
ডুবন্ত জাহাজের সঙ্গে নাকি জাহাজের ক্যাপ্টেনকেও সলিল সমাধি নিতে হয়। কাল মিরপুরে রোহিত শর্মাকে দেখে মনে হলো এমনই এক জাহাজের অধিনায়ক, মাঝসাগরে যার সলিল সমাধি অবধারিত। বুড়ো আঙুলের চোটের কারণে ব্যাট করতে নেমেছেন ৯ নম্বরে। অন্যপ্রান্তে সঙ্গী দীপক চাহার, ভারতের জিততে তখনো ৪৫ বলে ৬৫ রান দরকার।
ভাঙা আঙুলে সেখান থেকেই দলকে প্রায় জিতিয়েই দিচ্ছিলেন রোহিত, ৫ ছক্কা আর ৩ বাউন্ডারিতে ২৭ বলে ৫১ রানের ইনিংস খেলে অসম্ভব এক সমীকরণ প্রায় মিলিয়েই দিয়েছিলেন ভারতীয় অধিনায়ক। শেষ বলে জয়ের জন্য লাগত ছয় রান, সৌম্য সরকারের বলে বছর চারেক আগে কলম্বোতে যে হিসাবটা মিলিয়ে দিয়েছিলেন দীনেশ কার্তিক। কিন্তু রোহিত পারলেন না, বলা যায় মোস্তাফিজুর রহমান পারতে দিলেন না। শেষ বলটা করেছেন লেগস্টাম্পে ইয়র্কার, উড়িয়ে মারার জন্য জায়গাই দেননি রোহিতকে। তাতেই ৫ রানের জয়ে ওয়ানডে সিরিজটা ২-০ তে নিজেদের করে নিল বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের বিপক্ষে রোহিত সবসময়ই সফল। ব্যাট হাতে, নেতৃত্বেও। ২০১৮ সালের নিদাহাস ট্রফিতে সে-সময়কার নিয়মিত অধিনায়ক বিরাট কোহলি বিশ্রামে, নেতৃত্বে রোহিত। শেষ বলে ছক্কায় রোহিতের হাতে ট্রফি এনে দিলেন দীনেশ কার্তিক। একই বছর এশিয়া কাপ, সেখানেও ফাইনালে শ্বাসরুদ্ধকর জয়ে রোহিতের ভারতের হাতে শিরোপা। ২০১৫ ও ২০১৯, দুই বিশ্বকাপেই বাংলাদেশের বিপক্ষে শতরান। বাংলদেশের বিপক্ষে এত সাফল্য যার, অধিনায়ক হিসেবে বাংলাদেশ সফরে এসে তাকেই কি না নিতে হচ্ছে ওয়ানডে সিরিজে হারের দায়ভার? মোহাম্মদ সিরাজের বলে সিøপে এনামুল হক বিজয়ের বলে ক্যাচ নিতে গিয়ে আঙুলে চোট পেয়েছিলেন রোহিত। শেষ চেষ্টা হিসেবেই ব্যাটিং গ্লাভস কেটে, বুড়ো আঙুলে ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে ব্যাট করতে নামা রোহিতের। এভাবেও জিতিয়েই দিচ্ছিলেন ভারতকে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারলেন না। বরং কাছে এসেও হৃদয় ভাঙার যে কষ্ট ভারতের কাছে হেরে পেয়েছে বাংলাদেশ, তারই যে প্রতিশোধ দেশের মাটিতে। প্রথম ম্যাচটা শেষ উইকেটে বাংলাদেশ জিতেছে, পরের ম্যাচটা ভারত হেরেছে শেষ বলে।
এই সিরিজে টানা দ্বিতীয়বারের মতো টসে জিতলেন লিটন দাস। দলে এক পরিবর্তন, হাসান মাহমুদের জায়গায় নাসুম আহমেদকে এনে তিন স্পিনারে ভারতকে আটকানোর চেষ্টা। কিন্তু টস জেতার পর লিটন আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত জানাতেই খানিকটা বিস্ময়, রাতের শিশিরে স্পিনারদের তো বল হাতে ধরতেই সমস্যা।
গোড়াপত্তনে একটু অদল-বদল, ডান-বামের প্রথা ভেঙে লিটনের সঙ্গী আনামুল হক। কিন্তু তাতে বাংলাদেশের টপ অর্ডারের চেহারাটা একটু ভালো হলেও বদলায়নি। আগের ম্যাচে নাজমুল হোসেন শান্ত আউট হয়েছিলেন প্রথম বলে, এনামুল দুই চারে ১১ রান করে আউট হলেন। শান্ত নিচে নেমে কিছু রান পেয়েছেন, ২১ রান করার পর উমরান মালিকের যে বলটায় তার স্টাম্প উড়ে গেছে সে বলের গতি ছিল ঘণ্টায় ১৫১ কিলোমিটার!
পরপর দুই ওভারে ওয়াশিংটন সুন্দরের শিকার সাকিব আল হাসান (৮) ও মুশফিকুর রহিম (১২)। দলীয় ৬৯ রানে নেই ৬ উইকেট, চোখ রাঙাচ্ছে একশর নিচে অলআউট হওয়ার চোখ রাঙানি। এমন সময় দৃশ্যপটে মেহেদি হাসান মিরাজের আগমন। আগের ম্যাচে বাংলাদেশকে অবিস্মরণীয় এক জয় এনে দিয়েই নিজের কাজটা শেষ মনে করেননি মিরাজ, কাল আবারও দায়িত্বশীল ইনিংসে বুঝিয়ে দিলেন ব্যাটিংয়ের হাতটা খারাপ নয় তার। সপ্তম উইকেটে মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে ১৬৫ বলে ১৪৮ রানের জুটি গড়েন মিরাজ। আগের ম্যাচে নেতিবাচক মানসিকতার ব্যাটিং করায় বেশ সমালোচনাই শুনতে হয়েছে মাহমুদউল্লাহকে। কাল ফের দেখালেন, আগের সেই ঝলক এখনো খানিকটা আছে তার ব্যাটে।
৯৬ বলে ৭৭ রানে আউট হয়েছেন মাহমুদউল্লাহ, তবে মিরাজকে আউট করা যায়নি। শেষ ওভারে ১৫ রান নিয়ে নিজের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি করার পাশাপাশি বাংলাদেশকেও ২৭১ রানের সংগ্রহে পৌঁছে দিয়েছেন মিরাজ। ১০ রানে ৩ উইকেট ওয়াশিংটন সুন্দরের, জোড়া শিকার উমরান মালিক ও মোহাম্মদ সিরাজের।
বছর তিনেক আগে, ইডেনে গোলাপি বলের টেস্টে বিরাট কোহলিকে আউট করার পর সেই যে স্যালুট ঠুকেছিলেন ইবাদত হোসেন, তার প্রায় তিন বছর ধরে ভারতের এই ব্যাটসম্যানের কোনো শতরান ছিল না! কাল সেই ইবাদতকে পুল করতে গিয়ে স্টাম্পে বল টেনে আনলেন কোহলি। রোহিতের অবর্তমানে ইনিংসের সূচনায় নেমে মাত্র ৫ রানে বোল্ড হয়ে ফেরেন কোহলি, মোস্তাফিজের বলে মিরাজের হাতে ক্যাচ দিয়ে আউট শিখর ধাওয়ানও। ১৩ রানে নেই ভারতের ২ উইকেট। ওয়াশিংটন সুন্দরকে (১১) আগে পাঠিয়েও লাভ হয়নি, ভরসা জোগাতে পারেননি লোকেশ রাহুলও (১৪)। ভারতকে ম্যাচে রাখে শ্রেয়াশ আইয়ার আর অক্ষর প্যাটেলের ১০৭ রানের জুটি।
কিন্তু এই দুজনের দ্রুত বিদায়ে ভারত যখন হারের দোরগোড়ায়, তখনই দৃশ্যপটে রোহিতের আগমন। ভাঙা আঙুল নিয়ে ব্যাট করে ভারতকে জিতিয়েই দিচ্ছিলেন রোহিত, যদিও তাকে শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখার জন্য বাংলাদেশের ফিল্ডারদের অবদানও কম নয়। মাহমুদউল্লাহ’র করা ৪৯তম ওভারটায় রোহিত কোনো সিঙ্গেলস নেননি, জায়গায় দাঁড়িয়ে ব্যাট চালিয়ে শুধু ছক্কার চেষ্টাই করে গেছেন। দুটো ছক্কা হয়েছে, ক্যাচ পড়েছে দুটো। একবার ফেলেছেন ইবাদত, আরেকবার আনামুল
শেষ ওভারে মোস্তাফিজকে আটকাতে হবে ২০ রান, প্রথম বলটা ডট হলেও পরের দুই বলে দুই বাউন্ডারিতে লক্ষ্যের কাছে পৌঁছে যায় ভারত। শেষ তিন বলে ভারতের চাই ১২ রান, মোস্তাফিজ একটা ডট বল দিলেও পরের বলটায় সোজা ছয় মারেন রোহিত। আবারও শেষ বলে ছয় রানের সমীকরণ, কিন্তু এবার আর কলম্বো ফিরল না ঢাকায়। মোস্তাফিজের ইয়র্কারে নিশ্চিত হলো বাংলাদেশের ৫ রানের জয়, সেই সঙ্গে ২-০ তে নিশ্চিত হলো সিরিজও।
বিএনপির আগামী ১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে রাজধানীর নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। গতকাল বুধবার বিকেল ৩টা থেকে শুরু হয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা চলা সংঘর্ষের সময় পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে বিএনপি কার্যালয় ও এর আশপাশের এলাকা। এ সময় মুহুর্মুহু ককটেল বিস্ফোরণ হয়। সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মকবুল হোসেন নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তাকে নিজেদের দলীয় কর্মী বলে দাবি করেছে বিএনপি। এ ছাড়া সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশের ছোড়া শর্টগানের গুলিতে দলের আরও অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন বিএনপি নেতারা।
দলটির নেতাদের অভিযোগ, হঠাৎ করে পুলিশ দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে তাদের নেতাকর্মীদের সরিয়ে দিতে ফাঁকা গুলি ছোড়ে। একই সঙ্গে কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকে দরজা-জানালা ভাঙচুর করে। তবে পুলিশ বলছে, যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিএনপি নেতাকর্মীদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে গেলে তারা প্রথমে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন। বিএনপি কার্যালয়ের ভেতর থেকে শতাধিক নেতাকর্মীকে আটকের পর বিপুলসংখ্যক ককটেল উদ্ধার করা হয় বলেও জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
এদিকে সংঘর্ষ শেষে সন্ধ্যায় বিএনপি কার্যালয়ে তল্লাশি শুরু করে পুলিশ, যা শেষ হয় রাত ৯টায়। সেখান থেকে দলটির কয়েকজন শীর্ষ নেতাসহ তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল সকাল থেকেই বিএনপি ও এর অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হতে থাকেন। সব মিলিয়ে দুই হাজারের বেশি নেতাকর্মী হাজির হন। সেখানে দুটি ট্রাকে অস্থায়ী মঞ্চ বানিয়ে নেতারা বক্তব্য রাখছিলেন। বিকেল ৩টার দিকে পুলিশ তাদের রাস্তা ছেড়ে চলে যেতে অনুরোধ জানায়। কিন্তু নেতাকর্মীরা সেই অনুরোধে সাড়া না দিলে পুলিশ তাদের রাস্তা থেকে সরানোর চেষ্টা করে। এ সময় ককটেল বিস্ফোরণে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ তখন রাবার বুলেট, টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালায়। বিএনপি নেতাকর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে আশপাশের অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ভেতর থেকেও ইটপাটকেল ছোড়া হয়। আবার নেতাকর্মীদের ছুড়ে মারা ইটের টুকরো তুলে তা পাল্টা নিক্ষেপ করতেও দেখা যায় পুলিশকে। নয়াপল্টনের প্রধান সড়কে অবস্থান নেয় পুলিশ। বিকেল সাড়ে ৩টার মধ্যে পুরো পল্টনের রাস্তা নিয়ন্ত্রণে নেয় পুলিশ। এরপর থেমে থেমে কয়েক দফা দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্ক ও ফকিরেরপুল এলাকায় মুখোমুখি অবস্থান নেয় পুলিশ ও বিএনপির নেতাকর্মীরা। সংঘর্ষ চলাকালে নয়াপল্টন, ফকিরেরপুল এবং নাইটিঙ্গেল ও কাকরাইল মোড় পর্যন্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যা পর্যন্ত থেমে থেমে সংঘর্ষ চলে। বিএনপি কার্যালয়ের উল্টো পাশ থেকে দলটির নেতাকর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু ককটেল ছুড়লে বিস্ফোরণের ধোঁয়ায় পুরো এলাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরপর হঠাৎ করেই বিএনপি নেতাকর্মীরা গলি থেকে বেরিয়ে এসে ককটেল নিক্ষেপ করেন। এ সময় পুলিশকেও পাল্টা আক্রমণ করতে দেখা গেছে। পুলিশ দফায় দফায় টিয়ার শেল ছুড়তে থাকে। ফকিরেরপুল পানির ট্যাঙ্কের সামনে টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সংঘর্ষ শুরুর আগে সকাল থেকে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন সেøাগান দিতে থাকেন। মাইক ও ব্যানারসহ কার্যালয়ের সামনে অস্থায়ী মঞ্চও ছিল। একপর্যায়ে মাইক্রোফোনে ঘোষণা দেওয়া হয় নেতাকর্মীদের রাস্তায় বসে পড়তে। মুহূর্তে শত শত নেতাকর্মী রাস্তায় বসে পড়লে ফকিরেরপুল থেকে কাকরাইল পর্যন্ত রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ আগে থেকেই সেখানে সতর্ক অবস্থানে ছিল। প্রিজন ভ্যান ও জলকামানও প্রস্তুত রাখা ছিল।
সংঘর্ষ চলাকালেই আহত কয়েকজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মকবুল হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক পৌনে ৪টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, সংঘর্ষ শুরুর পর অসংখ্য নেতাকর্মীর সঙ্গে আহত ব্যক্তিরাও বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের ভেতরে অবস্থান নেন। এই সময় পুলিশ কার্যালয়ের ভেতর কাঁদানে গ্যাসের কয়েকটি শেল ছোড়ে। তখন বিএনপির পক্ষ থেকে চারটি অ্যাম্বুলেন্স নয়াপল্টন কার্যালয়ের সমানে এলে সেগুলোকে দাঁড়াতে দেয়নি পুলিশ। তারা দাবি করেন, ভেতরে অবস্থান নেওয়া অন্তত ১৫ থেকে ২০ জন আহত ছিলেন। কাঁদানে গ্যাসের কারণে তাদের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।
বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেন, সন্ধ্যা ৫টা ২০ মিনিটে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য নিয়ে বিএনপি কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশ করেন। এ সময় দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় দরজা বন্ধ পান। পরে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকেন। সেখান থেকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, প্রচার সম্পাদক ও মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি আবদুল কাদের ভূইয়া জুয়েল, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, আমান উল্লাহ আমানসহ দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে আটক করেন। এ সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে ছুটে এলেও তাকে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। দলীয় কার্যালয়ের গেট আটকে রাখলে গেটের সামনেই বসে পড়েন। সেখানে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এটা ন্যক্কারজনক হামলা। পুলিশ গেট বন্ধ করে ভেতরে তল্লাশির নামে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করছে। ভেতরে বিস্ফোরক ঢুকিয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার ব্যবস্থা করছে। এটা অসাংবিধানিক।’
আটকের আগে রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশের এ গুলি চালানো সম্পূর্ণ পরিকল্পিত। ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ বানচাল করতে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থানরত নিরীহ নেতাকর্মীদের ওপর গুলি ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করা হয়েছে।’
নেতাকর্মীদের আটকের পর কার্যালয়ের সামনে থেকে সমাবেশের প্রচারের কাজে থাকা দুটি ট্রাক র্যাকার দিয়ে টেনে নিয়ে যায় পুলিশ।
সংঘর্ষ থামার পর ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল জোনের উপ-কমিশনার হায়াতুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘সমাবেশের স্থান নিয়ে যখন আলোচনা চলছে তখন এই সংঘর্ষ শুরু হলো। সকাল থেকে পল্টনে বিএনপির নেতাকর্মীরা ভিড় করতে শুরু করেন। একপর্যায়ে পুরো রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। আমরা তাদের সরে যেতে বারবার অনুরোধ করি। কিন্তু তারা আমাদের কথা শোনেননি। একপর্যায়ে তাদের সরিয়ে দিতে গেলে তারা পুলিশের ওপর হামলা করেন।’
তল্লাশি অভিযান শেষে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধান হারুন অর রশিদ বলেন, বিএনপি কার্যালয় থেকে নগদ ২ লাখ টাকা, ১৬০ বস্তা চাল, পৌনে ২ লাখ পানির বোতলসহ রান্নার উপকরণ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া অবিস্ফোরিত ১৫টি বোমা পাওয়া গেছে।
বিএনপি কার্যালয় থেকে ৩০০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আটকদের কারও বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, কারও বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। মামলার বাইরে যাদের আটক করা হয়েছে, যাচাই-বাছাই করে তাদের বিষয়ে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পেশায় কাপড়ের কারিগর ছিলেন নিহত মকবুল : নয়াপল্টনের সংঘর্ষে নিহত মকবুল হোসেন (৪৫) পেশায় কাপড় তৈরির কারিগর ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে। বাবার নাম মৃত আবদুস সামাদ। তিনি মিরপুর-১১’র লালমাটিয়া বাউনিয়া বাঁধের টিনশেড বাসায় ভাড়া থাকতেন। মকবুলের লাশ শনাক্ত করেন ভাই নুর হোসেন। তার লাশ দেখতে পরিবারের সদস্যরা হাসপাতালে ছুটে আসেন। এ সময় তাদের আহাজারিতে হাসপাতালের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। নিহত মকবুল গতকাল সকালে বাসা থেকে বের হন বলে জানান স্ত্রী হালিমা আক্তার। তাদের এক কন্যাসন্তান রয়েছে।
আইন অমান্য করে সমাবেশ করলে সর্বোচ্চ ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি : ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেছেন, জননিরাপত্তা ও জনদুর্ভোগের কথা চিন্তা করে নয়াপল্টনে বিএনপিকে গণসমাবেশের অনুমতি দেওয়া যাবে না। আইন অমান্য করলে বিএনপির বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গতকাল সন্ধ্যায় ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘নয়াপল্টনের সামনে ১০ লাখ লোকের জায়গা হবে না। সর্বোচ্চ এক লাখ লোক দাঁড়াতে পারবে। বাকি ৯ লাখ লোক ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ছড়িয়ে পড়বে। যার ওপর বিএনপির কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। আমরা গোয়েন্দা সংস্থা এবং মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পেরেছি, বিএনপি ঢাকা শহরে ১০ লাখ লোক জমায়েতের মাধ্যমে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। কাজেই পার্টি অফিসের সামনে জনদুর্ভোগ করে এবং ঢাকার আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন করে তাদের সেখানে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া যাবে না।’
প্রচলিত নিয়ম মেনেই সভা-সমাবেশ করতে হবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, বিএনপিকে দেশের প্রচলিত নিয়ম মেনেই সভা-সমাবেশ করতে হবে। ২০-২৫ লাখ মানুষের সমাগম ঢাকায় সম্ভব না। তবুও তারা পল্টনেই কেন সমাবেশ করতে চায়, তা খতিয়ে দেখবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গতকাল রাজধানীর তেজগাঁওয়ে আওলাদ হোসেন মার্কেটে এক অনুষ্ঠান শেষে তিনি এ সব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিগত সংসদ নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়ায় কক্সবাজারবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আসছে সংসদ নির্বাচনে নৌকার জন্য ভোট চান। তিনি বলেন, আপনারা ’১৮-তে নৌকায় ভোট দিয়েছেন। আমরা ক্ষমতায় এসেছি। টানা তিনবার ক্ষমতায় রয়েছি। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ভোট হবে, সেবারও আমাকে ভোট দিয়ে আমাদের জয়যুক্ত করবেন।
গতকাল বুধবার কক্সবাজারের শহীদ শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আয়োজিত আওয়ামী লীগের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী আগামী নির্বাচনের জন্য নৌকার পক্ষে থাকার এ আহ্বান জানান।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার নিজেরও কক্সবাজার খুবই প্রিয় উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনারা কি নৌকায় ভোট দেবেন? আপনারা হাত তুলে ওয়াদা করেন দেবেন কি না।’ এ সময় জনসভাস্থল থেকে হাত তুলে লাখো লাখো জনতা ‘শেখ হাসিনার সরকার বারবার দরকার’ স্লোগান দিতে থাকেন।
সমাবেশস্থল স্টেডিয়াম মাঠ ছিল কানায় কানায় পরিপূর্ণ। বেলা ১টার মধ্যে সমাবেশস্থল পূর্ণ হয়ে যায়। বাকিরা স্টেডিয়াম মাঠের বাইরে দাঁড়িয়েই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শোনেন। কক্সবাজারের স্থানীয় জনগণের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কক্সবাজারবাসী, আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাই যে আপনারা ২০১৮ সালের নির্বাচনে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আমাদের প্রার্থীদের জয়যুক্ত করেছিলেন। ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮বারবার আপনারা ভোট দিয়েছেন। আপনাদের ভোট বৃথা যায়নি।’ সাগরপাড়ের শেখ কামাল আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভাস্থলের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি লোক ছিল রাস্তায়। শহরের লালদীঘির পাড় থেকে শুরু করে হলিডের মোড় হয়ে কলাতলীর সুগন্ধা পয়েন্ট পর্যন্ত ছিল লোকারণ্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজার এলেন সাড়ে ৫ বছর পর। তবে এর মধ্যে তার সরকার টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কক্সবাজারের উন্নয়নে রেকর্ড পরিমাণ বরাদ্দ দেয়। এই উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে অভিভূত কক্সবাজারবাসী। গত মঙ্গলবার থেকেই চকরিয়া, পেকুয়া, টেকনাফ ও মহেশখালী থেকে হাজার হাজার নেতাকর্মী কক্সবাজার এসে জড়ো হন। আর গতকাল সকাল থেকেই মিছিল আর মিছিলের নগরীতে পরিণত হয় পুরো এলাকা। উৎসবের সাজে সড়কে সড়কে শোভা পায় ফেস্টুন, ব্যানার।
সরকারপ্রধান বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যই আমার সংগ্রাম। যে লক্ষ্য সামনে নিয়ে আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সে লক্ষ্যেই আমি কাজ করছি।’
বক্তব্যের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বাংলার জনগণের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। আপনারা বারবার ভোট দিয়ে আমাকে নির্বাচিত করেছেন বলেই আমি দেশের জন্য কাজ করতে পারছি।’
জামায়াত-বিএনপি অগ্নিসন্ত্রাস, খুন ও মানি লন্ডারিং দিয়েছে : জামায়াত-বিএনপি এ দেশের মানুষকে কী দিয়েছে? এই প্রশ্ন রেখে শেখ হাসিনা বলেন, অগ্নিসন্ত্রাস, খুন, মানি লন্ডারিং এগুলো দিয়েছে। তিনি বিএনপি-জামায়াতকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘যারা দেশের উন্নয়ন না করে সম্পদ বিদেশে পাচার করেছে, লুট করেছে এবং জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে তারা কীভাবে জনগণের পাশে থাকবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এতিমের টাকা মেরে খাওয়া ও বিদেশে সম্পদ পাচারই ছিল খালেদা-তারেকের কাজ। তারা দেশের শান্তি চায় না। অস্ত্র মামলায় এখনো তাদের একজন সাজা ভোগ করছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড বোমা হামলা ঘটিয়েছে ওরা। তারা জ্বালাও-পোড়াও ছাড়া কিছুই পারে না।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘যে গ্রেনেড যুদ্ধের মাঠে ব্যবহার করা হয়, সেই গ্রেনেড মারা হয়েছিল আমাদের ওপর। গ্রেনেড হামলায় আমাদের আইভি রহমানসহ অনেকে মারা গেছেন। আল্লাহর রহমতে আমি সেদিন বেঁচে গিয়েছিলাম। ধ্বংস করা ছাড়া বিএনপি-জামায়াত এ দেশকে কিছুই দিতে পারে না। পঁচাত্তরের পর এরা ২১ বছর ক্ষমতায় ছিল। কী দিয়েছে বাংলাদেশকে? তারা কিছুই দিতে পারেনি।’
আবার আসিব ফিরে, এই কক্সবাজার সমুদ্রের তীরে : শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার বাবা যখন জেল থেকে বের হতেন, তখন আমাদের কক্সবাজার নিয়ে আসতেন। আমরা এখানে ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। এতই উন্নয়ন করেছি, একসময় দেখবেন, এই মহেশখালী সিঙ্গাপুরের চেয়ে সুন্দর হবে।’ ভবিষ্যতে কক্সবাজারে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কুতুবদিয়া ও মহেশখালীতে আরও দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করে দেব। আমাদের সব সময়ের লক্ষ্য এ অঞ্চলের উন্নয়ন। মানুষের সমস্যা আমরা জানি, আমরা সে অনুযায়ী কাজ করছি।’ কক্সবাজারকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করে কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা ‘আবার আসিব ফিরে’-এর অনুকরণে ‘ আবার আসিব ফিরে, এই কক্সবাজার সমুদ্রের তীরে’-এই পঙ্তি দিয়ে তিনি বক্তব্য শেষ করেন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কেউ কক্সবাজারের দিকে মুখ ফিরে তাকায়নি : প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর এই কক্সবাজার তথা বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের প্রতি কেউ ফিরে তাকায়নি। দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে কক্সবাজারকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছিল। কক্সবাজারে একে একে ১২টি মেগা প্রকল্পসহ ৭৩টি উন্নয়ন প্রকল্প কক্সবাজারে চলমান রয়েছে। ইতিমধ্যে ২৯টি প্রকল্প সমাপ্ত করতে পেরেছি। কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, রেললাইন, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে জনগণ এর সুফল ভোগ করবে। বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধিশীল দেশে রূপান্তরের কাজ চলছে। ২০৪১ সালে আমরা সে লক্ষ্যে পৌঁছাব, ইনশা আল্লাহ। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশে কোনো মানুষ ঠিকানাহীন ও গৃহহীন থাকবে না।’
জনসভায় অন্যান্যের মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফসহ কেন্দ্রীয় এবং জেলা পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
নজর কেড়েছে সেলিমের মোটরসাইকেল: রংবেরঙের টিশার্ট-টুপি পরে মিছিলে মিছিলে দলে দলে সবাই ছুটছেন শেখ হাসিনার জনসভায়। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে সমাবেশস্থলের একটু সামনের মোটেল রোডের লাবণী মোড়ের তিন রাস্তার মাথায় উৎসুক জনতার দৃষ্টি আটকে গেল একটি মোটরসাইকেলের আরোহীর দিকে। মিছিল থেকে বেরিয়ে অনেকেই তার সঙ্গে সেলফি তুলছেন। কেউ কেউ গল্পও জুড়ে দিয়েছেন লাল-সবুজ টুপি ও বাদামি রঙের পাঞ্জাবির ওপর মুজিব কোট পরিহিত মধ্যবয়সী ওই লোকের সঙ্গে। এই মোটরসাইকেলের পেছনেই শোভা পাচ্ছে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকা। জাতীয় পতাকার সঙ্গে মিলিয়ে লাল-সবুজ রঙের সাজানো হয়েছে নৌকাটি। এতে লেখা রয়েছে নৌকায় ভোট দিন। তার নাম মোহাম্মদ সেলিম। তিনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ২৯ নম্বর ওয়ার্ড পশ্চিম মাদারবাড়ী এলাকার। নৌকার আদলের মোটরসাইকেল নিয়ে ১৫৮ কিলোমিটার মহাসড়ক পাড়ি দিয়ে এসেছেন শেখ হাসিনার ভাষণ শুনতে।
পেট্রলবোমায় নিহত বাবা, বিচার দাবি : ২০১৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি কাতার যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকায় যাচ্ছিলেন কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বরইতলীর ইউসুফ। কিন্তু কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে পৌঁছার পর ঢাকাগামী বাসে আগুন-সন্ত্রাসীদের পেট্রলবোমা হামলায় মারা যান তিনি। এর সাত বছরে সেই ঘটনার বিচার হয়নি। নিহত বাবার হত্যার বিচার চেয়ে গতকাল ফেস্টুন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সমাবেশস্থলের সামনের সড়কে অবস্থান করছিলেন জাহেদ ইসলাম রুবেল। প্রধানমন্ত্রীর নজরে পড়লেই বাবা হত্যার বিচার পাবেন এমন আশায় সারা দিনই তিনি ছিলেন সমাবেশস্থলের আশপাশে।
ঢাকার বাইরে বিভাগীয় গণসমাবেশ সফল হওয়ায় বিএনপির নেতাকর্মীদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাস বেড়েছে বহুগুণে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে রাজধানীতে ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশের আগেই দলটির নেতাকর্মীদের সেই মনোবল ও আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরাতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এরই অংশ হিসেবে বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-মামলা ও আটক অভিযান শুরু করা হয়েছে। চলবে আরও কয়েক দিন। বিএনপিকে দুর্বল করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব জানা গেছে।
ক্ষমতাসীন দলের নেতারা জানান, বিএনপির নেতাকর্মীদের আটক অভিযান অব্যাহত রেখে মনোবল দুর্বল করা যাবে, নিশ্চিত হয়েই এ কৌশলে এগোচ্ছে সরকার। এ কৌশলের কারণে আন্তর্জাতিক মনোভাব ও প্রতিক্রিয়া কী হয় সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিতে চায় আওয়ামী লীগ।
ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে দিতে চাইলেও কোনোভাবেই চরমপন্থা নিতে চায় না। অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটিয়ে সমালোচনার দায় নিতে চায় না ক্ষমতাসীনরা।
গতকাল বুধবার বিএনপির কার্যালয়ের সামনে পুলিশের অভিযানের সময় সংঘর্ষে মৃত্যুর ঘটনা ঠিক কী কারণে তা খতিয়ে দেখবে সরকার। অন্য কোনো পক্ষ সুবিধা নিতে চায় কি না, সেটাও সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা হবে। কারণ, এমন ঘটনা সরকার বা আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা চান না।
ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকার ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের চাওয়া হলো ঢাকা মুক্ত রাখা। তাই ঢাকার বাইরে বিনা বাধায়ই বিএনপি বিভাগীয় সমাবেশ করেছে। তবে ঢাকায় কর্মসূচি পালন করতে বিএনপিকে ছাড় দেওয়া হবে না, সে ব্যাপারে আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখা হয়েছে। ঢাকায় বিনা বাধায় কর্মসূচি পালন করতে থাকলে বিএনপি আরও চাঙ্গা হয়ে উঠবে। তাই বিএনপির ঢাকার কর্মসূচিকে গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে আওয়ামী লীগ ও সরকার।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আজকে (গতকাল) বিএনপির পূর্বনির্ধারিত কোনো কর্মসূচি ছিল না। বিএনপির নেতাকর্মীরা কেন নয়াপল্টনে গেল, পুলিশের ওপর হামলা করল? এতেই প্রমাণ হয়, বোঝা যায় বিএনপির সংঘাত-নাশকতা করার পূর্বপরিকল্পনা রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপির নেতাকর্মীরা পুলিশের ওপর হামলা করল, ককটেল ফাটাল, এত ককটেল আসে কোত্থেকে?’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘যেকোনো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে কেউ কোনো বাধা দেবে না। এ জন্যই বিএনপি শান্তি নষ্ট করার কর্মসূচি বেশি করতে চায়।’
আওয়ামী লীগের একাধিক নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১০ ডিসেম্বর ঘিরে পুলিশ যেমন মাঠে থাকবে, তেমনি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও সতর্ক থাকবে।
দলটির নীতিনির্ধারকরা দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, বিএনপির সংঘাত-সংঘর্ষ প্রতিরোধ করা হবে। তাই ১০ ডিসেম্বরের আগেই মাঠে নামতে শুরু করেছে ক্ষমতাসীনরা। নয়াপল্টনেই বসবে গতকাল বিএনপি এমন বার্তা দিতে চাইলে বসে থাকেনি সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীও আটক করার সুযোগ তৈরি হয়। পাশাপাশি বিএনপি কার্যালয়ে তল্লাশিও করেছে পুলিশ।
সূত্র জানায়, সমাবেশের স্থান নিয়ে বিএনপি অনড় অবস্থান দেখাবে সেটা জানাই ছিল ক্ষমতাসীন দলের। সমাবেশের স্থান নিয়ে মূলত বিতর্ক শুরু হয়েছে। ফলে ইস্যু সৃষ্টি করতে হলে সমাবেশ স্থান নিয়ে বিতর্ক তোলা জরুরি ছিল। শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে।
ওই সূত্র জানায়, বিএনপি যেহেতু স্থান নিয়ে অনড় অবস্থানে চলে গিয়েছে সে ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানে যেতে হয়েছে সরকারকেও। এ প্রশ্নে বিএনপি যেমন ছাড় দিতে চায় না, আওয়ামী লীগও ছাড় দেবে না। ওই সূত্র আরও জানায়, সমাবেশ স্থান নিয়ে কোনো পক্ষই এখন পিছু হটবে না। যে পক্ষই পিছু হটতে যাবে সে পক্ষই একরকম পরাজয় মেনে নিতে হবে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘১০ ডিসেম্বরের বিএনপির কর্মসূচি ঘিরে কোনো ষড়যন্ত্র না থাকলে সমাবেশের স্থান নিয়ে কেন তারা অনড় অবস্থানে চলে গিয়েছে? জনগণের ভোগান্তি হবে এ কারণে সরকার জনবহুল এলাকা বাদ দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির কর্মসূচির প্রস্তাব করেছে। এ প্রস্তাবকে ভিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই।’
এদিকে ওই দিনটি ঘিরে আজ বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও দুই অংশের মেয়রদের সঙ্গে বৈঠকে বসবে আওয়ামী লীগের সম্পাদকম-লী। সকাল সাড়ে ১০টায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এ সভা থেকে ১০ ডিসেম্বরের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হবে।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, গতকাল সকাল থেকে মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন স্থানে মিছিলসহকারে অবস্থান নেন। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নেতাকর্মীদের অনেকেই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে সতর্কাবস্থানে থেকেছেন। ছোট ছোট মিছিল দেখা গেছে ভূতের গলি, হাতিরপুল ও রাসেল স্কয়ারে।
বিএনপির গণসমাবেশ সামনে রেখে শুক্রবার বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের দক্ষিণ গেটে সমাবেশ করবে মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ। এ সমাবেশ থেকে নেতাকর্মীদের একটি অংশ ১০ ডিসেম্বর শনিবার পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ এলাকায় থেকে যাওয়ার কথা জানা গেছে। প্রায় প্রতিদিনই সকাল-বিকেল সভা-সমাবেশ করে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের নগর উত্তর-দক্ষিণের নেতারা। সে সঙ্গে বিভিন্ন ওয়ার্ডে মহড়া দিচ্ছেন তারা।
মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ১০ ডিসেম্বর তারা টঙ্গী, আশুলিয়া ও গাবতলীতে সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করবেন। ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ সাভারের রেডিও কলোনি মাঠে ১০ ডিসেম্বর সমাবেশ ডেকেছে। পাশাপাশি দলটির নেতাকর্মীরা কেরানীগঞ্জেও সতর্ক পাহারার ব্যবস্থা নিয়েছেন।
রাজধানীতে ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ সামনে রেখে হঠাৎ করেই গতকাল বুধবার বিকেলে পুলিশ বিএনপির কার্যালয়ের সামনে অভিযান শুরু করে। একপর্যায়ে কার্যালয়েও ঢুকে পড়ে। পুলিশ টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড মেরে বিএনপির কার্যালয়ে জড়ো হওয়া নেতাকর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে। পুলিশের অভিযানের বিষয়টি আগে থেকে আঁচ করতে পেরেছিল জানিয়ে দলটির নেতারা বলেছেন, তাদের আশঙ্কাই সত্যি হলো।
এ ঘটনার প্রতিবাদে আজ বৃহস্পতিবার গুলশানে হোটেল লেকশোরে সংবাদ সম্মেলন করবেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
গতকাল নয়াপল্টনে সংঘর্ষের খবর শুনে ছুটে আসেন মির্জা ফখরুল। তিনি কার্যালয়ে ঢুকতে চাইলে কলাপসিবল গেট বন্ধ করে দেয় পুলিশ। এ সময় বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমার দলের কার্যালয়ে কেন আমি ঢুকতে পারব না। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে চেয়েছি। সরকার ভয়াবহ ঘটনা ঘটিয়েছে। সমাবেশ বানচাল করতেই এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ঘটনার দায় সরকারকে নিতে হবে। পরিস্থিতি শান্ত করতে ডিএমপি কমিশনার আমাকে নয়াপল্টনে আসতে বলেছেন। অথচ আসার পরে আমাকে অফিসে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।’
আচমকা পুলিশের মারমুখী আচরণে বিস্ময় প্রকাশ করে বিএনপি মহাসচিব কার্যালয়ের সামনে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ব্যবহার করে একটা ভয়াবহ, ভীতিকর ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা আশা করতে পারি না, একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ের সামনে এ রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।’ এ সময় তিনি এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে সেখান থেকে পুলিশ প্রত্যাহারের দাবি জানান। মির্জা ফখরুল বলেন, ‘অন্যথায় সব দায়দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তাবে।’
কার্যালয়ের সামনে বসে দেশ রূপান্তরকে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিএনপির শান্তিপূর্ণ আন্দোলন বিতর্কিত করতে পারে সরকার এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করে গত মঙ্গলবার ঢাকার বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার মিশন প্রধানদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে বলেছিলাম। এরপর ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই সরকার তার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে নয়াপল্টনে আমাদের দলীয় কার্যালয়ে অবস্থানরত নেতাকর্মীদের ওপর টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে শতাধিক নেতাকর্মীকে আহত করেছে। দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে।’
এর আগে ২০১৩ সালে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করেছিল গোয়েন্দা পুলিশ। তখন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দেড় শতাধিক শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার সাংবাদিকদের কাছে দাবি করে বলেন, ‘বিএনপির পার্টি অফিসে বোমা রয়েছে। পুলিশকে লক্ষ্য করেও বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে।’ তবে বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক ও সাবেক সংসদ সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা একটা ভিডিও ফুটেজ পেয়েছি। যেখানে দেখা যাচ্ছে ডিবি পুলিশ একটি বাজারের পলিথিনের ব্যাগে করে কার্যালয়ে ঢুকছে। পুলিশ বাজারের একটি ব্যাগে করে দলের কার্যালয়ের ভেতর বোমা নিয়ে গেছে।’
১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশের স্থান ঘিরে সরকারের সঙ্গে বিএনপির দরকষাকষি চলছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে। তবে বিএনপি এতে রাজি নয়। দলটি নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনেই গণসমাবেশ করতে চাইছে।
এ পরিস্থিতিতে ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ কি করা সম্ভব এমন এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সমাবেশকে কেন্দ্র করেই তো এগুলো হচ্ছে। তারা সমাবেশকে নষ্ট করার চেষ্টা করছে।’
রাতে ফখরুলের পাশে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা : রাতে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গিয়ে মির্জা ফখরুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, ভাসানী অনুসারী পরিষদ আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুুম, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) কার্যকরী সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, গণ অধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া ব্যারিস্টার কায়সার কামালের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতারা নয়াপল্টনে মির্জা ফখরুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
মির্জা আব্বাসের বাসা ঘিরে রাখা হয় : রাতে মির্জা আব্বাস অভিযোগ করে বলেন, ‘নয়াপল্টনে নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশের হামলার খবর পেয়ে সেখানে যেতে চাইলে আমার বাসার সামনের গেট ও রাস্তা অবরুদ্ধ করে রাখে পুলিশ, র্যাব ও ডিবি পুলিশ। এ ছাড়া স্থানীয় ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা আমার বাসার সামনে অবস্থান নেয়। তাদের বাধার কারণে আমি যেতে পারিনি।’
আহতদের হাসপাতালে নিতে দেয়নি পুলিশ : বিএনপির স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পুলিশের ছোড়া টিয়ার শেলে আহত নেতাকর্মীরা কার্যালয়ে অবস্থান করে বারবার আমাকে অনুরোধ করেছিলেন অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে তাদের যেন হাসপাতালে নেওয়া হয়। কার্যালয়ে আটকে পড়া জ্যেষ্ঠ নেতারা আমাকে ফোন করে অনুরোধ জানান। খবর পেয়ে আহতদের হাসপাতালে নিতে দুটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে গিয়েছিলাম বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। পুলিশ আহতদের আনতে দেয়নি। শুধু তাই নয়, অ্যাম্বুলেন্সে আঘাত করেছে। ভাঙার চেষ্টা করেছে। পরে আমরা সেখান থেকে চলে যাই।’
গত রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠক হয়েছে। বৈঠক শেষে স্থায়ী কমিটির এ সদস্য দেশ রূপান্তরকে জানান, দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলার প্রতিবাদে আজ বৃহস্পতিবার সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে আজ বিকেল ৩টায় হোটেল লেকশোয় শরিক দলগুলোকে নিয়ে যে সংবাদ সম্মেলন করার কথা ছিল তা স্থগিত করা হয়েছে।
নয়াপল্টনেই সমাবেশ : সংঘর্ষের আগে গতকাল দুপুরে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘সরকার গ্রহণযোগ্য ও পছন্দনীয় স্থানের প্রস্তাব না করলে বিএনপি আগামী ১০ ডিসেম্বর নয়াপল্টনেই সমাবেশ করবে।’ রাতে স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত বহাল রাখা হয়েছে বলে কমিটির এক সদস্য জানিয়েছেন।
কাতারে এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপ খুব চমৎকার ভাবে হচ্ছে। আমরা দেখেছি বেশ কিছু ছোট দলকে দারুণ সব জয় পেতে। আবার অনেক দলকে দেখেছি দুর্ভাগ্যজনক ভাবে হেরে যেতে। এসবই ফুটবলের সৌন্দর্য, এজন্যই ফুটবল অনিশ্চয়তার খেলা। এখন আমরা নকআউট পর্বে পৌঁছে গেছি। আসর যত এগোবে, ছোট দলের সম্ভাবনা ততই কমে আসবে আর যেসব দল অনেক ভালো প্রস্তুতি নিয়ে আসতে পেরেছে এবং নিজেদের কৌশল ও ট্যাকটিকসকে বিশ্বকাপের ছন্দের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পেরেছে তারাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে।
নেইমারের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করেছে যে ব্রাজিল শিরোপার দৌড়ে এগিয়ে আছে। ব্রাজিল তাদের শেষ ম্যাচে এমন এক পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছে যা দর্শকদের কাছে মন্ত্রমুগ্ধকর আর পরবর্তী প্রতিপক্ষ ক্রোয়েশিয়ার কাছে আতঙ্কের। তিতের ব্রাজিল রীতিমতো দক্ষিণ কোরিয়ার রক্ষণকে ছিন্নভিন্ন করে প্রথমার্ধেই চারটা গোল করে দারুণ এক জয় তুলে নিয়েছে। দুঃখজনক ভাবে ম্যাচটা আমার দেখা হয়নি কারণ কাতারে গোটা দুয়েক ম্যাচ দেখার পর সেখান থেকে তখন আমি মাত্র দেশে ফিরে এসেছি।
লোকে তিতের কৌশল নিয়ে অনেক প্রশ্ন তোলে। প্রথমে অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন ফুটবলারদের গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে বিশ্রাম দেওয়া নিয়ে, যে ম্যাচটা ব্রাজিল হেরেছিল। এরপর প্রশ্ন ওঠে পরের ম্যাচে শুরু থেকেই কেন নেইমারকে খেলানো হচ্ছে। আমার মনে হয় তারা উত্তরটা পেয়ে গেছে। যখন নেইমার মাঠে থাকে, তখন প্রতিপক্ষ তাকে আটকে রাখতেই ব্যস্ত থাকে। তার পেছনেই দেখা যায় এক-দুইজন খেলোয়াড়কে সারাক্ষণ পাহারায়। এতে করে রিচার্লিসন, ভিনিসিয়ুস ও রাফিনহাদের জন্য অনেক জায়গা বের হয় আর তখন তারা অনেক বেশি সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। আর দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ব্রাজিল দলকে আমরা যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে খেলতে দেখলাম, সেটা সম্ভব হয়েছে ওই একটা ম্যাচে বিশ্রাম দেওয়ার ফলেই।
আমার মনে হয় রক্ষণটা কোন কৌশলে কাদের নিয়ে সাজাতে হবে, তার চূড়ান্ত সমাধান পেয়ে গেছে তিতে। তার এই কৌশলটা নিখুঁতভাবে কাজ করছে। মিলিতাও আরও একবার খুব ভালো খেলেছে, দানিলো বাম দিকে খেলেছে আর এটাই ওর আসল জায়গা। মাঝমাঠও খুব ভালো করেছে আর খুব জমাট ছিল, প্রতিপক্ষ বল নিয়ে সহজে মাঝমাঠই পার করতে পারেনি।
শেষ আটে লড়াইটা হবে ব্রাজিলের আক্রমণভাগের সঙ্গে ক্রোয়েশিয়ার অভিজ্ঞ রক্ষণভাগের। ক্রোয়েশিয়া দলটার সঙ্গে ২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপে রানার্সআপ হওয়া দলের খুব একটা পার্থক্য নেই। তবে তাদের সবারই বয়স চার বছর করে বেড়েছে। রাশিয়ায় রানার্সআপ হওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়েই জøাতকো দালিচের দল শেষ আটে ব্রাজিলের বিপক্ষে মাঠে নামবে আর প্রস্তুত হবে শেষ আটে ব্রাজিলের বিপক্ষে বাঁচা-মরার লড়াইয়ের জন্য।
মাঝমাঠে লড়াইটা হবে কাসেমিরো আর লুকা মদ্রিচের। তারা একে অন্যকে খুব ভালো করে জানে। এই বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত ব্রাজিল দলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে কাসেমিরো। তিতে তার ওপর খুব ভরসা করে। ৩৭ বছর বয়সী লুকা মদ্রিচকে আরও একবার কাপ জয়ের লড়াইতে দেখতে পারাটাও হবে দারুণ ব্যাপার। অভিজ্ঞতা আর নৈপুণ্য বিচার করলে মদ্রিচ কিন্তু এগিয়ে থাকবে কাসেমিরোর চেয়ে। তবে ব্রাজিলিয়ানের পক্ষে আছে তার বয়স আর রক্ষণ আগলে রাখার কৌশল। এই ম্যাচটা হবে ব্রাজিলের আক্রমণের বিপক্ষে ক্রোয়েশিয়ার রক্ষণের, যারা চেষ্টা করবে শেষ পর্যন্ত গোল করার সব রাস্তা আটকে রেখে ম্যাচটা টাইব্রেকারের দিকে নেওয়ার। এই ম্যাচে তুরুপের তাস হবে নেইমার। তার আক্রমণাত্মক কৌশল আর বুদ্ধিদীপ্ততাই ভাঙতে পারে ক্রোয়েশিয়ার রক্ষণ দেয়াল। এই মুহূর্তে দলে কোনো চোট সমস্যা নেই আর দারুণ সব খেলোয়াড় মাঠে নামতে মুখিয়ে আছে।
আমি আশা করছি সম্ভাব্য সেরা ফলের; আমাদের জাতীয় দল যদি এই ছন্দ ধরে রাখতে পারে তাহলে তারাই আবারও বিশ্বকাপ জিতবে।
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার সকালে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এরপর দুপুরে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। এই বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তিন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখানে মূলত আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে দেশের রাজনীতিতে যে উত্তাপ দেখা দিয়েছে তা নিয়েই আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে আনিসুল হক গণমাধ্যমে বলেছেন, তাদের এ বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মূলত শ্রম আইন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরামর্শ ছিল। বৈঠকে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এ মাসেই জেনেভা যাওয়ার কথা রয়েছে।
পরে বেলা ১টা ১০ মিনিটে মার্কিন দূতাবাসে প্রবেশ করেন বিএনপি মহাসচিব। এরপর বেলা আড়াইটার দিকে তিনি দূতাবাস থেকে বের হন। রাতে মির্জা ফখরুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই নীতি দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক হবে আমরা মনে করি বলে রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রদূতকে আমি জানিয়েছি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া আওয়ামী লীগের অধীনে দেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। দেশের জনগণও তাই মনে করে। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমাদের কোনো আলাপ হয়নি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সম্প্রতি আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছিলেন, “নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন।” তার এমন বক্তব্য নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠলে পরে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেয় আইন মন্ত্রণালয়। এরপর গতকাল মঙ্গলবার সকালে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কীভাবে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দেশের সংবিধানে কী আছে তা-ও জানতে চেয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।’
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আরও বেশি দৌড়ঝাঁপ শুরু করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দূরত্ব এখন স্পষ্ট। আলোচনা আছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা এ দেশটি হঠাৎ আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য ছিল না। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে দেশটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ নিয়ে কোনো দ্বিমত করেনি। এরই মধ্যে, ভিসানীতি ঘোষণা করে সরকারকে বড় চাপ দেওয়ার পূর্বাভাস দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। তবে ভিসানীতি যে সরকারের ও আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি চাপ তৈরি করেছে, সেটা ভেতরে-বাইরে আলোচনা আছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও কূটনীতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পাল্টে নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনে সংবিধানের বাইরে যেতে হবে সরকারকে এমন প্রস্তাব দিতে চলেছে। ওই সূত্রগুলো দাবি করেছে, গত মাসের শেষের দিকে অথবা চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাসভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিটার হাস ওই বৈঠকে রাজনৈতিক সমঝোতায় না আসলে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সরকারের আদলে একটা কিছু করার বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। তা না হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানসম্মত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও দেওয়া হয়েছে। আনিসুল হকের সঙ্গে শ্রম আইন নিয়েও দীর্ঘ আলাপ করেন এ রাষ্ট্রদূত।
আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের ওই প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেলে তাতে বড় আপত্তি তোলা হয়। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়া যাবে না এটা ধরেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর বার্তা দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তারা স্বীকার করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তবে নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতা করবে ধরে নিয়েই সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পিটার হাস সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও নির্ধারিত-অনির্ধারিত বৈঠক করা শুরু করেছেন। গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে পিটার হাসকে উদ্দেশ্য করে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রাষ্ট্রদূতরা সীমা লঙ্ঘন করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে সরকার।
আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘নাহি ছাড়ি’ অবস্থান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
সরকারের দুই মন্ত্রীও দেশ রূপান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের বিপক্ষে যেতে শুরু করেছে। ‘অন্যায় হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে পিটার হাসের।
আওয়ামী লীগের কূটনীতিসম্পৃক্ত এক নেতা বলেন, সরকার বিকল্প হিসেবে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে চলেছে। বিকল্প দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে নির্বাচন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে মাইনাস করে চলার এক ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হবে। এ কৌশলে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করা হবে নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভিসানীতি মূলত সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই ভিসানীতিকে সব গেল বলে ধরে নিয়ে অবস্থান টলমলে করে তুলতে চায়। এরকম অবস্থা আওয়ামী লীগকে একটু চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা যেন সাহস হারিয়ে না ফেলে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করার কৌশল গ্রহণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ কি তাদের অবস্থান থেকে সরতে শুরু করবে? আবার প্রশ্নও আছে যে, নির্বাচন কি হবে? জাতীয় সরকার আসবে খুব শিগগিরই, এমন গুঞ্জনও রয়েছে জোরালোভাবে। শুধু তাই নয়, বাতিল হওয়া নির্বাচন পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমন গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। যদিও এসবে কোনো ভিত্তি রয়েছে মনে করেন না আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা দাবি করেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। এ ইস্যুতে কোনো শক্তির সঙ্গেই আপস করবেন না আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো দেশের চাওয়ায় বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হবে না। দেশের মানুষের চাওয়া অনুযায়ী সংবিধানসম্মতভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, সবার মতো করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে বদ্ধপরিকর।
কূটনীতিসম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরেক নেতা বলেন, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মনে করা হলেও সেপ্টেম্বরের আগে পশ্চিমা এ দেশটি তার চূড়ান্ত অবস্থান পরিষ্কার করবে না বলে তারা মনে করছেন। ওই নেতা বলেন, সেপ্টেম্বরে ভারত সফর রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। মূলত সেই সফরেই বোঝা যাবে সরকার কোনদিকে যাবে। এ নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের ডিপ্লোম্যাসি (পররাষ্ট্রনীতি) পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতি। কূটনীতিতে প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি অনেক নেতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। সেই আস্থা-বিশ্বাসও প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের রয়েছে।’
এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে না ওঠায় সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করতেন, দেশটিকে তারা বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রমাণ করে না যে, ক্ষমতাধর দেশটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া ঠিক আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণার পরই দেশটির অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে এমন কথা কেউ আর বিশ্বাস করছে না।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমেরিকাকে মাইনাস ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় রাজনীতিতে তারা ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি একটাই বুঝি, একটাই জানি, আগামী নির্বাচন সংবিধানসম্মতভাবেই হবে। এ জায়গা থেকে একটুও নড়বে না সরকার।’
রাজধানীর বনানীর একটি রেস্তোরাঁ থেকে জামায়াতে ইসলামীর বনানী শাখার ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তাদের মধ্যে বনানী থানা জামায়াতের আমির তাজুল ইসলাম এবং সেক্রেটারি আব্দুর রাফি রয়েছেন।
বনানী থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওয়ারলেস গেটে অবস্থিত নবাবী রেস্টুরেন্টে গোপন মিটিং করাকালে বনানী থানা জামায়াতে ইসলামী আমির তাজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা রাফিসহ ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
আটক ১০ জনের মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাও রয়েছেন।
পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকার ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয় ব্যবসায়ীদের। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেনাপোল, হিলি ও ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে গত সোমবার থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হয়েছে। ট্রান্সপোর্ট খরচ, ট্যাক্স পরিশোধ ও লেবার খরচসহ আমদানিকরদের হাতে ভারতীয় পেঁয়াজের মূল্য দাঁড়িয়েছে ২৭ টাকা। যা ভারতের বাজারে ১৪-১৫ রুপি দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে এখানেও মধ্যস্বত্বভোগীর কারসাজি রয়েছে। দেশি পেঁয়াজের মতো কয়েক হাত ঘুরে অস্বাভাবিক দামে ২৭ টাকার পেঁয়াজ পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ৫৬-৬০ টাকায়। তবে আমদানি করা পেঁয়াজ এখনো খুচরা বাজারে পৌঁছায়নি।
গতকাল মঙ্গলবার কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সোমবার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন দেওয়া শুরু হয়। প্রথম দিনে ২ লাখ ৮০ হাজার ৮০০ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। গতকাল দ্বিতীয় দিন শেষে আইপি বা আমদানি অনুমোদনের পরিমাণ ৪ লাখ ৩৩ হাজার টনে দাঁড়িয়েছে।
দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বছরে প্রায় ২৮ থেকে ৩০ লাখ টন। চলতি বছর পেঁয়াজের নিট উৎপাদন ধরা হচ্ছে ২৪ লাখ ৫৩ হাজার টন। ফলে বাকি পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬ লাখ ৬৫ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছিল। গতকাল কৃষি মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, এদিন বিকেল ৫টা পর্যন্ত বিভিন্ন স্থলবন্দর হয়ে ১ হাজার ২৮৮ টন পেঁয়াজ দেশে এসেছে।
চলতি বছর পেঁয়াজের দর রোজার ঈদের পর থেকেই বাড়তে শুরু করেছিল। এক মাসের ব্যবধানে তা ৩০ থেকে ৮০ টাকায় উঠে যায়। গত কয়েক দিন ধরে ১০০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছিল।
কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার কথা বলে এতদিন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি কৃষি মন্ত্রণালয় না দিলেও পরিস্থিতি দেখে রবিবার সায় দেয়। পরদিনই পাইকারি বাজারে এর প্রভাব দেখা যায়। দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় পেঁয়াজ আসা শুরু হলে পাইকারিতে দাম কমে যায় এক ধাক্কায় ৩০ টাকা। প্রতি কেজি পেঁয়াজের খুচরা মূল্য এখন ৪৫ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয় বলে সরকার মনে করে। আর প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে যে পেঁয়াজ দেশে এসেছে, সেগুলো কেনা প্রতি কেজি ২১ থেকে ২২ টাকার মধ্যে ছিল বলে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা জানিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সব খরচ মিলিয়ে বন্দর পর্যন্ত প্রতি কেজি পেঁয়াজের ক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ২৭ টাকায়। আমদানিকারকরা কেজিপ্রতি ২ টাকা লাভে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে ২৯ টাকায় বিক্রি করছেন। স্থানীয়রা আরও ৫ টাকা লাভে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ঢাকার পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন ৩৪ টাকায়। ঢাকার পাইকাররা শ্যামবাজারে সেই পেঁয়াজ বিক্রি করেন ৫০-৫৬ টাকায়। শ্যামবাজার ব্যবসায়ীর হাতবদল হয়ে কারওয়ান বাজার পাইকারি মার্কেটে এসে বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা করে।
ভোমরা স্থলবন্দরের আমদানিকারক আমির হামজা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভারতীয় বাজার থেকে ১৪-১৫ রুপিতে কিনে সব খরচসহ বন্দর পর্যন্ত প্রতি কেজি পেঁয়াজের মূল্য দাঁড়িয়েছে ২৭ টাকা। কেজিতে ২ টাকা লাভে ভোমরা স্থলবন্দরের স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে ২৯ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
হিলির বন্দর এলাকার আরেক ব্যবসায়ী আহমেদ আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মূলত আমদানিকারকদের থেকে আমরা পেঁয়াজ কিনে থাকি। আমাদের কাছ থেকে ঢাকার ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ সংগ্রহ করেন। কেজিপ্রতি ৩১-৩২ টাকা আমাদের কেনা পড়ে। ঘরভাড়া, লেবার খরচসহ প্রতি কেজি পেঁয়াজে সামান্য লাভ করে ৩৪-৩৫ টাকা বিক্রি করতে হয়। এর নিচে বিক্রি করলে আমাদের ৭০-৮০ পয়সার মতো লোকসান হয়।’
গতকাল রাজধানীর শ্যামবাজার ঘুরে দেখা যায়, ভারত থেকে আসা পেঁয়াজ বাছাই করে দুই ভাগে বিক্রি করছেন শ্যামবাজারের ব্যবসায়ীরা। আকারে কিছুটা ছোট পেঁয়াজের কেজি ৪০-৪৫ ও ভালো মানের পেঁঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৬ টাকায়।
শ্যামবাজারের মেসার্স নিউ সেবা এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার শেখর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আজই (গতকাল) আমদানি করা পেঁয়াজের চালান শ্যামবাজারে এসেছে। হাতেগোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী ভারতীয় পেঁয়াজ পেলেও অধিকাংশ ব্যবসায়ী আমদানি করা এসব পেঁয়াজ পাননি। বেশ কিছু পেঁয়াজ ট্রাকে পচে যাওয়ায় দুই ভাগে তা বিক্রি হয়েছে। তুলনামূলক ভালো প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৪০-৪৫ ও ভালো মানের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৬ টাকা করে।’
জানতে চাইলে শ্যামবাজার পেঁয়াজ সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজি মোহাম্মদ মাজেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বর্তমানে ভারতের বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৩-১৫ রুপিতে। সেই হিসাবে সব খরচ মিলিয়ে আমাদের দেশের পাইকারি বাজারগুলোতে ৩৫-৩৬ টাকায় ভোক্তারা কিনতে পারবেন। তবে এ পেঁয়াজ কেন ৫০ টাকার ওপর বিক্রি হচ্ছে সে বিষয়ে আমার জানা নেই।’
এদিকে ভারত থেকে আসা প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৬০ টাকা করে বিক্রি করতে দেখা গেছে কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীদের। পেঁয়াজ ব্যবসায়ী ময়না মিঞা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভারতীয় পেঁয়াজ দেশের বাজারে আসায় আমাদের অনেক লস হয়েছে। আগের কেনা দেশি পেঁয়াজের কেজিপ্রতি ২০-২৫ টাকা করে লস দিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে আমদানি করা যেসব পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে, তা শ্যামবাজার থেকে বেশি দামে কিনতে হয়েছে। মার্কেটে ক্রেতা না থাকায় সব খরচ মিলিয়ে প্রতি কেজিতে ২ টাকা লাভ করতেও এখন কষ্ট হচ্ছে।’
এদিকে খুচরা বাজারগুলোতে খবর নিয়ে জানা যায়, এখনো ভারত থেকে আসা আমদানি করা পেঁয়াজ খুচরা বাজারে প্রবেশ করেনি। আমদানি করা পেঁয়াজ খুচরা বাজারে না এলেও দেশি পেঁয়াজের দামে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০-৯০ টাকা দরে। যা গত তিন দিন আগেও বিক্রি হয়েছে ১০০-১০৫ টাকায়।
এদিকে ভারতীয় পেঁয়াজ আসায় স্থানীয় বাজারে পেঁয়াজের দাম কমেছে বলে জানান দিনাজপুর ও সাতক্ষীরা প্রতিনিধি। তাদের তথ্যমতে, সোমবার বিকেলে ভোমরা বন্দর দিয়ে ২৮৭ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও ৫০ ট্রাক পেঁয়াজ দেশে প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে।
অন্যদিকে হাকিমপুর প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুরের হিলি বন্দর দিয়ে গত দুদিনে ১৬ ট্রাক পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। আমদানি করা পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকা দরে। আর দেশি পেঁয়াজ ৬০-৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে খরচ বাড়ছে। কোনো যাত্রী আকাশপথে ভ্রমণ করলেই তাকে দিতে হবে ২০০ টাকার কর। একই সঙ্গে বিদেশগামী বিমানযাত্রীদের কর ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে সরকারের তৃতীয় মেয়াদের শেষ (২০২৩-২৪ অর্থবছর) বাজেট উপস্থাপনকালে এসব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এদিকে পর্যটন খাত ও বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে।
পর্যটন খাত : অর্থমন্ত্রীর তার
বক্তৃতায় বলেন, ডলার সাশ্রয়ের জন্য অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ হ্রাস করা, কৃচ্ছ্রতার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং নতুন রাজস্ব আয়ের খাত তৈরি করতে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে ভ্রমণ কর ৬৭ শতাংশ বাড়িয়ে ২ হাজার, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাওয়ার ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ বেড়ে ৪ হাজার এবং অন্যান্য দেশে ৫০ শতাংশ বেড়ে ৬ হাজার টাকা ভ্রমণ কর দিতে হবে।
পর্যটন খাত নিয়ে ব্যাপক পরিকল্পনা : অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় আরও বলেছেন, পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক মানের আবাসন ও বিনোদন সুবিধা নিয়ে কক্সবাজার জেলায় সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কভিড-১৯ মহামারীর সময় দেশের পর্যটনশিল্প মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে এ শিল্পকে সহায়তা করার জন্য সরকার ১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে। বাংলাদেশে পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোতে উন্নয়নে সরকারি অর্থায়নে ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে। পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে একটি পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পর্যটনের উন্নয়ন ও বিকাশের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে ৩৬টি জেলার পর্যটন ব্র্যান্ডিং অনুসারে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার পর্যটন এলাকার ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানগুলো সংরক্ষণে এবং পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান বিষয়ে ডকুমেন্টারি ও টেলিভিশন কমার্শিয়াল প্রস্তুত করা হচ্ছে।
বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়ন : অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বলেন, সরকার দেশে আন্তর্জাতিক মানের বিমান পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তুলতে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। আকাশপথে যাত্রীদের চাহিদা বিবেচনায় চলতি বছরে মালদ্বীপ ও কানাডার টরন্টোতে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট চালু করা হয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের
তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণকাজ ২০২৩ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বর্তমানে দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই কাজ চলছে। কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার লক্ষ্যে রানওয়ে সম্প্রসারণ ও নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করে সেখানে একটি আঞ্চলিক হাব গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে। তাছাড়া দেশের অন্যান্য অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অবকাঠামো, রানওয়ে, ট্যাক্সিওয়ে, হ্যাঙ্গার ও আমদানি-রপ্তানি পণ্য সংরক্ষণের শেডগুলো সংস্কার ও উন্নয়নসাধনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।