
রাজধানীর আজিমপুর গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষার্থীসংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি। পুরনো ভবনে শিক্ষার্থীদের স্থান সংকুলান না হওয়ায় প্রায় ছয় মাস আগে পাঁচতলা একটি নতুন ভবন হয়েছে। কিন্তু ভবন হলেও সেখানে কোনো আসবাবপত্র সরবরাহ করা হয়নি। আগামী বছরের শুরুতেও সেখানে আসবাবপত্র সরবরাহের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এখনো ভবনটি অব্যবহৃতই আছে।
প্রতিষ্ঠানটির সহকারী প্রধান শিক্ষক গৌতম চন্দ্র পাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের ক্লাসরুমের সংকট রয়েছে। ক্যানটিন ও ল্যাবরেটরি করার জন্যও জায়গার প্রয়োজন। এসব আমরা নতুন ভবনে করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভবন নির্মাণ শেষ হলেও কোনো আসবাবপত্র দেওয়া হচ্ছে না। সংকটের মধ্য দিয়েই শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে।’
জামালপুর, মৌলভীবাজার, দিনাজপুর, রংপুর প্রভৃতি জেলায়ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণ শেষ হয়েছে। সেসব স্কুল থেকে প্রতিনিয়ত আসবাবপত্রের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। সেখানকার কর্তৃপক্ষ আগামী শিক্ষাবর্ষের শুরু থেকে নতুন ভবনে ক্লাস করতে চায়।
প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৭১টি নতুন ভবনের জন্য প্রায় ২৫০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। ভবন নির্মাণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেঞ্চ-টেবিলসহ প্রয়োজনীয় ফার্নিচার দেওয়ার কথা। এরপর ভবনের ব্যবহার শুরু হবে। কিন্তু ভবন নির্মাণ ছয় মাস আগে শেষ হলেও আসবাবপত্র সরবরাহ করা হয়নি। অথচ ৭১টি ভবনে সর্বোচ্চ ২৫ কোটি টাকার আসবাবপত্রের প্রয়োজন হতে পারে।
জানা যায়, জেলা পর্যায়ের সরকারি জেলা স্কুলগুলো অনেক পুরনো। অনেক আগে এসব স্কুলে ভবন হলেও নতুন ভবন তেমন একটা হয়নি। সরকারি নতুন স্কুলগুলোতে নতুন নতুন ভবন হলেও জেলা স্কুলগুলো ছিল দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত। ফলে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলছে শ্রেণিকক্ষ সংকট। সে জন্য সরকার ২০১৭ সালে ‘সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে ৩ হাজার ২৮৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়, যার কাজ মূলত ২০১৮ সালে শুরু হয়। এর আওতায় ৩২৩টি স্কুলে নতুন ভবন নির্মাণ, ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ, দুর্গম এলাকায় ২৪টি হোস্টেল নির্মাণ, আসবাবপত্র কেনা, কম্পিউটার সামগ্রী ও বই কেনা, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও ক্রীড়াসামগ্রী কেনার কথা রয়েছে। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৪ হাজার ৬৫৩টি নতুন কক্ষ যুক্ত করার কথা।
সূত্র জানায়, ১০২টি ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণযোগ্য ভবনের মধ্যে গত আগস্টে ৭০টির কাজ শেষ হয়েছে। ৫টি ভবনের নির্মাণকাজ ৮০ থেকে ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত, চারটি ভবন ৬০ থেকে ৭৯ শতাংশ পর্যন্ত, চারটি ভবন ৪০ থেকে ৫৯ শতাংশ পর্যন্ত, সাতটি ভবন ২০ থেকে ৩৯ শতাংশ পর্যন্ত এবং সাতটি ভবনের কাজ ১৯ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে।
আর ৩২০টি নতুন একাডেমিক ভবনের ১৭২টি হবে জেলা পর্যায়ে আর ১৪৮টি হবে উপজেলা পর্যায়ে। জেলা পর্যায়ে ছয়তলা ভবনের বদলে ১০ তলা ভবন করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হওয়ায় ১৬২টি ভবন নির্মাণের কাজ স্থগিত রয়েছে। ১৪৫টির দরপত্র আহ্বান শেষ হয়েছে। প্রক্রিয়াধীন রয়েছে তিনটি ভবনের কাজ। ১৩৭টি চলমান কাজের মধ্যে গত আগস্টে একটি ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। ৩২টি ভবনের কাজ ৮০ থেকে ৯৯ শতাংশ, ৩৫টির ৬০ থেকে ৭৯ শতাংশ, ২৬টির ৪০ থেকে ৫৯ শতাংশ, ২৪টির ২০ থেকে ৩৯ শতাংশ এবং ১৯টির ১৯ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
‘সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো উন্নয়ন প্রকল্প’-এর পরিচালক অধ্যাপক মো. নাসির উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ইতিমধ্যে ৭০টি ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ ও একটি নতুন ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে আরও প্রায় ৩৭টি ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। শতভাগ কাজ সম্পন্ন হওয়া স্কুলগুলোর প্রধান শিক্ষকরা আসবাবপত্রের জন্য আমাদের ফোন দিচ্ছেন। চলতি অর্থবছরে আসবাবপত্রের জন্য যে বরাদ্দ রয়েছে তাতে আমরা সর্বোচ্চ দুই-তিনটি ভবনের আসবাবপত্র কিনতে পারব। ফলে আগামী অর্থবছরের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।’
অধ্যাপক মো. নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের প্রকল্পের গড় অগ্রগতি ৩০ শতাংশের বেশি। করোনার জন্য গত দুই অর্থবছরে কাজ তেমন এগোয়নি। প্রকল্পটি অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক ‘বি’ ক্যাটাগরির ঘোষিত হওয়ায় খাতওয়ারি অর্থছাড় স্থগিত আছে। এটির মেয়াদ ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ‘কোনো স্কুল ভবনের নির্মাণকাজ ৫০ শতাংশ শেষ হলেই আসবাবপত্র সরবরাহের দরপত্র প্রক্রিয়ার কাজ শুরু হয়। কিন্তু এ প্রকল্পের ক্ষেত্রে তা দেখা যায়নি। চলতি অর্থবছরেও এসব ভবনের আসবাবের জন্য বরাদ্দ নেই। ফলে এসব ভবন রক্ষণাবেক্ষণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।’
জানা যায়, ‘বি’ ক্যাটাগরির হওয়ায় এই প্রকল্পে ২০২২-২৩ অর্থবছরে যা বরাদ্দ রয়েছে সেখান থেকে ৫০ শতাংশ অর্থ ছাড় করা হবে। সে হিসেবে এ অর্থবছরে এই প্রকল্পে খরচ করা যাবে ২০০ কোটি টাকারও কম। এর প্রায় সবটকুই চলমান নির্মাণকাজের বিল পরিশোধে ব্যয় হবে। এর বাইরে দুই-তিনটি স্কুলের আসবাব, খেলাধুলার সামগ্রী কেনাসহ বেশকিছু কাজের পরিকল্পনা রয়েছে।
সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো উন্নয়নবিষয়ক প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন হয় ২০১৭ সালের ২১ মার্চ। পরিকল্পনা কমিশনের প্রশাসনিক আদেশ হয় ২০১৮ সালের ১০ মে। ওই বছরের ২০ মে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক আদেশ জারি হয়। ২০১৮ সালের ২৪ মে প্রকল্প-পরিচালক নিয়োগ করা হয়। করোনার কারণে ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রকল্পের কাজ খুব একটা এগোয়নি। তাই প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৬ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে প্রকল্পের অর্থ তেমন ছাড় হচ্ছে না। যতটুকুই কাজ হয়েছে এর সুফলও পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা।
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। বিএনপির এটা জানা দরকার জনগণের ভোট চুরি করলে, তারা ছেড়ে দেয় না। জনগণ জানে কীভাবে সেই সরকার উৎখাত করতে হয়। আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়। আমরা ভোট চুরি করতে যাব কেন? জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের ভোট দেয়।’ গতকাল মঙ্গলবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের ৩০তম জাতীয় সম্মেলনে এসব কথা বলেন শেখ হাসিনা।
বেলা ১১টা ২০ মিনিটের পরে তিনি সম্মেলনস্থলে উপস্থিত হন। এরপর জাতীয় পতাকা, দলীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। এবার রেওয়াজ পাল্টে সংগঠনের সম্মেলন এক দিনেই করা হয়। তবে গতকাল দুপুরের পরে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে দ্বিতীয় অধিবেশন হয়। সেখানেও ছাত্রলীগের নেতৃত্বে নতুন কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানান, ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় ত্রিবার্ষিক সম্মেলনের আগে ছাত্রলীগের নতুন নেতৃত্ব ঘোষণা করা হবে। এ প্রসঙ্গে অন্য একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, ৯ বা ১০ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের শীর্ষ পদের নেতাদের নাম ঘোষণা আসবে। ওবায়দুল কাদের তা জানিয়ে দেবেন।
ছাত্রলীগের সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপির কাজই হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করা। এখনকার ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তো নতুন, পুরনো যে নেতাকর্মী রয়েছে, নিশ্চয়ই তাদের মনে আছে। খালেদা জিয়া হুমকি দিয়েছিল আওয়ামী লীগকে শিক্ষা দিতে তার ছাত্রদলই যথেষ্ট। তাই ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিল। আমি এর প্রতিবাদে ছাত্রদের হাতে বই, খাতা, কলম তুলে দিয়েছিলাম। আমাদের শক্তি জনগণ। আমাদের পেটোয়া বাহিনী লাগে না। কিন্তু ছাত্ররা শিক্ষাগ্রহণ করে উপযুক্ত নাগরিক হবে। ভবিষ্যতে দেশের দায়িত্বভার নেবে। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
বিএনপির জন্ম সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের পকেট থেকে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। গণতন্ত্র উদ্ধার নিয়ে তাদের আন্দোলনের বিষয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘সেনানিবাসে বসে গোয়েন্দাদের সহায়তায় এ দল গঠন। সেই দল কিছু রাজনীতি শিখেছে আমাদের সঙ্গে যৌথ আন্দোলন করে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে কিছু শিখেছে। তা ছাড়া তাদের রাজনীতি কী ছিল?’
আওয়ামী লীগ সব সময় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে বলে দাবি করেন তিনি। বলেন, ‘যতবার ক্ষমতায় এসেছে, জনগণের ভোট নিয়ে সরকারে এসেছে। কখনো ভিন্ন পথে সরকারে আসে নাই। আসবেও না।’
আওয়ামী লীগের অপরাধ কী? জানতে চান প্রধানমন্ত্রী। সরকার গঠনের পরে মানুষের জন্য কাজ করার কথা জানান তিনি। বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০০১ সালেই শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছিল। এ ছাড়া আর কোনো দিন কি দেশে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে? কখনো হয়নি। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস করে।’
২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি আসনভিত্তিক মনোনয়ন-বাণিজ্য করেছিল বলে দাবি করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, সেখানে হলো টাকার খেলা। শেষে সরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমাদের নির্বাচন করতে দিল না।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিএনপির দুজন নেতা আমার কাছে এসে নালিশ করে গেছে। সিলেটের ইনাম আহমেদ চৌধুরী এসে বললেন, “দেখো আমার কাছে টাকা চেয়েছে তারেক জিয়া, আমি দিতে পারি নাই। আমার মনোনয়ন বাতিল করে যার কাছ থেকে টাকা পেয়েছে, তাকে দিয়েছে।” ‘মোর্শেদ খান নিজে এসে বলেছেন তার কাছে মোটা অঙ্কের টাকা চেয়েছে। সে জন্য তিনি বলেছেন, “আমি এই টাকা দিতে পারব না। তাই তার মনোনয়ন বাতিল করা হলো।” এই হলো ২০১৮ সালের তাদের নির্বাচন।’
খালেদা জিয়া এতিমের টাকা আত্মসাৎ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার প্রশ্ন অনেক জ্ঞানী-গুণী বিএনপির সঙ্গে হাত মেলায়। অনেক তত্ত্ব কথা শোনায়। গণতন্ত্রের সবক দেয়। গণতন্ত্র উদ্ধার করতে চায়। এরা নিজেদের বুদ্ধিজীবী বলে। আমি বলি, বুদ্ধি প্রতিবন্ধীজীবী। তারা সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে নেতা মেনে তাদের সঙ্গে জড়ো হয় সরকার উৎখাতের জন্য।’
ব্যাংকে টাকা নেই এ ধরনের গুজবে কান না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ব্যাংকে টাকার কোনো সমস্যা নেই, দেশের প্রতিটি ব্যাংকে টাকা আছে। এটা আমি আগেও বলেছি, এখনো বলি। এদের কি চোরের সঙ্গে কোনো সমঝোতা আছে কি না যে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ঘরে রাখলে চোরের পোয়া বারো, চোর চুরি করে খেতে পাবে।’
এসডিজি সচিব, অর্থ সচিব এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেছি। আমাদের কোনো সমস্যা নাই, প্রতি ব্যাংকেই টাকা আছে। কাজেই আমি বলব, গুজবে কেউ কান দেবেন না।’
সম্মেলনে ছাত্রলীগের বিদায়ী সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় সভাপতিত্ব ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য সঞ্চালনা করেন। বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
পটুয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ ইউনিয়নের দিয়ারচর ও উত্তর চরমোন্তাজ গ্রাম। দুই গ্রামের মাঝে প্রায় আড়াইশ ফুট প্রশস্ত এক খাল। দিয়ারচরের শিক্ষার্থীদের ওই খাল পার হয়েই প্রতিদিন যেতে হয় উত্তর চরমোন্তাজের মাঝেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তবে খাল পার হওয়ার জন্য না আছে সেতু, না আছে সাঁকো। নেই খেয়া পারাপারের ব্যবস্থাও। অগত্যা প্রাইমারি পড়–য়াদের খাল সাঁতরেই যেতে হয় স্কুলে। শীত বা বর্ষা নেই, সব মৌসুমেই বই-খাতার সঙ্গে রান্নার হাঁড়ি নিয়ে রওনা করে শিক্ষার্থীরা। হাঁড়ির মধ্যে বইপুস্তক আর স্কুলের পোশাক নিয়ে পার হয় খাল। ভেজা জামা কাপড় রোদে শুকাতে দিয়ে স্কুল পোশাক পরে ছোটে ক্লাসে।
দিয়ারচরের অর্ধশত শিশুশিক্ষার্থী এভাবে খাল সাঁতরে স্কুলে আসা-যাওয়া করে। তাদেরই একজন শিক্ষার্থী জান্নাতুল (৮)। তৃতীয় শ্রেণি পড়–য়া এ শিক্ষার্থী বলে, ‘আমাদের আসতে অনেক ভয় হয়। দুই-একসময় হাত থেকে পাতিল (হাঁড়ি) ছুইট্টা (ছুটে) যায়। আমরা অনেক কষ্ট করি। দুই-তিন দিন আগে হাত থেকে পাতিল ছুইট্টা গেছে। আমরা অনেক কান্না করছি। কেউ ছিল না। পরে আমরাই আস্তে আস্তে কিনারে আনছি। বই-খাতা ভিজে গেছে। এখনো শুকায়নি।’
জান্নাতুলের মতো ওই স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির নাসরিন, চতুর্থ শ্রেণির কেয়ামণি, নাজমুলের ভাষ্য, খাল সাঁতরে স্কুলে যেতে ভয় করে ওদের। কষ্ট হয় এই শীতে খাল পার হতেও। খালটিতে একটি সেতু নির্মাণের দাবি তাদের।
স্থানীয়রা জানান, খাল পেরিয়ে স্কুলে যেতে হয় শিশুদের। কেউ খাল সাঁতরে পার হয়। কেউ আবার পার হয় নৌকায়। কাঁচা হাতে নিজেই নৌকার বৈঠা বেয়ে খাল পার হওয়া দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ইউসুফ বলে, ‘যহন (যখন) নৌকা পাই, তহন স্কুলে আই (আসি)।’
দিয়ারচর গ্রামের হোসেন মিয়া বলেন, ‘আমার দুই ছেলে এই স্কুলে পড়ে। সপ্তাহখানেক আগে আমার এক ছেলে খাল পার হতে গিয়ে ডুবে যাওয়া ধরছে। আমি এসে উডাউয়া (উঠিয়ে) স্কুলে দিয়ে গেছি। আমার অনেক কষ্টে এই দুই ছেলে এখন স্কুলে আনা-নেওয়া করতে হয়। এর চেয়ে এখানে একটি স্কুল হলে ভালো হয়। আর তা না হলে এই খালে একটি ব্রিজ হলেও ছেলেমেয়েদের স্কুলে পড়তে দেওয়া যায়।’
স্কুল কর্র্তৃপক্ষ জানায়, স্থানীয়দের উদ্যোগে কয়েকবার বাশের সাঁকো নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু নোনা জলে সাঁকো বেশিদিন টেকে না। ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলে সাঁকো থাকাকালে ৩০০-৪০০ শিক্ষার্থী ছিল। এরমধ্যে প্রায় দুইশ শিক্ষার্থী ছিল ওই দুই চরের। সাঁকো না থাকায় এখন শিক্ষার্থী কমে গেছে। এখন দুই চর থেকে ৫০ জনের মতো শিক্ষার্থী আসে। এদের কেউ কেউ নিয়মিত আসেও না।
মাঝেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘দিয়ারচর ও উত্তর চরমোন্তাজের শিক্ষার্থীরা পাতিল নিয়ে খাল সাঁতরে এই বিদ্যালয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আসে। অনেক অভিভাবকই এই ঝুঁকি নিয়ে ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়ে আসতে দেয় না। যদি স্কুলের পূর্ব পাশের এই খালে একটি ব্রিজ হতো, তাহলে শিশুশিক্ষার্থীরা এই ঝুঁকি থেকে রেহাই পেত। এই শীতের সময়ে শিক্ষার্থীদের অনেক কষ্ট হয়। অনেকেই প্রায় পাঁচ কিলোমিটার ঘুরে স্কুলে আসে। অনেকে নিয়মিত স্কুলেও আসতে পারে না।’
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘দুর্গম এলাকা থেকে শিক্ষার্থীদের একটি খাল পেরিয়ে স্কুলে আসতে হয়। সেখানে একটি ব্রিজ নির্মাণের জন্য বেশ কিছুদিন আগে কর্র্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাবনা দিয়েছি। এই মুহূর্তে জরুরি ভিত্তিতে বিকল্প কী করা যায় সে জন্য ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষ, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আছে তাদের সঙ্গে আলাপ করে অতিদ্রুত বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করব।’
এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী মিজানুল কবির বলেন, ‘আমরা সেখানকার খোঁজখবর নেব। প্রয়োজনে ব্রিজ নির্মাণের জন্য প্রস্তাবনা পাঠাব।’
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ডা. জহির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা জেনেছি শিশুশিক্ষার্থীরা বই-খাতা এবং জামা-কাপড় পাতিলে ভরে সাঁতার কেটে স্কুলে যায়। যেটা জেনে আমার কাছে খুব খারাপ লেগেছে। কোমলমতি শিশুদের পারাপারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ সালেক মুহিদ বলেন, ৭ ডিসেম্বর আমাদের মাসিক মিটিংয়ে বিষয়টি উত্থাপন করব। দ্রুত বিষয়টি সমাধানের জন্য রাজস্ব তহবিল অথবা পিআইও অফিসের প্রকল্পের মাধ্যমে ওখানে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।’
মুক্তিযুদ্ধের ১৬টি সফল মিশনের বিস্তারিত ধারাবাহিকভাবে লিখছেন সালেক খোকন
মেলাঘর থেকে ৫২ জনের গেরিলা দল নিয়ে আমরা আসি রোহা গ্রামে। ধামরাই-মানিকগঞ্জ বর্ডারে গ্রামটা। কমান্ডার ছিলেন রেজাউল করিম মানিক (পরে তিনি শহীদ হন)। সহ-কমান্ডার ছিলেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। তখন রোহা গ্রামের আশপাশে রাজাকারদের আধিপত্য ছিল। প্রথমেই তাদের নিউট্রালাইজড (নিষ্ক্রিয়) করার কাজে নামি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে অ্যাটাক করেছি। সন্ধ্যায় ভাত খেয়েই অপারেশনে বের হয়ে যেতাম। ফলে পুরো এলাকা আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কিন্তু আমাদের অপারেশন করতে হবে মূলত ঢাকায়; যাতে বিশ্বগণমাধ্যমে সে খবর ছড়িয়ে পড়ে। মানিক ভাই মগবাজার, তেজগাঁও, সিদ্ধেশ্বরী, মোহাম্মদপুরে পরিচিতদের বাসায় অস্ত্র রাখার ব্যবস্থা করেন। তেজগাঁওয়ে অস্ত্র থাকত সাহার বাড়িতে। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক দিন আগে রাজাকাররা সে কথা জেনে যায়। সাহা ও তার ভাইদের গুলি করে হত্যা করে তারা।
রোহা গ্রাম থেকে নৌকায় সাভারে; সেখান থেকে বাসে ঢাকায় ঢুকতাম। পরিচিতদের বাসায় আত্মগোপন করে থাকতে হতো। ট্রেনিংয়ে বলা ছিল, তোমরা এক জায়গা থেকে গিয়ে অপারেশন করে উঠবা আরেক জায়গায়। অন্যরা জানবে না তুমি কোথা থেকে আসছ এবং কোথায় যাবে। তবে সবাই জানবে কোন জায়গায় তোমরা মিট করবে। কেউ মিট না করলে বুঝতে হবে সে নিউট্রালাইজড হয়েছে বা ধরা পড়েছে। পাকিস্তানি সেনারা তাকে মেরে ফেললেও যেন অন্য গেরিলাদের ঠিকানা না পায়, এ কারণেই ছিল এই কৌশল। অপারেশনের সময় অস্ত্র কোথা থেকে তুলব, কোথায় ড্রপ করব, এটা শুধু জানতে চাইতাম। গেরিলা হিসেবে এ বিষয়গুলো কঠোরভাবে মেনে চলতে হতো আমাদের।
একাত্তরে ঢাকার গেরিলাদের নানা কৌশল ও বীরত্বের কথা এভাবেই তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা তৌফিকুর রহমান।
আবু নাঈম মো. মুছাদ্দিকুর রহমান ও মাহবুবা রহমানের বড় সন্তান তৌফিকুর রহমান। বাবা ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সচিব। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়, কাঁঠালবাগানে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন ঢাকা শাহীন স্কুলের মেট্রিক পরীক্ষার্থী। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি চলে যান ভারতে। ১২ নম্বর প্লাটুনে এক মাসের প্রশিক্ষণ নেন মেলাঘরে। ২ নম্বর সেক্টরের অধীন গেরিলা অপারেশন করেন ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। তার নেতৃত্বেই কাকরাইল পেট্রলপাম্প উড়িয়ে দেওয়া হয়।
কীভাবে হয়েছিল সেই অপারেশন?
তৌফিকুর রহমান বলেন, একদিন মানিক ভাইকে বললাম আমদের যেহেতু এক্সপ্লোভিস ট্রেনিং আছে; সঙ্গে আছে প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ ও ফসফরাস গ্রেনেড। তাই ঢাকায় পাকিস্তানি আর্মি বা পুলিশ থাকে এমন জায়গার আশপাশে বড় বিস্ফোরণ ঘটাতে চাই। তিনি বলেন, কেমনে করবা? বললাম, দুটো দিন সময় দিলে পুরো প্ল্যানটা করা যাবে। তিনি সময় দিলেন।
আলতাফ হোসেন টুনিকে নিয়ে রেকি করতে বের হই। কাকরাইল পেট্রলপাম্পটি ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের খুুব কাছে। সেটাই বেছে নিই। পাম্পের উল্টোদিকে ছোট একটা টং দোকান ছিল। সেখানে চা খেতে খেতে কোথায় এক্সক্লোসিভ লাগাব, ওয়েট (চাপা দেওয়ার মতো ভারী জিনিস) দেওয়ার মতো কী আছে, কয়জন ডিউটি করে সব দেখে আসি। ক্যাম্পে এসে মানিক ভাই ও বাচ্চু ভাইকে নিয়ে পুরো প্ল্যানটা করি। চারজন লাগবে। আমি আর টুনি যাব। সঙ্গে থাকবে আরও দুজন। কিন্তু বিস্ফোরণ ঘটলে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস থেকে পুলিশ আসতে এক মিনিটও লাগবে না। পালাব কীভাবে?
খন্দকার মাহাবুব উদ্দিনের ছেলে নেহাল ছিল বন্ধু। তার কাছে গাড়ি চাইলাম। সে বলল, রোজার মাস। আব্বা তো গাড়ি বের করতে দেয় না। শুধু ইফতারের সময় বের হই। তখনই মাথায় ক্লিক করে ‘দ্যাট ইজ দ্য বেস্ট টাইম।’ তাকে রাজি করালাম। ক্যাম্পে ফিরে মানিক ভাইকে বললাম, একটা স্টেনগান লাগবে দুটো ম্যাগাজিন ফুল লোডেড। তারা বললেন, মহাখালী ওয়্যারলেস গেটে গেলে ফেরদৌস নামের একজন তোমাদের আর্মস দেবে। অপারেশন শেষে সেটা রাজারবাগের শেল্টারে রেখে যাবে।
১ নভেম্বর ১৯৭১। মানিক ভাই দুটো ছেলে দিলেন। ওরা বাজারের ব্যাগে করে এক্সপ্লোসিভ নিয়ে আসে। আমি আর টুনি রিকশায় মহাখালী ওয়্যারলেস থেকে একটা কম্বলে মোড়ানো স্টেনগান নিয়ে গন্তব্যে যাই। নেহালও গাড়ি নির্দিষ্ট জায়গায় পার্ক করে; স্টার্ট দেওয়া অবস্থায় গাড়ির তিনটি দরজাও খোলা রাখে। ইফতারের ঠিক আগে চোখের ইশারায় চারজন মুভ করলাম। আমি আর টুনি স্টেনগান নিয়ে পাম্পের বাইরে যে দুজন কাজ করছিল তদের নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। পর্দা টেনে দিয়ে সবাইকে বললাম, চুপ করে বসেন। আপনাদের কোনো ক্ষতি করা হবে না। একটা বোমা লাগানো হচ্ছে এখানে। এরপর আপনারা দৌড়ে সরে যাবেন।
দুজন গেরিলা আমার নির্দেশ মোতাবেক বাইরে এক্সপ্লোসিভ লাগাতে থাকে। বালিভর্তি দুটি বালতি এক্সপ্লোসিভের ওপর চাপা দেয়। প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভের সঙ্গে ডেটোনেটর সেট করে দুই মিনিটের ফিউজ লাগায়। ফিউজে আগুন দিয়েই ওরা ডাক দেয় আমাদের। তখন পাম্পের লোকদের বলি, তোমরা শুধু দৌড়াতে থাকবে। নইলে মারা পড়বে। এটা বিশাল বোমা। আমরাও দ্রুত গাড়িতে উঠে সরে পড়লাম।
একদম টাইমমতো সব হয়েছিল। রাজারবাগ এলাকায় ওমর নামে এক মুক্তিযোদ্ধার বাড়িটি ছিল শেল্টার। সেখানে আমাদের নামিয়ে দিয়ে নেহাল মাত্র গাড়িটি স্টার্ট দিয়েছে; তখন বিশাল বিস্ফোরণ। গোটা পেট্রলপাম্প ওই বিস্ফোরণে উড়ে গিয়েছিল। পুরো ঢাকা কেঁপে ওঠে। আমরা আনন্দে একে অপরের মুখের দিকে তাকাই। আমি টুনির, টুনিও আমার হাত চেপে ধরে। মনে হচ্ছিল চিৎকার দিয়ে বলি ‘জয় বাংলা’। এরপর শেল্টারে অস্ত্র রেখে রিকশায় যে যার মতো সরে পড়ি।
ঢাকায় পেট্রলপাম্প উড়িয়ে দিয়েছে গেরিলারা এ সংবাদ প্রচার করে বিবিসি। পরদিন ইত্তেফাকসহ জাতীয় দৈনিকগুলোতে শিরোনাম হয় ‘ঢাকার কাকরাইলে বোমা বিস্ফোরণ’। ইত্তেফাকের ওই সংখ্যাটা এখনো সংগ্রহে আছে। ঢাকা যে শান্ত না, ঢাকায় গেরিলা ঢুকে পড়েছে ওই অপারেশনের পর এটা স্পষ্ট হয়ে যায়। সব দিক থেকেই অপারেশনটা সাকসেসফুল ছিল। মনে হলে এখনো শিহরিত হই।
স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে সহ্য করতে পারেন না এই গেরিলা যোদ্ধা। নতুন প্রজন্মকে বিশ্বাসী হিসেবে তৈরি করতে হলে নিজেদের আগে অনেস্ট হতে হবে। দেখাতে হবে, আমরাও ভালো কাজ করছি। না হলে প্রজন্মও তৈরি হবে না, মনে করেন এই সূর্যসন্তান। বর্তমান প্রজন্মের উদ্দেশে মুক্তিযোদ্ধা তৌফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা খুব কষ্ট করেছি। একাত্তরে পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর অনেক অত্যাচার করেছে। তোমরা আমাদের একাত্তরের ত্যাগের ইতিহাসটুকু জেনে নিয়ো। মনে রেখো, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসই তোমাদের পথ দেখাবে।’
নতুন গোলের মানুষ এসে গেছেন পর্তুগালে। এতদিন গোলের দায়িত্বটা যার কাঁধে ছিল, পর্তুগাল ফুটবল ইতিহাসের সেরা তারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে বেঞ্চে পাঠিয়ে বিশ্বকাপে পর্তুগালের প্রথম একাদশে অভিষেক হয়েছে অবিশ্বাস্য গোল বিস্ফোরণে। আগের দুই ম্যাচে বদলি হয়ে নামা গনসালো রামোসের দুর্দান্ত হ্যাটট্রিকে পতুর্গাল ৬-১ গোলে সুইজারল্যান্ডকে হারিয়ে পৌঁছে গেছে কোয়ার্টার ফাইনালে।
প্রথমবারের মতো তিনি একাদশে আসেন ঠিক রোনালদোর জায়গায়। বয়স পর্তুগিজ ফুটবলের মহাতারকার যৌবন কেড়ে নিয়েছে, তাই তার জায়গায় রামোসের তারুণ্যের সংযোজন। সুযোগটি এভাবে কাজে লাগিয়ে বিশ্বকাপ রাঙিয়ে দেবেন, সেটাও হয়তো ভাবেননি ২১ বছর বয়সী বেনফিকার ফরোয়ার্ড। ১৭ মিনিটে তার দুর্দান্ত প্রথম গোলের পর একটু যেন ফ্যাকাসে হয় রোনালদোর চেহারা। দ্বিতীয় গোলের পর সেই চেহারায় যৎসামান্য হাসি। হ্যাটট্রিক গোলে যেন তিনি আরও হতবাক! বেঞ্চে বসেই দেখলেন তার রাজত্বে নতুনের আগমনী বেজে উঠেছে। নতুনকে জায়গা ছাড়া বড় কঠিন, তবে এ নতুনই হয়তোবা রাঙিয়ে দেবেন রোনালদোর শেষ বিশ্বকাপ।
২০০৮ সালের পর আর কখনো পর্তুগালের প্রথম একাদশের বাইরে থাকেননি রোনালদো। ৩৮ ম্যাচ পর বয়স আর পড়তি ফর্মে তাকে যেতে হয়েছে বেঞ্চে। হয়তো বিশ্বকাপের বাকি সময়টায় আর প্রথম একাদশে ফেরা হবে না পর্তুগিজ রাজার। এমন অভিষেকের পর নিশ্চয়ই কোচ ফার্নান্দো সান্তোস রামোসকে বসিয়ে রাখার ভুল করবেন না।
এই রামোসের কল্যাণেই ৫৬ ম্যাচে এসে প্রথম হ্যাটট্রিক দেখল মরুর বিশ্বকাপ। তাকে নিয়ে বিশ্বকাপের ইতিহাসে হ্যাটট্রিক করা ফুটবলারের সংখ্যা দাঁড়াল ৪৯ জন। তবে হ্যাটট্রিক সংখ্যা ৫২টি। রামোসের লুসাইল স্টেডিয়ামের সব আলো কেড়ে নেওয়ার শুরু ১৭ মিনিটে। ফেলিক্সের থ্রো-ইন ধরে বক্সের বাঁদিক থেকে বুলেট গতির শটে সুইস কিপার সোমারকে পরাস্ত করেন রামোস। ৩৩ মিনিটে পর্তুগালকে আরও এগিয়ে নেন ৩৯ বছরের পেপে। ব্রুনো ফার্নান্দেজের কর্নারে তার হেড পৌঁছে যায় সুইসদের জালে। প্রথমার্ধে আরও কয়েকবার হামলে পড়েও গোল পাননি রামোস। তবে বিরতি থেকে ফিরেই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে চতুর্থ গোলের দেখা পান। ডানদিক থেকে দিয়াগো দালতের লো ক্রসের বাঁ পায়ের প্লেসিংয়ে সুইস কিপারের পায়ের নিচ দিয়ে জালে জড়িয়ে দেন। চার মিনিট পর রাফায়েল গেরেরোকে দিয়ে গোল করান রামোস। কাউন্টার অ্যাটাক থেকে আক্রমণে উঠে দ্রুত বাঁদিকে রাফায়েলের কাছে বল বাড়ান ২১ বছরের তরুণ ফরোয়ার্ড। বক্সে ঢুকে বাঁ পায়ের জোরালো শটে গোলের আনুষ্ঠানিকতা সারেন রাফায়েল। তিন মিনিট পর অবশ্য আকানজি গোল করে ব্যবধান কমিয়েছিলেন সুইজারল্যান্ডের। তবে ৬৭ মিনিটে ফেলিক্সের থ্রু ধরে বক্সে ঢুকে আগুয়ান সোমারকে পরাস্ত করে হ্যাটট্রিক পূরণ করেন রামোস। ১৯৯০ বিশ্বকাপের পর নকআউট পর্বে প্রথম হ্যাটট্রিকের কীর্তি গড়লেন এ স্ট্রাইকার। ৩২ বছর আগে নকআউট পর্বে কোস্টারিকার বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেছিলেন অবিভক্ত চেকোসøাভাকিয়ার স্কুরাভির।
এই গোলের কিছুক্ষণ বাদে রামোসের জায়গায় মাঠে এসেছেন রোনালদো। বারদুয়েক গোলের চেষ্টাও করেছেন। একবার জালেও বল পাঠিয়েছিলেন, তবে সেটা বাতিল হয়েছে পরিষ্কার অফসাইডে। রোনালদো গোল না পেলেও ঠিকই যোগ করা সময়ে পর্তুগালের গোলোৎসবে যোগ দেন বদলি ফরোয়ার্ড রাফায়েল লিয়াও।
নতুনের ছোঁয়ায় ১৬ বছর পর কোয়ার্টার ফাইনালে নাম লিখিয়েছে পর্তুগাল। আগামী শনিবার তাদের লড়তে হবে টাইব্রেকারে ২০১০-এর চ্যাম্পিয়ন স্পেনকে বিদায় করে দেওয়া মরক্কোর সঙ্গে। সে ম্যাচেও নিশ্চয়ই রোনালদোর জায়গা হবে বেঞ্চে। বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে কখনো গোল পাননি সিআর সেভেন। রামোস তা শুধু করেই দেখাননি, জয় করে নিয়েছেন হাজারো ভক্তেরও। তাতে হয়তো একটু মন খারাপ হবে রোনালদোর। তবে ৩৭ বছরের পর্তুগিজ রাজার শেষ বিশ্বকাপটা রাঙানোর দায়টাও যে এই নতুনের।
কী চমৎকারই না খেলল ব্রাজিল! গোটা বিশ্ব বুঁদ হয়ে দেখল ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের জাদু। দক্ষিণ কোরিয়ার দুর্বল রক্ষণাত্মক কৌশল গুঁড়িয়ে দিয়ে জয় নিশ্চিত করতে তিতের ব্রাজিলের সময় লাগল মাত্র আধঘণ্টা। রাতটা ছিল ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের নান্দনিক প্রদর্শনীর, যা তিতের মতো গম্ভীর স্বভাবের কোচকেও খেলোয়াড়দের সঙ্গে নেচে উদযাপন করতে বাধ্য করেছে। চতুর্থ গোলটার পর তো কোচকেও দেখা গেল খেলোয়াড়দের সঙ্গে নাচতে!
১২ মিনিটে দুই গোল দিয়ে যে ফুটবল প্রদর্শনীর শুরুটা করেছিল হলুদ পাখির দল, সেটা শেষ হল ৩৬ মিনিটে ৪-০ গোলে এগিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। প্রথমার্ধে ব্রাজিল ৬ বার দক্ষিণ কোরিয়ার গোলমুখে পৌঁছে গিয়েছিল আর ৪টা গোল আদায় করে নিল। এই ম্যাচটা আমাকে ২০০২ বিশ্বকাপের ব্রাজিল-চীন ম্যাচের কথা মনে করিয়ে দেয়, যে ম্যাচটা ব্রাজিল ৪-০ গোলে জিতেছিল।
দক্ষিণ কোরিয়াকে ৪-১ গোলে হারিয়ে ব্রাজিল শুধু কোয়ার্টার ফাইনালেই পা রাখল না, একই সঙ্গে পরবর্তী প্রতিপক্ষ ক্রোয়েশিয়ার কপালেও চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিল। একই সঙ্গে তারা প্রমাণ করে দিল, কেন তারা এই বিশ্বকাপের শিরোপার সবচেয়ে বড় দাবিদার। শুধু চিন্তার জায়গাটা হচ্ছে, তারা এখন পর্যন্ত বড় কোনো দল বা শক্তিশালী কোনো আক্রমণভাগের মোকাবিলা করেনি।
নেইমার ফিরেছে, তাকে দেখে মনে হচ্ছে চোট থেকে সে সেরে উঠেছে। আশা করা যাচ্ছে, অবশেষে সে তার সতীর্থদের নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে সামনের দিকে। সে-ই ব্যবধানটা গড়ে দিয়েছে। এখন সে যদি আর খেলতে নাও পারে, তবুও ব্রাজিলের সেই আত্মবিশ্বাসটা থাকবে যে তাকে ছাড়াও ব্রাজিলের পক্ষে কাপ জেতা সম্ভব।
সে ফিরেছে, পেনাল্টি থেকে গোলও করেছে। তবে ব্রাজিলের এই অনুপম ফুটবল প্রদর্শনীর পেছনে আসলে সামনে তাদের চার খেলোয়াড়ের কৃতিত্বই সবচেয়ে বেশি। রাফিনহা-নেইমার-ভিনিসিয়ুস-রিচার্লিসন; এই চারজন ছিল কোরিয়ান রক্ষণের কাছে আতঙ্কের নাম। ব্রাজিল সত্যিকারের ফুটবল দক্ষতা কী সেটা দেখিয়েছে। নেইমারের প্রত্যাবর্তনে উজ্জীবিত দলটা মাঠে খেলাটা উপভোগ করেছে আর মেতে উঠেছিল নিজেদের মেলে ধরার প্রতিযোগিতায়। প্রথমার্ধেই তারা ছয়বার গোলমুখে বল এনে যেভাবে চারটা গোল করল, সেটাই তিতেকে সুযোগ দিয়েছে একে একে সেরা খেলোয়াড়দের তুলে নেওয়ার বিলাসিতাটা দেখানোর।
এখন ব্রাজিলের সামনে ক্রোয়েশিয়া, গত বিশ্বকাপের রানার্সআপ। জাপানের সঙ্গে ম্যাচটা ওদের জিততে খুবই কষ্ট হয়েছে, শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে ভাগ্য খুলেছে তাদের। বলা যায় ব্রাজিলের চেয়ে অনেক কষ্ট করে এবং ঘাম ঝরিয়েই তারা এসেছে শেষ আটে। তাদের ভেতর দ্বিধাও অনেক বেশি কাজ করবে। ব্রাজিল কোয়ার্টার ফাইনালে এগিয়ে থেকেই মাঠে নামবে, তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে ম্যাচটা সহজ হবে না। ব্রাজিলকে ফেভারিট ধরে নিয়েই ওরা অনেক বেশি কাজ করবে এবং ব্রাজিলকেও অনেক খেটেই ম্যাচটা জিততে হবে। তিতের হাতে অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যের মিশ্রণে ভালো একটা দল রয়েছে এবং মনে হয় তিতে শক্ত দলগুলোকে চমকে দেওয়ার জন্য কিছু একটা ভেবে রেখেছে।
দারুণ ছন্দে থেকেই কাতারে পা রেখেছিল নেইমার, পরিসংখ্যান তার হয়ে কথা বলবে। ১৯ ম্যাচে ১৫ গোল আর ১২ অ্যাসিস্ট ছিল নেইমারের, বিশ্বকাপে এসে তৃতীয় ব্রাজিলিয়ান হয়ে তিন বা তার বেশি বিশ্বকাপে গোল করার রেকর্ডটা সে ছুঁয়ে ফেলল। এখন তার স্বপ্নটা হবে ব্রাজিলের জয়ের ধারা ধরে রেখে বিশ্বকাপ জেতা এবং ক্লাব ফুটবলে ফিরে যাওয়ার পর প্যারিস সেন্ট জার্মেইর হয়ে এই ফর্মটা ধরে রেখে ব্যালন ডি’অর জিতে নেওয়া। এই পুরস্কারটা সে কখনো জেতেনি। ৩০ বছর হয়ে গেছে নেইমারের, সে কিন্তু জানে ওর জন্য এটা হয় এবার নয়তো কখনোই নয়।
ধারাবাহিকভাবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় চলতি বোরো মৌসুমে সেচে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। তবে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে সরকার নানারকম প্রস্তুতি নিয়েছে বলে দাবি করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুতের যে পরিস্থিতি তাতে গ্রীষ্মে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। বেশি দাম দিয়েও কৃষক ঠিকমতো বিদ্যুৎ না পেলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। এতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়তে পারে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, জ্বালানি তেল, সার ও বীজের দাম বেড়েছে। এখন আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। তার মানে চারদিক থেকে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এর ফলে কৃষকের ‘সিগনিফিকেন্ট লস’ হবে। এভাবে দাম বাড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বোরো উপকরণনির্ভর ফসল। কিন্তু উপকরণের দাম এভাবে বাড়তে থাকলে, কৃষক আগ্রহ হারিয়ে ফেললে; সে ঠিকমতো উপকরণ ব্যবহার করতে পারবে না। এতে উৎপাদন ব্যাহত হবে। উৎপাদন খারাপ হলে চালের ঘাটতি হবে। এমনিতেই এখন প্রায় ৭০ লাখ টন গম ও ভুট্টা আমদানি করতে হচ্ছে। এরমধ্যে যদি চাল আমদানি করতে হয়; তাহলে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
ড. জাহাঙ্গীর বলেন, ‘সারাবিশ্ব নানারকম সংকটে ভুগছে। এ অবস্থায় আমাদের অন্তত খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সুযোগ রয়েছে। সেজন্য যে পরিমাণ দাম বেড়েছে সে পরিমাণ নগদ অর্থ সহায়তা দিতে হবে কৃষককে। ২০০৯-১০ সালের দিকে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে এক কোটির বেশি কৃষককে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা সরাসরি নগদ সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। এজন্য তারা ১০ টাকা দিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্টও খুলেছিলেন। তাদের সেই অ্যাকাউন্ট এখনো আছে, কিন্তু সহায়তা দেওয়া হয় না। এখন যদি সেই সহায়তা দেওয়া হয় তাহলে কৃষক আবার উৎসাহ পাবে।’
বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, প্রতি বছর সেচ মৌসুমে (ফেব্রুয়ারি থেকে মে) বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায়। গত মৌসুমে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। চলতি বছর সম্ভাব্য চাহিদা ধরা হয়েছে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। গত বছরের তুলনায় এ বছর সেচ সংযোগের সংখ্যা ১ হাজার ৯১টি বেড়ে মোট ৪ লাখ ৬৫ হাজার ৪৫৯টি হয়েছে। এজন্য বিদ্যুৎ লাগবে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট।
সেচ মৌসুমে অগ্রাধিকার দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। সম্প্রতি তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিদ্যুতের চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় রেখে উৎপাদনও বাড়ানো হচ্ছে। সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য গ্যাস, ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল সরবরাহ বৃদ্ধি করা, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্যাস সরবরাহ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সার্বিকভাবে পরিস্থিতি ভালো হবে।’
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে প্রতিদিন ১৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস, ৭৭ হাজার ৪০০ টন ফার্নেস অয়েল এবং ৬৬ হাজার ১০০ টন ডিজেলের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে। সূত্রমতে, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের সরবরাহ করা বাস্তবে খুব কঠিন ব্যাপার। গত বছর বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পিডিবির দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ১৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট ছিল। বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এ বছর জ¦ালানির ঘাটতি আরও বেশি। তবে সরকার খোলাবাজার থেকে এলএনজি আমদানি করে ঘাটতি মেটানোর উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু আমদানিকৃত গ্যাস দিয়ে চাহিদা অনুযায়ী কতটা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে তা নিয়ে কর্মকর্তাদের অনেকেই সন্দিহান।
পিডিবির তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ২২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে ১০ হাজার থেকে ১০ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। গ্যাস ও কয়লা সংকটের কারণে সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার মেগাওয়াট কম বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। এ ছাড়া রক্ষণাবেক্ষণের কারণেও কিছু কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে।
দেশে নির্মাণাধীন ও আমদানিকৃত বিদ্যুৎকেন্দ্রের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আগামী মার্চের শেষ দিকে ভারতের আদানি থেকে অতি উচ্চ দামে ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ ছাড়া মে মাসের দিকে চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের নির্মাণাধীন তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে ৬১২ মেগাওয়াট এবং অন্যান্য কিছু ছোট বা মাঝারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১৫০ থেকে ২০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হতে পারে। এপ্রিল-মে মাসের দিকে বিদ্যুতের চাহিদা সবচেয়ে বেশি হবে। তখন এসব কেন্দ্র সময়মতো উৎপাদনে এলেও ১৩ হাজার মেগাওয়াটের জোগান দেওয়া সম্ভব হবে। এর বাইরে উচ্চ মূল্যের জ্বালানি আমদানির মাধ্যমে কিছু কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে পারে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম মনে করেন, চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করার সক্ষমতা সরকারের নেই। কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি সরবরাহ করতে সরকারের ডলার খরচের যে সক্ষমতা দরকার তা সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘জ্বালানি খাতে সরকারের ভুলনীতি আর অন্যায্য ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয়ের কারণে দাম বেড়েই চলেছে। সেই ব্যয় মেটাতে এখন বিদ্যুৎ জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি করে ভর্তুকি সমন্বয় করতে চাইছে। এই পরিস্থিতিতে উচ্চ দামে বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানি করে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা অসম্ভব ব্যাপার।’
এদিকে ডলার সংকট এবং ঋণপত্র (এলসি) খোলার বিলম্বের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানি আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। সরকারের কাছে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মোটা অঙ্কের বিল পাওনা থাকলেও তারা ঠিকমতো না পাওয়ার কারণে প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করতে পারছেন না। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নির্মাণকাজ এবং জ্বালানি আমদানির যে অগ্রগতি তাতে চাহিদার তুলনায় আগামী গ্রীষ্মে বিদ্যুতের ঘাটতি হবে আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার মেগাওয়াট। তবে সাশ্রয় নীতি অবলম্বনের মাধ্যমে ১ হাজার মেগাওয়াট এবং উচ্চ মূল্যের জ্বালানি আমদানির মাধ্যমে আরও ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণ করতে পারে সরকার। এরপরও অন্তত ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি থাকবে।
এদিকে দাম সমন্বয়ের নামে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) পাশ কাটিয়ে গণশুনানি ছাড়াই নির্বাহী আদেশে জানুয়ারি মাসে ১৮ দিনে চার দফা গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করেছে সরকার। এর মধ্যে দু’দফায় অন্তত ১০ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর আগে গত বছরের আগস্টে সেচে ব্যবহৃত ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ২৯ টাকা দাম বাড়ানো হয়। বিদ্যুৎ ও জ¦ালানির মূল্যবৃদ্ধির ফলে কৃষিতে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে।
কুমিল্লার নাঙলকোট উপজেলার বাসন্ডা গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম মজুমদার বলছিলেন, গত বছর এক বিঘা বা ৩৩ শতক জমিতে ধান চাষ করতে সেচের জন্য ২৭৫০ টাকা ব্যয় হয়েছে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে চলতি বোরো মৌসুমে এ ব্যয় বেড়ে অন্তত ৪ হাজার টাকা হবে। এর বাইরে অন্যান্য খরচও আনুপাতিক হারে অনেক বেড়েছে। ফলে এখন ধান চাষ করলে প্রতি বিঘা জমিতে অন্তত দেড় থেকে দুই হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে।
ডিজেলচালিত ইঞ্জিনের মাধ্যমে জমিতে সেচ দেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুর গ্রামের শিয়ালা গ্রামের কৃষক নাঈম। শনিবার রাতে টেলিফোনে তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রতিবিঘা জমিতে এ বছর সেচের ব্যয় বেড়েছে ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা। সার, বীজ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণের দামও বেড়েছে।
এর আগে মূল্যবৃদ্ধির গণশুনানির সময় বিইআরসি কৃষক ও প্রান্তিক মানুষের কথা বিবেচনা করলেও নির্বাহী আদেশের সময় এসব কিছুই বিবেচনা করা হয় না।
অতীতে সামাজিক সুরক্ষার অংশ হিসেবে প্রতিমাসে ৫০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীকে লাইফলাইন বা প্রান্তিক ব্যবহারকারী হিসেবে বিবেচনা করে তাদের বিদ্যুতের দাম তুলনামূলক কম বাড়াত কমিশন। দেশে এ ধরনের গ্রাহক রয়েছে ১ কোটি ৬৩ লাখ, যাদের অধিকাংশই কৃষক। কিন্তু সর্বশেষ বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির আদেশে এ সুবিধা বাতিল করা হয়েছে।
লাইফ লাইন শ্রেণির প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের বিল ছিল ৩.৭৫ টাকা। গত ডিসেম্বরে তা বাড়িয়ে ৩.৯৪ টাকা করেছিল মন্ত্রণালয়। সেখান থেকে এবার আরেক দফা বাড়িয়ে ৪.১৪ টাকা করা হয়েছে। ফলে গত দুই মাসের ব্যবধানে দরিদ্র মানুষকে এখন প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য ৩৯ পয়সা বাড়তি ব্যয় করতে হবে।
কৃষকের কথা বিবেচনা করে আগে সেচে ব্যবহৃত বিদ্যুতের দাম সবসময়েই তুলনামূলক সাশ্রয়ী রাখার চেষ্টা করা হতো। কিন্তু এখন কৃষকেরাও রেহাই পাচ্ছে না। গত ১২ ডিসেম্বর কৃষিতে ব্যবহৃত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ২১ পয়সা বাড়িয়ে ৪.৩৭ টাকা করা হয়। সেখান থেকে এবার আরও ২২ পয়সা বাড়িয়ে ৪.৫৯ টাকা করা হয়েছে।
রংপুরের একজন কৃষক আনোয়ার আলী খানিকটা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দফায় দফায় যেভাবে সবকিছুর দাম বাড়ছে তাতে চাষি তো আর বেশিদিন বাঁচতে পারবে না। তিনি বলেন, ‘ধান চাষ করে এখন লাভ তো দূরের কথা খরচই ওঠে না। তাই আগের চেয়ে ধান চাষ কমিয়ে দিয়েছি। এখন সারা বছর খাওয়ার জন্য যতটুকু ধান দরকার ততটুকুই চাষ করি। তাতে লোকসান হলেও কী করব? ডাল-ভাত তো খাওয়া লাগবে।’
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খারের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তারা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গতিশীল হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। শ্রীলঙ্কার ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে যোগ দিতে দেশটিতে সফরে আছেন মোমেন ও হিনা। গতকাল শনিবার সেখানে তাদের মধ্যে সাইডলাইন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
রেডিও পাকিস্তান ও নিউজ নেটওয়ার্কের প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খার পাকিস্তান-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেন। তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে অর্থনীতি ও বাণিজ্যে পারস্পরিক উপকারী দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অর্থনৈতিক, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংযোগ জোরদার করার এবং পর্যটন ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। অনেক আন্তর্জাতিক ইস্যুতে বিশেষ করে মুসলিম উম্মাহ সংক্রান্ত বিষয়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে মতের মিল রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা সহযোগিতা জোরদারের আশা : এদিকে গত শুক্রবার বিকেলে দেশটির প্রধানমন্ত্রী পদুজানা পেরামুনা পার্টির দিনেশ গুনাবর্ধনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। এ সময় তারা দুই দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীর মধ্যে চলমান সেক্টরাল সহযোগিতা আরও বাড়ানোর গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত করেন। বিশেষ করে বাণিজ্য সহজীকরণ, ব্যবসা ও বিনিয়োগ, পর্যটন ও সংযোগের ক্ষেত্রে সহযোগিতার ওপর জোর দেন তারা।
গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, এর আগে সেদিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী সাবরির দেওয়া মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন। সন্ধ্যায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী মর্যাদাপূর্ণ ‘লক্ষ্মণ কাদিরগামার স্মারক বক্তৃতা’ শিরোনামে ‘শেয়ারড প্রসপারটি : এ ভিশন ফর সাউথ এশিয়া’ প্রদান করেন। সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দক্ষিণ এশীয় সম্প্রদায়ের সম্মিলিত আকাক্সক্ষা এবং যৌথ সমৃদ্ধির জন্য দক্ষিণ এশিয়া সম্মিলিতভাবে যে লক্ষ্যগুলো অনুসরণ করতে পারে সে সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। শ্রীলঙ্কার ঐতিহ্যবাহী পারফরমিং আর্ট সমন্বিত ঐতিহাসিক ইন্ডিপেন্ডেন্স হলে সাংস্কৃতিক উৎসব ‘লঙ্কারলঙ্কা’তে অংশগ্রহণ করেন।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, শ্রীলঙ্কার ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে অংশগ্রহণের জন্য দেশটিতে সফর করছেন ড. মোমেন। গত ৪ ফেব্রুয়ারি সকালে স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এ সফরে তিনি প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী সাবরি, নেপালের সদ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করা বিমলা রায় পাওডেলের সঙ্গে এবং মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খারের সঙ্গেও বৈঠক করেন। আশা করা হচ্ছে, সফর শেষে আজ ঢাকায় পৌঁছাবেন ড. মোমেন।
'পাঠান' মুক্তির আগে থেকেই অনুরাগীদের সঙ্গে শাহরুখের যোগাযোগের একটাই মাধ্যম, টুইটার। শনিবার ফের টুইটারে 'আস্ক এসআরকে' সেশনে ধরা দিলেন শাহরুখ। হালকা মেজাজে, খোলামেলা আড্ডায় মাতলেন অনুরাগীদের সঙ্গে। অনুরাগীদের প্রশ্ন উত্তর দিলেন। সেখানেই একজন টুইটার ব্যবহারকারীর উপদেশ- বয়স অনুযায়ী চরিত্রে অভিনয়ের করার। পাল্টা জবাব দেন শাহরুখও। বলেন, 'তিনি হিরো ছিলেন, আছেন, থাকবেন'।
অনুরাগীরা যেমন রয়েছেন, তেমনই ট্রোল করার লোকের সংখ্যাও কম নয় শাহরুখের সোশালে। বছর সাতান্নর 'তরুণ' এই অভিনেতাকে একজনের প্রশ্ন, 'আপনি কি এভাবেই হিরোর চরিত্রেই অভিনয় করবেন, নাকি কোনো দিন নায়ক-নায়িকার বাবার চরিত্র করার পরিকল্পনাও রয়েছে?' তাতে শাহরুখ যা জবাব দিয়েছেন, তা রীতিমত ছড়িয়ে পড়েছে সোশালে।
এমনিতেই রসিক মানুষ শাহরুখ। তবে কোন কথায় কাকে কী উত্তর দেবেন, তা ভালোই জানা তার। বাদশাহ লেখেন, 'তুই বাপ হ… আমি হিরোর চরিত্রেই ঠিক আছি।'
শনিবারের 'আস্ক এসআরক'-এ সেশনে, শাহরুখের কাছে জানতে চাওয়া হয় 'পাঠান'-এর মোট আয়ের পরিসংখ্যান। তাকেও ফেরাননি শাহরুখ। উত্তর দিয়ে লেখেন, 'ভালোবাসা ৫ হাজার কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে, ৩ হাজার কোটি প্রশংসা, ৩২৫০ কোটি হাগ, ২০০০ কোটি হাসি এখনও গণণা চলছে। তোমার অ্যাকাউন্ট্যান্ট কী বলছেন?'
'পাঠান' ঘিরে উন্মাদনা নজিরবিহীন। প্রেক্ষাগৃহের বাইরে এই ছবি দেখার ঢল। শাহরুখ অভিনীত ছবিটি লম্বা রেসের ঘোড়া, বলেছেন সিনেমা বিশেষজ্ঞরা। ৪ বছর পর শাহরুখ পর্দায় ফিরেছেন বলেই শুধু নয়, ৭ দিনে বক্স অফিসে ৭০০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে 'পাঠান', যা বলিউডে বছরের সেরা ব্লকবাস্টার হিসাবে গণ্য হতে চলেছে।
বিশ্বে জনপ্রিয় ফলগুলোর মধ্যে পেঁপে একটি। পুষ্টিগুণের জন্যই সবাই এই ফলটি বেশি পছন্দ করেন।
চিকিৎসক থেকে পুষ্টিবিদ— সকলেই এই ফলকে ‘মহৌষধ’ বলে থাকেন। শিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে, বয়স্কদের অর্শের সমস্যায় আবার কম বয়সীদের ওজন কমানোর ডায়েটে পাকা পেঁপের স্থান সকলের আগে। বিভিন্ন ভিটামিন এবং খনিজের প্রাকৃতিক উৎস পাকা পেঁপে চোখের জন্যও উপকারী। বিটা ক্যারোটিনে ভরপুর পাকা পেঁপে ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
অ্যান্টি অক্সিডেন্টে ভরপুর
ভিটামিন সি এবং অ্যান্টি অক্সিড্যান্টে ভরপুর পাকা পেঁপে ক্যানসারের মতো দুরারোগ্য ব্যধির প্রতিরোধক। এ ছাড়াও পেঁপেতে ছড়েছে ক্যারোটিনয়েড, ভিটামিন সি এবং ই, যা ত্বকের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
হজমে সহায়ক
পেঁপে মুখের রুচি ফেরায়। সেই সঙ্গে খিদেও বাড়ায় এবং পেট পরিষ্কার রাখে। পেট পরিষ্কার থাকলে গ্যাস অম্বলের সমস্যাও নিয়ন্ত্রণে থাকে। শুধু তাই নয়, যাদের অর্শের সমস্যা রয়েছে, চিকিৎসকরা তাদের পেঁপে খাওয়ার পরামর্শ দেন।
প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে সক্ষম
পেঁপে কিন্তু শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ১০০ শতাংশ ভিটামিন সি পাওয়া যায় এই পাকা পেঁপে থেকেই। শরীরে কোনও সংক্রমণ হলে, তা কমাতে চিকিৎসকরা পাকা পেঁপে খাওয়ার পরামর্শ দেন।
ওজন কমাতে
পাকা পেঁপেতে যথেষ্ট পরিমাণ ফাইবার থাকায় তা অন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষা করে। পাশাপাশি বিপাক হারও বাড়িয়ে তোলে। এ ছাড়াও যারা ওজন কমাতে ডায়েট মেনে খাবার খেয়ে থাকেন, তাদের জন্যও ভাল পাকা পেঁপে।
হার্টের স্বাস্থ্যরক্ষা করে
হার্টের স্বাস্থ্য ভাল রাখতে পটাশিয়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করে এই যৌগ। প্রাকৃতিকভাবে পটাশিয়ামের উৎস হল পাকা পেঁপে।
সংক্ষিপ্ত সফরে নেপাল হয়ে বিকেলে ঢাকায় এসেছেন মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন নাসুসন ইসমাইল। আজ শনিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছালে তাকে স্বাগত জানান ঢাকায় নিযুক্ত মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার হাজনা মো. হাশিম।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরটা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি শ্রমবাজারের জটিলতা নিয়ে আলাপ করবেন। কিভাবে দেশটিতে আমরা সহজে কর্মী পাঠাতে পারি; সেগুলো আলোচনায় উঠে আসবে। আমাদেরও কিছু প্রস্তাব রয়েছে। আমাদের কর্মীদের স্বার্থ আগে আমরা চাই, সবার জন্য বাজার খুলে দেওয়া হোক। নিয়োগকর্তার পছন্দমতো রিক্রুটিং এজেন্সি নিয়োগ— এটা আমরা চাই না। অভিবাসন ব্যয়
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার গত কয়েক বছর ধরে অস্থির। দেশটিতে প্রত্যাশিত শ্রমিক পাঠাতে পারছে না বাংলাদেশ। এমন পরিস্থিতিতে শ্রমবাজারটির জটিলতা নিরসনে আলোচনা করতে সংক্ষিপ্ত সফরে নেপাল হয়ে ঢাকায় আসছেন মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন নাসুসন ইসমাইল।
তার সফরে শ্রমবাজারটি গতিশীল করতে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) পরিবর্তন, অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয় কমানোসহ দেশের সব বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির জন্য বাজার উন্মুক্ত করার প্রস্তাব দেবে ঢাকা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, ২৪ ঘণ্টার সফরে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বৈঠক করবেন। পাশাপাশি তিনি সেনাকল্যাণ সংস্থার সঙ্গেও একটি বৈঠক করবেন।
শ্রম পরিদর্শক পদে যোগ দেওয়ার ৩৪ বছর পর পদোন্নতি পেলেন মাহমুদুল হক। স্বপ্ন দেখতেন পদোন্নতির সিঁড়ি বেয়ে একসময় প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে যাবেন। সেই স্বপ্ন আট বছরেই লুটিয়ে পড়ল জ্যেষ্ঠতার তালিকায়।
১৯৮৮ সালে যোগ দেওয়ায় ’৯৫ সালেই পদোন্নতি পাওয়ার কথা ছিল মাহমুদুল হকের। কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর প্রতিষ্ঠানপ্রধানের অদূরদর্শিতা সে স্বপ্ন শুরুতেই বাধা পেল। এন্ট্রি পোস্টে যোগ দেওয়ার পর তার মতো অন্য কর্মচারীরা যখন পদোন্নতির স্বপ্নে বিভোর, তখন তাতে গা-ই করলেন না সেই সময়ের প্রতিষ্ঠানপ্রধান।
মাহমুদুল অপেক্ষায় রইলেন পরিবর্তিত পরিস্থিতির জন্য। সেই পরিবর্তন আসতে আসতে চাকরিতে কেটে গেল আঠারো বছর। আঠারোতে মানুষ প্রাপ্তবয়স্ক হয়। তিনিও ভাবলেন আঠারোতে তিনি না হয় ‘জব ম্যাচিউরিটি’তে পৌঁছালেন। চাকরির আঠারো বছরে পদোন্নতি পেলেও মন্দ হয় না।
কিন্তু অবাক ব্যাপার, কর্তৃপক্ষ পদোন্নতি দিল, তবে মাহমুদুলকে ছাড়া। পদোন্নতির প্রজ্ঞাপনে কোথাও তার নাম নেই। হতাশায় মুষড়ে পড়লেন তিনি। জুনিয়র কর্মকর্তারদের নাম আছে, অথচ তার নাম নেই। প্রতিষ্ঠানের নীতি-নির্ধারকদের দরজায় দরজায় ঘুরলেন ন্যায়বিচারের আশায়। কিন্তু তারা পাত্তাই দিলেন না বিষয়টি।
তারা আমলে না নিলেও মাহমুদুলের স্বপ্ন তো সেখানেই থেমে যাওয়ার নয়। সেই স্বপ্ন পুঁজি করে তিনি গেলেন আদালতে। সেই ভিন্ন জগৎটাও কম চ্যালেঞ্জিং ছিল না। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল তার পক্ষে রায় দিল। মাহমুদুল আনন্দে আত্মহারা হলেন। কিন্তু সেই আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হলো না। সরকার আপিল করল প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে। মামলার ফল উল্টে গেল। হতাশায় ভেঙে না পড়ে তিনি গেলেন উচ্চ আদালতে। আপিল বিভাগে সিভিল আপিল মামলা করলে প্রশাসনিক আপিল আদালতের রায় বাতিল হয়। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল থাকে।
জলে নেমে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করার মতো মাহমুদুল হকও যেন সরকারের সঙ্গে লড়াই করতে নামলেন। আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন করল সরকারপক্ষ। একপর্যায়ে সরকার বুঝতে পারল কোনোভাবেই তারা এ মামলায় জিততে পারবে না। সরকারপক্ষে রিভিউ পিটিশন প্রত্যাহার করা হলো। আদালত সরকারের পদোন্নতির প্রজ্ঞাপনকে আইনের কর্তৃত্ববহির্ভূত বলে ঘোষণা করল। জুনিয়র কর্মকর্তাকে যেদিন থেকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে এবং যতবার পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, একইভাবে মাহমুদুল হককে পদোন্নতি দেওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত। বকেয়া বেতন-ভাতাসহ সব পাওনা কড়ায়-গ-ায় পরিশোধের নির্দেশনা আসে।
আদালতের এই নির্দেশনা দেওয়া হয় ২০১৮ সালে। এরপর আদেশ বাস্তবায়ন করতে সরকারের লেগে যায় প্রায় চার বছর। ২০২২ সালের ১১ মে তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ৩৪ বছর পর পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন মাহমুদুল হক। আবারও তাকে ঠকিয়েছে সরকার। জুনিয়র কর্মকর্তা যুগ্ম মহাপরিদর্শক হলেও তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয় তার দুই ধাপ নিচের সহকারী মহাপরিদর্শক পদে। উপমহাপরিদর্শক ও যুগ্ম মহাপরিদর্শক আরও ওপরের পদ। আদালতের নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
কখনোই প্রজ্ঞাপন মাহমুদুল হকের জন্য ভালো বার্তা বয়ে আনেনি। পুরো চাকরিজীবন আদালতের বারান্দায় ঘুরে তিনি পৌঁছেছেন অবসরের প্রান্তসীমায়। আর তিন মাস পরে তিনি অবসরে যাবেন। যৌবন ও মধ্য বয়সের দিনগুলোতে আদালতে ঘুরে বেড়ানোর শক্তি ও সাহস থাকলেও মাহমুদুল হক এখন সেই সাহস দেখাতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করছেন। পারবেন তো শেষ সময়ে এসে সরকারের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপসহীন মনোভাব দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে?
মাহমুদুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, তিনি আদালতের কাছেই জানতে চাইবেন, আদালতের বিচার না মানার শাস্তি কী।
পুরো ঘটনা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা শুনিয়ে জানতে চাইলেন, কতজনের পক্ষে মাহমুদুল হকের মতো লড়াকু মনোভাব দেখানো সম্ভব?
সীমাহীন আনন্দ নিয়ে মানুষ সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়। এরপরই তার মধ্যে যে স্বপ্নটি দানা বাঁধে তা হচ্ছে পদোন্নতি। কার কীভাবে পদোন্নতি হবে তা আইনকানুন, নিয়ম-নীতি দিয়ে পোক্ত করা। পুরো বিষয়টি কাচের মতো স্বচ্ছ। এরপরও পদোন্নতি হয় না। দিন, মাস, বছর পার হয়ে যায়, কাক্সিক্ষত পদোন্নতির দেখা মেলে না।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ক্যাডারে নিয়মিত পদোন্নতি হয়। বাকি ক্যাডারে হতাশা। তার চেয়েও কঠিন পরিস্থিতি নন-ক্যাডারে। ক্যাডার কর্মকর্তারা নিজের পদোন্নতির ষোলো আনা বুঝে নিয়ে ঠেকিয়ে দেন নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি। সংখ্যায় বেশি হওয়ায় নন-ক্যাডাররা একজন আরেকজনকে নানা ইস্যুতে আটকাতে গিয়ে পুরো প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেন। সরকারের মোট কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ কর্মচারী। সেই হিসেবে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনবলের পদোন্নতি হয় না। পে-কমিশন হলেই কর্মচারীদের পদোন্নতির জন্য করুণা উথলে ওঠে। এমনকি ব্লকপোস্টে যারা আছেন, তাদের জন্যও পদোন্নতির বিকল্প সুবিধা বাতলে দেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কর্মচারীদের পদোন্নতি উপেক্ষিতই থাকে।
যখন সময়মতো পদোন্নতি হয় না, তখন নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে থাকে। এসব সমস্যা সংশ্লিষ্ট দপ্তর-অধিদপ্তরের চৌহদ্দি পেরিয়ে আমজনতাকেও প্রভাবিত করে। নন-ক্যাডার কর্মকর্তা আর সঙ্গে কর্মচারীরা যখন বুঝতে পারেন পদোন্নতির আশা তাদের নেই, তখন তারা দুহাতে টাকা কামানোর ধান্দায় মেতে ওঠেন। এতে করে ঘুষের সংস্কৃতি সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। অকার্যকর পথে হাঁটে রাষ্ট্র। সাধারণ মানুষ টাকা ছাড়া তাদের কাছ থেকে কোনো সেবা পায় না, ব্যবসায়ীরা নতুন কোনো আইডিয়া নিয়ে ব্যবসায় আসেন না, ব্যবসাবান্ধব পরিস্থিতি না থাকায় মুখ ফিরিয়ে নেন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। প্রধানমন্ত্রীর বারবার আহ্বানেও বিনিয়োগকারীরা সাড়া দেন না। সাধারণ মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে সেবা দেওয়ার বাণীতেও উদ্বুদ্ধ হন না সংশ্লিষ্টরা।
এই পরিস্থিতিতে অনিয়ম আটকে রাখার সব কৌশলই ব্যর্থ হচ্ছে। যথাযথ তদারকি না থাকায় বিভাগীয় ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে গেছে। ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৩৫০টি অডিট আপত্তি ঝুলে থাকায় অডিট প্রতিষ্ঠানগুলোও আগ্রহ হারিয়ে নিজেরাই জড়িয়ে পড়ছে অনিয়মে। দন্তহীন বাঘে পরিণত হওয়ার তথ্য সাংবাদিকদের জানান দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান নিজেই।
নন-ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারীর পদোন্নতির বড় একটা অংশ আটকে রাখে মন্ত্রণালয়গুলো। এই আটকে রাখার কারণ হচ্ছে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের স্বার্থ। বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তরে নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিলে নিয়ম অনুযায়ী পদোন্নতিপ্রাপ্তদের ওপরের পদে বসাতে হবে। এতে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের এককালীন লাভ; অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে একবার পদোন্নতি দেওয়া যাবে। কিন্তু পদোন্নতি না দিয়ে সংশ্লিষ্টদের চলতি দায়িত্ব দিলে বছরজুড়ে টাকা আয় করতে পারেন নীতিনির্ধারকরা। দপ্তর, অধিদপ্তরে বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়। চলতি দায়িত্বপ্রাপ্তদের আয় অনুসারে নীতিনির্ধারকদের মাসোহারা দিতে হয়। নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি দেওয়া হলে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের নিয়মিত আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে আইন বা বিধি-বিধানের ফাঁকফোকর গলিয়ে নন-ক্যাডার এবং কর্মচারীদের পদোন্নতি আটকে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়।
সরকারি কর্মচারী সংহতি পরিষদের সভাপতি নিজামুল ইসলাম ভূঁইয়া মিলন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সচিবালয় এবং সারা দেশের সরকারি কর্মচারীদের পদোন্নতির মধ্যে একটু পার্থক্য আছে। নন-ক্যাডারের কিছু বিষয় ছাড়া সচিবালয়ের কর্মচারীরা সময়মতো পদোন্নতি পায়। কিন্তু সচিবালয়ের বাইরে পদোন্নতি হয় না বললেই চলে। সচিবালয়ে মাত্র ১০ হাজার কর্মচারী আছেন। সচিবালয়ের বাইরে আছেন ১০ লাখের বেশি। এসব কর্মচারীর পদোন্নতি নিয়ে বহু বছর ধরে চেষ্টা করছি। কিন্তু কোনো ফল পাইনি। সর্বশেষ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ সমস্যা নিয়ে কাজ করার জন্য একটি কমিটি করে দিয়েছে। কমিটি কিছু সুপারিশ করেছে। ব্যস, ওই পর্যন্তই। এরপর এর কোনো অগ্রগতি নেই। যেখানে সরকারপ্রধান বলেন, চাকরিজীবনে সবাই যেন কমপক্ষে একটি পদোন্নতি পায়। সেখানে বহু কর্মচারী কোনো পদোন্নতি ছাড়াই অবসরে যাচ্ছেন। সরকারপ্রধানের নির্দেশনা উপেক্ষা করেন আমলারা। তাদের আগ্রহ কেনা-কাটায়, বিদেশ ভ্রমণে, নতুন জনবল নিয়োগে। এসব করলে তাদের লাভ। কর্মচারী পদোন্নতি দিতে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। এর নিশ্চয়ই একটা শেষ আছে। বৈষম্যের পরিণতি কী হয়, তা অনেক দাম দিয়ে বিডিআর বিদ্রোহে আমরা দেখেছি।’
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি ঝুলছে বছরের পর বছর। এই অধিদপ্তরের কয়েক শ কর্মকর্তা পাঁচ বছর আগেই পদোন্নতির যোগ্য হয়েছেন। নানা কায়দা-কানুন করে তাদের পদোন্নতি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক সংশ্লিষ্টদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করে তাদের পদোন্নতির প্রক্রিয়া এগিয়ে নিলেও শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নতুন করে জ্যেষ্ঠতার তালিকা করার নামে সময়ক্ষেপণ করছে। জ্যেষ্ঠতার তালিকা করার পর এখন তাদের পারিবারিক সদস্যদের তথ্য যাচাই-বাছাই করার জন্য একটি সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ওই সংস্থা নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদেরও তথ্য তালাশ করছে। তাদের আত্মীয়দের মধ্যে কে কোন দলের সমর্থক তার তথ্য নিচ্ছেন সংস্থার কর্মকর্তারা।
গত মাসে শেষ হওয়া জেলা প্রশাসক সম্মেলনে দায়িত্ব পালন করছিলেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের সুরম্য ভবনে দায়িত্ব পালন করলেও ওই নন-ক্যাডার কর্মকর্তার মনের অবস্থাটা মনোহর ছিল না। কেমন আছেন জানতে চাইলে ওই নন-ক্যাডার কর্মকর্তা বলেন, ‘ভালো নেই। চাকরি করছি, পদোন্নতি নেই। ২০১৫ সালের আগে পদোন্নতি না পেলেও টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড ছিল। তাও তুলে দেওয়া হয়েছে। তুলে দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল সময়মতো পদোন্নতি হবে, ব্লকপোস্টধারীদের দেওয়া হবে বিশেষ আর্থিক সুবিধা। এসবের কোনোটাই হয়নি।’
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে একটি প্রশাসনিক আদেশ খুবই পরিচিত। সেই প্রশাসনিক আদেশ ১৬/২০১৮ অনুযায়ী ৭০ ভাগ কর্মকর্তা সরাসরি নিয়োগ হবে। আর ৩০ ভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। ৭০ ভাগ কর্মকর্তা সরাসরি নিয়োগের ফলে বিমানে বর্তমানে প্রয়োজনের তুলনায় কর্মকর্তা বেশি। নীতিনির্ধারকদের নতুন জনবল নিয়োগে আগ্রহ বেশি। পুরনোদের পদোন্নতি দিয়ে ওপরের পদ পূরণের চেয়ে তারা নতুন নিয়োগে যান। ফলে কারও চাকরিজীবনে একবারও পদোন্নতি হয় না। নামমাত্র যে পদোন্নতি হয় তা অনিয়মে ভরপুর।
নন-ক্যাডার ছাড়াও ১৩তম গ্রেড থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত পদোন্নতি হয় না বললেই চলে। প্রতিটি দপ্তরে এসব গ্রেডের পদোন্নতি আটকে আছে। অথচ এসব গ্রেডেই বেশি লোক চাকরি করছেন। সরকারের মোট জনবল প্রায় ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৯২৭ জন। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ২৩ শতাংশ পদের মধ্যেও নন-ক্যাডার রয়েছেন। এ ছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৭৭ শতাংশ পদই ১৩তম থেকে তার পরের গ্রেডের। এতে করে সহজেই বোঝা যায় সরকারের জনবলের বড় অংশই পদোন্নতির চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে। সরকারের জনবলের এই বিশাল অংশ যখন পদোন্নতি নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগেন, তখন তারা নানা অনিয়মে ঝুঁকে পড়েন।
বেশির ভাগ দপ্তর, অধিদপ্তর পরিচালনা করেন বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তারা তাদের প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় থেকে প্রেষণে ক্যাডার কর্মকর্তাদের দপ্তর, অধিদপ্তরে পাঠান। প্রেষণে গিয়ে অনেক কর্মকর্তা শুধু রুটিন কাজটুকুই করতে চান। শূন্যপদে জনবল নিয়োগ বা পদোন্নতি রুটিন কাজ না হওয়ায় তা উপেক্ষিত থাকে। তা ছাড়া পদোন্নতি দিতে গিয়ে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়; বিশেষ করে মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রী বা সচিব তাদের পছন্দের লোককে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য সংস্থার প্রধানকে চাপ দেন। এই চাপ উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ না থাকায় অযোগ্য লোককে পদোন্নতি দিতে হয় সংস্থার প্রধানকে। এই জটিলতা থেকে দূরে থাকার জন্য সংশ্লিষ্টদের পদোন্নতি দেওয়া থেকেও দূরে থাকেন সংস্থার প্রধানরা।
নন-ক্যাডার কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের পদোন্নতি না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের ১৪ গ্রেডের একজন কর্মচারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাইরের লোকের ইচ্ছাটাই জাগে না আমাদের পদোন্নতি দিতে। আমাদের দপ্তরপ্রধান মহাপরিচালক প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। অতিরিক্ত মহাপরিচালকও অনেক সময় প্রশাসন ক্যাডার থেকে প্রেষণে আসেন। তাদের কেন ইচ্ছা জাগবে আমাদের পদোন্নতি নিয়ে। যদি এসব পদে ফুড ক্যাডারের কর্মকর্তা থাকতেন, তাহলে তারা খাদ্য বিভাগের সমস্যা বুঝতেন। তা ছাড়া নিয়োগ বিধি সংশোধনের নামে আমরা দীর্ঘদিন একই পদে আটকে আছি।’
গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে এক আবেদনে জানান, ‘বর্তমানে সচিবালয়ে প্রায় দুই হাজারের বেশি প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা কর্মরত। এর বিপরীতে ক্যাডারবহির্ভূত সংরক্ষিত পদের সংখ্যা ২৬৭টি, যা খুবই নগণ্য। ফলে একই পদে ২০-২২ বছরের বেশি সময় কর্মরত থাকার পরও অনেকে পদোন্নতি পাচ্ছেন না। পদোন্নতি না পাওয়ায় সৃষ্ট হতাশার ফলে কর্মস্পৃহা নষ্ট হচ্ছে।’
সরকার এ সমস্যা থেকে কীভাবে বের হতে পারে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এসব সমস্যা সমাধানে সরকার সব সময়ই কাজ করে। কিন্তু এ চেষ্টা জটিলতার তুলনায় কম। এ বিষয়ে আরও এফোর্ট দিতে হবে।
বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনের উপনির্বাচনে বেসরকারিভাবে ১১২ কেন্দ্রের ফলাফলে ৯৫১ ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছেন বহুল আলোচিত স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলম। একতারা প্রতীক নিয়ে তিনি পেয়েছেন ১৯ হাজার ৪৮৬ ভোট। এ আসনে জয় পেয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ (ইনু) সমর্থিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম তানসেন। মশাল প্রতীক নিয়ে তিনি পেয়েছেন ২০ হাজার ৪৩৭ ভোট।
বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে বগুড়ার দুইটিসহ মোট ৬ আসনে উপনির্বাচনের ভোট গ্রহণ শুরু হয়। ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর বিএনপির এমপিরা পদত্যাগের ঘোষণা দিলে এ আসনগুলো শূন্য হয়।
তখন, বগুড়া-৬ (সদর) এবং বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেন হিরো আলম। নির্বাচন কমিশন একদফা তার প্রার্থিতা বাতিল করলেও পরে আদালতে গিয়ে প্রার্থিতা ফিরে পান তিনি।
বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) ও বগুড়া-৬ (সদর) আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আশরাফুল হোসেন হিরো আলম বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) দুপুর পর্যন্ত ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘সদরের কেন্দ্র সব দখল হয়্যা গ্যাছে। ডিসি-এসপিক কয়্যাও কোনো কাম হচ্চে না। সদরের আশা সব শ্যাষ। কাহালু-নন্দীগামের অনেক কেন্দ্র ঘুরে ঘুরে দেকছি। ভোট খুব সুষ্ঠু হচ্চে। মাঠের অবস্থা ভালো। কাহালু-নন্দীগ্রামে নিশ্চিত এমপি হচ্চি।’
এর আগে, সকালে সদর উপজেলার এরুলিয়া উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে যান তিনি। ভোট দেওয়ার পর হিরো আলম বলেন, ‘বগুড়া-৬ আসনে আগে থেকেই গোলযোগের আশঙ্কা করেছিলাম, সেটাই সত্যি হয়েছে। নির্বাচনি এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তবে বগুড়া-৪ আসনে ভোট সুষ্ঠু হচ্ছে। এভাবে সুষ্ঠু ভোট হলে এই আসনে আমিই বিজয়ী হবো।’
এদিকে বগুড়া-৬ আসনের উপনির্বাচনে কয়েকটি কেন্দ্রে নৌকা প্রার্থীর এজেন্ট বাদে অন্য এজেন্টদের ভোটকক্ষ থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আজ সকালে হিরো আলমসহ তিনজন প্রার্থী এ অভিযোগ করেন। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাদের এজেন্টদের বের করে দিয়েছেন বলে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করা হয়।
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ লাখ ৫০ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা খরচের হিসাব ধরে বাজেট প্রস্তাব প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে সরকার। যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৭২ হাজার ১৩০ কোটি টাকা বেশি। অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে খরচের বেশিরভাগ অর্থ জোগাড়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ১৯ শতাংশ বাড়ানো হবে। আসছে জুনের প্রথমভাগে জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আগামী বাজেট হবে জাতীয় নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারের চলতি মেয়াদের শেষ বাজেট। তাই এখানে নেওয়া কোনো পদক্ষেপে যেন আওয়ামী লীগ সরকার সমালোচনার মুখে না পড়ে এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্টদের থাকছে বিশেষ নজর। এ ছাড়া রয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। তাই সংকট ও নির্বাচন দুটোই মাথায় রাখতে হচ্ছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের বাজেট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে মোটাদাগে একটি রূপরেখা পাঠানো হয়েছে। নতুন পরিকল্পনার পাশাপাশি গত তিন মেয়াদে সরকার কী কী উন্নয়ন করেছে আগামী বাজেট প্রস্তাবে তা মনে করিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি এবং উচ্চপর্যায়ের সরকারি নীতিনির্ধারকদের উপস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ‘বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ কমিটির বৈঠকে’ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো আগামী বাজেটের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আর গত সপ্তাহে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি পাঠিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে রাজস্ব আদায়ের কৌশল নির্ধারণে কাজ শুরু করতে বলা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, যে হিসাব ধরে অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেট প্রস্তাব প্রস্তুতির কাজ শুরু করেছে তা কয়েক দফা খতিয়ে দেখা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে চূড়ান্ত করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। তিনি প্রয়োজনীয় সংশোধন, যোগ-বিয়োগ করে আবারও অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন। বাজেট প্রস্তাব চূড়ান্ত হওয়ার আগেও অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে থাকে।
ডলার সংকটে পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খুলতে পারছেন না সাধারণ ব্যবসায়ীরা। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় পণ্যের দাম বাড়ছে। কাঁচামাল সংকটে বিপাকে শিল্প খাত। ব্যাংক খাতে অস্থিরতা। নতুন চাকরির সুসংবাদ নেই বললেই চলে। দফায় দফায় জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। খুব শিগগিরই এসব সংকট কেটে যাবে বলে মনে করছেন না অর্থনীতিবিদরা। অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে ঋণদাতা সংস্থার কঠিন শর্তের বেড়াজালে আছে সরকার। এমন পরিস্থিতিতেই আগামী অর্থবছরের বাজেট তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশি^ক অস্থিরতা মোকাবিলায় সরকার কী কী পদক্ষেপ নেবে তা আগামী বাজেটে স্পষ্ট করা হবে। দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে একগুচ্ছ পরিকল্পনার কথাও বলা হবে। তবে শত সংকটের মধ্যেও আগামী বাজেটে ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী যতটা সুবিধা দেওয়া সম্ভব তা দিতে সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে বাজেট প্রস্তুত কমিটির কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষভাবে কাঁচামাল আমদানিতে রাজস্ব ছাড় দিতে হিসাব কষা হচ্ছে।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডলার সংকটে আমদানি রপ্তানি প্রায় বন্ধ। ব্যবসা-বাণিজ্যে সংকটকাল চলছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী বাজেটে আমাদের দাবি অনুযায়ী নগদ সহায়তা দিতে হবে। রাজস্ব ছাড় দিতে হবে। কর অবকাশ ও কর অব্যাহতি বাড়াতে দিতে হবে।’
ঋণদাতা সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া সংস্কারের শর্ত মানার অঙ্গীকার করে সরকার ঋণ পেয়েছে। শর্ত পালনে ব্যর্থ হলে ঋণের যেকোনো কিস্তি আটকে দিতে পারে প্রতিষ্ঠানটি। পর্যায়ক্রমে প্রতি অর্থবছরের বাজেটে এসব সংস্কার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করে বাস্তবায়ন করা হবে। আসছে বাজেটে শর্ত মানার চেষ্টা থাকবে। বিশেষভাবে অতীতের মতো ঢালাওভাবে কর অব্যাহতি দেওয়া হবে না। আর্থিক খাতের সংস্কারের কিছু ঘোষণা থাকবে। বিশেষভাবে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জোর দেওয়া হবে। আইএমএফের সুপারিশে এরই মধ্যে ভ্যাট আইন চূড়ান্ত হয়েছে। আয়কর আইন মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন হয়েছে। শুল্ক আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ে আছে। এ তিন আইন অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ের কৌশল নির্ধারণ করা হবে। আসছে বাজেটে টেকসই অর্থনৈতিক সংস্কারের অংশ হিসেবে সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করার কথা বলা হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কিছু উদ্যোগের কথা শোনানো হবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঋণদাতা সংস্থার শর্ত মানার কথা বলা হলেও সব আগামী বাজেটে একবারে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করতে হবে। না হলে অর্থনীতির গতি কমে যাবে।’
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে এনবিআর-বহির্ভূত খাত এবং এনবিআর খাতের জন্য মোট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে ৪ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৯ শতাংশ বাড়িয়ে ধরা হতে পারে। এতে লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা হবে। এনবিআর এ লক্ষ্যমাত্রা কমানোর জোরালো আবেদন করেছে। কিন্তু তা আমলে আনেননি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। নতুন অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে প্রায় ৩৫ শতাংশ বা ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর (মূসক) হিসেবে, ৩৪ শতাংশ বা ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা আয়কর হিসেবে এবং ৩১ শতাংশ বা বাকি ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা শুল্ক হিসেবে সংগ্রহ করার কথা বলা হতে পারে বলে জানা গেছে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রার কথা শুধু বললেই হবে না। কীভাবে অর্জিত হবে, সেটি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা না থাকলে প্রতিবারের মতো ঘাটতি থাকবে। রাজস্ব ঘাটতি হলে অর্থনীতিতে আয় ব্যয়ের ভারসাম্য নষ্ট হয়। তাই এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবসম্মত হওয়া উচিত।’
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের জন্য নির্ধারিত এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এনবিআর উৎসে করের আওতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। সম্পদশালীদের ওপর নজর বাড়ানো হবে। শুধু বেশি সম্পদ থাকার কারণে অতিরিক্ত কর গুনতে হবে। সারচার্জ বহাল রাখা হবে। সুপারট্যাক্স গ্রুপকে উচ্চহারে গুনতে হবে কর। আগামী অর্থবছরেও অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুবিধা থাকবে। অর্থ পাচারোধে আইনের শাসন কঠোর করা হবে। অর্থ পাচার আটকাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হবে। করপোরেট কর কমানোর দাবি থাকলেও তা মানা হবে না। অন্যদিকে নির্বাচনের আগের বাজেট হওয়ায় করমুক্ত আয় সীমা বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করতে খোদ অর্থমন্ত্রী বললেও রাজস্ব আদায় কমে যাবে এমন যুক্তি দেখিয়ে এনবিআর রাজি নয় বলে জানিয়ে দিয়েছে। কমানো হবে শিল্পের অধিকাংশ কাঁচামাল আমদানি শুল্ক। ডলারের ওপর চাপ কমাতে বেশি ব্যবহৃত পণ্য আমদানিতে রাজস্ব ছাড় দেওয়া হবে। বিলাসবহুল পণ্য আমদানি কমাতে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হবে। তৈরি পোশাক খাতের সব সুবিধা বহাল রাখা হবে। শিল্পের অন্যান্য খাতেও কতটা সুবিধা বাড়ানো যায় তা নিয়ে এনবিআর হিসাব করছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া বাজেট প্রস্তুতিবিষয়ক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন প্রকল্পে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি এবং ঘাটতি ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হতে পারে। আগামী অর্থবছরে জিডিপির ৬ শতাংশ ঘাটতি ধরে ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হতে পারে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হতে পারে বলে জানা যায়। ঋণদাতা সংস্থার কাছ থেকে ভর্তুকি কমানোর চাপ থাকলেও আগামীবার এ খাতে বেশি ব্যয় ধরা হতে পারে। এ খাতে ১ লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে। চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি ব্যয় আছে ৮৬ হাজার কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, গত সোমবার রাতে আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ অনুমোদন করে। ঋণদাতা সংস্থাটির কাছ থেকে বাংলাদেশ ছয় কিস্তিতে তিন বছরে ৪৭০ কোটি ডলার পাচ্ছে। ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের দিন আইএমএফ ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক নিয়ে পূর্বাভাস দেয়। সংস্থাটি বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বেড়ে হতে পারে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা হতে পারে ৭ দশমিক ১ শতাংশ।
এতে রিজার্ভ সম্পর্কে বলা হয়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমে দাঁড়াবে ৩ হাজার কোটি ডলার। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে তা ধারাবাহিকভাবে বাড়বে এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছর শেষে প্রথমবারের মতো রিজার্ভ ৫ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।