
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এবারের সম্মেলনে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে ২২তম জাতীয় সম্মেলনে অন্তত ১০ নেতা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলনস্থল পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেন তিনি।
আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘অপরিহার্যতা’ তুলে ধরে ওবায়দুল কাদের বলেন, দলের সভাপতি যিনি আছেন, তিনি আমাদের ঐক্যের প্রতীক। তিনি এখানে অপরিহার্য। তাকে সমর্থন করে না এমন একজনও কাউন্সিলর খুঁজে পাওয়া যাবে না। কাজেই এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।
দলটির সাধারণ সম্পাদকের বিষয়ে তিনি বলেন, এই পদে প্রার্থী হতে অনেকেরই ইচ্ছা থাকতে পারে। আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক দল। আমার জানা মতে, এ পদে অন্তত ১০ প্রার্থী আছেন, যারা সাধারণ সম্পাদক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। তাদের কে হবেন, তা নেত্রীর সিদ্ধান্ত এবং কাউন্সিলরদের মতামতে সবকিছুর প্রতিফলন ঘটবে সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে।
তিনি বলেন, আমরা আগেই বলেছি, এবারের সম্মেলনে যে কমিটি হবে, তাতে তেমন একটা পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা কম। পরবর্তী সম্মেলন নির্বাচনের পরে হবে। আপাতত বড় ধরনের কোনো পরিবর্তনের ব্যাপারে আমরা ভাবছি না। তবে কাউন্সিলরদের মতামতের ওপর সবকিছু নির্ভর করবে। আমি এই মুহূর্তে কোনো কিছু প্রেডিক্ট করতে চাই না।
বিতর্কিতদের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের ভাবনা জানতে চাইলে ওবায়দুল কাদের বলেন, এবারের নির্বাহী কমিটি অত্যন্ত সক্রিয় একটা কমিটি। করোনার মধ্যেও কাজ করতে দেখেছি। নেত্রীর ওপর নির্ভর করে সবকিছু। আমরা কেউ পারফেক্ট মানুষ না, ভুলত্রুটি নিয়েই মানুষ। নতুন নেতৃত্ব খুঁজতে অনেক কিছু চিন্তাভাবনা করতে হবে। বিতর্কিতদের ব্যাপারে আমাদের চিন্তাভাবনা আছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সহযোগিতায় ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন আওয়ামী লীগের লক্ষ্য ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। ২০৪১ পর্যন্ত উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করব আমরা। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা এগিয়ে যাব এবং এবারকার সম্মেলন এটা হবে একটা চ্যালেঞ্জিং টাইমস।
বৈশ্বিক যুদ্ধ এবং নিষেধাজ্ঞার প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ সংকটে আছে মন্তব্য করে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, এই সংকটকে সম্ভাবনায় রূপ দিতে এবারের সম্মেলনে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ উপস্থিতি থাকবে। এবারের সম্মেলন ঐতিহাসিক সম্মেলন হবে। সারা দেশে জাগরণের ঢেউ আছে। সম্মেলনে নেতাকর্মীদের ঢল নামবে।
তিনি বলেন, সুশৃঙ্খল, সুসংগঠিত উপস্থিতির মাধ্যমে আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছি। আগামী নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আমরা জাতির কাছে অঙ্গীকার রেখেছি, সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাব। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে আওয়ামী লীগকে আরও সুসংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করে গড়ে তুলতে চাই আমরা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ প্রস্তুত জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। আগামী সরকার পরিচালনার জন্য আমরা প্রস্তুত, ঐক্যবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল এটাই বার্তা আমাদের।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে টানা দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছেন ওবায়দুল কাদের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী তিনি। আগামীকাল ২৪ ডিসেম্বর দলের ২২তম জাতীয় সম্মেলন। আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে কে হচ্ছেন সাধারণ সম্পাদক?
সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ওবায়দুল কাদেরের নাম বেশি আলোচিত হচ্ছে। এবার হলে তৃতীয়বারেরমতো এ দায়িত্ব পাবেন তিনি। তবে তার শারীরিক অসুস্থতার ব্যাপারটিও বেশ আলোচিত। তিনি বাদ পড়তে যাচ্ছেন কি না সে সম্পর্কে কৌতূহল রয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেলেও তিনি কি তা সামলাতে পারবেন এমন প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে তাদের মনে।
দলের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সরকারের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ওবায়দুল কাদের দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছেন। তার মন্ত্রণালয়ের অধীনেই দেশের সবচেয়ে বড় অর্জন পদ্মা সেতু হয়েছে। বিশে^ বাংলাদেশকে সম্মানের আসনে বসিয়েছে এই সেতু।
তৃতীয়বার সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আলোচনায় থাকলেও নানাবিধ চ্যালেঞ্জও সামনে রয়েছে ওবায়দুল কাদেরের। বড় চ্যালেঞ্জ হবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ মাঠে বিরোধী দল বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন মোকাবিলা করা। তৃতীয় চ্যালেঞ্জ দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা। এই তিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটা সফল হবেন বা ব্যর্থ হলে কী সংকট সৃষ্টি হবে তা নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে বিস্তর আলোচনা চলছে। আলোচনা চলছে ওবায়দুল কাদের ছাড়া বিকল্প কে আছেন, তা নিয়েও।
২২তম জাতীয় সম্মেলনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদাকাক্সক্ষীরা ও তাদের অনুসারীরা তৃতীয় দফায় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দেখতে চান না ওবায়দুল কাদেরকে। ফলে ওবায়দুল কাদেরের শারীরিক অসুস্থতার বিষয়টি আলোচনায় আনা হচ্ছে। দলের একটি অংশ মনে করে, আগামী নির্বাচন সামলাতে ও আন্দোলন মোকাবিলা করতে হলে সাধারণ সম্পাদকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার পাশে সুস্থ-সবল একজন সাধারণ সম্পাদকের বিশেষ প্রয়োজন। তাতে সভাপতি কিছুটা চাপমুক্ত থাকতে পারবেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সারা দেশ সফর করতে হবে দলের সাধারণ সম্পাদককে। কৌশলী রাজনীতি ও সিদ্ধান্তের প্রয়োজন পড়বে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি-কূটনীতি দক্ষতার সঙ্গে সামলাতে হবে দলের সভাপতির পাশাপাশি দলের সাধারণ সম্পাদককেও। আলোচনায় থাকা ওবায়দুল কাদেরের জন্য বয়স ও শারীরিক অবস্থার কারণে এসব কাজ সঠিকভাবে করে ওঠা কঠিন হবে।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকম-লীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা-মেধা-দক্ষতায়, সর্বোপরি আওয়ামী লীগের জন্য কৌশলী একজন সাধারণ সম্পাদক সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যিনি দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারবেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ভালোভাবে সামাল দিতে পারবেন ও আন্দোলন মোকাবিলা করতে পারবেন। কৌশলগত রাজনীতিতে বিশেষ পারদর্শী হবেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থাকায় বিভিন্ন মত-পথের ও আদর্শের লোক দলে জায়গা নিয়েছে, ব্যক্তি-অনুসারী বেড়েছে দলে। সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে আদর্শের-স্বার্থের দ্বন্দ্ব-কোন্দল এখন চরমে। দ্বন্দ্ব ন্যূনতম মাত্রায় রাখতে সাধারণ সম্পাদকের ভূমিকা অনেক বেশি। এটি বিশেষ আমলে রাখতে হবে।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অবর্তমানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে উঠেছেন। সামনে ফখরুল আরও গুরুত্বপূর্ণ হবেন। এই সময়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমন কাউকে হতে হবে, যিনি ভাবমূর্তি সম্পন্ন হবেন এবং মির্জা ফকরুলকে মাঠের রাজনীতিতে ঘায়েল করতে পারবেন। গ্রহণযোগ্য একজন নেতাকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে বসাতে হবে।
আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আওয়ামী লীগের দায়িত্ব হাতে নিয়ে দল পরিচালনায় সফলতার যে স্বাক্ষর রেখেছেন, দলকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাতে যিনিই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হবেন তাকে সবসময় ছায়া সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হবে। সৈয়দ আশরাফ দায়িত্ব পালনের সময়ে নানা সমালোচনায় পড়লেও দায়িত্ব ছাড়ার পর আওয়ামী লীগের সর্বস্তরে একটি আস্থার নাম হয়ে ওঠেন। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দলের সবাই চান একজন সৈয়দ আশরাফকে।
দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও শুভাকাক্সক্ষীরা দাবি করেন, এখন কাদেরের চেয়ে ভালো সাধারণ সম্পাদক বেছে নেওয়াও কঠিন। আর যাই হোক ওবায়দুল কাদেরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ার আছে। তার দলের জন্য ত্যাগও আছে। একাধিকবার কারাবরণ করেছেন। রাজনীতির সুসময়-দুঃসময় দুটোই দেখেছেন কাছ থেকে। সারা দেশে পরিচিতিও আছে। তার চেয়ে বেশি জানাশোনা কম নেতারই আছে। আওয়ামী লীগের জন্য কমিটমেন্টও নেহায়েত কম নয় কাদেরের।
দলের সম্পাদকম-লীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগের মতো প্রাচীন একটি দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এমন দুয়েকজনের নাম শোনা যায়, যারা দায়িত্ব পেলে রাজনীতি ছেড়ে দিতে চাইবেন অনেকে। তিনি বলেন, সভাপতিমন্ডলীর তিন জন ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদের একজন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আলোচনায় আছেন। ওনাদের মধ্যে একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও রাজনীতি-আন্দোলন ও নির্বাচন মোকাবিলা করা যাবে। এর বাইরে যারা রয়েছেন কেউই এই সময়ে সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য ফিট নন।
২০১৬ সালে দলের ২০তম সম্মেলনে প্রথমবার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান ওবায়দুল কাদের। ২০১৯ সালের মার্চে ২১তম সম্মেলনের আগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তার শারীরিক অসুস্থতার বিষয়টি সামনে এনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এই পদে তাকে পিছিয়ে রাখতে বহু চেষ্টা করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আস্থা অর্জন করেছেন তিনিই।
১৯৭১ সালে মুজিব বাহিনীর হয়ে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলয় আহত ওবায়দুল কাদের। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দীর্ঘ আড়াই বছর কারাগারে ছিলেন। কারাগারে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। পরের মেয়াদেও সভাপতি হন। তিন বারের সংসদ সদস্য ওবায়দুল কাদের। বর্ণাঢ্য এই রাজনীতিক ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
১৯৭৫-পরবর্তী কঠিন সময়ের রাজনীতির অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ ওবায়দুল কাদের সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক পদ নিয়ে প্রথমে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আসেন। পরের দুটি সম্মেলনে এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯তম সম্মেলনে সভাপতিম-লীর সদস্য হন ওবায়দুল কাদের। ২০তম ও ২১তম সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক হন।
ওই সম্মেলনের আগেই সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা দিয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ওবায়দুল কাদেরকে ফিরিয়ে আনা হয়। বানানো হয় টানা দ্বিতীয়বারের মতো সাধারণ সম্পাদক। তবে দায়িত্ব পেলেও শারীরিক অবস্থা ও করোনা মহামারীর কারণে দেড় বছর ঘরবন্দি থাকতে হয়েছে তাকে। সড়ক, যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী হিসেবে দাপ্তরিক কাজও সেরেছেন ঘর থেকেই। এর ফলে সরকারি কাজে তেমন প্রভাব না পড়লেও সারা দেশে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমে বিরূপ প্রভাব পড়ে; সংগঠন ঝিমিয়ে পড়ার দশায়। ঘরে বসে গণমাধ্যমে সরব থেকেছেন ওবায়দুল কাদের। প্রতিদিন গণমাধ্যমে দলের ও সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরেছেন সংবাদ সম্মেলনে।
চলতি বছরের শেষের দিকে ঘর থেকে বাইরে বের হতে শুরু করেন ওবায়দুল কাদের। দলীয় কর্মকা-ে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। তৃণমূলের সম্মেলন-বর্ধিতসভা, কর্মিসভা এসব আয়োজনে যাওয়া-আসা শুরু করেন। ঢাকার বাইরেও নিয়মিত যাতায়াত করছেন। শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে শোনা যায়। তাই নিজের শক্তি-সামর্থ্য প্রমাণ করতে আগের মতো সরব হয়ে উঠেছেন তিনি। এই নেতার ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তৃতীয়বারের মতো সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেতে আগ্রহী তিনি। অসুস্থতার কথা ভুলে দলীয় কার্যক্রমে নিয়মিত উপস্থিত থাকছেন তিনি।
চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে বিএনপিকে এগিয়ে নিচ্ছিলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলের মুখপাত্র হিসেবে সারা দেশে ব্যাপক সাড়া ফেলছিলেন। সরকার তাকে কারাগারে পাঠিয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে এসব কথা জানান বিএনপির একাধিক নেতা।
নেতারা বলেন, দলের চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে মির্জা ফখরুল সারা দেশে বিভাগীয় সমাবেশ-সফর করে দলকে চাঙ্গা করেন। গত ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোলাপবাগে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশের আগে ৮ ডিসেম্বর তাকে উত্তরার বাসভবন থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গভীর রাতে আটক করে মিন্টো রোডের অফিসে নিয়ে যান। ৯ ডিসেম্বর তার জামিন বাতিল করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। বিএনপি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তার মুক্তি দাবি করে। এরপর চার দফা আদালতে জামিনের আবেদন করে ব্যর্থ হন দলের আইনজীবীরা। বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার জানান, তার বিরুদ্ধে ৮১টি মামলা রয়েছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক ও ময়মনসিংহ বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মহাসচিবের মুক্তির দাবিতে আমরা রাজপথে কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আমাদের মহাসচিব যখন সবার প্রিয় হয়ে উঠেছেন, তখন তাকে থামিয়ে দিতে সরকার মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে নিয়েছে। তবে তাকে জনগণের হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে পারবে না।’
বিএনপি নেতারা বলেন, দল পরিচালনার পাশাপাশি মির্জা ফখরুল ঢাকায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার ও মিশনপ্রধানরা সাক্ষাৎ করতে এলে তাতেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যেরও জবাব দিয়েছেন তিনি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা প্রায়ই প্রশ্ন করেন বিএনপির পরবর্তী নেতা কে?
দলটির নেতারা বলছেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আমাদের নেতা। তাদের অনুপস্থিতিতে মহাসচিব মির্জা ফখরুলই আমাদের নেতা হিসেবে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারা দেশে তিনশো আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে দলীয় যে মনোনয়নপত্র দেওয়া হয়েছিল তাতে স্বাক্ষর করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল তাকে। সরকার পতনের পর যে নির্বাচন হবে তাতেও দলীয় মনোনয়নপত্রে স্বাক্ষর করবেন তিনি।
মির্জা ফখরুল ১৯৯১ সালের পঞ্চম ও ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঠাকুরগাঁও-১ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়নে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ প্রার্থী খাদেমুল ইসলামের কাছে পরাজিত হন। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই আসনে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগের রমেশ চন্দ্র সেনকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একই বছর নভেম্বরে বিএনপি সরকার গঠন করলে খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় মন্ত্রিসভায় প্রথমে কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও পরে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। ২০০৬ সালের অক্টোবরে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগপর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। তখন তিনি বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। এরপর দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব নির্বাচিত হন। ২০১১ সালের মার্চে দলের মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের মৃত্যুর পর তিনি ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হন। ২০১৬ সালে দলের ষষ্ঠ কাউন্সিলে মহাসচিব নির্বাচিত হন।
বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, দলের মহাসচিব নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তার বিরুদ্ধে অনিয়মের কোনো অভিযোগ ওঠেনি। দেশ-বিদেশে একজন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মির্জা ফখরুল বিএনপিতে নিজের নেতৃত্ব যেমন প্রতিষ্ঠিত করেছেন তেমনি জনপ্রিয় হয়েছেন। সারা দেশে বিএনপির চলমান আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। তার নেতৃত্বে বিএনপির নেতাকর্মীরা ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠেছে। বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে জনসমাগমের রেকর্ড হয়েছে। সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি প্রভৃতি দাবিতে সফলতা আশা করছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা।
তারা বলেন, দলে যে অবস্থানে মির্জা ফখরুল উঠেছেন তা হঠাৎ করে হয়নি। বিভিন্ন কর্মকা-ে দলের মধ্যে সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তাকে অপছন্দ করেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে। সব গুঞ্জন উড়িয়ে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তাকে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলীয় মনোনয়নপত্রে স্বাক্ষর দেওয়ার অনুমিত দেন। তখন আপত্তি করেননি তৎকালীন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সে সময় ঠাকুরগাঁও-১ ও বগুড়া-৬ আসনে নির্বাচনে অংশ নেন তিনি। ঠাকুরগাঁও-১ আসনে পরাজিত হলেও বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচিত হন মির্জা ফখরুল। নির্বাচিত হলেও সংসদে যোগ দেননি। তবে দলের বাকি নির্বাচিতরা শপথ নেন। তিনি জানান, রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে তিনি শপথ নেননি।
বিএনপির এক বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক দেশ রূপান্তরকে বলেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সর্বোচ্চ ব্যক্তি। তার নেতৃত্বে আমরা বিএনপিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। গত ১২ অক্টোবর শুরু হওয়া বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের প্রধান অতিথি করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল স্থায়ী কমিটিতে। পরে এ সিদ্ধান্ত বাতিল করে সব বিভাগীয় সমাবেশে তাকে প্রধান অতিথি করা হয়।
খালেদা জিয়ার মেজো বোন সেলিমা ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, মির্জা ফখরুল আমাদের ভাগ্নে। দলের দুর্দিনে সে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছে। প্রথমে দলের কেউ কেউ তাকে অসহযোগিতা করেছে। এখন দুই-একজন ছাড়া সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরা তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাচ্ছে।
মির্জা ফখরুল-বিরোধী স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার না করার অঙ্গীকার করেন। কিন্তু এরপরও নেতাকর্মীদের ধরতে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্তদের ঘরে আটকে রাখতে শুরু করে। এমনকি ১৮ জনের মতো সংসদ সদস্য প্রার্থীকে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়। তখন স্থায়ী কমিটির সদস্য প্রয়াত ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদসহ অনেকে নির্বাচন বর্জনের দাবি তোলেন। কেউ কেউ নির্বাচন কমিশনে গিয়ে অবস্থান নিতে পরামর্শ দেন। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় এবং কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ার জন্য মির্জা ফখরুলের সমালোচনা করেন নেতাকর্মীদের একটি অংশ। নির্বাচনের পর গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট করারও সমালোচনা করেন বিএনপির কিছু নেতা। মহাসচিব সব সিদ্ধান্ত দলীয়ভাবে চেয়ারপারসন দিয়েছেন বলে জানান। সর্বশেষ সংসদ থেকে পদত্যাগের বিষয়ে স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য ভার্চুয়াল সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানালেও তাতে মির্জা ফখরুল একমত হননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিভাগীয় সমাবেশে অন্য নেতাদের পাঠালে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো ঢাকা থেকে তাদের প্রতিনিধি পাঠাবে না বলে জানিয়ে দেয় বিএনপিকে। মির্জা ফখরুল প্রধান অতিথি থাকলে তারা ঢাকা থেকে রিপোর্টার পাঠানোর ও গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ প্রচার করার কথা জানায়। পরে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সব বিভাগীয় সমাবেশে মির্জা ফখরুলকে প্রধান অতিথি করার নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে আলোচনার দায়িত্ব দেওয়া হয় মির্জা ফখরুলকে। এভাবে সবকিছুর নিয়ামক হয়ে ওঠেন তিনি।
৭৫ বছর বয়সী মির্জা ফখরুল শারীরিক নানা জটিলতা নিয়ে দলের নেতৃত্বে রয়েছেন। ১৯৭২ সালে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষা ক্যাডারে ঢাকা কলেজে অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষকতায় যোগ দেন তিনি। বেশ কয়েকটি সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৮৬ সালে ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৮ সালে এরশাদের আমলে তিনি শিক্ষা বিভাগের ডিজি ছিলেন। ১৯৮৮ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মির্জা ফখরুল পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের শেষের দিকে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৯২ সালে তিনি বিএনপির ঠাকুরগাঁও জেলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে মির্জা ফখরুল যখন বিএনপির মনোনয়ন পান তখন তিনি ঠাকুরগাঁও জেলার প্রাথমিক সদস্যও ছিলেন না। চাচা বিএনপির প্রভাবশালী নেতা মির্জা গোলাম হাফিজের সুবাদে তিনি মনোনয়ন পান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) মির্জা ফখরুল ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (পরে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন) সদস্য ছিলেন এবং এসএম হল শাখার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ছিলেন। জিয়াউর রহমান সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এসএ বারী এটি। তার ব্যক্তিগত সচিব পদে মির্জা আলমগীর দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮২ সাল পর্যন্ত। স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর এসএ বারী উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করলে শিক্ষকতা পেশায় ফিরে যান তিনি। নিজ জেলা শহর ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপক পদে যোগ দেন। পরে আবার রাজনীতিতে যুক্ত হন। রাজনীতিতে যোগ দিয়ে প্রথমে ঠাকুরগাঁও পৌরসভার মেয়র হন।
মির্জা ফখরুল বিবাহিত এবং দুই মেয়ের বাবা। বড় মেয়ে মির্জা শামারুহ বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে কর্মরত। ছোট মেয়ে মির্জা সাফারুহ একটি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। স্ত্রী রাহাত আরা বেগম বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।
একদিন বাদেই বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন দল আওয়ামী লীগের জাতীয় ত্রিবার্ষিক সম্মেলন। ২৪ ডিসেম্বর সম্মেলন শেষ হয়ে যাবে। কর্মী-সমর্থকের মাঝে প্রশ্ন কে হচ্ছেন সাধারণ সম্পাদক। সম্মেলনের ক্ষণ যতই এগিয়ে আসছে নেতাকর্মীদের আগ্রহ তত বাড়ছে। এই আগ্রহের ইতি টানতে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শামসুল হক। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেছেন।
ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা কি নতুনেই ভরসা রাখবেন না রেকর্ড গড়বেন কৌতূহল সবার। শেখ হাসিনার সংকেত বুঝতে যেমন নেতাকর্মীরা চেষ্টা করছেন তেমনি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আরও বেশি চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কারণ, রেকর্ড করার একমাত্র সুযোগ তারই।
তৃতীয়বার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হতে পারলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহচর তাজউদ্দীন আহমদের পাশে ওবায়দুল কাদেরের নাম লেখা হবে। বিরল এই রেকর্ড গড়তে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। ওবায়দুল কাদেরই হচ্ছেন তৃতীয়বারের সাধারণ সম্পাদক এমন আলোচনাও রয়েছে সর্বস্তরে।
ওবায়দুল কাদের গতকাল বৃহস্পতিবার সম্মেলনমঞ্চ পরিদর্শনে গিয়ে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এবারের সম্মেলনে বড় ধরনের পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তার এই বক্তব্যে ওবায়দুল কাদেরই থাকছেন সেই আলোচনা আরও জোরালো হয়ে উঠেছে। ফলে ক্ষমতাসীন দলের সম্মেলন ঘিরে যে উত্তাপ থাকার কথা তাতে একটু ভাটা পড়েছে। এ পদের প্রার্থীরা যেমন তাপ হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষও আগ্রহ হারাতে বসেছেন।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সম্মেলন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সাধারণ সম্পাদক পদে ১৬ বছর দায়িত্ব পালন করার নজির থাকলেও টানা তিনবার সাধারণ সম্পাদক হওয়ার নজির রয়েছে মাত্র দুজনের। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানা তিনবার সাধারণ সম্পাদক পদে থেকে নজির স্থাপন করেছেন। তিন দফার পরেও ১৯৬৪ সালে তলবি সম্মেলনেও সাধারণ সম্পাদক থাকেন বঙ্গবন্ধু। ধরা যায় চার মেয়াদ। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ও জাতীয় চার নেতার একজন তাজউদ্দীন আহমদও টানা তিনবার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ওবায়দুল কাদের এবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলে রেকর্ড করবেন তিনিও। বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের পাশে লেখা থাকবে তার নামও। আওয়ামী লীগের সবচেয়ে লম্বা সময় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দুইবার ও তার কন্যা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দুইবার। চার দফায় ১৬ বছর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। কিশোরগঞ্জ জেলার সভাপতির দায়িত্ব পালন করা জিল্লুর রহমান ১৯৭২ সালে প্রথম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সভাপতি হন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৪ সালেও সাধারণ সম্পাদক থাকেন। তবে সেবার সভাপতি হন এএইচএম কামরুজ্জামান। শেখ হাসিনার সঙ্গে জিল্লুুর রহমান সাধারণ সম্পাদক হন ১৯৯২ সালে। ১৯৯৭ সালে চতুর্থ দফায় সাধারণ সম্পাদক হয়ে দায়িত্ব পালন করেন ২০০২ সাল পর্যন্ত। তবে টানা তিনবার থাকার সুযোগ হয়নি তার।
দ্বিতীয় লম্বা সময় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রথমে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক থেকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৫৩ সালে পূর্ণাঙ্গ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে চার মেয়াদে ১৯৬৪ সাল ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। ’৬৪তে তলবি সম্মেলনেও সাধারণ সম্পাদক হন।
এরপর দুই দফায় ১০ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন প্রয়াত নেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। আওয়ামী লীগে মহিলাবিষয়ক সম্পাদক পদে কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৭৮ সালের সম্মেলনে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৩ সালে সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক বহিষ্কার হলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৭ সালের সম্মেলনে নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ১৯৭৫-পরবর্তী রাজনীতির উত্তাল সময়েও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা কারাগারে আটক থাকায় দায়িত্ব চালান তিনি। এই পদে তৃতীয় সর্বোচ্চ সময় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। রাজনীতিবিরোধী ওয়ান ইলেভেনের সরকারের সময়ে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার মুক্তির আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনে যাওয়ার দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তিনিই। অস্থির ওই সময়ে নেতাকর্মীদের দিকনির্দেশনা দিয়ে দলকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করেন, ঐক্য অটুট রাখেন। ২০০৯ সালে প্রথম ও ২০১২ সালে দ্বিতীয়বার সাধারণ সম্পাদক হয়ে দায়িত্ব পালন করেন ২০১৬ সাল পর্যন্ত। ৮ বছর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ২ মেয়াদে ৮ বছর থাকলেও এক মেয়াদেই ৭ বছর ছিলেন প্রয়াত আবদুল জলিল। ২০০২ সালের সম্মেলনে সভাপতিম-লী থেকে সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। টানা তিনটি সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেও সবচেয়ে কম সময় দায়িত্ব পালন করেন তাজউদ্দীন আহমদ। আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদে ৬ বছর ছিলেন তিনি। তাজউদ্দীন সাংগঠনিক সম্পাদক থেকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গেই দুই মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক। পাঁচ বছর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নেতৃত্ব দেন। সাংগঠনিক সম্পাদক থেকে ১৯৭৮ সালে প্রথম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৮১ সালে দ্বিতীয় দফায় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। ১৯৮৩ সালে বহিষ্কার হন তিনি।
এরপর দুই মেয়াদে ৬ বছর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দেন ওবায়দুল কাদের। কাদের ১৯৮৭ সালে সদস্য পদে কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হন। শিক্ষা-সংস্কৃতি, যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক থেকে সভাপতিম-লীর সদস্য হয়ে সাধারণ সম্পাদক পদে আসেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর টানা দুইবার সাধারণ সম্পাদক হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন তিনজন জিল্লুর রহমান, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও ওবায়দুল কাদের। সৈয়দ আশরাফ ২০১৬ সালে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় থেকেও টানা তিনবার সাধারণ সম্পাদক হতে পারেননি। তবে তাকে ক্রান্তিকালের সাধারণ সম্পাদক বলা যায়। প্রায় একই অবস্থায় ওবায়দুল কাদেরও রয়েছেন। সাধারণ সম্পাদকের আলোচনায় থাকলেও আগামীকাল শনিবার পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আগে প্রায় সবাই সম্পাদকীয় পদ থেকে হয়েছেন সাধারণ সম্পাদক। প্রয়াত আবদুল জলিল ও ওবায়দুল কাদের ব্যতিক্রম। এই দুজন সভাপতিম-লীর সদস্য থেকে সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। আওয়ামী লীগে আগে কিংবা পরে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকদের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার নজির বেশি।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন আলোচনা যাই থাকুক, সমাধানে আসা এখনই সম্ভব নয়। তারা বলেন, এখনো ‘আনপেডিক্টেবল’, চূড়ান্তভাবে কিছু বলা যাবে না। ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। অন্যদিকে একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা বলেছেন, অন্য সম্মেলনের সপ্তাহখানেক আগে যে সাধারণ সম্পাদক হচ্ছেন তিনি বা তার অনুসারীরা সংকেত পেয়ে যেতেন। এবার মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সবুজ সংকেত আসেনি। আবার সম্পাদকম-লীর অন্য কয়েকজন নেতা বলেন, ওবায়দুল কাদের সংকেত পেয়ে গেছেন, তা না হলে বড় পরিবর্তন হবে না বলে এ কথা বলতেন না। তার কার্যক্রম ও চেহারা দেখে তারা বলেন, সম্ভবত তিনিই হচ্ছেন তৃতীয়বারের মতো সম্পাদক।
সম্পাদকম-লীর ওই নেতারা বলেন, পরিবর্তন না হলে দলে প্রাণচাঞ্চল্য আসবে না। করোনা-পরিস্থিতি ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন মাথায় রেখে পরিবর্তন হবে না বলে যে আলোচনা বাজারে আছে তা অযৌক্তিক। তাদের অনেকেই দাবি করেন, দলের ভেতরে যেসব নেতা পদপ্রত্যাশী তাদের মধ্য থেকে বেছে নিলেও দল চাঙ্গা হয়ে উঠবে। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফসহ অন্য প্রার্থীদের অনেকের সারা দেশে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। হানিফের প্রতি এক ধরনের আস্থা সৃষ্টি হয়েছে সারা দেশে।
চলতি ডিসেম্বর মাসের ২৮ তারিখে বহুল কাক্সিক্ষত মেট্রোরেল উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশে চলাচল করবে। এতে মেট্রোরেলের প্রথম সুবিধা পাবেন মিরপুরবাসী। তারপর যারা উত্তরা থেকে মিরপুর যাতায়াত করবেন তারা এ সুবিধাভোগী হবেন। এদিকে মেট্রোরেল উদ্বোধনের দিন স্থানীয়দের সাতটি নির্দেশনা মেনে চলতে বলেছে পুলিশ। সরেজমিনে গতকাল বৃহস্পতিবার মিরপুর গিয়ে দেখা যায়, একসময় এই এলাকায় রাস্তায় মেট্রোরেলের মালামাল রাস্তার ওপরই থাকত। এখন সেখানে মালামাল নেই। আগের থেকে রাস্তা সম্প্রসারণ হয়েছে। আগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যাম লেগে থাকলেও গতকাল তেমনটা দেখা যায়নি।
আগারগাঁও এলাকার বাসিন্দা রাশেদ খান দেশ রূপান্তরকে জানান, মিরপুরে একসময় ধুলায় একাকার ছিল মেট্রোরেলের নির্মাণকাজের জন্য। বাসা থেকে বের হলেই নানা সমস্যায় পড়তে হতো। কিন্তু এখন অনেকটাই কমতে শুরু করেছে এ সমস্যাগুলো।
মিরপুর-১২ এলাকার বাসিন্দা আলিম উদ্দীন বলেন, ‘মিরপুরের নাম শুনলে অনেক সিএনজিচালক এই এলাকায় আসতে চাইত না। এলেও ভাড়া ডাবল চাইত। কারণ, মিরপুর মানেই যানজটের শহর। এখন এখানকার রাস্তা বড় হওয়ার পাশাপাশি ফুটপাত দিয়ে মানুষ যাতায়াত করতে পারছে। তাই মেট্রোরেল চালু হলে আমরাই এখন প্রথম সুবিধাভোগী হব।’
এই এলাকার আরেক বাসিন্দা রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আমার অফিসের কাজে উত্তরায় যাওয়া হয় মাঝেমধ্যে। এখন মিরপুর থেকে উত্তরা যেতে দুই থেকে তিন ঘণ্টা লেগে যায়। কিন্তু মেট্রোরেল চালু হলে মিরপুর থেকে খুব সহজে উত্তরায় যাওয়া যাবে। এতে সময়ও বাঁচবে অনেক।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ সাইফুন নেওয়াজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মেট্রোরেল একটি পরীক্ষিত যাতায়াতমাধ্যম। এর সুবিধাটা ধীরে ধীরে সবাই পাবে। কিন্তু প্রথম সুবিধাভোগী হবে মিরপুরবাসী। এরপর যারা উত্তরা থেকে মিরপুরের উদ্দেশ্য যাতায়াত করবে তারাও সুবিধাভোগী হবে। তবে এ মেট্রোরেলের জন্য অনেক ভোগান্তিতে পড়েছিল মিরপুরের বাসিন্দারা। যেসব রাস্তা আগে সংকুচিত ছিল, সেগুলোর সমস্যা আর থাকবে না। তিনি আরও বলেন, মিরপুরের বাসিন্দা কেউ যদি উত্তরায় যেতে চায় তাহলে ২০ মিনিটের মধ্যে যেতে পারবে। যেটার সময় এখন বাসে এক থেকে দুই ঘণ্টাও লেগে যায়।’
উদ্বোধনী দিনের নির্দেশনা : এদিকে ২৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে উপস্থিত থেকে মেট্রোরেল উদ্বোধন করবেন। সে জন্য উদ্বোধনের দিন স্থানীয়দের পুলিশের পক্ষ থেকে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো ১. কোনো ভবন, বিল্ডিং বা ফ্ল্যাটে আগামী ২৯ ডিসেম্বরের আগে নতুন কোনো ভাড়াটিয়া উঠতে পারবে না। ২. কোনো ভবনের কমার্শিয়াল স্পেসে আগামী ২৮ ডিসেম্বর নতুন কোনো অফিস, দোকান, রেস্টুরেন্ট খোলা যাবে না। ৩. মেট্রোরেলসংলগ্ন কোনো ভবনের ব্যালকনিতে, ছাদে কাপড় শুকাতে দেওয়া যাবে না এবং কেউ দাঁড়াতে পারবেন না। ৪. ভবন, বিল্ডিং বা ফ্ল্যাটে ওইদিন কোনো ছবি বা ফেস্টুন লাগানো যাবে না। ৫. মেট্রোরেলসংলগ্ন কোনো ভবনের কমার্শিয়াল স্পেসে বা আবাসিক হোটেলে ২৮ ডিসেম্বর কেউ অবস্থান করতে পারবে না। ৬. কোনো ভবন বা ফ্ল্যাটে যদি কোনো বৈধ অস্ত্র থাকে, তা ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে থানায় জমা দিতে হবে। ৭. মেট্রোরেলের দুই পাশের সব ব্যাংক বা এটিএম বুথ ২৮ ডিসেম্বর সকাল থেকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান চলাকালীন পর্যন্ত বন্ধ রাখার কথা এ নির্দেশনায় দেওয়া হয়েছে।
বিধিমতে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী তার অধীন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদক্রম অনুযায়ী সর্বোচ্চ নির্বাহী প্রকৌশলী পর্যন্ত বদলির এখতিয়ার রাখেন। কিন্তু এখন থেকে তিনি অধিদপ্তরের কোনো ধরনের বদলির সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। এ মর্মে চিঠি দিয়ে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রধান প্রকৌশলী মো. শামীম আখতারের বিষয়ে তদন্ত করতেও নির্দেশনা দিয়েছে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়কে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীদের বদলি করা নিয়ে নিজ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পর্কের ফাটল ধরে প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতারের। সেই সূত্রেই তার নানা অনিয়ম নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে সংস্থা প্রধানকে কারণ দর্শানোর নোটিসও দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে বলে জানা যায়। এরই মধ্যে প্রধান প্রকৌশলীর চেয়ারে বসতে সংস্থাটির আরও দুজন প্রভাবশালী প্রকৌশলীর জোর তৎপরতাও চোখে পড়ার মতো।
ঘটনার সূত্রপাত : গণপূর্ত অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের মধ্যে নগর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর চেয়ারটি নানা দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ চেয়ারে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করেছেন স্বর্ণেন্দু শেখর ম-ল। এ প্রকৌশলী চেয়ারে বসার শুরু থেকেই এখানে নিজের পছন্দের লোক বসাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী। আর দীর্ঘ সময় ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের চাকরি করা স্বর্ণেন্দু শেখর ম-লও নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন আগেভাগে। এরই মধ্যে গত ৬ ডিসেম্বর হঠাৎ এ প্রকৌশলীকে নগর ডিভিশন থেকে বদলি করে শেরপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী করা হয়। সেই সঙ্গে এক দিনের মধ্যে তাকে কর্মস্থলে যোগ দিতে অফিস আদেশ দেওয়া হয়। এ প্রকৌশলীকে অনেকটা বলপ্রয়োগ করে ঢাকার বাইরে পাঠাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন প্রধান প্রকৌশলী। ঢাকায় একই চেয়ারে চার-পাঁচ বছর হয়েছে এমন প্রকৌশলীদের রেখে মাত্র এক বছরের মাথায় বদলি করা হয়। বিষয়টি নিয়ে স্বর্ণেন্দু শেখর ম-ল নিজ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দেনদরবার করেন। একপর্যায়ে সংশ্লিষ্ট আশীর্বাদ পেয়ে গেলে বদলি আদেশ বাতিল করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়টি নিয়েই মূলত প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন তৈরি হয় প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতারের। তবে এ বিষয়ে নগর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী স্বর্ণেন্দু শেখর ম-লের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বদলি বন্ধ : সম্প্রতি গণপূর্ত অধিদপ্তরে চলমান উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে গত ২০ ডিসেম্বর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে একটি অফিস আদেশ জারি করা হয়। মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শেখ নূর মোহাম্মদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, সম্প্রতি গণপূর্ত অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের হয়রানিমূলক বদলিসংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়টি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এবং বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের নজরে এসেছে। সমন্বয়হীনভাবে এ ধরনের বদলি করায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে। এমতাবস্থায় মন্ত্রণালয় থেকে পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত গণপূর্ত অধিদপ্তরের তার নিয়ন্ত্রণাধীন সকল প্রকার বদলি/পদায়নসংক্রান্ত কার্যক্রম বন্ধ রাখার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিঠি : গত ১৯ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিবের কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-৩ আবদুল্লাহ আল খায়রুম স্বাক্ষরিত চিঠিতে ‘গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এবং এইচবিআরআইর সাবেক মহাপরিচালক লেবাসধারী ভন্ডপীর মো. শামীম আখতারের দুর্নীতি প্রসঙ্গে’ শিরোনামে চিঠিতে বলা হয়, এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে অবহিত করতে হবে।
চেয়ারের দৌড়ে আরও দুজন : বিসিএস গণপূর্ত ক্যাডারের ১৫তম ব্যাচের প্রথম হলেন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম। নিয়মমাফিক তিনি এ ব্যাচ থেকে প্রধান প্রকৌশলীর চেয়ারে বসেছিলেন। কিন্তু এ প্রকৌশলী তার দায়িত্ব পালনকালীন নিজ দপ্তরসহ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। ওই সময়ের প্রভাবশালী সচিব শহীদ উল্লা খন্দকারের সঙ্গে প্রকাশ্যে বিবাদে জড়ান। একপর্যায়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একজন সচিবের সঙ্গে একটি বিষয় নিয়ে বিবাদে জড়ালে আশরাফুল আলমকে হাউজ বিল্ডিং রিসার্স ইনস্টিটিউটে বদলি করা হয়। সরকারপন্থি প্রকৌশলী হিসেবে দাবিদার আশরাফুল আলমও তার আগের চেয়ার অর্থাৎ গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর চেয়ার পেতে তৎপর রয়েছেন বলে জানা যায়।
এ ছাড়া প্রধান প্রকৌশলী চেয়ারে বসতে চান একই ব্যাচের তৃতীয় স্থানে অবস্থান করা মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ। নিয়ম অনুযায়ী আশরাফুল আলমের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার কথা ছিল এ প্রকৌশলীর। কারণ দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করা অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. মইনুল ইসলামের চাকরিসংক্রান্ত জটিলতা থাকায় মোসলেহ উদ্দিনের দায়িত্ব পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই সময় বিতর্কিত ঠিকাদার জি কে শামীমের ঘটনায় দুদকের একটি মামলায় আসামি ছিলেন মোসলেহ উদ্দিন। তাই সরকার বিতর্ক এড়াতে একই ব্যাচের সপ্তম অবস্থানে থাকা অনেকটা ক্লিন ইমেজের শামীম আখতারকে আবিষ্কার করে প্রধান প্রকৌশলীর চেয়ারে এনে বসায়। এরই মধ্যে দুদকের মামলা থেকে নির্দোষ হয়েছেন মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ। সেই সঙ্গে শামীম আখতারও প্রায় দুই বছর প্রধান প্রকৌশলীর চেয়ারে দায়িত্ব পালন চলছে। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর উন্নয়নকাজে কিছুটা স্থবিরতা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়েছে এমন দাবি করেন মোসলেহ উদ্দিনপন্থি প্রকৌশলীরা। তারা মনে করেন, মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব করে আসা অভিজ্ঞ ও মেধাবী মোসলেহ উদ্দিনই এ চেয়ারের বসার যোগ্য। এ লক্ষ্যে তিনিও বেশ তৎপর রয়েছেন বলে জানা যায়।
এ বিষয়ে জানতে মোসলেহ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিস্তারিত শুনে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
যা বললেন সংশ্লিষ্টরা : এসব বিষয়ে কথা বলতে প্রধান প্রকৌশলী মো. শামীম আখতারের মোবাইলে ফোন করা হলে তিনি ধরেননি। এইচবিআরআইয়ের মহাপরিচালক মো. আশরাফুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শামীম আখতার এইচবিআরআইয়ের দায়িত্ব পালনকালে বেশ কিছু অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন। এগুলো তিনটি তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। যেহেতু তিনি এখানে সংস্থাপ্রধান ছিলেন তাই আমি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না। যে কারণে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা সব প্রমাণাদি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি ব্যাচের প্রথম অবস্থায় রয়েছি। প্রধান প্রকৌশলীর চেয়ারে দায়িত্ব পালন করে আমাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ভাড়া ৫৩ হাজার টাকা। এ রুটের অন্যসব এয়ারলাইনস আরও কম দামে যাত্রী বহন করলেও বিমান করে না। খালি যাবে, তাও কম ভাড়ায় যাত্রী নেয় না বিমান।
ঢাকা থেকে বিমান কত বেশি ভাড়া নেয় তা স্পষ্ট বোঝা যায় নিকটতম প্রতিবেশী শহর কলকাতার দিকে চোখ বোলালে। কলকাতার নেতাজি সুভাষ বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমানের তিন ভাগের এক ভাগ ভাড়া দিয়ে কুয়ালালামপুর যাওয়া যায়।
ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে উড়ে যাওয়া এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে বিমানের ভাড়া বেশি। বিমানের ভাড়া শুধু বেশিই নয়, এই এয়ারলাইনস ভাড়া বাড়ানোর নেতৃত্ব দেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রথমে বিমান ভাড়া বাড়ায় পরে প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য এয়ারলাইনসগুলো সেই সুযোগ নেয়।
অন্য এয়ারলাইনসের তুলনায় বিমানের ভাড়া বেশি এ অভিযোগ ছিল মূলত জনশক্তি রপ্তানিকারক ও ট্রাভেল এজেন্টদের। তাদের সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছেন সাধারণ যাত্রীরাও। কুয়ালালামপুর, রিয়াদ বা জেদ্দার মতো বাংলাদেশি শ্রমিকপ্রবণ শহরগুলোতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ব্যবহারকারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, দেশের বেসরকারি টেলিভিশন এমনকি খবরের কাগজগুলোতে যেচে এসে বলে যাচ্ছেন বিমান অনেক বেশি ভাড়া নিচ্ছে।
কীভাবে বিমান ভাড়া বাড়ায় জানতে চাইলে একজন জনশক্তি রপ্তানিকারক জানান, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিতে কী ভূমিকা রাখে তা নতুন করে বলার দরকার নেই। তাদের কর্মস্থলে পাঠাতে বা ফিরিয়ে আনতে বিমানের বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই। বিমান কোনো দিন কোনো ঘোষণায় বলেনি ‘এ উদ্যোগটি শুধু রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য’। এই শ্রমজীবীদের জন্য বিমানের কোনো ছাড় নেই। বরং যখন যে ‘আদম বাজার’ চাঙ্গা হয় তখন সেখানে ভাড়া বাড়িয়ে দেয় বিমান। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় প্রচুর শ্রমিক যাচ্ছে। সেখানে ভাড়া বাড়িয়েছে সংস্থাটি। শ্রমিক এবং ওমরাহর কারণে জেদ্দার টিকিটই পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও তা অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়।
এ অবস্থা থেকে বিমান কীভাবে বের হয়ে আসতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিমান নানা পলিসি নিতে পারে। বিকল্প রুট চালু করতে পারে। ট্রানজিট দিয়ে যাত্রীদের গন্তব্যে নিতে পারে। এতে যাত্রীরা কম দামে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ যাত্রী যেহেতু শ্রমজীবী তাই তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর বিষয়টিই গুরুত্বপূর্ণ। কত সময় ট্রানজিট নিয়ে গেল তা মুখ্য নয়। ঠিক এ জায়গাটিতেই এগিয়ে আছে আমাদের নিকটবর্তী শহর কলকাতা। ঢাকার তুলনায় অনেক কম দামে কলকাতার যাত্রীরা গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন। সেখান থেকে পরিচালিত এয়ারলাইনসগুলো সরাসরি বা এক-দুটি ট্রানজিট দিয়ে অনেক কমে যাত্রী বহন করে। বিমান কেন পারে না সেই প্রশ্নটি কেউ তুলছে না।
এক সপ্তাহ পর আগামী ৪ এপ্রিল ফ্লাই (যাত্রা) করার জন্য গতকাল সোমবার দুপুরে ঢাকা কুয়ালালামপুর রুটের বিমান টিকিটের দাম ছিল ৫৩ হাজার ২৭ টাকা। থাই এয়ারওয়েজ ৪১ হাজার ৭৬ টাকায়, ইন্ডিগো এয়ার ৪৩ হাজার ৬৪৪, ইউএস-বাংলা ৪৭ হাজার ১৯, এয়ার এশিয়া ৪৯ হাজার ৪৪৫, মালিন্দো এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৯০ এবং মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের ভাড়া ছিল ৬১ হাজার ৪৭২ টাকা।
অথচ কলকাতা থেকে এয়ার এশিয়া একই দিনে একই গন্তব্যে নন-স্টপ ফ্লাইটে মাত্র ১৭ হাজার ৩৭৯ টাকায় পৌঁছে দেওয়ার অফার ছিল অনলাইনে। এয়ারক্রাফটের মানভেদে একই দিনে বিভিন্ন সময়ে টিকিটটির দাম ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত ছিল। ইন্ডিগো এয়ার চেন্নাইয়ে একটি স্টপেজ দিয়ে ২০ হাজার ৩৩৭ টাকায় অফার দেয়। কলকাতা থেকে কুয়ালালামপুরে যাওয়ার জন্য এয়ার ইন্ডিয়ার টিকিটের দাম ছিল ২৯ হাজার ৬৩৯ টাকা। মুম্বাই এবং সিঙ্গাপুরে দুই স্টপেজ দিয়ে এয়ারলাইনসটি এ ভাড়া নির্ধারণ করে। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস মুম্বাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে কলকাতা থেকে ৫৪ হাজার ৩২৬ টাকায় যাত্রীদের নিয়ে যায় কুয়ালালামপুর।
ঢাকা রিয়াদ রুটে আগামী ৩ এপ্রিলের এয়ার অ্যারাবিয়ার ভাড়া ৫৪ হাজার ৯৫১ টাকা। শারজায় একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। কলম্বোতে একটি স্টপেজ দিয়ে শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনস রিয়াদ নিয়ে যাবে ৫৬ হাজার ৫৪৫ টাকায়। জাজিরা কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৫ হাজার টাকায়, গালফ এয়ার বাহরাইনে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৭ হাজার ৬৭৭ টাকায়, সৌদিয়া এয়ারলাইনস ৭১ হাজার ৭১১ টাকায় সরাসরি, কুয়েত এয়ারওয়েজ কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৩ হাজার ২৪৭ টাকায়, ওমান এয়ার মাস্কটে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৩২ টাকায়, ফ্লাই দুবাই দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৬৩ টাকায়, কাতার এয়ারওয়েজ দোহায় এক স্টপেজ দিয়ে ৮২ হাজার ৫৫৭ টাকায়, এমিরেটস দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৮৪ হাজার ২৩১ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে। আর ঢাকা-রিয়াদ রুটে বিমানের ভাড়া ১ লাখ ৫৫ হাজার ১৪৭ টাকা। ৩ এপ্রিল কলকাতা থেকে রিয়াদ যাওয়ার ভাড়াও ঢাকা রিয়াদের তুলনায় অনেক কম।
কলকাতা থেকে মাত্র ৩৫ হাজার ৩২৪ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে এয়ার ইন্ডিয়া। মুম্বাইতে মাত্র একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীদের সেখানে পৌঁছে দিচ্ছে। ওইদিন সময়ভেদে তাদের ভাড়া ৪১ হাজার টাকা পর্যন্ত ওঠানামা করছে। এক স্টপেজ দিয়ে ফ্লাই দুবাই নিয়ে যাচ্ছে ৪১ হাজার ৫৬০ টাকায়। ইতিহাদ এয়ারওয়েজের ভাড়া ৪১ হাজার থেকে ৪২ হাজার টাকা। এয়ার ইন্ডিয়া দিল্লিতে একটি স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪১ হাজার ৪১৯ টাকা। গালফ এয়ার মুম্বাই এবং বাহরাইনে দুই দফা স্টপেজ দিয়ে নিচ্ছে ৪৫ হাজার ৫৮৭ টাকা। ইন্ডিগো এয়ার দিল্লিতে এক স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪৮ হাজার ১৮৭ টাকা। দুবাইতে এক দফা বিরতি দিয়ে এমিরেটস কলকাতা থেকে রিয়াদের ভাড়া নিচ্ছে ৫৪ হাজার ৬৪৬ টাকা। কাতার এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৩৮ টাকায় এবং এমিরেটস ৬০ হাজার ১০৮ টাকায় একটি বিরতি দিয়ে কলকাতা থেকে রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে।
এসব রুটে বিমানের উচ্চমূল্য নির্ধারণই ভাড়া বৃদ্ধির মূল কারণ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এর সঙ্গে আছে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর ফ্লাইট কমানো এবং উচ্চ দামের সুযোগ নিতে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের কারসাজি এবং ২০২৩ সালে ডলারের বর্ধিত বিনিময় দর। জেট ফুয়েলের দাম বৃদ্ধিও টিকিটের দাম বৃদ্ধির কারণ।
বিমানের এমডি শফিউল আজিম বিমান ভাড়া বৃদ্ধিতে নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টি না মানলেও রিক্রুটিং এজেন্ট, ট্রাভেল এজেন্ট বা হজ এজেন্সির তরফ থেকে বরাবরই এ অভিযোগ করা হচ্ছে। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, যখন বিমান ভাড়া বাড়ায় তখন অন্য এয়ারলাইনসগুলোও ভাড়া বাড়ায়। বিমান যখন বাড়ায় তখন কোনো সীমা মানে না। তারা ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ায়।
৩৫ বছরের পেশাজীবনের কথা উল্লেখ করে মাজহারুল ইসলাম বলেন, বিমানের ভাড়ার সঙ্গে কুলাতে পারছি না। একজনকে বাইরে পাঠানোর সব খরচ অনুমান করা যায়, বিমান ভাড়া ছাড়া। কারণ ৫ ডলারের ভিত্তিভাড়া তারা ৩০ ডলার থেকে শুরু করে। বিমান ধারাবাহিকভাবে জ্বালানি খরচ বৃদ্ধির কথা বলে। কিন্তু জ্বালানি খরচ কমছে। যখন কমে তখন বিমান ভাড়া কমায় না। বিমান যেভাবে ভাড়া বাড়ায় তাতে ব্যবহারকারীদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এ অবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার বলে তিনি মনে করেন।
বিমানের ভাড়া প্রায় মহামারীর সময়ের মতো অবস্থায় চলে গেছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্টরা । বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে শ্রম আমদানিকারক দেশের গন্তব্যগুলোতে ভাড়া বেড়েছে। ঢাকা-জেদ্দা রুটে টিকিট পাওয়াই সৌভাগ্য। এ মাসের শুরুতে যে ভাড়া ছিল ৫০ হাজার তা এখন ৮০ হাজারেও পাওয়া যাচ্ছে না।
বিমান ভাড়া বৃদ্ধির সবচেয়ে বেশি খেসারত দিচ্ছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি)-ওয়েবসাইট তথ্য দিচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ২ লাখ ১৩ হাজার শ্রমিক বিদেশে গেছে। যাদের বেশিরভাগই গেছেন মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।
গত বছরের শেষদিকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলা হয়। বাজার নতুন করে শুরু হওয়ার পর ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে টিকিটের দাম আকস্মিকভাবে বেড়েছে। ব্যাংকক, কলম্বো বা অন্যান্য শহরে ট্রানজিট ফ্লাইট দিয়েও অনেক এয়ারলাইন কুয়ালালামপুরে যাত্রী বহন করছে। এতে টিকিটের দাম কমেছে ৩০-৪০ হাজার টাকা।
এবার হজ প্যাকেজে বিমান ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। এ টাকা বাড়িয়ে হজ প্যাকেজ ঘোষণার পর সংশ্লিষ্টরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। হজযাত্রী এবং হাবের ধারাবাহিক বিরোধিতা উপেক্ষা করে বিমান ভাড়া বাড়িয়ে যচ্ছে। এবারও বাড়িয়েছে। গত ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হজবিষয়ক এক সভায় হাবের সিনিয়র সহসভাপতি ইয়াকুব শরাফতি হজে বিমান ভাড়া কমানোর অনুরোধ করেন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত বিমানের এমডি ভাড়া কমানোর সুযোগ নেই বলে জানান। বৈঠকে হজে কেন বিমান ভাড়া বাড়নো হলো তার যৌক্তিকতা জনসমক্ষে তুলে ধরার নির্দেশনা দেওয়া হয় এমডিকে।
ইয়াকুব শরাফতি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করেছি হজের বিমান ভাড়া কমানোর জন্য। বিমান কোনোভাবেই কমাতে রাজি হয়নি।’
বিমানের বর্ধিত ভাড়ার সুযোগে সৌদিয়া দেশ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে যাচ্ছে। কারণ বিমান যে ভাড়া নির্ধারণ করে সৌদিয়াও একই ভাড়ায় হজযাত্রী বহন করে। হজের চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশি হজযাত্রীদের অর্ধেক বহন করবে সৌদি আরবের এয়ারলাইনস।
আটাবের সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া জানান, প্রধান এয়ারলাইনসগুলোর পাশাপাশি এয়ার অ্যারাবিয়ান, ফ্লাই দুবাই, সালাম এয়ারের মতো বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলো তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের তুলনায় কম ভাড়া নেওয়ার কথা। অথচ কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের চেয়ে বেশি নিচ্ছে। বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলোও তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে মাত্র ৫০০ বা ১০০০ টাকা কম নিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে বেশি ভাড়া নিচ্ছে। অথচ সরকারের কাছে তাদের প্রজেকশন ছিল তারা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে অর্ধেক মূল্যে যাত্রী নেবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার মনিটরিং কম থাকায় তারা ইচ্ছেমতো ভাড়া নিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
সাতক্ষীরার পৌরসভার ব্যাংক লেনদেন সচল রাখার দাবিতে ময়লার গাড়ি রেখে ব্যাংকের প্রবেশ পথ আড়াই ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন বেতন না পাওয়া পৌর কর্মচারীরা।
সোমবার (২৭ মার্চ) সকাল ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সাতক্ষীরার সুলতানপুর বড় বাজার সড়কস্থ সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের সামনে এ অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন তারা।
এ সময় ব্যাংকের সাধারণ গ্রাহকরা লেনদেন করতে না পেরে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরে পুলিশের উপস্থিতিতে ব্যাংক ম্যানেজার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে বিষয়টি নিষ্পত্তির আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
তবে, সমস্যা সুরাহা করতে ১২ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছেন পৌর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক আন্দোলনকারী জানিয়েছেন, সাতক্ষীরা পৌরসভার কোনো কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী ২/৩ মাস যাবত বেতন তুলতে পারছেন না। বেতনের টাকা উত্তোলনকে কেন্দ্র করে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক কর্মকর্তা ও পৌর কর্মচারীদের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। সে কারণে ব্যাংকের সামনে পৌরসভার ময়লার গাড়ি রেখে অবরোধ করা হয়।
পরে, পুলিশের উপস্থিতিতে ব্যাংক ম্যানেজারের আশ্বাসে আন্দোলন আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। ১২ ঘণ্টার মধ্যে সুরাহা না হলে ফের আন্দোলনে নামতে বাধ্য হব, যোগ করেন ওই আন্দোলনকারী।
জানা যায়, সাতক্ষীরার পৌর মেয়র তাজকিন আহমেদ চিশতীর বিরুদ্ধে নাশকতার মামলায় হওয়ায় ৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে বরখাস্ত হন। এ সময় ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন কাজী ফিরোজ হাসান।
এরপর ১৪ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি কে এম কামরু কাদের ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর সমন্বিত হাইকোর্ট ডিভিশনের দ্বৈত বেঞ্চ এক আদেশে চিশতীর বরখাস্তের ওই আদেশ স্থগিত করেন। কিন্তু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত তাকে মেয়র পদে বসতে দেয়নি পৌর কর্তৃপক্ষ।
এদিকে, চিশতীর পক্ষে দেওয়া উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কপি সোনালী ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, সাউথবাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকে জমা দিলে পৌরসভার ব্যাংক লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। যে কারণে ২/৩ মাস পৌর কর্মচারীরা বেতন না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে।
এক পর্যায়ে তারা সোমবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত পৌরসভার ময়লার গাড়ি নিয়ে পূবালী ব্যাংক, সাউথবাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রবেশ পথ বন্ধ করে অবরোধ কর্মসূচি পালন করে।
এ ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত পৌর মেয়র কাজী ফিরোজ হাসান বলেন, পৌর কর্মচারীদের মাসিক বেতন দিতে তার এবং পৌরসভার সিইওয়ের যৌথ স্বাক্ষরে একটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয় সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকে। কিন্তু হাইকোর্টের চিঠি আছে টাকা তোলা যাবে না বলে বিভিন্ন তালবাহানা করছে তারা।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলেছি আমি আর আমার পৌর কর্মচারীরা বেতন পাবে না। তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। টাকার জন্য পৌরসভার অন্যান্য কার্যক্রম ব্যাহত হবে, তাও কাম্য নয়। পৌরসভার ২ লাখ বাসিন্দা টাকার অভাবে নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে, এ হতে পারে না। ব্যাংক ম্যানেজার কেন একক সিদ্ধান্তে এ রকম তালবাহানা করল তা জানা নেই। মঙ্গলবারের (২৮ মার্চ) মধ্যে ব্যাংকে জমা রাখা সমুদয় টাকা দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।
অন্যদিকে, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ অফিসার সরফরাজ নেওয়াজ বলেন, পৌর কর্মচারীদের বেতন দিয়ে দিতে বাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা হয়েছে। ২/১ দিনের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে।
প্রসঙ্গত, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে মামলা হওয়া কথা উল্লেখ করে ৬ ফেব্রুয়ারি পৌর মেয়র তাজকিন আহমেদ চিশতীকে বরখাস্ত করে। চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি নাশকতার মামলায় তিনি কারাগারে যান এবং ৯ ফেব্রুয়ারি তারিখে জামিনে মুক্ত হন।
পাবনার বেড়া উপজেলায় অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসন প্রকল্প ‘বীর নিবাস’-এ বাড়ি বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজ পরিবারের নামে সেখানে বাড়ি নিয়েছেন বরাদ্দ কমিটির সদস্য সচিব বেড়া উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। তাকে এ কাজে সহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে উপজেলা চেয়ারম্যান এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মুজিববর্ষে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ‘বীর নিবাস’ নামে সারা দেশে ৩০ হাজার একতলা পাকা বাড়ি নির্মাণ করছে সরকার। নীতিমালা অনুসারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সভাপতি ও সমাজসেবা কর্মকর্তা সদস্য সচিব হিসেবে বরাদ্দ কমিটি গঠন করে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা বাছাইয়ের কাজ করবেন।
বাস্তবে দেখা গেল, রক্ষক ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ছোট ভাই শফিউদ্দিন ফকিরের জন্য বীর নিবাসের বাড়ি বরাদ্দ নিয়েছেন বেড়া উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। বাড়ির নির্মাণকাজ শেষ, এখন তা হস্তান্তরের পালা।
‘বীর নিবাস’-এ বরাদ্দ নীতিমালায় বলা হয়েছে, সরকারি আবাসন কিংবা ভূমি সুবিধা পাননি এমন অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা বা তার পরিবার সেখানে বরাদ্দ পাবেন। যুদ্ধাহতরা অগ্রাধিকার পাবেন। আবেদনকারী আর্থিকভাবে অসচ্ছল হলেই শুধু বিবেচনাধীন হবেন।
কিন্তু বেড়া উপজেলার কাজীরহাটে বাড়ি বরাদ্দ পাওয়া সমাজসেবা কর্মকর্তার ভাই শফিউদ্দিন ফকির অসচ্ছল ব্যক্তি নন। তিনি সরকারি চাকরিজীবী, কাজীরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। রফিকুলের আরেক ছোট ভাই শওকত আলী ফকির পাবনার সুজানগর উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা। রফিকুল ইসলামরা তিন ভাই রফিকুল, শফিউদ্দিন ও শওকত।
অভিযোগ উঠেছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজ পরিবারের সদস্যকে বীর নিবাসে বরাদ্দ দিয়েছেন রফিকুল ইসলাম।
সরেজমিনে কাজীরহাটে গিয়ে দেখা গেছে, শফিউদ্দিন ফকিরের জন্য বীর নিবাসের বাড়ি নির্মাণ শেষ হয়েছে। ওই বাড়ির পাশেই তিনতলা বাড়িতে থাকেন তার বড় ভাই বেড়া উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম।
শফিউদ্দিন জানান, তাদের বাবা মৃত মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন ফকিরের নামে পরিবারের পক্ষ থেকে বরাদ্দ কমিটির কাছে বীর নিবাসে বাড়ি বরাদ্দ চান তারা। পৈতৃক জমিতে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় তারা মাসুমদিয়া ইউনিয়নে জায়গা কেনেন। সেখানেই বীর নিবাসের বাড়ি বরাদ্দ করেছে বরাদ্দ কমিটি। ভালো বেতনে সরকারি চাকরি করেও অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার ঘর কীভাবে বরাদ্দ পেলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে ইউএনও সাহেব বলতে পারবেন।’
বরাদ্দপ্রাপ্তির পর বাড়ির ভোগদখলের জন্য শফিউদ্দিনকে ক্ষমতা দিয়ে হলফনামা করেন পরিবারের অন্য সদস্যরা। সে সময় আবুল হোসেনের দ্বিতীয় স্ত্রী হালিমা খাতুন বরাদ্দ দাবি করলে উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও ও ইউপি চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে প্রভাব খাটিয়ে বীর নিবাসের স্বত্ব ছাড়তে লিখিত দলিল করিয়ে নেন প্রথম পক্ষের সন্তানরা। এ অভিযোগ করেছেন দ্বিতীয় স্ত্রী হালিমা খাতুন।
হালিমা খাতুন বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার বিধবা স্ত্রী হিসেবে বাড়িপ্রাপ্তিতে আমার অগ্রাধিকার আছে। আমার একটি নাবালিকা মেয়েও আছে। প্রথম পক্ষের ছেলেরা সরকারি চাকরি করে। তাদের অবস্থা ভালো।’
তিনি বলেন, ‘বাড়ি বরাদ্দের কথা শুনে আমি ইউএনও অফিসে যোগাযোগ করি। কিন্তু তারা আমাকে বরাদ্দ দেয়নি। শফির নামে বাড়ি বরাদ্দ হবে বলে জানায়। পরে উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, রূপপুর ইউপি চেয়ারম্যান রূপপুর ইউনিয়ন পরিষদে বৈঠক করে আমার মেয়ের নামে এক লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলে দলিলে সই করিয়ে নেয়। বাধ্য হয়েই তাদের সিদ্ধান্ত আমাকে মেনে নিতে হয়েছে।’
রূপপুর ইউপি চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা মাজহারুল ইসলাম মোহন বলেন, ‘উপজেলা কমিটির কাছ থেকে বীর নিবাসে বরাদ্দ নেওয়ার পর মৃত আবুল হোসেন ফকিরের প্রথম পক্ষের ছেলেদের সঙ্গে দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর বিরোধ বাধে। পরে উপজেলা চেয়ারম্যান এবং ইউএনও আমার পরিষদে উভয় পক্ষকে নিয়ে বৈঠকে বসেন। সেখানে দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর নাবালিকা মেয়ের জন্য এক লাখ টাকা ব্যাংকে স্থায়ী আমানত ও বিয়ের সময় সহযোগিতার শর্তে বীর নিবাসের বাড়ির মালিকানা প্রথম পক্ষের মেজো ছেলে শফিউদ্দিনকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।’
শফিউদ্দিন বীর নিবাসের বাড়ির বরাদ্দ নেওয়ায় অনিয়ম হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পুরো প্রক্রিয়াই অনিয়মের মধ্য দিয়ে গেছে। কারণ আবুল হোসেন ফকির মুক্তিযোদ্ধাই নন। তিনি ভারতেও প্রশিক্ষণে জাননি, কোনো দিন মুক্তিযুদ্ধ করেছেন বলেও শুনিনি। অথচ এসব পরিবারের লোকজন মুক্তিযোদ্ধার সুবিধা ভোগ করছেন। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বঞ্চিত হচ্ছেন। আমি এর বিপক্ষে।’
‘বীর নিবাস’ নিয়ে সমাজসেবা কর্মকর্তা রফিকুলের পারিবারিক সালিশ শেষে দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর কাছ থেকে বীর নিবাসের দাবি না করার অঙ্গীকারনামা-দলিল করে নেওয়া হয়। সেই দলিলে সাক্ষী হিসেবে সই করেছেন বেড়া উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল হক বাবু।
তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আবুল হোসেন ফকিরের বিধবা স্ত্রীর সঙ্গে প্রথম পক্ষের সন্তানদের বীর নিবাস নিয়ে বিরোধ তৈরি হয়। পরে উভয় পক্ষ বসে সমঝোতা করে নিয়েছে। বৈঠকে আমি অসচ্ছল বিধবা স্ত্রীর অগ্রাধিকারের কথা বলেছিলাম। কিন্তু উভয় পক্ষ সমঝোতা করে স্ট্যাম্প করে। সবার অনুরোধে আমি সাক্ষী হিসেবে স্ট্যাম্পে সই করেছি। উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে আমার স্বাক্ষর দেওয়া ঠিক হয়নি। আমি তখন বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তা করিনি; সরল মনে স্বাক্ষর করেছি। সমাজসেবা কর্মকর্তার ক্ষমতা ব্যবহার করে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি কেন নিতে হবে, আমার বোধগম্য হয় না। এটি লজ্জারও বিষয়।’
এ বিষয়ে বেড়া উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বীর নিবাসে বাড়ির জন্য আবেদন আবেদন কম ছিল। আবার যারা আবেদন করেছিল তাদের অনেকেরই প্রয়োজনীয় জমি নেই। আমার পরিবারের সদস্যকে বীর নিবাসে বাড়ি বরাদ্দ আমি একা দিইনি। কমিটি যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
বাড়ি বরাদ্দে অনিয়ম হয়নি বলে দাবি করেছেন বরাদ্দ কমিটির সভাপতি ও বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সবুর আলী। তিনি বলেন, কমিটির সবার মতামতের ভিত্তিতেই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শফিউদ্দিনের নিজের বাড়ি নেই। অসচ্ছল হিসেবেই তাকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’
এ বিষয়ে পাবনা জেলা প্রশাসক বিশ্বাস রাসেল হোসেন বলেন, ‘সচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা বা তার পরিবারের কোনো সদস্যের বীর নিবাসে বরাদ্দপ্রাপ্তির সুযোগ নেই। খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
চলতি রমজান মাসের শুরুতে টানা তিন দিন ছিল সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটি। যে কারণে ওই তিন দিনে রাজধানীতে যানজট তেমন একটা সৃষ্টি হয়নি। তবে ছুটি শেষে গতকাল সোমবার রমজানের প্রথম কর্মদিবসে যানজটে নাকাল হতে হয়েছে রাজধানী ঢাকার বাসিন্দাদের। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো রাজধানীতে যানজটের মাত্রাও বাড়তে থাকে। ১০ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে লেগে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ফলে তীব্র গরমের মধ্যে অসহনীয় ভোগান্তিতে পড়তে হয় অফিসগামী ও বিভিন্ন গন্তব্যমুখী মানুষকে।
গতকাল রাজধানীর সদরঘাট, গুলিস্তান, পল্টন, শাহবাগ, ফার্মগেট, রামপুরা ও মিরপুরসহ বেশ কটি এলাকা ঘুরে সকাল থেকে তীব্র যানজট দেখা যায়। যানজটে আটকা পড়ে অনেককে হাঁসফাঁস করতে দেখা যায়। কাউকে কাউকে আবার বাসে দীর্ঘ সময় বসে থেকে পরে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য হেঁটেই রওনা দিতে দেখা যায়। অনেক জায়গায় শুধু সড়ক নয়, ফ্লাইওভারে দেখা দেয় তীব্র যানজট।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগরীর অনেক জায়গায় রাস্তাঘাটের সংস্কারকাজ চলায় বিকল্প পথ ব্যবহারের কারণে যানজটের শিকার বেশি হতে হচ্ছে ওইসব এলাকার যাত্রীদের। বিশেষ করে অফিসের শুরু ও শেষের দিকে যানবাহনের দীর্ঘ সারি দেখা যায়।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী রাইসুল হক চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মতিঝিল থেকে মহাখালী যেতে তিন ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়। মতিঝিলের চারপাশে জায়গায় জায়গায় রাস্তা কাটা থাকায় ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। তা ছাড়া কোনো কিছুরই সঠিক পরিকল্পনা নেই। এক রাস্তা কয়েকবার কাটতে দেখা যায়। আর এজন্যই মূলত এত যানজট।’
মিরপুরের বাসিন্দা মো. জয় বলেন, ‘অফিসের কাজে প্রতিদিন শহরের বিভিন্ন প্রান্তে যেতে হয়। কিন্তু যানজটের কারণে কোনো কাজই সময়মতো করতে পারছি না। রমজানের শুরু থেকেই সব রাস্তাঘাটে জ্যাম (যানজট) লেগেই আছে। রমজানের বাকি সময়ে যানজট পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।’
যানজটের কারণে যাত্রীদের পাশাপাশি ক্ষুব্ধ গণপরিবহনের চালক ও কর্মীরাও। তানজীল পরিবহনের চালক মো. তানভীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সকাল থেকেই রাস্তায় প্রচণ্ড যানজট ছিল। কোনোভাবেই গাড়ি সামনে যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতি থাকলে সারা দিন গাড়ি চালিয়েও লোকসানে পড়তে হবে।’
এদিকে নগরবাসীর দুর্ভোগ লাঘবে যানজট নিরসনে ছোট ছোট গাড়ি কমিয়ে গণপরিবহন ব্যবস্থা আরও উন্নত করার দাবি জানিয়েছেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি শহরের জন্য যতটুকু পরিমাণ রাস্তাঘাট দরকার তার কোনো কিছুই মানা হচ্ছে না এই নগরীতে। আর প্রতিদিন কী পরিমাণ যানবাহন সড়কে চলছে তার সঠিক সংখ্যাও জানা নেই বিআরটিএর। এ ছাড়া এখনো অনেক জায়গায় প্রকাশ্যে অবৈধ অনেক যানবাহন চলাচল করছে। সেই সঙ্গে ছোট ছোট গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু গণপরিবহনের দিকে কারও নজর নেই। অথচ ছোট গাড়ি কমিয়ে গণপরিবহনকে আরও উন্নত করার বিষয়টি প্রাধান্য দিলে যানজট অনেকটাই কমে যেত।’
রাজধানী জুড়ে তীব্র যানজট সৃষ্টির কারণ জানতে চাইলে গতকাল সন্ধ্যায় ফার্মগেটে দায়িত্বরত ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) মো. মমতাজ ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যানজট নিরসনের জন্য ট্রাফিক পুলিশ সব সময় কাজ করে। টানা কয়েক দিনের ছুটির পর সড়কে গাড়ি বেশি নামায় কিছুটা যানজট বেড়েছে। সকালের দিকে একটু বেশি যানজট ছিল। বেলা ২টার পর কিছুটা কমলেও আবার বিকেলের দিকে অফিসগামীদের জন্য গাড়ির কিছুটা জটলা দেখা যায়। তবে যানজট নিরসনের জন্য আমাদের সিনিয়র কর্মকর্তাও রাস্তায় নেমেছেন, কীভাবে যানজট নিরসন করা যায় সেই পদক্ষেপ নিতে।’
কনটেন্ট ক্রিয়েশন এখন চাহিদামূলক পেশার তালিকায় প্রথম। দেশের অনেকে কনটেন্ট ক্রিয়েশন করে উপার্জন করছেন। অনেকে আবার পেশা হিসেবেই বেছে নিয়েছেন। লিখেছেন অনিন্দ্য শোভা
সালটি ২০১৭। প্রথমে নিজ প্রোফাইলে মজার মজার ভিডিও আপলোড করতেন সাইফুদ্দিন সিয়াম। যা তার পরিচিতদের হাসির খোরাক হতো। পরে এসপি ক্রিয়েশন (SP. creation) ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে শুরু করেন। পছন্দের মানুষের মন খারাপ বা রাগ ভাঙানোর জন্য ছোট ছোট ফানি ভিডিও ইনবক্সে পাঠিয়ে ভালো-খারাপ ফ্রিডব্যাক পাওয়ার মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ায় কনটেন্ট ক্রিয়েশন হিসেবে তার যাত্রা শুরু। শুরুতে পেশা হিসেবে না ভাবলেও পরে নিয়মিত হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘পেশা হিসেবে কনটেন্ট ক্রিয়েশন ভালো আবার খারাপও দুটো দিকই আছে। ঝুঁকিও কম নয়। কারণ সফল হবেন কি না সেটার নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। তবে নিয়মিত ধৈর্য ধরে মানসম্পন্ন কাজটা করলে সফলতা অবশ্যই ধরা দেবে।’ ডাকো কেন (DAKO KEN) চ্যানেলের কনটেন্ট ক্রিয়েটর আবদুল্লাহ মজাদার (ফানি) কনটেন্ট ক্রিয়েটিং করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে কনটেন্ট ক্রিয়েশনের দিকটা ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে, চাহিদা বাড়ছে। পেশা হিসেবে কনটেন্ট ক্রিয়েশন ভালো একটি পছন্দ হতে পারে। অবসর সময়েই করতে হবে এমন নয়, এটিও যেহেতু একটি কাজ তাই পেশা হিসেবেও নেওয়া যায়।’
‘কী ধরনের কনটেন্ট তৈরি করবেন তার ওপর নির্ভর করে যন্ত্রপাতি। তবে কনটেন্ট ক্রিয়েশন শুরু করতে বেশি কিছুর প্রয়োজন হয় না। ভিডিও ধারণের জন্য একটা মোবাইল ফোন, মাইক্রোফোন হলেই হয়’ যোগ করেন আবদুল্লাহ। তার কণ্ঠে সুর মিলিয়ে সাইফুদ্দিন সিয়ামও বলেন, ‘অনেকে মনে করে নামিদামি ক্যামেরা, গ্যাজেট না হলে কনটেন্ট ক্রিয়েশন করা যায় না। এটা ভুল ধারণা।’
একটা সময় অনেকেই শখের বশে কন্টেন্ট ক্রিয়েশন করতেন। সময়ের দোলাচলে বিশ্বব্যাপী ডিজিটালাইজেশন, স্মার্টফোন সহজলভ্য এবং উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধা হওয়ায় কন্টেন্ট ক্রিয়েশনে ঝুঁকছে তরুণ-তরুণী থেকে বিভিন্ন বয়সের মানুষ। অনেকে পেশা হিসেবে নিতে শুরু করেছে। কনটেন্ট ক্রিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি বলতে ‘ইউটিউব’কেই একটা সময় সবাই জানত। তবে সময়ের ধারাবাহিকতায় ইউটিউবের বাইরেও ফেসবুক, ব্লগার, পোডকাস্টার, স্টিমার ইত্যাদিতে কনটেন্ট ক্রিয়েট চলছে সমানতালে। আয়ও করছে ভালো পরিমাণে।
কনটেন্ট ক্রিয়েটর সোহাগ মিয়া বলেন, ‘আমাদের দেশে অনেকেই গতানুগতিক এবং সাধারণ কনটেন্ট নিয়ে কাজ করে, তাদের জন্য পেশা হিসেবে কনটেন্ট ক্রিয়েশন না। যারা সিরিয়াসলি প্রফেশনালভাবে কনটেন্ট ক্রিয়েশনকে নেবে এবং কোয়ালিটিপূর্ণ কনটেন্ট নিয়ে কাজ করবে, তাদের ভবিষ্যৎ আলোকিত।’
কী নিয়ে কাজ করব
প্রতি বছর বাংলাদেশে কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের সংখ্যা বাড়ছে। আগে সবাই ইউটিউবকেন্দ্রিক হলেও বর্তমানে ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন মার্কেটপ্লেসে নিয়মিত হচ্ছে। বর্তমানে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর (রান্নাবান্না, ভ্রমণ ভøগ, রিভিউ, হাস্য-রসাত্মক, শিক্ষণীয়, টিচিং ইত্যাদি) কনটেন্ট ক্রিয়েট করছে।
এ বিষয়ে কথা হয় কনটেন্ট ক্রিয়েটর সোহাগ মিয়ার সঙ্গে, যিনি বর্তমানে ‘সোহাগ ৩৬০ ডিগ্রি’ এবং ‘বেসিক ভাই’ ফেসবুক পেজ পরিচালনা করছেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ট্রাভেল, ফুড, টেক, কুকিং, বিনোদন নিয়ে কনটেন্টের চাহিদা বাড়ছে। তবে যে বিষয় নিয়েই কাজ করুক না কেন, সেটা প্রফেশনালি করতে হবে এবং ইউনিক কনটেন্ট হতে হবে।’
হরেক উপায়ে আয়
একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটর বিভিন্ন উপায়ে আয় করতে পারেন। ফেসবুক ও ইউটিউবের ক্ষেত্রে প্রথমে মনিটাইজেশন করতে হয়। তবে এই মনিটাইজেশন পেতে হলে নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণের ভিত্তিতে ফেসবুক এবং ইউটিউব পার্টনারশিপ প্রোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। এরপর থেকে বিভিন্ন কোম্পানির বিজ্ঞাপন ভিডিওতে দেখাবে এবং যত বেশি দর্শক (ভিউয়ার) দেখবে তার ওপর ভিত্তি করে টাকা পাবেন কনটেন্ট ক্রিয়েটররা। এছাড়া বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বা পণ্যের স্পনসরশিপ, এফিলিয়েট মার্কেটিংসহ আরও কয়েকটি ধাপে আয় করা যায়।
কনটেন্ট ক্রিয়েটর আবদুল্লাহ বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশে বিজ্ঞাপন ও স্পন্সরে বেশি আয় হচ্ছে। স্পন্সরের বিষয়টা হলো, একটি ব্যান্ডের পণ্য ভিডিও বা পোস্টের মাধ্যমে প্রমোট করলে ব্যান্ড নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে থাকে।’
আয় কেমন
সোহাগ মিয়া বলেন, ‘আয়টা ভিউয়ার এবং সাবসক্রাইবের ওপর নির্ভর করে। তবে সাধারণভাবে ২০ হাজার থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব।’
বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের ফলে মানুষও প্রযুক্তি-নির্ভর হচ্ছে, তাই কনটেন্ট ক্রিয়েটিংও পেশা হিসেবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য, নিয়মিত এবং প্রফেশনালভাবে কনটেন্ট ক্রিয়েশনকে সামনে রেখে শুরু করলে এই পেশাতেও সাফল্য অর্জন সম্ভব বলে জানান কনটেন্ট ক্রিয়েটররা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
রাজধানীর মিরপুরের একটি মাধ্যমিক-সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে সিফাত। একই এলাকায় বসবাসকারী তার বন্ধু সিয়াম পড়ে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে। সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবার থেকে রোজার ছুটি। আর সরকারি প্রাথমিকে ছুটি ১৫ রোজা অর্থাৎ ৭ এপ্রিল থেকে।
এক দেশে একই শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ভিন্ন নিয়মে ছুটি পাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এতে লেখাপড়ায় কেউ এগিয়ে যাবে, আবার কেউ পিছিয়ে পড়বে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সৈয়দ মামুনুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার বা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিলে ভেবেচিন্তেই নেয়। তবে সব ধরনের স্কুলে একটা কো-অর্ডিনেশন থাকলে ভালো হয়। আমরা ছুটির ব্যাপারে আরও আলাপ-আলোচনা করব।’
জানা গেছে, চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে আগামী শুক্রবার শুরু হতে পারে রমজান মাস। বছরের শুরুতেই স্কুলগুলোর ছুটির তালিকা অনুমোদন করা হয়। সে অনুযায়ী পবিত্র রমজান, স্বাধীনতা দিবস, ইস্টার সানডে, বৈসাবি, নববর্ষ ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি, বেসরকারি মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছুটি ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি কলেজ, আলিয়া মাদ্রাসা ও টিটি (টিচার্স ট্রেনিং) কলেজেও একই সময়ে ছুটির ঘোষণা রয়েছে মন্ত্রণালয়ের।
তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ছুটির তালিকা ভিন্ন। তারা পবিত্র রমজান, ইস্টার সানডে, চৈত্র-সংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আগামী ৭ থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ প্রায় ১৫ রমজান পর্যন্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা থাকবে।
রাজধানীসহ বড় বড় শহরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। তাই এসব প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও মাধ্যমিকের মতোই তাদের ছুটি থাকবে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রোজার ছুটিও একই। তবে মাদ্রাসায় রোজার ছুটি শুরু এক দিন আগেই অর্থাৎ আজ বুধবার, ২২ মার্চ।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান। তাই বুধবার ক্লাস করে বৃহস্পতিবার রোজার ছুটি শুরু হবে। তবে সব স্কুলে একই ধরনের ছুটি থাকা জরুরি। এতে একই সময়ে সিলেবাস শেষ করা যাবে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও সন্তুষ্ট থাকবে।’
রমজানে মাধ্যমিকে স্কুল বন্ধ আর প্রাথমিকে খোলা রাখায় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চার লাখ শিক্ষকের মধ্যে। তারা বলছেন, যেসব অভিভাবকের সন্তান প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই স্কুলেই পড়ে তাদের সমস্যা হবে। রমজান মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রাথমিকের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরাও রোজা রাখেন। তাই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে মিল রেখে প্রাথমিকের ছুটি নির্ধারণ করা যৌক্তিক হবে।
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাংগাঠনিক সম্পাদক জুলফিকার আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ বছর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সরকারি ছুটি ৭৬ দিন, কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ৫৪ দিন। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিন্ন ছুটি নির্ধারণের যুক্তি তুলে ধরে আমরা ইতিমধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আবেদন করেছি। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এখনো সাড়া পাইনি।’