
বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মন্তব্য ও পরামর্শ দেওয়া অব্যাহত রয়েছে। রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষের সভা-সমাবেশের অধিকার, সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া ও গণতান্ত্রিক কাঠামো নিয়ে যখন যুক্তরাষ্ট্র এমন সরব ভূমিকা পালন করছে তখনই বাংলাদেশের বিষয়ে হস্তক্ষেপের অধিকার অন্য কোনো রাষ্ট্রের নেই বলে বিবৃতি দিয়েছে রাশিয়া। বিবৃতিতে রাশিয়া দাবি করেছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ ও জার্মান রাষ্ট্রদূতও যুক্ত রয়েছেন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের শাহীনবাগে যাওয়াকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের সঙ্গেও তুলনা করেছে রাশিয়া। জবাবে এদিকে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস ইউক্রেনের বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া যখন একের পর এক কৌশলগত অবস্থান পরিবর্তনে ব্যস্ত তখন দেশ দুটির দ্বন্দ্বের এবার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বাংলাদেশেও। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া শীতল লড়াই থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ ইস্যুতে প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে জড়িয়ে বাংলাদেশকে প্রভাবিত করার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের অকুণ্ঠ সমর্থন আদায়ের পথেও হাঁটছে। যদিও এই মুহূর্তে বাংলাদেশকে দেশ দুটির অবস্থান গভীর পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। কেননা, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার একের পর এক বিবৃতি, টুইট ও পাল্টা তর্ক-বিতর্কে হুটহাট করে বাংলাদেশের জড়িয়ে পড়া ঠিক হবে না।
বাংলাদেশ ইস্যুতে মূল ঘটনার সূত্রপাত গত ১৪ ডিসেম্বর। এদিন সকালে রাজধানীর শাহীনবাগে প্রায় এক দশক ধরে নিখোঁজ বিএনপির নেতা সাজেদুল ইসলামের বাসায় গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সময় একদল লোক তাকে ঘিরে ধরার চেষ্টা করেন। তিনি নিরাপত্তাকর্মীদের সহায়তায় সেখান থেকে বেরিয়ে যান। এরপর মার্কিন রাষ্ট্রদূত জরুরি ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক ছুটে যান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, শাহীনবাগের ঘটনায় রাষ্ট্রদূত খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছেন। নিরাপত্তা নিয়ে তিনি একটু দুশ্চিন্তায় আছেন। রাষ্ট্রদূতকে বলেছি, অধিকতর নিরাপত্তা চাইলে আমরা আপনাকে ও আপনার লোকদের নিরাপত্তা দেব।
ঘটনার পরদিন ১৫ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরানকে ডেকে রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে ঢাকায় অনাকাক্সিক্ষত আচরণে উষ্মা প্রকাশ এবং তার নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানান। ওই ঘটনায় বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উদ্বেগ জানিয়েছে দেশটি। ২২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমকে ফোন করেন যুক্তরাষ্ট্রের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়েন্ডি শারম্যান। তিনি রাষ্ট্রদূত পিটার হাসসহ ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের সর্বস্তরের কর্মীদের নিরাপত্তা এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতের তাগিদ দেন। শারম্যানকে শাহরিয়ার আলম বলেছেন, তারা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা পেতে থাকবেন। তবে কোনো বিষয়ে জনসম্মুখে মন্তব্য করার আগে রাষ্ট্রদূতদের বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে জানা জরুরি।
এমন পরিস্থিতিতে ২০ ডিসেম্বর ঢাকায় রাশিয়া দূতাবাসের এক বিবৃতিতে বলা হয়, যারা নিজেদের বিশ্বের শাসক বলে মনে করে, তারা ‘গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ’ রক্ষার অজুহাতে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে। গণতন্ত্র সুরক্ষা বা অন্য কোনো অজুহাতে বাংলাদেশসহ তৃতীয় কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার বিষয়ে রাশিয়া বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশের মতো অনেক রাষ্ট্র বিদেশি শক্তির নেতৃত্ব অনুসরণ না করে তাদের নিজস্ব জাতীয় স্বার্থের জন্য তাদের বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ নীতি গঠন করে, তারা একই পথ অনুসরণ করে। আমরা এ দেশগুলোর আকাক্সক্ষাকে সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করি।
পিটার হাসের শাহীনবাগে যাওয়াকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের শামিল বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা। পিটার হাসকে ঘিরে ধরার চেষ্টাকে ‘প্রত্যাশিত’ উল্লেখ করে বলেছেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের জনগণের মানবাধিকার সুরক্ষার কথা বলে ক্রমাগত অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ২২ ডিসেম্বর রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে করা মারিয়া জাখারোভার মন্তব্য ২৫ ডিসেম্বর প্রচার করে ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির দূতাবাস।
এর এক দিন পর ২৩ ডিসেম্বর ওই বিবৃতি নিয়ে পাল্টা একটি টুইট করে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস। টুইটে দূতাবাস প্রশ্ন তুলেছে, জাতিসংঘের ঘোষণা অনুসরণ করে রাশিয়া অন্য কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার বিষয়ে বদ্ধপরিকর থাকার বিষয়টি তারা ইউক্রেনের ক্ষেত্রে অনুসরণ করেছিল কি না।
এদিকে পিটার হাসের ঘটনাকে নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দেখার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। তিনি বলেন, একটি ঘটনা বা আচরণ সেই সম্পর্ক রিমুভ করে ফেলবে, সেই সম্ভাবনা আমরা দেখি না। এতে দুই দেশের সম্পর্কে কোনো প্রভাবও পড়বে না। স্পর্শকাতর এলাকায় চলাফেরা করতে হলে কূটনীতিকদের অনুমতি নিতে হয়। যেমন পার্বত্য চট্টগ্রাম। তবে ঢাকার মধ্যে কূটনীতিকদের চলাফেরায় কোনো অনুমতি লাগে না। তারা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারেন।
শূন্যপদের দুই দিক। একদিকে কর্তৃপক্ষ, অন্যদিকে বেকার। দুই পক্ষ দুই মেরুতে অবস্থান করে। কর্তৃপক্ষ শূন্যপদ পূরণে বরাবরই অনীহা দেখায়। আর চাকরিপ্রার্থীরা হাহাকার নিয়ে অপেক্ষা করে।
এই দুই পক্ষের মধ্যে সেতুবন্ধের কাজটি ঠিকমতো করতে পারছে না সরকার। জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ যখন বেকার, তখন শূন্যপদ পূরণে যে তৎপরতা দেখানো দরকার তা অনুপস্থিত। দীর্ঘদিনে এই জায়গাটিতে কোনো দক্ষতাও গড়ে ওঠেনি।
নতুন মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার দায়িত্ব নিয়েই যেসব কাজে গুরুত্ব দিয়েছেন তার মধ্যে শূন্যপদ পূরণ অন্যতম। প্রশাসনের রেওয়াজ হচ্ছে তিন থেকে ছয় মাস পর সচিব সভা করা। মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের এ সভায় প্রশাসনের সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনার আলোকে নানা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
কিন্তু নতুন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছয় মাস অপেক্ষা করতে চাচ্ছেন না। এ কারণে সচিব সভা হওয়ার মাত্র ৩০ দিনের মধ্যেই তিনি নতুন করে সচিব সভা ডেকেছেন। আগের সচিব সভাটি ছিল বিদায়ী মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের অধীনে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সভা। এবারের সচিব সভাটি হবে বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিব কীভাবে প্রশাসনকে সাজাতে চান তার বার্তা দেওয়ার সভা।
আজ সোমবার অনুষ্ঠেয় সভার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হচ্ছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের শূন্যপদে নিয়োগের বিষয়ে আলোচনা। বৈঠকে মন্ত্রণালয় ও অধীনস্ত দপ্তরের শূন্যপদ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য সচিবদের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বৈঠকে শূন্যপদ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন দর্শন বাস্তবায়নে সচিবদের ভূমিকা এবং ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে মন্ত্রণালয়গুলোর ভূমিকা নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হবে। তবে শূন্যপদ কীভাবে পূরণ করা যায় সেটাই মুখ্য। সচিবদের শূন্যপদ সংক্রান্ত সব তথ্য সঙ্গে নিয়ে যেতে বলা হয়েছে। এছাড়া শূন্যপদের তথ্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগও সংগ্রহ করেছে। সরকারের মোট শূন্যপদের সংখ্যা ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৬৩৭। এর মধ্যে সাতটি মন্ত্রণালয়ের অধীনেই ২ লাখ ৩০ হাজার ৩৯৬। সবচেয়ে বেশি শূন্যপদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের, ৬৬ হাজার ৫৩৪টি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শূন্যপদ ৫৬ হাজার ১৩৮, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ৩০ হাজার ৫৯১, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২৭ হাজার ৬১০, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ২২ হাজার ৭৭৬, কৃষি মন্ত্রণালয়ের ১৪ হাজার ৬২৪, শিল্প মন্ত্রণালয়ের ১২ হাজার ১২৩, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের ১১ হাজার ১০২।
সরকারের মোট ৪৪টি মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে কিছু মন্ত্রণালয়ের একাধিক বিভাগ রয়েছে। সাধারণত একজন মন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রণালয় পরিচালিত হলেও প্রতিটি বিভাগের আলাদা সচিব রয়েছেন। এসব সচিবই আজকের সচিব সভায় অংশ নেবেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, যে সাত মন্ত্রণালয়ে শূন্যপদ বেশি সেগুলোতে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হবে। বাকিগুলো তদারকির আওতায় থাকলেও কম গুরুত্ব পাবে। আর খেয়াল রাখা হবে এগুলোতে জনবল নিয়োগ করতে না করতেই যেন আবারও পদ শূন্য না হয়ে যায়। সংস্থাগুলো সাধারণত শূন্যপদ জমিয়ে রাখে। অর্থাৎ একসঙ্গে অনেক শূন্যপদ হলে তারা নিয়োগের উদ্যোগ নেয়। এই অবস্থা থেকেও বের হয়ে আসা যাবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের শূন্যপদের বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, শূন্যপদ পূরণে কৃষি মন্ত্রণালয় তৎপর। কৃষির এত বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী যে, একদিকে লোক নেওয়া হয়, অন্যদিকে অবসরে চলে যায়। এসব শূন্যপদে যেন কোনো শূন্যতার সৃষ্টি না হয় সেটা আমরা বরাবরই লক্ষ রেখেছি।
দেশে যে পরিমাণ চাকরিপ্রত্যাশী তার তুলনায় চাকরির সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। শ্রম মন্ত্রণালয়ের মতে, প্রতি বছর ২০ থেকে ২৫ লাখ জনশক্তি শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। এই কর্মসংস্থানের মাত্র ৫ শতাংশ সরকারি আর ৯৫ শতাংশ বেসরকারি খাতের। উচ্চশিক্ষা শেষ করে অনেকে সরকারি চাকরির জন্য অপেক্ষা করেন বছরের পর বছর। একাধিক বিসিএস এবং একের পর এক সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিতে দিতে তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বেকারত্বের হার ৩৪ শতাংশ আর স্নাতক পর্যায়ে এই হার ৩৭ শতাংশ। মহামারীর আগে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২৮টি দেশের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের দিক থেকে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। আইএলও’র এ বছর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই অঞ্চলে মহামারীর পর বেকারের সংখ্যা মহামারীর আগের তুলনায় ৫০ লাখ বেড়েছে।
২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল চাকরির সুবিধা পরিবারে পরিবারে পৌঁছে দেওয়া। যেখানে রাজস্ব খাতভুক্ত পদের বড় সংখ্যা শূন্য থাকে, সেখানে ক্ষমতাসীন দলের এ প্রতিশ্রুতি যে পূরণ হয়নি তা সহজেই অনুমান করা যায়। বছরে সরকার গড়ে ৫০ হাজার শূন্যপদ পূরণ করতে পারে। গত অর্থবছরে সরকার ৫১ হাজার ৯০৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছে। মহামারীর কারণে তার আগের অর্থবছর এই সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ৫৫৩, যা অর্ধেকেরও কম।
বিপুলসংখ্যক পদ শূন্য থাকার পরও সরকার শূন্যপদে জনবল নিয়োগ করতে পারে না। এই ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা দপ্তরের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা শূন্যপদ পূরণে আগ্রহী হন না। জনবল নিয়োগ করতে গেলে ‘বদনাম’ হওয়ার আশঙ্কায় তারা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকেন। বদনাম হলে আরও ওপরের পদে পদোন্নতি পাওয়ার আশা ভঙ্গ হতে পারে এ কারণে কর্মকর্তারা নিয়োগে আগ্রহ হারান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সচিব দেশ রূপান্তরকে বলেন, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিলেই সবার আগে ডেকে পাঠান মন্ত্রী। তিনি জানতে চান নিয়োগে তার সুপারিশমতো কত শতাংশ নেওয়া হবে। অনেক ক্ষেত্রেই মন্ত্রীর কথা রাখতে গেলে আর কোনো প্রার্থী নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ থাকে না। কখনো কখনো মন্ত্রীরা শূন্যপদের চেয়ে বেশিসংখ্যক প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য চাপ দেন।
কিন্তু সচিবের বক্তব্যের ঠিক উল্টো অভিযোগ করেন মন্ত্রীরা। গত মাসে সচিবালয়ে চার নম্বর ভবনে গিয়েছিলেন একজন চাকরিপ্রার্থী। নওগাঁ থেকে আসা ওই প্রার্থী একটি অধিদপ্তরে জনবল নিয়োগের সর্বশেষ অবস্থার খবর নিতে গিয়েছিলেন। ঘটনাচক্রে তিনি মন্ত্রীর রুমে পৌঁছে যান। শূন্যপদে নিয়োগের খবর নিতে মন্ত্রী ফোনে কথা বলেন ওই অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে। ফোনে কথা বলা শেষ করে মন্ত্রী উপস্থিত দেশ রূপান্তরের প্রতিনিধিকে জানান, টাকা খাওয়ার হিসাব চূড়ান্ত করতে পারছেন না। যতক্ষণ পর্যন্ত টাকার হিসাব না মিলবে ততক্ষণ নিয়োগ আটকে রাখেন আমলারা।
মন্ত্রী-সচিবদের ধাক্কাধাক্কিতে একদিকে শূন্যপদ বাড়ছে। অন্যদিকে বেকারদের হাহাকার দীর্ঘতর হচ্ছে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের একজন সাবেক শিক্ষার্থী জানান, অনেকে মনে করেন ইংরেজিতে পাস করলেই চাকরি পাওয়া যায়। আসলে তা নয়। মাস্টার্স করতে করতেই ২৭ বছর পার হওয়া ওই তরুণ বলেন, বিশ^বিদ্যালয় শেষ করে চেষ্টা করলে দুটো বিসিএস দেওয়া যায়। এছাড়া নন-ক্যাডার চাকরিই ভরসা। কিন্তু তিন বছরে কত আর দরখাস্ত করা যায়। দরখাস্ত করলেই লিখিত পরীক্ষা বা ইন্টারভিউ কার্ড আসে না। আবার অনেক সময় একদিনে পাঁচটি লিখিত পরীক্ষারও চিঠি এসেছে। আর ক্যাডার পদের সংখ্যা কম থাকায় এতে তীব্র প্রতিযোগিতা হয়। এসব কারণে বেসরকারি চাকরিই ভরসা। সেই বেসরকারি চাকরি করতেও ইদানিং ঘুষ দিতে হয় বলে তিনি অভিযোগ করেন।
নিজে কিছু করছেন না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, যুব উন্নয়নে গিয়েছিলাম। তারা এক লাখ টাকা ঋণ দেবে। কিন্তু তারা সাপোর্ট হিসেবে জমির দলিল চায়। আমি জমির দলিল পাব কী করে। আমার বাবা বেঁচে থাকা অবস্থায় তো আমার নামে কোনো জমি হবে না।
বাংলাদেশ মধ্য ও উন্নত আয়ের দেশের দিকে যাচ্ছে। দেশে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশে উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়ের অভাব নেই। কিন্তু সমস্যা হলো এই তরুণদের উপযুক্ত শিক্ষা নেই। ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষায়ও তারা দক্ষ নন। এই কারণে দেশীয় তরুণদের বাদ দিয়ে বিদেশিদের নিয়োগ দিতে হচ্ছে। এসব বিদেশি নাগরিক বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছেন।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মো. ফিরোজ মিয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারের শূন্যপদ পূরণ করতে হলে ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নিতে হবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছাড়া এসব পদ পূরণ করা সম্ভব হবে না। কার বদনাম হবে বা কে টাকা ঘুষ নিচ্ছে এগুলো উপেক্ষা করে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শুধু সিদ্ধান্তেই চলবে না নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তা না হলে বিপর্যয়ের সময় শুনতে হবে জনবল নেই। নারায়ণগঞ্জের হাশেম ফুডের কারখানায় দীর্ঘ সময় আগুন জ¦লছিল। এ আগুন দ্রুত নেভানো গেল না দক্ষ জনবলের অভাবে।
আগামী দিনগুলোতে আওয়ামী লীগকে কী করতে হবে সেটা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। দলের নবনির্বাচিত কমিটিকে সে অনুযায়ী কাজ করার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। এ অবস্থায় আগের কমিটির অধিকাংশ নেতাকে রেখেই নতুন যে কমিটি করা হয়েছে সেটা নিয়ে নানা আলোচনাও তৈরি হয়েছে। দলের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এই কমিটি কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে সেই অঙ্ক নিয়ে বসেছেন সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা।
আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় ত্রিবার্ষিক সম্মেলন শেষ হয়েছে গত শনিবার। সভাপতি শেখ হাসিনা ও টানা তৃতীয়বার সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৮১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের ৪৮ নেতা নির্বাচন করেছেন দলের কাউন্সিলররা। সভাপতিমণ্ডলীর দুটি পদ, ৫টি সম্পাদকীয় পদ ও ২৮টি কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ সদস্যের পদ এখনো শূন্য রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের সম্মেলনে যেমন উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা থাকার কথা ছিল এবার শুরু থেকেই তাতে ঘাটতি দেখা গেছে। কারণ সম্মেলনে তেমন বড় পরিবর্তন হবে নাআগে থেকেই এই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তবু কেউ কেউ যেমন পদোন্নতির আশায় ছিলেন, তেমনি বাদ পড়ার আশঙ্কাও ছিল।
নেতা নির্বাচনের অধিবেশনে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, সামনে নির্বাচনএ বিষয়টি মাথায় রেখে দলের নেতৃত্বে খুব বেশি পরিবর্তন চান না তিনি। নেতৃত্ব নির্বাচন শেষ হওয়ার পর দেখা গেছে সারা বছর যারা সক্রিয় থেকেছেন, এবারের সম্মেলনে পদোন্নতির আশায় ছিলেনতারা নিরাশ হয়েছেন। আবার আগামী নির্বাচনের স্বার্থে যে ধরনের কার্যকর নেতৃত্ব মনে মনে ভেবে রেখেছিলেন সেটা না হওয়ায়ও নিরাশ হয়েছেন নেতাকর্মীদের বড় একটি অংশ।
ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের বড় একটি অংশ এবারের সম্মেলনে তাদের মূল্যায়ন হবে আশা করেছিল, নেতা হতে না পারায় বড় ওই অংশটিও হতাশ হয়েছে। আবার টানা দুই-তিনবার একই পদে পড়ে থাকা নেতারাও পদোন্নতি না হওয়ায় অসন্তুষ্টিতে আছেন।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে পাঁচবার থাকা মাহাবুবউল আলম হানিফ ও ডা. দীপু মনিকে পেছনের দিকে রেখে এ পদের নেতাদের তালিকা ঘোষণা সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। সভাপতি শেখ হাসিনা প্রথমে হাছান মাহমুদের নাম ঘোষণা করেন, এরপর হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম ও সর্বশেষ নাম ঘোষণা করেন দীপু মনির। সঙ্গে সঙ্গেই সম্মেলনস্থলে আলোচনার কেন্দ্র হয়ে ওঠেন হানিফ। উপস্থিত কাউন্সিলর-ডেলিগেটসহ সবার প্রশ্ন, ঘোষণা কী ভুল হলো? না হানিফ ও দীপু মনির পদাবনতি ঘটল? এরপর অনেকেই আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইটে ঢু মারতে শুরু করেন। গতকাল এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নতুন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বাইরে আর কোনো নাম নেই। ২০তম সম্মেলনের পরও এ পদ নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়। সেবারও প্রথম হানিফের নাম ঘোষণা করা হয়। দ্বিতীয় নাম ঘোষণা করা হয় জাহাঙ্গীর কবির নানকের। পরের দিন নানক গণভবনে গিয়ে তাকে এক নম্বর বানাতে সভাপতি শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করেন। এসময় তিনি রাজনীতিতে জ্যেষ্ঠতার কথা ও নিজের ত্যাগের কথা তুলে ধরেন, কিন্তু সংশোধন করা হয়নি।
অবশ্য গতকাল সকালে ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, যেভাবে ঘোষণা হয়েছে সেটাই থাকবে। এই নিয়ে কমিটির সংশ্লিষ্ট পদের নেতাসহ কয়েক নেতার কাছে জানতে চাইলে কোনো কথা বলতে রাজি হননি তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রসঙ্গটি নিয়ে কোনো কথা বলতে পারব না।’ তবে তিনি বলেন, দুয়েকদিন পর বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সম্পাদকীয় পদের এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, অধিবেশন মঞ্চ থেকে যেভাবে ঘোষণা হয় সাধারণত ক্রমিক নম্বরও সেভাবেই থাকে। ঘোষণা অনুযায়ী থেকে থাকলে ৫ বারের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হানিফ ও দীপুর পদাবনতি ঘটেছে।
একাধিক সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিশেষ পরিকল্পনায় ক্রমিকে হাছান মাহমুদকে এগিয়ে এক নম্বরে আনা হয়েছে। আগামী বছর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। সেখানে রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে এগিয়ে রাখা হয়েছে। তেমন কিছু ঘটলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেওয়ার সম্ভাবনা হাছান মাহমুদের। এ ছাড়া আগামী সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাকে এগিয়ে রাখার পরিকল্পনা থেকেও এটি হতে পারে। এবারও একই জটিলতায় পড়লেন হানিফ। এটি অনেক নেতাকর্মীর মধ্যে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
সম্মেলন ও নতুন নেতা নির্বাচন প্রসঙ্গে ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দীপক কুমার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নেত্রী (শেখ হাসিনা) যাকে নিয়ে দল পরিচালনা করবেন আমরাও তাকে চাই।’ আগামী নির্বাচনে জয় ছিনিয়ে আনা ও আন্দোলন মোকাবিলায় এই কমিটি কতটা উপযুক্ত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই উপযুক্ত।’
নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুভাষ বোস দেশ রূপান্তরকে বলেন, নতুন এই কমিটির সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, এরমধ্যে অন্যতম দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রাখাও চ্যালঞ্জ বলেন তিনি।
নতুন কমিটির চার চ্যালেঞ্জ
আওয়ামী লীগের নতুন নির্বাচিত কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে দলের নবনির্বাচিত সভাপতি শেখ হাসিনা নির্দেশনা দিয়েছেন। গতকাল রবিবার নির্বাচিত নেতারা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে গেলে এসব কথা বলেন তিনি।
সেখানে উপস্থিত থাকা একাধিক নেতা আওয়ামী লীগ সভাপতিকে উদ্ধৃত করে দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, দলের মধ্যে যেখানে যে ছোটখাটো ভুলত্রুটি আছে তা মিটিয়ে সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে বলেছেন তিনি।
নতুন কমিটির সামনে যে চারটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে জানিয়েছেন শেখ হাসিনা তার মধ্যে প্রধান চ্যালেঞ্জটি হলো আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন।
দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ বিএনপির ধ্বংসাত্মক রাজনীতি, মিথ্যাচার-গুজব মোকাবিলা করা। তৃতীয় চ্যালেঞ্জ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরূপ প্রভাব নিরসনে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলো মানুষের কাছে তুলে ধরা। শেষ চ্যালেঞ্জ দলের ঐক্য অটুট রাখা।
করোনা মহামারী প্রসঙ্গ তুলে শেখ হাসিনা নবনির্বাচিত নেতৃত্বকে বলেছেন, এ বিষয়ে আমাদের সবাইকে সাবধান থাকতে হবে। কারণ করোনা আবার চোখ রাঙাচ্ছে। এ ছাড়া অপপ্রচারের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেছেন, পাড়া-মহল্লা পর্যন্ত সংগঠনের কার্যক্রম বিস্তার করতে হবে। যেসব জেলায় সংগঠনের দুর্বল অবস্থা সেখানে সবল করতে কেন্দ্রীয় নেতাদের উদ্যোগ নিতে হবে। নির্বাচন পর্যন্ত সবাইকে ঘরে নয়, মাঠে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের পাশে থাকতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, গত শনিবারে সম্মেলনে সারা দেশ থেকে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি জানিয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগের অবস্থান ভালো। এখন শুধু তাদের উজ্জীবিত রাখাই কেন্দ্রীয় নেতাদের একমাত্র কাজ।
জানতে চাইলে ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমরা নির্বাচিতরা নেত্রীর সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে গিয়েছি। এসময় তিনি ৪টি চ্যালেঞ্জ নতুন কমিটিকে মোকাবিলা করতে হবে জানিয়ে প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন।
বাম ঘরানার প্রভাব কমেছে
দেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগে বাম আদর্শের অনুসারী নেতারাও যোগ দিয়েছেন। আওয়ামী লীগে তাদের একরকম আধিপত্যও ছিল। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, সাংগঠনিক সম্পাদক, প্রচার সম্পাদক, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, দপ্তর সম্পাদকসহ সম্পাদকম-লীর একাধিক পদে ছিলেন বাম ঘরানা থেকে আসা নেতারা। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর ধীরে ধীরে বাম আদর্শের নেতাদের সংখ্যা কমতে শুরু করে।
সর্বশেষ গত শনিবার দলের ২২তম জাতীয় সম্মেলনে বিভিন্ন পদে নির্বাচিত ৪৮ নেতার মধ্যে বামপন্থা ছেড়ে আসা দুজন নেতা আছেন। তারা দুজনই সভাপতিম-লীতে আছেন। এ দুজন হলেন মতিয়া চৌধুরী ও শাজাহান খান। বাদ পড়েছেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদ ও আবদুল মান্নান খান। তাদের দুজনকেই দলের উপদেষ্টা পরিষদে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
যদিও বাম আদর্শের বিভিন্ন দল নিয়ে ২০০৪ সালে ২৩ দফার ভিত্তিতে ১৪ দলীয় জোট গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। তৎকালীন ক্ষমতায় থাকা বিএনপির বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন শুরু করে আদর্শিক জোট ১৪ দল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন সময় সরকারেও ছিলেন বাম শরিকের নেতারা। বাদ পড়েন বর্তমান সরকারের সময়।
প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করায় প্রায় ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে আরটি-পিসিআর সংবলিত মডার্ন মাইক্রোবায়োলজি ল্যাবটি কোনো কাজে আসছে না। বর্তমানে এটি হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের রেস্ট হাউজে পরিণত হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, গত কয়েক মাস ধরে মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ সুনির্মল রায় ভবনটিকে বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করছেন।
করোনা মহামারীর সময়ে করোনা রোগী শনাক্ত করার জন্য সরকার হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজে পিসিআরসহ মাইক্রো বায়োলজি ল্যাব তৈরির জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। কিন্তু ৫ বছরেও শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের নিজস্ব ক্যাম্পাস না হওয়ায় শুরু থেকেই হবিগঞ্জ ২৫০ শয্যা হাসপাতালের নতুন ভবনের ২টি ফ্লোর অস্থায়ী ক্যাম্পাস ও অফিস হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। ফলে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালের আইসোলেশন বিভাগটিতে ল্যাব স্থাপন করার জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কক্ষটি দিতে প্রথমে গড়িমসি শুরু করেন। এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে দ্রুত সময়ে আইসোলেশন বিভাগ থেকে পুরনো মালামাল সরিয়ে নেওয়া হয়।
হবিগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগ ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে আইসোলেশন বিভাগে ৭টি এসি, নতুন টাইলস, সিলিং, পানি, বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে মডার্ন মাইক্রো বায়োলজি ল্যাব স্থাপনে উপযোগী করে দেয়। কাজ শেষ হওয়ার পর ল্যাবটি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক নাকি মেডিকেল কলেজ অধ্যক্ষ গ্রহণ করবেন এ নিয়ে শুরু হয় ঠেলাঠেলি। নানা অজুহাত দেখিয়ে কেউ এর দায়িত্ব নিতে রাজি না হওয়ায় এভাবে প্রায় ৬ মাস পার হয়ে যায়।
অবশেষে গত ১১ এপ্রিল গণপূর্ত বিভাগ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসার ডা. সুনির্মল রায়ের কাছে ল্যাবটি হস্তান্তর করে। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ল্যাবের একটি এসি রুমে চেয়ার, টেবিল, পালং, পর্দা, টেলিফোনসহ অন্যান্য সরঞ্জাম দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়েছে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওই কক্ষে অবস্থানরত অধ্যক্ষ সুনির্মলকে সেখানে থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি উত্তর না দিয়ে দ্রুত বাথরুমে চলে যান। এ সময় তার সঙ্গে কলেজ থেকে আসা পিয়ন স্বাধীন সরকার ভবনের মূল গেটে তালা লাগিয়ে এ প্রতিনিধিকে নিয়ে বের হয়ে যান। স্বাধীন জানান, ‘স্যারের বাসা না থাকায় এখানে থাকেন।’
ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় প্রতিনিধি আব্দুল আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, করোনা মহামারীর বিষয়টি চিন্তা করে ল্যাব উপযোগী করতে দিন-রাত কাজ করিয়েছি। দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য গণপূর্ত বিভাগ দৌড়ের ওপর রেখেছিল। দুঃখের বিষয় এখন তা রেস্টহাউজ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এখনো কাজের বিল না পাওযায় প্রতিদিন অফিসে ধরনা দিচ্ছি।
এদিকে মেডিকেল কলেজের মাইক্রো বায়োলজি বিভাগের প্রধান ডা. কান্ত্রিপ্রিয় দাশের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘মেশিনপত্র কবে আসবে তা তারা জানেন না। ভবনটি খালি পড়ে থাকায় সেখানে অধ্যক্ষ সুনির্মল রায় আপাতত বসবাস করছেন। মেশিনপত্র এলে তিনি সরে যাবেন।’
দেশে বছরজুড়ে করোনা নিয়ন্ত্রণেই ছিল। বছরের শেষের দিকে সংক্রমণ সর্বনিম্নে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ভারত ও চীনে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট রোগটি নিয়ে দেশে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন ভ্যারিয়েন্ট ঠেকাতে আবার নতুন সতর্কতা দিয়েছে।
চলতি বছর ডেঙ্গুর সর্বোচ্চ প্রাদুর্ভাব দেখেছে মানুষ। ডেঙ্গুতে ২২ বছরের ইতিহাসে এ বছরই সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ মারা গেছে। নতুন রোগ মাঙ্কিপক্স নিয়ে বেশ আতঙ্কে ছিল মানুষ। ডেঙ্গুও ভুগিয়েছে বেশ। সে হিসেবে এ বছর রোগ-শোক নিয়েই দিন কেটেছে মানুষের। স্বাস্থ্য বিভাগও ব্যস্ত ছিল এসব রোগ প্রতিরোধে, চিকিৎসাসেবায়।
অবশ্য স্বাস্থ্য খাতে বছরের বড় সাফল্য ছিল করোনার টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে। গত বছরের শেষের দিকে শুরু হওয়া করোনা টিকার বুস্টার বা তৃতীয় ডোজ কর্মসূচি এ বছর আরও গতি পায়। নতুন করে শুরু হয় ১২-১৭ বছর ও ৫-১১ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ টিকাদান কর্মসূচি।
চলতি বছর স্বাস্থ্য খাতে নতুন কোনো পরিবর্তন আসেনি বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্য পরামর্শক কমিটির সদস্য ও জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. আবু জামিল ফয়সাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে একটা জিনিস পরিলক্ষিত হয়েছে যে আমরা সব সময় রি-অ্যাকটিভ, কোনো সময় প্রো-অ্যাকটিভ হতে পারলাম না; অর্থাৎ আমরা বুঝতে পারি সমস্যা আসছে, কিন্তু সমাধানে আগেভাগেই কোনো কাজ করতে পারি না। যখন সমস্যা আসে, তখন খুব প্রো-অ্যাকটিভ হই, হুড়োহুড়ি শুরু করি। ফলে শুরুর দিকে বেশ দুর্ভোগে পড়তে হয় মানুষকে, অনেক ক্ষতি হয়ে যায়।’
এই জনস্বাস্থ্যবিদ চলতি বছর স্বাস্থ্য খাতে দুটি সাফল্যের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা কভিডকে ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছি। আমাদের মৃত্যুর সংখ্যা ও গুরুতর অসুস্থতা কম হয়েছে। দ্বিতীয় সাফল্য টিকা। কভিড টিকার সাফল্য অনেক বেশি। তবে এই সফলতার মধ্যেও অনেক ব্যর্থতা আছে। তৃতীয় ডোজ ঠিকমতো দিতে পারছি না। এখন চতুর্থ ডোজের লোকই পাওয়া যাচ্ছে না।’
বছর শেষে করোনায় নতুন উদ্বেগ : ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়। এরপর এর প্রকোপ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ২০২২ সালের শুরুর দিক থেকে কমে আসে সংক্রমণ। তবে দফায় দফায় সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ভীতির সৃষ্টি করে জনমনে। এ বছর জুন-জুলাইয়ে করোনার প্রাদুর্ভাব বাড়লে চতুর্থ ঢেউয়ের আশঙ্কা করেন বিশেষজ্ঞরা। প্রতিবেশী দেশ ভারত, চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধিতে সে শঙ্কা আরও প্রবল হয়। বছরের শেষ দিকে এসে করোনা সংক্রমণের ধারা নিম্নমুখী হয়। কিন্তু এ মাসের শুরু থেকেই করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট নতুন করে উদ্বেগে ফেলেছে বাংলাদেশকে। ভারতে নতুন ভ্যারিয়েন্ট দেখা দেওয়ায় এবং চীনে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় স্বাস্থ্য বিভাগ নতুন করে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে।
এ ব্যাপারে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা এবং সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে সংক্রমণ সর্বনিম্ন। টিকা নেওয়ার হার ভালো। অনেকে সংক্রমিত হয়ে গেছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, সারা বিশে^ ৯০ শতাংশ লোক হয় টিকা অথবা সংক্রমিত হয়ে করোনা প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করেছে। আমাদের দেশে সেই হার ৯৫ শতাংশ। সারা বিশে^র মধ্যে শুধু আফ্রিকার কয়েকটি দেশে টিকার অবস্থা ভালো নয়। বাংলাদেশে টিকার হার ভালো। কিন্তু নতুন ভ্যারিয়েন্ট যদি ছড়াতে থাকে, তাহলে সেটা আরও বেশি মিউটেশন বা পরিবর্তিত হয়ে আরও খারাপ হতে পারে। কাজেই সতর্ক থাকতে হবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সাত দিন পর গতকাল করোনায় একজনের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত করোনায় দেশে মোট মারা গেল ২৯ হাজার ৪৩৯ জন। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত রোগী আরও কমে ছয়জনে ও শনাক্তের হার শূন্য দশমিক ৪৪ শতাংশে নেমে এসেছে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত মোট শনাক্ত হলো ২০ লাখ ৩৭ হাজার ২৪ জন।
সাফল্য করোনা টিকায় : চলতি বছর করোনা টিকা সংগ্রহ ও দেওয়ার ক্ষেত্রে সাফল্য দেখিয়েছে স্বাস্থ্য খাত। বিশে^ যে পাঁচটি দেশ প্রথম টিকার ব্যাপারে পরিকল্পনা করেছিল তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। টিকাদানের হারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম এবং বিশে^র মধ্যে পঞ্চম অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে।
টিকার সংকট কেটে যাওয়ায় গণটিকা ও বুস্টার ডোজ দেওয়ার নানা উদ্যোগ নেয় সরকার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গতকাল রবিবার পর্যন্ত মোট জনসংখ্যার ৮৭ শতাংশ টিকার প্রথম ডোজ, ৭৪ শতাংশ দ্বিতীয় ডোজ ও ৪৮ শতাংশ তৃতীয় ডোজ নিয়েছে। ২০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া টিকার চতুর্থ ডোজ নিয়েছে ৬৬ হাজার ২৩৯ জন।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ‘গত বছরের মতো এ বছরও আমাদের সবচেয়ে বড় সফলতা টিকা কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা কভিড নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছি। কয়েক দফায় বিশেষ কর্মসূচি নেওয়ায় দ্বিতীয় ডোজের হার বেড়েছে। এখন তৃতীয় ও চতুর্থ ডোজ চলছে। করোনা কমে যাওয়ায় মানুষের টিকা নেওয়ার আগ্রহ কিছুটা কমেছে। কিন্তু করোনা থেকে সুরক্ষিত থাকতে হলে টিকা নিতে হবে।’
মাঙ্কিপক্স নিয়ে আতঙ্ক : করোনার মধ্যেই নতুন রোগ মাঙ্কিপক্স আতঙ্ক দেখা দেয় দেশে। এ বছর আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশে^র প্রায় ১২টি দেশে এ রোগের সংক্রমণ ঘটে। গত আগস্টে ভারতেও মাঙ্কিপক্স আক্রান্ত রোগী শনাক্তের খবর পাওয়া যায়। এ নিয়ে বাংলাদেশেও ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয়। সংক্রমণ এড়াতে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেশের স্থল, বিমান ও নৌপথে সতর্কতা জারি করে। এর মধ্যে ঢাকায় চর্মরোগে আক্রান্ত একজন তুরস্কের নাগরিকের দেহে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়েছে এমন খবরে হইচই পড়ে যায়। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ওই ব্যক্তি মাঙ্কিপক্স আক্রান্ত রোগী নয় বলে জানায়। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব ঘটেনি।
ডেঙ্গুর সর্বোচ্চ প্রাদুর্ভাব : দেশে ডেঙ্গুর ২২ বছরের ইতিহাসে এবারই সর্বোচ্চ ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল বাদে বছরের প্রায় পুরোটা সময়ই দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ ছিল। জুন থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ হয়ে ওঠে। সেপ্টেম্বরে ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকা ছাড়াও কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়ে। এ সময় দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর শয্যা সংকট দেখা দেয়। আগের বছরগুলোতে সেপ্টেম্বরের শেষে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে এলেও এ বছর সেপ্টেম্বরের পর সংক্রমণ ছিল ঊর্ধ্বমুখী।
অতীতের যেকোনো বছরের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যু দেখেছে বাংলাদেশ। চলতি বছর এ পর্যন্ত মারা গেছে ২৭৬ জন, যা দেশের ইতিহাসে এক বছরে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে ১৭৯ জনের মৃত্যু হয়। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল রবিবার পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৬২ হাজার ২১ জন। এর মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৩৯ হাজার ৫৬ এবং ঢাকার বাইরের ২২ হাজার ৯৬৫ জন।
ছিল অন্যান্য রোগের প্রকোপ : ব্যাকটেরিয়াজনিত ডায়রিয়ার প্রকোপও শঙ্কা ছড়িয়েছিল বছরের মার্চ ও এপ্রিলের দিকে। গরমের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মাঝে এই পানিবাহিত ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়তে থাকে। এ অবস্থা চলমান থাকে অক্টোবর পর্যন্ত। এতে রাজধানীর মহাখালী কলেরা হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীদের চাপ বাড়ে।
এ বছর দেশে অসংক্রামক রোগের প্রবণতাও বেড়েছে। হৃদরোগ, ক্যানসারসহ অনেক রোগের ব্যাপারে বছরজুড়ে সভা-সেমিনারে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
স্বপ্নের মেট্রোরেল এখন বাস্তবে রূপ নেবে। ২৮ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে দেশের প্রথম মেট্রোরেল। উদ্বোধনের দিন প্রথম টিকিট কেটে যাত্রী হবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর সাধারণ যাত্রীরা ২৯ ডিসেম্বর থেকে চড়তে পারবেন মেট্রোরেলে। মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া হবে ২০ টাকা। এ ছাড়া কার্ডেও কাটা যাবে মেট্রোরেলের টিকিট। গতকাল রবিবার ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ এন ছিদ্দিক এসব তথ্য জানান।
এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, ‘২৮ ডিসেম্বর মেট্রোরেলের প্রথম টিকিট কাটবেন প্রধানমন্ত্রী। তবে প্রধামন্ত্রীর সঙ্গে মন্ত্রী, সচিব, জাইকা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্টরা ভ্রমণ করবেন। প্রধানমন্ত্রী নিজে টিকিট কেটে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলে চড়বেন। এখন পর্যন্ত এমন সিদ্ধান্তই হয়েছে।’
মেট্রোরেল সংশ্লিষ্টরা জানান, সাপ্তাহিক, মাসিক বা পারিবারিক কার্ডে আগে থেকে টিকিট কিনতে হবে। মেট্রোরেলের প্রতিটি স্টেশনে থাকা যন্ত্রে কার্ডে টাকা ভরা (রিচার্জ) যাবে। পরবর্তী সময়ে মুঠোফোনে রিচার্জের মতো করে যেকোনো জায়গা থেকে কার্ড রিচার্জের ব্যবস্থা চালু করা হবে।
প্ল্যাটফর্মে ঢোকার সময় যাত্রীদের কার্ড পাঞ্চ করতে হবে, তা না হলে দরজা খুলবে না। এরপর নেমে যাওয়ার সময় আবার কার্ড পাঞ্চ করতে হবে, তা না হলে যাত্রী বের হতে পারবেন না। আরেকটি কার্ড সাময়িক, যা প্রতি যাত্রায় দেওয়া হবে। এটাকে সিঙ্গেল জার্নি টিকিটও বলা হয়। স্টেশন থেকে নির্দিষ্ট গন্তব্যের ভাড়া দিয়ে এ কার্ড সংগ্রহ করতে হবে। এটিও স্মার্ট কার্ডের মতো। ভাড়ার অতিরিক্ত যাতায়াত করলে ওই কার্ড দিয়ে দরজা খুলতে পারবেন না। সে ক্ষেত্রে দায়িত্বে থাকা কর্মীদের কাছে বাড়তি ভাড়া পরিশোধ করেই বের হতে হবে।
এদিকে মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া হবে ২০ টাকা। এখন দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত দূরত্ব অতিক্রম করতে ভাড়া দিতে হবে ৬০ টাকা। উত্তরা নর্থ স্টেশন থেকে উত্তরা সেন্টার ও উত্তরা সাউথ স্টেশনের ভাড়া একই ২০ টাকা। এ ছাড়া প্রথম স্টেশন (উত্তরা নর্থ) থেকে পল্লবী ও মিরপুর-১১ স্টেশনের ভাড়া ৩০ টাকা, মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনের ভাড়া ৪০ টাকা এবং শেওড়াপাড়া স্টেশনের ভাড়া ৫০ টাকা।
আবার পল্লবী থেকে মিরপুর-১১ বা কাজীপাড়া যেকোনো স্টেশনে নামলেই ২০ টাকা ভাড়া দিতে হবে। তবে পল্লবী থেকে শেওড়াপাড়া বা আগারগাঁও যেকোনো স্টেশনে নামলে ভাড়া দিতে হবে ৩০ টাকা। তবে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের মেট্রোরেলে চলাচলে কোনো ভাড়া দিতে হবে না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ সাইফুন নেওয়াজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাজধানীর বড় একটা অংশের যাত্রীদের এ মেট্রোরেলে চড়াতে পারলে এর সুফল পাওয়া যাবে। আর মেট্রোরেল যানজটের শহরে নিরাপদ একটি বাহন হবে দেশের মানুষের জন্য।’
বর্তমান সময়ে একটি খবর অনেক শেয়ার হতে দেখেছি ফেসবুকে। সেট হলো বিয়ে বিচ্ছেদের খবর। আধুনিক তরুণ-তরুণীরা একসঙ্গে বেশি দিন থাকতে চান না। এ মানসিকতা কেন গড়ে উঠল? এমনকি প্রেমের বিয়েও টিকছে না। এই জটিল পরিস্থিতি নিয়ে কিছু কথা মনে পড়ল। যেমন-
‘আমাদের সোসাইটির সমস্যাটাই এখানে। আমরা সব সময় সম্পর্কের পরিণতি নিয়ে চিন্তা করি। আরে বাবা প্রেমটা তো প্রেমই। প্রেমের আবার পরিণতি থাকতে হবে কেন? সম্পর্কের আগে অবশ্যই মানুষ চিন্তা ভাবনা করে সম্পর্কে জড়াবে না। কারণ এটা মানুষের সঙ্গে থাকতে থাকতে হয়ে যায়। কারো সাথে জোর করে তো সম্পর্ক হয় না।’
কথাগুলো বলেছে কুঞ্জ। সুশ্রী, ইন্টেরিয়র ডিজাইনার কুঞ্জ অবশ্য বাস্তব কোনো চরিত্র নয়। একটি উপন্যাসের চরিত্র। উপন্যাসটির নাম ‘প্রেম যমুনার মাতাল হাওয়া’। এর লেখক মাহবুব নাহিদ।
কুঞ্জ বাস্তবে বিচরণ না করলেও আধুনিক সময়ের নাগরিকদের মনের এক জটিল জিজ্ঞাসাকে সামনে নিয়ে এসেছে। এই যে ‘প্রেমের আবার পরিণতি থাকতে হবে কেন?’ কিংবা বিয়ের পরও প্রেম থাকে কি না-এ সংকট অনেকের বেঁচে থাকাকে বিপন্ন করে তুলতে পারে।
উপন্যাসেও কুঞ্জকে আমরা পাই বিপন্ন অবস্থায়। সৌহার্দ্যের সঙ্গে তার প্রেমের পর বিয়ে হলেও ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।
আমাদের সমাজে বিয়ের পর সেপারেশনে থাকা একজন নারীকে কী যন্ত্রণা পোহাতে হয় তার উদাহরণ এই কুঞ্জ। ঘরের মা থেকে শুরু করে সমাজের নানা অংশের মানুষ তাদের জীবন বিষিয়ে তোলে।
‘বিষ’ দিয়ে শুরু হয় মাহবুব নাহিদের উপন্যাস ‘প্রেম যমুনার মাতাল হাওয়া’। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত একটি পরিবারের হাসি, কষ্ট, রাগ, অভিমান নিয়ে শুরু হওয়া উপন্যাসটি এগিয়ে যেতে থাকে কুঞ্জকে কেন্দ্র করে। ইন্টেরিয়র ডিজাইনার কুঞ্জ সৌহার্দ্যের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর এক বান্ধবীর বাবার রিসোর্টে কাজের অফার পায়। তবে পরিবারের নির্দেশে একা শ্রীমঙ্গলে যাওয়া হয় না তার। বোন বৃন্তকে সঙ্গে নিতে হয়। এই বৃন্ত খুব মজার এক চরিত্র উপন্যাসে। নিজের দুষ্টু বুদ্ধি দিয়ে পরিবারের সব মুশকিল আসান করে সে।
শ্রীমঙ্গলে কুঞ্জর সঙ্গে দেখা হয় দিহানের। দিহানও মজার একটি চরিত্র। ক্ষণে ক্ষণে পাঠককে হাসাতে পারার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তার। দিহানের আচরণে কুঞ্জ মাঝে মাঝে রেগে যায় আবার হেসেও দেয়।
তাদের দুজনের সম্পর্ক কিছুটা উষ্ণ হওয়ার সময়ে রিসোর্টে এসে হাজির সৌহার্দ্য। উপন্যাসের শুরু থেকে যে কষ্ট কুঞ্জর মনকে আবদ্ধ করে রাখছিল, পাঠকের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয় এখানে এসে।
এরপর এক বৃষ্টির দিনে কুঞ্জ আর সৌহার্দ্য দেখা থেকে শুরু করে প্রেমের ঘটনা জানা যায়। আধুনিক মনস্ক দুটি ব্যক্তি কত যে টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে যায়! তারপর তাদের যখন সংসার হয়, যতই প্রেম থাকুক, দুজন মানুষ যখন সারাক্ষণ একসঙ্গে থাকতে শুরু করে-তখন তাদের একে অপরের অন্য রূপ দেখতে পায়। যেমন সৌহার্দ্য বলে, ‘আমরা পুরুষ মানুষ ভারী অদ্ভুত এ বুঝলে। তুমি হয়তো জান না। প্রায় প্রত্যেক পুরুষের মাঝেই এক ধরনের অচেনা সত্তা বাস করে। ভয়ংকর সত্তা। অবচেতন মনে এরা ভয়ংকর কল্পনায় মেতে ওঠে। অথচ নিজেও সেটা কোনো দিন টের পায় না। তুমি সেই রূপ দেখেছ তাই তোমার কাছে আমার অপ্রকাশ্য আর কিছুই নেই। তুমি যদি শাস্তিস্বরূপ আমাকে আজীবন দূরে সরিয়ে রাখতে চাও, রাখতে পারো। কিন্তু বিশ্বাস করো কুঞ্জ, আমরা দুজন দুজনকে অসম্ভব ভালোবাসি। আমরা একে অপরকে ছাড়া থাকতে পারব না। অযথা এই শাস্তি নিজেকে দিও না।’
কুঞ্জও যেমন ভাবে, ‘প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে গেলো কুঞ্জ। পুরুষ মানুষ এমনও হয়! এ আবেগের নাম কি দেবে সে? তার নিজের একজন ইস্পাতের মতো কঠিন পুরুষ মানুষ আছে। সেই মানুষের সম্পূর্ণ বিপরীত এই পুরুষ মানুষটি। তার মানুষটা উদাসীন, প্রিয়তমা ও সংসারের বাইরে ভিন্ন একজন মানুষ। আর দিহান, প্রচণ্ড সংসারীমনা, প্রিয়তমাকে ভালোবেসে সর্বক্ষণ নিজের উজাড় করে দিতে প্রস্তুত ধরনের একজন। জগতে কত অদ্ভুত প্রজাতির মানুষ বাস করে তা বোঝা মুশকিল।’
শেষ পর্যন্ত কুঞ্জ ভাবে, ‘ভালোবাসা এমন একটা অসহ্য বিষয়, না একেবারে ছেড়ে থাকা যায়, না পুরোপুরি নিয়ে থাকা যায়!’
একটি সরল উপন্যাসে জীবনের জটিল দিকটি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন মাহবুব নাহিদ। তার উপন্যাসে এমন একটি মেসেজ আছে যা বিয়ে বিচ্ছেদ, সম্পর্কের টানাপোড়েনের জটিলতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। কী সেই মেসেজ তা অবশ্য পাঠককে পড়েই জানতে হবে।
বইটি প্রকাশ করেছে দাঁড়িকমা, প্রচ্ছদ করেছেন সাদিতউজ্জামান। ৮০ পৃষ্ঠার বইটির দাম ২৫০ টাকা।
রাজধানীর বনানীর একটি ক্লাবে গোপন বৈঠক চলাকাল বিএনপির ৫৪ নেতাকর্মীকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
রোববার (১৯ মার্চ) রাতে তাদের আটক করা হয়। সোমবার (২০ মার্চ) সকালে এই তথ্য জানিয়েছেন বনানী থানার ডিউটি অফিসার এসআই সিদ্দিক।
তিনি জানান, রোববার রাতে বনানী ক্লাবে গোপন বৈঠকে রাষ্ট্রবিরোধী পরিকল্পনা করছিলেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। খবর পেয়ে রাত একটার দিকে সেখানে অভিযান চালায় গোয়েন্দা পুলিশ। পরে ৫৪ জনকে আটক করা হয়।
পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, রাষ্ট্রবিরোধী পরিকল্পনার জন্য দেশের বিভিন্ন জেলার বিএনপির নেতৃবৃন্দ বনানী ক্লাবে গোপন বৈঠক করছে বলে খবর আসে পুলিশের কাছে। পরে ক্লাবটিতে অভিযান চালানো হয়।
আটকদের বিরুদ্ধে বনানী থানায় রাষ্ট্রবিরোধী পরিকল্পনার মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানান তিনি।
আওয়ামী লীগ সরকার বেসরকারি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে উল্লেখ্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাই প্রতিটি সেক্টরকে উদ্যোক্তাদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। কারণ সরকারের একার পক্ষে দেশের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়।
সোমবার (২০ মার্চ) সরকারি বাসভবন গণভবনে রপ্তানি সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির ১১তম সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।
২০২৬ সালের পর স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার কথা বিবেচনা করে নতুন দীর্ঘমেয়াদি রপ্তানি নীতি প্রণয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ২০২৬ সালের পর যখন আমরা এলডিসি থেকে একটি উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হব, আমরা কিছু সুযোগ পাব... আমাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে এবং দেশের আরও উন্নয়ন করতে আমাদের সেই সুযোগগুলোকে কাজে লাগাতে হবে।
তিনি উল্লেখ করেন যে একটি উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পর লক্ষ্য হবে উন্নত দেশে পরিণত হওয়া।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে উদ্ভূত বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য বাড়ানোর সুযোগ কাজে লাগাতেও সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে থাকায় বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্যের নতুন বাজার সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে।তিনি আরও বলেন, ইতিমধ্যে অনেক দেশ বাংলাদেশ থেকে খাদ্য সামগ্রী আমদানিতে আগ্রহ দেখিয়েছে।
সরকার প্রধান বলেন, স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে আমরা খাদ্য সামগ্রী রপ্তানি করতে পারতাম। আমরা এর জন্য উদ্যোগ নিতে পারি।তিনি বলেন, দেশে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প স্থাপন এবং সেসব পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বিপুল সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার রপ্তানি খাতকে গুরুত্ব দিয়েছে। তিনি বলেন, ভারত গ্রহণের পর, আমরা এক বছরের ভিত্তিতে নীতির পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদি রপ্তানি নীতি প্রণয়নের পদক্ষেপ নিয়েছি। অর্জনগুলো ধরে রাখতে হলে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের কোনো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, সরকার ২০২৪ (২০২১-২০০৪) পর্যন্ত রপ্তানি নীতি প্রণয়ন করেছে।...কিন্তু এর পর আমরা কী করব? এরই মধ্যে, আমরা একটি উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হচ্ছি। আমি মনে করি আগামী দিনে আমরা কী করব বা আমরা কীভাবে এগিয়ে যাব তা বিবেচনা করার এটাই সঠিক সময়।
তিনি বিশ্বব্যাপী বর্তমান অর্থনৈতিক অস্থিরতার কথা মাথায় রেখে অর্থনীতির জন্য পরবর্তী পদক্ষেপগুলো নির্ধারণের ওপর জোর দেন।
তিনি বলেন, আমাদের সারা বিশ্বে নতুন বাজার খুঁজতে হবে। আমাদের পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে, আমাদের রপ্তানি ঝুড়িতে নতুন আইটেম অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, রপ্তানি খাতের উন্নয়নের জন্য একটি কৌশল গ্রহণ করতে হবে এবং পণ্য চিহ্নিত করতে হবে। এজন্য আমরা একটি সম্ভাব্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি-২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে একটি উন্নত দেশে পরিণত করতে।
প্রধানমন্ত্রী আইসিটি এবং ডিজিটাল ডিভাইস, আরএমজি, ফার্মাসিউটিক্যালস, হালকা ও মাঝারি ওজনের শিল্প, মোটরযান এবং ইলেকট্রনিক মোটর গাড়ির কথা উল্লেখ করে পণ্য বৈচিত্র্যের কথা বলেন।
তিনি বলেন, সরকার দেশ-বিদেশের বিনিয়োগ নিয়ে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করছে। বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে বলেও জানান তিনি।
দেবর-ভাবির দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টির (জাপা) ভেতর বিভক্তি আবারও প্রকট হয়ে উঠছে। আজ সোমবার পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জন্মদিন পালনের মধ্য দিয়ে সেই বিভাজন ও দ্বন্দ্ব দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এরশাদের স্ত্রী, পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ এবং এরশাদের ভাই ও পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের আলাদা কর্মসূচি নিয়েছেন। নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে জন্মদিন পালন করছেন দুপক্ষের নেতাকর্মীরা। কেউ কাউকে আমন্ত্রণ জানাননি। এমনকি যৌথভাবে পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের জন্মদিন পালনে কোনো উদ্যোগও নেয়নি কোনোপক্ষ।
জাপায় অভ্যন্তরীণ বিভাজন এতটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, দুপক্ষের শীর্ষনেতারা পরস্পরকে দলের ‘কেউ না’ বলেও মন্তব্য করেছেন। জিএম কাদেরপন্থিরা বলছেন, তাদের অংশই পার্টির মূল। রওশন এরশাদের সঙ্গে যারা আছেন, তারা পার্টির কেউ না। আবার রওশনপন্থিদের অভিমত, পার্টির মূলধারার নেতাকর্মীরা তাদের সঙ্গে আছেন। সুতরাং তারাই জাপার মূল অংশ। এই পক্ষ জিএম কাদেরপন্থিদের ‘প্রতারক’ বলেও মন্তব্য করেছেন ও কাদেরপন্থিরা তাদের ‘কেউ না’ বলে জানিয়েছেন।
৯৪তম জন্মদিন আজ : আজ পালিত হচ্ছে এরশাদের ৯৪তম জন্মদিন। ১৯৩০ সালের ২০ মার্চ কুড়িগ্রাম শহরের ‘লাল দালান’ বাড়িখ্যাত নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সাবেক এ রাষ্ট্রপতি ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পান ১৯৫২ সালে। ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণ করেন এরশাদ। ১৯৮৬ সালে তার প্রতিষ্ঠিত দল জাপার প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি দেশে উপজেলা পদ্ধতি চালু করেন। বিরোধী দলের লাগাতার আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা থেকে বিদায় নেন। এরপর গ্রেপ্তার হয়ে ছয় বছর কারারুদ্ধ ছিলেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক কীর্তি গড়েছেন এরশাদ। ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি পান। কারাগারে থাকাকালীন ১৯৯১ ও ’৯৬ সালের নির্বাচনে পাঁচটি করে আসনে জয়ী হন। এরশাদের হাতে গড়া জাপা এখন সংসদে প্রধান বিরোধী দল। দশম জাতীয় সংসদেও প্রধান বিরোধী দল ছিল জাপা। ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন এরশাদ।
পরস্পরকে অস্বীকার দুপক্ষের : পৃথকভাবে জন্মদিন পালনের ব্যাপারে জিএম কাদেরপন্থি জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু গতকাল রবিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পার্টির পক্ষ থেকে আমরা জন্মদিন পালন করছি। এর অংশ হিসেবে আগামীকাল (আজ সোমবার) জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে স্যারের (এরশাদ) প্রতিকৃতিতে মাল্যদান ও বিকেল ৩টায় বনানী কার্যালয়ে কেক কাটব। আর স্যারের জন্মদিন উপলক্ষে ২২ মার্চ আলোচনা সভা হবে। সেখানে কাদের সিদ্দিকীসহ আরও কয়েকজন অতিথি অংশ নেবেন।’
এরশাদের জন্মদিন উপলক্ষে রওশনপন্থিদের কর্মসূচির ব্যাপারে জাপা মহাসচিব বলেন, ‘ম্যাডামের পক্ষ থেকে তার বাসভবনে পারিবারিকভাবে মিলাদের আয়োজন করেছে। তারা একসঙ্গে জন্মদিন পালনের কোনো আলাপ-আলোচনা জাপার কারও সঙ্গে, বিশেষ করে আমার সঙ্গে করেনি।’
পৃথক এ জন্মদিন পালনের মধ্য দিয়ে দলের মধ্যকার দ্বন্দ্বের ব্যাপারে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘পার্টির বাইরে কেউ কিছু বললে আমাদের বলার কিছু নেই। তারা পার্টির কেউ কিছু না।’
কিন্তু রওশনপন্থি জাপার নেতা ও এরশাদ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান কাজী মামুনুর রশীদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যেহেতু স্যার জীবিত নেই, ম্যাডাম জীবিত আছেন, তাই তার বাসায় একটা কোরআন তেলাওয়াত দোয়ার আয়োজন করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় পার্টির সঙ্গে আছি। জিএম কাদের আমাদের কোনোদিন ডাকেন না। সুতরাং আমরা তো স্বাভাবিকভাবে আমাদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের জন্মদিন পালন করব।’
কাদেরপন্থি জাপার ব্যাপারে এ নেতা বলেন, ‘পার্টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান হয়েছিল জানুয়ারিতে। ওই অনুষ্ঠানটা একসঙ্গে করার কথা ছিল। এর জন্য একটা যৌথ বিবৃতিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অনুষ্ঠানে দেখা গেল, একটা প্রতারণা করে জিএম কাদেররা শুধু ম্যাডামকে নিয়ে গেছেন। আমাদের মঞ্চে আনুপাতিক হারে আসন দেবে বা কোথায় বসবে, সেটা আয়োজন করার কথা ছিল। কিন্তু সেগুলোর কিছুই করা হয়নি। তাদের এখন আমরা প্রতারক হিসেবে জানি। ভবিষ্যতে তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক ঐক্য হবে কি না, সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।’
দুপক্ষের পৃথক কর্মসূচি : জন্মদিন উপলক্ষে জিএম কাদেরপন্থি জাপা সকাল ১০টায় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয় কাকরাইল চত্বরে এরশাদের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবে। এ ছাড়া আগামীকাল বুধবার বিকেল ৩টায় কাকরাইলের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের মাল্টিপারপাস হলে আলোচনা সভা রয়েছে। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করবেন জিএম কাদের। জাপা চেয়ারম্যানের প্রেস সেক্রেটারি-০২ খন্দকার দেলোয়ার জালালী এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কর্মসূচির তথ্য জানান।
অন্যদিকে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ্ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানান, আজ বেলা ১১টায় গুলশানের ৬৭ নম্বর সড়কের ৪/১-এ বিরোধীদলীয় নেতার বাসভবনে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে বিশেষ দোয়া ও কেক কাটার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে রওশন এরশাদ প্রধান অতিথি হিসেবে এবং এরশাদপুত্র রাহগীর আল মাহি সাদ এরশাদ এমপিসহ পার্টির শীর্ষ নেতারা উপস্থিত থাকবেন। এ ছাড়া স্বাধানীতা দিবস উপলক্ষে ২৭ মার্চ আলোচনা সভা, দোয়া ও ইফতার আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়েছে : গত বছর নভেম্বরে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী, দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ দলের ভেতর ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন। সে ডাকে সাড়া দিয়ে বেশ কিছু উদ্যোগও নিতে দেখা গেছে এরশাদের ছোটভাই ও দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে। এরই অংশ হিসেবে জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাপার নেতারা রওশন এরশাদের সঙ্গে কয়েক দফা দেখা করেন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে দল পরিচালনায় বেশ কিছু অঙ্গীকারও করেন।
ঐক্যের অংশ হিসেবে ঐক্যবদ্ধভাবে ১ জানুয়ারি জাপার ৩৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন করা হয়। প্রায় চার বছর পর ওই অনুষ্ঠানে একমঞ্চে পাশাপাশি বসেন দেবর-ভাবি কাদের-রওশন। এমনকি টানা ১১ মাস পর সেদিন পার্টির কোনো অনুষ্ঠানে সশরীরেও যোগ দেন রওশন এরশাদ। সর্বশেষ ২০১৮ সালে দলের এক অনুষ্ঠানে একসঙ্গে মঞ্চে ছিলেন এ দুই নেতা।
জাপা নেতরা জানান, জানুয়ারির পর দুপক্ষের মধ্যে আর কোনো ধরনের সমঝোতা বা ঐক্যের আভাস পাওয়া যায়নি। বরং জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে রওশনপন্থি দুই নেতার মামলার কারণে দেবর-ভাবির সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটে। সেই অবনতির সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে দেখা দেয় এরশাদের জন্মদিন।
এ ব্যাপারে রওশনপন্থি নেতারা দেশ রূপান্তরকে জানান, জিএম কাদের গত ৬ মার্চ এরশাদের জন্মদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। সেই কর্মসূচির ব্যাপারে রওশন এরশাদকে কিছুই বলেননি। জিএম কাদের ঐক্যবদ্ধভাবে পালন করতে রাজি না। উনি বিভাজন রেখেই যাচ্ছেন।
দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হচ্ছে জানিয়ে রওশনপন্থি শীর্ষ নেতারা জানান, রওশনপন্থি জাপা ইতিমধ্যেই দেশের ৫২ জেলায় আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেছে। এসব জেলায় যারা পার্টির প্রতিষ্ঠাকালীন ও এরশাদের সময় থেকে পার্টির সঙ্গে আছেন, জিএম কাদের তাদের বাদ দিয়ে নিজের লোকজনদের নিয়ে কমিটি করেছেন। মূলধারার লোকজনদের বাদ দিয়ে রাজনীতি করছেন। এরই অংশ হিসেবে সর্বশেষ ১৫ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আহ্বায়ক কমিটির তথ্য জানানো হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রওশনপন্থি এক নেতা বলেন, রওশন এরশাদ আবারও জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রোজার পর থেকে সম্মেলনের কাজ পুরোদমে শুরু হবে। ২৭ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি সম্মেলন স্থগিত প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে পারেন। সম্মেলন হবে।
জিএম কাদেরের মামলার ব্যাপারে রওশনপন্থি নেতারা বলেন, আমরাও চাই মামলা থেকে জিএম কাদের অব্যাহতি পাক। সে জন্য আমরা নতুন করে আপিল করিনি। আপিল করেও ঝুলিয়ে রেখেছি। উনি যদি সোজা পথে আসেন তাহলে মামলাটা শেষ করব। কিন্তু উনি সেটা চাইছেন না বলে আমরাও সময়ক্ষেপণ করছি। আমরা ওনাকে সুযোগ দিচ্ছি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) হল দখল, উন্নয়নকাজের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ছাত্রী ও সাংবাদিক হেনস্তাসহ নানা বিশৃঙ্খলায় অছাত্র ও বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীদের নাম আসছে বারবার। সেই সব অছাত্র, বহিষ্কৃত ও বহিরাগতদের ক্যাস্পাস ত্যাগের নির্দেশ দিলেও তারা এখনো বহাল।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বোর্ড অব রেসিডেন্স, হেলথ অ্যান্ড ডিসিপ্লিনের সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ১৫ মার্চের মধ্যে ছাত্রত্বহীন ও বহিরাগতদের আবাসিক হল ও ক্যাম্পাস ছাড়তে হবে। অন্যথায় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কিন্তু নির্দিষ্ট সময়সীমার তিন দিন পেরিয়ে গেলেও প্রশাসন কোনো উদ্যোগ নেয়নি; বরং প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে কোনো সদুত্তরও পাওয়া যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে প্রশাসনের সদিচ্ছা এবং নির্দেশনা বাস্তবায়নে উদাসীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
উপাচার্য অধ্যাপক শিরীণ আখতারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে ক্যাম্পাসের পরিবেশ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ রাখতে রাতে অভিযান চলমান আছে বলে জানিয়েছেন সহকারী প্রক্টর মোহাম্মদ রোকন উদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নিয়মিত রাতে অভিযান চালানো শুরু করেছি। ক্যাম্পাসে বহিরাগত লোকজনকে আমরা সতর্ক করে দিচ্ছি। বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রাতে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াতে দেখলেই আমরা তাদের সতর্ক করে দিই, যেন তারা অকারণে ঘোরাঘুরি না করে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়ার পরও যারা হলে আছেন ও যারা বহিষ্কৃত, তাদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাই প্রশাসন তাদের ক্যাম্পাস ত্যাগের নির্দেশনা দিলেও সেটা বাস্তবায়নে উদাসীনতা দেখাচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষার্থী বলেন, ক্যাম্পাসে যারা অছাত্র আছে, তাদের হাত ধরেই অধিকাংশ অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের কাছে অনিরাপদ। আবার যেসব জুনিয়র শিক্ষার্থী বিশৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত, তাদেরও এই অছাত্ররাই নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। এতে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপ, উপগ্রুপের দফায় দফায় সংঘর্ষ, উপাচার্যের কক্ষ ভাঙচুর, শিক্ষক প্রার্থীকে মারধর, হল দখল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ছাত্রী হেনস্তা, সাংবাদিক হেনস্তাসহ ইত্যাদি ঘটনায় সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। অধিকাংশ ঘটনায় জড়িত বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক থেকে শুরু করে বেশির ভাগ ছাত্রলীগ নেতার ছাত্রত্ব নেই। এতে ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এই সংকট কাটাতে অছাত্র ও বহিরাগতদের ক্যাম্পাস ছাড়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলেও আবাসিক হলগুলো ছাড়েনি তারা। অংশ নিচ্ছে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। এমনকি বোর্ড অব রেসিডেন্স, হেলথ অ্যান্ড ডিসিপ্লিনের সদস্য সচিব ও প্রক্টর নুরুল আজিম সিকদার তার দায়িত্ব গ্রহণের সময় ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছে অনেক অছাত্র ও বহিষ্কৃত শিক্ষার্থী।
এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিরাজ উদ দৌল্লাহ বলেন, ‘সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে না পেরে প্রশাসনিক দেউলিয়াত্বের পরিচয় দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করা তাদের ব্যর্থতা।’
প্রশাসনের সিদ্ধান্তকে লোক দেখানো বলে মন্তব্য করেছেন ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন নিজামী।
তবে সমন্বিত উদ্যোগের কথা বলেছেন আরেক সহকারী প্রক্টর সৌরভ সাহা জয়। তিনি বলেন, ‘আমরা পুরো প্রক্টরিয়াল বডি নতুন নিয়োগ পেয়েছি। আমরা এ বিষয়ে অবগত আছি। তবে আমরা কিছুটা সময় নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগে এ বিষয়টির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করব। কারণ, এতে অনেকগুলো বিষয়ের সমন্বয় প্রয়োজন।’
শুরুতেই হোঁচট খেল এক বছরে বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের বর্ষপঞ্জি। প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পিছিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। প্রিলিমিনারির রেশ ধরে পেছাতে হবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সূচিও।
অথচ এই বিসিএস দিয়েই বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ এক বছরে শেষ করার ছক এঁকেছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অবস্থায় বর্ষপঞ্জিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি ৩০ নভেম্বর শুরু না করে ১ জানুয়রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৪৬তম বিসিএস থেকে পরিবর্তিত এক বর্ষপঞ্জিতেই বিসিএস শেষ করার নতুন পরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমরা ৪৬তম বিসিএস থেকে বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করব।’
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই সোহরাব হোসাইন এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার কথা বলেছিলেন। চাকরি জীবনে খ্যাতিমান এই আমলা এগিয়েছিলেনও বহুদূর। তিনি যখন চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন, তখন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩ বিসিএস চলমান ছিল। এর মধ্যে ৪০-এর সুপারিশ হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। ৪১তম বিসিএসের অর্ধেক মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মহামারির সময় চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ৪২তম বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয় এবং অল্প সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। আর ১৫ দিনের মধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ শেষ হবে। ৪৪তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যানের মূল টার্গেট ছিল এক বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএস শেষ করা। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়েছিল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছাপানোর জটিলতায় সূচি অনুযায়ী প্রিলিমিনারি নিতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি সচরাচর বিজিপ্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপাত।
বিসিএস বর্ষপঞ্জি কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিজিপ্রেস থেকে সরে আসে পিএসসি। তারা একটা বিশেষ জায়গা থেকে এ প্রশ্নপত্র ছাপায়। ৪৫তম বিসিএসে ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। ৬ সেট প্রশ্ন ছাপাতে হয়। সেই হিসাবে প্রায় ২১ লাখ প্রশ্নপত্র ছাপানোর প্রক্রিয়া সময়মতোই শুরু করে পিএসসি। দরসহ বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার কাজ আটকে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতৈক্য হলেও শিগগিরই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারছে না। ২৩ বা ২৪ মার্চ রোজা শুরু হবে। রোজায় এ বিশাল পরীক্ষা আয়োজনের কোনো রেওয়াজ নেই। পিএসসিও চায় না নতুন করে এর নজির তৈরি করতে। কাজেই মে মাসের আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মে মাসজুড়ে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হলে প্রিলিমিনরি নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিভাগীয় শহরের অনেক স্কুলে উভয় পরীক্ষার সিট পড়ে। সেই হিসেবে জুন মাসের আগে প্রিলিমিনারি নিতে পারছে না পিএসসি। এতে করে চার মাস পিছিয়ে যাবে ৪৫তম বিসিএসের সব ধরনের পরীক্ষা।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। একটা বিসিএসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এ থেকে পিএসসিকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছেলেমেয়েরা কাজবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণী পরিবারের ভরসাস্থল। তাদের দিকে চেয়ে থাকে পুরো পরিবার। বেকারত্বের বিষয়টি পিএসসিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবে। আগে অল্প দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারলে এখন কেন পারবে না? আগের চেয়ে পিএসসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে জানতে চাইলে কমিশনের একজন সদস্য বলেন, পিএসসি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরের অর্থাৎ ৪৬তম বিসিএস থেকে যেন এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা এখনই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা বিসিএস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সাধারণত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার এক মাস আগে পিএসসির একজন সদস্যকে ওই বিসিএসটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্ব এখনই একজন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। ওই বিসিএস সমন্বয় করবেন কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ।
কমিশনের সদস্য ও পিএসসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির সদস্যরা একমত হয়েছেন ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করে ১ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এতে প্রচলিত ক্যালেন্ডার ইয়ার ঠিক থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বর্ধিত সময়ে যাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে তাদের কী হবে। সেই সমস্যাটিও আলোচনা করে মোটামুটি সেরে রেখেছেন সদস্যরা। ৪৬তম বিসিএসে যারা বয়সের ফেরে পড়বেন তাদের বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। খুব শিগগির ওই বিসিএসের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু হবে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সিলেবাস নিয়ে। সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান থাকলেও সেই কাজ ৪৬ বিসিএসের আগে শেষ হবে না। কাজেই এক বছর আগেই প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজেও কোনো জটিলতা দেখছেন না পিএসসির সদস্যরা।
কিছুদিন ধরে পিএসসি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবর্তন আনা সেই সংস্কারেরই অংশ। পিএসসি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে চায়। মুখস্থ বিদ্যাধারীদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও তারা সিলেবাসে আমূল বদল আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায়ও পরিবর্তন এনেছে। কোনো চাকরি প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় তার জেলার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করা যাবে না। এ ধরনের প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি হয় বলে পিএসসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। পিএসসির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য পর্যন্ত চাকরি প্রার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পরীক্ষার প্রার্থীদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৫ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়। আদেশে বলা হয়েছে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য ‘কোডেড ফরম্যাটে’ থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সব তথ্যের কোডিং ও ডি-কোডিংয়ের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবে। কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন হলে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে ডি-কোডিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওই অফিস আদেশে।
৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আবেদন শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে চিকিৎসায়। সহকারী ও ডেন্টাল সার্জন মিলিয়ে ৫৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চিকিৎসার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ৪৩৭ জন। এরপর পুলিশে ৮০, কাস্টমসে ৫৪, প্রশাসনে ২৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্কোর কার্ডে জ্বলজ্বল করছে, বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী। তবুও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাওয়াশ, তাও টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন, তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এই ফল। লক্ষ্য ছিল ভালো ক্রিকেট খেলা, সে তো সবসময়ই থাকে। তবে বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডকে ঠিক পরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেই ৩-০-তে হারিয়ে দেওয়াটা যে স্বপ্নেরও সীমানা ছাড়িয়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজের একটা থ্রো। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১৪তম ওভারে বল করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের বলেই পেয়েছেন ডাভিড মালানের উইকেট। নতুন আসা ব্যাটসম্যান বেন ডাকেট। বলে ব্যাট লাগিয়েই ছুটলেন ডাকেট, অন্যপ্রান্ত থেকে জস বাটলার এসে স্ট্রাইকিং প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পয়েন্ট থেকে মিরাজের অসাধারণ থ্রো ভেঙে দেয় স্টাম্প। পরপর দুই বলে আউট দুই সেট ব্যাটসম্যান। তাতে রঙ বদলে যায় ম্যাচের। ১ উইকেটে ১০০ রান থেকে ৩ উইকেটে ১০০ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড, দুই প্রান্তে তখন দুই নতুন ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টি-টোয়েন্টির চ্যাম্পিয়নরা। পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে তাই আক্ষেপ করেই জস বাটলার বললেন, ‘পরপর দুই বলে দুই উইকেট হারানোটা খুব বাজে হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ম্যাচটা হারিয়েছে। আমি কেন যে ডাইভ দিলাম না এ নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে।’
২৪০ বলের ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ওই দুটো বলের ঘটনাই। মালান যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই হবে। ঢাকা লিগ ও বিপিএল খেলে যাওয়া মালান জানেন এই উইকেটে রান তোলার কৌশল, যা দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতানো শতরানের ইনিংস খেলে। কালও মনে হচ্ছিল মালানই তীরে তরী ভিড়িয়ে নেবেন, কিন্তু মোস্তাফিজের অল্প একটু বাড়তি লাফিয়ে ওঠা বলে পুল করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললেন এ বাঁহাতি। ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে যেটা তালুবন্দি করতে ভুল করেননি লিটন দাস। পরের বলে বাটলারের পড়িমরি করে ছুটেও রান সম্পূর্ণ করতে না পারা, মিরাজের দারুণ থ্রোর কাছে পরাস্ত হওয়া। এ দুটো বলই আসলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ইংল্যান্ডের। অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ১৫৯ রানের লক্ষ্য ভালোভাবেই উতরে যাবে ইংলিশরা। টস জিতে আগে বোলিং নেন বাটলার। লিটন ও রনি তালুকদারের ৫৫ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আদিল রশিদ, রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ দেন ২২ বলে ২৪ রান করা রনি। অবশ্য তার ইনিংসের ইতি ঘটতে পারত আগেই, রনির ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন রেহান আহমেদ। জীবন পেয়েছেন লিটনও, তার ক্যাচ ছেড়েছেন বেন ডাকেট। ১৪তম ওভারের প্রথম বলে লিটন ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডিপ-মিডউইকেটে, কিন্তু ডাকেট বলটা হাতে জমাতে পারেননি। দুবারই দুর্ভাগা বোলারটির নাম জোফরা আর্চার।
৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হন লিটন, নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান করে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিটা কমে আসে বাংলাদেশের। ১৫ ওভার পর যেখানে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ১৩১, সেখানে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ২ উইকেটে ১৫৮ রানে। শেষ ৩০ বলে ৯ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ তোলে মাত্র ২৭ রান তখন মনে হচ্ছিল বেশ ভালো ব্যাটিং উইকেটে অন্তত ২০-২৫টা রান কম হয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যাটিংয়ের শেষটা আর বোলিংয়ের শুরুটা, দুটো পক্ষে যায়নি বাংলাদেশের। অভিষিক্ত তানভীর ইসলাম ফিল সল্টকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের বলে ডাভিড মালানের বিপক্ষে মাঠের আম্পায়ার এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিলেও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। বাটলারকে নিয়ে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদের ব্যাটে ইংল্যান্ড ছিল জয়ের দিশাতেই কিন্তু পরপর দুই বলে দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ে বিপদে পড়া ইংল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি হারের বৃত্ত থেকে। একে একে মইন আলি (৯), বেন ডাকেট (১১) ও স্যাম কারেনের (৪) উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকা রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭ রান, ক্রিস ওকস প্রথম দুই বলে দুটি চার মারলেও পরের বলগুলোতে আর পাননি বাউন্ডারির দেখা। ইংল্যান্ড থেমে যায় ৬ উইকেটে ১৪২ রানে, ১৬ রানের জয়ে সিরিজ ৩-০-তে জিতে নেয় বাংলাদেশ।
দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের, তবে তার সঙ্গে মিশে আছে ঘরের মাঠে পছন্দসই উইকেট বানিয়ে জেতার সমালোচনাও। এবারের সিরিজ জয়ে সেই কালিমা নেই, বরং আছে বিশ্বজয়ীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জেতার গর্ব। সাকিব তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি আমাদের ম্যাচ জিততে হবে বা এমন কিছু। আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাটিংয়ে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংটা আমাদের তিনটি ম্যাচেই আমার মনে হয় অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে।’
ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সেটাও টি-টোয়েন্টিতে, যে সংস্করণে বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। সাকিব এ সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে। যেখানে ভালো করা ক্রিকেটাররাই ভালো করেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাতেই এসেছে অবিস্মরণীয় এই জয়, যে অর্জন টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে চেনাল নতুন করে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক