
রাজধানীতে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশের স্থান নিয়ে উত্তেজনা সহিংসতার পর সমঝোতার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিএনপি নয়াপল্টনে তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কের পরিবর্তে তাদের পছন্দের স্থান হিসেবে কমলাপুর স্টেডিয়ামে সমাবেশের অনুমতি চেয়েছে। অন্যদিকে ঢাকার পুলিশ প্রশাসন তাদের মিরপুরের দারুস সালাম এলাকার বাঙলা কলেজ মাঠের প্রস্তাব দিয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দুপক্ষের মধ্যে আজ শুক্রবারের মধ্যে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
উল্লেখ্য, আগামীকাল শনিবার বিএনপির গণসমাবেশের দিন নির্ধারিত রয়েছে। দলটি নয়াপল্টনে সমাবেশ করার ব্যাপারে অনড় অবস্থান নেয়। অন্যদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) তাদের নানা শর্তে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার প্রস্তাব দেয়। এ নিয়ে উত্তেজনা চলার মধ্যে বিএনপি নেতাকর্মীরা নয়াপল্টনে অবস্থান নিতে শুরু করেন। গত বুধবার পুলিশ সেখানে অভিযান চালালে দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। আটক করা হয় বিএনপির কয়েকশ নেতাকর্মীকে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দলটির দায়িত্বশীল নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলছেন, তারা নয়াপল্টনে সমাবেশ করবেন। যেকোনো মূল্যে নেতাকর্মীরা কার্যালয়ের সামনে হাজির হবেন। আসবেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা। তবে বিএনপির মহাসচিব সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সরকার যদি বিকল্প প্রস্তাব দেয় এবং সে স্থান যদি তাদের পছন্দ হয়, তাহলে ভেবে দেখবেন তারা। এরপরই সমাবেশের স্থান নিয়ে বিএনপি ও পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে আলোচনা হয়।
কমলাপুর স্টেডিয়াম চায় বিএনপি, পুলিশ বলছে বাঙলা কলেজ : গতকাল রাতে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকের সঙ্গে বৈঠক হয় বিএনপির একটি প্রতিনিধিদলের। বৈঠক শেষে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লা বুলু সাংবাদিকদের বলেন, ‘দুটি স্পট নিয়ে আমাদের আলোচনা হয়েছে। আমরা জায়গা পরিদর্শন করে সিদ্ধান্ত জানাব।’
এদিকে বিএনপির প্রতিনিধির সঙ্গে ডিএমপি কমিশনারের সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আজকেই সমাবেশের মাঠের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। গণসমাবেশের স্থান নিয়ে যে সমস্যা চলছে তার সমাধান হবে বলে আশা করছি।’
গতকাল বুলুর নেতৃত্বে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এ জে মোহাম্মদ আলী, অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান, অধ্যাপক ডাক্তার এ জেড এম জাহিদ হোসেন ও বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল ডিএমপি কার্যালয়ে যান।
এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিএনপি নেতৃবৃন্দ ডিএমপিতে গিয়ে আলাপ করুক।’ এরপর বিএনপির প্রতিনিধিদল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ডিএমপি কার্যালয়ে যায়।
বিএনপির সংবাদ সম্মেলন : গতকাল বিকেলে গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিকল্প প্রস্তাব না পেলে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গণসমাবেশ করবেন তারা। তিনি বলেন, ‘আমরা সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে চাই। গণসমাবেশের দিন আমরা নয়াপল্টনে যাব। জনগণ কী সিদ্ধান্ত নেয় তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করতে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। কার্যালয় খুলে দিতে হবে। আটক নেতাকর্মীদের মুক্তি দিতে হবে। মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। গণসমাবেশ করার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গণসমাবেশের দিন আমরা সমাবেশস্থলে যাব।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সংবিধানসম্মত শান্তিপূর্ণভাবে গণসমাবেশ করবে বিএনপি। প্রশাসন যদি আমাদের অন্য কোনো প্রস্তাব দেয় সেটি যদি আমাদের অনুকূলে হয়, তাহলে আমরা ভেবে দেখব। তবে আমরা নয়াপল্টনেই শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে চাই।’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বোমা নিয়ে গেছে কার্যালয়ে : সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল দাবি করেন, ‘পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্য নয়াপল্টনে অযাচিতভাবে প্রবেশ করে সিমেন্টের ব্যাগে করে হাতবোমা নিয়ে যায়। সেখানে রেখে আসে, যা বিভিন্ন মিডিয়ায় সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছে। এরপর দলীয় কার্যালয়ে তারা ন্যক্কারজনকভাবে অভিযান চালিয়ে নিচতলা থেকে ষষ্ঠতলা পর্যন্ত বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের বিভিন্ন কক্ষ তছনছ করেছে।’ তিনি আরও দাবি করেন, ‘কার্যালয়ের ভেতর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিএনপি চেয়ারপারসনের কক্ষ, মহাসচিবের কক্ষ, অফিস কক্ষের দরজা ভেঙে প্রবেশ করেন এবং সব আসবাবপত্র, ফাইল, গুরুত্বপূর্ণ নথি তছনছ করেন। তারা কম্পিউটার, ল্যাপটপ, হার্ডডিস্ক এবং দলীয় সদস্যদের প্রদেয় মাসিক চাঁদার টাকা, ব্যাংকের চেক বই, নির্বাচন কমিশনসংক্রান্তসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথি নিয়ে যান।’
বিএনপি মহাসচিব অভিযোগ করে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ গত বুধবার পুরো ঢাকা শহরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। তাদের সশস্ত্র ও উচ্ছৃঙ্খল কর্মীরা পাড়া-মহল্লায় জঙ্গি মিছিল করে এবং বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়িতে হামলা ও তাদের পরিবার-পরিজনের ওপর হামলা করে।’ তার দাবি, ‘আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ওয়ারী থানার যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ফয়সাল মেহবুব মিজুকে বাসায় না পেয়ে তার বৃদ্ধ বাবা মিল্লাত হোসেনকে বেদম প্রহার করে। যার ফলে তিনি ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছেন।’
মির্জা ফখরুল দাবি করেন, ‘পুলিশের গুলিতে পল্লবী থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা মকবুল হোসেন নিহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন অসংখ্য নেতাকর্মী ও পথচারী।’ তিনি মকবুল নিহত হওয়ার ঘটনার তদন্ত দাবি করেন।
গতকাল সকালে কার্যালয়ে যেতে বাধা দেওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আইনজীবীসহ নয়াপল্টনের কার্যালয়ে প্রবেশ করতে চাইলে সেখানে দায়িত্বরত পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, বিএনপি কার্যালয়ে বিস্ফোরকদ্রব্য পাওয়া গেছে। তল্লাশি চালানোর জন্য ক্রাইম সিন ঘোষণা করে সেখানে সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। অথচ আইন হচ্ছে কোনো বাড়িতে তল্লাশি চালাতে হলে সেই বাড়ির মালিককে সঙ্গে রাখতে হবে এবং নিরপেক্ষ সাক্ষী থাকতে হবে। সাধারণত এ ধরনের তল্লাশি চালাতে হলে সার্চ ওয়ারেন্ট ইস্যু করতে হয়। এ ক্ষেত্রে কিছুই করা হয়নি।’
সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ড. আবদুল মঈন খান, মির্জা আব্বাস, গয়েশ^র চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স প্রমুখ।
গণসমাবেশের প্রস্তুতি : নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক ভাইস চেয়ারম্যান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশ সফল করার প্রস্তুতি আমাদের আছে। আমরা পরিকল্পনা করছি, কীভাবে পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে নয়াপল্টনে জড়ো হব। সারা দেশ থেকে ইতিমধ্যে নেতাকর্মীরা ঢাকায় পৌঁছে গেছেন।’ যেকোনো মূল্যে তারা সমাবেশ সফল করবেন জানিয়ে ওই নেতা বলেন, ‘বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা গণসমাবেশ সফল করতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ঢাকা শহরে লাখের ওপর আমাদের নেতা রয়েছেন। এর বাইরে কর্মী-সমর্থকরা আছেন।’
এদিকে গত বুধবার নয়াপল্টনে পুলিশের হামলা, অভিযান ও নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে গতকাল ঢাকা মহানগর দক্ষিণের চকবাজার, রমনা, খিলগাঁও, মতিঝিল ও বংশাল থানা বিএনপির নেতাকর্মীরা প্রতিবাদ মিছিল করেছেন। বংশাল থানার নেতাকর্মীদর মিছিল থেকে আকাশ ও জনিসহ কয়েকজনকে আটক করেছে পুলিশ।
কার্যালয়ে যেতে ফখরুলকে বাধা : সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যাওয়ার পথে বিএনপি মহাসচিবের গাড়ি নাইটিঙ্গেল মোড়ে এলে পুলিশ কর্মকর্তারা তাকে আটকে দেন। এ সময়ে মহাসচিবের সঙ্গে দলের ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স ও মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান ছিলেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার তাদের জানান, ‘ক্রাইম সিনের’ কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিএনপি অফিসে কারও প্রবেশাধিকার নেই।
এ সময় বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘বিএনপি অফিসে কোনো ধরনের বিস্ফোরক ছিল না। পুলিশ এসব বোমা রেখেছে।’
মকবুলের পরিবারের পাশে মির্জা ফখরুল : বেলা ১১টার দিকে বিএনপি মহাসচিব ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে কিছুক্ষণ অবস্থান করে নয়াপল্টনে সংঘর্ষে নিহত মকবুলের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন বিএনপির স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম। নিহত মকবুল হোসেনের ভাই নূর হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিএনপির মহাসচিব হঠাৎ এসে আমাদের সঙ্গে কয়েক মিনিট কথা বলে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান। তিনি মকবুলের স্ত্রী ও বাচ্চাকে সান্ত¡না দিয়ে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন।’
আমরা তখন ভারতের টাকিতে, ত্বকীপুর ইয়ুথ ক্যাম্পে। আটজন বাঙালি সাবমেরিনার ফ্রান্স থেকে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে চলে আসেন ভারতে। ভারতীয় নৌবাহিনীর সহযোগিতায় তারা সমন্বিত একটি দল গঠন করার উদ্যোগ নেন। ১২ মে, ১৯৭১। ক্যাম্পে তখন পাঁচ হাজারের মতো যুবক। সবাইকে ফল-ইন করিয়ে তারা ১২০ জনকে সিলেক্ট করে। শারীরিক গঠন আর সাঁতার জানা ছিল মাপকাঠি। বাড়ির একমাত্র ছেলে হলেই আনফিট করে দেওয়া হতো। নদীর পাড়ের ছেলেরা টিকে যায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যায়। সে হিসেবে আমাকেও তারা নিয়ে নেয়।
টাকি থেকে প্রথমে কল্যাণী এবং পরে ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয় পলাশীতে। ভাগীরতি নদীর তীরে জঙ্গল পরিষ্কার করে আমরা ক্যাম্প করি। এরপর শুরু হয় ট্রেনিং। প্রথমে শপথ নিই ‘দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে আমি স্বেচ্ছায় এ আত্মঘাতী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছি।’ ট্রেনিংয়ে ভারতীয় নৌবাহিনী আমাদের শেখায় বিশেষ ধরনের সাঁতার। পানির নিচে শরীর এবং ওপরে নাক-চোখ ভাসিয়ে সাঁতার দিতে হতো। এ পদ্ধতিতে সাঁতার কেটে নিঃশব্দে যেকোনো মানুষের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া যেত। সবচেয়ে কঠিন ছিল পানির নিচ দিয়ে সাঁতরে গিয়ে জাহাজে মাইন-অ্যাসেম্বল সেট করা। নৌবাহিনীর তিন বছরের ট্রেনিং আমরা নিই তিন মাসে। আমার নৌ-কমান্ডো নম্বর ছিল ০০৬০। ট্রেনিং চলাকালে ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রধান, বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও কর্নেল এমএজি ওসমানী সাহেব এসেছিলেন।
প্রশিক্ষণ শেষে পরিকল্পনা হয় চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরে একই দিনে একই সময়ে বিস্ফোরণ ঘটানোর। সমন্বিত এ আক্রমণের নাম অপারেশন জ্যাকপট।
একাত্তরের কথা এভাবেই তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নৌ-কমান্ডো মো. খলিলুর রহমান। আয়জুদ্দিন ও ওয়ালিউর নেছার সপ্তম সন্তান খলিলুর রহমান। বাড়ি সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার ভাতশালা গ্রামে। তার মুখেই শুনি মোংলা অপারেশনের কথা।
তিনি বলেন আমরা নৌ-কমান্ডো। যোদ্ধা ছিলাম ১৬০ জন। চট্টগ্রামের জন্য ৬০, মোংলার জন্য ৬০, চাঁদপুরের জন্য ২০ ও নারায়ণগঞ্জের জন্য ২০ জন করে চারটি গ্রুপ গঠন করা হয়। আমি ছিলাম মোংলা বন্দরের গ্রুপে। কমান্ডার ছিলেন প্রয়াত আহসান উল্লাহ বীরপ্রতীক।
৭ আগস্ট, ১৯৭১। ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে আমাদের নেওয়া হয় ব্যারাকপুর ক্যাম্পে। গঙ্গায় নামিয়ে একটি জাহাজ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। পরে ক্যানিং থেকে দেশি নৌকায় রায়মঙ্গল নদী পার হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সুন্দরবনের ভেতর কৈখালি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে পৌঁছি। ক্যাম্প কমান্ডার ছিলেন জর্জ মার্টিস, লেফটেন্যান্ট কফিল। প্র্যাকটিসের জন্যই স্থলপথে না নিয়ে ভয়াল নদী পথে আমাদের নিয়ে আসা হয়।
সমুদ্রের পাশ দিয়ে হেঁটে সুন্দরবনের ভেতর প্রথমে উঠি কালাবগি নামের গ্রামে। পরে ক্যাম্প গড়ি সুতারখালিতে। অপারেশনের জন্য ২০ জনের তিনটি দলে ভাগ হই। দল তিনটির নেতা মজিবর রহমান, আফতাব উদ্দিন এবং আমি। আমাদের সাপোর্টের জন্য আসে ২০ জন গেরিলা। তাদের কমান্ডার ছিলেন খিজির আলী বীরবিক্রম। আমরা নির্দেশের অপেক্ষায় থাকি।
বলা ছিল, চারটি বন্দরে আক্রমণের জন্য সবকটি গ্রুপকে একসঙ্গে নির্দেশ দেওয়া হবে। কীভাবে? এর জন্য প্রত্যেক গ্রুপকে দেওয়া হয় একটি করে রেডিও। বলা হয় তোমরা ১৩ আগস্ট থেকে প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে আকাশবাণী ‘খ’ কেন্দ্র শুনবে। যেকোনো দিন পঙ্কজ মল্লিকের কণ্ঠে তোমাদের একটা গান শোনানো হবে ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান...।’ এ গান শুনলেই বুঝতে হবে প্রস্তুতির নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। এর ২৪ ঘণ্টা বা তারও পরে শোনানো হবে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে একটি গান ‘আমার পুতুল আজকে যাবে শ^শুর বাড়ি...।’ এ গান শুনলে ওইদিনই টার্গেটে হিট করতে হবে।
১৩ আগস্ট রেডিওতে আমরা প্রথম গানটি শুনলাম। কিন্তু দ্বিতীয় গানটি শোনানো হলো ৪৮ ঘণ্টা পর অর্থাৎ ১৫ আগস্ট সকালে। টিম লিডার আহসান উল্লাহ সাহেব সবাইকে ডেকে নির্দেশ দিলেন হিট করার। প্রস্তুত হয়ে নিলাম। সাঁতার কাটার জন্য পায়ে শুধু ফিনস এবং গায়ে সুইমিং কস্টিউম। গামছা দিয়ে শরীরে পেঁচিয়ে নিলাম মাইনটি। জাহাজের গায়ে মাইন লাগানোর জন্য সঙ্গে ছিল একটি ড্যাগার।
গেরিলারা রেকি করে আসে দিনের বেলায়। ওইদিন সন্ধ্যার পরই আমাদের শপথ করানো হলো ‘আমরা সবাই ভাই ভাই। দেশের জন্য জীবন দিতেও দ্বিধা করব না। কাউকে বিপদে ফেলব না এবং বিপদ দেখে সরে পরব না।’
রাতে নৌকায় করে রওনা হলাম। স্রোত ছিল প্রতিকূলে। ফলে ভোরের দিকে পৌঁছলাম মোংলা বন্দরের অন্য তীরে, বানিয়াশান্তা গ্রামে। আমরা অবস্থান নিই বেড়িবাঁধের নিচে। কথা ছিল মধ্যরাতে অপারেশন করার। কিন্তু তা হলো না। তখন সূর্য উঠছে। শরীরে সরিষার তেল মেখে কস্টিউম পরে নিই। বুকে মাইন বেঁধে পানিতে নেমে দিবালোকেই অপারেশন করি। মোংলা বন্দরের জাহাজগুলোতে মাইন লাগিয়ে যে যার মতো সরে পড়ি। পানির ওপরে তখন পাকিস্তানিদের গানবোট। সকাল তখন ৯টার মতো। একে একে বিস্ফোরিত হতে থাকে মাইনগুলো। এটাই ছিল অপারেশন জ্যাকপট। এ অপারেশনে চারটি বন্দরের ২৬টি জাহাজ আমরা ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলাম।
অপারেশনের পর সরে যেতে গিয়ে ধরা পড়েন নৌ-কমান্ডো খলিলুর রহমান। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৮ আগস্ট ১৯৭১। অপারেশন জ্যাকপট শেষে ফেরার পথে সাতক্ষীরার বুদহাটাতে আমরা সাতজন পাকিস্তানি সেনাদের অ্যামবুশের মুখে পড়ি। নদীপথে নৌকা দিয়ে যাচ্ছিলাম। সবাই খুব ক্লান্ত। একজন পাহারা দিলে বাকিরা ঘুমাত। রাত ১টা। পাহারার দায়িত্ব ছিল মোহসিনের। হঠাৎ চারদিকে গুলির শব্দ। নৌকার ওপর লাইট মেরে পাকিস্তানি সেনারা গুলি ছুড়ছে। আমাদের না জাগিয়েই মোহসিন প্রাণ বাঁচাতে সাঁতরে পালিয়ে গেল। চোখ খুলে দেখি, চারপাশ থেকে শুধু গুলি আসছে। প্রত্যেকের হাতেই একটা করে এসএমজি আর দুটো করে ম্যাগাজিন। এসএমজি দিয়ে মাত্র ২৫ গজ দূরে আঘাত করা যায়। আমরা পেরে উঠলাম না। ওখানেই আফতাব উদ্দিন ও সাতক্ষীরার কাটিয়া গ্রামের সিরাজুল ইসলাম মারা যায়। ডাঙ্গায় ওঠার আগেই আমরা অস্ত্র ফেলে দিই। বন্দি হই আমিসহ মুজিবর রহমান, ইমাম বারি ও ইমদাদুল হক। ওরা বুঝে যায় আমরা মুক্তিযোদ্ধা। ধরে নিয়ে শুরু করে নির্মম টর্চার।
তিনি বলেন, চোখ বেঁধে, সারা শরীরে রড দিয়ে পেটাত ওরা। প্রচন্ড যন্ত্রণায় কোমর পর্যন্ত অবশ হয়ে যায়। ওদের আঘাতে আমার সামনের সব দাঁত ভাঙা। একদিন ইটের খোয়ার রাস্তায় জিপ গাড়ির সঙ্গে পা বেঁধে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। পেটের চামড়া উঠে গিয়ে রক্ত পড়ছিল। মা-গো, বাবা-গো বলে চিৎকার করছিলাম। উত্তেজিত হয়ে তারা প্রায়ই বেয়নেট দিয়ে শরীরে খোঁচা দিত।
এরপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় সাতক্ষীরায়, ডায়মন্ড হোটেলে। সেখানে প্রতিরাতে শুনতাম মেয়েদের আর্তচিৎকার। একদিন কবর খুঁড়ে সেখানে নিয়ে গিয়ে ওরা বলে, মুখ খোল, না হলে এখনই মেরে ফেলব। আমরা তবু মুখ খুলিনি। পরে নিয়ে যাওয়া হয় যশোর ক্যান্টনমেন্টে। সেখান থেকেই কৌশলে ঝুঁকি নিয়ে পালিয়ে আসি।
নৌ-কমান্ডো খলিলুর রহমান এখন প্রয়াত। কিন্তু তার বলা কথা বর্তমান প্রজন্মের কাছে ইতিহাস হয়ে থাকবে। প্রজন্মের প্রতি আশা নিয়ে তিনি বললেন আমরা একটা ভৌগোলিক কাঠামো, পতাকা ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশটাকে অর্থনৈতিকভাবে তোমাদেরই সমৃদ্ধ করতে হবে। তোমরা ত্যাগী, সাহসী আর প্রতিবাদী হইও। শুধু নিজের চিন্তা করে দেশ ত্যাগ করো না। ভালোবেসে নিজের দেশের পাশে থেকো।
সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পাড়া মহল্লায় সতর্ক অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘সেই পঁচাত্তর থেকে একুশ বছর শুধু মার খেয়েছি। ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত শুধু মার খেয়েছি। এবার যে হাত দিয়ে মারবে সেই হাত ভেঙে দিতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এবার যেন আর কোনো বিআরটিসির বাস পোড়াতে না পারে। যেটা পোড়াতে যাবে এখন তো সবার হাতে ক্যামেরা। ভিডিও ফুটেজ দেখে যেই হাতে আগুন দেবে, সেই হাত সঙ্গে সঙ্গে পুড়িয়ে দিতে হবে। পোড়ার যন্ত্রণাটা তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে। কোনোদিন বলিনি এখন বলবআর মার খাওয়ার সময় নেই।’
গতকাল বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু এভিনিউ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের এক যৌথ সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এমন কড়া বক্তব্য দেন তিনি। এসময় তিনি বলেন, ‘অনেক মার খেয়েছি, আর নয়।’
বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশের স্থান নিয়ে উত্তেজনা চলার মধ্যে গত বুধবার বিএনপি কার্যালয়ের সামনে পুলিশের সঙ্গে দলটির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে হতাহত ও আটকের ঘটনা ঘটে। এরপর রাতে চট্টগ্রামে বিএনপির বিক্ষোভ মিছিল থেকে গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরকার বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করার ব্যাপারে অনড়। তারা বিকল্প প্রস্তাব পছন্দ হলে ভেবে দেখবে বলেও জানায়।
বসে বসে মার খাব না : প্রধানমন্ত্রী তবে প্রশাসন বলছে, রাস্তায় কাউকে সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না। এ অবস্থায় রাজনৈতিক পরিম-লে উত্তেজনা চলছে।
এমন প্রেক্ষাপটে দলীয় সভায় যুক্ত হয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘কারও গায়ে হাত দিলে আর ক্ষমা করা হবে না। এরা (বিএনপি) কীভাবে অত্যাচার করেছে সেটা মানুষের কাছে তুলে ধরতে হবে। বিএনপির অপকর্ম তুলে ধরতে হবে। আমাদের যেসব নেতাকর্মী বিএনপির হাতে ছেঁচা মার খেয়েছে তাদের বসে থাকলে তো চলবে না। বসে বসে আর মার খাওয়া যাবে না।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘অগ্নিসন্ত্রাসী, স্বাধীনতাবিরোধীদের আর ক্ষমতায় আসতে দেওয়া যাবে না। এটা পরিষ্কার কথা। ওরা আমাদের উৎখাত করবে? ওরা পকেট থেকে এসেছে, আবার পকেটেই থাকবে। গণতন্ত্রের কথা ওদের মুখে মানায় না।’
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশিদের বিভিন্ন বক্তব্যের সমালোচনা করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘যেসব দেশ আমাদের দেশের গণতন্ত্রের কথা বলে তাদের দেশের অবস্থা তো আমরা জানি। প্রতিদিন মানুষ খুন হয়। ভোট চুরি হয়েছে বলে তাদের ক্যাপিটাল হিলেও আক্রমণ হয়। পাঁচ-ছয়জনকে গুলি করে মারে। তাদের কাছ থেকে আমার গণতন্ত্রের সবক নিতে হবে? আমার বাংলাদেশ, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকবে।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে এনে সাজা বাস্তবায়ন করা হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মুচলেকা দিয়ে গেছিল সাজাপ্রাপ্ত আসামি। আমি ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করব, তারেক জিয়াকে বাংলাদেশে ধরে এনে সাজা বাস্তবায়ন করব।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমেরিকা...তারা খুনি পালতেছে একটা। আবার কানাডা পালে আরেকটা। পাকিস্তানে আছে দুইটা। সব দেশকে বলব এই খুনিদের ফেরত পাঠাতে হবে। ব্রিটিশ সরকারকে বলব তারেক জিয়াকে দেশে ফেরত পাঠাতে। কারণ সে সাজাপ্রাপ্ত আসামি। তারা মানবতার কথা বলে, দুর্নীতির কথা বলে আবার সেই খুনি-দুর্নীতিবাজকে আশ্রয় দেয়। কাজেই তাকে বাংলাদেশের কাছে হ্যান্ডওভার করতে হবে।’
গণমাধ্যমের মালিকদের উদ্দেশে সরকারপ্রধান বলেন, ‘যেসব মিডিয়া এখন ধরনা দিচ্ছে, এত টেলিভিশন এগুলো তো আমারই দেওয়া। আমি যদি উন্মুক্ত না করে দিতাম, এত মানুষের চাকরিও হতো না। এত মানুষ ব্যবসাও করতে পারত না।’
সবার শান্তি নিশ্চিত করেছে তার সরকারএ কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সে বিএনপির ব্যবসায়ীই হোক, আওয়ামী লীগের ব্যবসায়ী হোক, সবাই কিন্তু শান্তিতে ব্যবসা করেছে। হাওয়া ভবনও আমরা খুলি নাই। খাওয়া ভবনও আমরা খুলি নাই। ব্যবসা করার সুযোগ করে দিয়েছি। আবারও হাওয়া ভবন আসলে এখন আরেকটা নাম দেবে। আবারও চুষে চুষে খাবে। শান্তিতে ব্যবসা করতে হবে না।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপিকে যারা তেল মারছে, আমরা তাদেরও হিসাব করব। বিএনপির আমলে তো এত আরামে ব্যবসা করতে পারেননি। মিডিয়া একটু উল্টাপাল্টা লিখলেই তো মারত। তার পরও এত আহ্লাদ কীসে, এত তেল মারা কীসে, আমি তো জানি না। কত তেল আছে আমি দেখব।’
বিএনপির সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ প্রতিহিংসার রাজনীতি করে না। ২০০১ সালের নির্বাচনের পরপরই একেকজন বাড়ি দখল করে রাতারাতি পুকুর কেটে কলাগাছের বাগান করেছে। মেয়েদের ওপর পাশবিক অত্যাচার করেছে। ছয় বছরের মেয়ে থেকে শুরু করে ৬০ বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। সেই পূর্ণিমা-ফাহিমা সারা বাংলাদেশের কত নাম বলব সবার চিকিৎসা করতে হয়েছে। অনেকে লজ্জায় নামই প্রকাশ করেনি।’ তিনি বলেন, ‘২০০১ সালে যে অত্যাচারটা আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর করেছে আমরা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর গুণে গুণে সেই অত্যাচারের জবাব দিতে পারতাম। সেই ক্ষমতা আওয়ামী লীগ রাখে। কই আমরা তো তা করি নাই। আমরা তো তাদের ওপর এইভাবে অত্যাচার নির্যাতন করতে যাইনি। বরং ২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালে তারা আগুনে পুড়িয়ে মারা শুরু করল।’
বিএনপির নেতা খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘খুব বড় গলায় বলেন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। তারা তাদের কোনো ইশতেহার বাস্তবায়ন করতে পেরেছে? পারেনি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাকে যখন আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হলো আমি তখনই দেশে চলে এসেছি। তারেক জিয়ার বাপও আমাকে ঠেকাতে পারেনি। আবার যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার তখনো পারেনি। এতই নেতৃত্ব দেওয়ার শখ, দেশের বাইরে পালিয়ে থেকে কেন? ডিজিটাল বাংলাদেশ করে দিয়েছি সেই সুযোগে ডিজিটালি কথা বলে।’
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি গত বুধবার লাশ ফেলার দুরভিসন্ধি কার্যকর করেছে। আজ (বৃহস্পতিবার) থেকে সারা দেশে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা সতর্ক পাহারায় থাকবে, রাস্তায় কোনো সমাবেশ করতে দেব না।
গতকাল বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যদের সঙ্গে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের এক যৌথসভায় এ কথা বলেন তিনি। এ সময় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী নেতাকর্মীদের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেন।
বিদেশিদের উদ্বেগের বিষয় তুলে ধরে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিদেশিরা আমাদের বন্ধু। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কিন্তু এটা একপেশে, এটা উচিত নয়। আমরা আপনাদের বন্ধু। আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করবেন না। জনতা কার সঙ্গে সেটা যদি পাবলিক জমায়েতে মনে হয়ে থাকে, তাহলে যশোর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের সমাবেশ দেখুন। জনগণ কী চায় বুঝতে পারবেন।’
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘আজকে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা করতে উসকানি দিচ্ছে বিএনপি। তাদের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে তারা সংঘাতের উসকানি দিচ্ছে। সাম্প্রদায়িক শক্তি, জঙ্গিবাদী শক্তি মাঠে নামিয়ে লাশ ফেলার দুরভিসন্ধি তারা কার্যকর করেছে গত বুধবার।’
তিনি বলেন, ‘রাস্তা বন্ধ করে জনগণকে কষ্ট দিয়ে সমাবেশ করা, এটা আর হতে দেওয়া হবে না। আমরাও করব না। মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সমাবেশ আমরা মহানগর নাট্যমঞ্চে করব।’
নেতাকর্মীদের পাড়া-মহল্লায় সতর্ক অবস্থানে থাকার নির্দেশ দিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সারা বাংলাদেশের সব জেলা-উপজেলা, মহানগর, থানা, পৌরসভা, ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা আজ (বৃহস্পতিবার) থেকে সতর্ক পাহারায় থাকবেন। আক্রমণ আমরা করব না, আক্রমণের উসকানি দিলে সমুচিত জবাব দেওয়া হবে। এই বিজয়ের মাসে আমরা দেশকে সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে তুলে দিতে পারি না। এটা আমাদের শপথ।’ গণমাধ্যম একপক্ষ নিয়েছেএ অভিযোগ করে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘অনেকেই নিরপেক্ষতার কথা বলেন, বস্তুনিষ্ঠতার কথা বলেন। পুলিশ মার খেয়ে রাস্তায় পড়ে আছে, কেউ তো সেই ছবি দিলেন না। বিআরটিসির গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কেউ পত্রিকায় ছবি দিলেন না। এই দুর্ব্যবহার কেন করা হচ্ছে? মিডিয়া কেন একটা পক্ষ নিচ্ছে, পক্ষপাতিত্ব করছে। এটা আমার অভিযোগ।’
সভায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান; যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, হাছান মাহমুদ, আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম; সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, মির্জা আজম, এসএম কামাল হোসেন; বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়–য়া ও উপদপ্তর সম্পাদক সায়েম খানসহ কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
বিজয়ের মাসে নাশকতার বিরুদ্ধে খেলা হবে : আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ডিসেম্বর মাস বিজয়ের মাস। বিজয়ের মাসে নাশকতার বিরুদ্ধে খেলা হবে। কুমিল্লার মানুষকে প্রস্তুত থাকতে হবে, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে খেলা হবে, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে খেলা হবে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে খেলা হবে, ভোট চুরির বিরুদ্ধে খেলা হবে, ভুয়া ভোটার তালিকার বিরুদ্ধে খেলা হবে। বিএনপির দুরভিসন্ধি আমরা বুঝে গেছি, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী তথা দেশবাসী প্রস্তুত, নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে এবার রুখে দাঁড়াবে।
গতকাল বিকেলে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন ভার্চুয়ালি উদ্বোধনকালে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। এতে আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক, জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সবুর, সাবেক মন্ত্রী মুজিবুল হক মুজিব, নাসিমুল আলম নজরুল এমপি, আবুল হাশেম খান এমপিসহ জেলার সিনিয়ার নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন।
বিএনপি নেতাকর্মীরা নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বসে পড়ার পরিকল্পনা নিয়েছিল বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বলেন, ‘বিএনপি পার্টি অফিসে অনেক চালের মজুদ, পানির মজুদ ছিল। চিনি-ডালের মজুদ ছিল, ১৫টি অবিস্ফোরিত হাতবোমা ছিল। ছুরি-কাঁচি ছিল। ডেগে ডেগে খিচুড়ি ছিল। এগুলো আনার পেছনে কারণ কী? তা আমরা জানি। বড় জমায়েত হলে এমন হয়। কিন্তু আমরা এখন শুনছি তারা এখানে সমাবেশ করতে এসে বসে পড়ার পরিকল্পনা হিসেবে এসব রসদ এনেছিল।’
গতকাল বৃহস্পতিবার নয়াপল্টনে সংঘর্ষের ঘটনায় রাজধানীর রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে গিয়ে এসব কথা বলেন তিনি। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন ও ডিএমপি কমিশনারসহ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
ভাঙচুর ও জানমালের ক্ষতি করলে পুলিশ বসে থাকবে না বলে বিএনপিকে সতর্ক করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। দলটিকে শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবে দলীয় কাজ করেন। আপনারা মিছিল করেন, মিটিং করেন কোনো আপত্তি নেই। তবে আপনারা যদি ভাঙচুর করেন, জানমালের ক্ষতি করেন, পুলিশকে আহত করেন, তখন তো নিরাপত্তা বাহিনী বসে থাকবে না। তাদের কাজই তো প্রটেকশন দেওয়া।’
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘পরিস্থিতি নাজুক হয়েছে সেটা আমরা মনে করি না। পরিস্থিতি সবসময় আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক, তাদের একঘেয়েমি ছেড়ে হয় তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসুক। বিরাট সমাবেশ করুক, আমরাও দেখি, দেশবাসীও দেখবে। নয়তো কালশী মাঠে যাক। এরপরও আলোচনা হতে পারে। তারা আসুক ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে বসুক।’
বুধবার নয়াপল্টনে পুলিশ বাধ্য হয়েই অ্যাকশনে গিয়েছিল দাবি করে তিনি বলেন, ‘তারা (পুলিশ) যেভাবে মার খাচ্ছিল, এ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। বিশৃঙ্খলা করলে তো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তো চুপ থাকবে না।’
পুলিশ ব্যাগে করে বিএনপি কার্যালয়ে ককটেল নিয়ে গিয়েছিল বিএনপি নেতাদের এমন বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের যেসব পুলিশ আহত হয়েছে তাদের দেখে আসুন, তারা কি নিজেরা নিজেরা ককটেলে আহত হয়েছে? তারা মার খেয়েছে, ককটেলের হামলার শিকার হয়েছে।’
নির্ধারিত দিনেই আগামীকাল শনিবার রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ করতে চায় বিরোধী দল বিএনপি। তবে পুলিশ বলছে, সমাবেশের জন্য অনুমতি দেওয়া স্থান ছাড়া অন্য কোথাও করলে তা বেআইনি বলে গণ্য করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমন পরিস্থিতিতে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে বিএনপি ও পুলিশ। এছাড়া নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয়ের সামনে গত বুধবার পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনায় চারটি মামলা হয়েছে। পল্টন, মতিঝিল, শাহজাহানপুর ও রমনা থানায় হওয়া মামলাগুলোতে ঘটনার দিনই আটক বিএনপির কয়েকজন শীর্ষ নেতাসহ ৭১৪ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এর বাইরে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে আরও ২ হাজার ২৫০ জনকে। সব মামলার বাদীই পুলিশ।
এদিকে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশের আগে রাজধানীর আশপাশের বিভিন্ন জেলায় পথে পথে তল্লাশি চৌকি বসিয়েছে পুলিশ। এসব তল্লাশি চৌকি পার হওয়ার সময় রাজধানীমুখী বিভিন্ন যানবাহনের যাত্রীদের পড়তে হচ্ছে কড়া জিজ্ঞাসাবাদের মুখে। এছাড়া যানবাহন চলাচল কম থাকায় তাদের ভোগান্তিতেও পড়তে হয়েছে। এছাড়া গত কয়েক দিনের ধারাবাহিকতায় গত বুধবার রাতে এবং গতকাল বৃহস্পতিবার দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিএনপি নেতাদের বাড়িতে বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। এ সময় দলটির ৩০ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া নারায়ণগঞ্জে এক নেতার বাসায় অভিযান চালিয়ে তাকে না পেয়ে ছেলেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।
বুধবারের সংঘর্ষের পর গতকাল বিকেল ৪টা পর্যন্ত নয়াপল্টন এলাকায় রাস্তার দুই পাশেই চলাচল বন্ধ করে রেখেছিল পুলিশ। ডিএমপি মতিঝিল জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) গোলাম রুহানী বলেন, ‘জনগণের দুর্ভোগের কথা ভেবে সড়ক আমরা খুলে দিয়েছি। তবে পার্টি অফিস বন্ধ রয়েছে। আমাদের পুলিশ টহল অব্যাহত রয়েছে।’
সংঘর্ষের ঘটনায় ৪ মামলা : বুধবারের সংঘর্ষের ঘটনায় পল্টন, মতিঝিল, শাহজাহানপুর ও রমনা থানায় আলাদা ৪টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ওইদিনই আটক ৭১৪ জন বিএনপি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে ২ হাজার ২৫০ জনকে। সব মামলার বাদীই পুলিশ। ডিএমপি মুখপাত্র উপকমিশনার মো. ফারুক হোসেন গতকাল এসব তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেন। জানা গেছে, পল্টন থানায় বিএনপি নেতা রুহুল কবীর রিজভী, আমান উল্লাহ আমান, আব্দুস ছালাম, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী অ্যানি, ফজলুল হক মিলন, খাইরুল কবীর খোকন, শামসুর রহমান ও শিমুল বিশ্বাসসহ ৪৭০ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১৫০০-২০০০ জনকে আসামি করে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা হয়েছে। এছাড়াও গতকাল মতিঝিল থানায় বিস্ফোরক আইনে ২৮ জনের নাম উল্লেখ করে, রমনা থানায় ১৬৪ জনের নাম উল্লেখ করে এবং শাহজাহানপুর থানায় ৫২ জনের নাম উল্লেখ ও ২০০-২৫০ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করে মামলা হয়।
আমান ও জুয়েলের জামিন, রিজভী কারাগারে : বুধবার সংঘর্ষের দিন গ্রেপ্তার নেতাকর্মীদের গতকাল আদালতে হাজির করা হলে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন শুনানি শেষে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আমানুল্লাহ আমান ও আব্দুল কাদের জুয়েলকে জামিন দেন। অন্যদিকে বিএনপির সহ-জলবায়ু সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সেলিমুজ্জামান সেলিম, ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার আবু আশফাক, বিএনপি নেতা শাহজাহান, এ কে এম আমিনুল ইসলাম, ওয়াকিল আহমেদ, সজীব ভূঁইয়া, সারোয়ার হোসেন শেখ, সাইদুল ইকবাল মাহমুদ, মিজানুর রহমান, আল-আমিন, সাইফুল, শুভ ফরাজি ও মাহমুদ হাসান রনিকে রিমান্ডে নেওয়ার নির্দেশ দেন। আর কারাগারে পাঠানো হয় বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্মমহাসচিব খাইরুল কবীর খোকন, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস ও গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ফজলুল হক মিলনসহ বাকি আসামিদের।
আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে গুলি ছোড়া ব্যক্তির পরিচয় মিলেছে : বুধবার সংঘর্ষের সময় আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে শটগান হাতে এক যুবকের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ওই যুবকের ছবি ফেইসবুকে শেয়ার করে অনেকেই তাকে ছাত্রলীগের নেতা বলে দাবি করেন। তার পরিচয় শনাক্ত করেছে পুলিশ। গতকাল বিকালে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘ওই যুবকের নাম মাহিদুর রহমান, তিনি আনসার সদস্য। তিনি পল্টন থানার অন্তর্ভুক্ত হয়ে দায়িত্ব পালন করছিলেন।’
বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি, পথে পথে চেকপোস্ট : টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে নাশকতা চেষ্টার অভিযোগে বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের চার নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত বুধবার রাতে উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। ঝিনাইদহ সদরসহ জেলার চার উপজেলায় নাশকতার আশঙ্কা ও মামলায় বিএনপির ২৬ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বুধবার রাত থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত সময়ে চালানো অভিযানে তাদের আটক করা হয়। নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির যুগ্মআহ্বায়ক মনিরুল ইসলাম রবির বাসায় বুধবার রাত ২টার দিকে অভিযান চালায় পুলিশ। এ সময় রবিকে বাসায় না পেয়ে তার ছেলে প্রীতমকে (২০) ধরে নিয়ে যায়।
রাজধানীর প্রবেশপথ আমিনবাজার ও আশুলিয়ায় চেকপোস্ট বসিয়েছে পুলিশ। গতকাল সকাল থেকেই এসব চেকপোস্টে যানবাহন থামিয়ে যাত্রীদের তল্লাশি করতে দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। এর ফলে অফিসগামী ও জরুরি কাজে বের হওয়া মানুষকে কিছুটা ভোগান্তিতে পড়তে হয়। মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মোটরগাড়ি ও মাইক্রোবাসে বেশি তল্লাশি চালানো হচ্ছে। এছাড়া কোনো পথচারীর সঙ্গে বড় ব্যাগ থাকলে তার গতিরোধ করে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। তল্লাশির কারণে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের আমিনবাজার এলাকায় ঢাকামুখী লেনে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।
উত্তরাঞ্চল থেকে রাজধানীতে প্রবেশদ্বার গাজীপুরের কালিয়াকৈরের চন্দ্রা ত্রিমোড় এবং শ্রীপুরের জৈনা বাজার এলাকায় পুলিশ প্রতিটি গাড়ি ও যাত্রীকে তল্লাশি করছে। টঙ্গী ব্রিজের দক্ষিণ প্রান্ত এবং আব্দুল্লাহপুর ফ্লাইওভারের নিচে চেকপোস্ট বসিয়ে প্রতিটি যানবাহনে তল্লাশি করা হচ্ছে।
মুন্সীগঞ্জে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-দোহার এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, অন্তত ৩০টি পয়েন্টে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। এসব চেকপোস্টে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা। একসঙ্গে ৪-৫ জন দেখলেই পুলিশের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে যাত্রীদের।
গতকাল সকাল থেকে হেমায়েতপুর-সিংগাইর-মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের ধল্লা ভাষাশহীদ রফিক সেতুর পশ্চিম পাশে পুলিশ চেকপোস্টে নজরদারি বাড়ানো হয়। এছাড়া ধল্লা চেকপোস্ট এলাকায় সকাল থেকে অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
নারায়ণগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়তি তৎপরতা দেখা গেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। এছাড়া শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েনের পাশাপাশি সাঁজোয়া যান মোতায়েন করা হয়েছে। বুধবার সকাল থেকে সিদ্ধিরগঞ্জের মৌচাক, ফতুল্লার সাইনবোর্ড লিংক রোড এলাকায় এবং মঙ্গলবার রাত থেকে সোনারগাঁয়ের মেঘনাঘাট টোল প্লাজা এলাকায় একাধিক চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালানো হচ্ছে।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট জেলা-উপজেলার প্রতিনিধি ও সংবাদদাতারা
দুর্নীতি দমন কমিশনার (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ বলেছেন, নির্বাচনের বছরে দুদক চোখ-কান খোলা রাখবে। আইন অনুসারে আমাদের যেটুকু অংশ, আমরা তা নিরপেক্ষভাবে পালনের চেষ্টা করব। আমরা সাধ্যমতো কাজ করছি।
মঙ্গলবার সেগুনবাগিচায় প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এক সংবাদ সন্সেলনে দুদক চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ও মো. জহুরুল হক এবং দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচনের বছরে সব প্রার্থীর হলফনামায় যে সম্পদ বিবরণী থাকে তা খতিয়ে দেখবে দুদক। এ বছর চোখ-কান খোলা রাখবে। সমস্ত প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করবে। আগামী বছরে দুদকের কাজে আরো গতিশীলতা আনার জন্য কাজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সোমবার রাতে বার্ষিক প্রতিবেদনটি (২০২২) রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি দুদকের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়ে কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থান নিতে বলেছেন। দুদক স্বচ্ছতার সঙ্গে সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবগত করা হয়েছে।
ফাঁদ মামলা কেন কমেছে এমন এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা যতটুকু তথ্য পেয়েছি, সেই অনুসারে ফাঁদ মামলা হয়েছে। আমরা শতভাগ সফল হতে পারিনি। বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় গত বছর সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের করেছি। ওই বছর এফআরটি কম হয়েছে। মামলা বেশি হয়েছে, এফআরটি কমেছে। সাজার হার বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুদক ঠিকমতো কাজ করছে না, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, মামলা, তদন্ত, অনুসন্ধান সব কিছুই বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। তারা তাদের বক্তব্য দিয়েছে। আমরা তথ্য দিলাম, এগুলো সংরক্ষিত আছে। আপনারাই বিবেচনা করবেন।
এ সময় বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, মামলাগুলো চলমান। এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি তিনি।
সম্প্রতি আলোচিত দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানের ‘অর্থপাচার’ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে দুদক চেয়ারম্যান জানান, এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই, পেলে কাজ করবে দুদক।
এদিকে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেন, দেশের টাকা বাইরে চলে গেছে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়তো কাজ করতে পারেনি দুদক। পাচারকৃত অর্থ নিয়ে কাজ করে আরো অনেকগুলো সংস্থা। শুধু দুদকের একার কাজ নয় এটি। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি টাকা ফিরিয়ে আনার।
দুদকের অসন্তুষ্টির জায়গা কোনটি এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক বড় বড় দুর্নীতি বিশেষ করে দেশের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেক দুর্নীতিবাজ দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে, ব্যবসার আড়ালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে। এই বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের মাত্র একটি অপরাধের এখতিয়ার আছে। বাকি ২৬টি অপরাধের বিষয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এখতিয়ার। কিন্তু জনগণের মনে এখনো ভ্রান্ত ধারণা দুদক কী কাজ করে। কিন্তু আমাদের অংশে আমরা কাজ করি ও শতভাগ সাফল্য রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশেরে এক পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেন, দেশে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বাড়ে নাই, বরং কমেছে। তবে আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বন্ধ করতে পারিনি। মামলা পরিচালনা ক্ষমতা কমেছে এটা মিথ্যা কথা। কারণ মানিলন্ডারিং মামলায় ১০০ ভাগ সাফল্য, অন্যান্য মামলায় সাজার পরিমাণ ৬৭ থেকে ৭০ ভাগ আমাদের পক্ষে। আমাদের সক্ষমতা কমেছে কে এটা বলেছে। এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।
দুদকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরে দুদকে জমা পড়ে ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ। এসব যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের জন্য সংস্থাটি হাতে নিয়েছে ৯০১টি অভিযোগ, যা মোট অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৯৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ অভিযোগই অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিতে পারেনি দুদক। ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগের মধ্যে ৩ হাজার ১৫২টি অভিযোগ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে। ২০২২ সালে চার্জশিট অনুমোদন হয়েছে ২২৪টি, মামলা হয়েছে ৪০৬টি, ফাঁদ মামলা হয়েছে মাত্র ৪টি।
২০২১-২২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সাজা, নিষ্পত্তি ও খালাসের পরিমাণ বেড়েছে। এরমধ্যে গতবছর সংস্থাটির ৩৪৬টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এছাড়া এই সময়ে কমিশন আমলের ৬৪ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ব্যুরো আমলের ৩৫ দশমিক ৯০ মামলার আসামির সাজা হয়েছে। ২০২২ সালের দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন তুলে ধরেন দুদক চেয়ারম্যান। উপস্থাপনকালে এই তথ্য জানানো হয়।
ছেলে ইজহান মালিককে সঙ্গে নিয়ে ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরবে রয়েছেন ভারতের সাবেক টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একাধিক ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেছেন তিনি।
মঙ্গলবার ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে মনিদা শরীফে তোলা নিজের একাধিক ছবি পোস্ট করেন সানিয়া। ভিডিও পোস্ট করেছেন ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে।
ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা প্রথম ছবিতেই দেখা যাচ্ছে সানিয়া তাকিয়ে আছেন তার ছেলের দিকে। সানিয়ার পরনে কালো রঙের বোরকা।
ছবিগুলো পোস্ট করে ক্যাপশনে সানিয়া লিখেছেন, ‘আলহামদুল্লিাহ। আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করুন।’
সানিয়ার পোস্ট করা ছবিগুলোর কয়েকটিতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও রয়েছেন। তবে তার স্বামী পাকিস্তানি ক্রিকেটার শোয়েব মালিককে কোনোটাতেই দেখা যায়নি।
শুরুতেই হোঁচট খেল এক বছরে বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের বর্ষপঞ্জি। প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পিছিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। প্রিলিমিনারির রেশ ধরে পেছাতে হবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সূচিও।
অথচ এই বিসিএস দিয়েই বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ এক বছরে শেষ করার ছক এঁকেছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অবস্থায় বর্ষপঞ্জিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি ৩০ নভেম্বর শুরু না করে ১ জানুয়রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৪৬তম বিসিএস থেকে পরিবর্তিত এক বর্ষপঞ্জিতেই বিসিএস শেষ করার নতুন পরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমরা ৪৬তম বিসিএস থেকে বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করব।’
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই সোহরাব হোসাইন এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার কথা বলেছিলেন। চাকরি জীবনে খ্যাতিমান এই আমলা এগিয়েছিলেনও বহুদূর। তিনি যখন চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন, তখন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩ বিসিএস চলমান ছিল। এর মধ্যে ৪০-এর সুপারিশ হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। ৪১তম বিসিএসের অর্ধেক মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মহামারির সময় চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ৪২তম বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয় এবং অল্প সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। আর ১৫ দিনের মধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ শেষ হবে। ৪৪তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যানের মূল টার্গেট ছিল এক বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএস শেষ করা। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়েছিল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছাপানোর জটিলতায় সূচি অনুযায়ী প্রিলিমিনারি নিতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি সচরাচর বিজিপ্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপাত।
বিসিএস বর্ষপঞ্জি কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিজিপ্রেস থেকে সরে আসে পিএসসি। তারা একটা বিশেষ জায়গা থেকে এ প্রশ্নপত্র ছাপায়। ৪৫তম বিসিএসে ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। ৬ সেট প্রশ্ন ছাপাতে হয়। সেই হিসাবে প্রায় ২১ লাখ প্রশ্নপত্র ছাপানোর প্রক্রিয়া সময়মতোই শুরু করে পিএসসি। দরসহ বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার কাজ আটকে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতৈক্য হলেও শিগগিরই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারছে না। ২৩ বা ২৪ মার্চ রোজা শুরু হবে। রোজায় এ বিশাল পরীক্ষা আয়োজনের কোনো রেওয়াজ নেই। পিএসসিও চায় না নতুন করে এর নজির তৈরি করতে। কাজেই মে মাসের আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মে মাসজুড়ে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হলে প্রিলিমিনরি নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিভাগীয় শহরের অনেক স্কুলে উভয় পরীক্ষার সিট পড়ে। সেই হিসেবে জুন মাসের আগে প্রিলিমিনারি নিতে পারছে না পিএসসি। এতে করে চার মাস পিছিয়ে যাবে ৪৫তম বিসিএসের সব ধরনের পরীক্ষা।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। একটা বিসিএসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এ থেকে পিএসসিকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছেলেমেয়েরা কাজবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণী পরিবারের ভরসাস্থল। তাদের দিকে চেয়ে থাকে পুরো পরিবার। বেকারত্বের বিষয়টি পিএসসিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবে। আগে অল্প দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারলে এখন কেন পারবে না? আগের চেয়ে পিএসসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে জানতে চাইলে কমিশনের একজন সদস্য বলেন, পিএসসি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরের অর্থাৎ ৪৬তম বিসিএস থেকে যেন এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা এখনই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা বিসিএস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সাধারণত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার এক মাস আগে পিএসসির একজন সদস্যকে ওই বিসিএসটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্ব এখনই একজন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। ওই বিসিএস সমন্বয় করবেন কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ।
কমিশনের সদস্য ও পিএসসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির সদস্যরা একমত হয়েছেন ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করে ১ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এতে প্রচলিত ক্যালেন্ডার ইয়ার ঠিক থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বর্ধিত সময়ে যাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে তাদের কী হবে। সেই সমস্যাটিও আলোচনা করে মোটামুটি সেরে রেখেছেন সদস্যরা। ৪৬তম বিসিএসে যারা বয়সের ফেরে পড়বেন তাদের বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। খুব শিগগির ওই বিসিএসের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু হবে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সিলেবাস নিয়ে। সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান থাকলেও সেই কাজ ৪৬ বিসিএসের আগে শেষ হবে না। কাজেই এক বছর আগেই প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজেও কোনো জটিলতা দেখছেন না পিএসসির সদস্যরা।
কিছুদিন ধরে পিএসসি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবর্তন আনা সেই সংস্কারেরই অংশ। পিএসসি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে চায়। মুখস্থ বিদ্যাধারীদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও তারা সিলেবাসে আমূল বদল আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায়ও পরিবর্তন এনেছে। কোনো চাকরি প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় তার জেলার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করা যাবে না। এ ধরনের প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি হয় বলে পিএসসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। পিএসসির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য পর্যন্ত চাকরি প্রার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পরীক্ষার প্রার্থীদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৫ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়। আদেশে বলা হয়েছে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য ‘কোডেড ফরম্যাটে’ থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সব তথ্যের কোডিং ও ডি-কোডিংয়ের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবে। কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন হলে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে ডি-কোডিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওই অফিস আদেশে।
৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আবেদন শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে চিকিৎসায়। সহকারী ও ডেন্টাল সার্জন মিলিয়ে ৫৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চিকিৎসার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ৪৩৭ জন। এরপর পুলিশে ৮০, কাস্টমসে ৫৪, প্রশাসনে ২৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্কোর কার্ডে জ্বলজ্বল করছে, বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী। তবুও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাওয়াশ, তাও টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন, তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এই ফল। লক্ষ্য ছিল ভালো ক্রিকেট খেলা, সে তো সবসময়ই থাকে। তবে বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডকে ঠিক পরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেই ৩-০-তে হারিয়ে দেওয়াটা যে স্বপ্নেরও সীমানা ছাড়িয়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজের একটা থ্রো। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১৪তম ওভারে বল করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের বলেই পেয়েছেন ডাভিড মালানের উইকেট। নতুন আসা ব্যাটসম্যান বেন ডাকেট। বলে ব্যাট লাগিয়েই ছুটলেন ডাকেট, অন্যপ্রান্ত থেকে জস বাটলার এসে স্ট্রাইকিং প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পয়েন্ট থেকে মিরাজের অসাধারণ থ্রো ভেঙে দেয় স্টাম্প। পরপর দুই বলে আউট দুই সেট ব্যাটসম্যান। তাতে রঙ বদলে যায় ম্যাচের। ১ উইকেটে ১০০ রান থেকে ৩ উইকেটে ১০০ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড, দুই প্রান্তে তখন দুই নতুন ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টি-টোয়েন্টির চ্যাম্পিয়নরা। পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে তাই আক্ষেপ করেই জস বাটলার বললেন, ‘পরপর দুই বলে দুই উইকেট হারানোটা খুব বাজে হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ম্যাচটা হারিয়েছে। আমি কেন যে ডাইভ দিলাম না এ নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে।’
২৪০ বলের ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ওই দুটো বলের ঘটনাই। মালান যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই হবে। ঢাকা লিগ ও বিপিএল খেলে যাওয়া মালান জানেন এই উইকেটে রান তোলার কৌশল, যা দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতানো শতরানের ইনিংস খেলে। কালও মনে হচ্ছিল মালানই তীরে তরী ভিড়িয়ে নেবেন, কিন্তু মোস্তাফিজের অল্প একটু বাড়তি লাফিয়ে ওঠা বলে পুল করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললেন এ বাঁহাতি। ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে যেটা তালুবন্দি করতে ভুল করেননি লিটন দাস। পরের বলে বাটলারের পড়িমরি করে ছুটেও রান সম্পূর্ণ করতে না পারা, মিরাজের দারুণ থ্রোর কাছে পরাস্ত হওয়া। এ দুটো বলই আসলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ইংল্যান্ডের। অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ১৫৯ রানের লক্ষ্য ভালোভাবেই উতরে যাবে ইংলিশরা। টস জিতে আগে বোলিং নেন বাটলার। লিটন ও রনি তালুকদারের ৫৫ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আদিল রশিদ, রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ দেন ২২ বলে ২৪ রান করা রনি। অবশ্য তার ইনিংসের ইতি ঘটতে পারত আগেই, রনির ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন রেহান আহমেদ। জীবন পেয়েছেন লিটনও, তার ক্যাচ ছেড়েছেন বেন ডাকেট। ১৪তম ওভারের প্রথম বলে লিটন ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডিপ-মিডউইকেটে, কিন্তু ডাকেট বলটা হাতে জমাতে পারেননি। দুবারই দুর্ভাগা বোলারটির নাম জোফরা আর্চার।
৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হন লিটন, নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান করে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিটা কমে আসে বাংলাদেশের। ১৫ ওভার পর যেখানে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ১৩১, সেখানে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ২ উইকেটে ১৫৮ রানে। শেষ ৩০ বলে ৯ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ তোলে মাত্র ২৭ রান তখন মনে হচ্ছিল বেশ ভালো ব্যাটিং উইকেটে অন্তত ২০-২৫টা রান কম হয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যাটিংয়ের শেষটা আর বোলিংয়ের শুরুটা, দুটো পক্ষে যায়নি বাংলাদেশের। অভিষিক্ত তানভীর ইসলাম ফিল সল্টকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের বলে ডাভিড মালানের বিপক্ষে মাঠের আম্পায়ার এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিলেও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। বাটলারকে নিয়ে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদের ব্যাটে ইংল্যান্ড ছিল জয়ের দিশাতেই কিন্তু পরপর দুই বলে দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ে বিপদে পড়া ইংল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি হারের বৃত্ত থেকে। একে একে মইন আলি (৯), বেন ডাকেট (১১) ও স্যাম কারেনের (৪) উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকা রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭ রান, ক্রিস ওকস প্রথম দুই বলে দুটি চার মারলেও পরের বলগুলোতে আর পাননি বাউন্ডারির দেখা। ইংল্যান্ড থেমে যায় ৬ উইকেটে ১৪২ রানে, ১৬ রানের জয়ে সিরিজ ৩-০-তে জিতে নেয় বাংলাদেশ।
দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের, তবে তার সঙ্গে মিশে আছে ঘরের মাঠে পছন্দসই উইকেট বানিয়ে জেতার সমালোচনাও। এবারের সিরিজ জয়ে সেই কালিমা নেই, বরং আছে বিশ্বজয়ীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জেতার গর্ব। সাকিব তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি আমাদের ম্যাচ জিততে হবে বা এমন কিছু। আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাটিংয়ে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংটা আমাদের তিনটি ম্যাচেই আমার মনে হয় অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে।’
ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সেটাও টি-টোয়েন্টিতে, যে সংস্করণে বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। সাকিব এ সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে। যেখানে ভালো করা ক্রিকেটাররাই ভালো করেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাতেই এসেছে অবিস্মরণীয় এই জয়, যে অর্জন টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে চেনাল নতুন করে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।