
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। পররাষ্ট্র দপ্তরে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে স্থানীয় সময় গত মঙ্গলবার এক প্রশ্নে এ উদ্বেগ প্রকাশ করেন দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস। একই সঙ্গে ঢাকায় নাগরিকদের জনসমাগম এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস।
নেড প্রাইস ওয়াশিংটনে ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশে বলপ্রয়োগ ও রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন। মতপ্রকাশ, সমাবেশ ও শান্তিপূর্ণ সমাগমের মৌলিক অধিকারের প্রতি সম্মান ও তা রক্ষার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি আমরা।’
বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশের ওপর কড়াকড়ি আরোপের ঘটনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন বলে জানান যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র। তিনি বলেন, ‘আইনের শাসনের প্রতি সম্মান দেখাতে এবং সহিংসতা, হয়রানি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন থেকে বিরত থাকতে আমরা সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা প্রার্থীকে হুমকি, উসকানি অথবা এক দল আরেক দল বা প্রার্থীর ওপর যাতে সহিংসতা ঘটাতে না পারে, বিষয়টি নিশ্চিত করতে আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।’
ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়েও কথা বলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র। তিনি বলেন, ‘অর্থপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করতে হলে সহিংসতা, হয়রানি ও নির্ভয়ে ভোটারদের সঙ্গে প্রার্থীদের জনসংযোগ করার সুযোগ করে দিতে হবে। একই সঙ্গে সহিংসতার ঘটনার পূর্ণাঙ্গ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত এবং এসব ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে সরকারকে উৎসাহী করি।’
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য সতর্কবার্তা : ঢাকায় অবস্থানরত নাগরিকদের উদ্দেশে সতর্কবার্তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস। গতকাল বুধবার ঢাকায় দেশটির দূতাবাস তাদের ওয়েবসাইট ও টুইটারে দেওয়া বার্তায় ১০ ডিসেম্বর গণসমাবেশ এড়িয়ে চলার পাশাপাশি বড় জমায়েত এবং তার আশপাশের এলাকার বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে।
ঢাকায় দূতাবাসের টুইট বার্তায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল ঢাকার ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় সমাবেশের ডাক দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের বিক্ষোভ এড়িয়ে চলা উচিত এবং যেকোনো বড় গণজমায়েতের আশপাশে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।’
গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ওয়েবসাইটে দেওয়া বার্তায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন ২০২৪ সালের জানুয়ারি কিংবা তার আগে অনুষ্ঠিত হতে পারে। এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলের সমাবেশ ও নির্বাচনকেন্দ্রিক তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। সাধারণ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক দলের মিছিল ও গণসমাবেশ ক্রমান্বয়ে বাড়তে পারে। বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল ১০ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গণসমাবেশ আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে।’
এ প্রেক্ষাপটে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস দেশটির নাগরিকদের সম্ভাব্য বিপদের বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে। কারণ তাদের মনে রাখা উচিত, বাংলাদেশে সমাবেশ শান্তিপূর্ণ হলেও তা সংঘাতময় হয়ে পরবর্তীকালে সহিংসতায় রূপ নিতে পারে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের গণসমাবেশ এড়িয়ে চলার পাশাপাশি বড় সমাবেশের আশপাশের এলাকার বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত। এ পরিস্থিতিতে ঢাকায় অবস্থানরত নাগরিকদের নিজেদের নিরাপত্তার পরিকল্পনা পর্যালোচনার পাশাপাশি স্থানীয় অনুষ্ঠানসহ নিজেদের চারপাশের বিষয়ে সতর্ক থাকা এবং হালনাগাদ তথ্য জানতে স্থানীয় খবরে নজর রাখার পরামর্শ দিয়েছে।
মানবাধিকার সনদ মেনে চলার তাগিদ জাতিসংঘের : শান্তিপূর্ণ সমাবেশ অনুষ্ঠান এবং মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ মানবাধিকার সনদের বিভিন্ন বিধান মেনে চলার অঙ্গীকার রক্ষায় বাংলাদেশকে তাগিদ দিয়েছে জাতিসংঘ। ঢাকায় নিযুক্ত সংস্থাটির আবাসিক প্রতিনিধি গোয়েন লুইস গতকাল এক বিবৃতিতে এ তাগিদ দেন।
বাংলাদেশে জাতিসংঘ আবাসিক কার্যালয়ের ওয়েবসাইট ও ফেইসবুক পেজে গতকাল বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বিবৃতিটি প্রকাশ করা হয়। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে বিবৃতিটি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির আবাসিক প্রতিনিধি।
বিএনপির আগামী ১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে রাজধানীর নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। গতকাল বুধবার বিকেল ৩টা থেকে শুরু হয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা চলা সংঘর্ষের সময় পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে বিএনপি কার্যালয় ও এর আশপাশের এলাকা। এ সময় মুহুর্মুহু ককটেল বিস্ফোরণ হয়। সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মকবুল হোসেন নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তাকে নিজেদের দলীয় কর্মী বলে দাবি করেছে বিএনপি। এ ছাড়া সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশের ছোড়া শর্টগানের গুলিতে দলের আরও অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন বিএনপি নেতারা।
দলটির নেতাদের অভিযোগ, হঠাৎ করে পুলিশ দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে তাদের নেতাকর্মীদের সরিয়ে দিতে ফাঁকা গুলি ছোড়ে। একই সঙ্গে কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকে দরজা-জানালা ভাঙচুর করে। তবে পুলিশ বলছে, যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিএনপি নেতাকর্মীদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে গেলে তারা প্রথমে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন। বিএনপি কার্যালয়ের ভেতর থেকে শতাধিক নেতাকর্মীকে আটকের পর বিপুলসংখ্যক ককটেল উদ্ধার করা হয় বলেও জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
এদিকে সংঘর্ষ শেষে সন্ধ্যায় বিএনপি কার্যালয়ে তল্লাশি শুরু করে পুলিশ, যা শেষ হয় রাত ৯টায়। সেখান থেকে দলটির কয়েকজন শীর্ষ নেতাসহ তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল সকাল থেকেই বিএনপি ও এর অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হতে থাকেন। সব মিলিয়ে দুই হাজারের বেশি নেতাকর্মী হাজির হন। সেখানে দুটি ট্রাকে অস্থায়ী মঞ্চ বানিয়ে নেতারা বক্তব্য রাখছিলেন। বিকেল ৩টার দিকে পুলিশ তাদের রাস্তা ছেড়ে চলে যেতে অনুরোধ জানায়। কিন্তু নেতাকর্মীরা সেই অনুরোধে সাড়া না দিলে পুলিশ তাদের রাস্তা থেকে সরানোর চেষ্টা করে। এ সময় ককটেল বিস্ফোরণে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ তখন রাবার বুলেট, টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালায়। বিএনপি নেতাকর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে আশপাশের অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ভেতর থেকেও ইটপাটকেল ছোড়া হয়। আবার নেতাকর্মীদের ছুড়ে মারা ইটের টুকরো তুলে তা পাল্টা নিক্ষেপ করতেও দেখা যায় পুলিশকে। নয়াপল্টনের প্রধান সড়কে অবস্থান নেয় পুলিশ। বিকেল সাড়ে ৩টার মধ্যে পুরো পল্টনের রাস্তা নিয়ন্ত্রণে নেয় পুলিশ। এরপর থেমে থেমে কয়েক দফা দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্ক ও ফকিরেরপুল এলাকায় মুখোমুখি অবস্থান নেয় পুলিশ ও বিএনপির নেতাকর্মীরা। সংঘর্ষ চলাকালে নয়াপল্টন, ফকিরেরপুল এবং নাইটিঙ্গেল ও কাকরাইল মোড় পর্যন্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যা পর্যন্ত থেমে থেমে সংঘর্ষ চলে। বিএনপি কার্যালয়ের উল্টো পাশ থেকে দলটির নেতাকর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু ককটেল ছুড়লে বিস্ফোরণের ধোঁয়ায় পুরো এলাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরপর হঠাৎ করেই বিএনপি নেতাকর্মীরা গলি থেকে বেরিয়ে এসে ককটেল নিক্ষেপ করেন। এ সময় পুলিশকেও পাল্টা আক্রমণ করতে দেখা গেছে। পুলিশ দফায় দফায় টিয়ার শেল ছুড়তে থাকে। ফকিরেরপুল পানির ট্যাঙ্কের সামনে টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সংঘর্ষ শুরুর আগে সকাল থেকে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন সেøাগান দিতে থাকেন। মাইক ও ব্যানারসহ কার্যালয়ের সামনে অস্থায়ী মঞ্চও ছিল। একপর্যায়ে মাইক্রোফোনে ঘোষণা দেওয়া হয় নেতাকর্মীদের রাস্তায় বসে পড়তে। মুহূর্তে শত শত নেতাকর্মী রাস্তায় বসে পড়লে ফকিরেরপুল থেকে কাকরাইল পর্যন্ত রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ আগে থেকেই সেখানে সতর্ক অবস্থানে ছিল। প্রিজন ভ্যান ও জলকামানও প্রস্তুত রাখা ছিল।
সংঘর্ষ চলাকালেই আহত কয়েকজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মকবুল হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক পৌনে ৪টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, সংঘর্ষ শুরুর পর অসংখ্য নেতাকর্মীর সঙ্গে আহত ব্যক্তিরাও বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের ভেতরে অবস্থান নেন। এই সময় পুলিশ কার্যালয়ের ভেতর কাঁদানে গ্যাসের কয়েকটি শেল ছোড়ে। তখন বিএনপির পক্ষ থেকে চারটি অ্যাম্বুলেন্স নয়াপল্টন কার্যালয়ের সমানে এলে সেগুলোকে দাঁড়াতে দেয়নি পুলিশ। তারা দাবি করেন, ভেতরে অবস্থান নেওয়া অন্তত ১৫ থেকে ২০ জন আহত ছিলেন। কাঁদানে গ্যাসের কারণে তাদের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।
বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেন, সন্ধ্যা ৫টা ২০ মিনিটে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য নিয়ে বিএনপি কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশ করেন। এ সময় দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় দরজা বন্ধ পান। পরে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকেন। সেখান থেকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, প্রচার সম্পাদক ও মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি আবদুল কাদের ভূইয়া জুয়েল, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, আমান উল্লাহ আমানসহ দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে আটক করেন। এ সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে ছুটে এলেও তাকে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। দলীয় কার্যালয়ের গেট আটকে রাখলে গেটের সামনেই বসে পড়েন। সেখানে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এটা ন্যক্কারজনক হামলা। পুলিশ গেট বন্ধ করে ভেতরে তল্লাশির নামে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করছে। ভেতরে বিস্ফোরক ঢুকিয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার ব্যবস্থা করছে। এটা অসাংবিধানিক।’
আটকের আগে রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশের এ গুলি চালানো সম্পূর্ণ পরিকল্পিত। ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ বানচাল করতে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থানরত নিরীহ নেতাকর্মীদের ওপর গুলি ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করা হয়েছে।’
নেতাকর্মীদের আটকের পর কার্যালয়ের সামনে থেকে সমাবেশের প্রচারের কাজে থাকা দুটি ট্রাক র্যাকার দিয়ে টেনে নিয়ে যায় পুলিশ।
সংঘর্ষ থামার পর ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল জোনের উপ-কমিশনার হায়াতুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘সমাবেশের স্থান নিয়ে যখন আলোচনা চলছে তখন এই সংঘর্ষ শুরু হলো। সকাল থেকে পল্টনে বিএনপির নেতাকর্মীরা ভিড় করতে শুরু করেন। একপর্যায়ে পুরো রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। আমরা তাদের সরে যেতে বারবার অনুরোধ করি। কিন্তু তারা আমাদের কথা শোনেননি। একপর্যায়ে তাদের সরিয়ে দিতে গেলে তারা পুলিশের ওপর হামলা করেন।’
তল্লাশি অভিযান শেষে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধান হারুন অর রশিদ বলেন, বিএনপি কার্যালয় থেকে নগদ ২ লাখ টাকা, ১৬০ বস্তা চাল, পৌনে ২ লাখ পানির বোতলসহ রান্নার উপকরণ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া অবিস্ফোরিত ১৫টি বোমা পাওয়া গেছে।
বিএনপি কার্যালয় থেকে ৩০০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আটকদের কারও বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, কারও বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। মামলার বাইরে যাদের আটক করা হয়েছে, যাচাই-বাছাই করে তাদের বিষয়ে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পেশায় কাপড়ের কারিগর ছিলেন নিহত মকবুল : নয়াপল্টনের সংঘর্ষে নিহত মকবুল হোসেন (৪৫) পেশায় কাপড় তৈরির কারিগর ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে। বাবার নাম মৃত আবদুস সামাদ। তিনি মিরপুর-১১’র লালমাটিয়া বাউনিয়া বাঁধের টিনশেড বাসায় ভাড়া থাকতেন। মকবুলের লাশ শনাক্ত করেন ভাই নুর হোসেন। তার লাশ দেখতে পরিবারের সদস্যরা হাসপাতালে ছুটে আসেন। এ সময় তাদের আহাজারিতে হাসপাতালের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। নিহত মকবুল গতকাল সকালে বাসা থেকে বের হন বলে জানান স্ত্রী হালিমা আক্তার। তাদের এক কন্যাসন্তান রয়েছে।
আইন অমান্য করে সমাবেশ করলে সর্বোচ্চ ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি : ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেছেন, জননিরাপত্তা ও জনদুর্ভোগের কথা চিন্তা করে নয়াপল্টনে বিএনপিকে গণসমাবেশের অনুমতি দেওয়া যাবে না। আইন অমান্য করলে বিএনপির বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গতকাল সন্ধ্যায় ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘নয়াপল্টনের সামনে ১০ লাখ লোকের জায়গা হবে না। সর্বোচ্চ এক লাখ লোক দাঁড়াতে পারবে। বাকি ৯ লাখ লোক ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ছড়িয়ে পড়বে। যার ওপর বিএনপির কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। আমরা গোয়েন্দা সংস্থা এবং মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পেরেছি, বিএনপি ঢাকা শহরে ১০ লাখ লোক জমায়েতের মাধ্যমে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। কাজেই পার্টি অফিসের সামনে জনদুর্ভোগ করে এবং ঢাকার আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন করে তাদের সেখানে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া যাবে না।’
প্রচলিত নিয়ম মেনেই সভা-সমাবেশ করতে হবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, বিএনপিকে দেশের প্রচলিত নিয়ম মেনেই সভা-সমাবেশ করতে হবে। ২০-২৫ লাখ মানুষের সমাগম ঢাকায় সম্ভব না। তবুও তারা পল্টনেই কেন সমাবেশ করতে চায়, তা খতিয়ে দেখবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গতকাল রাজধানীর তেজগাঁওয়ে আওলাদ হোসেন মার্কেটে এক অনুষ্ঠান শেষে তিনি এ সব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিগত সংসদ নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়ায় কক্সবাজারবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আসছে সংসদ নির্বাচনে নৌকার জন্য ভোট চান। তিনি বলেন, আপনারা ’১৮-তে নৌকায় ভোট দিয়েছেন। আমরা ক্ষমতায় এসেছি। টানা তিনবার ক্ষমতায় রয়েছি। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ভোট হবে, সেবারও আমাকে ভোট দিয়ে আমাদের জয়যুক্ত করবেন।
গতকাল বুধবার কক্সবাজারের শহীদ শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আয়োজিত আওয়ামী লীগের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী আগামী নির্বাচনের জন্য নৌকার পক্ষে থাকার এ আহ্বান জানান।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার নিজেরও কক্সবাজার খুবই প্রিয় উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনারা কি নৌকায় ভোট দেবেন? আপনারা হাত তুলে ওয়াদা করেন দেবেন কি না।’ এ সময় জনসভাস্থল থেকে হাত তুলে লাখো লাখো জনতা ‘শেখ হাসিনার সরকার বারবার দরকার’ স্লোগান দিতে থাকেন।
সমাবেশস্থল স্টেডিয়াম মাঠ ছিল কানায় কানায় পরিপূর্ণ। বেলা ১টার মধ্যে সমাবেশস্থল পূর্ণ হয়ে যায়। বাকিরা স্টেডিয়াম মাঠের বাইরে দাঁড়িয়েই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শোনেন। কক্সবাজারের স্থানীয় জনগণের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কক্সবাজারবাসী, আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাই যে আপনারা ২০১৮ সালের নির্বাচনে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আমাদের প্রার্থীদের জয়যুক্ত করেছিলেন। ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮বারবার আপনারা ভোট দিয়েছেন। আপনাদের ভোট বৃথা যায়নি।’ সাগরপাড়ের শেখ কামাল আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভাস্থলের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি লোক ছিল রাস্তায়। শহরের লালদীঘির পাড় থেকে শুরু করে হলিডের মোড় হয়ে কলাতলীর সুগন্ধা পয়েন্ট পর্যন্ত ছিল লোকারণ্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজার এলেন সাড়ে ৫ বছর পর। তবে এর মধ্যে তার সরকার টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কক্সবাজারের উন্নয়নে রেকর্ড পরিমাণ বরাদ্দ দেয়। এই উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে অভিভূত কক্সবাজারবাসী। গত মঙ্গলবার থেকেই চকরিয়া, পেকুয়া, টেকনাফ ও মহেশখালী থেকে হাজার হাজার নেতাকর্মী কক্সবাজার এসে জড়ো হন। আর গতকাল সকাল থেকেই মিছিল আর মিছিলের নগরীতে পরিণত হয় পুরো এলাকা। উৎসবের সাজে সড়কে সড়কে শোভা পায় ফেস্টুন, ব্যানার।
সরকারপ্রধান বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যই আমার সংগ্রাম। যে লক্ষ্য সামনে নিয়ে আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সে লক্ষ্যেই আমি কাজ করছি।’
বক্তব্যের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বাংলার জনগণের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। আপনারা বারবার ভোট দিয়ে আমাকে নির্বাচিত করেছেন বলেই আমি দেশের জন্য কাজ করতে পারছি।’
জামায়াত-বিএনপি অগ্নিসন্ত্রাস, খুন ও মানি লন্ডারিং দিয়েছে : জামায়াত-বিএনপি এ দেশের মানুষকে কী দিয়েছে? এই প্রশ্ন রেখে শেখ হাসিনা বলেন, অগ্নিসন্ত্রাস, খুন, মানি লন্ডারিং এগুলো দিয়েছে। তিনি বিএনপি-জামায়াতকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘যারা দেশের উন্নয়ন না করে সম্পদ বিদেশে পাচার করেছে, লুট করেছে এবং জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে তারা কীভাবে জনগণের পাশে থাকবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এতিমের টাকা মেরে খাওয়া ও বিদেশে সম্পদ পাচারই ছিল খালেদা-তারেকের কাজ। তারা দেশের শান্তি চায় না। অস্ত্র মামলায় এখনো তাদের একজন সাজা ভোগ করছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড বোমা হামলা ঘটিয়েছে ওরা। তারা জ্বালাও-পোড়াও ছাড়া কিছুই পারে না।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘যে গ্রেনেড যুদ্ধের মাঠে ব্যবহার করা হয়, সেই গ্রেনেড মারা হয়েছিল আমাদের ওপর। গ্রেনেড হামলায় আমাদের আইভি রহমানসহ অনেকে মারা গেছেন। আল্লাহর রহমতে আমি সেদিন বেঁচে গিয়েছিলাম। ধ্বংস করা ছাড়া বিএনপি-জামায়াত এ দেশকে কিছুই দিতে পারে না। পঁচাত্তরের পর এরা ২১ বছর ক্ষমতায় ছিল। কী দিয়েছে বাংলাদেশকে? তারা কিছুই দিতে পারেনি।’
আবার আসিব ফিরে, এই কক্সবাজার সমুদ্রের তীরে : শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার বাবা যখন জেল থেকে বের হতেন, তখন আমাদের কক্সবাজার নিয়ে আসতেন। আমরা এখানে ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। এতই উন্নয়ন করেছি, একসময় দেখবেন, এই মহেশখালী সিঙ্গাপুরের চেয়ে সুন্দর হবে।’ ভবিষ্যতে কক্সবাজারে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কুতুবদিয়া ও মহেশখালীতে আরও দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করে দেব। আমাদের সব সময়ের লক্ষ্য এ অঞ্চলের উন্নয়ন। মানুষের সমস্যা আমরা জানি, আমরা সে অনুযায়ী কাজ করছি।’ কক্সবাজারকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করে কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা ‘আবার আসিব ফিরে’-এর অনুকরণে ‘ আবার আসিব ফিরে, এই কক্সবাজার সমুদ্রের তীরে’-এই পঙ্তি দিয়ে তিনি বক্তব্য শেষ করেন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কেউ কক্সবাজারের দিকে মুখ ফিরে তাকায়নি : প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর এই কক্সবাজার তথা বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের প্রতি কেউ ফিরে তাকায়নি। দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে কক্সবাজারকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছিল। কক্সবাজারে একে একে ১২টি মেগা প্রকল্পসহ ৭৩টি উন্নয়ন প্রকল্প কক্সবাজারে চলমান রয়েছে। ইতিমধ্যে ২৯টি প্রকল্প সমাপ্ত করতে পেরেছি। কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, রেললাইন, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে জনগণ এর সুফল ভোগ করবে। বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধিশীল দেশে রূপান্তরের কাজ চলছে। ২০৪১ সালে আমরা সে লক্ষ্যে পৌঁছাব, ইনশা আল্লাহ। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশে কোনো মানুষ ঠিকানাহীন ও গৃহহীন থাকবে না।’
জনসভায় অন্যান্যের মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফসহ কেন্দ্রীয় এবং জেলা পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
নজর কেড়েছে সেলিমের মোটরসাইকেল: রংবেরঙের টিশার্ট-টুপি পরে মিছিলে মিছিলে দলে দলে সবাই ছুটছেন শেখ হাসিনার জনসভায়। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে সমাবেশস্থলের একটু সামনের মোটেল রোডের লাবণী মোড়ের তিন রাস্তার মাথায় উৎসুক জনতার দৃষ্টি আটকে গেল একটি মোটরসাইকেলের আরোহীর দিকে। মিছিল থেকে বেরিয়ে অনেকেই তার সঙ্গে সেলফি তুলছেন। কেউ কেউ গল্পও জুড়ে দিয়েছেন লাল-সবুজ টুপি ও বাদামি রঙের পাঞ্জাবির ওপর মুজিব কোট পরিহিত মধ্যবয়সী ওই লোকের সঙ্গে। এই মোটরসাইকেলের পেছনেই শোভা পাচ্ছে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকা। জাতীয় পতাকার সঙ্গে মিলিয়ে লাল-সবুজ রঙের সাজানো হয়েছে নৌকাটি। এতে লেখা রয়েছে নৌকায় ভোট দিন। তার নাম মোহাম্মদ সেলিম। তিনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ২৯ নম্বর ওয়ার্ড পশ্চিম মাদারবাড়ী এলাকার। নৌকার আদলের মোটরসাইকেল নিয়ে ১৫৮ কিলোমিটার মহাসড়ক পাড়ি দিয়ে এসেছেন শেখ হাসিনার ভাষণ শুনতে।
পেট্রলবোমায় নিহত বাবা, বিচার দাবি : ২০১৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি কাতার যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকায় যাচ্ছিলেন কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বরইতলীর ইউসুফ। কিন্তু কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে পৌঁছার পর ঢাকাগামী বাসে আগুন-সন্ত্রাসীদের পেট্রলবোমা হামলায় মারা যান তিনি। এর সাত বছরে সেই ঘটনার বিচার হয়নি। নিহত বাবার হত্যার বিচার চেয়ে গতকাল ফেস্টুন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সমাবেশস্থলের সামনের সড়কে অবস্থান করছিলেন জাহেদ ইসলাম রুবেল। প্রধানমন্ত্রীর নজরে পড়লেই বাবা হত্যার বিচার পাবেন এমন আশায় সারা দিনই তিনি ছিলেন সমাবেশস্থলের আশপাশে।
ঢাকার বাইরে বিভাগীয় গণসমাবেশ সফল হওয়ায় বিএনপির নেতাকর্মীদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাস বেড়েছে বহুগুণে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে রাজধানীতে ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশের আগেই দলটির নেতাকর্মীদের সেই মনোবল ও আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরাতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এরই অংশ হিসেবে বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-মামলা ও আটক অভিযান শুরু করা হয়েছে। চলবে আরও কয়েক দিন। বিএনপিকে দুর্বল করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব জানা গেছে।
ক্ষমতাসীন দলের নেতারা জানান, বিএনপির নেতাকর্মীদের আটক অভিযান অব্যাহত রেখে মনোবল দুর্বল করা যাবে, নিশ্চিত হয়েই এ কৌশলে এগোচ্ছে সরকার। এ কৌশলের কারণে আন্তর্জাতিক মনোভাব ও প্রতিক্রিয়া কী হয় সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিতে চায় আওয়ামী লীগ।
ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে দিতে চাইলেও কোনোভাবেই চরমপন্থা নিতে চায় না। অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটিয়ে সমালোচনার দায় নিতে চায় না ক্ষমতাসীনরা।
গতকাল বুধবার বিএনপির কার্যালয়ের সামনে পুলিশের অভিযানের সময় সংঘর্ষে মৃত্যুর ঘটনা ঠিক কী কারণে তা খতিয়ে দেখবে সরকার। অন্য কোনো পক্ষ সুবিধা নিতে চায় কি না, সেটাও সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা হবে। কারণ, এমন ঘটনা সরকার বা আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা চান না।
ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকার ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের চাওয়া হলো ঢাকা মুক্ত রাখা। তাই ঢাকার বাইরে বিনা বাধায়ই বিএনপি বিভাগীয় সমাবেশ করেছে। তবে ঢাকায় কর্মসূচি পালন করতে বিএনপিকে ছাড় দেওয়া হবে না, সে ব্যাপারে আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখা হয়েছে। ঢাকায় বিনা বাধায় কর্মসূচি পালন করতে থাকলে বিএনপি আরও চাঙ্গা হয়ে উঠবে। তাই বিএনপির ঢাকার কর্মসূচিকে গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে আওয়ামী লীগ ও সরকার।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আজকে (গতকাল) বিএনপির পূর্বনির্ধারিত কোনো কর্মসূচি ছিল না। বিএনপির নেতাকর্মীরা কেন নয়াপল্টনে গেল, পুলিশের ওপর হামলা করল? এতেই প্রমাণ হয়, বোঝা যায় বিএনপির সংঘাত-নাশকতা করার পূর্বপরিকল্পনা রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপির নেতাকর্মীরা পুলিশের ওপর হামলা করল, ককটেল ফাটাল, এত ককটেল আসে কোত্থেকে?’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘যেকোনো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে কেউ কোনো বাধা দেবে না। এ জন্যই বিএনপি শান্তি নষ্ট করার কর্মসূচি বেশি করতে চায়।’
আওয়ামী লীগের একাধিক নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১০ ডিসেম্বর ঘিরে পুলিশ যেমন মাঠে থাকবে, তেমনি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও সতর্ক থাকবে।
দলটির নীতিনির্ধারকরা দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, বিএনপির সংঘাত-সংঘর্ষ প্রতিরোধ করা হবে। তাই ১০ ডিসেম্বরের আগেই মাঠে নামতে শুরু করেছে ক্ষমতাসীনরা। নয়াপল্টনেই বসবে গতকাল বিএনপি এমন বার্তা দিতে চাইলে বসে থাকেনি সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীও আটক করার সুযোগ তৈরি হয়। পাশাপাশি বিএনপি কার্যালয়ে তল্লাশিও করেছে পুলিশ।
সূত্র জানায়, সমাবেশের স্থান নিয়ে বিএনপি অনড় অবস্থান দেখাবে সেটা জানাই ছিল ক্ষমতাসীন দলের। সমাবেশের স্থান নিয়ে মূলত বিতর্ক শুরু হয়েছে। ফলে ইস্যু সৃষ্টি করতে হলে সমাবেশ স্থান নিয়ে বিতর্ক তোলা জরুরি ছিল। শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে।
ওই সূত্র জানায়, বিএনপি যেহেতু স্থান নিয়ে অনড় অবস্থানে চলে গিয়েছে সে ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানে যেতে হয়েছে সরকারকেও। এ প্রশ্নে বিএনপি যেমন ছাড় দিতে চায় না, আওয়ামী লীগও ছাড় দেবে না। ওই সূত্র আরও জানায়, সমাবেশ স্থান নিয়ে কোনো পক্ষই এখন পিছু হটবে না। যে পক্ষই পিছু হটতে যাবে সে পক্ষই একরকম পরাজয় মেনে নিতে হবে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘১০ ডিসেম্বরের বিএনপির কর্মসূচি ঘিরে কোনো ষড়যন্ত্র না থাকলে সমাবেশের স্থান নিয়ে কেন তারা অনড় অবস্থানে চলে গিয়েছে? জনগণের ভোগান্তি হবে এ কারণে সরকার জনবহুল এলাকা বাদ দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির কর্মসূচির প্রস্তাব করেছে। এ প্রস্তাবকে ভিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই।’
এদিকে ওই দিনটি ঘিরে আজ বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও দুই অংশের মেয়রদের সঙ্গে বৈঠকে বসবে আওয়ামী লীগের সম্পাদকম-লী। সকাল সাড়ে ১০টায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এ সভা থেকে ১০ ডিসেম্বরের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হবে।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, গতকাল সকাল থেকে মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন স্থানে মিছিলসহকারে অবস্থান নেন। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নেতাকর্মীদের অনেকেই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে সতর্কাবস্থানে থেকেছেন। ছোট ছোট মিছিল দেখা গেছে ভূতের গলি, হাতিরপুল ও রাসেল স্কয়ারে।
বিএনপির গণসমাবেশ সামনে রেখে শুক্রবার বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের দক্ষিণ গেটে সমাবেশ করবে মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ। এ সমাবেশ থেকে নেতাকর্মীদের একটি অংশ ১০ ডিসেম্বর শনিবার পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ এলাকায় থেকে যাওয়ার কথা জানা গেছে। প্রায় প্রতিদিনই সকাল-বিকেল সভা-সমাবেশ করে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের নগর উত্তর-দক্ষিণের নেতারা। সে সঙ্গে বিভিন্ন ওয়ার্ডে মহড়া দিচ্ছেন তারা।
মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ১০ ডিসেম্বর তারা টঙ্গী, আশুলিয়া ও গাবতলীতে সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করবেন। ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ সাভারের রেডিও কলোনি মাঠে ১০ ডিসেম্বর সমাবেশ ডেকেছে। পাশাপাশি দলটির নেতাকর্মীরা কেরানীগঞ্জেও সতর্ক পাহারার ব্যবস্থা নিয়েছেন।
রাজধানীতে ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ সামনে রেখে হঠাৎ করেই গতকাল বুধবার বিকেলে পুলিশ বিএনপির কার্যালয়ের সামনে অভিযান শুরু করে। একপর্যায়ে কার্যালয়েও ঢুকে পড়ে। পুলিশ টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড মেরে বিএনপির কার্যালয়ে জড়ো হওয়া নেতাকর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে। পুলিশের অভিযানের বিষয়টি আগে থেকে আঁচ করতে পেরেছিল জানিয়ে দলটির নেতারা বলেছেন, তাদের আশঙ্কাই সত্যি হলো।
এ ঘটনার প্রতিবাদে আজ বৃহস্পতিবার গুলশানে হোটেল লেকশোরে সংবাদ সম্মেলন করবেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
গতকাল নয়াপল্টনে সংঘর্ষের খবর শুনে ছুটে আসেন মির্জা ফখরুল। তিনি কার্যালয়ে ঢুকতে চাইলে কলাপসিবল গেট বন্ধ করে দেয় পুলিশ। এ সময় বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমার দলের কার্যালয়ে কেন আমি ঢুকতে পারব না। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে চেয়েছি। সরকার ভয়াবহ ঘটনা ঘটিয়েছে। সমাবেশ বানচাল করতেই এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ঘটনার দায় সরকারকে নিতে হবে। পরিস্থিতি শান্ত করতে ডিএমপি কমিশনার আমাকে নয়াপল্টনে আসতে বলেছেন। অথচ আসার পরে আমাকে অফিসে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।’
আচমকা পুলিশের মারমুখী আচরণে বিস্ময় প্রকাশ করে বিএনপি মহাসচিব কার্যালয়ের সামনে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ব্যবহার করে একটা ভয়াবহ, ভীতিকর ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা আশা করতে পারি না, একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ের সামনে এ রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।’ এ সময় তিনি এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে সেখান থেকে পুলিশ প্রত্যাহারের দাবি জানান। মির্জা ফখরুল বলেন, ‘অন্যথায় সব দায়দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তাবে।’
কার্যালয়ের সামনে বসে দেশ রূপান্তরকে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিএনপির শান্তিপূর্ণ আন্দোলন বিতর্কিত করতে পারে সরকার এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করে গত মঙ্গলবার ঢাকার বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার মিশন প্রধানদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে বলেছিলাম। এরপর ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই সরকার তার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে নয়াপল্টনে আমাদের দলীয় কার্যালয়ে অবস্থানরত নেতাকর্মীদের ওপর টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে শতাধিক নেতাকর্মীকে আহত করেছে। দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে।’
এর আগে ২০১৩ সালে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করেছিল গোয়েন্দা পুলিশ। তখন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দেড় শতাধিক শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার সাংবাদিকদের কাছে দাবি করে বলেন, ‘বিএনপির পার্টি অফিসে বোমা রয়েছে। পুলিশকে লক্ষ্য করেও বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে।’ তবে বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক ও সাবেক সংসদ সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা একটা ভিডিও ফুটেজ পেয়েছি। যেখানে দেখা যাচ্ছে ডিবি পুলিশ একটি বাজারের পলিথিনের ব্যাগে করে কার্যালয়ে ঢুকছে। পুলিশ বাজারের একটি ব্যাগে করে দলের কার্যালয়ের ভেতর বোমা নিয়ে গেছে।’
১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশের স্থান ঘিরে সরকারের সঙ্গে বিএনপির দরকষাকষি চলছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে। তবে বিএনপি এতে রাজি নয়। দলটি নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনেই গণসমাবেশ করতে চাইছে।
এ পরিস্থিতিতে ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ কি করা সম্ভব এমন এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সমাবেশকে কেন্দ্র করেই তো এগুলো হচ্ছে। তারা সমাবেশকে নষ্ট করার চেষ্টা করছে।’
রাতে ফখরুলের পাশে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা : রাতে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গিয়ে মির্জা ফখরুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, ভাসানী অনুসারী পরিষদ আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুুম, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) কার্যকরী সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, গণ অধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া ব্যারিস্টার কায়সার কামালের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতারা নয়াপল্টনে মির্জা ফখরুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
মির্জা আব্বাসের বাসা ঘিরে রাখা হয় : রাতে মির্জা আব্বাস অভিযোগ করে বলেন, ‘নয়াপল্টনে নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশের হামলার খবর পেয়ে সেখানে যেতে চাইলে আমার বাসার সামনের গেট ও রাস্তা অবরুদ্ধ করে রাখে পুলিশ, র্যাব ও ডিবি পুলিশ। এ ছাড়া স্থানীয় ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা আমার বাসার সামনে অবস্থান নেয়। তাদের বাধার কারণে আমি যেতে পারিনি।’
আহতদের হাসপাতালে নিতে দেয়নি পুলিশ : বিএনপির স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পুলিশের ছোড়া টিয়ার শেলে আহত নেতাকর্মীরা কার্যালয়ে অবস্থান করে বারবার আমাকে অনুরোধ করেছিলেন অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে তাদের যেন হাসপাতালে নেওয়া হয়। কার্যালয়ে আটকে পড়া জ্যেষ্ঠ নেতারা আমাকে ফোন করে অনুরোধ জানান। খবর পেয়ে আহতদের হাসপাতালে নিতে দুটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে গিয়েছিলাম বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। পুলিশ আহতদের আনতে দেয়নি। শুধু তাই নয়, অ্যাম্বুলেন্সে আঘাত করেছে। ভাঙার চেষ্টা করেছে। পরে আমরা সেখান থেকে চলে যাই।’
গত রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠক হয়েছে। বৈঠক শেষে স্থায়ী কমিটির এ সদস্য দেশ রূপান্তরকে জানান, দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলার প্রতিবাদে আজ বৃহস্পতিবার সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে আজ বিকেল ৩টায় হোটেল লেকশোয় শরিক দলগুলোকে নিয়ে যে সংবাদ সম্মেলন করার কথা ছিল তা স্থগিত করা হয়েছে।
নয়াপল্টনেই সমাবেশ : সংঘর্ষের আগে গতকাল দুপুরে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘সরকার গ্রহণযোগ্য ও পছন্দনীয় স্থানের প্রস্তাব না করলে বিএনপি আগামী ১০ ডিসেম্বর নয়াপল্টনেই সমাবেশ করবে।’ রাতে স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত বহাল রাখা হয়েছে বলে কমিটির এক সদস্য জানিয়েছেন।
কাতারে এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপ খুব চমৎকার ভাবে হচ্ছে। আমরা দেখেছি বেশ কিছু ছোট দলকে দারুণ সব জয় পেতে। আবার অনেক দলকে দেখেছি দুর্ভাগ্যজনক ভাবে হেরে যেতে। এসবই ফুটবলের সৌন্দর্য, এজন্যই ফুটবল অনিশ্চয়তার খেলা। এখন আমরা নকআউট পর্বে পৌঁছে গেছি। আসর যত এগোবে, ছোট দলের সম্ভাবনা ততই কমে আসবে আর যেসব দল অনেক ভালো প্রস্তুতি নিয়ে আসতে পেরেছে এবং নিজেদের কৌশল ও ট্যাকটিকসকে বিশ্বকাপের ছন্দের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পেরেছে তারাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে।
নেইমারের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করেছে যে ব্রাজিল শিরোপার দৌড়ে এগিয়ে আছে। ব্রাজিল তাদের শেষ ম্যাচে এমন এক পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছে যা দর্শকদের কাছে মন্ত্রমুগ্ধকর আর পরবর্তী প্রতিপক্ষ ক্রোয়েশিয়ার কাছে আতঙ্কের। তিতের ব্রাজিল রীতিমতো দক্ষিণ কোরিয়ার রক্ষণকে ছিন্নভিন্ন করে প্রথমার্ধেই চারটা গোল করে দারুণ এক জয় তুলে নিয়েছে। দুঃখজনক ভাবে ম্যাচটা আমার দেখা হয়নি কারণ কাতারে গোটা দুয়েক ম্যাচ দেখার পর সেখান থেকে তখন আমি মাত্র দেশে ফিরে এসেছি।
লোকে তিতের কৌশল নিয়ে অনেক প্রশ্ন তোলে। প্রথমে অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন ফুটবলারদের গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে বিশ্রাম দেওয়া নিয়ে, যে ম্যাচটা ব্রাজিল হেরেছিল। এরপর প্রশ্ন ওঠে পরের ম্যাচে শুরু থেকেই কেন নেইমারকে খেলানো হচ্ছে। আমার মনে হয় তারা উত্তরটা পেয়ে গেছে। যখন নেইমার মাঠে থাকে, তখন প্রতিপক্ষ তাকে আটকে রাখতেই ব্যস্ত থাকে। তার পেছনেই দেখা যায় এক-দুইজন খেলোয়াড়কে সারাক্ষণ পাহারায়। এতে করে রিচার্লিসন, ভিনিসিয়ুস ও রাফিনহাদের জন্য অনেক জায়গা বের হয় আর তখন তারা অনেক বেশি সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। আর দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ব্রাজিল দলকে আমরা যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে খেলতে দেখলাম, সেটা সম্ভব হয়েছে ওই একটা ম্যাচে বিশ্রাম দেওয়ার ফলেই।
আমার মনে হয় রক্ষণটা কোন কৌশলে কাদের নিয়ে সাজাতে হবে, তার চূড়ান্ত সমাধান পেয়ে গেছে তিতে। তার এই কৌশলটা নিখুঁতভাবে কাজ করছে। মিলিতাও আরও একবার খুব ভালো খেলেছে, দানিলো বাম দিকে খেলেছে আর এটাই ওর আসল জায়গা। মাঝমাঠও খুব ভালো করেছে আর খুব জমাট ছিল, প্রতিপক্ষ বল নিয়ে সহজে মাঝমাঠই পার করতে পারেনি।
শেষ আটে লড়াইটা হবে ব্রাজিলের আক্রমণভাগের সঙ্গে ক্রোয়েশিয়ার অভিজ্ঞ রক্ষণভাগের। ক্রোয়েশিয়া দলটার সঙ্গে ২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপে রানার্সআপ হওয়া দলের খুব একটা পার্থক্য নেই। তবে তাদের সবারই বয়স চার বছর করে বেড়েছে। রাশিয়ায় রানার্সআপ হওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়েই জøাতকো দালিচের দল শেষ আটে ব্রাজিলের বিপক্ষে মাঠে নামবে আর প্রস্তুত হবে শেষ আটে ব্রাজিলের বিপক্ষে বাঁচা-মরার লড়াইয়ের জন্য।
মাঝমাঠে লড়াইটা হবে কাসেমিরো আর লুকা মদ্রিচের। তারা একে অন্যকে খুব ভালো করে জানে। এই বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত ব্রাজিল দলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে কাসেমিরো। তিতে তার ওপর খুব ভরসা করে। ৩৭ বছর বয়সী লুকা মদ্রিচকে আরও একবার কাপ জয়ের লড়াইতে দেখতে পারাটাও হবে দারুণ ব্যাপার। অভিজ্ঞতা আর নৈপুণ্য বিচার করলে মদ্রিচ কিন্তু এগিয়ে থাকবে কাসেমিরোর চেয়ে। তবে ব্রাজিলিয়ানের পক্ষে আছে তার বয়স আর রক্ষণ আগলে রাখার কৌশল। এই ম্যাচটা হবে ব্রাজিলের আক্রমণের বিপক্ষে ক্রোয়েশিয়ার রক্ষণের, যারা চেষ্টা করবে শেষ পর্যন্ত গোল করার সব রাস্তা আটকে রেখে ম্যাচটা টাইব্রেকারের দিকে নেওয়ার। এই ম্যাচে তুরুপের তাস হবে নেইমার। তার আক্রমণাত্মক কৌশল আর বুদ্ধিদীপ্ততাই ভাঙতে পারে ক্রোয়েশিয়ার রক্ষণ দেয়াল। এই মুহূর্তে দলে কোনো চোট সমস্যা নেই আর দারুণ সব খেলোয়াড় মাঠে নামতে মুখিয়ে আছে।
আমি আশা করছি সম্ভাব্য সেরা ফলের; আমাদের জাতীয় দল যদি এই ছন্দ ধরে রাখতে পারে তাহলে তারাই আবারও বিশ্বকাপ জিতবে।
দুর্নীতি দমন কমিশনার (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ বলেছেন, নির্বাচনের বছরে দুদক চোখ-কান খোলা রাখবে। আইন অনুসারে আমাদের যেটুকু অংশ, আমরা তা নিরপেক্ষভাবে পালনের চেষ্টা করব। আমরা সাধ্যমতো কাজ করছি।
মঙ্গলবার সেগুনবাগিচায় প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এক সংবাদ সন্সেলনে দুদক চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ও মো. জহুরুল হক এবং দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচনের বছরে সব প্রার্থীর হলফনামায় যে সম্পদ বিবরণী থাকে তা খতিয়ে দেখবে দুদক। এ বছর চোখ-কান খোলা রাখবে। সমস্ত প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করবে। আগামী বছরে দুদকের কাজে আরো গতিশীলতা আনার জন্য কাজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সোমবার রাতে বার্ষিক প্রতিবেদনটি (২০২২) রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি দুদকের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়ে কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থান নিতে বলেছেন। দুদক স্বচ্ছতার সঙ্গে সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবগত করা হয়েছে।
ফাঁদ মামলা কেন কমেছে এমন এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা যতটুকু তথ্য পেয়েছি, সেই অনুসারে ফাঁদ মামলা হয়েছে। আমরা শতভাগ সফল হতে পারিনি। বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় গত বছর সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের করেছি। ওই বছর এফআরটি কম হয়েছে। মামলা বেশি হয়েছে, এফআরটি কমেছে। সাজার হার বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুদক ঠিকমতো কাজ করছে না, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, মামলা, তদন্ত, অনুসন্ধান সব কিছুই বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। তারা তাদের বক্তব্য দিয়েছে। আমরা তথ্য দিলাম, এগুলো সংরক্ষিত আছে। আপনারাই বিবেচনা করবেন।
এ সময় বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, মামলাগুলো চলমান। এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি তিনি।
সম্প্রতি আলোচিত দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানের ‘অর্থপাচার’ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে দুদক চেয়ারম্যান জানান, এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই, পেলে কাজ করবে দুদক।
এদিকে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেন, দেশের টাকা বাইরে চলে গেছে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়তো কাজ করতে পারেনি দুদক। পাচারকৃত অর্থ নিয়ে কাজ করে আরো অনেকগুলো সংস্থা। শুধু দুদকের একার কাজ নয় এটি। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি টাকা ফিরিয়ে আনার।
দুদকের অসন্তুষ্টির জায়গা কোনটি এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক বড় বড় দুর্নীতি বিশেষ করে দেশের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেক দুর্নীতিবাজ দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে, ব্যবসার আড়ালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে। এই বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের মাত্র একটি অপরাধের এখতিয়ার আছে। বাকি ২৬টি অপরাধের বিষয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এখতিয়ার। কিন্তু জনগণের মনে এখনো ভ্রান্ত ধারণা দুদক কী কাজ করে। কিন্তু আমাদের অংশে আমরা কাজ করি ও শতভাগ সাফল্য রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশেরে এক পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেন, দেশে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বাড়ে নাই, বরং কমেছে। তবে আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বন্ধ করতে পারিনি। মামলা পরিচালনা ক্ষমতা কমেছে এটা মিথ্যা কথা। কারণ মানিলন্ডারিং মামলায় ১০০ ভাগ সাফল্য, অন্যান্য মামলায় সাজার পরিমাণ ৬৭ থেকে ৭০ ভাগ আমাদের পক্ষে। আমাদের সক্ষমতা কমেছে কে এটা বলেছে। এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।
দুদকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরে দুদকে জমা পড়ে ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ। এসব যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের জন্য সংস্থাটি হাতে নিয়েছে ৯০১টি অভিযোগ, যা মোট অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৯৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ অভিযোগই অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিতে পারেনি দুদক। ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগের মধ্যে ৩ হাজার ১৫২টি অভিযোগ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে। ২০২২ সালে চার্জশিট অনুমোদন হয়েছে ২২৪টি, মামলা হয়েছে ৪০৬টি, ফাঁদ মামলা হয়েছে মাত্র ৪টি।
২০২১-২২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সাজা, নিষ্পত্তি ও খালাসের পরিমাণ বেড়েছে। এরমধ্যে গতবছর সংস্থাটির ৩৪৬টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এছাড়া এই সময়ে কমিশন আমলের ৬৪ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ব্যুরো আমলের ৩৫ দশমিক ৯০ মামলার আসামির সাজা হয়েছে। ২০২২ সালের দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন তুলে ধরেন দুদক চেয়ারম্যান। উপস্থাপনকালে এই তথ্য জানানো হয়।
ছেলে ইজহান মালিককে সঙ্গে নিয়ে ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরবে রয়েছেন ভারতের সাবেক টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একাধিক ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেছেন তিনি।
মঙ্গলবার ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে মনিদা শরীফে তোলা নিজের একাধিক ছবি পোস্ট করেন সানিয়া। ভিডিও পোস্ট করেছেন ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে।
ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা প্রথম ছবিতেই দেখা যাচ্ছে সানিয়া তাকিয়ে আছেন তার ছেলের দিকে। সানিয়ার পরনে কালো রঙের বোরকা।
ছবিগুলো পোস্ট করে ক্যাপশনে সানিয়া লিখেছেন, ‘আলহামদুল্লিাহ। আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করুন।’
সানিয়ার পোস্ট করা ছবিগুলোর কয়েকটিতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও রয়েছেন। তবে তার স্বামী পাকিস্তানি ক্রিকেটার শোয়েব মালিককে কোনোটাতেই দেখা যায়নি।
শুরুতেই হোঁচট খেল এক বছরে বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের বর্ষপঞ্জি। প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পিছিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। প্রিলিমিনারির রেশ ধরে পেছাতে হবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সূচিও।
অথচ এই বিসিএস দিয়েই বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ এক বছরে শেষ করার ছক এঁকেছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অবস্থায় বর্ষপঞ্জিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি ৩০ নভেম্বর শুরু না করে ১ জানুয়রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৪৬তম বিসিএস থেকে পরিবর্তিত এক বর্ষপঞ্জিতেই বিসিএস শেষ করার নতুন পরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমরা ৪৬তম বিসিএস থেকে বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করব।’
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই সোহরাব হোসাইন এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার কথা বলেছিলেন। চাকরি জীবনে খ্যাতিমান এই আমলা এগিয়েছিলেনও বহুদূর। তিনি যখন চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন, তখন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩ বিসিএস চলমান ছিল। এর মধ্যে ৪০-এর সুপারিশ হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। ৪১তম বিসিএসের অর্ধেক মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মহামারির সময় চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ৪২তম বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয় এবং অল্প সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। আর ১৫ দিনের মধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ শেষ হবে। ৪৪তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যানের মূল টার্গেট ছিল এক বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএস শেষ করা। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়েছিল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছাপানোর জটিলতায় সূচি অনুযায়ী প্রিলিমিনারি নিতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি সচরাচর বিজিপ্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপাত।
বিসিএস বর্ষপঞ্জি কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিজিপ্রেস থেকে সরে আসে পিএসসি। তারা একটা বিশেষ জায়গা থেকে এ প্রশ্নপত্র ছাপায়। ৪৫তম বিসিএসে ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। ৬ সেট প্রশ্ন ছাপাতে হয়। সেই হিসাবে প্রায় ২১ লাখ প্রশ্নপত্র ছাপানোর প্রক্রিয়া সময়মতোই শুরু করে পিএসসি। দরসহ বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার কাজ আটকে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতৈক্য হলেও শিগগিরই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারছে না। ২৩ বা ২৪ মার্চ রোজা শুরু হবে। রোজায় এ বিশাল পরীক্ষা আয়োজনের কোনো রেওয়াজ নেই। পিএসসিও চায় না নতুন করে এর নজির তৈরি করতে। কাজেই মে মাসের আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মে মাসজুড়ে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হলে প্রিলিমিনরি নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিভাগীয় শহরের অনেক স্কুলে উভয় পরীক্ষার সিট পড়ে। সেই হিসেবে জুন মাসের আগে প্রিলিমিনারি নিতে পারছে না পিএসসি। এতে করে চার মাস পিছিয়ে যাবে ৪৫তম বিসিএসের সব ধরনের পরীক্ষা।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। একটা বিসিএসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এ থেকে পিএসসিকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছেলেমেয়েরা কাজবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণী পরিবারের ভরসাস্থল। তাদের দিকে চেয়ে থাকে পুরো পরিবার। বেকারত্বের বিষয়টি পিএসসিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবে। আগে অল্প দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারলে এখন কেন পারবে না? আগের চেয়ে পিএসসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে জানতে চাইলে কমিশনের একজন সদস্য বলেন, পিএসসি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরের অর্থাৎ ৪৬তম বিসিএস থেকে যেন এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা এখনই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা বিসিএস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সাধারণত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার এক মাস আগে পিএসসির একজন সদস্যকে ওই বিসিএসটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্ব এখনই একজন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। ওই বিসিএস সমন্বয় করবেন কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ।
কমিশনের সদস্য ও পিএসসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির সদস্যরা একমত হয়েছেন ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করে ১ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এতে প্রচলিত ক্যালেন্ডার ইয়ার ঠিক থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বর্ধিত সময়ে যাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে তাদের কী হবে। সেই সমস্যাটিও আলোচনা করে মোটামুটি সেরে রেখেছেন সদস্যরা। ৪৬তম বিসিএসে যারা বয়সের ফেরে পড়বেন তাদের বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। খুব শিগগির ওই বিসিএসের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু হবে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সিলেবাস নিয়ে। সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান থাকলেও সেই কাজ ৪৬ বিসিএসের আগে শেষ হবে না। কাজেই এক বছর আগেই প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজেও কোনো জটিলতা দেখছেন না পিএসসির সদস্যরা।
কিছুদিন ধরে পিএসসি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবর্তন আনা সেই সংস্কারেরই অংশ। পিএসসি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে চায়। মুখস্থ বিদ্যাধারীদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও তারা সিলেবাসে আমূল বদল আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায়ও পরিবর্তন এনেছে। কোনো চাকরি প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় তার জেলার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করা যাবে না। এ ধরনের প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি হয় বলে পিএসসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। পিএসসির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য পর্যন্ত চাকরি প্রার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পরীক্ষার প্রার্থীদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৫ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়। আদেশে বলা হয়েছে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য ‘কোডেড ফরম্যাটে’ থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সব তথ্যের কোডিং ও ডি-কোডিংয়ের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবে। কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন হলে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে ডি-কোডিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওই অফিস আদেশে।
৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আবেদন শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে চিকিৎসায়। সহকারী ও ডেন্টাল সার্জন মিলিয়ে ৫৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চিকিৎসার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ৪৩৭ জন। এরপর পুলিশে ৮০, কাস্টমসে ৫৪, প্রশাসনে ২৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্কোর কার্ডে জ্বলজ্বল করছে, বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী। তবুও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাওয়াশ, তাও টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন, তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এই ফল। লক্ষ্য ছিল ভালো ক্রিকেট খেলা, সে তো সবসময়ই থাকে। তবে বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডকে ঠিক পরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেই ৩-০-তে হারিয়ে দেওয়াটা যে স্বপ্নেরও সীমানা ছাড়িয়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজের একটা থ্রো। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১৪তম ওভারে বল করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের বলেই পেয়েছেন ডাভিড মালানের উইকেট। নতুন আসা ব্যাটসম্যান বেন ডাকেট। বলে ব্যাট লাগিয়েই ছুটলেন ডাকেট, অন্যপ্রান্ত থেকে জস বাটলার এসে স্ট্রাইকিং প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পয়েন্ট থেকে মিরাজের অসাধারণ থ্রো ভেঙে দেয় স্টাম্প। পরপর দুই বলে আউট দুই সেট ব্যাটসম্যান। তাতে রঙ বদলে যায় ম্যাচের। ১ উইকেটে ১০০ রান থেকে ৩ উইকেটে ১০০ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড, দুই প্রান্তে তখন দুই নতুন ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টি-টোয়েন্টির চ্যাম্পিয়নরা। পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে তাই আক্ষেপ করেই জস বাটলার বললেন, ‘পরপর দুই বলে দুই উইকেট হারানোটা খুব বাজে হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ম্যাচটা হারিয়েছে। আমি কেন যে ডাইভ দিলাম না এ নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে।’
২৪০ বলের ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ওই দুটো বলের ঘটনাই। মালান যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই হবে। ঢাকা লিগ ও বিপিএল খেলে যাওয়া মালান জানেন এই উইকেটে রান তোলার কৌশল, যা দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতানো শতরানের ইনিংস খেলে। কালও মনে হচ্ছিল মালানই তীরে তরী ভিড়িয়ে নেবেন, কিন্তু মোস্তাফিজের অল্প একটু বাড়তি লাফিয়ে ওঠা বলে পুল করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললেন এ বাঁহাতি। ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে যেটা তালুবন্দি করতে ভুল করেননি লিটন দাস। পরের বলে বাটলারের পড়িমরি করে ছুটেও রান সম্পূর্ণ করতে না পারা, মিরাজের দারুণ থ্রোর কাছে পরাস্ত হওয়া। এ দুটো বলই আসলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ইংল্যান্ডের। অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ১৫৯ রানের লক্ষ্য ভালোভাবেই উতরে যাবে ইংলিশরা। টস জিতে আগে বোলিং নেন বাটলার। লিটন ও রনি তালুকদারের ৫৫ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আদিল রশিদ, রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ দেন ২২ বলে ২৪ রান করা রনি। অবশ্য তার ইনিংসের ইতি ঘটতে পারত আগেই, রনির ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন রেহান আহমেদ। জীবন পেয়েছেন লিটনও, তার ক্যাচ ছেড়েছেন বেন ডাকেট। ১৪তম ওভারের প্রথম বলে লিটন ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডিপ-মিডউইকেটে, কিন্তু ডাকেট বলটা হাতে জমাতে পারেননি। দুবারই দুর্ভাগা বোলারটির নাম জোফরা আর্চার।
৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হন লিটন, নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান করে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিটা কমে আসে বাংলাদেশের। ১৫ ওভার পর যেখানে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ১৩১, সেখানে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ২ উইকেটে ১৫৮ রানে। শেষ ৩০ বলে ৯ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ তোলে মাত্র ২৭ রান তখন মনে হচ্ছিল বেশ ভালো ব্যাটিং উইকেটে অন্তত ২০-২৫টা রান কম হয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যাটিংয়ের শেষটা আর বোলিংয়ের শুরুটা, দুটো পক্ষে যায়নি বাংলাদেশের। অভিষিক্ত তানভীর ইসলাম ফিল সল্টকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের বলে ডাভিড মালানের বিপক্ষে মাঠের আম্পায়ার এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিলেও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। বাটলারকে নিয়ে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদের ব্যাটে ইংল্যান্ড ছিল জয়ের দিশাতেই কিন্তু পরপর দুই বলে দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ে বিপদে পড়া ইংল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি হারের বৃত্ত থেকে। একে একে মইন আলি (৯), বেন ডাকেট (১১) ও স্যাম কারেনের (৪) উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকা রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭ রান, ক্রিস ওকস প্রথম দুই বলে দুটি চার মারলেও পরের বলগুলোতে আর পাননি বাউন্ডারির দেখা। ইংল্যান্ড থেমে যায় ৬ উইকেটে ১৪২ রানে, ১৬ রানের জয়ে সিরিজ ৩-০-তে জিতে নেয় বাংলাদেশ।
দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের, তবে তার সঙ্গে মিশে আছে ঘরের মাঠে পছন্দসই উইকেট বানিয়ে জেতার সমালোচনাও। এবারের সিরিজ জয়ে সেই কালিমা নেই, বরং আছে বিশ্বজয়ীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জেতার গর্ব। সাকিব তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি আমাদের ম্যাচ জিততে হবে বা এমন কিছু। আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাটিংয়ে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংটা আমাদের তিনটি ম্যাচেই আমার মনে হয় অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে।’
ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সেটাও টি-টোয়েন্টিতে, যে সংস্করণে বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। সাকিব এ সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে। যেখানে ভালো করা ক্রিকেটাররাই ভালো করেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাতেই এসেছে অবিস্মরণীয় এই জয়, যে অর্জন টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে চেনাল নতুন করে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।