
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর আগে কৃষিশুমারির ফল প্রকাশ করেছিল ২০০৮ সালে। এবার ২০১৯ সালের শুমারির তথ্য প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানেই প্রশ্ন উঠেছে কৃষিশুমারির প্রকাশিত তথ্য নিয়ে। বিতর্কে যোগ দিয়েছেন স্বয়ং পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ও প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশিত শুমারি প্রতিবেদনে মোট কৃষি-পরিবারের তথ্য থাকলেও মোট কৃষকের সংখ্যা নেই।
বিবিএস জানায়, দেশে মোট কৃষি-খানার বা কৃষি-পরিবারের সংখ্যা ১ কোটি ৬৮ লাখ ৮১ হাজার; ২০০৮ সালে ছিল ১ কোটি ৫১ লাখ ৮৩ হাজার। কৃষি মজুর-খানার সংখ্যা বা যাদের নিজেদের জমি নেই, অন্যের জমিতে মজুরি খাটেন এমন পরিবারের সংখ্যা ৯২ লাখ; আগের শুমারিতে ছিল ৮৮ লাখ ৪৪ হাজার।
কৃষি-পরিবারের সংখ্যা প্রকাশ করা হলেও দেশে মোট কৃষকের সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি। এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক আলাউদ্দিন আজাদ বলেন, আমরা শুমারিতে যে প্রশ্নগুলো রেখেছি তাতে কৃষকদের নিয়ে আলাদা প্রশ্ন ছিল না। শুধু খানা (পরিবার বা হাউজহোল্ড) বিবেচনায় নিয়েছি। তাই কৃষকের সংখ্যা আসেনি।
প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, শুমারির গুরুত্ব আছে বটে, কিন্তু ৮ বা ১০ বছর পরের জরিপের প্রাসঙ্গিকতা নেই। এতে সঠিক তথ্য আসে না।
বিবিএসকে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, আপনারা শুমারিকে প্রকল্প হিসেবে না নিয়ে নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে নিন। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনকে প্রকল্প হিসেবে না নিয়ে নিয়মিত কাজ হিসেবে বিবেচনায় নেয়। আপনারাও তাই করুন। আমি সংসদে বলেছি, এখন থেকে এগুলো প্রকল্প হিসেবে থাকবে না।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন,শুমারিগুলো প্রতি দশকে একবার হওয়ার কথা থাকলেও হয়নি কোনো সময়। কোনো শুমারি ৮ বছর পর হয়েছে, কোনোটি ১২ বা ১৪ বছর পর হয়েছে। ২০১৯ সালের শুমারির তথ্য প্রকাশ করতে কেন তিন-চার বছর লেগেছে তাও পরিষ্কার নয়। গুরুত্বপূর্ণ দলিল সময়মতো প্রকাশ করা উচিত।
তিনি বলেন, জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষির অবদান ক্রমশ কমছে কিন্তু কৃষির গুরুত্ব কমছে না। জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়নে কৃষিশুমারির গুরুত্ব অপরিসীম। তাই এটি সঠিকভাবে করা উচিত।
কৃষিশুমারির তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত কৃষিশুমারি অনুযায়ী মোট খানার সংখ্যা ৩ কোটি ৫৫ লাখ ৫২ হাজার, ২০০৮ সালে ছিল ২ কোটি ৮৬ লাখ ১৫ হাজার। মোট কৃষি-খানার সংখ্যা ১ কোটি ৬৮ লাখ ৮১ হাজার, ২০০৮ সালে ছিল ১ কোটি ৫১ লাখ ৮৩ হাজার।
শুমারির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশে সাধারণ খানার সংখ্যা যে হারে বেড়েছে কৃষি-খানা সে হারে বাড়েনি। দেশে নিট আবাদি জমির পরিমাণ ১ কোটি ৮৬ লাখ ৮১ হাজার একর; নিট অস্থায়ী ফসলি জমির পরিমাণ ১ কোটি ৬৪ লাখ ২৩ হাজার একর এবং স্থায়ী ফসলি জমির পরিমাণ ১১ লাখ ৭০ হাজার একর।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে আউশ ফসলের চাষের জমি কিছুটা কমলেও আমন, বোরো, আলু, গম, ভুট্টা, পাট প্রভৃতি ফসল চাষের জমির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ফসলের নিবিড়তা ২১৪, ২০০৮ সালে ছিল ১৭০। ফসলের নিবিড়তা বলতে বোঝানো হয়েছে একটি জমি বছরে কয়বার চাষ করা হয়।
গরু, ছাগল, ভেড়া ও মুরগি-হাঁসের সংখ্যা ২০০৮ সালের তুলনায় বেড়েছে। কিন্তু তাতে শুধু গৃহস্থালির হিসাব তুলে ধরা হয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে আবাদ করা গরু, ছাগল ও হাঁস-মুরগির হিসাব তুলে ধরা হয়নি। মোট গরুর সংখ্যা ২ কোটি ৯৪ লাখ ৫২ হাজার। মোট ছাগলের সংখ্যা ১ কোটি ৯৪ লাখ ৪৪ হাজার।
মোরগ-মুরগি ও হাঁসের সংখ্যা যথাক্রমে ১৯ কোটি ৯৪ লাখ ৩ হাজার ও ৭ কোটি ৪৪ লাখ ১৩ হাজার। কৃষিশুমারি ২০১৯-এ মোট মাছ চাষের জমির পরিমাণ ১২ লাখ ১২ হাজার ১০৭ একর। ব্যবহারভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায় পুকুরে মাছ চাষ সবচেয়ে বেশি, ৬ লাখ ৮১ হাজার একর জায়গায়।
২০১৯ সালের কৃষিশুমারি সারা দেশে ৯ থেকে ২০ জুন পর্যন্ত পরিচালিত হয়। এতে কৃষিজমির পরিমাণ, মালিকানা, সেচ ব্যবস্থা, আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ, ভূমির ব্যবহার, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর সংখ্যা প্রভৃতি তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন। সভাপতিত্ব করেন বিবিএসের মহাপরিচালক মো. মতিয়ার রহমান।
দেশে স্বপ্নের মেট্রোরেল বাস্তবে রূপ নিচ্ছে আজ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবুজ পতাকা উড়িয়ে ও ফিতা কেটে উদ্বোধন করবেন কাক্সিক্ষত এ প্রকল্পের। প্রথম যাত্রী হিসেবে টিকিট কেটে উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে উঠে আগারগাঁও স্টেশনে এসে নামবেন শেখ হাসিনা। ঐতিহাসিক এই প্রকল্পের শুরুটাও হচ্ছে নতুন ইতিহাস তৈরির মাধ্যমে। দেশের প্রথম মেট্রোরেল চলবে নারী চালক মরিয়ম আফিজার হাতেই। ম্যাস ট্রানজিট লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মেট্রোরেল লাইন-৬-এর ‘উত্তরা থেকে আগারগাঁও’ অংশের উদ্বোধন উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
এদিকে মেট্রোরেল উদ্বোধন উপলক্ষে দেওয়া এক বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, মেট্রোরেল উদ্বোধনের মাধ্যমে জনবান্ধব সরকারের আরেকটি সাফল্য অর্জিত হলো। মেট্রোরেলের যাত্রা ঢাকা মহানগরীর যাতায়াত ব্যবস্থায় ভিন্ন মাত্রা ও গতি যোগ করবে। নগরবাসীর কর্মঘণ্টা সাশ্রয় হবে।
আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে বলেছেন, বাংলাদেশের গর্ব ও আকাক্সক্ষার প্রতীক মেট্রোরেল বাংলাদেশের নগর গণপরিবহন ব্যবস্থায় একটি অনন্য মাইলফলক। মেট্রোরেল ঢাকা মহানগরবাসীর বহু প্রতীক্ষিত স্বপ্ন। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের শুভ উদ্বোধনের মাধ্যমে মহানগরবাসীর সেই স্বপ্ন পূরণ হলো। মেট্রোরেল উদ্বোধনের এ মাহেন্দ্রক্ষণে আমি দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।
গতকাল সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘উদ্বোধনী প্রোগ্রাম হবে বেলা ১১টায় উত্তরা ১৫ সেক্টরের সি/এ’র মাঠে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আদলে প্রোগ্রাম হবে। এখানে একটি সুধী সমাবেশের আয়োজন করা হবে। জাপানের রাষ্ট্রদূত এখানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেবেন। বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেবেন। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কোনো আতশবাজির আয়োজন থাকবে না।’
কাদের জানান, মেট্রোরেল আপাতত চলবে দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পর বৃহস্পতিবার থেকে যাত্রী চলাচল শুরু হবে। শুরুতে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করবে। সাপ্তাহিক বন্ধ থাকবে মঙ্গলবার। আপাতত মেট্রোরেলের উত্তরা উত্তর স্টেশন (দিয়াবাড়ী) থেকে সরাসরি ট্রেন আসবে আগারগাঁও। আসতে ভাড়া হবে ৬০ টাকা। মাঝে কোনো স্টেশনে ট্রেন থাকবে না। আর আগামী ২৬ মার্চ থেকে মাঝের সব স্টেশনে যাত্রী ওঠানামা শুরু হবে।
মেট্রোরেলে শিক্ষার্থীরা হাফ পাস পাবেন না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এমআরটি পাসধারীরা ১০ শতাংশ ছাড় পাবেন। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী মেট্রোরেলে সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা বিনা ভাড়ায় মেট্রোরেলে চলাচল করতে পারবেন। আবার অভিভাবকদের সঙ্গে তিন ফুট উচ্চতা পর্যন্ত কোনো শিশু মেট্রোরেলে চলাচল করতে চাইলে ওই টিকিট লাগবে না।
মেট্রোরেলের ভাড়া প্রসঙ্গে কাদের বলেন, মিনিমাম রিকশা ভাড়াও এখন ২০ টাকা। তা ছাড়া এখন যে অবস্থান ঢাকা সিটিতে, আপনি উত্তরা থেকে কমলাপুর আসবেন ১০০ টাকা। কত মিনিটে আসবেন? ৩৮ মিনিটে। তাহলে কোথায় লস হলো। তাই প্রত্যেকে আনন্দের সঙ্গে এটা গ্রহণ করবে। ভাড়া একটা বিষয়। তবে বাস্তবে এটা সবাই এক্সেপ্ট করবে।’
মেট্রোরেলের পরিচালক এন এম ছিদ্দিক বলেন, ‘প্রত্যেকটা স্টেশন প্রস্তুত আছে। এখানে কোনো তাড়াহুড়ার বিষয় নেই।
আমরা একাধিকবার বলেছি। মানুষের অভ্যস্ততা হলো বড় বিষয়। এজন্য এটা করা হয়েছে। মানুষের অভ্যস্ততার সঙ্গে সামঞ্জস্য করার জন্য আমরা এটা করেছি। ৩ মাস পরে ২৬ মার্চ প্রত্যেকটি স্টেশনে ট্রেন থেমে যাবে এবং আস্তে আস্তে মানুষ যখন অভ্যস্ত হয়ে যাবে তখন ট্রেনের সংখ্যাও বাড়বে। আমাদের এখানে কোথাও কোনো কাজ বাকি নেই। এখানে কোনো তাড়াহুড়ার বিষয় নেই। বাস্তবতার নিরিখে এটা আন্তর্জাতিক স্বীকৃত একটা পদ্ধতি। আমরা সেই পদ্ধতি অনুসরণ করে অগ্রসর হচ্ছি।’
এদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপির অপারেশন্স শাখার যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে সড়কপথে উত্তরার দিয়াবাড়ী মেট্রোরেল উদ্বোধনস্থলে পৌঁছাবেন। অনুষ্ঠান শেষে তিনি যখন উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে মেট্রোরেলে চড়ে আগারগাঁও আসবেন এবং স্টেশন ত্যাগ না করা পর্যন্ত মেট্রোরেলের নিচের সড়কে চলাচল বন্ধ থাকবে।
মেট্রোরেল উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে ডিএমপির পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। দেওয়া হয়েছে সাত দফা নির্দেশনা। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, মেট্রোরেলের আশপাশে সুউচ্চ ভবনগুলোতে ২৮ ডিসেম্বর সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ছাদে ওঠা যাবে না। বেলকনিতে থাকা যাবে না। ছাদে কোনো কাপড় শুকাতেও দেওয়া যাবে না। ছাদে কেউ অবস্থান করতে পারবেন না। এদিন সংশ্লিষ্ট এলাকায় কোনো অফিস, দোকান বা রেস্টুরেন্ট খোলা রাখা যাবে না। এমনকি এসব এলাকায় ২৯ ডিসেম্বরের আগে নতুন কোনো ভাড়াটিয়াও ওঠানো যাবে না।
এ ছাড়া নির্দেশনায় বলা হয়েছে, মেট্রোরেলের পাশে কোনো ছবি কিংবা ফেস্টুন লাগানো যাবে না। মেট্রোরেলের আশপাশের ভবন কিংবা ফ্ল্যাটে কারও কাছে বৈধ অস্ত্র থাকলে তা থানায় জমা দেওয়ার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
এলাকাগুলোর ভবন, ফ্ল্যাট, রেস্টুরেন্ট, হোটেল ও কমার্শিয়াল স্পেসে ২৮ ডিসেম্বর কোনো লোক থাকবে না। এমনকি মেট্রোরেলের দুই পাশের সব ব্যাংকের এটিএম বুথ সকাল থেকে অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগারগাঁও স্টেশন ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।
আগামী বছর ডিসেম্বরে মতিঝিল পর্যন্ত চলাচল করবে দেশের প্রথম বিদ্যুৎচালিত ট্রেন। আর কমলাপুর পর্যন্ত চলাচল করতে অপেক্ষা করতে হবে ২০২৫ সাল পর্যন্ত।
বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’ এখন সারা দুনিয়ার দৃষ্টান্ত। পঞ্চাশ বছর আগে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তার কাক্সিক্ষত স্বপ্নচূড়া অতিক্রম করে। আর তারই কন্যা টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’র স্বপ্নগুলো একে একে বাস্তবায়ন করে গড়ছেন ইতিহাস। তারই নেতৃত্বে এক এক করে আধুনিক শহরের সবগুলো সূচক পূরণের দিকে রাজধানী ঢাকা। পদ্মা সেতুর পর আরেক স্বপ্ন পূরণের বড় মাহেন্দ্রক্ষণ আজ।
বিজয়ের মাসেই নগরবাসীর জন্য প্রধানমন্ত্রীর এই উপহার সবার মধ্যেই উচ্ছ্বাস আর আনন্দবার্তা নিয়ে এসেছে। শুধু যোগাযোগেই মাইলফলক নয়। বিজয়ের মাসে এই নতুন যুগের সূচনায় ৫১ বছর আগের কথা। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, তখনকার কথা। হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি। আজ তার জবাব বাংলাদেশ কাজ দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে।
আজ বুধবার স্বপ্ন ডানা থেকে বাস্তবে নামবে মেট্রোরেল। এদিন থেকেই বাংলাদেশ বিদ্যুৎ-চালিত মেট্রোরেলব্যবস্থার যুগে প্রবেশ করছে। একটি আধুনিক ও গতিশীল শহরে মেট্রোরেল এক অনন্য সংযোজন। বিশে^র জনবহুল শহরের শীর্ষ দশে থাকা ঢাকার নাগরিক সুবিধায় বর্তমান সরকার অনেকগুলো প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা থেকে যানবাহন বের হওয়া ও ঢাকায় যানজটমুক্তভাবে প্রবেশের জন্য রাজধানীর ভেতরে ও প্রবেশমুখে চারটি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকার ভেতরে ৫টিরও বেশি ফ্লাইওভার। ঢাকা শহর ও পাশর্^বর্তী এলাকার যানজট নিরসনে ২০৩০ সালের মধ্যে ৬টি মেট্রোরেলের মাধ্যমে একটি আধুনিক ও সমন্বিত যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া মেট্রোরেলের পাশাপাশি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও পাতালরেলের কাজও হাতে নেওয়া হয়েছে।
এর মধ্যে বেশির ভাগ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। ঢাকার যানজট নিরসন ৩৫ বছর ধরে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। মানুষ বাড়ছে নগরীতে, তেমনি বাড়ছে পরিবহন। আর সেই সঙ্গে অন্যান্য বড় বড় শহরের মতো রাজধানীর সম্প্রসারণও থেমে নেই।
দেশব্যাপী ১৪ বছরের উন্নয়ন যজ্ঞের সঙ্গে আধুনিক ও তিলোত্তামা ঢাকার জন্যও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিয়েছেন সব পরিকল্পনা। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আর উন্নয়ন যজ্ঞে নিরবচ্ছিন্ন চলাচলে বঙ্গবন্ধুকন্যার সুদূরপ্রসারী ও দূরদর্শী চিন্তার নাম এই মেট্রোরেল। ঢাকার পরিধি বেড়েছে। রাজধানী বলতে এখন আর সেই ছোট্ট পরিসর মতিঝিল, সংসদ ভবন, রামপুরা, মিরপুর নয়। ঢাকা মানে এখন উত্তরা ছাড়িয়ে টঙ্গী, এদিকে সাভার, নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত ব্যাপ্তি। আর উত্তরা থেকে মতিঝিল আসতে তো দিন শেষ। মানুষের নিরবচ্ছিন্ন যাতায়াতের আর কোনো বিকল্প নেই। এই বাস্তবতা বুঝেই শেখ হাসিনা যোগাযোগব্যবস্থাকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
২০৪১ সাল নাগাদ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার আধুনিক রূপ সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিদীপ্ত, জ্ঞানভিত্তিক, উদ্ভাবনী, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের রূপকল্প ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। মেট্রোরেল সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের একটি। ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট তথা মেট্রোরেল প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন পায়। প্রথম পর্যায়ে নির্মাণের জন্য এমআরটি-৬ নামক ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ নির্ধারণ করা হয়। প্রকল্পটি গ্রহণ করার পর এর অর্থ সংকুলান নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগে কাজটি দ্রুত শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। প্রথম পর্যায়ে নির্মাণের জন্য এমআরটি-৬ নামক ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ পথকে নির্ধারণ করা হয়। ২০১৬ সালের ২৬ জুন দেশের প্রথম উড়াল মেট্রোরেল প্রকল্পের নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন সরকারপ্রধান।
বারবারই মেট্রোরেলে কাজ দ্রুত শেষ করার তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আসে করোনার সময়। দুনিয়াজুড়ে কভিডে দেশে দেশে যখন উন্নয়ন যজ্ঞের কাজ বন্ধ হয়ে যায়, বাংলাদেশেও আলোচনা আসে মেগা প্রকল্পের কাজগুলো বন্ধ রাখার। কিন্তু শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলের কাজ চালিয়ে যাওয়ার সব ধরনের নিরাপদ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। তবে করোনার একদম পিক টাইমে কাজের গতি কিছুদিন কম ছিল। তবে এক দিনের জন্যও মেট্রোরেলের কাজ থেমে থাকেনি।
দেশের প্রথম উড়াল মেট্রোরেল উদ্বোধন উপলক্ষে ৫০ টাকা মূল্যমানের একটি স্মারক নোট মুদ্রণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আজ বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ স্মারক নোটটি আনুষ্ঠানিকভাবে অবমুক্ত করবেন। গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, অবমুক্তকরণের পর ২৯ ডিসেম্বর থেকে এ স্মারক নোট বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিস এবং পরবর্তী সময়ে অন্যান্য শাখা অফিসে পাওয়া যাবে।
স্মারক নোটের ডিজাইন ও নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য : বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার স্বাক্ষরিত ১৩০ মিলিমিটার বাই ৬০ মিলিমিটার পরিমাপের এ স্মারক নোটের সম্মুখভাগের বামপাশে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিকৃতি এবং ব্যাকগ্রাউন্ডে মেট্রোরেলের ছবি সংযোজন করা হয়েছে। নোটের পেছন ভাগে মেট্রোরেলের আরেক ছবি সংযোজন করা হয়েছে। নোটের সম্মুখভাগে ‘বাঁচবে সময়, বাঁচবে পরিবেশ, যানজট কমাবে মেট্রোরেল’ এবং পেছন ভাগে ‘Moving People, Saving Time and Environment’ মুদ্রিত রয়েছে।
নোটের সম্মুখভাগে ওপরে ডান এবং বাম কোণে স্মারক নোটের মূল্যমান ইংরেজিতে ‘৫০’, নিচে ডান কোণে মূল্যমান বাংলায় ‘৫০’ এবং উপরিভাগে মাঝখানে ‘পঞ্চাশ টাকা’ লেখা রয়েছে। নোটের পেছন ভাগে ওপরে বাম কোণে ইংরেজিতে ‘৫০’ এবং নিচে বাম কোণে বাংলায় ‘৫০’ লেখা রয়েছে। এ ছাড়া, নোটের ওপরে ডান কোণে ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রাম’ এবং নিচে ডানপাশে ‘FIFTY TAKA’ ও ডানপাশে ‘BANGLADESH BANK’ লেখা রয়েছে।
১০০ শতাংশ কটন কাগজে মুদ্রিত স্মারক নোটটির সম্মুখভাগে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিকৃতির ডানে ২ মিলিমিটার চওড়া নিরাপত্তা সুতা রয়েছে এবং নোটের ডানদিকে জলছাপ হিসেবে ‘বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি’, ‘৫০’ এবং ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রাম’ মুদ্রিত রয়েছে। এ ছাড়া নোটের উভয় পৃষ্ঠে বার্নিশের প্রলেপ সংযোজন করা হয়েছে।
৫০ টাকা অভিহিত মূল্যের স্মারক নোটটির জন্য পৃথকভাবে বাংলা ও ইংরেজি লিটারেচার সংবলিত ফোল্ডার প্রস্তুত করা হয়েছে। ফোল্ডার ছাড়া শুধু খামসহ স্মারক নোটটির মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ টাকামাত্র এবং ফোল্ডার ও খামসহ স্মারক নোটটির মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ টাকা।
দেশের মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৮০ শতাংশ প্রতিবন্ধী। এর মধ্যে পুরুষ ৫৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এই প্রতিবন্ধীরা ১১ ধরনের প্রতিবন্ধিতার শিকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জাতীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জরিপ-২০২১-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিবিএস অডিটোরিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
বিবিএস জানায়, ২০১১ সালের জনশুমারির তথ্য অনুযায়ী, হিসাব করলে মোট প্রতিবন্ধীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০ লাখ ৩৩ হাজার ২৬৮। সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধী মানুষ খুলনা বিভাগে এবং সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জন্মগত সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ৪১ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ মানুষ প্রতিবন্ধী হচ্ছে। কর্মক্ষমতা থাকার পরও কর্মের বাইরে রয়েছে ৬৬ দশমিক ২২ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের মোট প্রতিবন্ধীর মধ্যে শহরের জনসংখ্যার ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং পল্লী এলাকায় ২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। প্রতিবন্ধী মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শারীরিক প্রতিবন্ধী ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এ ছাড়া অটিজমের শিকার শূন্য দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। প্রতিবন্ধিতা তৈরি করে এমন মানসিক অসুস্থতা আছে শূন্য দশমিক ২৯ শতাংশের। এ ছাড়া দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ, বাকপ্রতিবন্ধী শূন্য দশমিক ৩২ শতাংশ, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শূন্য দশমিক ২২ শতাংশ এবং শ্রবণপ্রতিবন্ধী শূন্য দশমিক ৩৮ শতাংশ। সেরিব্রাল পালসি শূন্য দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ, ডাউন সিনড্রোম শূন্য দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, শ্রবণ ও দৃষ্টি উভয় প্রতিবন্ধিতা শূন্য দশমিক শূন্য ২ শতাংশ, বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধিতা শূন্য দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ঢাকা বিভাগে প্রতিবন্ধী মানুষ আছে ২ দশমিক ৫১ শতাংশ, চট্টগ্রাম বিভাগে ২ দশমিক ৪১, বরিশালে ২ দশমিক ৪২, ময়মনসিংহে ২ দশমিক ৪৫, রাজশাহীতে ৩ দশমিক ৩০ এবং রংপুর বিভাগে প্রতিবন্ধী আছে ৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
প্রতিবন্ধিতার কারণগুলোর মধ্যে অসুস্থতাজনিত ৩৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ, গাছ বা ছাদ থেকে পড়ে ১২ দশমিক ২৭ শতাংশ, সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং অগ্নিদুর্ঘটনায় ১ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ, রেল দুর্ঘটনায় শূন্য দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ এবং অন্যান্য দুর্ঘটনায় প্রতবন্ধী হচ্ছে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ মানুষ। সেই সঙ্গে বেশি বয়স্ক মানুষদের মধ্যে প্রতিবন্ধিতার হার বেশি বলে লক্ষ করা গেছে।
প্রতিবেদন বলছে, বৈষম্যমূলক আচরণ বা নিগ্রহের শিকার হয়েছে এমন প্রতিবন্ধীর শতকরা হার ৪৩ দশমিক ৭০। এ ছাড়া যাদের নিবন্ধন রয়েছে, এমন প্রতিবন্ধীরা যারা কখনো ভাতা পেয়েছে তাদের হার ৯১ দশমিক ৪৩ শতাংশ, নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলে কখনো ভাতা পেয়েছে ৩৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ প্রতিবন্ধী।
প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিবিএসের মহাপরিচালক মতিয়ার রহমান। প্রধান অতিথি ছিলেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন। বিশেষ অতিথি ছিলেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (গ্রেড-১) ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামাল। বক্তব্য দেন বিবিএসের ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ উইংয়ের পরিচালক মাসুদ আলম। মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন জাতীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জরিপ প্রকল্পের পরিচালক ইফতেখাইরুল করিম। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম সচিব ড. দীপংকর রায়।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, জরিপ প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এটি ২০১৯ সালের জুলাই থেকে চলতি ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত মেয়াদে বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় দেশের ৮০০ নমুনা এলাকা থেকে ৩৬ হাজার খানা (পরিবার) থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. শাহনাজ আরেফিন বলেন, এসব তথ্য সরকারের নীতি নির্ধারণ এবং গবেষণাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখবে। ফলে প্রতিবন্ধীদের কল্যাণ এবং তাদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিকল্পনা নেওয়াটা সহজ হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামাল বলেন, প্রতিবেদনে দেখা গেছে সাধারণ মানুষের চেয়ে প্রতিবন্ধীরা আড়াই গুণ পিছিয়ে আছে। এটি একেবারেই নতুন একটি বিষয়। এ ছাড়া প্রতিবন্ধীদের মধ্যে কর্মে নিয়োজিত নয় এমন সংখ্যা মোট প্রতিবন্ধীর ৬৬ দশমিক ২২ শতাংশ। এর বাইরে কর্মে নিয়োজিত আছে ৩৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এসব তথ্য নীতি নির্ধারণের ব্যাপক কাজে আসবে।
বিশৃঙ্খলা বা সহিংসতার বড় কোনো ঘটনা ছাড়াই হয়ে গেল রংপুর সিটি করপোরেশন (রসিক) নির্বাচন। ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপচেপড়া ভিড় থাকলেও ভোট গ্রহণকালে ঘটেনি কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা। রাতে ফলাফল ঘোষণার পর পরাজিত এক প্রার্থীর সমর্থকরা বিজিবি সদস্য বহনকারী একটি গাড়িতে আগুন দিলেও ঘটেনি কোনো হতাহতের ঘটনা। তবে ভোট দিতে হয়রানি আর বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছে ভোটারদের। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ত্রুটি, আঙুলের ছাপ না মেলাসহ ভোটাররা পদ্ধতি বুঝতে না পারায় হয়েছে বিলম্ব। অনেকে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ভোট না দিয়েই চলে গেছেন। আবার অনেক কেন্দ্রে সন্ধ্যা ৭টা অবধি চলেছে ভোটগ্রহণ।
এ কারণে ইভিএমের সমালোচনা করেছেন মেয়র পদের জয়ী প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফাসহ অন্যরা।
নিজে ভোট দিতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়া মোস্তাফিজার ইভিএমকে অকার্যকর ব্যবস্থা হিসেবেও মন্তব্য করেছেন। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ইভিএম নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। তার ভাষ্য, ভোটার বেশি উপস্থিতির কারণেই ভোটগ্রহণে বিলম্ব হয়েছে।
গতকাল সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত প্রথম দফায় টানা ভোটগ্রহণ চললেও ইভিএম বিড়ম্বনায় কোনো কোনো কেন্দ্রে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ভোট নিতে হয়েছে। এ কারণে ফল ঘোষণাও বিলম্ব হয়েছে। গতকাল রাত সোয়া ১২টায় আনুষ্ঠানিকভাবে ২২৯ কেন্দ্রের সমন্বিত ফল ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা আবদুল বাতেন। রংপুর শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে ফল ঘোষণার সময় অন্যান্য নির্বাচনী কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
আবদুল বাতেন জানান, মেয়র পদে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা ১ লাখ ৪৬ হাজার ৭৯৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী আমিরুজ্জামান পিয়াল হাতপাখা প্রতীকে পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৮৯২ ভোট। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী লতিফুর রহমান মিলন হাতি প্রতীকে পেয়েছেন ৩৩ হাজার ৮৮৩ ভোট। আর নৌকা প্রতীকে হোসেনে আরা লুৎফা ডালিয়া পেয়েছেন ২২ হাজার ৩০৬ ভোট।
এ ছাড়া বাংলাদেশ কংগ্রেসের আবু রায়হান ১০ হাজার ৫৪৯, জাকের পার্টির খোরশেদ আলম ৫ হাজার ৮০৯ ভোট, খেলাফত মজলিসের তৌহিদুল রহমান ম-ল ২ হাজার ৮৬৪ ভোট, মেহেদী হাসান স্বতন্ত্র প্রার্থী ২ হাজার ৬৭৯ ভোট, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের শফিয়ার রহমান ৫ হাজার ১৫৬ ভোট পেয়েছেন।
এ ছাড়াও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে ১১ জন ও ৩৩টি ওয়ার্ডে ৩৩ জন সাধারণ কাউন্সিলর বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। তবে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য মেলেনি।
রসিকের মোট ভোটারের সংখ্যা ৪ লাখ ২৬ হাজার ৪৬৯। এর মধ্যে গতকাল ভোট পড়েছে ২ লাখ ৭৯ হাজার ৯৩৬টি।
গতকাল সকালে শীত উপেক্ষা করে কেন্দ্রে আসতে থাকেন ভোটাররা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটের লাইন বড় হতে থাকে। দুপুরের পর বেশ কিছু কেন্দ্রে ভোটারের বড় লাইন দেখা যায়। সকাল সোয়া ৯টার দিকে নগরীর আলমনগর কলেজ রোড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) মেয়র প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। তবে তিনি ভোট দিতে যাওয়ার পরই সাময়িক অকার্যকর হয়ে যায় ইভিএম। এ সময় ইভিএমের নানা ত্রুটি নিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখি ইভিএম হ্যাং হয়েছে। এই যদি ইভিএমের অবস্থা হয়, তাহলে মানুষ ভোট দেবে কীভাবে? আমরা প্রথম থেকে ইভিএম সচল রাখতে বলেছিলাম, কিন্তু রিটার্নিং অফিসার কথা শোনেননি। এ মেশিনে যে সমস্যা তা আজ প্রমাণ হয়েছে।’
এরপর ভোটকেন্দ্রের সামনে অপেক্ষা করছিলেন মোস্তাফিজার রহমান। আধা ঘণ্টা পর ইভিএম সচল হলে কেন্দ্রের লোকজন তাকে ডেকে নিয়ে যান। ভোট দিয়ে বেরিয়ে তিনি বলেন, ‘জয়ের ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী।’
গতকাল বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে ঘুরে দেখা গেছে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন। তবে বিলম্ব হওয়ার কারণে তাদের ক্ষোভও ছিল। প্রতিটি কেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকায় ঘটেনি কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা। সেই কথা মনে করিয়ে দিয়ে, দুপুরে রিটার্নিং কর্মকর্তা আবদুল বাতেন বলেন, ‘নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুয়েকটি জায়গা থেকে ইভিএমে ভোট দিতে একটু সমস্যার কথা শোনা গেলেও কিন্তু আমরা তা তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান করেছি।’ তিনি বলেন, ‘আসলে সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণে সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছিল নির্বাচন কমিশন আর অনিয়ম ঠেকাতে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রসহ সব ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কাজ করেছেন।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় নগরীর ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বুড়িরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে দেখা যায় ভোটারদের দীর্ঘ লাইন। মাঝে মাঝে কিছু ইভিএমে ত্রুটি দেখা দিলে তা তাৎক্ষণিক সমাধান করে নেন প্রিসাইডিং অফিসাররা। অনেক ভোটার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্ত হয়ে যান।
এদিকে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে নগরীর লায়ন্স স্কুলে অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ভোট দিতে যান নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া। তবে সে কেন্দ্রটিতে তিনি লাঙ্গলের কাছে বিপুল ভোটে হেরেছেন।
নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে-সিইসি : প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল দাবি করেছেন, রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ হয়েছে। ভোটার উপস্থিতি ব্যাপক ছিল। স্বতঃস্ফূর্ত ছিল। ভোট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে।
গতকাল ভোটগ্রহণ শেষে আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘ব্যালটের তুলনায় ইভিএমে ভোটগ্রহণ ধীরগতিতে হয়েছে।’ বিকেলে সিইসি বলেন, ‘যেটা কাস্ট হয়েছে ৪টা পর্যন্ত কোথাও ৬৭ শতাংশও পাচ্ছি, আবার কোথাও ৩৯ শতাংশও পাচ্ছি। অ্যাভারেজ অনুমান করছি এটা ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ এবং পরিশেষ ৬০ শতাংশের ওপরে বা কমও হতে পারে। এটা অনুমান করে বলছি। চূড়ান্ত গণনার পর দেখা যাবে কত হলো।’
তুলনামূলকভাবে ইভিএমটা ব্যালটের চেয়ে সেøা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখনো লোক লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। ধীরগতি দুটো কারণে হয়। ভোটার উপস্থিতি বেশি হলে হয়। এর ইতিবাচক দিক আছে। ইভিএমের সমস্যা সবসময় একই। এখানে ভোটার উপস্থিতি বেশি হয়েছে।’
রংপুরের ৪ লাখ ২৬ হাজার ৪৭০ ভোটারের ভোটাধিকার প্রয়োগ সুষ্ঠু করতে, সকাল ৮টা থেকেই আগারগাঁওয়ের নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের কন্ট্রোল রুমে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা মনিটরিং করছিল নির্বাচন কমিশন। একে একে তিনজন নির্বাচন কমিশনারের পর কন্ট্রোল রুমে উপস্থিত হন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। এ সময় বড় স্ক্রিনে ৪৪টি ওয়ার্ডের সব কেন্দ্র প্রাঙ্গণ, ভোটকক্ষের ছবি জুম করে পর্যবেক্ষণ করা হয়।
রংপুরে ভোটগ্রহণ এবং ভোট দেওয়া দুটোই সুশৃঙ্খলভাবে হয়েছে মন্তব্য করে সিইসি বলেন, ‘ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ, আগ্রহ, উদ্দীপনা, আনন্দঘন পরিবেশ পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রথম থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য সহযোগিতা করে আসছে, তারা সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে আছে।’
তিনি বলেন, ‘কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি, ঘটলেও মোকাবিলা করা সম্ভব। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়েছে। কোনোরকম সংঘর্ষ, সংঘাত নেই। একটা জিনিস খুবই সুখকর, সেটা হচ্ছে মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে সংযমের সঙ্গে দাঁড়িয়ে অবস্থান করছে। এটা একটা ভালো দিক।’
জাতীয় পার্টির প্রার্থীর অভিযোগের বিষয়ে সিইসি বলেন, ‘জাপার একজনের ভোট দিতে অসুবিধা হয়েছিল, পরে ভোট দিয়েছেন। প্রার্থী তাৎক্ষণিকভাবে হয়তো দিতে পারেননি, পরপরই দিতে পেরেছেন। প্রযুক্তিতে প্রবলেম হতে পারে। এখানে কিছু মেকানিক্যাল প্রবলেম হয়ে থাকতেই পারে।’
বরিশালের উজিরপুরে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে এসে সংসদ সদস্যের সামনে আওয়ামী লীগের এক সহসভাপতিকে পিটিয়েছেন আরেক সহসভাপতি। গতকাল রবিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে উজিরপুর উপজেলা পরিষদের সামনে এ ঘটনা ঘটে। মারধরে আহত আওয়ামী লীগ নেতাকে উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
তিনি হলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। নাম মো. ইদ্রিস সরদার (৪৫)। তাকে পিটিয়েছেন একই কমিটির সহসভাপতি ও উজিরপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. হাফিজুর রহমান ওরফে ইকবাল। তারা দুজনই বরিশাল-২ আসনের সংসদ সদস্য মো. শাহ আলম তালুকদারের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। দুজনই এই সংসদ সদস্যের সঙ্গে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। এদিকে মারামারির এ ঘটনায় দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের দুই নেতা এবং ইউনিয়ন যুবলীগের এক নেতাকে সাময়িকভাবে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী, স্থানীয় লোকজন ও আহত আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে উজিরপুর উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গতকাল সকাল ১০টায় উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য মো. শাহ আলম তালুকদার। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে প্রধান অতিথি অনুষ্ঠানস্থলে হাজির হন। তার সঙ্গে ছিলেন হাফিজুর রহমান ও ইদ্রিস সরদার। এ সময় হাফিজুর সংসদ সদস্যের সামনে ইদ্রিসকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করলে ইদ্রিস তার প্রতিবাদ জানান। এরপর হাফিজুর তাকে সংসদ সদস্যের সামনেই মারধর শুরু করেন।
মারধরের শিকার ইদ্রিস অভিযোগ করে বলেন, ‘সংসদ সদস্যের সামনে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান হাফিজুর আমাকে নিয়ে কটূক্তি ও অশালীন মন্তব্য করে। আমি প্রতিবাদ করলে হাফিজ আমার ওপর হামলা চালিয়ে মারধর শুরু করে। এ সময় তার সঙ্গে থাকা ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ক্যাডার কাজী রিয়াজ, পলাশ তালুকদার ও রুবেল হোসেনসহ ৭-৮ জন সন্ত্রাসী আমাকে লাঠিপেটা করে রক্তাক্ত জখম করে।’
তবে ইদ্রিসকে মারধরের ঘটনা তার এবং সংসদ সদস্যের সামনে ঘটেনি বলে দাবি করেন অভিযুক্ত হাফিজুর।
উজিরপুর মডেল থানার ওসি মো. কামরুল হাসান গতকাল বিকেলে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘উপজেলা পরিষদের মাঠে ফুল দেওয়ার পরে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে হাতাহাতি হয়। এ ঘটনায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি যারা আছেন, তারা বসে বিষয়টি মিটমাট করেছেন।’
দল থেকে ৩ নেতা বহিষ্কর : মারামারির এ ঘটনায় দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বামরাইল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান পলাশ, শিকারপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ রিয়াজুল ইসলাম কাজী ও বামরাইল ইউনিয়ন যুবলীগের সদস্য জসিম উদ্দিন রুবেলকে সাময়িকভাবে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে তাদের বহিষ্কারের বিষয়টি উজিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. গিয়াস উদ্দিন বেপারী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মারামারির ঘটনায় দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে উজিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের এক জরুরি সভার সিদ্ধান্তে তাদের সাময়িকভাবে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে উজিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. গিয়াস উদ্দিন বেপারী বলেন, ‘দল থেকে সাময়িকভাবে তিনজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বিষয়টি আমাদের রাজনৈতিক অভিভাবক আলহাজ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহকে অবহিত করা হয়েছে। তিনি পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন।’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সংসদ সদস্য শাহ আলম তালুকদারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
নেত্রকোনায় র্যালিতে বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষ, আহত ৬০ : নেত্রকোনার দুর্গাপুরে মহান স্বাধীনতা দিবসে শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদনে র্যালি নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। গতকাল রবিবার সকাল ১০টার দিকে উপজেলার কাচারি মোড় থেকে ব্যানার নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা শহীদ বেদিতে যাওয়ার সময় এ ঘটনা ঘটে।
সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় নিজেদের অন্তত ৬০ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন বলে দাবি বিএনপি নেতাদের। অন্যদিকে বিএনপি নেতাকর্মীদের হামলায় পাঁচ সদস্য আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এছাড়া ঘটনার সময় বিএনপির চার কর্মীকে আটকের কথা জানানো হয়।
এদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দুর্গাপুরে বিএনপির স্বাধীনতা দিবসের র্যালিতে পুলিশ হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করে এর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
নেত্রকোনা পুলিশের দাবি, র্যালি নিয়ে শহীদ বেদিতে ফুল দিতে যাওয়ার সময় পুলিশকে লক্ষ্য করে গালিগালাজ শুরু করেন দুর্গাপুর বিএনপির নেতাকর্মীরা। একপর্যায়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। তখন তাদের বাধা দিলে সংঘর্ষে জড়ান। এ সময় উভয়পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে চার রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। পরে বিএনপির চার নেতাকর্মীকে আটক করা হয়।
তবে বিএনপি নেতাদের দাবি, র্যালি নিয়ে শহীদ বেদিতে ফুল দিতে যাওয়ার সময় ব্যানার নিতে বাধা দেয় পুলিশ। এ নিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয় পুলিশের। একপর্যায়ে লাঠিচার্জ করলে সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে নেতাকর্মীরা আহত হন।
বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, পুলিশ চার রাউন্ড গুলি ছোড়ার কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে ১৫-২০ রাউন্ড রাবার বুলেট ছোড়াসহ ঘটনাস্থল থেকে সাতজন নেতাকর্মীকে ধরে নিয়ে যায়।
উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জহিরুল আলম ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘কাচারি মোড় এলাকা থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণের জন্য শত শত নেতাকর্মীদের নিয়ে শহীদ মিনারে যাওয়ার প্রাক্কালে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশ তর্কবিতর্কে জড়িয়ে গিয়ে আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে আমাদের ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে। পরে আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর লাঠিচার্জ শুরু করে পুলিশ। এছাড়া সেখান থেকে বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে ধরে নিয়ে যায়।’
দুর্গাপুর উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব সম্রাট গণি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পুলিশের সঙ্গে প্রথমে আমাদের ব্যানার নিয়ে টানাটানি ও কাগজ ছোড়াছুড়ি হয়। পরে যুবদলের পক্ষ থেকে সেøাগান দিতে থাকে। একপর্যায়ে পুলিশ ১৫-২০ রাউন্ড রাবার বুলেট ছুড়ে। নিরস্ত্র অবস্থায় তখন আমরাও ঢিল দিই। মোবাইলে ভিডিও করার সময় আমাদের ৭-৮টি মোবাইল ছিনিয়ে নেয় পুলিশ। এছাড়াও মসজিদের ভেতরে নেতাকর্মীদের রাখা প্রায় তিনশ’ মোটরসাইকেলের খোঁজ নেই। কিন্তু পুলিশ বলছে, তারা ৩০-৪০টার মতো মোটরসাইকেল নিয়ে গেছে। আমার ডান হাঁটুতে বুলেট লেগেছে। ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক শিশিরের মাথায় গুলি লাগাসহ ৫০-৬০ জন নেতাকর্মী আহত হন।’
তবে দুর্গাপুর থানার ওসি মো. শিবিরুল ইসলাম উল্টো বিএনপি নেতাকর্মীরা আগে পুলিশের ওপর হামলা চালায় বলে অভিযোগ করেছেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপির লোকজন রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করেছে। ইট-পাটকেল মারাসহ ককটেল ও বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।’
আর নেত্রকোনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি ও মিডিয়া) মো. লুৎফর রহমান বলেন, ‘সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিএনপির লোকজন শহীদ মিনারে ফুল দিতে আসার সময় দুর্গাপুর পৌরসভার কাচারি মোড় এলাকায় পৌঁছার পরে পুলিশকে দেখে বিভিন্ন ধরনের সেøাগান ও অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। পুলিশ গালিগালাজের কারণ জিজ্ঞেস করলে তখন বিএনপির নেতাকর্মীরা ঠেলা ধাক্কা দেওয়া শুরু করে ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। পরে পুলিশ তাদের সতর্ক করে লাঠিচার্জ ও চার রাউন্ড ফায়ার করে এবং চারজনকে আটক করে।’
নিন্দা ও প্রতিবাদ ফখরুলের : বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করে বলেছেন, ‘স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও বিএনপিসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের ওপরই কেবল বাধা দেওয়া হচ্ছে না, বরং যেকোনো জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানের ওপরও ন্যক্কারজনক হামলা চালানো হচ্ছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলায় কেবল আওয়ামী সন্ত্রাসীরাই নয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এ ধরনের হামলায় পিছিয়ে নেই।’ গতকাল বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু স্বাক্ষরিত গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি এসব কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘দুর্গাপুর উপজেলা ও পৌর বিএনপিসহ সব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত মহান স্বাধীনতা দিবসের র্যালিতে পুলিশের বাধা দিয়েছে, টিয়ারশেল, গুলি ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করেছে। এতে ৬০ জনের অধিক নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধ এবং ৮ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আহত নেতাকর্মীরা গুরুতর আহতাবস্থায় বর্তমানে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আহতদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আমরা এ ধরনের পৈশাচিক ও ন্যক্কারজনক হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশে আইনের শাসন না থাকার কারণে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মাত্রা এখন আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। পুলিশ আইনের রক্ষক অথচ তারাই আইনভঙ্গের মাধ্যমে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম চালাচ্ছে।’
বিবৃতিতে বিএনপি মহাসচিব অবিলম্বে গ্রেপ্তার নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা ‘মিথ্যা মামলা’ প্রত্যাহারসহ তাদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানান। এছাড়া তিনি ‘পুলিশি গুলিবর্ষণে’ আহত নেতাকর্মীদের আশু সুস্থতা কামনা করেন।
প্রতিবেদনটি নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল প্রতিনিধি ও উজিরপুর সংবাদদাতার তথ্যে তৈরি
রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় চিকিৎসাধীন খলিলুর রহমান হাসান (৩২) নামে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ২৫।
গতকাল রবিবার সকাল ৯টার দিকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় খলিলের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বার্ন ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন। তিনি জানান, হাসানের শরীরের ১২ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল। এছাড়া তার শরীরে গুরুতর আঘাতও ছিল। আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল তাকে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সকালে তার মৃত্যু হয়েছে।
হাসানের ছোট ভাই রাহাতুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে জানান, তাদের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার সোনাপুর গ্রামে। বাবার নাম আবু আহমেদ সিদ্দিক। দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক হাসান। সিদ্দিকবাজার এলাকায় থাকতেন হাসান। ফুটপাতে ব্যাগ বিক্রি করতেন। ঘটনার সময় সিদ্দিকবাজারের রাস্তায় বসে ব্যাগ বিক্রি করছিলেন। তখন বিস্ফোরণে তিনি গুরুতর আহত ও দগ্ধ হন।
২০১৬ সালে যাত্রা শুরু করা ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপ টিকটকের জনপ্রিয়তা এখন বিশ্বজুড়ে। একেবারে কৈশোর শুরু করে সদ্য তারুণ্যে পা রাখাদের কাছে এই চীনা অ্যাপ ভরপুর বিনোদন আবার কারও কারও কাছে রীতিমতো নেশা। ব্যবহারকারীদের বিচিত্র কাণ্ডকারখানার জন্য ব্যাপক আলোচিত টিকটক এখন ইন্টারনেট জগতে জনপ্রিয়তার কাতারে তৃতীয়। বলছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। সংবাদমাধ্যমটি বলছে, প্রতি মাসে কমপক্ষে ১০০ কোটি মানুষ টিকটক ব্যবহার করে। কিন্তু টিকটকের এই টগবগিয়ে ছুটে চলায় বাদ সাধছে পশ্চিমা সরকারগুলোর চীনভীতি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে পশ্চিমা প্রায় সব দেশেই বেশ বাধার সম্মুখীন এখন তারুণ্যের অ্যাপটি। পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে টিকটকের ব্যাপারে সর্বশেষ কঠোর অবস্থানে গেল মানুষের বৈচিত্র্য আর শিল্প-সংস্কৃতির দেশ হিসেবে পরিচিত ফ্রান্সও। তবে ফ্রান্সের কড়াকড়ি কেবল টিকটকেই নয়, ফরাসি সরকারের নিজস্ব জনপ্রতিনিধিদের ডিভাইস থেকে টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, নেটফ্লিক্স এমনকি ক্যান্ডিক্রাশের মতো গেম অ্যাপেও সরিয়ে ফেলতে বলা হয়েছে। যার মূল কারণ সাইবার নিরাপত্তা কিংবা তথ্য বেহাতের ঝুঁকি। দেশটির জনসেবা দপ্তরের মন্ত্রী স্ট্যানিসলাস গুয়েরিনি বলেন, ‘এসব অ্যাপ কর্মী ও প্রশাসন উভয় পক্ষের ডেটাই ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে।’
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার ও ডজনখানেক অঙ্গরাজ্য, কানাডা, ইউরোপীয় কমিশন ও যুক্তরাজ্যের সরকারি ডিভাইসগুলোতে এরই মধ্যে নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছে টিকটক। এর পরপরই ফ্রান্সের এই সিদ্ধান্ত এলো। ওই সব ঘটনার পেছনের যুক্তি প্রায় একই ধরনের, যেখানে দেশগুলোর উদ্বেগ, চীনা সরকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহ করে তাদের সম্পর্কে ভুল প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি টিকটকের মূল কোম্পানি বাইটড্যান্সকে বিভিন্ন সংবেদনশীল তথ্য হস্তান্তরে বাধ্য করতে পারে।
তবে চীন সরকারের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ ক্রমাগত নাকচ করে আসছে টিকটক। টিকটকের কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানাতে গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস শুনানিতে উপস্থিত হন টিকটকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শাও জি চিউ। শুনানিতে এক প্রশ্নের জবাবে টিকটক অ্যাপের মাধ্যমে চীনা গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেন শাও জি চিউ। শুধু তা-ই নয়, চীন সরকারের অনুরোধে টিকটকের কোনো আধেয় মুছে ফেলা বা প্রচারণা চালানো হয় না বলেও জানিয়েছেন তিনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
বাংলাদেশের অপরাধীরা আগে ভারতে গিয়ে আত্মগোপন করত। এরপর জানা গেল, সেখান থেকে দেশে অপরাধ ঘটায় তারা। কারও কারও নেপালে অবস্থানের কথাও জানা যায়। ভারতকে নিরাপদ মনে না করায় আরব আমিরাতের দুবাই বেছে নিচ্ছে অপরাধীরা। সেখানে তারা আস্তানা গেড়েছে।
পুলিশসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দেশের অপরাধজগতের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীরা অপরাধ করেই দুবাই চলে যাচ্ছে। সেখানে বসেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কলকাঠি নাড়ছে। এখন বিতর্কিত মডেল, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরাও দুবাইকে কেন্দ্র করে নানা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। সেখানে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যও আছে। তাদের কেউ কেউ সোনার কারবারও করছেন। ওই দেশে ভারতের দুর্ধর্ষ অপরাধী দাউদ ইব্রাহিমের শিষ্যত্ব নেওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ওইসব অপরাধীর তথ্য জানার পরও তাদের ফেরত আনতে পারছেন না। আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের ‘রেড নোটিসের’ দিকেই তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে পুলিশকে। তালিকাভুক্ত অপরাধীদের ধরতে রেড নোটিস জারি হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তারা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৮ সালে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান হত্যাকাণ্ডের পর অনেকে পার পেয়ে গেছে। যদিও মামলাটি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। তবে নতুন করে আলোচিত মামলাটির পুনঃতদন্ত করার কথা ভাবছে পুলিশ। এ নিয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠক করছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেশ রূপান্তরকে জানান, ২০২২ সালের ২৪ মার্চ সড়কে গুলি চালিয়ে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যা করা হয়। গুলিতে নিহত হন এক কলেজছাত্রী। চাঞ্চল্যকর এই জোড়া খুনের মূল হোতা সুমন শিকদার ওরফে মুসা ঘটনার রাতেই দেশ ছেড়ে চলে যায় দুবাইয়ে। সেখানে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও জয়ের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে আধিপত্য নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে মুসা চলে যায় ওমানে। জিসান ও জয় এখনো দুবাইতেই বসবাস করছে। যদিও ওমান থেকে মুসাকে ওই বছরের ৯ জুন ইন্টারপোলের মাধ্যমে ঢাকায় ফিরিয়ে আনে পুলিশ সদর দপ্তর। এ ঘটনার রেশ না কাটতেই ফের আলোচনায় আসে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও হিরো আলমের দুবাই সফরকে কেন্দ্র করে। তারা বনানীতে পুলিশ হত্যাকাণ্ডের আসামি আরাভ খান নামধারী রবিউল ইসলামের সোনার দোকান উদ্বোধন করতে সেখানে যান। দুবাই যাওয়ার কারণে সাকিব ও হিরো আলমকে যেকোনো সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি কার্যালয়ে ডাকা হতে পারে। এ ছাড়া ‘প্লেজার ট্যুরের’ জন্য এখন দেশের শিল্পপতিদের পছন্দের জায়গা হয়ে উঠেছে দুবাই। কারণ ঢাকাকে তারা নিরাপদ মনে করছেন না। পাশাপাশি দেশে আটক সোনার চালানের ৮০ শতাংশ জব্দ হচ্ছে দুবাইফেরত বিভিন্ন এয়ারলাইনস থেকে। সব মিলিয়ে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে দুবাই।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অপরাধীরা যে দেশেই থাকুক না কেন, তাদের চিহ্নিত করে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে আটক করার পর দুবাই থেকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফেরত আনতে চেয়েছিল পুলিশ। সম্প্রতি আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলার অন্যতম আসামি আরাভকে দুবাই থেকে ফেরত আনতে ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। আশা করি অল্প সময়ে সুখবর দেওয়া সম্ভব হবে।’
পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে জানান, সম্প্রতি আলোচনায় আসা আরাভ খানকে দেশে ফেরাতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি ভারতের পাসপোর্টধারী। দেশে তার নামে ১২টি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। ওইসব পরোয়ানার কপি ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে পাঠানোর পর দ্রুতই তাকে ফেরানো সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। যদিও এর আগে জিসান ও জয়কে দুবাই থেকে ফেরত আনার উদ্যেগ নিয়েও আনতে পারেনি। টের পেয়ে তারা দুবাই ছেড়ে কানাডায় চলে যায়। তারা আবার দুবাই এসেছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে।
ওই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে বিতর্কিত মডেল, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা এই দেশে অপরাধ করে দুবাই গিয়ে আস্তানা গাড়েন। ইতিমধ্যে পুলিশ একটি তালিকা করেছে। ওই তালিকায় গুলশান ও বনানী এলাকার মডেলের সংখ্যা বেশি। বছরখানেক আগে গ্রেপ্তার হওয়া ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও চলচ্চিত্র প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ বেশিরভাগ সময় দুবাই থাকেন। তাদের সঙ্গে অপরাধ জগতের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সখ্য আছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে। এমনকি বনানীতে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন হত্যাকান্ডে তাদেরও সম্পৃক্ততা ছিল বলেও অভিযোগ উঠেছিল। ঘটনার পর পিয়াসা, রাজ ও আরাভকে আটকও করা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের এক বড় মাপের নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তার অনুরোধে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এসব বিষয় নিয়ে পুনরায় তদন্ত করা হতে পারে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংগীতশিল্পী, এক ব্যবসায়ীর স্ত্রী ও কয়েকজন মডেল নিয়মিত দুবাই আসা-যাওয়া করেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, ২০০১ সালে তৎকালীন সরকার ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসী ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন ধরা পড়েছে। আবার কেউ ক্রসফায়ারে মারা গেছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার তাড়া খেয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মগোপনে আছে কেউ কেউ। আত্মগোপনে থেকেই তারা অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই দুবাই রয়েছে।
পুলিশ সূত্র আরও জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় আছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। এ নিয়ে পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তারা কয়েক দফায় বৈঠক করেছেন। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও আলাদাভাবে বৈঠক হয়েছে। ওইসব বৈঠকে বলা হয়েছে, ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করার পরও কেন তারা ধরা পড়ছে না তা খতিয়ে দেখতে হবে। ২০০৩ সালে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশের দুই সদস্যকে হত্যার পর শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দুবাই চলে যায়। সেখান থেকেও ঢাকায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে। তার সহযোগী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সোহেল শাহরিয়ার ওরফে শটগান সোহেল, কামরুল হাসান হান্নান, ইব্রাহীম, রবিন ও শাহাদৎ হোসেন বেশিরভাগ সময় দুবাই থাকে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্দিবিনিময় চুক্তি থাকায় বেশ কয়েকজন শীর্ষ অপরাধীকে বাংলাদেশে ফেরত আনা হয়। শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, শাহাদৎ, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার আসামি নুর হোসেনসহ অনেকেই কলকাতায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। নুর হোসেন ছাড়া অন্য সন্ত্রাসীদের দেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। সুব্রত, মোল্লা মাসুদ ও শাহাদৎ ভারতে সুবিধা করতে না পেরে মুম্বাই হয়ে দুবাই চলে যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকার অপরাধজগতের এক সন্ত্রাসী এ প্রতিবেদককে বলেন, অপরাধীরা এখন আর ভারত যেতে চায় না। কারণ ওই দেশে শান্তিতে থাকা যায় না। ফলে সবাই এখন দুবাইমুখী হচ্ছে। দুবাইয়ে সবাই নিরাপদে থাকতে পারছে।