
রাজধানীতে ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ সামনে রেখে হঠাৎ করেই গতকাল বুধবার বিকেলে পুলিশ বিএনপির কার্যালয়ের সামনে অভিযান শুরু করে। একপর্যায়ে কার্যালয়েও ঢুকে পড়ে। পুলিশ টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড মেরে বিএনপির কার্যালয়ে জড়ো হওয়া নেতাকর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে। পুলিশের অভিযানের বিষয়টি আগে থেকে আঁচ করতে পেরেছিল জানিয়ে দলটির নেতারা বলেছেন, তাদের আশঙ্কাই সত্যি হলো।
এ ঘটনার প্রতিবাদে আজ বৃহস্পতিবার গুলশানে হোটেল লেকশোরে সংবাদ সম্মেলন করবেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
গতকাল নয়াপল্টনে সংঘর্ষের খবর শুনে ছুটে আসেন মির্জা ফখরুল। তিনি কার্যালয়ে ঢুকতে চাইলে কলাপসিবল গেট বন্ধ করে দেয় পুলিশ। এ সময় বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমার দলের কার্যালয়ে কেন আমি ঢুকতে পারব না। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে চেয়েছি। সরকার ভয়াবহ ঘটনা ঘটিয়েছে। সমাবেশ বানচাল করতেই এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ঘটনার দায় সরকারকে নিতে হবে। পরিস্থিতি শান্ত করতে ডিএমপি কমিশনার আমাকে নয়াপল্টনে আসতে বলেছেন। অথচ আসার পরে আমাকে অফিসে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।’
আচমকা পুলিশের মারমুখী আচরণে বিস্ময় প্রকাশ করে বিএনপি মহাসচিব কার্যালয়ের সামনে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ব্যবহার করে একটা ভয়াবহ, ভীতিকর ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা আশা করতে পারি না, একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ের সামনে এ রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।’ এ সময় তিনি এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে সেখান থেকে পুলিশ প্রত্যাহারের দাবি জানান। মির্জা ফখরুল বলেন, ‘অন্যথায় সব দায়দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তাবে।’
কার্যালয়ের সামনে বসে দেশ রূপান্তরকে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিএনপির শান্তিপূর্ণ আন্দোলন বিতর্কিত করতে পারে সরকার এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করে গত মঙ্গলবার ঢাকার বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার মিশন প্রধানদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে বলেছিলাম। এরপর ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই সরকার তার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে নয়াপল্টনে আমাদের দলীয় কার্যালয়ে অবস্থানরত নেতাকর্মীদের ওপর টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে শতাধিক নেতাকর্মীকে আহত করেছে। দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে।’
এর আগে ২০১৩ সালে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করেছিল গোয়েন্দা পুলিশ। তখন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দেড় শতাধিক শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার সাংবাদিকদের কাছে দাবি করে বলেন, ‘বিএনপির পার্টি অফিসে বোমা রয়েছে। পুলিশকে লক্ষ্য করেও বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে।’ তবে বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক ও সাবেক সংসদ সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা একটা ভিডিও ফুটেজ পেয়েছি। যেখানে দেখা যাচ্ছে ডিবি পুলিশ একটি বাজারের পলিথিনের ব্যাগে করে কার্যালয়ে ঢুকছে। পুলিশ বাজারের একটি ব্যাগে করে দলের কার্যালয়ের ভেতর বোমা নিয়ে গেছে।’
১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশের স্থান ঘিরে সরকারের সঙ্গে বিএনপির দরকষাকষি চলছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে। তবে বিএনপি এতে রাজি নয়। দলটি নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনেই গণসমাবেশ করতে চাইছে।
এ পরিস্থিতিতে ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ কি করা সম্ভব এমন এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সমাবেশকে কেন্দ্র করেই তো এগুলো হচ্ছে। তারা সমাবেশকে নষ্ট করার চেষ্টা করছে।’
রাতে ফখরুলের পাশে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা : রাতে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গিয়ে মির্জা ফখরুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, ভাসানী অনুসারী পরিষদ আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুুম, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) কার্যকরী সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, গণ অধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া ব্যারিস্টার কায়সার কামালের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতারা নয়াপল্টনে মির্জা ফখরুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
মির্জা আব্বাসের বাসা ঘিরে রাখা হয় : রাতে মির্জা আব্বাস অভিযোগ করে বলেন, ‘নয়াপল্টনে নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশের হামলার খবর পেয়ে সেখানে যেতে চাইলে আমার বাসার সামনের গেট ও রাস্তা অবরুদ্ধ করে রাখে পুলিশ, র্যাব ও ডিবি পুলিশ। এ ছাড়া স্থানীয় ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা আমার বাসার সামনে অবস্থান নেয়। তাদের বাধার কারণে আমি যেতে পারিনি।’
আহতদের হাসপাতালে নিতে দেয়নি পুলিশ : বিএনপির স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পুলিশের ছোড়া টিয়ার শেলে আহত নেতাকর্মীরা কার্যালয়ে অবস্থান করে বারবার আমাকে অনুরোধ করেছিলেন অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে তাদের যেন হাসপাতালে নেওয়া হয়। কার্যালয়ে আটকে পড়া জ্যেষ্ঠ নেতারা আমাকে ফোন করে অনুরোধ জানান। খবর পেয়ে আহতদের হাসপাতালে নিতে দুটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে গিয়েছিলাম বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। পুলিশ আহতদের আনতে দেয়নি। শুধু তাই নয়, অ্যাম্বুলেন্সে আঘাত করেছে। ভাঙার চেষ্টা করেছে। পরে আমরা সেখান থেকে চলে যাই।’
গত রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠক হয়েছে। বৈঠক শেষে স্থায়ী কমিটির এ সদস্য দেশ রূপান্তরকে জানান, দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলার প্রতিবাদে আজ বৃহস্পতিবার সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে আজ বিকেল ৩টায় হোটেল লেকশোয় শরিক দলগুলোকে নিয়ে যে সংবাদ সম্মেলন করার কথা ছিল তা স্থগিত করা হয়েছে।
নয়াপল্টনেই সমাবেশ : সংঘর্ষের আগে গতকাল দুপুরে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘সরকার গ্রহণযোগ্য ও পছন্দনীয় স্থানের প্রস্তাব না করলে বিএনপি আগামী ১০ ডিসেম্বর নয়াপল্টনেই সমাবেশ করবে।’ রাতে স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত বহাল রাখা হয়েছে বলে কমিটির এক সদস্য জানিয়েছেন।
বিএনপির আগামী ১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে রাজধানীর নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। গতকাল বুধবার বিকেল ৩টা থেকে শুরু হয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা চলা সংঘর্ষের সময় পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে বিএনপি কার্যালয় ও এর আশপাশের এলাকা। এ সময় মুহুর্মুহু ককটেল বিস্ফোরণ হয়। সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মকবুল হোসেন নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তাকে নিজেদের দলীয় কর্মী বলে দাবি করেছে বিএনপি। এ ছাড়া সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশের ছোড়া শর্টগানের গুলিতে দলের আরও অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন বিএনপি নেতারা।
দলটির নেতাদের অভিযোগ, হঠাৎ করে পুলিশ দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে তাদের নেতাকর্মীদের সরিয়ে দিতে ফাঁকা গুলি ছোড়ে। একই সঙ্গে কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকে দরজা-জানালা ভাঙচুর করে। তবে পুলিশ বলছে, যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিএনপি নেতাকর্মীদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে গেলে তারা প্রথমে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন। বিএনপি কার্যালয়ের ভেতর থেকে শতাধিক নেতাকর্মীকে আটকের পর বিপুলসংখ্যক ককটেল উদ্ধার করা হয় বলেও জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
এদিকে সংঘর্ষ শেষে সন্ধ্যায় বিএনপি কার্যালয়ে তল্লাশি শুরু করে পুলিশ, যা শেষ হয় রাত ৯টায়। সেখান থেকে দলটির কয়েকজন শীর্ষ নেতাসহ তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল সকাল থেকেই বিএনপি ও এর অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হতে থাকেন। সব মিলিয়ে দুই হাজারের বেশি নেতাকর্মী হাজির হন। সেখানে দুটি ট্রাকে অস্থায়ী মঞ্চ বানিয়ে নেতারা বক্তব্য রাখছিলেন। বিকেল ৩টার দিকে পুলিশ তাদের রাস্তা ছেড়ে চলে যেতে অনুরোধ জানায়। কিন্তু নেতাকর্মীরা সেই অনুরোধে সাড়া না দিলে পুলিশ তাদের রাস্তা থেকে সরানোর চেষ্টা করে। এ সময় ককটেল বিস্ফোরণে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ তখন রাবার বুলেট, টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালায়। বিএনপি নেতাকর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে আশপাশের অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ভেতর থেকেও ইটপাটকেল ছোড়া হয়। আবার নেতাকর্মীদের ছুড়ে মারা ইটের টুকরো তুলে তা পাল্টা নিক্ষেপ করতেও দেখা যায় পুলিশকে। নয়াপল্টনের প্রধান সড়কে অবস্থান নেয় পুলিশ। বিকেল সাড়ে ৩টার মধ্যে পুরো পল্টনের রাস্তা নিয়ন্ত্রণে নেয় পুলিশ। এরপর থেমে থেমে কয়েক দফা দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্ক ও ফকিরেরপুল এলাকায় মুখোমুখি অবস্থান নেয় পুলিশ ও বিএনপির নেতাকর্মীরা। সংঘর্ষ চলাকালে নয়াপল্টন, ফকিরেরপুল এবং নাইটিঙ্গেল ও কাকরাইল মোড় পর্যন্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যা পর্যন্ত থেমে থেমে সংঘর্ষ চলে। বিএনপি কার্যালয়ের উল্টো পাশ থেকে দলটির নেতাকর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু ককটেল ছুড়লে বিস্ফোরণের ধোঁয়ায় পুরো এলাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরপর হঠাৎ করেই বিএনপি নেতাকর্মীরা গলি থেকে বেরিয়ে এসে ককটেল নিক্ষেপ করেন। এ সময় পুলিশকেও পাল্টা আক্রমণ করতে দেখা গেছে। পুলিশ দফায় দফায় টিয়ার শেল ছুড়তে থাকে। ফকিরেরপুল পানির ট্যাঙ্কের সামনে টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সংঘর্ষ শুরুর আগে সকাল থেকে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন সেøাগান দিতে থাকেন। মাইক ও ব্যানারসহ কার্যালয়ের সামনে অস্থায়ী মঞ্চও ছিল। একপর্যায়ে মাইক্রোফোনে ঘোষণা দেওয়া হয় নেতাকর্মীদের রাস্তায় বসে পড়তে। মুহূর্তে শত শত নেতাকর্মী রাস্তায় বসে পড়লে ফকিরেরপুল থেকে কাকরাইল পর্যন্ত রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ আগে থেকেই সেখানে সতর্ক অবস্থানে ছিল। প্রিজন ভ্যান ও জলকামানও প্রস্তুত রাখা ছিল।
সংঘর্ষ চলাকালেই আহত কয়েকজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মকবুল হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক পৌনে ৪টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, সংঘর্ষ শুরুর পর অসংখ্য নেতাকর্মীর সঙ্গে আহত ব্যক্তিরাও বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের ভেতরে অবস্থান নেন। এই সময় পুলিশ কার্যালয়ের ভেতর কাঁদানে গ্যাসের কয়েকটি শেল ছোড়ে। তখন বিএনপির পক্ষ থেকে চারটি অ্যাম্বুলেন্স নয়াপল্টন কার্যালয়ের সমানে এলে সেগুলোকে দাঁড়াতে দেয়নি পুলিশ। তারা দাবি করেন, ভেতরে অবস্থান নেওয়া অন্তত ১৫ থেকে ২০ জন আহত ছিলেন। কাঁদানে গ্যাসের কারণে তাদের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।
বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেন, সন্ধ্যা ৫টা ২০ মিনিটে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য নিয়ে বিএনপি কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশ করেন। এ সময় দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় দরজা বন্ধ পান। পরে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকেন। সেখান থেকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, প্রচার সম্পাদক ও মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি আবদুল কাদের ভূইয়া জুয়েল, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, আমান উল্লাহ আমানসহ দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে আটক করেন। এ সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে ছুটে এলেও তাকে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। দলীয় কার্যালয়ের গেট আটকে রাখলে গেটের সামনেই বসে পড়েন। সেখানে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এটা ন্যক্কারজনক হামলা। পুলিশ গেট বন্ধ করে ভেতরে তল্লাশির নামে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করছে। ভেতরে বিস্ফোরক ঢুকিয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার ব্যবস্থা করছে। এটা অসাংবিধানিক।’
আটকের আগে রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশের এ গুলি চালানো সম্পূর্ণ পরিকল্পিত। ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ বানচাল করতে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থানরত নিরীহ নেতাকর্মীদের ওপর গুলি ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করা হয়েছে।’
নেতাকর্মীদের আটকের পর কার্যালয়ের সামনে থেকে সমাবেশের প্রচারের কাজে থাকা দুটি ট্রাক র্যাকার দিয়ে টেনে নিয়ে যায় পুলিশ।
সংঘর্ষ থামার পর ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল জোনের উপ-কমিশনার হায়াতুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘সমাবেশের স্থান নিয়ে যখন আলোচনা চলছে তখন এই সংঘর্ষ শুরু হলো। সকাল থেকে পল্টনে বিএনপির নেতাকর্মীরা ভিড় করতে শুরু করেন। একপর্যায়ে পুরো রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। আমরা তাদের সরে যেতে বারবার অনুরোধ করি। কিন্তু তারা আমাদের কথা শোনেননি। একপর্যায়ে তাদের সরিয়ে দিতে গেলে তারা পুলিশের ওপর হামলা করেন।’
তল্লাশি অভিযান শেষে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধান হারুন অর রশিদ বলেন, বিএনপি কার্যালয় থেকে নগদ ২ লাখ টাকা, ১৬০ বস্তা চাল, পৌনে ২ লাখ পানির বোতলসহ রান্নার উপকরণ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া অবিস্ফোরিত ১৫টি বোমা পাওয়া গেছে।
বিএনপি কার্যালয় থেকে ৩০০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আটকদের কারও বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, কারও বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। মামলার বাইরে যাদের আটক করা হয়েছে, যাচাই-বাছাই করে তাদের বিষয়ে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পেশায় কাপড়ের কারিগর ছিলেন নিহত মকবুল : নয়াপল্টনের সংঘর্ষে নিহত মকবুল হোসেন (৪৫) পেশায় কাপড় তৈরির কারিগর ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে। বাবার নাম মৃত আবদুস সামাদ। তিনি মিরপুর-১১’র লালমাটিয়া বাউনিয়া বাঁধের টিনশেড বাসায় ভাড়া থাকতেন। মকবুলের লাশ শনাক্ত করেন ভাই নুর হোসেন। তার লাশ দেখতে পরিবারের সদস্যরা হাসপাতালে ছুটে আসেন। এ সময় তাদের আহাজারিতে হাসপাতালের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। নিহত মকবুল গতকাল সকালে বাসা থেকে বের হন বলে জানান স্ত্রী হালিমা আক্তার। তাদের এক কন্যাসন্তান রয়েছে।
আইন অমান্য করে সমাবেশ করলে সর্বোচ্চ ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি : ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেছেন, জননিরাপত্তা ও জনদুর্ভোগের কথা চিন্তা করে নয়াপল্টনে বিএনপিকে গণসমাবেশের অনুমতি দেওয়া যাবে না। আইন অমান্য করলে বিএনপির বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গতকাল সন্ধ্যায় ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘নয়াপল্টনের সামনে ১০ লাখ লোকের জায়গা হবে না। সর্বোচ্চ এক লাখ লোক দাঁড়াতে পারবে। বাকি ৯ লাখ লোক ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ছড়িয়ে পড়বে। যার ওপর বিএনপির কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। আমরা গোয়েন্দা সংস্থা এবং মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পেরেছি, বিএনপি ঢাকা শহরে ১০ লাখ লোক জমায়েতের মাধ্যমে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। কাজেই পার্টি অফিসের সামনে জনদুর্ভোগ করে এবং ঢাকার আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন করে তাদের সেখানে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া যাবে না।’
প্রচলিত নিয়ম মেনেই সভা-সমাবেশ করতে হবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, বিএনপিকে দেশের প্রচলিত নিয়ম মেনেই সভা-সমাবেশ করতে হবে। ২০-২৫ লাখ মানুষের সমাগম ঢাকায় সম্ভব না। তবুও তারা পল্টনেই কেন সমাবেশ করতে চায়, তা খতিয়ে দেখবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গতকাল রাজধানীর তেজগাঁওয়ে আওলাদ হোসেন মার্কেটে এক অনুষ্ঠান শেষে তিনি এ সব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিগত সংসদ নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়ায় কক্সবাজারবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আসছে সংসদ নির্বাচনে নৌকার জন্য ভোট চান। তিনি বলেন, আপনারা ’১৮-তে নৌকায় ভোট দিয়েছেন। আমরা ক্ষমতায় এসেছি। টানা তিনবার ক্ষমতায় রয়েছি। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ভোট হবে, সেবারও আমাকে ভোট দিয়ে আমাদের জয়যুক্ত করবেন।
গতকাল বুধবার কক্সবাজারের শহীদ শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আয়োজিত আওয়ামী লীগের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী আগামী নির্বাচনের জন্য নৌকার পক্ষে থাকার এ আহ্বান জানান।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার নিজেরও কক্সবাজার খুবই প্রিয় উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনারা কি নৌকায় ভোট দেবেন? আপনারা হাত তুলে ওয়াদা করেন দেবেন কি না।’ এ সময় জনসভাস্থল থেকে হাত তুলে লাখো লাখো জনতা ‘শেখ হাসিনার সরকার বারবার দরকার’ স্লোগান দিতে থাকেন।
সমাবেশস্থল স্টেডিয়াম মাঠ ছিল কানায় কানায় পরিপূর্ণ। বেলা ১টার মধ্যে সমাবেশস্থল পূর্ণ হয়ে যায়। বাকিরা স্টেডিয়াম মাঠের বাইরে দাঁড়িয়েই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শোনেন। কক্সবাজারের স্থানীয় জনগণের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কক্সবাজারবাসী, আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাই যে আপনারা ২০১৮ সালের নির্বাচনে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আমাদের প্রার্থীদের জয়যুক্ত করেছিলেন। ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮বারবার আপনারা ভোট দিয়েছেন। আপনাদের ভোট বৃথা যায়নি।’ সাগরপাড়ের শেখ কামাল আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভাস্থলের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি লোক ছিল রাস্তায়। শহরের লালদীঘির পাড় থেকে শুরু করে হলিডের মোড় হয়ে কলাতলীর সুগন্ধা পয়েন্ট পর্যন্ত ছিল লোকারণ্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজার এলেন সাড়ে ৫ বছর পর। তবে এর মধ্যে তার সরকার টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কক্সবাজারের উন্নয়নে রেকর্ড পরিমাণ বরাদ্দ দেয়। এই উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে অভিভূত কক্সবাজারবাসী। গত মঙ্গলবার থেকেই চকরিয়া, পেকুয়া, টেকনাফ ও মহেশখালী থেকে হাজার হাজার নেতাকর্মী কক্সবাজার এসে জড়ো হন। আর গতকাল সকাল থেকেই মিছিল আর মিছিলের নগরীতে পরিণত হয় পুরো এলাকা। উৎসবের সাজে সড়কে সড়কে শোভা পায় ফেস্টুন, ব্যানার।
সরকারপ্রধান বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যই আমার সংগ্রাম। যে লক্ষ্য সামনে নিয়ে আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সে লক্ষ্যেই আমি কাজ করছি।’
বক্তব্যের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বাংলার জনগণের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। আপনারা বারবার ভোট দিয়ে আমাকে নির্বাচিত করেছেন বলেই আমি দেশের জন্য কাজ করতে পারছি।’
জামায়াত-বিএনপি অগ্নিসন্ত্রাস, খুন ও মানি লন্ডারিং দিয়েছে : জামায়াত-বিএনপি এ দেশের মানুষকে কী দিয়েছে? এই প্রশ্ন রেখে শেখ হাসিনা বলেন, অগ্নিসন্ত্রাস, খুন, মানি লন্ডারিং এগুলো দিয়েছে। তিনি বিএনপি-জামায়াতকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘যারা দেশের উন্নয়ন না করে সম্পদ বিদেশে পাচার করেছে, লুট করেছে এবং জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে তারা কীভাবে জনগণের পাশে থাকবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এতিমের টাকা মেরে খাওয়া ও বিদেশে সম্পদ পাচারই ছিল খালেদা-তারেকের কাজ। তারা দেশের শান্তি চায় না। অস্ত্র মামলায় এখনো তাদের একজন সাজা ভোগ করছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড বোমা হামলা ঘটিয়েছে ওরা। তারা জ্বালাও-পোড়াও ছাড়া কিছুই পারে না।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘যে গ্রেনেড যুদ্ধের মাঠে ব্যবহার করা হয়, সেই গ্রেনেড মারা হয়েছিল আমাদের ওপর। গ্রেনেড হামলায় আমাদের আইভি রহমানসহ অনেকে মারা গেছেন। আল্লাহর রহমতে আমি সেদিন বেঁচে গিয়েছিলাম। ধ্বংস করা ছাড়া বিএনপি-জামায়াত এ দেশকে কিছুই দিতে পারে না। পঁচাত্তরের পর এরা ২১ বছর ক্ষমতায় ছিল। কী দিয়েছে বাংলাদেশকে? তারা কিছুই দিতে পারেনি।’
আবার আসিব ফিরে, এই কক্সবাজার সমুদ্রের তীরে : শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার বাবা যখন জেল থেকে বের হতেন, তখন আমাদের কক্সবাজার নিয়ে আসতেন। আমরা এখানে ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। এতই উন্নয়ন করেছি, একসময় দেখবেন, এই মহেশখালী সিঙ্গাপুরের চেয়ে সুন্দর হবে।’ ভবিষ্যতে কক্সবাজারে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কুতুবদিয়া ও মহেশখালীতে আরও দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করে দেব। আমাদের সব সময়ের লক্ষ্য এ অঞ্চলের উন্নয়ন। মানুষের সমস্যা আমরা জানি, আমরা সে অনুযায়ী কাজ করছি।’ কক্সবাজারকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করে কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা ‘আবার আসিব ফিরে’-এর অনুকরণে ‘ আবার আসিব ফিরে, এই কক্সবাজার সমুদ্রের তীরে’-এই পঙ্তি দিয়ে তিনি বক্তব্য শেষ করেন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কেউ কক্সবাজারের দিকে মুখ ফিরে তাকায়নি : প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর এই কক্সবাজার তথা বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের প্রতি কেউ ফিরে তাকায়নি। দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে কক্সবাজারকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছিল। কক্সবাজারে একে একে ১২টি মেগা প্রকল্পসহ ৭৩টি উন্নয়ন প্রকল্প কক্সবাজারে চলমান রয়েছে। ইতিমধ্যে ২৯টি প্রকল্প সমাপ্ত করতে পেরেছি। কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, রেললাইন, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে জনগণ এর সুফল ভোগ করবে। বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধিশীল দেশে রূপান্তরের কাজ চলছে। ২০৪১ সালে আমরা সে লক্ষ্যে পৌঁছাব, ইনশা আল্লাহ। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশে কোনো মানুষ ঠিকানাহীন ও গৃহহীন থাকবে না।’
জনসভায় অন্যান্যের মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফসহ কেন্দ্রীয় এবং জেলা পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
নজর কেড়েছে সেলিমের মোটরসাইকেল: রংবেরঙের টিশার্ট-টুপি পরে মিছিলে মিছিলে দলে দলে সবাই ছুটছেন শেখ হাসিনার জনসভায়। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে সমাবেশস্থলের একটু সামনের মোটেল রোডের লাবণী মোড়ের তিন রাস্তার মাথায় উৎসুক জনতার দৃষ্টি আটকে গেল একটি মোটরসাইকেলের আরোহীর দিকে। মিছিল থেকে বেরিয়ে অনেকেই তার সঙ্গে সেলফি তুলছেন। কেউ কেউ গল্পও জুড়ে দিয়েছেন লাল-সবুজ টুপি ও বাদামি রঙের পাঞ্জাবির ওপর মুজিব কোট পরিহিত মধ্যবয়সী ওই লোকের সঙ্গে। এই মোটরসাইকেলের পেছনেই শোভা পাচ্ছে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকা। জাতীয় পতাকার সঙ্গে মিলিয়ে লাল-সবুজ রঙের সাজানো হয়েছে নৌকাটি। এতে লেখা রয়েছে নৌকায় ভোট দিন। তার নাম মোহাম্মদ সেলিম। তিনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ২৯ নম্বর ওয়ার্ড পশ্চিম মাদারবাড়ী এলাকার। নৌকার আদলের মোটরসাইকেল নিয়ে ১৫৮ কিলোমিটার মহাসড়ক পাড়ি দিয়ে এসেছেন শেখ হাসিনার ভাষণ শুনতে।
পেট্রলবোমায় নিহত বাবা, বিচার দাবি : ২০১৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি কাতার যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকায় যাচ্ছিলেন কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বরইতলীর ইউসুফ। কিন্তু কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে পৌঁছার পর ঢাকাগামী বাসে আগুন-সন্ত্রাসীদের পেট্রলবোমা হামলায় মারা যান তিনি। এর সাত বছরে সেই ঘটনার বিচার হয়নি। নিহত বাবার হত্যার বিচার চেয়ে গতকাল ফেস্টুন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সমাবেশস্থলের সামনের সড়কে অবস্থান করছিলেন জাহেদ ইসলাম রুবেল। প্রধানমন্ত্রীর নজরে পড়লেই বাবা হত্যার বিচার পাবেন এমন আশায় সারা দিনই তিনি ছিলেন সমাবেশস্থলের আশপাশে।
ঢাকার বাইরে বিভাগীয় গণসমাবেশ সফল হওয়ায় বিএনপির নেতাকর্মীদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাস বেড়েছে বহুগুণে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে রাজধানীতে ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশের আগেই দলটির নেতাকর্মীদের সেই মনোবল ও আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরাতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এরই অংশ হিসেবে বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-মামলা ও আটক অভিযান শুরু করা হয়েছে। চলবে আরও কয়েক দিন। বিএনপিকে দুর্বল করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব জানা গেছে।
ক্ষমতাসীন দলের নেতারা জানান, বিএনপির নেতাকর্মীদের আটক অভিযান অব্যাহত রেখে মনোবল দুর্বল করা যাবে, নিশ্চিত হয়েই এ কৌশলে এগোচ্ছে সরকার। এ কৌশলের কারণে আন্তর্জাতিক মনোভাব ও প্রতিক্রিয়া কী হয় সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিতে চায় আওয়ামী লীগ।
ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে দিতে চাইলেও কোনোভাবেই চরমপন্থা নিতে চায় না। অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটিয়ে সমালোচনার দায় নিতে চায় না ক্ষমতাসীনরা।
গতকাল বুধবার বিএনপির কার্যালয়ের সামনে পুলিশের অভিযানের সময় সংঘর্ষে মৃত্যুর ঘটনা ঠিক কী কারণে তা খতিয়ে দেখবে সরকার। অন্য কোনো পক্ষ সুবিধা নিতে চায় কি না, সেটাও সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা হবে। কারণ, এমন ঘটনা সরকার বা আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা চান না।
ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকার ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের চাওয়া হলো ঢাকা মুক্ত রাখা। তাই ঢাকার বাইরে বিনা বাধায়ই বিএনপি বিভাগীয় সমাবেশ করেছে। তবে ঢাকায় কর্মসূচি পালন করতে বিএনপিকে ছাড় দেওয়া হবে না, সে ব্যাপারে আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখা হয়েছে। ঢাকায় বিনা বাধায় কর্মসূচি পালন করতে থাকলে বিএনপি আরও চাঙ্গা হয়ে উঠবে। তাই বিএনপির ঢাকার কর্মসূচিকে গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে আওয়ামী লীগ ও সরকার।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আজকে (গতকাল) বিএনপির পূর্বনির্ধারিত কোনো কর্মসূচি ছিল না। বিএনপির নেতাকর্মীরা কেন নয়াপল্টনে গেল, পুলিশের ওপর হামলা করল? এতেই প্রমাণ হয়, বোঝা যায় বিএনপির সংঘাত-নাশকতা করার পূর্বপরিকল্পনা রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপির নেতাকর্মীরা পুলিশের ওপর হামলা করল, ককটেল ফাটাল, এত ককটেল আসে কোত্থেকে?’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘যেকোনো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে কেউ কোনো বাধা দেবে না। এ জন্যই বিএনপি শান্তি নষ্ট করার কর্মসূচি বেশি করতে চায়।’
আওয়ামী লীগের একাধিক নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১০ ডিসেম্বর ঘিরে পুলিশ যেমন মাঠে থাকবে, তেমনি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও সতর্ক থাকবে।
দলটির নীতিনির্ধারকরা দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, বিএনপির সংঘাত-সংঘর্ষ প্রতিরোধ করা হবে। তাই ১০ ডিসেম্বরের আগেই মাঠে নামতে শুরু করেছে ক্ষমতাসীনরা। নয়াপল্টনেই বসবে গতকাল বিএনপি এমন বার্তা দিতে চাইলে বসে থাকেনি সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীও আটক করার সুযোগ তৈরি হয়। পাশাপাশি বিএনপি কার্যালয়ে তল্লাশিও করেছে পুলিশ।
সূত্র জানায়, সমাবেশের স্থান নিয়ে বিএনপি অনড় অবস্থান দেখাবে সেটা জানাই ছিল ক্ষমতাসীন দলের। সমাবেশের স্থান নিয়ে মূলত বিতর্ক শুরু হয়েছে। ফলে ইস্যু সৃষ্টি করতে হলে সমাবেশ স্থান নিয়ে বিতর্ক তোলা জরুরি ছিল। শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে।
ওই সূত্র জানায়, বিএনপি যেহেতু স্থান নিয়ে অনড় অবস্থানে চলে গিয়েছে সে ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানে যেতে হয়েছে সরকারকেও। এ প্রশ্নে বিএনপি যেমন ছাড় দিতে চায় না, আওয়ামী লীগও ছাড় দেবে না। ওই সূত্র আরও জানায়, সমাবেশ স্থান নিয়ে কোনো পক্ষই এখন পিছু হটবে না। যে পক্ষই পিছু হটতে যাবে সে পক্ষই একরকম পরাজয় মেনে নিতে হবে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘১০ ডিসেম্বরের বিএনপির কর্মসূচি ঘিরে কোনো ষড়যন্ত্র না থাকলে সমাবেশের স্থান নিয়ে কেন তারা অনড় অবস্থানে চলে গিয়েছে? জনগণের ভোগান্তি হবে এ কারণে সরকার জনবহুল এলাকা বাদ দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির কর্মসূচির প্রস্তাব করেছে। এ প্রস্তাবকে ভিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই।’
এদিকে ওই দিনটি ঘিরে আজ বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও দুই অংশের মেয়রদের সঙ্গে বৈঠকে বসবে আওয়ামী লীগের সম্পাদকম-লী। সকাল সাড়ে ১০টায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এ সভা থেকে ১০ ডিসেম্বরের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হবে।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, গতকাল সকাল থেকে মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন স্থানে মিছিলসহকারে অবস্থান নেন। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নেতাকর্মীদের অনেকেই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে সতর্কাবস্থানে থেকেছেন। ছোট ছোট মিছিল দেখা গেছে ভূতের গলি, হাতিরপুল ও রাসেল স্কয়ারে।
বিএনপির গণসমাবেশ সামনে রেখে শুক্রবার বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের দক্ষিণ গেটে সমাবেশ করবে মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ। এ সমাবেশ থেকে নেতাকর্মীদের একটি অংশ ১০ ডিসেম্বর শনিবার পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ এলাকায় থেকে যাওয়ার কথা জানা গেছে। প্রায় প্রতিদিনই সকাল-বিকেল সভা-সমাবেশ করে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের নগর উত্তর-দক্ষিণের নেতারা। সে সঙ্গে বিভিন্ন ওয়ার্ডে মহড়া দিচ্ছেন তারা।
মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ১০ ডিসেম্বর তারা টঙ্গী, আশুলিয়া ও গাবতলীতে সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করবেন। ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ সাভারের রেডিও কলোনি মাঠে ১০ ডিসেম্বর সমাবেশ ডেকেছে। পাশাপাশি দলটির নেতাকর্মীরা কেরানীগঞ্জেও সতর্ক পাহারার ব্যবস্থা নিয়েছেন।
কাতারে এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপ খুব চমৎকার ভাবে হচ্ছে। আমরা দেখেছি বেশ কিছু ছোট দলকে দারুণ সব জয় পেতে। আবার অনেক দলকে দেখেছি দুর্ভাগ্যজনক ভাবে হেরে যেতে। এসবই ফুটবলের সৌন্দর্য, এজন্যই ফুটবল অনিশ্চয়তার খেলা। এখন আমরা নকআউট পর্বে পৌঁছে গেছি। আসর যত এগোবে, ছোট দলের সম্ভাবনা ততই কমে আসবে আর যেসব দল অনেক ভালো প্রস্তুতি নিয়ে আসতে পেরেছে এবং নিজেদের কৌশল ও ট্যাকটিকসকে বিশ্বকাপের ছন্দের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পেরেছে তারাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে।
নেইমারের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করেছে যে ব্রাজিল শিরোপার দৌড়ে এগিয়ে আছে। ব্রাজিল তাদের শেষ ম্যাচে এমন এক পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছে যা দর্শকদের কাছে মন্ত্রমুগ্ধকর আর পরবর্তী প্রতিপক্ষ ক্রোয়েশিয়ার কাছে আতঙ্কের। তিতের ব্রাজিল রীতিমতো দক্ষিণ কোরিয়ার রক্ষণকে ছিন্নভিন্ন করে প্রথমার্ধেই চারটা গোল করে দারুণ এক জয় তুলে নিয়েছে। দুঃখজনক ভাবে ম্যাচটা আমার দেখা হয়নি কারণ কাতারে গোটা দুয়েক ম্যাচ দেখার পর সেখান থেকে তখন আমি মাত্র দেশে ফিরে এসেছি।
লোকে তিতের কৌশল নিয়ে অনেক প্রশ্ন তোলে। প্রথমে অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন ফুটবলারদের গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে বিশ্রাম দেওয়া নিয়ে, যে ম্যাচটা ব্রাজিল হেরেছিল। এরপর প্রশ্ন ওঠে পরের ম্যাচে শুরু থেকেই কেন নেইমারকে খেলানো হচ্ছে। আমার মনে হয় তারা উত্তরটা পেয়ে গেছে। যখন নেইমার মাঠে থাকে, তখন প্রতিপক্ষ তাকে আটকে রাখতেই ব্যস্ত থাকে। তার পেছনেই দেখা যায় এক-দুইজন খেলোয়াড়কে সারাক্ষণ পাহারায়। এতে করে রিচার্লিসন, ভিনিসিয়ুস ও রাফিনহাদের জন্য অনেক জায়গা বের হয় আর তখন তারা অনেক বেশি সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। আর দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ব্রাজিল দলকে আমরা যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে খেলতে দেখলাম, সেটা সম্ভব হয়েছে ওই একটা ম্যাচে বিশ্রাম দেওয়ার ফলেই।
আমার মনে হয় রক্ষণটা কোন কৌশলে কাদের নিয়ে সাজাতে হবে, তার চূড়ান্ত সমাধান পেয়ে গেছে তিতে। তার এই কৌশলটা নিখুঁতভাবে কাজ করছে। মিলিতাও আরও একবার খুব ভালো খেলেছে, দানিলো বাম দিকে খেলেছে আর এটাই ওর আসল জায়গা। মাঝমাঠও খুব ভালো করেছে আর খুব জমাট ছিল, প্রতিপক্ষ বল নিয়ে সহজে মাঝমাঠই পার করতে পারেনি।
শেষ আটে লড়াইটা হবে ব্রাজিলের আক্রমণভাগের সঙ্গে ক্রোয়েশিয়ার অভিজ্ঞ রক্ষণভাগের। ক্রোয়েশিয়া দলটার সঙ্গে ২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপে রানার্সআপ হওয়া দলের খুব একটা পার্থক্য নেই। তবে তাদের সবারই বয়স চার বছর করে বেড়েছে। রাশিয়ায় রানার্সআপ হওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়েই জøাতকো দালিচের দল শেষ আটে ব্রাজিলের বিপক্ষে মাঠে নামবে আর প্রস্তুত হবে শেষ আটে ব্রাজিলের বিপক্ষে বাঁচা-মরার লড়াইয়ের জন্য।
মাঝমাঠে লড়াইটা হবে কাসেমিরো আর লুকা মদ্রিচের। তারা একে অন্যকে খুব ভালো করে জানে। এই বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত ব্রাজিল দলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে কাসেমিরো। তিতে তার ওপর খুব ভরসা করে। ৩৭ বছর বয়সী লুকা মদ্রিচকে আরও একবার কাপ জয়ের লড়াইতে দেখতে পারাটাও হবে দারুণ ব্যাপার। অভিজ্ঞতা আর নৈপুণ্য বিচার করলে মদ্রিচ কিন্তু এগিয়ে থাকবে কাসেমিরোর চেয়ে। তবে ব্রাজিলিয়ানের পক্ষে আছে তার বয়স আর রক্ষণ আগলে রাখার কৌশল। এই ম্যাচটা হবে ব্রাজিলের আক্রমণের বিপক্ষে ক্রোয়েশিয়ার রক্ষণের, যারা চেষ্টা করবে শেষ পর্যন্ত গোল করার সব রাস্তা আটকে রেখে ম্যাচটা টাইব্রেকারের দিকে নেওয়ার। এই ম্যাচে তুরুপের তাস হবে নেইমার। তার আক্রমণাত্মক কৌশল আর বুদ্ধিদীপ্ততাই ভাঙতে পারে ক্রোয়েশিয়ার রক্ষণ দেয়াল। এই মুহূর্তে দলে কোনো চোট সমস্যা নেই আর দারুণ সব খেলোয়াড় মাঠে নামতে মুখিয়ে আছে।
আমি আশা করছি সম্ভাব্য সেরা ফলের; আমাদের জাতীয় দল যদি এই ছন্দ ধরে রাখতে পারে তাহলে তারাই আবারও বিশ্বকাপ জিতবে।
ডুবন্ত জাহাজের সঙ্গে নাকি জাহাজের ক্যাপ্টেনকেও সলিল সমাধি নিতে হয়। কাল মিরপুরে রোহিত শর্মাকে দেখে মনে হলো এমনই এক জাহাজের অধিনায়ক, মাঝসাগরে যার সলিল সমাধি অবধারিত। বুড়ো আঙুলের চোটের কারণে ব্যাট করতে নেমেছেন ৯ নম্বরে। অন্যপ্রান্তে সঙ্গী দীপক চাহার, ভারতের জিততে তখনো ৪৫ বলে ৬৫ রান দরকার।
ভাঙা আঙুলে সেখান থেকেই দলকে প্রায় জিতিয়েই দিচ্ছিলেন রোহিত, ৫ ছক্কা আর ৩ বাউন্ডারিতে ২৭ বলে ৫১ রানের ইনিংস খেলে অসম্ভব এক সমীকরণ প্রায় মিলিয়েই দিয়েছিলেন ভারতীয় অধিনায়ক। শেষ বলে জয়ের জন্য লাগত ছয় রান, সৌম্য সরকারের বলে বছর চারেক আগে কলম্বোতে যে হিসাবটা মিলিয়ে দিয়েছিলেন দীনেশ কার্তিক। কিন্তু রোহিত পারলেন না, বলা যায় মোস্তাফিজুর রহমান পারতে দিলেন না। শেষ বলটা করেছেন লেগস্টাম্পে ইয়র্কার, উড়িয়ে মারার জন্য জায়গাই দেননি রোহিতকে। তাতেই ৫ রানের জয়ে ওয়ানডে সিরিজটা ২-০ তে নিজেদের করে নিল বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের বিপক্ষে রোহিত সবসময়ই সফল। ব্যাট হাতে, নেতৃত্বেও। ২০১৮ সালের নিদাহাস ট্রফিতে সে-সময়কার নিয়মিত অধিনায়ক বিরাট কোহলি বিশ্রামে, নেতৃত্বে রোহিত। শেষ বলে ছক্কায় রোহিতের হাতে ট্রফি এনে দিলেন দীনেশ কার্তিক। একই বছর এশিয়া কাপ, সেখানেও ফাইনালে শ্বাসরুদ্ধকর জয়ে রোহিতের ভারতের হাতে শিরোপা। ২০১৫ ও ২০১৯, দুই বিশ্বকাপেই বাংলাদেশের বিপক্ষে শতরান। বাংলদেশের বিপক্ষে এত সাফল্য যার, অধিনায়ক হিসেবে বাংলাদেশ সফরে এসে তাকেই কি না নিতে হচ্ছে ওয়ানডে সিরিজে হারের দায়ভার? মোহাম্মদ সিরাজের বলে সিøপে এনামুল হক বিজয়ের বলে ক্যাচ নিতে গিয়ে আঙুলে চোট পেয়েছিলেন রোহিত। শেষ চেষ্টা হিসেবেই ব্যাটিং গ্লাভস কেটে, বুড়ো আঙুলে ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে ব্যাট করতে নামা রোহিতের। এভাবেও জিতিয়েই দিচ্ছিলেন ভারতকে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারলেন না। বরং কাছে এসেও হৃদয় ভাঙার যে কষ্ট ভারতের কাছে হেরে পেয়েছে বাংলাদেশ, তারই যে প্রতিশোধ দেশের মাটিতে। প্রথম ম্যাচটা শেষ উইকেটে বাংলাদেশ জিতেছে, পরের ম্যাচটা ভারত হেরেছে শেষ বলে।
এই সিরিজে টানা দ্বিতীয়বারের মতো টসে জিতলেন লিটন দাস। দলে এক পরিবর্তন, হাসান মাহমুদের জায়গায় নাসুম আহমেদকে এনে তিন স্পিনারে ভারতকে আটকানোর চেষ্টা। কিন্তু টস জেতার পর লিটন আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত জানাতেই খানিকটা বিস্ময়, রাতের শিশিরে স্পিনারদের তো বল হাতে ধরতেই সমস্যা।
গোড়াপত্তনে একটু অদল-বদল, ডান-বামের প্রথা ভেঙে লিটনের সঙ্গী আনামুল হক। কিন্তু তাতে বাংলাদেশের টপ অর্ডারের চেহারাটা একটু ভালো হলেও বদলায়নি। আগের ম্যাচে নাজমুল হোসেন শান্ত আউট হয়েছিলেন প্রথম বলে, এনামুল দুই চারে ১১ রান করে আউট হলেন। শান্ত নিচে নেমে কিছু রান পেয়েছেন, ২১ রান করার পর উমরান মালিকের যে বলটায় তার স্টাম্প উড়ে গেছে সে বলের গতি ছিল ঘণ্টায় ১৫১ কিলোমিটার!
পরপর দুই ওভারে ওয়াশিংটন সুন্দরের শিকার সাকিব আল হাসান (৮) ও মুশফিকুর রহিম (১২)। দলীয় ৬৯ রানে নেই ৬ উইকেট, চোখ রাঙাচ্ছে একশর নিচে অলআউট হওয়ার চোখ রাঙানি। এমন সময় দৃশ্যপটে মেহেদি হাসান মিরাজের আগমন। আগের ম্যাচে বাংলাদেশকে অবিস্মরণীয় এক জয় এনে দিয়েই নিজের কাজটা শেষ মনে করেননি মিরাজ, কাল আবারও দায়িত্বশীল ইনিংসে বুঝিয়ে দিলেন ব্যাটিংয়ের হাতটা খারাপ নয় তার। সপ্তম উইকেটে মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে ১৬৫ বলে ১৪৮ রানের জুটি গড়েন মিরাজ। আগের ম্যাচে নেতিবাচক মানসিকতার ব্যাটিং করায় বেশ সমালোচনাই শুনতে হয়েছে মাহমুদউল্লাহকে। কাল ফের দেখালেন, আগের সেই ঝলক এখনো খানিকটা আছে তার ব্যাটে।
৯৬ বলে ৭৭ রানে আউট হয়েছেন মাহমুদউল্লাহ, তবে মিরাজকে আউট করা যায়নি। শেষ ওভারে ১৫ রান নিয়ে নিজের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি করার পাশাপাশি বাংলাদেশকেও ২৭১ রানের সংগ্রহে পৌঁছে দিয়েছেন মিরাজ। ১০ রানে ৩ উইকেট ওয়াশিংটন সুন্দরের, জোড়া শিকার উমরান মালিক ও মোহাম্মদ সিরাজের।
বছর তিনেক আগে, ইডেনে গোলাপি বলের টেস্টে বিরাট কোহলিকে আউট করার পর সেই যে স্যালুট ঠুকেছিলেন ইবাদত হোসেন, তার প্রায় তিন বছর ধরে ভারতের এই ব্যাটসম্যানের কোনো শতরান ছিল না! কাল সেই ইবাদতকে পুল করতে গিয়ে স্টাম্পে বল টেনে আনলেন কোহলি। রোহিতের অবর্তমানে ইনিংসের সূচনায় নেমে মাত্র ৫ রানে বোল্ড হয়ে ফেরেন কোহলি, মোস্তাফিজের বলে মিরাজের হাতে ক্যাচ দিয়ে আউট শিখর ধাওয়ানও। ১৩ রানে নেই ভারতের ২ উইকেট। ওয়াশিংটন সুন্দরকে (১১) আগে পাঠিয়েও লাভ হয়নি, ভরসা জোগাতে পারেননি লোকেশ রাহুলও (১৪)। ভারতকে ম্যাচে রাখে শ্রেয়াশ আইয়ার আর অক্ষর প্যাটেলের ১০৭ রানের জুটি।
কিন্তু এই দুজনের দ্রুত বিদায়ে ভারত যখন হারের দোরগোড়ায়, তখনই দৃশ্যপটে রোহিতের আগমন। ভাঙা আঙুল নিয়ে ব্যাট করে ভারতকে জিতিয়েই দিচ্ছিলেন রোহিত, যদিও তাকে শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখার জন্য বাংলাদেশের ফিল্ডারদের অবদানও কম নয়। মাহমুদউল্লাহ’র করা ৪৯তম ওভারটায় রোহিত কোনো সিঙ্গেলস নেননি, জায়গায় দাঁড়িয়ে ব্যাট চালিয়ে শুধু ছক্কার চেষ্টাই করে গেছেন। দুটো ছক্কা হয়েছে, ক্যাচ পড়েছে দুটো। একবার ফেলেছেন ইবাদত, আরেকবার আনামুল
শেষ ওভারে মোস্তাফিজকে আটকাতে হবে ২০ রান, প্রথম বলটা ডট হলেও পরের দুই বলে দুই বাউন্ডারিতে লক্ষ্যের কাছে পৌঁছে যায় ভারত। শেষ তিন বলে ভারতের চাই ১২ রান, মোস্তাফিজ একটা ডট বল দিলেও পরের বলটায় সোজা ছয় মারেন রোহিত। আবারও শেষ বলে ছয় রানের সমীকরণ, কিন্তু এবার আর কলম্বো ফিরল না ঢাকায়। মোস্তাফিজের ইয়র্কারে নিশ্চিত হলো বাংলাদেশের ৫ রানের জয়, সেই সঙ্গে ২-০ তে নিশ্চিত হলো সিরিজও।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তাকে প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাল ইস্যু নিয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলতে দেখা যায়। যুবলীগে পদ পেয়েও পরে অব্যাহতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার সুমন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে আপনি যে ভিডিও আপলোড করেন এর প্রধান উদ্দেশ্য কি টাকা ইনকাম করা?
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে টাকা ইনকামের সুযোগ আসার কয়েক বছর আগে থেকেই আমি ভিডিও আপলোড করি। আমার প্রথম যে কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল তখন মনিটাইজেশন নামে কোন শব্দের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। আমার ফেসবুক থেকে যে ইনকাম হয়, ব্যারিস্টারি থেকে যে আয় হয় এবং বিদেশে থাকা আমার পরিবারের মানুষেরা যে টাকা পাঠান তার সব আমি মানুষের জন্য খরচ করি। এর প্রমাণ হিসাবে দেশে বিদেশে আমার নামে কিংবা আমার পরিবারের কারও নামে কোন ফ্ল্যাট নেই।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া স্যার ইস্যু নিয়ে আপনার অবস্থান কি?
স্যার ম্যাডাম মহোদয় এইগুলো নাম নাম মাত্র। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাজে কতটুকু এগোলাম আমরা। একজন মানুষ যে কাজে সরকারী অফিসে যান সেই কাজ টা যদি ঠিক মত হয় তাহলে কি নামে ডাকলেন সেটা কোন সমস্যা বলে আমার কাছে মনে হয়না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
আপনি নমিনেশন চাইবেন আওয়ামী লীগ থেকে?
আমি আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন চাইব। দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি নির্বাচন করব। না হলে দল যাকে নমিনেশন দেবে আমি তার হয়ে কাজ করব।
যুবলীগ থেকে আপনাকে বহিষ্কারের পর আপনার কেমন লেগেছিল, আপনার অবস্থানে কি আপনি অনড়?
আমার কাছে একদম খারাপ লাগেনি। নেতা যাকে ইচ্ছে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজন না হলে ফেলে দিতে পারেন। আমাকে যখন যুবলীগে নেওয়া হয়েছিল, তখন হয়তো আমাকে প্রয়োজন ছিল, এখন মনে হয় হয়তোবা আমি যেভাবে কাজ করি তা উনাদের পছন্দ না। তবে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম সে বিষয়ে আমি অনড়। একজন ওসি কখনো নির্দিষ্ট এমপি কে খুশি করার জন্য স্লোগান দিতে পারেন না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনাকে কথা বলতে কম দেখা যাচ্ছে কেন ?
দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা বিশ্ব পরিস্থিতির অংশ। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মত দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমরা টিকে আছি। আমাদের অধিকাংশ জিনিস আমদানি করতে হয়। তাই এ সমাধান আমাদের হাতে নেই। তবে আমি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে কথা না বললেও দুর্নীতি নিয়ে কিন্তু প্রতিদিন কথা বলতেছি। দুর্নীতি আর টাকা পাচার যদি বন্ধ করা যেত তাহলে জিনিস পত্রের দাম এত বাড়ত না। তাই বলতে পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আমার অন্য সবকিছুকে কাভার করে।
শোনা যায় অনেকেই রাজনীতি করে কানাডায় বাড়ি কিনছেন, এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
রাজনীতিকে এখন ওনারা ধারণ করেন না। এমপি পদ টাকে তারা আরও সম্পদ উপার্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ওনারা মনে করেন পরেরবার এমপি মন্ত্রী হতে পারেন বা না পারেন টাকা বানিয়ে ফেলি যাতে আর অসুবিধা না হয়।
আব্দুস সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে বানানো ভিডিও সরিয়ে ফেলতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।এটা কি আপনার পরাজয়?
সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে আমি অনেকগুলো ভিডিও বানিয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ২টা ভিডিও সড়াতে হয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার মেরিট যেন নষ্ট না হয় এর জন্য ভিডিও সড়াতে বলা হয়েছে। এটাকে আমি পরাজয় মনে করি না।
বর্তমান সরকারকে অনেকে অনির্বাচিত বলেন, এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
সংবিধান মেনে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। রাজনৈতিক বিষয়ে যা ঘটেছে বা ঘটছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এ নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আপনার অবস্থান কি?
পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বিশ্বাস কতটুকু সেটাও ভেবে দেখতে হবে। একটা সময় আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল তখন কিন্ত বিএনপি এই দাবি মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়।
রাজনীতির চেয়ে সামাজিক ইস্যুতে আপনাকে বেশি কথা বলতে দেখা যায়। এটা কি সুবিধাজনক অবস্থান?
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবেই আমার রাজনীতিতে আসা। আমার বাবা বা অন্য কেউ এমপি মন্ত্রী নয়। যে আমি এমনি এমনি রাজনীতিতে আসছি। আমি সামাজিক কাজ করতে করতে এ জায়গায় আসছি। আমি যদি রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করি তখনও দেখবেন আমি সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলব কাজ করব।
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আপনার অবস্থান?
একটা ভিডিওতে তিন লাখ টাকা সাকিবকে দেওয়া নিয়ে আমার মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে সাকিব আমাকে মারতে আসেন। আমি মনে করি, সাকিবকে কোটি মানুষ অনুসরণ এখন তিনি যদি জুয়ার এম্বাসেডর হন টাকার লোভে মার্ডারের আসামীর দাওয়াতে যান তাহলে আমাদের দুর্ভাগ্য।
ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আমি সরাসরি বলব বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস করার কারিগর কাজী সালাউদ্দীন ও আব্দুস সালাম মোর্শেদি। তারা ফুটবল কে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলেও নিজেরা এগিয়ে গিয়েছেন। ফুটবলকে সিঁড়ি করে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন।
ফুটবল নিয়ে অনেক আগ্রহ আপনার , অগ্রগতি কতদূর?
আমার ক্লাবের অগ্রগতি অনেক। গত দেড় বছরে ১২ জন খেলোয়াড় ঢাকার বিভিন্ন লীগে খেলছেন। ৩ জন খেলোয়ার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি সি টিমে থাকা ২/৩ জন ( যাদের বয়স ১২-১৩) আগামীতে জাতীয় দলে খেলবেন এটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলে দিতে পারি।
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় বিদ্যুৎ বিভাগের ১২টি প্রতিষ্ঠান নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মীদের ‘ইনসেনটিভ বোনাস’ প্রদান করলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ক্ষেত্রে এ সুবিধা দিতে অপারগতা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।
প্রতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কী কী কাজ করবে তা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে অন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা দলিল হলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদার করার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ চুক্তি করা হয়।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য গত ২৯ ডিসেম্বর এক সভায় ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তা অনুমোদন দেয়। গত ২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী সচিব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এপিএ অর্জনের সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শতকরা ৯৯ দশমিক ৩২ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটিকে তার কর্মীদের ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ডিপিডিসি এবং ওজোপাডিকোকে ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভের সুপারিশ করা হয় যাদের প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে ৯৬ দশমিক ৬৯ এবং ৯৫ দশমিক ২৩। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং পিজিসিবি এ চারটি প্রতিষ্ঠানকে ১ দশমিক ২৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হয়েছে। ১টি ইনসেনটিভ বোনাসপ্রাপ্তরা হলো বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (৯২.০৮), নেসকো (৯২.২৫) এবং আরপিসিএল (৯৩)। এ ছাড়া ডেসকো, ইজিসিবি এবং বি-আর পাওয়ারজেন শূন্য দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে সুপারিশ অনুযায়ী কর্মীদের বোনাস প্রদান করে। তবে পিডিবির কর্মীরা এখনো ইনসেনটিভ বোনাস পাননি। আদৌ তা পাবেন কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ইনসেনটিভ বোনাস পরিশোধের অনুমোদনের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২ জানুয়ারি পিডিবির সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি পাঠান। এতে বলা হয়, ১টি ইনসেনটিভ বোনাস হিসেবে পিডিবির প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পিডিবির রাজস্ব বাজেটে সংস্থান আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থ বিভাগের এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানোর পর গত ২১ মার্চ তা নাকচ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগ তাদের চিঠিতে বলেছে, এপিএ অর্জনের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক রয়েছে, যা সরকারের প্রতিটি সংস্থার ‘রুটিন’ কাজ। রুটিন কাজের জন্য ইনসেনটিভ বোনাস দাবি করা যৌক্তিক নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশে অনেক সংস্থা আছে, যাদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় সরকারের অনুদানে পরিচালিত হয়। এসব সংস্থা বা দপ্তরগুলো এপিএ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে থাকে। এখন যদি পিডিবিকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বোনাস দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিটি সংস্থা থেকে একই দাবি আসবে। এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বিঘিœত হতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিপরীতে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করা হলো।
বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি সন্তোষজনক না। তারপরও এ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কোম্পানি বা সংস্থাকে ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া যেতে পারে তাদের কাজের পারফরম্যান্স বিবেচনায়। শুধু পুরস্কার দিলেই হবে না। পাশাপাশি কেউ যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কাজের গতি বাড়বে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে যদি ইনসেনটিভ বোনাসের কথা উল্লেখ থাকে তাহলে তারা যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে তবে এটা তাদের প্রাপ্য।
এ বিষয়ে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এর আগেও তারা এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে বোনাস পেয়েছেন। এবারও বোনাসের আশায় বাড়তি কাজ করেছেন। হঠাৎ বোনাস না পাওয়ার খবর শুনে সবার ভেতর চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রতিষ্ঠানের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সব কোম্পানি এমনকি পিডিবির সমমনা প্রতিষ্ঠান আরইবি তাদের পরিচালনা পর্যদের সিদ্ধান্তে অন্তত এক মাস আগে এ বোনাস প্রদান করেছে। তাদের কর্মীদের ওই টাকা খরচও হয়ে গেছে। আর আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদন চাওয়ার নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। অন্যরা পেলেও পিডিবির কর্মীরা কেন বঞ্চিত হবে? সবার জন্য একই নিয়ম থাকা দরকার।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের অনেক সময় অফিসের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় পরিবারকে সময় দিতে পারি না। এরপরও যদি বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে কর্মীরা বাড়তি কাজ করতে উৎসাহ হারাবে।’
ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ভাড়া ৫৩ হাজার টাকা। এ রুটের অন্যসব এয়ারলাইনস আরও কম দামে যাত্রী বহন করলেও বিমান করে না। খালি যাবে, তাও কম ভাড়ায় যাত্রী নেয় না বিমান।
ঢাকা থেকে বিমান কত বেশি ভাড়া নেয় তা স্পষ্ট বোঝা যায় নিকটতম প্রতিবেশী শহর কলকাতার দিকে চোখ বোলালে। কলকাতার নেতাজি সুভাষ বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমানের তিন ভাগের এক ভাগ ভাড়া দিয়ে কুয়ালালামপুর যাওয়া যায়।
ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে উড়ে যাওয়া এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে বিমানের ভাড়া বেশি। বিমানের ভাড়া শুধু বেশিই নয়, এই এয়ারলাইনস ভাড়া বাড়ানোর নেতৃত্ব দেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রথমে বিমান ভাড়া বাড়ায় পরে প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য এয়ারলাইনসগুলো সেই সুযোগ নেয়।
অন্য এয়ারলাইনসের তুলনায় বিমানের ভাড়া বেশি এ অভিযোগ ছিল মূলত জনশক্তি রপ্তানিকারক ও ট্রাভেল এজেন্টদের। তাদের সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছেন সাধারণ যাত্রীরাও। কুয়ালালামপুর, রিয়াদ বা জেদ্দার মতো বাংলাদেশি শ্রমিকপ্রবণ শহরগুলোতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ব্যবহারকারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, দেশের বেসরকারি টেলিভিশন এমনকি খবরের কাগজগুলোতে যেচে এসে বলে যাচ্ছেন বিমান অনেক বেশি ভাড়া নিচ্ছে।
কীভাবে বিমান ভাড়া বাড়ায় জানতে চাইলে একজন জনশক্তি রপ্তানিকারক জানান, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিতে কী ভূমিকা রাখে তা নতুন করে বলার দরকার নেই। তাদের কর্মস্থলে পাঠাতে বা ফিরিয়ে আনতে বিমানের বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই। বিমান কোনো দিন কোনো ঘোষণায় বলেনি ‘এ উদ্যোগটি শুধু রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য’। এই শ্রমজীবীদের জন্য বিমানের কোনো ছাড় নেই। বরং যখন যে ‘আদম বাজার’ চাঙ্গা হয় তখন সেখানে ভাড়া বাড়িয়ে দেয় বিমান। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় প্রচুর শ্রমিক যাচ্ছে। সেখানে ভাড়া বাড়িয়েছে সংস্থাটি। শ্রমিক এবং ওমরাহর কারণে জেদ্দার টিকিটই পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও তা অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়।
এ অবস্থা থেকে বিমান কীভাবে বের হয়ে আসতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিমান নানা পলিসি নিতে পারে। বিকল্প রুট চালু করতে পারে। ট্রানজিট দিয়ে যাত্রীদের গন্তব্যে নিতে পারে। এতে যাত্রীরা কম দামে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ যাত্রী যেহেতু শ্রমজীবী তাই তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর বিষয়টিই গুরুত্বপূর্ণ। কত সময় ট্রানজিট নিয়ে গেল তা মুখ্য নয়। ঠিক এ জায়গাটিতেই এগিয়ে আছে আমাদের নিকটবর্তী শহর কলকাতা। ঢাকার তুলনায় অনেক কম দামে কলকাতার যাত্রীরা গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন। সেখান থেকে পরিচালিত এয়ারলাইনসগুলো সরাসরি বা এক-দুটি ট্রানজিট দিয়ে অনেক কমে যাত্রী বহন করে। বিমান কেন পারে না সেই প্রশ্নটি কেউ তুলছে না।
এক সপ্তাহ পর আগামী ৪ এপ্রিল ফ্লাই (যাত্রা) করার জন্য গতকাল সোমবার দুপুরে ঢাকা কুয়ালালামপুর রুটের বিমান টিকিটের দাম ছিল ৫৩ হাজার ২৭ টাকা। থাই এয়ারওয়েজ ৪১ হাজার ৭৬ টাকায়, ইন্ডিগো এয়ার ৪৩ হাজার ৬৪৪, ইউএস-বাংলা ৪৭ হাজার ১৯, এয়ার এশিয়া ৪৯ হাজার ৪৪৫, মালিন্দো এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৯০ এবং মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের ভাড়া ছিল ৬১ হাজার ৪৭২ টাকা।
অথচ কলকাতা থেকে এয়ার এশিয়া একই দিনে একই গন্তব্যে নন-স্টপ ফ্লাইটে মাত্র ১৭ হাজার ৩৭৯ টাকায় পৌঁছে দেওয়ার অফার ছিল অনলাইনে। এয়ারক্রাফটের মানভেদে একই দিনে বিভিন্ন সময়ে টিকিটটির দাম ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত ছিল। ইন্ডিগো এয়ার চেন্নাইয়ে একটি স্টপেজ দিয়ে ২০ হাজার ৩৩৭ টাকায় অফার দেয়। কলকাতা থেকে কুয়ালালামপুরে যাওয়ার জন্য এয়ার ইন্ডিয়ার টিকিটের দাম ছিল ২৯ হাজার ৬৩৯ টাকা। মুম্বাই এবং সিঙ্গাপুরে দুই স্টপেজ দিয়ে এয়ারলাইনসটি এ ভাড়া নির্ধারণ করে। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস মুম্বাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে কলকাতা থেকে ৫৪ হাজার ৩২৬ টাকায় যাত্রীদের নিয়ে যায় কুয়ালালামপুর।
ঢাকা রিয়াদ রুটে আগামী ৩ এপ্রিলের এয়ার অ্যারাবিয়ার ভাড়া ৫৪ হাজার ৯৫১ টাকা। শারজায় একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। কলম্বোতে একটি স্টপেজ দিয়ে শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনস রিয়াদ নিয়ে যাবে ৫৬ হাজার ৫৪৫ টাকায়। জাজিরা কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৫ হাজার টাকায়, গালফ এয়ার বাহরাইনে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৭ হাজার ৬৭৭ টাকায়, সৌদিয়া এয়ারলাইনস ৭১ হাজার ৭১১ টাকায় সরাসরি, কুয়েত এয়ারওয়েজ কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৩ হাজার ২৪৭ টাকায়, ওমান এয়ার মাস্কটে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৩২ টাকায়, ফ্লাই দুবাই দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৬৩ টাকায়, কাতার এয়ারওয়েজ দোহায় এক স্টপেজ দিয়ে ৮২ হাজার ৫৫৭ টাকায়, এমিরেটস দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৮৪ হাজার ২৩১ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে। আর ঢাকা-রিয়াদ রুটে বিমানের ভাড়া ১ লাখ ৫৫ হাজার ১৪৭ টাকা। ৩ এপ্রিল কলকাতা থেকে রিয়াদ যাওয়ার ভাড়াও ঢাকা রিয়াদের তুলনায় অনেক কম।
কলকাতা থেকে মাত্র ৩৫ হাজার ৩২৪ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে এয়ার ইন্ডিয়া। মুম্বাইতে মাত্র একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীদের সেখানে পৌঁছে দিচ্ছে। ওইদিন সময়ভেদে তাদের ভাড়া ৪১ হাজার টাকা পর্যন্ত ওঠানামা করছে। এক স্টপেজ দিয়ে ফ্লাই দুবাই নিয়ে যাচ্ছে ৪১ হাজার ৫৬০ টাকায়। ইতিহাদ এয়ারওয়েজের ভাড়া ৪১ হাজার থেকে ৪২ হাজার টাকা। এয়ার ইন্ডিয়া দিল্লিতে একটি স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪১ হাজার ৪১৯ টাকা। গালফ এয়ার মুম্বাই এবং বাহরাইনে দুই দফা স্টপেজ দিয়ে নিচ্ছে ৪৫ হাজার ৫৮৭ টাকা। ইন্ডিগো এয়ার দিল্লিতে এক স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪৮ হাজার ১৮৭ টাকা। দুবাইতে এক দফা বিরতি দিয়ে এমিরেটস কলকাতা থেকে রিয়াদের ভাড়া নিচ্ছে ৫৪ হাজার ৬৪৬ টাকা। কাতার এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৩৮ টাকায় এবং এমিরেটস ৬০ হাজার ১০৮ টাকায় একটি বিরতি দিয়ে কলকাতা থেকে রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে।
এসব রুটে বিমানের উচ্চমূল্য নির্ধারণই ভাড়া বৃদ্ধির মূল কারণ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এর সঙ্গে আছে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর ফ্লাইট কমানো এবং উচ্চ দামের সুযোগ নিতে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের কারসাজি এবং ২০২৩ সালে ডলারের বর্ধিত বিনিময় দর। জেট ফুয়েলের দাম বৃদ্ধিও টিকিটের দাম বৃদ্ধির কারণ।
বিমানের এমডি শফিউল আজিম বিমান ভাড়া বৃদ্ধিতে নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টি না মানলেও রিক্রুটিং এজেন্ট, ট্রাভেল এজেন্ট বা হজ এজেন্সির তরফ থেকে বরাবরই এ অভিযোগ করা হচ্ছে। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, যখন বিমান ভাড়া বাড়ায় তখন অন্য এয়ারলাইনসগুলোও ভাড়া বাড়ায়। বিমান যখন বাড়ায় তখন কোনো সীমা মানে না। তারা ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ায়।
৩৫ বছরের পেশাজীবনের কথা উল্লেখ করে মাজহারুল ইসলাম বলেন, বিমানের ভাড়ার সঙ্গে কুলাতে পারছি না। একজনকে বাইরে পাঠানোর সব খরচ অনুমান করা যায়, বিমান ভাড়া ছাড়া। কারণ ৫ ডলারের ভিত্তিভাড়া তারা ৩০ ডলার থেকে শুরু করে। বিমান ধারাবাহিকভাবে জ্বালানি খরচ বৃদ্ধির কথা বলে। কিন্তু জ্বালানি খরচ কমছে। যখন কমে তখন বিমান ভাড়া কমায় না। বিমান যেভাবে ভাড়া বাড়ায় তাতে ব্যবহারকারীদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এ অবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার বলে তিনি মনে করেন।
বিমানের ভাড়া প্রায় মহামারীর সময়ের মতো অবস্থায় চলে গেছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্টরা । বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে শ্রম আমদানিকারক দেশের গন্তব্যগুলোতে ভাড়া বেড়েছে। ঢাকা-জেদ্দা রুটে টিকিট পাওয়াই সৌভাগ্য। এ মাসের শুরুতে যে ভাড়া ছিল ৫০ হাজার তা এখন ৮০ হাজারেও পাওয়া যাচ্ছে না।
বিমান ভাড়া বৃদ্ধির সবচেয়ে বেশি খেসারত দিচ্ছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি)-ওয়েবসাইট তথ্য দিচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ২ লাখ ১৩ হাজার শ্রমিক বিদেশে গেছে। যাদের বেশিরভাগই গেছেন মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।
গত বছরের শেষদিকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলা হয়। বাজার নতুন করে শুরু হওয়ার পর ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে টিকিটের দাম আকস্মিকভাবে বেড়েছে। ব্যাংকক, কলম্বো বা অন্যান্য শহরে ট্রানজিট ফ্লাইট দিয়েও অনেক এয়ারলাইন কুয়ালালামপুরে যাত্রী বহন করছে। এতে টিকিটের দাম কমেছে ৩০-৪০ হাজার টাকা।
এবার হজ প্যাকেজে বিমান ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। এ টাকা বাড়িয়ে হজ প্যাকেজ ঘোষণার পর সংশ্লিষ্টরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। হজযাত্রী এবং হাবের ধারাবাহিক বিরোধিতা উপেক্ষা করে বিমান ভাড়া বাড়িয়ে যচ্ছে। এবারও বাড়িয়েছে। গত ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হজবিষয়ক এক সভায় হাবের সিনিয়র সহসভাপতি ইয়াকুব শরাফতি হজে বিমান ভাড়া কমানোর অনুরোধ করেন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত বিমানের এমডি ভাড়া কমানোর সুযোগ নেই বলে জানান। বৈঠকে হজে কেন বিমান ভাড়া বাড়নো হলো তার যৌক্তিকতা জনসমক্ষে তুলে ধরার নির্দেশনা দেওয়া হয় এমডিকে।
ইয়াকুব শরাফতি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করেছি হজের বিমান ভাড়া কমানোর জন্য। বিমান কোনোভাবেই কমাতে রাজি হয়নি।’
বিমানের বর্ধিত ভাড়ার সুযোগে সৌদিয়া দেশ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে যাচ্ছে। কারণ বিমান যে ভাড়া নির্ধারণ করে সৌদিয়াও একই ভাড়ায় হজযাত্রী বহন করে। হজের চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশি হজযাত্রীদের অর্ধেক বহন করবে সৌদি আরবের এয়ারলাইনস।
আটাবের সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া জানান, প্রধান এয়ারলাইনসগুলোর পাশাপাশি এয়ার অ্যারাবিয়ান, ফ্লাই দুবাই, সালাম এয়ারের মতো বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলো তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের তুলনায় কম ভাড়া নেওয়ার কথা। অথচ কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের চেয়ে বেশি নিচ্ছে। বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলোও তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে মাত্র ৫০০ বা ১০০০ টাকা কম নিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে বেশি ভাড়া নিচ্ছে। অথচ সরকারের কাছে তাদের প্রজেকশন ছিল তারা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে অর্ধেক মূল্যে যাত্রী নেবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার মনিটরিং কম থাকায় তারা ইচ্ছেমতো ভাড়া নিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।