিনটি রুখে দিয়েছেন এ গোলকিপার। নির্ধারিত সময়ে ১-১ ব্যবধানে ড্র ছিল ম্যাচ। গতবারের রানার্সআপদের বিপক্ষে এগিয়ে গিয়েও নিজেদের ইতিহাসে সেরা অর্জন পাওয়া হলো না জাপানের। বিশ্বকাপে শেষ ষোলোই ছিল জাপানের সেরা অর্জন। এবার প্রথমবার কোয়ার্টারে ওঠার হাতছানি ছিল। কিন্তু তা মিলিয়ে গেল ওই দ্বিতীয় রাউন্ডেই।
দারুণ এক জয়ে লিওনেল স্কালোনির আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছে গেছে। এখন লুই ফন গালের দলের বিপক্ষে খেলতে হবে তাকে। ম্যাচটা হবে লুসাইল স্টেডিয়ামে, যেখানে আর্জেন্টিনা আরও দুটো ম্যাচ খেলেছে, একটিতে হেরেছে সৌদি আরবের কাছে আর অন্যটিতে জিতেছে মেক্সিকোর বিপক্ষে।
আর্জেন্টিনা দলে কোচ স্ক্যালোনি একটা জিনিস স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে তিনি শক্ত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করতে পারেন। দলের খেলার উন্নতির জন্য যদি প্রচলিত ছক ভেঙে নতুন ছকেও খেলাতে হয়, স্কালোনি সেই ঝুঁকিটাও নিতে রাজি। কোনো পরিবর্তন আনতে তিনি কোনো দ্বিধাবোধ করেন না। সৌদি আরবের সঙ্গে ম্যাচটা হেরে যাওয়ার পর মেক্সিকোর সঙ্গে ম্যাচে তিনি একাদশে পাঁচটা পরিবর্তন এনেছিলেন। এরপর পোল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে তিনি চারটা পরিবর্তন আনেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পরের ম্যাচটায় অবশ্য তার একই একাদশ ফের মাঠে নামানোরই ইচ্ছা ছিল কিন্তু অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ার চোটের কারণে বাধ্য হয়ে তিনি পাপু গোমেজকে মাঠে নামান।
ডি মারিয়া পরের ম্যাচে শুরু থেকে খেলতে পারবেন কি না এটা অনিশ্চিত। পোল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের ম্যাচটিতে ডি মারিয়া তার উরুর পেশিতে ব্যথা অনুভব করেছেন, যে কারণে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটা তিনি খেলতে পারেননি। আলেজান্দ্রো (পাপু) গোমেজ তার জায়গায় খেলেছেন। ধারণা করছি, ডি মারিয়ার চোটটা খুব গুরুতর নয় এবং আশা করছি শুক্রবারের ম্যাচে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েই খেলবেন।
এই দলটায় কোনো প্রাচীন সংস্কার আঁকড়ে রাখার মানসিকতা নেই, নেই একইভাবে সব ম্যাচ খেলার প্রবণতা। প্রথম দিকে আর্জেন্টিনা দলটার উদ্দেশ্য ছিল শুধুই জেতা, প্রতিপক্ষের ওপর নির্ভর করে খেলার ধরনে পরিবর্তন আনা এক পাশ থেকে অন্য পাশে বলের আদান প্রদান। আর্জেন্টিনা জিতেছে আক্রমণভাগে জুলিয়ান আলভারেজের সাবলীলতা আর মাঝমাঠে অভিজ্ঞ মিডফিল্ডার এনজো ফার্নান্দেজের ধীরস্থিরতায়। মেসিকে দলে পাওয়ার যে সুবিধা আর্জেন্টিনা পেয়েছে, সেটা হচ্ছে প্রতিপক্ষ এখন মেসির ভয়েই রক্ষণ সামলাতে অনেক বেশি ব্যস্ত। রোমেরো-ওতামেন্দির জুটিটাকেও বেশ কার্যকর মনে হচ্ছে আর লিসান্দ্রো মার্তিনেজের উপস্থিতি রক্ষণভাগকে করেছে আরও বহুমাত্রিক, কারণ সে অনেকগুলো পজিশনেই খেলতে পারে।
এই বিশ্বকাপে যে চারটা দল এখন পর্যন্ত অপরাজিত, লুই ফন হালের দল তাদের একটা। বাকি দলগুলো হচ্ছে ইংল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া আর মরক্কো। রাশিয়ায় ২০১৮ বিশ্বকাপে সুযোগ না পেয়ে ডাচরা সম্পূর্ণ নতুন একটা দল নিয়েই ২০২২ বিশ্বকাপে খেলতে এসেছে। এটা নেদারল্যান্ডসের নতুন প্রজন্মের দল যারা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে চায়। এরই মধ্যে কাতারে তারা তাদের সুসময়ের ঝলক দেখাচ্ছে, তারা জিতেছে স্বাগতিক কাতার ও সেনেগালের বিপক্ষে আর ড্র করেছে ইকুয়েডরের সঙ্গে। শনিবার তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে এমন একটা ম্যাচে জিতল, যেখানে তারা খুব কম বলের দখল রাখলেও সেটপিস এবং যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েছে।
শেষ আটের লড়াইতে লোকে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের হাই-ভোল্টেজ ম্যাচ দেখতে পাবে যেটা তাদের সমৃদ্ধ ইতিহাসকেও ছাপিয়ে। এই দুই দল প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হবে বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে। এই দুই দল গ্রুপপর্বে মুখোমুখি হয়েছে দুইবার এবং দুইবারই জিতেছে ইংল্যান্ড। ১৯৬৬ বিশ্বকাপে ২-০ ও ১৯৮২ বিশ্বকাপে ৩-১ ব্যবধানে।
ফ্রান্স কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছেছে পোল্যান্ডকে ৩-১ গোলে হারিয়ে। এই ফরাসি দলটা পরিচালনা করছেন দিদিয়ের দেশম, এই দলের খেলোয়াড়রা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আর এরা বিশ্বকাপের সবচেয়ে আক্রমণাত্মক দলগুলোর একটি। সামনে খেলছেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। অন্যদিকে ইংল্যান্ড শেষ আটে এসেছে সেনেগালকে ৩-০ গোলে হারিয়ে, গোলগুলো করেছেন জর্ডান হেন্ডারসন, হ্যারি কেইন ও বুকায়ো সাকা। এই ম্যাচটা হতে যাচ্ছে অত্যন্ত রোমাঞ্চকর কারণ দুই দলেই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো বারুদ আছে।
ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের অন্যতম বড় সংগঠন ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলন আজ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম এ সংগঠনটির ৩০তম জাতীয় সম্মেলন এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন সরকারবিরোধী আন্দোলন চলছে। এ ছাড়া সামনে রয়েছে জাতীয় নির্বাচনের বড় চ্যালেঞ্জ।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ গঠিত হয়। সংগঠনটির বয়স বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যোগ হয়েছে নানা বিতর্ক। নানা সময়ে বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকান্ডে সংগঠনটির গৌরবোজ্জ্বল অতীত ম্লান হয়েছে। ছাত্রলীগের নামে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুনোখুনি, দখলবাজির মতো গুরুতর অভিযোগ উঠছে। চাঁদাবাজির অভিযোগে পদ হারাতে হয়েছে সংগঠনটির সাবেক শীর্ষ দুই নেতা শোভন-রাব্বানীকে।
এ অবস্থায় সম্মেলন ঘিরে ছাত্রলীগের সোনালি অতীত ফিরিয়ে আনার প্রত্যাশা করছেন সংগঠনের সাবেক ও বর্তমান নেতারা। তাদের চাওয়া, এমন নেতৃত্ব খুঁজে বের করা উচিত যারা ঘুণে ধরা ছাত্রলীগকে গৌরবের ছাত্রলীগে রূপান্তর করবে। বৈষয়িক নেতার চেয়ে আদর্শিক নেতা বেরিয়ে আসবে। মোটাদাগে বিতর্কহীন নেতৃত্ব এ সংগঠনের নেতৃত্ব দেবে।
ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বাহালুল মজনুন চুন্নু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ছাত্রলীগকে অবশ্যই দেশের মানুষের জন্য কাজ করা উচিত। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা উচিত। আমাদের সময়ে ছাত্রনেতারা সংগঠনের আদর্শ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বলে ছাত্রলীগ করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। এখন সেই কর্মকান্ড নেই। এখনকার নেতাদের মধ্যে সুবিধা নেওয়ার বিষয় কাজ করে, যেটা আমাদের সময় ছিল না।’
ছাত্রলীগের ২৯তম সম্মেলন হয় ২০১৮ সালের মে মাসে। ওই বছরের ৩১ জুলাই শোভন ও রাব্বানীর হাতে সংগঠনের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পদচ্যুত হন শোভন-রাব্বানী। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্ব দেওয়া হয় আল নাহিয়ান খান জয় ও লেখক ভট্টাচার্যকে। পরের বছর ২০২০ সালের ৪ জানুয়ারি তারা পূর্ণ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান।
আজ মঙ্গলবার ৩০তম জাতীয় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগে নতুন নেতৃত্ব আসবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক দিনের এ সম্মেলন হবে। এর আগে সংগঠনের জাতীয় সম্মেলন হতো দুদিনব্যাপী।
ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০০ সালের পর থেকে যারা সংগঠনের নেতৃত্বে এসেছেন তাদের হাত ধরে বিতর্কের শুরু। সর্বশেষ নেতৃত্ব জয় ও লেখক সংগঠনকে আরও বেশি বিতর্কিত করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন সংগঠনের এখনকার নেতাকর্মীরা। তাদের দাবি, পদবাণিজ্য থেকে শুরু করে শিবির-ছাত্রদল করার অভিযোগ থাকা ছাত্রদেরও এ সংগঠনে বড় পদ দিয়েছেন তারা। টাকার সুবিধা নিয়ে নেতা বানিয়ে ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন এ দুজন। এমন অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গত অক্টোবরে রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। গত রবিবার রাতে ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা জয়কে অবরুদ্ধ করেন। জানতে চান, সংগঠনকে কেন বিতর্কিত করেছেন তারা। অবশ্য, পরে জয়কে ছেড়ে দেওয়া হয়।
সম্মেলন না করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কমিটি দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে টাকা লেনদেনের অভিযোগ ওঠে। তবে ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘টাকা খেয়ে কমিটি, পদবাণিজ্যের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।’
গত নভেম্বরের মাঝামাঝি সম্মেলন ছাড়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কমিটি না দিতে সংগঠনটিকে আওয়ামী লীগ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। নতুন কমিটি না দিলেও গত কয়েক দিন ৩১ জুলাইয়ে স্বাক্ষরে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির পদ পেয়েছেন দাবি করে অনেকই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি দিয়ে জানাচ্ছেন। গত ৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সজীবুর রহমান সজীব ও সাধারণ সম্পাদক আবু ইউসুফ হল শাখার সহসভাপতি মীর লায়েককে কারণ ব্যাখ্যার জন্য চিঠি দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, ‘গত ৪ ডিসেম্বর আপনার ফেইসবুক আইডিতে দেওয়া পোস্টে আপনি ৩১ জুলাই ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক মনোনীত হয়েছেন। কিন্তু গত ১১ সেপ্টেম্বর হল কমিটির পদের জন্য দেওয়া জীবনবৃত্তান্তে বিষয়টি উল্লেখ ছিল না।’
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কমিটি গঠনের বিষয়ে সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন পরে করোনা মহামারীর কারণে সব স্থবির হয়ে যায়। ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের চার নেতা ছাড়াও আমাদের অভিভাবক শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করে কমিটি নির্ধারণ করেছি।’
পুরনো তারিখ দিয়ে নেতা বানানোর যে অভিযোগ উঠেছে সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে দেশ রূপান্তরকে জানান ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম।
বর্তমান কমিটির নেতাদের নামে এত নানা সমালোচনা-বিতর্ক থাকলেও তাদের অনেকেই জনকল্যাণমূলক কাজ করে আলোচনায় এসেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরী অন্যতম। ডাকসুর সম্পাদকীয় পদে শিক্ষার্থীদের বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। করোনা মহামারীতে যখন অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছিল তখন সাদের নেতৃত্বে সংগঠনের কর্মীরা ‘জয় বাংলা অক্সিজেন সেবা’ নিয়ে পথেঘাটে ঘুরেছেন। চাল-ডাল নিয়ে অসহায় মানুষের দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছেন। সাদকে ‘ছাত্রলীগের অক্সিজেন’ হিসেবেই সারা দেশের মানুষ চেনে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যা সমাধানে চেষ্টা করে গেছেন। হায়দার মোহাম্মদ জিতু গণমাধ্যমে লেখালেখি করে পরিচিতি লাভ করেছেন। সবুর খান কলিন্স, তানভীর রহমান মাহিদ ও বরিকুল হাসান বাঁধন সামাজিক বিভিন্ন কাজে সম্পৃক্ত থেকে ছাত্রলীগের সুনাম রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন।
এদিকে গত সম্মেলনে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বের বয়সসীমা অনূর্ধ্ব ২৯ বছর ছিল। দুই বছর মেয়াদি কমিটির সম্মেলন চার বছর সাত মাস পর হওয়ায় এবারের সম্মেলনে বয়সসীমা কত হবে তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
এবার ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থিতার ফরম জমা দিয়েছেন ২৫৪ জন। এর মধ্যে সভাপতি পদে ৯৬ এবং সম্পাদক পদে ১৫৮ জন। দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, তারা দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে তারা সংক্ষিপ্ত তালিকা দেবেন। তিনি সেগুলো থেকে যাচাই-বাছাই করবেন। তার বাইরে থেকেও নেতা নির্বাচন করা হতে পারে। তবে বয়স নিয়ে ছাড় চান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। তারা বলেন, যোগ্য নেতৃত্ব বের করতে হলে বয়সের ব্যাপারটি ছাড় দেওয়া উচিত। আর গঠনতন্ত্রে দুই বছর মেয়াদে সম্মেলন হওয়ার নিয়ম আছে। সেখানে চার-পাঁচ বছর পর সম্মেলন হয়। সে ক্ষেত্রে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সম্মেলন না হলে শুধু বয়সের ক্ষেত্রে গঠনতন্ত্র মানতে হবে। সেটি ঠিক হবে না।
ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ও আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘বয়সের বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি, কিন্তু এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এবারে যেহেতু করোনাসহ বিভিন্ন ক্রাইসিস সময় আমরা পার করছি তাই এ ব্যাপারে নতুন সিদ্ধান্ত আসতে পারে।’
৬ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দুই শীর্ষ নেতার পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতার নাম ঘোষণা করার সম্ভাবনা রয়েছে। পদপ্রত্যাশীদের মধ্যে আলোচনায় রয়েছেন সোহান খান, সাদ্দাম হোসেন, সৈয়দ আরিফ হোসেন, ইয়াজ আল রিয়াদ, কামাল খান, মাজহারুল ইসলাম শামীম, তাহসান আহমেদ রাসেল, সাদ বিন কাদের চৌধুরী, বরিকুল ইসলাম বাঁধন, তানভীর হাসান সৈকত, ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী সজীব, আবু হাসনাত সরদার হিমেল, ফুয়াদ হোসেন শাহাদাত, হায়দার মোহাম্মদ জিতু, আবদুল্লাহ হীল বারী, রনি মুহাম্মদ, তিলোত্তমা শিকদার, ফরিদা পারভীন, তানভীর রহমান মাহিদ, জয়দীপ দত্ত (জয়াজিৎ), খাদিমুল বাশার জয়, আরিফুজ্জামান ইমরান, শেখ ওয়ালী আসিফ (ইনান), ফাল্গুনী দাস তন্বী, তারেক আজীজ, শেখ মেহেদী হাসান, রফিকুল ইসলাম সবুজ, শরীফ বায়েজিদ ইবনে মাহমুদ কোতওয়াল ও ইমরান জমাদ্দার।
ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি সম্পাদক অসীম কুমার উকিল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ছাত্রলীগের ইতিহাস। নেতৃত্ব নির্বাচন করে সেই জায়গা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করা হবে, এটাই প্রত্যাশা।’
দুর্নীতি দমন কমিশনার (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ বলেছেন, নির্বাচনের বছরে দুদক চোখ-কান খোলা রাখবে। আইন অনুসারে আমাদের যেটুকু অংশ, আমরা তা নিরপেক্ষভাবে পালনের চেষ্টা করব। আমরা সাধ্যমতো কাজ করছি।
মঙ্গলবার সেগুনবাগিচায় প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এক সংবাদ সন্সেলনে দুদক চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ও মো. জহুরুল হক এবং দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচনের বছরে সব প্রার্থীর হলফনামায় যে সম্পদ বিবরণী থাকে তা খতিয়ে দেখবে দুদক। এ বছর চোখ-কান খোলা রাখবে। সমস্ত প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করবে। আগামী বছরে দুদকের কাজে আরো গতিশীলতা আনার জন্য কাজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সোমবার রাতে বার্ষিক প্রতিবেদনটি (২০২২) রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি দুদকের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়ে কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থান নিতে বলেছেন। দুদক স্বচ্ছতার সঙ্গে সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবগত করা হয়েছে।
ফাঁদ মামলা কেন কমেছে এমন এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা যতটুকু তথ্য পেয়েছি, সেই অনুসারে ফাঁদ মামলা হয়েছে। আমরা শতভাগ সফল হতে পারিনি। বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় গত বছর সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের করেছি। ওই বছর এফআরটি কম হয়েছে। মামলা বেশি হয়েছে, এফআরটি কমেছে। সাজার হার বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুদক ঠিকমতো কাজ করছে না, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, মামলা, তদন্ত, অনুসন্ধান সব কিছুই বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। তারা তাদের বক্তব্য দিয়েছে। আমরা তথ্য দিলাম, এগুলো সংরক্ষিত আছে। আপনারাই বিবেচনা করবেন।
এ সময় বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, মামলাগুলো চলমান। এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি তিনি।
সম্প্রতি আলোচিত দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানের ‘অর্থপাচার’ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে দুদক চেয়ারম্যান জানান, এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই, পেলে কাজ করবে দুদক।
এদিকে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেন, দেশের টাকা বাইরে চলে গেছে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়তো কাজ করতে পারেনি দুদক। পাচারকৃত অর্থ নিয়ে কাজ করে আরো অনেকগুলো সংস্থা। শুধু দুদকের একার কাজ নয় এটি। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি টাকা ফিরিয়ে আনার।
দুদকের অসন্তুষ্টির জায়গা কোনটি এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক বড় বড় দুর্নীতি বিশেষ করে দেশের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেক দুর্নীতিবাজ দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে, ব্যবসার আড়ালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে। এই বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের মাত্র একটি অপরাধের এখতিয়ার আছে। বাকি ২৬টি অপরাধের বিষয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এখতিয়ার। কিন্তু জনগণের মনে এখনো ভ্রান্ত ধারণা দুদক কী কাজ করে। কিন্তু আমাদের অংশে আমরা কাজ করি ও শতভাগ সাফল্য রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশেরে এক পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেন, দেশে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বাড়ে নাই, বরং কমেছে। তবে আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বন্ধ করতে পারিনি। মামলা পরিচালনা ক্ষমতা কমেছে এটা মিথ্যা কথা। কারণ মানিলন্ডারিং মামলায় ১০০ ভাগ সাফল্য, অন্যান্য মামলায় সাজার পরিমাণ ৬৭ থেকে ৭০ ভাগ আমাদের পক্ষে। আমাদের সক্ষমতা কমেছে কে এটা বলেছে। এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।
দুদকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরে দুদকে জমা পড়ে ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ। এসব যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের জন্য সংস্থাটি হাতে নিয়েছে ৯০১টি অভিযোগ, যা মোট অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৯৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ অভিযোগই অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিতে পারেনি দুদক। ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগের মধ্যে ৩ হাজার ১৫২টি অভিযোগ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে। ২০২২ সালে চার্জশিট অনুমোদন হয়েছে ২২৪টি, মামলা হয়েছে ৪০৬টি, ফাঁদ মামলা হয়েছে মাত্র ৪টি।
২০২১-২২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সাজা, নিষ্পত্তি ও খালাসের পরিমাণ বেড়েছে। এরমধ্যে গতবছর সংস্থাটির ৩৪৬টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এছাড়া এই সময়ে কমিশন আমলের ৬৪ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ব্যুরো আমলের ৩৫ দশমিক ৯০ মামলার আসামির সাজা হয়েছে। ২০২২ সালের দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন তুলে ধরেন দুদক চেয়ারম্যান। উপস্থাপনকালে এই তথ্য জানানো হয়।
ছেলে ইজহান মালিককে সঙ্গে নিয়ে ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরবে রয়েছেন ভারতের সাবেক টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একাধিক ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেছেন তিনি।
মঙ্গলবার ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে মনিদা শরীফে তোলা নিজের একাধিক ছবি পোস্ট করেন সানিয়া। ভিডিও পোস্ট করেছেন ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে।
ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা প্রথম ছবিতেই দেখা যাচ্ছে সানিয়া তাকিয়ে আছেন তার ছেলের দিকে। সানিয়ার পরনে কালো রঙের বোরকা।
ছবিগুলো পোস্ট করে ক্যাপশনে সানিয়া লিখেছেন, ‘আলহামদুল্লিাহ। আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করুন।’
সানিয়ার পোস্ট করা ছবিগুলোর কয়েকটিতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও রয়েছেন। তবে তার স্বামী পাকিস্তানি ক্রিকেটার শোয়েব মালিককে কোনোটাতেই দেখা যায়নি।
‘বস্তি এলাকার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। পানি সরবরাহ ও নর্দমা লাইন প্রায়ই এক হয়ে যাচ্ছে। নিরুপায় হয়ে দূষিত ও নোংরা পানি পান করছেন তারা।’ এভাবে বলছিলেন ঢাকার বস্তির জীবন মান নিয়ে কাজ করা ব্র্যাকের উন্নয়ন কর্মী বাছেরা আক্তার।
শুধু বস্তি এলাকা নয়, দেশের সব এলাকার সুপেয় পানি সরবরাহের চিত্র এমনই। রাজধানী ঢাকায় সরবরাহ করা পানিই না ফুটিয়ে পান করা যায় না। চট্টগ্রাম শহরের পানি লবণাক্ত। রাজশাহীর পানিতে ময়লা ও দুর্গন্ধ। খুলনায় সরবরাহ করা পানিও না ফুটিয়ে পান করা যায় না। রয়েছে লবণাক্ততাও। গভীর নলকূপের পানিও নিরাপদ নয়, আর্সেনিক ও লবণাক্ততার কারণে ব্যবহার করাও দুষ্কর। পাহাড়ে সুপেয় পানির উৎস সীমিত। পাহাড়ি ছড়া শুকিয়ে যাচ্ছে। উজানে বাঁধ দেওয়ার কারণে নদন্ডনদীর পানিও কমছে। সুপেয় পানি ও সেচের জন্য অত্যধিক মাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতার কারণে পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে দিন দিন।
এ পরিস্থিতিতে আজ ২২ মার্চ পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য : ‘আসুন নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সংকট সমাধানে পরিবর্তন ত্বরান্বিত করি।’
সরকারের পানি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় মিষ্টি পানিসমৃদ্ধ বাংলাদেশেও সুপেয় পানি দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকার মানুষ সুপেয় পানির বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করেও নিরাপদ পানি মিলছে না। এ ব্যর্থতা ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনও হুমকিতে পড়ার শঙ্কা তৈরি করেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. তানভীর আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহকৃত পানিকে সুপেয় পানি বলা যায়। তবে সেখানে কোনো ময়লা ঢুকে পড়লে সেই পানিকে আর সুপেয় থাকে না। সুপেয় পানি না ফুটিয়েই পান করা যাবে।’
পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ওয়াসার পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে অনেক সময় বাইরে ময়লা ঢুকে পড়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। এমন ঘটনা ঘটলে সেই পানিকে নিরাপদ বলা যাবে না। শুধু ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের পানির মান ভালো হলে চলবে না, বাসা পর্যন্ত ভালো পানি পৌঁছে দিতে হবে। কেননা সরবরাহ লাইনের পানি নিরাপদ রাখাও সংস্থার দায়িত্ব।’
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালে এসডিজি অর্জন এবং ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে কাজ করছে। এ জন্য সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে সরকার কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা পিছিয়ে রয়েছি। আশা করি সবাই মিলে কাজ করে পানি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা দূর করে আমরা নির্ধারণ সময়ে লক্ষ্যপূরণ করতে পারব।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার। এর মধ্যে ৫৯ ভাগ অর্থাৎ ৯ কোটি ৭৪ লাখ ৪৩ হাজার ২২০ জন মানুষ সুপেয় পানি সুবিধার আওতায় এসেছে। আর সুপেয় পানি সুবিধার বাইরে রয়েছে ৪১ ভাগ অর্থাৎ ৬ কোটি ৭৭ লাখ ১৪ হাজার ৭৮০ জন মানুষ। এখনো দেশের ১০ ভাগ মানুষ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে।
বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-তে বলা হয়েছে, দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা সুপেয় পানি প্রাপ্যতার বিবেচনায় ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে চর এলাকা, বন্যাপ্রবণ এলাকা, উপকূলীয় এলাকা, হাওর এলাকা, বরেন্দ্র অঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকা। দেশের এই ছয় শ্রেণির এলাকা বিস্তৃত রয়েছে ১০০টি উপজেলায়। দেশের ১৫৯ সিটি ও পৌরসভায় সরবরাহ করা পানির মানও একই। ওইসব এলাকায় ১৬৮টি পানি শোধনাগার, ১ হাজার ৫০০টি গভীর নলকূপে ১৫ হাজার কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা সরকার চালু রেখেছে। গ্রাম পর্যায়ের ২০ লাখ টিউবওয়েলের পানি নিরাপদ হওয়ার কথা ছিল। তবে আর্সেনিক ও মাত্রাতিরিক্ত আয়রন সে পানিও জনজীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেছে।
২০১৬ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বিশে^র সবচেয়ে বড় ‘গণবিষ’-এর উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের আর্সেনিক পরিস্থিতিকে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বছরে আর্সেনিকে ৪৩ হাজার মানুষ মারা যাওয়ার তথ্য প্রকাশ করা হয়। আর ২০০৩ সালে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের জরিপ অনুযায়ী, দেশের ২৯ শতাংশ নলকূপে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি আর্সেনিক পাওয়া যায়। আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী শনাক্তে ২০১২ সালে একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। তখন ৬৫ হাজার ৯১০ জন রোগী শনাক্ত করা হয়। ২০১৭ সালে ৪২টি জেলার হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ তথ্য সংগ্রহ করে। ওই হিসাব অনুযায়ী, ওই বছর এসব হাসপাতালে ১৮ হাজার ৬৬২ আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী সেবা গ্রহণ করে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের সরকারিভাবে স্থাপিত গভীর ও অগভীর নলকূপ রয়েছে প্রায় ২০ লাখ। সেই হিসাবে জনসংখ্যার বিবেচনায় সরকার ৮৩ জনে একটি পানির উৎস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। সমগ্র জনসংখ্যার বিবেচনায় বর্তমান পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে ১১ ভাগ। আর শহর এলাকার জনসংখ্যা বিবেচনায় ৩৮ ভাগ।
এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ২০৩০ সালের মধ্যে সরকারকে সুপেয় পানি সরবরাহে শতভাগ সাফল্য অর্জন করতে হবে। সেটা করতে হলে প্রতি বছর ছয় ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। বর্তমান অগ্রগতি প্রায় এক ভাগ। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সে কারণে সামনের দিনগুলোতে পানি সরবরাহ খাতের অর্জন আরও কম হতে পারে। এ জন্য লক্ষ্য পূরণে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে চারগুণ তৎপরতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে আরও জানা যায়, দেশে বেসরকারি টিউবওয়েল রয়েছে প্রায় দেড় কোটি। আর সরকারি টিউবওয়েল রয়েছে প্রায় ২০ লাখ। এ দুটো ধরে হিসাব করতে দাঁড়ায় প্রতি ১০ জনে একটি পানির উৎস রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে খুলনার উপকূলীয় উপজেলা দাকোপ, কয়রা, বাগেরহাটের মোংলা, শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জ, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি এলাকায় পানযোগ্য পানি খুবই দুষ্পাপ্য। এসব এলাকার বেশিরভাগ উপজেলায় গভীর নলকূপ কার্যকর নয়। সরকার পানি সরবরাহ সেবার আওতায় আনতে পেরেছে ৯৮ দশমিক ৫০ ভাগ মানুষকে। এখনো ১ দশমিক ৫০ ভাগ মানুষ পানি সুবিধার আওতার বাইরে রয়েছে।
নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর : ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা বাড়ায় স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। যে হারে পানির স্তর নামছে, সে হারে পানির স্তর পূরণ হচ্ছে না। স্বাভাবিক অবস্থা ৬ থেকে ৭ ফুট নিচেই ভূগর্ভস্থ উৎসে পানি পাওয়ার কথা। কিন্তু সে অবস্থা এখন আর নেই। ঢাকায় পানি পেতে ২৫৫ থেকে ২৬০ মিটার নিচে নামতে হচ্ছে। খুলনায় ভূগর্ভস্থ পানি নেমে গেছে ২৫-৩০ ফুট। রাজশাহী ও বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর ১২০ থেকে ১৪০ ফুট নিচে নেমে গেছে। খরার মৌসুমে এ অবস্থা থাকে। বর্ষার মৌসুমে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়।
অন্যদিকে দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২-৩ মিটার নেমে যায়। আর ২৫ ভাগ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৫-১০ মিটার নেমে যায়। বর্ষার মৌসুমে এসব এলাকার বেশিরভাগ অংশে পানির ভূগর্ভস্থ স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসে। তবে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল ও দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের কিছু এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে আসে না। দেশের গৃহস্থালি ও খাবার পানির ৯৪ শতাংশ চাহিদা পূরণ হচ্ছে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। গ্রাম এলাকায় এ উৎস থেকে ৯৯ শতাংশ ও শহর এলাকায় ৮০ শতাংশ পানি সরবরাহ করা হয়। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ১৮ শতাংশ নলকূপের পানি উত্তোলনে সমস্যা হয়। এ ছাড়া ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা, মধুমতী, আড়িয়াল খাঁ, গড়াই নদীর পানি কমে যাওয়ায় এসব এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পুনঃভরণ হয় না।
ভূ-উপরিস্থ সুপেয় পানির উৎসের অভাবে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর অঞ্চলে সারা বছর সুপেয় পানির সংকট থাকে। বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্যরকম সংকট। খরার মৌসুমে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনার নলকূপগুলোতে পানি পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। বর্ষার মৌসুমে দেশের অন্যান্য এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির শূন্য স্তরের ২৫ শতাংশ পূরণ হয়ে যায়। তবে বরেন্দ্র অঞ্চলে মাত্র ৮ শতাংশ পূরণ হয়। ওইসব এলাকায় ১৬০ ফুটের আগে পানির দেখা মিলছে না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভূগর্ভস্থ পানি বিভাগের পরিচালক এবং পানি বিশেষজ্ঞ ড. আনোয়ার জাহিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারকে বর্ষায় কৃত্রিমভাবে মাটির নিচে পানি প্রবেশ করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এমন উদ্যোগ নেওয়া না হলে ভবিষ্যতে দেশ বড় ধরনের পানি সংকটের মুখোমুখি হতে পারে।
উপকূলে লবণাক্ততা সমস্যা : ভূতত্ত্ববিদদের মতে, উপকূলীয় এলাকার পানিতে একবার লবণাক্ত পানি প্রবেশ করলে ওখানকার ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হয়ে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নদীতে পানি না থাকলে স্বাভাবিকভাবেই অববাহিকা অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচের দিকে নেমে যাবে। একই সঙ্গে সাগরের দিক থেকে লবণ পানি প্রবেশের হার বাড়বে।’
চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগরের উপকূলীয় এলকাগুলোতে আমরা গভীর নলকূপ বসাতে পারি না। এই এলাকায় নলকূপে লবণাক্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে।’
উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা কমাতে উজান থেকে পানির প্রবাহ বাড়ানোর কথা বলছে ভূতত্ত্ববিদরা। কিন্তু ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ৫৬টি যৌথ নদী থেকে ইতিমধ্যে পানি প্রত্যাহার শুরু হয়েছে। এর প্রভাবে দেশের নদীগুলোতে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে এবং শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়েও যাচ্ছে। নদীগুলোর গভীরতা কমে গিয়ে পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সারা নওরিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশের উত্তরাঞ্চলে স্বাভাবিকভাবেই পানির স্তর নিচে। এখন এই হার আরও বেড়েছে।’
বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে আলোচিত পুলিশ হত্যা মামলার অন্যতম আসামি রবিউল ইসলাম আপন ওরফে আরাভের রেসিডেন্ট পারমিট বাতিল করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই সরকার। এর ফলে তার ভিসাও বাতিল হয়ে গেছে। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। একই সঙ্গে ভারতও তার পাসপোর্ট বাতিল করেছে বলে পুলিশ একটি সূত্র জানিয়েছে।
অন্যদিকে, গতকাল মঙ্গলবার দিনভর গুঞ্জন ছিল দুবাই পুলিশ আরাভকে আটক করেছে। তবে তাকে আটকের বিষয়টি কেউ স্বীকার করছে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আরাভের বিষয়ে ইন্টারপোলের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। তারা নিশ্চিত হয়েছেন যে, দুবাইতে থাকা আরাভের রেসিডেন্ট পারমিট সোমবার বাতিল করা হয়েছে। আটকের বিষয়ে তিনি বলেন,তাদের কাছে এ ধরনের কোনো তথ্য নেই। যতক্ষণ ইন্টারপোল বা দুবাই পুলিশ তাদের নিশ্চিত না করবে ততক্ষণ তারা গুঞ্জনকে পাত্তা দেবেন না। তবে তাকে আটকের জন্য ইন্টারপোলের মাধ্যমে তারা চেষ্টা করছেন। আরাভ আটক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের টিম দুবাই পাঠানো হবে। সে জন্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নেওয়া হয়েছে।
পুলিশের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, আরাভকে নজরদারির মধ্যে রাখা আছে বলে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে।
এদিকে পুলিশে একটি সূত্র জানিয়েছে, পুলিশ কর্মকর্তা খুনের পর আরাভ খান নামধারী রবিউল ভারতে পালিয়ে যান। আরাভ খান নামে ওই দেশের পাসপোর্ট নিয়ে পরে তিনি দুবাই চলে যান। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তার সে পাসপোর্ট বাতিল করেছে।
আটক হওয়ার বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) খন্দকার গোলাম ফারুক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ ধরনের তথ্য আমার কাছে নেই। তবে দ্রুত তাকে আটক করা যাবে বলে আশা করছি।’
গতকাল পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও বলেছেন, পুলিশ পরিদর্শক মামুন হত্যা মামলার পলাতক আসামি আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলাম দুবাইয়ে গ্রেপ্তার হননি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি এটুকুই বলতে পারি যে, বাংলাদেশের কোনো আসামি বন্ধু রাষ্ট্রে গিয়ে পালিয়ে থাকতে পারবে না। আরাভের গ্রেপ্তারের বিষয়ে ঢাকার পক্ষ থেকে অফিশিয়ালি দুবাইয়ে যোগাযোগ করা হয়েছে।’
গত সোমবার পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, আরাভ খানের বিরুদ্ধে রেড নোটিস জারি করার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করা হয়েছিল। ইন্টারপোল সেই আবেদন গ্রহণ করেছে।
জানা গেছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে গত সপ্তাহে এক জমকালো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আরাভ জুয়েলার্সের উদ্বোধন করার পর আলোচনায় আসেন জুয়েলার্সের মালিক আরাভ খান। ওই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ক্রীড়া ও বিনোদন জগতের অনেক তারকাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ফেসবুকে একাধিক পোস্ট দিয়েছিলেন তিনি। সেই তাকে পুলিশ সদস্য হত্যা মামলার আসামি বলে শনাক্ত করে ফেলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা। আরাভ জুয়েলার্স নামের ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক আরাভ খানের আসল নাম রবিউল ইসলাম। বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় তার বাড়ি। তিনি সোহাগ মোল্লা, হৃদয় শেখ, আপন এরকম কয়েকটি নামেও পরিচিত। ২০১৮ সালের ৭ জুলাই ঢাকায় পুলিশের পরিদর্শক মামুন ইমরান খান খুন হন। সেই খুনের আসামি হয়ে দেশ ছেড়েছিলেন রবিউল। দেশ ত্যাগের আগে ওই খুনের ঘটনার অন্য আসামিদের সঙ্গে আরাভকে আটক করেছিল ডিবি পুলিশ। ডিবি পুলিশ কার্যালয়ে দুদিন রাখার পর তাকে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তা ও রাজনৈতিক নেতার অনুরোধে ছেড়ে দেওয়া হয়।
মামলা ও নথিপত্র সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে বনানীর একটি ফ্ল্যাটে জন্মদিনের দাওয়াতে গিয়ে খুন হন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান। গুম করতে লাশ গাড়িতে করে নেওয়া হয় গাজীপুরের কালীগঞ্জের একটি জঙ্গলে। সেখানে লাশে পেট্রল ঢেলে আগুনে ঝলসে দেওয়া হয় চেহারা। সেই হত্যা মামলার অভিযোগপত্র অনুযায়ী পলাতক আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আপন। ওই বছরের ১০ জুলাই মামুনের ভাই ঢাকার বনানী থানায় মামলা করেন। এ মামলায় ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ।
মামলা ও নথিপত্র সূত্রে জানা যায়, নারীদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করে বিত্তশালীদের ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া একটি চক্রের কবলে পড়েন মামুন ইমরান খান। এরপর তাকে ধরে নিয়ে হত্যার পর পেট্রল ঢেলে লাশ পুড়িয়ে গাজীপুরের জঙ্গলে ফেলে দেয় হত্যাকারীরা। এ মামলার ৬ নম্বর আসামি হলেন আরাভ খান।
মামুন ইমরান হত্যা মামলায় বাদীর সাক্ষ্য : মামুন ইমরান খান হত্যা মামলার আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খানসহ আটজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন নিহতের ভাই ও মামলার বাদী জাহাঙ্গীর আলম খান। গতকাল তার সাক্ষ্য ও জেরা শেষ হয়। ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ফয়সাল আতিক বিন কাদের পরবর্তী সাক্ষ্যের জন্য আগামী ৪ জুন ধার্য করেন।
মামুন ইমরান হত্যা মামলার তদন্ত শেষে ডিবির পরিদর্শক শেখ মাহবুবুর রহমান ২০১৯ সালের ৮ এপ্রিল আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে আরাভের স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার কেয়া, ইমরানের বন্ধু রহমত উল্লাহ, স্বপন সরকার, দিদার পাঠান, মিজান শেখ, আতিক হাসান, সারোয়ার হোসেন এবং দুই কিশোরী রয়েছেন। তাদের মধ্যে আরাভ ও সুরাইয়া পলাতক, দুই কিশোরী অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তাদের বিচার হচ্ছে শিশু আদালতে এবং তারা জামিনে আছেন।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা জানান, হত্যা মামলা হওয়ায় পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীরা শুনানি করছেন। এ মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে ৩৮ জনকে।
স্বোপার্জিত স্বাধীনতাসহ অনেক ভাস্কর্যের শিল্পী শামীম সিকদার আর নেই। নিভৃতে জীবন কাটানো এই শিল্পী চলেও গেলেন খুব নিভৃতে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় একুশে পদকজয়ী ভাস্কর শামীম সিকদারের। আলোচিত কমিউনিস্ট নেতা সিরাজ সিকদারের বোন শামীম সিকদারের বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামীম সিকদারের ভাস্কর্যগুলোর কিউরেটর মো. ইমরান হোসেন জানান, ঢাবির চারুকলার সাবেক অধ্যাপক নিজের শিল্পকর্ম সংরক্ষণ করতে কয়েক মাস আগে যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরেছিলেন। তবে দেশে ফিরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রথমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। পরে তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখানে তিনি প্রায় এক সপ্তাহ লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। গতকাল বিকেল ৪টার দিকে মৃত্যু হয় তার।
তিনি জানান, শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আজ বেলা ১১টায় শামীম সিকদারের মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণে নেওয়া হবে। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তার মরদেহ শহীদ মিনার কিংবা তার যেকোনো একটি ভাস্কর্য প্রাঙ্গণে নিয়ে যাওয়া হতে পারে। তার পরিবারের সদস্য ও শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে দাফনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে
মোহাম্মদপুরে তার বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাকে দাফনের একটি পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
শামীম সিকদার ১৯৫২ সালের ২২ অক্টোবর বগুড়া জেলার মহাস্থান গড়ের চিংগাশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৫ বছর বয়সে তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে ভর্তি হন। পরে ১৯৭৬ সালে তিনি লন্ডনের স্যার জন কাস স্কুলে চলে যান। গত শতকের আশির দশকে চারুকলায় শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি।
১৯৭৪ সালে এই ভাস্কর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মরণে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অবস্থিত ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’ শিরোনামের ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। ভাস্কর্যটির মূল বেদিতে আছে একাত্তরের বিভিন্ন ঘটনার চিত্র। ১৯৮৮ সালের ২৫ মার্চ এটি স্থাপন করা হয়। স্বামী বিবেকানন্দের ভাস্কর্য নির্মাণ করেন ১৯৯৪ সালে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে স্থাপন করা হয়। ১৯৮০ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ললিতকলা অনুষদের একজন ফ্যাকাল্টি মেম্বার ছিলেন। তিনি ২০০০ সালে একুশে পদক পান।
শামীম সিকদারের ছাত্র ও বর্তমানে ঢাবি ভাস্কর্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুকুল কুমার বাড়ৈ প্রিয় শিক্ষকের মৃত্যুর পর দেশ রূপান্তকে জানিয়েছেন তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। তিনি বলেন, ‘শামীম আরা সিকদার ভাস্কর্য বিভাগে আমার শিক্ষক ছিলেন। তার মতো শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষক আজকের সময়ে খুবই কম পাওয়া যায়। তিনি অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের নানাভাবে সহযোগিতা করতেন, শিক্ষার্থীদের মুখ দেখলেই তিনি বুঝতে পারতেন শিক্ষার্থী হয়তো সকালের খাবার খেয়ে আসেনি, তিনি তৎক্ষণাৎ তার খাবারের ব্যবস্থা করতেন। অসচ্ছল মেধাবী শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য তিনি ক্লাস ওয়ার্কের বাইরে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করার জন্য বিভিন্ন ধরনের কমিশন ওয়ার্ক দিয়ে দিতেন। অত্যন্ত আধুনিকমনস্ক শিল্পী করে গড়ে তুলতে চেষ্টা করতেন শিক্ষার্থীদের। প্রচ- মাত্রায় পরিশ্রমী কাজপাগল একজন ভাস্কর ছিলেন তিনি।’
মুকুল কুমার বলেন, ‘বাংলাদেশের আধুনিক ভাস্কর্য চর্চার ইতিহাসে সামাজিকভাবে ভাস্কর্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তার অবদান বিশালতম। তিনি আপাদমস্তক একজন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। স্বাধীনতাসংগ্রামে অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ করার কথা মাঝেমধ্যে আমাদের শোনাতেন। বাংলাদেশের ভাস্কর্য চর্চার ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।’
শুরুতেই হোঁচট খেল এক বছরে বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের বর্ষপঞ্জি। প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পিছিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। প্রিলিমিনারির রেশ ধরে পেছাতে হবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সূচিও।
অথচ এই বিসিএস দিয়েই বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ এক বছরে শেষ করার ছক এঁকেছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অবস্থায় বর্ষপঞ্জিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি ৩০ নভেম্বর শুরু না করে ১ জানুয়রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৪৬তম বিসিএস থেকে পরিবর্তিত এক বর্ষপঞ্জিতেই বিসিএস শেষ করার নতুন পরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমরা ৪৬তম বিসিএস থেকে বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করব।’
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই সোহরাব হোসাইন এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার কথা বলেছিলেন। চাকরি জীবনে খ্যাতিমান এই আমলা এগিয়েছিলেনও বহুদূর। তিনি যখন চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন, তখন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩ বিসিএস চলমান ছিল। এর মধ্যে ৪০-এর সুপারিশ হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। ৪১তম বিসিএসের অর্ধেক মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মহামারির সময় চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ৪২তম বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয় এবং অল্প সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। আর ১৫ দিনের মধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ শেষ হবে। ৪৪তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যানের মূল টার্গেট ছিল এক বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএস শেষ করা। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়েছিল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছাপানোর জটিলতায় সূচি অনুযায়ী প্রিলিমিনারি নিতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি সচরাচর বিজিপ্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপাত।
বিসিএস বর্ষপঞ্জি কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিজিপ্রেস থেকে সরে আসে পিএসসি। তারা একটা বিশেষ জায়গা থেকে এ প্রশ্নপত্র ছাপায়। ৪৫তম বিসিএসে ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। ৬ সেট প্রশ্ন ছাপাতে হয়। সেই হিসাবে প্রায় ২১ লাখ প্রশ্নপত্র ছাপানোর প্রক্রিয়া সময়মতোই শুরু করে পিএসসি। দরসহ বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার কাজ আটকে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতৈক্য হলেও শিগগিরই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারছে না। ২৩ বা ২৪ মার্চ রোজা শুরু হবে। রোজায় এ বিশাল পরীক্ষা আয়োজনের কোনো রেওয়াজ নেই। পিএসসিও চায় না নতুন করে এর নজির তৈরি করতে। কাজেই মে মাসের আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মে মাসজুড়ে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হলে প্রিলিমিনরি নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিভাগীয় শহরের অনেক স্কুলে উভয় পরীক্ষার সিট পড়ে। সেই হিসেবে জুন মাসের আগে প্রিলিমিনারি নিতে পারছে না পিএসসি। এতে করে চার মাস পিছিয়ে যাবে ৪৫তম বিসিএসের সব ধরনের পরীক্ষা।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। একটা বিসিএসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এ থেকে পিএসসিকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছেলেমেয়েরা কাজবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণী পরিবারের ভরসাস্থল। তাদের দিকে চেয়ে থাকে পুরো পরিবার। বেকারত্বের বিষয়টি পিএসসিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবে। আগে অল্প দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারলে এখন কেন পারবে না? আগের চেয়ে পিএসসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে জানতে চাইলে কমিশনের একজন সদস্য বলেন, পিএসসি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরের অর্থাৎ ৪৬তম বিসিএস থেকে যেন এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা এখনই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা বিসিএস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সাধারণত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার এক মাস আগে পিএসসির একজন সদস্যকে ওই বিসিএসটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্ব এখনই একজন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। ওই বিসিএস সমন্বয় করবেন কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ।
কমিশনের সদস্য ও পিএসসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির সদস্যরা একমত হয়েছেন ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করে ১ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এতে প্রচলিত ক্যালেন্ডার ইয়ার ঠিক থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বর্ধিত সময়ে যাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে তাদের কী হবে। সেই সমস্যাটিও আলোচনা করে মোটামুটি সেরে রেখেছেন সদস্যরা। ৪৬তম বিসিএসে যারা বয়সের ফেরে পড়বেন তাদের বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। খুব শিগগির ওই বিসিএসের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু হবে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সিলেবাস নিয়ে। সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান থাকলেও সেই কাজ ৪৬ বিসিএসের আগে শেষ হবে না। কাজেই এক বছর আগেই প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজেও কোনো জটিলতা দেখছেন না পিএসসির সদস্যরা।
কিছুদিন ধরে পিএসসি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবর্তন আনা সেই সংস্কারেরই অংশ। পিএসসি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে চায়। মুখস্থ বিদ্যাধারীদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও তারা সিলেবাসে আমূল বদল আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায়ও পরিবর্তন এনেছে। কোনো চাকরি প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় তার জেলার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করা যাবে না। এ ধরনের প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি হয় বলে পিএসসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। পিএসসির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য পর্যন্ত চাকরি প্রার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পরীক্ষার প্রার্থীদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৫ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়। আদেশে বলা হয়েছে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য ‘কোডেড ফরম্যাটে’ থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সব তথ্যের কোডিং ও ডি-কোডিংয়ের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবে। কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন হলে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে ডি-কোডিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওই অফিস আদেশে।
৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আবেদন শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে চিকিৎসায়। সহকারী ও ডেন্টাল সার্জন মিলিয়ে ৫৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চিকিৎসার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ৪৩৭ জন। এরপর পুলিশে ৮০, কাস্টমসে ৫৪, প্রশাসনে ২৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্কোর কার্ডে জ্বলজ্বল করছে, বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী। তবুও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাওয়াশ, তাও টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন, তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এই ফল। লক্ষ্য ছিল ভালো ক্রিকেট খেলা, সে তো সবসময়ই থাকে। তবে বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডকে ঠিক পরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেই ৩-০-তে হারিয়ে দেওয়াটা যে স্বপ্নেরও সীমানা ছাড়িয়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজের একটা থ্রো। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১৪তম ওভারে বল করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের বলেই পেয়েছেন ডাভিড মালানের উইকেট। নতুন আসা ব্যাটসম্যান বেন ডাকেট। বলে ব্যাট লাগিয়েই ছুটলেন ডাকেট, অন্যপ্রান্ত থেকে জস বাটলার এসে স্ট্রাইকিং প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পয়েন্ট থেকে মিরাজের অসাধারণ থ্রো ভেঙে দেয় স্টাম্প। পরপর দুই বলে আউট দুই সেট ব্যাটসম্যান। তাতে রঙ বদলে যায় ম্যাচের। ১ উইকেটে ১০০ রান থেকে ৩ উইকেটে ১০০ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড, দুই প্রান্তে তখন দুই নতুন ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টি-টোয়েন্টির চ্যাম্পিয়নরা। পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে তাই আক্ষেপ করেই জস বাটলার বললেন, ‘পরপর দুই বলে দুই উইকেট হারানোটা খুব বাজে হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ম্যাচটা হারিয়েছে। আমি কেন যে ডাইভ দিলাম না এ নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে।’
২৪০ বলের ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ওই দুটো বলের ঘটনাই। মালান যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই হবে। ঢাকা লিগ ও বিপিএল খেলে যাওয়া মালান জানেন এই উইকেটে রান তোলার কৌশল, যা দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতানো শতরানের ইনিংস খেলে। কালও মনে হচ্ছিল মালানই তীরে তরী ভিড়িয়ে নেবেন, কিন্তু মোস্তাফিজের অল্প একটু বাড়তি লাফিয়ে ওঠা বলে পুল করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললেন এ বাঁহাতি। ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে যেটা তালুবন্দি করতে ভুল করেননি লিটন দাস। পরের বলে বাটলারের পড়িমরি করে ছুটেও রান সম্পূর্ণ করতে না পারা, মিরাজের দারুণ থ্রোর কাছে পরাস্ত হওয়া। এ দুটো বলই আসলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ইংল্যান্ডের। অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ১৫৯ রানের লক্ষ্য ভালোভাবেই উতরে যাবে ইংলিশরা। টস জিতে আগে বোলিং নেন বাটলার। লিটন ও রনি তালুকদারের ৫৫ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আদিল রশিদ, রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ দেন ২২ বলে ২৪ রান করা রনি। অবশ্য তার ইনিংসের ইতি ঘটতে পারত আগেই, রনির ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন রেহান আহমেদ। জীবন পেয়েছেন লিটনও, তার ক্যাচ ছেড়েছেন বেন ডাকেট। ১৪তম ওভারের প্রথম বলে লিটন ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডিপ-মিডউইকেটে, কিন্তু ডাকেট বলটা হাতে জমাতে পারেননি। দুবারই দুর্ভাগা বোলারটির নাম জোফরা আর্চার।
৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হন লিটন, নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান করে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিটা কমে আসে বাংলাদেশের। ১৫ ওভার পর যেখানে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ১৩১, সেখানে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ২ উইকেটে ১৫৮ রানে। শেষ ৩০ বলে ৯ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ তোলে মাত্র ২৭ রান তখন মনে হচ্ছিল বেশ ভালো ব্যাটিং উইকেটে অন্তত ২০-২৫টা রান কম হয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যাটিংয়ের শেষটা আর বোলিংয়ের শুরুটা, দুটো পক্ষে যায়নি বাংলাদেশের। অভিষিক্ত তানভীর ইসলাম ফিল সল্টকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের বলে ডাভিড মালানের বিপক্ষে মাঠের আম্পায়ার এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিলেও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। বাটলারকে নিয়ে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদের ব্যাটে ইংল্যান্ড ছিল জয়ের দিশাতেই কিন্তু পরপর দুই বলে দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ে বিপদে পড়া ইংল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি হারের বৃত্ত থেকে। একে একে মইন আলি (৯), বেন ডাকেট (১১) ও স্যাম কারেনের (৪) উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকা রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭ রান, ক্রিস ওকস প্রথম দুই বলে দুটি চার মারলেও পরের বলগুলোতে আর পাননি বাউন্ডারির দেখা। ইংল্যান্ড থেমে যায় ৬ উইকেটে ১৪২ রানে, ১৬ রানের জয়ে সিরিজ ৩-০-তে জিতে নেয় বাংলাদেশ।
দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের, তবে তার সঙ্গে মিশে আছে ঘরের মাঠে পছন্দসই উইকেট বানিয়ে জেতার সমালোচনাও। এবারের সিরিজ জয়ে সেই কালিমা নেই, বরং আছে বিশ্বজয়ীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জেতার গর্ব। সাকিব তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি আমাদের ম্যাচ জিততে হবে বা এমন কিছু। আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাটিংয়ে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংটা আমাদের তিনটি ম্যাচেই আমার মনে হয় অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে।’
ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সেটাও টি-টোয়েন্টিতে, যে সংস্করণে বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। সাকিব এ সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে। যেখানে ভালো করা ক্রিকেটাররাই ভালো করেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাতেই এসেছে অবিস্মরণীয় এই জয়, যে অর্জন টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে চেনাল নতুন করে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।